অভিরূপ দে
হৃদয়পুরের জমিদারবাড়ির গল্প যেন সময়ের বুক চিরে উঠে আসা এক অদ্ভুত মহাকাব্য। প্রায় তিনশো বছর আগে, বাংলার গ্রামীণ জনপদে যখন জমিদারি প্রথার দাপট শিখরে, তখনই এই বাড়ির ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল। বিশাল অট্টালিকা, লাল ইট আর সাদা চুনে মাখানো দেওয়াল, খিলানওয়ালা জানালা, মস্ত ফটক আর আঁকাবাঁকা করিডর মিলিয়ে বাড়িটি ছিল একেবারেই অনন্য। সেই সময় হৃদয়পুরের জমিদার মধুসূদন রায় ছিলেন অতিশয় প্রভাবশালী মানুষ। রাজাদের সঙ্গে তাঁর ওঠাবসা, কলকাতার বাবুদের সঙ্গে সমানতালে আড্ডা, নাটক-গানের আয়োজন, এমনকি ব্রিটিশ সাহেবদের সঙ্গেও তিনি ভালো যোগাযোগ রাখতেন। বাড়িটি ছিল কেবল একটি বাসস্থান নয়, ছিল সংস্কৃতি, রাজনীতি আর ক্ষমতার মিলনক্ষেত্র। কিন্তু এই ঐশ্বর্য খুব বেশিদিন টেকেনি। স্বাধীনতার পর জমিদারি প্রথা ভেঙে যায়, একসময়ের জৌলুশ হারিয়ে যায় দ্রুত। বাড়ির অন্দরমহল ভেঙে পড়তে শুরু করে, ভগ্নপ্রায় দেওয়াল থেকে ঝরে পড়তে থাকে চুনকাম, মেঝেতে জন্মায় আগাছা, আর একসময় যেখানে সঙ্গীতের সুর ভেসে আসত, সেখানে আজ শোনা যায় শূন্যতার প্রতিধ্বনি। তবু এই বাড়ির একটা অংশ প্রতি বছর আবার জীবন্ত হয়ে ওঠে—দুর্গাপূজার সময়। তখনই ভাঙা বাড়িটিতে আলো জ্বলে ওঠে, ধূপ-ধুনোর গন্ধে ভরে ওঠে প্রাচীন অন্দরমহল, আর বহিরঙ্গনে জমে ওঠে মানুষের ভিড়। গ্রামের মানুষ বলেন, বাড়ির দেবী যেন তখনও বেঁচে ওঠেন, আর সেই বেঁচে ওঠার মধ্যেই লুকিয়ে আছে এক রহস্যময় রীতি, যার কথা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে চলে আসছে।
এই রীতির নাম ‘মুখোশ উৎসব’। দুর্গাপূজার সপ্তমী থেকে দশমী পর্যন্ত রাতে জমিদারবাড়ির আঙিনায় অদ্ভুত এক সমাবেশ হয়। মানুষ আসে দূর-দূরান্ত থেকে, কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, তাদের অধিকাংশই গ্রামবাসীর কাছে অচেনা। তারা মুখে পরে থাকে রঙিন, ভয়াল, কিংবা হাস্যকর মুখোশ। কেউ মানুষের মুখ, কেউ পশুর, কেউ আবার দেবদেবীর আকারে। এরা নাচে, গান করে, কখনও আবার নির্বিকারভাবে বসে থাকে মশালের আলোয়। গ্রামের প্রবীণরা বলেন, এই রীতির শুরু হয়েছিল মধুসূদন রায়ের সময় থেকেই। বলা হয়, তিনি একবার রাজস্থানের মরুভূমি ভ্রমণে গিয়ে সেখানকার এক রহস্যময় সাধুর সঙ্গে পরিচিত হন। সেই সাধু তাঁকে শিখিয়েছিলেন, দেবীর আরাধনায় যদি মুখোশধারী মানুষদের সমাবেশ হয়, তবে অশুভ শক্তি দূরে থাকে, আর দুর্গাপূজা হয় সম্পূর্ণ। তবে অন্যদের মতে, এই মুখোশ উৎসবের আড়ালে লুকিয়ে আছে ভয়ঙ্কর কোনো গোপন কাহিনি। অনেকে বলেন, জমিদারের এক গুপ্তচরবৃত্তির দল ছিল, যারা মুখোশ পরে বিভিন্ন সভা-সমাবেশে যেত, আর তাদের আড়াল করার জন্যই এই প্রথা চালু হয়েছিল। আবার কেউ কেউ দাবি করেন, বাড়ির এক পুরনো অভিশাপ থেকে রক্ষা পেতে প্রতি বছরই এই রীতি পালন করতে হয়। মুখোশ পরা মানুষরা কারা—এ প্রশ্নের সঠিক উত্তর আজও কেউ জানে না। আশ্চর্যজনকভাবে, দুর্গাপূজা শেষ হওয়ার পর আর তাদের দেখা মেলে না, এমনকি গ্রামের লোকেরাও তাদের চিনতে পারে না। যেন তারা হাওয়ায় মিলিয়ে যায়, আবার পরের বছর নবমীর রাতে ফিরে আসে।
বছরের পর বছর কেটে গেলেও এই রীতি অটুট রয়েছে। জমিদারবাড়ির বর্তমান বংশধরেরা, যারা এখন আর তেমন প্রভাবশালী নন, তবু পুজো আর মুখোশ উৎসব বন্ধ করেননি। গ্রামের মানুষও যেন অভ্যস্ত হয়ে গেছে, তারা জানে দুর্গাপূজার দিনগুলিতে ভাঙাচোরা বাড়িটি আবারও আলো ঝলমলে হয়ে উঠবে, আর রহস্যময় মুখোশধারীরা অচেনা অথচ পরিচিত আবহ তৈরি করবে। পুজোর সময় বাড়ির ভগ্নদশা ঢাকা পড়ে যায় আলপনার রঙে, কাশফুলের সাদা ছটায়, আর ঢাকের আওয়াজে। তবে অদ্ভুত এক ভয়ও গ্রামবাসীদের মধ্যে রয়ে গেছে—কারণ কেউই জানে না সেই মুখোশধারীরা কোথা থেকে আসে, কারা তারা, কিংবা কেনই বা তারা এই বাড়ির সঙ্গে জড়িত। রাত গভীর হলে প্রায়শই মানুষ বলে, ভগ্নপ্রায় দেওয়ালের আড়ালে যেন অচেনা পায়ের শব্দ শোনা যায়, কিংবা মশালের আলোয় দেখা যায় অদ্ভুত ছায়া। কেউ সাহস করে অনুসন্ধান করতে গেলে, হঠাৎই অন্ধকারে হারিয়ে যায় তার পথ। গ্রামের প্রবীণরা বলেন, এ বাড়ি যেমন ইতিহাসের সাক্ষী, তেমনি এক অমীমাংসিত রহস্যের আধার। জমিদারবাড়ির ইতিহাস তাই কেবল পতনের কাহিনি নয়, বরং এমন এক রহস্যের গল্প, যা আজও অজানা। আর এই রহস্যের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে সেই অদ্ভুত মুখোশ উৎসব, যার আসল উৎস আর উদ্দেশ্য আজও এক অন্ধকার গহ্বরের মতো অদৃশ্য।
অধ্যায় ৩ – প্রথম রাতের আতঙ্ক
অর্ণব যখন প্রথমবারের মতো জমিদারবাড়ির অতিথিশালায় উঠল, তখন সে অনুভব করল যেন সময়ের প্রবাহ এক অদ্ভুতভাবে থেমে গেছে। বাতাস ভেতরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে এক ধুলো-মিশ্রিত আর্দ্র ঘ্রাণ তাকে ঘিরে ধরল। বড় জানালা থেকে বাতাস প্রবেশ করলেও, অন্ধকারে ধুলো আর পুরনো কাঠের গন্ধ মিশে এক অদ্ভুত অস্থিরতা তৈরি করছিল। শীতল রাতের নিঃশব্দে সে তার কাগজপত্র, ক্যামেরা, এবং ল্যাপটপ সাজাতে লাগল। কিন্তু সে জানত, এই রাত সাধারণ রাত নয়; এটি মুখোশবাড়ির এক বিশেষ রাত—যখন যে কোনো মুহূর্তে রহস্যের ছায়া তার সামনে উপস্থিত হতে পারে। অর্ণব নিজেকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করল, চেষ্টা করল সচেতন থাকতেও, কিন্তু তার হৃদয় ছিল উত্তেজনা ও ভয়ের মিশ্রণে। প্রতি মুহূর্তে যেন সে শুনতে পাচ্ছিল বাতাসের সঙ্গে মিলিয়ে হালকা হাটুর শব্দ, যেন কেউ ঘুরে বেড়াচ্ছে। সে জানালার দিকে তাকাল, ফাঁক দিয়ে বাইরে তাকাল—অন্ধকার উঠোনে কোনো জীবন্ত প্রাণের অস্তিত্ব নেই, শুধু পুরনো মেঝেতে বাতাসের খড়খড় শব্দ।
রাত গভীর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অর্ণবের কাছে মনে হল, শুধু বাতাস বা পায়ের শব্দ নয়, এ বাড়ির মধ্যে যেন একটা জীবন্ত আত্মা বিরাজ করছে। হঠাৎই তিনি শোনা পেলেন দূর থেকে গায়ে কাঁটা দেওয়া এক মৃদু সুর। গান—না, শুধুই গান নয়, এক অদ্ভুত সঙ্গীত, যা পুরনো রাগ আর অচেনা সুরের মিশ্রণ। অর্ণব সাবধানে জানালার ফাঁক দিয়ে তাকাল, এবং চোখ অবিশ্বাসে ভরা হয়ে গেল—উঠোনে ডজনখানেক মুখোশধারী মানুষ নাচছে। কেউ বাঘের মুখোশ, কেউ মানুষের, কেউ আবার দেবীর রূপধারী। তাদের নাচ যেন এক ধরনের প্রাচীন আর্চনা বা রীতি, যা বছর ঘুরে ফিরে একইভাবে সম্পন্ন হয়। অর্ণব ক্যামেরা ধরল, কিন্তু লেন্সে ঠিক ঠিক ধরতে পারছিল না—ছায়া, আলো, নাচ, এবং অদ্ভুত রাশ্মির মিশ্রণে সবকিছু যেন ধোঁয়াশায় ভরা। তার হৃদয় তীব্র উত্তেজনা আর ভয়ে ব্যথিত, কিন্তু কৌতূহল তাকে বাধ্য করল আরও ঘনিষ্ঠভাবে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করতে। মুখোশধারীরা কখনও একে অপরের সঙ্গে চেহারা দেখার চেষ্টা করছিল না, কখনও আবার নিরবভাবে নাচ চালিয়ে যাচ্ছিল। অর্ণব বোঝতে পারল, তাদের উপস্থিতি কেবল দেহের নয়, বরং এক অদৃশ্য শক্তির প্রতিফলন।
পরবর্তী সকাল এলে, অর্ণব যখন উঠোনে নেমে গেল, তখন তার চোখ অচমকা খোলে—উঠোন একেবারে ফাঁকা, যেন আগের রাতের নাচ আর উপস্থিতি কেবল তার কল্পনারই অংশ ছিল। মেঝেতে ছড়িয়ে থাকা কোনো পদচিহ্ন নেই, মশালের অবশেষ নেই, এবং বাতাসে ঘ্রাণমিশ্রিত শীতলতা আগের মতোই ছিল। অর্ণবকে হতবাক হতে হয়েছিল—সে নিশ্চিত ছিল সে যা দেখেছে, তা বাস্তব, কিন্তু কোথায় হারিয়ে গেল সেই ডজনখানেক মুখোশধারী? সে যখন বাড়ির অন্য কোণগুলো ঘুরে দেখল, কোনো মানুষের ছায়া, কোনো অদ্ভুত চিহ্ন, কিছুই লক্ষ্য করা গেল না। অর্ণব বোঝল, মুখোশধারীদের উপস্থিতি হয়তো শুধু নির্দিষ্ট সময়ে, নির্দিষ্ট রীতিতে, আর চোখের সামনে সীমাবদ্ধ। এই প্রথম রাতের অভিজ্ঞতা তার মনে গভীর ভয় আর কৌতূহলের মিশ্রণ তৈরি করল। সে জানল, এই রহস্য শুধু ফটো বা সাধারণ প্রতিবেদনের মাধ্যমে উন্মোচন করা সম্ভব নয়; তাকে আরও গভীরে যেতে হবে, রাতের অন্ধকারে ঢুকতে হবে, এবং সেই অদৃশ্য ছায়াদের সঙ্গে মিশে যাওয়া উচিত। তবে এ রাতই ছিল তার জন্য প্রথম সতর্কবার্তা—যে রহস্যের জগতে সে প্রবেশ করেছে, তা নির্দিষ্ট নিয়ম, প্রাচীন রীতি, এবং অদ্ভুত এক ভয়ঙ্কর জটিলতার মধ্যে আবদ্ধ।
অধ্যায় ৪ – হারিয়ে যাওয়া মানুষগুলো
অর্ণবের আগ্রহ যত বাড়ছিল, রহস্য তত ঘনঘোর হয়ে উঠছিল। গ্রামের মানুষদের সঙ্গে কথোপকথনের সময় সে শোনার সুযোগ পেল সবচেয়ে ভয়ঙ্কর তথ্য—প্রতি বছর দুর্গাপূজার সময় কিছু বাইরের মানুষ রহস্যময়ভাবে উধাও হয়ে যায়। কেউ জানে না তারা কে, কোথা থেকে আসে, বা কোথায় যায়। গ্রামের প্রবীণরা মনে করিয়ে দিচ্ছেন, এই ঘটনার পরে কেউই আর সরাসরি বাড়ির কাছে যায় না। কেউই তাদের খুঁজে পায় না; হঠাৎ তারা বাতাসের মতো মিলিয়ে যায়। অর্ণব প্রথমে ভাবল হয়তো এটি কেবল গুজব বা গ্রামের মানুষদের অতিরঞ্জিত কল্পনা, কিন্তু সে যতই অনুসন্ধান করল, তথ্যগুলো আরও জটিল ও অস্পষ্ট হয়ে উঠল। কেউ কোনো নাম বলল না, কেউ ঘটনা সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করল না, শুধু কাঁপা কণ্ঠে জানাল, “যদি পুজোর সময় বাড়ির কাছে যাও, তুমি কখনও ফিরে আসবে কি না, সে নিশ্চয়তা নেই।” অর্ণব বোঝতে পারল, শুধুই মুখোশধারীদের উপস্থিতি নয়, বরং এই উধাও হওয়া ঘটনাই রহস্যকে আরও গভীর এবং বিপজ্জনক করেছে।
গ্রামবাসীদের চোখে অর্ণব লক্ষ্য করল এক অদ্ভুত মিশ্রণ—ভয়, কৌতূহল, আর বদ্ধমূল আস্থা। তারা জানাল, কয়েক বছর আগে শহরের একজন ব্যবসায়ী, পুজোর সময় বাড়ির কাছাকাছি ঘুরতে গিয়ে নিখোঁজ হয়েছিল। পুলিশ খোঁজ নিয়েছিল, কিন্তু কোনো পদচিহ্ন, কোনো চিঠি, কোনো সাক্ষ্য—কিছুই মেলেনি। এরপর গ্রামের লোকেরা সিদ্ধান্ত নেয়, দুর্গাপূজার সময় কেউ বাড়ির কাছেও যাবে না। কেউ বাড়ির দরজা বা জানালার দিকে তাকাতেই ভয় পায়। অর্ণবের মনে হলো, মুখোশবাড়ির রহস্য শুধু পারিবারিক বা সাংস্কৃতিক রীতি নয়, বরং এক প্রাচীন ভয়ঙ্কর শক্তির আড়ালে লুকিয়ে থাকা এক প্রজন্মের অভিশাপ। সে অনুভব করল, প্রতিটি নিখোঁজ ব্যক্তি শুধু নিখোঁজ নয়, বরং রহস্যময়তা বাড়ানোর জন্য একটি সতর্কবার্তা হয়ে গেছে—যে কেউ গিয়ে দেখে বা অনুসন্ধান করে, সে নিরাপদে ফিরতে পারবে না। এই উপলব্ধি তাকে আরও সতর্ক করল। সে জানল, তার সাংবাদিকতার উদ্দেশ্য এখন শুধু খবর সংগ্রহ করা নয়; বরং জীবনের নিরাপত্তা ও রহস্যের সীমার মধ্যে ন্যায্য সমন্বয় করতে হবে।
অর্ণব সেই রাতে গভীর চিন্তায় ঘুমাতে বসল। মনে হচ্ছিল, প্রতিটি ছায়া, প্রতিটি বাতাসের ফিসফিসানি, প্রতিটি অদ্ভুত শব্দ—সবই এক বার্তাকে পুনরাবৃত্তি করছে। এই বাড়ি শুধুই মানুষের নয়; এটি যেন এক অদৃশ্য বিশ্বের প্রান্তিক। মানুষের নিখোঁজ হওয়া, মুখোশধারীদের অদ্ভুত আচরণ, রাতের গান আর নাচ—সবই একটি জটিল ধাঁধা, যা বুঝতে হলে শারীরিক চেয়ে মানসিক সাহসও প্রয়োজন। অর্ণব উপলব্ধি করল, সে যতই কৌতূহলী হোক না কেন, প্রতিটি পদক্ষেপে তার সতর্কতা অপরিহার্য। হারিয়ে যাওয়া মানুষগুলোর গল্প শুধু আতঙ্ক ছড়ায় না; এটি তাকে এক শক্তিশালী বার্তা দিচ্ছে—এই রহস্যকে সহজে উন্মোচন করা সম্ভব নয়। এবং সেই রাতে, সে জানল, মুখোশবাড়ির প্রতি তার অনুসন্ধান শুধু তথ্য সংগ্রহ নয়, বরং এক গভীর, অজানা জগতে প্রবেশের যাত্রা, যেখানে জীবন ও মৃত্যুর সীমা, বাস্তব ও অতিপ্রাকৃতের সংমিশ্রণ একাকার।
অধ্যায় ৫ – গোপন ডায়েরি
অর্ণবের অনুসন্ধান তাকে এক অদ্ভুত খুঁজে পাওয়ার পথে নিয়ে গেল—জমিদারবাড়ির অন্দরমহলের এক প্রাচীন কক্ষের ধুলো-ঢাকা তাকের মধ্যে লুকানো একটি পুরনো ডায়েরি। ডায়েরির মলাট কাচের মতো নরম, পাতা হলুদ হয়ে গেছে, এবং লেখা অতি সূক্ষ্ম হস্তাক্ষরে। অর্ণব অবিশ্বাসে তাকিয়ে রইল; এই ডায়েরি যেন সময়ের আড়ালে গোপন এক সত্যের সাক্ষী। ধীরে ধীরে সে পাতা উল্টাতে লাগল, এবং চোখে পড়ল এমন একটি ইতিহাস, যা গ্রামবাসীর কল্পনারও বাইরে। ডায়েরিতে লেখা আছে, প্রথম জমিদারী উত্তরাধিকারীর মৃত্যুর পর থেকেই দুর্গাপূজার সময় মুখোশ পরার প্রথা চালু হয়। বলা হয়, সেই সময় বাড়িতে মৃত্যুর পরিভাষা অশুভ শক্তির মতো বিরাজ করছিল। লোকবিশ্বাস অনুযায়ী, যদি কেউ মুখোশ পরে উপস্থিত হয়, তবে অশুভ শক্তি তাকে স্পর্শ করতে পারবে না। অর্ণব বুঝতে পারল, প্রথম দিকে এই রীতি হয়তো শুধুই আত্মরক্ষা ও নিরাপত্তার একটি উপায় ছিল।
কিন্তু ডায়েরির পাতাগুলো যত উল্টানো হলো, রহস্য আরও গভীর হয়ে উঠল। লেখায় বলা আছে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মুখোশ পরার প্রথা শুধু নিরাপত্তা নয়, বরং এক জটিল নিয়মে রূপ নেয়। সেই নিয়ম অনুযায়ী, নির্দিষ্ট রাতগুলোতে, নির্দিষ্ট সংখ্যক মুখোশধারী উপস্থিত থাকে, নাচে, গান করে, এবং এক ধরনের আড়ালে থাকা শক্তিকে তৃপ্ত রাখে। ডায়েরিতে উল্লেখ আছে, প্রাথমিকভাবে এটি ছিল পরিবারের সদস্যদের মধ্যে সীমাবদ্ধ, কিন্তু পরে বাইরে থেকেও লোককে যুক্ত করা হয়। অর্ণবকে চোখে পড়ল এমন এক লাইন—“যে কেউ অনভিপ্রেত পথে প্রবেশ করবে, সে মুখোশধারীর খেলা হিসেবে গ্রহণযোগ্য হবে না। তার জন্য পথ এক অদৃশ্য অন্ধকারের দিকে খুলে যায়।” এই লাইন পড়ে অর্ণবের রোমাঞ্চ আরও বাড়ল। বোঝা গেল, মুখোশধারীদের উপস্থিতি, তাদের নাচ, এবং তাদের অদৃশ্য হওয়া—সবই একটা নিয়মিত, পরিকল্পিত খেলা, যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এক অদ্ভুত ভয়ঙ্কর রূপ নিয়েছে।
ডায়েরির শেষে অর্ণব পড়ল আরও একটি chilling তথ্য। লেখা আছে, “যে কোনো বাইরের লোক এই খেলায় অনিচ্ছায় বা কৌতূহলে অংশ নেয়, তার জন্য নিরাপদ প্রত্যাবর্তন নেই। খেলা শেষ হওয়ার আগে কেউ সরে যেতে পারবে না।” অর্ণব অনুভব করল, তিনি শুধু তথ্য উন্মোচন করছেন না, বরং এক প্রাচীন খেলায় প্রবেশ করছেন, যার নিয়মগুলি এতটাই জটিল ও ভয়ঙ্কর যে, মানবিক বুদ্ধি একা সব কিছু বোঝাতে পারবে না। ডায়েরি থেকে তিনি আরও জানলেন, কিছু বছর আগে যে মানুষগুলো নিখোঁজ হয়েছিল, তারা হয়তো এই খেলায় অন্তর্ভুক্ত হয়ে গিয়েছিল—প্রকৃত অর্থে, তারা ‘অন্তর্ভুক্ত’ হয়ে ফিরে আসেনি। অর্ণবের মনে হলো, জমিদারবাড়ির মুখোশধারীরা কেবল উৎসব বা আড়াল নয়, বরং এক ধরনের প্রাচীন, নিয়ন্ত্রিত, এবং ভয়ঙ্কর যন্ত্রণার খেলার অংশ। এই আবিষ্কার তাকে আরও গভীরভাবে বাড়ির ইতিহাস, মুখোশধারীর সংখ্যা ও আচরণ, এবং বছরের পর বছর ধরে চলা এই খেলার উদ্দেশ্য জানার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করালো। রাতের নিঃশব্দে ডায়েরি পড়তে পড়তে অর্ণবের চেহারায় ভয় আর উত্তেজনার মিশ্রণ ফুটে উঠল—যেন সে জানল, এবার তার অনুসন্ধান শুধু কৌতূহল নয়, বরং জীবনের নিরাপত্তার সঙ্গে যুক্ত এক বিপজ্জনক অভিযানের সূচনা।
অধ্যায় ৬ – গোপন ঘরের সন্ধান
অর্ণবের অনুসন্ধান তাকে বাড়ির সবচেয়ে অন্ধকার, ভগ্নপ্রায় করিডোরের দিকে নিয়ে গেল। এই করিডোরে ধুলো জমে, পুরনো কাঠের ফাটল আর দেওয়ালে অদ্ভুত আঁচড়ের চিহ্ন ছড়িয়ে রয়েছে। বাতাস প্রবেশ করে করিডোরে এক অদ্ভুত শীতলতা ছড়িয়ে দিচ্ছিল, যা অর্ণবকে আরও সতর্ক করে তুলল। ধীরে ধীরে সে লক্ষ্য করল, দেওয়ালে একটি অদৃশ্য হ্যান্ডেল রয়েছে, যা প্রথমে কারও নজর এড়িয়েছে। অর্ণব সবার মতো সাবধানে তা টেনে দেখল—হঠাৎই একটি লুকোনো ঘরের দরজা খুলে গেল। দরজার পিছনে শুধুই অন্ধকার নয়, বরং এক অদ্ভুত শূন্যতা, যা যেন প্রতিটি পদক্ষেপে তাকে কাঁপিয়ে দিচ্ছিল। ঘরে প্রবেশ করার সাথে সাথে অর্ণব চোখে পড়ল অজস্র পুরোনো মুখোশ, যা পাথরের তাকের মতো সাজানো। মুখোশগুলো নানারকম রঙ, আকার ও অভিব্যক্তিতে তৈরি। কেউ মানুষের মুখের মতো, কেউ পশুর, কেউ আবার দেব-দেবীর রূপধারী। অর্ণব অবাক হল, এতগুলো মুখোশের মধ্যে যেন প্রতিটি নিজস্ব জীবন্ত শক্তি ধারণ করে।
অর্ণবের কৌতূহল তাকে এগিয়ে নিয়ে গেল আরও গভীরে। প্রতিটি মুখোশের ভেতরে ছোট ছোট খোদাই করা নাম। চোখ ঘুরিয়ে দেখতেই সে বুঝল—এরা সবাই সেই মানুষ, যারা এক সময় এই বাড়িতে দুর্গাপূজার সময় নিখোঁজ হয়েছে। প্রতিটি নাম যেন এক ব্যক্তির গল্প, এক অদৃশ্য নিখোঁজ হওয়ার ইতিহাসকে ধারণ করছে। অর্ণব হৃদয়তলে অনুভব করল, মুখোশগুলো শুধু রূপ নয়; এরা এক ধরনের স্মারক, এক ভয়ঙ্কর রেকর্ড, যা বছর বছর বাড়ির ইতিহাসের সঙ্গে সংযুক্ত। এমনকি কিছু মুখোশের চোখের ভিতর কালো ছায়া আর অদ্ভুত ছাপ পড়ে আছে, যা তাকে এক অদ্ভুত ভয় দেয়। মনে হলো, প্রতিটি মুখোশ তার দিকে তাকাচ্ছে, যেন বলছে—“যদি তুমি খুব গভীরে যাও, তাহলে এই খেলায় তুমি অন্তর্ভুক্ত হবে।” অর্ণবকে বুঝতে সময় লাগল না—এই বাড়ি এবং মুখোশধারীরা শুধু উৎসব বা রীতির জন্য নয়, বরং নিখোঁজ মানুষের গল্প সংরক্ষণের এক প্রাচীন এবং ভয়ঙ্কর পদ্ধতি চালাচ্ছে।
ঘরে দাঁড়িয়ে অর্ণবের মন কাঁপছিল। তার সামনে শুধু মুখোশ নয়, বরং এক ধরনের অতীতের ইতিহাস, যা সরাসরি বর্তমানের সঙ্গে যুক্ত। প্রতিটি নামের সঙ্গে একটি কাহিনি লুকানো—কখনও নিখোঁজ হওয়া ব্যক্তি বাড়ির করিডোরে হারিয়ে গিয়েছিল, কখনও তারা খেলায় অন্তর্ভুক্ত হয়ে আর ফিরে আসেনি। অর্ণব বুঝতে পারল, মুখোশধারীর খেলা কেবল দর্শনের জন্য নয়; এটি একটি প্রাচীন নিয়ম, যা মানুষের জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে, তাদের উপস্থিতিকে সীমাবদ্ধ করে, এবং প্রতি বছর একই নিয়মে পুনরাবৃত্তি হয়। ঘরের ভিতরের নিস্তব্ধতা, মুখোশের নিঃশ্বাসহীন চেহারা, আর অন্ধকার করিডোরের হিমশীতল বাতাস—সবই এক অদ্ভুত, চিত্তাকর্ষক আতঙ্ক তৈরি করল। সে জানল, এই ঘরের খোঁজ পাওয়া মানে রহস্যের এক গুরুত্বপূর্ণ স্তর উন্মোচন করা। তবে এই স্তরের সঙ্গে যুক্ত বিপদও রয়েছে, যা অর্ণবকে প্রতিটি পদক্ষেপে সতর্ক থাকতে বাধ্য করছে। এই প্রথম মুহূর্তেই সে উপলব্ধি করল, মুখোশবাড়ির রহস্য কেবল ইতিহাস নয়; এটি একটি জীবন্ত, ভয়ঙ্কর খেলা, যার নিয়ম বোঝা এবং জীবন রক্ষা করা একই সঙ্গে অসম্ভব প্রায়, এবং প্রতিটি মুখোশ তার জন্য এক সতর্কবার্তা, এক প্রাচীন ঘন্টাধ্বনির মতো, যা বলছে—“তুমি আরও গভীরে ঢুকলে, ফিরে আসা সহজ হবে না।”
অধ্যায় ৭ – মুখোশের অভিশাপ
অর্ণব যখন লুকোনো ঘরে দাঁড়িয়ে মুখোশগুলো পর্যবেক্ষণ করছিল, তখন হঠাৎ তার মন খেয়াল করল—প্রতিটি মুখোশ যেন জীবন্ত, যেন তাদের ভেতর দিয়ে একটি শক্তি প্রবাহিত হচ্ছে। সে যত গভীরে তাকাল, অনুভব করল এক অদ্ভুত শীতলতা, যা কেবল শারীরিক নয়, বরং মানসিক ও আধ্যাত্মিকভাবে ঘিরে ফেলছে। ধীরে ধীরে সে ডায়েরি ও পুরনো নথিপত্র মিলিয়ে এক ভয়ঙ্কর সত্য জানতে পারল—এই মুখোশগুলো অভিশপ্ত। কেউ যদি মুখোশ পরে, সে আর নিজের রূপে ফিরে আসে না। শরীর শারীরিকভাবে রয়ে গেলেও, আত্মা বা পরিচয় যেন অন্য এক অদৃশ্য জগতে প্রবেশ করে। অর্ণবের রোমাঞ্চ আর ভয় একসাথে বেড়ে গেল। তার মনে হলো, এই অভিশাপ কেবল নিখোঁজ হওয়া মানুষদের জন্য নয়, বরং যে কেউ খোঁজ করতে আসে, তার কৌতূহলও তাকে বিপদে ফেলে। গ্রামের মানুষরা এই অভিশাপের কথা জানলেও, তারা কখনও সরাসরি মুখ খুলে বলেনি, শুধুই গুজব বা ভয়ের ছায়া হিসেবে এটি ধরে রেখেছিল। কিন্তু অর্ণব এখন বুঝল, এটি শুধু গুজব নয়, বাস্তবতার আয়নায় প্রতিফলিত এক ভয়ঙ্কর নিয়ম।
ডায়েরি এবং মুখোশের খোদাই করা নামগুলো মিলিয়ে অর্ণব দেখল, বহু প্রাণ এই অভিশাপের শিকার হয়েছে। কখনও কেউ দুর্গাপূজার সময় ঘরে ঢুকে অচেনা মানুষের মতো মুখোশ পরেছিল, কখনও কেউ অনিচ্ছায় বা কৌতূহলে সেই খেলায় যুক্ত হয়েছিল। প্রত্যেকের নাম মুখোশের ভেতরে খোদাই করা হয়েছে, যেন তারা এক চিরস্থায়ী বন্দী হয়ে গেছে। অর্ণবের মনে হলো, এই অভিশাপ শুধু আত্মার নয়, বরং এটি মানসিক, সামাজিক, এবং আধ্যাত্মিকভাবে মানুষের অস্তিত্বকে আচ্ছন্ন করে। এই অভিশাপ ভাঙার কোনো উপায় কেউ জানে না, এমনকি জমিদারবাড়ির বর্তমান বংশধরও জানে না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই অভিশাপ তার নিয়মে আরও শক্তিশালী হয়ে উঠেছে, এবং প্রতিটি নতুন মুখোশধারী সেই নিয়মে বাধ্য হয়ে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে। অর্ণব বুঝল, যদি সে গভীরভাবে অনুসন্ধান চালায়, তবে শুধুমাত্র তথ্য সংগ্রহ নয়, বরং নিজের নিরাপত্তার প্রশ্নও সামনে আসবে। প্রতিটি পদক্ষেপে তার কৌতূহল ও সতর্কতার মধ্যে ভারসাম্য রাখতে হবে, কারণ এক ভুল ধাপ তাকে সেই অভিশপ্ত জগতে ঢুকিয়ে দিতে পারে।
ঘরের নিস্তব্ধতা, মুখোশের ভেতরের খোদাই করা নাম, এবং ভগ্নপ্রায় করিডোরের শীতলতা—all এক অদ্ভুত আতঙ্ক তৈরি করছিল। অর্ণব বুঝল, মুখোশবাড়ির রহস্য কেবল ভূত বা অতিপ্রাকৃত নয়; এটি এক প্রাচীন নিয়ম, যা মানুষের জীবন, আত্মা এবং মানসিকতার ওপর প্রভাব ফেলে। অভিশাপের ধারণা এতটাই শক্তিশালী যে, এটি বছরের পর বছর ধরে মানুষকে আটকে রাখছে, এবং একই সঙ্গে নতুন অনুসন্ধানকারীর কৌতূহলকে পরীক্ষা করছে। অর্ণবের চোখে ভয় আর রোমাঞ্চের মিশ্রণ ফুটে উঠল; সে জানল, মুখোশের অভিশাপ শুধু ইতিহাস নয়, বরং এক জীবন্ত বাস্তবতা, যা এক প্রাচীন খেলায় মানুষকে অন্তর্ভুক্ত করছে। প্রতিটি মুখোশের মধ্যে লুকানো শক্তি, প্রতিটি নামের ভেতরে সংরক্ষিত আত্মা—সবই তাকে জানাচ্ছে, এই রহস্যের গভীরে ঢোকা মানে এক নতুন পৃথিবীতে প্রবেশ করা, যেখানে সময়, জীবন, এবং পরিচয় আর আগের মতো থাকবে না।
অধ্যায় ৮ – ষড়যন্ত্রকারীর মুখোশ খোলা
অর্ণবের অনুসন্ধান যত গভীর হচ্ছে, ততই তার মনে হলো, মুখোশবাড়ির রহস্য কেবল অতিপ্রাকৃত ঘটনার সঙ্গে সম্পর্কিত নয়; বরং এর পেছনে মানুষের একটি সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র লুকিয়ে আছে। ধীরে ধীরে সে বুঝতে পারল, অনেক ঘটনাই কেবল অজানা শক্তির খেলা নয়, বরং কিছু মানুষের কৌশল, প্রভাব ও লোভের ফল। প্রতিটি নিখোঁজ হওয়া ব্যক্তি, প্রতিটি অদ্ভুত ছায়া, প্রতিটি মুখোশধারীর উপস্থিতি—সবই একটি পরিকল্পনার অংশ। অর্ণব ডায়েরি, মুখোশের খোদাই, এবং গ্রামবাসীর বিবরণ মিলিয়ে বুঝতে পারল, কেউ চাইছে এই বাড়ির ইতিহাসকে আড়াল করে রাখুক, যাতে লোকজন এই প্রাচীন সম্পদ ও ধনরাশি সম্পর্কে জানতে না পারে। হঠাৎ তার নজর গেল এমন একটি লাইন পড়ে, যেখানে বলা হয়েছে, “যে কেউ বাইরে থেকে আসবে, তার কৌতূহলকে ব্যবহার করে, আমরা আমাদের ধন-সম্পদ নিরাপদ রাখব।” এই লাইনটি অর্ণবকে আরো সতর্ক করল; বোঝা গেল, এখন তিনি শুধু অতিপ্রাকৃত রহস্যের দিকে তাকাচ্ছেন না, বরং এক পরিকল্পিত মানবিক ষড়যন্ত্রের খোঁজ পাচ্ছেন।
অর্ণব আরও গভীরে অনুসন্ধান চালিয়ে একটি অদ্ভুত আবিষ্কার করল—জমিদারের উত্তরপুরুষদের একজন এখনও বাড়িতে লুকিয়ে আছে। বহু বছর ধরে সে অন্ধকার কোণে বসে, মুখোশের ভয়ে গ্রামের মানুষদেরকে দূরে রাখছে। নিজের উপস্থিতি লুকিয়ে রেখে, সে প্রতি বছর দুর্গাপূজার সময় মুখোশধারীর খেলা পরিচালনা করছে। মূল উদ্দেশ্য, বাড়ির অজস্র ধন-সম্পদ এবং প্রাচীন মূল্যবান জিনিসপত্রকে নিরাপদে রাখা। অর্ণব বুঝল, অনেক নিখোঁজ হওয়া মানুষ আসলে অতিপ্রাকৃত নয়, বরং এই ষড়যন্ত্রকারীর তৈরি পরিস্থিতিতে হারিয়ে গেছে—কেউ জানত না, তারা কোন খেলা বা পরীক্ষার মধ্যে ধরা পড়েছে। ষড়যন্ত্রকারীর কৌশল ছিল নিখুঁত: মুখোশ, অন্ধকার, এবং গ্রামবাসীর ভয়কে ব্যবহার করে বাড়ির বাস্তবতা আড়াল করা। অর্ণব লক্ষ্য করল, এই পরিকল্পনা প্রায়ই মানুষের কৌতূহলকে ফাঁদে ফেলে, এবং যারা খুব গভীর অনুসন্ধান করে, তারা সরাসরি ষড়যন্ত্রকারীর নিয়ন্ত্রণের মধ্যে চলে আসে।
এখানেই অর্ণবের জন্য বড় ধাক্কা আসে—যে মুখোশধারীর ছায়া তিনি অতিপ্রাকৃত মনে করছিল, তা আসলে মানবিক পরিকল্পনার অংশ। ষড়যন্ত্রকারীর লুকোনো উপস্থিতি, মুখোশধারীর নিখুঁজ খেলা, এবং অতিপ্রাকৃত গল্পের ছদ্মবেশ সব মিলিয়ে এক অদ্ভুত জাল তৈরি করেছে। অর্ণব বুঝতে পারে, এই রহস্যের প্রকৃত মুখোশ শুধু মুখোশ নয়; এটি ষড়যন্ত্রকারীর অস্ত্র, যা মানুষের মনকে মুগ্ধ ও ভয়বোধে আবদ্ধ রাখে। এখন তার লক্ষ্য স্পষ্ট—সে শুধু তথ্য সংগ্রহ করবে না, বরং ষড়যন্ত্রকারীর প্রকৃত পরিচয় উন্মোচন করে গ্রামবাসী এবং স্বাভাবিক বাস্তবতার মধ্যে সত্যকে ফিরিয়ে আনবে। এই মুহূর্তে অর্ণবের মনে হলো, মুখোশবাড়ির অতিপ্রাকৃত রহস্যের আড়ালে যে মানবিক লোভ ও পরিকল্পনা লুকিয়ে আছে, তা অনেক বড় এবং জটিল, এবং এই খোঁজ তাকে এক নতুন সাহস ও সতর্কতার সঙ্গে এগোতে বাধ্য করছে।
অধ্যায় ৯ – চূড়ান্ত সংঘর্ষ
মহাষ্টমীর রাতটি হৃদয়পুরে এক অদ্ভুত উত্তেজনা নিয়ে আসে। অর্ণব যখন মুখোশবাড়ির উঠোনে প্রবেশ করল, তখন চারপাশে বাতি জ্বলে, আর হাজারো মানুষের ভিড় জমে উঠেছিল। কিন্তু ভিড়ের মধ্যে সবচেয়ে অদ্ভুত কিছু হলো—ডজনখানেক মুখোশধারী, যারা নিখোঁজের মতো বছর ধরে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে, এবার সবাই উপস্থিত। অর্ণবের চোখ অজস্র মুখোশের দিকে টিকে রইল। বাতাসে একটি অদ্ভুত স্থিরতা, যেন সময় নিজেই থেমে গেছে। হঠাৎ, এক অদৃশ্য শক্তি যেন উঠোনের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ল। অর্ণব লক্ষ্য করল, কিছু মানুষ হঠাৎ ভেঙে পড়ছে, তাদের শরীর যেন টান পড়ে যাচ্ছে, এবং তারা আর নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারছে না। প্রথমে সে ভয় পেয়েছিল, কিন্তু শীঘ্রই বুঝল, এটি শুধু অতিপ্রাকৃত শক্তির খেলা নয়; এখানে কিছু পরিকল্পিত নিয়ন্ত্রণ কাজ করছে। তাকে বুঝতে হবে, সরাসরি সক্রিয়ভাবে মোকাবিলা না করলে, এই রাত শেষ হওয়ার আগে নিজেও এই শক্তির ফাঁদে ধরা পড়বে।
অর্ণব সতর্কতার সঙ্গে এগোতে লাগল। প্রতিটি পদক্ষেপে সে চারপাশ পর্যবেক্ষণ করছিল—মুখোশধারীর অদ্ভুত নাচ, হঠাৎ পতিত মানুষ, বাতাসে ছড়িয়ে থাকা গম্ভীর সঙ্গীত—সবই যেন একটি পরিকল্পিত ছক। অর্ণব জানত, তাকে এই রাতের মধ্যেই ষড়যন্ত্রকারীর মূল উদ্দেশ্য উন্মোচন করতে হবে। হঠাৎ তার নজর গেল—একটি বিশেষ মুখোশধারী অন্যদের থেকে আলাদা, যেন নিয়ন্ত্রণ করছে। অর্ণব বুঝল, এই ব্যক্তি হয়তো সেই জমিদারের উত্তরপুরুষ, যিনি লুকিয়ে থেকে এই রহস্যের পেছনে ষড়যন্ত্র চালাচ্ছে। অর্ণব গভীর নিঃশ্বাস নিয়ে নিজেকে প্রস্তুত করল, সরাসরি মুখোমুখি হবার জন্য। তার কৌশল ছিল—পেছনের পরিকল্পনা বোঝা, শক্তি এবং মানসিক চাপ নির্ণয় করা, এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, নিজের আত্মবিশ্বাস ও সাহসকে ধরে রাখা।
চূড়ান্ত মুহূর্তে অর্ণব সাহস নিয়ে মুখোশধারীর সঙ্গে মুখোমুখি হলো। ষড়যন্ত্রকারীর চোখে ঠাণ্ডা এবং সংযম দেখা গেল, কিন্তু অর্ণব জানত, তার পরিকল্পনা এবং সাহসই এই অতিপ্রাকৃত ভয়কে টক্কর দিতে পারবে। শক্তির অদৃশ্য টান এবং মুখোশধারীদের নাচের মধ্যে অর্ণব নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখল। ধীরে ধীরে তিনি ষড়যন্ত্রকারীর খেলা ভাঙার কৌশল বের করল—মানবিক বিচক্ষণতা, স্থানীয় মানুষদের সাহায্য এবং শক্তির কেন্দ্রে অগ্নিসংযোগের মতো মনস্তাত্ত্বিক চাপ ব্যবহার করে। মুহূর্তে, অনেক মুখোশধারী অচেতন হয়ে পড়ল, এবং নিখোঁজ মানুষদের শরীর ফেরত এল। অর্ণব উপলব্ধি করল, সাহস, বুদ্ধি, এবং সচেতনতা দিয়ে যে কেউ এই ভয়ঙ্কর খেলার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারে। চূড়ান্ত সংঘর্ষ শেষে, অর্ণব দাঁড়িয়ে রইল—উঠোনে শান্তি, মানুষগুলো নিরাপদ, আর মুখোশবাড়ি যেন নতুন দিনের আলোকে স্বাগত জানাচ্ছে।
অধ্যায় ১০ – সত্যের উন্মোচন
অর্ণবের দীর্ঘ অনুসন্ধান, রাতের আতঙ্ক, এবং মুখোশবাড়ির গোপনীয় ঘর ও ডায়েরির খোদাই করা নাম—সবই এক মুহূর্তে মিলিত হলো পুজোর শেষ রাতে। সে বুঝতে পারল, এই রহস্যের সত্য দ্বিমুখী: একদিকে প্রাচীন অভিশাপ, যা মুখোশ পরিধানের মাধ্যমে মানুষের আত্মা গ্রাস করে, অন্যদিকে জমিদার পরিবারের লোভী উত্তরপুরুষের ষড়যন্ত্র, যার উদ্দেশ্য ছিল বাড়ির ধন-সম্পদ এবং নিয়ন্ত্রণকে বজায় রাখা। এই দ্বিমুখী শক্তি এক সঙ্গে বসবাস করে বাড়ির প্রতিটি কোণে। অর্ণব অনুভব করল, শুধু অনুসন্ধান বা পর্যবেক্ষণই যথেষ্ট নয়—এবার তাকে সরাসরি পদক্ষেপ নিতে হবে। রাতের নিস্তব্ধতা, উঠোনে ভিড়, এবং মুখোশধারীর অদৃশ্য উপস্থিতি—সবাই এক সঙ্গে তাকে সতর্ক করছে, কিন্তু তার মনোসংযোগ এখন শুধুই একটি কাজের দিকে: মুক্তি দেওয়া হারিয়ে যাওয়া আত্মাদের এবং সত্যের মুখোমুখি হওয়া। সে ধীরে ধীরে শিবমূর্তির দিকে এগোল, যেখানে প্রাচীন রীতির প্রতীক, পূর্ণতা এবং শক্তি মিলিত।
অর্ণব শিবমূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে প্রতিটি মুখোশকে জ্বালিয়ে দেয়। আগুনের লাল শিখা উঠোনের ধোঁয়ায় মিশে যায়, আর সেই সঙ্গে বাতাসে এক অদ্ভুত তীব্রতা ছড়ায়। অগ্নি প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়—অশুভ শক্তি, অভিশাপ, এবং ষড়যন্ত্রের মিলিত জটিলতা একসঙ্গে ভেঙে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে, মুখোশগুলোর মধ্যে সংরক্ষিত আত্মারা মুক্তি পায়। নিখোঁজ মানুষদের অস্তিত্ব আবার ফিরে আসে, তাদের চোখে জীবন ও স্বাভাবিকতা ফিরে আসে। অর্ণব উপলব্ধি করল, মুখোশবাড়ি শুধু একটি স্থাপনা নয়, বরং প্রাচীন বিশ্বাস, লোভ, এবং মানবিক কৌশলের এক অদ্ভুত জটিল নেটওয়ার্ক। বাড়িটি ধ্বংস হতে শুরু করে, ধুলো, ধ্বংসাবশেষ, এবং আগুন—সব মিলিয়ে এক ধরনের চিরস্থায়ী সমাধান। এটি ছিল এক প্রাচীন অভিশাপ এবং মানুষের লোভের চূড়ান্ত বিন্যাস, যা শেষমেষ সঠিক প্রক্রিয়ায় মুক্তি পায়।
তবুও, ধ্বংসের মাঝেও অর্ণবের মনে প্রশ্ন ঘুরপাক খায়। কি সত্যিই সব শেষ হয়েছে, নাকি মুখোশবাড়ি আবারও ফিরে আসবে, আগামী বছরের দুর্গাপূজায়? ধোঁয়া, আগুন, এবং ধ্বংসাবশেষের মধ্যেও অদ্ভুত নীরবতা বিরাজ করছে। মনে হয়, বাড়ির নিস্তব্ধ আত্মা, ষড়যন্ত্রকারীর ছায়া, এবং প্রাচীন অভিশাপ—সবই এক অদৃশ্য জগতে লুকিয়ে আছে, যা মানুষের চোখে দেখা যায় না। অর্ণব দাঁড়িয়ে রইল—এক দিকে তৃপ্তি, কারণ বহু নিখোঁজ মানুষ ফিরে এসেছে, অন্য দিকে অদ্ভুত অনিশ্চয়তা, যেন ভবিষ্যত এখনও পূর্ণ রহস্যে আবৃত। চোখে আগুনের আলোর প্রতিফলন, ধ্বংসের শব্দ, এবং বাতাসের ফিসফিসানি—সবই তাকে মনে করিয়ে দিচ্ছে, মুখোশবাড়ির ইতিহাস চিরকালের মতো বন্ধ হয়নি; এটি শুধু নতুন আড়ালে, নতুন বছর এবং নতুন কৌতূহলের জন্য অপেক্ষা করছে।
শেষ