Bangla - প্রেমের গল্প

প্রতিশ্রুতি কেবল আকাশের নয়

Spread the love

উদ্দীপ্ত সাহা


মেঘলার জন্ম সেই গ্রামের মাঝখানেই, যেখানে ভোর হলে প্রথমে শোনা যেত পাখির ডাক আর দূরে ভেসে আসত গরুর ঘণ্টার টুংটাং আওয়াজ। চারদিক সবুজে ঘেরা, বাঁশঝাড় আর কাঁচা রাস্তার ভেতর দিয়ে সকালের আলো যখন নেমে আসত, তখনই শিশুরা মাঠের দিকে ছুটত খেলতে। মেঘলা ছোটবেলা থেকেই ছিল হাসিখুশি আর একটু দুষ্টু স্বভাবের মেয়ে। তার চোখে যেন সবসময় এক ধরনের কৌতূহল ঝিলিক দিত—কোথাও নতুন কিছু ঘটছে কি না, কে কাকে নিয়ে খেলছে, নদীর জলে কত মাছ লাফাচ্ছে। আর্যের সঙ্গে তার পরিচয়ও এই খেলাধুলার মাঠেই। গ্রামের প্রায় সব শিশু একসঙ্গে দৌড়ঝাঁপ করলেও মেঘলা ও আর্যের মধ্যে ছিল এক অদ্ভুত সখ্যতা। দুজনেই যেন একে অপরকে ছাড়া সম্পূর্ণ হতো না। যখন অন্যরা লাঠিখেলা বা গুলি খেলার মধ্যে মেতে থাকত, তখন এরা দু’জন আলাদা হয়ে বসত নদীর ধারে, পাথর ছুঁড়ে জলে ছড়িয়ে পড়া ঢেউ দেখত, আর একে অপরকে মনের গল্প শোনাত। বৃষ্টির দিনে কাদামাটির ভেতর পা ডুবিয়ে হেসে গড়াগড়ি খাওয়া হোক, কিংবা গরম দুপুরে তালগাছের ছায়ায় বসে শাড়ির আঁচলে বাতাস খাওয়া—তাদের শৈশব যেন গ্রামের সবার থেকে আলাদা হয়ে উঠেছিল।

এই বন্ধুত্বের মধ্যে নিস্পাপ টান ছিল, যা তখনকার বয়সে তারা বোঝেনি, কিন্তু হৃদয়ের গভীরে এক অজানা বাঁধনে বাঁধা পড়েছিল। মেঘলা যখন স্কুলে যেতে চাইত না, আর্যই তার হাত ধরে নিয়ে যেত। ক্লাসে নতুন কিছু শেখালে আর্য মেঘলাকে ধীরে ধীরে বুঝিয়ে দিত, যেন তার পড়াশোনা পিছিয়ে না পড়ে। আবার অন্যদিকে, মেঘলা ছিল প্রাণবন্ত গল্পকার; সে আর্যকে প্রায়ই কল্পনার গল্প শোনাত—কখনও রাজকন্যা, কখনও জলপরী, কখনও আবার অদ্ভুত কোনও গুহার কথা। এই গল্পগুলো শুনতে শুনতে আর্যের চোখে স্বপ্নের রঙ লাগত, আর দুজনেই মনে মনে প্রতিশ্রুতি দিত—যতদিন বাঁচবে একসঙ্গে থাকবে। তাদের বন্ধুত্বকে গ্রামের বাকি শিশুরা কখনও হিংসা করত, কখনও ঠাট্টা করত। কিন্তু কেউই এই দু’জনকে আলাদা করতে পারত না। একবার বর্ষার সময় গ্রামে বন্যা এল, চারপাশ জলমগ্ন, খাওয়ার কষ্ট, ঘরবাড়ি ডোবার ভয়—তখনও আর্য নিজের হাতে মেঘলার পরিবারকে সাহায্য করল, বাঁশের ভেলা বানিয়ে নিরাপদ জায়গায় নিয়ে গেল। সেই সময় মেঘলার চোখে জল এসে গিয়েছিল, কিন্তু সে কিছু বলেনি—শুধু মনের ভেতর আরও দৃঢ় হলো আর্যের প্রতি ভরসা আর ভালোবাসা।

তাদের শৈশবের দিনগুলো ছিল অমূল্য, যা কেবল হাসি আর খেলার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং জীবনের প্রথম শিক্ষা দিয়েছিল—ভালোবাসা আর বন্ধুত্ব মানে একে অপরের পাশে থাকা। নদীর তীরে বসে দু’জনে প্রায়ই আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকত, যেখানে মেঘেরা ভেসে বেড়ায়। মেঘলা বলত, “দেখো, ওই মেঘটা ঠিক আমাদের মতো—কখনও কাছে আসে, কখনও আবার দূরে ভেসে যায়, কিন্তু আকাশ ছেড়ে যায় না।” আর্য মৃদু হেসে জবাব দিত, “যত দূরেই যাক, আবার ফিরে আসবে।” তাদের মনে তখনও শহরের ব্যস্ততা বা ভবিষ্যতের চিন্তা ঢোকে নি, কিন্তু অজান্তেই তারা জীবনের এক অটুট প্রতিশ্রুতির দিকে এগোচ্ছিল। গ্রামবাসী অনেকেই তাদের নাম একসঙ্গে উচ্চারণ করত, যেন এই দুই শিশু ভবিষ্যতেও পাশাপাশি চলবে। কাঁচা রাস্তায় হাঁটার শব্দ, মাঠে ছুটোছুটির হাসি, পুকুরঘাটের জলতরঙ্গ—সবকিছুতেই যেন মিশে ছিল মেঘলা আর আর্যের শৈশব। সেই সরল দিনের স্মৃতিই তাদের পরবর্তী জীবনের ভিত্তি হয়ে রইল, যা সময়, দূরত্ব, কিংবা দুঃখ-কষ্টও মুছে দিতে পারবে না।

গ্রামের বার্ষিক মেলাটা যেন সারা বছর ধরে সবাই যার জন্য অপেক্ষা করে, সেই বিশেষ দিন। বিকেলের আগেই মাঠের চারপাশে আলো ঝলমল করে উঠেছিল, প্যান্ডেলগুলিতে লাউডস্পিকারে বাজছিল লোকগান, কোথাও নাগরদোলার চিৎকার-হাসি, কোথাও আবার পসরা সাজিয়ে বসা দোকানিদের ডাকাডাকি। বাতাসে মিশে ছিল জিলিপির গরম মিষ্টি ঘ্রাণ, ভাজা বাদামের গন্ধ, আর গরম মাটির চায়ের কাপে ভেসে আসা ধোঁয়া। মেঘলা রঙিন লাল জামা পরে এসেছিল, চুলে খোপা, চোখে খাঁটি আনন্দের ঝিলিক। আর্য নতুন সুতির পাঞ্জাবি পরে, পকেটে কয়েকটা সঞ্চিত পয়সা নিয়ে দাঁড়িয়েছিল, যাতে মেঘলার জন্য কিছু কিনতে পারে। তারা দু’জন একসঙ্গে হাত ধরে মেলায় ঘুরতে শুরু করল—কখনও খেলনার দোকানের সামনে থামল, কখনও কাঠের ঘোড়ায় চড়ল, কখনও আবার হুল্লোড় করে মিষ্টির দোকানে দাঁড়িয়ে রসগোল্লা ভাগাভাগি করে খেল। সেই রাতের আকাশটা ছিল অন্যরকম—কালো মেঘের ফাঁক গলে পূর্ণিমার আলো চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল, আর দূরে দূরে দেখা যাচ্ছিল রঙিন ফানুস আকাশে উড়ছে। যেন এই সাধারণ মেলাকে এক জাদুকরী মুহূর্তে পরিণত করেছিল প্রকৃতি।

রাত যত বাড়ছিল, ভিড়ও তত জমছিল, কিন্তু মেঘলা আর আর্য নিজেরাই যেন নিজেদের পৃথিবীতে ডুবে ছিল। নাগরদোলায় বসার সময় মেঘলা ভয় পেয়ে আর্যের হাত শক্ত করে ধরেছিল, আর্য আশ্বস্ত করেছিল—“আমি আছি, তুমি পড়ে যাবে না।” নাগরদোলা যখন উপরে উঠেছিল, তখন তাদের চোখের সামনে খুলে গিয়েছিল পুরো গ্রামের আলো, দূরের মাঠ, নদীর ঝিলিক আর আকাশে ভেসে বেড়ানো অসংখ্য ফানুস। সেই মুহূর্তে মেঘলার হৃদয়টা অদ্ভুতভাবে কেঁপে উঠেছিল—এ যেন কেবল খেলা নয়, যেন জীবনের এক অদৃশ্য প্রতিশ্রুতি তাদের দুজনকে কাছে টেনে নিচ্ছে। মাটিতে নেমে আবার যখন তারা ভিড় ঠেলে বেরিয়ে এলো, তখন হঠাৎই তাদের পা থেমে গেল নদীর ঘাটের দিকে। মেলা থেকে আলোর ঝলকানি ভেসে আসছিল দূরে, কিন্তু নদীর ঘাটে ছিল এক নিস্তব্ধ সৌন্দর্য। হালকা ঠান্ডা হাওয়া বইছিল, জলে প্রতিফলিত হচ্ছিল আকাশের তারাগুলো। এই নীরবতা তাদের ভেতরের অনুভূতিকে যেন আরও স্পষ্ট করে দিল। মেঘলা চোখ নামিয়ে ফিসফিস করে বলল, “যদি কখনও আমাদের আলাদা করে দেয়?” আর্য কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে তার হাত শক্ত করে ধরে বলল, “যাই হোক না কেন, আমরা একসঙ্গে থাকব।”

এই কথাগুলো শুধু শিশুসুলভ প্রতিশ্রুতি ছিল না; সেই রাতের পরিবেশ, নদীর ধারে সেই নিস্তব্ধতা, আকাশে ভেসে বেড়ানো ফানুসের মতো স্বপ্নময় মুহূর্ত—সবকিছু মিলে তাদের হৃদয়ে গভীরভাবে খোদাই হয়ে গেল। মেঘলার চোখে জল চিকচিক করল, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে তার ঠোঁটে ফুটল এক হালকা হাসি। সে বিশ্বাস করল, আর্যের কথাই সত্যি হবে, জীবনের সব বাধা কেটে যাবে একদিন। দূরে মেলার ঢাকের শব্দ ভেসে আসছিল, আলো ঝলমল করছিল, কিন্তু তাদের দুজনের পৃথিবী যেন সীমাবদ্ধ হয়ে গেল সেই প্রতিশ্রুতির ভেতরেই। রাত শেষে বাড়ি ফেরার পথে তারা চুপচাপ হাঁটছিল, তবু নীরবতার মধ্যে একটা দৃঢ়তা কাজ করছিল—এখন থেকে তারা আর কেবল বন্ধু নয়, তারা একে অপরের জীবনের অংশ। গ্রামের কাঁচা রাস্তার ধুলো, বাতাসে ভেসে আসা নাগরদোলার গানের প্রতিধ্বনি আর নদীর শীতল স্পর্শ—সবকিছু মিলে সেই রাতকে এমন এক স্মৃতি করে তুলল, যা মেঘলা আর আর্যের জীবনে চিরকাল বেঁচে থাকবে। সেই মেলার রাতেই তাদের শৈশবের বন্ধুত্ব পেরিয়ে জন্ম নিল এক অটুট প্রতিশ্রুতি, যা ভবিষ্যতের ঝড়-ঝাপটা পেরিয়েও আলো জ্বেলে রাখবে।

গ্রামের নিস্তব্ধ জীবনের সঙ্গে শহরের ব্যস্ততার তফাৎটা মেঘলা প্রথমবার অনুভব করেছিল যখন তার বাবা তাকে কলকাতায় পড়াশোনার জন্য নিয়ে এলেন। ছোট্ট গ্রাম থেকে ট্রেন চেপে যখন শহরে নামল, তখনই চারপাশের অগণিত মানুষের ভিড়, অচেনা কোলাহল আর উঁচু উঁচু বাড়িগুলো তাকে অবাক করে তুলেছিল। এখানে আর নেই খোলা মাঠ, নদীর ঘাট, কিংবা তালগাছের ছায়া; তার বদলে আছে ইট-কংক্রিটের দেওয়াল, যানজট, আর তাড়া-তাড়ি করা মানুষ। মেঘলা এক নতুন আবাসিক স্কুলে ভর্তি হলো, যেখানে পড়াশোনা কঠোর, প্রতিযোগিতা তীব্র, আর প্রতিটি মুহূর্ত সময়ের সঙ্গে লড়াই। প্রথম কয়েক দিন সে রাতে চুপচাপ জানলার পাশে বসে গ্রামটার কথা ভাবত—আর্যের সঙ্গে নদীর ধারে বসা, মেলার রাতের প্রতিশ্রুতি, কিংবা কাদামাটির ভেতর ছুটোছুটি। মনে মনে প্রতিদিনই সে আর্যকে লিখত, কিন্তু কাগজে কলম ধরার সময় কথাগুলো অনেক সময় আটকে যেত। তবুও সে চিঠি পাঠাত—ছোট ছোট কথায় ভরা, যেখানে সে বলত শহরের নতুন জীবন কেমন, পড়াশোনার চাপ কেমন, আর কতটা মিস করছে সেই গ্রামীণ সহজ জীবনকে।

অন্যদিকে, আর্যও কিছুদিন পর শহরে চলে এল পড়াশোনার জন্য, তবে তার পরিস্থিতি ছিল আলাদা। বড় কলেজে ভর্তি হলেও তাকে পড়াশোনার পাশাপাশি টিউশনি করতে হতো, কারণ পরিবারিক অবস্থার জন্য অর্থ উপার্জন জরুরি হয়ে পড়েছিল। শহরে এসে সে দ্রুত বুঝে গেল—এখানে কেউ কারও জন্য সময় রাখে না। ক্লাস, লাইব্রেরি, টিউশনি, তারপর রাত করে হোস্টেলে ফেরা—এভাবেই দিন কেটে যাচ্ছিল। প্রথম দিকে সে মেঘলার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখত, দু’জন ফোনে দীর্ঘক্ষণ কথা বলত, চিঠি লিখত। মেঘলা তার নতুন ক্লাসের গল্প শোনাত, আর্য শোনাত তার লড়াইয়ের কথা। কিন্তু ধীরে ধীরে ব্যস্ততা বাড়তে থাকল, ফোন কলগুলো ছোট হয়ে এলো, চিঠিগুলোও বিরল হতে শুরু করল। কখনও পড়াশোনার চাপে মেঘলা কল ধরতে পারত না, কখনও আর্য রাতের ক্লান্তিতে লিখতে পারত না। তবু দু’জনের মনেই ছিল একটুখানি আক্ষেপ—কেন যেন আগের মতো কাছাকাছি থাকা যাচ্ছে না।

শহরের মানুষ আর জীবনের প্রতিযোগিতা যেন তাদের মধ্যে অদৃশ্য এক দেয়াল তুলে দিল। আগের মতো নদীর ধারে বসে প্রতিশ্রুতি দেওয়ার সুযোগ আর ছিল না; এখানে ছিল পরীক্ষার সিলেবাস, টিউশনির ফি, সহপাঠীদের প্রতিযোগিতা আর ভবিষ্যতের দুশ্চিন্তা। মাঝে মাঝে উৎসবের সময় গ্রামে ফিরলে তারা দেখা করত, কিন্তু সেই দেখা আর আগের মতো স্বচ্ছন্দ ছিল না। ভিড়ের মধ্যে, আত্মীয়-পরিজনের চোখের সামনে দাঁড়িয়ে তারা আর শৈশবের মতো হাসতে পারত না, সেই অবাধ সময়টা যেন কেড়ে নিয়েছে শহর। তবু হৃদয়ের গভীরে প্রতিশ্রুতির স্মৃতি রয়ে গিয়েছিল—মেলার রাতের আকাশে ভেসে বেড়ানো ফানুসের মতো। তারা জানত, জীবন যতই পাল্টে যাক, সেই শৈশবের শেকড় তাদের দু’জনকে কোথাও না কোথাও ধরে রাখবে। কিন্তু বাস্তবতার কঠিন দায়িত্ব, শহরের অচেনা ছন্দ আর ব্যস্ততার ঘূর্ণি ধীরে ধীরে সেই প্রতিশ্রুতিকে ফিকে করে দিল, যেন কাগজের চিঠির কালি ধুয়ে যাচ্ছে সময়ের বৃষ্টিতে।

শহরের গণ্ডিতে মেঘলা যেন এক নতুন জীবনের জন্ম নিল। সকাল থেকেই ভিড়, গাড়ির শব্দ, ক্লাসের তাড়া—সবকিছু তাকে ঘিরে ধরেছে, কিন্তু একই সঙ্গে নতুন সুযোগের আলোও ছড়িয়ে দিল। কলেজের বড় লাইব্রেরি, আধুনিক ল্যাব, শিক্ষক-ছাত্রদের আলোচনার ক্ষেত্র—সবকিছু মেঘলার চোখে জাদুকরী মনে হচ্ছিল। সে বুঝতে পারল, শহর শুধু স্থান নয়, এটি চেতনার এক নতুন দিগন্ত, যেখানে স্বপ্নগুলো আরও বড়, উচ্চাভিলাষ আরও স্পষ্ট। ক্লাস শেষে লাইব্রেরিতে বসে সে পড়ত, কখনও বা কলেজ ক্যাফের একটি কোণে চুপচাপ নোট লিখত, নিজের ভবিষ্যতের ছবি আঁকত। গ্রামের সরল জীবন এবং আর্যের সঙ্গে কাটানো নির্দোষ মুহূর্তগুলো এখন যেন স্মৃতির পাতায় গুটিয়ে রাখা হয়েছে—একটা কোমল, দূরে ছড়ানো নীলাভ আলোর মতো। মাঝে মাঝে গ্রামের কথা মনে হলে চোখে জল জমত, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে মনে হতো, এই নতুন জীবন তাকে আরও শক্তিশালী করে তুলছে, আর ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত করছে। মেঘলার মন নতুন বন্ধুত্ব, নতুন অভিজ্ঞতা, নতুন স্বপ্নের মধ্যে আবদ্ধ, আর সেই স্বপ্নগুলো তাকে গ্রামীণ বন্ধুত্বের মধুর স্মৃতির সঙ্গে লড়াই করতে শেখাচ্ছিল।

আর্যও শহরের ছন্দে নিজেকে হারাতে শুরু করল। কলেজের প্রতিযোগিতা, পরীক্ষার চাপ, সহপাঠীদের সঙ্গে তুলনা—সবই তার জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করছিল। সে বুঝতে পারল, পড়াশোনার জগৎ এক ধরনের গতি, যেখানে থেমে থাকা যায় না। গ্রামের মেলার রাতের প্রতিশ্রুতি, নদীর ধারে বসে চোখের দেখা—সবকিছু এখন মনে পড়লেও তার দৈনন্দিন ব্যস্ততার ছায়ায় ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে আসছিল। কখনও মেঘলার লেখা চিঠি পাওয়া মানেই হৃদয় একটু জেগে উঠত, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে বোঝত—এই শহরের জটিলতা, সময়ের সীমাবদ্ধতা এবং নতুন সম্পর্কগুলো তাকে আরেকভাবে ব্যস্ত করে রেখেছে। তাই ফোন কল, চিঠি, সংক্ষিপ্ত বার্তা—সবই এখন ছোট, কম্প্রাণবদ্ধ এবং হঠাৎ ফিকে হয়ে যাওয়া। তবু প্রতিশ্রুতির ছায়া, মেলার রাতের উজ্জ্বল আলো এবং নদীর নীরব ধ্বনি হৃদয়ে আরও গভীরে প্রোথিত। আর্য বুঝতে পারছিল, কষ্ট হলেও এই দূরত্ব তাকে মেঘলার প্রতি আরও অনুভূতিশীল করে তুলছে, আর সেই স্মৃতি তাকে কখনোই ছেড়ে যাবে না।

সময় যেমন বদলেছে, মেঘলা আর আর্যের মধ্যেকার সম্পর্কও বদলেছে। গ্রামীণ সাদাসিধে বন্ধুত্বটা এখন শহরের বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে বাধ্য। তারা দুজনই বড় হচ্ছে, নতুন দায়িত্ব গ্রহণ করছে, কিন্তু মনের গভীরে সেই প্রতিশ্রুতির চিহ্ন যেন অক্ষয়। মেঘলা এখন বুঝতে পারছে, জীবনের বড় স্বপ্নগুলো অর্জন করতে গেলে অবশ্যই পথিকের মতো ধীরে ধীরে চলতে হবে, আর্যও অনুভব করছে, প্রতিদ্বন্দ্বিতার চাপের মধ্যে বন্ধুত্ব ও ভালোবাসাকে টিকিয়ে রাখা এক অদৃশ্য যুদ্ধ। শহরের কোলাহল, ব্যস্ততা, নতুন মানুষদের ভিড়—সবকিছু তাদের কাছে এক ধরনের পরীক্ষা, যা তাদের সম্পর্ককে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরও দৃঢ় বা দুর্বল করতে পারে। কিন্তু মনের ভিতরে তারা জানে, মেলার রাতের ফানুস, নদীর ধারের নীরবতা, একে অপরের হাতে ধরার সেই দৃঢ় হাত—এই সবকিছু চিরকাল তাদের জীবনে আলোর মতো জ্বলছে। শহর যতই বড় হোক, সময় যতই ব্যস্ত হোক, এই প্রতিশ্রুতির ছায়া তাদের দুই হৃদয়কে মধুরভাবে বাঁধে রেখেছে, যেন তারা একদিন আবার সেই সরল গ্রামের রঙিন রাতগুলোতে ফিরে যেতে পারবে, যেখানে শৈশবের বন্ধুত্ব জীবনের প্রথম সত্যিকারের শিক্ষা হয়ে গিয়েছিল।

অনেক বছর পর, মেঘলার জীবনে এক অপ্রত্যাশিত সুযোগ আসে—গ্রামে ফিরে যাওয়ার। শহরের ব্যস্ততা, ক্লাস, পরীক্ষার চাপ আর প্রতিযোগিতার দৌড়ের মধ্যেই এই সুযোগ যেন এক প্রিয় বন্ধুর হঠাৎ ডাক। ট্রেনের জানলার বাইরে দিয়ে ভেসে আসা পরিচিত সব দৃশ্য—হলুদ সূর্যের আলো, কাঁচা রাস্তা, ধুলোমাখা পথ—তার মনকে অদ্ভুতভাবে উচ্ছ্বাসিত করে তোলে। গ্রামের চেনা ঘরগুলো এখন অনেকটা বদলে গেছে; পাকা রাস্তা, আধুনিক দোকান, নতুন বাড়ি, এবং অনেকেই স্মৃতির মতো ছোট বেলা থেকে বড় হয়ে এসেছে। মেঘলা যখন সেই রাস্তা পেরিয়ে নদীর ঘাটের দিকে এগোয়, মনে হয় যেন প্রতিটি ধাপ তার অতীতকে জাগিয়ে তুলছে। শহরের পরিশীলিত জীবন, ব্যস্ততা, প্রতিযোগিতা—সবকিছু এই মুহূর্তে যেন অদৃশ্য হয়ে গেছে। নদীর পাশে পৌঁছতেই সে দেখল আর্যও এসে দাঁড়িয়েছে, চেনা পোশাকের বদলে একটু বড়, কিন্তু চোখের সেই পরিচিত উজ্জ্বলতা যেন আগের মতোই রয়ে গেছে।

নদীর ঘাটে দু’জনের দেখা মুছে যাওয়া বছরের সব দুঃখ, দূরত্ব, ব্যস্ততা—সবই যেন ঝাপসা হয়ে যায়। চোখে চোখ পড়তেই হারানো সময় যেন ফিরে আসে; সেই মেলার রাতের ফানুস, গ্রামের ধুলোমাখা মাঠ, কাদামাটির খেলা—সব স্মৃতি মুহূর্তের মধ্যে জীবন্ত হয়ে ওঠে। তারা একে অপরের দিকে তাকিয়ে থাকে, যেন প্রথমবার দেখা হচ্ছে আবার, কিন্তু একই সঙ্গে সেই পরিচিত আত্মীয়তার স্নিগ্ধতা বজায় থাকে। আর্য বলত না কিছু, শুধু মেঘলার হাতে হাত রাখল, আর মেঘলাও ধীরে ধীরে তার হাত শক্ত করে ধরল। চারপাশের পরিবর্তন, নতুন বাড়ি, আধুনিকতার ছোঁয়া—সবকিছু মুছে গেছে চোখের সামনে, শুধু তাদের দুইজনের মধ্যে সেই চিরন্তন বন্ধুত্ব এবং প্রতিশ্রুতির ছায়া রয়ে গেছে। নদীর জল এখন একটু আধুনিক ব্রিজের নিচ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে, কিন্তু তার প্রতিফলন আগের মতোই কোমল, আগের মতোই শান্ত। তারা দু’জন একসাথে বসে নদীর ধারে, কোনো শব্দ ছাড়া, শুধু চোখের যোগাযোগে হারানো বছরের সমস্ত অনুভূতি ভাগাভাগি করছে।

এই আকস্মিক সাক্ষাৎ যেন একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা। শহরের কঠোর বাস্তবতা, সময়ের চাপ, দীর্ঘ বছর ধরে জমে থাকা ফিকে হওয়া চিঠি আর ফোন কল—সব কিছু এখানে অদৃশ্য হয়ে গেছে। শুধু সেই শৈশবের বন্ধুত্ব, মেলার রাতের প্রতিশ্রুতি, নদীর ধারের নীরবতা—এই সবকিছু তাদের দু’জনকে আবার একত্রিত করেছে। তাদের মনে গভীরভাবে অনুভূত হয়, সময় যতই ফাঁকি দিল, দূরত্ব যতই দীর্ঘ হল, সত্যিকারের বন্ধুত্ব এবং হৃদয়ের প্রতিশ্রুতি কখনও মুছে যায় না। এই হঠাৎ ফিরে দেখা শুধু অতীতকে জীবন্ত করছে না, বরং নতুনভাবে তাদের সম্পর্ককে শক্তিশালী করছে, যেন তারা জানে—যত বছরই কাটুক, শহরের ব্যস্ততা যতই ঢুকে পড়ুক জীবনে, এই বন্ধুত্ব, এই প্রতিশ্রুতি চিরকাল তাদের দু’জনকে একসাথে রাখবে। নদীর জল, বাতাস, পরিবর্তিত গ্রামের দৃশ্য—সবকিছু মিলিয়ে এই মুহূর্তকে করে তুলেছে এক স্মৃতিময় এবং অনন্তকালীন সংযোগের সাক্ষী, যা তাদের জীবনের পরবর্তী পথে আলোর মতো জ্বলবে।

নদীর ধারে হঠাৎ মিলনের পর মেঘলা আর আর্যের মধ্যে শৈশবের বন্ধুত্ব আবার জীবন্ত হয়ে ওঠে। চোখে চোখ পড়লেই মনে হয়, সেই মেলার রাতের প্রতিশ্রুতি আবার ফিরে এসেছে—হৃদয়টা কেঁপে ওঠে, মধুর আবেগে ভরে যায়। কিন্তু দ্রুতই তারা উপলব্ধি করে, সময় শুধু তাদের দৈহিক অবস্থান নয়, মনোভাব, দায়িত্ব আর সম্পর্ককেও বদলে দিয়েছে। মেঘলা এখন শহরের কলেজ, নতুন বন্ধু, বিভিন্ন অভিজ্ঞতা এবং উচ্চশিক্ষার দায়িত্বে আবদ্ধ। আর্যও শহরের প্রতিযোগিতা, পারিবারিক দায়িত্ব, এবং নিজের পেশাগত ভবিষ্যৎ নিয়ে ব্যস্ত। তারা দুজনেই বুঝতে পারছে যে শৈশবের নির্দোষ বন্ধুত্ব আর প্রথম ভালোবাসার স্বপ্ন আর সহজভাবে বজায় রাখা সম্ভব নয়। চোখের যোগাযোগে যে আনন্দ এবং হৃদয়ের উত্তেজনা আছে, তার মধ্যে একটি অদ্ভুত দ্বিধা ও অনিশ্চয়তা জড়িয়ে আছে—যেমন তারা একে অপরের কাছে আকৃষ্ট কিন্তু বাস্তবতার প্রাচীর তাদের ধীরে ধীরে আলাদা রাখছে।

মেঘলার বাবা-মার দিক থেকেও চাপ আসতে শুরু করেছে। বাবা মেঘলার ভবিষ্যতের কথা ভাবছেন, এমনকি অন্য সম্পর্ক বা সামাজিক নিরাপত্তার দিকে মন দিতে চাইছেন, যাতে মেঘলার জীবন স্থিতিশীল হয়। মেঘলা যতই আবেগপ্রবণ হোক, তিনি বুঝতে পারছেন যে বাবা-মায়ের চিন্তাও তার জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আর্যও নিজের দায়িত্ব নিয়ে চাপ অনুভব করছে; পরিবারের অবস্থা, পেশার নিরাপত্তা, এবং শহরের প্রতিযোগিতার দুনিয়া—সবকিছু তাকে আবদ্ধ করছে। দু’জনের মধ্যে যে সরলতা ছিল, সেই সরলতা এখন শিথিল হয়ে এসেছে বাস্তবতার চাপের কারণে। তারা একে অপরকে কাছে চাইছে, তবু অনুভব করছে—যদি অতি আবেগপ্রবণভাবে সম্পর্ককে এগোয়ান, তাহলে হয়তো কেউ কষ্ট পাবে। এই দ্বিধার মধ্যেই জন্ম নিচ্ছে নতুন ধরনের টানাপোড়েন—হৃদয় ও বাস্তবতার মধ্যে, আবেগ ও দায়িত্বের মধ্যে।

তবুও, মনের গভীরে প্রতিশ্রুতির ছায়া তাদের টেনে ধরে রাখছে। প্রতিটি আলোড়িত মুহূর্ত, ছোট্ট চোখের দেখা, হাসি—সবকিছু আগের স্মৃতির সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। নদীর ধারে বসে, তারা দুজন অনেকক্ষণ চুপচাপ একে অপরকে দেখে, মনে মনে সেই পুরনো শপথগুলো মনে করিয়ে নিচ্ছে—যে প্রতিশ্রুতি তারা একে অপরকে দিয়েছিল, যে বন্ধুত্ব জন্মেছিল শৈশবে। প্রতিটি হৃদস্পন্দন মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, সময় বদলেছে, কিন্তু আবেগ এখনও অটুট। দ্বিধা ও টানাপোড়েনের মাঝেও তারা বুঝতে পারছে, এই সম্পর্ক শুধু অতীত নয়, এটি তাদের জীবনের অংশ, যা যতই কঠিন হোক, যতই বাস্তবতার বাধা থাকুক, কখনো মুছে যাবে না। শহরের আলো, গ্রামের নদী, পরিবর্তিত সমাজ—সবকিছু মিলিয়ে এই দ্বিধা এবং টানাপোড়েনকে এক ধরনের সৌন্দর্য দিচ্ছে, যা তাদের সম্পর্ককে আরও গভীর ও জটিল করে তুলেছে, এবং সেই গভীরতা তাদের ভবিষ্যতের পথে নতুন আলো জ্বালাতে প্রস্তুত।

গ্রামে ফিরে আসার পর, মেঘলা আর আর্য দু’জনেই অনুভব করল যে পরিবর্তিত সময় শুধু তাদের মধ্যে নয়, চারপাশের পরিবেশেও প্রতিফলিত হচ্ছে। গ্রামের মানুষ—যারা একসময় তাদের শৈশবের খেলা, মেলার রাত, নদীর ধারের গল্প দেখেছে—এখন ফিসফিস করে নানা কথা বলতে শুরু করল। দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে কেউ বলল, “মেঘলা আর আর্য আবার একসাথে বেশি দেখা যাচ্ছে,” কেউ বলল, “দেখো, তারা যেন আগে যেমন ছিল, আর নেই।” এই কথাগুলো তাদের কানে এসে পৌঁছলে প্রথমে দু’জনেই হেসেছিল, মনে হয়েছিল, হয়তো গ্রামের মানুষ শুধু আগ্রহী। কিন্তু সময়ের সঙ্গে এই কৌতূহল এবং আত্মীয়স্বজনের নজর তাদের ভেতরে একটা অদ্ভুত চাপ তৈরি করতে লাগল। তারা বুঝতে পারল, শুধুমাত্র নিজেদের আবেগ আর বন্ধুত্ব নয়, সমাজের দৃষ্টি, গ্রামীণ নিয়মনীতি, এবং পারিবারিক প্রত্যাশাও তাদের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করছে।

সামাজিক চাপ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মেঘলা আর আর্যের মধ্যেকার দ্বিধাও আরও গভীর হয়ে উঠল। তারা একে অপরকে কাছে টানতে চায়, তবু জানে, যদি খুব প্রকাশ্যভাবে মিলন ঘটায়, তা গ্রামীণ সমাজের চোখে ভিন্নভাবে দেখা হবে। আত্মীয়স্বজন, পরিচিত বন্ধু, এমনকি অনাকাঙ্ক্ষিত মন্তব্যগুলোও তাদের আবেগকে পরীক্ষা করছে। মেঘলা ভাবতে লাগল, “আমাদের শৈশবের সহজ অনুভূতি কি বাস্তবতার জটিলতার মধ্যে হারিয়ে যাবে?” আর্যও নিজেকে প্রশ্ন করতে লাগল—বন্ধুত্ব আর ভালোবাসার সীমারেখা কোথায়? শহরের জীবনের শিক্ষা, পারিবারিক দায়িত্ব, এবং গ্রামীণ মানসিকতার চাপ—সব মিলিয়ে তারা এক অদৃশ্য সীমানার মধ্যে দাঁড়িয়ে। চোখে চোখ পড়লেই হৃদয় কেঁপে যায়, তবু তারা বুঝতে পারল, এখন তাদের আবেগ শুধুই তাদের নিজেদের নয়; এটি এখন সামাজিক এবং পারিবারিক নিয়মের চাপে আবদ্ধ।

এই সংকটের মধ্যেই, মেঘলা আর আর্য ধীরে ধীরে শিখছে এক নতুন ধরণের সম্পর্ক—যেখানে আবেগ এবং বাস্তবতার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করতে হয়। তারা বুঝতে পারছে, বন্ধুত্ব আর প্রেমের সীমানা কখনও সহজে চিহ্নিত করা যায় না; দু’টি অনুভূতি একে অপরের মধ্যে ঢুকে সময় এবং সমাজের সীমাবদ্ধতায় নিজেকে খাপ খাইয়ে নেয়। নদীর ধারে বসে তারা চুপচাপ একে অপরকে দেখছে, শৈশবের স্মৃতি মনে করছে, কিন্তু গ্রামবাসীর ফিসফিস শব্দ যেন তাদের ভেতরের দ্বিধা আরও বাড়াচ্ছে। তবু, এই সব চাপ এবং সামাজিক নজরের মাঝেও, তাদের অন্তর জানে—যে সম্পর্ক সত্যি, তা কখনও মুছে যায় না। তারা একে অপরের হাতে হাত রাখল, চোখে চোখ রাখল, আর চুপচাপ সেই অনুভূতিকে শক্তিশালী করল, যা যতই সামাজিক বাধা, সময়ের পরিবর্তন বা পরিবারের প্রত্যাশা হোক না কেন, তাদের একসাথে রাখবে। গ্রামীণ মানুষের কণ্ঠস্বর, তাদের বিশ্লেষণ এবং চাপ—সবকিছু মিলিয়ে এই অধ্যায় তাদের আবেগের জটিলতা এবং সম্পর্কের গভীরতা আরও দৃঢ় করে।

বর্ষার সন্ধ্যা, যখন আকাশে ধূসর মেঘ জমে গেছে এবং হালকা বৃষ্টির ফোঁটা ভেজা ঘাসে পড়ছে, মেঘলা আর আর্য মাঠের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকে। চারপাশে গ্রামটি নীরব, শুধুই দূরের গাছের পাতা ও নদীর জলের হালকা শব্দ ভেসে আসছে। শহরের ব্যস্ততা, দূরত্ব, সামাজিক প্রত্যাশা—সবকিছু যেন অদৃশ্য হয়ে গেছে, শুধু তারা দু’জনের উপস্থিতি বাকি। মেঘলার চুল ভেজা, চোখে অদ্ভুত উজ্জ্বলতা, আর্যের দৃষ্টিতে সে যেন শৈশবের সেই মেঘলা, নদীর ধারের ফানুসের আলোয় ভাসমান। তারা চুপচাপ একে অপরের দিকে তাকিয়ে আছে, দীর্ঘদিন ধরে যে আবেগ ভিতরে চাপা ছিল, যে ভালোবাসা প্রকাশের জন্য সময়ের জন্য অপেক্ষা করছিল—এবার সব উথলে উঠছে। বৃষ্টির হালকা ফোঁটায় তাদের হৃদয় যেন মিলিত হচ্ছে, সেই মেলার রাতের প্রতিশ্রুতির স্মৃতি নতুন শক্তি পেয়েছে।

আবেগের বোঝা এতদিন চেপে থাকার কারণে দুইজনের চোখে জল জমেছে। আর্য মৃদু হেসে বলল, “মেঘলা, এই সব বছর—যত দূরত্ব, সময় আর বাধা এসেছিল—আমাদের অনুভূতি একটিও কমেনি।” মেঘলাও কাঁপতে কাঁপতে জবাব দিল, “আমিও আর্য, যতদূরই যাক, যতদিনই আলাদা থাকি, আমি সবসময় তোমার সঙ্গে আছি।” তারা দু’জন হাত ধরে একে অপরের হাতে শক্তভাবে আঁকড়ে ধরল, যেন শব্দের চেয়ে শক্তিশালী তাদের স্পর্শই যথেষ্ট। নদীর ধারে দাঁড়িয়ে, মাঠের ভেজা ঘাসে পা ডুবিয়ে, তারা একে অপরের চোখে নিজের ছায়া খুঁজে পেল। শৈশবের আনন্দ, মেলার রাতের ফানুস, শহরের দূরত্বের চাপ—সব কিছু মিলিয়ে এই মুহূর্তকে আরো গভীর এবং স্মৃতিময় করে তুলেছে। তাদের আবেগ শুধু ভালোবাসা নয়, বরং জীবনের সমস্ত সময় ও অভিজ্ঞতার প্রতিফলন, যা তাদের সম্পর্ককে এক নতুন স্তরে নিয়ে গেছে।

শেষে, বর্ষার হালকা ঝরনা, ঘাসের ভেজা স্পর্শ, নদীর ধারের শান্ত প্রতিধ্বনি—সব মিলিয়ে তাদের সত্যিকারের অনুভূতি প্রকাশের জন্য নিখুঁত পরিবেশ তৈরি করেছে। তারা দু’জন চুপচাপ একে অপরের সাথে দাঁড়িয়ে থাকে, কিন্তু এই নীরবতা তাদের আবেগের বহিঃপ্রকাশ। শব্দের চেয়ে বেশি, হৃদয়ের স্পন্দনই এখন তাদের ভাষা। প্রতিটি স্পর্শ, প্রতিটি দৃষ্টিবিনিময় তাদের শৈশবের প্রতিশ্রুতি, মধ্যযুগের দূরত্ব, শহরের ব্যস্ততা—সবকে অতিক্রম করে সরাসরি হৃদয়ে পৌঁছে যায়। এই বর্ষার সন্ধ্যা তাদের সম্পর্ককে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করেছে—বন্ধুত্ব, ভালোবাসা, প্রতিশ্রুতি সব মিলিয়ে চিরন্তন হয়ে উঠেছে। মাঠের ভেজা ঘাসে দাঁড়িয়ে, চোখে চোখ রেখে, তারা বুঝতে পারল—যত সময়ই কেটে যাক, যত বাধাই আসুক, সত্যিকারের অনুভূতি কখনো মুছে যায় না, বরং আরও শক্তিশালী হয়ে জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ে আলোর মতো জ্বলতে থাকে।

মেঘলা আর আর্য যতই একে অপরের অনুভূতির কাছে কাছে আসছিল, ততই পরিবারিক বাস্তবতার চাপ বেড়ে যেতে থাকে। মেঘলার বাবা-মা তাদের মেয়ের স্বপ্ন, ভবিষ্যৎ এবং সামাজিক নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত। একদিন বসে তারা মেঘলার সঙ্গে কঠোরভাবে বললেন, “বন্ধুত্ব আলাদা, কিন্তু বিয়ে আলাদা ব্যাপার। তুমি শুধু আবেগের ছায়ায় জীবনটি ঝুঁকিতে ফেলতে পারো না।” মেঘলার মন এই কথায় ভাঙতে চাইলেও সে জানত, বাবা-মায়ের অভিপ্রায় সৎ—তারা মেঘলার জন্য সঠিক জীবন চাইছে। অন্যদিকে, আর্যও বুঝতে পারল তার পরিবার—যারাও তার ভবিষ্যতের নিরাপত্তা এবং সামাজিক অবস্থানের প্রতি যত্নশীল—এখন তাকে চিন্তাভাবনার মধ্য দিয়ে যাচাই করতে চাইছে। এই চাপ দু’জনের মধ্যকার আবেগকে পরীক্ষার মতো করল। তারা দুজনেই জানল, শুধু চোখের ভালোবাসা আর শৈশবের প্রতিশ্রুতি দিয়ে নয়, বরং জীবনের বাস্তবতা এবং দায়িত্বের সঙ্গে মিলিয়ে প্রমাণ করতে হবে যে তাদের ভালোবাসা স্থায়ী।

পরিবারের প্রতিক্রিয়ায় তারা দুজন ধীরে ধীরে বুঝতে লাগল, ভালোবাসা কেবল আবেগ নয়; এটি নিখুঁত বোঝাপড়া, সহনশীলতা এবং বাস্তব জীবনের দায়িত্ব বহন করার ক্ষমতাও দাবি করে। মেঘলা আর আর্য একে অপরের চোখে চোখ রাখল, মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল—তাদের সম্পর্ক শুধু আবেগের খেলনা নয়, বরং জীবনভর মধুর বন্ধন। আর্য শহরের ব্যস্ততা এবং পারিবারিক চাপের মধ্যেও মেঘলার পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিল, আর মেঘলাও জানল, তার জন্য সবচেয়ে বড় পরীক্ষা হলো পরিবার এবং সমাজের চাপে নিজেকে স্থির রাখা। দু’জনেই বুঝতে পারল, তাদের সম্পর্ককে শক্তিশালী করতে হবে, যেন পারিবারিক দ্বিধা, সামাজিক মানসিকতা, সময়ের দূরত্ব—সব কিছু অতিক্রম করতে পারে। এই পর্যায়ে দেখা গেল, প্রেম কেবল হৃদয়ের আবেগ নয়, বরং একটি নীরব যুদ্ধ—যেখানে তারা নিজেদের বিশ্বাস, ধৈর্য এবং জীবনের সিদ্ধান্তকে প্রমাণ করতে হয়।

নদীর ধারের সেই নীরবতা, মাঠের ভেজা ঘাস, বর্ষার ফোঁটা—সব কিছু এখনও তাদের স্মৃতির সঙ্গে জড়িয়ে আছে। কিন্তু এখন সেই স্মৃতি শুধু আবেগ নয়, বাস্তব জীবনের দায়িত্বের সঙ্গে মিলিত হয়েছে। পরিবার এবং সামাজিক মানসিকতার বাধা তারা বুঝতে পারছে, এবং এই বাধার মধ্যেও তারা একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধা, বোঝাপড়া এবং ভালোবাসা বজায় রাখার চেষ্টা করছে। তারা প্রতিটি কথোপকথনে, প্রতিটি চেষ্টায় প্রমাণ করছে যে তাদের ভালোবাসা কেবল আবেগ নয়; এটি তাদের জীবনের প্রতিশ্রুতি, যা সময়, পরীক্ষা এবং দ্বিধার মধ্যেও টিকে থাকবে। এই অধ্যায়ে পারিবারিক সংঘাতের মধ্য দিয়ে, মেঘলা আর আর্য শিখছে—বাস্তবতা এবং আবেগের সমন্বয় ছাড়া সত্যিকারের ভালোবাসা স্থায়ী হয় না। পরিবার, সমাজ এবং সময়ের চাপ—সব মিলিয়ে তাদের সম্পর্ককে আরও পরিপক্ক ও দৃঢ় করে তুলছে, যেন তারা জানে, কঠিন পরীক্ষা পেরিয়েও সত্যিকারের অনুভূতি জ্বলতে থাকে।

১০

মেঘলা আর আর্যের দীর্ঘ লড়াই, দ্বিধা এবং পারিবারিক সংঘাতের পর অবশেষে পরিবারও তাদের সম্পর্ককে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হলো। মেঘলার বাবা-মা বুঝতে পারলেন, তাদের মেয়ের আবেগ কেবল এক অস্থায়ী রোমাঞ্চ নয়, বরং বাস্তব জীবনের দায়িত্ব এবং ধৈর্যের সঙ্গে মিলিত সত্যিকারের ভালোবাসা। আর্যের পরিবারও স্বীকার করল, ছেলের সিদ্ধান্ত এবং চেতনা শক্তিশালী; সে যে মেঘলার পাশে দাঁড়াচ্ছে, তা শুধু আবেগের কারণে নয়, বরং জীবনের প্রতিশ্রুতির কারণে। এই স্বীকৃতি তাদের হৃদয়ে এক নতুন আনন্দ এবং প্রশান্তি নিয়ে আসে। নদীর ধারে দাঁড়িয়ে, মাঠের ভেজা ঘাসে পা রেখে তারা অনুভব করে—যতদিনই সময় কেটে গেছে, যত বাধাই এসেছে, প্রকৃত ভালোবাসা সব বাধা অতিক্রম করতে পারে। এখন তাদের সম্পর্ক শুধু দুই হৃদয়ের মিলন নয়; এটি পরিবার এবং সমাজের স্বীকৃতিও লাভ করেছে, যা তাদের প্রেমকে আরও শক্তিশালী করে।

মেলার আকাশে আবার রঙিন ফানুস উড়ছে, কিন্তু এবার সেই আলো তাদের শৈশবের স্মৃতি নয়, বরং জীবনের সত্যিকারের প্রতিশ্রুতির প্রতীক। তারা একে অপরের দিকে তাকায়, চোখে চোখ রেখে অনুভব করে—শৈশবের প্রতিশ্রুতি, দীর্ঘ বছর ধরে ধরা আবেগ, পারিবারিক দ্বিধা এবং সামাজিক চাপ সব মিলিয়ে এখন একটি জীবন্ত সম্পর্কের রূপ নিয়েছে। নদীর ধারের নীরবতা, মাঠের ভেজা ঘাস, বর্ষার হালকা ফোঁটা—সবকিছু যেন এই মুহূর্তকে চিরস্থায়ী করে রাখছে। তারা জানে, প্রতিশ্রুতি কেবল আকাশে ভেসে যাওয়ার জন্য নয়, বরং মাটিতে শেকড় গাড়ার জন্যও। এই উপলব্ধি তাদের সম্পর্ককে গভীর করে, আবেগের সাথে বাস্তবতার সংমিশ্রণ এনে দেয়। শহরের ব্যস্ততা, দূরত্ব, সামাজিক বাধা—সব কিছু অতিক্রম করে, তারা দু’জন একে অপরের কাছে এক নতুনভাবে শক্তিশালী হয়।

শেষে, মেঘলা আর আর্য প্রমাণ করে যে প্রতিশ্রুতি শুধু রূপক নয়; এটি জীবনের অংশ হতে পারে। তারা জানে, মেলার উড়ন্ত ফানুসের মতো সময়ের সঙ্গে আবেগও উড়ে যেতে পারে, কিন্তু স্থির ইচ্ছা, ধৈর্য এবং বোঝাপড়ার মাধ্যমে সেই প্রতিশ্রুতি মাটিতে শেকড় গাড়তে পারে। পরিবার, বন্ধু, সমাজ—সবকিছু মিলিয়ে এই মুহূর্তকে আরও মূল্যবান করেছে। তারা দু’জন একে অপরের হাতে হাত রেখে, চোখে চোখ রেখে, শপথ নেয়—যে সম্পর্ক তারা ধরে রেখেছে, তা শুধু আবেগ নয়, জীবনভর প্রতিশ্রুতি। বর্ষার হালকা ফোঁটা, নদীর ধারের নীরবতা, গ্রামীণ পরিবেশ—সব মিলিয়ে তাদের প্রেমের গল্পকে এক চিরন্তন অধ্যায়ে পরিণত করেছে। এভাবে মেঘলা আর আর্য প্রমাণ করল, প্রতিশ্রুতি কেবল আকাশের জন্য নয়, বাস্তব জীবনের মাটিতেও তার শেকড় গভীরভাবে স্থাপন করা যায়, এবং সত্যিকারের ভালোবাসা সব বাধা অতিক্রম করতে সক্ষম।

-শেষ-

 

1000070564.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *