দেবব্ৰত মণ্ডল
১
গ্রামের প্রাচীন মন্দিরটির অবস্থান যেন সময়ের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। জনবসতি থেকে খানিকটা দূরে, গা ছমছমে বটগাছের ছায়ায় ঢাকা পড়া এই মন্দিরের অস্তিত্ব আজও গ্রামের মানুষের কৌতূহল আর ভয়ের কেন্দ্রবিন্দু। শতবর্ষ আগে নির্মিত হয়েছিল এই দেবালয়—পাথরের খোদাই, দেয়ালে পুরনো লিপি আর ভাঙাচোরা অলঙ্করণ এখনো ম্লান হয়ে গেলেও স্পষ্ট করে বলে দেয় তার গৌরবময় অতীতের কথা। অথচ আশ্চর্যজনকভাবে মন্দিরের মূল দ্বার, যেটি লাল রঙের বিশাল কাঠের কপাট দিয়ে বন্ধ, কখনোই খোলা হয়নি গ্রামবাসীর চোখের সামনে। গ্রামের বয়োজ্যেষ্ঠরা বলেন, সেই লাল কপাট শত বছর আগে হঠাৎ একদিন বন্ধ হয়ে যায়, তারপর থেকে কেউ আর সাহস করেনি তা খোলার। বলা হয়, শেষ যে পুরোহিত কপাট খোলার চেষ্টা করেছিলেন, তিনি আর ফিরে আসেননি। কেউ বলে, তিনি অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিলেন, কেউ বলে ভেতরে থেকে ভেসে এসেছিল এমন চিৎকার, যা শুনে গ্রামের মানুষ রাতভর আতঙ্কে কাটিয়েছিল। সেই থেকেই মন্দিরের চারপাশ নিষিদ্ধ, এবং লাল কপাটের সামনে দাঁড়ানো মানেই সর্বনাশ ডেকে আনা। অজস্র গল্প জন্ম নিয়েছে এই মন্দির ঘিরে—কেউ বলে অভিশাপ, কেউ বলে ভয়ঙ্কর আত্মার আবাস, আবার কেউ দাবি করে দেবতার ক্রোধের ফল এটি।
দিনের আলোয় মন্দিরের চারপাশ দেখতে হয়তো নিস্পাপ, কিন্তু সূর্য অস্ত যাওয়ার পর ওখানকার পরিবেশ পাল্টে যায় সম্পূর্ণ। মন্দিরের পাশ দিয়ে গেলেই হঠাৎ বাতাস ভারী হয়ে ওঠে, জ্যোৎস্না রাতে কপাটের লাল রঙ যেন আরও তীব্র হয়ে ওঠে, আর বাতাসে মিশে থাকে অদ্ভুত এক সোঁদা গন্ধ। গবাদি পশুরা পর্যন্ত কাছাকাছি যেতে ভয় পায়, কুকুরেরা মন্দির ঘেঁষে ঘেউ ঘেউ করে উঠলেও ভিতরে পা রাখে না। গ্রামবাসীর শিশুদের জন্ম থেকেই সতর্ক করে দেওয়া হয়—“মন্দিরের পথে যেও না, লাল কপাটে হাত দিও না।” এরকম নিষেধাজ্ঞা এতটাই দৃঢ় হয়ে গেছে যে, প্রজন্মের পর প্রজন্ম মেনে চলেছে। গ্রামের উৎসব, পূজা, বিয়ে কিংবা শোক—কোনো সামাজিক আয়োজনেই মন্দিরটির প্রসঙ্গ উঠে এলে হঠাৎ নীরবতা নেমে আসে। কিছু সাহসী তরুণ একসময় অন্ধকার রাতে গিয়েছিল সেখানে, কিন্তু ফিরে এসে তারা আর কিছু বলতে পারেনি—শুধু ফ্যাকাশে মুখ আর আতঙ্কিত চোখ। কেউ দাবি করে, তারা ভেতর থেকে করুণ সুর শুনেছিল, আবার কেউ বলে অদ্ভুত ছায়ারা দেয়ালের উপর দিয়ে নড়ছিল। এমন গল্পে সত্য-মিথ্যার সীমারেখা মুছে যায়, কিন্তু ভয় আরও গাঢ় হয়ে ওঠে।
তবুও গ্রামের মানুষের মনে এক অদৃশ্য টান লেগেই থাকে মন্দিরটির দিকে। অজানা জিনিসের প্রতি আকর্ষণ যেমন থাকে, তেমনি ভয়ও তার ছায়ার মতো লেগে থাকে। লাল কপাট যেন এক অদ্ভুত প্রতীক—গ্রামের অতীত, রহস্য, এবং অভিশাপের অদৃশ্য শিকল। অনেকে বলে, কপাটের ওপারে বন্দি আছে এক ভয়ঙ্কর আত্মা, যাকে মুক্তি দেওয়া মানে সমগ্র গ্রাম ধ্বংস। আবার কেউ বিশ্বাস করে, ভেতরে আছে এমন এক গোপন শক্তি, যা মানুষের লোভে গ্রাস হলে ভয়ঙ্কর বিপর্যয় ডেকে আনবে। সময়ের সাথে সাথে কাহিনি আরও জটিল হয়েছে, গল্পের ভাঁজে ভাঁজে যোগ হয়েছে নতুন ঘটনা, নতুন ব্যাখ্যা। তবুও সত্যটা কী, তা কেউ জানে না। গ্রামের প্রতিটি ঘরে রাতে যখন বাতি নিভে যায়, বাতাসে গুঞ্জন ওঠে মন্দিরের ছায়ার গল্পে। লাল কপাট যেন নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থেকে সবার দিকে তাকিয়ে থাকে, একদিন কেউ তার রহস্য উন্মোচন করবে—এমন এক অদৃশ্য প্রতিশ্রুতি বুকে নিয়ে। কিন্তু গ্রামবাসী জানে, যে দিন কপাট খুলবে, সেদিন হয়তো অন্ধকারই গ্রাস করবে তাদের পৃথিবীকে।
২
গ্রামের প্রবীণরা যখন বসে গল্প করেন, তখন তাঁদের চোখে মুখে ভেসে ওঠে এক অদ্ভুত ছায়া, যেন তাঁরা যা বলতে যাচ্ছেন তা কেবল গল্প নয়, বরং বুকে জমে থাকা এক নিষিদ্ধ স্মৃতি। লাল কপাটের রহস্যের পেছনে যে ইতিহাস লুকিয়ে আছে, তা শোনার পর থেকে গ্রামবাসীর মনে আতঙ্ক স্থায়ী হয়ে গেছে। বলা হয়, শতবর্ষ আগে এই মন্দির ছিল ভক্তি আর আচার-অনুষ্ঠানের কেন্দ্রস্থল। তখনকার পুরোহিতরা নিয়মিত পূজা দিতেন, আর গ্রামবাসীও ভক্তিভরে দেবতার সান্নিধ্য পেত। কিন্তু হঠাৎ একদিন ঘটে যায় এক ভয়ানক ঘটনা। এক ভ্রমণকারী সাধু, যিনি কালো পোশাকে সারা শরীর ঢেকে রাখতেন, তিনি মন্দিরে প্রবেশ করেন। প্রথমদিকে তাঁকে এক সাধারণ সন্ন্যাসী ভেবেছিল সবাই, কিন্তু খুব শিগগিরই প্রকাশ পায় তাঁর প্রকৃত উদ্দেশ্য। তিনি দেবতার আরাধনা করতে আসেননি, বরং এসেছিলেন এক অদ্ভুত মন্ত্র প্রয়োগ করতে—যা অশুভ শক্তিকে টেনে আনে। সেই সাধুর মুখ থেকে যে মন্ত্র উচ্চারিত হয়েছিল, তা শুনে উপস্থিত ভক্তরা আতঙ্কে ছড়িয়ে পড়েন, এবং বাতাসে এক অদ্ভুত শীতলতা ছড়িয়ে পড়ে। কথিত আছে, সেই রাতেই এক যুবতীর প্রাণহীন দেহ পাওয়া যায় মন্দিরের ভেতরে, তাঁর চোখ জ্বলছিল অস্বাভাবিক লাল আলোয়। গ্রামবাসী বুঝতে পারে, সাধুর মন্ত্রে এক ভয়ঙ্কর আত্মা মুক্তি পেয়েছে, যা মানব রক্তের তৃষ্ণায় ঘুরে বেড়াতে শুরু করেছে।
পরদিন গ্রামের সাহসী লোকেরা একত্র হয়ে মন্দিরে প্রবেশ করে। তারা দেখতে পায়, সাধুটি আর সেখানে নেই, কিন্তু ভেতরের পরিবেশ পাল্টে গেছে সম্পূর্ণ। পাথরের দেয়ালে কালো দাগ, ভাঙা প্রদীপ, আর মেঝেতে শুকনো রক্তের দাগ যেন ভেতরে ঘটে যাওয়া ভয়াবহতার সাক্ষ্য বহন করছে। প্রবীণরা বলেন, সেই আত্মা ছিল এক অভিশপ্ত সত্তা—এক নারী, যিনি বহু যুগ আগে অন্যায়ভাবে বলি দেওয়া হয়েছিল এই মন্দিরে। তাঁর আত্মা শান্তি পায়নি, বরং প্রতিশোধের আগুনে জ্বলতে থাকে। সাধুটি সেই প্রতিশোধস্পৃহী আত্মাকে মুক্ত করেছিল, হয়তো নিজের শক্তি অর্জনের জন্য, হয়তো গ্রাম ধ্বংস করার জন্য। গ্রামের পুরোহিতরা বুঝতে পারেন, এ শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ না করলে সর্বনাশ আসন্ন। বহু রাত্রি ধরে তাঁরা মন্ত্রপাঠ করেন, দেবতার আশীর্বাদ কামনা করেন, অবশেষে এক চূড়ান্ত যজ্ঞে তাঁরা আত্মাটিকে আবার বন্দি করতে সক্ষম হন। তবে তার বিনিময়ে দিতে হয়েছিল ভয়ঙ্কর মূল্য—গ্রামের কয়েকজন যুবক যজ্ঞকালে অদৃশ্য হয়ে যায়, আর প্রধান পুরোহিত প্রাণ হারান অগ্নিশিখার ভেতর। তখন থেকেই মন্দিরের মূল দ্বার লাল কপাট দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়, আর বলা হয়, কপাট একবার খোলা মানেই সেই অভিশপ্ত আত্মা আবার মুক্ত হবে। লাল রঙে রাঙানো কপাটের প্রতীক ছিল রক্তের—যত রক্ত ঝরেছে, যত প্রাণ বিসর্জন হয়েছে, সবকিছুর সাক্ষ্য বহন করে দাঁড়িয়ে থাকা এক নিঃশব্দ প্রাচীর।
প্রবীণরা এখনও বলেন, কপাটের ভেতর থেকে মাঝেমাঝেই শোনা যায় অদ্ভুত শব্দ—কান্নার মতো, আবার কখনো হাসির মতো। অন্ধকার রাতে যদি কেউ মন্দিরের খুব কাছে যায়, তবে শীতল বাতাসের সঙ্গে কানে ভেসে আসে নারীকণ্ঠের ফিসফিসানি, যেন ডেকে নিচ্ছে ভিতরে। এই কাহিনিগুলোকে কেউ কুসংস্কার বলে এড়িয়ে গেলেও গ্রামের মানুষের বিশ্বাসে এটাই হয়ে উঠেছে চরম সত্য। শিশুরা বড় হওয়ার আগেই শিখে যায়, ওই কপাট খোলা মানেই সর্বনাশ। তবুও ভেতরে কী আছে তা নিয়ে কৌতূহল কমেনি, বরং বছরের পর বছর তা আরও বেড়েছে। কেউ বলে, আত্মাটি মুক্ত হলে গ্রাম নিশ্চিহ্ন হবে, আবার কেউ বলে, আত্মাটির মুক্তিই গ্রামকে মুক্তি দেবে এক অদৃশ্য অভিশাপ থেকে। সত্যি-মিথ্যার এই টানাপোড়েনে কপাট ঘিরে রহস্য আরও ঘনীভূত হয়। তবে প্রবীণদের কণ্ঠে একটাই সতর্কতা—“যে দিন কপাট খোলা হবে, সেদিন আবার রক্ত ঝরবে।” এই নিষিদ্ধ কাহিনিই গ্রামবাসীর আতঙ্ক, আর লাল কপাটই তার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে শতবর্ষ ধরে।
৩
শহরের কোলাহল, যান্ত্রিক জীবন আর বইয়ের পাতায় সীমাবদ্ধ ইতিহাসের ভেতর ডুবে থাকা অর্ণবের মনে সবসময়ই এক অদম্য কৌতূহল কাজ করত। সে ছিল এক তরুণ প্রত্নতত্ত্ববিদ, গবেষণার প্রতি যার আকর্ষণ শুধু পেশাগত নয়, বরং আত্মার তৃষ্ণা। বই, প্রাচীন দলিল আর ভ্রমণকাহিনিতে বারবার চোখে পড়েছিল রহস্যময় সেই মন্দিরের নাম, যার কপাট শত বছর ধরে বন্ধ। প্রথমে বিষয়টিকে নিছক লোককথা ভেবেছিল, কিন্তু যত পড়তে থাকে ততই টের পায়, এখানে কিছু আছে যা কেবল কল্পকাহিনি নয়—এ যেন সত্যিই সময়ের গর্ভে চাপা পড়ে থাকা এক অমীমাংসিত রহস্য। পুরনো মানচিত্র, সরকারি রেকর্ড আর বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্কাইভ ঘেঁটে সে খুঁজে পায়, শতাব্দী আগে এই গ্রামকে কেন্দ্র করে এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছিল, কিন্তু তার লিখিত প্রমাণ খুব সামান্য। বাকিটা জুড়ে আছে ভয়, নীরবতা আর নিষিদ্ধতার পর্দা। অর্ণবের মন সেসব ফাঁকফোকর পূরণ করতে উদগ্রীব হয়ে ওঠে। ইতিহাস তার কাছে শুধু তথ্য নয়, বরং মানুষের জীবনের প্রতিচ্ছবি, এবং সেই প্রতিচ্ছবিতে যদি রহস্য মিশে যায় তবে তা খুঁজে বের করাই তার কাছে সত্যিকারের অভিযান। তাই অবশেষে এক বর্ষার ভোরে, ব্যাগ কাঁধে আর হাতে নোটবুক নিয়ে, অর্ণব যাত্রা করে সেই গ্রামের উদ্দেশে—যেখানে লাল কপাট দাঁড়িয়ে আছে শতবর্ষ ধরে, নিঃশব্দে প্রহর গুনছে।
গ্রামে পৌঁছে অর্ণব প্রথমেই টের পায় শহর আর গ্রামের মধ্যে ব্যবধান কত গভীর। কাঁচা রাস্তা, কাদা, মাটির ঘর আর নিস্তব্ধতার মধ্যে যেন সময় থমকে গেছে। গ্রামের প্রবেশদ্বারে দাঁড়িয়ে থাকা বটগাছ তার দৃষ্টি আটকে দেয়, আর চারপাশের পরিবেশে ছড়িয়ে থাকা এক অদ্ভুত শীতলতা তার শরীর কাঁপিয়ে তোলে। গ্রামের মানুষজন তাকে সন্দেহের চোখে দেখে, যেন বাইরের মানুষ মানেই সর্বনাশ ডেকে আনে। প্রথমে কেউ কথা বলতে চায় না, কিন্তু ধীরে ধীরে এক বৃদ্ধ তার কৌতূহলী মুখ দেখে এগিয়ে আসে। অর্ণব মৃদু হেসে পরিচয় দেয়—“আমি অর্ণব, প্রত্নতত্ত্ব নিয়ে গবেষণা করি। শুনেছি এখানে একটা প্রাচীন মন্দির আছে, তার ইতিহাস জানতে চাই।” বৃদ্ধের মুখের ভাঁজ হঠাৎ আরও গভীর হয়ে ওঠে। তিনি নিচু স্বরে বলেন, “মন্দির? ওখানে যাওয়ার কথা ভুলেও বোলো না। ওই কপাটের কাছে যাওয়া মানেই মৃত্যুকে ডেকে আনা।” অর্ণব অবাক হয়, কিন্তু তার কৌতূহল আরও বেড়ে যায়। গ্রামের চায়ের দোকানে বসে সে মানুষের কথা শোনে, কেউ ফিসফিস করে আত্মার গল্প বলে, কেউ আবার স্পষ্ট জানিয়ে দেয়—বাইরের মানুষ এলে সর্বনাশ অবধারিত। কিন্তু এই ভয় দেখানো কথাগুলো অর্ণবের ভেতরে আতঙ্ক নয়, বরং এক অদ্ভুত উত্তেজনা জাগায়। সে বুঝতে পারে, এই গ্রামে যা লুকানো আছে তা কেবল কল্পনা নয়, বরং ইতিহাসের অন্ধকার অধ্যায়।
রাত নামতেই অর্ণব বুঝতে পারে গ্রামের আসল রূপ। চারপাশ নিস্তব্ধ হয়ে যায়, শুধু মাঝে মাঝে শোনা যায় ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক বা হাওয়ার শব্দ। দূরে মন্দিরের ছায়া যেন কালো পাহাড়ের মতো দাঁড়িয়ে থাকে। চাঁদের আলোয় কপাটের লাল রঙ স্পষ্ট দেখা যায়, যেন অন্ধকারের বুক চিরে জ্বলে ওঠা আগুনের মতো। অর্ণব দাঁড়িয়ে দূর থেকে তাকিয়ে থাকে সেই দিকে, মনে হয় যেন তাকে ডাকছে। তার শিরায়-উপশিরায় কৌতূহল বয়ে যায়—যা নিষিদ্ধ, যা শত বছর ধরে বন্ধ, তার ভেতরে কী আছে? মানুষের ভয়, প্রজন্মের গল্প, নাকি সত্যিই এক অভিশপ্ত আত্মা? সে জানে, এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করতে পারলেই তার গবেষণা এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছবে। হয়তো প্রমাণ করতে পারবে, লোককথার আড়ালে ইতিহাস লুকিয়ে আছে। হয়তো খুঁজে পাবে এক বিস্মৃত কাহিনি, যা কেউ লিখে রাখতে পারেনি। কিন্তু একইসঙ্গে তার মনে হালকা কাঁপনও জাগে, কারণ প্রবীণদের সতর্ক কণ্ঠস্বর যেন রাতের বাতাসে ভেসে আসে—“কপাট একবার খুললেই সর্বনাশ।” তবুও অর্ণব জানে, তার যাত্রা শুরু হয়েছে, আর এখন আর ফেরার পথ নেই। গ্রাম, মন্দির আর লাল কপাট—সবকিছু মিলিয়ে তার জীবনের সবচেয়ে বড় অধ্যায় শুরু হতে চলেছে।
৪
অর্ণব গ্রামে আসার দ্বিতীয় রাতেই বুঝতে পারল, এখানকার অদ্ভুত পরিবেশকে কেবল কুসংস্কার বলে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। সূর্য ডোবার সঙ্গে সঙ্গেই গ্রাম যেন নিস্তব্ধতার আবরণে ঢেকে যায়। দিনের বেলা গ্রামের শিশুরা মাঠে খেলে, নারীরা নদী থেকে জল আনে, পুরুষেরা আড্ডা দেয়, কিন্তু রাত নামতেই সব কোলাহল মিলিয়ে যায়। মাটির ঘরের দরজা শক্ত করে বন্ধ হয়, জানালার ফাঁক গুলোতে কাপড় গুঁজে দেওয়া হয়, যেন বাইরের কিছু ভেতরে ঢুকে না পড়ে। সেই রাতে অর্ণব তার অস্থায়ী থাকার জায়গা থেকে বেরিয়ে পড়েছিল নোটবুক হাতে, কেবল নিজের চোখে মন্দিরকে দেখার জন্য। দূরে দাঁড়ানো সেই লাল কপাট চাঁদের আলোয় যেন আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল, আর চারপাশে নেমে আসা নিস্তব্ধতা তাকে অদ্ভুতভাবে আকৃষ্ট করছিল। কিন্তু যতই সে এগোতে থাকে, বাতাস তত ঠান্ডা হয়ে আসে। তার মনে হলো হঠাৎ যেন কারো উপস্থিতি অনুভব করছে, যদিও চারপাশ ফাঁকা। হাওয়ার শব্দের সঙ্গে মিলেমিশে কানে ভেসে আসছিল যেন ক্ষীণ ফিসফিসানি—কখনো নাম ধরে ডাকা, কখনো আবার অচেনা ভাষায় উচ্চারিত মন্ত্রের মতো কিছু।
অর্ণব থমকে দাঁড়াল। তার মেরুদণ্ড বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেলেও কৌতূহল ভয়কে পেছনে ঠেলে দিল। সে কান খাড়া করে শোনার চেষ্টা করল। ফিসফিসানির আওয়াজ স্পষ্ট হচ্ছিল—মাঝে মাঝে যেন নারীকণ্ঠে, আবার কখনো কর্কশ পুরুষস্বরের মতো। সে তাকাল মন্দিরের দিকে, লাল কপাট অচল অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু কপাটের ফাঁক দিয়ে যেন এক ঝলক নড়াচড়া চোখে পড়ল। তার মনে হলো, ভেতর থেকে কেউ তাকিয়ে আছে। বাতাসে ভেসে এল এক সোঁদা, আর্দ্র গন্ধ, যেন বহুদিনের অন্ধকারে বন্দি জায়গা থেকে বাতাস বেরিয়ে আসছে। হঠাৎই পাশের গাছগুলো একসঙ্গে কেঁপে উঠল, অথচ বাতাসের ঝাপটা কোথাও দেখা গেল না। অর্ণব মনে মনে নিজেকে শক্ত করে বলল—“এ সব ভ্রম, ভয় দেখানোর জন্য কল্পনা।” কিন্তু ঠিক তখনই স্পষ্টভাবে তার কানে এলো এক শব্দ—“অর্ণব…” সে চমকে উঠল। এই দূর গ্রামে যেখানে কেউ তার নাম জানার কথা নয়, সেখানে কে তাকে এভাবে ডাকছে?
পরদিন সকালে যখন সে গ্রামের চায়ের দোকানে বসে এই অভিজ্ঞতার কথা বলতে শুরু করল, চারপাশে এক অস্বস্তিকর নীরবতা নেমে এল। বৃদ্ধরা একে অপরের দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে দিল, আর এক মহিলা ফিসফিস করে বলল, “আমরা তো বলেছিলাম, ওখানে যেও না।” গ্রামের এক প্রবীণ ব্যক্তি কড়া গলায় বললেন, “ওসব আওয়াজ, ওসব ফিসফিসানি—সবই ওর ছল। তুমি যদি বারবার ওদিকে যাও, তবে একদিন ফিরে আসতে পারবে না।” অর্ণব হেসে কথাগুলো এড়িয়ে গেল। তার যুক্তিবাদী মন এসব কুসংস্কারে বিশ্বাস করল না, বরং ভেতরে ভেতরে সে আরও উৎসাহ পেল। যতই গ্রামবাসী সতর্ক করছিল, ততই তার কৌতূহল বেড়ে যাচ্ছিল। সে বুঝল, এই রহস্যকে উন্মোচন করতে হলে রাতের মন্দিরকেই তার পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র করতে হবে। ভয়, সতর্কতা, অভিশাপ—এসব শব্দ তার কাছে আর শুধুই ইতিহাস খোঁজার পথে প্রতিবন্ধক। কিন্তু সে জানত না, রাতের সেই ফিসফিসানি কেবল কল্পনার প্রতিধ্বনি নয়, বরং অন্ধকারের বুক থেকে ভেসে আসা এক নিষিদ্ধ ডাক, যা ধীরে ধীরে তাকে টেনে নিচ্ছিল এমন এক গহ্বরে, যেখান থেকে ফেরা সহজ নয়।
৫
অর্ণবের কৌতূহল রাতের ফিসফিসানির পর আরও তীব্র হয়ে উঠেছিল। গ্রামবাসীরা যতই তাকে দূরে থাকতে বলেছে, ততই সে কাছে যাওয়ার পথ খুঁজতে শুরু করেছে। একদিন দুপুরে, যখন চারপাশে সবাই মাঠে কাজে ব্যস্ত, অর্ণব একাই এগিয়ে গেল ভগ্নপ্রায় মন্দিরের দিকে। মন্দিরের দেয়াল ধসে পড়েছে অনেক জায়গায়, জায়গায় জায়গায় শ্যাওলা জমে পাথর কালচে হয়ে গেছে, কিন্তু তার দৃষ্টি আটকে গেল ভেতরের একটি কোণে। সেখানে খোদাই করা আছে অদ্ভুত কিছু চিহ্ন, যেগুলো প্রথমে সাধারণ অলংকরণ বলে মনে হলেও কাছ থেকে দেখতেই বোঝা গেল এগুলো কোনো লিপি। অর্ণব হাতে খাতায় নকশা আঁকল, আঙুল বোলাতে গিয়ে বুঝল এই লিপিগুলো খুবই প্রাচীন, হয়তো হাজার বছরেরও পুরনো। মসৃণ পাথরের ওপর খোদাই করা অক্ষরগুলো আধুনিক ভাষার সঙ্গে মেলে না, কিন্তু তার ভেতরে গবেষণার তাগিদ অর্ণবকে মনে করিয়ে দিল—এই ধরনের প্রতীক সে আগে বইয়ে পড়েছে, এগুলো তান্ত্রিক লিপি। সে হঠাৎ অনুভব করল, মন্দিরের দেয়াল কেবল ধর্মীয় প্রতীক বহন করছে না, বরং গোপন এক ইতিহাসকে ধরে রেখেছে। ঠিক সেই মুহূর্তেই তার মনে হলো, রাতের সেই ফিসফিসানি হয়তো এই লিপির সঙ্গেই কোনোভাবে জড়িয়ে আছে।
সে রাতেই অর্ণব তার টেবিলে বসে খাতায় কপি করা প্রতিটি প্রতীকের অর্থ খুঁজতে শুরু করল। প্রাচীন তান্ত্রিক সাধনার বই, বিশ্ববিদ্যালয়ের রেফারেন্স, আর নিজের স্মৃতির ভেতর থেকে টেনে আনল নানা তথ্য। অবশেষে কিছুটা মিল পেল। লিপিতে বর্ণিত আছে এক ভয়ঙ্কর তান্ত্রিকের কথা—যিনি বহু শতাব্দী আগে এই মন্দিরে আশ্রয় নিয়েছিলেন। বলা হয়, তিনি অশুভ শক্তির সাধক ছিলেন এবং মানুষের আত্মাকে নিজের শক্তি বাড়ানোর জন্য ব্যবহার করতেন। গ্রামবাসীরা প্রথমে তাকে মহাজ্ঞানী ভেবে শ্রদ্ধা করেছিল, কিন্তু খুব শিগগিরই বুঝতে পারে তিনি দেবতার উপাসক নন, বরং মৃত্যুর দেবতার পূজারি। তখন গ্রামের পুরোহিতরা একত্র হয়ে তাকে থামানোর চেষ্টা করে, এবং এক মহাযজ্ঞের মাধ্যমে তাকে বন্দি করতে সক্ষম হয়। সেই বন্দিত্বই আজকের লাল কপাটের উৎপত্তি। লিপিতে লেখা ছিল—“যে কপাট ভেদ করবে, সে মুক্তি দেবে মৃত্যুর সাধককে, আর রক্তে ভরবে এই ভূমি।” অর্ণবের গা শিউরে উঠল, কারণ রাতের সেই ডাকে সে যেন এখন স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে তান্ত্রিকের কণ্ঠস্বর—অদৃশ্য, অথচ উপস্থিত।
পরদিন গ্রামে খবর ছড়িয়ে পড়ল যে অর্ণব লিপি খুঁজে পেয়েছে। প্রবীণরা একে অশুভ লক্ষণ বলে ঘোষণা করল। তারা বলল, “যা চাপা পড়ে আছে, তা চাপা থাকাই ভালো। ওই লিপি পড়া মানেই সর্বনাশ ডেকে আনা।” কিন্তু অর্ণবকে থামানো গেল না। তার চোখে-মুখে এখন অন্য রকম আলো—ইতিহাস আবিষ্কারের উত্তেজনা আর অদ্ভুত এক নেশা। সে নিজেকে বোঝাল, হয়তো এ কেবল কিংবদন্তি, বাস্তবে তেমন কিছু নেই। কিন্তু তার ভেতরে আরেকটি কণ্ঠ ফিসফিস করে বলছিল—“হ্যাঁ, আমি আছি, আমাকে মুক্ত করো।” সেই কণ্ঠকে সে যুক্তি দিয়ে অস্বীকার করতে চাইলেও, হৃদয়ের গভীরে বুঝতে পারল, সে এখন আর নিরপেক্ষ গবেষক নয়; সে হয়ে উঠছে সেই অন্ধকার শক্তির টানে আবদ্ধ একজন। লাল কপাটের রহস্য, ভগ্নপ্রায় দেয়ালের লিপি, আর গ্রামের আতঙ্ক—সব মিলিয়ে অর্ণবের জীবনে এক নতুন অধ্যায় শুরু হয়ে গেল, যেখানে তার প্রতিটি পদক্ষেপ তাকে নিয়ে যাচ্ছে তান্ত্রিক আত্মার আরও কাছাকাছি।
৬
অর্ণব সেই রাত থেকেই অস্বস্তি বোধ করতে শুরু করল, যেদিন সে মন্দিরের দেয়ালে খোদাই করা লিপি আবিষ্কার করেছিল। গ্রামে আসার সময় তার মনে হয়েছিল সে শুধুই একটি প্রাচীন রহস্য উন্মোচন করতে এসেছে—কিন্তু এখন যেন সেই রহস্য তাকে ঘিরে ধরছে। রাত গভীর হলে, নিস্তব্ধ অন্ধকারে যখন হাওয়া থমকে যায়, তখনই অর্ণব স্বপ্নে লাল কপাট দেখতে পায়। স্বপ্নের ভেতর সে মন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে, চারদিক শূন্য, আর অদৃশ্য কোনো সত্তা যেন কপাটের ভেতর থেকে হাত বাড়িয়ে তাকে আহ্বান করছে। প্রথমে সে ভেবেছিল এগুলো শুধুই তার কল্পনা—প্রত্নতাত্ত্বিক মানসিকতা আর অতিরিক্ত কৌতূহলের কারণে তৈরি বিভ্রম। কিন্তু দিন বাড়ার সাথে সাথে সে বুঝতে পারল, এই স্বপ্নগুলো বারবার আসছে, আর প্রতিবারই যেন আরও স্পষ্ট হয়ে উঠছে। স্বপ্নে লাল কপাটের কাঠে আঁচড়ের দাগ, রক্তের মতো গাঢ় লাল ছোপ, আর ভেতর থেকে শোনা যায় ফিসফিসানি—যেন কেউ বন্দি হয়ে কেঁদে ডাকছে। অর্ণবের বুক ধকধক করে ওঠে, ঘাম ভিজে যায় শরীর, অথচ সে জেগে উঠলেও মনে হয় সেই ডাক এখনও তাকে তাড়া করছে।
গ্রামের প্রবীণরা তাকে বারবার সাবধান করেছিল—“কপাটের কাছে যেও না, ওটা শুধুই পাপের ছায়া।” কিন্তু অর্ণব তাদের কথা শুনতে পারছিল না। তার ভেতরে এক অদৃশ্য শক্তি কাজ করছিল, যেন স্বপ্নের মধ্য দিয়ে কেউ তাকে টেনে নিচ্ছে। দিনে সে চেষ্টা করত নিজেকে গবেষণার কাজে ব্যস্ত রাখতে, লিপি ও মন্দিরের ইতিহাস বিশ্লেষণ করতে, কিন্তু অজানা এক ঘূর্ণির মতো তার চিন্তা সবসময় গিয়ে আটকে যেত লাল কপাটে। রাতে যখন সে শয্যায় শুয়ে পড়ত, তখন আবার সেই অদ্ভুত স্বপ্ন—লাল কপাট ধীরে ধীরে খুলে যাচ্ছে, আর ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে এক ছায়ামূর্তি, যার চোখ জ্বলছে আগুনের মতো। এবার শুধু ফিসফিসানি নয়, বরং স্পষ্ট শোনা যায় আহ্বান—“এসো… দরজা খোলো… আমার মুক্তি দাও…”। অর্ণব জেগে উঠে বুঝতে পারত যে তার ঠোঁট শুকিয়ে গেছে, বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠছে, আর মনে হচ্ছে সেই কণ্ঠস্বর বাস্তবেই তার কানে বাজছে। এক অদ্ভুত দ্বন্দ্বে পড়ে গেল সে—বিজ্ঞান ও যুক্তির মানুষ সে, অথচ এই অভিজ্ঞতাগুলো তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল এক ভয়ঙ্কর অজানার দিকে।
অর্ণব যতই এই ডাককে উপেক্ষা করার চেষ্টা করল, ততই তা তাকে আচ্ছন্ন করতে লাগল। এক রাতে সে ঘুম ভেঙে দেখল জানালার বাইরে বাতাস নেই, অথচ গাছের ডালপালা হঠাৎ কেঁপে উঠছে। ম্লান চাঁদের আলোয় তার চোখে পড়ল—মন্দিরের দিক থেকে যেন ধোঁয়ার মতো কিছু উঠছে, যা আস্তে আস্তে তার ঘরের দিকে ভেসে আসছে। পর মুহূর্তেই তার কানে আবার ভেসে এলো সেই ডাক—“অর্ণব… তুমি ছাড়া আর কেউ আমাকে মুক্তি দিতে পারবে না…”। এইবার আর শুধু স্বপ্ন নয়, যেন জেগে থেকেও সে শুনতে পাচ্ছে সেই কণ্ঠস্বর। শীতল এক স্রোত তার শরীর বেয়ে নামল, সে বুঝল, যে শক্তি তাকে ডাকছে তা কেবল কল্পনা নয়, বরং বাস্তবের ভেতর প্রবেশ করেছে। অর্ণবের চোখে তখন অদ্ভুত এক দ্যুতি ফুটে উঠল—ভয় আর কৌতূহলের মিশ্র আলো। সে বুঝতে পারল, আর বেশিদিন সে এই ডাক এড়িয়ে যেতে পারবে না। তার নিয়তি হয়তো লেখা আছে সেই লাল কপাটের ভেতরেই, আর এক অজানা শক্তি তাকে সেখানে নিয়ে যেতেই দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।
৭
সেদিন রাতটা ছিল অন্যসব রাতের চেয়ে আলাদা—অর্ণব নিজেও জানত না কেন তার ভেতর এত অস্থিরতা। দিনভর গবেষণার ভান করলেও তার চোখ-মনে ঘুরছিল একটাই ছবি—লাল কপাট। সেই আহ্বানের শব্দ যেন তার ভেতর গেঁথে গেছে, প্রতি মুহূর্তে তাকে টেনে নিচ্ছে অন্ধকার মন্দিরের দিকে। গ্রাম জুড়ে তখন গভীর নিস্তব্ধতা, কেবল দূরে জোনাকির আলো আর শিউলি গাছের নিচে ঝরে পড়া সাদা ফুল। কিন্তু এই নীরবতার মাঝেই অর্ণব অনুভব করছিল এক অদৃশ্য টান, যেন কপাটের পেছন থেকে কেউ শ্বাস নিচ্ছে আর তার নাম ধরে ডাকছে। আর থাকতে পারল না সে। মশাল হাতে একা একাই সে হাঁটতে শুরু করল মন্দিরের দিকে, কাঁপা পায়ে পেরোতে লাগল ভগ্নপ্রায় সিঁড়ি। মন্দিরের সামনে এসে দাঁড়াতেই তার বুক ধকধক করে উঠল—লাল কপাট যেন অন্ধকারে আরও ভয়ঙ্কর, তার উপরকার রঙ ম্লান চাঁদের আলোয় রক্তের মতো ঝলমল করছে। বহু শতাব্দীর জমাট ধুলো-মাকড়সার জালে ঢেকে থাকা কপাট যেন হঠাৎ সজাগ হয়ে উঠেছে, শীতল বাতাসে মৃদু কম্পন পাঠাচ্ছে চারপাশে। অর্ণব জানত, এই মুহূর্তটাই নিষিদ্ধ—তবুও তার হাত উঠতে লাগল ধীরে ধীরে, যেন তার নিয়ন্ত্রণ নেই নিজের ওপর।
মুহূর্তটা ছিল অদ্ভুত, যেন সময় থমকে গেছে। অর্ণবের আঙুল কপাটের কাঠে স্পর্শ করতেই শিরায় শিরায় এক বিদ্যুৎ প্রবাহ ছড়িয়ে গেল। কপাটের দেহটা কেঁপে উঠল এমনভাবে, যেন ভেতরে কেউ বন্দি হয়ে উঠছে আর মুক্তির জন্য ছটফট করছে। একই সঙ্গে দূরে কোথাও থেকে গ্রামের কুকুরেরা হাউল দিয়ে উঠল—তাদের সমবেত চিৎকারে রাতের আকাশ ছিঁড়ে গেল। কপাটে হাত রাখা মাত্র অর্ণবের চোখের সামনে ভেসে উঠল অজস্র ছায়া—শত শত মানুষের বিকৃত মুখ, যারা যেন যন্ত্রণায় চিৎকার করছে, ভিক্ষা চাইছে মুক্তির। অর্ণব চেষ্টা করল হাত সরাতে, কিন্তু তার আঙুল যেন আটকে গেছে সেই কাঠে, এক অদৃশ্য শক্তি তাকে আঁকড়ে ধরে রেখেছে। হঠাৎই চারপাশের বাতাস ভারী হয়ে গেল, কপাটের ফাঁকফোকর থেকে বের হতে লাগল গাঢ় লাল কুয়াশা। সেই কুয়াশার সঙ্গে ছড়িয়ে পড়ল এক অচেনা গন্ধ—রক্ত, মাটি আর পোড়া ধূপের মিশ্র গন্ধ। অর্ণব বুঝল, এ কেবল কল্পনা নয়—এ শক্তি বাস্তব, এ ডাক তাকে ছাড়বে না। তার কানে আবার ভেসে এলো ফিসফিসানি—“অবশেষে… তুমি আমাকে ছুঁয়েছো।”
অর্ণবের বুকের ভেতর তখন ঝড় বইছে—ভয়, বিস্ময় আর অদ্ভুত এক আকর্ষণের মিশ্র অনুভূতি। তার শরীর ঘামে ভিজে যাচ্ছিল, অথচ মনে হচ্ছিল কোনো অদৃশ্য শক্তি তার শিরায় প্রবাহিত হচ্ছে। সে শুনতে পেল কপাটের ভেতর থেকে ধপধপ শব্দ, যেন হৃদস্পন্দন; মন্দিরের দেয়াল থেকে ধুলো ঝরে পড়ছিল, মাটিতে ফাটল ধরছিল। চারপাশের বাতাসে শিউলি ফুলের গন্ধ মিলেমিশে যাচ্ছিল সেই লাল গন্ধে, আর সেই মিশ্রণ তাকে আরও বিভ্রান্ত করে তুলছিল। দূরে পাহাড়ে ঝড়ের গর্জন শোনা যাচ্ছিল, অথচ আকাশ ছিল নির্লিপ্ত, চাঁদ নির্দয় আলো ছড়িয়ে দিচ্ছিল। কপাটের শীতল কাঠে হাত রেখে দাঁড়িয়ে অর্ণব অনুভব করল, সে আর আগের মানুষ নেই—তার ভেতর ঢুকে গেছে কোনো প্রাচীন অভিশপ্ত শক্তি, যা ধীরে ধীরে তার মনকে গ্রাস করছে। সেই মুহূর্তে গ্রাম যেন তার নিঃশ্বাস বন্ধ করে রেখেছে, সব মানুষ ঘরে বন্দি, অথচ অর্ণব দাঁড়িয়ে আছে অজানার সামনে, যেখানে এক ভুল স্পর্শেই জেগে উঠতে পারে বহু শতাব্দীর পুরোনো ভয়ঙ্কর সত্য। আর তখনই, মন্দিরের ভেতর থেকে এলো হালকা এক আঘাতের শব্দ—যেন কেউ ভেতর থেকে কপাটে চাপড় মারল, মুক্তির প্রতিশ্রুতি নিয়ে। অর্ণব বুঝল, তার ভাগ্য সিলমোহর হয়ে গেছে—সে চাইলেই আর এই আহ্বান থেকে পালাতে পারবে না।
৮
রাতের গভীরতম নিস্তব্ধতায় দাঁড়িয়ে অর্ণব অনুভব করছিল, তার হাত আর কপাটের কাঠ যেন এক হয়ে গেছে। সেই অদৃশ্য শক্তি তার রক্তনালী দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল, আর ফিসফিসানি ধীরে ধীরে পরিণত হচ্ছিল গর্জনে। সে জানত, যদি এখন হাত সরিয়ে নেয় তবে হয়তো বেঁচে যাবে, কিন্তু তার ভেতরের অচেনা আকর্ষণ তাকে ছাড়ছিল না। হঠাৎই কপাট কেঁপে উঠল, প্রথমে মৃদুভাবে, তারপর এক প্রবল ভূমিকম্পের মতো কম্পন ছড়িয়ে পড়ল চারপাশে। মাটির ফাটল থেকে উঠে আসতে লাগল গরম বাতাস, যার সঙ্গে মিশে ছিল পোড়া ধূপ আর রক্তের ঘন গন্ধ। গ্রামের কুকুরেরা হাউল দিতে দিতে পালিয়ে গেল, মুরগির খোপ ভেঙে ছুটল ডানাওয়ালা প্রাণীরা, আর দূরের বাড়িগুলো থেকে ভীত মানুষের কান্না ভেসে এলো। অর্ণবের চোখ তখন রক্তাভ, ঠোঁট শুকনো, শরীর কাঁপছিল—তবুও সে টের পাচ্ছিল, তার হাত ক্রমে কপাট ঠেলে দিচ্ছে। শত শত বছর ধরে বন্ধ থাকা সেই লাল কপাটের কবজা যেন গোঙানি দিয়ে উঠল, আর মুহূর্তের মধ্যেই ধুলো ঝড়ে মাটিতে পড়ে গেল। এক বিকট শব্দে দরজা ধীরে ধীরে খুলে গেল, আর অর্ণব দেখল তার সামনে তৈরি হলো গভীর কালো এক ফাঁক, যেন পৃথিবীর অন্তঃস্থল।
কপাট পুরোপুরি খোলার সঙ্গে সঙ্গে মন্দিরের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো এক প্রবল ঝড়ের স্রোত। সেই ঝড় আলোকে গিলে ফেলছিল, চারদিক ঘন কালো অন্ধকারে ঢেকে গেল। অর্ণব প্রথমে দেখল ধোঁয়ার মতো এক স্রোত মন্দির থেকে ছুটে বের হচ্ছে, তারপর সেই ধোঁয়া ধীরে ধীরে রূপ নিতে লাগল—এক বিশাল ছায়ামূর্তি। সেই ছায়ার কোনো নির্দিষ্ট আকৃতি নেই, তবুও তার চোখ দুটো লালচে অগ্নিশিখার মতো জ্বলছিল। যেন শতাব্দীর বন্দিত্ব আর অভিশাপ মিলেমিশে তার অস্তিত্বকে আরও ভয়ঙ্কর করে তুলেছে। চারপাশের গাছপালা শুকিয়ে যেতে লাগল, মাটির ঘাস মুহূর্তে কালো হয়ে গেল, আর গ্রামজুড়ে এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা নেমে এলো। হঠাৎই সেই ছায়া এক বিকট গর্জন ছড়াল, আর পুরো গ্রাম কেঁপে উঠল—ঘরবাড়ির দেয়াল ফেটে গেল, কুয়ার পানি কালো হয়ে গেল, আকাশের চাঁদ ম্লান হয়ে রক্তাভ রঙ ধারণ করল। অর্ণব দাঁড়িয়ে ছিল স্তব্ধ, তার মনে হচ্ছিল এক ভয়ঙ্কর শক্তি তার দেহ ভেদ করে ভেতরে প্রবেশ করছে, তাকে নিজের দাসে পরিণত করছে। গ্রামের প্রবীণরা যারা জানালা দিয়ে তাকিয়ে ছিল, ভয়ে দরজা-জানালা বন্ধ করে দিল, আর প্রার্থনা শুরু করল সেই ভেতরের সত্তার হাত থেকে বাঁচার জন্য।
অর্ণবের চোখের সামনে গ্রাম মুহূর্তে ভিন্ন জগতে রূপ নিল। আলো নিভে গিয়ে প্রতিটি কোণ অন্ধকারে ঢেকে গেল, শুধু সেই ছায়ামূর্তির লালচে দৃষ্টি গ্রামকে ভেদ করছিল। বাতাস ভারী হয়ে উঠেছিল, শ্বাস নেওয়াই কঠিন হয়ে পড়ল। অর্ণব টের পাচ্ছিল তার কানে সেই প্রাচীন তান্ত্রিক আত্মার কণ্ঠ বাজছে—“শতাব্দী ধরে আমি অপেক্ষা করেছি… আমার মুক্তি হয়েছে… আর তুমিই সেই দ্বার খুলেছো।” সেই কণ্ঠ যেন আকাশ-পাতাল কাঁপিয়ে তুলছিল। অর্ণব বুঝল, সে এমন এক শক্তি মুক্ত করেছে, যা গ্রাম তো দূরের কথা, পুরো অঞ্চলকে ধ্বংস করতে সক্ষম। কিন্তু তার ভেতরে অদ্ভুত দ্বন্দ্ব—ভয় আর এক অজানা গর্ব। কারণ সেই আত্মা তাকে ‘নির্বাচিত’ বলছে। হঠাৎ গ্রাম অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে গেল, শুধু দূরের দিগন্তে আগুনের মতো আভা ছড়িয়ে পড়ল। এই মুক্তির সঙ্গে শুরু হলো এক অভিশাপের নতুন অধ্যায়—যেখানে গ্রামের প্রতিটি প্রাণী, প্রতিটি মানুষ, প্রতিটি আত্মা এখন বন্দি সেই ছায়ার করুণার ওপর। অর্ণব ধীরে ধীরে হাঁটুতে বসে পড়ল, তার চোখে জল জমল, কিন্তু সে জানত—পেছনে ফেরার আর কোনো পথ নেই। সে নিজের হাতে জাগিয়ে তুলেছে বহু শতাব্দীর ভয়ের উৎস, আর এই মুহূর্ত থেকেই শুরু হলো অভিশপ্ত মুক্তির প্রকৃত কাহিনি।
৯
লাল কপাট ভেঙে যাওয়ার পরের রাতেই গ্রামজুড়ে শুরু হলো অচিন্তনীয় ভয়ের এক অধ্যায়। শতাব্দীর পর বন্দিত্ব থেকে মুক্তি পাওয়া সেই কালো আত্মা ধীরে ধীরে তার রূপ ছড়িয়ে দিল চারদিকে। প্রথমে বাতাস ভারী হয়ে উঠল, তারপর সেই ভারী বাতাসে ছড়িয়ে পড়ল আগুনের গন্ধ। গ্রামবাসীরা জানল, অশুভ কিছু শুরু হয়েছে। মাটির ঘরে জ্বলতে থাকা প্রদীপগুলো নিজে নিজেই নিভে গেল, আর কয়েক মুহূর্ত পরেই গ্রামের প্রান্তে শুকনো খড়ের গাদায় লেলিহান শিখা দেখা দিল। সেই আগুন মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়তে লাগল, যেন অদৃশ্য হাত সবকিছুতে ঘি ঢালছে। মানুষ চিৎকার করে পালাতে লাগল, শিশুরা মায়ের আঁচলে লুকোল, কিন্তু কোথাও আশ্রয় মেলেনি। ছায়া যেন প্রতিটি ঘরের ভেতর ঢুকে পড়ছিল, প্রতিটি জানালা ভেদ করে তার লালচে চোখ গ্রামবাসীদের ভয়ংকর মৃত্যুবার্তা দিচ্ছিল। গ্রামের প্রবীণরা যে প্রার্থনা শুরু করেছিল, সেই প্রার্থনার সুর ছিন্ন হয়ে গেল যখন একটি কুটিরের চাল হঠাৎ জ্বলে উঠল, আর ভেতরে থাকা মানুষগুলো আগুনে পুড়ে চিৎকার করতে লাগল। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল বজ্রপাতের মতো, আর প্রতিটি মুখে শুধু একটাই শব্দ—“অভিশাপ।”
অর্ণব দাঁড়িয়ে ছিল মন্দিরের সামনে, যেখানে কয়েক ঘণ্টা আগে সে নিজের হাত দিয়ে মুক্ত করেছিল সেই আত্মাকে। তার বুক কাঁপছিল অপরাধবোধে, মাথায় যেন হাতুড়ি মারার মতো শব্দ হচ্ছিল—সে বুঝতে পারছিল, সে এক ভয়ঙ্কর ভুল করে ফেলেছে। তার চোখের সামনে দৃশ্যগুলো ঘটে চলেছিল, অথচ সে এক পা-ও এগোতে পারছিল না। কালো ছায়া কখনো ধোঁয়ার মতো আকাশে উঠছিল, কখনো মানুষ আকৃতি নিয়ে গ্রামবাসীদের ঘাড় মটকাচ্ছিল, কখনো আগুনে পরিণত হয়ে ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দিচ্ছিল। শিশুদের কান্না, নারীদের আর্তচিৎকার, পুরুষদের মরিয়া চেষ্টা—সবকিছু একসঙ্গে মিশে তৈরি করছিল এক নরকীয় শব্দ। অর্ণব কানে হাত চাপা দিল, তবুও সেই শব্দ তাকে বিদ্ধ করতে থাকল। তখনই সে শুনল, সেই ছায়ার ভয়ঙ্কর কণ্ঠ আবার প্রতিধ্বনিত হলো আকাশে—“তোমরা আমাকে বন্দি করেছিলে, শতাব্দী ধরে আমার যন্ত্রণা উপভোগ করেছিলে। আজ আমি তোমাদের শ্বাস কেড়ে নেব, তোমাদের রক্ত দিয়ে ধুয়ে ফেলব এই ভূমি।” কণ্ঠস্বরের সঙ্গে সঙ্গে গ্রামের কুয়োর পানি কালো হয়ে গেল, ধানখেত শুকিয়ে ভেঙে পড়ল, আর প্রতিটি প্রাণী—গরু, ছাগল, কুকুর—হঠাৎ করেই মরে গেল। মৃত্যুর ছায়া এত দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল যে গ্রামের মানুষরা বোঝার আগেই তারা পতিত হলো ভয়াবহতার মুখে।
অর্ণব এবার বুঝতে পারল, এই ধ্বংসযজ্ঞের জন্য সবার আগে দায়ী সে-ই। তার কৌতূহল, তার অজানা আকর্ষণ, তার যুক্তিহীন স্পর্শ—সব মিলেই গ্রামে নেমে এসেছে এই বিভীষিকা। তার বুক ফেটে যাচ্ছিল অনুতাপে, তবুও চোখ সরাতে পারছিল না। মন্দিরের চারপাশে অগ্নিগোলক ঘুরছিল, আকাশ রক্তে রাঙা, আর গ্রামের প্রতিটি কোণে ছড়িয়ে পড়েছিল মৃত্যু। সে দেখল, কয়েকজন সাহসী গ্রামবাসী মিলে পুকুরের ধারে ছুটে গেল আগুন নেভানোর জন্য, কিন্তু ছায়া তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। মুহূর্তে তাদের শরীর মাটিতে ছাই হয়ে গেল। অর্ণব হাঁটুতে বসে পড়ল, তার ঠোঁটে ফিসফিসানি—“আমি কী করেছি… আমি কীভাবে এ ভুল ফিরিয়ে নেব?” কিন্তু কোনো উত্তর এলো না, শুধু চারপাশের ভাঙচুর, আগুন আর মৃত্যু তাকে গ্রাস করে ফেলল। সেই রাতেই গ্রাম রূপ নিল এক অভিশপ্ত ভূমিতে, যেখানে প্রতিটি গাছ পোড়া কাঠের মতো কালো হয়ে গেল, আর প্রতিটি ঘর ধ্বংসস্তূপে পরিণত হলো। অর্ণব বুঝল, এ শুধু শুরু—আত্মার প্রতিশোধ থেমে থাকবে না, বরং আরও বড় অশুভের দিকে এগিয়ে যাবে। আর সে, অর্ণব, এখন সেই অশুভের কেন্দ্রবিন্দু—একটি ভুলের কারণে যে নিজেকে, গ্রামকে, হয়তো পুরো পৃথিবীকে ডেকে আনল অনিবার্য সর্বনাশের মুখে।
১০
গ্রামের অগ্নিকাণ্ড আর মৃত্যুর হাহাকার যখন পুরো রাতকে রক্তলাল করে তুলেছিল, তখন অর্ণব বুঝতে পারল আর কোনো পথ খোলা নেই। তার সামনে শুধু একটাই দায়িত্ব—যে অশুভ শক্তিকে সে মুক্ত করেছে, তাকে আবার সেই লাল কপাটের অন্ধকারে ফিরিয়ে দেওয়া। সে জানত, এটা সহজ হবে না, আর এ পথে হয়তো তার নিজের প্রাণও বাঁচবে না। তবুও বুকের ভেতরে অপরাধবোধের বোঝা তাকে থামতে দিল না। সে আবার ছুটে গেল মন্দিরের দিকে, যেখানে শতাব্দী প্রাচীন পাথরের দেয়ালগুলো কাঁপছিল, আর ভেতরে সেই ভয়ঙ্কর আত্মা লালচে চোখে গ্রামকে ধ্বংস করে চলছিল। চারপাশে মৃতদেহের স্তূপ, পোড়া গাছ, ভাঙা ঘর—সবকিছুই যেন তাকে মনে করিয়ে দিচ্ছিল, এ দায়ভার থেকে পালানোর আর কোনো সুযোগ নেই। মন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে সে হাত জোড় করে ফিসফিস করে বলল, “আমাকে ক্ষমা করো… আমি ভুল করেছি।” কিন্তু বাতাসে ভেসে এলো কেবল আত্মার হাহাকার—“তুমি আমার মুক্তিদাতা, আর তুমি-ই হবে আমার বাহন।” অর্ণব শিউরে উঠল, কিন্তু তবুও এগিয়ে গেল সেই কপাটের দিকে, যা সে নিজ হাতে খুলেছিল।
আত্মা এবার তার সামনে সম্পূর্ণ রূপে প্রকাশ পেল—এক বিশাল ছায়ামূর্তি, যার শরীর আগুনের মতো দাউ দাউ করে জ্বলছে, আর যার চোখে জমাট বাঁধা শতাব্দীর ঘৃণা। অর্ণব দেখল, সেই দৃষ্টি শুধু গ্রামবাসীদের নয়, তাকে-ও ভস্ম করে দিতে চাইছে। কিন্তু সে জানত, লাল কপাট আবার বন্ধ করার একমাত্র উপায় হলো নিজের আত্মা বিসর্জন দেওয়া। প্রাচীন লিপি যেটা সে মন্দিরের দেয়ালে পড়েছিল, তাতে লেখা ছিল—“যে মুক্তি দেবে, সেই-ই হবে বন্ধনের উৎসর্গ।” তার চোখ ভিজে গেল, গলা শুকিয়ে এলো, কিন্তু বুকের ভেতর যেন এক অচেনা সাহস জেগে উঠল। সে ধীরে ধীরে হাঁটতে লাগল কপাটের দিকে, হাতে থাকা মশাল ছুঁড়ে দিল আগুনে। আত্মা গর্জন করে উঠল, “না! তুমি পারবে না আমাকে ফেরাতে!” ঝড়ের মতো বাতাস এসে অর্ণবকে পেছনে ঠেলে দিল, কিন্তু সে দাঁত চেপে এগোতে লাগল। এক সময় সে হাত রাখল কপাটের কাঠে—মুহূর্তেই বিদ্যুৎ প্রবাহের মতো ঝাঁকুনি তার শরীর কাঁপিয়ে দিল। রক্ত ঝরতে লাগল তার নাক থেকে, কিন্তু সে হাত ছাড়ল না। কপাট ধীরে ধীরে বন্ধ হতে লাগল, আর আত্মা গর্জন করে তার দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ল।
শেষ মুহূর্তে অর্ণব বুঝল, এ তার জীবনের শেষ লড়াই। আত্মা তার বুক ভেদ করে ঢুকতে চাইছিল, অথচ তার দেহ তখন লাল কপাটের সঙ্গে একাকার হয়ে যাচ্ছিল। আগুন, ধোঁয়া, চিৎকার, আর ভাঙা পৃথিবীর ভেতরে অর্ণব অনুভব করল তার শ্বাস থেমে আসছে, কিন্তু কপাট ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আত্মার আর্তচিৎকার ছড়িয়ে পড়ছিল চারদিকে, যেন আকাশ বিদীর্ণ হয়ে যাচ্ছে। অবশেষে এক বিকট শব্দে কপাট বন্ধ হয়ে গেল, আর চারপাশের বাতাস নিস্তব্ধ হয়ে গেল। আগুন নিভে গেল, গ্রাম ডুবে গেল মৃতপ্রায় অন্ধকারে, আর আকাশে চাঁদ আবার উঁকি দিল। গ্রামবাসীরা ধীরে ধীরে বেরিয়ে এল ভাঙা ঘর থেকে, তাদের চোখে ক্লান্তি, কিন্তু এক অদ্ভুত স্বস্তি। তারা দেখল মন্দিরের সামনে অর্ণবের দেহ পড়ে আছে নিথর, রক্তে ভিজে গেছে, আর লাল কপাট আবার বন্ধ হয়ে আছে। কিন্তু প্রশ্ন রয়ে গেল—এই বন্ধন কি সত্যিই চিরদিনের জন্য? নাকি কোনো এক রাতে, শতাব্দী পর আবারও কেউ কৌতূহলবশত সেই কপাট ছুঁয়ে ফেলবে? মন্দিরের চারপাশে নেমে এলো ভয়ঙ্কর নিস্তব্ধতা, আর বাতাসে ভেসে রইল হালকা ফিসফিসানি—যেন অশুভ আত্মা এখনও কপাটের ভেতরে জেগে আছে, শুধু অপেক্ষা করছে নতুন মুক্তির।
শেষ