Bangla - প্রেমের গল্প

ফটোগ্যালারির প্রেম

Spread the love

সৌম্যজিত দে


শহরের এক প্রান্তে, যেখানে আধুনিকতার কোলাহল আর নতুন বিল্ডিংয়ের উজ্জ্বল আলো পৌঁছায় না, সেখানে দাঁড়িয়ে আছে একটি পুরনো ফটোগ্যালারি। দীর্ঘদিন অবহেলায় ঢাকা ছিল এই জায়গা—ভাঙা ছাদের কোণ থেকে চুইয়ে পড়া বৃষ্টির পানি, কাঠের দরজায় কড়া নেড়ে যাওয়া বাতাসের শব্দ, আর অযত্নে পড়ে থাকা ভাঙা-চোরা ফ্রেম যেন সময়ের সাক্ষী হয়ে অপেক্ষা করছিল। শহরের মানুষ ধীরে ধীরে ভুলেই গিয়েছিল এর অস্তিত্ব, যেমন ভুলে যাওয়া যায় এক পুরনো গান বা বহু বছর ধরে বন্ধ হয়ে থাকা থিয়েটার। কিন্তু সম্প্রতি সংস্কারের উদ্যোগ নিয়ে আবার খুলে দেওয়া হলো গ্যালারিটি। একরাশ ধুলো সরিয়ে, মরিচা পড়া তালা ভেঙে, আলতো করে ফটোগ্যালারির দরজা খোলার মুহূর্তটা যেন সময়ের বুক চিরে অতীতকে ফিরিয়ে আনার মতো ছিল। ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়ে অর্ধ-অন্ধকার ঘর, যেখানে ম্লান আলোয় টিমটিম করছে কয়েকটি বাতি। কাঠের পুরনো তাকগুলোতে স্তূপ করে রাখা পুরনো ফ্রেম, অ্যালবাম, আর আলোকচিত্র যেন অতীতের গল্প বলার অপেক্ষায়। দেয়ালের চুন-সুরকির ফাঁক দিয়ে জন্মানো ছোট ছোট লতাগুল্ম মনে করিয়ে দিচ্ছিল কতদিন ধরে মানুষহীন ছিল এই জায়গা। অথচ সেই অযত্নের ভেতরও লুকিয়ে আছে এক অদ্ভুত সৌন্দর্য, যেন শতাব্দীর স্মৃতিগুলো গোপন করে রাখা হয়েছে নিঃশব্দে। এই ফটোগ্যালারির ভেতরে প্রবেশ মানেই যেন ইতিহাসের গর্ভে হারিয়ে যাওয়া, আর নতুনভাবে তাকে আবিষ্কার করার প্রথম ধাপ।

এখানেই কাজ শুরু করে অরিজিৎ নামের এক যুবক। বয়সে তরুণ, কিন্তু চোখে-মুখে এক অদ্ভুত পরিণত ভাব। ছোটবেলা থেকেই তার ছিল ছবির প্রতি অদম্য ভালোবাসা। অন্য বাচ্চারা খেলাধুলায় মগ্ন থাকলেও অরিজিৎ ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দিতো পুরনো ছবি অ্যালবাম ঘেঁটে। তার মনে হতো—প্রতিটি ছবি আসলে একেকটি জীবন্ত দলিল, যেখানে মানুষ, সময় আর আবেগ বন্দি হয়ে আছে। ফটোগ্রাফির প্রতি এই আকর্ষণই তাকে এনে দেয় এই গ্যালারিতে। শহরের অন্য কেউ যখন এই পুরনো জায়গাটিকে অপ্রয়োজনীয় বলে এড়িয়ে যায়, তখন অরিজিৎ মনে করে এটিই তার স্বপ্ন পূরণের উপযুক্ত জায়গা। প্রথমদিন গ্যালারির দরজায় পা রাখার মুহূর্তেই তার মনে হয়েছিল যেন কোনো গুপ্তধনের ভাণ্ডারের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। গ্যালারির প্রতিটি ধুলো জমা তাক, প্রতিটি ছেঁড়া কাগজ, প্রতিটি মরিচা ধরা ফ্রেম তার কাছে হয়ে ওঠে একেকটি রহস্য। সে হাত বাড়িয়ে আলতো করে ছুঁয়ে দেখে দেয়ালে ঝোলানো একটি পুরনো সাদা-কালো ছবি। ছবিতে দেখা যায় শহরের সেই একই রাস্তা, কিন্তু কতটা ভিন্ন ছিল তার রূপ—ঘোড়ার গাড়ি চলছে, মানুষের মুখে অন্যরকম ভাব, দোকানপাটে অন্য সাজসজ্জা। ছবিটা দেখে অরিজিতের মনে হয় যেন সে মুহূর্তের জন্য সত্যিই সেই সময়ে পৌঁছে গেছে। গ্যালারির ভেতরের নীরবতা তাকে গ্রাস করে নেয়, তবুও এই নীরবতাই তাকে টানে, আকর্ষণ করে। সে মনে করে, এখানে তার কাজ শুধু ছবি গুছিয়ে রাখা নয়, বরং অতীতের ভেতরে লুকিয়ে থাকা গল্পগুলোকে নতুন করে মানুষের সামনে তুলে ধরা।

অরিজিতের কাজ শুরু হয় গ্যালারির ভেতরের প্রতিটি কোণ পরিষ্কার করার মধ্য দিয়ে। দিনের পর দিন ঝাড়পোঁছ করে, ধুলো সরিয়ে, ভাঙা কাচ বদলে, সে ধীরে ধীরে জায়গাটিকে নতুন প্রাণ দেয়। কিন্তু এর চেয়েও বড় কাজ ছিল প্রতিটি ছবির ইতিহাস খুঁজে বের করা। প্রতিটি ফ্রেম হাতে নিয়ে সে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দেয়, ছবির তারিখ খোঁজে, ছবিতে ধরা পড়া মুখগুলো চিনতে চেষ্টা করে, ছবির পেছনে লেখা অস্পষ্ট হস্তাক্ষর পড়ে বোঝার চেষ্টা করে—এরা কারা ছিল, কেমন ছিল তাদের সময়। অরিজিতের মনে হয় এই কাজের ভেতর দিয়েই সে যেন হারিয়ে যাওয়া মানুষের কণ্ঠ শুনতে পাচ্ছে। তার কাছে প্রতিটি ছবি একেকটি অপূর্ণ গল্প, আর গ্যালারিটি হয়ে ওঠে গল্পের গ্রন্থাগার। দিনের আলো যখন গ্যালারির জানালা দিয়ে ভেতরে ঢোকে, তখন মনে হয় এই ধূসর ছবি গুলোও আলোতে ভরে উঠছে। আর রাতের নীরবতায় যখন সে একা গ্যালারির ভেতরে থাকে, বাতাসে উড়ে আসা পাতার শব্দে যেন ছবির মানুষগুলো তার সঙ্গে ফিসফিস করে কথা বলছে। সময়ের স্রোতে হারিয়ে যাওয়া সেই মানুষগুলোর হাসি, কান্না আর স্বপ্ন যেন এই দেয়ালের মধ্যে এখনো বেঁচে আছে। অরিজিত জানে, তার কাজ শুধু ছবি সাজানো নয়, বরং সেই আলো-আঁধারির ভেতর থেকে মানুষের হারিয়ে যাওয়া স্মৃতিগুলোকে ফিরিয়ে আনা। আর এই দায়িত্বই তাকে নতুন করে বেঁধে ফেলে গ্যালারির সঙ্গে—যেন এই পুরনো দরজার ওপারে সে নিজের জীবন খুঁজে পায়, নিজের গল্পের শুরু দেখতে পায়।

ফটোগ্যালারিতে অরিজিতের দিনগুলো তখন ধীরে ধীরে একঘেয়ে রুটিনে বাঁধা পড়ছিল। প্রতিদিন সকালে এসে ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে, পুরনো অ্যালবাম পরিষ্কার করতে করতে সে যেন একা একাই কথোপকথনে ডুবে যেত ছবির সঙ্গে। কিন্তু একদিন গ্যালারির দরজার কড়ায় হালকা শব্দ হলো—যেন নতুন এক যাত্রার সূচনা। ভেতরে ঢুকল মেঘলা। বয়সে অরিজিতের সমান, তবে চেহারায় এক অদ্ভুত উজ্জ্বলতা ছিল। তার চোখ দুটি যেন সবসময় কিছু জানার জন্য উন্মুখ, কৌতূহলে ভরা; আর ঠোঁটে লেগে থাকা সহজ হাসি যেন গ্যালারির অন্ধকার ভেতরে হঠাৎ আলোর রেখা এনে দিল। সে নিজেকে পরিচয় করিয়ে দিল গ্যালারির নতুন কর্মী হিসেবে। প্রথম দিনই তাকে দেখে অরিজিত কিছুটা অবাক হলো—কারণ এতদিনের নিস্তব্ধতা, একা কাজ করার অভ্যেস ভেঙে গেল যেন। অথচ বিস্ময়ের মাঝেই অরিজিত মুগ্ধ হয়ে লক্ষ্য করল, মেয়েটির চোখেমুখে ভরসা আর আত্মবিশ্বাস ঝলমল করছে। যেন গ্যালারির ধুলো-মাখা ইতিহাসকেও সে প্রাণবন্ত করে তুলতে পারে।

মেঘলা কাজ শুরু করার পর গ্যালারির পরিবেশ একেবারে বদলে গেল। তার প্রাণবন্ত স্বভাব আর কৌতূহলী চোখ প্রতিটি ছবির দিকে নতুন দৃষ্টিতে তাকাতো। একটা ফ্রেম তুলে সে হাসতে হাসতে বলতো, “দেখো, এই মেয়েটির চোখে কি দুষ্টুমির ঝিলিক নেই? মনে হয় ছবির ভেতর থেকে সে এখনও কিছু বলতে চাইছে।” আবার কোনো পুরনো গ্রুপ ফটো দেখে মেঘলা অরিজিতকে প্রশ্ন করত, “তুমি কি মনে করো, এরা সবাই একসঙ্গে কী উদ্‌যাপন করছিল?” তার প্রতিটি প্রশ্নে অরিজিত থমকে যেত, কারণ সে নিজে এতদিন ছবিকে ইতিহাসের দলিল হিসেবে দেখেছে, কিন্তু মেঘলা দেখছে ছবিকে জীবন্ত মানুষদের প্রতিচ্ছবি হিসেবে। অরিজিতের নীরব, চিন্তাশীল স্বভাব মেঘলার এই উচ্ছ্বাসের সঙ্গে যেন বিপরীত, অথচ আশ্চর্যজনকভাবে দু’জনের মধ্যে এক ধরনের ভারসাম্য তৈরি হলো। মেঘলা যেভাবে প্রতিটি ছবিকে কল্পনায় গল্পে বুনে ফেলতে পারত, অরিজিৎ সেই কল্পনার ফাঁকে যুক্তির আলো ফেলত। তাদের কথোপকথন ধীরে ধীরে হয়ে উঠল ছবির মতোই রঙিন—কখনো ইতিহাসের গভীর বিশ্লেষণ, কখনো আবার নিছক হালকা মজা। গ্যালারির পুরনো নীরবতায় এই প্রাণবন্ত আলাপ যেন নতুন সুরের জন্ম দিল।

সময় যতই এগোতে থাকল, অরিজিত বুঝতে পারল মেঘলা কেবল তার সহকর্মী নয়, বরং এক অন্যরকম উপস্থিতি, যে তার জীবনযাত্রার ছন্দটাই পাল্টে দিচ্ছে। মেঘলার আত্মবিশ্বাস আর হাসি তাকে প্রতিদিন নতুন উদ্যমে কাজ করতে শেখাল। যেখানে অরিজিত ছবির ভেতরে ইতিহাস খুঁজত, মেঘলা সেখানে খুঁজে পেত আবেগ আর স্বপ্ন। এই ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি তাদের মধ্যে অদ্ভুত এক সেতুবন্ধন তৈরি করল। মেঘলা অরিজিতের নীরবতা আর গভীর চিন্তাভাবনাকে আলাদা চোখে দেখতে শুরু করল—তার কাছে এটা ছিল এক ধরনের শক্তি, যা সাধারণ মানুষকে অন্যভাবে জিনিসগুলো দেখতে শেখায়। আর অরিজিত মেঘলার প্রাণবন্ত উপস্থিতিতে বুঝতে পারল, ইতিহাস কেবল অতীতের দলিল নয়, বরং বর্তমানের হৃদয়েও তার প্রতিধ্বনি বেঁচে থাকে। গ্যালারির দেয়ালগুলো, যেগুলো একসময় ধুলো আর নিস্তব্ধতায় ঢাকা ছিল, এখন যেন আলো আর কণ্ঠে ভরে উঠল। অরিজিৎ আর মেঘলার একসঙ্গে কাজের শুরুটা কেবল ফটোগ্যালারিকে নতুন করে প্রাণ দেওয়া নয়, বরং তাদের জীবনেরও এক নতুন অধ্যায় হয়ে উঠল, যেখানে দুই ভিন্ন মানুষ ধীরে ধীরে আবিষ্কার করতে লাগল একে অপরকে—একটি ফ্রেমের ভেতরে থাকা দুটি আলাদা আলো, যারা মিলেমিশে তৈরি করছে নতুন এক জ্যোতি।

সেদিন বিকেলের আলো গ্যালারির পুরনো জানালা দিয়ে ভেতরে ঢুকছিল এক অদ্ভুত কোমলতায়। ধুলো জমা ফ্রেমগুলো আলোর স্পর্শে যেন মুহূর্তের জন্য উজ্জ্বল হয়ে উঠছিল। অরিজিৎ আর মেঘলা তখন গ্যালারির ভেতর ছবি গুছিয়ে রাখছিল, হঠাৎ মেঘলার চোখ আটকে গেল একটি পুরনো সাদা-কালো ছবিতে। ছবিটি ছিল মাঝারি আকারের, কাঠের ফ্রেমে বাঁধানো, আর বয়সের কারণে কাচে হালকা ফাটল ধরে গেছে। ছবির ভেতরে দাঁড়িয়ে আছে এক তরুণ সৈনিক—গায়ে ইউনিফর্ম, চোখে দৃঢ় দৃষ্টি, পাশে তার স্ত্রী, হাতে একটি ছোট শিশু। ছবির প্রেক্ষাপট ছিল গ্রাম্য উঠোনের মতো, কিন্তু তার ভেতর লুকিয়ে ছিল এক অদ্ভুত আবেগ। মেঘলা ছবির দিকে তাকিয়ে থমকে গেল, তার চোখে ফুটে উঠল এক ধরনের বিস্ময় আর অজানা আকর্ষণ। সে আস্তে করে বলল, “অরিজিৎ, দেখো তো… এই ছবির ভেতরে কী অদ্ভুত প্রাণ আছে! মনে হচ্ছে, এরা যেন এখনও আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে।” অরিজিৎ কাছে এসে ছবিটিকে নীরবে পর্যবেক্ষণ করল। তারপর শান্ত কণ্ঠে বলতে শুরু করল ছবির পেছনের ইতিহাস, যেটা সে আগে গবেষণা করতে গিয়ে জেনেছিল। সে জানাল, ছবিটি প্রায় নব্বই বছরের পুরনো। ছবির সৈনিক ছিলেন স্বাধীনতার আগে ব্রিটিশ আর্মির অংশ, কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তাঁকে ফ্রন্টলাইনে পাঠানো হয়। যুদ্ধ থেকে আর তিনি ফিরে আসেননি। ছবিটি ছিল তাঁর পরিবারকে দেওয়া শেষ উপহার, যা আজও টিকে আছে।

অরিজিতের বর্ণনা শুনতে শুনতে মেঘলার চোখ ভিজে উঠল। সে ছবির শিশুটির দিকে তাকিয়ে বলল, “ভাবতে পারো, এই শিশুটি হয়তো বাবার মুখটাই মনে রাখতে পারেনি। ছবিই ছিল তার একমাত্র স্মৃতি।” তার কণ্ঠে যেন ভেসে এল এক অদ্ভুত কম্পন, যা অরিজিতের হৃদয়েও আঘাত করল। সে শান্ত গলায় বলল, “হ্যাঁ, কিন্তু এই ছবিটিই তো প্রমাণ যে ভালোবাসা কেবল শরীর দিয়ে নয়, স্মৃতি দিয়েও টিকে থাকে। হয়তো সেই শিশুটি বড় হয়ে বারবার এই ছবির দিকে তাকিয়ে বাবার উপস্থিতি অনুভব করেছে।” দুজনের কথোপকথন ক্রমে গভীর হয়ে উঠল। ছবিটি আর কেবল সাদা-কালো কাগজে আঁকা প্রতিচ্ছবি রইল না, বরং জীবন্ত হয়ে উঠল তাদের কল্পনায়। তারা দুজনেই ছবির পরিবারটিকে নিয়ে গল্প বুনতে শুরু করল—মেঘলা কল্পনা করছিল, সৈনিকের স্ত্রী কেমন করে প্রতিদিন সন্ধ্যায় উঠোনে বসে স্বামীর অপেক্ষা করত, শিশুটি কেমন করে বড় হতে হতে বাবার ছায়া খুঁজত। আর অরিজিৎ সেই গল্পের ভেতরে ঐতিহাসিক সত্যের রঙ যোগ করছিল—যুদ্ধের ভয়াবহতা, এক প্রজন্মের হারিয়ে যাওয়া স্বপ্ন, আর স্মৃতির শক্তি যা মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে। এভাবে তারা দুজনেই বুঝতে পারল, একটি ছবির ভেতরে কত অগণিত গল্প লুকিয়ে থাকতে পারে, আর কত ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিতে সেই গল্পকে দেখা যায়।

এই মুহূর্তটিই তাদের সম্পর্ককে অন্য মাত্রায় নিয়ে গেল। অরিজিৎ সবসময় নিজের ভেতরেই ডুবে থাকত, ছবি নিয়ে গবেষণা করত, কিন্তু কখনো আবেগের দিকটা এতটা স্পষ্টভাবে অনুভব করেনি। মেঘলার চোখ ভরা আবেগ তাকে শিখিয়ে দিল যে ইতিহাস কেবল তথ্য নয়, ইতিহাসের ভেতর মানুষের কান্না, ভালোবাসা, ত্যাগ আর স্বপ্নও লুকিয়ে থাকে। অন্যদিকে, মেঘলা অরিজিতের বিশ্লেষণ শুনে বুঝল যে আবেগকে সত্যের মাটিতে দাঁড় করালে সেটাই হয়ে ওঠে সম্পূর্ণ গল্প। তাদের কথোপকথনের ভেতরেই জন্ম নিল এক অদ্ভুত ঘনিষ্ঠতা—যেন তারা কেবল ছবির মানুষদের নিয়েই নয়, একে অপরকেও নতুন করে আবিষ্কার করছে। ছবির ফ্রেমের ভেতরে বাঁধানো সেই সৈনিক আর তার পরিবার হয়ে উঠল তাদের দুজনের সংযোগের সেতু, যা নিস্তব্ধ গ্যালারির ভেতর অদৃশ্য আলো ছড়িয়ে দিল। যখন বাইরে সূর্যাস্তের আভা আকাশকে লাল করে তুলছিল, তখন ভেতরে এই দুজন তরুণ-তরুণী বুঝতে পারল—একটি সাদা-কালো ছবির ভেতর দিয়েই তারা খুঁজে পেয়েছে এমন এক গল্প, যা তাদের হৃদয়কে এক অদ্ভুত নীরবতায় বেঁধে ফেলেছে, যেখানে শব্দের দরকার নেই, কেবল দৃষ্টি আর অনুভবই যথেষ্ট।

দিনের কাজ শেষ হলে গ্যালারির ভেতর ধীরে ধীরে নেমে আসে এক নিস্তব্ধতা, যেন শতাব্দী প্রাচীন দেয়ালগুলো দিনের আলো ঝেড়ে ফেলে রাতের অন্ধকারকে বুকে টেনে নেয়। বাইরের শহরে তখন যানবাহনের শব্দ, মানুষের ভিড়, বাজারের কোলাহল মিলেমিশে তৈরি করছে ব্যস্ত এক সুর, কিন্তু গ্যালারির ভেতরে তার কোনো প্রতিধ্বনি নেই। অরিজিৎ আর মেঘলা দিনের সব কাজ গুছিয়ে রেখে কাঠের টেবিলে বসে যায়। চারপাশে ছড়িয়ে থাকে কিছু পুরনো ফটো অ্যালবাম, ফ্রেম, আর কাগজপত্র। ঠিক এই সময়েই শুরু হয় তাদের গোপন আড্ডা। প্রথমে ছবিগুলো ঘেঁটে তারা নানা আলোচনা করে—কোনো ছবির অচেনা মুখ দেখে মেঘলা প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়, “অরিজিৎ, তুমি কি মনে করো এই লোকটা কেমন স্বভাবের ছিল?” অরিজিৎ হালকা হেসে উত্তর দেয়, “ছবিতে যেমন গম্ভীর লাগছে, হয়তো বাস্তবে সে খুব চুপচাপ ছিল। তবে তার চোখের ভেতরে লুকোনো দুঃখটা তুমি খেয়াল করেছো?” এই ধরনের কথোপকথন চলতে চলতে তারা অজান্তেই একে অপরের খুব কাছাকাছি চলে আসে। গ্যালারির খালি ঘর ভরে ওঠে তাদের স্বর আর হাসির প্রতিধ্বনিতে।

কখনো তারা ছবির মানুষদের নিয়ে কল্পনার জাল বুনে ফেলে। মেঘলা এক বৃদ্ধ দম্পতির ছবি দেখে হেসে বলে, “দেখো, এরা নিশ্চয়ই গোপনে পালিয়ে বিয়ে করেছিল। নাহলে এত খুশি খুশি কেন লাগছে?” অরিজিৎ ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ ছবির দিকে তাকিয়ে থেকে বলে, “কে জানে, হয়তো যুদ্ধ শেষে দীর্ঘদিন পর একে অপরকে ফিরে পেয়েছিল, তাই মুখে এতো আনন্দ।” মেঘলার হাসি আর অরিজিতের গভীর বিশ্লেষণ মিলে তৈরি হয় এমন সব গল্প, যা কখনো মজার, কখনো আবেগময়, আর কখনো নিস্তব্ধতার মাঝেও মনকে আলোড়িত করে। কিন্তু একসময় ছবির বাইরে তাদের আলাপ গড়িয়ে যায় নিজেদের জীবনে। মেঘলা সহজভাবেই শেয়ার করে তার ছোটবেলার স্মৃতি—গ্রামের স্কুল, খেলার মাঠ, প্রথম ক্যামেরা হাতে নেওয়ার অভিজ্ঞতা। অরিজিৎও ধীরে ধীরে তার ভেতরের পর্দা সরিয়ে রাখে। সে বলে তার একাকী বড় হয়ে ওঠার কথা, ইতিহাস পড়তে পড়তে কেমন করে ছবি আর বই তার সঙ্গী হয়ে উঠেছিল। তাদের আলাপচারিতা তখন আর ছবির চার দেয়ালের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং প্রসারিত হয় তাদের ব্যক্তিগত আবেগ, আশা-আকাঙ্ক্ষা, আর ভয়-স্বপ্নের দিকে।

এই সন্ধ্যার আড্ডাগুলো অদ্ভুতভাবে তাদের ভেতরে এক অদৃশ্য সেতুবন্ধন তৈরি করে। গ্যালারির খালি ঘরে তাদের হাসি প্রতিধ্বনিত হয়, আবার কোনো কোনো কথায় অদৃশ্য এক টানাপোড়েনও তৈরি হয়—যা তারা মুখে বলে না, তবু দুজনেই অনুভব করে। মেঘলার চোখে অরিজিতের নীরব গভীরতা এক ধরনের আকর্ষণ তৈরি করে, আর অরিজিত বুঝতে শুরু করে মেঘলার হাসির ভেতরে লুকানো অজানা আবেগের ঢেউ। বাইরে যখন অন্ধকার গাঢ় হয় আর শহরের আলো জানালার ফাঁক দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে, তখন এই আড্ডাগুলো যেন আরও অন্তরঙ্গ হয়ে ওঠে। তারা দুজনেই জানে, এ মুহূর্তগুলো শুধু গ্যালারির দেয়ালের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং তাদের হৃদয়ে চিরস্থায়ী হয়ে থাকবে। এই গোপন আড্ডা যেন কেবল ছবির গল্প নয়, বরং তাদের নিজেদের গল্পকেও জন্ম দিচ্ছে—একটি গল্প, যা অদৃশ্যভাবে প্রতিদিন একটু একটু করে তাদের জীবনকে বেঁধে ফেলছে একই সুতোয়।

সেদিন গ্যালারির ভেতরে অন্যদিনের মতোই ছবিগুলো গোছানোর কাজ চলছিল। পুরনো অ্যালবামগুলোর স্তূপ থেকে ধুলো উড়িয়ে একে একে সাজিয়ে তুলছিল তারা। হঠাৎ মেঘলার দৃষ্টি আটকে গেল একটি অ্যালবামে, যার পাতাগুলো সময়ের ভারে নরম হয়ে গেছে। অ্যালবাম খুলতেই হঠাৎ যেন তার নিশ্বাস আটকে এলো—চোখের সামনে ভেসে উঠল এক পরিচিত মুখ। পুরনো সাদা-কালো ছবির ভেতর দাঁড়িয়ে আছে এক তরুণ-তরুণী, যাদের চোখেমুখে তখনকার দিনের সরল হাসি আর লাজুক গাম্ভীর্যের ছাপ। মেঘলা কাঁপা গলায় বলল, “এরা আমার দাদু-দিদিমা…” অরিজিৎ অবাক হয়ে তার দিকে তাকাল। মেঘলার আঙুল ছবির উপর দিয়ে আলতোভাবে বুলিয়ে যাচ্ছিল, যেন বহু বছর আগের স্মৃতিকে ছুঁয়ে দেখতে চাইছে। ছবির ভেতরে দাঁড়িয়ে থাকা সেই দুই মানুষ কেবল কাগজে আঁকা প্রতিচ্ছবি নয়, বরং মেঘলার শেকড়, তার পরিবারের ইতিহাস। এই হঠাৎ পাওয়া ছবিটা যেন তার হৃদয়ের গভীর থেকে কিছু ছিঁড়ে এনে সামনে রাখল। সে নিস্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল ছবির দিকে, চোখের কোণে অশ্রু জমে উঠল অজান্তেই।

অরিজিৎ চুপচাপ তার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। সে দেখল, কীভাবে এক মুহূর্তে প্রাণবন্ত, হাসিখুশি মেঘলা নিস্তব্ধ হয়ে গেছে। সাধারণত অন্যদের গল্পে ডুবে থাকা মেয়েটি এবার নিজের গল্পের সামনে দাঁড়িয়ে পড়েছে, আর সেই গল্পে আছে তার সবচেয়ে আপন মানুষগুলো। মেঘলার ঠোঁট কেঁপে উঠল, সে ফিসফিস করে বলল, “আমি দাদুকে কখনো দেখিনি… শুধু দিদিমার মুখে গল্প শুনেছি। এই ছবিটা… যেন আমাকে সেই সময়ে নিয়ে গেল।” কথাগুলো উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গেই তার গলা ধরে এলো, চোখের পানি গড়িয়ে পড়তে লাগল। তখন অরিজিৎ কোনো শব্দ করল না, কারণ সে জানত—কিছু আবেগ আছে যাকে ভাষায় বোঝানো যায় না। সে কেবল এগিয়ে এসে আলতো করে মেঘলার হাত ধরল। সেই স্পর্শ ছিল নিঃশব্দ আশ্বাস, এক অদৃশ্য সান্ত্বনা। মেঘলা বিস্মিত হয়ে তার দিকে তাকাল, তারপর চোখ নামিয়ে নিল। তার হাত কাঁপছিল, কিন্তু অরিজিতের দৃঢ় উষ্ণতা তাকে ধীরে ধীরে স্থির করল। সে অনুভব করল, এই মুহূর্তে সে একা নয়—তার শোক, তার আবেগ, তার অতীত ভাগ করে নেওয়ার মতো কেউ আছে।

এই মুহূর্তটিই তাদের সম্পর্ককে অন্য এক স্তরে নিয়ে গেল। গ্যালারির দেয়ালজুড়ে অগণিত ছবির মধ্যে এক ছবিই হয়ে উঠল তাদের হৃদয়ের সংযোগ। মেঘলার চোখের জল, অরিজিতের নীরব সঙ্গ, আর দুজনের হাতের উষ্ণতায় গড়ে উঠল এমন এক বোঝাপড়া, যা শব্দের বাইরে। ছবির ভেতরে দাঁড়িয়ে থাকা দাদু-দিদিমা যেন অদৃশ্যভাবে তাদের এই মুহূর্তের সাক্ষী হয়ে থাকলেন। মেঘলা বুঝল, ছবির মতোই সম্পর্কও স্মৃতি আর অনুভূতিতে বেঁচে থাকে, আর অরিজিৎ বুঝল, মেঘলার প্রাণবন্ত হাসির আড়ালে কতটা গভীরতা লুকিয়ে আছে। সেদিন সন্ধ্যা নামল গ্যালারির জানালা দিয়ে, বাইরে অন্ধকার ঘনিয়ে এলো, অথচ ভেতরে তাদের নিঃশব্দ বোঝাপড়ার আলো আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠল। এই ছোট্ট স্পর্শ, এই ভাগাভাগি করা আবেগই ছিল তাদের সম্পর্কের নতুন সূচনা—যেন ছবির ফ্রেম থেকে বেরিয়ে এসে দুজনের জীবনে এক অদ্ভুত গল্পের জন্ম দিল, যার অধ্যায় লিখতে থাকবে সময় নিজেই।

গ্যালারির ভেতরটা সেদিন অদ্ভুতভাবে ভারী হয়ে উঠেছিল। বিকেলের আলো জানালা দিয়ে ঢুকে এক ফ্রেমে আটকানো ছবির উপর পড়ে সোনালি আভা ছড়িয়ে দিচ্ছিল। ছবিটি ছিল একটি গ্রুপ ফটো—একসাথে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকজন মানুষ, যাদের মধ্যে একজনের পরিচয় নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করছিল অরিজিৎ। সে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করত ছবির মানুষটি শহরের একজন বিখ্যাত রাজনৈতিক কর্মী, যিনি স্বাধীনতা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। মেঘলা কিন্তু ভিন্নমত পোষণ করল। সে বলল, ছবির ভেতরের মানুষের পোশাক আর ভঙ্গি তার কাছে অনেকটাই গ্রামীণ স্কুলশিক্ষকের মতো মনে হচ্ছে, ইতিহাসের বড় চরিত্র নয়। প্রথমে হালকা বিতর্ক দিয়েই শুরু হলো কথোপকথন—অরিজিৎ তথ্য, নথি, বইয়ের উল্লেখ টেনে আনছিল, আর মেঘলা নিজের অনুভূতি ও কল্পনার দিক থেকে যুক্তি দিচ্ছিল। কিন্তু আস্তে আস্তে স্বর উঁচু হতে শুরু করল, আর কথার ভেতরে লুকিয়ে থাকা অভিমান বেরিয়ে এলো। অরিজিৎ বিরক্ত হয়ে বলল, “তুমি সবসময় কল্পনা দিয়ে ছবি পড়ো, কিন্তু ইতিহাস শুধু অনুভূতির উপর দাঁড়ায় না।” মেঘলা তৎক্ষণাৎ পাল্টা জবাব দিল, “আর তুমি সবসময় তথ্যের খাঁচায় বন্দি থাকো, মানুষকে ভুলে যাও। ছবিতে মানুষ আছে, শুধু চরিত্র নয়।” তাদের কণ্ঠের প্রতিধ্বনি গ্যালারির দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসছিল, যেন দেয়ালও বুঝতে পারছিল এই দ্বন্দ্ব কেবল ছবির জন্য নয়, বরং তাদের ভেতরের অদৃশ্য দ্বিধার প্রতিফলন।

কথা কাটাকাটি গড়াল নীরব অভিমানে। সেই দিনের পর থেকে গ্যালারির পরিবেশ যেন বদলে গেল। তারা দুজনেই একই টেবিলে কাজ করত, ছবিগুলো গুছিয়ে রাখত, কিন্তু আগের মতো প্রাণবন্ত গল্প বা হাসি আর শোনা যেত না। মেঘলা ছবির অ্যালবাম উল্টাত নির্লিপ্তভাবে, আর অরিজিৎ নিজের কাজে ডুবে থাকত এমন ভঙ্গিতে, যেন কারও সঙ্গে কোনো কথা বলার প্রয়োজন নেই। অথচ দুজনের মনেই ছিল অস্বস্তি। মাঝে মাঝে চোখাচোখি হয়ে যেত, কিন্তু সেই দৃষ্টি দ্রুত সরিয়ে নেওয়া হতো। মেঘলার প্রাণচঞ্চল স্বভাবের জায়গায় নেমে এলো এক অদ্ভুত নীরবতা, আর অরিজিতের গভীর মনোযোগের আড়ালে জমে রইল একরাশ ক্ষোভ। গ্যালারির দেয়ালগুলো, যেগুলো এতদিন তাদের হাসি আর গল্পে মুখর ছিল, হঠাৎ যেন নির্বাক হয়ে গেল। যেন ছবিগুলোও তাদের অভিমান বুঝে নীরব হয়ে আছে। সন্ধ্যার আড্ডা, একসাথে ছবি ঘেঁটে গল্প বানানো, সবকিছু থেমে গেল অদৃশ্য একটা দূরত্বে।

তবুও এই অস্বস্তিকে এড়িয়ে যাওয়া গেল না। কয়েকদিন কেটে গেল, অথচ তাদের ভেতরের অনুচ্চারিত কথাগুলো আরও ভারী হয়ে উঠতে লাগল। গ্যালারির জানালা দিয়ে হাওয়া এলে ফ্রেমগুলো দুলে উঠত, মনে হতো সেও যেন কিছু বলতে চাইছে—“তোমাদের নীরবতা আমাদেরও নিস্তব্ধ করে দিচ্ছে।” অরিজিৎ মাঝেমধ্যে চুপচাপ মেঘলার দিকে তাকাত, মনে মনে ভাবত ক্ষমা চাইবে, কিন্তু মুখ খুলতে পারত না। মেঘলাও একা বসে ছবির দিকে তাকিয়ে থাকত, মনে হতো, যদি অরিজিৎ কাছে এসে তার সঙ্গে আগের মতো গল্প শুরু করত! অথচ কেউই প্রথম পদক্ষেপ নিল না। এই কয়েকদিনে তারা দুজনেই টের পেল, তাদের ঝগড়া কেবল একটি ছবির সত্যতা নিয়ে নয়—এটা আসলে তাদের ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির সংঘর্ষ, যেখানে আবেগ আর তথ্য একে অপরকে বোঝার চেষ্টা করছে। কিন্তু বোঝাপড়ার বদলে তারা নিজেদের ভেতরে গুটিয়ে গেল। গ্যালারির নিস্তব্ধতায় জমে উঠল এক অদ্ভুত চাপা টানাপোড়েন, যা তাদের সম্পর্ককে কেটে দূরে সরিয়ে দিচ্ছিল, অথচ ভেতরে ভেতরে দুজনেই জানত—এই নীরব দূরত্ব বেশিদিন টিকবে না, কারণ তাদের গল্প এখনও শেষ হয়নি।

বর্ষার সেই বিকেলটি ছিল গ্যালারির জন্য অদ্ভুতভাবে জীবন্ত। জানালা দিয়ে ঢোকার বৃষ্টির শব্দ এবং বাতাসে ভেসে আসা কাঁচের ফ্রেমে আঘাতের ঝনঝনানি যেন পুরো ঘরকে এক নতুন রূপে সাজিয়ে তুলেছিল। অরিজিৎ এক ফ্রেম সামলাচ্ছিলো, মেঘলা পাশ থেকে সহায়তা করছিল। হঠাৎ বজ্রপাতের এক তীব্র আলো গ্যালারির ভেতর ছড়িয়ে পড়ে, সাথে সঙ্গে বিদ্যুৎ চলে যায়। অন্ধকার হঠাৎ সব কিছুকে গ্রাস করে নেয়। ফ্রেমগুলো, যা দিনের আলোয় স্থির ও নিঃশব্দ দেখাতো, অন্ধকারে যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে—ছবি থেকে মানুষগুলো যেন চোখের পলকে বেরিয়ে এসে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বাতাসের সঙ্গে ফ্রেমগুলো ধুলোর সঙ্গে নেচে ওঠে, আর সেই অদ্ভুত ঝনঝনানি মেঘলার মনে ভয় ও অসুবিধার ঢেউ তুলে দেয়। সে অস্থিরভাবে পেছনে হেলে গিয়ে অরিজিতের পাশে দাঁড়ায়, হাতটি টেনে ধরে, তার চোখে ভরা আতঙ্ক এবং অশান্তি। অরিজিৎ তৎক্ষণাৎ তার দিকে এগিয়ে আসে, তার হাত শক্ত করে ধরে, হালকা কণ্ঠে বলে, “চিন্তা কোরো না, সব ঠিক আছে। আমি এখানে আছি।” বিদ্যুতের অন্ধকার, বজ্রপাতের ঝলক, ফ্রেমের নাচ—সবকিছু মিলিয়ে তখন যেন এক অদ্ভুত নাটক হয়ে উঠেছিল, কিন্তু অরিজিতের উপস্থিতি মেঘলাকে স্থির করার মতো শক্তি প্রদান করল।

মেঘলা তার কাঁপা হাত অরিজিতের হাতে রেখে আস্তে আস্তে ধীরে ধীরে নিজেকে শান্ত করতে লাগল। অরিজিৎ তার হাত ছেড়ে না দিয়ে মৃদুভাবে বলল, “দেখো, কোনো ঝুঁকি নেই। এই অন্ধকার শুধু মুহূর্তের। আমাদের সাহস একসাথে থাকলেই সব ঠিক হবে।” এই কথাগুলো শোনার সঙ্গে সঙ্গে মেঘলার চোখে থাকা ভয় ক্রমে কমতে শুরু করল। তাদের হাতের স্পর্শে তৈরি হওয়া তাপ আর চোখের চোখে যোগাযোগ, যা দিনের ঝগড়া ও দূরত্বের অভিমান তৈরি করেছিল, হঠাৎ যেন নরম হয়ে গেল। বজ্রপাতের এক ফ্ল্যাশে ফ্রেমগুলোর ছবিতে অদ্ভুত ছায়া খেলছিল, আর সেই ছায়ার মধ্যে তারা দুজনের মুখের প্রকাশ, চোখের দৃষ্টি একে অপরকে বোঝাচ্ছিল—কেন তারা এতদিন একে অপরের কাছ থেকে দূরে থেকেছে। আবহাওয়ার নাটকীয়তা, বিদ্যুতের অনিশ্চয়তা, এবং বজ্রপাতের ঝলক—সব মিলিয়ে তাদের ভেতরের আবেগের ভাঙা দেয়ালগুলো ধীরে ধীরে ভেঙে দিল। মেঘলা অনুভব করল, এতদিনের দূরত্ব আসলে বাস্তব নয়, বরং কেবল অভিমান, যা ভালোবাসার প্রকৃত অনুভূতি আড়াল করে রেখেছিল।

বিদ্যুত ফিরে আসার পর গ্যালারি আবার আলোয় ভরে উঠল। কিন্তু এই আলোতে তারা আর আগের মতো একা নয়। বর্ষার আর্দ্রতা, বজ্রপাতের উত্তেজনা, অন্ধকারের ভয়—সবকিছু মিলিয়ে তাদের মধ্যকার আবেগের সেতু আরও দৃঢ় হয়ে উঠল। অরিজিৎ মেঘলার হাত এখনও ছাড়েনি, আর মেঘলা বুঝতে পারল যে, তাদের মাঝে থাকা নীরব দূরত্ব কেবল অভিমান ছিল, আসল ভালোবাসা সবসময় সেখানে থেকেছে। তারা ধীরে ধীরে একে অপরের দিকে হাসল, আর সেই হাসি ছিল নিস্তব্ধ শান্তি, যেটি কয়েকদিন ধরে থেমে থাকা সম্পর্ককে পুনরায় প্রাণ দেয়। গ্যালারির দেয়াল, যা এতদিন তাদের নীরব অভিমানকে অনুভব করেছিল, এখন সেই মিলনের মুহূর্তের সাক্ষী হয়ে উপস্থিত। তাদের হাতে থাকা উষ্ণতা, চোখের ভেতরের আন্তরিকতা, আর নিঃশব্দ বোঝাপড়া—সব মিলিয়ে তৈরি হলো একটি নতুন অধ্যায়, যেখানে কোনো ঝগড়া, কোনো দূরত্ব আর প্রভাব ফেলতে পারবে না। বর্ষার সেই বিকেলটি শুধু আকাশ ও বজ্রপাতের নাটকীয়তা নয়, বরং তাদের সম্পর্কের নতুন সূচনার মুহূর্ত হয়ে রইল, যা চিরদিনের জন্য তাদের হৃদয়ে গেঁথে গেল।

গ্যালারির এক কোণে নতুন প্রদর্শনীর কাজ শুরু হলো। বর্ষার পরের এক উজ্জ্বল সকাল, যেখানে জানালা দিয়ে ঢুকছে কোমল আলো, আর বাতাসে ভাসছে বৃষ্টির ভেজা মাটির গন্ধ। অরিজিৎ এবং মেঘলা একসাথে ছবি বাছাই করতে বসে, প্রতিটি ফ্রেমকে সঠিক জায়গায় রাখার জন্য আলোচনা করছে। মেঘলা নিজের চোখে দেখে প্রতিটি ছবির ভেতরের গল্প, আর অরিজিৎ তথ্য আর ইতিহাসের খুঁটিনাটি বিবেচনা করে। তারা দুজন মিলে ফ্রেম সাজাচ্ছে, ছবির রঙ, দিক, আলো এবং স্থাপনার ভারসাম্য মিলিয়ে ঠিক করছে যেন প্রতিটি ছবিই দর্শকের চোখে জীবন্ত হয়ে ওঠে। মাঝে মাঝে তারা একে অপরের দিকে তাকিয়ে হালকা হেসে দেয়, আর সেই হাসিটা যেন পুরো প্রদর্শনীকে প্রাণবন্ত করে তোলে। সময় কখনো থেমে গেছে, কখনো এগোচ্ছে—তারা দুজনই বুঝতে পারছে, এই কাজ শুধু প্রদর্শনীর জন্য নয়, বরং নিজেদের গল্পকে এক বিশেষ স্থানে ধরে রাখার মতো।

প্রদর্শনীর শেষ ছবিগুলো সাজানোর সময় একটি বিশেষ ফ্রেম রাখার পরিকল্পনা আসে। মেঘলা এক ফ্রেম তুলে ধরে বলে, “এবার আমাদের ছবিটা কোথায় রাখব?” অরিজিৎ চোখে চোখ রেখে হেসে উত্তর দেয়, “শেষে, যেন এটা সব ছবির মাঝে আমাদের গল্পের সেরা অংশ হয়ে থাকে।” তারা দুজন মিলে ফ্রেমটি এমনভাবে সাজায়, যেন অন্য ছবিগুলোর গল্পের সঙ্গে এটিও স্বাভাবিকভাবে মিশে যায়, কিন্তু সেই ফ্রেমে থাকা ছবি সম্পূর্ণ আলাদা—একটি হাসিমাখা ছবি, যেখানে তারা দুজন হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে। ছবি তোলার সময় তাদের চোখে অজানা আনন্দ, হাসি এবং এক ধরনের উষ্ণতা ছিল। ফ্রেমটি শুধু একটি ছবি নয়, বরং তাদের সম্পর্কের প্রতীক, সেই মুহূর্তের স্মৃতি যা চিরদিন ধরে থাকবে। প্রদর্শনীতে অন্যরা যখন ছবি দেখবে, তারা কেবল ছবির শিল্পকর্ম দেখবে, কিন্তু এই ফ্রেম তাদের মধ্যেকার সম্পর্কের সাক্ষী। ধীরে ধীরে তারা বুঝতে পারল, কতোটা ছোট ছোট মুহূর্ত, হাসি আর স্পর্শ মিলে এই প্রেমকে বাস্তব করে।

প্রদর্শনী খোলার দিন, গ্যালারিটি দর্শকপ্রিয় হয়ে ওঠে। মানুষ ছবি দেখছে, গল্প শুনছে, ইতিহাসের ছোঁয়া পাচ্ছে। কিন্তু তাদের জন্য সবচেয়ে বিশেষ অংশ হলো সেই শেষ ফ্রেম। তারা দুজন সেখানে দাঁড়িয়ে, একে অপরের হাতে হাত রেখে, দেখছে যে এই ফ্রেম কেবল একটি শিল্পকর্ম নয়, বরং একটি জীবন্ত গল্প, যা তাদের ভালোবাসা এবং সম্পর্ককে চিরকাল ধরে রাখবে। গ্যালারির দেয়াল, যা অতীতে ধুলো আর নিস্তব্ধতায় ঢাকা ছিল, এখন তাদের হাসি, সান্ত্বনা, আবেগ আর প্রেমের স্পর্শে প্রাণবন্ত। সেই ফ্রেম যেন তাদের জীবনের গল্পের প্রতীক, একটি ছোট্ট বিশ্ব যা তাদের দুজনকে একসাথে বেঁধে রাখে। আর এই প্রেমের ফ্রেমই স্মরণ করিয়ে দেয়, যে সম্পর্কও একটি ছবির মতো—যে ছবি যত মন দিয়ে দেখা হয়, ততই সে জীবন্ত হয়ে ওঠে, চিরকাল টিকে থাকে, নিস্তব্ধতায় হলেও হৃদয়ের কোণে আলো জ্বালিয়ে রাখে। এক ফ্রেমে বন্দী হয়ে থাকা এই হাসিমাখা ছবি তাদের গ্যালারিতে এবং জীবনে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করল, যেখানে প্রতিটি দিন, প্রতিটি মুহূর্ত, যেন প্রেমের রঙে রাঙানো হয়ে থাকবে।

—-

1000070198.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *