Bangla - রহস্য গল্প

কর্ণসুবর্ণের স্বর্ণমুদ্রা

Spread the love

অরিত্র সেনগুপ্ত


প্রথম পর্ব: ভাঙা মন্দিরের ছায়া

কলকাতার গরম দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরনো গ্রন্থাগারে বসে ঋদ্ধি মুখোপাধ্যায় ধুলোমাখা এক দলিল উল্টেপাল্টে দেখছিল। দলিলটা এসেছে এক ব্রিটিশ কালেক্টরের আর্কাইভ থেকে—মলিন, ফ্যাকাশে কাগজে অদ্ভুত সব আঁকিবুঁকি। প্রথমে ওগুলো অর্থহীন দাগ মনে হলেও, চোখ অভ্যস্ত হতে না হতেই ঋদ্ধি দেখল ম্লান লাল কালি দিয়ে আঁকা একটা মানচিত্র। নদী, গাছপালা, আর মাঝখানে লেখা কয়েকটি সংস্কৃত শব্দ—“যত সূর্যের ছায়া, তত রাজাধন।”

ঋদ্ধির বুকের ভেতর ঝড় উঠল। এ শুধু কোনো দলিল নয়—এ যেন ইতিহাসের অমূল্য দরজা খুলে দেওয়ার চাবি। কর্ণসুবর্ণ—গৌড়ের সেই প্রাচীন রাজধানী যেখানে শশাঙ্কদেব একসময় রাজত্ব করেছিলেন, সেখানকার ধনের ইঙ্গিত লুকিয়ে আছে মানচিত্রে।

ঠিক তখনই গ্রন্থাগারের নিস্তব্ধতা ভেঙে ফোনটা বেজে উঠল। ওপারে অপর্ণা দত্ত—একজন তরুণ সাংবাদিক, যিনি ঋদ্ধির সহপাঠিনী ছিলো একসময়।
—“শুনেছিস? মুর্শিদাবাদের কর্ণসুবর্ণের কাছে খাল খননের সময় অদ্ভুত কিছু পাথর বেরিয়েছে। লোকজন বলছে ওগুলো প্রাচীন শিলালিপি।”
ঋদ্ধির চোখ জ্বলে উঠল। দুটো সূত্র একসঙ্গে মিলছে।

তারা ঠিক করল পরের সপ্তাহেই রওনা হবে।

 

ট্রেনে চেপে ঋদ্ধি আর অপর্ণা পৌঁছে গেল মুর্শিদাবাদে। নেমেই তারা এক স্থানীয় বৃদ্ধের সঙ্গে দেখা করল—হরিদাস পাল। মাথাভর্তি সাদা চুল, গলার স্বর কাঁপা, কিন্তু চোখদুটো এখনো উজ্জ্বল।
—“ধন খুঁজতে এসেছো না?” হরিদাস মৃদু হাসলেন।
অপর্ণা অবাক। —“আপনি জানলেন কী করে?”
—“আমি ছোটবেলায় শুনেছি, রাজা শশাঙ্ক ধন লুকিয়ে রেখেছিলেন সূর্যমূর্তির ছায়ার নিচে। আমার ঠাকুরদা বলেছিলেন, রাতে কবরস্থানের পাশে নাকি আলো দেখা যায়। সেদিকে যেও না, মেয়ে… অভিশাপ আছে।”

ঋদ্ধি তার নোটবইয়ে কথাগুলো লিখে রাখল। লোককথার আড়ালে প্রায়ই সত্যি লুকিয়ে থাকে।

সন্ধের পর তারা গেল ভাঙা এক মন্দিরের ধ্বংসাবশেষে। লাল ইটের গায়ে লতাপাতা জড়ানো, ভেতরে পাখির বাসা। ম্লান চাঁদের আলো পড়ছিল মন্দিরের ভগ্ন সূর্যমূর্তির ওপর। মূর্তির ছায়া পড়েছিল ভাঙা সিঁড়ির এক অদ্ভুত কোণে।

ঋদ্ধির গলা শুকিয়ে গেল। ঠিক মানচিত্রে যেমন দেখেছিল, এখানেই সূত্র।
কিন্তু ছায়ার নিচে দাঁড়াতেই কোথা থেকে যেন শোনা গেল পায়ের শব্দ। কেউ যেন অন্ধকারে তাদের নজর রাখছে…

দ্বিতীয় পর্ব: কবরস্থানের আলো

রাত নেমেছে কর্ণসুবর্ণের গ্রামে। অন্ধকারে গ্রামের পথ যেন আরও রহস্যময়—জোনাকিরা ছুটছে, হাওয়ার ঝাপটায় তালগাছগুলো শিস দিচ্ছে। ঋদ্ধি আর অপর্ণা হরিদাস পালের বাড়ির সামনে বসে কাঁচা আমের আচার খেতে খেতে শুনছিলেন তাঁর গল্প।

“কবরস্থানের দিকে রাতে যেয়ো না,” আবার সতর্ক করলেন বৃদ্ধ। “আমার ঠাকুরদা বলতেন, শশাঙ্কদেব ধনের চারপাশে রক্ষাকবচ রেখেছিলেন। আলো নেমে আসে আকাশ থেকে, কিন্তু যার লোভ হয় সে আর ফেরে না।”

অপর্ণা হেসে উঠল, “এ তো ভূতের গল্পের মতো শোনাচ্ছে।”
কিন্তু ঋদ্ধি চুপ। লোককথা উপেক্ষা করা যায় না। অভিশাপ হয়তো সত্যি নয়, কিন্তু ধনের পাহারা দিতে ফাঁদ, সুড়ঙ্গ, এমনকি গোপন সংকেত থাকতেই পারে।

 

মধ্যরাতে তারা চুপিচুপি বেরোল। হাতে টর্চলাইট, ব্যাগে মানচিত্র, আর বুকভরা অদ্ভুত উত্তেজনা। দূর থেকে দেখা যাচ্ছিল প্রাচীন কবরস্থানের কালো ছায়া। ভাঙা সমাধিফলকের সারি, কুচকুচে অন্ধকারে শিয়ালের ডাক।

হঠাৎ—
আলো!

অপর্ণা প্রথম দেখতে পেল। সমাধিফলকের ফাঁক দিয়ে যেন মৃদু নীলচে আলো বেরোচ্ছে। টর্চ নিভিয়ে তারা লুকিয়ে পড়ল এক গাছের আড়ালে। আলো ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ল চারপাশে, যেন মাটির নিচ থেকে কোনো লণ্ঠন জ্বলছে।

ঋদ্ধির হাত কাঁপছিল, কিন্তু চোখ উজ্জ্বল। “ঠিক আছে… মানচিত্রে সূর্যমূর্তির ছায়া এখানেই এসে মিশেছিল। মানে ধনের আসল চিহ্ন এটাই।”

 

কিন্তু তারা এগোতে না এগোতেই আচমকা শব্দ হলো। শুকনো ডাল ভাঙার টকাস করে আওয়াজ। দু’জন একে অপরের দিকে তাকাল। কেউ একজন আছে ওখানে।

অপর্ণা ফিসফিস করে বলল, “তুই শুনলি?”
ঋদ্ধি মাথা নাড়ল।

মুহূর্তের মধ্যে অন্ধকার থেকে তিনটে ছায়ামূর্তি বেরিয়ে এল। কালো কাপড়ে ঢাকা, হাতে ধাতব দণ্ড। বিদেশি উচ্চারণে একজন বলল,
—“ওরা এখানে কী করছে?”

অপর্ণার বুক কেঁপে উঠল। এরা নিশ্চয়ই সেই কালোবাজারি চক্রের লোক, যারা ধনের খোঁজ করছে।

ঋদ্ধি দ্রুত অপর্ণাকে টেনে নিয়ে গেল ভাঙা সমাধিফলকের আড়ালে। নিঃশব্দে শ্বাস আটকে তারা লুকিয়ে রইল। দূরে সেই নীলচে আলো এখনো মাটির নিচে কাঁপছে, আর তার চারপাশে দাঁড়িয়ে শিকারিরা খোঁড়াখুঁড়ি শুরু করেছে।

ঋদ্ধির মনে হলো—
যদি এখনই কিছু না করা যায়, তবে গুপ্তধনের রহস্য তাদের হাতেই হারিয়ে যাবে।

তৃতীয় পর্ব: গোপন সুড়ঙ্গের দরজা

অন্ধকার কবরস্থানের মধ্যে গোপনে বসে ঋদ্ধি আর অপর্ণা শিকারিদের খোঁড়াখুঁড়ি দেখছিল। তিনজন কালোবাজারি লোক লণ্ঠনের আলোয় মাটি খুঁড়ছে, তাদের মুখে রুক্ষ বিদেশি ভাষার শব্দ। নীলচে আলো যেন ওদের কাজকে আরও রহস্যময় করে তুলছিল।

অপর্ণা কানে কানে বলল, “এভাবে বসে থাকলে চলবে না। ওরা যদি কিছু পায়, তবে সব শেষ।”
ঋদ্ধি গম্ভীর মুখে মাথা নাড়ল। “আমাদের আগে এগোতে হবে।”

তারা নিঃশব্দে সমাধিফলকের ফাঁক গলে অন্যদিক দিয়ে এগোল। কবরস্থানের শেষ প্রান্তে এক পুরোনো শিলালিপি দাঁড়িয়ে ছিল—ভাঙা, তবু খোদাই করা অক্ষরগুলো ঝলসে উঠছিল টর্চের আলোয়। সংস্কৃত শ্লোক পড়ে ঋদ্ধির বুক কেঁপে উঠল—
অগ্নির পথ জলে মিশে, যেখানে ছায়া সূর্যের সঙ্গী, সেখানেই রাজার ধন লুকোনো।”

শিলালিপির পেছনে ঝোপঝাড় সরাতেই দেখা গেল একটা পাথরের ফলা। চারপাশে কাঁটা গাছ, মাটির সঙ্গে মিশে আছে যেন। ঋদ্ধি ওটা ঠেলে দেখল—পাথরের নিচে ফাঁক।

“সুড়ঙ্গ,” ফিসফিস করল সে।

অপর্ণার চোখ বড় বড় হয়ে গেল। অন্ধকারের ভেতর থেকে ভ্যাপসা বাতাস বেরিয়ে আসছিল। মনে হচ্ছিল বহু শতাব্দী ধরে বন্ধ দরজা এখন আবার খুলছে।

 

তারা দ্রুত ভেতরে ঢুকল। সরু ইটের দেয়াল, মাটির সিঁড়ি নেমে গেছে গভীরে। টর্চের আলোয় দেখা যাচ্ছিল ভাঙা ভাঙা প্রতীক, দেয়ালে সূর্যমণ্ডলের খোদাই। পায়ের নিচে মাটির গন্ধে শ্বাস ভারী হয়ে আসছিল।

“এই পথটাই নিশ্চয় ধনের দিকে নিয়ে যায়,” ঋদ্ধি বলল।

কিন্তু হঠাৎই উপরের দিক থেকে পায়ের শব্দ ভেসে এলো। কালোবাজারিরা টের পেয়েছে!

 

তারা টর্চ নিভিয়ে অন্ধকারে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। শিকারিদের গলা শোনা যাচ্ছিল—
—“ওরা কোথায় গেল?”
—“মাটির নিচে নামিয়েছে নিশ্চয়ই। চল, আমাদেরও ঢুকতে হবে।”

অপর্ণার হাত ঠান্ডা হয়ে গেছে। ঋদ্ধি তার হাত শক্ত করে ধরল।
“আমাদের আগে পৌঁছতে হবে,” সে ফিসফিস করল।

 

তারা দ্রুত সিঁড়ি নামল। সুড়ঙ্গ বাঁক নিয়ে হঠাৎ খুলে গেল এক বিশাল চেম্বারে। মশালদানি এখনো দেয়ালে ঝোলানো, যদিও বহু আগে নিভে গেছে। মাঝখানে পাথরের তৈরি এক বেদি, তার উপর অদ্ভুত খাঁজকাটা ছাপ—যেন কোনো সিন্দুক একসময় রাখা ছিল এখানে।

অপর্ণা বিস্ময়ে বলল, “এখানেই ধন ছিল?”

ঋদ্ধি বেদির গায়ে হাত বোলাল। ঠান্ডা পাথরের ভেতর থেকে মিলল এক ছোট লোহার রিং। টান দিতেই মেঝেতে কঁকিয়ে উঠল একটা ফাঁদ—পাথর সরিয়ে নিচে আরও এক দরজা দেখা গেল।

ঋদ্ধির গলায় শিহরণ।
“এটাই… আসল সুড়ঙ্গের দরজা।”

 

কিন্তু দরজার ভেতরে নামার আগেই পিছনে পায়ের শব্দ প্রতিধ্বনিত হলো।
শিকারিরা নেমে এসেছে।

অপর্ণা ফিসফিস করে বলল, “এবার কী করব?”
ঋদ্ধির চোখে ঝিলিক—“ধনের আসল রহস্য আমাদের খুঁজে বের করতেই হবে। ওরা আসার আগেই।”

চতুর্থ পর্ব: মৃত্যুফাঁদের পথ

গোপন চেম্বারের ভেতরে বাতাস যেন আরও ভারী হয়ে উঠেছিল। টর্চের আলোয় বেদির নিচের পাথর সরে গিয়ে যে সুড়ঙ্গের মুখ দেখা দিল, সেখান থেকে বেরোচ্ছে স্যাঁতসেঁতে হাওয়া আর এক অচেনা গন্ধ—মাটি, শ্যাওলা আর ধাতুর মিশ্রণ। ঋদ্ধির বুক ধকধক করছিল। অপর্ণার চোখে ভয় আর কৌতূহল মিলেমিশে ঝলমল করছে।

“এখানে নামা মানে বিপদে ঝাঁপ দেওয়া,” অপর্ণা চাপা গলায় বলল।
ঋদ্ধি ঠোঁটে হাসি টেনে উত্তর দিল, “বিপদ না নিলে ধনও পাওয়া যায় না।”

তারা নামতেই পাথরের সিঁড়ি সরু হতে শুরু করল। দেয়ালে খোদাই করা ছিল সূর্যচক্র, অগ্নিশিখা আর কিছু অদ্ভুত প্রতীক। মনে হচ্ছিল প্রাচীন কোনো তন্ত্রকৌশলের অংশ।

হঠাৎ মেঝে কেঁপে উঠল। একটা পাথরের সlab চাপা পড়ল সিঁড়ির ওপর—অল্পের জন্য তারা দুজন গড়িয়ে নিচে নেমে বাঁচল। উপরে শিকারিদের গলার শব্দ ভেসে আসছিল—
“ওরা ভেতরে ঢুকেছে, পিছু নাও!”

 

সুড়ঙ্গ আরও আঁকাবাঁকা হয়ে এক লম্বা করিডরে এসে মিশল। করিডরের দু’পাশে পাথরের মূর্তি—সাপ, সিংহ, অদ্ভুত দৈত্য। টর্চের আলো পড়তেই যেন মূর্তির চোখ লালচে হয়ে উঠল।

ঋদ্ধি ফিসফিস করে বলল, “এইগুলো সতর্কবার্তা। মানে সামনের পথটা ফাঁদে ভরা।”

কিছু দূর এগোতেই দেখা গেল মেঝেতে বর্গাকার খাঁজ। ঋদ্ধি ব্যাগ থেকে একটা ছোট পাথর ছুঁড়ল। সাথে সাথেই খাঁজের ওপর চাপ পড়তেই সামনের দেয়াল থেকে বেরিয়ে এল ধারালো বর্শা। অপর্ণা হাঁ করে তাকিয়ে রইল।

“এটা… মৃত্যুফাঁদ।”

তারা সাবধানে, একেকটা খাঁজ এড়িয়ে এগোতে লাগল। ঘাম টপটপ করে গড়িয়ে পড়ছিল। যেকোনো ভুল মানেই মৃত্যু।

 

ঠিক তখনই পেছন থেকে মৃদু আলো দেখা গেল। কালোবাজারি শিকারিরা টর্চ নিয়ে নামছে। তাদের পায়ের শব্দ প্রতিধ্বনি তুলছে, যেন পুরো সুড়ঙ্গ কাঁপছে।

অপর্ণা ফিসফিস করে বলল, “এরা যদি আমাদের ধরে ফেলে?”
ঋদ্ধি চোয়াল শক্ত করল, “তার আগে আমাদের ধন খুঁজে বের করতেই হবে।”

 

শেষমেশ তারা এক বিশাল দরজার সামনে এসে দাঁড়াল। দরজাটা পাথরের, তাতে খোদাই করা সূর্যদেবতার মুখ। মুখের মাঝখানে একটা গর্ত, যেন কোনো বিশেষ চাবির জন্য বানানো।

ঋদ্ধি মাটিতে পড়ে থাকা একটা তামার ডিস্ক কুড়িয়ে নিল। ডিস্কে খোদাই ছিল একই সূর্যচিহ্ন। সে সেটা গর্তে ঢুকাতেই দরজাটা কেঁপে উঠল। ধীরে ধীরে খুলতে শুরু করল—ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো অন্ধকারের সঙ্গে সোনালি ঝলক।

অপর্ণার নিশ্বাস আটকে গেল।
“এটা… স্বর্ণমুদ্রার ভাণ্ডার?”

কিন্তু দরজা পুরোপুরি খোলার আগেই হঠাৎ এক বিকট শব্দ হলো। মেঝে কেঁপে উঠল, আর ওপাশ থেকে আসা শিকারিদের ছায়া চোখে পড়ল।

এখন আর ফেরার পথ নেই।

পঞ্চম পর্ব: অভিশপ্ত সিন্দুক

পাথরের দরজা খুলতেই এক ঝলক সোনালি আলো অন্ধকার চেম্বার ভরিয়ে দিল। টর্চের আলো মিলিয়ে গেল যেন, চারপাশে শুধু প্রতিফলিত দীপ্তি। ঋদ্ধি আর অপর্ণা থমকে দাঁড়াল। তাদের সামনে বিশাল এক প্রাচীন কক্ষ—চারপাশে খোদাই করা ছিল সূর্য, চন্দ্র আর অগ্নিশিখা। আর মাঝখানে রাখা ছিল এক বিশাল লোহার সিন্দুক, কালো হয়ে গেছে সময়ের ভারে, তবুও তাতে খোদাই করা রাজার প্রতীক স্পষ্ট।

অপর্ণা শ্বাসরুদ্ধ কণ্ঠে বলল, “এটাই… স্বর্ণমুদ্রার ভাণ্ডার।”

ঋদ্ধি ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল। সিন্দুকের গায়ে হাত বোলাতেই হঠাৎ ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল শরীর জুড়ে। মনে হচ্ছিল যেন সিন্দুকটা জীবন্ত, যেন কেউ তার নিদ্রা ভাঙাতে চাইছে না।

ঠিক তখনই চেম্বারের বাইরে থেকে ভেসে এলো গলার শব্দ।
—“ওরা ভেতরে!”
কালোবাজারি শিকারিরা দরজা ভেঙে ঢুকে পড়ল।

তাদের নেতা, লম্বা দেহী এক বিদেশি লোক, বন্দুক উঁচিয়ে দাঁড়াল।
—“পাশে সরে দাঁড়াও। ওই সিন্দুকটা আমাদের।”

অপর্ণার চোখে আগুন। “এটা বাংলার ইতিহাস, কোনো কালোবাজারির সম্পত্তি নয়।”

লোকটা হেসে উঠল, “ইতিহাস বিক্রি করলেই দাম ওঠে।”

 

পরিস্থিতি উত্তপ্ত, কিন্তু হঠাৎই এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। সিন্দুক থেকে ভেসে এলো ধাতব ঘর্ষণের শব্দ, তারপর এক বিকট আওয়াজ। সিন্দুকের ঢাকনা আস্তে আস্তে ফাঁক হয়ে গেল, যেন ভেতর থেকে কেউ ঠেলে দিচ্ছে।

সবাই স্তব্ধ হয়ে গেল। ভেতর থেকে ঝলমল করে বেরোল সোনালি স্বর্ণমুদ্রা—শত শত, হাজার হাজার। মুদ্রার প্রতিটি গায়ে খোদাই সূর্যচক্র আর শশাঙ্কদেবের রাজমুদ্রা।

কিন্তু মুদ্রাগুলো মাটিতে পড়তেই হঠাৎ বাতাস ভারী হয়ে উঠল। টর্চের আলো নিভে যাওয়ার উপক্রম। অদ্ভুত এক শিস বাজতে লাগল চারপাশে, যেন অদৃশ্য কোনো শক্তি ঘুরে বেড়াচ্ছে।

হরিদাস পালের কথা মনে পড়ে গেল—আলো নেমে আসে, কিন্তু যার লোভ হয় সে আর ফেরে না।”

 

শিকারিরা উল্লাসে মুদ্রা কুড়োতে লাগল। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে এক জনের হাত রক্তাক্ত হয়ে গেল—মুদ্রার ধারালো প্রান্ত চিরে দিল তার চামড়া। আরেকজন হঠাৎ চিৎকার করে উঠল—তার শরীর কাঁপতে লাগল, যেন কোনো অদৃশ্য আগুন তাকে গ্রাস করছে।

ঋদ্ধি অপর্ণাকে টেনে দূরে সরিয়ে নিল। “আমি বুঝতে পারছি… এটা অভিশপ্ত সিন্দুক। ধন নিতে এলে মৃত্যু অবধারিত।”

কিন্তু শিকারিরা থামল না। তাদের নেতা সিন্দুকের ভেতরে মাথা ঢুকিয়ে আরও মুদ্রা তুলতে লাগল। ঠিক তখনই সিন্দুক থেকে বেরোল এক অগ্নিসদৃশ আলো, চারপাশ কেঁপে উঠল। নেতা চিৎকার করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল, আর বাকি দু’জন আতঙ্কে পালিয়ে গেল অন্ধকারের ভেতর।

 

অপর্ণা স্তব্ধ গলায় বলল, “তাহলে… সত্যিই অভিশাপ আছে।”

ঋদ্ধির চোখে দৃঢ়তা। “না, এটা অভিশাপ নয়। রাজারা ধন পাহারা দিতে এমন তন্ত্রকৌশল ব্যবহার করত। শশাঙ্কদেব জানতেন—ধন সঠিক হাতে না এলে তা ধ্বংস ডেকে আনবে।”

সে সিন্দুকের ঢাকনা সাবধানে নামিয়ে দিল। অগ্নির আলো মুছে গেল, আবার নিস্তব্ধতা নামল চেম্বারে।

ঋদ্ধি গভীর শ্বাস নিল।
“ধন মানে শুধু সোনা নয়। এই মুদ্রার ভেতরে আছে ইতিহাস—যা বাংলার প্রথম স্বাধীন সম্রাটের সাক্ষ্য।”

অপর্ণা তাকিয়ে রইল তার দিকে। অন্ধকারে টর্চের ক্ষীণ আলোয় দুজনের চোখে একটাই প্রশ্ন—
এ ইতিহাস তারা কীভাবে রক্ষা করবে?

ষষ্ঠ পর্ব: ইতিহাসের রক্ষাকবচ

চেম্বারের ভেতর তখন নিস্তব্ধতা। শুধু দেওয়ালের ফাঁক দিয়ে ঝরে পড়া পানির শব্দ কানে আসছিল। সিন্দুক আবার বন্ধ হয়ে আছে, তার চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে কয়েকটা স্বর্ণমুদ্রা, যেন ইতিহাসের ছাপ রেখে গেছে। ঋদ্ধি আর অপর্ণা দু’জনেই ক্লান্ত কিন্তু চোখে আলো—ওরা বুঝে গেছে, কেবল সোনার ভাণ্ডার নয়, এটা বাংলার স্বাধীনতার প্রমাণ।

অপর্ণা নিচু গলায় বলল, “ঋদ্ধি, আমরা কি এটা বাইরে নিয়ে যেতে পারব? মুদ্রাগুলো যদি সরকারের হাতে যায়, তবে সত্যিই ইতিহাস রক্ষা পাবে।”
ঋদ্ধি দীর্ঘশ্বাস ফেলল, “সহজ নয়। এই জায়গা বিপদে ভরা। আর শিকারিরা এখনো পুরোপুরি হার মানেনি।”

ঠিক তখনই করিডরের দিক থেকে আসল হালকা গর্জন। টর্চের আলো ফেলতেই দেখা গেল দেয়ালে নতুন ফাটল ধরেছে। যেন ভূগর্ভস্থ কাঠামো তাদের উপস্থিতিতে নড়েচড়ে উঠছে।

 

দু’জন দ্রুত মুদ্রাগুলো ব্যাগে ভরতে গেল না। বরং ঋদ্ধি ব্যাগ থেকে বের করল তার নোটবই, একে একে প্রতিটি মুদ্রার ছবি আঁকতে লাগল, প্রতীক, সূর্যচক্র আর খোদাই হুবহু কপি করল। অপর্ণা মোবাইল দিয়ে কয়েকটা ছবি তুলল, যদিও আলো অল্প।

“আমাদের প্রমাণ চাই,” ঋদ্ধি বলল দৃঢ় গলায়। “ধন তুলে নিলেই ইতিহাস হারিয়ে যাবে। আমাদের উচিত তার নথি বাইরে নিয়ে যাওয়া।”

অপর্ণা সম্মত হল।

 

কিন্তু বেরোনোর পথ আর শান্ত নেই। সুড়ঙ্গের ভেতর বাতাস হঠাৎই ভারী হয়ে উঠল। পেছনে শোনা গেল ক্ষীণ শব্দ—যেন পদশব্দ, হয়তো অবশিষ্ট শিকারিরা ফিরে আসছে।

তারা তড়িঘড়ি করে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগল। করিডরের বর্শাওয়ালা ফাঁদ এড়াতে আবার প্রাণপণে লাফাতে হলো। এবার সামান্য ভুলেই অপর্ণার স্কার্ফ বর্শার ডগায় আটকে গেল। অল্পের জন্য ঋদ্ধি তাকে টেনে বাঁচাল।

“এই ফাঁদগুলোই আসল রক্ষাকবচ,” ঋদ্ধি হাঁপাতে হাঁপাতে বলল। “যে লোভী হবে, সে মরবেই।”

 

অবশেষে তারা সুড়ঙ্গের মুখে পৌঁছল। কবরস্থানের ওপরে তখন ভোরের আলো ফুটছে। আকাশে প্রথম সূর্যোদয়—শশাঙ্কদেবের প্রতীক যেন আবার জীবন্ত হয়ে উঠল।

হরিদাস পাল দূরে দাঁড়িয়ে ছিল, যেন তাদের অপেক্ষায়। দু’জনকে দেখে সে কেঁপে কেঁপে বলল, “তোমরা বেঁচে ফিরেছো! সিন্দুকটা…?”

ঋদ্ধি শান্ত গলায় উত্তর দিল, “আমরা ধন ছুঁইনি। আমরা শুধু তার প্রমাণ নিয়ে ফিরছি। ইতিহাস বাঁচাতে ধনকে যেখানে আছে সেখানেই থাকতে হবে।”

হরিদাস মাথা নাড়ল। “ঠিক বলেছো। ধনের পাহারা শশাঙ্কেরই হাতে থাকুক।”

 

অপর্ণা আকাশের দিকে তাকাল। সূর্যের আলো ধীরে ধীরে ভাঙা মন্দিরের ওপর পড়ছে। মনে হলো শশাঙ্কদেব যেন এখনও পাহারা দিচ্ছেন।

ঋদ্ধি নোটবইটা শক্ত করে বুকে চেপে ধরল।
“আমাদের দায়িত্ব এখন শুরু হলো। এই প্রমাণকে বিশ্বমানচিত্রে পৌঁছে দিতে হবে—যাতে সবাই জানে, বাংলার ইতিহাস কতটা গভীর।”

আর দূরে, ভাঙা কবরস্থানের ছায়ার ভেতর দিয়ে যেন আবারও হালকা নীলচে আলো জ্বলে উঠল। হয়তো সেই অভিশাপ, নয়তো ইতিহাসের নিজস্ব রক্ষাকবচ—যে চিরকাল লুকিয়ে রাখবে কর্ণসুবর্ণের স্বর্ণমুদ্রা

সপ্তম পর্ব: বিশ্বাসঘাতকের ছায়া

ভোরের আলোয় কর্ণসুবর্ণের গ্রামটা যেন নতুন রঙে ভেসে উঠেছিল। মাটির গন্ধে ভিজে বাতাস, দূরে গঙ্গার ধার থেকে আসা শাঁখ বাজনার শব্দ—সবকিছুই যেন শান্ত আর নিরীহ। কিন্তু ঋদ্ধি আর অপর্ণার মনে শান্তি আসেনি। সিন্দুকের অভিশাপ, মুদ্রার দীপ্তি আর মৃত্যুফাঁদ—সব মিলিয়ে তারা যেন ইতিহাসের সঙ্গে এক অনন্ত যুদ্ধ লড়ে ফিরছে।

হরিদাস পাল তাদের বারবার বলছিল, “চুপচাপ চলে যাও, ছেলেমেয়েরা। ধনের ছোঁয়া মানেই বিপদ।”
ঋদ্ধি মাথা নাড়ল। “না দাদু, ইতিহাসকে লুকিয়ে রাখা যায় না। প্রমাণটা আমাদের দেখাতে হবে।”

অপর্ণা সহমত হল। ওদের হাতে এখন নোট, ছবি আর কিছু আঁকাবাঁকা প্রতীক—যা প্রমাণ করবে বাংলার প্রথম স্বাধীন সম্রাটের রাজমুদ্রার অস্তিত্ব।

 

কিন্তু তারা জানত না, বিপদ সেখানেই শেষ নয়।

গ্রাম ছেড়ে বেরোতেই দূর থেকে একটা মোটরবাইকের শব্দ ভেসে এল। কালো জ্যাকেট পরা দু’জন লোক বাইক নিয়ে এসে দাঁড়াল সামনে। চোখে সানগ্লাস, হাতে মোবাইল। তাদের চেহারা চেনা। হ্যাঁ, ওরা সেই কালোবাজারি দলের লোক, যারা কবরস্থানে পালিয়েছিল।

একজন খিকখিক করে হেসে বলল, “তোমরা ভেবেছো আমাদের হাত থেকে বাঁচবে?”
অপর্ণা ঠান্ডা গলায় বলল, “আমরা ধন নিইনি। আমরা শুধু প্রমাণ নিয়ে যাচ্ছি।”
লোকটা হেসে উঠল, “প্রমাণই তো আমাদের কাছে সোনা। তোমরা সেটা দিয়ে দিলেই পথ ছেড়ে দেব।”

ঋদ্ধির চোখে রাগের ঝিলিক। “ইতিহাস বিক্রি করার জন্য নয়।”

 

তখনই ঘটল অপ্রত্যাশিত ঘটনা। হরিদাস পাল, যে এতক্ষণ নিঃশব্দে দাঁড়িয়েছিল, হঠাৎ করে এগিয়ে এসে লোকগুলোর সঙ্গে চাপা স্বরে কিছু বলতে লাগল। ঋদ্ধি অবাক হয়ে দেখল, হরিদাস যেন তাদের সঙ্গেই পরিচিত!

অপর্ণা ফিসফিস করে বলল, “ঋদ্ধি, এ কি সম্ভব?”

মুহূর্তের মধ্যে সত্যিটা পরিষ্কার হল। হরিদাস আসলে এক দ্বিমুখো চরিত্র। বহু বছর ধরে সে গ্রামের মানুষদের অভিশাপের ভয় দেখিয়ে দূরে সরিয়ে রেখেছিল, অথচ গোপনে সে শিকারিদেরই তথ্য দিত।

হরিদাস ফিসফিস করে বলল, “আমার ঠাকুরদা ধন দেখেছিল, আমি নয়। এত বছর ধরে সঠিক মানুষ খুঁজছিলাম যে ভেতরে পৌঁছবে। তোমরাই সেটা করলে, আর আমি সেই খবর দিলাম ওদের।”

অপর্ণার গলা কাঁপল, “আপনি… আমাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করলেন?”
বৃদ্ধর চোখে এক অদ্ভুত লোভী ঝিলিক। “ইতিহাস নয়, ধনই আসল। আমি ওদের সঙ্গে ভাগ করব।”

 

শিকারিরা এবার এগিয়ে এল। “এখন তোমাদের কাছে যা আছে, সব দিয়ে দাও।”

ঋদ্ধি আর অপর্ণা বুঝল, এ লড়াই শুধু ধনের নয়—এ লড়াই বিশ্বাসঘাতকতার, ইতিহাস আর লোভের।

ঋদ্ধি বুক শক্ত করে ব্যাগটা আঁকড়ে ধরল। “তোমরা যদি ভাবো ইতিহাস এত সহজে হাতছাড়া হবে, তবে ভুল ভাবছো।”

কিন্তু বাইকের শব্দ আবার জোরে উঠল। আরও লোক আসছে। বিশ্বাসঘাতকের ছায়া তাদের চারপাশ ঘিরে ফেলছে।

অষ্টম পর্ব: দৌড়ে বাঁচার খেলা

মোটরবাইকের শব্দে চারপাশ কেঁপে উঠছিল। দু’জন নয়—এবার চারজন কালোবাজারি লোক গ্রামপথে এসে দাঁড়াল। হাতে লোহার রড, চোখে হিংস্র দৃষ্টি। ঋদ্ধি আর অপর্ণা একপাশে, পিঠে ব্যাগে ইতিহাসের প্রমাণ, সামনে বিশ্বাসঘাতক হরিদাস, আর চারদিক থেকে ঘিরে আসছে শিকারিরা।

অপর্ণা ফিসফিস করে বলল, “আমাদের এখনই পালাতে হবে।”
ঋদ্ধির গলায় দৃঢ়তা, “হ্যাঁ, ইতিহাসকে তাদের হাতে পড়তে দেওয়া যাবে না।”

শিকারিদের নেতা বন্দুক উঁচিয়ে বলল, “ব্যাগটা দাও, নইলে এখানেই শেষ।”

হঠাৎ অপর্ণা ব্যাগটা শক্ত করে বুকে চেপে ধরল আর এক ঝটকায় পাশের ঝোপে দৌড় দিল। ঋদ্ধি তার পিছু নিল। চারপাশে চিৎকার উঠল, বাইকের ইঞ্জিন গর্জে উঠল। শুরু হলো দৌড়ে বাঁচার খেলা।

 

কর্ণসুবর্ণের ভাঙা মন্দির আর শালগাছের ঘন অরণ্যের মধ্যে দিয়ে তারা ছুটছে। শিকারিরা বাইক নিয়ে পিছন থেকে ধেয়ে আসছে। পাথুরে রাস্তায় টায়ারের ঘর্ষণ, বাতাস কেটে যাওয়ার শব্দ—সব মিলিয়ে চারপাশ যেন যুদ্ধক্ষেত্র।

ঋদ্ধি চিৎকার করে বলল, “অপর্ণা, বাঁদিকে যাও!”

দু’জনে হঠাৎ বাঁক নিয়ে ঢুকে গেল সরু এক মাটির পথে। বাইকগুলো সামলাতে না পেরে ধাক্কা খেয়ে কিছুটা পিছিয়ে গেল। তবে বেশিক্ষণ নয়—আবার তারা পিছু নিল।

 

তাদের সামনে এল একটা ভাঙা খালের ধারে কাঠের সেতু। সেতু পুরনো, কচকচ করে কেঁপে উঠছে। অপর্ণা ছুটে সেতু পার হয়ে গেল, ঋদ্ধিও তার পিছু নিল। কিন্তু ঠিক তখনই সেতুটা ভেঙে পড়তে শুরু করল।

একটা বাইক পুরোপুরি খালে উলটে গেল। চিৎকারে বাতাস ফেটে গেল। বাকিরা থমকে দাঁড়াল, কিন্তু ততক্ষণে ঋদ্ধি আর অপর্ণা ওপারের জঙ্গলে ঢুকে গেছে।

জঙ্গলের ভেতর শালপাতার ফাঁক দিয়ে সূর্যের আলো ঢুকছে। পাখিদের চিৎকার, দূরে বাঁশির আওয়াজ—সব মিলিয়ে যেন প্রকৃতি নিজেই তাদের পথ দেখাচ্ছে।

অপর্ণা হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, “ঋদ্ধি, আর কতক্ষণ দৌড়াবো?”
ঋদ্ধি ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে উত্তর দিল, “যতক্ষণ না নিরাপদ জায়গায় পৌঁছাই। ইতিহাসকে রক্ষা করতে হলে জীবন বাজি রাখতে হবে।”

কিন্তু তারা জানত না, পেছনে এখনো ছায়ার মতো লেগে আছে দু’জন শিকারি—আর তাদের গাইড করছে সেই বিশ্বাসঘাতক হরিদাস।

 

দূরে ভাঙা প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ দেখা যাচ্ছিল। ঋদ্ধি ফিসফিস করে বলল, “ওখানেই আশ্রয় নিতে হবে। ভেতরে হয়তো আরও কোনো গোপন পথ আছে।”

অপর্ণা মাথা নাড়ল। দু’জন ছুটতে লাগল প্রাসাদের দিকে।
আর পেছনে বাজল হরিদাসের গলা—
“থামো! ইতিহাস আমাদের হবে, তোমাদের নয়!”

নবম পর্ব: প্রাসাদের অন্তঃপুর

ভাঙা প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ সামনে আসতেই ঋদ্ধি আর অপর্ণা একে অপরের দিকে তাকাল। বাতাসে অদ্ভুত শীতলতা, যেন এত বছর ধরে পরিত্যক্ত এই প্রাসাদও তাদের আগমনের অপেক্ষায় ছিল। ভাঙা খিলান, শ্যাওলা ঢাকা দেয়াল আর মাকড়সার জাল—সব মিলিয়ে জায়গাটা ভয়াবহ অথচ টানটান রহস্যে ভরা।

তারা ভেতরে ঢুকতেই বাতাস যেন ভারী হয়ে উঠল। মেঝেতে ভাঙা মূর্তি, দেয়ালে অর্ধেক খসে যাওয়া ফ্রেস্কো—যেখানে সূর্যদেব আর সৈন্যদের ছবি আঁকা। অপর্ণা শ্বাস আটকে ফিসফিস করে বলল, “ঋদ্ধি, এটা কি রাজপ্রাসাদের অন্তঃপুর?”
ঋদ্ধি গম্ভীরভাবে উত্তর দিল, “হ্যাঁ, এখানেই হয়তো রাজার ব্যক্তিগত কক্ষ ছিল। এখানেই লুকোনো থাকতে পারে আরও সূত্র।”

 

প্রাসাদের ভেতর অন্ধকার, শুধু টর্চের আলোয় একেকটা প্রতীক ধরা দিচ্ছিল। হঠাৎ ঋদ্ধি দেখল দেয়ালের কোণে একটা অদ্ভুত খোদাই—সূর্যের চারদিকে ছড়ানো শিখা, আর মাঝখানে শশাঙ্কদেবের নাম সংস্কৃত অক্ষরে। নিচে লেখা—
যে ইতিহাস ভুলে যায়, সে ধ্বংস হয়। যে রক্ষা করে, সে অমর।”

অপর্ণা স্তব্ধ হয়ে গেল। “এ যেন আমাদের জন্যই লেখা।”

 

ঠিক তখনই বাইরে থেকে পায়ের শব্দ ভেসে এলো। শিকারিরা আর হরিদাস তাদের খুঁজে বের করেছে। বন্দুকের লোহার শব্দ প্রতিধ্বনিত হলো ভাঙা খিলানের ভেতর।

হরিদাসের কণ্ঠ শোনা গেল, “এবার আর পালাতে পারবে না। সিন্দুক পেয়েছো, ইতিহাসও পেয়েছো—সব আমাদের হাতে তুলে দাও।”

ঋদ্ধি ব্যাগটা শক্ত করে আঁকড়ে ধরল। “না, ইতিহাস কখনো বিক্রি হয় না।”

 

তারা প্রাসাদের ভেতর আরও গভীরে ঢুকে পড়ল। এক সরু করিডর বেয়ে তারা পৌঁছল এক গোপন ঘরে। ঘরটা গোলাকার, ছাদে ছোট্ট ছিদ্র দিয়ে ভোরের আলো ঢুকছে। আলো ঠিক পড়ছে মেঝের এক বিশেষ চিহ্নে—সূর্যের প্রতীক খোদাই।

ঋদ্ধির চোখ ঝলমল করে উঠল। “এটাই… আসল অন্তঃপুর। শশাঙ্কদেব এখানে রক্ষাকবচ রেখেছিলেন।”

অপর্ণা ফিসফিস করে বলল, “মানে, এখানেই শেষ সূত্র?”

কিন্তু কথা শেষ হবার আগেই দরজার ফাঁক ভেঙে শিকারিরা ঢুকে পড়ল। বন্দুক উঁচিয়ে তারা ঘিরে ধরল ঋদ্ধি আর অপর্ণাকে।

হরিদাস কড়া গলায় বলল, “ব্যাগটা দাও, নইলে এখানেই তোমাদের কবর হবে।”

 

চারপাশে টানটান উত্তেজনা। প্রাসাদের দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হলো পাখির ডানার শব্দ, আর মেঝের প্রতীকের ওপর পড়া সূর্যের আলো ক্রমশ ঘুরতে ঘুরতে যেন নতুন রহস্য উন্মোচন করতে চাইছে।

ঋদ্ধি জানত, এটাই শেষ খেলা—
ইতিহাসকে রক্ষা করবে নাকি হারিয়ে যাবে চিরকালের জন্য।

 

দশম পর্ব: সূর্যমুদ্রার সত্য

প্রাসাদের অন্তঃপুরের গোল ঘরে দাঁড়িয়ে ঋদ্ধি আর অপর্ণা মৃত্যুর মুখোমুখি। চারপাশে শিকারিদের বন্দুক উঁচিয়ে ধরা, সামনে বিশ্বাসঘাতক হরিদাস। আর মেঝেতে সূর্যের প্রতীক খোদাই করা চিহ্নে ভোরের আলো ক্রমে ছড়িয়ে পড়ছে।

হরিদাস গম্ভীর কণ্ঠে বলল, “ব্যাগটা দিয়ে দাও, আর বেঁচে যাও। ইতিহাস তোমাদের দিয়ে কী হবে? বিক্রি করলেই আসল দাম ওঠে।”

ঋদ্ধি দৃঢ় গলায় উত্তর দিল, “ইতিহাস বিক্রির জিনিস নয়।”

শিকারিরা এগিয়ে এল। কিন্তু হঠাৎই সূর্যের আলো ঘুরে এসে প্রতীকের কেন্দ্রবিন্দুতে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গেই মেঝে কেঁপে উঠল, আর প্রতীকটা চাপা দরজার মতো ফেটে খুলে গেল।

সবার চোখ বিস্ময়ে বড় হয়ে গেল। ভেতরে দেখা গেল এক গোপন আস্তানা—সেখানে সারি সারি মাটির কলস, আর প্রতিটি ভরে আছে স্বর্ণমুদ্রা। আলোয় ঝলমল করে উঠল সেই মুদ্রাগুলো, যেন সূর্যোদয়ের সঙ্গে তারা নতুন জীবন পেল।

অপর্ণা স্তব্ধ গলায় বলল, “এটাই… কর্ণসুবর্ণের আসল ভাণ্ডার।”

 

কিন্তু মুদ্রার দীপ্তি শিকারিদের চোখে লোভের আগুন জ্বালিয়ে দিল। তারা ঝাঁপিয়ে পড়ল ভাণ্ডারের দিকে। তখনই ঘটল অদ্ভুত কিছু—দেয়াল থেকে বেরিয়ে এল ধারালো বর্শা, ছাদের ফাঁক থেকে ঝরে পড়ল পাথর। একে একে শিকারিরা চিৎকার করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।

ঋদ্ধি চমকে উঠল। “এটাই ছিল রাজার রক্ষাকবচ। ধনের প্রতি লোভী হলেই মৃত্যু নিশ্চিত।”

হরিদাস আতঙ্কে পিছু হটল, কিন্তু হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল মেঝের ফাঁদে। মুহূর্তের মধ্যে অন্ধকার তাকে গ্রাস করল।

 

এখন ঘরে বেঁচে রইল শুধু ঋদ্ধি আর অপর্ণা। আলোয় ঝলমল করছে শত শত সূর্যমুদ্রা। ঋদ্ধি মুদ্রা হাতে তুলে নিল। খোদাই করা সূর্যচক্র, চারপাশে শশাঙ্কদেবের রাজমুদ্রা—এ যেন ইতিহাসের এক জীবন্ত দলিল।

অপর্ণা বলল, “আমরা যদি এগুলো তুলে নিয়ে যাই, তবে হয়তো বিশ্বজুড়ে বাংলার ইতিহাস নতুন করে লেখা হবে।”

ঋদ্ধি মাথা নাড়ল। “না, অভিশাপ সত্যি হোক বা না হোক, ধন এখানে থাকাই উচিত। তবে প্রমাণটা আমাদের হাতে আছে। নোট, ছবি আর এই একটি মুদ্রা যথেষ্ট।”

সে একটি মাত্র মুদ্রা ব্যাগে রেখে দিল। বাকি সব রেখে গেল রাজার আস্তানায়, ইতিহাসের পাহারায়।

 

প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে আসতেই সূর্য আকাশে উঠেছে। গঙ্গার ধার থেকে আসছে সকালবেলার ঘণ্টাধ্বনি। ঋদ্ধি আর অপর্ণা ক্লান্ত শরীরে দাঁড়িয়ে রইল, কিন্তু চোখে এক অদ্ভুত শান্তি।

অপর্ণা মৃদু হেসে বলল, “আমরা লড়াই জিতেছি।”
ঋদ্ধি উত্তর দিল, “না, আমরা ইতিহাসকে বাঁচিয়েছি।”

তাদের হাতে এখন একমাত্র সূর্যমুদ্রা—বাংলার প্রথম স্বাধীন সম্রাটের সাক্ষ্য, যা প্রমাণ করবে কর্ণসুবর্ণের গৌরব। আর ভাঙা প্রাসাদের অন্তঃপুরে, অন্ধকারের ভেতর, শত শত মুদ্রা থেকে গেল চিরকালের মতো—শশাঙ্কদেবের নিজের রক্ষাকবচে।

সমাপ্ত

WhatsApp-Image-2025-09-17-at-9.41.12-AM.jpeg

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *