Bangla - হাস্যকৌতুক

ঠাকুমার কুকুর–কাণ্ড

Spread the love

উপাসনা ব্যানার্জী


আমাদের ঠাকুমা বড়ই দাপুটে মহিলা। আশেপাশের সবাই তাকে “হেডমাস্টার ঠাকুমা” বলে ডাকে। কারণ, তার কথার জোর স্কুলের প্রধান শিক্ষকের থেকেও বেশি। সকালবেলা কার ঘরে কে দেরি করে উঠলো, কে দাঁত মাজলো না, কে লুকিয়ে কচুরি খেয়ে ফেললো—সব খবর তার নখদর্পণে।

কিন্তু সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, ঠাকুমা নতুন কুকুর “ভোলানাথ” বাড়িতে এনেছেন। শুনতে শান্তশিষ্ট মনে হলেও ভোলানাথ আসলে একেবারে দস্যি। ঠাকুমার সামনে সে নরম ভদ্রলোকের মতো বসে থাকে, লেজ নাড়ায়, কিন্তু ঠাকুমা উল্টোদিকে মুখ ফেরালেই, গামছা টেনে নেয়, ভাতের হাঁড়ি উল্টে দেয়, আর পাড়ার বাচ্চাদের জুতো চুরি করে পালায়।

একদিন সকালে ঠাকুমা কাকিমাকে বলে দিলেন—
“আজ থেকে ভোলানাথকে আমি নিজে হাঁটাতে বের করবো। তোমাদের আলস্যে কুকুরটা বখে যাচ্ছে।”

সবাই ভয়ে চুপ। ভাবছিলাম ঠাকুমা সামলাতে পারবেন তো?

যা ভেবেছি তাই হলো। ঠাকুমা ভোলানাথকে দড়ি দিয়ে নিয়ে রওনা দিলেন পাড়ার মাঠে। প্রথম পাঁচ মিনিট সব শান্ত। ঠাকুমা গম্ভীর মুখে হাঁটছেন, কুকুর হাঁটছে পাশে। হঠাৎ পাড়ার মুদি দোকানের সামনে গরম সিঙ্গাড়া ভাজার গন্ধ পেল ভোলানাথ। সঙ্গে সঙ্গে দৌড়! ঠাকুমা “আয় আয় আয়” বলে পেছনে দৌড়লেন। ভোলানাথ দড়ি টেনে এমন টান মারলো যে ঠাকুমা সোজা দোকানের ভেতরে ঢুকে পড়ে এক হাঁড়ি ডাল ভাজায় হুড়মুড় করে পড়লেন।

মুদি দোকানদার হাঁ করে তাকিয়ে, আর ঠাকুমা উঠে দাঁড়িয়ে কপাল থেকে ডালের ফোড়ন মুছতে মুছতে বললেন—
“দেখিস ভোলানাথ! আজকে তোর সাত পুরুষেরও ভাত নেই!”

পাড়ার লোকজন হো হো করে হাসছে। আর ভোলানাথ দাঁড়িয়ে, জিভ বার করে, এমন ভাব করছে যেন কিছুই হয়নি।

ভোলানাথ কুকুরটার কাণ্ডকারখানা যেন দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। ঠাকুমার মুখে চিরকাল একটাই বুলি—“এই কুকুরটা একদিন আমাদের ভিটেমাটি খেয়ে ছাড়বে।” কিন্তু তারপরও প্রতিদিন সকালে ঠাকুমা ভোলানাথকে গলায় ঘণ্টা বেঁধে সগর্বে বারান্দায় বসিয়ে রাখেন, যেন পাড়ার সবাই দেখে নিক, তাদের বাড়িরও এক “দারোয়ান” আছে।

কিন্তু বিপদ বাঁধলো এক রবিবার সকালে। পাড়ার নাট্যদলের মহড়া হচ্ছিল মাঠে। সবাই মিলে রিহার্সাল করছে—নাটক “সীতার বনবাস।” রামচন্দ্র দাঁড়িয়ে গম্ভীর সংলাপ দিচ্ছে, “ও সীতা, বনবাসে চল—।” হঠাৎ ঠিক তখনই ভোলানাথ মাঠে ঢুকে পড়লো।

প্রথমে সবাই ভাবলো কুকুরটা চুপচাপ চলে যাবে। কিন্তু ভোলানাথ তো ভোলানাথ! এক ঝটকায় নকল স্বর্ণমুকুট মাথা থেকে ছিঁড়ে নিয়ে দৌড়। রামচন্দ্র দাঁড়িয়ে মাথায় হাত, আর সীতা চেঁচিয়ে বলছে—“আহা, কুকুরটা আমার স্বামীকে লুঠ করলো!”

পুরো মাঠ হেসে গড়াগড়ি। কেউ দৌড়াচ্ছে মুকুট ফেরত নিতে, কেউ কুকুরটার লেজ টানছে, কেউ আবার সংলাপ ভুলে গিয়েই হাসছে। শেষে ঠাকুমা খড়ম হাতে হাজির। চেঁচিয়ে উঠলেন—
“ভোলানাথ! তুই আজ নাটকে রাক্ষস চরিত্রে নেমেছিস নাকি?”

লোকজন হেসে একেবারে পাগল। আর ভোলানাথ তখনও গর্ব করে মাথায় মুকুট পরে বসে আছে নাট্যমঞ্চের মাঝখানে, যেন সত্যিই সে-ই রামের আসল অবতার।

পাড়ায় রবিবার মানেই একেবারে উৎসবের আমেজ। সকলে বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আড্ডা দেয়, কেউ লুডো খেলে, কেউ ক্রিকেট। আর সেই দিনই পাড়ার “স্বাস্থ্য শিবির” বসলো। ডাক্তার সাহেব নিজের গাড়ি নিয়ে এসে মাঠের এক কোণে টেবিল সাজিয়ে বসেছেন—চাপ মাপা, ইনজেকশন, ওষুধ সব একসঙ্গে।

সবাই লাইনে দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ দেখা গেলো—ভোলানাথ কোথা থেকে উধাও! ঠাকুমা ততক্ষণে খুঁজে খুঁজে হাপিয়ে উঠেছেন। হঠাৎই শিবিরে হৈচৈ শুরু হলো। ভোলানাথ নাকি ডাক্তারের টেবিলে উঠে বসে গেছে।

ডাক্তার সাহেব গম্ভীর মুখে প্রেসক্রিপশন লিখছিলেন। ভোলানাথ গিয়ে সোজা স্টেথোস্কোপ মুখে তুলে খেলনা বানিয়ে ফেললো। ডাক্তার যতবার টেনে নিচ্ছেন, ভোলানাথ ততবার টান দিয়ে ছুটে যাচ্ছে। একসময়ে তো সে গ্লুকোজের বোতল টেবিল থেকে টেনে ফেলে দিলো—টুপ করে পড়ে অর্ধেকটা ভিজে গেলো।

ঠাকুমা দৌড়ে এসে হাঁক ছাড়লেন—
“ডাক্তারবাবু, চিন্তা করবেন না, ভোলানাথ আসলে খুব স্বাস্থ্য সচেতন। পরীক্ষা-নিরীক্ষা নিজেরই করে নিতে চায়!”

পাড়ার লোকজন হেসে হেসে একেবারে কাত। আর ডাক্তারবাবু তো মাথায় হাত দিয়ে বসেছেন—কোনোদিন ভেবেছিলেন কি কুকুরও তার স্বাস্থ্য শিবিরে প্রধান রোগী হয়ে যাবে?

শেষমেশ ঠাকুমা লজ্জিত মুখে ভোলানাথকে টেনে নিয়ে গেলেন, কিন্তু যাওয়ার সময় কুকুরটা আবারও টেবিল থেকে একটা থার্মোমিটার মুখে করে নিয়ে দৌড়ালো। সবাই ফেটে পড়লো হাসিতে—“এই দেখো, কুকুরও এবার জ্বরে ভুগছে!”

পাড়ার গৌরব হলো দুর্গাপূজার ভোজ। মহালয়ার দিন থেকেই সবার মধ্যে আলোচনা—কে কত লুচি ভাজবে, কে সব্জি বানাবে, কে পায়েসের দায়িত্বে। ঠাকুমা তো চিরকাল “ভোজের কমিটি”র প্রধান। তার চোখ এড়িয়ে এক চামচ ঘি পর্যন্ত কেউ ব্যবহার করতে পারে না।

সেই দিন সকালে ভোজের রান্না শুরু হলো। বিশাল হাঁড়িতে খিচুড়ি, পাশে লুচি ভাজার তেল গরম হচ্ছে। সবাই ব্যস্ত, আর তখনই কে এসে হাজির—ভোলানাথ! ঠাকুমা তাকে বাঁশের খুঁটির সঙ্গে দড়ি দিয়ে বেঁধে রেখেছিলেন, কিন্তু কে জানে কীভাবে ছিঁড়ে পালালো।

ভোলানাথ ঢুকেই প্রথমে হাঁড়ির গন্ধ শুঁকে লাফ দিলো। এক লাফে গরম খিচুড়ির হাঁড়ির ঢাকনায় উঠে পড়লো। ঢাকনা কেঁপে খিচুড়ি ছলকে উঠলো, চারপাশে উষ্ণ ভাতের বৃষ্টি। লোকজন ছুটে এসে বাঁচাতে গেল, আর ভোলানাথ ততক্ষণে সোজা লুচির দিকে।

গরম তেলে লুচি ফুলছে, ভোলানাথ সেটাই দেখে দাঁত বার করে আনন্দে লাফ দিলো। ভাগ্য ভালো, ঠিক সময়ে ঠাকুমা তার কান মুচড়ে ধরে ফেললেন। চেঁচিয়ে উঠলেন—
“ওরে ভোলানাথ! তুই কি দুর্গার ভোগ খেতে নামিস নাকি?”

পাড়ার মহিলারা একেবারে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়লো। কারও হাতে লুচির খামির, কেউ খিচুড়ি মাখা অবস্থায় হেসে কাত। শেষে ভোজের দায়িত্বশীলরা ঠিক করলো—ভোলানাথের জন্য আলাদা থালা রাখা হবে, না হলে ঠাকুমা আর ভোলানাথ দুজনেই ভোজের মেনু উল্টেপাল্টে দেবে।

আর ভোলানাথ? সে মাটিতে বসে শান্ত মুখে লেজ নেড়ে খিচুড়ির প্লেটের দিকে তাকিয়ে থাকলো, যেন বলছে—“এই তো আমার আসল পূজা প্রসাদ।”

পাড়ায় হঠাৎ খবর ছড়িয়ে গেল—আজকে নাকি নতুন একটা কেবল টিভির লাইন বসানো হবে। সকলে খুশি, কারণ এবার থেকে সবাই একসঙ্গে লাইভ সিরিয়াল দেখতে পারবে। দুপুরবেলা মিস্ত্রিরা খুঁটি গেঁড়ে তার টানতে টানতে কাজ শুরু করলো।

সবাই দারুণ উৎসাহ নিয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে। এমন সময় ভোলানাথও হাজির। তার কৌতূহল সবকিছুর চেয়ে বেশি। সে দেখে লম্বা লম্বা তার পাড়ার এক মাথা থেকে অন্য মাথায় টানছে। প্রথমে সে একবার শুঁকে দেখলো। তারপর একেবারে দাঁত দিয়ে টেনে ধরলো।

মিস্ত্রিরা চেঁচিয়ে উঠলো—“ওরে বাবা! কেবল কাটলেই তো পুরো সিরিয়াল বন্ধ!”

লোকজন ছুটে এলো, কিন্তু ততক্ষণে ভোলানাথ দৌড় শুরু করেছে, দাঁতে ঝুলছে কালো কেবল। ঠাকুমা খড়ম হাতে পেছন পেছন ছুটছেন। ভোলানাথ একেবারে মাঠের মাঝখানে গিয়ে বসে কেবলটাকে এমনভাবে লেজ নাড়িয়ে টানাটানি করছে যেন খেলনা দড়ি।

শেষমেশ মিস্ত্রিরা কোনো রকমে কেবল বাঁচিয়ে আনলো। ঠাকুমা হাঁপাতে হাঁপাতে বসে পড়লেন। আর চারপাশে লোকজন হেসে খুন। কেউ বললো—“ভোলানাথ তো আসলে পাড়ার প্রথম কেবল অপারেটর।”

সন্ধেবেলা যখন টিভিতে খবর চালু হলো, তখনও ছবিটা কেঁপে কেঁপে আসছিল। সবাই বললো—
“ওই তো ভোলানাথের অবদান—লাইভ টিভির সঙ্গে লাইভ কমেডি ফ্রি।”

পাড়ায় প্রতি শনিবার বিকেল মানেই ক্রিকেট টুর্নামেন্ট। মাঠে দল ভাগ হয়ে খেলা চলে, বাচ্চারা ব্যাট-বল নিয়ে হৈহল্লা করে, আর বড়রা গ্যালারিতে বসে চা খেতে খেতে মন্তব্য করে। সেই দিনও খেলা জমে উঠেছিল—একদিকে “তরুণ সংঘ”, আরেকদিকে “জাগরণী স্পোর্টিং ক্লাব।”

টস হলো, ব্যাটিং শুরু। প্রথম বলে চার, দ্বিতীয় বলে ছয়, উত্তেজনায় মাঠ গরম। হঠাৎ কে যেন বল নিয়ে দৌড়ে পালালো—কে আর? আমাদের ভোলানাথ!

সে বলটা মুখে পুরে এমন দৌড় দিলো যে ব্যাটসম্যান তো হতবাক, ফিল্ডাররা পিছনে ছুটছে, আম্পায়ার বাঁশি বাজাচ্ছেন, আর দর্শকরা হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছে। ভোলানাথ একবার গ্যালারিতে গিয়ে থামলো, তারপর আবার মাঠে ফিরে বলটা আকাশে ছুড়ে দিয়ে লাফিয়ে ধরতে লাগলো—যেন টেস্ট ম্যাচের ক্যাচ প্র্যাকটিস করছে।

ঠাকুমা দৌড়ে মাঠে এসে চেঁচালেন—
“এই ভোলানাথ! খেলা তুই খেলবি নাকি মানুষ খেলবে?”

তখনকার দৃশ্যটা ছিল দেখার মতো—খেলার মাঝখানে কুকুরকে তাড়া করছে দশজন ফিল্ডার, ব্যাটসম্যান ব্যাট হাতে দাঁড়িয়ে অবাক, আর দর্শকরা একেবারে পাগলের মতো হাসছে।

শেষমেশ ভোলানাথ ক্লান্ত হয়ে বলটা মাঠের মাঝখানে ফেলে দিলো। লোকজন আবার খেলা শুরু করলো, কিন্তু স্কোরবোর্ডে লিখে দিলো—
“Special Over by: ভোলানাথ (0 রান, 0 উইকেট, Unlimited হইচই)”

পাড়ায় সেইদিন একেবারে জমজমাট অনুষ্ঠান—সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা। গান, আবৃত্তি, নাচ—সব মিলিয়ে মহোৎসব। ঠাকুমা তো আগেই বলেছিলেন, “আমাদের বাড়ির সুনাম থাকবে, আমি নিজে মঞ্চে বসে বিচার করবো।” সবাই জানে, ঠাকুমার বিচার মানে হল কঠোর শাসন আর লম্বা বক্তৃতা।

মঞ্চে প্রথমে ছোটদের নাচ হলো, তারপর গানের অনুষ্ঠান। হঠাৎই এক কিশোর আবৃত্তি শুরু করলো—
“যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে—।”
কিন্তু মঞ্চের পেছনেই কে যেন এক অদ্ভুত আওয়াজ তুলছে—“ভৌ ভৌ!”

হ্যাঁ, অনুমান ঠিক—ভোলানাথ পিছন দিয়ে মঞ্চে উঠে পড়েছে। তার মাথায় কার যেন ফুলের মালা জড়িয়ে গেছে, আর গলায় রঙিন কাপড় ঝুলছে। আলো-আঁধারিতে দেখে মনে হচ্ছে, সে-ও নাচের দলের একজন।

প্রথমে দর্শকরা ভেবেছিল এটা হয়তো অনুষ্ঠানের অংশ। কিন্তু মিনিট পাঁচেকের মধ্যে বোঝা গেলো, ভোলানাথ মঞ্চে দাঁড়িয়ে নিজের মতো নাচ শুরু করেছে। গান বাজতে থাকলো, আর ভোলানাথ হাত-পা (মানে চারটে পা) ছুঁড়ে ঘুরতে লাগলো।

আবৃত্তিকার কবিতা ভুলে থেমে গেলো, শিল্পীরা হেসে কাত, আর দর্শকরা হাততালি দিয়ে হইহই করছে। ঠাকুমা উঠে দাঁড়িয়ে গম্ভীর গলায় বললেন—
“এই অনুষ্ঠান তো এখন থেকে ভোলানাথ নৃত্য উৎসব নামে চালাতে হবে।”

শেষে সবাই ঠিক করলো, এবারের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি আর কেউ নয়—ভোলানাথ নিজে

পাড়ায় একদিন সিদ্ধান্ত হলো—সকলকে নিয়ে পিকনিক হবে। ভোরবেলা বাস ভাড়া করে সকলে লালমাটির মাঠের দিকে রওনা দিলো। হাঁড়ি-পাতিল, মাছ-মাংস, চা-বিস্কুট—সবই সঙ্গে। ঠাকুমা ঘোষণা দিলেন, “আমি পুরো রান্নার দায়িত্বে।” আর ভোলানাথ? সে-ও লেজ নাড়িয়ে উঠোন থেকে উঠে পড়লো বাসে।

বাস চলতে শুরু করতেই ভোলানাথ সিট থেকে সিটে ঘুরতে লাগলো। কারও কোলের বিস্কুট কাড়লো, কারও ঝোলার ভেতর মাথা ঢুকিয়ে কলা বার করলো। পিকনিক মাঠে পৌঁছে সবাই যখন গাছের নিচে বসে রান্নার আয়োজন করছে, তখন ভোলানাথ নিজের মতো অভিযান শুরু করলো।

প্রথমে সে খুঁজে বের করলো মাছের ঝুড়ি। তারপর এমন এক ঝাঁপ দিলো যে ঝুড়ির অর্ধেক ইলিশ ছিটকে পড়লো মাঠে। লোকজন ছুটোছুটি শুরু করলো। তারপরে মাংসের হাঁড়ি পেতে রাখা হলো চুলোর পাশে—ভোলানাথ গিয়ে চারপাশে শুঁকে একেবারে ঢাকনা ফেলে মুখ ঢুকিয়ে দিলো।

ঠাকুমা চেঁচিয়ে উঠলেন—
“আরে, এই কুকুরটাকে একদিন না খাইয়ে রাখলে বুঝতো কেমন হয়!”

কিন্তু তখনও নাটক শেষ হয়নি। খাওয়া শুরু হতেই ভোলানাথ মাটিতে পাতা কলাপাতার ভেতর থেকে একে একে লুচি টেনে নিচ্ছে। বাচ্চারা প্রথমে ভয় পেলেও পরে তার সঙ্গে লুচি-টানা খেলায় মেতে উঠলো।

শেষমেশ সবাই বুঝলো, ভোলানাথ ছাড়া পিকনিকের কোনো মজা নেই। তাই ওর জন্য আলাদা করে একটি পাত ভরে দেওয়া হলো—মাংস, লুচি, পায়েস। ভোলানাথ শান্ত হয়ে বসে খেতে লাগলো, আর সবাই হেসে বললো—
“পিকনিকের আসল অতিথি তো আমাদের ভোলানাথই।”

শীতকালে পাড়ায় বার্ষিক মেলা বসে। নাগরদোলা, ঝালমুড়ি, জিলিপি, বইয়ের স্টল—সব মিলিয়ে একেবারে উৎসবের আবহ। ঠাকুমা তো সকাল থেকেই ঘোষণা দিলেন, “মেলায় যাবো, আর ভোলানাথও সঙ্গে যাবে। তবে শর্ত—সে যেন কোনো কাণ্ড না করে।”

কথা যত সহজ শোনায়, কাজ তত নয়। মেলায় ঢুকতেই ভোলানাথের নাকে নাকে ঢুকলো জিলিপির গন্ধ। সে সোজা ছুটে গিয়ে জিলিপিওয়ালার টেবিলের পাশে লাফ দিলো। এক ঝাঁপে থালার অর্ধেক জিলিপি উল্টে গেল। লোকজন চেঁচিয়ে উঠলো, আর ভোলানাথ মিষ্টির রসে ভিজে চকচক করছে।

তারপর নাগরদোলার সামনে দাঁড়িয়ে সে চিৎকার শুরু করলো—“ভৌ ভৌ!” মনে হলো যেন সেও চড়তে চায়। শেষ পর্যন্ত মজার ছলে এক বালক তাকে কোলে নিয়ে উঠলো নাগরদোলায়। ওপরে ঘুরতে ঘুরতে ভোলানাথ খুশিতে লেজ নেড়ে এমন দৃশ্য তৈরি করলো যে নিচে দাঁড়িয়ে থাকা লোকজন হাসতে হাসতে কাত।

মেলার শেষে সবাই খেলনা, বই, জামা কিনলো। আর ভোলানাথ? সে একেবারে নিজে দাঁত দিয়ে টেনে নিয়ে এলো একটা রঙিন বেলুন। ঠাকুমা অবাক হয়ে বললেন—
“ওরে বাবা! এ আবার কবে থেকে বেলুনপ্রেমী হলো?”

শেষমেশ পাড়ার সবাই একমত হলো—যে মেলায় ভোলানাথ থাকে না, সে মেলা একেবারেই অসম্পূর্ণ।

বছরের শেষে পাড়ায় একেবারে জমকালো অনুষ্ঠান হয়—বর্ষবরণ উৎসব। মাইক বাজে, গান হয়, নাচ হয়, আর মধ্যরাতে সবাই মিলে আতশবাজি ফোটায়। ঠাকুমা ঘোষণা দিলেন, “আমাদের পরিবার থেকে আমিই উদ্বোধনী বক্তৃতা দেবো।” আর ভোলানাথ? সে-ও লেজ নাড়িয়ে মাঠে হাজির।

মঞ্চের সামনে লোকজন ভিড় করেছে। ঠাকুমা গম্ভীর গলায় বক্তৃতা শুরু করলেন—
“প্রিয় পাড়াবাসী, আজকের দিনটি আমাদের জীবনে নতুন আশা—”
ঠিক তখনই ভোলানাথ মঞ্চে লাফিয়ে উঠে মাইক্রোফোনে মুখ দিলো—“ভৌ! ভৌ!”

মাইক্রোফোনে কুকুরের ডাক এমন ভেসে গেল যে পুরো মাঠে হাসির রোল উঠলো। ঠাকুমা রেগে গেছেন বটে, কিন্তু ততক্ষণে সবাই ভোলানাথকে “বিশেষ অতিথি” বলে হাততালি দিচ্ছে।

এরপর আতশবাজি ফোটার পালা। পটকা ফাটতেই ভোলানাথ ভয় পেয়ে দৌড় দিলো—সোজা মিষ্টির টেবিলে গিয়ে দাঁড়ালো। রসগোল্লার হাঁড়ি উল্টে পড়ে গেল, মিষ্টির রস চারদিকে গড়িয়ে গেল। ভোলানাথ মুখ মুছে একেবারে চকচকে।

শেষমেশ আতশবাজি, গান, নাচ সব মিলে দারুণ উৎসব হলো। কিন্তু সবচেয়ে বড় খবর—পাড়ার লোকজন স্থির করলো, আগামী বছর থেকে “বর্ষবরণ উৎসব”-এর নাম পাল্টে দেওয়া হবে—
ভোলানাথ উৎসব”

ঠাকুমা হাঁপ ছেড়ে বললেন—
“এই কুকুরটা একদিন আমাদের পাড়ার সভাপতি হয়ে বসবে, মনে রেখো!”

সবাই আবারও হেসে গড়াগড়ি।

শেষ

WhatsApp-Image-2025-09-17-at-9.30.34-AM.jpeg

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *