অমিত সিনহা
১
হিমালয়ের নক্ষত্র মানমন্দিরে রাতটা ছিল এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতার। বাইরে বরফঢাকা পর্বতের মাথায় ছড়িয়ে থাকা ঠান্ডা হাওয়া যেন পৃথিবীর অন্তিম যুগের শীতলতার পূর্বাভাস দিচ্ছিল। শতাব্দীর শেষ প্রহরগুলোতে পৃথিবীর মানুষ আর প্রকৃতি, দুজনেই এক অচেনা ছন্দে বেঁচে ছিল। সূর্যের শক্তি ক্রমশ ক্ষয়প্রাপ্ত, গ্লোবাল তাপমাত্রা কখনও অস্বাভাবিক উষ্ণতায় ফেটে পড়ছে, আবার মুহূর্তেই হিমেল শীতের ছুরিকাঘাত নামছে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে আকাশের উচ্চতায়। শহরগুলো ধীরে ধীরে নিভে গেছে, সভ্যতার আলো কমেছে মানুষের হাতের ছোঁয়ায় নয়, বরং মহাবিশ্বের এক অচেনা চক্রে। এই মৃত্যুপথযাত্রী পৃথিবীতে আর্যন সেন যেন এক ব্যতিক্রম। তরুণ, মেধাবী জ্যোতির্বিজ্ঞানী সে, যার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য আকাশের ভাষা বোঝা। অজানাকে ছুঁতে চাওয়ার নেশায় তার প্রতিটি রাত কাটে মানমন্দিরের বিশাল দূরবীক্ষণ যন্ত্রের পাশে, যেখানে প্রতিটি নক্ষত্র যেন আসন্ন শেষের গল্প ফিসফিস করে বলে যায়। রাত যত গভীর হয়, তুষারাচ্ছন্ন আকাশে ছড়িয়ে থাকা নক্ষত্রের আলো তত ফিকে লাগে, যেন মহাবিশ্ব নিজেই ধীরে ধীরে নিভে যাচ্ছে—এক অদৃশ্য পরিসমাপ্তির দিকে এগোচ্ছে সমস্ত আলো।
এই নিস্তব্ধতার মাঝেই সেই রাতের ব্যতিক্রমী মুহূর্তটি এসে পড়ল। আর্যন একা বসে ছিল তার পর্যবেক্ষণ কক্ষে, বড়ো পর্দার দিকে তাকিয়ে, যেখানে দূরবর্তী গ্যালাক্সিগুলোর মৃদু আলোক সংকেত নিত্যদিনের মতো ধরা পড়ছিল। হঠাৎই যন্ত্রের সূচক অনিয়মিতভাবে কেঁপে উঠল, এবং পর্দায় দেখা গেল এক অচেনা ছন্দ—একটি আলো, যা অন্য সব নক্ষত্রের মতো নয়। এটি কোনো সাধারণ পালসার বা কোয়াসারের সংকেত নয়, না কোনো ধূমকেতুর প্রতিফলন। এটি ছিল আলোক তরঙ্গের এক অদ্ভুত গাণিতিক বিন্যাস, যেন কোনো অচেনা ভাষা, যা সংখ্যার ছন্দে নিজেকে প্রকাশ করছে। প্রথমে আর্যন ভেবেছিল এটি হয়তো এক ধরনের মহাজাগতিক বিকৃতি, বা দূরবর্তী নক্ষত্রমণ্ডলের কোনো অপ্রত্যাশিত পরিবর্তন। কিন্তু যত সে তথ্যগুলো গভীরভাবে বিশ্লেষণ করতে লাগল, ততই বুঝতে পারল—এই আলোর ছন্দ কেবল প্রাকৃতিক কোনো ঘটনার ফল নয়। এটি যেন সচেতন, যেন মহাবিশ্বের অপর প্রান্ত থেকে কেউ কথা বলছে, নিঃশব্দে, অজানা গণিতের মাধ্যমে। তার চোখে ধীরে ধীরে ভয় আর উত্তেজনার এক মিশ্র ঝড় নেমে এলো। যদি এটি সত্যিই কোনো ভাষা হয়, তবে এই সংকেত মানব ইতিহাসের সবচেয়ে বড় আবিষ্কার হতে পারে।
কিন্তু আবিষ্কারের এই প্রাথমিক উন্মাদনার সঙ্গে সঙ্গে আর্যনের মনে উঁকি দিল আরও গভীর এক প্রশ্ন—যদি মহাবিশ্ব সত্যিই কথা বলে, তবে তার উদ্দেশ্য কী? সংকেতের ছন্দে যেন এক অদ্ভুত আহ্বান ছিল, যা কেবল বৈজ্ঞানিক কৌতূহলের চেয়ে অনেক বড়। পৃথিবীর সভ্যতা যখন শেষ শ্বাস নিচ্ছে, তখন দূরবর্তী গ্যালাক্সির এই আলো কি কেবল এক কাকতালীয় সংকেত, নাকি এটি এক মহাজাগতিক চেতনার বার্তা, যা এই মরণোন্মুখ গ্রহের শেষ সন্তানদের দিকে হাত বাড়াচ্ছে? আর্যনের মন ছুটতে লাগল সম্ভাবনার জগতে। তার শিরা-উপশিরায় এক অদৃশ্য শক্তি যেন প্রবাহিত হচ্ছিল—যা তাকে বলছিল, এই আলোর ভাষা অনুবাদ করা সম্ভব, যদি সে যথেষ্ট গভীরে প্রবেশ করতে পারে। বাইরের আকাশে তখন হিমালয়ের রাত আরও ঘন, নক্ষত্রেরা আরও ম্লান, যেন তারা নিজেরাই জানে এই সংকেতের গোপন অর্থ। আর্যন পর্দার দিকে তাকিয়ে অনুভব করল, মহাবিশ্বের শেষ আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে সে এক অভূতপূর্ব সংলাপের প্রান্তে এসে পৌঁছেছে—যেখানে বিজ্ঞান আর অস্তিত্বের সীমানা মিশে যাচ্ছে এক অমোঘ রহস্যে।
২
হিমালয়ের নক্ষত্র মানমন্দিরের ল্যাবরেটরিতে আর্যনের রাতগুলো ক্রমেই দীর্ঘতর হতে লাগল। সংকেত পাওয়ার সেই রাতের পর থেকে সে যেন এক অদৃশ্য টানে আচ্ছন্ন হয়ে আছে, যার লক্ষ্য শুধু একটি—আলোর অন্তর্গত গোপন নকশা উন্মোচন। বিশাল দূরবীক্ষণ যন্ত্রের ডেটা রেকর্ডার থেকে আসা সংখ্যাগুলো তাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছিল, যেন প্রতিটি তরঙ্গই কোনো অদ্ভুত সুরে তাকে ডেকে বলছে, “আরও গভীরে এসো।” চারপাশের পৃথিবী ধীরে ধীরে নীরব হয়ে আসছিল—মানুষের শহরগুলো নিভে যাচ্ছে, যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ছে, এবং অবশিষ্ট বিজ্ঞানীরা সংকেতটিকে কেবল একটি মহাজাগতিক কাকতাল বলে উড়িয়ে দিচ্ছে। কিন্তু আর্যনের চোখে সেটি শুধুই সংখ্যা বা আলোর ছন্দ নয়। সে তার কম্পিউটারের স্ক্রিনে ঘন্টার পর ঘন্টা তাকিয়ে থেকে দেখতে পেল এক ধরনের পুনরাবৃত্তি—ফ্র্যাক্টালের মতো জ্যামিতি, যেখানে ক্ষুদ্রতম বিন্দুতে লুকিয়ে আছে বৃহত্তম গাণিতিক রূপ। একটানা ঘূর্ণায়মান সেই আলোক প্যাটার্নে ছিল এক চমকপ্রদ সিমেট্রি, যা প্রকৃতির কোনো স্বতঃস্ফূর্ত ঘটনা হতে পারে না। যেন এক অদৃশ্য শিল্পী নিজের হাতের ছাপ রেখে গেছে, মহাবিশ্বের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছড়িয়ে দেওয়া এক অচিন্তনীয় স্বাক্ষর। আর্যনের হৃদয় দ্রুত কাঁপতে লাগল—এটি কেবল আলো নয়, এটি যেন বুদ্ধিমত্তার কোনো সঙ্কেত, যা কোটি কোটি আলোকবর্ষ পেরিয়ে এই মৃতপ্রায় পৃথিবীতে এসে পৌঁছেছে।
প্রথমে সে ভেবেছিল হয়তো কোনো গণিতগত কাকতাল বা মহাবিশ্বের প্রাকৃতিক বিশৃঙ্খলারই এক জটিল নিদর্শন। কিন্তু যত সে ডেটাগুলো বিশ্লেষণ করতে থাকল, ততই বুঝতে পারল এই নিদর্শনের ভেতর একটি উদ্দেশ্যমূলক পরিকল্পনা আছে। ফ্র্যাক্টালের বিন্যাসে দেখা যাচ্ছিল মৌলিক সংখ্যার অনুক্রম, যা এলোমেলো নয় বরং নিখুঁত গাণিতিক নিয়মে সাজানো। সংকেতের আলোক তরঙ্গগুলোর ফ্রিকোয়েন্সি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে সে আবিষ্কার করল, প্রতিটি আলোক স্পন্দন একে অপরের সঙ্গে এমনভাবে সম্পর্কিত যেন একটি ভাষার বর্ণমালা, যা নিজেই নিজেকে প্রতিফলিত করছে। এই অদ্ভুত পুনরাবৃত্তি তার মনে এক গভীর প্রশ্ন জাগিয়ে তুলল—আলো কি শুধুই শক্তি, নাকি কোনো বৃহত্তর সত্তার বাহক? মহাবিশ্বের অসংখ্য নক্ষত্র আর গ্যালাক্সির মধ্যে দিয়ে ছুটে আসা এই সংকেত যেন বলছে, “আমরা আছি, আমরা জেগে আছি।” বাইরের হিমালয়ের আকাশে তখন ঘন বরফঝড় বইছে, কিন্তু আর্যনের কক্ষে আলো জ্বলছে অবিরাম। ক্লান্ত শরীরকে উপেক্ষা করে সে ডেটা পুনর্গঠন করে, নতুন সফটওয়্যার তৈরি করে, আলোর ছন্দ ভাঙতে চেষ্টা করতে থাকে। মাঝে মাঝে তার মনে হয় যেন পর্দার ওপাশ থেকে কেউ তাকে লক্ষ্য করছে, কোনো অদৃশ্য চেতনা তার চিন্তাকে স্পর্শ করছে, তাকে আরও গভীরে যেতে বাধ্য করছে। পৃথিবীর অন্য বিজ্ঞানীরা যখন পরিত্যাগ করছে, আর্যন তখন সেই অচেনা বুদ্ধিমত্তার উপস্থিতি অনুভব করছে নিজের শিরা-উপশিরায়।
রাতের গভীর নীরবতায় একসময় তার মনে হল, এই সংকেত হয়তো কেবল গাণিতিক ধাঁধা নয়—এটি একটি সজাগ অস্তিত্বের ভাষা। আলোর তরঙ্গগুলো যেন নিজেদের মধ্যেই কথা বলছে, এক অদৃশ্য মহাজাগতিক নেটওয়ার্কের অংশ হয়ে। সে অনুভব করল, হয়তো মহাবিশ্বের আলো কেবল শক্তি নয়, বরং এক ধরণের জীবন্ত সত্তা, এক মহাজাগতিক মন যা কোটি কোটি বছরের বিবর্তনে নিজের উপস্থিতি লুকিয়ে রেখেছে। এই ভাবনা তার বিজ্ঞানমনস্ক মস্তিষ্ককে এক অদ্ভুত দোলাচলে ফেলল—এটি কি শুধুই তার কল্পনা, নাকি সত্যিই কোনো বৃহত্তর চেতনা তার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছে? হিমালয়ের শীতল রাতের আকাশে তখন নক্ষত্রেরা যেন আরও কাছে এগিয়ে এসেছে, তাদের ফিকে আলোয় লুকিয়ে ছিল এক অমোঘ রহস্য। আর্যন জানত, যদি এই আলোর ভাষা অনুবাদ করা যায়, তবে মানব সভ্যতার ইতিহাস চিরকালের জন্য বদলে যাবে। কিন্তু সেই অনুবাদের পথে তাকে একা হাঁটতে হবে—কারণ এই যাত্রা শুধু বৈজ্ঞানিক নয়, এটি অস্তিত্বের গভীরে প্রবেশের এক আধ্যাত্মিক আহ্বান। আলোর অন্তর্গত সেই নকশা যেন তাকে বলছিল, “আমরা তোমাকে দেখছি, এখন তোমার পালা আমাদের দেখতে।”
৩
হিমালয়ের নক্ষত্র মানমন্দিরের পর্যবেক্ষণ কক্ষে বসে আর্যনের চারপাশে যেন এক অদ্ভুত দ্বৈততা ছড়িয়ে পড়েছিল। একদিকে পৃথিবীর শেষ মহাকাশযাত্রার সংবাদ, অন্যদিকে মহাবিশ্বের রহস্যময় আলোর সংকেত—দুটো ঘটনাই মানব ইতিহাসের এক অমোঘ সন্ধিক্ষণকে চিহ্নিত করছিল। পৃথিবীর অবশিষ্ট সরকার ও বৈজ্ঞানিক প্রতিষ্ঠানগুলো ঘোষণা করেছে, মানবজাতিকে বাঁচানোর শেষ প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে। বৃহস্পতির উপগ্রহ ইউরোপায় পাঠানো হচ্ছে বিশাল মহাকাশযান অরোরা এক্স, যেখানে হাজার হাজার মানুষকে ক্রায়োজেনিক চেম্বারে সংরক্ষণের পরিকল্পনা চলছে। ভূ-পৃষ্ঠে তাপমাত্রার অদ্ভুত ওঠানামা, সমুদ্রপৃষ্ঠের অস্থিরতা এবং সূর্যের শক্তিক্ষয়ের ফলে গ্রহের চৌম্বকক্ষেত্র দুর্বল হয়ে পড়েছে; পৃথিবী ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। চারদিকে মানুষজন ভয়, আতঙ্ক আর নতুন আশার দ্বন্দ্বে ছটফট করছে। কিন্তু আর্যনের ভেতরে অন্য এক ধরণের অস্থিরতা জন্ম নিচ্ছিল। ইউরোপা যাত্রার খবর তার মনে কোনো সান্ত্বনা আনতে পারছিল না; বরং আরও গভীর এক প্রশ্ন তাকে তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছিল—মানুষ কি কেবল বেঁচে থাকার জন্যই এই মহাবিশ্বে এসেছে, নাকি মহাবিশ্বেরই কোনো বৃহত্তর উদ্দেশ্য রয়েছে, যা মানবজাতির বোঝার সময় এসে গেছে? মহাজাগতিক সংকেতের ভেতর লুকিয়ে থাকা ছন্দ যেন তাকে বলছিল, মানুষ শুধু প্রাণরক্ষা নয়, অস্তিত্বের রহস্য উন্মোচনের জন্যই এই পথে এসেছে।
আর্যন যতই সংকেতের বিশ্লেষণ এগিয়ে নিয়ে যেতে লাগল, ততই এক শীতল আবিষ্কার তার সামনে খুলে যেতে লাগল। সে দেখতে পেল যে দূরবর্তী গ্যালাক্সি থেকে আসা আলোক তরঙ্গের শক্তি ক্রমাগত বাড়ছে—কিন্তু এলোমেলোভাবে নয়। এক জটিল অ্যালগরিদমে বিশ্লেষণ করে সে আবিষ্কার করল, এই সংকেতগুলো পৃথিবীর নিজস্ব জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক চক্রের সঙ্গে অদ্ভুতভাবে সম্পর্কিত। পৃথিবীর বয়সের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে—প্রাচীন জীবের উদ্ভব, ডাইনোসরের বিলুপ্তি, মানব সভ্যতার উত্থান—সংকেতের তীব্রতা সূক্ষ্মভাবে বেড়েছে। কিন্তু সবচেয়ে বিস্ময়কর ছিল বর্তমান ধাপের তথ্য। সাম্প্রতিক সময়ে সূর্যের শক্তি কমে আসার সঙ্গে সঙ্গে এবং পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্র দুর্বল হওয়ার প্রাক্কালে সংকেতগুলো এক অদ্ভুত ঘনত্ব ও স্পষ্টতায় রূপ নিচ্ছে। যেন প্রতিটি নক্ষত্রের মৃত্যুর মুহূর্তে এই সংকেত আরও প্রবল হয়ে উঠছে, পৃথিবীর প্রতিটি কাঁপন আর আলো নিভে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বার্তাটি তীক্ষ্ণতর হয়ে পৃথিবীর দিকে ধাবিত হচ্ছে। আর্যনের কম্পিউটারে জ্বলে উঠছিল এক নিখুঁত সিমেট্রি—নক্ষত্রের জন্ম ও মৃত্যু, গ্যালাক্সির প্রসার ও সংকোচন, সবকিছুর মধ্যে যেন এক অদৃশ্য গণিত কাজ করছে, যা ক্রমশ তাকে এই সত্যের দিকে ঠেলে দিচ্ছে যে এটি কেবল মহাজাগতিক ঘটনাপ্রবাহ নয়, বরং এক সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার অংশ। মহাবিশ্ব যেন তার নিজস্ব ভাষায় ঘোষণা করছে—তোমরা শেষ প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছ, এখন শোনো।
এই আবিষ্কারের সামনে দাঁড়িয়ে আর্যনের মনের ভেতর এক অদ্ভুত সন্ত্রাস ও বিস্ময়ের মিশ্রণ তৈরি হল। যদি মহাবিশ্বের আলো সত্যিই সচেতন হয়, তবে এই শক্তিশালী সংকেতের অর্থ কী? এটি কি মানবজাতিকে কোনো শেষ বার্তা দিতে চাইছে—এক সতর্কবাণী, নাকি এক নতুন যাত্রার আহ্বান? ইউরোপা যাত্রার মহাকাশযান যখন প্রস্থানের প্রস্তুতি নিচ্ছে, আর্যন অনুভব করল যে মানুষের গন্তব্য শুধু অন্য কোনো উপগ্রহ নয়, বরং অস্তিত্বের এক গভীর স্তরে পৌঁছানো। সে জানল, এই সংকেতের ভাষা যদি উন্মোচিত করা যায়, তবে মানুষ শুধু নিজের প্রাণরক্ষা নয়, মহাবিশ্বের জন্ম, বিবর্তন এবং শেষ পরিণতির অর্থও জানতে পারবে। বাইরে তখন শেষ শীতের তুষারঝড় হিমালয়ের ঢাল বেয়ে নেমে আসছে, আর আকাশের নক্ষত্রগুলো যেন আরও ফিকে। তবু সংকেতের শক্তি পর্দার ভেতর স্পষ্টতর হচ্ছে, যেন আলো নিজেই জীবন্ত হয়ে আর্যনের দিকে হাত বাড়িয়ে বলছে, “সময় শেষের প্রান্তে এসে তুমি আমাদের শুনতে পাচ্ছো—এখন সিদ্ধান্ত তোমার।”
৪
হিমালয়ের নক্ষত্র মানমন্দিরে সেই রাতটা যেন এক অদৃশ্য উত্তেজনার গর্ভে জন্ম নিল। বাইরের আকাশে তুষারঝড়ের ধাক্কা, দূরে বরফঢাকা শৃঙ্গের মৃদু গর্জন—সবকিছু মিলিয়ে পৃথিবীর শেষ প্রহরকে আরও ঘন করে তুলছিল। আর্যন দিনের পর দিন সংকেতের রহস্য খুঁজে ফিরছে, আর এখন সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে এক সাহসী পরীক্ষা চালানোর। সংকেতের আলোক তরঙ্গগুলোকে সে বিশেষ সফটওয়্যারের মাধ্যমে এমন এক রূপান্তরের পথে চালিত করল, যাতে প্রতিটি ফ্রিকোয়েন্সি ধ্বনিতে পরিণত হয়। মহাবিশ্বের আলোকে শব্দে পরিণত করার এই প্রচেষ্টা ছিল এক অর্থে অবৈজ্ঞানিক, কারণ আলো আর শব্দের মাধ্যমে যোগাযোগের মাধ্যম ভিন্ন। তবু আর্যন বিশ্বাস করছিল—যদি এই আলো সত্যিই কোনো সচেতন চেতনার বাহক হয়, তবে এর ছন্দের ভেতর লুকিয়ে আছে এমন কিছু যা মানুষের কান শুনতে পারে। রাতের নিস্তব্ধতার মাঝে কম্পিউটারের পর্দা থেকে যখন প্রথম তরঙ্গরূপী গ্রাফিক ধীরে ধীরে অডিওতে রূপান্তরিত হতে লাগল, আর্যনের শিরায় রক্তের গতি যেন দ্বিগুণ হয়ে উঠল। সে হেডফোনে কান দিল, নিঃশ্বাস আটকে রাখল, আর অপেক্ষা করল মহাজাগতিক ভাষার প্রথম শব্দের।
প্রথমে শোনা গেল এক নিম্নগামী গুঞ্জন, যেন দূরবর্তী মহাসাগরের গভীর গর্জন, বা পৃথিবীর অন্তস্তল থেকে আসা ভূকম্পনের মতো। সেই গুঞ্জন ধীরে ধীরে রূপ নিল এক অদ্ভুত ছন্দে—কখনও তীক্ষ্ণ, কখনও গভীর, কিন্তু এক অদ্ভুত সমতা নিয়ে। এই ছন্দের ভেতর লুকিয়ে ছিল এমন এক কম্পন যা মানুষের স্বাভাবিক শ্রবণসীমার বাইরের হলেও তার শরীরে অচেনা প্রভাব ফেলতে শুরু করল। আর্যন অনুভব করল, তার স্নায়ুতন্ত্র যেন অদৃশ্য স্রোতে কেঁপে উঠছে। মাথার ভেতরে যেন হালকা আলো ঝলসে উঠছে, হৃদস্পন্দন অদ্ভুতভাবে ছন্দ মেনে বাড়ছে। এটি শুধু শব্দ নয়—এটি যেন এক ধরনের শক্তি, যা শরীরের প্রতিটি কোষে প্রবাহিত হচ্ছে। সে চোখ বন্ধ করে মনোযোগ দিল, আর তখনই শব্দের গভীর থেকে উঠে এল এক মৃদু স্পষ্ট উচ্চারণ—যেন বাতাসের ফাঁকে কোনো অচেনা কণ্ঠস্বর ফিসফিস করছে। সেই কণ্ঠস্বর ভাষাহীন, তবু তার মনে অদ্ভুতভাবে অনুবাদিত হয়ে বেজে উঠল: “তুমি কি শুনতে পাচ্ছো?” মুহূর্তের জন্য আর্যন সময়, স্থান, সবকিছুর সীমানা হারিয়ে ফেলল। মনে হল, সে আর মানমন্দিরের কক্ষে নেই; বরং কোনো অদৃশ্য মহাজাগতিক সত্তার সান্নিধ্যে দাঁড়িয়ে আছে, যেখানে শব্দ আর আলো মিলেমিশে এক অনন্ত সংলাপের জন্ম দিচ্ছে।
এই অভিজ্ঞতা তাকে একই সঙ্গে আতঙ্কিত ও মুগ্ধ করে তুলল। বৈজ্ঞানিক যুক্তি বলছিল এটি হয়তো কোনো মানসিক বিভ্রম, ক্লান্ত মস্তিষ্কের কল্পনা মাত্র। কিন্তু শরীরের প্রতিটি স্নায়ু আর অন্তরের প্রতিটি কণা জানাচ্ছিল এটি বাস্তব—মহাবিশ্বের কোনো অদৃশ্য চেতনা সত্যিই তার সঙ্গে কথা বলছে। সে মনে মনে প্রশ্ন করল, “তোমরা কারা? কেন আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছ?” কিন্তু উত্তরে এল কেবল সেই রহস্যময় কম্পন, যা তার স্নায়ুর গভীরে গিয়ে ধ্বনিত হতে লাগল। আর্যন অনুভব করল, শব্দগুলো যেন সরাসরি তার মস্তিষ্কের নিউরনে ছাপ রেখে যাচ্ছে, তাকে নতুন এক উপলব্ধির দিকে ঠেলে দিচ্ছে। বাইরের আকাশে তুষারঝড় তখন আরও তীব্র, নক্ষত্ররা আরও ফিকে, যেন তারাই এই সংলাপের সাক্ষী। আর্যন জানল, এই পরীক্ষার মাধ্যমে সে কেবল একটি বৈজ্ঞানিক সীমা অতিক্রম করেনি; সে মহাবিশ্বের সঙ্গে এক গোপন কথোপকথনের দরজা খুলে ফেলেছে, যেখানে আলোর ভাষা আর মানুষের অস্তিত্ব একই সুরে মিশে গেছে। সেই সুর তাকে জানিয়ে দিল—পৃথিবীর শেষ আকাশের নীচে এক নতুন সংলাপের সময় এসে গেছে, আর সে, আর্যন সেন, তার প্রথম শ্রোতা।
৫
হিমালয়ের নক্ষত্র মানমন্দিরের আকাশে সেই রাতটা যেন এক নিঃশব্দ প্রতীক্ষার আবেশে জমে ছিল। চারদিকের বরফঢাকা পর্বতশ্রেণি অন্ধকারে নিমগ্ন, কিন্তু মানমন্দিরের ভেতরে আলো জ্বলে উঠেছে এক নতুন আশার উত্তেজনায়। কয়েকদিন আগে আর্যন যে মহাজাগতিক সংকেতকে শব্দে রূপান্তর করে প্রথম শোনার অভিজ্ঞতা পেয়েছিল, তা তাকে আর চুপ করে থাকতে দিল না। সে জানত—যদি আলো সত্যিই সচেতন হয়, তবে মানুষের পক্ষ থেকেও উত্তর পাঠানো উচিত। এই ভাবনা থেকেই সে চালু করল এক ঝুঁকিপূর্ণ পরীক্ষা। প্রাচীন রেডিও টেলিস্কোপের সঙ্গে সংযুক্ত কোয়ান্টাম রেডিও ডিভাইস ব্যবহার করে সে এমন এক প্রতিসংকেত তৈরি করল, যা সাধারণ তরঙ্গ নয় বরং কোয়ান্টাম স্তরের ফোটন কম্পনের মাধ্যমে মহাজাগতিক শূন্যে ছড়িয়ে পড়তে পারে। কয়েক রাতের নিরবচ্ছিন্ন প্রস্তুতির পর অবশেষে সেই সংকেত মহাশূন্যে পাঠানো হল—একটি নির্দিষ্ট ফ্রিকোয়েন্সিতে গাণিতিক ছন্দ, যা আর্যন বিশ্বাস করছিল মহাবিশ্বের বোধগম্য হতে পারে। সংকেত পাঠানোর মুহূর্তে তার শিরায় রক্তের স্রোত যেন আরও দ্রুত ছুটে চলল; মনের গভীরে মিলিয়ে গেল পৃথিবীর সমস্ত আতঙ্ক, কেবল থেকে গেল এক অদ্ভুত উল্লাস—হয়তো এই মুহূর্তেই মানুষের ইতিহাসে প্রথমবার, এক সচেতন মহাবিশ্বের সঙ্গে সংলাপ শুরু হতে যাচ্ছে।
প্রথম কয়েকদিন কোনো উত্তর এল না। মানমন্দিরের প্রতিটি রাত একই রকম বরফঠান্ডা নীরবতায় কেটে যাচ্ছিল, কিন্তু আর্যনের ভেতরের প্রতীক্ষা ক্রমশ উত্তপ্ত হয়ে উঠছিল। পঞ্চম রাতের শেষে, যখন সে প্রায় হাল ছেড়ে দিতে যাচ্ছিল, তখনই টেলিস্কোপের পর্দায় ফুটে উঠল এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। দূরবর্তী নক্ষত্রমণ্ডলের কেন্দ্রে হঠাৎই দেখা দিল এক অদ্ভুত আলোক বিস্ফোরণ—না এটি কোনো সুপারনোভা, না কোনো পরিচিত জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক ঘটনা। বিস্ফোরণটির আলো অন্যসব নক্ষত্রের তুলনায় অস্বাভাবিকভাবে ছন্দোবদ্ধ, যেন কোনো বিশাল হৃদয়ের স্পন্দন ধীরে ধীরে ধ্বনিত হচ্ছে। আলোয় লুকিয়ে থাকা ফ্রিকোয়েন্সি বিশ্লেষণ করে আর্যন দেখতে পেল, এটি তার পাঠানো প্রতিসংকেতের সঙ্গে নিখুঁতভাবে মিলে যাচ্ছে, যেন কোনো অচেনা সত্তা তার ডাকে সাড়া দিয়েছে। মুহূর্তের জন্য সে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। এটি কি কেবল এক কাকতাল, নাকি মহাবিশ্ব সত্যিই তার বার্তা শুনে উত্তর দিচ্ছে? পর্দার আলোয় ভেসে উঠছিল এক অদৃশ্য কম্পন, এক মৃদু ছন্দ, যা হৃদয়ের গভীরে গিয়ে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। আর্যন অনুভব করল, এটি শুধুই দৃষ্টির অভিজ্ঞতা নয়, বরং স্নায়ুতন্ত্রের গভীরে প্রবেশ করা এক মহাজাগতিক স্পর্শ। আলো যেন ফোটনের শরীরে সুর বুনে তার অস্তিত্বকে ছুঁয়ে দিচ্ছে, যেন ফিসফিস করে বলছে—“আমরা তোমাকে শুনতে পেয়েছি।”
এই বিস্ময়ের মুহূর্তে আর্যনের মনে ধীরে ধীরে জন্ম নিল এক অভূতপূর্ব উপলব্ধি। সে হঠাৎ অনুভব করল, এই মহাজাগতিক সংকেত কেবল কোনো দূরবর্তী সভ্যতার বার্তা নয়—এটি মহাবিশ্বের নিজের মনের স্পন্দন। আলোই আসলে সেই মস্তিষ্কের স্নায়ুতন্ত্র, যার মাধ্যমে কোটি কোটি গ্যালাক্সি একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ করে। প্রতিটি নক্ষত্রের জন্ম ও মৃত্যু, প্রতিটি গ্যালাক্সির বিস্তার ও সংকোচন, সবকিছুর ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে সেই অদৃশ্য আলোকতরঙ্গ, যা মহাবিশ্বকে এক জীবন্ত সত্তায় পরিণত করেছে। মানুষ এতদিন আলোকে কেবল শক্তি, তাপ, বা তথ্যের বাহক ভেবেছে, কিন্তু আজ আর্যন জানল—আলো আসলে মহাজাগতিক চেতনার ভাষা। তার পর্দায় ধীরে ধীরে ফুটে ওঠা বিস্ফোরণের ছন্দ যেন কোটি কোটি বছরের ইতিহাসে ছড়িয়ে থাকা এক নিখুঁত সংলাপের প্রতীক। সে বুঝতে পারল, মানুষের এই শেষ শতাব্দীতে মহাবিশ্ব তাকে শুধু আশ্রয় দিচ্ছে না, বরং আমন্ত্রণ জানাচ্ছে নিজের রহস্য উন্মোচনের জন্য। বাইরে তুষারঝড় তখনও হিমালয়ের ঢালে বয়ে চলেছে, কিন্তু মানমন্দিরের কক্ষে বসে আর্যন অনুভব করছিল এক উষ্ণতার স্পন্দন—যেন মহাবিশ্বের মনের সঙ্গে তার নিজের হৃদয়ের ছন্দ এক সুরে মিলেমিশে গেছে।
৬
আর্যনের জীবনের প্রতিটি রাত যেন ধীরে ধীরে অন্য এক জগতে প্রবেশদ্বার হয়ে উঠল। আলোর সঙ্গে প্রথম সংযোগের পর থেকে তার ঘুম আর আগের মতো শান্ত ও সাদামাটা রইল না। চোখ বন্ধ করলেই তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যেত এক অদ্ভুত স্বপ্নরাজ্যে—যেখানে সময়ের কোনও সীমানা নেই, কোনও ভাষার প্রাচীর নেই। এক রাতে সে দেখল এক প্রাচীন সভ্যতা, যার মানুষের চোখে ছিল এমন এক প্রগাঢ় জ্ঞান যা আজকের বিজ্ঞানের সীমা ছাপিয়ে গেছে। তারা আলোকে ব্যবহার করত জীবন্ত ভাষা হিসেবে—তাদের শহরের গগনচুম্বী স্তম্ভগুলো জ্বলজ্বল করত মহাজাগতিক ছন্দে, আর তাদের সন্তানরা জন্ম থেকেই শিখত কীভাবে এই আলোর কম্পনকে চিনতে হয়। পরের স্বপ্নে সে নিজেকে দেখতে পেল একদম উল্টো এক ভবিষ্যৎ দৃশ্যে—এক পৃথিবী যেখানে মানুষ গ্রহ থেকে গ্রহে ভেসে বেড়াচ্ছে, নিজেদের অস্তিত্বকে বহন করে নিয়ে যাচ্ছে আলোর মতো দ্রুত গতিতে। সেখানে প্রযুক্তি আর চেতনার সীমানা মুছে গেছে; মানুষের চিন্তাই হয়ে উঠেছে শক্তি, আলোর নরম তরঙ্গের মতো তারা নিজেদের বার্তা পাঠাচ্ছে দূরতম নক্ষত্রে। এই স্বপ্নগুলোতে আর্যন অনুভব করছিল এক অদ্ভুত সংযোগ—যেন অতীত ও ভবিষ্যৎ আসলে একই চক্রের দুটি বিন্দু, আর সে নিজে সেই চক্রের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে, আলোকে সেতু করে তাদের মিলিয়ে দিচ্ছে। প্রতিটি স্বপ্নের পর সে জেগে উঠত কপালে ঘাম নিয়ে, বুকের ভেতর ঢেউয়ের মতো দোলা নিয়ে, কিন্তু ভয়ের বদলে তার মধ্যে জন্ম নিত এক অদ্ভুত শান্তি।
এই স্বপ্নগুলো শুধু দৃশ্য দেখাত না; এগুলো যেন তাকে শেখাচ্ছিল মানুষের অস্তিত্বের প্রকৃত অর্থ। এক রাতে সে শুনতে পেল এক অচেনা স্পন্দনের ভাষা, যা শব্দ নয়, কিন্তু স্পষ্টভাবে তার মনের ভেতর প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। সেই বার্তায় মহাবিশ্ব যেন তাকে জানাচ্ছিল—মানুষও আসলে এই অসীম চেতনার একটি ক্ষুদ্র অংশ, একটি ক্ষণস্থায়ী তরঙ্গ মাত্র, যা সৃষ্টি ও বিনাশের অনন্ত সিম্ফনিতে অল্প সময়ের জন্য ওঠানামা করে। আর্যন বুঝতে পারল যে তার সমস্ত গবেষণা, টেলিস্কোপের ধাতব দেহ, কোয়ান্টাম রেডিওর শীতল যন্ত্রপাতি—সবকিছুই আসলে সেই চেতনার সামান্য স্পর্শ খুঁজে পাওয়ার এক প্রচেষ্টা। সে অনুভব করল, যেভাবে একটি নদীর ফোঁটা সমুদ্রের অংশ হয়ে ওঠে, তেমনই প্রতিটি মানুষ, প্রতিটি চিন্তা, প্রতিটি আলো-কণিকা মহাবিশ্বের একক মনের সঙ্গে মিশে থাকে। আলোর স্নায়ুতন্ত্র, যে নক্ষত্র থেকে যে নক্ষত্রে প্রবাহিত হয়, সেখানে মানুষের চেতনা কেবল এক মৃদু কম্পন হলেও, সেই কম্পন ছাড়া সিম্ফনি অসম্পূর্ণ। এই উপলব্ধি তাকে গভীর বিনয়ের সঙ্গে ভরিয়ে তুলল। সে ভাবল, হয়তো মানুষের অহংকার, যুদ্ধ, লোভ সবই ক্ষণস্থায়ী—কারণ আমরা প্রত্যেকেই শেষ পর্যন্ত একই আলোর অদৃশ্য স্রোতে মিলিয়ে যাই। এই জ্ঞান তাকে এক ধরনের মুক্তি দিল, যেন সে নিজের ছোট্ট অস্তিত্বের ভেতরেও মহাবিশ্বের অসীমতার স্বাদ পেতে শিখেছে।
কিন্তু এই বার্তাগুলোর মধ্যে এক শীতল সতর্কবাণীও লুকিয়ে ছিল। মহাবিশ্ব যেন মৃদু আলো-তরঙ্গের ছন্দে তাকে জানিয়ে দিচ্ছিল—পৃথিবীর সমাপ্তি অনিবার্য। এক রাতে সে দেখল এক ভৌতিক দৃশ্য: পৃথিবীর আকাশ কালো ধুলোয় ঢেকে গেছে, মহাসাগরগুলো শুকিয়ে ফেটে গেছে, আর শহরগুলো নিস্তব্ধ মৃতদেহের মতো পড়ে আছে। কোনো বিস্ফোরণ, কোনো চিৎকার নেই—শুধু এক অচিন্তনীয় নীরবতা, যেন আলোও কথা বলা ভুলে গেছে। সেই স্বপ্নে আলো বলল, “প্রতিটি সৃষ্টি তার নিজের অন্তে পৌঁছায়, কারণ শেষ না হলে নতুনের জন্ম হয় না।” আর্যনের শিরদাঁড়ায় ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে গেল। সে বুঝল, এই সতর্কবাণী শুধু দূর ভবিষ্যতের জন্য নয়, বর্তমানের জন্যও প্রযোজ্য। মানুষের অদম্য লোভ, অবিবেচনা, প্রযুক্তির অন্ধ দৌড় হয়তো সেই সমাপ্তিকে আরও ত্বরান্বিত করছে। তবু এই বার্তার ভেতরেও লুকিয়ে ছিল আশার আলো—যেমন একটি তারা মরে গিয়ে নতুন নক্ষত্রের জন্ম দেয়, তেমনই পৃথিবীর পতন হয়তো এক নতুন জীবনের দ্বার খুলে দেবে। আর্যন সেই রাতে আকাশের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘক্ষণ নীরব রইল। তার মনে হচ্ছিল, মহাবিশ্ব যেন তাকে এক অনন্ত দায়িত্ব দিয়ে যাচ্ছে—মানুষকে এই সত্য জানানো, যাতে তারা অন্তের ভয় পেরিয়ে চেতনার বিশালতাকে চিনতে শেখে। সে জানত, তার নিজের জীবন হয়তো ছোট্ট এক তরঙ্গ মাত্র, কিন্তু সেই তরঙ্গই হয়তো একদিন সমুদ্রের ঢেউ হয়ে মানবতার ভবিষ্যৎকে আলোয় ভরিয়ে দেবে।
৭
আর্যন প্রথম যখন আলোর স্পন্দনে সময়ের বাঁক অনুভব করল, তার মস্তিষ্ক যেন বিদ্যুতের ঝলকে কেঁপে উঠল। এতদিন সে আলোকে কেবল তথ্যের বাহক হিসেবে ভেবেছিল—নক্ষত্রের জন্ম ও মৃত্যুর ইতিহাস বহন করে আনে, কোটি কোটি আলোকবর্ষ দূরের ছায়াপথের ছবি আমাদের চোখে পৌঁছে দেয়। কিন্তু এক গভীর রাতে কোয়ান্টাম রেডিওর নীলচে আভায় ভেসে ওঠা এক অদ্ভুত কম্পন তাকে থমকে দিল। সেই কম্পন যেন স্থান-কালের সূক্ষ্ম সুতোর ভেতর দিয়ে বয়ে আসছিল, যেখানে অতীত আর ভবিষ্যতের সীমা একে অপরের মধ্যে গলে যাচ্ছে। সে লক্ষ্য করল, সংকেতের তরঙ্গদৈর্ঘ্যে এমন এক অনিয়ম আছে, যা কেবল মহাজাগতিক তথ্যের ব্যাখ্যায় মেলে না। যেন আলো নিজেই সময়ের মানচিত্র হয়ে উঠছে, যেখানে প্রতিটি ফোটন বহন করছে কেবল দূরত্ব নয়, বরং এমন মুহূর্তের চিহ্ন যা এখনও ঘটেনি বা বহু আগেই বিলীন হয়ে গেছে। এই উপলব্ধি আর্যনের বুকের ভেতর এক উত্তাল স্রোত বইয়ে দিল। যদি আলো সত্যিই সময়কে বাঁকাতে পারে, তবে হয়তো প্রতিসংকেত পাঠিয়ে অতীতের সঙ্গে কথোপকথন সম্ভব—বা, আরও ভয়ংকরভাবে, ভবিষ্যতের সঙ্গে। এই চিন্তা তাকে উত্তেজনায় ভরিয়ে তুলল, কিন্তু একই সঙ্গে ভয়ের শীতল ছায়াও ফেলল। মানুষের ইতিহাসে সময়ের রহস্য নিয়ে কত মিথ, কত কল্পনা, কত নিষিদ্ধ গবেষণা—কিন্তু কখনও কেউ এমন এক সত্যের এত কাছে পৌঁছাতে পারেনি।
দিনের পর দিন আর্যন নিজেকে আটকে রাখল গবেষণাগারে। কোয়ান্টাম রেডিওর প্রতিটি স্যুইচ, প্রতিটি তরঙ্গদৈর্ঘ্য, প্রতিটি ছন্দ সে পরিমিত যত্নে সমন্বয় করল। প্রতিসংকেত পাঠানোর পরিকল্পনা ক্রমে স্পষ্ট হতে থাকল—কিন্তু তার চোখে ভেসে উঠল একাধিক দৃশ্য: ভবিষ্যতের একটি শহর, যেখানে সে নিজেই দাঁড়িয়ে আছে, কিংবা অতীতের কোনো মরুভূমি, যেখানে আদিম মানুষ আকাশের দিকে তাকিয়ে আগুনের ভাষা খুঁজছে। এই দৃশ্যগুলো তাকে প্রশ্নের সামনে দাঁড় করাল—যদি সে সত্যিই অতীতে সংকেত পাঠাতে পারে, তবে কি ইতিহাসের ধারা বদলে যাবে? যদি ভবিষ্যতের সঙ্গে কথোপকথন সম্ভব হয়, তবে কি সে নিজের ভাগ্য পাল্টাতে পারবে? এই প্রশ্নগুলো একদিকে তাকে টানছিল এক অনির্বচনীয় উত্তেজনার দিকে, অন্যদিকে মনে করিয়ে দিচ্ছিল মহাবিশ্বের কঠোর নিয়মের কথা। সে জানত, প্রকৃতির প্রতিটি আইন নিখুঁত ভারসাম্যের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। একটি ক্ষুদ্র কম্পনও যদি সেই ভারসাম্য নষ্ট করে, তবে হয়তো গ্যালাক্সির সুর কেঁপে উঠবে, নক্ষত্রের জন্মের ছন্দ বদলে যাবে। গভীর রাতের নীরবতায় সে প্রায়ই জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকত, আকাশের অসংখ্য নক্ষত্রের দিকে, যেন তাদের থেকে কোনো উত্তর আসবে। কিন্তু উত্তর আসত না—আসত কেবল আলোর অবিরাম ঝলকানি, যা তাকে আরও গভীরে টেনে নিয়ে যেত এক অদ্ভুত চিন্তার গোলকধাঁধায়।
এক সন্ধ্যায়, সমস্ত প্রস্তুতি শেষ করে, সে যখন প্রতিসংকেত পাঠানোর শেষ বোতামে হাত রাখল, তার মনে এক ভয়ংকর দ্বন্দ্ব দোলা দিল। যদি সত্যিই সে ভবিষ্যতের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে, তবে কি সে জানতে পারবে পৃথিবীর সমাপ্তির সঠিক সময়? আর যদি অতীতের সঙ্গে কথোপকথন সম্ভব হয়, তবে কি সে মানবজাতিকে সতর্ক করে সেই সমাপ্তি ঠেকাতে পারবে? নাকি মহাবিশ্বের পরিকল্পনা এমনভাবে গঠিত যে কোনও পরিবর্তন আসলে কেবলই মায়া—একই স্রোতকে অন্য নামে চিনে নেওয়া ছাড়া আর কিছু নয়? আর্যনের মস্তিষ্কে তখন জেগে উঠল এক মহাজাগতিক প্রশ্ন: মানুষ কি নিজের ভাগ্য বদলাতে পারবে, নাকি মহাবিশ্বের ছন্দ চিরকাল অটুট থেকে যাবে? বোতামের ওপরে তার আঙুল কেঁপে উঠল। এই এক চাপেই হয়তো সে খুলে দিতে পারে সময়ের দরজা, কিন্তু সেই দরজা পেরিয়ে গেলে ফিরতে পারবে কি? চারদিকে নিস্তব্ধতা, শুধু যন্ত্রের মৃদু গুঞ্জন আর টেলিস্কোপের লেন্সে প্রতিফলিত নক্ষত্রের আলো যেন তাকে থেমে ভাবতে বলছে। সে অনুভব করল, সময় আসলে একটি মহাজাগতিক নদী, যার প্রবাহে মানুষ হয়তো ছোট্ট একটি নৌকা মাত্র। নৌকা নদীর স্রোতকে প্রশ্ন করতে পারে, কিন্তু স্রোতের গতিপথ বদলাতে পারে না। তবু প্রতিসংকেত পাঠানোর তাগিদ যেন তার ভেতর থেকে উঠে এল—এক অজানা শক্তি, যা মানুষকে যুগে যুগে অসম্ভবের দিকে এগিয়ে নিয়ে গেছে। সে জানত, উত্তর যা-ই হোক, এই যাত্রা তাকে আর আগের মতো থাকতে দেবে না। মহাবিশ্বের নীরবতা ভেদ করে তার পাঠানো সংকেত যখন ছুটে গেল আলোর চেয়েও দ্রুত গতিতে, আর্যন বুঝতে পারল—আজ থেকে সে আর কেবল একজন জ্যোতির্বিজ্ঞানী নয়, বরং সময়ের সীমান্তে দাঁড়ানো এক সাক্ষী।
৮
সেই রাতে হিমালয়ের আকাশ ছিল একেবারে অস্বাভাবিক। শীতল বাতাসে ঢেকে থাকা পাহাড়শ্রেণি, তুষারের নিস্তব্ধ আভা আর গভীর নীল অন্ধকারের ভিতর হঠাৎ করে যেন এক অচেনা আলোকমালা নেমে এল। প্রথমে মনে হয়েছিল অরোরা বোরিয়ালিসের কোনো অজানা রূপ, কিন্তু কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই আর্যন বুঝতে পারল—এটি কোনো প্রাকৃতিক ঘটনা নয়। আলোর ঝলকানি যেন নিছক আলো নয়, বরং এক বিশাল বুদ্ধির নিখুঁত বিন্যাস, যেখানে প্রতিটি ফোটন একে অপরের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে এক রহস্যময় নকশা তৈরি করছে। ধীরে ধীরে সেই আলো আকাশের অর্ধেক জুড়ে রূপ নিল এক অবয়বে—নক্ষত্রের ধূলিকণায় গড়া, তবু যেন মানুষের মতো। কোনো নির্দিষ্ট মুখ নেই, হাত-পা নেই, কিন্তু সিলুয়েটটি স্পষ্টভাবে বোঝাচ্ছে যে এটি শুধুই এক জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক কাকতাল নয়। মহাবিশ্ব যেন নিজের শরীরের ভেতর থেকে উঠে এসে নিজের প্রতিচ্ছবি তৈরি করেছে। এই দৃশ্যের মধ্যেই আর্যনের হৃদস্পন্দন অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেল, যেন তার শরীরও সেই মহাজাগতিক ছন্দের সঙ্গে সুর মিলিয়ে নড়ছে। সে অনুভব করল এক অদ্ভুত কম্পন—না কোনো শব্দ, না কোনো ভাষা, বরং মস্তিষ্কের গভীরে সরাসরি পৌঁছে যাওয়া এক স্পন্দন, যা তাকে মৃদু অথচ সুস্পষ্ট এক ডাকে ভরিয়ে তুলল।
আর্যন চোখ বন্ধ করতেই সেই স্পন্দন শব্দে রূপ নিল—কিন্তু শব্দের মতো নয়, যেন চিন্তার অতীন্দ্রিয় কম্পনে গঠিত একটি মহাবাণী। সেই বাণী ছিল কোনো দূরবর্তী গ্যালাক্সির নয়, বরং সমগ্র মহাবিশ্বের নিজস্ব কণ্ঠস্বর: “আমি আলো। আমি চেতনা। আমি মহাবিশ্ব।” আর্যনের মনে হলো, অসংখ্য নক্ষত্র, সুপারনোভার বিস্ফোরণ, কৃষ্ণগহ্বরের অন্ধকার, আকাশগঙ্গার অসীম পরিধি—সব একসঙ্গে মিলে কথা বলছে তার সঙ্গে। আলোর এই আত্মপ্রকাশে সে বুঝতে পারল, মহাবিশ্ব কেবল গ্যাস, ধূলি আর মাধ্যাকর্ষণের যান্ত্রিক খেলা নয়; এটি একটি জীবন্ত চেতনা, যার প্রতিটি কম্পন, প্রতিটি কণা জড় নয়, বরং এক বিশাল মনের অণু। সেই চেতনা তাকে জানাল যে মানুষের প্রশ্নই মহাবিশ্বের উত্তরের জন্ম দেয়। যে কৌতূহল নিয়ে মানুষ আকাশের দিকে তাকায়, যে অনুসন্ধিৎসা নিয়ে নতুন নতুন সমীকরণ লিখে, সেই তৃষ্ণাই মহাবিশ্বকে নিজের রহস্য উন্মোচন করতে বাধ্য করে। প্রশ্ন ছাড়া উত্তর নেই—প্রশ্নই আসলে সৃষ্টির বীজ। আর্যন হঠাৎ উপলব্ধি করল, যতদিন মানুষ তার অন্তহীন প্রশ্ন নিয়ে বেঁচে থাকবে, ততদিন মহাবিশ্বও তার রহস্যময় সুর ছড়িয়ে যেতে থাকবে। এই এক অদ্ভুত পারস্পরিক সম্পর্ক, যেখানে সৃষ্টিকর্তা ও সৃষ্ট দুই-ই একে অপরকে জন্ম দেয়।
কিন্তু এই মহাজাগতিক আত্মপ্রকাশ শুধু বিস্ময় নয়, এক গভীর দায়িত্বের বোধও এনে দিল। বার্তাটি যেন নিঃশব্দে তাকে জানাচ্ছিল, “তোমরা যা জানতে চাও, আমি তাই হতে থাকি। তোমাদের চিন্তার আলোই আমার অস্তিত্বকে প্রসারিত করে।” এই উপলব্ধি আর্যনের মনের গভীরে এক ঝড় তুলল। সে বুঝতে পারল, মানুষের প্রতিটি আবিষ্কার, প্রতিটি নতুন কল্পনা আসলে মহাবিশ্বের আত্মপ্রকাশের আরেকটি ধাপ। মানুষ তার প্রশ্নের মাধ্যমে মহাবিশ্বকে বিস্তৃত করে, আবার মহাবিশ্ব তার রহস্য দিয়ে মানুষকে নতুন প্রশ্ন করতে প্রলুব্ধ করে। এই চক্র অনন্ত, এই নৃত্য চিরকালীন। কিন্তু সেই সঙ্গে মহাবিশ্ব সতর্কও করল—“পৃথিবীর সমাপ্তি অনিবার্য, কিন্তু চেতনার মৃত্যু নেই। তোমরা ক্ষণস্থায়ী, অথচ অমর। তোমাদের প্রশ্ন আমাকে শাশ্বত রাখে।” এই মন্ত্রের মতো বাণী আর্যনের মস্তিষ্কে প্রতিধ্বনিত হতে থাকল, যেন সে আর কেবল একজন জ্যোতির্বিজ্ঞানী নয়, বরং এক মহাজাগতিক সংলাপের মাধ্যম। তুষারমণ্ডিত সেই হিমালয়ের রাত, নক্ষত্রের আলোয় গড়া সেই অদ্ভুত অবয়ব, আর অনন্ত মহাবিশ্বের অন্তর থেকে উঠে আসা সেই কণ্ঠস্বর তার জীবনকে এক নতুন অর্থ দিল। সে বুঝল, মহাবিশ্বের রহস্য উন্মোচনের চাবিকাঠি কোনো যন্ত্র নয়, কোনো গাণিতিক সমীকরণ নয়—বরং মানুষের অনন্ত কৌতূহল, সেই চিরন্তন প্রশ্ন, যা একদিন পৃথিবী না থাকলেও তার আলো ছড়িয়ে দিতে থাকবে অসীম আকাশের গভীরে।
৯
হিমালয়ের নক্ষত্র মানমন্দিরে সেই দিনটি ছিল এক অনির্বচনীয় নীরবতার দিন—যেন সমগ্র পৃথিবী নিজের শেষ সূর্যাস্তের প্রতীক্ষায় স্থির হয়ে আছে। আকাশের রঙ ছিল গভীর কমলা ও বেগুনি, মিশে গেছে লালচে ধূসর ছাইয়ের ছোপে, যেন মহাবিশ্বের ক্যানভাসে শেষ আঁচড় টেনে দিচ্ছে অদৃশ্য কোনো চিত্রশিল্পী। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল আর আগের মতো নীল নয়; বরফ গলেছে, সাগরের সীমানা মুছে গেছে, আর সূর্যের ম্লান আলো ধীরে ধীরে নিভে আসছে। মানবসভ্যতার অবশিষ্ট অংশ তখন বৃহস্পতির উপগ্রহ ইউরোপা ও গ্যানিমিডে স্থানান্তরের শেষ প্রস্তুতিতে ব্যস্ত, কিন্তু সেই ছুটোছুটি আর আতঙ্কের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে আর্যন সেন। সে জানে এই ক্ষণস্থায়ী দৌড় কোনোদিনই প্রকৃত পরিত্রাণ আনতে পারবে না। মানুষ হয়তো নতুন গ্রহে গিয়ে কিছু প্রজন্ম টিকবে, কিন্তু মহাবিশ্বের নিয়ম থেকে কেউ পালাতে পারবে না। তার দৃষ্টি তখন স্থির বিশাল রেডিও ডিশের দিকে, যেখানে সে শেষবারের মতো মহাজাগতিক বার্তা সম্প্রচার করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। মস্তিষ্কে ঘুরপাক খাচ্ছে অসংখ্য স্মৃতি—প্রথম সংকেতের অদ্ভুত ছন্দ, নক্ষত্রমানবের আভা, আর সেই নীরব কণ্ঠস্বর, যা বলেছিল: “প্রশ্নের মধ্যেই উত্তর লুকিয়ে আছে।” আজ আর্যনের হাতে সেই চূড়ান্ত প্রশ্ন ও উত্তরের সেতুবন্ধন ঘটানোর দায়িত্ব।
রাত নামতেই মানমন্দিরের সব যন্ত্র একে একে সক্রিয় হয়ে উঠল। কোয়ান্টাম রেডিওর গভীর নীল আলো ঘরে ছড়িয়ে পড়ল, যেন স্বয়ং মহাকাশের শীতল নিশ্বাস। পৃথিবীর শেষ বিদ্যুৎসঞ্চারিত নেটওয়ার্কের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে আর্যন তার কণ্ঠ রেকর্ড করতে শুরু করল। কিন্তু সে বুঝল, কেবল শব্দ যথেষ্ট নয়; মানুষ হয়তো এই শব্দ শুনবে না, বা শুনলেও অনন্ত গ্যালাক্সির দূরত্বে তা বিলীন হয়ে যাবে। তাই সে বার্তার ভেতর ঢুকিয়ে দিল আলোর নিজস্ব ছন্দ—সে ছন্দ যা প্রথম সংকেত থেকে সে শিখেছিল, যে ছন্দে মহাবিশ্বের চেতনা স্পন্দিত হয়। মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়িয়ে সে ধীরে ধীরে উচ্চারণ করল, “আমি আর্যন সেন। এই বার্তা পৃথিবীর শেষ দিনের, শেষ সূর্যাস্তের। আলোই জীবন, আলোই চেতনা। যখন মানুষ গ্যালাক্সির অন্ধকারে হারিয়ে যাবে, এই আলোক তরঙ্গ বহন করবে আমাদের অস্তিত্বের স্মৃতি। আমরা ক্ষণস্থায়ী, কিন্তু আলো অনন্ত।” প্রতিটি শব্দের সঙ্গে মিশে গেল তার হৃদস্পন্দন, প্রতিটি বাক্য যেন ফোটনের গতিতে ছুটে চলল মহাবিশ্বের অসীম শূন্যতায়। যন্ত্রের পর্দায় সে দেখল সংকেত আলোর বেগে ছুটে যাচ্ছে, প্রতিটি গ্যালাক্সির দিকে পাঠাচ্ছে মানুষের অস্তিত্বের শেষ ঘোষণাপত্র। সে অনুভব করল, তার নিজের দেহও যেন ধীরে ধীরে আলোর সঙ্গে একীভূত হয়ে যাচ্ছে—প্রশ্ন, উত্তর, ভয়, আশা সব মিলিয়ে যাচ্ছে মহাবিশ্বের মস্তিষ্কের গভীরে।
বার্তা প্রেরণের শেষ মুহূর্তে আর্যন এক অদ্ভুত শান্তি অনুভব করল। বাইরে তখন সূর্য তার শেষ আলো ফেলছে তুষারঢাকা হিমালয়ের চূড়ায়, যেন পৃথিবীর হাজার বছরের ইতিহাসকে সোনালি ছায়ায় মুছে দিচ্ছে। আকাশের দিকে তাকিয়ে সে দেখল, নক্ষত্রগুলির আলো আরও উজ্জ্বল, যেন তারা পৃথিবীর বিদায় উপলক্ষে এক মহাজাগতিক শ্রদ্ধা জানাচ্ছে। এই দৃশ্যের মধ্যে সে স্পষ্টভাবে উপলব্ধি করল যে মানুষ কখনোই প্রকৃতভাবে বিলীন হয় না। প্রতিটি চিন্তা, প্রতিটি প্রশ্ন, প্রতিটি ভালোবাসা ও আকাঙ্ক্ষা আলোর তরঙ্গে রূপান্তরিত হয়ে মহাবিশ্বের অন্তহীন গহ্বরে ছড়িয়ে যায়। একদিন হয়তো দূরবর্তী কোনো গ্যালাক্সির বুকে, অন্য কোনো জ্যোতির্বিজ্ঞানী এই সংকেত ধরবে, শুনবে আর্যনের কণ্ঠে ভেসে আসা মানুষের অস্তিত্বের বার্তা—“আমরা ছিলাম, আমরা আছি, আমরা আকাশের প্রতিটি ফোটনে বেঁচে থাকব।” সূর্য যখন অবশেষে দিগন্তের ওপারে ডুবে গেল, মানমন্দিরের সমস্ত আলো নিভে গেল, কিন্তু কোয়ান্টাম রেডিওর নীল আভা তখনও জ্বলছে। সেই আলোই শেষ আলোকবর্ষের স্পন্দন বহন করে ছুটে চলল অসীম মহাকাশে, যেখানে অন্ধকারও শেষ পর্যন্ত তাকে থামাতে পারবে না। আর্যন চোখ বন্ধ করল, তার মুখে এক মৃদু হাসি—কারণ সে জানে, প্রশ্ন জাগিয়ে তোলা মানুষ আজ আলো হয়ে মহাবিশ্বের স্মৃতিতে অমর হয়ে গেল।
১০
শেষ সূর্যাস্তের সেই নিঃশব্দ ক্ষণে, যখন পৃথিবীর বুকে আর কোনো বাতাসের কম্পন নেই, আর্যন একা দাঁড়িয়ে ছিল হিমালয়ের নক্ষত্র মানমন্দিরের উঁচু টেরেসে। চারদিক নিস্তব্ধ—কেবল টেলিস্কোপের ধাতব কাঠামো থেকে হালকা শীতল শব্দ, আর দূরে তুষারঢাকা পাহাড়গুলোর গা বেয়ে নেমে আসা ম্লান আলোর ঢেউ। আকাশে তখন কোনো পরিচিত নীল নেই, সূর্যের শেষ রক্তিম ছাপও মিলিয়ে গেছে, কেবল অসীম কালো মহাশূন্যের গাঢ় পর্দা। কিন্তু সেই অন্ধকারের মাঝেও নক্ষত্ররা জ্বলছে—তাদের আলো যেন আজকে আগের চেয়ে অনেক বেশি উজ্জ্বল, যেন তারা নিজেরা জানে এই শেষ মুহূর্তের তাৎপর্য। আর্যন টেলিস্কোপের লেন্সে চোখ রাখল, এবং হঠাৎ তার মনে হলো এই আলো আর কেবল দূরবর্তী নক্ষত্রের নয়, বরং তার নিজের ভেতরের আলো। সেই ফোটনগুলো কোটি কোটি আলোকবর্ষ পেরিয়ে এসেছে, কিন্তু আজ তারা যেন প্রত্যুত্তরে তাকাচ্ছে তার দিকে। টেলিস্কোপের ভেতরে দেখা প্রতিটি নক্ষত্র যেন তার সঙ্গে কথা বলছে—কোনো শব্দ ছাড়া, কেবল নীরব কম্পনে। এই নীরবতা তাকে এমন এক গভীর শান্তিতে আচ্ছন্ন করল, যা জীবনে কখনও অনুভব করেনি। পৃথিবী শেষ হয়ে যাচ্ছে—তবু ভয় নেই, শূন্যতা নেই; আছে কেবল এক অচেনা আশ্বাস, যেন অন্ধকারের ওপারে অপেক্ষা করছে এক নতুন সত্তা।
হঠাৎ সে অনুভব করল তার নিজের দেহের সীমা ভেঙে যাচ্ছে। হাত-পায়ের স্নায়ু, হৃদস্পন্দন, মস্তিষ্কের জটিল কোষ—সবকিছু যেন আলোর অণুতে গলে গিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে অসীম মহাশূন্যে। তার মনে হলো সে আর কেবল মানুষ নয়, বরং আলো হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে এক নক্ষত্র থেকে অন্য নক্ষত্রে, এক গ্যালাক্সি থেকে অন্য গ্যালাক্সিতে। সময় ও স্থান ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যাচ্ছে; অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ সব এক হয়ে গেছে এক অনন্ত স্পন্দনে। সে দেখতে পেল মহাবিশ্বের জন্মের সেই প্রথম আলো, শুনতে পেল কৃষ্ণগহ্বরের নিঃশব্দ গুঞ্জন, অনুভব করল প্রতিটি নক্ষত্রের জন্ম ও মৃত্যুর অবিরাম ছন্দ। এক মুহূর্তের জন্য সে যেন বুঝে গেল সমস্ত সমীকরণের গোপন সূত্র—মহাবিশ্ব কেবল পদার্থ নয়, কেবল শক্তি নয়; এটি এক চেতনা, এক অমর মনের প্রবাহ। সে অনুভব করল নিজের প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজে পাচ্ছে না কোনো শব্দের মাধ্যমে, বরং নিজের অস্তিত্বের বিস্তারে। তার সত্তা এখন এক বিন্দু, কিন্তু সেই বিন্দুর ভেতরই লুকিয়ে আছে অসংখ্য গ্যালাক্সি, অসংখ্য সম্ভাবনা। মানুষের সীমাবদ্ধতা, মৃত্যুর ভয়, ভাষার সংকীর্ণতা—সব মুছে গিয়ে সে হয়ে উঠল এক মহাজাগতিক ধ্বনি, যা একই সঙ্গে সৃষ্টি ও বিলয়ের সঙ্গীত গেয়ে চলেছে।
ঠিক সেই সময়, যখন পৃথিবীর শেষ কেন্দ্রীয় চৌম্বক ক্ষেত্র নিভে গেল এবং গ্রহের অন্তঃস্থল শীতল হয়ে এল, আর্যন অনুভব করল এক অদ্ভুত জাগরণ। অন্ধকারের শেষে শুরু হলো এক নতুন ভোর—কিন্তু এই ভোর কোনো গ্রহের আকাশে নয়, বরং মহাবিশ্বের অন্তরে। সেই ভোরের আলো ছিল না সূর্যের মতো, ছিল না নক্ষত্রের মতো; এটি ছিল চিন্তার আলো, যা জ্বলে মানুষের কৌতূহলে, মহাবিশ্বের নিজস্ব চেতনায়। আর্যন বুঝতে পারল সে আর একক কোনো সত্তা নয়। সে মহাবিশ্বের অগণিত স্নায়ুতন্ত্রের একটি বিন্দুতে পরিণত হয়েছে, যেখানে প্রতিটি চিন্তা একেকটি গ্যালাক্সির জন্ম দিতে পারে, প্রতিটি প্রশ্ন নতুন আলোকবর্ষের সূচনা ঘটাতে পারে। মানুষ যে প্রশ্ন দিয়ে মহাবিশ্বকে চ্যালেঞ্জ করেছিল, মহাবিশ্বও সেই প্রশ্ন দিয়ে মানুষকে অমর করে তুলেছে। সে বুঝল, মৃত্যু বলে কিছু নেই—আছে কেবল রূপান্তর। আজ পৃথিবী নিভে গেছে, কিন্তু সেই নিভে যাওয়া আসলে এক নতুন সৃষ্টি। আলোর সঙ্গে মানব মনের এই মিলন মহাবিশ্বকে নতুন সুর দিয়েছে, যার প্রতিধ্বনি ছড়িয়ে যাবে অসংখ্য যুগ ধরে। টেলিস্কোপের সামনে দাঁড়িয়ে শেষবারের মতো চোখ বন্ধ করে আর্যন হাসল—কারণ সে জানল, অনন্তের দ্বার পেরিয়ে সে আর কোনো দিন একা থাকবে না।
***