অদ্বৈত বসু
পর্ব ১: নীল পুকুরের কিংবদন্তি
গ্রামের নাম কদমডাঙা। বর্ধমান জেলার ভেতরে, ঘন বন আর ধানক্ষেতের মাঝখানে লুকিয়ে থাকা এই গ্রামটিকে খুব বেশি কেউ চিনত না। লোকেরা সাধারণত এখানে আসে না, আসলেও সন্ধে নামলেই তাড়াতাড়ি ফিরতে চায়। কারণ, গ্রামটিকে ঘিরে রয়েছে এক ভয়াল কাহিনি—গ্রামের মাঝখানে যে পুকুরটা, তাকে সবাই বলে “নীল পুকুর।” পুকুরের জল দিনে সাধারণ, কাদামাটির মতো ঘোলা আর অচেনা গন্ধে ভরা। কিন্তু রাত নামলেই, বিশেষ করে পূর্ণিমার আলোয়, পুকুরের জল হয়ে ওঠে অস্বাভাবিক নীল। লোককথায় আছে, সেই নীল আলো আসলে কোনো চাঁদের প্রতিফলন নয়, বরং পুকুরের তলায় ঘুমিয়ে থাকা এক নিষিদ্ধ তন্ত্রশক্তির জ্যোতি।
অদিত্য বহু বছর পর গ্রামে ফিরছিল। শহরে বড় হয়ে ওঠা, কলেজ, চাকরি—সব মিলিয়ে গ্রামের সঙ্গে যোগাযোগ কমে গিয়েছিল অনেকদিন। কিন্তু গত বছর মীরা মারা যাওয়ার পর থেকেই তার মধ্যে এক শূন্যতা তৈরি হয়েছে। মীরা, তার ছোট বোন, যে হাসতে হাসতে পুরো বাড়িটাকে ভরে রাখত, এক অদ্ভুত দুর্ঘটনায় মারা গেল। রাতের বেলা খেলার ছলে পুকুরের ধার ঘেঁষে গিয়ে হঠাৎ হারিয়ে যাওয়া, আর সকালে গ্রামের লোকেরা তার নিথর দেহ পেয়েছিল জলের উপরে ভেসে। ডাক্তার বলেছিল সাধারণ ডুবে যাওয়া, কিন্তু অদিত্যের মনে হয়েছিল, এর মধ্যে কিছু অস্বাভাবিকতা আছে।
ফিরে আসার দিন সকালে ট্রেন থেকে নেমেই তার মনে হচ্ছিল, চারপাশ যেন এক অদৃশ্য পর্দায় ঢাকা। পুরোনো স্টেশন, ভাঙা বেঞ্চ, লাল মাটির রাস্তা—সব একই রকম, কিন্তু ভেতরে যেন সময় থেমে আছে। সে হাঁটতে হাঁটতে যখন কদমডাঙার প্রান্তে পৌঁছোল, তখনই শুনল দু’জন বয়স্ক গ্রামবাসী কথা বলছে—
“এইবার নাকি আবার পূর্ণিমার রাতে পুকুর নীল হয়ে উঠেছে।”
“হুঁ… কারও না কারও অমঙ্গল হবেই। নীলতন্ত্রের ছায়া তো কাটে না।”
অদিত্য শুনে থমকে গেল। নীলতন্ত্র? এই শব্দটা আগে কখনো শোনেনি।
বাড়িতে পৌঁছেই সে দেখল, উঠোন আগের মতোই পড়ে আছে। মাটির দেয়ালে ফাটল, বারান্দার কোনায় ধুলো জমে থাকা কেরোসিন লণ্ঠন। মা কেমন যেন কুঁজো হয়ে গেছেন, চোখের কোলে ক্লান্তির ছাপ। বাবা নেই—অনেকদিন হলো মারা গেছেন। শুধু মায়ের নিঃশ্বাস আর হাহাকারই যেন ঘর ভরিয়ে রেখেছে। মায়ের চোখে অদিত্যের দিকে তাকানোর ভেতরেও অদ্ভুত এক ভয় মিশে আছে।
“তুই আবার ফিরলি কেন রে? শহরে থাক, গ্রাম তোর জন্য নয়।” মা বললেন, গলায় কাঁপন।
“মীরার কথা আমাকে ছাড়ে না মা। আমি জানতে চাই আসলে কী হয়েছিল সেদিন।”
মা আর কিছু বললেন না। শুধু মাটির দিকে তাকিয়ে রইলেন।
রাতে অদিত্য চুপচাপ বেরিয়ে গেল। পুকুরটা দেখবে মনে করে। গ্রাম নিস্তব্ধ, শুধু কুকুরের ঘেউ ঘেউ আর মাঝে মাঝে ঝিঁঝিঁর ডাক। সে যত পুকুরের কাছে এগোল, বাতাস যেন ভারী হয়ে উঠল। দূর থেকেই দেখল, জলের উপর অদ্ভুত নীল আলো ঝলমল করছে। প্রথমে মনে হলো আকাশের প্রতিফলন, কিন্তু মাথা উঁচু করতেই বুঝল—আকাশে মেঘে ঢাকা চাঁদ, আলো নেই। তবু পুকুর ঝিকমিক করছে অদ্ভুত নীল জ্যোতিতে।
কাছাকাছি যেতেই হঠাৎ কানে এল কারও ফিসফিসানি। যেন একসাথে বহু মানুষের আওয়াজ—কেউ নাম ডাকছে, কেউ মন্ত্র পড়ছে, কেউ আবার হাহাকার করছে। অদিত্যর বুক কেঁপে উঠল। সে তাকিয়ে দেখল, পুকুরের জলে অসংখ্য ফোটা গোল বুদবুদ উঠছে আর মিলিয়ে যাচ্ছে। যেন নিচে কেউ শ্বাস নিচ্ছে।
ঠিক তখনই পিছন থেকে গলা ভেসে এল—
“ওখানে দাঁড়িয়ে থাকিস না। রাতের বেলায় পুকুরের ধারে গেলে ফেরার পথ হারাবি।”
অদিত্য ফিরে তাকিয়ে দেখল, এক বৃদ্ধ দাঁড়িয়ে আছেন। গায়ে পুরোনো চাদর, চোখে জ্বলজ্বল আলো। তিনি বললেন, “তুই খুঁজছিস তোর বোনকে, জানি। কিন্তু সাবধান, নীল পুকুর কারও প্রিয়জন ফেরায় না, সে শুধু দাম নেয়।”
অদিত্য হতভম্ব হয়ে গেল। বৃদ্ধ কে, কীভাবে মীরার কথা জানেন, কিছুই বোঝার আগে তিনি অন্ধকারে মিলিয়ে গেলেন।
রাতে বাড়ি ফিরে এসে ঘুমোতে পারছিল না অদিত্য। মনে হচ্ছিল, তার কানে ক্রমাগত ভেসে আসছে মন্ত্রোচ্চারণের শব্দ। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছিল, মীরা যেন তার নাম ডাকছে—“দাদা, আমায় ফিরিয়ে আনো।”
সে জানত, গ্রামের মানুষ তাকে বোঝাবে এটা সব বিভ্রম। কিন্তু অদিত্যের মনে হচ্ছিল, নীল পুকুরের তলায় সত্যিই কিছু লুকিয়ে আছে—কোনো প্রাচীন শক্তি, কোনো নিষিদ্ধ তন্ত্র, যা তার জীবনের সঙ্গে মিশে গেছে।
আর তখনই প্রথমবার তার মনে এলো সেই শব্দটা—নীলতন্ত্র।
পর্ব ২: পান্ডুলিপির সন্ধান
সকালের আলোয় কদমডাঙা গ্রামটা দেখতে নিরীহ আর চেনা মনে হলেও, অদিত্যের ভেতরটা কেমন যেন দমবন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। আগের রাতের সেই নীল আলো আর বৃদ্ধের সতর্কবার্তা তার মাথার ভেতরে প্রতিধ্বনির মতো বাজছিল। মীরার হাসি, মীরার চিৎকার, আর তার ঠান্ডা দেহ—সব মিশে এক অদৃশ্য ভার চাপিয়ে রেখেছিল বুকের উপর।
সে বুঝতে পারছিল, গ্রামটা শুধু কুসংস্কারে নয়, অদৃশ্য এক ইতিহাসে ডুবে আছে। আর সেই ইতিহাসের কেন্দ্রে রয়েছে ওই পুকুর।
সকালের নাস্তার পর, গ্রামের কয়েকজন বৃদ্ধ আড্ডা দিচ্ছিল কালীমন্দিরের বারান্দায়। অদিত্য গিয়ে বসতেই তাদের ফিসফিসানি থেমে গেল। সে বুঝতে পারল, ওরা জানে কিছু, কিন্তু বলবে না। খানিকক্ষণ পর এক বৃদ্ধা বললেন,
“বাবা, বেশি খোঁজাখুঁজি করিস না। মেয়েটাকে ভুলে যা। ওখানে যারা যায়, তারা ফেরে না।”
অদিত্য চুপ করে রইল। সে জানত, গ্রামবাসীরা ভয়ে সত্যি লুকিয়ে রাখে।
দুপুরে এক পুরোনো বন্ধু, দেবব্রত, দেখা করতে এলো। শহরে কাজ করে, মাঝে মাঝে গ্রামে আসে। গল্প করতে করতে হঠাৎ দেবব্রত বলল,
“তুই জানিস, মীরার মৃত্যুর পর পুকুরটার পাশে ক’দিন ধরে মাটির ভেতর থেকে কিছু খোদাই করা পাথর বেরিয়েছিল?”
“কীসের পাথর?”
“কেউ জানে না। কিন্তু ওতে নাকি তন্ত্রমন্ত্রের মতো চিহ্ন আছে। পুরোনো মন্দির ভেঙে পড়ছে, সেখান থেকেও এরকম কিছু পাওয়া গেছে। সবাই ভয় পায়, তাই আর কেউ ওদিকে যায় না।”
অদিত্যর বুক ধক করে উঠল। মীরার মৃত্যু, পুকুরের নীল আলো, আর এই খোদাই—সব যেন এক সূত্রে বাঁধা।
সন্ধের পর, হাতে টর্চ নিয়ে সে একা বেরিয়ে পড়ল। গন্তব্য সেই ভাঙা মন্দির। গ্রামের বাইরে, বটগাছের নিচে, আধভাঙা ইটের গায়ে শ্যাওলা জমে আছে। ভেতরে প্রবেশ করতেই সে এক অদ্ভুত গন্ধ পেল—ধূপের মতো, আবার পোড়া মাংসের মতো। বাতাস ঠান্ডা হয়ে এল।
ভাঙা সিঁড়ি বেয়ে নামতেই দেখতে পেল, মাটির তলায় চাপা দেওয়া কিছু ভাঙা পাথর। কাছে গিয়ে টর্চ ফেলতেই বুকের ভেতর কেঁপে উঠল। প্রতিটি পাথরে অদ্ভুত অক্ষরে কিছু খোদাই করা আছে—যেন বাংলা, সংস্কৃত আর কোনো অচেনা ভাষার মিশ্রণ। এক জায়গায় স্পষ্ট লেখা—“নীলতন্ত্র”।
হাত বুলিয়ে দিতেই সে হঠাৎ যেন কানে শুনল ফিসফিসানি—“পড়ো না, পড়ো না…” আবার অন্য এক আওয়াজ বলছে, “খুলে দাও, রক্ত দিয়ে খুলে দাও…”
অদিত্যর চোখে ভেসে উঠল মীরার মুখ। মনে হলো, মীরা যেন ঠিক তার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। টর্চ নিভে গেল। অন্ধকারের মধ্যে কেবল শিলালিপির অক্ষরগুলো অস্বাভাবিক জ্যোতিতে জ্বলজ্বল করছে।
সে অন্ধকারে হাতড়ে একটা অর্ধেক ভাঙা খাতার মতো কিছু বের করল। চামড়ার বাঁধাই, পাতা হলদে আর ভঙ্গুর। মলাটে স্পষ্ট খোদাই করা এক প্রতীক—একটি বৃত্ত, যার ভেতরে তিনটি চোখ আর ঘিরে থাকা সাপ। নিচে আবার সেই শব্দ—“নীলতন্ত্র”।
অদিত্য বইটা বুকে চেপে ধরল। মনে হচ্ছিল, এটাই তার খোঁজার উত্তর। হয়তো এর ভেতরেই লুকিয়ে আছে মীরাকে ফেরানোর পথ।
কিন্তু তখনই আবার সেই বৃদ্ধের গলা ভেসে এল পিছন থেকে—
“তুই যেটা হাতে ধরেছিস, সেটা শাস্ত্র নয়, অভিশাপ। ওটা পড়লে আর ফেরার পথ থাকবেনা।”
অদিত্য চমকে তাকাল। বৃদ্ধ দাঁড়িয়ে আছেন, চোখে অদ্ভুত আগুন।
“কে আপনি?”
বৃদ্ধ ধীরে ধীরে বললেন, “আমি এই গ্রামে শেষ সাক্ষী। আমি জানি নীলতন্ত্র কীভাবে জন্মেছিল।”
অদিত্য কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল, “তাহলে আমাকে বলুন, কীভাবে আমি মীরাকে ফেরাতে পারি?”
বৃদ্ধ ঠান্ডা হেসে উত্তর দিলেন,
“নীলতন্ত্র রক্ত চায়। প্রতিটি ডুব মানে এক জীবন। তুই কি সেই দাম দিতে রাজি?”
অদিত্যের বুকের ভেতর হাহাকার ছিঁড়ে গেল। মীরার মুখ মনে পড়ল—তার হাসি, তার ছোট্ট হাত ধরে হাঁটার মুহূর্ত, তার শেষ নিথর দেহ। বুকের গভীর থেকে একটাই উত্তর ভেসে উঠল—
“হ্যাঁ, আমি রাজি।”
বৃদ্ধ নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন,
“তাহলে সাবধান। কারণ একবার পথ শুরু হলে আর থামানো যায় না। নীল পুকুর সময় ফেরায়, কিন্তু সে প্রতিবার তোকে একটু একটু করে গিলে নেয়।”
অদিত্যর চোখ পড়ল হাতে ধরা বইটার দিকে। সে জানত, তার জীবন এখন থেকে আর আগের মতো থাকবে না।
পর্ব ৩: রাতের প্রথম ডুব
রাত তখন গভীর। গ্রাম নিস্তব্ধ, দূরে কেবল কুকুরের গলা ফাটানো ডাক আর মাঝে মাঝে ঝিঁঝিঁর একটানা সুর। অদিত্য ঘরে বসে বারবার সেই অদ্ভুত বইটা উল্টেপাল্টে দেখছিল। পাতাগুলো এত পুরোনো যে সামান্য চাপ দিলেই গুঁড়ো হয়ে ভেঙে যাচ্ছে। কিন্তু ভেতরের অক্ষরগুলো—কালো, নীল আর লাল রঙের মিশ্রণে আঁকা—অস্বাভাবিক ভাবে পরিষ্কার। কিছু অক্ষর সে চিনতে পারছিল—সংস্কৃত মন্ত্র, কিছু প্রাচীন বাংলার শব্দ—কিন্তু বাকি অংশ অচেনা এক ভাষার, যেন মানুষ আর প্রেতের মাঝামাঝি কারও লেখা।
মলাটের ভেতরের পাতায় আঁকা ছিল একটি বৃত্ত, যার মাঝখানে তিনটি চোখ। প্রতিটি চোখের চারপাশে সাপ কুণ্ডলী পাকিয়ে রয়েছে। নিচে লেখা—“যে ডুব দেবে, সে সময়কে বাঁকাবে; কিন্তু সময়ের সঙ্গে বাঁকাবে তার আত্মাও।”
অদিত্যর বুক কেঁপে উঠল। বুকের গভীর থেকে একটাই শব্দ উঠে আসছিল—“মীরা।” সে জানত, আর দেরি করলে পারবে না। বইয়ের নির্দেশ মেনে পূর্ণিমার রাতে ডুব দিতে হবে। আজই সেই রাত।
সে চুপিচুপি ঘর থেকে বেরোল। হাতে কেরোসিনের লণ্ঠন, বগলে বইটা। আকাশে চাঁদ নিস্তেজ আলো ছড়াচ্ছে, কিন্তু পুকুরের দিক থেকে অদ্ভুত নীলাভ জ্যোতি ভেসে আসছে। দূর থেকেই অদিত্যর মনে হচ্ছিল, যেন কেউ তাকে টানছে ভেতরে।
পুকুরপাড়ে পৌঁছে দেখল, বাতাস যেন ভারী হয়ে উঠেছে। কাঁপতে কাঁপতে সে বইয়ের প্রথম পাতার নির্দেশ পড়ল। সেখানে লেখা ছিল—
“রক্ত দিয়ে মন্ত্র জাগাতে হবে।”
অদিত্য থমকে গেল। কিন্তু পরক্ষণেই নিজের তালুতে ছোট্ট একটা কেটে রক্ত ঝরাল। রক্তের ফোঁটা পড়তেই পুকুরের জল অস্বাভাবিক ভাবে ঢেউ খেলল, যেন পুকুর শ্বাস নিচ্ছে। সেই মুহূর্তে কানে ভেসে এল এক মন্ত্রোচ্চারণ—একসাথে বহু মানুষের কণ্ঠে—
“ওঁ নীলতন্ত্রায় নমঃ…”
অদিত্য আর দেরি করল না। জামাকাপড় খুলে ধীরে ধীরে জলে নামল। প্রথমে ঠান্ডা শিহরণ, তারপর হাড় ভেদ করে আসা শীতলতা। কিন্তু যত সে গভীরে নামতে লাগল, তত অনুভব করল, পুকুরের তলা যেন তাকে টেনে নিচ্ছে। জলের নিচে আলো বাড়তে লাগল। মনে হচ্ছিল, সে আর কোনো সাধারণ পুকুরে নেই—বরং এক অন্তহীন গহ্বরে নেমে যাচ্ছে।
চোখের সামনে ভেসে উঠল অসংখ্য মুখ—কেউ কাঁদছে, কেউ হাসছে, কেউ রক্তে ভেসে যাচ্ছে। হঠাৎ তার সামনে উদ্ভাসিত হলো মীরার মুখ। সাদা পোশাক, ভেজা চুল, ঠোঁটে হাসি।
“দাদা… আমায় ফিরিয়ে নাও…”
অদিত্য হাত বাড়াল। কিন্তু হাত বাড়াতেই সে অনুভব করল, জলের ভেতর থেকে এক অদ্ভুত শক্তি তার হাত চেপে ধরল। মনে হলো, হাজারো অদৃশ্য আঙুল তার শরীর বেঁধে নিচ্ছে। বুক ধড়ফড় করতে লাগল। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল।
ঠিক তখনই বইয়ের অক্ষরগুলো অদ্ভুত ভাবে মাথার ভেতর প্রতিধ্বনিত হতে লাগল।
“এক জীবন দিয়ে এক জীবন ফেরে। কে দেবে প্রথম জীবন?”
অদিত্যর চোখের সামনে তখন ভেসে উঠল মীরার দেহ। মনে হচ্ছিল, সে হাত বাড়ালেই টেনে আনতে পারবে। কিন্তু বুকের গভীর থেকে ভেসে এল ভয়ঙ্কর এক প্রশ্ন—যদি সত্যিই মীরা ফিরে আসে, তবে কাকে নিয়ে যাবে পুকুর?
হঠাৎ অদিত্য অনুভব করল, তার চারপাশের জল গরম হয়ে উঠছে। যেন কেউ তার রক্ত ফুটিয়ে তুলছে। সে প্রাণপণে জলে ভেসে উঠতে চাইলো। বুক ফেটে যাচ্ছিল। তখনই মীরা আবার ডেকেছে—
“দাদা… তুই যদি না আসিস, আমি আর ফিরব না…”
অদিত্যর চোখে অন্ধকার নেমে এল। সে শেষ শক্তি দিয়ে জলের উপরে উঠে এলো।
তীরে এসে শ্বাস নিতে নিতে বুঝল, পুরো গ্রামটা নিস্তব্ধ হয়ে গেছে। রাতের শব্দ থেমে গেছে, কুকুরের ডাক নেই, ঝিঁঝিঁর সুর নেই। চারপাশে কেবল এক অস্বাভাবিক নীরবতা।
অদিত্য হাঁপাতে হাঁপাতে চারদিকে তাকাল। আর তখনই তার বুক কেঁপে উঠল—
গ্রামটা যেন পাল্টে গেছে। কুঁড়েঘরগুলো অন্যরকম, মন্দিরের গায়ে নতুন রঙ, আর দূরে কয়েকজন মানুষ হেঁটে যাচ্ছে—যাদের সে কোনোদিন দেখেনি।
সবচেয়ে ভয়ঙ্কর হলো, আকাশে চাঁদ নেই। আকাশ সম্পূর্ণ ফাঁকা।
অদিত্য বুঝতে পারল, প্রথম ডুব তাকে ফেরালো না—বরং টেনে নিয়ে গেল অন্য এক সময়ে।
পর্ব ৪: পাল্টে যাওয়া গ্রাম
অদিত্য হাঁপাতে হাঁপাতে তীরে বসে রইল। বুকের ভেতর ঢেউ খেলছে আতঙ্ক আর বিস্ময়। সে নিশ্চিত ছিল যে রাতের ডুব তাকে কেবল বিভ্রমে ঠেলে দেবে, কিন্তু চোখের সামনে যা ঘটল তা বিভ্রম নয়, বাস্তব। পুকুরের জল এখনও নীলাভ আলো ছড়াচ্ছে, কিন্তু চারপাশের গ্রাম যেন অচেনা। কুঁড়েঘরগুলোর ছাদে খড়ের বদলে টালির ছাউনি, মন্দিরের গায়ে নতুন রঙ আর গম্বুজের মাথায় সোনালি কপোত। যেন কয়েক দশক পেরিয়ে হঠাৎ গ্রাম এক নতুন রূপে দাঁড়িয়ে আছে।
অদিত্য কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়াল। শরীর ভিজে একেবারে ঠান্ডা হয়ে গেছে, কিন্তু ভেতরের কৌতূহল তাকে ঠেলে নিয়ে গেল গ্রামের দিকে। পায়ের শব্দ যেন অস্বাভাবিকভাবে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। প্রতিটি বাড়ির সামনে প্রদীপ জ্বলছে, অথচ বাতাসে কোনো শব্দ নেই। না কুকুর, না পাখি—কেবল নীরবতা।
গ্রামের মোড়ে পৌঁছতেই সে দেখতে পেল, কয়েকজন লোক আগুন জ্বালিয়ে বসে আছে। তাদের পোশাক অন্যরকম—কোনওটা পুরোনো ধুতি, কোনওটা গেরুয়া কাপড়। মুখে এক অদ্ভুত শান্ত ভাব, চোখে শূন্যতা। অদিত্য কাছে যেতেই তারা একসাথে ঘুরে তাকাল। চোখগুলো লালচে, মুখে হাসি নেই।
“তুই এলি?” এক বৃদ্ধ ফিসফিস করে বলল।
অদিত্য হতভম্ব, “চেনেন আমায়?”
বৃদ্ধ মাথা নাড়ল, “তুইই তো তাকে খুঁজছিস—যে একবার হারিয়েছিল, আবার ফিরে আসবে।”
অদিত্যর বুক কেঁপে উঠল। “মীরা?”
তখনই পাশের এক যুবক বলে উঠল, “আজ রাতে সে ফিরবে। কিন্তু মনে রাখিস, যে ফেরে সে আগের মতো থাকে না।”
অদিত্যর গা শিরশির করে উঠল। সে বুঝতে পারছিল, এরা সবাই জানে কিছু। কিন্তু তাদের মুখে উত্তর নেই, কেবল অদ্ভুত ধাঁধা।
সে দ্রুত হাঁটতে হাঁটতে নিজের বাড়ির সামনে এল। অথচ বাড়িটাও অন্যরকম। দেওয়ালের ফাটল নেই, বারান্দা ঝকঝকে, উঠোনে তালপাতার ছায়া। সে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়ল—মা রান্নাঘরে ব্যস্ত। অথচ মা তো আজ বৃদ্ধা, কুঁজো, কষ্টে হাঁটেন। কিন্তু সামনে যে মানুষটা দাঁড়িয়ে আছে সে প্রায় পঁয়ত্রিশ বছরের তরুণী, চুলে পাকা নেই, চোখে আলো।
“দাদা, এত দেরি করলি?”
অদিত্য ঘুরে দাঁড়াল। বুকের ভেতর রক্ত জমাট বেঁধে গেল। মীরা দাঁড়িয়ে আছে দরজার পাশে। সাদা পোশাক, চুল খোলা, ঠোঁটে অচেনা হাসি।
“মীরা… তুই…”
“আমি ফিরেছি। তোকে ছেড়ে যাই নাকি?”
অদিত্যর চোখ ভিজে উঠল। সে দৌড়ে গিয়ে বোনকে জড়িয়ে ধরতে চাইলো, কিন্তু ঠিক তখনই তার গায়ে এক অদ্ভুত ঠান্ডা লাগল। যেন বরফের দেয়াল। মীরার শরীর উষ্ণ নয়, বরং অচেনা শীতলতায় ভরা।
“তুই… সত্যিই মীরা?” অদিত্য কাঁপা গলায় বলল।
মীরা কেবল মুচকি হাসল। সেই হাসি ছিল অদ্ভুত, অচেনা।
রাত বাড়তে থাকল। অদিত্য বুঝতে পারছিল, তার চারপাশের সবকিছুই পাল্টে গেছে। বাড়ি, মা, গ্রাম—সব নতুন, সব অচেনা। অথচ মীরার ফিরে আসা তাকে এক অদ্ভুত আশা দিচ্ছে। সে ভাবছিল, হয়তো এটাই নীলতন্ত্রের শক্তি—সময়কে উল্টে দেওয়া।
কিন্তু রাত যত এগোতে থাকল, অদিত্য তত বুঝল, মীরার ভেতরে কিছু যেন বদলে গেছে। তার চোখে মাঝে মাঝে অদ্ভুত লালচে আভা জ্বলে ওঠে। খাবার খাওয়ার সময় সে কাঁটাচামচের বদলে খালি হাতে ভাত মুঠোয় নিয়ে মুখে পুরে দেয়। মাঝেমাঝে হঠাৎ হেসে ওঠে, আর সেই হাসি ঘরের দেয়ালে প্রতিধ্বনি হয়ে বাজে।
অদিত্য বুক কাঁপতে কাঁপতে বলল, “তুই মীরা… তাই তো?”
মীরা তখন ধীরে ধীরে উত্তর দিল, “আমি মীরা… আবার আমি মীরা নই।”
অদিত্যর শরীর ঠান্ডা হয়ে গেল। সে বুঝতে পারল, প্রথম ডুব তাকে বোনকে ফিরিয়ে দিলেও, সেই বোন আর আগের বোন নয়।
বাইরে তখন হঠাৎ ঝড় উঠেছে। বাতাসে তালপাতার ছায়া নাচছে, পুকুরের জলে নীল আলো আরও তীব্র হয়ে উঠছে। অদিত্য জানত, এ কেবল শুরু। নীলতন্ত্র তাকে আরও গভীরে টেনে নিয়ে যাবে।
পর্ব ৫: মৃতের ফিরে আসা
রাতের অন্ধকারে হঠাৎ গ্রাম যেন নিঃশ্বাস ফেলে থেমে গেল। দূরে কেবল তালপাতার শব্দ আর পুকুরের জলে ওঠা নীল আভা, যেন কোনো ভেতরের শ্বাস ফুঁসে বেরিয়ে আসছে। অদিত্য মীরার মুখের দিকে তাকিয়ে স্থির হয়ে রইল। কতদিন পর সে বোনকে কাছে পেল, অথচ বুকের ভেতর প্রশান্তির বদলে অস্বস্তি গিঁট বেঁধে বসছে।
মীরার চোখে সেই চেনা কৌতুক নেই, সেই অগোছালো ছেলেমানুষি নেই। চোখদুটো যেন গভীর কূপের মতো—যেখানে তাকালে বোঝা যায় না ভেতরে জল আছে নাকি শুধু অন্ধকার। সে বারবার মুচকি হেসে বলছিল, “দাদা, তুই আমায় ফিরিয়ে এনেছিস। আমি তোকে ছেড়ে যাই কীভাবে?” কিন্তু সেই হাসি অদিত্যের হাড়ে কাঁপন ধরাচ্ছিল।
সকালে গ্রামবাসীরা অবাক হয়ে দেখল—মীরা জীবিত। লোকেরা ফিসফিস করতে লাগল, কেউ বলল ঈশ্বরের কৃপা, কেউ বলল নীল পুকুরের খেলা। কিন্তু তাদের চোখে ভয় ছিল। অনেকে দোর বন্ধ করে দিল, কেউ কানে তুলো গুঁজে রাখল, যেন মীরার উপস্থিতি তাদের জন্য অশনি সংকেত।
অদিত্য দিনভর মীরার সঙ্গে কাটাল। বোনের হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে মনে হচ্ছিল, সে যেন স্বপ্নে আছে। কিন্তু ছোট ছোট মুহূর্তে ভয়ঙ্কর সত্যি ধরা দিচ্ছিল। মীরা যখন খাবার খেল, তার হাতের আঙুলগুলো অস্বাভাবিক ভাবে লম্বা হয়ে যাচ্ছিল। তারপর হঠাৎ আগের মতো হয়ে গেল। সন্ধেবেলা যখন তারা পুকুরপাড়ে গেল, মীরার চোখে অদ্ভুত আলো জ্বলে উঠল—জলের নীল আভা যেন তার দেহে মিশে যাচ্ছে।
“তুই আবার সেখানে যাবি?” মীরা জিজ্ঞেস করল, ঠোঁটে অদ্ভুত বাঁকা হাসি।
অদিত্য কেঁপে উঠল। “কোথায়?”
“নীচে। যেখানে সময় ঘুমিয়ে আছে।”
অদিত্য বুঝতে পারল, মীরা সব জানে। যেন সে পুকুরের তলা থেকে কোনো অচেনা জ্ঞান নিয়ে ফিরে এসেছে।
রাতে ঘুম ভাঙল অদিত্যের। শুনল মীরা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। ফিসফিস করে মন্ত্র উচ্চারণ করছে—
“ওঁ নীলতন্ত্রায় নমঃ… এক প্রাণ দিয়ে আরেক প্রাণ…”
অদিত্যর বুক ঠান্ডা হয়ে গেল। সে ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে দেখল, মীরার ঠোঁটে রক্ত লেগে আছে।
“এ কেমন হল?”
মীরা হেসে বলল, “আমি ক্ষুধার্ত দাদা। তুই তো জানিস, ফেরার পথে যে দাম দিতে হয়, সেটা আমি দিয়ে এসেছি। এখন আবার দিতে হবে।”
অদিত্য কাঁপতে কাঁপতে বলল, “তুই আসলে কে?”
মীরা উত্তর দিল না। শুধু ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে তার কানে ফিসফিস করে বলল,
“আমি মীরা… আবার আমি মীরা নই। আমি সেই শক্তি, যে তোর ডাক শুনে এসেছি।”
হঠাৎ অদিত্য অনুভব করল, চারপাশ অস্বাভাবিক নীরব। যেন গ্রাম নিঃশ্বাস বন্ধ করে অপেক্ষা করছে। দূরে কুকুর হুক্কার মতো ডাকল, আর পুকুরের নীল আলো এক ঝলকে আকাশ পর্যন্ত ছড়িয়ে গেল।
অদিত্যর বুকের গভীর থেকে চিৎকার উঠল—সে বুঝতে পারল, বোন ফিরে এসেছে বটে, কিন্তু যে ফিরেছে সে কেবল মাংস আর রক্তে মীরার মতো। ভেতরে সে অন্য কিছু। এমন এক শক্তি, যা তাকে চিনতে দেবে না, আবার তাকে ছাড়বেও না।
সেই রাতে অদিত্যর মনে প্রথমবার তীব্র ভয় জন্ম নিল। সে উপলব্ধি করল, নীলতন্ত্র কেবল মৃতকে ফেরায় না—মৃতকে নতুন রূপে বাঁচিয়ে তোলে। আর সেই রূপ ভয়ঙ্কর, অচেনা, দুঃস্বপ্নের থেকেও গভীর।
পর্ব ৬: তান্ত্রিকের আবির্ভাব
পরদিন সকালটা অদিত্যের কাছে এক অদ্ভুত দুঃস্বপ্নের মতো ছিল। মীরা ঘরে বসে ছিল শান্তভাবে, কিন্তু তার মুখের দিকে তাকালেই মনে হচ্ছিল কিছু যেন বেমানান। সে যখন হাসছিল, ঠোঁটের কোণে অচেনা কঠোরতা জমে থাকছিল। সে যখন কথা বলছিল, কণ্ঠস্বরের ভেতরে কোথাও যেন প্রতিধ্বনি হচ্ছিল, যেন আরেকজন কথা বলছে তার ভেতর দিয়ে।
অদিত্য যতই বোঝানোর চেষ্টা করছিল যে সব স্বাভাবিক, ততই গ্রামবাসীদের চোখে আতঙ্ক আরও স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। কারও দোর বন্ধ, কারও শিস কাটা, কারও আবার হঠাৎ ফিসফিস করে ওঠা—সব মিলিয়ে অদিত্য অনুভব করল, মীরার ফিরে আসা আসলে এক অনিবার্য ভয়ের জন্ম দিয়েছে।
বিকেলের দিকে অদিত্য পুকুরপাড়ে গেল। বুকের ভেতর দ্বন্দ্ব চলছিল—সে কি দ্বিতীয়বার ডুব দেবে? যদি মীরাকে পুরোপুরি ফিরিয়ে আনা যায়? কিন্তু মনে হচ্ছিল, প্রতিবারের ডুব তার নিজের অস্তিত্বকে আরও ক্ষয় করে দেবে।
ঠিক তখনই পেছন থেকে কর্কশ গলা ভেসে এল—
“তুই যদি আবার নামিস, আর ফেরার পথ পাবি না।”
অদিত্য ঘুরে তাকাল। বৃদ্ধ দাঁড়িয়ে আছে। চোখে লালচে আভা, হাতে রুদ্রাক্ষের মালা। বাতাস কেমন ভারী হয়ে উঠল তার উপস্থিতিতে। অদিত্য প্রথমেই চিনল, এ সেই মানুষ যাকে প্রথম রাতে পুকুরের ধারে দেখেছিল।
“আপনি কে?” অদিত্য কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল।
বৃদ্ধ ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে বলল, “আমি তান্ত্রিক। এই গ্রামের শেষ সাধক। নীলতন্ত্র কী, আমি জানি। আর জানি, তুই কীভাবে তার ফাঁদে পা দিয়েছিস।”
অদিত্যর বুক ধড়ফড় করতে লাগল। “আমার বোন… আমি তো শুধু ওকে ফেরাতে চেয়েছিলাম।”
তান্ত্রিক হেসে উঠল, গলায় ভয়ঙ্কর সুর, “মৃতকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা সবসময়ই এক অভিশাপ। তুই যা ফিরিয়ে এনেছিস সেটা আর মীরা নয়—সে কেবল এক খোলস, যার ভেতরে নীলতন্ত্রের আত্মা বাসা বেঁধেছে।”
অদিত্য স্তব্ধ হয়ে গেল। “তাহলে মীরা…?”
“সে নেই। তার প্রাণ তোকে ডাকে, কিন্তু তার শরীর এখন শাস্ত্রের পাত্র।”
তান্ত্রিক বসে পড়ল মাটিতে। ধুলোয় আঙুল চালিয়ে এক বৃত্ত আঁকল। বৃত্তের ভেতরে তিনটি চোখ আঁকতে আঁকতে বলল, “এই প্রতীকই নীলতন্ত্রের মূল। শত বছর আগে এই গ্রামে এক যজ্ঞ হয়েছিল। তাতে শত প্রাণ বলি গিয়েছিল। তাদের আত্মা এখনও পুকুরে বন্দি। নীল আলো আসলে সেই আত্মাদের শ্বাসপ্রশ্বাস। যে সেখানে ডুব দেয়, তাকে তারা নতুন করে লিখে ফেলে।”
অদিত্যর শরীর ঠান্ডা হয়ে গেল। সে কাঁপা গলায় বলল, “কিন্তু আমি কী করব? আমি তো ওকে ছাড়া বাঁচতে পারব না।”
তান্ত্রিক ধীরে ধীরে তাকাল, চোখে এক ঝলক দুঃখ ফুটে উঠল। “তুই যদি সত্যিই ওকে ফেরাতে চাস, তবে তোর নিজের প্রাণ দিতে হবে। নীলতন্ত্র রক্তের বিনিময়েই কাজ করে। তুই কি সেই দাম দিতে রাজি?”
অদিত্যর মাথায় ঝড় বয়ে গেল। মীরার হাসি, মীরার খুনসুটি, মীরার ডুবে যাওয়া দেহ—সব একসাথে ভেসে উঠল চোখের সামনে। বুকের গভীর থেকে একটা উত্তর উঠে আসছিল—হ্যাঁ, সে রাজি। কিন্তু গলার কাছে শব্দ আটকে গেল।
তান্ত্রিক তখন ফিসফিস করে বলল, “সাবধান। তুই যদি একবার এই পথ বেছে নিস, তবে তোর আত্মা আর তোকে ফিরিয়ে দেবে না। তুই সময়ে হারিয়ে যাবি, আর যা বাকি থাকবে সেটা কেবল এক খালি খোলস।”
হঠাৎ ঝড় উঠল। পুকুরের জল উথালপাতাল করতে লাগল। দূরে মীরার হাসির আওয়াজ ভেসে এলো—শীতল, অচেনা, অথচ টানটান পরিচিতির মতো। অদিত্যর চোখ ভিজে উঠল। সে বুঝল, এই যুদ্ধ আর বাইরের নয়, ভেতরের।
তান্ত্রিক তখন উঠে দাঁড়াল। কণ্ঠে বজ্রের মতো দৃঢ়তা—
“মৃতের সঙ্গে খেলা কোরো না। কিন্তু যদি খেলতেই হয়, তবে প্রস্তুত থাকিস—প্রতি ডুব মানে তোকে একটু একটু করে গ্রাস করবে। আর একদিন তুই নিজেই চিনতে পারবি না, তুই কে।”
অদিত্য বুক চেপে শ্বাস নিল। সে জানত, সিদ্ধান্ত তাকে নিতেই হবে।
সেদিন রাতে আকাশ কালো মেঘে ঢেকে গেল। পুকুরের নীল আলো আরও তীব্র হয়ে উঠল। দূরে কোথাও শকুনের ডাক ভেসে এলো। অদিত্য জানল, খেলার নিয়ম বদলাচ্ছে। মীরাকে ফিরিয়ে আনার খেলা এখন নীলতন্ত্রের হাতে।
পর্ব ৭: আত্মার লেনদেন
রাত গভীর হচ্ছিল। পুকুরের ধারে বসে অদিত্যর মনে হচ্ছিল, সে যেন এক অদৃশ্য দড়ির টানে আটকে পড়েছে। একদিকে তান্ত্রিকের সতর্কবার্তা, অন্যদিকে মীরার হাসি—যা এখন আর কেবল তার বোনের হাসি নয়, বরং এক অচেনা শক্তির প্রতিধ্বনি। আকাশে চাঁদ মেঘে ঢাকা, কিন্তু নীল আলো জল ভেদ করে চারদিক ছড়িয়ে পড়ছে, যেন অদৃশ্য কোনো যজ্ঞের অগ্নিশিখা।
অদিত্যর হাতে তখনও সেই পুরোনো পান্ডুলিপি। পাতাগুলো উল্টাতে উল্টাতে সে দেখতে পেল, অদ্ভুত কিছু মন্ত্র আঁকিবুঁকি করে লেখা। প্রতিটি পাতার পাশে রক্তের মতো দাগ, শুকনো, কালচে। একটি পাতায় স্পষ্ট লেখা ছিল—“এক প্রাণ দিয়ে এক প্রাণ ফেরে। আত্মার বিনিময়ে আত্মা। দান না দিলে ফেরত নেই।”
অদিত্যর বুক ঠান্ডা হয়ে গেল। সে অনুভব করছিল, মীরার ফিরে আসার নেপথ্যে তার নিজেরই কোনো অংশ চলে গেছে। হয়তো প্রথম ডুবেই সে নিজের প্রাণের কিছু টুকরো হারিয়েছে। সে চোখ বন্ধ করতেই ভেসে উঠল ভয়ঙ্কর স্বপ্ন—সে নিজেই দাঁড়িয়ে আছে পুকুরের তলায়, বুক ফুঁড়ে অন্ধকারে ছড়িয়ে দিচ্ছে রক্ত, আর সেই রক্তে মীরা দাঁড়িয়ে হাসছে।
হঠাৎ পেছন থেকে মীরার কণ্ঠ ভেসে এল—
“দাদা, তুই কি সত্যিই আমায় চাইছিস?”
অদিত্য ঘুরে তাকাল। মীরা দাঁড়িয়ে আছে, সাদা পোশাকে, চোখে অদ্ভুত লাল আভা। তার ঠোঁটের কোণে একটুকরো রক্ত জমে আছে।
“তুই আবার…?” অদিত্য কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল।
মীরা ধীরে ধীরে এগিয়ে এল, তার পায়ের ছাপ যেন ভিজে কাদায় ডুবে যাচ্ছে, যদিও মাটিতে কাদা নেই। সে ফিসফিস করে বলল,
“আমি তোকে ছাড়া থাকতে পারি না। কিন্তু তুই যদি আমায় রাখতে চাস, তবে তোর আত্মা আমার সঙ্গে ভাগ করে নিতে হবে।”
অদিত্য স্তব্ধ। বুকের ভেতর দম বন্ধ হয়ে আসছিল। “মানে?”
মীরা মৃদু হাসল। সেই হাসিতে মানবিকতা ছিল না, ছিল এক গভীর প্রলোভন।
“তুই যদি দ্বিতীয়বার ডুব দিস, তবে তোর আত্মার আরও এক টুকরো আমার হবে। তখন আমি আরও স্থায়ী হব। আমি বাঁচব, তুইও বাঁচবি, কিন্তু আমরা একসাথে হব। তোর শরীরে তোর আত্মা যেমন থাকবে, তেমনই আমারও থাকবে।”
অদিত্যর কানে কথাগুলো বাজছিল—আত্মার লেনদেন।
সে অনুভব করল, শরীর শীতল হয়ে যাচ্ছে। এ কি প্রলোভন, না ফাঁদ?
ঠিক তখনই অন্ধকারের ভেতর থেকে তান্ত্রিকের গলা শোনা গেল—
“শোন, এ খেলা তুই হারবেই। মৃতকে বাঁচানো মানে নিজের জীবন খুঁড়ে দেওয়া। তুই যদি ডুব দিস, তোর আত্মা চিরতরে ভাগ হয়ে যাবে। তুই তখন আর তুই থাকবি না।”
মীরা হেসে উঠল, তীক্ষ্ণ, অচেনা। “তুই কে রে বুড়ো? আমার দাদাকে ভয় দেখাচ্ছিস? ও তো আমায় ভালোবাসে, ও যে কোনো দাম দেবে।”
তান্ত্রিক কড়া স্বরে বলল, “ভালোবাসা নয়, এটা আসক্তি। আর আসক্তিই নীলতন্ত্রের শক্তি। তুই যদি এই প্রলোভনে পড়িস, তবে চিরকালের জন্য তুই হারিয়ে যাবি।”
অদিত্যর বুক কেঁপে উঠল। কিন্তু সে জানত, মীরার ছাড়া তার পৃথিবী শূন্য। হঠাৎ তার মনে পড়ল, মীরার ছোটবেলায় বলা কথা—
“দাদা, আমি যদি হারিয়ে যাই, তুই আমায় খুঁজে আনবি তো?”
সে তখন মাথা নেড়ে বলেছিল, “হ্যাঁ, অবশ্যই।”
আজ সেই প্রতিশ্রুতি যেন বুক ফুঁড়ে জ্বলে উঠল। অদিত্য ধীরে ধীরে জলের দিকে এগোল।
“আমি দ্বিতীয়বার ডুব দেব।”
তান্ত্রিক চিৎকার করে উঠল, “না! তুই জানিস না, কী হারাবি!”
মীরা ফিসফিস করে বলল, “এসো দাদা, এবার আমরা একসাথে হব।”
অদিত্য বুক চেপে জলে পা দিল। ঠান্ডা শিহরণ আবার শরীর ভেদ করল। পুকুর যেন আগের থেকেও ক্ষুধার্ত। ঢেউ তীব্র হয়ে উঠল, কানে অসংখ্য কণ্ঠ গর্জে উঠল—
“এক প্রাণ দিয়ে এক প্রাণ ফেরে… আত্মা দিয়ে আত্মা ফেরে…”
অদিত্য অনুভব করল, তার শরীর থেকে আলো ছিঁড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। বুকের গভীরে শূন্যতা তৈরি হচ্ছে। সে ডুবতে ডুবতে দেখতে পেল, মীরার মুখ তার পাশে ভেসে উঠেছে, কিন্তু সেই মুখে এবার মানবিকতা নেই, আছে এক অদ্ভুত বিজয়ের হাসি।
হঠাৎ চারপাশ অন্ধকার হয়ে গেল। শেষবারের মতো অদিত্য মনে করল, তার নিজের ভেতর থেকে কিছু বেরিয়ে যাচ্ছে—যেন আত্মার অর্ধেক টুকরো মীরার হাতে তুলে দিল।
পুকুরের জল তখন শান্ত হয়ে এলো। নীল আলো নিভে গেল। তীরে উঠে এলো অদিত্য—ক্লান্ত, নিঃশ্বাসহীন, ফ্যাকাশে। আর মীরা দাঁড়িয়ে আছে তার পাশে, চোখে আগুনের মতো আলো।
সে মুচকি হেসে বলল, “এবার আমি পুরোপুরি বেঁচে আছি, দাদা। কিন্তু তুই… তুই আর আগের মতো নেই।”
অদিত্য হাঁপাতে হাঁপাতে বুঝল, সত্যিই তার ভেতর থেকে কিছু নেই হয়ে গেছে। সে এখন অর্ধেক অদিত্য, আর অর্ধেক কেবল নীলতন্ত্রের ছায়া।
পর্ব ৮: উন্মোচিত গোপন ইতিহাস**
অদিত্যর দিনগুলো যেন অন্যরকম হয়ে উঠল। দ্বিতীয়বারের ডুবের পর থেকে তার শরীর ভারী, নিঃশ্বাস ছোট ছোট, চোখে অস্বাভাবিক ক্লান্তি। আয়নায় তাকালে সে বুঝতে পারত—তার চোখের ভেতরেও অদ্ভুত নীলাভ আভা জমে উঠেছে। মীরা সারাক্ষণ তার পাশে, কিন্তু মীরার প্রতিটি নড়াচড়ায় অদিত্য আরও অস্বস্তি অনুভব করছিল। সে যখন হাঁটে, তখন মাটিতে পায়ের ছাপ পড়ে না। সে যখন হাসে, তখন গ্রামের কুকুররা হঠাৎ চিৎকার করে ওঠে।
গ্রামবাসীরা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছিল। তারা জানত, এই ভাই-বোন এখন আর সাধারণ মানুষ নয়—তারা নীলতন্ত্রের ফাঁদে আটকে গেছে। সন্ধ্যেবেলা উঠোনে আলো জ্বললে দূর থেকে কেউ আসত না। বাচ্চাদের বেরোতে দিত না কেউ। বাতাসে নিস্তব্ধতা আরও ঘনীভূত হচ্ছিল।
একদিন অদিত্য আবার সেই তান্ত্রিককে খুঁজতে বেরোল। পুকুরপাড়ে বৃদ্ধ বসে ছিলেন, রুদ্রাক্ষের মালা হাতে। অদিত্য হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, “আমাকে সব বলুন। আমি জানতে চাই এই শাস্ত্র কোথা থেকে এলো। আমার বোনকে যদি ফিরিয়ে আনা যায়, তবে এর অন্তরালে কী আছে আমি না জেনে পারব না।”
তান্ত্রিক ধীরে চোখ তুললেন। গলায় গভীর সুর, “তুই যে পথ বেছেছিস সেটা বহু বছর আগে লেখা হয়েছিল। নীলতন্ত্রের জন্ম হয়েছিল এক অভিশপ্ত যজ্ঞ থেকে। তখন এই গ্রামটা এক জমিদারের অধীনে ছিল। জমিদার অদম্য ক্ষমতা চেয়েছিল, আর সেই ক্ষমতা আনতে এক তান্ত্রিককে ডেকে আনে। তান্ত্রিক প্রস্তাব দিল—যদি সে শত প্রাণ উৎসর্গ পায়, তবে এক শাস্ত্র লিখবে যা সময়কেও বাঁকাতে পারবে।”
অদিত্যর গা শিরশির করে উঠল। তান্ত্রিকের চোখে প্রতিফলিত হচ্ছিল বহু বছরের দুঃখ।
“সেই যজ্ঞে শতজন গ্রামবাসীকে বলি দেওয়া হয়েছিল। তাদের রক্তে লেখা হয়েছিল এই পান্ডুলিপি। শাস্ত্রের অক্ষর মানুষের নয়, আত্মার। প্রতিটি শব্দে একটি করে আত্মা বাঁধা। তাই এই শাস্ত্র পড়লেই বা ব্যবহার করলেই তার দাম দিতে হয় আত্মা দিয়ে।”
অদিত্যর বুক কেঁপে উঠল। সে ফিসফিস করে বলল, “তাহলে মীরাকে ফেরানো মানে… আমি আসলে এই শাস্ত্রের জালে জড়িয়ে পড়ছি?”
তান্ত্রিক ঠান্ডা মাথায় বললেন, “ঠিক তাই। তুই ইতিমধ্যে নিজের আত্মার অর্ধেক দিয়ে দিয়েছিস। তুই যতবার ডুব দিবি, ততবার তোর ভেতর থেকে আলো সরে যাবে। একদিন তুই আর তুই থাকবি না।”
অদিত্যর চোখে জল এসে গেল। “কিন্তু আমি ওকে ছাড়া বাঁচব না।”
বৃদ্ধ দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। “এই তো নীলতন্ত্রের শক্তি। সে ভালোবাসাকে প্রলোভনে পরিণত করে। তুই ভাবছিস তুই তোর বোনকে বাঁচাচ্ছিস, কিন্তু আসলে তুই নিজের মৃত্যুর রাস্তা পাকা করছিস।”
হঠাৎ চারপাশের বাতাস কেঁপে উঠল। পুকুর থেকে ভেসে এল অদ্ভুত আওয়াজ—কান্না, হাহাকার, মন্ত্রোচ্চারণ সব একসাথে। অদিত্যর চোখ ঝাপসা হয়ে গেল। সে দেখল, পুকুরের তল থেকে অসংখ্য হাত বেরিয়ে আসছে—পাতলা, রক্তে ভেজা হাত—যেন তাকে ডাকছে।
তান্ত্রিক হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠলেন, “দেখ, এরা সেই শত আত্মা। ওরা এখনও মুক্তি পায়নি। প্রতিবার তুই ডুব দিস, ওরা তোকে টেনে নিতে চায়।”
অদিত্য কানে হাত চাপল। কিন্তু মীরার গলা আবার তার মাথার ভেতর প্রতিধ্বনিত হল—
“দাদা… তুই যদি আবার ডুব দিস, আমি পুরোপুরি বাঁচব।”
অদিত্যর বুক ফেটে যাচ্ছিল। তার চোখে ভেসে উঠল মীরার ছোটবেলার মুখ—পড়ন্ত চুল, খিলখিল হাসি, রোদে দৌড়ে বেড়ানো। সেই মীরাকে সে চেয়েছিল। কিন্তু আজকের মীরার ভেতর দাঁড়িয়ে আছে অন্য কিছু।
তান্ত্রিক ধীরে ধীরে ফিসফিস করে বললেন, “মনে রাখিস, প্রতিটি আত্মার লেনদেন মানে এক নতুন শিকল। তুই যদি আবার তলায় নামিস, তবে আর ফিরতে পারবি না।”
অদিত্য কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল, “কোনও উপায় নেই?”
বৃদ্ধ কিছুক্ষণ নীরব থেকে বললেন, “একটাই উপায় আছে—শাস্ত্র ধ্বংস করা। কিন্তু সেটা করতে হলে তোকে নিজেকে উৎসর্গ করতে হবে।”
অদিত্যর বুক ধক করে উঠল। একদিকে মীরার মুখ, অন্যদিকে নিজের অস্তিত্ব।
আকাশে বজ্রপাত হল। পুকুরের নীল আলো আকাশ ছুঁয়ে উঠল। বাতাসে রক্তের গন্ধ ভেসে এল। আর অদিত্য বুঝল—এই লড়াই থেকে তার ফেরার পথ নেই।
পর্ব ৯: শেষ ডুবের সিদ্ধান্ত
বাতাসটা এখন আগের চেয়ে কাঁকড়া ঠান্ডা। পুকুরপাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা ঝোপঝাড়েরা যেন ডানায় ভরা কালো ছাই—নিঃশব্দ। অদিত্য ব্যথা আর ক্লান্তি নিয়ে হেঁটে ফিরছিল, কিন্তু প্রতিটি পদক্ষেপে মনে হচ্ছিল সে কালের প্রতি এক ধাক্কা খেলেই ফেলেছে—হাঁটা হচ্ছে ঢেউয়ের বিপরীত। আত্মার ভাঙন তার শরীরে চিহ্ন রেখে গেছে; আয়নায় সে আর নিজেকে চিনতে পারে না। চোখে নীলাভ কুঁচো, মুখে ঝাপসা হাসি—এগুলো সব জানিয়ে দিচ্ছে, তার ভেতর থেকে কিছু চুরি হয়ে গেছে।
তিন দিন কেটেছে। তিন দিন ধরে মীরা সকাল-সন্ধ্যা পুকুরের ধারে বসে থাকে, হাতে অদ্ভুত মন্ত্র ফিসফিস করে, এবং মাঝে মাঝে গ্রামের কাছাকাছি লোকজনের নামে ডাকে—যাদের কেউ চেনেই না। গ্রামবাসীরা ঘরের দরজায় তালা টেনে বসে আছে; শিশুরা বাইরে ঝোঁপে খেলার সাহস ধরে না। কেউ কেউ বলছে মীরার সঙ্গে অদ্ভুত ঘটনা ঘটছে—হঠাৎ রাতের মধ্যেই কেউ চিৎকার করে উঠে ক্লান্ত হয়ে পড়ে, কেউ দেখতে পেয়েছে মীরার চোখে অচেনা ছায়া ঘুরছে।
অদিত্যর কাছে সময় এখন আর হিসাবের বিষয় নয়; প্রতিটি মুহূর্তে সে অনুভব করছিল, তার মধ্যে কি কমে যাচ্ছে, কি বাড়ছে — জানা নেই। তোরণ-সুবর্ণ-ঝঙ্কারে ভরা গ্রাম এখন যেন ধীরেই ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে। সে বুঝতে পারল, সিদ্ধান্তটা মনের অগভীর থেকে আসছে—শেষ ডুব। কিন্তু শেষ ডুব মানে কি মুক্তি? না কি চিরস্থায়ী হারা?
রাতের দিকে তান্ত্রিক এসে গেল — হাঁটতেই মনে হচ্ছিল যেন পৃথিবীর নাভি ঠান্ডা হয়ে গেল। বৃদ্ধের চোখে এইবার বিমূর্ত এক তীব্রতা; সে আর সতর্কবাণী কেবল দিল না, বরং দেয়াল-চিহ্নগুলো খুলে বলল—“এখনও একটা উপায় বাকি আছে। কিন্তু সেটা দামের চেয়েও বেশি চাইবে: তুই যদি শাস্ত্র ভাঙতে চাস, তোর চূড়ান্ত আত্ম-উৎসর্গ দিতে হবে।”
উৎসর্গ—এই শব্দের ভেতরেই অদিত্যর সব থাকাপন্ন ডুবে গেল। কি জিজ্ঞেস করলো—“কি মানে?”
তান্ত্রিক চোখের কোণে ঝলক দেখিয়ে বলল, “শাস্ত্র ভাঙার মানে—উৎসাহিত লিঙ্কগুলো ছিন্ন করা। প্রতিটি লিঙ্ক একটি জীবন; তুই যদি নিজের আত্মাকে পুরোপুরি ছাড়তে রাজি আছিস, তবেই ওই পুকুর থেকে সব আত্মা মুক্ত হবে। কিন্তু একবার তুই নিজের জীবন ছাড়লে, ফিরে আসার পথ থাকবে না।”
অদিত্য মনের ভেতর একটি ছবি দেখতে পেল—মীরার শিশুশ্রাবণ মুখ, সে কিভাবে তার মনে খেলা করত; তার ভাঙা টুকরো স্মৃতি, সবই যেন এখন একটি ঝাঁকুনি খাচ্ছে। সে ভাবল, যদি একবার সব আত্মা মুক্ত হয়ে যায়, মীরা কি সত্যিকারে ফিরে আসবে? যদি না আসে—তবে কি সবকিছু বৃথা হয়ে যাবে? তান্ত্রিকের চোখে সে ভয় দেখল—“অনেকেই হয়েছে, যারা বিশ্বাস করেছে, যে ভালোবাসা সবকিছু জিতবে। শেষ পর্যন্ত ওরা হারায়।”
সে রাতে অদিত্য দীর্ঘক্ষণ নিঃশ্বাস নিয়ে মীরার দিকে তাকিয়ে রইল। মীরা শুয়ে আছে, চোখ বন্ধ—কিন্তু মনে হচ্ছিল চোখের পলকও ভেতর থেকে অদ্ভুতভাবে নাড়াচাড়া করছে। তার শরীর ঠান্ডা, কিন্তু প্রাণচঞ্চলতার কোনো চিহ্ন আছে; সে মাঝে মাঝে কাঁধ নড়ায়, যেন কেউ ভিতর থেকে কথা বলছে। অদিত্য শোনে, মীরার স্বরে একটা অচেনা সুর—“এইবার তুই কি দেবে?”
সন্ধ্যা হয়ে গেলে গ্রামটা নিঃশব্দে এক চূড়ান্ত সংকল্পের কাছে পৌঁছে গেল। কেউ গোপনে কাঁচা রুটি নিয়ে নেমে আসে, কেউ কেবল দোয়া করে বসে। কেউ কেঁদে কেঁদে ফিরে যায়। আর অদিত্য? সে জানে যে সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করলে আর হবে না—নীলতন্ত্র তেমন লোককে ক্ষমা করে না।
পরের রাতেই সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে—অতঃপর আর কোন ফিরবার নেই। তান্ত্রিক বলল যে কর্মটা করণীয় হবে পুকুরের মাঝিমাঝি, যেখানে শূন্যতা সবচেয়ে গভীর। সেই স্থানে একটি বৃত্ত আঁকা হবে, অগ্নি জ্বালানো হবে, এবং নিজের নাম উচ্চারণ করে তোর আত্মাকে ছেড়ে দিতে হবে—ততক্ষণে যত আত্মা বন্ধ আছে, তারা মুক্তি পাবে। কিন্তু যদি তুই নাম ভাঙতে পারিস না—তবে তোর আত্মার অংশটাই গ্রাস করে নীলতন্ত্র।
অদিত্য বিস্মিত—তার ভেতরকার শেষ ভয়টা তখন রক্তের মতো উথলে উঠল: সে কি শিখতে পারবে তার নাম ছেড়ে দিতে? নাম ছাড়া কে সে থাকবে? নামই কি চেনার কথা নয়? তবু নীরবে সে বুঝল—তাঁর কাছে আর কোনো বিকল্প নেই।
রাত যখন গম্ভীর, তারা সবাই পুকুরপাড়ে জড়ো হল—গ্রামবাসী, তান্ত্রিক, অদিত্য ও একরাশ প্রত্যাশা ও ভয়। মীরাকে সে পাশে বসিয়ে রাখল—তার দেহ যেন জ্বলজ্বল করছে, কিন্তু মুখে এক অদ্ভুত প্রশান্তি নেই। তান্ত্রিক বললেন শেষ কথা—“এটাই একমাত্র পথ। তুই যদি নাম ছেড়ো, তবে আমি শাস্ত্র ভেঙে দেব।” অদিত্য মুখে কাঁটা দিয়ে বলল, “আমি চাই মীরা ফিরে আসুক—নিরপেক্ষভাবে, পুরোপুরি।”
তান্ত্রিক চোখ বন্ধ করে নীরবে মন্ত্র কি উচ্চারণ করল—চোখ বুজে সকলেই শুনল না শোনা কথা। বাতাসে এমন একটি চাপ এসে লাগল, যেন আকাশ আর মাটি একই সুরে গাইছে। অদিত্য তখন ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল। সে বুক থেকে সমস্ত শব্দ কেটে ফেলল—তার নাম বলার সময়। সে নিজেকে খুঁজে পেল না—কীভাবে বলবো, সে কি অদিত্যের নাম বলবে, নাকি অন্য কিছুর?
তান্ত্রিক এবার বলল—“তোর নাম বললেই হবে না—তোর আত্মার পরিচয় ছেড়ে দিতে হবে: তোর সব স্মৃতি, তোর সব স্বপ্ন, সব ন্যূনতম টুকরো—ছেড়ে দিতেই হবে।”
অদিত্য মুখে কাঁটা নিয়ে বলল—“আমি তুই”—তার গলা মাঠে কেঁপে উঠল—“আমি অদিত্য বসু, আমি মীরাকে ফিরে আনব।” কিন্তু নাম উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গেই সে অনুভব করল—তার ভেতর থেকে এক ভীতু নিঃশ্বাস ছুটে যাচ্ছে; স্মৃতির পাতা একে একে ফড়িং দিয়ে পড়ছে। প্রথমে অর্ধেক—তার বাবার হাসি, মায়ের রান্নাঘরের গন্ধ—সব ম্লান হয়ে এল। তারপর ছোট ছোট গল্প—স্কুলের ছুটি, মীরার কাঁদা মুখ—সব ডুবে যেতে লাগল।
তান্ত্রিক দ্রুত বৃত্তের চারধারে ঘূর্ণে উঠল; মন্ত্রের তালে পুকুরে তরঙ্গ উঠল। আকাশে অদ্ভুত আলো—নীল, লাল, সাদা—সব একসাথে মিশল। অদিত্য তখন বুঝতে পারল—প্রতিটি স্মৃতি পাল্টে মিলছে, পাঠ্য হয়ে যাচ্ছে আর ফিকে হয়ে পড়ছে, আর সাথে সাথে পুকুরে বন্ধ আটকে থাকা আত্মারা ধীরেসুস্থে মুক্ত হচ্ছে। তারা প্রথমে কাঁদল, তারপর হেসে উঠল, শেষে এক সৌম্য প্রশান্তিতে গেল।
মীরার চোখ একফুটের মতো উজ্জ্বল হয়ে উঠল; সে তখনই কাঁদতে লাগল—শুধু দু’টি নীরব অশ্রু। গ্রামবাসীরা প্রথমবার মুক্তির সেই ভাব দেখল—কেউ কেঁদে উঠল, কেউ হাঁটতে থাকল, কেউ হাত জোড় করল। তান্ত্রিকের গলায় কেঁদে ওঠার মতো কিছু সুর—সে জানত, বহু বছর কষ্টের পর এমনটা মুখে ফোটায়।
কিন্তু তারপর—অদিত্য ধীরে ধীরে বুঝল, তার ভেতরে এক বিশাল শূন্যতা রয়ে গেছে। সে এখন ঠিক লোকটি নন, যে সেই সব স্মৃতি নিয়ে ফিরে যেত। তার চোখের ভেতর একটি ফালি খালি রেখা—তার জীবনের একটা শব্দ নেই। সে বুঝল তার নিজের নাম এখন ফিকে হয়ে আসছে—শেষে, সে নিজেকে বলে উঠল, “আমি—” তবে বাকিটা আর নেই।
মীরা তখন চিৎকার করে উঠে বলল, “দাদা, তুই কোথায়?” তার কণ্ঠে পলক নরম, কিন্তু ভিতরে যেন এক দীর্ঘ অপেক্ষা—কেউ বোঝে না। অদিত্য কেবল হেসে বলল, “আমি আছি।” কিন্তু জানে না সত্যিই আছে কী না।
পুকুর নীরব, আকাশ কিছুক্ষণের জন্য পরিষ্কার হয়ে গেল। গ্রামবাসীরা একে একে ফিরতে লাগল, আবার যেন নতুন কর্মের দিকে ধাবিত। কিন্তু অদিত্য জানে—তাঁর ভিতরে যা হারাতে হয়েছে, তা আর ফিরে আসবে না। সে এখন লাফিয়ে পড়েনি মাত্র একটি মহাকালের ভিতর; সে এক ক্ষুদ্র মানুষ—মায়া আর স্মৃতির ভাঙা খোলসে বন্দী থেকেছে।
পর্ব ১০: নীল সময়ের ফাঁদ
গ্রামের আকাশে পূর্ণিমার আলো মিলিয়ে গিয়েছে, অথচ নীলাভ আভা থেকে গেছে। পুকুর শান্ত, জলের উপর ঢেউ নেই, কিন্তু সেই শান্তি ভেতর থেকে ভয়ঙ্কর। অদিত্য তীরে বসে আছে—চোখে ফাঁকা দৃষ্টি। কয়েক ঘণ্টা আগেই সে নিজের আত্মার এক বিশাল অংশ ছেড়ে দিয়েছে, আর এখন তার ভেতর কেবল শূন্যতা।
গ্রামবাসীরা ধীরে ধীরে নিজেদের ঘরে ফিরে গেছে, অনেকে কেঁদেছে, অনেকে হাত জোড় করেছে। তারা বিশ্বাস করছে শত আত্মা মুক্তি পেয়েছে। কিন্তু অদিত্য জানে, মুক্তির পথে সে নিজেই বন্দি হয়ে গেছে।
মীরা তার পাশে বসে আছে। তার চোখে এইবার অদ্ভুত কোমলতা, যেন সত্যিকারের মীরা ফিরেছে। ঠোঁট কাঁপছে, গলায় জড়তা—
“দাদা, তুই আমায় ফিরিয়ে এনেছিস। কিন্তু তুই… তুই তো আর তুই নেই।”
অদিত্য তাকাল বোনের দিকে। চোখে জল এলেও অনুভূতি নেই। মায়ের মুখ, বাবার মৃত্যুর দিন, শৈশবের খেলা—সবই অস্পষ্ট। সে কেবল নাম মনে করতে পারছে—মীরা। কিন্তু নিজের নামও যেন অর্ধেক মুছে গেছে।
তান্ত্রিক তখন এগিয়ে এলেন। গলায় কর্কশ ক্লান্তি, চোখে শূন্যতা।
“সব শেষ হয়েছে। আত্মারা মুক্ত হয়েছে। কিন্তু তুই… তুই সময়ের কাছে বন্ধক রেখে দিলি নিজের পরিচয়। নীলতন্ত্র আরকে গিলে নেয়নি, তবু তুইও মুক্ত নোস।”
অদিত্য ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, “আমি কি এখনো অদিত্য?”
তান্ত্রিক মাথা নাড়লেন, “তুই শুধু এক নামের ছায়া। তুই আছিস, আবার নেই।”
হঠাৎ পুকুরের জলে ঢেউ উঠল। এক মৃদু শব্দ—মন্ত্র, ফিসফিসানি, কান্না সব মিলেমিশে। অদিত্যর মনে হলো, কেউ তাকে ডাকছে ভেতর থেকে। তার শরীর ভারী হয়ে আসছিল, পা যেন অদৃশ্য টানে জলের দিকে এগোতে চাইছে।
মীরা তার হাত ধরে বলল, “না, দাদা। তোকে আমি হারাব না।”
অদিত্য শান্ত স্বরে বলল, “কিন্তু আমি তোকে আগেই হারিয়েছি। তোকে ফিরিয়ে আনতে গিয়ে আমি নিজেকেই হারিয়ে ফেলেছি।”
বাতাসে এক অদ্ভুত চাপ ছড়াল। আকাশে হঠাৎ ঝলকানি। গ্রাম নিঃশ্বাস বন্ধ করে থাকল। অদিত্যর চোখে তখন পুকুরের তল দেখা গেল—অসংখ্য মুখ, অসংখ্য হাত, মুক্তির আনন্দে মিলিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সেই মুক্তির ভেতরও একটা কণ্ঠ ভেসে এল—“তুই এখন আমার। নীল সময়ের ফাঁদ থেকে কেউ ফেরে না।”
অদিত্য হঠাৎ থমকে গেল। সে বুঝল, তার মুক্তি অসম্ভব। পুকুর তাকে টেনে নেবে, সময় তাকে আটকে রাখবে। সে হাসল—এক ফাঁকা, ক্লান্ত হাসি।
“মীরা, তুই বাঁচিস। আমি আছি, তোর স্মৃতির ভেতর।”
মীরার চোখে জল গড়াল। সে চিৎকার করল, “না দাদা, তুই কোথাও যাবি না!” কিন্তু ঠিক তখনই অদিত্যর শরীর কাঁপতে লাগল, চোখে অদ্ভুত আলো জ্বলল। মুহূর্তের ভেতর তার ছায়া টেনে নিল পুকুর। জলে একটা ঢেউ উঠল, তারপর সব শান্ত।
মীরা মাটিতে বসে কাঁদছিল। তান্ত্রিক দূর থেকে তাকিয়ে ছিলেন। তার ঠোঁট নড়ল, “এটাই নিয়তি। নীলতন্ত্র কাউকে ছাড়ে না।”
পরদিন গ্রামবাসীরা দেখল, গ্রাম স্বাভাবিক হয়ে গেছে। আকাশে পাখির ডাক, বাচ্চাদের খেলা, বাতাসে ধানের গন্ধ। কিন্তু পুকুরের ধারে একটা নীরব শূন্যতা থেকে গেল। কেউ আর ওদিকে যায়নি।
মীরা বেঁচে রইল, কিন্তু তার চোখের ভেতর চিরকাল খোদাই হয়ে গেল দাদার মুখ। আর পুকুর? পূর্ণিমার রাতে এখনও জলে নীল আলো জ্বলে ওঠে। গ্রামের লোকেরা বলে, জলের গভীরে আজও একটা ছায়া ভেসে থাকে—শূন্য চোখে তাকিয়ে থাকে আকাশের দিকে।
সে অদিত্য।
যে বোনকে ফেরাল, কিন্তু নিজের নাম আর খুঁজে পেল না।
সে বন্দি হয়ে রইল—নীল সময়ের ফাঁদে।