Bangla - ভূতের গল্প

জোড়াসাঁকোর পুরনো প্রাসাদ

Spread the love

সৌম্য বক্সী


অধ্যায় ১: রহস্যময় প্রাসাদের ডাক

শহরের ব্যস্ততা থেকে দূরে, উত্তর কলকাতার এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে জোড়াসাঁকোর পুরনো প্রাসাদ। চারপাশে আধুনিক ভবন, গাড়ির কোলাহল, হর্নের শব্দ—সবই ভেসে আসে, তবু প্রাসাদটিকে ঘিরে যেন এক অদৃশ্য দেওয়াল তৈরি হয়েছে। ভাঙা রেলিং, শ্যাওলা ধরা দেয়াল, আধভাঙা সিঁড়ি আর অন্ধকারমাখা জানালা, সব মিলিয়ে জায়গাটা যেন সময়ের গর্ভে আটকে গেছে। মানুষজন এদিক দিয়ে এলে দূর থেকেই চোখ সরিয়ে নেয়, কারণ দীর্ঘদিন ধরেই এর চারপাশে নানা গুজব ছড়িয়ে পড়েছে। কারও দাবি, রাতে সিঁড়ি বেয়ে নামতে দেখা যায় সাদা শাড়ি পরা এক নারীকে। কেউ বলে, জানালার কাচে প্রতিফলিত হয় অদ্ভুত ছায়া। আবার অনেকেই বিশ্বাস করে, প্রাসাদের ভেতরে একাধিক অচেনা মানুষ ঘুরে বেড়ায়—যাদের এখানে থাকার কথা নয়। স্থানীয়দের মধ্যে এত গল্প চালু যে, প্রাসাদের নাম শুনলেই গায়ে কাঁটা দেয়। কিন্তু এইসব কাহিনি যতই ভয়ঙ্কর শোনাক না কেন, গবেষক অনির্বাণের কাছে এগুলো ছিল শুধু মানুষের কল্পনা আর ইতিহাসের অন্ধকার দিকের মিশ্রণ। সে ইতিহাসের ছাত্র, ফটোগ্রাফারও বটে, আর তার বিশ্বাস—প্রতিটি পুরনো স্থাপত্যই শুধু ইট-পাথরের ভগ্নাবশেষ নয়, বরং একেকটা সাক্ষী, যাদের বুকে লেখা থাকে শত বছরের অজানা কাহিনি। তাই সবার নিষেধাজ্ঞা অগ্রাহ্য করে, সে এক বর্ষণমুখর বিকেলে কাঁধে ক্যামেরা নিয়ে পৌঁছে যায় প্রাসাদের সামনে।

প্রাসাদটির মূল দরজাটা অনেক আগেই ভেঙে পড়েছে, কেবল একটি বিশাল কাঠের ফ্রেম দাঁড়িয়ে আছে, যেন ক্লান্ত কোনো বৃদ্ধ খুঁটির ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মৃত্যুর আগে শেষবার। দরজা পেরোতেই অনির্বাণের পায়ে লেগে যায় শুকনো পাতার স্তূপ, ভেতরে ঢুকতেই অনুভব করে এক ধরনের ভিজে স্যাঁতসেঁতে গন্ধ, যেটা পুরনো কাঠ, ধুলো আর অবহেলার গন্ধ মিলিয়ে তৈরি। করিডরের দেয়ালে লম্বা ফাটল, জায়গায় জায়গায় প্লাস্টার খসে পড়ে ইট বেরিয়ে এসেছে। সিঁড়িগুলো এতটাই দুর্বল যে, পা রাখলেই কাঁপতে শুরু করে, আর কোথাও কোথাও কাঠ ভেঙে গিয়ে কালো অন্ধকার গহ্বর তৈরি হয়েছে। ছাদের ফাঁক দিয়ে ঢুকে পড়া আলোয় ধুলো ভেসে বেড়ায়, আর সেই আলোয় প্রাসাদটা যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে। অনির্বাণ এইসবই ক্যামেরায় বন্দি করতে শুরু করে, কারণ তার কাছে প্রতিটি ভাঙাচোরা চিহ্নই ইতিহাসের আলামত। কিন্তু ঠিক তখনই, শাটারের শব্দের সঙ্গে যেন মিলিয়ে ভেসে আসে আরেকটা অচেনা আওয়াজ—কোনো অচেনা ঘরে ধাতব কিছু পড়ে যাওয়ার মতো। অনির্বাণ থেমে যায়, শোনে। চারপাশ নিস্তব্ধ, শুধু তার নিজের নিঃশ্বাস আর দূরে পাখির ডাক। আবার যখন ক্যামেরা তোলে, মনে হয় আলো-ছায়ার ফাঁকে কেউ দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে। কিন্তু চোখ মেলে ভালো করে দেখলেই দেখা যায়—শুধু ফাঁকা জায়গা, ভাঙা দেয়াল। তবু বুকের ভেতর অজানা কিছুর ধাক্কা কাজ করতে থাকে।

এই প্রথমবার, অনির্বাণ বুঝতে পারে প্রাসাদটা নিছক স্থাপত্য নয়—এর শরীরে অদৃশ্য কিছু লেগে আছে। হয়তো মানুষের অমীমাংসিত স্মৃতি, হয়তো কারও মৃত্যুর আর্তনাদ, অথবা হয়তো নিছকই তার কল্পনা। সে নিজেকে বোঝায়—একজন গবেষকের কাজ হলো তথ্য খোঁজা, কল্পকাহিনি নয়। তাই আবার মনোযোগ ফেরায় ক্যামেরার লেন্সে। দেয়ালের এক কোণে নজর পড়তেই চমকে ওঠে—অসাবধানী আলোর ছটায় এক ম্লান প্রতিকৃতি ফুটে উঠেছে, যেন কোনো নারীর মুখাবয়ব, যার চোখ দুটো গভীর অন্ধকারে ডুবে গেছে। অনির্বাণ ভাবল, হয়তো দেয়ালের দাগ, ছত্রাক বা ভাঙাচোরা অংশের কারণে এমনটা মনে হচ্ছে। কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তেই, ক্যামেরায় ক্লিক করার পর স্ক্রিনে ফুটে ওঠে স্পষ্ট চিত্র—এক নারী তাকিয়ে আছে সরাসরি তার দিকে। ছবিতে নারী উপস্থিত, অথচ বাস্তবে দেয়ালটা ফাঁকা। অনির্বাণ কেঁপে ওঠে, তবু এক অদ্ভুত টান তাকে প্রাসাদের আরও গভীরে যেতে বাধ্য করে। অজানা রহস্য, ইতিহাসের অন্ধকার ছায়া, আর ক্যামেরার চোখে ধরা পড়া অদৃশ্য মানুষ—সব মিলে যেন এক নতুন যাত্রার দরজা খুলে গেল। প্রথমবার তার মনে হলো, এই প্রাসাদ তাকে ডাকছে, তার অপেক্ষায় ছিল অনেকদিন ধরে।

অধ্যায় ২: প্রথম পদচারণা

প্রাসাদের ভেতরে পা বাড়াতেই অনির্বাণের মনে হলো, যেন সে প্রবেশ করছে আরেকটা পৃথিবীতে। বাইরে তখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে, আলোর রঙ ধীরে ধীরে হলদেটে হয়ে উঠছে, আর সেই আলো করিডরের ফাঁক দিয়ে ঢুকে পড়ায় জায়গাটা আরও ভৌতিক হয়ে ওঠে। ছাদের কোণায় ঝুলে থাকা মাকড়সার জাল বাতাসে দুলছে, আর ফাঁকা ঘরে অনবরত প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে আসছে তার নিজের পদচারণার শব্দ। ধুলোতে ঢাকা মেঝে, অর্ধেক ভেঙে যাওয়া পাথরের মূর্তি, ছেঁড়া পর্দা সবকিছুই যেন অতীতের মৃত সাক্ষী হয়ে আছে। অনির্বাণ ভেতরে ভেতরে একটু অস্বস্তি অনুভব করলেও তার অনুসন্ধিৎসু মন দমে যায় না। সে প্রতিটি কোণে ক্যামেরা তাক করল, যেন চোখ এড়িয়ে যাওয়া কোনো অজানা চিহ্ন হঠাৎ ধরা পড়ে। কক্ষগুলো ফাঁকা, কিন্তু প্রতিটি ঘর যেন লুকিয়ে রেখেছে এক অদৃশ্য উপস্থিতি। দেয়ালের দাগ, মেঝের ফাটল, কাঠের খচখচে শব্দ—সবই যেন নিঃশব্দ ভাষায় বলতে চাইছে কোনো অজানা কাহিনি।

প্রাসাদের এক লম্বা করিডরে পৌঁছাতেই অনির্বাণ থেমে যায়। করিডরের শেষে এক বিশাল দরজা আধখোলা, ভিতরে অন্ধকার ঘনিয়ে আছে। সে টর্চ জ্বালিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। ঘরটা দেখে মনে হলো একসময় এখানে জমকালো আসবাবপত্র ছিল—কিন্তু এখন কেবল কাঠের ভাঙা চেয়ার, পোকায় খাওয়া টেবিল আর ভাঙা ঝাড়লণ্ঠন পড়ে আছে। তবু ঘরের ভেতরে একটা অদ্ভুত স্থিরতা আছে, যেন এই নিস্তব্ধতার আড়ালে লুকিয়ে আছে কারও নিশ্বাস। অনির্বাণ ছবি তুলতে তুলতে লক্ষ্য করল, দেয়ালের কোণে শুকনো রক্তের মতো কালচে দাগ। হাতের তালু ঘেমে উঠল, কিন্তু ক্যামেরা নামাল না। ফ্ল্যাশের আলো ঘরটাকে মুহূর্তের জন্য আলোকিত করতেই তার মনে হলো এক ছায়ামূর্তি টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু আলো নিভতেই জায়গাটা ফাঁকা। চোখের ভুল ভেবে আবার ছবি তুলল, আর স্ক্রিনে ফুটে উঠল অস্পষ্ট অবয়ব—একজন লম্বা মানুষ, পুরনো ধুতি পরা, মুখটা ছায়ায় ঢাকা। বাস্তবে কাউকে দেখা যাচ্ছে না, অথচ ছবিতে উপস্থিতি এতটাই স্পষ্ট যে অনির্বাণের বুকের ভেতর ঠান্ডা শিহরণ খেলে গেল।

ভয় আর কৌতূহলের মিশ্রণে সে আরও ভেতরে এগোল। করিডরের বাঁ দিকে ছিল একটি ছোট সিঁড়ি, যা উপরের তলায় নিয়ে যায়। সিঁড়ির কাঠগুলো পচে গেছে, প্রতিটি ধাপে চাপ দিলেই ভেঙে পড়ার শব্দ হয়। তবু অনির্বাণ পা বাড়াল। ওপর থেকে আসছে হালকা শীতল বাতাস, যেন কেউ অদৃশ্যভাবে শ্বাস ফেলছে। সে সিঁড়ি বেয়ে ওঠার সময় অনুভব করল, যেন পিছনে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল, কিন্তু অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই নেই। উপরের তলায় পৌঁছে সে দেখতে পেল আরেকটি করিডর, যেখানে জানালা ভাঙা, কাচের টুকরোগুলো ছড়িয়ে আছে। মেঝেতে পায়ের শব্দ অদ্ভুত প্রতিধ্বনি তৈরি করছিল, যেন একসাথে দু’জন হাঁটছে। অনির্বাণ এবার বুঝল—এ প্রাসাদ নিছক ভগ্নাবশেষ নয়, এখানে কিছু একটা সত্যিই আছে। হয়তো ছায়া, হয়তো অতীতের অদৃশ্য মানুষ, কিংবা তার ক্যামেরার লেন্সই এখন পর্দা সরিয়ে আসল চেহারা দেখাচ্ছে। কিন্তু সে আর পিছু হটল না, কারণ মনে হচ্ছিল—প্রাসাদের প্রতিটি অচেনা ছায়া আসলে তাকে এগিয়ে আসতে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে।

অধ্যায় ৩: ক্যামেরার চোখে ধরা পড়া

উপরতলার অন্ধকার করিডরে দাঁড়িয়ে অনির্বাণ অনুভব করল, তার চারপাশটা ক্রমেই ভারী হয়ে উঠছে। বাতাস যেন জমাট বেঁধে গেছে, নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু তার গবেষণার তৃষ্ণা ও ফটোগ্রাফারের প্রবৃত্তি তাকে পিছিয়ে যেতে দিল না। সে ক্যামেরা হাতে নিয়ে জানালার ভাঙা ফ্রেমের দিকে তাক করল। বাইরের আলো করিডরের ভেতরে এসে পড়ায় কিছুটা দৃশ্যমান হলো—ধুলো জমা মেঝে, ভাঙা কাচে আলো প্রতিফলন, আর ফাঁকা দেয়ালের দাগ। শাটার চাপতেই মুহূর্তের জন্য ঘরটা ফ্ল্যাশের আলোয় ঝলসে উঠল, আর ঠিক সেই সময় তার চোখে পড়ল এক অদ্ভুত দৃশ্য—দূরে করিডরের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে দু’টি ছায়া, যেন মানুষ, অথচ বাস্তবে কিছু নেই। অবচেতনে তার বুকের ভেতর ধক করে উঠল, তবু সে ক্যামেরার স্ক্রিনের দিকে তাকাল। ছবিতে স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে এক তরুণী, সাদা পোশাকে, চুল খোলা, আর তার পাশেই এক বৃদ্ধ মানুষ লাঠি ধরে দাঁড়িয়ে আছে। বাস্তবে ফাঁকা করিডর, অথচ ছবিতে তারা এতটাই প্রকট যে অনির্বাণের হাত কাঁপতে লাগল।

সে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল সেই দিকেই। প্রতিটি পদক্ষেপে মেঝের কাঠ ভাঙা শব্দ তুলছিল, আর মনে হচ্ছিল—অদৃশ্য চোখ তাকে লক্ষ্য করছে। ক্যামেরা আবার তুলতেই হঠাৎ এক অদ্ভুত শব্দ ভেসে এলো, যেন কারও মৃদু ফিসফিসানি। অনির্বাণ কানে ধরার চেষ্টা করল, কিন্তু শব্দটা মিলিয়ে গেল পরমুহূর্তেই। সে ক্যামেরার স্ক্রিনে আবার নজর দিল, আর এবার ছবিতে শুধু সেই তরুণীর মুখ দেখা গেল, পুরো ফ্রেম জুড়ে। তার চোখদুটো কালো শূন্যতায় ভরা, অথচ দৃষ্টিটা যেন সরাসরি অনির্বাণের দিকে নিবদ্ধ। তার শরীর শিউরে উঠল, কিন্তু ভেতরের কৌতূহল তাকে থামাল না। হঠাৎ সে খেয়াল করল, ছবির ভেতরের মেয়েটি যেখানে দাঁড়িয়ে আছে, বাস্তবে ঠিক সেই জায়গায় মেঝেতে ভাঙা গ্লাস ছড়িয়ে আছে, যেন কেউ সম্প্রতি সেখানে দাঁড়িয়েছিল। গ্লাসে আলো প্রতিফলিত হয়ে হালকা চকচক করছিল, আর সেই দৃশ্য তার অস্থিরতা আরও বাড়িয়ে দিল।

ঠিক তখনই পাশের একটি দরজা হালকা ঠাস করে বন্ধ হয়ে গেল। হাওয়া বা বাতাসের জোর নয়, যেন ভেতর থেকে কেউ হাত দিয়ে টেনে দিল। অনির্বাণ দৌড়ে গিয়ে দরজাটা খোলার চেষ্টা করল, কিন্তু সেটি শক্তভাবে আটকে আছে। কপালে ঘাম জমে উঠল, বুকের ভেতর ধুকপুকানি বেড়ে গেল, অথচ সে আবার ক্যামেরা তোলে, কারণ তার মনে হলো—এই মুহূর্তেই সত্যিকারের প্রমাণ ধরা পড়বে। শাটার চাপতেই স্ক্রিনে ধরা পড়ল এক অবিশ্বাস্য ছবি—দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকজন মানুষ, কারও চোখ নেই, কারও মুখ বিকৃত, আর তারা সবাই একসঙ্গে তাকিয়ে আছে অনির্বাণের দিকে। ছবি দেখে তার শরীর জমে গেল, শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল স্রোত নেমে এলো। তবু সে বুঝতে পারল—এখন আর পিছু হটার উপায় নেই, কারণ প্রাসাদের অদৃশ্য বাসিন্দারা তার ক্যামেরার চোখে ধরা দিতে শুরু করেছে। এই রহস্যের সূচনা মাত্র, আর সামনে অপেক্ষা করছে আরও ভয়ঙ্কর সত্য।

অধ্যায় ৪: অদৃশ্য দর্শকরা

প্রাসাদের নিস্তব্ধতার ভেতর দাঁড়িয়ে অনির্বাণ এখন প্রায় নিশ্চিত, সে একা নেই। তার ক্যামেরা যেটা ধরছে, সেটা বাস্তব চোখে দেখা যাচ্ছে না, অথচ অদ্ভুতভাবে সত্যি হয়ে উঠছে। ক্যামেরার লেন্সের প্রতিটি ক্লিকে যেন অদৃশ্য মানুষেরা ধরা দিচ্ছে, যাদের এখানে থাকার কথা নয়। সে যতই ছবি তুলছিল, ততই নতুন মুখ ভেসে উঠছিল—কখনো অল্পবয়সি এক চাকর, চোখে আতঙ্ক; কখনো আবার ঘোমটা টানা এক নারী, যার ঠোঁট হালকা নড়ছে যেন নিঃশব্দে কিছু বলতে চাইছে। অনির্বাণ ছবিগুলো একটার পর একটা স্ক্রিনে দেখছিল আর বুকের ভেতর শ্বাস ভারী হয়ে আসছিল। আশ্চর্যের বিষয়, প্রতিটি ছবিতে যারা দেখা দিচ্ছে, তাদের মুখে একই অভিব্যক্তি—একটা নিস্তব্ধ অনুরোধ, একটা অদ্ভুত হতাশা, আর গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকার ভঙ্গি। যেন তারা চায় অনির্বাণ তাদের কিছু বুঝুক, কিছু খুঁজে বার করুক।

সে ধীরে ধীরে নিচতলার দিকে নামতে শুরু করল, কারণ ভেতরের অস্বস্তি এখন অসহ্য হয়ে উঠেছে। সিঁড়ি বেয়ে নামার সময় মনে হচ্ছিল, পেছনে কেউ নরম পায়ে হাঁটছে। যতই সে দ্রুত পা চালাচ্ছিল, ততই সেই প্রতিধ্বনি তাল মিলিয়ে বাড়ছিল। একসময় বিরক্ত হয়ে হঠাৎ ঘুরে দাঁড়াতেই দেখতে পেল ফাঁকা সিঁড়ি, শুধু ধুলো উড়ছে। কিন্তু ক্যামেরা তুলতেই চমকে উঠল—লেন্সে দেখা গেল, তার ঠিক দু’ধাপ পেছনে দাঁড়িয়ে আছে এক বৃদ্ধা। শাড়ি গায়ে, চুলে সাদা রঙের ছোপ, মুখে তীব্র যন্ত্রণা আঁকা। অনির্বাণের বুক ধক করে উঠল, হাত কেঁপে উঠল, কিন্তু সে চোখ সরাতে পারল না। আবার তাকিয়ে দেখল বাস্তবে সিঁড়ি ফাঁকা। সে বোঝে গেল, প্রাসাদের বাসিন্দারা তার পিছু নিয়েছে, আর এখন থেকে তাদের অদৃশ্য উপস্থিতি তার ছায়ার মতো লেগে থাকবে।

নিচতলায় পৌঁছে সে এক বড় হলঘরে প্রবেশ করল। জায়গাটা দেখে মনে হলো একসময় জমকালো আসর বসত এখানে। দেয়ালে ভাঙা আয়না, মাঝখানে ভাঙাচোরা পিয়ানো, আর চারপাশে ছড়িয়ে থাকা আসবাবপত্র। ফ্ল্যাশ জ্বালাতেই চোখে পড়ল, আয়নায় ম্লান প্রতিফলন—সে একা দাঁড়িয়ে নেই। পেছনে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকজন মানুষ, যাদের মধ্যে নারী, পুরুষ, এমনকি শিশু পর্যন্ত আছে। আয়নার কাঁচে স্পষ্ট তাদের প্রতিফলন, কিন্তু ঘুরে তাকাতেই ফাঁকা হলঘর। ক্যামেরায় ক্লিক করতেই ছবিটা প্রমাণ হয়ে গেল—প্রাসাদের অদৃশ্য দর্শকরা শুধু তাকিয়ে নেই, তারা যেন একে একে তার কাছে নিজেদের প্রকাশ করছে। অনির্বাণ বুঝল, এখন আর এই যাত্রা শুধু গবেষণা বা ফটোগ্রাফির অভিযান নয়; সে এক অদ্ভুত চক্রে আটকে গেছে, যেখানে প্রতিটি ছবি আরেকটা রহস্যের দরজা খুলছে।

অধ্যায় ৫: প্রাসাদের অতীত

অনির্বাণ এখন আর শুধু ফটোগ্রাফার নয়, সে যেন এক অভিযাত্রী, যে অদৃশ্য সত্যের কাছে পৌঁছতে মরিয়া। প্রাসাদের প্রতিটি দেয়াল, প্রতিটি জানালা, প্রতিটি ভাঙাচোরা আসবাব তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল অতীতের দিকে। তাই সে স্থির করল, এই রহস্যের সূত্র খুঁজতে হলে প্রথমে জানতে হবে এই প্রাসাদের ইতিহাস। পরদিন সকালে সে স্থানীয় গ্রন্থাগারে গিয়ে খোঁজখবর শুরু করল। ধুলো জমা ফাইল, হলুদ হয়ে যাওয়া সংবাদপত্র, পুরনো নথিপত্রের ভেতর থেকে ধীরে ধীরে ফুটে উঠল প্রাসাদের অন্ধকার কাহিনি। জানা গেল, উনিশ শতকের শেষদিকে এই প্রাসাদ ছিল উত্তর কলকাতার এক ধনী জমিদার পরিবারের বসবাসস্থল। তাদের ঐশ্বর্য, আভিজাত্য, আর বিলাসিতার ছাপ ছিল প্রতিটি ইটের গায়ে। কিন্তু সমৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে জন্ম নিয়েছিল অহংকার, হিংসা আর গোপন শত্রুতার। জমিদারের ছেলেরা একে অপরের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিল, চাকরদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল ভয় আর ক্ষোভ। একসময় প্রাসাদে ঘটে এক ভয়ঙ্কর অগ্নিকাণ্ড, যেখানে কয়েকজন চাকর ও এক তরুণী করুণ পরিণতির শিকার হয়। স্থানীয় পত্রিকায় ছোট্ট খবর বেরিয়েছিল, কিন্তু সেই মৃত্যুগুলো ধামাচাপা দেওয়া হয়। অনির্বাণ পড়তে পড়তে আঁতকে উঠল—যে তরুণীর নাম সংবাদপত্রে উল্লেখ আছে, তার বর্ণনা হুবহু মিলে যায় ক্যামেরায় ধরা পড়া মেয়েটির সঙ্গে।

এ তথ্য জানার পর তার শরীর কেঁপে উঠল। সে ভাবল, তাহলে কি সত্যিই সেই অগ্নিকাণ্ডে মৃত মানুষগুলো এখনো প্রাসাদে আটকে আছে? তাদের আত্মা কি অমীমাংসিত যন্ত্রণার মধ্যে ভাসছে? এক অজানা ভার বুকের ভেতর জমতে শুরু করল, যেন প্রাসাদের অদৃশ্য চোখগুলো এখনো তাকে লক্ষ্য করছে, এমনকি লাইব্রেরির ভেতরেও। অনির্বাণ আরও তথ্য খুঁজল—অগ্নিকাণ্ডের রাত নিয়ে অনেক গুজব শোনা যায়। কেউ বলে, জমিদারের পরিবার ইচ্ছে করেই আগুন লাগিয়েছিল চাকরদের বিদ্রোহ থামাতে। আবার কেউ বলে, কোনো এক অশুভ আচার চলছিল, তার ফলেই আগুন লেগেছিল। সরকারি রিপোর্টে লেখা ছিল কেবল—“দুর্ভাগ্যজনক দুর্ঘটনা।” কিন্তু নথিগুলোর ফাঁকফোকর থেকেই স্পষ্ট বোঝা যায়, ঘটনার আড়ালে অজানা সত্য চাপা পড়ে আছে।

লাইব্রেরি থেকে বেরিয়ে রাতের দিকে অনির্বাণ আবার প্রাসাদের সামনে দাঁড়াল। চারপাশে কুয়াশা নামতে শুরু করেছে, বাতাসে হালকা শীতলতা। তার মনে হচ্ছিল, প্রাসাদটা যেন অপেক্ষা করছে তার জন্য, যেন সে জানুক অতীতের সত্য, আরেকবার ভেতরে প্রবেশ করুক। বুকের ভেতর ভয় আর কৌতূহল একসঙ্গে খেলে গেলেও সে জানত, পিছু হটার উপায় নেই। কারণ এখন আর এই যাত্রা কেবল ছবি তোলার নয়—এটা মৃতদের না-পাওয়া মুক্তির, অন্ধকার ইতিহাসের সত্য প্রকাশের। সে বুঝল, প্রাসাদের অতীত তাকে ধীরে ধীরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে এমন এক গভীরে, যেখান থেকে হয়তো ফেরার পথ আর খোলা নেই।

অধ্যায় ৬: রাতের অচেনা শব্দ

অতীতের ভয়াবহ সত্য জানার পরও অনির্বাণের মনে হলো, প্রাসাদকে বোঝা সম্ভব নয় বাইরে থেকে। তাই এক বর্ষণভেজা রাতে সে স্থির করল ভেতরে থেকে যাবে, যতক্ষণ না রহস্যের আরেকটি পরত খুলে আসে। রাত তখন প্রায় ন’টা, আকাশে মেঘ, চারপাশ অন্ধকারে ডুবে গেছে। প্রাসাদে ঢুকতেই দরজা ঠাস করে বন্ধ হয়ে গেল পেছনে, যেন কেউ ইচ্ছে করে আটকে দিল। অনির্বাণ টর্চ আর ক্যামেরা নিয়ে ভেতরে এগোল। ভিজে গন্ধে ভরে আছে করিডর, ভাঙা জানালা দিয়ে ঢুকে আসছে শীতল বাতাস। প্রথমে সব শান্ত মনে হলেও, অল্প সময়ের মধ্যেই নিস্তব্ধতার ভেতর ভেসে এলো অচেনা শব্দ। কোথাও পায়ের আওয়াজ, যেন কেউ সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছে; কোথাও আবার দরজা কেঁপে উঠল অকারণে। অনির্বাণ থেমে শোনার চেষ্টা করল, কিন্তু শব্দ যত থামছে, ভেতরে আতঙ্ক তত বাড়ছে। ক্যামেরা হাতে সে ছবি তুলতে শুরু করল, আর স্ক্রিনে ভেসে উঠল অস্পষ্ট আলোর রেখা, যেন অদৃশ্য কেউ পাশ দিয়ে হেঁটে গেল।

রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রাসাদের ভেতরে শব্দগুলো আরও স্পষ্ট হতে লাগল। কোথাও ভেসে আসছে এক নারীর কান্নার মতো সুর, কোথাও আবার শিশুর হাসির প্রতিধ্বনি, যা শুনে তার রক্ত হিম হয়ে গেল। সে এক বড় ঘরে গিয়ে দাঁড়াল, যেখানে মেঝের ওপর ভাঙা পিয়ানো পড়ে আছে। হঠাৎ করেই সেই পিয়ানো থেকে ভেসে এলো কিছু সুর—অতল অন্ধকারে ভেসে আসা বিষণ্ণ সঙ্গীত। অনির্বাণ অবাক হয়ে ক্যামেরা তোলে, শাটার ক্লিক হতেই ফ্ল্যাশে দেখা গেল পিয়ানোর সামনে বসে আছে এক অস্পষ্ট ছায়া, আঙুলগুলো কীবোর্ডে চলছে। কিন্তু ফ্ল্যাশ নিভতেই জায়গাটা ফাঁকা। বুকের ভেতর ধড়ফড় শুরু হলো, তবু সে ছবি দেখতে লাগল। প্রতিটি ছবিতে ধরা পড়ছে অদৃশ্য মানুষের ছায়া—কখনো এক বৃদ্ধ চাকর, কখনো তরুণী, কখনো আবার ছোট্ট একটি শিশু। তারা সবাই যেন অনির্বাণকে দেখছে, তার প্রতিটি পদক্ষেপ নজরে রাখছে।

একসময় হঠাৎ সারা প্রাসাদজুড়ে দরজা-জানালা একসঙ্গে কেঁপে উঠল, যেন এক অদৃশ্য ঝড় বইল ভেতরে। বাতাস এত ঠান্ডা হয়ে গেল যে নিঃশ্বাস জমে আসতে লাগল। অনির্বাণ বুঝতে পারল, প্রাসাদের অদৃশ্য বাসিন্দারা আর লুকোচুরি খেলছে না—তারা প্রকাশ্যে তাকে জানিয়ে দিচ্ছে, এই জায়গাটা তাদেরই। তবু সে পালাল না। বরং মনে হলো, যত ভয়ঙ্করই হোক, প্রাসাদ আসলে তাকে ডাকছে। রাতের অচেনা শব্দ শুধু ভয় দেখানোর জন্য নয়, বরং কোনো গভীর বার্তা পৌঁছে দেওয়ার জন্য। আর সেই বার্তাটা জানার জন্য তাকে আরও গভীরে প্রবেশ করতেই হবে।

অধ্যায় ৭: ছবির ভেতরের ফিসফিস

রাত প্রায় মাঝরাত ছুঁইছুঁই, প্রাসাদের চারপাশ নিস্তব্ধ হলেও ভেতরের বাতাস যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছিল। অনির্বাণ সিঁড়ির ধাপে বসে ক্যামেরার মেমোরি কার্ডের ছবিগুলো একে একে দেখতে লাগল। যতই সে ছবিগুলো স্ক্রল করছিল, ততই অনুভব করছিল অস্বাভাবিক কিছু—প্রথম দিককার ছবিতে যারা ছিল কেবল ফ্রেমের ভেতরে অস্পষ্ট ছায়া, তারা এখন যেন আরও স্পষ্ট, আরও জীবন্ত হয়ে উঠছে। প্রথমে তারা তাকিয়ে ছিল ক্যামেরার দিকে, কিন্তু পরের ছবিগুলোতে তারা সরাসরি তাকাচ্ছে তার চোখের ভেতরে। ছবির ভেতরের সেই মানুষগুলোর চোখে অদ্ভুত এক গভীরতা—কখনো যন্ত্রণা, কখনো ক্রোধ, কখনো আবার নিঃশব্দে সাহায্যের আর্তি। অনির্বাণ স্ক্রিনে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আচমকা কানে ভেসে এলো ফিসফিস শব্দ। প্রথমে ভেবেছিল বাতাস, কিন্তু শব্দগুলো ছবির সঙ্গে মিলে যাচ্ছিল। যেন ছবির ভেতরের মানুষগুলো ক্যামেরার লেন্সের ফাঁক গলে সরাসরি তার কানে কথা বলছে।

সে মন দিয়ে শোনার চেষ্টা করল। শব্দগুলো ভাঙা, কর্কশ, তবু স্পষ্ট হয়ে উঠছিল কিছু বাক্য—“আমাদের দেখো…”, “আমাদের ভুলে যেও না…”, “মুক্তি…”। অনির্বাণের গা শিউরে উঠল। মনে হলো, অদৃশ্য দৃষ্টি শুধু ক্যামেরায় ধরা পড়ছে না, বাস্তবেও তার চারপাশে ছড়িয়ে আছে। হঠাৎ সে খেয়াল করল, টর্চের আলোয় এক দেয়ালে ছায়া পড়ে আছে—কিন্তু তার শরীরের সঙ্গে ছায়ার আকার মিলছে না। ছায়াটা এক নারীর, লম্বা চুলে মুখ ঢেকে আছে, আর হাত দুটো প্রসারিত করে যেন তার দিকে ডাকছে। সে তাড়াহুড়ো করে ক্যামেরা তুলতেই ছবিতে দেখা গেল, সেই নারী এতটাই কাছে যে মনে হলো আরেক সেকেন্ড দেরি হলে হয়তো ছুঁয়ে ফেলবে তাকে। ছবির ভেতরের চোখদুটি এবার সরাসরি তাকিয়ে আছে তার দিকে, আর ঠোঁট সামান্য নড়ে উঠছে, যেন স্পষ্টভাবে কিছু বলতে চাইছে।

অবাক হয়ে সে ছবির দিকে তাকিয়ে থাকতেই আবার সেই ফিসফিস শব্দ কানে এলো—এবার অনেক জোরে, অনেক পরিষ্কার। “আমাদের মুক্তি দাও…”। অনির্বাণের বুক ধক করে উঠল। তার মনে হলো, এই প্রাসাদে যারা প্রাণ হারিয়েছে, তাদের আত্মারা এখনো মুক্তি পায়নি, আর তার ক্যামেরা সেই অদৃশ্য বন্দিদশার পর্দা সরিয়ে দিয়েছে। সে জানত না এই মুক্তি কীভাবে দেওয়া সম্ভব, কিংবা সত্যিই সেটা তার পক্ষে সম্ভব কি না। কিন্তু নিশ্চিত হলো, তারা এখন তাকে চিনেছে, তার সঙ্গে যোগাযোগ করছে। আর এর মানে, প্রাসাদের রহস্য আর শুধুই অতীতের কাহিনি নয়—সে এখন তারই অংশ হয়ে গেছে।

অধ্যায় ৮: অশরীরীর বার্তা

প্রাসাদের গভীর অন্ধকারে বসে অনির্বাণ এখন সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিত—তার ক্যামেরা কেবল ছবি তুলছে না, বরং এক অদৃশ্য জগতের দরজা খুলে দিচ্ছে। মেমোরি কার্ডের ছবিগুলো স্ক্রল করতে করতে সে হঠাৎ লক্ষ্য করল, এক ফ্রেমে অদ্ভুত ছাপ ফুটে উঠেছে। প্রথমে মনে হলো, হয়তো ক্যামেরার লেন্সে কোনো দাগ লেগেছে বা আলো প্রতিফলনের কারণে এমন হয়েছে। কিন্তু ভালো করে তাকাতেই তার বুক কেঁপে উঠল। ছবির দেয়ালের কোণে অস্পষ্ট কালো রেখার ভেতর ফুটে উঠেছে শব্দ—বাংলায় লেখা, হালকা কুঁচকানো অক্ষরে—“আমাদের মুক্তি দাও।” অক্ষরগুলো এতটা স্পষ্ট যে আর কোনো সন্দেহ রইল না। অনির্বাণ ছবিটি কয়েকবার জুম করে দেখল, শব্দগুলো একেবারেই কৃত্রিম নয়। বরং মনে হলো, কেউ ক্যামেরার লেন্সের ওপাশ থেকে ইচ্ছে করে এই বার্তাটা রেখে দিয়েছে।

হাত কাঁপছিল, কিন্তু সে আরও কয়েকটা ছবি তুলল একই জায়গায়। আশ্চর্যজনকভাবে প্রতিটি ছবিতেই অন্য রকম চিহ্ন ফুটে উঠতে লাগল। কোথাও হাতের ছাপ, কোথাও ভাঙাচোরা মুখের অর্ধেক প্রতিচ্ছবি, আর কোথাও আবার ভাঙা আয়নায় প্রতিফলিত হয়ে লেখা ভেসে উঠল—“আমরা আটকে আছি।” প্রতিটি ছবিই যেন একেকটা আর্তনাদ, একেকটা দুঃখের দলিল। অনির্বাণ শ্বাস আটকে ছবিগুলো দেখছিল, আর মনে হচ্ছিল প্রতিটি শব্দ তার মনের ভেতর গেঁথে যাচ্ছে। কানে আবার ভেসে এলো ফিসফিসানি, আগের চেয়ে অনেক বেশি পরিষ্কার—“আগুনে আমরা পুড়েছি… অন্যায় হয়েছে… আমাদের মুক্তি চাই।” গলার ভেতর শুকনো কাঁটার মতো ব্যথা অনুভব করল সে, যেন এই বার্তাগুলো শুধু কানে আসছে না, বুকের ভেতর আঘাত করছে।

হঠাৎ এক প্রবল বাতাস ঘরের ভেতর বয়ে গেল। দরজা-জানালা কেঁপে উঠল, ধুলো উড়ে চারপাশ ঢেকে গেল। অনির্বাণ বুঝল, এ শুধু বাতাস নয়—কোনো শক্তি তার উপস্থিতি টের পেয়েছে। সে ক্যামেরা বুকে চেপে ধরল, যেন এটিই একমাত্র সেতু যার মাধ্যমে সে যোগাযোগ করতে পারছে। চোখ মেলে অন্ধকার ঘরের দিকে তাকাতেই মনে হলো, দেয়ালের প্রতিটি ফাটল থেকে একাধিক ছায়া ভেসে আসছে। তারা সবাই মুখ খুলছে, অথচ কোনো শব্দ নেই—কেবল ছবির ভেতর ধরা পড়ছে তাদের কণ্ঠ। অনির্বাণ অনুভব করল, এ শুধু ভয় নয়, বরং একটা দায়িত্বও তার ওপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তারা তাকে বেছে নিয়েছে, কারণ তার ক্যামেরাই প্রথমবার তাদের আর্তনাদ শুনিয়েছে বাইরের দুনিয়ায়। কিন্তু মুক্তি দেওয়ার অর্থ কী? কিভাবে সম্ভব? এই প্রশ্নগুলো মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল, আর সে বুঝতে পারল, প্রাসাদের রহস্য তাকে এখন আরও গভীর অন্ধকারে টেনে নিয়ে যাচ্ছে, যেখানে সত্য জানার পথই হয়তো মৃত্যুর পথ হয়ে উঠতে পারে।

অধ্যায় ৯: প্রাসাদের গোপন কক্ষ

বারবার ছবিতে উঠে আসা মুক্তির আর্তনাদ অনির্বাণকে আর নিশ্চুপ থাকতে দিল না। সে বুঝতে পারল, প্রাসাদের ভেতরে নিশ্চয়ই কোনো লুকোনো জায়গা আছে, যেখানে এই রহস্যের আসল উত্তর লুকিয়ে আছে। টর্চের আলো আর ক্যামেরা হাতে নিয়ে সে একের পর এক ঘর খুঁজতে লাগল। দীর্ঘ করিডর পেরিয়ে, ভাঙা সিঁড়ি বেয়ে হেঁটে, অবশেষে সে পৌঁছাল এক অদ্ভুত দেয়ালের সামনে। দেয়ালের গায়ে পুরনো কাঠের আলমারি ঠেসে রাখা, আর চারপাশে ছত্রাকের দাগ। প্রথমে ব্যাপারটা সাধারণ মনে হলেও, হঠাৎ তার চোখে পড়ল মেঝের ধুলোয় টানা কিছু অদ্ভুত দাগ, যেন কেউ আলমারিটা সরানোর চেষ্টা করেছিল। বুক ধকধক করতে করতে অনির্বাণ আলমারির পাশে হাত লাগাল। অবাক হয়ে দেখল, ভেতরটা ফাঁপা, আর আলমারিটা সরাতেই উন্মোচিত হলো এক গোপন দরজা। দরজার ফাঁক দিয়ে বেরোচ্ছে এক তীব্র স্যাঁতসেঁতে গন্ধ, যেন বহু বছর ধরে কেউ খোলেনি।

দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই চারদিক অন্ধকার গ্রাস করল তাকে। টর্চ জ্বালাতেই স্পষ্ট হলো, এ এক সঙ্কীর্ণ ঘর, যেন ইচ্ছে করেই লুকিয়ে রাখা হয়েছে। মেঝেতে কালচে পোড়া দাগ ছড়িয়ে আছে, দেয়ালের গায়ে জমে আছে ঘন কালো ধোঁয়ার ছাপ। চারপাশে ছড়িয়ে রয়েছে পোড়া কাঠ, ভাঙা ধাতব পাত্র, আর কোণের দিকে কিছু হাড়গোড়ের মতো অবশিষ্টাংশ। অনির্বাণের হাত থেকে ক্যামেরা প্রায় পড়ে যাচ্ছিল, শিউরে উঠল সে—এখানেই ঘটেছিল সেই অগ্নিকাণ্ড, এখানে আটকা পড়েই মারা গিয়েছিল তারা। ভেতরের বাতাস এত ভারী যে মনে হচ্ছিল প্রতিটি নিঃশ্বাসে দুঃখ আর যন্ত্রণা ঢুকে যাচ্ছে শরীরে। সে ক্যামেরায় ক্লিক করল, আর ছবির স্ক্রিনে ফুটে উঠল আরও ভয়ানক দৃশ্য। অদৃশ্য ছায়ারা এখন আর অস্পষ্ট নয়—একজন তরুণী হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে, এক বৃদ্ধ শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে, কয়েকজন চাকর মাটিতে লুটিয়ে আছে। ছবির প্রতিটি মুখে আঁকা আতঙ্ক, আর সেই আতঙ্কই যেন বারবার উচ্চারণ করছে মুক্তির দাবি।

অনির্বাণের মনে হলো ঘরটা জীবন্ত হয়ে উঠেছে। চারপাশের অন্ধকার ফিসফিস করতে শুরু করল, ভাঙা জিনিসপত্র কেঁপে উঠল, আর বাতাসে ভেসে এলো দগ্ধ মাংসের গন্ধ। সে বুঝল, এ শুধু অতীতের নিদর্শন নয়—এখানেই আত্মারা বন্দি হয়ে আছে, এখানেই তাদের চিরকালের যন্ত্রণার মূল। এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো, সে আর ফিরে যেতে পারবে না, যেন দরজাটা অদৃশ্যভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। ঘরের ভেতরে দাঁড়িয়ে সে ক্যামেরা শক্ত করে ধরে ফিসফিস করে বলল, “আমি শুনতে পাচ্ছি… তোমাদের গল্প আমি পৌঁছে দেব।” ঠিক সেই মুহূর্তেই টর্চের আলো কেঁপে উঠল, ক্যামেরার স্ক্রিন ঝলসে উঠল, আর ছবিতে একসঙ্গে বহু মুখ ফুটে উঠল—তাদের হাত প্রসারিত, যেন তাকে টেনে নিতে চাইছে তাদের গোপন দুঃস্বপ্নে। অনির্বাণ বুঝল, সে এখন প্রাসাদের গোপন কক্ষের সঙ্গে একাকার হয়ে গেছে, আর এই রাত তাকে আর সহজে মুক্তি দেবে না।

অধ্যায় ১০: মুক্তির আহ্বান

গোপন কক্ষের ভেতরে দাঁড়িয়ে অনির্বাণের শরীর শিউরে উঠছিল। চারপাশের দেয়াল যেন আগুনে জ্বলছিল, অথচ টর্চের আলো স্পষ্ট প্রমাণ দিচ্ছিল—এ সব কেবল দৃশ্যমান নয়, অনুভবযোগ্যও। হাড়গোড়ের স্তূপ থেকে ভেসে এলো ক্ষীণ আর্তনাদ, মেঝের পোড়া দাগ থেকে উঠতে লাগল ধোঁয়া। অনির্বাণের ক্যামেরা ঝলসে উঠল একের পর এক ফ্ল্যাশে, আর প্রতিটি ছবিতেই ধরা পড়তে লাগল ভিন্ন ভিন্ন আত্মার মুখ—ভয়ার্ত, বিকৃত, তবু গভীর যন্ত্রণায় ভরা। তারা হাত বাড়িয়ে আছে তার দিকে, ঠোঁট নড়ছে একই শব্দ উচ্চারণ করে—“মুক্তি… মুক্তি… মুক্তি…”। অনির্বাণের মনে হলো, এ কেবল তার সামনে ধরা পড়া দৃশ্য নয়, বরং একটা আহ্বান। তাকে দিয়ে কিছু করাতে চাইছে তারা, এমন কিছু যা বহু বছর ধরে হয়নি। বুকের ভেতর দমবন্ধ করা ভার যেন হঠাৎ তার কানে ফিসফিস করে উঠল, “সত্য প্রকাশ কর… আমাদের কণ্ঠ পৌঁছে দাও বাইরের দুনিয়ায়…”।

সে হাঁটু গেড়ে বসল মেঝেতে, হাত বুলাল পোড়া দাগের ওপর। মুহূর্তেই অনুভব করল, তার শরীর দিয়ে অদৃশ্য কষ্ট বয়ে যাচ্ছে—যেন আগুনের শিখা তার ত্বকে ছুঁয়ে যাচ্ছে, শ্বাসরোধী ধোঁয়া তার ফুসফুস ভরিয়ে তুলছে। সে বুঝল, এ যন্ত্রণা কেবল দেখার নয়, অনুভব করার দাবি রাখে। অনির্বাণ কাঁপতে কাঁপতে ফিসফিস করে বলল, “আমি তোমাদের কথা লিখে যাব, সবাইকে জানাব। তোমাদের ভুলে যাওয়া হবে না।” কথাটা উচ্চারণ করতেই ঘরের ভেতরে এক অদ্ভুত পরিবর্তন হলো। হঠাৎ করেই ফিসফিসানি থেমে গেল, অন্ধকারের চাপা ভার কিছুটা হালকা হয়ে এল। ক্যামেরার স্ক্রিন ঝিলমিল করতে করতে ধীরে ধীরে অন্ধকার হলো, আর শেষবারের মতো সেখানে ভেসে উঠল এক তরুণীর শান্ত মুখ—আগুনে দগ্ধ হলেও এবার মুখে প্রশান্তির ছাপ। সে মাথা হেলিয়ে যেন সম্মতি জানাল, তারপর ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল।

হঠাৎ কক্ষের ভেতর তীব্র আলো ছড়িয়ে পড়ল। আলমারির লুকোনো দরজাটা নিজে থেকেই খুলে গেল, আর বাইরের করিডরের শীতল বাতাস ভেতরে এসে ছড়িয়ে পড়ল। অনির্বাণ ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল, বুকের ভেতর এখনো ধুকপুকানি চলছে, কিন্তু সে অনুভব করল এক অদ্ভুত স্বস্তি। যেন অর্ধেক দায়িত্ব সে পূর্ণ করেছে, বাকিটা তার কলম আর কাগজের ওপর নির্ভর করছে। ক্যামেরাটা শক্ত করে বুকে জড়িয়ে নিয়ে সে বেরিয়ে এলো গোপন কক্ষ থেকে। প্রাসাদের করিডর পেরিয়ে বাইরে আসতেই রাতের আকাশে ভোরের প্রথম আলো ফুটে উঠছিল। পাখিরা ডাকতে শুরু করেছে, আর বাতাসে আর কোনো ফিসফিস নেই। তবু অনির্বাণ জানত, এই অভিজ্ঞতা তার জীবন বদলে দেবে। সে আর কেবল এক গবেষক নয়—সে এখন ইতিহাসের অদৃশ্য কণ্ঠের বাহক, যারা মুক্তি পেয়েছে তার চোখ আর কলমের মাধ্যমে। জোড়াসাঁকোর পুরনো প্রাসাদের রহস্য সে উন্মোচন করেছে, কিন্তু তার ভেতরের আতঙ্ক আর যন্ত্রণার ছায়া হয়তো চিরকাল তার সঙ্গেই থাকবে।

সমাপ্ত

 

1000068688.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *