বিশ্বরূপ বসাক
আর্যন সবসময়ই ছিলেন একা মানুষ। কলকাতার উত্তর শহরের একটি ছোট্ট স্টুডিও-ঘরে তিনি দিন-রাত রঙের সঙ্গে যুদ্ধ করতেন। তার তুলি আর ক্যানভাস ছিল একমাত্র সঙ্গী। তিনি শহরের কোলাহল পছন্দ করতেন না, বরং নিস্তব্ধতার মধ্যেই নিজের সৃজনশীলতাকে খুঁজে পেতেন। তবে গত কয়েক মাস ধরে তিনি এক অদ্ভুত চাপ অনুভব করছিলেন—কোনও প্রদর্শনীর ডেডলাইন নয়, কোনও আর্ট-ক্রিটিকের সমালোচনাও নয়, বরং এক অজানা অস্বস্তি। তিনি যখনই নতুন ছবি আঁকার চেষ্টা করতেন, নিজের মনের কল্পনা থেকে চরিত্রের আকার দিতে যেতেন, তখনই তার হাত যেন নিজে থেকেই অন্য রূপ গড়ে তুলত। মুখ, চোখ, নাক, ঠোঁট—সবকিছু এতটাই স্পষ্ট হয়ে উঠত যে তিনি অবাক হয়ে যেতেন। প্রথমে ভেবেছিলেন এটি নিছক কাকতালীয়—শিল্পীরা তো প্রায়ই একই ধরণের ছায়া বা গঠন বারবার তৈরি করে ফেলে। কিন্তু যখন তিনি ভিন্ন ভিন্ন থিম নিয়ে কাজ করতে বসতেন, যেমন একটি গ্রামীণ দৃশ্য, একটি ফুলের তোড়া, কিংবা একটি বিমূর্ত চিত্রকলা—তখনও হঠাৎ সেই একই মুখ ক্যানভাসে ফুটে উঠত। কালো গভীর চোখ, চোয়ালের শক্ত রেখা, ঠোঁটে অদ্ভুত রহস্যময় হাসি, যেন কোথাও তিনি মানুষটিকে চিনেছেন অথচ মনে করতে পারছেন না।
দিন গড়াতে লাগল, আর আর্যনের ভেতরে আতঙ্কের সঙ্গে কৌতূহলও বাড়তে থাকল। তিনি রাতে ঘুমোতে পারতেন না। চোখ বন্ধ করলে সেই মুখ যেন অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এসে তাকিয়ে থাকত তার দিকে। মাঝে মাঝে মনে হতো, মুখটি যেন তার নিজের চেতনাকে নিয়ন্ত্রণ করছে, তার হাতকে নির্দেশ দিচ্ছে। তিনি ঠিক করলেন, হয়তো এটা মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা—অতিরিক্ত একাকীত্ব, নিঃসঙ্গতা কিংবা অচেতন মনের খেলা। কিন্তু নিজের যুক্তি দিয়ে যতই বোঝাতে চান, ততই যেন সেই মুখ আরও তীব্রভাবে প্রকাশ পেতে থাকে। এক রাতে তিনি স্থির করলেন, ইচ্ছে করে সম্পূর্ণ আলাদা কিছু আঁকবেন—একটি শহরের বিমূর্ত রাতের দৃশ্য। অনেক রঙ মিশিয়ে যখন তিনি আলোর রেখা টানছিলেন, তখন হঠাৎ করেই ব্রাশ সরে গিয়ে আরেকটি চোখের রূপরেখা তৈরি করল। আঁচড়ে আঁচড়ে অজান্তেই আবার সেই মুখ ফুটে উঠল। ব্রাশ নামিয়ে তিনি হাঁপিয়ে উঠলেন, যেন কারও সঙ্গে অদৃশ্য লড়াই করছেন। পর মুহূর্তে ক্যানভাস থেকে তাকিয়ে থাকা চোখদুটোকে দেখে তার শরীরে কাঁপুনি ধরে গেল। যেন ওগুলো জীবন্ত, নিছক রঙের ছোপ নয়।
এরপর থেকে আর্যন বুঝতে পারলেন, এ শুধু কোনও কল্পনার খেলা নয়, এর মধ্যে লুকিয়ে আছে কোনও রহস্য। তিনি ক্যানভাসগুলো সারি করে রাখলেন—প্রতিটিতেই একই মুখ। কিন্তু মজার বিষয় হলো, প্রতিটি চিত্রে মুখের অভিব্যক্তি একটু একটু করে বদলাচ্ছে। একটিতে দুঃখ, অন্যটিতে রাগ, কোথাও আবার ভৌতিক শান্তি। যেন এক অচেনা মানুষ তাকে জীবনের নানা রূপ দেখাচ্ছে। আর্যন ভাবলেন, হয়তো কোনও অতীত স্মৃতি কিংবা দেখা-শোনা মানুষের ছবি অবচেতনে রয়ে গেছে। কিন্তু যতই মনে করার চেষ্টা করেন, তিনি কখনও সেই মানুষটির অস্তিত্ব খুঁজে পাননি। তখনই এক অদ্ভুত ভয় চেপে বসল—যদি মুখটি আদৌ বাস্তবের না হয়? যদি কোনও মৃত মানুষ, কোনও হারানো আত্মা তার রঙের ভেতর দিয়ে কথা বলতে চায়? অজানা এক অস্বস্তি ও কৌতূহলের দোলাচলে আর্যনের রাত কাটতে লাগল। তিনি জানতেন না, এ কেবল শিল্পীর মানসিক অবসাদ, নাকি এক ভয়ঙ্কর সত্যের পূর্বাভাস, যা ধীরে ধীরে তার জীবনকে গ্রাস করতে চলেছে।
–
আর্যন প্রথমদিকে নিজের আঁকা মুখগুলিকে আড়াল করে রেখেছিলেন। তিনি জানতেন, অন্যরা দেখলে হয়তো হাসাহাসি করবে কিংবা মনে করবে তিনি নিজের মানসিক ভারসাম্য হারাচ্ছেন। কিন্তু একদিন তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু নন্দিনী, যে নিজেও একজন শিল্পী এবং প্রায়ই তার স্টুডিওতে যেত, হঠাৎই টেবিলের পাশে দাঁড়ানো একটি অসমাপ্ত ছবির দিকে চোখ রাখে। ছবির মধ্যে থাকা চোখদুটো দেখে তার মুখের রঙ পাল্টে যায়। সে বিস্মিত স্বরে বলে ওঠে, “আর্যন, এই মানুষটা কে? আমি এরকম গভীর চোখ জীবনে দেখিনি।” আর্যন প্রথমে হেসে উড়িয়ে দিতে চাইলেও, নন্দিনীর কণ্ঠে থাকা কম্পন বুঝতে পারল—সে সত্যিই আতঙ্কিত। এরপর থেকে ধীরে ধীরে অন্য বন্ধুরাও ছবিগুলো দেখতে শুরু করল, এবং প্রত্যেকে একই প্রশ্ন করতে থাকল—“কে এই মানুষ?” সবাই বলত, মুখটি এতটাই স্পষ্ট, যেন জীবন্ত একজন মানুষ ক্যানভাস থেকে বেরিয়ে আসবে। কেউ কেউ বলত, ছবির চোখে এমন এক শূন্যতা আছে যা মানুষকে ভিতর থেকে নাড়িয়ে দেয়। কিন্তু আর্যন দৃঢ় কণ্ঠে বলল, সে এই মানুষটিকে কখনও দেখেনি। এটা তার মনের ভেতর থেকে আসা এক রহস্যময় প্রতিচ্ছবি, যার উৎস সে নিজেও জানে না।
প্রশ্নের ঘূর্ণি যেন চারদিক থেকে তাকে ঘিরে ধরল। সহকর্মীরা কেউ কেউ অনুমান করতে লাগল, হয়তো আর্যন কাউকে গোপনে ভালোবেসেছে, সেই অচেনা মানুষটি তার শিল্পে বারবার ফিরে আসছে। কেউ আবার বলল, হয়তো কোনো অতীত ট্রমার প্রতিফলন এটা, যা তার অবচেতন মনে ঘুরপাক খাচ্ছে। এমনকি কয়েকজন কৌতূহলী শিল্প-সমালোচক যখন ছবিগুলো দেখল, তারা বলল মুখের রেখাগুলো এত শক্তিশালী, যেন কোনো কিংবদন্তি চরিত্রের প্রতিচ্ছবি। কিন্তু আর্যনের ভেতরে ভিন্ন স্রোত বয়ে যাচ্ছিল। যতই অন্যরা এ মুখ নিয়ে প্রশ্ন করছিল, ততই সে ভেতরে ডুবে যাচ্ছিল এক অদ্ভুত শূন্যতার মধ্যে। মুখটির পরিচয় সে দিতে পারছিল না, অথচ প্রতিটি ক্যানভাসে মুখটি আরও পরিষ্কার হয়ে উঠছিল। যেন ছবিগুলো কোনও অদৃশ্য শক্তির হাত ধরে এগোচ্ছে, তার নিজের ইচ্ছার বাইরে। মাঝে মাঝে আর্যন মনে করত, যদি মুখটির উৎস না জানে তবে হয়তো সে পাগল হয়ে যাবে। রাতে ঘুম ভাঙলে সে আঁধারের ভেতরে তাকিয়ে দেখত, দেওয়ালের ছায়াগুলোও যেন সেই মুখের অবয়ব নিচ্ছে।
ধীরে ধীরে আর্যনের চারপাশে এক অস্থিরতা জমতে লাগল। বন্ধুরা আর তার সঙ্গে আগের মতো স্বাভাবিকভাবে কথা বলত না। সবাই শুধু জানতে চাইত—মুখটার রহস্য কী? একদিন এক সাংবাদিক তার স্টুডিওতে এল, আর প্রশ্ন করল, “আপনার ছবির মানুষটি কি কোনো হারিয়ে যাওয়া চরিত্র? নাকি কোনো বাস্তব ঘটনার প্রতিচ্ছবি?” আর্যন বারবার একই উত্তর দিলেও—“আমি চিনি না, আমি জানি না”—কেউ যেন বিশ্বাস করতে চাইছিল না। একসময় সে নিজেও নিজের উত্তর নিয়ে সন্দিহান হয়ে উঠল। হয়তো সে কোথাও কখনও এই মানুষটিকে দেখেছিল, হয়তো কোনও স্বপ্নে, কিংবা শৈশবের ভোলা স্মৃতিতে? কিন্তু স্মৃতির দরজা যতই খুলতে গেল, ভেতরে ততই শূন্যতা আর অন্ধকার। এই শূন্যতা তাকে এমনভাবে গ্রাস করল যে প্রতিবার ক্যানভাসে নতুন মুখ আঁকার সময় তার বুকের ভেতর এক অদ্ভুত চাপা ব্যথা জমে উঠত। সে বুঝতে পারছিল, এটা কেবল ছবির প্রশ্ন নয়, এটা এমন এক রহস্য যা তার জীবনকে ধীরে ধীরে গ্রাস করতে শুরু করেছে।
–
আর্যনের দিনগুলো তখন এক অদ্ভুত ঝড়ের ভেতর দিয়ে চলছিল। তার ক্যানভাসে ভেসে ওঠা মুখ তাকে নিস্তার দিচ্ছিল না, আর চারপাশের প্রশ্নগুলো যেন প্রতিদিন আরও তীক্ষ্ণ হয়ে উঠছিল। এক রাতে স্টুডিওতে একা বসে তিনি হঠাৎ ভাবলেন, হয়তো কিছু সূত্র পাওয়া যাবে পুরোনো আর্কাইভ ঘেঁটে। ছোটবেলায় তার বাবা কলকাতার একটি গ্রন্থাগারে চাকরি করতেন, সেখানকার পুরোনো সংবাদপত্র আর ম্যাগাজিনের স্তূপে অনেক সময় লুকিয়ে থাকত অদ্ভুত সব তথ্য। সেই স্মৃতি মনে করে তিনি পরের দিন পা রাখলেন ন্যাশনাল লাইব্রেরির আর্কাইভ বিভাগে। ধুলো জমে থাকা বাঁধানো সংবাদপত্রের পাতা উল্টাতে উল্টাতে হঠাৎই তার চোখ থেমে গেল এক জায়গায়। একটা হলদেটে পৃষ্ঠার কোণে ছাপা হয়েছিল খুনের খবর—তারিখ প্রায় কুড়ি বছর আগের। ছোট্ট শিরোনামে লেখা: “চাঞ্চল্যকর খুন: রহস্যময় মৃত্যু এক যুবকের।” কিন্তু যা দেখে আর্যনের বুক কেঁপে উঠল, তা হলো নিচে ছাপা ছবি। ছবিটিতে যে মুখ, সেই মুখের প্রতিটি রেখা, প্রতিটি ছায়া হুবহু মিলে যাচ্ছে তার আঁকা ছবির সঙ্গে। কালো চোখ, তীক্ষ্ণ নাক, ঠোঁটের কোণে সেই রহস্যময় অভিব্যক্তি—সবকিছু যেন ক্যানভাস থেকে উঠে এসে এখানে মুদ্রিত হয়ে গেছে।
আর্যনের হাত কাঁপতে লাগল। তিনি চোখ বড় বড় করে ছবিটা দেখছিলেন, যেন বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। পাতার নিচে লেখা ছিল, যুবকের নাম অমর পাল, বয়স তখন মাত্র আটাশ। খুনের ঘটনার বিস্তারিত লেখা—তিনি এক সন্ধ্যায় শহরের এক প্রান্তে নির্মমভাবে খুন হন, এবং পুলিশ এখনও অপরাধীকে খুঁজে পায়নি। মামলা সময়ের স্রোতে হারিয়ে গেছে, কেউ আর জানেও না কীভাবে মৃত্যু হয়েছিল তার। কিন্তু সেই ছবির চোখের দিকে তাকিয়ে আর্যন বুঝতে পারলেন, এটা নিছক কাকতালীয় নয়। তার আঁকা মুখগুলো কেবল কল্পনা নয়, বরং এই খুন হওয়া যুবকের প্রতিচ্ছবি। আতঙ্কে তার শরীর ঠান্ডা হয়ে এলো। এতদিন ধরে যাকে তিনি ভেবেছিলেন অবচেতনের খেলা, সে আসলে একজন মৃত মানুষ, বহু বছর আগে যার জীবন হঠাৎ শেষ হয়ে গিয়েছিল। তার মনে হলো, যেন অমর পাল নিজেই ক্যানভাসের মাধ্যমে ফিরে আসছে, নিজের গল্প জানাতে চাইছে।
এরপরের দিনগুলোতে আর্যনের ভেতরে যেন দ্বন্দ্বের ঘূর্ণিঝড় শুরু হলো। তিনি কাগজের কাটিংটা নিজের স্টুডিওতে এনে রাখলেন। প্রতিদিন আঁকার সময় তিনি তাকাতেন সেই ছবির দিকে, আর তারপর নতুন ক্যানভাসে হাত দিতেন। আশ্চর্যজনকভাবে, তার ছবির মুখগুলো আরও স্পষ্ট হতে শুরু করল, যেন জীবন্ত হয়ে উঠছে। একসময় মনে হতে লাগল, ছবির চোখদুটি তার সঙ্গে কথা বলছে—নির্বাক অথচ প্রবল তীব্রতায়। তিনি বুঝতে পারলেন, এই মানুষটির আত্মা বোধহয় শান্তি খুঁজে পায়নি। খুনের রহস্য হয়তো অমীমাংসিত থেকে গেছে, আর সেই কারণে মৃত মানুষটির ছায়া আজও ঘুরে বেড়াচ্ছে, শিল্পীর ক্যানভাসে আশ্রয় নিচ্ছে। আর্যনের ভেতরে তখন এক অদ্ভুত দায়বোধ জন্ম নিল। তিনি শুধু একজন শিল্পী নন, বরং হয়তো এক সেতু, যার মাধ্যমে অমর পাল তার অদৃশ্য কাহিনি প্রকাশ করতে চাইছে। কিন্তু এ দায় বহন করা সহজ ছিল না। প্রতিটি রাতেই ঘুম ভাঙত তার, কানে বাজত ফিসফিসানি—যেন কেউ তাকে ডেকে বলছে, “আমার সত্য খুঁজে বের করো।” অন্ধকার ঘরের কোণে দাঁড়িয়ে থাকা ক্যানভাসগুলো তখন নিছক ছবি নয়, বরং অমীমাংসিত মৃত্যুর প্রমাণ হয়ে উঠছিল, আর আর্যন বুঝতে পারছিলেন যে তিনি ধীরে ধীরে এক গভীর অজানার দিকে টেনে নেওয়া হচ্ছেন।
–
সেদিন রাতটা ছিল অদ্ভুত নীরব। বাইরে শরতের হাওয়ায় পাতার খসখস শব্দ পর্যন্ত যেন চাপা পড়ে গিয়েছিল। স্টুডিওর জানালা দিয়ে ঢুকে আসা চাঁদের আলোয় ক্যানভাসের সারি নিস্তব্ধ সৈন্যের মতো দাঁড়িয়ে ছিল, আর্যন শুয়েছিলেন খাটে, কিন্তু তার চোখে ঘুম আসছিল না। খবরের কাগজের কাটিং থেকে জানা সত্য তার ভেতরে ঝড় তুলেছিল। তিনি যতবার চোখ বন্ধ করছিলেন, ততবারই সেই মুখ ভেসে উঠছিল—অমর পালের গভীর কালো চোখ। অবশেষে ক্লান্ত হয়ে যখন আধো-ঘুমে তলিয়ে গেলেন, তখনই হঠাৎ কানে এলো এক অদ্ভুত শব্দ, যেন কাঠের মেঝেতে কেউ ধীরে ধীরে হাঁটছে। প্রথমে তিনি ভেবেছিলেন এটা হয়তো ইঁদুর বা বাতাসের খেলা, কিন্তু শব্দটা ক্রমশ ভারী হয়ে উঠছিল, যেন মানুষের পায়ের চাপ। শরীরের প্রতিটি রোমকূপ সজাগ হয়ে উঠল, তিনি ধীরে ধীরে উঠে বসলেন। ঘরজুড়ে অস্বাভাবিক ঠান্ডা ছড়িয়ে পড়েছিল, আর অজানা এক চাপা গন্ধ যেন নাকে এসে লাগছিল—এক ধরনের ধোঁয়ার মতো, আবার পচা মাটির মতো।
আর্যন চোখ মেলেই তাকালেন ঘরের আয়নার দিকে। সেই আয়নাটা ছোট হলেও তার সামনে থাকা টেবিলের ওপরে রাখা ছিল, যেখানে তিনি মাঝে মাঝে নিজের আঁকার সময় মুখাবয়ব মিলিয়ে নিতেন। কিন্তু এ রাতে আয়নাটা যেন হঠাৎই ভিন্ন রূপ ধারণ করেছে। নিজের প্রতিচ্ছবি দেখার বদলে তিনি আঁতকে উঠলেন—তার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে আরেকটি মুখ। হ্যাঁ, সেই একই মুখ, যা তার ক্যানভাসে বারবার ফুটে উঠছিল। ঠোঁটের কোণে সেই রহস্যময় রেখা, চোখে গভীর অন্ধকার। মুহূর্তে আর্যনের শরীর অবশ হয়ে গেল। তিনি বুঝতে পারছিলেন, এটা নিছক ছবির প্রতিফলন নয়, এটা জীবন্ত উপস্থিতি। কয়েক সেকেন্ডের জন্য তিনি অনুভব করলেন, যেন সেই মুখ তাকে দেখছে, তার ভেতরটাকে ছিঁড়ে ফেলছে। বুকের ভেতরে ধকধক শব্দ উঠল, আর তার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেল। তিনি চিৎকার করতে চাইলেন, কিন্তু গলা দিয়ে কোনও শব্দ বেরোল না। মনে হচ্ছিল, সেই আয়নার প্রতিচ্ছবি তাকে ডাকছে—কোথাও এক অচেনা অন্ধকারে টেনে নিয়ে যাবে।
কিন্তু যত দ্রুত দৃশ্যটা এসেছিল, তত দ্রুতই মিলিয়ে গেল। এক ঝলকের মতো হঠাৎ করে সব অদৃশ্য হয়ে গেল, আবার শুধু নিজের ক্লান্ত মুখটিই দেখা গেল আয়নায়। চারপাশের শব্দও থেমে গেল, ঘর আবার নিস্তব্ধ হয়ে উঠল। আর্যন হাঁপাতে হাঁপাতে বিছানায় বসে রইলেন, মাথা থেকে ঘাম গড়িয়ে পড়ছিল। তিনি নিজেকে বোঝাতে চেষ্টা করলেন, হয়তো এটা স্বপ্ন ছিল, অতিরিক্ত চাপ আর আতঙ্কের কারণে সৃষ্ট ভ্রম। কিন্তু অন্তরের গভীরে তিনি জানতেন, এটা নিছক স্বপ্ন নয়। কোনও অদৃশ্য শক্তি তার চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তার শিল্পের সঙ্গে মিশে গিয়ে ধীরে ধীরে বাস্তবতাকে আচ্ছন্ন করছে। সেই রাতে তিনি আর ঘুমোতে পারলেন না। জানালার বাইরে আকাশ ভোরের দিকে হালকা আলোয় ভরতে থাকলেও তার ভেতরে ছড়িয়ে ছিল এক অদ্ভুত অন্ধকার। মনে হচ্ছিল, রাতটা কেবল শুরু হলো, আর তার জীবনের ভেতরে প্রবেশ করতে চলেছে আরও ভয়ের, আরও গভীর রহস্যের আভাস।
–
দিনের পর দিন অদ্ভুত অভিজ্ঞতার পর অবশেষে আর্যন স্থির করলেন, চুপচাপ বসে থাকার সময় শেষ। কেবল আঁকা বা আতঙ্কে ঘরবন্দি থেকে রহস্যের সমাধান হবে না। তিনি খুঁজে বের করবেন সত্যিটা—কে এই মানুষ, কেন তার মুখ বারবার ছবিতে ফুটে উঠছে। প্রথম সূত্র হিসেবে তিনি ধরে নিলেন সেই পুরোনো খবরের কাগজের কাটিং। লাইব্রেরির আর্কাইভে আবার গেলেন তিনি, একটার পর একটা পুরোনো পত্রিকার স্তূপ উল্টে দেখতে লাগলেন। কয়েক ঘণ্টা পরই হঠাৎ চোখে পড়ল একটি বিশদ রিপোর্ট—যেখানে খুনের ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা দেওয়া ছিল। সেখানে নাম উল্লেখ ছিল—অভিরূপ সেন। বয়স উনত্রিশ, পেশায় ছিলেন ব্যবসায়ী, তবে তার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে নানা গুজব ছিল। আর্যনের চোখে যেন আলো জ্বলে উঠল। এতদিন তিনি ভেবেছিলেন মানুষটির নাম অমর পাল, কিন্তু নতুন রিপোর্টে স্পষ্ট লেখা আছে—অভিরূপ। হয়তো একই ঘটনার উপর ভিন্ন সংবাদপত্র ভিন্ন নাম ব্যবহার করেছে, অথবা হয়তো এটি ছিল এক ধরণের বিভ্রান্তি। তবে ছবিতে যে মুখ ছাপা হয়েছিল, তা নিঃসন্দেহে সেই একই মানুষের, যাকে তিনি আঁকছেন।
আর্যন আরও খোঁজ করতে শুরু করলেন। পুরোনো পুলিশ রেকর্ড ঘাঁটার অনুমতি পাওয়া কঠিন হলেও তিনি কিছু পরিচিতের মাধ্যমে কাগজপত্রের কপি জোগাড় করতে পারলেন। সেখানে লেখা ছিল, অভিরূপ সেনের মৃত্যু ছিল একেবারেই রহস্যজনক। এক সন্ধ্যায় শহরের প্রান্তে তার মৃতদেহ উদ্ধার হয়। গলায় ছিল অদ্ভুত আঘাতের চিহ্ন, কিন্তু অস্ত্র কখনও পাওয়া যায়নি। পুলিশের সন্দেহ ছিল এটি পরিকল্পিত খুন, তবে কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি। নথিতে আরও লেখা ছিল, ঘটনার পর কয়েক মাস ধরে অভিরূপের পরিবার নিখোঁজ হয়ে যায়, যেন ইচ্ছে করেই শহর ছেড়ে চলে গিয়েছিল। মামলাটি ধীরে ধীরে অমীমাংসিত তালিকায় চলে যায়। আর্যনের বুকের ভেতর কাঁপুনি ধরল—এমন এক রহস্যময় মৃত্যু, যার কোনও উত্তর নেই, আর সেই মৃত মানুষের মুখই বারবার তার ক্যানভাসে ধরা দিচ্ছে। তার মনে হলো, এই ছবিগুলো নিছক শিল্প নয়, এগুলো এক অদৃশ্য সত্যকে প্রকাশ করতে চাইছে।
এখন আর্যনের মধ্যে এক নতুন সংকল্প জন্ম নিল। তিনি কেবল শিল্পী নন, তিনি যেন হয়ে উঠলেন এক অনুসন্ধানী। প্রতিটি ছবি তার কাছে হয়ে উঠছিল একেকটি সূত্র, একেকটি টুকরো ইশারা, যেগুলো জুড়ে দিলে হয়তো রহস্যের দরজা খুলবে। তার ভেতরে ভয় এখনও ছিল, কিন্তু কৌতূহল এবং দায়বোধ সেই ভয়কে ছাপিয়ে গেল। প্রতিটি রাতে তিনি নতুন ক্যানভাসে মুখ আঁকতেন, আর ভোর হলে বসে তুলনা করতেন—চোখের ভঙ্গি, ঠোঁটের বাঁক, কিংবা মুখের ছায়া কোনও নতুন কিছু বলছে কি না। মাঝে মাঝে মনে হতো, ছবিগুলো জীবন্ত হয়ে উঠছে, অভিরূপ তাকে পথ দেখাচ্ছে। এক অদ্ভুত অনুভূতি কাজ করছিল—যেন মৃত মানুষটির আত্মা তাকে ব্যবহার করছে, যাতে সত্য প্রকাশ পায়। তিনি জানতেন না এই যাত্রা তাকে কোথায় নিয়ে যাবে, কিন্তু অন্তরের গভীরে বুঝতে পারছিলেন—এটাই কেবল শুরু। তদন্তের পথ যত এগোবে, তার জীবনের ভেতরে তত অদ্ভুত ছায়া নেমে আসবে।
–
শুরুতে আর্যন এটিকে কেবল কল্পনার এক পালাবদল ভেবেছিলেন—কেউ কেউ বলত শিল্পীর কাজেই মাঝে মাঝে রঙ জীবন্ত মনে হয়। কিন্তু এ একেবারেই ভিন্ন কিছু ছিল। একদিন সকালে নতুন ক্যানভাস থেকে উঠে আসা রঙের ওপরেই যখন তার আঙুলের ছাপ দেখতে পেল, তখন সবটা ভুল করা যায় না। সে ছবি আঁকার সময় যেনই ক্যানভাসে লালচে ছোপ পড়ে, একটি রেখা অচিন্ত্যে ভেঙে যায়—পরের মুহূর্তেই সেই রেখা ফুলে ওঠে, রক্তঝরার মতো এক ছোপে পরিণত হয়। আর্যন প্রথমে মনে করলেন, পেইন্টের সঙ্গে কোনো রঙের প্রতিক্রিয়া হয়েছে; হয়তো তেল-রঞ্জক মিশে এমন হচ্ছে। কিন্তু যতবারই তিনি ক্যানভাস থেকে সেই দাগ মুছতে গেলেন, ততবারই মুছনো যায়নি; মুছে ফেলার সঙ্গে সঙ্গে যেন দাগ আরও গাঢ় হয়ে উঠে, এবং এক্কেবারে শুকোতেও চায় না—রং লেপের নিচ থেকে ধীরে ধীরে রক্তস্বরূপ ছোপ বেরোচ্ছে বলে মনে হত। এমনকি একটি ক্যানভাসে একেবারে চোখের কোণ থেকে একটি লালচে সরু ফোঁটা ঝরে পরল—আর্যন সেটি ছোঁয়ার পর অনুভব করলেন তা শীতল, লৌহসম গন্ধ মেশানো, যেন ধাতুর গন্ধের সঙ্গে মাটির বেদন। তার হাত কেঁপে উঠল; তিনি বুঝতে পারলেন, এটি শুধু একটি অদ্ভুত বিজ্ঞানী দোষ নয়—কিছু অবিশ্বাস্য, অশুভ ঘটছে।
ক্যানভাস থেকে যে ভয়ঙ্কর ছায়া বেরোচ্ছে, তা মৃদু শুরু হলেও ধীরে ধীরে তার চারপাশের পরিবেশ বদলে দিতে শুরু করল। দিনের আলো থাকলেও স্টুডিওর কোণে একটি অদৃশ্য অন্ধকার জমতে লাগল—এক ধরণের শীতলতা যা বাতাসকে স্থির করে দেয়। ক্যানভাসের সামনে দাঁড়ালে যেন সময় থমকে যায়; আত্মার ভিতর থেকে কিছুর চাপ অনুভূত হয়। আর্যনের কাঁধে, ঘাড়ে এমন এক ভার এসে লেগে গেল যে কাজ করাও কঠিন হয়ে উঠল। তিনি চেষ্টা করল ক্যানভাসগুলোর ওপর প্রতিরোধ গড়ে তুলতে—গ্লাস কেস বানালেন, ক্যানভাসগুলোকে ঢেকে রাখলেন, এমনকি রঙ শুকানোর রাসায়নিক লাগালেন—কিন্তু সব কিছু অকার্যকর। কখনো ক্যানভাস নিজেই ছিঁড়তে শুরু করল, আঁচড়ে আঁচড়ে যেন ফেটে সেখানে থেকে রক্তচাপা দাগ বহুগুণে বেড়ে গেল। একবার তিনি বিশাল ক্যানভাসটি বাইরে রেখে একটি আংশিক আগুন নিক্ষেপ করলেন—কয়েক সেকেন্ডে আগুন নিভে গেল, ক্যানভাস অক্ষত থেকে গেল, আর কেবল দু’একটি কালো ছোপ ছাড়া কিছুই সুযোগ দিল না। ওই রাতেই তার ঘুম সম্পূর্ণ ভেঙে গেল; খিঁচুনি-ফোঁটা চোখে চোখ রেখে সে ক্যানভাসগুলোকে যেন এক অভিশপ্ত পুরাকীর্ণকথা মনে করল—কিছু যে তার চেয়েও শক্তিশালী, এবং তা ক্যানভাসের ভেতর লুকিয়ে আছে।
সবচেয়ে ভয়ের বিষয়টি ছিল মানসিক দিকটা—আর্যনই বুঝতে পারছিলেন যে কেউ বা কিছু তাকে ব্যবহার করছে। ক্যানভাসের মুখ থেকে প্রকাশিত অভিশপ্ত ছায়া যেন তার ব্যাথা, তার ভয়, তার নীরব আকুলতাগুলোকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল; প্রতিটি ছবি যেন একটি বার্তা, একটি অংশখোলা স্মৃতি। যে রাতে ক্যানভাসটি রক্তাক্ত হয়ে উঠল, সেই রাতে তিনি স্বপ্নে দেখলেন অভিরূপ—নির্জন রাস্তার মুখে দাঁড়িয়ে আছে, হালকা কাতকা চুল, চোখে অস্থিরতা; শুধু সে চেয়ে আছে আর্যনের দিকে, কোনো শব্দ নেই, কিন্তু স্পষ্টভাবে বোঝা যায় সে চাইছে—“ছেলেটি, আমার কথা বলো।” জেগে উঠে আর্যন যখন নিজের হাতে দেখল লাল রঞ্জকের মতো দাগ, তিনি বুঝতে পারলেন এটি আর কল্পনা নয়; অভিরূপের কণ্ঠ তার মধ্য দিয়ে কাজ করছে। এক পর্যায়ে তিনি নিজেই বিভক্ত হয়ে পড়লেন—একদিকে তদন্তচেতনা, অন্যদিকে গভীর ভয়। বন্ধুদের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হতে লাগল; কেউ জিজ্ঞেস করলে সে জবাব দিতেন কল্পনাপূর্ণভাবে, কিংবা চুপ করে যেতেন। তার খাওয়া-দাওয়ার অভ্যাস বদলে গেল, রাত্রে ঘুম কমে গেল, আর ছবি আঁকার সময় তার হাত যেন বলপওয়া হয়ে উঠল—কখনো একটি রেখা টেনে ফেলল, তারপর ঘন্টার পর ঘন্টা ক্যানভাসের দিকে নীরবে তাকিয়ে রইত। তিনি ভয় পাচ্ছিলেন যে কতদূর এই ব্যবহার শক্তি টেনে নিতে চাইবে—কি একদিন সে তার মনের সব স্মৃতি খসে ফেলবে, কি একদিন সে তার জীবনও ছিনিয়ে নেবে?
তবে ভয়ের সঙ্গে ছিল এক অবরোধহীন দায়বোধও—যদি ক্যানভাস সত্যিই কোনো অমীমাংসিত কাহিনি বলতে চায়, আর্যন ছাড়া কে বলবে? তিনি থেমে থাকতেই পারলেন না। প্রতিটি রক্তাক্ত দাগ তাকে আর বেশি করে অনুপ্রাণিত করল খোঁজ চালাতে; প্রতিটি অনশনের মতো রেখা তাকে বলল—“আরো নিকটে চলে এসো।” আর্যনকে এখন শুধু এক অদ্ভুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে—সে কি ক্যানভাসকে ভেঙে ফেলবে, অথবা যার তথ্যগুলো ক্যানভাসে লুকিয়ে আছে সেগুলো বের করে আনবে? এ দ্বন্দ্বই এই অধ্যায়ের কেন্দ্রবিন্দুতে দাঁড়িয়ে আছে—অন্তরের ভয়ের সঙ্গে ভালবাসা, আত্মরক্ষা ও ন্যায়বোধের টানাপোড়েন। ক্যানভাসগুলো অভিশপ্ত, এটা প্রমাণিত; কিন্তু সেই অভিশপ্ততার ভেতরেই এক অনামিক ডাক লুকিয়ে আছে, যে ডাক শুনে আর্যন জানে নিজেকে আর পিছন ফিরে দেখতে পারবে না।
–
এক সন্ধ্যায় আর্যন এক বৃদ্ধকে সাক্ষাৎকার নিতে যান। বৃদ্ধটির নাম ছিল নীরদবাবু, বয়স আশির কোঠায়, কাঁপা হাতে চায়ের পেয়ালা ধরে আছেন তিনি। তাঁর গলাটা ফাটা হলেও চোখ দুটো অদ্ভুত তীক্ষ্ণ। নীরদবাবু অভিরূপকে ব্যক্তিগতভাবে চিনতেন, এবং সেই কারণেই আর্যনের মনে হলো হয়তো তিনি কিছু অমূল্য তথ্য জানাতে পারবেন। নীরদবাবু ধীরে ধীরে বলতে শুরু করলেন—অভিরূপ কেবল একজন সাধারণ মানুষ ছিলেন না, তিনি ছিলেন এক ধনী শিল্প-সংগ্রাহক, যার ভাণ্ডারে বহু দুর্লভ চিত্রকলা জমা ছিল। শিল্পজগতে তাঁর নাম ছিল বিতর্কিত কারণ তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল, অনেক সময় তিনি চুরি করা শিল্পকর্মও নিজের সংগ্রহে নিয়ে আসতেন। তাঁর চারপাশে ছিল শত্রুর ভিড়, শিল্পী থেকে ব্যবসায়ী, এমনকি রাজনৈতিক লোকজনও তাঁর বিরোধী ছিল। কিন্তু তাঁর সবচেয়ে বড় রহস্য ছিল একটি ছবি—এক রহস্যময় ক্যানভাস, যা নিয়ে গুজব ছিল এটি অভিশপ্ত। কেউ কেউ বলত, যে এই ছবিটি নিজের করে রাখবে, সে অদ্ভুত মৃত্যু ডেকে আনবে। বৃদ্ধের কণ্ঠস্বর কেঁপে উঠছিল, তাঁর স্মৃতির ঝাঁপি খুলে যেন অন্ধকার বেরিয়ে আসছিল। তিনি বললেন, অভিরূপের মৃত্যুর ঠিক কয়েক সপ্তাহ আগে তিনি নিজেই সেই ছবিটি কিনেছিলেন কোনো এক গুপ্ত নিলাম থেকে। তার পরেই শুরু হয় আতঙ্ক, তাঁর বাড়িতে ঘটতে থাকে অস্বাভাবিক ঘটনা—ছবি থেকে কান্নার শব্দ, মাঝরাতে রক্তের দাগ, আর অবশেষে এক অজ্ঞাত আততায়ীর হাতে তাঁর মৃত্যু।
আর্যন মন দিয়ে শুনছিলেন। তাঁর মনের ভেতর ধীরে ধীরে নানা সূত্র মিলতে লাগল। তিনি মনে করলেন, তাঁর নিজের আঁকা ক্যানভাসগুলোতে যে মুখ বারবার ফুটে উঠছে, সেটি হয়তো স্রেফ অভিরূপের প্রতিচ্ছবি নয়—বরং সেই অভিশপ্ত ছবিটির সঙ্গে কোনো অদৃশ্য যোগ রয়েছে। নীরদবাবু হঠাৎ করেই থেমে গেলেন, যেন অনেকটা দ্বিধায় ভুগছেন। আর্যন তাঁকে উৎসাহ দিয়ে জানতে চাইলেন, সেই ছবিটি এখন কোথায়? বৃদ্ধ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “সেই ছবির খোঁজ আজও কেউ পায়নি। পুলিশ খুঁজেছিল, সংগ্রাহকরা খুঁজেছিল, কিন্তু ছবিটি যেন অদৃশ্য হয়ে যায়। অনেকেই বলে, ছবিটি অভিরূপের মৃত্যুর পর কোথাও লুকিয়ে রাখা হয়েছিল—কেউ কেউ বলে ছবিটি অভিরূপের আত্মার সঙ্গে মিশে গেছে।” আর্যনের শরীর ঠান্ডা হয়ে এল। তিনি মনে মনে ভাবলেন, তবে কি তাঁর নিজের হাতে যে মুখ বারবার আঁকা হচ্ছে, সেটিই সেই ছবির অবশিষ্ট প্রতিচ্ছবি? বৃদ্ধ হঠাৎ তাঁর দিকে তাকিয়ে বললেন, “তুমি সাবধান হও বাবা, যদি সেই ছবি সত্যিই তোমার ক্যানভাসে ফিরে আসে, তবে তুমি আর নিরাপদ থাকবে না।” কথাগুলো শুনে আর্যনের হৃদস্পন্দন বেড়ে গেল। তাঁর মনে হলো, তিনি ধীরে ধীরে এমন এক রহস্যের দিকে টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছেন, যার থেকে মুক্তি পাওয়া সহজ হবে না।
সাক্ষাৎকার শেষে আর্যন বাড়ি ফেরার পথে এক অদ্ভুত ভার অনুভব করলেন। রাত তখন নেমে এসেছে, রাস্তার বাতি জ্বলে উঠেছে, কিন্তু তাঁর চারপাশে যেন এক অচেনা অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে। তাঁর মনে হচ্ছিল, কেউ তাঁকে অনুসরণ করছে, যদিও পেছনে তাকালে কাউকে দেখা যাচ্ছিল না। বৃদ্ধের বলা প্রতিটি শব্দ মাথায় বাজতে থাকল—অভিশপ্ত ছবি, শত্রুদের ষড়যন্ত্র, আর অমীমাংসিত মৃত্যু। আর্যনের মনে হলো, তিনি হয়তো নিজের অজান্তেই অভিরূপের অসমাপ্ত কাহিনির মধ্যে ঢুকে পড়েছেন। তাঁর ক্যানভাস এখন আর কেবল ছবি আঁকার জায়গা নয়—এটি যেন একটি দরজা হয়ে উঠেছে, যার ওপাশে অজানা এক শক্তি অপেক্ষা করছে। তিনি নিজের মনে প্রতিজ্ঞা করলেন, যতই ভয়ের হোক, তাঁকে খুঁজে বের করতেই হবে সেই ছবির রহস্য। কারণ যতক্ষণ না সত্য প্রকাশ পায়, ততক্ষণ এই অচেনা মুখ তাঁর জীবনে তাড়া করে ফিরবে। কিন্তু গভীরে তিনি জানতেন, এই পথ আর স্রেফ শিল্পের পথ নয়—এটি মৃত্যুর ছায়ায় মোড়া এক অজানা যাত্রা।
–
সেই রাতে আর্যনের ঘুম আসছিল না। মাথার মধ্যে বারবার ভেসে উঠছিল বৃদ্ধ নীরদবাবুর বলা কথা, অভিশপ্ত ক্যানভাস আর অভিরূপের রহস্যময় মৃত্যু। ক্লান্তি শরীরকে গ্রাস করলেও তাঁর চোখের পাতা এক মুহূর্তের জন্যও বন্ধ হচ্ছিল না। অবশেষে গভীর রাতের অচেতন ঘোরে তিনি স্বপ্ন দেখতে শুরু করলেন। স্বপ্নে তিনি নিজেকে দেখতে পেলেন এক বিশাল অন্ধকার ঘরে দাঁড়িয়ে, চারপাশে কেবল কুয়াশার মতো ধোঁয়া ভাসছে। দূরে একটি ঝাপসা আলো জ্বলজ্বল করছে, আর সেই আলোর দিকে এগিয়ে গেলেই স্পষ্ট হয়ে উঠল একটি মুখ—অভিরূপের। কিন্তু এইবার মুখটা ছবির মতো স্থির নয়, বরং জীবন্ত, কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে তাঁর ঠোঁট থেকে। অভিরূপের চোখ দুটি লালচে আলোয় জ্বলছিল, যেন অন্তহীন যন্ত্রণা আর অভিশাপ জমে আছে সেখানে। সে বলল, “আমাকে ভুলভাবে হত্যা করা হয়েছিল, আর আমার মৃত্যুর রহস্য চাপা দেওয়া হয়েছে। আমার নাম কলঙ্কিত করা হয়েছে, আমাকে চোর বলে অপবাদ দেওয়া হয়েছে, অথচ আমি সত্যিই সেই ছবির মালিক ছিলাম।” আর্যনের গলা শুকিয়ে গেল, তিনি কিছু বলতে চাইলেও কথা আটকে যাচ্ছিল। অভিরূপ আবার বলল, “আমার আত্মা অশান্ত, কারণ সত্য এখনও অন্ধকারে বন্দি। যতক্ষণ না সত্য উন্মোচন হয়, আমি মুক্তি পাব না।”
আর্যনের স্বপ্নের ভেতর সেই কণ্ঠস্বর যেন শীতল বাতাসের মতো কাঁপিয়ে দিচ্ছিল তাঁকে। তিনি এক পা পিছিয়ে গেলেন, কিন্তু হঠাৎ কুয়াশার ঘূর্ণির ভেতর থেকে অদ্ভুত সব ছবি ভেসে উঠতে লাগল—একটি ভাঙা জানালা, ছায়ার ভেতর লুকিয়ে থাকা এক ব্যক্তি, রক্তে ভিজে থাকা একটি চিত্রকর্ম, আর চিৎকার করে ভেঙে পড়া একটি চেয়ার। প্রতিটি দৃশ্য যেন অভিরূপের মৃত্যুর টুকরো টুকরো স্মৃতি। আর্যনের মনে হলো, তিনি স্রেফ স্বপ্ন দেখছেন না, বরং সরাসরি অভিরূপের অতীতের সাক্ষী হয়ে উঠেছেন। স্বপ্নে অভিরূপ হাত বাড়িয়ে দিলেন, তাঁর আঙুলগুলো রক্তমাখা, আর ঠান্ডা কণ্ঠে বললেন, “তুমি একজন শিল্পী, ক্যানভাসে সত্যকে আঁকতে পারো। আমার সত্য তুমি ছাড়া আর কেউ প্রকাশ করতে পারবে না। যারা আমাকে হত্যা করেছিল তারা এখনও ছায়ার আড়ালে বেঁচে আছে। যদি তুমি মুখ ফিরিয়ে নাও, তবে তাদের অভিশাপ তোমার জীবনকেও গ্রাস করবে।” এই কথাগুলো শুনে আর্যনের শরীর শিউরে উঠল, কিন্তু একইসঙ্গে তাঁর ভেতরে এক অদ্ভুত দায়বদ্ধতা জন্ম নিল। তিনি অনুভব করলেন, এই আত্মা তাঁকে ভয় দেখাতে আসেনি, বরং তাকে আহ্বান করছে—সত্য উদঘাটনের পথে নামতে।
ঘুম ভাঙার পর আর্যন ঘামে ভিজে গিয়েছিলেন। জানলার ফাঁক দিয়ে ভোরের আলো ঢুকছিল, কিন্তু সেই আলোতেও তিনি শান্তি পাচ্ছিলেন না। তাঁর মনে হচ্ছিল, অভিরূপের আত্মা এখনও ঘরের ভেতর ভাসছে, দেয়ালের আড়াল থেকে তাঁকে দেখছে। তিনি জানলেন, এই রহস্য থেকে তিনি আর পিছু হটতে পারবেন না। কারণ এখন তিনি শুধু একজন শিল্পী নন, বরং এক অশান্ত আত্মার সাক্ষী, যাকে মুক্তি দেওয়ার দায়িত্ব তাঁর কাঁধে এসে পড়েছে। তিনি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের প্রতিচ্ছবির দিকে তাকালেন—কিন্তু সেখানে এক মুহূর্তের জন্য দেখলেন অভিরূপের ছায়া, চোখে রক্তিম শূন্যতা নিয়ে তাকিয়ে আছে। আর্যন বুঝলেন, এখন থেকে প্রতিটি আঁচড়, প্রতিটি রঙ, প্রতিটি ক্যানভাস তাঁর জন্য এক ধরনের প্রমাণ হয়ে উঠবে, যা সত্যকে প্রকাশ করবে। তাঁর হৃদয় ভারী হয়ে গেল, কিন্তু একইসঙ্গে এক কঠিন সংকল্প জন্ম নিল। তিনি ধীরে ধীরে নিজের মনে উচ্চারণ করলেন, “আমি সত্য খুঁজে বের করব, অভিরূপ। তোমার আত্মাকে মুক্তি না দেওয়া পর্যন্ত আমি থামব না।” সেই মুহূর্তে তাঁর মনে হলো ঘরের হাওয়া হালকা হয়ে গেল, যেন অদৃশ্য কেউ সম্মতি জানাল। আর্যন জানতেন, তাঁর জীবনের পথ এখন আর আগের মতো রইল না—এটি রক্ত, রহস্য আর অশান্ত আত্মার পথে রূপান্তরিত হয়ে গেল।
–
আর্যনের অনুসন্ধান এক এক করে শহরের আড়ালে চাপা পড়া ইতিহাসের দরজা খুলে দিচ্ছিল। তিনি যখন পুরোনো সংবাদপত্র, নথি আর অচেনা মানুষের স্মৃতি জোড়া লাগাচ্ছিলেন, তখন তাঁর মনে হচ্ছিল যেন একটি অদৃশ্য হাত তাঁকে পথ দেখাচ্ছে। একদিন এক পুরোনো আইনজীবীর ফাইল থেকে তিনি চমকে যাওয়ার মতো তথ্য পেলেন—অভিরূপ সেনের মৃত্যুর আগে একটি সম্পত্তি বিরোধ চলছিল। বিরোধটা ছিল সাধারণ কোনো জমিজমা বা অর্থ নিয়ে নয়, বরং একটি দুর্লভ ছবি নিয়ে, যেটি অভিরূপ সংগ্রহ করেছিলেন বহু বছর আগে। ছবিটির মূল্য এতটাই বিপুল ছিল যে আন্তর্জাতিক কালোবাজারে কোটি টাকার বিনিময়ে বিক্রি হতে পারত। আইনজীবীর নোটে লেখা ছিল—অভিরূপ ছবিটির একমাত্র বৈধ মালিক হলেও তাঁর কাছের কিছু মানুষ এর দাবি করেছিল। এদের মধ্যে ছিলেন তাঁর শৈশবের বন্ধু, এমনকি আত্মীয়েরাও। এই জায়গাটাই আর্যনের চোখ খুলে দিল। তিনি বুঝলেন, খুন কোনো হঠাৎ সংঘটিত অপরাধ ছিল না, বরং লোভের ফল, যেখানে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কগুলোও বিশ্বাসঘাতকতায় ভেঙে পড়েছিল।
ধীরে ধীরে আর্যনের সামনে কাহিনি স্পষ্ট হয়ে উঠতে লাগল। তদন্তে উঠে এল, অভিরূপের ঘনিষ্ঠ বন্ধু কৌশিক, যে তাঁর ব্যবসার সঙ্গীও ছিল, আসলে খুনের মূল ষড়যন্ত্রকারী। কৌশিক একসময় অভিরূপের প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা রাখলেও যখন সেই রহস্যময় ছবিটি তাঁর হাতে আসে, লোভ তাঁকে অন্ধ করে দেয়। কৌশিক একাই এই ষড়যন্ত্রে জড়িত ছিল না। অভিরূপের আত্মীয় রত্না, যিনি একসময়ে তাঁর মায়ের মতো ছিলেন, সেও পরিকল্পনার অংশ ছিল। প্রমাণ লুকোতে তারা প্রথমে ছবিটি গোপন করে, তারপর পুলিশি তদন্ত ভেস্তে দেওয়ার জন্য সমস্ত প্রমাণ ধ্বংস করে ফেলে। আর্যন ভেবে অবাক হয়ে গেলেন, কীভাবে এত কাছের মানুষরা নিজের স্বার্থে এমন ভয়ানক বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে। সব কাগজপত্রে স্পষ্ট উল্লেখ ছিল না, কিন্তু ঘটনাগুলোকে মিলিয়ে দিতে দিতে তিনি নিশ্চিত হলেন—অভিরূপের মৃত্যু কেবল হত্যাই নয়, তা ছিল বিশ্বাসের ভাঙন, যা সবচেয়ে ভেতরের শত্রুদের হাতেই ঘটেছিল।
সবচেয়ে বিস্ময়কর বিষয় ছিল—এই হারিয়ে যাওয়া প্রমাণগুলো যেন আবারও ফিরে আসছিল আর্যনের ক্যানভাসে। তিনি লক্ষ্য করলেন, যতই নতুন ছবি আঁকেন, সেখানে কখনও একটি হাতের ছাপ, কখনও রক্তমাখা দরজা, কখনও বা একটি মুখ আংশিক ছায়ায় ঢাকা অবস্থায় ফুটে উঠছে। এগুলো কেবল তাঁর কল্পনার সৃষ্টি নয়, বরং অভিরূপের আত্মা তাঁর মাধ্যমে সেই চাপা দেওয়া সত্যের অংশবিশেষ প্রকাশ করছে। একদিন তিনি আঁকলেন এমন এক দৃশ্য—অভিরূপ দাঁড়িয়ে আছেন, আর তাঁর পাশে একটি ছুরি ধরা হাত, হাতটি স্পষ্টতই কৌশিকের। পরদিন আরেকটি ক্যানভাসে ফুটে উঠল রত্নার মুখ, তাঁর চোখে ভয় আর লোভের মিশ্র ছাপ। আর্যনের শরীর শীতল হয়ে গেল। তিনি বুঝলেন, ছবিগুলো এখন শুধু শিল্প নয়, এগুলো সাক্ষ্য, অদৃশ্য আদালতের দলিল, যা প্রমাণ করে দিচ্ছে সত্যিটাকে। অভিরূপের আত্মা তাঁর হাত দিয়ে রক্তাক্ত ইতিহাসকে প্রকাশ করছে, যাতে পৃথিবী জানে কারা ছিল আসল খুনি। আর্যনের মনে হলো, এই চিত্রগুলোই একদিন হয়ে উঠবে অভিরূপের ন্যায়বিচারের হাতিয়ার, আর তিনি সেই অদৃশ্য বিচারের একজন সাক্ষী।
–
অবশেষে আর্যন নিজের অন্তরের ভয় আর দ্বিধা কাটিয়ে পুলিশের কাছে হাজির হলেন। হাতে নিয়ে গেলেন তাঁর আঁকা ছবিগুলো, যা প্রথম দেখায় নিছক শিল্পকর্ম হলেও প্রতিটি রেখার ভেতর লুকিয়ে ছিল অভিরূপের হত্যার কাহিনি। পুলিশ প্রথমে বিশ্বাস করতে চাইল না, কারণ এ ধরনের অদ্ভুত প্রমাণ আদালতে কোনোদিন গ্রহণযোগ্য হয়নি। কিন্তু যখন আর্যন ছবিগুলো একে একে খুলে ধরলেন, তাতে দেখা গেল ঘটনাস্থলের বিবরণ—যে ঘরে অভিরূপ খুন হয়েছিলেন তার ভাঙা জানালা, মেঝেতে গড়িয়ে পড়া চেয়ার, রক্তে ভিজে থাকা ক্যানভাস, আর সবচেয়ে ভয়ের ছবি—অভিরূপের পাশে ছুরি ধরা কৌশিকের হাত ও রত্নার বিকৃত মুখ। পুলিশ অবাক হয়ে গেল, কারণ এইসব বিবরণ বহু বছর ধরে আড়াল করা হয়েছিল, যা কেবল খুনিরা জানত। আর্যন বললেন, “এগুলো আমি কল্পনা থেকে আঁকি না, এগুলো নিজে থেকে আমার ক্যানভাসে ফুটে ওঠে। অভিরূপের আত্মাই এই প্রমাণগুলো আমার হাতে দিচ্ছে।” পুলিশের এক সিনিয়র অফিসার ছবিগুলো দীর্ঘক্ষণ দেখে গম্ভীরভাবে মাথা নাড়লেন। তদন্ত পুনরায় শুরু হল, গোপন নথি আর পুরোনো সাক্ষীদের আবার খুঁজে বের করা হল। ধীরে ধীরে কৌশিক আর রত্নার নাম উঠে এল সামনের সারিতে। তাদের অতীত ব্যবসায়িক লেনদেন, গোপন কথোপকথনের নথি আর আর্যনের ছবির সঙ্গে মিলিয়ে যখন তদন্ত এগোল, সত্য আর লুকোনো রইল না।
কিছুদিনের মধ্যেই শহরজুড়ে খবর ছড়িয়ে পড়ল—অভিরূপ সেনের বহু পুরোনো খুনের রহস্য অবশেষে উন্মোচিত হয়েছে। পুলিশ আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করল যে কৌশিক ও রত্না-ই আসল খুনি, যারা লোভ আর প্রতারণার কারণে অভিরূপকে হত্যা করেছিল। তাদের গ্রেপ্তার করা হল, আর আদালতে ছবি ও পুনরুদ্ধার করা প্রমাণ হাজির করা হল। সংবাদমাধ্যমে তুমুল আলোড়ন উঠল। সবাই অবাক হল কীভাবে একজন শিল্পীর ক্যানভাসে চাপা দেওয়া অপরাধের ইতিহাস উন্মোচিত হতে পারে। আর্যন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে এলেন, তবে তিনি কোনও খ্যাতি বা প্রশংসা চাননি। তাঁর কেবল মনে হচ্ছিল, তিনি নিজের দায়িত্ব শেষ করেছেন। সেই রাতেই, যখন সবকিছু প্রকাশ্যে এসেছে, আর্যন ঘরে ফিরে ক্যানভাসের সামনে বসে থাকলেন। হঠাৎ তাঁর চোখের সামনে অভিরূপের ছায়া ভেসে উঠল—এইবার আর রক্তাক্ত নয়, বরং শান্ত। অভিরূপের আত্মা ধীরে ধীরে ঝাপসা আলোয় মিলিয়ে যেতে লাগল। বিদায় নেওয়ার আগে তার ঠোঁটে এক হালকা হাসি, চোখে কৃতজ্ঞতার আভা। আর্যন অনুভব করলেন, এক অদৃশ্য বোঝা নেমে গেল তাঁর কাঁধ থেকে, ঘরটা হালকা হয়ে উঠল। তিনি জানলেন, অভিরূপ অবশেষে মুক্তি পেয়েছেন।
কিন্তু মুক্তির সঙ্গে সঙ্গেই এক নতুন আতঙ্ক জন্ম নিল। আর্যন ভেবেছিলেন সব শেষ, ক্যানভাস এখন নিশ্চয়ই খালি থাকবে। কিন্তু কয়েকদিন পর যখন তিনি নতুন করে ছবি আঁকতে বসেন, তাঁর হাতে কোনো পরিকল্পনা না থাকলেও ক্যানভাসে আবার এক মুখ ভেসে উঠতে শুরু করে। প্রথমে অস্পষ্ট, তারপর ধীরে ধীরে স্পষ্ট। মুখটি তিনি আগে কখনো দেখেননি—চোখে গভীর শূন্যতা, ঠোঁটে অদ্ভুত হাসি। আর্যনের গলা শুকিয়ে এল। তিনি বুঝলেন, “কালপুরুষের ছায়া” শেষ হয়নি, এটি কেবল এক অদৃশ্য ধারাবাহিকতার অংশ, যেখানে মৃত আত্মারা তাঁর হাত ব্যবহার করে সত্য প্রকাশ করতে চায়। প্রতিটি মুখ মানে এক নতুন গল্প, এক নতুন রহস্য, আর হয়তো আরেকটি অশান্ত আত্মা। জানলার বাইরে রাতের অন্ধকার নেমে আসছিল, হাওয়ার সঙ্গে কেমন এক অদ্ভুত ফিসফিসানি ভেসে আসছিল, আর ক্যানভাসে ভেসে ওঠা মুখটি তাকিয়ে ছিল সরাসরি আর্যনের চোখে। আর্যনের মনে হল—তিনি হয়তো নিজের জীবনের নিয়তি থেকে পালাতে পারবেন না। তিনি কেবল এক শিল্পী নন, বরং মৃতদের সাক্ষী, এক অদৃশ্য সত্যের দূত। আর এই অশেষ যাত্রা মাত্র শুরু হল।
***