Bangla - তন্ত্র

অতল শক্তি

Spread the love

ঋতম মুখাৰ্জী


কলকাতার এই শতবর্ষপ্রাচীন গ্রন্থাগারটির নাম আজকাল প্রায় কেউই উচ্চারণ করে না, অথচ একসময় তা শহরের বৌদ্ধিক প্রাণকেন্দ্র ছিল। উচ্চ সিলিং, কাঠের খোদাই করা বুকশেলফ, আর দীর্ঘ করিডরজুড়ে পেতলের ল্যাম্পের আলো—এমনই ছিল এককালের আভিজাত্য। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে নতুন প্রজন্মের পাঠকরা ইন্টারনেটের মোহে আকৃষ্ট হয়ে পড়ে, আর গ্রন্থাগার রয়ে যায় বিস্মৃত, প্রায় পরিত্যক্ত। দিনের আলোতেও ভেতরে ঢুকলে কেমন এক চাপা অন্ধকার অনুভূত হয়; কাঠের পুরোনো টেবিলগুলো কেমন যেন শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে, আর বুকশেলফে সাজানো চামড়ার বাঁধাই বইগুলোর গায়ে জমে থাকা ধুলো যেন কালের সাক্ষী হয়ে নীরবতা রক্ষা করে। অদিত্য, কলকাতারই এক কলেজপড়ুয়া ছাত্র, পড়াশোনার কাজে প্রয়োজনীয় রেফারেন্স খুঁজতে একদিন এই গ্রন্থাগারে ঢোকে। তার কৌতূহলী দৃষ্টি বইয়ের তাক ছাড়িয়ে গিয়ে পৌঁছোয় গ্রন্থাগারের এক প্রান্তের অন্ধকার কোণে—যেখানে যেন কেউ আর বহু বছর পা বাড়ায়নি। ভাঙা জানালা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করা আলোয় দেখা যায়, এক বুকশেলফের পেছনে পড়ে আছে ধুলোয় ঢাকা চামড়ার বাঁধাই এক বিশাল বই, যার গায়ে অদ্ভুত খোদাই—মুদ্রার মতো গোলাকার চিহ্ন, আর মাঝখানে লেখা আছে এক অপরিচিত লিপি, যা বাংলার কিংবা ইংরেজির কোনো বর্ণমালার সঙ্গে মেলে না। অদিত্যর কৌতূহল চেপে রাখা সম্ভব হয় না; সে সাবধানে বইটি তুলে নেয়, কিন্তু অবাক হয়ে দেখে—যতটা পুরোনো দেখায়, ওজন তার থেকেও বেশি, যেন কোনো অদৃশ্য শক্তি বইয়ের পাতার ভেতরে বন্দি হয়ে আছে।

অদিত্য বইটি যখন টেবিলে রাখে, হঠাৎ যেন গ্রন্থাগারের বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। চারপাশের নীরবতা আরও ঘন হয়, দূরের কোনো কোণে ইঁদুর ছুটে যাওয়ার শব্দও যেন কানে বাজতে থাকে। বইয়ের কভারে হাত রাখতেই তার শরীরে শিহরণ বয়ে যায়, ঠাণ্ডা স্রোত নামতে থাকে মেরুদণ্ড বেয়ে। তবুও কৌতূহল প্রবল, সে ধীরে ধীরে বইটির প্রথম পাতা উল্টায়। পাতাগুলো সময়ের ভারে ক্লান্ত, তবু প্রতিটি অক্ষরে যেন এক অদ্ভুত দীপ্তি রয়েছে, যা মৃদু আলো ছড়িয়ে টেবিলের উপর ছায়ার খেলায় মাতিয়ে তোলে। প্রথম পাতাতেই লেখা আছে—‘অতল তন্ত্র’। অদিত্য বুঝতে পারে, এটি কোনো সাধারণ বই নয়। এর ভেতরে লিপিবদ্ধ মন্ত্র, জ্যোতিষ চক্র, এবং অজানা ভাষায় লেখা মর্মর ধ্বনি—যেন কারো উদ্দেশ্যে নয়, বরং কারো বন্দিত্বকে টিকিয়ে রাখার জন্য। হঠাৎ এক অদ্ভুত অনুভূতি হয় তার, যেন অন্ধকারের ভেতর থেকে কেউ তাকে দেখছে, অদৃশ্য চোখে তাকিয়ে আছে বইয়ের প্রতিটি অক্ষরের সঙ্গে সঙ্গে। সে চোখ সরাতে চায়, কিন্তু অদ্ভুতভাবে দৃষ্টি আটকে থাকে পাতার উপর। মনে হয়, অক্ষরগুলো ধীরে ধীরে নড়ছে, মিশে যাচ্ছে, আরেকটি অজানা শব্দ তৈরি করছে, যা শূন্যতার ভেতর প্রতিধ্বনি তুলছে। তার হৃদস্পন্দন দ্রুত হতে থাকে, ঘাম জমে কপালে, অথচ কক্ষের ভেতর তীব্র ঠাণ্ডা বাতাস বইতে থাকে। বাইরে থেকে কোনো শব্দ আসছে না, কিন্তু টেবিলের চারপাশে ছায়াগুলো যেন নিজের ইচ্ছেমতো নড়াচড়া করছে, দীর্ঘায়িত হয়ে অদিত্যকে ঘিরে ধরছে।

অদিত্য বইটি বন্ধ করতে চায়, কিন্তু তার হাত যেন স্থবির হয়ে যায়। অদৃশ্য কোনো শক্তি তাকে বাধ্য করছে পড়তে। পাতা উল্টাতে উল্টাতে দেখতে পায়, প্রতিটি পাতার সঙ্গে সঙ্গে গ্রন্থাগারের বাতাস ঘনীভূত হচ্ছে, অদ্ভুত গন্ধ ভেসে আসছে—যেন জ্বলা তেলের, ধূপের, আর পচা মাংসের এক অদ্ভুত মিশ্রণ। বুকশেলফের মধ্যে দিয়ে শব্দ ওঠে, যেন শত কণ্ঠে একসঙ্গে ফিসফিসানি—কিন্তু ভাষা বোঝা যায় না, কেবল অনুভূত হয় শীতলতার প্রবাহ। হঠাৎ মোমবাতির মতো আলো ঝলক দিয়ে নিভে যায়, চারপাশ ঘন অন্ধকারে ডুবে যায়। অদিত্য বুকের ভেতর চেপে ধরা ভয় অনুভব করে, কিন্তু তবুও বইয়ের পাতা থেকে চোখ সরাতে পারে না। তখনই সে বুঝতে পারে, গ্রন্থাগারের অন্ধকারে সে একা নয়। টেবিলের ওপরে বইয়ের পাতা উজ্জ্বল হয়ে উঠছে, যেন অদৃশ্য কোনো দৃষ্টি তাকে পর্যবেক্ষণ করছে। অদিত্যর মনে হয়, প্রতিটি শব্দ ধীরে ধীরে তার আত্মার ভেতর ঢুকে পড়ছে, আর তার মনের গভীরে অদৃশ্য কোনো দরজা খুলে যাচ্ছে। সেই মুহূর্তে এক শীতল কণ্ঠস্বর, যা সে কানে শুনতে পাচ্ছে না কিন্তু মস্তিষ্কে অনুরণিত হচ্ছে, বলে ওঠে—“তুই পড়া শুরু করেছিস, থামতে পারবি না।” অদিত্য শিউরে ওঠে, চোখ বড় বড় হয়ে যায়। গ্রন্থাগারের ঘন অন্ধকারে, ধুলো আর নীরবতার স্তরের মধ্যে, তার মনে হয় সত্যিই সে তাকিয়ে আছে অদৃশ্য চোখের দিকে—যা শত বছর ধরে এই বইয়ের পাতার ভেতরে বন্দি ছিল, মুক্তির অপেক্ষায়।

গ্রন্থাগারের সেই প্রথম রাতের অভিজ্ঞতার পর অদিত্যর ভেতরে কেমন এক অদম্য আগ্রহ জন্ম নিল। তার মনে হচ্ছিল, বইটি তাকে ডাকছে, এক অদৃশ্য সুতোয় টেনে নিয়ে যাচ্ছে অন্ধকারের গভীরে। সে যতবার চোখ বন্ধ করত, দেখতে পেত সেই অদ্ভুত অক্ষরগুলো যেন তার চোখের সামনে ভেসে বেড়াচ্ছে, আবার মিলিয়ে যাচ্ছে। বইয়ের পাতায় আঁকা রহস্যময় চিত্রগুলো—মানুষের শরীরের অর্ধেক অংশ পশুর আকারে, মণ্ডলাকৃতির চিহ্ন, রক্তমাখা বৃত্তের ভেতর বসে থাকা সন্ন্যাসী—সবকিছুই তার মনের মধ্যে ছায়ার মতো ঘুরপাক খাচ্ছিল। এমনকি ক্লাসে বসেও সে একাগ্র হতে পারত না; লেকচারের শব্দ যেন দূরের সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো শোনাত, আর তার সামনে বারবার ভেসে উঠত ‘অতল তন্ত্র’-এর মলাট। বন্ধু সৌরভ আর মেহুল প্রথমে মজা করলেও পরে চিন্তিত হতে শুরু করে। তারা লক্ষ্য করে, অদিত্যর চোখে ঘুম নেই, মুখ শুকিয়ে গেছে, অথচ তার ভেতরে এক অদ্ভুত দীপ্তি কাজ করছে। একদিন সৌরভ তাকে বলে ওঠে, “দেখ, তুই এসব বই পড়ে বিপদে পড়বি। অদ্ভুত অদ্ভুত জিনিস লিখে রেখেছে ওই বইতে, এগুলো তন্ত্র-মন্ত্র নিয়ে খেলবার জিনিস নয়।” কিন্তু অদিত্য কেবল মৃদু হেসে এড়িয়ে যায়। তার মনে হচ্ছিল, বন্ধুরা কিছুই বুঝতে পারছে না; তারা বুঝতে পারছে না এই বইয়ের ভেতরে কতটা শক্তি লুকিয়ে আছে। রাতে, যখন শহরের কোলাহল স্তব্ধ হয়ে আসে, তখন অদিত্য নিঃশব্দে গ্রন্থাগারের পথে বেরিয়ে পড়ে, হাতে টর্চলাইট আর ব্যাগে খাতাপত্র।

প্রতিটি রাত যেন এক নতুন আবিষ্কার হয়ে উঠছিল তার কাছে। বইয়ের ভেতরে শুধু মন্ত্রই নয়, ছিল অদ্ভুত সব চিত্রকলা ও সংকেত, যেগুলো ধীরে ধীরে তার অবচেতন মনকে আচ্ছন্ন করতে শুরু করে। অদিত্য খেয়াল করে, যখনই সে ওই মন্ত্রগুলো উচ্চারণ করার চেষ্টা করে, চারপাশের বাতাস ভারী হয়ে ওঠে, যেন দেয়ালগুলো শ্বাস নিচ্ছে। কখনও টেবিলের উপর রাখা মোমবাতি নিজে নিজেই নেভে, আবার কখনও কোনো পাতার উপর আঙুল রাখলেই মৃদু আলো জ্বলে ওঠে। এসব ঘটনাকে সে ভয় নয়, বরং বিস্ময় হিসেবে গ্রহণ করতে শুরু করে। মনে হচ্ছিল, বইটি তাকে বেছে নিয়েছে—যেন তার আগমনের অপেক্ষায় ছিল বহু বছর ধরে। ধীরে ধীরে অদিত্যর মনের ভেতর আর বাইরের বাস্তবতার পার্থক্য ঝাপসা হতে শুরু করল। কোনোদিন সে হঠাৎ দেখত, রাস্তার ভিড়ের মধ্যে কেউ তাকে অনুসরণ করছে—গায়ে পুরনো ধুতি, চোখ ফাঁকা, যেন বইয়ের আঁকা চিত্র থেকে বেরিয়ে আসা কোনো চরিত্র। আবার কোনোদিন ক্লাসে বসে থাকতে থাকতে মনে হত, শিক্ষক নয়, বরং গ্রন্থাগারের সেই অন্ধকার ছায়া তার দিকে তাকিয়ে আছে। বন্ধুরা এসব কথা শুনে আরও সতর্ক হতে বলে, কিন্তু অদিত্যর কাছে সবকিছুই এক অজানা অভিযানের মতো মনে হচ্ছিল। সে আরেকটু গভীরে ঢুকতে চেয়েছিল, আরও জানার ইচ্ছে হচ্ছিল, যেন জ্ঞান নয়, আসলে শক্তির নেশা তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলছে।

এই কৌতূহল ধীরে ধীরে আসক্তিতে পরিণত হতে লাগল। রাতগুলো তার কাছে যেন ভোর পর্যন্ত বইয়ের পাতায় বন্দি হয়ে থাকা সময়ের মতো। সে খাওয়া-দাওয়া ভুলে যেতে শুরু করল, ক্লাস এড়িয়ে চলতে লাগল, কেবল অপেক্ষা করত কবে আবার গ্রন্থাগারে ঢুকতে পারবে। তার চোখে লালচে আভা, ঠোঁট শুষ্ক, কিন্তু দৃষ্টিতে অদ্ভুত দৃঢ়তা। আশেপাশের মানুষ বুঝতে পারছিল, সে ধীরে ধীরে এক অদ্ভুত অন্ধকারের মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু তাকে টেনে আনার ক্ষমতা কারও নেই। অদিত্যর মনে হচ্ছিল, বইটি তার ভেতর জায়গা করে নিচ্ছে—প্রতিটি অক্ষর, প্রতিটি ছবি যেন তার রক্তে মিশে যাচ্ছে, তার চিন্তার ভিতর শিকড় গেঁথে দিচ্ছে। মাঝে মাঝে সে ভয় পেত, মনে হত বইটা পড়া বন্ধ করতে হবে, কিন্তু পরক্ষণেই কানে ভেসে আসত সেই অদৃশ্য কণ্ঠস্বর—“থামিস না… পড়… আরও পড়।” তখন সে বুঝতে পারত, বইটি কেবল একখানা গ্রন্থ নয়, বরং এক জীবন্ত সত্তা, যার ক্ষুধা অশেষ। আর সেই ক্ষুধা মেটাতে সে নিজেকে সঁপে দিচ্ছে, ধীরে ধীরে নিজের স্বাভাবিক জীবন ভুলে এক অতল গহ্বরে নেমে যাচ্ছে—যেখান থেকে ফেরার পথ হয়তো আর নেই।

অদিত্যর চোখ প্রথমে অবিশ্বাসে ভরা, তারপর ভয়ের অর্ধেক, কৌতূহলের অর্ধেক—মিশ্রিত আবেগে ভরে যায়। সেই রাতটি ছিল অন্য রকম; গ্রন্থাগারের ভেতর এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা বিরাজ করছিল, যা যেন তার আগমনের অপেক্ষায় দীর্ঘ সময় ধরে ধরে রাখা হয়েছে। সে ‘অতল তন্ত্র’-এর এক পাতা উচ্চারণ করল, স্বর ধীর, কিন্তু স্পষ্ট, যেন শব্দগুলো নিজেই বায়ুর মধ্যে লাফাচ্ছে। মুহূর্তের মধ্যেই তার শরীরে শীতল কণার মতো ঢেউ ছড়িয়ে পড়ল, মেরুদণ্ডে সঙ্কোচনের মতো অনুভূতি। হঠাৎ, টেবিলের উপরে রাখা বইগুলো নিজে নিজে নড়তে লাগল। পাতা উল্টানো, মলাটের শব্দ, এমনকি ধূলোর কণাও যেন বাতাসে ভেসে উঠল। অদিত্য হতভম্ব হয়ে চারপাশে তাকাল; তার চোখে দেখার শক্তি এবং মনোযোগ বইয়ের প্রতি এতটাই নিবদ্ধ যে সময় যেন থেমে গেছে। বাতাসে ভেসে আসা অজানা গন্ধ—ধূপ, পুরনো মাটির আর্দ্রতা, এমনকি কোনোটির গন্ধ যেন তার স্মৃতির ভেতর ঢুকে পড়ল—তার মনকে আরও অস্থির করে তুলল। অদৃশ্য কোনো শক্তি তার চারপাশের জগৎকে নড়াচড়া করতে বাধ্য করছে, আর অদিত্য নিজের শরীরের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারাতে লাগল।

তার ছায়া, যা সবসময় তার সাথে ছিল, হঠাৎই অস্বাভাবিকভাবে লম্বা হয়ে উঠল। দেওয়ালের দিকে ছায়া পড়ল, এবং তা যেন জীবন্ত হয়ে উঠল; ধীরগতিতে নড়াচড়া করল, পেছনে পিছনে অদ্ভুত রেখা আঁকতে লাগল। অদিত্য প্রথমে ভয় পেয়েও কিছুতেই পিছু হটতে পারল না। মনে হচ্ছিল, তার শরীর আর মনের মধ্যে কোনো অদৃশ্য শক্তি ঢুকেছে, যা তাকে নিয়ন্ত্রণ করছে। সে হাত বাড়ালে বইপত্র বাতাসে ভেসে আসে, ল্যাম্পের আলো ঝলসে ওঠে, এবং সমস্ত গ্রন্থাগার যেন এক অদ্ভুত জীবন্ত সত্তা হয়ে যায়। অদিত্যর হৃদস্পন্দন তীব্র, শ্বাসকষ্ট হচ্ছে, কিন্তু সে স্থিরভাবে অনুভব করল, এই রূপান্তরের মধ্যেই রয়েছে বইটির আসল শক্তি। একটি শব্দ উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে, তার ভেতরের ভাবনা, চিন্তা, এমনকি ভয়ও পরিবর্তন হতে লাগল; সে অনুভব করল, বইয়ের পাতার অক্ষরগুলো তার মনের ভেতরে ঢুকে রঙ বদলাচ্ছে, প্রতিটি চিত্র যেন তার আত্মার সঙ্গে মিলেমিশে যাচ্ছে।

সময় যত বাড়ল, তার চারপাশের বাস্তবতা আরও বিকৃত হতে থাকল। বইয়ের পাতা নিজেই নড়াচড়া করছে, লেখা অক্ষরগুলো ধীরভাবে ঝাপসা হয়ে অন্য আকৃতি নিচ্ছে। অদিত্যর দৃষ্টি যেন অবরুদ্ধ; সে লক্ষ্য করল, নিজের হাতের আঙুলগুলো স্বাভাবিক রঙ হারাচ্ছে, অস্বাভাবিকভাবে লম্বা, পাতলা হয়ে যাচ্ছে। কক্ষের প্রতিটি প্রাচীর যেন ভেসে উঠছে, এবং বাতাসে ভেসে আসা গন্ধ তার মস্তিষ্ককে বিভ্রান্ত করছে। হঠাৎ, সে নিজেকে টেবিলের পাশে বসা প্রতিফলনে দেখে—ছায়ার অর্ধেক অংশ তার শরীরের থেকে আলাদা, অদ্ভুত অন্ধকারে ঢাকা। সে শিহরিত, কিন্তু কোনোভাবে ভয় নয়, বরং অদ্ভুত উত্তেজনা। বুঝতে পারে, বইটি তার শরীর ও আত্মার মধ্যে প্রথম রূপান্তর ঘটাচ্ছে। মনে হচ্ছিল, প্রতিটি উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে তার আত্মার কিছু অংশ বইয়ের সঙ্গে মিলিত হচ্ছে, এবং সে ধীরে ধীরে এক নতুন বাস্তবতার সঙ্গে সংযুক্ত হচ্ছে—একটি জগৎ যেখানে নিয়ম, সময়, এবং স্থান স্বাভাবিক নেই। সেই রাতটিতে অদিত্য কেবল একজন ছাত্র নয়; সে হয়ে উঠল সেই অদৃশ্য শক্তির অর্ধেক অংশ, যা শতাব্দী ধরে ‘অতল তন্ত্র’-এর ভেতরে বন্দি ছিল। বাতাসে ভেসে আসা গন্ধ, নড়াচড়া করা বইপত্র, অস্বাভাবিক ছায়া—সবকিছু মিলিয়ে এক জাগ্রত প্রলয়, যা তাকে ধীরে ধীরে নতুন সত্তার দিকে টেনে নিয়ে যায়।

রূপান্তরের প্রথম রাতের অভিজ্ঞতা অদিত্যকে এক অদ্ভুত জগতে নিয়ে গেছে, যেখানে নিয়ম, বাস্তবতা, এবং সময়—সবকিছুই তার ইচ্ছার অধীনে। প্রথমবার সে নিজেকে বাতাস থামাতে দেখেছিল, এবং তখন বুঝতে পারল, একটি ছোঁয়াতেই বাতাসের গতিপথ পরিবর্তন করা সম্ভব। ছোট ছোট বইপত্র, ধূলির কণার মতো, তার আঙুলের ইশারায় নাচতে শুরু করল। প্রথমে ভয়, ঠোঁটে কেঁপে ওঠা, শরীরের প্রতিটি অংশে শিহরণ—সব কিছু মিলিয়ে সে অস্থির হয়ে পড়ল। কিন্তু তারপর, ধীরে ধীরে ভয় হারিয়ে গেল, এবং সেই শক্তির স্বাদ তাকে এমন এক আনন্দ দিল, যা সে আগে কখনো অনুভব করেনি। নিজের হাতে চারপাশের জগৎকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা, বাতাস, আলো, ছায়া—সবকিছু তার ইচ্ছামতো বাঁকানো, যেন একটি খেলার মতো, তাকে মুগ্ধ করল। গ্রন্থাগারের পুরোনো দেয়াল, মাটির ধুলো, বইয়ের নড়াচড়া—সবকিছু যেন তার অদৃশ্য স্পর্শে জীবন্ত হয়ে উঠল। প্রথমবারের মতো সে উপলব্ধি করল, এই শক্তি কেবল ভয় তৈরিই করে না; এটি একটি মায়াময় আনন্দ, যা তাকে ক্ষমতার অনুভূতি দেয়।

কিন্তু যতক্ষণ অদিত্য শক্তির খেলায় মগ্ন, ততক্ষণ তার ভিতরে জন্ম নিল দ্বন্দ্ব। একটি দিকে ছিল তার স্বাভাবিক জীবন—পড়াশোনা, বন্ধু, কলেজের জীবন, প্রতিদিনের অভ্যাস। অন্যদিকে ছিল এই অতল শক্তি, যা তাকে দৈনন্দিন বাস্তবতার সীমা ছাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। সে জানত, একবার সে এই শক্তির জগতে ডুবে গেলে, নিয়মিত জীবন আর ফিরবে না। এই দ্বন্দ্ব তার মনে ক্রমশ বীজ বপন করল। সকালে কলেজে বসে সে বইপত্র হাতে নিয়ে পড়াশোনা করার চেষ্টা করল, কিন্তু মনে হচ্ছিল, প্রতিটি শব্দ তার মনের মধ্যে ঘুরে আসছে, চোখে ভেসে উঠছে অক্ষর, মন্ত্র, অদ্ভুত চিহ্ন। বন্ধুরা হাসি-ঠাট্টা করলেও, সে তাদের সঙ্গে পুরোপুরি যুক্ত হতে পারত না; মনে হচ্ছিল, তার মন আরও গভীরে, গ্রন্থাগারের অন্ধকারের মধ্যে। দুপুরে কলেজ লাইব্রেরিতে বসে সে চেষ্টা করল, কিন্তু বইয়ের পাতায় থাকা প্রতিটি অক্ষর তার চোখে নড়াচড়া করতে লাগল, আর বাতাসের মতো শব্দ তার কানে ভেসে আসল। ধীরে ধীরে সে বুঝতে লাগল, তার শক্তি কেবল ভয়ই নয়, আনন্দও তৈরি করছে, কিন্তু একই সঙ্গে নিয়ন্ত্রণ হারানোর শঙ্কা জাগাচ্ছে।

শক্তির স্বাদ যত বাড়ল, তার সঙ্গে বাড়ল জটিলতা। এক রাতে গ্রন্থাগারের টেবিলের উপরে বসে সে নিজের শক্তি পরীক্ষা করল। বাতাসকে বাঁকাল, বইপত্রকে উড়ালাল, মোমবাতির আলোকে তার ইচ্ছামতো নাচাল। হঠাৎ অনুভব করল, প্রতিটি কাজের সঙ্গে সঙ্গে তার চিন্তা আরও দ্রুত হচ্ছে, মন আরও শক্তিশালী হচ্ছে, অথচ শরীরিক ক্ষণিকের শিথিলতা তৈরি হচ্ছে। সে ভয় পেল—যদি শক্তি হঠাৎ বাইরে চলে যায়, যদি নিয়ন্ত্রণ হারায়? কিন্তু সেই ভয়ের মাঝেই ছিল এক অদ্ভুত উত্তেজনা, যা তাকে আরও গভীরে ধাক্কা দিল। মনে হচ্ছিল, এই শক্তি তারই অন্তর্গত, আর এটি ব্যবহার না করলে সে অসম্পূর্ণ। প্রথমবারের মতো অদিত্য অনুভব করল, মানুষ শুধুমাত্র জ্ঞান অর্জন করলেই শক্তিশালী হয় না; কখনো কখনো এই অদৃশ্য জগতে প্রবেশ করাটাই প্রকৃত শক্তির পরীক্ষণ। কিন্তু সাথে জন্ম নিল দ্বন্দ্ব—কোন পথে যাবে সে? পড়াশোনার স্থির জগৎ, না এই অতল শক্তির অবাধ যাত্রা? রাতের নিঃশব্দে গ্রন্থাগারের দেয়ালে প্রতিফলিত তার দীর্ঘ ছায়া যেন নিজেই প্রশ্ন করছে, “কোন পথে যাবি তুমি—নিয়মিত জীবন নাকি অজানা শক্তির খেলা?” অদিত্য অনুভব করল, এই দ্বন্দ্ব তাকে এক অদৃশ্য জগৎ এবং বাস্তবতার মধ্যে বাঁধা ফেলছে, আর এই বাঁধন ভেঙে যেতেই হবে, না হলে শক্তি কখনো পূর্ণ স্বাদ দিতে পারবে না।

অদিত্যর কৌতূহল ক্রমশ ভয়ানক রূপ নিতে শুরু করল। শক্তির স্বাদ তাকে যেন এক অদৃশ্য জগতে টেনে নিয়ে গেছে, কিন্তু সেই সঙ্গে তার মনের ভেতর একটি প্রশ্ন জন্ম নিল—এই বইটি কোথা থেকে এসেছে, এবং কেন এমন অদ্ভুত ক্ষমতা এতে নিহিত। একদিন কলেজের লাইব্রেরির স্থায়ী রেফারেন্স সেকশনে খোঁজ করতে গিয়ে সে একটি পুরনো আর্কাইভের খুঁটিনাটি নথি খুঁজে পেল। সেখানে লেখা ছিল—‘অতল তন্ত্র’ এক প্রাচীন তান্ত্রিক ভূতনাথ অঘোরীর লেখা, যিনি শতাব্দী আগেই কলকাতায় বসবাস করতেন। তিনি এক অদ্ভুত পরিকল্পনা করেছিলেন: নিজের আত্মাকে সাধারণ মানুষের চোখ থেকে লুকিয়ে রেখে, একটি চামড়ার বইয়ের ভেতরে বন্দী করে রাখা। নথিতে আরও উল্লেখ ছিল, যে বইটি যত বেশি পড়া হবে, তার পাঠকের দেহ ও মন ধীরে ধীরে সেই শক্তির প্রতি সংবেদনশীল হবে, এমনকি একদিন সেই শক্তি পুরোপুরি দখল করে নেবে। অদিত্য প্রথমে অবিশ্বাস করল, কিন্তু সবকিছুই তার অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিলে যাচ্ছে। বইয়ের পাতায় অক্ষরগুলো যেন তার মনের ভেতর ঢুকে শক্তি তৈরি করছে, আর প্রতিটি চিত্র, প্রতিটি মন্ত্র তার চারপাশের বাস্তবতাকে বিকৃত করছে। ধীরে ধীরে সে বুঝতে পারল, এই বই শুধু জ্ঞান নয়, বরং এক জীবন্ত সত্তা, যা চায়—নিয়ন্ত্রণ এবং প্রলয়।

অদিত্যর মনে ভয় ও উত্তেজনার এক অদ্ভুত মিশ্রণ জন্ম নিল। রাতে গ্রন্থাগারে বসে বই পড়তে পড়তে সে লক্ষ্য করল, প্রতিটি মন্ত্র উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে বাতাসের চাপ বদলাচ্ছে, বইপত্র নিজে নিজে নাচছে, আর বাতাসে ভেসে আসা অদ্ভুত গন্ধ আরও ঘন হয়ে যাচ্ছে। এমনকি টেবিলের উপর থাকা মোমবাতি তার হাতে না ছুঁড়ে জ্বলে উঠছে, আর তার ছায়া দেওয়ালে অস্বাভাবিকভাবে দীর্ঘ ও বিচিত্র আকার নিচ্ছে। সে ভয় পেল, কিন্তু একই সঙ্গে মনে হচ্ছিল, এই শক্তি তাকে বিস্মৃত আনন্দ দিচ্ছে। তারপর তার খোঁজে নেমে এল আরও গভীর রহস্য। আর্কাইভের নথিতে লেখা ছিল, যে ভূতনাথ অঘোরী এমন কিছু মন্ত্র ও চিত্র তৈরি করেছিলেন, যা পাঠকের শরীর ও মনকে এক নতুন স্তরে নিয়ে যায়—যেখানে বাস্তবতা, সময়, এবং স্থান নিজেই লুপ্ত হয়ে যায়। প্রতিটি উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে, অদিত্য বুঝতে লাগল, নিজের দেহ-মন ক্রমশ বইয়ের ভিতরে বন্দী ভূতনাথের শক্তির সঙ্গে মিলছে। এবং সেই মিলনের সঙ্গে জন্ম নিল এক ভয়ঙ্কর জাগ্রত অবস্থা, যেখানে সে আর স্বাভাবিক মানুষের মতো নয়; তার ভেতরের প্রতিটি সেল, প্রতিটি চিন্তা, বইয়ের শক্তির সঙ্গে সঙ্গম করছে।

অদিত্যর ভেতর ক্রমশ একটি লক্ষ্য জন্ম নিল—যত বেশি সম্ভব জানার, যত বেশি সম্ভব শক্তি অনুভব করার। সে বুঝতে পারল, বই পড়া মানে শুধু মন্ত্র উচ্চারণ করা নয়; এটি এক প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে পাঠকের আত্মা ধীরে ধীরে বইয়ের সঙ্গে মিশে যায়। কিন্তু একই সঙ্গে তার মনে প্রশ্ন উঠল—এতটা শক্তি পাওয়া কি নিরাপদ? যদি একদিন নিয়ন্ত্রণ হারায়, সে কি নিজেকে হারাবে, না তার চারপাশের বাস্তবতাকে? সে চেষ্টা করল বন্ধুর সঙ্গে আলোচনা করার, কিন্তু বন্ধুরা তাকে বুঝতে পারছে না। এমনকি কোনো একজন তাকে সতর্ক করার চেষ্টা করলেও, অদিত্য নিজেকে থামাতে পারছে না। প্রতিটি রাতে সে গ্রন্থাগারে ফিরে আসে, বই খোলে, মন্ত্র উচ্চারণ করে এবং তার চারপাশের জগৎকে নিজের ইচ্ছায় বাঁকায়। সে বুঝতে পারল, বইটি কেবল জ্ঞান নয়, বরং একটি পরীক্ষা—যদি পাঠক সাহসী হয়, ধৈর্যী হয় এবং আরও গভীরে যায়, তাহলে শক্তি তাকে সম্পূর্ণ গ্রাস করবে। আর এই উপলব্ধি অদিত্যর ভেতর এক অদ্ভুত উত্তেজনা জাগায়, যা তাকে প্রতিনিয়ত গ্রন্থাগারের অন্ধকারে টেনে নিয়ে যায়, বইয়ের গভীরে ডুবিয়ে দেয় এবং শক্তির স্বাদ দেয়, যা একদিকে আনন্দ, অন্যদিকে ভয় সৃষ্টি করছে।

রাতটি ছিল পুরোপুরি ভিন্ন, এক অদ্ভুত ঘন অন্ধকারের আবহে ঢাকা। অদিত্য গ্রন্থাগারের অন্ধকার কক্ষে একা, হাতে ‘অতল তন্ত্র’-এর নির্দেশ অনুসারে একটি আচার সম্পন্ন করার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। পূর্ণিমার আলো দূরের জানালা দিয়ে সরু রেখায় প্রবেশ করছে, আর তার চারপাশের বাতাসে এক অদ্ভুত ভারী ঘ্রাণ ভেসে আসছিল—পুরনো মোমবাতি, ধূলি, এবং মাটির মিশ্রণ, যা তার নাকে অচেনা তাজা শীতলতা এনে দিচ্ছিল। সে নিজেকে ধীরে ধীরে শান্ত করার চেষ্টা করল, কিন্তু মনে হচ্ছিল, তার হৃদস্পন্দন দ্রুত হয়ে গেছে, মন অস্থির, এবং শরীরের প্রতিটি অণু যেন প্রত্যেক নিঃশ্বাসের সঙ্গে সাড়া দিচ্ছে। আচারটি শুরু করার আগে সে নিজের কাঁধে হাত রাখল, দম নিয়ে গভীরভাবে মন্ত্রের প্রথম শব্দ উচ্চারণ করল। মুহূর্তের মধ্যেই গ্রন্থাগারের চারপাশের নীরবতা ভেঙে গেল, বাতাসের নড়াচড়া তীব্র হয়ে উঠল, আর বইপত্র হঠাৎ স্বেচ্ছায় নাচতে লাগল। মোমবাতির আলো ঝলমল করে ছায়ার খেলায় পরিণত হলো, যা দেয়ালে অদ্ভুত অর্ধ-মানবীয়, অর্ধ-অদৃশ্য আকারের প্রতিচ্ছবি তৈরি করল।

অদিত্যর চোখ বড় বড় হয়ে গেল, শরীর কেঁপে উঠল, কিন্তু সে থামল না। বইয়ের নির্দেশ অনুসারে রক্ত দিয়ে আচার করতে করতে সে উচ্চারণ করল মন্ত্রগুলি, ধীর, কিন্তু গভীর প্রতিধ্বনিতে। প্রতিটি শব্দ তার কানে নয়, বরং তার মনের ভেতর থেকে প্রতিধ্বনি তুলছিল। হঠাৎ, গ্রন্থাগারের দেয়ালগুলো যেন শ্বাস নিতে শুরু করল—ধীরে ধীরে নড়াচড়া, কেমন অদ্ভুত কম্পন, যা মাটির ফাঁক দিয়ে তার কানে পৌঁছছে। বাতাসের সঙ্গে বাতাসে ভেসে আসা গন্ধ আরও ঘন হয়ে উঠল—রক্ত, ধূপ, অচেনা মাটির ঘ্রাণ। অদিত্য লক্ষ্য করল, তার ছায়া একাই নয়, বরং একটি অদ্ভুত ছায়ামূর্তি তার সামনে উদ্ভাসিত হচ্ছে। সিলুয়েটটি ছিল মানুষ নয়, বরং একটি অর্ধ-অর্ধাকার আকার, যা ধীরে ধীরে মানুষ এবং অদ্ভুত প্রাণীর মধ্যে মিলিত হচ্ছে। সেই ছায়ামূর্তির চোখে যেন অদৃশ্য আগুন জ্বলছে, যা সরাসরি অদিত্যর ভেতরের শক্তিকে টোকাচ্ছে। সে ভয় পেল, মনে হল, বইয়ের শক্তি এখন তার হাতের বাইরে চলে গেছে, আর গ্রন্থাগার পুরোপুরি জীবন্ত হয়ে উঠেছে, তার চারপাশের বাতাস, বইপত্র, আলো—সবকিছু এক অদ্ভুত সমন্বয়ে নড়াচড়া করছে।

আচার চলাকালীন সময়ে অদিত্য অনুভব করল, তার ভেতরের শক্তি এক অদ্ভুত মাত্রায় পৌঁছে গেছে। মন্ত্রোচ্চারণের সাথে সঙ্গে তার দৃষ্টি অতল জগতে প্রবেশ করল, যেখানে সময়, স্থান, এবং বাস্তবতার সমস্ত নিয়ম নিজেই অদৃশ্য হয়ে গেছে। সে বুঝতে পারল, এই ছায়ামূর্তি শুধু প্রতিফলন নয়; এটি ভূতনাথ অঘোরীর আত্মার আংশিক অবয়ব, যা বইয়ের ভেতরে বন্দী ছিল, এবং যা এখন তার কাছে প্রলয়কর রূপে উদ্ভাসিত হয়েছে। অদিত্যর মন ভয় ও উত্তেজনার এক অদ্ভুত সংমিশ্রণে দুলছে—একদিকে আনন্দ, অন্যদিকে শিহরণ। সে লক্ষ্য করল, যে শক্তি এতটাই তীব্র যে তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না; সে বই পড়া বন্ধ করতে চাইলেও মন নিজেই পুনরায় আচার নির্দেশের দিকে টানছে। পুরো গ্রন্থাগার যেন এক অদৃশ্য সত্তার অধীনে বসবাস করছে—যা অদিত্যর শক্তি, তার মানসিক অবস্থা এবং তার পদক্ষেপের সাথে সঙ্গতি রেখে প্রতিটি পদক্ষেপের সঙ্গে নড়াচড়া করছে। রাতের শেষ দিকে, আচার সম্পন্ন হওয়ার পরও, গ্রন্থাগারের বাতাস ভারী, বইপত্র অস্থির, আর সেই ছায়ামূর্তি অদৃশ্য হয়ে গেলেও তার উপস্থিতি অদৃশ্য ছায়ার মতো অদিত্যর মনে থেকে যায়। সে বুঝতে পারল, একবার এই নিষিদ্ধ শক্তির স্বাদ পেলে, আর কখনো ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়; এবং তার ভেতরের দ্বন্দ্ব আরও তীব্র হয়ে উঠল—শক্তির আনন্দ বনাম মানবিক ভয়, ক্ষমতার লোভ বনাম বাস্তব জীবনের সীমাবদ্ধতা।

গ্রন্থাগারের অন্ধকারে নিষিদ্ধ আচার সম্পন্ন করার পর অদিত্যর দৃষ্টি যেন এক নতুন মাত্রায় প্রবেশ করল। হঠাৎ, ছায়ামূর্তি তার সামনে ধীরে ধীরে দৃঢ় হয়ে উঠল, এক অদ্ভুত আকর্ষণ তৈরি করল, যা অদিত্যকে বলল—“এসো, গভীরে দেখো।” অদিত্য, ভয় ও উত্তেজনার এক অদ্ভুত মিশ্রণ নিয়ে, ছায়ামূর্তির পিছনে চলতে লাগল। মুহূর্তের মধ্যেই সে বুঝতে পারল, গ্রন্থাগারের দেয়াল, তাক, বই—সব কিছু যেন মিলিয়ে যাচ্ছে, আর তার চারপাশের বাস্তবতা অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। বাতাসের ঘ্রাণ, বাতাসের কম্পন, এমনকি মৃদু আলোও অদ্ভুত রূপে বিকৃত হচ্ছে। সে লক্ষ্য করল, সময় আর স্থান সাধারণ নিয়ম মানছে না—মুহূর্ত এবং ঘণ্টা, দূরত্ব এবং ঘনত্ব সবকিছু অদ্ভুতভাবে মিলেমিশে গেছে। ছায়ামূর্তির নড়াচড়া অনুসরণ করতে করতে সে একটি অচেনা জগতে প্রবেশ করল, যা অতলের গভীরতার মতো—রঙ, শব্দ, এবং আকৃতি মানুষের চোখে ধরা সম্ভব নয়। প্রতিটি পদক্ষেপে তার মস্তিষ্কের ভেতরে অজানা উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ল; যেন তার মানসিক সীমা ক্রমশ ভেঙে যাচ্ছে।

অদিত্য যখন গভীরে প্রবেশ করল, তখন তার চারপাশের দৃশ্যাবলী আরও জটিল হয়ে উঠল। বাতাসে ভেসে আসছে এক অদ্ভুত সুর, যা কোন যন্ত্র বা জীবন্ত প্রাণীর নয়, বরং অদৃশ্য শক্তির কম্পন। রঙগুলো এতটাই প্রাণবন্ত এবং অস্বাভাবিক যে চোখে তা একসাথে গ্রহণ করা সম্ভব নয়—নীল, সবুজ, লাল, বেগুনি, এমনকি যে রঙের নাম কেউ জানে না, সবকিছুই একসাথে নৃত্য করছে। আকৃতি পরিবর্তন হচ্ছে, কখনও স্থির, কখনও তরঙ্গের মতো ছড়িয়ে পড়ছে। অদিত্য লক্ষ্য করল, মাটির কোনো ধারণা নেই; পায়ের তলে যা অনুভব হচ্ছে, তা সময়ের মতো তরল এবং বায়ুর মতো অদৃশ্য। মনে হচ্ছিল, প্রতিটি পদক্ষেপে তার মস্তিষ্ক নিজেই রঙ এবং শব্দের সঙ্গে মিলিত হয়ে ভেঙে পড়ছে। সে চেষ্টা করল, চোখ বন্ধ করে বাস্তব জগতে ফিরে আসতে, কিন্তু কোনো পথ নেই। ছায়ামূর্তি তার দিকে তাকিয়ে আছে, ধীর কিন্তু দৃঢ়, এবং বলছে—“ফিরে যেও না, দেখ, অনুভব কর।”

প্রতিটি মুহূর্তে অদিত্যর মস্তিষ্ক ধীরে ধীরে ভেঙে পড়ছিল, আর তার ভেতরের চিন্তা, স্মৃতি, স্বপ্ন—সবকিছু এক অদ্ভুত তরঙ্গের সঙ্গে মিলিত হয়ে নতুন জগৎ তৈরি করছে। সে অনুভব করল, আত্মার ভেতরের স্তরগুলো খুলে যাচ্ছে, এবং তার নিজের সত্তার একটি অংশ বইয়ের শক্তির সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। আতঙ্ক এবং বিস্ময়, আনন্দ এবং ভয়—সবকিছু একসাথে মিলেমিশে এক অভূতপূর্ব অনুভূতি তৈরি করছে। ছায়ামূর্তির দৃষ্টি তাকে শিখাচ্ছে, এই জগৎকে শুধুমাত্র দেখা নয়, অনুভব করাও সম্ভব, এবং অনুভব করার সঙ্গে সঙ্গে সে নিজেও বইয়ের শক্তির অংশ হয়ে যাচ্ছে। প্রতিটি পদক্ষেপে, প্রতিটি দৃষ্টি, প্রতিটি শ্বাস—সবকিছু এক অদ্ভুত সমন্বয়ে মিলে যাচ্ছে। অদিত্য বুঝতে পারল, একবার অতলের ভেতরে প্রবেশ করলে আর ফিরে আসা সম্ভব নয়; সে ধীরে ধীরে বইয়ের শক্তির সঙ্গে মিলিত হচ্ছে, এবং তার মনের ভেতরের প্রতিটি কোণা নতুন মাত্রা পাচ্ছে—একটি জগৎ, যা শুধুমাত্র অভিজ্ঞতার মাধ্যমে বোঝা যায়, যা চোখে দেখা যায় না, যা নিয়ম আর বাস্তবতার বাইরে।

গ্রন্থাগারের অন্ধকার আরও গভীর হয়ে গেছে, আর অদিত্যর নিঃশব্দতা যেন চারপাশের স্থায়ী নিস্তব্ধতায় মিশে গেছে। সে অতলের ভেতরে আটকে, তার নিজের শরীর খালি, কিন্তু আত্মা ভেসে বেড়াচ্ছে এক অচেনা জগতে, যেখানে রঙ, শব্দ এবং ছায়া তার মনকে জর্জরিত করছে। ঠিক সেই সময়, তার বন্ধু সৌমিক, যিনি অদিত্যর দীর্ঘ অনুপস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন, সন্ধান করতে করতে গ্রন্থাগারে প্রবেশ করল। গ্রন্থাগারের ভেতরের বাতাসে মৃদু শীতল কম্পন, বইপত্রের হালকা নড়াচড়া—সবকিছু তাকে সতর্ক করছিল। সে দেখল, অদিত্যর চেয়ারে বসা শরীর নিস্ক্রিয়, চোখ বন্ধ, কিন্তু সে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। সৌমিক মুহূর্তে বুঝতে পারল, এটি শুধুমাত্র শারীরিক অসুস্থতা নয়; অদিত্যর আত্মা এক অদ্ভুত জগতে আটকে গেছে, এবং এটি একটি অতিপ্রাকৃতিক শক্তি—‘অতল তন্ত্র’-এর ফল। বইটি হাতের কাছে পেয়ে সে অনুভব করল, এ বইয়ে লুকানো শক্তি এতটা তীব্র যে, এটি শুধু অদিত্যর আত্মাকে নয়, যে কেউ বইয়ের স্পর্শ করবে, তাকে অবলীলায় প্রভাবিত করতে পারে।

সৌমিক জানত একমাত্র উপায়—গ্রন্থটিকে ধ্বংস করা। সে ধীরে ধীরে বইটি ধরল, কিন্তু মুহূর্তের মধ্যেই বইয়ের শক্তি তার দৃষ্টি, মন এবং স্পর্শের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে গিয়েছিল। বাতাসে অদ্ভুত কম্পন, হঠাৎ আলো ঝলমল, আর ছায়াপথের অর্ধ-মানবীয়, অর্ধ-অদৃশ্য প্রতিচ্ছবি উদ্ভাসিত হলো। সৌমিক মনে মনে প্রার্থনা করল, যেন বইয়ের শক্তি তাকে ভয় দেখায় না। সে ধীরে ধীরে বইটি আগুনের দিকে নিয়ে গেল, আর সেই সময় গ্রন্থাগারের প্রতিটি কোণা যেন জীবন্ত হয়ে উঠল—বাতাস নড়াচড়া করতে শুরু করল, বইপত্র উড়ে গেল, মোমবাতি ঝলমল করল, আর অদ্ভুত গন্ধে ভরপুর বাতাসে অদৃশ্য শক্তি জাগ্রত হলো। সৌমিক বুঝতে পারল, এটি সহজ কাজ নয়; বই নিজেই বাঁচার চেষ্টা করছে, তার ভেতরের শক্তি দিয়ে তাকে থামানোর চেষ্টা করছে। সে নিজের ভয়কে চাপা দিয়ে বইটি আগুনে ছুঁড়ে দিল, এবং ধীরে ধীরে বইয়ের পাতা আগুনে জ্বলে উঠল, অদ্ভুত শব্দে শীর্ণ হয়ে যায়।

আগুন বইয়ের প্রতিটি পাতার সঙ্গে লড়ছে, আর অদিত্যর আত্মা ধীরে ধীরে অতলের ভেতর থেকে বের হয়ে আসতে শুরু করল। প্রথমে এটি অস্পষ্ট, ঝাপসা, কিন্তু ক্রমশ স্থির হয়ে আসে। অদিত্য চোখ খুলল, শরীরের চারপাশের বাস্তবতা পুনরায় স্পষ্ট হলো। সৌমিক তাকে ধরে রাখল, বোঝাল, সব ঠিক আছে—অদিত্য ফিরে এসেছে। বইয়ের আগুনে ঝলসে যাওয়া ধোঁয়া গ্রন্থাগারের কোণায় ভেসে গেল, আর সেই সঙ্গে ভয়ঙ্কর শক্তির উপস্থিতিও কমে গেল। অদিত্য ধীরে ধীরে বুঝতে পারল, একমাত্র সাহসী ও ত্যাগী বন্ধু, যিনি গ্রন্থটির ধ্বংসের পথে এগিয়েছে, তার জীবন এবং আত্মাকে রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু তার ভেতরে এখনও এক অদ্ভুত ছায়া থেকে গেছে—যে শক্তি তাকে অতলের ভেতরে নিয়ে গিয়েছিল, যা তাকে ছিন্ন আত্মার মতো কেঁপে উঠতে বাধ্য করেছিল। সে বুঝতে পারল, ক্ষমতা লোভ এবং কৌতূহল কতটা বিপজ্জনক হতে পারে। সেই রাতের অভিজ্ঞতা তাকে চিরকাল স্মরণ করিয়ে দেবে, যে কোনো অজানা শক্তি কেবলই ক্ষমতার স্বাদ দিতে পারে না, বরং ছিন্ন আত্মা, অন্ধকার এবং অদৃশ্য বিপদের সঙ্গে মিলিত হতে পারে।

গ্রন্থাগারের বাতাসে আগুনের গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে, আর অদিত্য এবং সৌমিক দুজনেই চরম উত্তেজনা এবং ভয়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে। তারা ভেবেছিল, বই আগুনে ঝলসে গেলে সবকিছু শেষ হয়ে যাবে, কিন্তু আগুনের মধ্যে কিছু অদ্ভুত ঘটে যাচ্ছে। বইয়ের পাতা ঝলসে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে, আগুনের শিখা যেন অদৃশ্য শক্তির প্রবাহের সঙ্গে মিলিত হয়ে একাধিক ছায়ামূর্তি বের করতে শুরু করেছে। প্রথমে একেকটি ছায়া অর্ধ-মানবীয়, অর্ধ-অদৃশ্য আকৃতিতে, এবং ধীরে ধীরে সংখ্যায় বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাদের চোখে অগ্নি ঝলমল করছে, কিন্তু তা কোনও সাধারণ আলো নয়—প্রতিটি শিখা যেন তাদের ভেতরের ভয়, লোভ এবং আগ্রহকে খুঁজে বের করছে। অদিত্যর হৃদয় দ্রুত বেগে ধুকছে, সে বুঝতে পারছে, এই ছায়ামূর্তিগুলি শুধুই প্রতিফলন নয়; তারা জীবন্ত শক্তি, যা অতল তন্ত্রের ভেতরে বন্দী, এবং তাদের উদ্দেশ্য একটাই—পাঠককে চিরকাল ধরে রাখা। সৌমিকও চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে, তার হাতে বই, চোখে হতাশা এবং ভয়। সে উপলব্ধি করছে, একমাত্র সাহসী পদক্ষেপই তাদের জীবন রক্ষা করতে পারে।

ছায়ামূর্তিগুলি আগুনের শিখার মধ্যে থেকে বেরিয়ে আসছে, ধীরে ধীরে গ্রন্থাগারের প্রতিটি কোণায় ছড়িয়ে পড়ছে। বাতাস নড়াচড়া করছে, বইপত্র উড়ে যাচ্ছে, আর মোমবাতির আলো যেন ঝলমল করে প্রতিটি ছায়ার রূপ প্রকাশ করছে। সৌমিক উপলব্ধি করছে, এই ছায়া কেবল অদিত্যকে নয়, নিজের জীবনকেও আঘাত করতে পারে। প্রতিটি মুহূর্তে তাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে—অদিত্যকে মুক্ত করার জন্য সে নিজেকে বলি দেবে, নাকি বন্ধু হারানোর ভয়কে মান্য করে পিছু হটবে। ভয়, দ্বিধা, এবং বন্ধুত্বের দায়বদ্ধতার মধ্যে সে এক অদ্ভুত মানসিক দ্বন্দ্বে ভুগছে। মনে হচ্ছে, সময়ও স্থির হয়েছে, প্রতিটি শ্বাস যেন মুহূর্তের মধ্যে স্থির। সৌমিকের মনে উঠেছে, বন্ধুত্ব এবং আত্মত্যাগের প্রকৃত পরীক্ষা এখনই—যদি সে না পারে সাহসী সিদ্ধান্ত নিতে, অদিত্য চিরকাল অতলের শক্তির বন্দী হয়ে যাবে, আর সে নিজেও রক্ষা পাবে না।

সৌমিক চুপচাপ বুক ভরে নিঃশ্বাস নিল, আর সিদ্ধান্ত নিল। সে নিজের শরীরের সমস্ত শক্তি, সাহস এবং মনোবল একত্রিত করে বইয়ের দিকে এগিয়ে গেল। প্রতিটি শিখা, প্রতিটি ছায়ামূর্তি তাকে থামানোর চেষ্টা করল, কিন্তু সে পিছপা হল না। এক মুহূর্তে, সে নিজের শরীরকে বলি দিতে প্রস্তুত—অদিত্যকে মুক্ত করার জন্য। সে বইয়ের ওপর হাত রাখল, আর নিজের জীবনের ওপর আস্থা রেখে এক চূড়ান্ত উচ্চারণ করল। আগুনের শিখা, ছায়ামূর্তিরা, এবং বইয়ের শক্তি—all মিলিত হয়ে এক বিশাল কম্পন সৃষ্টি করল, কিন্তু সৌমিকের সাহস ও আত্মত্যাগের কারণে অদিত্যর আত্মা ধীরে ধীরে অতলের জগৎ থেকে মুক্তি পেতে শুরু করল। অদিত্য চোখ খুলল, সে বুঝল, বন্ধু নিজের জীবনকে বিপন্ন করে তাকে বাঁচাচ্ছে। আগুনের মধ্যে থেকে বইটি ধীরে ধীরে ছাই হয়ে গেল, ছায়ামূর্তিগুলি অদৃশ্য হয়ে গেল, এবং গ্রন্থাগার পুনরায় শান্ত হয়ে গেল। সেই রাতের অভিজ্ঞতা অদিত্য ও সৌমিকের জীবনে চিরকাল স্মৃতিপ্রায় হয়ে থাকবে—একটি বন্ধুত্বের পরীক্ষা, সাহস এবং আত্মত্যাগের গল্প, যা শিখিয়েছে, প্রকৃত শক্তি কখনো লোভের জন্য নয়, বরং সঠিক কাজের জন্য ব্যবহৃত হয়।

১০

গ্রন্থাগারের অন্ধকার স্থির, কিন্তু অদিত্যর ভেতরের জগৎ ক্রমশ স্থির হচ্ছে না। সৌমিকের সাহসী আত্মত্যাগের মুহূর্তগুলো তার চোখের সামনে ভেসে উঠছে—কীভাবে সে নিজের প্রাণকে বলি দিয়ে বইয়ের অতল শক্তির শিকল ভাঙল, এবং তাকে অতলের জগৎ থেকে মুক্ত করল। অদিত্য ধীরে ধীরে চোখ খুলল, আর বাস্তবতার আলো তার চারপাশে ছড়িয়ে পড়ল। বাতাসের ঘ্রাণ, বইপত্রের নড়াচড়া, মোমবাতির আলো—সবকিছু আবারও স্থির এবং নিঃশব্দ। সে বুঝতে পারল, সে ফিরে এসেছে, কিন্তু তার ভেতরের অনুভূতি এখন আর আগের মতো নয়। অতলের গভীর অন্ধকারের সঙ্গে তার সংযোগের ছাপ এতটাই গভীর যে, চোখের পলক ফেললেই সেই অচেনা জগতের ঝলক তার মনে ভেসে ওঠে। মনে হচ্ছে, যদিও সে মুক্ত, তার মনের ভেতর অতলের শক্তির আবেশ এখনও বয়ে চলেছে।

গ্রন্থাগারের অন্ধকার কোণে, যেখানে ‘অতল তন্ত্র’ শেকড়ে বসে আছে, বইটি ধীরে ধীরে আবারও ধুলোয় ঢাকা অবস্থায় ফিরে গেছে। অদিত্য জানে, এই বই শুধুমাত্র তার জন্য নয়—পরের পাঠক, পরবর্তী কৌতূহলী হৃদয়, যে সাহসী হবে এবং গভীরভাবে পড়বে, সে এই শক্তির আবেশ অনুভব করবে। সৌমিকের আত্মত্যাগ, বন্ধুত্ব, এবং সাহস অদিত্যর কাছে এক জীবন্ত শিক্ষা হয়ে গেছে—যে শক্তি যদি অসাবধানভাবে ব্যবহার করা হয়, তবে তা আত্মা ভেঙে দিতে পারে, জীবন ছিন্ন করতে পারে। অদিত্য বুঝতে পারল, প্রকৃত শক্তি কখনোই জয়ী হয় না শুধু জ্ঞান বা ক্ষমতার জন্য; এটি আত্মত্যাগ, সতর্কতা এবং সঠিক মনোভাবের সঙ্গে মিলিত হলে জীবনের অর্থ পায়। কিন্তু সাথে থাকল এক অদ্ভুত শিহরণ—যে বই আবারও অন্ধকারে অপেক্ষা করছে, তার নতুন পাঠকের জন্য।

অদিত্য ধীরে ধীরে গ্রন্থাগারের মধ্য দিয়ে বেরিয়ে আসে, কিন্তু তার চোখে অতলের ছায়া এখনো দৃঢ়ভাবে লেগে আছে। সে বুঝতে পারল, যে অভিজ্ঞতা তার জীবনকে চিরতরে বদলে দিয়েছে। বন্ধুর আত্মত্যাগ তাকে শিখিয়েছে যে, শক্তি কখনোই ব্যক্তিগত লোভ বা কৌতূহলের জন্য ব্যবহার করা উচিত নয়; বরং বন্ধুত্ব, সতর্কতা এবং মানবিক মূল্যবোধের সঙ্গে সংযুক্ত হলে তা জীবনের পথপ্রদর্শক হতে পারে। গ্রন্থাগারের অন্ধকার কোণে বইটি নিঃশব্দে অপেক্ষা করছে—পরের কৌতূহলী পাঠকের জন্য, যা নতুন শক্তির আবির্ভাব ঘটাবে। অদিত্য জানে, সে ফিরে এসেছে বাস্তবের মধ্যে, কিন্তু অন্তরের অতল অন্ধকার কখনো পুরোপুরি মুছে যায় না; এটি একটি স্মৃতি, একটি শিখন, এবং একই সঙ্গে এক অদৃশ্য বার্তা—শক্তি কখনোই সম্পূর্ণ মুক্ত নয়, বরং এটি সবসময় কিছু না কিছু আবেশ রেখে যায়। সে ধীরে ধীরে সরু করিডর পার হয়, মৃদু বাতাস তার মুখে লাগে, আর মনে হয়, অতল এখনও তার সঙ্গে আছে—নিঃশব্দে, অদৃশ্য, কিন্তু চিরন্তনভাবে।

শেষ

 

1000068675.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *