Bangla - ভূতের গল্প

জমিদারের ভোগঘর

Spread the love

শ্রেয়া বসু


প্রথম পর্ব

গ্রীষ্মের দুপুরে দক্ষিণবঙ্গের এক অখ্যাত গ্রাম—নাম কুড়ুলিয়া। এখানে আসলে যেন সময় থেমে আছে। মাটির পথ, দুই ধারে শাল, সেগুন, আমগাছের সারি, আর একেবারে প্রান্তে গিয়ে হঠাৎ ভেসে ওঠে বিরাট এক ধ্বংসস্তূপের মতো ইমারত—কুড়ুলিয়া জমিদারবাড়ি। একসময় এখানে ছিলো উৎসব, মহাফেজখানা, পূজোর জাঁকজমক, বেহালার সুর। এখন শুধু ভাঙা দেওয়ালের ফাঁক দিয়ে জন্মানো লতাগুল্ম, আর মাঝে মাঝে রাতের বেলা শেয়ালের ডাক।

লোকজন বলে, জমিদারের ভোগঘরটা বহু বছর ধরে বন্ধ। ভোগঘর মানে দেবদেবীর নৈবেদ্য রাখার জায়গা নয়, এখানে তার আলাদা মানে। বলা হয়, জমিদারের ভোগঘরে রাজপ্রাসাদের গোপন আনন্দ-আয়োজন হত। দাসী, নর্তকী, সঙ্গীত, মদ আর রাতভর ভোগ। কিন্তু সেই ভোগঘরের ভিতরেই ঘটেছিলো রক্তাক্ত এক ঘটনা—যেটা আজও কাউকে সেখানে ঢুকতে দেয় না।

রুদ্রনীল দত্ত, কলকাতার এক তরুণ গবেষক, লোককথা আর লোকসংস্কৃতির ছাত্র। থিসিসের জন্য সে বেছে নিয়েছে ‘বাংলার জমিদার সংস্কৃতির লুপ্ত দিক’। তাই কুড়ুলিয়া গ্রামের নাম শুনেই তার কৌতূহল বেড়ে ওঠে। ট্রেন থেকে নামার পর, রিকশাওয়ালা পর্যন্ত তাকে বারবার সাবধান করে দিয়েছিলো—

—“ওই ভোগঘরে যাবেন না বাবু, সন্ধ্যা নামার আগেই কাজ শেষ করে বেরিয়ে পড়বেন।”

রুদ্র হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলো। ভূতের গল্পে সে বিশ্বাস করে না। তার কাছে এগুলো শুধু লোককথা, যা সমাজতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা দাবি করে।

সেদিন দুপুরে গ্রামের এক বৃদ্ধ তাকে নিয়ে যায় জমিদারবাড়ির ফটকের কাছে। ভাঙা সিংহদুয়ার, উপরের নকশা প্রায় মুছে গেছে। বাঁদিকে মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ, ডানদিকে শুকনো পুকুর, যার ধারে এখন শুধু ঝোপঝাড়। ভেতরে ঢুকতেই রুদ্রর মনে হলো, হাওয়ার মধ্যে যেন অদ্ভুত একটা গন্ধ—পুরোনো কাঠ, ধুলো, আর কোথাও একটা স্যাঁতস্যাঁতে আর্দ্রতা।

বৃদ্ধ বলল—
—“ওই যে সামনের দিকটা দেখছেন, যেটার জানলা-দরজা সব কড়া মারা… ওটাই ভোগঘর। দিনের বেলা গেলেও খারাপ কিছু হয় না, কিন্তু রাত্রে সেখানে কারো থাকার সাহস নেই। শুনেছি ভেতর থেকে শঙ্খ বাজে, আবার মেয়েদের কান্নার আওয়াজ ভেসে আসে।”

রুদ্র নোটবই বের করে লিখে নেয় কথাগুলো। তারপর সে বাড়ির বাইরে ঘোরে, ছবি তোলে, দেয়ালের অলংকরণ খুঁটিয়ে দেখে। বিকেলের দিকে একসময় দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকে। ভোগঘরের দরজা বিশাল কাঠের, মরচে ধরা তালা ঝোলানো। হাত দিয়ে ছোঁয়া মাত্রই রুদ্রর মনে হলো তালাটা অদ্ভুত ঠাণ্ডা। যেন ধাতুর মধ্যে জমে আছে ক’শো বছরের অজানা স্মৃতি।

হঠাৎই কোথা থেকে একটা ঝোড়ো হাওয়া বইলো, আর তার সঙ্গে দরজার ফাঁক দিয়ে আসলো কেমন যেন এক শিস ধ্বনি। যেন ভেতরে কেউ ফিসফিস করছে। রুদ্রর শরীর কেঁপে উঠলো, কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিলো। যুক্তি দিয়ে ভয় কাটানোই তার অভ্যাস।

সন্ধ্যা নামার আগে সে গ্রামে ফিরে এলো। মাটির বাড়ি, গাছতলায় বসা লোক, আর দাওয়ায় দাওয়ায় আলো জ্বলা—সবকিছু শান্ত। কিন্তু রাতের খাবারের সময় রুদ্র লক্ষ্য করলো, গ্রামের মানুষজন এ বিষয়টা নিয়ে কথা বলতে চায় না। ভোগঘরের প্রসঙ্গ উঠলেই মুখ গম্ভীর হয়ে যায়, কেউ কেউ কাশি দিয়ে প্রসঙ্গ ঘোরায়।

রুদ্র ভাবলো, নিশ্চয়ই এখানে ইতিহাসের সঙ্গে মিলেমিশে আছে লোকভয়। সে স্থির করলো—কাল সকালে সে ভোগঘরের ভেতরে ঢুকবেই।

কিন্তু রাত যত গভীর হতে লাগলো, ততই সে নিজের ঘরে শুয়ে অদ্ভুত এক অনুভূতিতে কুঁকড়ে গেলো। বাইরে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাকের ফাঁকে ফাঁকে যেন দূর থেকে শোনা যাচ্ছে শঙ্খের টানা আওয়াজ।

দ্বিতীয় পর্ব

রুদ্রনীল রাতের সেই অদ্ভুত শঙ্খধ্বনিকে অবজ্ঞা করতে চাইলেও ঘুম ভাঙা ভাঙা কাটলো। ভোরে উঠে বাইরে বেরোতেই চারদিকে নরম কুয়াশা, ভিজে মাটির গন্ধ আর নির্জনতার মধ্যে যেন চেপে থাকা এক শূন্যতা। গ্রামের মানুষজন ধীরে ধীরে জেগে উঠছে, কেউ গরুকে খড় দিচ্ছে, কেউ কুয়ো থেকে জল তুলছে। অথচ কারও চোখে উৎসাহ নেই, সবাই যেন এক অদৃশ্য ভয়ের আবরণে ঢাকা।

চা খেতে খেতে রুদ্র গ্রাম্য এক প্রৌঢ়াকে জিজ্ঞেস করলো—
—“মা, ভোগঘরের ইতিহাসটা জানেন?”

বৃদ্ধা শিউরে উঠলেন। তারপর ধীরে ধীরে বললেন—
—“শোনো বাবু, ওই ভোগঘরে জমিদারের বোন মাধবীলতা কবে যেন নিখোঁজ হয়েছিলো। অনেকে বলে তাকে সেখানে জীবন্ত কবর দেওয়া হয়েছিলো। সেই থেকে ভোগঘর কারও পা সহ্য করে না। যারা গিয়েছিলো, ফেরেনি।”

রুদ্র একবার নোটবইয়ে লেখে রাখলো। তারপর হঠাৎ ভাবলো, লোকজন এত ভয় পাচ্ছে মানে, এর পেছনে নিশ্চয়ই কোনো সামাজিক ইতিহাস আছে—সম্ভবত নারীর উপর নির্যাতন, অথবা ক্ষমতার লালসা।

দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে না হতেই রুদ্র একাই বেরিয়ে পড়লো জমিদারবাড়ির দিকে। সূর্য নামতে শুরু করেছে, গাছপালার ছায়া লম্বা হচ্ছে। বাড়ির ভাঙা ফটক পেরিয়ে ভেতরে ঢুকতেই আবার সেই স্যাঁতস্যাঁতে বাতাস তার শরীর জড়িয়ে ধরলো।

আজ সে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। দরজার তালাটা খুলতে হবে। কাছাকাছি লোহার তালাচাবির দোকান থেকে আগেই নিয়ে এসেছে ভারী এক চাবির গোছা। অনেক চেষ্টা করার পর, মরচে ধরা তালা অবশেষে খুলে গেলো এক অদ্ভুত কড়কড় শব্দে।

ভোগঘরের দরজা ঠেলতেই ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো ঘন অন্ধকার আর ঠাণ্ডা বাতাস। রুদ্র টর্চ জ্বালিয়ে ভেতরে ঢুকলো। চারপাশে ছাইয়ের মতো ধুলো, ভাঙা আসবাবপত্র, দেওয়ালে প্রায় মুছে যাওয়া রঙিন ছবি। তবুও বোঝা যায়, একসময় এই ঘরে সঙ্গীত আর নাচ চলতো।

ঘরের এক কোণে একটা ভাঙা প্রতিমার অবশিষ্ট পড়ে আছে—দেবীর হাত আলাদা, কিন্তু চোখ দুটো যেন অদ্ভুতভাবে জ্বলজ্বল করছে। রুদ্র এগিয়ে গিয়ে দেখতে চাইলো। হঠাৎই মনে হলো, প্রতিমার চোখে জমে আছে জলের আস্তরণ।

সে হতভম্ব। আলো ফেলে বারবার দেখলো, সত্যিই চোখে জল যেন চিকচিক করছে।

হঠাৎ তার কানে ভেসে এলো মৃদু শঙ্খধ্বনি। প্রথমে মনে হলো বাইরে থেকে আসছে, কিন্তু শব্দটা ক্রমে ঘরের ভেতরেই ঘুরতে লাগলো। চারদিকে যেন অদৃশ্য স্রোতের মতো প্রতিধ্বনি।

রুদ্র বুক ধড়ফড় করতে লাগলো। ভয়কে সরিয়ে যুক্তি খুঁজতে চেষ্টা করলো—হয়তো কোনো বাতাসে খোলের ভেতর শব্দ তৈরি হচ্ছে। কিন্তু সে জানে, ভোগঘরের ভেতরে এমন কিছু নেই।

হঠাৎই দরজাটা নিজের থেকেই কটাকট শব্দে বন্ধ হয়ে গেলো। ভেতরটা আরও অন্ধকার হয়ে উঠলো। টর্চের আলো কাঁপতে লাগলো। রুদ্র দরজার দিকে ছুটে গেলো, কিন্তু দেখলো দরজা বাইরে থেকে বন্ধ হয়ে গেছে।

ঠিক সেই মুহূর্তে তার পায়ের নিচে কেমন যেন নরম কিছু চাপা পড়লো। আলো ফেলে দেখে অবাক হয়ে গেলো—পুরোনো একটা লাল শাড়ি মাটির ধুলোয় ঢাকা। শাড়িটা যেন অনেকটা সময় ধরে কেউ ব্যবহার করেনি, অথচ তাতে এখনও শুকনো রক্তের দাগ স্পষ্ট।

রুদ্রর বুকের ভেতর কেঁপে উঠলো অদ্ভুত এক শিহরণ। মনে হলো, যেন শাড়িটার সাথে এখনও জড়িয়ে আছে এক নারীর দীর্ঘশ্বাস।

চারপাশে আবার শোনা গেলো ফিসফিস কণ্ঠস্বর—
—“আমায় ছাড়ো… আমায় বাঁচাও…”

রুদ্র বুঝলো, ভোগঘরের অন্ধকারে সে আর একা নেই।

তৃতীয় পর্ব

রুদ্র দরজার পাশে দাঁড়িয়ে ঠাণ্ডা ঘামে ভিজে গেলো। সে জানে, ভেতর থেকে দরজাটা বন্ধ হওয়ার কোনো যুক্তি নেই, অথচ তালার কড়া বাইরে থেকে চাপা পড়েছে স্পষ্ট। টর্চের আলো বারবার ঝিমিয়ে আসছে, যেন অন্ধকারটাই আলোকে গিলে খেতে চাইছে।

মাটির উপর লাল শাড়িটার কোণা নড়ছে যেন হাওয়ার টানে। কিন্তু ভেতরে বাতাস চলাচলের কোনো উপায় নেই। শাড়ির ভাঁজ থেকে ধীরে ধীরে ভেসে এলো এক ধরনের গন্ধ—পচা ফুলের মতো, আবার কোথাও মাটির স্যাঁতস্যাঁতে গন্ধ।

রুদ্র কণ্ঠ শুকিয়ে গেলো। বুকের ভেতর ধুকপুক শব্দ বেড়ে চলেছে। সে টর্চটা প্রতিমার দিকে ফেললো। ভাঙা প্রতিমার মুখে আগের মতোই সেই জলের আভা, কিন্তু এবার স্পষ্ট মনে হলো প্রতিমার ঠোঁট নড়ছে।

একটা অস্পষ্ট নারীকণ্ঠ ভেসে এলো—
—“রক্ত… এখনো শুকোয়নি…”

রুদ্রর গা শিউরে উঠলো। সে চিৎকার করে উঠতে চাইলো, কিন্তু গলা দিয়ে কোনো শব্দ বের হলো না। শুধু মনের ভেতর শব্দ হচ্ছিলো—এটা ভ্রম, এটা আমার মানসিক প্রতিক্রিয়া, এর কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই।

কিন্তু প্রতিটি যুক্তিকে ছিঁড়ে ফেলছিলো ঘরের মধ্যে ভেসে আসা হাহাকার। কান পাতলেই শোনা যাচ্ছিলো মৃদু চিৎকার, নারীর কাঁদো সুর, শিকল টানার শব্দ।

হঠাৎ মেঝের একটা অংশ কাঁপলো। ধুলো উড়লো উপরে। রুদ্র হাঁটু গেড়ে নিচে আলো ফেললো। মেঝের ফাঁক দিয়ে মনে হলো রক্তে ভিজে থাকা আঙুল বেরিয়ে আসতে চাইছে। সে ভয়ে পেছনে সরে দাঁড়ালো।

দরজার বাইরে যেন কারও পায়ের শব্দ—কাঠের বারান্দায় ধীর ভারী পা ফেলার আওয়াজ। রুদ্র চিৎকার করে ডাকলো, কিন্তু বাইরে কোনো সাড়া নেই। শুধু শব্দটা ক্রমশ ঘুরে বেড়াচ্ছে দরজার চারপাশে।

ঠিক তখনই হাওয়ায় ভেসে এলো একটা শীতল কণ্ঠস্বর—
—“কে তুমি? কেন এলে আমার ঘরে?”

রুদ্র দিশেহারা। গলা শুকিয়ে কাঠ। সে কাঁপা কাঁপা গলায় বললো—
—“আমি… আমি গবেষক… আমি শুধু জানতে চাই…”

অন্ধকারের ভেতর থেকে প্রতিধ্বনির মতো উত্তর এলো—
—“গবেষণা? আমাদের কান্নায় কারো লেখা হয়নি কোনো ইতিহাস… আমাদের রক্তে লেখা হয়নি কোনো কাগজ…”

টর্চটা হঠাৎ নিভে গেলো। এখন শুধু সম্পূর্ণ অন্ধকার। আর অন্ধকারের ভিতর থেকে ভেসে আসছে শ্বাসের শব্দ—খুব কাছ থেকে। যেন কেউ তার মুখের সামনে দাঁড়িয়ে।

রুদ্র মরিয়া হয়ে দরজার দিকে হাতড়ে চাবি খুঁজতে লাগলো। তখনই পিঠে ঠাণ্ডা হাতের স্পর্শ। সে ঘুরে দাঁড়ালো, কিছুই নেই। কিন্তু ঘাড়ের কাছে শীতল নিশ্বাস অনুভব করলো স্পষ্ট।

এক ঝটকায় দরজাটা খুলে গেলো। বাইরে ঢল নামা অন্ধকার, আকাশে আধখানা চাঁদ। রুদ্র হোঁচট খেতে খেতে বাইরে বেরিয়ে এলো। তার হাতে এখনো লাল শাড়ির একটা ছেঁড়া অংশ আঁকড়ে ধরা, কবে যে সেটা তার হাতে লেগেছে, সে নিজেই জানে না।

গ্রামে ফিরে আসতেই সবাই অবাক দৃষ্টিতে তাকালো। কারও মুখে কথা নেই। শুধু এক বৃদ্ধা ফিসফিস করে বললেন—
—“ওই লাল কাপড়… ওইটা তো মাধবীলতার… যাকে ভোগঘরে কবর দিয়েছিলো…”

রুদ্র হিম হয়ে গেলো। তার হাতে ধরা শাড়ির টুকরোটা যেন কেঁপে উঠলো।

চতুর্থ পর্ব

রুদ্রর হাতে ধরা শাড়ির টুকরোটা যেন গ্রামের বাতাসকেও জমাট করে ফেললো। চারপাশে যারা দাঁড়িয়ে ছিলো, তারা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলো, কেউ এগিয়ে এসে টুকরোটা ছুঁতেও সাহস পেলো না। শুধু ফিসফিসানি ছড়িয়ে পড়লো—“মাধবীলতা… মাধবীলতার শাড়ি।”

রুদ্র বুঝলো, এখানে কোনো লোককথার গোঁড়ামি নয়—কিছু একটা সত্যিই ঘটেছিলো। তার গবেষকের কৌতূহল আরও বেড়ে গেলো। সে গ্রাম্যদের জিজ্ঞেস করতে লাগলো—
—“মাধবীলতা কে ছিলেন? কেন তার নাম উচ্চারণেই তোমাদের মুখ সাদা হয়ে যায়?”

এক বৃদ্ধ, যিনি আগে চুপ করে ছিলেন, ধীরে ধীরে এগিয়ে এলেন। গলায় কাঁপুনি, কিন্তু চোখে একরাশ দুঃখ।
—“তিনি জমিদারের একমাত্র বোন ছিলেন। রূপে, গুণে, কণ্ঠে তিনি ছিলেন অনন্যা। গ্রামে সকলেই তাঁকে দেবীর মতো মানতো। কিন্তু তাঁর ভাই—জমিদার হরিশঙ্কর—ছিলো দানব। লোভ, ভোগ, ক্ষমতা—এই তিনেই সে অন্ধ হয়ে গিয়েছিলো।”

রুদ্র মন দিয়ে শুনছিলো। বৃদ্ধ আরও বললেন—
—“শোনা যায়, এক কবির সঙ্গে মাধবীলতার প্রেম ছিলো। কবি এসে তাকে গান শোনাতেন, কবিতা লিখে দিতেন। জমিদার যখন এটা জানতে পারে, তখন রক্তচক্ষু হয়ে ওঠে। এক রাতে ভোগঘরের ভেতরে মাধবীলতাকে আটকে রেখে নির্মম শাস্তি দেয়। কেউ জানে না আসলে কী হয়েছিলো, তবে সকালে শুধু খবর বেরোয়—‘মাধবীলতা নেই’। কেউ আর তার দেহ খুঁজে পায়নি। শুধু ভোগঘরের মেঝেতে শুকনো রক্ত আর লাল শাড়ির ছেঁড়া অংশ পড়ে ছিলো।”

রুদ্রর বুকের ভেতর কেমন যেন হাহাকার জেগে উঠলো। সে চুপ করে শাড়ির টুকরোটার দিকে তাকিয়ে থাকলো। সত্যিই যদি মাধবীলতাকে জীবন্ত কবর দেওয়া হয়ে থাকে, তবে এই শাড়িই সেই শেষ সাক্ষ্য।

রাতে রুদ্রর ঘুম এলো না। ঘরে আলো নিভিয়েও সে বারবার লাল কাপড়টার দিকে তাকাচ্ছিলো। কাপড় থেকে হালকা গন্ধ বেরোচ্ছিলো—কখনও ফুলের, কখনও রক্তের। চোখ বন্ধ করলেই কানে বাজছিলো মৃদু কান্নার সুর।

একসময় সে স্বপ্ন আর বাস্তবের সীমারেখা হারিয়ে ফেললো। অর্ধনিদ্রায় হঠাৎ দেখলো, ঘরের কোণে দাঁড়িয়ে আছে এক নারী—মুখে অশ্রু, হাতে শঙ্খ। তিনি কিছু বলতে চাইছেন, ঠোঁট নড়ছে, কিন্তু কোনো শব্দ বেরোচ্ছে না। রুদ্র ঝটকা মেরে উঠে বসলো। ঘরে কেউ নেই।

ভোর হওয়ার আগেই সে সিদ্ধান্ত নিলো—মাধবীলতার সত্য ইতিহাস তাকে জানতে হবে। শুধু গুজব নয়, প্রমাণ খুঁজে বের করতে হবে।

পরদিন সকালে রুদ্র বেরিয়ে পড়লো জমিদারবাড়ির আঙিনায়। ভোগঘর এখনও তার চোখে অন্ধকার এক দানবের মতো দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু এবার সে সোজা গেলো বাড়ির পেছনের দিকে। সেখানে একটা জরাজীর্ণ লাইব্রেরি ছিলো, যেটা এখন ধ্বংসস্তূপে পরিণত। ধুলোয় ঢাকা কাঠের তাক, ছেঁড়া কাগজ, পোড়া বইয়ের স্তূপ।

অনেক খোঁজাখুঁজির পর, এক কোণে ভেজা কাঠের সিন্দুকের ভেতর থেকে সে খুঁজে পেলো একটা পুরোনো ডায়েরি। মলাটে লেখা—মাধবীলতা দেবী”

রুদ্রর চোখ জ্বলজ্বল করে উঠলো। কাগজগুলো আধা-খাওয়া, স্যাঁতস্যাঁতে, তবুও শব্দগুলো পড়া যাচ্ছে। সেখানে লেখা—

ভাই ক্রমশ অচেনা হয়ে উঠছে। ভোগঘরে রাত্রে যে ভোজন হয়, তা আসলে মাংস আর রক্তের উৎসব। আমি ভয় পাচ্ছি। কবি আজ এসেছিলো, বললো পালিয়ে যেতে। কিন্তু আমি জানি, আমার পলায়ন সম্ভব নয়। কেউ যদি কখনো এই ডায়েরি খুঁজে পায়, জেনে রেখো, আমি সত্যিই বেঁচে থাকতে চাই। আমার শঙ্খ বাজুক মুক্তির সুরে…”

রুদ্রর হাত কাঁপতে লাগলো। ডায়েরির পাতার শেষ লাইন হঠাৎ ফেটে গেছে, কালি মাখা। যেন লেখার সময়ই কেউ তা থামিয়ে দিয়েছে।

ঠিক সেই মুহূর্তে, লাইব্রেরির ভাঙা জানলা দিয়ে ভেসে এলো সেই পরিচিত শঙ্খধ্বনি। রুদ্রর বুক কেঁপে উঠলো। বাইরে কেউ নেই। শুধু ভোগঘরের দিকে তাকাতেই দেখা গেলো—বদ্ধ জানলার ফাঁক দিয়ে এক নারীর ছায়া দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে।

পঞ্চম পর্ব

লাইব্রেরির ধুলোভরা ঘরে দাঁড়িয়ে রুদ্রর হাত থেকে ডায়েরিটা প্রায় পড়ে যাচ্ছিলো। বাইরে থেকে আসা শঙ্খধ্বনি যেন তার বুকের ভেতরকে ফাঁকা করে দিলো। ভোগঘরের জানলার ফাঁকে দাঁড়িয়ে থাকা সেই নারীর ছায়া—রুদ্র স্পষ্ট দেখলো, লম্বা চুল, শাড়ি ঢাকা শরীর, কিন্তু মুখ যেন আবছা অন্ধকারে ঢাকা।

সে চোখের পলক ফেলতে না ফেলতেই ছায়াটা মিলিয়ে গেলো। রুদ্র দম নিতে ভুলে গেলো। তার যুক্তিবাদী মন বারবার বলছিলো—“এটা হ্যালুসিনেশন, হয়তো আলো-আঁধারের খেলা।” কিন্তু বুকের ভেতরের শিহরণ তাকে অন্য কিছু বোঝাচ্ছিলো।

ডায়েরিটা ব্যাগে রেখে সে বেরিয়ে এল জমিদারবাড়ির আঙিনা থেকে। গ্রামে ফিরে এলে লোকেরা তাকে কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞেস করলো কিছু পেলেন কি না। রুদ্র কাউকে কিছু বললো না, শুধু মাথা নেড়ে সরে গেলো।

সন্ধের দিকে সে বসলো নদীর ধারে। কুড়ুলিয়ার পাশ দিয়ে বইছে ছোট্ট এক নদী—বহরমতী। জলে ঢেউ খেলছে, আকাশে লাল আভা। রুদ্র ডায়েরির পাতাগুলো আবার পড়তে লাগলো। সেখানে মাধবীলতার ভয়, তার কবির প্রতি ভালোবাসা, আর ভাইয়ের নিষ্ঠুরতার ইঙ্গিতগুলো ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছিলো।

এক জায়গায় লেখা—
ভোগঘরের মেঝের নিচে কিছু চাপা পড়ছে বারবার। আমি শুনতে পাই রাতের বেলা কান্না আর পায়ের শব্দ। হয়তো আমাকেও একদিন সেখানে ফেলবে…”

রুদ্রর বুক কেঁপে উঠলো। মেঝের নিচে? তবে কি ভোগঘরের নীচেই মাধবীলতার সমাধি?

রাত নেমে এলো। গ্রামে তখনকার মতো নিস্তব্ধতা। কুয়াশার ভেতর দিয়ে লণ্ঠনের আলোয় লোকেরা তাড়াতাড়ি দরজা বন্ধ করছে। রুদ্রর থাকার ঘরে একটাই কেরোসিন বাতি। হঠাৎ বাতাসে সেটা কেঁপে উঠলো, শিখা দুললো।

ঠিক তখনই সে স্পষ্ট শুনলো—শঙ্খের সুর, এবার খুব কাছে, যেন ঘরের মধ্যেই বাজছে। কানের পর্দা ফেটে যাওয়ার মতো ভেসে এলো নারীকণ্ঠ—
—“আমায় মাটি থেকে তোল… আমায় মুক্তি দাও…”

রুদ্রর শরীর অবশ হয়ে গেলো। সে ঘামতে লাগলো প্রচণ্ডভাবে। কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়াতেই দেখলো, দরজার পাশে দাঁড়িয়ে আছে এক নারীর অবয়ব। সাদা আলোয় ভেসে থাকা শরীর, ভেজা চুল, হাতে রক্তমাখা শঙ্খ। মুখে যন্ত্রণার রেখা, চোখে অনন্ত হাহাকার।

রুদ্র চিৎকার করে উঠলো, কিন্তু কণ্ঠ বেরোল না। অবয়বটা ধীরে ধীরে তার দিকে এগোতে লাগলো। বাতাস জমাট, ঘরের মধ্যে পচা ফুলের গন্ধ।

হঠাৎ জানলা দিয়ে ঝোড়ো হাওয়া ঢুকে আলো নিভিয়ে দিলো। চারপাশে অন্ধকার নেমে এলো। অন্ধকারের ভেতর শুধু একটা সুর বাজতে থাকলো—
শঙ্খ বাজাও মুক্তির জন্য… শঙ্খ বাজাও…”

রুদ্র দিশেহারা হয়ে ছটফট করতে লাগলো। হাতড়ে সে নিজের ব্যাগ থেকে লাল শাড়ির টুকরোটা বের করলো। ঠিক তখনই অন্ধকার কেঁপে উঠলো। যেন সেই কাপড়ের মধ্যে বন্দি আত্মা শ্বাস নিচ্ছে।

নারীকণ্ঠ আবার ভেসে এলো—
—“আমায় ফিরিয়ে দাও… মেঝের নিচে… আমি এখনও বন্দি…”

রুদ্রর মাথা ঘুরতে লাগলো। তার যুক্তি, বিজ্ঞান, সমস্ত বিশ্বাস ভেঙে পড়ছিলো। এখন সে শুধু জানে, ভোগঘরের মেঝের নিচে কিছু আছে, আর সেই কিছুই মাধবীলতার সত্য ইতিহাস উন্মোচন করবে।

রাতের শেষ প্রহরে, ভোর হওয়ার আগেই রুদ্র সিদ্ধান্ত নিলো—সে আবার ভোগঘরে যাবে। এবার শাড়ি আর ডায়েরি সঙ্গে নিয়ে।

বাইরে তখন কাক ডাকছে, আকাশে হালকা আলো ফুটছে। কিন্তু জমিদারবাড়ির দিকে তাকাতেই রুদ্রর মনে হলো, জানলার ফাঁকে দাঁড়িয়ে কেউ তাকে দেখছে—নীরবে, অশ্রুভরা চোখে।

ষষ্ঠ পর্ব

রুদ্রর চোখ লাল হয়ে আছে রাতভর আতঙ্ক আর নির্ঘুমতায়। তবু ভোরের আলো উঠতেই সে যেন নতুন দৃঢ়তা পেলো। শাড়ির টুকরো আর মাধবীলতার ডায়েরি ব্যাগে ভরে সে আবার পা বাড়ালো জমিদারবাড়ির দিকে। গ্রাম তখনও ঘুমজড়ানো, কুয়াশার চাদরে ঢাকা। গলি দিয়ে হেঁটে যাবার সময় কয়েকজন তাকে থামানোর চেষ্টা করলো।

—“বাবু, ওখানে আবার যাচ্ছেন? আরেকবার গেলে ফিরতে পারবেন না।”
রুদ্র শুধু মৃদু হেসে বললো,
—“আমি যদি না যাই, তবে সত্যি লুকোনোই থেকে যাবে।”

বাড়ির ফটক পেরিয়ে সে যখন ভোগঘরের সামনে দাঁড়ালো, তখন মনে হলো যেন পুরো ইমারতটা নিশ্বাস নিচ্ছে—ভারী, শীতল, দীর্ঘশ্বাসভরা নিশ্বাস। দরজার তালা আগের রাতে সে ভাঙা রেখেছিলো, তাই এবার তেমন কষ্ট হলো না।

ভেতরে ঢুকতেই ঘন অন্ধকার। টর্চ জ্বালাতেই দেওয়ালে ঝোলানো ভাঙাচোরা ছবি চোখে পড়লো—পুরুষদের ভোজন, নর্তকীদের নাচ। চারপাশে ধুলো জমে পুরু আস্তরণ। কিন্তু রুদ্রর মন এখন একটাই দিকে: মেঝের নিচে।

সে পকেট থেকে ছোট্ট খুন্তি আর হাতুড়ি বের করলো। মেঝের কোণায় চাপড় দিতে না দিতেই টুং শব্দ হলো—পাথরের তলায় ফাঁপা জায়গা। হৃদস্পন্দন বেড়ে গেলো। যত জোরে সে পাথর খুঁড়তে লাগলো, ততই ভেতর থেকে গুমগুম আওয়াজ উঠতে লাগলো। যেন ভেতরে বন্দি কিছু নড়ে উঠছে।

হঠাৎ শঙ্খের শব্দ ধ্বনিত হলো চারদিক থেকে। ঘরটা কেঁপে উঠলো, বাতাস ভারী হয়ে গেলো। ধুলো ঝরে পড়লো ছাদ থেকে। রুদ্রর হাতে থাকা টর্চ কাঁপতে লাগলো।

অবশেষে একটা পাথরের সlab খুলে গেলো। নিচে অন্ধকার ফাঁকা জায়গা। আলো ফেলতেই রুদ্রর গা শিউরে উঠলো—মাটির মধ্যে আধভাঙা কঙ্কাল পড়ে আছে। কঙ্কালের গলায় লাল শাড়ির ছেঁড়া অংশ, আর হাতের কাছে একটি শঙ্খ।

রুদ্রর শরীর জমে গেলো। এটা মাধবীলতার দেহ ছাড়া আর কিছু হতে পারে না। সে নিচু হয়ে শঙ্খটা হাতে তুললো। মুহূর্তেই কানে বাজলো নারীকণ্ঠ—
—“তুমি আমার কথা শুনেছো… আমাকে মাটি থেকে তুলেছো…”

আলো ঝলকে উঠলো ঘরজুড়ে। সামনে দাঁড়িয়ে আছে সেই নারী—দীর্ঘ কেশ, লাল শাড়ি, চোখে জলের রেখা। তিনি শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন রুদ্রর দিকে। মুখে মৃদু হাসি, কিন্তু তার ভেতরে হাহাকার লুকোনো।

রুদ্র কাঁপা গলায় বললো,
—“আপনি মাধবীলতা দেবী?”

নারী মাথা নেড়ে ধীরে ধীরে বললেন,
—“আমি বহু বছর ধরে বন্দি। ভাইয়ের পাপে আমি মাটি চাপা পড়েছি। কিন্তু আমার শঙ্খ বাজেনি মুক্তির সুরে… তুমি কি তা বাজাবে?”

রুদ্রর হাত কাঁপছিলো, কিন্তু শঙ্খ ঠোঁটে নিয়ে ফুঁ দিলো। শঙ্খ থেকে যে সুর বেরোল, তা ভোগঘরের দেওয়াল কাঁপিয়ে বাইরে ছড়িয়ে পড়লো। মুহূর্তেই যেন ঘরের প্রতিটি কোণ থেকে আলো বেরিয়ে এলো। প্রতিমার চোখে জমা জল গড়িয়ে পড়লো ধুলোর মেঝেতে।

মাধবীলতার অবয়ব ধীরে ধীরে আলোর ভেতর মিলিয়ে যেতে লাগলো। তার শেষ কণ্ঠস্বর ভেসে এলো—
—“তুমি আমার মুক্তি দিয়েছো… কিন্তু সাবধান, এই ঘর শুধু আমার নয়… আরও অনেকে বন্দি…”

অন্ধকার আবার নামলো, বাতাস নিস্তব্ধ হয়ে গেলো। রুদ্র একা দাঁড়িয়ে রইলো, হাতে শুধু পুরোনো শঙ্খ। মেঝের কঙ্কালটা যেন শান্ত হয়ে গেছে।

কিন্তু হঠাৎ পিছনে থেকে ভেসে এলো নতুন আরেকটা কণ্ঠস্বর—কর্কশ, পুরুষালি।
—“কেন আমার শিকারকে ছাড়ালে? ভোগঘর কাউকে যেতে দেয় না।”

রুদ্র হঠাৎ ঘুরে দাঁড়ালো। দরজার পাশে দাঁড়িয়ে আছে এক কালো ছায়া, চোখ জ্বলছে আগুনের মতো।

সপ্তম পর্ব

রুদ্রর পা যেন মাটিতে গেঁথে গেছে। দরজার ধারে দাঁড়িয়ে থাকা সেই ছায়ামূর্তি ক্রমশ স্পষ্ট হতে লাগলো। উঁচু দেহ, কাঁধে রাজকীয় পাঞ্জাবির ছায়া, কপালে টিকলির মতো আলো—কিন্তু চোখ দুটো অগ্নিশিখার মতো জ্বলছে। মুখে শীতল হাসি, অথচ হাওয়ার মধ্যে কাঁপুনি ধরিয়ে দিচ্ছে।

—“আমি হরিশঙ্কর,” কর্কশ কণ্ঠে বললো ছায়ামূর্তি।
—“এই ভোগঘরের জমিদার। আমার ভোগে কেউ বাঁধা দিতে পারে না। মাধবীলতা ছিলো আমার লজ্জা, তাই তাকে মাটির নিচে শুইয়ে দিয়েছিলাম। আর তুমি… তুমি সাহস করলে তাকে মুক্তি দিতে!”

রুদ্রর গলা শুকিয়ে এলো। সে শঙ্খটা শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো।
—“তুমি তাকে অন্যায়ভাবে হত্যা করেছো। ওর আত্মা শান্তি পাবে, এই ভোগঘর তোমার অত্যাচার আর লালসার প্রমাণ।”

হরিশঙ্করের হাসি গর্জনের মতো প্রতিধ্বনিত হলো।
—“তুমি ভাবছো, এক শঙ্খের ধ্বনি আমার শতবর্ষের ভোগকে মুছে দিতে পারবে? না! এখানে শত শত আত্মা বন্দি আছে। দাসী, নর্তকী, কবি, বিদ্রোহী—সবাই আমার ভোগের অঙ্গ। তাদের কান্না আমার খোরাক। ভোগঘর আমার সাম্রাজ্য।”

বাতাসে হঠাৎ অসংখ্য ফিসফিসানি ভেসে উঠলো—নারীকণ্ঠ, পুরুষকণ্ঠ, শিশুকণ্ঠ। সারা ঘর কান্না আর হাহাকারে ভরে গেলো। রুদ্রর মাথা ঘুরতে লাগলো। মনে হলো, দেওয়ালগুলো রক্ত ঝরাচ্ছে।

হরিশঙ্কর ধীরে ধীরে এগিয়ে আসতে লাগলো। প্রতিটি পদক্ষেপে মেঝে কেঁপে উঠছে।
—“তুমি এখান থেকে বেরোতে পারবে না। তোমাকেও মাটির নিচে শুইয়ে দেবো। গবেষকের নাম হবে নতুন বন্দি।”

রুদ্র মরিয়া হয়ে শঙ্খ ঠোঁটে ধরলো আর ফুঁ দিলো। কিন্তু এবার কোনো সুর বের হলো না। শঙ্খ নিস্তব্ধ।

হরিশঙ্করের চোখে দাউ দাউ আগুন।
—“শঙ্খ শুধু মাধবীলতার ছিলো। তাকে মুক্তি দিয়ে তুমি সেটাকে নিস্তেজ করেছো। এখন তুমি আমার হাতে।”

রুদ্র পেছনে সরে গেলো, হাতড়ে খুঁজলো ডায়েরি আর লাল শাড়ির টুকরোটা। ঠিক তখনই ডায়েরির ভেতর থেকে একটা আলোর রেখা ছড়িয়ে পড়লো। পাতাগুলো যেন নিজে থেকেই উলটে গেলো। সেখানে অক্ষরগুলো ঝলমল করতে লাগলো—

যদি আমি মরে যাই, তবে যে আমার লেখা পড়বে, তার হাতে থাকবে আমার কণ্ঠ। সে-হবে আমার উত্তরাধিকার।”

হাওয়ায় কেঁপে উঠলো শঙ্খ। এবার সুর বের হলো, আগের চেয়ে তীব্রতর। রুদ্র বুঝলো, মাধবীলতার আত্মা তার ভেতর দিয়েই প্রতিরোধ করছে।

হরিশঙ্কর গর্জে উঠলো। তার শরীর বিকৃত হতে লাগলো, আগুনের মতো ছায়া ছড়িয়ে পড়লো চারদিকে। জানলা-দরজা নিজের থেকেই বন্ধ হয়ে গেলো। অন্ধকারে শুধু আলো ছড়াচ্ছে শঙ্খের সুর, আর রুদ্র দাঁড়িয়ে আছে সেই স্রোতের মধ্যে।

কান্না আর হাহাকার মিলেমিশে এক মহাবিস্ফোরণের মতো শব্দ তৈরি করলো। হরিশঙ্কর আর্তনাদ করে পেছনে সরে গেলো।
—“না… আমার ভোগঘর… আমার সাম্রাজ্য…”

তার শরীর ভেঙে ভেঙে ছায়ায় মিলিয়ে যেতে লাগলো। চারপাশে ধুলো ঝড়ে পড়লো, দেওয়ালের ভাঙা ছবি গুঁড়িয়ে গেলো।

শঙ্খের সুর থেমে যেতেই নিস্তব্ধতা নেমে এলো। কিন্তু সেই নিস্তব্ধতা শান্তির নয়, বরং অজানা অপেক্ষার।

রুদ্র হাঁপাতে হাঁপাতে দরজার দিকে এগোলো। বাইরে তখন ভোরের আলো ফুটেছে, আকাশে লাল আভা। সে জানে, মাধবীলতা মুক্তি পেয়েছে, কিন্তু হরিশঙ্করের গর্জন এখনও দেয়ালের ভেতর লেগে আছে।

ভোগঘরের সামনে দাঁড়িয়ে সে ভাবলো—এই যুদ্ধ কি শেষ হলো, নাকি শুরু হলো নতুন এক অধ্যায়?

অষ্টম পর্ব

ভোরের লাল আভায় ভোগঘরটা বাইরে থেকে আগের মতোই নিস্তব্ধ দাঁড়িয়ে আছে, যেন কিছুই ঘটেনি। অথচ ভেতরের অন্ধকারে রুদ্র যা দেখেছে, তা তার বুক কাঁপিয়ে দিচ্ছিলো বারবার। সে শঙ্খ আর ডায়েরিটা ব্যাগে রেখে গ্রামের দিকে ফিরলো।

গ্রামে পৌঁছাতেই কয়েকজন লোক তার দিকে দৌড়ে এলো।
—“বাবু, আপনি বেঁচে ফিরলেন!”
—“ভেতরে কী হলো?”

রুদ্র প্রথমে কিছু বলতে চাইলো না, কিন্তু গ্রামবাসীর আতঙ্কিত চোখ দেখে ধীরে ধীরে সব খুলে বললো। মাধবীলতার কঙ্কাল, শঙ্খ, হরিশঙ্করের ছায়া—সবকিছু। শুনে সবার মুখ পাথরের মতো শক্ত হয়ে গেলো।

এক বৃদ্ধা কেঁপে কেঁপে বললেন—
—“আমরা জানতাম, ওখানে অনেক আত্মা বন্দি। যদি হরিশঙ্কর সত্যিই আবার জেগে ওঠে, তবে এই গ্রাম ধ্বংস হবে।”

রুদ্র যুক্তির সুরে বললো—
—“ভয় পাবেন না। মাধবীলতা মুক্তি পেয়েছে। আর শঙ্খের শক্তিতে হরিশঙ্কর দুর্বল হয়ে পড়েছে।”

কিন্তু গ্রামের মানুষের মুখে ভরসা এলো না। তারা বললো—
—“ভোগঘর কাউকে ছাড়ে না বাবু। ওটা শুধু এক ভূতের ঠিকানা নয়, ওটা এক অভিশপ্ত স্থান। সেখানে আরও কত শত কান্না জমে আছে।”

রুদ্রর মন কাঁপলো। সত্যিই তো, হরিশঙ্কর বলেছিলো ভোগঘরে অসংখ্য আত্মা বন্দি। তবে কি মাধবীলতাকে মুক্তি দিলেও অন্যেরা এখনও আটকে আছে?

সেই রাতেই রুদ্র আবার স্বপ্ন দেখলো। সে শুয়ে আছে, আর ভোগঘরের দেওয়াল ভেঙে অসংখ্য মুখ বেরিয়ে আসছে। নারী-পুরুষ-শিশু—সবার চোখ ফাঁকা, ঠোঁট রক্তে ভিজে। তারা একসাথে চিৎকার করছে—
—“আমাদেরও মুক্তি দাও!”

রুদ্র ঘেমে উঠলো, দম নিতে পারলো না। বুঝলো, কাজ এখনো শেষ হয়নি।

পরদিন সে গ্রাম্য কয়েকজন তরুণকে সঙ্গে নিয়ে আবার ভোগঘরের ভেতরে ঢুকলো। সবাই হাতে প্রদীপ, মাটির তৈরি ধূপ। ঘরের ভেতর ঢুকতেই চারপাশে অদ্ভুত ঠাণ্ডা নেমে এলো।

রুদ্র মেঝের সেই ফাঁকা জায়গার চারপাশে প্রদীপ রাখলো। তারপর শঙ্খ বাজালো একটানা। সঙ্গে সঙ্গে চারপাশে অসংখ্য কণ্ঠস্বর ভেসে উঠলো। কান্না, হাহাকার, আর্তনাদে ঘর ভরে গেলো। গ্রামের তরুণরা ভয় পেয়ে পেছনে সরে গেলো, কিন্তু রুদ্র দাঁড়িয়ে রইলো দৃঢ়ভাবে।

ডায়েরির পাতায় লেখা শেষ লাইন মনে পড়লো—আমার কণ্ঠ যার হাতে যাবে, সে-হবে মুক্তির সেতু।”

রুদ্র গলা ছেড়ে বললো—
—“আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, আমি শুধু মাধবীলতার নয়, এখানে যারা বন্দি আছে, তাদেরও মুক্তি দেবো।”

হঠাৎ বাতাস কেঁপে উঠলো। ভোগঘরের দেওয়াল থেকে অসংখ্য ছায়া বেরিয়ে এলো—নারী নর্তকী, শিশু, বেহালাবাদক, কবি, দাস—সবাই। তাদের মুখে দীর্ঘশ্বাস, চোখে জল। তারা শঙ্খের সুরে ধীরে ধীরে মিলিয়ে যেতে লাগলো আকাশের আলোয়।

কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে হরিশঙ্করের গর্জন ভেসে এলো—
—“না! ভোগঘর আমারই থাকবে!”

ছায়াগুলো কেঁপে উঠলো, আলো নিভে যেতে লাগলো। গ্রাম্যরা আতঙ্কে বাইরে দৌড়ে পালালো। রুদ্র একা দাঁড়িয়ে শঙ্খ আঁকড়ে ধরে বারবার বাজাতে লাগলো। প্রতিবার সুর বেরোতেই হরিশঙ্করের ছায়া টালমাটাল হতে লাগলো।

শেষে এক প্রচণ্ড শব্দে পুরো ঘর কেঁপে উঠলো। মেঝে ফেটে গেলো, ধুলো উড়ে আকাশ ঢেকে দিলো। রুদ্র ছিটকে পড়লো দরজার বাইরে।

চোখ খুলে দেখে সে ভোগঘরের সামনে শুয়ে আছে। ঘরটা তখন আগুনে দাউ দাউ করছে। গ্রামবাসী ভয়ে দূরে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে। আগুনের ভেতর থেকে শোনা যাচ্ছে হরিশঙ্করের শেষ গর্জন—
—“ভোগঘর… আমার…”

তারপর সব নিস্তব্ধ। ভোগঘর ভস্মীভূত হতে শুরু করলো।

রুদ্র হাঁপাতে হাঁপাতে দাঁড়িয়ে গেলো। জানলো, এক অন্ধকার অধ্যায়ের শেষ হয়েছে। কিন্তু তার ভেতরে একটা ভয় রয়ে গেলো—ভস্ম হয়ে যাওয়া ভোগঘর কি সত্যিই মুক্তির প্রতীক, নাকি আরও বড় কোনো অশুভ শক্তি এখন মুক্ত হলো?

নবম পর্ব

ভোগঘরের আগুন তিনদিন তিনরাত ধরে জ্বললো। গ্রামবাসীরা দূর থেকে তাকিয়ে দেখলো, কেউ কাছে গেল না। আগুনের শিখা যেন অদ্ভুতভাবে নিজে থেকেই টিকে থাকলো—কোনো কাঠ, তেল বা ঘাস ছাড়াই। রুদ্র বারবার ভাবছিলো, এ শুধু অগ্নিকাণ্ড নয়, এক অভিশপ্ত ইতিহাসের দাহসংস্কার।

চতুর্থ দিনে যখন ভস্মস্তূপ ঠাণ্ডা হলো, গ্রামবাসীরা সাবধানে এগিয়ে এলো। ভোগঘরের জায়গাটা এখন ছাইয়ে ঢাকা কালো মাটি, তার ওপর পুড়ে যাওয়া ইট আর ভাঙা কাঠের স্তূপ। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার—ছাইয়ের মাঝখানে একেবারে অক্ষত অবস্থায় পড়ে আছে সেই শঙ্খ। রুদ্র সেটি হাতে তুলে নিতেই চারপাশে এক নিস্তব্ধতা নেমে এলো, যেন সবার নিঃশ্বাস আটকে গেছে।

গ্রামের বৃদ্ধরা কাঁপা কণ্ঠে বললো—
—“এবার হয়তো শান্তি এসেছে।”

কিন্তু রুদ্রর মনে শান্তি এলো না। রাত নামতেই সে আবার অদ্ভুত স্বপ্ন দেখতে লাগলো। স্বপ্নে দেখলো—ভোগঘরের ধ্বংসস্তূপ থেকে ধোঁয়া উঠে যাচ্ছে, ধোঁয়ার ভেতর থেকে অসংখ্য মুখ ভেসে উঠছে। তাদের চোখে শান্তি নেই, বরং ভয়ার্ত চাহনি। তারা একসাথে হাত বাড়িয়ে ডাকছে—
—“আমাদেরও মুক্তি দাও!”

চমকে ঘুম ভেঙে গেলো রুদ্রর। তার বুকের ভেতর প্রচণ্ড ধুকপুকানি। জানলো, ভোগঘরের আগুনে হয়তো মাধবীলতা আর কিছু আত্মা মুক্তি পেয়েছে, কিন্তু অনেকেই এখনও আটকে আছে—হয়তো মাটির গভীরে, হয়তো স্মৃতির গহ্বরে।

পরদিন সে গ্রামবাসীদের ডেকে বললো—
—“তোমরা কি কখনো ভোগঘরের নিচে খুঁড়ে দেখেছো? হয়তো সেখানে আরও দেহ, আরও ইতিহাস চাপা পড়ে আছে।”

গ্রামবাসীরা আতঙ্কিত হয়ে মাথা নেড়ে বললো—
—“ওসব মাটি খোঁড়া মানে বিপদ ডেকে আনা। আমাদের পূর্বপুরুষেরা শপথ করে দিয়েছে, কেউ ওদিকে হাত দেবে না।”

রুদ্র বুঝলো, তাকে একাই এগোতে হবে। সেই রাতে চাঁদের আলোয়, হাতে শঙ্খ নিয়ে সে একা গেল ভোগঘরের ধ্বংসস্তূপে। চারপাশে নিস্তব্ধতা, শুধু ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। ভস্মস্তূপে দাঁড়াতেই মনে হলো মাটি থেকে কেমন যেন গুঞ্জন ভেসে আসছে।

সে কোদাল নিয়ে খুঁড়তে শুরু করলো। মাটি নরম, কালো। খানিকটা খুঁড়তেই বেরিয়ে এলো একটি ভাঙা হাতের হাড়। তার সঙ্গে লাল কাচের চুড়ির টুকরো। রুদ্রর চোখে জল এসে গেলো—এত মানুষকে নিষ্ঠুরভাবে এখানে মাটিচাপা দেওয়া হয়েছিলো।

হঠাৎ চারদিক থেকে ফিসফিসানি ভেসে এলো—
—“তুমি কি আমাদের মুক্তি দেবে?”

রুদ্র কাঁপা হাতে শঙ্খ ঠোঁটে ধরলো। এবার সুর বের হলো আগের চেয়ে অনেক তীব্র। চারপাশে বাতাস কেঁপে উঠলো। ধ্বংসস্তূপ থেকে ধোঁয়ার মতো অসংখ্য ছায়া বেরিয়ে এলো, আকাশের দিকে ভেসে গেলো। তাদের চোখে কৃতজ্ঞতা, ঠোঁটে দীর্ঘশ্বাস।

কিন্তু ঠিক তখনই মাটির গভীর থেকে উঠলো এক গর্জন। আগের সবকিছুর চেয়ে ভয়ংকর। রুদ্র থমকে দাঁড়ালো। ছাই কেঁপে উঠলো, ফাটল ধরলো মাটিতে। অন্ধকার থেকে বিশাল কালো ছায়া বেরিয়ে এলো—হরিশঙ্কর নয়, তার থেকেও ভয়াবহ কিছু।

এক বিশাল দানবীয় মুখ, যার চোখ রক্তের মতো, দাঁত কুচকুচে সাদা। কণ্ঠ গর্জে উঠলো—
—“তুমি সাহস করলে শতবর্ষের ভোগ নষ্ট করতে? আমি হরিশঙ্করেরও প্রভু। আমি এই ভোগঘরের প্রকৃত অধিপতি। আমি অতৃপ্তি।”

রুদ্র শীতল হয়ে গেলো। এতদিন সে ভেবেছিলো হরিশঙ্করই ছিলো অশুভ শক্তির মূল, অথচ আসলে আরও গভীরে লুকিয়ে ছিলো ভয়ংকর এক অধিপতি—লোভ আর ভোগের প্রতিমূর্তি।

দানবীয় মুখ গর্জে উঠলো—
—“একজনকে মুক্তি দিলে কিছু হয় না। যতই মুক্ত করো, আমার ক্ষুধা মিটবে না। এই ভোগঘর আমার পেটে চিরকাল থাকবে।”

রুদ্রর হাতে শঙ্খ কাঁপতে লাগলো। এবার বুঝলো, লড়াই শেষ হয়নি—এ শুধু শুরু।

দশম পর্ব

অতৃপ্তির গর্জনে ভোগঘরের ধ্বংসস্তূপ কেঁপে উঠলো। আকাশে হাওয়ার সঙ্গে ঘুরপাক খেলো ধুলো আর ছাই। চারপাশের গাছপালা হঠাৎ হেলে পড়লো, যেন অদৃশ্য ঝড় বইছে। রুদ্র বুক শক্ত করে দাঁড়িয়ে রইলো। তার হাতে একমাত্র ভরসা সেই শঙ্খ, আর ব্যাগে রাখা মাধবীলতার ডায়েরি।

দানবীয় মুখ হাসতে লাগলো—রক্তমাখা দাঁতের ফাঁক দিয়ে গন্ধ ছড়িয়ে পড়লো।
—“তুমি ভেবেছো কয়েকটা কান্নার আত্মাকে মুক্তি দিয়ে আমায় হারাতে পারবে? আমি শতাব্দীর ভোগ, আমি মানুষের লালসা, আমি মৃত্যুর পরও অতৃপ্ত ক্ষুধা।”

রুদ্র কাঁপা গলায় বললো,
—“ভোগঘর তোমার সাম্রাজ্য হতে পারে, কিন্তু ইতিহাস তোমার দাস নয়। যতদিন কেউ সত্য খুঁজবে, তোমার বাঁধন ভাঙতেই থাকবে।”

সে ডায়েরির পাতাগুলো খুলে শঙ্খের সামনে ধরলো। পাতাগুলো থেকে আলো বেরোলো, অক্ষরগুলো ঝলমল করতে লাগলো। মাধবীলতার লেখা যেন জীবন্ত হয়ে উঠলো। এক কণ্ঠস্বর চারপাশে ভেসে এলো—
—“আমার মৃত্যুই শেষ নয়। যে-ই আমার লেখা পড়বে, সে-ই আমার কণ্ঠ।”

অতৃপ্তি গর্জে উঠলো। মাটি ফেটে কালো ধোঁয়া বেরোতে লাগলো। রুদ্র মরিয়া হয়ে শঙ্খ বাজালো। এবার সুর বেরোল বজ্রপাতের মতো তীব্র, আকাশ বিদীর্ণ হয়ে গেলো। সুরের তীব্রতায় গ্রাম কেঁপে উঠলো, দূরের কুড়ুলিয়ার ঘরে ঘরে প্রদীপ দুললো।

অসংখ্য ছায়া ধ্বংসস্তূপ থেকে বেরিয়ে এলো—নর্তকী, দাসী, কবি, সঙ্গীতজ্ঞ, নির্যাতিত মানুষ। তারা সবাই একসাথে শঙ্খসুরে ভেসে আকাশের দিকে উঠতে লাগলো। তাদের মুখে মুক্তির হাসি, চোখে জল।

অতৃপ্তি চিৎকার করলো—
—“না! তারা আমার খাদ্য! এভাবে যেতে পারে না!”

সে ছায়াগুলো আঁকড়ে ধরতে চাইলো, কিন্তু আলো তাকে ছুঁতেই তার হাত গলে যেতে লাগলো। রুদ্র শঙ্খ বাজাতে লাগলো আরও জোরে।

শেষে আলো এত তীব্র হয়ে উঠলো যে চোখ ধাঁধিয়ে গেলো। এক প্রচণ্ড বিস্ফোরণের মতো শব্দ হলো। যখন ধুলো বসলো, তখন আর কিছু অবশিষ্ট নেই—না ছায়া, না দানবীয় মুখ। শুধু ছাইয়ের মধ্যে শান্ত হয়ে পড়ে আছে একটি অদ্ভুত মূর্তি—দেবীর ভাঙা প্রতিমার অংশ, চোখে অশ্রু জমাট।

রুদ্র হাঁপাতে হাঁপাতে মাটিতে বসে পড়লো। শঙ্খ এখন নিস্তব্ধ। মনে হলো, ভোগঘরের শতবর্ষের অভিশাপ অবশেষে শেষ হয়েছে।

পরদিন গ্রামবাসীরা এসে দেখলো জায়গাটা এখন কেবল ধ্বংসস্তূপ। কারও কণ্ঠে আর হাহাকার নেই। বৃদ্ধরা মাটিতে হাত ছুঁয়ে বললো—
—“অবশেষে শান্তি ফিরে এসেছে।”

রুদ্র শঙ্খ আর ডায়েরি নিয়ে কলকাতায় ফিরে গেলো। তার গবেষণা শেষ হলো না, বরং নতুন পথ পেলো। সে জানলো, ইতিহাস শুধু বইয়ে লেখা হয় না—কখনও কখনও তা মাটির নিচে চাপা পড়ে থাকে, আর সত্য খুঁজে বের করাই গবেষকের দায়।

কিন্তু এক অদ্ভুত রহস্য থেকে গেলো। রাতের ঘুমে কখনও কখনও রুদ্র এখনও শুনতে পায় মৃদু শঙ্খধ্বনি। তখন মনে হয়, হয়তো অতৃপ্তি পুরোপুরি শেষ হয়নি—শুধু ঘুমিয়ে আছে সময়ের গহ্বরে, আবার জেগে ওঠার অপেক্ষায়।

আর ভোগঘরের ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে থাকা গ্রামবাসীরা মাঝে মাঝে দেখে—চাঁদের আলোয় এক লাল শাড়ি পরা নারী হাসছেন, চোখে মুক্তির আভা। তিনি মাধবীলতা, যিনি এখন কিংবদন্তি, কিন্তু যন্ত্রণার নয়—মুক্তির প্রতীক।

সমাপ্ত

WhatsApp-Image-2025-09-16-at-10.44.31-AM-1.jpeg

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *