Bangla - নারীবিষয়ক গল্প

আবিষ্কারের পথে

Spread the love

অদিতি পাল


অধ্যায় ১ : স্বপ্নের সূত্রপাত

কলকাতার ভোরের শহর তখনো পুরোপুরি জেগে ওঠেনি। পুরোনো পাড়ার সরু রাস্তাগুলোতে ছায়া আর কুয়াশার মিশ্রণ, দূরে কোথাও হালকা চায়ের গন্ধ ভেসে আসছে। এই পরিচিত পরিবেশের মধ্যেই হাঁটছে ঈশানি দত্ত—মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে, বয়স মাত্র ছাব্বিশ। সকালটা যেন তার কাছে এক নতুন দিনের প্রতীক, যেখানে দায়িত্ব আর স্বপ্নের সীমানা মিলেমিশে একাকার। ছোটবেলা থেকেই বিজ্ঞানের প্রতি এক অদ্ভুত টান অনুভব করত সে। কলেজে পড়ার সময় গঙ্গার পাড়ে হাঁটতে গিয়ে বারবার লক্ষ্য করেছে নদীর পানিতে ভেসে থাকা প্লাস্টিক, মরা মাছ, আর মানুষের অজান্তে ফেলে দেওয়া নানান বর্জ্য। সেই দৃশ্যগুলো তার মনে গোপনে এক ধরনের প্রশ্ন জাগিয়েছে—প্রকৃতি যদি আমাদের বাঁচিয়ে রাখে, তবে আমরা কেন তাকে এত অবহেলা করি? পরিবেশ বিজ্ঞানে মাস্টার্স করার সময় সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে সে শিখেছে দূষণ, রাসায়নিক প্রতিক্রিয়া আর জীববৈচিত্র্যের গভীর জটিলতা। আজ সে কলকাতার একটি স্বনামধন্য গবেষণাগারে কাজ শুরু করেছে, যেখানে তরুণ বিজ্ঞানীদের চোখেমুখে নতুন আবিষ্কারের নেশা। ঈশানি সেদিন ল্যাবরেটরির বড় জানালা দিয়ে গঙ্গার দিকে তাকিয়ে অনুভব করছিল, বিজ্ঞান শুধু তত্ত্বের বিষয় নয়—এটি মানুষের জীবনরক্ষার পথ।

গঙ্গা প্রকল্পের কাজ হাতে পাওয়ার পর ঈশানির দায়িত্ব ছিল নদীর বিভিন্ন অংশ থেকে পানি সংগ্রহ করে তার রাসায়নিক উপাদান পরীক্ষা করা। প্রথম সপ্তাহেই সে বুঝতে পারে পরিস্থিতি ভয়ঙ্কর। পানির নমুনা থেকে বেরিয়ে আসা ফলাফলে দেখা গেল অক্সিজেনের মাত্রা অস্বাভাবিকভাবে কমে গেছে, ভারী ধাতুর পরিমাণ আশঙ্কাজনক, আর মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি এত বেশি যে তা কেবল জলজ প্রাণীকেই নয়, মানুষের শরীরেও মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে। ল্যাবের সাদা আলোয় বসে থাকা ঈশানি সেই রিপোর্টের দিকে তাকিয়ে এক অদ্ভুত অসহায়তা অনুভব করল। বাইরে থেকে এই নদীকে এখনও অনেকে পবিত্র বলে মানে, পূজোর সময় ফুল আর ধূপ দিয়ে সাজায়, অথচ ভেতরে ভেতরে নদী যেন এক অসুস্থ দেহে পরিণত হয়েছে। সহকর্মীরা কেউ কেউ এটিকে কেবল তথ্য হিসেবে দেখে, রিপোর্ট তৈরি করে, ফাইল জমা দেয়। কিন্তু ঈশানির ভেতরে তীব্র এক অস্থিরতা কাজ করতে লাগল। রাতের বেলা বাড়ি ফিরে সে ঘুমোতে পারত না। চোখ বন্ধ করলেই নদীর কালচে জল, ভেসে থাকা আবর্জনা আর নিঃশ্বাস নিতে থাকা মরা মাছের ছবি ভেসে উঠত। তার মনে প্রশ্ন জাগত—শুধু ডেটা সংগ্রহ করেই কি দায়িত্ব শেষ? নাকি আরও কিছু করা সম্ভব? সেই মুহূর্তগুলোতে সে যেন নিজের ভেতরের বিজ্ঞানীকে চিনতে শুরু করল—যে শুধু সমস্যার পরিসংখ্যান নয়, সমাধান খুঁজতে চায়।

এই অস্থিরতা থেকেই জন্ম নিল এক অদ্ভুত স্বপ্ন। এক রাতে ছাদে বসে গঙ্গার দিকে তাকিয়ে ঈশানি হঠাৎ উপলব্ধি করল, নদীকে বাঁচাতে হলে চাই এমন একটি প্রযুক্তি যা শুধু দূষণ রোধই করবে না, বরং স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় নদীর জলকে বিশুদ্ধ করে তুলবে। তার মাথায় নানা খসড়া ভেসে উঠতে লাগল—জৈবপ্রযুক্তি, মাইক্রোবিয়াল ফিল্টার, সূর্যালোক ব্যবহার করে স্বয়ংক্রিয় পরিশোধন ব্যবস্থা—সবকিছুরই টুকরো টুকরো ছবি জোড়া লাগছিল মনের মধ্যে। হয়তো ধারণাগুলো তখনো অপরিণত, হয়তো কেউ এগুলোকে অবাস্তব বলবে, কিন্তু ঈশানির চোখে সেই স্বপ্ন একেবারে বাস্তব মনে হচ্ছিল। সে জানত এই পথ সহজ নয়। গবেষণার জন্য তহবিল জোগাড়, নতুন পদ্ধতির অনুমোদন, ল্যাবের রাজনীতি, সামাজিক উদাসীনতা—সবই তাকে থামানোর জন্য যথেষ্ট। তবু তার ভেতরের দৃঢ়তা তাকে বারবার বলছিল, “তুমি পারবে।” সেই রাতেই সে নিজের নোটবুকে প্রথমবার লিখে রাখল প্রজেক্টের সম্ভাব্য নাম—“নবজল প্রণালী।” কলমের কালিতে আঁকা সেই কয়েকটি শব্দ যেন তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার সংকেত হয়ে দাঁড়াল। সে জানত না এই পথে কত বাধা আসবে, কত মানুষ সন্দেহ করবে, কিন্তু সে এটুকু বুঝেছিল—নদীর ডাক উপেক্ষা করা তার পক্ষে আর সম্ভব নয়। সেই নীরব ছাদের অন্ধকারেই ঈশানি দত্তর জীবনে এক নতুন অধ্যায়ের সূত্রপাত হলো, যেখানে ব্যক্তিগত স্বপ্ন আর সামাজিক দায়িত্ব মিলেমিশে এক অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে জড়িয়ে গেল।

অধ্যায় ২ : গবেষণাগারের প্রথম লড়াই

কলকাতার বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞানের গবেষণাগারটা বাইরে থেকে যতটা আধুনিক দেখায়, ভেতরের বাস্তবতা কিন্তু তার থেকে অনেক আলাদা। ঈশানি যখন গঙ্গা দূষণ নিয়ন্ত্রণের নতুন প্রযুক্তির জন্য নিজের প্রজেক্টের খসড়া জমা দিল, তখনই বুঝে গেল তহবিলের অভাব এখানে এক নিত্যদিনের বাধা। ল্যাবের দেয়ালে ঝুলে থাকা পুরোনো যন্ত্রপাতি, ভাঙা টেবিলের কোণ আর অচল রাসায়নিক ফ্রিজ যেন নীরবে জানিয়ে দিচ্ছিল যে বড় স্বপ্নের জন্য এখানে জায়গা কম। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন জানালেও বরাদ্দকৃত অর্থ নিতান্তই অপ্রতুল—একটা পূর্ণাঙ্গ পরীক্ষার জন্য যত রিএজেন্ট, ফিল্টার কিংবা সেন্সর দরকার, তার অর্ধেকও মজুত নেই। অন্যদিকে একই বিভাগের কিছু সিনিয়র পুরুষ গবেষক সরকারের বড় প্রকল্পের জন্য মোটা অঙ্কের অনুদান পেয়ে নিজেদের কাজ এগিয়ে নিচ্ছেন। মিটিংয়ে তারা ঈশানির প্রজেক্টকে প্রশংসা করলেও পেছনে গিয়ে বলে, “গঙ্গা বাঁচানোর গল্প অনেক শোনা গেছে, কিন্তু নতুন কিছু করা সহজ নয়।” তাদের সেই অবজ্ঞার হাসি ঈশানির কানে স্পষ্ট ধ্বনিত হয়। বিশেষ করে এক সহকর্মী অরুণ বারবার বুঝিয়ে দেয় যে একজন নারী বিজ্ঞানীর পক্ষে এত বড় প্রজেক্ট সামলানো কঠিন। “তুমি তত্ত্বে ভালো, কিন্তু ফিল্ডওয়ার্কের ঝক্কি সামলাতে পারবে তো?”—এই ধরনের মন্তব্যে ঈশানির ভেতরে ক্ষোভ জমতে থাকে। সে জানে, এই লড়াই শুধু অর্থ বা যন্ত্রপাতির জন্য নয়, বরং নিজের অস্তিত্ব প্রমাণের জন্যও।

তহবিলের স্বল্পতা আর সহকর্মীদের পক্ষপাতের মাঝেই ঈশানি দিনরাত কাজ চালিয়ে যায়। সকালে ল্যাবের কড়া গন্ধমাখা ঘরে ঢুকেই শুরু হয় রাসায়নিক মাপঝোক, মাইক্রোস্কোপের নিচে নমুনা পর্যবেক্ষণ, ডেটা এন্ট্রি। সন্ধ্যা নামলেও তার কাজ শেষ হয় না; প্রজেক্টের অগ্রগতি নিশ্চিত করতে তাকে বারবার পুরোনো যন্ত্রগুলো মেরামত করে চালু করতে হয়। রাত গভীর হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের লম্বা করিডোরে লাইটগুলো নিভে যায়, কেবল গবেষণাগারের ভেতরের মৃদু ফ্লুরোসেন্ট আলোয় দেখা যায় ঈশানির ছায়া—মাইক্রোপিপেট হাতে, চোখের নিচে ক্লান্তির ছাপ। একের পর এক পরীক্ষা চালিয়ে যেতে গিয়ে ব্যর্থতার পর ব্যর্থতা ধাক্কা দেয়। কখনও ফিল্টার ভেঙে যায়, কখনও রাসায়নিক বিক্রিয়ায় অপ্রত্যাশিত ফল আসে, আবার কখনও কম্পিউটারের সফটওয়্যার ডেটা হারিয়ে ফেলে। প্রতিটি ব্যর্থতার সঙ্গে ল্যাবের ঠান্ডা দেয়াল যেন তাকে উপহাস করে। কিন্তু ঈশানি হার মানে না। তার মনে একটাই দৃঢ়তা—“বিজ্ঞান কোনো অলৌকিক জাদু নয়, এটি ধৈর্যের খেলা।” সঙ্গী হয় শুধু গভীর নীরবতা, মাঝে মাঝে দূরের ঘড়ির টিকটিক শব্দ। নিজের খরচ বাঁচিয়ে নতুন রাসায়নিক কিনতে হয়, বাড়িতে পরিবারের কাছে এই সংগ্রামের কথা বলতে দ্বিধা করে। মা শুধু এতটুকু বোঝেন যে মেয়েটি দিন দিন শারীরিকভাবে ক্লান্ত হয়ে পড়ছে, কিন্তু তার চোখে যে অদ্ভুত জেদ জমেছে, তা কেউ থামাতে পারে না।

অবশেষে এক ঝড়ো রাতে, যখন কলকাতার আকাশে মেঘ গর্জে উঠছে, ঈশানি একা বসে নিজের ডায়েরি খুলে বসে। ল্যাবের অর্ধেক আলো নিভে গেছে, জানলার বাইরে বৃষ্টির ফোঁটা কাঁচে টোকা দিচ্ছে। আজকের পরীক্ষাও ব্যর্থ হয়েছে—প্রোটোটাইপ ফিল্টার কোনোভাবেই নদীর ভারী ধাতু শোষণ করতে পারছে না। তবু এই ব্যর্থতার মাঝেই সে কলম হাতে তুলে নিল। কাগজে লিখল, “বিজ্ঞান শুধু সূত্র নয়, এক অবিরাম লড়াই।” সেই মুহূর্তে সে বুঝতে পারল, এই লড়াই শুধু তার নয়, বরং প্রতিটি মানুষের, যারা পৃথিবীকে বাঁচাতে চায় অথচ প্রতিকূলতার পাহাড় টপকাতে হয়। ডায়েরির পাতায় কালি ছড়িয়ে পড়ে, কিন্তু শব্দগুলো তার সংকল্পকে আরও দৃঢ় করে। বাইরে ঝড়ের শব্দ যেন তার মনের লড়াইয়ের প্রতিধ্বনি হয়ে ওঠে। ঈশানি অনুভব করল—তহবিলের ঘাটতি, যন্ত্রের অচলাবস্থা, পুরুষ সহকর্মীদের তাচ্ছিল্য—সবকিছুর ওপরে এক শক্তি আছে, সেটি হল জ্ঞানের প্রতি অটল বিশ্বাস। রাতের সেই নিঃশব্দ ল্যাবে নিজের লেখা দেখে সে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল, যত দেরিই হোক না কেন, এই গবেষণা শেষ করবেই। হয়তো এই শুরুটা তার জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময়, কিন্তু এই লড়াই থেকেই জন্ম নেবে আগামী দিনের আবিষ্কার।

অধ্যায় ৩ : অজানা সঙ্গী

গবেষণাগারের একঘেয়ে দিনগুলোতে হঠাৎই নতুন একটি উপস্থিতি ঈশানির জীবনে আলোড়ন তুলল। এক মলিন সকালে ল্যাবের করিডোরে ঢুকেই সে দেখল একজন অচেনা যুবক বিভাগের প্রধানের সঙ্গে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। গায়ের রঙ সামান্য শ্যামলা, তীক্ষ্ণ চোখের দৃষ্টি, কাঁধে ব্যাগ ঝোলানো—তাঁর নাম রুদ্র সেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য একটি প্রকল্পে অসাধারণ সাফল্যের কারণে তাঁকে এই ল্যাবে বিশেষ গবেষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। প্রথম দিনেই বিভাগের প্রধান পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, “রুদ্র বায়োটেকনোলজিতে দক্ষ। গঙ্গা প্রকল্পে হয়তো নতুন দিশা আনতে পারবে।” ঈশানির মনে প্রথমেই এক ধরনের অস্বস্তি কাজ করল। এতদিন যে প্রজেক্টটা একাই চালিয়ে যাচ্ছে, সেখানে হঠাৎ একজন নতুন সহকর্মীর আগমন মানেই নতুন মতভেদ, নতুন দ্বন্দ্ব। রুদ্রও প্রথম থেকেই নিজের মতামত নিয়ে দৃঢ়। প্রথম মিটিংয়েই সে বিদ্যমান ফিল্টার প্রক্রিয়ার কিছু দুর্বলতা তুলে ধরে বলল, “এভাবে রাসায়নিক পরিশোধনে আমরা সীমায় পৌঁছে গেছি। প্রকৃতির ভেতরেই সমাধান খুঁজতে হবে।” ঈশানি, যে এতদিন নিজের পদ্ধতি নিয়ে নিঃশব্দে লড়াই করেছে, এই মন্তব্যে খানিকটা ক্ষিপ্ত হলেও চুপ করে রইল। তার মনে হলো, নতুন কেউ আসলেই সবাই তাকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। কিন্তু রুদ্রের চোখের আত্মবিশ্বাস এবং স্পষ্ট যুক্তি অস্বীকার করাও সহজ ছিল না। কাজের শুরুতেই মতভেদ তৈরি হলেও এক অদ্ভুত প্রতিযোগিতা যেন দু’জনকে অদৃশ্য বন্ধনে বেঁধে ফেলল।

দিন গড়াতে গড়াতে ল্যাবের ভেতরে তাদের কথাবার্তা বাড়তে লাগল। রুদ্র কাজের ফাঁকে প্রায়ই নিজের আগের গবেষণার অভিজ্ঞতা শেয়ার করত—কিভাবে সে বায়োটেকনোলজি ব্যবহার করে দূষিত পুকুরের জল শোধনের চেষ্টা করেছিল, কিংবা মাইক্রো-অর্গানিজম দিয়ে ভারী ধাতু শোষণের এক্সপেরিমেন্ট চালিয়েছিল। প্রথমে ঈশানি এই গল্পগুলোকে অবান্তর মনে করলেও, ধীরে ধীরে বুঝতে পারল, রুদ্রের চিন্তার গভীরতা তার প্রজেক্টে নতুন দিশা আনতে পারে। এক সন্ধ্যায় ল্যাবের ম্লান আলোয় দাঁড়িয়ে রুদ্র বলল, “আমরা যদি বিশেষ ধরনের ব্যাকটেরিয়া ব্যবহার করি, যারা ধাতব আয়ন শোষণ করতে পারে, তাহলে রাসায়নিকের ওপর নির্ভরতা কমবে। ভাবো, নদীর নিজস্ব জীববৈচিত্র্যকেই যদি শোধনের শক্তি হিসেবে কাজে লাগানো যায়!” ঈশানি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। এতদিনের অগণিত ব্যর্থতার মাঝে এই ভাবনাটি যেন এক টুকরো আলোর ঝলক এনে দিল। তবু তার মনে সংশয় ছিল—এই প্রযুক্তি বাস্তবে কতটা কার্যকর হবে? রুদ্র ধৈর্য ধরে বুঝিয়ে বলল, কিভাবে জিনগতভাবে নির্বাচিত ব্যাকটেরিয়া ফিল্টার সিস্টেমের ভেতর বাস করতে পারে এবং ক্রমাগত দূষণ শোষণ করতে পারে। কথার পর কথায় দু’জনের মধ্যে এক ধরনের পারস্পরিক সম্মান গড়ে উঠল। ঈশানি লক্ষ্য করল, রুদ্র কখনো তার ধারণাকে অস্বীকার করে না; বরং প্রশ্ন করে, তর্ক করে, আবার প্রশংসা করে। এতদিনের একাকী সংগ্রামের মধ্যে হঠাৎ একজন সহযোদ্ধার উপস্থিতি তাকে নতুন শক্তি দিল।

রুদ্রের পরামর্শেই শুরু হলো নতুন ধাপের পরীক্ষা—বায়ো-ফিল্টার প্রযুক্তির প্রথম খসড়া। দিন-রাতের লড়াই আবার শুরু হলেও এবার আর একা নয়। দু’জন মিলে নমুনা ব্যাকটেরিয়া সংগ্রহ, তাদের উপযোগী পরিবেশ তৈরি, এবং ফিল্টারের জটিল কাঠামো তৈরি করতে লাগল। বহুবার পরীক্ষা ব্যর্থ হলো; কখনো ব্যাকটেরিয়া মারা গেল, কখনো ফিল্টারের ছিদ্রপথ আটকে গেল, কখনো রাসায়নিক প্রতিক্রিয়ায় অপ্রত্যাশিত বিষাক্ত পদার্থ তৈরি হলো। কিন্তু প্রতিটি ব্যর্থতার পর রুদ্র শান্ত কণ্ঠে বলত, “এটাই বিজ্ঞান, প্রতিটি ভুলই সঠিক পথে এক ধাপ এগোনো।” ঈশানি অনুভব করল, তার নিজের ধৈর্যের সঙ্গে রুদ্রের অধ্যবসায় মিলে যেন এক অদম্য শক্তি তৈরি করেছে। অবশেষে এক বর্ষার রাতে, যখন বাইরে আকাশ বিদ্যুৎ চমকে উঠছে, ল্যাবের ভেতর বায়ো-ফিল্টারের প্রোটোটাইপ প্রথমবারের মতো সফল ফলাফল দেখাল। নদীর নমুনা জল ফিল্টারের ভেতর দিয়ে গিয়ে বিশুদ্ধ হয়ে বেরিয়ে এল—ভারী ধাতুর মাত্রা উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। ঈশানি আনন্দে নিজের নোটবুকের দিকে তাকাল, যেখানে নতুন করে লিখল, “প্রথম সাফল্য।” সেই মুহূর্তে দু’জনের চোখে যে উচ্ছ্বাস, তা কোনো শব্দে বোঝানো সম্ভব নয়। এতদিনের নিঃসঙ্গ সংগ্রাম আজ একটি সঙ্গীর সঙ্গে নতুন পথে হাঁটতে শিখল। এই সাফল্য শুধু একটি প্রোটোটাইপের নয়, বরং দুই গবেষকের পারস্পরিক আস্থা, পরিশ্রম ও সম্ভাবনার এক অটুট বন্ধনের প্রতীক হয়ে রইল।

অধ্যায় ৪ : পেশাগত প্রতিযোগিতা

বায়ো-ফিল্টারের প্রথম সাফল্যের পর ঈশানির ল্যাব যেন নতুন প্রাণ ফিরে পেল। বিশ্ববিদ্যালয়ের করিডোরে এখন আগের তুলনায় বেশি আলোড়ন, সহকর্মীরা তাদের দিকে নতুন চোখে তাকাচ্ছে। কিন্তু এই সাফল্যের গুঞ্জন বাইরে ছড়িয়ে পড়তে বেশি সময় লাগল না। এক বিকেলে বিভাগের প্রধান হঠাৎ এক গম্ভীর মুখে মিটিং ডাকলেন। টেবিলের ওপর ছড়িয়ে দিলেন কয়েকটি সংবাদপত্র আর ই-মেইল প্রিন্টআউট। খবরের শিরোনাম প্রায় একই—একটি বড় প্রাইভেট রিসার্চ কোম্পানি “হাইড্রো-পিউর ইনোভেশন্স” দাবি করেছে যে তারা নদী শোধনের জন্য একই ধরনের বায়ো-ফিল্টার প্রযুক্তি আবিষ্কার করেছে এবং খুব শিগগিরই আন্তর্জাতিক পেটেন্টের জন্য আবেদন করবে। মুহূর্তেই ঘরটা নিস্তব্ধ হয়ে গেল। ঈশানি কাগজের পাতাগুলোতে চোখ বোলাতে বোলাতে বুঝতে পারছিল, এই খবর শুধু একটিমাত্র প্রযুক্তিগত লড়াই নয়, বরং একটি শক্তিশালী লবিং-এর আঘাত। কোম্পানিটি বিশাল তহবিল, রাজনৈতিক সংযোগ আর আইনি পরামর্শক নিয়ে প্রস্তুত; তাদের কাছে মিডিয়া এবং মুনাফা দুটোই হাতের মুঠোয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষও স্পষ্ট জানিয়ে দিল যে পেটেন্ট সংক্রান্ত যেকোনো জটিলতা এড়াতে প্রজেক্টের ফলাফল প্রকাশের আগে বাড়তি প্রমাণ জোগাড় করতে হবে। হঠাৎ করেই ঈশানি এবং রুদ্রের ল্যাব একটি অদৃশ্য চাপের জালে আটকা পড়ল। যে সাফল্য কয়েকদিন আগে গর্বের কারণ ছিল, সেটিই এখন হয়ে উঠল অনিশ্চয়তার উৎস।

পরবর্তী কয়েকদিন ঈশানি বুঝতে পারল, প্রতিযোগিতার লড়াই শুধু গবেষণাগারে নয়, রাজনীতি ও অর্থনীতির অদৃশ্য অঙ্গনেও চলতে থাকে। হাইড্রো-পিউর ইনোভেশন্স তাদের প্রতিনিধিদের পাঠিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বৈঠক করতে শুরু করল। গোপনে শোনা যাচ্ছে, তারা বিপুল অর্থের প্রস্তাব দিয়ে ল্যাবের ফলাফল এবং নকশা কিনে নিতে চায়। একই সময়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় নানা বিভ্রান্তিকর খবর ছড়িয়ে পড়ল—কেউ দাবি করছে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকল্প আসলে কোম্পানিটির পুরোনো গবেষণার নকল, কেউ আবার বলছে সরকার পেটেন্টের অনুমোদনে পক্ষপাত করবে। ঈশানি প্রতিদিন সকালে ল্যাবে ঢুকেই নতুন নতুন গুজব শুনছে, আর রাতে ক্লান্ত শরীরে বাড়ি ফিরছে এক অজানা আতঙ্ক নিয়ে। রুদ্র তাকে বোঝাতে চায়, “আমরা যদি ডেটা দিয়ে প্রমাণ করতে পারি যে প্রযুক্তির মৌলিক ধারণা আমাদের, তাহলে তারা কিছু করতে পারবে না।” কিন্তু বাস্তব এত সহজ নয়। আইনি লড়াইয়ের জন্য টাকা, সময় আর সংযোগ তিনটিই দরকার, যা একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রকল্পের পক্ষে অসম্ভব। এই চাপের মধ্যে ল্যাবের কাজও থেমে যেতে বসেছে—সরবরাহকারীরা হঠাৎ করে যন্ত্রপাতি দিতে দেরি করছে, কয়েকটি পরীক্ষার জন্য দরকারি রাসায়নিক আসতে দেরি হচ্ছে। যেন অদৃশ্য হাত চারদিক থেকে বাধা তৈরি করছে। ঈশানি মাঝে মাঝে জানলার বাইরে তাকিয়ে ভাবে, এই নদীকে বাঁচানোর লড়াই কি কেবলই ব্যবসায়িক প্রতিযোগিতার খেলায় হারিয়ে যাবে? কিন্তু প্রতিবারই তার ভেতরের এক শক্তি তাকে থামতে দেয় না।

এক ঝড়ো সন্ধ্যায়, যখন বৃষ্টি নামছে ল্যাবের টিনের ছাদে, ঈশানি রুদ্রের সঙ্গে বসে পরবর্তী পদক্ষেপ ঠিক করল। তাদের সিদ্ধান্ত স্পষ্ট—যেকোনো মূল্যে নিজেদের আবিষ্কার রক্ষা করতে হবে। ঈশানি দৃঢ় কণ্ঠে বলল, “আমরা যদি পিছিয়ে যাই, তাহলে শুধু আমাদের স্বপ্ন নয়, গঙ্গার ভবিষ্যৎও হারিয়ে যাবে। এই প্রযুক্তি কোনো প্রাইভেট কোম্পানির মুনাফার জন্য নয়, মানুষের জন্য।” তার চোখে অদ্ভুত এক দৃঢ়তা ফুটে উঠল, যা রুদ্রকে অবাক করল। তারা ঠিক করল, প্রোটোটাইপের প্রতিটি ধাপ নতুন করে নথিভুক্ত করা হবে, প্রতিটি পরীক্ষা ভিডিও করে সংরক্ষণ করা হবে, আর আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান সাময়িকীতে দ্রুত প্রাথমিক ফলাফল প্রকাশ করা হবে যাতে কোম্পানিটি পরে দাবি করতে না পারে যে প্রযুক্তি একান্ত তাদের। রাত জেগে কাজের তালিকা তৈরি করতে করতে ঈশানি নিজের ডায়েরি খুলে লিখল, “কোনওভাবেই আমি আমার আবিষ্কার হাতছাড়া হতে দেব না। বিজ্ঞান শুধু সূত্র নয়, এটি ন্যায়বিচারেরও লড়াই।” বাইরে বৃষ্টির শব্দ যেন তার প্রতিজ্ঞার সঙ্গে সঙ্গত করে বাজতে লাগল। এই মুহূর্তে সে জানত, লড়াই শুধু গবেষণাগারের ভেতরে নয়, বরং আদালত, মিডিয়া এবং জনমতের ময়দানেও। কিন্তু যে নদীর স্বপ্ন তাকে এই পথে এনেছে, সেই গঙ্গার ডাক উপেক্ষা করা তার পক্ষে অসম্ভব। নতুন দিনের প্রথম আলোয় সে বুঝল, তার আবিষ্কার বাঁচানোর এই লড়াইই তাকে প্রকৃত বিজ্ঞানী হিসেবে গড়ে তুলবে।

অধ্যায় ৫ : পরিবার ও সমাজের বাধা

ঈশানির ল্যাবে কাটানো দিনগুলো একদিকে যেমন সাফল্যের দিকে এগোচ্ছিল, অন্যদিকে বাড়ির পরিবেশ ক্রমশ জটিল হয়ে উঠছিল। কলকাতার একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ের জন্য রাত জেগে ল্যাবে কাজ করা মানে শুধু ক্লান্তি নয়, সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকেও তা “অসঙ্গত” মনে হত। মা-বাবা প্রতিদিন সকালে ঘুম ভেঙে উঠে তাকে ডেকে বলতেন, “ঈশানি, এত রাত জেগে তুমি কি ঠিক আছো? বিয়ে, সংসার—এসব তো ভাবতে হবে।” বাবা বলতেন, “তুমি কি বুঝছো, মেয়েরা বড় বড় আবিষ্কার করার জন্য নয়, বরং নিজের জীবনের স্থিরতা আর পরিবার নিয়ে ভাবার জন্যই বড় হয়।” ঈশানি শান্তভাবে তাদের কথা শুনত, কিন্তু ভেতরে এক অদ্ভুত কষ্ট জমে যেত। তার মনে প্রশ্ন জাগত—কেন বিজ্ঞানকে তার জীবনের মূল প্রেম হিসেবে না নেওয়াকে এতটা সীমাবদ্ধভাবে দেখা হচ্ছে? রাতের অন্ধকারে ল্যাবের আলোয় কাজ করার সময় সে জানত, এই প্রজেক্টের প্রতিটি ধাপই শুধু তার ব্যক্তিগত স্বপ্ন নয়, বরং নদী বাঁচানোর এক গুরুত্বপূর্ণ প্রয়াস। কিন্তু পরিবারের চাপ তাকে প্রায় ভেঙে দিতে চেয়েছিল। বাবা-মায়ের উদ্বেগ, মা-বাবার আতঙ্ক—সব মিলিয়ে যেন ঈশানির মনে এক ধূসর চাপ তৈরি করেছিল।

পরিবারের চাপের সঙ্গে মিলেমিশে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিও তাকে ঘিরে ধরে। আত্মীয়রা ও পরিবারের বন্ধুবান্ধব হঠাৎ করেই তার উপর নানা মন্তব্য করতে শুরু করল। বারবার শোনা যেত, “মেয়েদের কি এইসব বড় আবিষ্কার করার দরকার আছে?” “বিয়ে হবে না কীভাবে?” এমন মন্তব্য শুধু ঈশানির মনোবল কমাত না, বরং তার উপর societal guilt চাপিয়ে দিত। একদিন এক আত্মীয় এসেছিল, হাসিমুখে বলল, “তোমার বয়স হয়ে গেছে, তুমি বিজ্ঞানী হবেন, কিন্তু সংসার তো করতে হবে। এত রাত জেগে কাজ করলেই কি কেউ বিয়ে করবে?” ঈশানির চোখে তখন কিছুটা অস্থিরতা ফুটেছিল, কিন্তু সে কোনোভাবে মুখ দিয়ে উত্তর দিল না। মনে মনে সে জানত, এই পথটি সহজ নয়, কিন্তু যদি সে থেমে যায়, তাহলে নিজের স্বপ্ন, নিজের আবিষ্কার আর নদীকে বাঁচানোর স্বপ্ন—সবই হারাবে। তার ভেতরে ক্রমশ এক দৃঢ় সংকল্প জন্ম নিতে শুরু করল। সামাজিক ব্যর্থতার ভেতরেও সে নিজের পছন্দের পাথেয় খুঁজে পেতে শুরু করল—বিজ্ঞানই তার প্রথম ভালোবাসা।

এই চাপের মধ্যেও ঈশানি তার ল্যাবে আরও নিবদ্ধ হয়ে কাজ চালিয়ে গেল। রাতে ল্যাবের ফ্লুরোসেন্ট আলোয় বসে সে মনে মনে ডায়েরি খুলে লিখল, “আমার জীবন, আমার সিদ্ধান্ত। বিজ্ঞানই আমার প্রেম, এবং আমি তার জন্য লড়ব।” প্রতিটি ব্যর্থ পরীক্ষা, প্রতিটি রাত জেগে কাটানো ঘণ্টা যেন তার আত্মবিশ্বাসকে আরও দৃঢ় করে দিল। রুদ্রও পাশে ছিল—তার সমর্থন ঈশানিকে নতুন শক্তি দিচ্ছিল। একদিন তারা ফিল্টারের নতুন নকশা নিয়ে আলোচনা করছিল, তখন ঈশানি হঠাৎ বকাঝকা নয়, বরং নির্দিষ্টভাবে বলল, “আমি হয়তো সামাজিকভাবে চাপের মুখোমুখি, কিন্তু আমার আবিষ্কার কখনও অন্যের স্বার্থে বিক্রি করব না। এই প্রযুক্তি মানুষ এবং পরিবেশের জন্য, এবং আমি এটিকে শেষ পর্যন্ত রক্ষা করব।” রুদ্র শুধু হেসে উত্তর দিল, “এটাই তোমার শক্তি।” সেই রাতের নীরবতা, ল্যাবের ফাঁকা করিডোর আর ফ্লুরোসেন্ট আলো—সব মিলিয়ে ঈশানির মনে এক অদৃশ্য শক্তির জন্ম দিল। বাড়ির সামাজিক চাপ, আত্মীয়দের বিদ্রূপ, এবং রাত জেগে গবেষণার ক্লান্তি—সব মিলেই তাকে শিখিয়েছে, নিজের স্বপ্ন রক্ষা করাই প্রকৃত সাহস। আর সেই সাহসের মাঝে জন্ম নিল ঈশানি দত্তের সত্যিকারের বৈজ্ঞানিক পরিচয়—একজন নারী, যার প্রেম শুধু মানুষ নয়, বরং বিজ্ঞান ও প্রকৃতির জন্য।

অধ্যায় ৬ : ব্যর্থতার অন্ধকার

বৃষ্টিভেজা একটি সকালে ল্যাবে টেস্টিং চলছিল। বাইরের আকাশ মেঘলা, বাতাসে আর্দ্রতার গন্ধ, আর ল্যাবের ভিতরে ফ্লুরোসেন্ট আলোয় কাজ করছে ঈশানি ও রুদ্র। নতুন প্রোটোটাইপটি—বায়ো-ফিল্টারের উন্নত সংস্করণ—দীর্ঘ দিনের পরিশ্রমের প্রতীক ছিল। দু’জন ধরে রেখেছিলেন যে আজকের পরীক্ষা সফল হলে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে বড় স্বীকৃতি পাবেন এবং পেটেন্ট প্রক্রিয়া শুরু করা সম্ভব হবে। কিন্তু সেই উত্তেজনা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। প্রোটোটাইপের একটি অংশ হঠাৎ বিকল হয়ে যায়, সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, এবং ব্যাকটেরিয়ার কলোনিগুলি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। জলের নমুনা ফিল্টার হয়ে বের হয়নি, বরং সমস্ত পরীক্ষা ব্যর্থ হয়ে যায়। ঈশানির চোখের সামনে এতদিনের চেষ্টা, রাতের ঘুমোচ্ছাড়া, ছোট ছোট খসড়া ও নকশার নোট—সব —হঠাৎ ঝড়ের মতো উধাও হয়ে যায়। প্রায় অনুভূত হতে লাগল, প্রতিটি ড্রপ জল, প্রতিটি ব্যাকটেরিয়ার কলোনি তার হাতে লাফিয়ে যাচ্ছে। ল্যাবের নিস্তব্ধতা যেন এক অদৃশ্য আঘাতের মতো তার ভেতর ঢুকে পড়ল। রুদ্রও স্তব্ধ—যদি সে কিছু বলে, তা কেবল হতাশার ঢেউকে আরও বাড়িয়ে দিত। দীর্ঘদিনের প্রতিশ্রুতির বিপরীতে এই দুর্ঘটনা এক ধরনের আধ্যাত্মিক আঘাতের মতো।

নিষ্প্রাণ প্রোটোটাইপের ধ্বংস কেবল প্রযুক্তিগত ব্যর্থতা নয়; এর সঙ্গে সঙ্গে আশঙ্কার ঝড়ও বইতে লাগল। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানালেন, তহবিলের সীমিত টাকা এখন আর বিনিয়োগ করা সম্ভব নয়। পেটেন্টের প্রক্রিয়া বিলম্বিত হবে, এবং বড় প্রাইভেট কোম্পানিগুলি তাদের দাবি শক্ত করতে পারে। দলটির মধ্যে ভয়, সন্দেহ এবং হতাশা ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়ল। কেউ কেউ বুঝতে লাগল যে এই গবেষণা চালানো আর সম্ভব নয়; কেউ কেউ ছুটে গিয়েছিলেন অন্য প্রকল্পে। ল্যাবের করিডোর, যা আগের দিন পর্যন্ত উদ্দীপনা ও উত্তেজনায় ভরপুর ছিল, আজ নিঃশব্দ ও শূন্যতার ছায়ায় ঢেকে গেছে। সরঞ্জাম, নোটবুক, পরীক্ষার যন্ত্রপাতি—সবকিছু যেন একই সাথে থমকে গেছে। ঈশানির চোখে প্রতিটি দৃষ্টি তার ভেতরের ব্যর্থতার প্রতিবিম্ব দেখাচ্ছিল। কখনও কখনও মনে হচ্ছিল, এই রাতের অন্ধকার শুধুমাত্র বাইরে নয়, তার মনের ভেতরেও বিস্তৃত। এক পর্যায়ে তার মনে হলো, সমস্ত স্বপ্ন, সমস্ত আশা, সমস্ত প্রতিশ্রুতি—সবই নষ্ট হয়ে গেছে।

কিন্তু সেই গভীর হতাশার মধ্যেই ঈশানি রুদ্রের দিকে তাকিয়ে বলল, “এখনও যদি হাল ছেড়ে দিই, তাহলে সব শেষ।” রাতের নীরবতা, ফ্লুরোসেন্ট আলো, ল্যাবের ক্ষয়িষ্ণু যন্ত্রপাতি—সব মিলিয়ে তার কথায় এক অদ্ভুত দৃঢ়তা ফুটে উঠল। রুদ্রও বুঝল, এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় শক্তি হল ঈশানির অদম্য সংকল্প। তারা দু’জনে একসাথে সিদ্ধান্ত নিল, ব্যর্থতা তাদের পথ বন্ধ করতে পারবে না। নতুন উপায় খুঁজে বের করতে হবে, তহবিল পুনরায় জোগাড়ের চেষ্টা করতে হবে, এবং প্রোটোটাইপ পুনর্নির্মাণ করতে হবে। রাত জেগে তারা নোটবুকে নতুন পরিকল্পনার খসড়া লিখতে লাগল, অগ্রাধিকার ও সম্ভাব্য বিকল্পগুলো সাজাতে লাগল। ঈশানি জানত, লড়াই শুধুই প্রযুক্তির নয়—মানসিক দৃঢ়তা ও ধৈর্যেরও। প্রায় নিঃশব্দ সেই ল্যাবে, গভীর রাতের অন্ধকারে, তিনি বুঝলেন—ব্যর্থতা শুধু এক অস্থায়ী বাধা। সাফল্য তখনই সম্ভব, যখন তিনি নিজের সংকল্পকে হার মানাতে দেবেন না। সেই রাতের অন্ধকার ও হতাশার মাঝেই জন্ম নিল নতুন উদ্দীপনা, যা আগামী দিনের সব পরীক্ষার চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে তাকে শক্ত করে তুলল।

অধ্যায় ৭ : নতুন উদ্ভাবনের আলো

গভীর হতাশার রাতগুলো পার হওয়ার পর ঈশানি একটি নতুন সম্ভাবনার দিকে নজর দিল। গঙ্গার জল নমুনা বিশ্লেষণ করতে করতে সে লক্ষ্য করল নদীর শৈবালে—aquatic algae—একটি বিশেষ প্রজাতি আছে যা অন্যান্য জীবাণুর তুলনায় রাসায়নিক শোষণে অত্যন্ত কার্যকর। শৈবালগুলো ধীরে ধীরে ভারী ধাতু, রাসায়নিক পদার্থ এবং দূষণ উপাদান শোষণ করতে পারে, আর তা প্রাকৃতিকভাবে নিজেকে পুনর্জীবিতও করতে পারে। এই আবিষ্কারটি ঈশানির জন্য এক নতুন আলো নিয়ে আসে। যে প্রোটোটাইপ কয়েকদিন আগে ধ্বংস হয়েছিল, তার ব্যর্থতা আর ক্লান্তি কিছুটা যেন দূরে সরে গেল। শৈবালের এই ক্ষমতা ব্যবহার করে যদি তারা একটি নতুন বায়ো-ফিল্টার ডিজাইন করতে পারে, তবে পরীক্ষাগুলি কার্যকর ও পরিবেশবান্ধব হতে পারে। ঈশানি উদ্দীপনার সঙ্গে নোটবুকে সেই ধারণার খসড়া আঁকতে লাগল—কিভাবে শৈবালকে একটি নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে রেখে, রাসায়নিক শোষণের জন্য ব্যবহার করা যাবে, এবং ধীরে ধীরে বিশুদ্ধ পানি বের হবে। প্রতিটি লাইন, প্রতিটি ডায়াগ্রাম যেন তার নিজের ভেতরের আশা ও নতুন শক্তিকে প্রকাশ করছিল।

রুদ্র এই খসড়ার সঙ্গে যুক্ত হয়ে বিষয়টি আরও পরিস্কার করল। তার অভিজ্ঞতা অনুযায়ী, শুধু শৈবাল ব্যবহার করলেই হবে না, একটি সঠিক বায়ো-রিঅ্যাক্টর তৈরি করতে হবে যা শৈবালের কার্যক্ষমতা বজায় রাখবে। তারা ল্যাবের ক্ষয়িষ্ণু যন্ত্রপাতি দিয়ে একটি নতুন মডেল তৈরি শুরু করল। প্রাথমিক ডিজাইনে একটি ঘূর্ণায়মান চেম্বার, জলের প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা এবং শৈবাল বসানো বিশেষ পাত্র ছিল। তারা বুঝল, প্রতিটি পদক্ষেপে পরীক্ষা, পর্যবেক্ষণ এবং পরিমাপ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রাতভর ল্যাবে বসে তারা শৈবালের বৃদ্ধির হার, রিএকশন টাইম, এবং শোষিত পদার্থের পরিমাণ নথিভুক্ত করতে লাগল। প্রাথমিক দিনগুলোতে অনেক চ্যালেঞ্জ এসেছে—শৈবাল ঠিকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে না, কখনও কখনও অতিরিক্ত সাপ্লিমেন্ট দিলে তার কার্যকারিতা কমে যাচ্ছিল। তবে ঈশানি ও রুদ্র প্রতিটি ব্যর্থতার মধ্যেও শিখছিল, সমাধান খুঁজে বের করছিল। প্রতিটি ক্ষুদ্র অগ্রগতি তাদের মনোবল বাড়াচ্ছিল।

অবশেষে এক গভীর রাতের পর তারা প্রথম কার্যকরী মডেল তৈরি করতে সক্ষম হলো। শৈবালগুলি রিঅ্যাক্টরের ভেতরে স্থিতিশীলভাবে বেড়ে উঠছে, জলের রাসায়নিক দূষণ কমে আসছে এবং পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী ফিল্টারিং প্রক্রিয়া কার্যকর হচ্ছে। ঈশানি তার ডায়েরিতে লিখল, “নতুন উদ্ভাবনের আলো দেখছি—অন্ধকারের পরই সত্যিকারের উজ্জ্বলতা।” রুদ্রও আনন্দে হাততালি দিল, এবং দু’জনে বুঝল, ব্যর্থতার পরিশ্রমই এই সাফল্যের মূল। এই নতুন মডেল কেবল একটি প্রযুক্তিগত সাফল্য নয়, বরং তাদের অধ্যবসায়, ধৈর্য এবং সৃজনশীলতার ফল। রাতের নীরব ল্যাব, ঝলমল আলো, বৃষ্টির শব্দ বাইরে—সব মিলিয়ে তাদের মনে এক নতুন উদ্দীপনা এবং সম্ভাবনার ছাপ রেখে গেল। ঈশানি বুঝতে পারল, এই আবিষ্কার শুধু নদীকে বাঁচাবে না, তার নিজের জীবনের স্বপ্নকেও সত্যি করার পথে নতুন দিশা দেখাবে।

অধ্যায় ৮ : আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির পথে

ঈশানি ও রুদ্রের ল্যাবের রাতভর চেষ্টা এবং উদ্ভাবনের পরিশ্রম অবশেষে আন্তর্জাতিক মঞ্চে পৌঁছাল। তাদের বায়ো-ফিল্টার প্রযুক্তি নিয়ে একটি পেপার নির্বাচিত হয় একটি প্রখ্যাত আন্তর্জাতিক পরিবেশ বিজ্ঞান সম্মেলনে উপস্থাপনার জন্য। বিমানবন্দর, ল্যাবের যন্ত্রপাতি, শৈবালের নমুনা—সবকিছু নিয়ে দু’জন দীর্ঘ প্রস্তুতির মধ্য দিয়ে গেল। পেপারের উপস্থাপনায় ঈশানি দাঁড়িয়ে জোরালো কণ্ঠে প্রযুক্তির বৈজ্ঞানিক ভিত্তি, শৈবালের কার্যকারিতা এবং প্রোটোটাইপের সফল ফলাফল উপস্থাপন করল। বিদেশি বিজ্ঞানীরা মনোযোগ দিয়ে শুনল, প্রশ্ন করল, এবং প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর ঈশানি ও রুদ্র উদ্ভাবনীভাবে দিল। প্রতিটি প্রশ্নের পরে শ্রোতাদের প্রশংসা, বাহবা, এবং উৎসাহের ঝলক তাদের মনে এক নতুন আশা জন্ম দিল। বিশেষত কিছু বিদেশি গবেষক তাদের ল্যাব ভিজিট করতে আগ্রহ দেখালেন, যাতে আরও গভীরভাবে এই প্রযুক্তির কার্যকারিতা দেখা যায়। সেই সম্মেলন শুধু একটি পেপার উপস্থাপন নয়, বরং তাদের গবেষণার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি, বৈজ্ঞানিক মর্যাদা এবং ভবিষ্যতের সম্ভাবনার এক নতুন দরজা খুলে দিল। অনেক গবেষক আগ্রহ প্রকাশ করল, এবং ধীরে ধীরে তারা এই প্রযুক্তির ওপর গবেষণার জন্য নতুন অনুদান ও সহযোগিতার প্রস্তাব পেতে শুরু করল।

কিন্তু আন্তর্জাতিক প্রশংসার এই উচ্ছ্বাসের সঙ্গে দেশীয় বাস্তবতার চাপও ক্রমশ স্পষ্ট হতে লাগল। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও স্থানীয় সরকারি সংস্থা অনুপ্রেরণার বদলে নিয়মকানুন ও বেজায় জটিলতার মধ্য দিয়ে পথ বাধা দিচ্ছিল। পেটেন্টের প্রক্রিয়া, পরিবেশ অনুমোদন, বাজেট বরাদ্দ—সবকিছু ছিল কঠিন, ধীর এবং সময়সাপেক্ষ। কখনও কখনও মনে হতো যে প্রযুক্তি যতই কার্যকর হোক, এই আমলাতান্ত্রিক কাঠামো সেটিকে বাস্তবায়নে বাধা দিচ্ছে। দলের মধ্যে কিছু সদস্য হতাশ হয়ে ভাবতে লাগল যে আন্তর্জাতিক সম্মেলনে সাফল্য সত্ত্বেও দেশে বাস্তবায়ন প্রায় অসম্ভব। ল্যাবের ছোট ছোট যন্ত্রপাতি, রেকর্ডিং, এবং গবেষণার প্রমাণ কাগজে থাকলেও দেশীয় প্রশাসনের ধীর প্রক্রিয়া প্রকল্পকে বিপদে ফেলছিল। ঈশানি রাতে নিজের ডায়েরিতে লিখল, “বহু মানুষ এই সাফল্যকে বাহবা দিচ্ছে, কিন্তু প্রকৃত চ্যালেঞ্জ শুরু হবে এখান থেকে। বিজ্ঞান শুধু পুরস্কার নয়, প্রয়োগের ক্ষমতাও চাই।”

এই জটিলতার মধ্যে ঈশানি ও রুদ্র সিদ্ধান্ত নিলেন—ভেতরের হতাশাকে একপাশে রেখে, বাস্তবায়নের জন্য কৌশল তৈরি করতে হবে। তারা শুরু করল সরকারের বিভিন্ন সংস্থা, এনজিও এবং স্থানীয় পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে যোগাযোগ। খুঁজতে লাগল এমন মানুষ, যারা প্রযুক্তির কার্যকারিতা স্বীকৃতি দিতে পারে এবং প্রয়োগের জন্য প্রয়োজনীয় অনুমোদন সহজ করতে পারে। সেই ল্যাবের নিরব রাতগুলোতে, দু’জন বসে নোটবুকে নতুন পরিকল্পনার খসড়া তৈরি করল—যেভাবে দেশীয় প্রশাসনের জটিলতা অতিক্রম করা যাবে, কীভাবে স্থানীয় নদী সংরক্ষণ প্রকল্পের সঙ্গে প্রযুক্তি সংযুক্ত করা যাবে। আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি তাদের জন্য অনুপ্রেরণা হলেও বাস্তবায়নের জটিলতা স্পষ্ট করে দিল যে, বিজ্ঞান শুধু উদ্ভাবনের নাম নয়; এটি কৌশল, ধৈর্য এবং সমাজের মধ্যে চলমান নীতি-নীতি বোঝারও নাম। রাতের অন্ধকারে ল্যাবের ফ্লুরোসেন্ট আলোয় ঈশানি নিজের ডায়েরিতে লিখল, “স্বীকৃতি যতই বড় হোক, প্রকৃত সাফল্য হবে তখনই, যখন এই প্রযুক্তি নদীর জলকে পরিষ্কার করবে। বাধা যতই বড়, আমরা হাল ছাড়ব না।” এই সংকল্প, আন্তর্জাতিক প্রশংসা এবং দেশীয় বাস্তবতার চ্যালেঞ্জের মধ্যে জন্ম নিল নতুন উদ্দীপনা, যা প্রকল্পকে বাস্তবায়নের পথে আরও দৃঢ়ভাবে এগিয়ে নিল।

অধ্যায় ৯ : চূড়ান্ত পরীক্ষা

শীতের এক সকালে, নদীর ধারে নির্দিষ্ট একটি ঘাটে চূড়ান্ত পরীক্ষার প্রস্তুতি চলছিল। ঈশানি ও রুদ্র দীর্ঘদিন ধরে যে বায়ো-ফিল্টার প্রযুক্তির উপর কাজ করছিলেন, সেটি এবার বাস্তব নদীতে বসিয়ে দেখা হবে। ল্যাবের নিয়ন্ত্রিত পরিবেশ থেকে বেরিয়ে আসা প্রযুক্তি এখন প্রকৃত গঙ্গার সঙ্গে মিলিত হতে যাচ্ছিল। স্থানীয় প্রশাসন, পরিবেশবিদ এবং কিছু বিজ্ঞানী এই পরীক্ষায় উপস্থিত ছিলেন। নদীর জলের নমুনা, শৈবালের ছোট ছোট কলোনি, বিশেষ রিঅ্যাক্টর—সব কিছু পর্যবেক্ষণ এবং মাপের জন্য প্রস্তুত। ঈশানি, ল্যাব কোট আঁকিয়ে, হাতের গ্লাভস পরিয়ে, নদীর ধারের ঠান্ডা বাতাসে দাঁড়িয়ে তার হৃদয় দ্রুত ধড়ধড় করতে লাগল। বহু রাত জেগে গবেষণা, শত শত ব্যর্থতা এবং অনিশ্চয়তার পর এই মুহূর্তটি যেন তার স্বপ্নের পূর্ণতা। রুদ্রও পাশে দাঁড়িয়ে ছিল, নির্দিষ্ট যন্ত্রাংশ পরীক্ষা করছিল, এবং প্রতিটি কাজ মনোযোগ দিয়ে যাচাই করছিল। ফিল্টার নদীতে স্থাপন করার সময়, ঈশানি নিজেকে সমস্ত দ্বিধা, আতঙ্ক এবং প্রতিকূলতার উপরে দাঁড়িয়ে অনুভব করল।

ফিল্টার চালু হওয়ার পর প্রথম কয়েক ঘণ্টা ছিল সবচেয়ে অস্থির। নদীর জলের ধারা ধীরে ধীরে বায়ো-ফিল্টারের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হতে লাগল। শুরুতে পরিবর্তন দৃশ্যমান হয়নি, এবং ছোট ছোট সংশয় আবার ভেতরে জন্ম নিল—অবশ্য কি সব দিনের পরিশ্রম বৃথা হয়েছে? কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ধীরে ধীরে দেখা গেল, জলের রঙ হালকা স্বচ্ছ হতে শুরু করেছে। ছোট ছোট ধুলো-কণা, ভারী ধাতুর চিহ্ন ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে, এবং শৈবালগুলি তার কার্যকারিতা দেখাচ্ছে। স্থানীয় প্রশাসন এবং উপস্থিত বিজ্ঞানীরা অবাক চোখে পর্যবেক্ষণ করল। ঈশানি নীরবে নদীর জলের ধারা লক্ষ্য করছিল, তার চোখে আনন্দের জল ওঠা। বহু দিনের ব্যর্থতা, রাত জেগে গবেষণা এবং চাপের মধ্য দিয়ে অর্জিত এই সফলতা যেন তাকে নতুন শক্তি প্রদান করল। রুদ্রও হাঁপিয়ে হলেও হেসে বলল, “শেষমেশ আমরা সফল হয়েছি।” নদীর ছন্দময় প্রবাহ, হালকা বাতাস, এবং দূর থেকে পাখির ডাক—সব মিলিয়ে সেই মুহূর্তটি ঈশানির কাছে এক আবেগময় দৃশ্য হয়ে উঠল।

পরীক্ষার খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল। সংবাদমাধ্যমে শিরোনাম এল—“এক তরুণী বিজ্ঞানীর বিপ্লবী আবিষ্কার।” টেলিভিশন, অনলাইন নিউজ, এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় সবাই আলোচনা করতে শুরু করল। দেশের বড় বড় পত্রিকায় কভার স্টোরি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে স্বীকৃতি, এবং পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য সমর্থন—সবই ঈশানি ও রুদ্রের দিকে আসতে শুরু করল। ঘাটের স্থানীয় মানুষও উৎসাহিত হলেন, নদীর স্বচ্ছতার প্রমাণ দেখে। তবে ঈশানি জানত, এই মুহূর্ত শুধুমাত্র প্রচারণা নয়; প্রকৃত পরীক্ষা এখনো চলতে থাকবে, প্রযুক্তি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত স্থায়ীভাবে কার্যকর থাকবে কি না তা দেখার প্রয়োজন। কিন্তু অন্তত সেই দিন, বহু দিনের পরিশ্রমের ফসল তাদের হাতে দৃশ্যমান হয়ে দাঁড়াল—নদীর জলে সত্যিকারের পরিবর্তন। তিনি ডায়েরিতে লিখলেন, “আজ স্বপ্ন বাস্তব। বিজ্ঞানই আমার ভালোবাসা, এবং এই ভালোবাসা মানুষের জীবনে পরিবর্তন আনতে সক্ষম।” রাতের ল্যাবের আলো, নদীর শান্ত প্রবাহ এবং সংবাদমাধ্যমের আলোড়ন—সব মিলিয়ে চূড়ান্ত পরীক্ষার দিনটি ঈশানি ও রুদ্রের জীবনে এক স্মরণীয় অধ্যায় হয়ে রইল।

অধ্যায় ১০ : স্বপ্নের জয়

ঈশানি ও রুদ্রের বহু বছরের পরিশ্রম এবং অন্তহীন অধ্যবসায় অবশেষে সরকারের নজরে আসে। কেন্দ্রীয় পরিবেশ মন্ত্রক এবং নদী সংরক্ষণ সংক্রান্ত উচ্চপর্যায়ের কমিটি তাদের বায়ো-ফিল্টার প্রযুক্তি মূল্যায়ন করে, এবং প্রমাণিত হয় যে এটি শুধুমাত্র পরীক্ষাগারে নয়, বাস্তব নদীর জন্যও কার্যকর। কয়েক মাসের মীমাংসা, স্থানীয় প্রশাসন এবং বিশেষজ্ঞদের পরামর্শের পর সরকার প্রকল্পটিকে বৃহত্তর পরিসরে অনুমোদন দেয়। রাজধানী কলকাতা থেকে শুরু করে নদীর বিভিন্ন প্রবাহে এই প্রযুক্তি বসানোর পরিকল্পনা করা হয়। দেশের বিভিন্ন শহর থেকে বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলীরা ল্যাব ভিজিট করতে আসতে শুরু করে। ঈশানি, যিনি আগের দিনে রাত জেগে পরীক্ষার ফলাফল নথিভুক্ত করতেন, এখন দেশের গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক প্রকল্পের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তার চোখে সেই বহু রাতের পরিশ্রমের প্রতিফলন, যে রাতগুলোতে ক্লান্তি, হতাশা এবং সামাজিক চাপে ভুগেছিল, আজ তার স্বপ্নকে বাস্তব রূপ দিতে সাহায্য করছে।

জাতীয় স্বীকৃতি এবং পুরস্কারের মুহূর্তও আসল। পরিবেশ এবং বিজ্ঞান ক্ষেত্রে অসাধারণ অবদানের জন্য ঈশানি জাতীয় পুরস্কার পান। দেশের বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান থেকে তরুণ বিজ্ঞানীরা তাকে অনুসরণ করতে শুরু করে। বিভিন্ন সেমিনার, ওয়ার্কশপ এবং অনুপ্রেরণামূলক আলোচনায় তিনি উপস্থিত হয়ে তাদের জানাতে পারেন যে, “বিজ্ঞান শুধু সূত্র আর পরীক্ষার নাম নয়, এটি অধ্যবসায়, সাহস এবং সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতার নাম।” সংবাদমাধ্যম, টেলিভিশন, অনলাইন নিউজ এবং সোশ্যাল মিডিয়া—সব জায়গায় তার গল্প ছড়িয়ে পড়ে। শুধুমাত্র প্রযুক্তিগত সাফল্য নয়, তরুণীদের জন্য উদাহরণ হয়ে দাঁড়ানো তার সবচেয়ে বড় অর্জন। যারা আগে তাকে উপেক্ষা করত, পরিবার এবং আত্মীয়রা আজ গর্বিত চোখে তাকায়। কিন্তু ঈশানি জানে, প্রকৃত পুরস্কার হল সেই নদীর স্বচ্ছ জল, যেটি বহু দিনের চেষ্টা এবং আত্মত্যাগের প্রতিফলন।

সমাপনী দৃশ্যে, বিকেলের নরম আলোয় ঈশানি গঙ্গার তীরে দাঁড়িয়ে নদীর জল লক্ষ্য করছিল। বাতাসে হালকা আর্দ্রতা, দূরে হাঁসের ডাক এবং নদীর ধীরে ধীরে চলা প্রবাহ—সব মিলিয়ে যেন একটি শান্ত, নতুন পৃথিবীর প্রতীক। সে নীরবে দাঁড়িয়ে নদীর জলের দিকে তাকাল, মনে করল, প্রতিটি ব্যর্থতা, প্রতিটি রাত জেগে কাজ, সামাজিক ও পেশাগত প্রতিবন্ধকতা—সব মিলিয়ে এই মুহূর্তের জন্যই ছিল। ধীরে ধীরে সে বলল, “বিজ্ঞান শুধু গবেষণার গল্প নয়, এটি মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতার পথ।” এই কথাগুলো তার ভেতরের ভাবনা, অনুভূতি এবং দৃঢ় সংকল্পের প্রকাশ। আশেপাশে উপস্থিত তরুণ গবেষকরা তাকে অনুপ্রেরণা হিসেবে দেখছিল। নদীর স্বচ্ছ জলে তার ছায়া প্রতিফলিত হচ্ছিল, আর সেই প্রতিফলন যেন এক প্রতিশ্রুতি—যে কোনো বিপত্তি, সামাজিক প্রতিবন্ধকতা, বা ব্যর্থতা অতিক্রম করে, অধ্যবসায় ও সংকল্প সত্যিই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে পারে। এই মুহূর্তে ঈশানি বুঝল, তার জীবন, তার গবেষণা, এবং তার স্বপ্ন—সবই এক সঙ্গে জয়লাভ করেছে।

____

1000068579.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *