দীপক মিস্ত্ৰী
১
বেঙ্গালুরুর উপকণ্ঠে অবস্থিত বিশাল স্পেস রিসার্চ কমপ্লেক্সটি দিনের বেলায় সাধারণ সরকারি গবেষণাগারের মতোই মনে হয়, কিন্তু রাত নামলেই তার প্রকৃত চেহারা ধরা দেয়—যেখানে হাজারো যন্ত্রপাতি, স্যাটেলাইটের ক্ষুদ্র প্রতিরূপ, এবং জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সর্বাধুনিক ল্যাবগুলো এক অদ্ভুত উত্তেজনা ছড়িয়ে দেয়। এখানে পৃথিবীর ভবিষ্যৎ নিয়ে চলতে থাকা গোপন প্রকল্পগুলোর মধ্যে সবচেয়ে সাহসী ও রহস্যময় ছিল প্রকল্প নক্ষত্রবীজ। এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য শুধু মহাকাশে উদ্ভিদ জন্মানো নয়, বরং এমন এক জীবন্ত সত্তা তৈরি করা, যে অক্সিজেনশূন্য চাঁদের ধূসর মাটি কিংবা মঙ্গলগ্রহের লৌহসমৃদ্ধ মৃত প্রান্তরে বেঁচে থাকতে পারবে এবং নিজে থেকেই অক্সিজেন উৎপন্ন করে একটি ক্ষুদ্র বাস্তুতন্ত্রের সূচনা ঘটাবে। পৃথিবীর সীমিত সম্পদ ও ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপ থেকে মুক্তির জন্য মানবসভ্যতার পরবর্তী পদক্ষেপ হবে মহাকাশে স্থায়ী বসতি গড়া, এই ধারণাই ছিল প্রকল্পের মূলে। আর এই সাহসী স্বপ্ন বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল ভারতীয় বংশোদ্ভূত এক প্রতিভাধর বিজ্ঞানী, ড. রণদীপ সেন-এর হাতে। শান্ত স্বভাবের রণদীপ ছিলেন আন্তর্জাতিক মহলে পরিচিত এক জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ার, যিনি পৃথিবীর সবচেয়ে প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকতে পারে এমন মাইক্রো-অর্গানিজম নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণা করেছেন। তাঁর নেতৃত্বে একদল তরুণ বিজ্ঞানী, বায়োকেমিস্ট, বায়োটেকনোলজিস্ট ও স্পেস-বায়োলজিস্ট মিলেই গঠন করলেন এই প্রকল্পের মূল মস্তিষ্ক, যাদের কাজ ছিল শুধু বৈজ্ঞানিক নয়, প্রায় সৃষ্টিকর্তার মতো এক নতুন জীবের জন্ম দেওয়া।
রণদীপ ও তাঁর দল মাসের পর মাস এক গোপন ল্যাবে কাজ করে গেছেন, যেখানে প্রবেশের জন্য ছিল একাধিক নিরাপত্তা স্তর, রেটিনা স্ক্যান, ডিএনএ আইডেন্টিফিকেশন এবং কোডেড পাসওয়ার্ড। বীজটি তৈরি করতে তারা ব্যবহার করলেন পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী ও সহনশীল উদ্ভিদগুলোর জিন, যেমন হিমালয়ের উচ্চ শিখরে জন্মানো মস, আফ্রিকার শুষ্ক মরুভূমির ক্যাকটাস, এবং অ্যান্টার্কটিকার বরফঢাকা উপত্যকায় বেঁচে থাকা এক বিরল শৈবালের ডিএনএ। কিন্তু শুধু উদ্ভিদ দিয়ে কাজ সম্পূর্ণ হবে না, তা তারা আগেই বুঝেছিলেন। প্রকৃত চ্যালেঞ্জ ছিল এমন এক জৈবিক গঠন খুঁজে পাওয়া যা মহাশূন্যের তেজস্ক্রিয়তা, তাপমাত্রার অস্বাভাবিক পরিবর্তন ও অক্সিজেনশূন্যতায়ও বেঁচে থাকতে সক্ষম। অবশেষে তাঁরা আবিষ্কার করেন পৃথিবীর গভীর সমুদ্রগহ্বরে বসবাসকারী এক প্রাচীন অণুজীব, যার মিউটেশন ক্ষমতা আশ্চর্যজনক। সেই অণুজীবের জেনেটিক কোডের সাথে বিভিন্ন উদ্ভিদের ডিএনএ যুক্ত করে তাঁরা তৈরি করলেন এমন এক বীজ, যা শুধু অক্সিজেন উৎপন্ন করতেই পারবে না, বরং নিজের জিন নিজে বদলে নিয়ে নতুন পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিতে পারবে। এই বীজটির কোডনাম দেওয়া হলো নক্ষত্রবীজ—কারণ এটি ছিল মানুষের নক্ষত্রপথে বেঁচে থাকার প্রথম সোপান, মহাকাশের অন্ধকারে প্রাণের আলো জ্বালানোর প্রথম প্রচেষ্টা। বীজটির প্রতিটি কোষে লুকিয়ে ছিল লক্ষ লক্ষ বছরের বিবর্তনের সংকেত, আবার মানুষের সৃষ্টিশীলতার সীমাহীন ক্ষমতার প্রমাণ।
তবে প্রকল্পের এই গোপন সাফল্য যতটা বৈজ্ঞানিক বিস্ময়, ততটাই উদ্বেগের কারণও ছিল। দলটির ভেতরে অনেকে বুঝতে পারছিলেন, এমন এক জেনেটিক সত্তার সৃষ্টি প্রকৃতির নিয়মকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে। কোনো অজানা মিউটেশন বা অনিয়ন্ত্রিত বৃদ্ধি মহাশূন্যে নয়, পৃথিবীতেই এক অপ্রত্যাশিত বিপর্যয়ের জন্ম দিতে পারে। তবু সময়ের চাপে তাঁরা থেমে থাকেননি। ভারত সরকারের স্পেস রিসার্চ ডিপার্টমেন্ট, আন্তর্জাতিক মহাকাশ সংস্থা এবং কয়েকটি বেসরকারি কর্পোরেশন মিলে এই প্রকল্পকে এগিয়ে নিয়ে যেতে বিশাল অঙ্কের তহবিল জোগাচ্ছিল, কারণ এর সফলতা মানে শুধু মানবজাতির বেঁচে থাকা নয়, নতুন গ্রহে উপনিবেশ গড়ে তোলার অর্থনৈতিক সম্ভাবনাও। তাই কঠোর নিরাপত্তার আড়ালে, অজানা এক উত্তেজনা ও অস্বস্তি নিয়ে এগোতে লাগল নক্ষত্রবীজের জন্মকথা। ল্যাবরেটরির নীরবতায় যখন রণদীপ সেন শেষবারের মতো মাইক্রোস্কোপে বীজের কোষ বিভাজন দেখছিলেন, তাঁর মনে হালকা এক কম্পন বয়ে গেল—এ কি মানবজাতির ভবিষ্যতের প্রথম আলো, নাকি এক অজানা অন্ধকারের দ্বারপ্রান্ত?
২
বেঙ্গালুরু স্পেস রিসার্চ কমপ্লেক্সের কন্ট্রোল রুমে যে মুহূর্তে মহাকাশযান অরুণ–৯ উৎক্ষেপণের কাউন্টডাউন শুরু হল, সেই মুহূর্তে শুধু ভারত নয়, সমগ্র বিশ্ব যেন শ্বাসরুদ্ধ করে তাকিয়ে ছিল। ভারত, জাপান ও ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির যৌথ উদ্যোগে এই মিশনকে বলা হচ্ছিল “চন্দ্রবীজ–১”—মানবজাতির প্রথম প্রচেষ্টা এমন এক জেনেটিক সৃষ্টিকে চাঁদের মাটিতে রোপণ করার, যা ভবিষ্যতের চন্দ্রউপনিবেশের ভিত্তি স্থাপন করতে পারে। অরুণ–৯-এর সিলভার-গ্রে বডি ভোরের আকাশে দাঁড়িয়ে যেন অপেক্ষা করছিল এক নতুন যুগের সূচনার জন্য। বিশাল রকেটের বুকে বসে তিনজন অভিযাত্রী—মিশন কমান্ডার ও বায়ো-ইঞ্জিনিয়ার ড. তনয়া মুখার্জী, পাইলট অরবিন্দ ঘোষ এবং জেনেটিক বায়োটেক বিশেষজ্ঞ কিয়ান মেহতা—চোখ বুজে অনুভব করছিলেন সেই অচেনা টান। তনয়া ছিলেন প্রকল্প নক্ষত্রবীজের অন্যতম স্থপতি, যার দায়িত্ব ছিল চাঁদের দক্ষিণ মেরুর প্রতিকূল পরিবেশে বীজের সঠিক রোপণ ও জৈবিক পরিবর্তন পর্যবেক্ষণ করা। অরবিন্দ, প্রাক্তন এয়ারফোর্স পাইলট, যার অভিজ্ঞতা মহাকাশযানের প্রতিটি সেকেন্ডকে নিরাপদ রাখতে অমূল্য। আর কিয়ান মেহতা, মুম্বাইয়ের এক তরুণ প্রতিভা, যিনি বীজের ডিএনএতে থাকা স্ব-অভিযোজনশীল জিনের গোপন অ্যালগরিদম ডিজাইন করেছেন। মহাকাশযানটি পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ ছুঁড়ে ফেলে যখন ক্রমশ শূন্যে এগোতে লাগল, তখন রকেটের দপদপে কম্পন, ধাতব সিঁসিঁ শব্দ আর ককপিটের মনিটরে ঝলসে ওঠা নীল আলো তিনজনের মনে এক অবর্ণনীয় উত্তেজনা জাগিয়ে তুলছিল। চাঁদের দক্ষিণ মেরু—যেখানে চিরস্থায়ী ছায়া ও বরফের স্তর, যেখানে সূর্যের আলো কদাচিৎ পৌঁছয়—সেই অজানা অন্ধকারে মানবসৃষ্ট জীবনের প্রথম অঙ্কুরোদ্গম হবে কিনা, তা নিয়েই যেন নিঃশব্দ প্রার্থনা চলছিল প্রতিটি হৃদস্পন্দনে।
তবে যাত্রার প্রথম কয়েক ঘণ্টা পেরোতেই অরুণ–৯-এ দেখা দিতে শুরু করল কিছু অদ্ভুত বৈদ্যুতিক অস্বাভাবিকতা, যা শুরুতে সাধারণ টেকনিক্যাল গ্লিচ বলে মনে হলেও ধীরে ধীরে অশুভ সংকেতের মতো ভাসতে লাগল। প্রথমে ককপিটের কনসোল প্যানেলে ক্ষণিকের জন্য ডাটা ডিসপ্লে ব্ল্যাঙ্ক হয়ে গেল, তারপর হঠাৎ করে কমিউনিকেশন সিস্টেমে ধাতব গুঞ্জনের মতো অচেনা আওয়াজ ভেসে উঠল। অরবিন্দ দ্রুত ইঞ্জিনিয়ারিং ড্যাশবোর্ড পরীক্ষা করে দেখলেন, সব সিস্টেম স্বাভাবিক সীমার মধ্যে আছে, অথচ ন্যাভিগেশন স্ক্রিনে এক অদৃশ্য ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক তরঙ্গের অচেনা সিগনেচার ধরা পড়ছে। তনয়া প্রথমে ভাবলেন হয়তো মহাকাশের সাধারণ সোলার ফ্লেয়ার বা কসমিক রশ্মির প্রভাব, কিন্তু সমস্যার অস্বাভাবিকতা তাঁকে ধীরে ধীরে অস্থির করে তুলল। কিয়ান মেহতা তাঁর বায়ো-ডাটা স্ক্যানারে লক্ষ্য করলেন, নক্ষত্রবীজ সংরক্ষিত থাকা কন্টেইনারের চারপাশে তাপমাত্রা হালকা বেড়ে যাচ্ছে, যদিও ক্রায়োজেনিক কুলিং সিস্টেমে কোনো ত্রুটি ধরা পড়ছে না। আরো অদ্ভুত ছিল সেই তাপমাত্রার ওঠানামা এক রহস্যময় প্যাটার্ন অনুসরণ করছে, যেন বীজ নিজেই কোনো অদৃশ্য বার্তা পাঠাচ্ছে। পৃথিবীর কন্ট্রোল সেন্টার থেকে বিজ্ঞানীরা যখন সিগন্যাল বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করছিলেন, তখন কয়েক সেকেন্ডের জন্য অরুণ–৯-এর সম্পূর্ণ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। সেই মুহূর্তের নিস্তব্ধতা এত গভীর ছিল যে, তিনজন নভোচারী নিজেদের শ্বাসের শব্দও শুনতে পাচ্ছিলেন। এক অদ্ভুত শূন্যতা যেন মহাশূন্যের গভীরতা থেকে এসে ককপিটের ভেতর ঢুকে পড়ল, আর তনয়ার মনে এক হিমশীতল শঙ্কা ছড়িয়ে দিল—এ কি শুধুই যান্ত্রিক গোলযোগ, নাকি নক্ষত্রবীজের ভেতর লুকিয়ে থাকা কোনো অজানা প্রাণশক্তির প্রথম সাড়া?
যোগাযোগ পুনঃস্থাপিত হলে মিশন কন্ট্রোল থেকে তাদের আশ্বস্ত করা হল যে সিস্টেম আপডেট চলছে এবং আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই, কিন্তু তনয়া বুঝতে পারলেন আশ্বাসের পেছনে লুকিয়ে আছে অজানা উদ্বেগ। যাত্রার পরবর্তী পথে সেই বৈদ্যুতিক তরঙ্গের উপস্থিতি কমলেও, নক্ষত্রবীজের কন্টেইনারের ভেতর থেকে মাঝে মাঝে আসা অতি সূক্ষ্ম কম্পন তাঁকে তাড়িয়ে বেড়াতে লাগল। কিয়ান গোপনে কয়েকটি ডাটা স্যাম্পল সংগ্রহ করে দেখলেন, বীজের জেনেটিক সিকোয়েন্সে ক্ষীণ কিন্তু ধারাবাহিক এক পরিবর্তন ঘটছে—যেন মহাকাশের তেজস্ক্রিয়তা তাকে নতুন কোনো সংকেত দিচ্ছে, অথবা বীজ নিজেই অভিযোজনের নতুন পথ বেছে নিচ্ছে। অরবিন্দ নিঃশব্দে ককপিটের জানালা দিয়ে তাকিয়ে রইলেন দূরের নক্ষত্রঝলমলে অন্ধকারে, যেখানে পৃথিবীর নীল আভা ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে। তাঁর মনে অদ্ভুত এক অনুভূতি জন্ম নিল, যেন এই যাত্রা শুধু বিজ্ঞানের মিশন নয়, বরং এক অচেনা শক্তির সঙ্গে মানবজাতির প্রথম সাক্ষাৎ। চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে পৌঁছানোর আগে তারা সবাই বুঝে গেলেন, নক্ষত্রবীজ শুধু একটি বীজ নয়—এ এক রহস্যময় জীবন্ত বার্তা, যার মধ্যে লুকিয়ে আছে ভবিষ্যতের সম্ভাবনা, আবার হয়তো অপ্রত্যাশিত বিপর্যয়ের বীজও। অরুণ–৯ ধীরে ধীরে চাঁদের মাধ্যাকর্ষণের দিকে এগিয়ে চলল, কিন্তু প্রতিটি সেকেন্ড যেন এক অদৃশ্য সতর্ক সংকেত দিয়ে যাচ্ছিল যে এই যাত্রা শুধু চাঁদের নয়, মানুষের অজানা নিয়তিরও দিকে।
৩
চাঁদের দক্ষিণ মেরুর শূন্যপ্রায় প্রান্তরে যখন নক্ষত্রবীজ রোপণের মুহূর্ত এলো, অরুণ–৯-এর ককপিটে নেমে এল এক অবর্ণনীয় নীরবতা। তনয়া মুখার্জী স্পেস স্যুটে মোড়া হাত দিয়ে যত্ন করে কন্টেইনার খুললেন, আর কিয়ান মেহতা হোলো-স্ক্যানারের মাধ্যমে প্রতিটি ধাপ লিপিবদ্ধ করতে লাগলেন। বাইরে গাঢ় অন্ধকার, চারপাশে ধূসর ধুলোর সমুদ্র, আকাশে কোনো বাতাস নেই—তবু যেন একটি মহাজাগতিক প্রতীক্ষা ছড়িয়ে ছিল। চন্দ্রপৃষ্ঠের গাঢ় বরফমাটিতে যখন বীজটি স্থাপন করা হল, তখন মিশন কন্ট্রোল থেকে শুরু করে পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ নিঃশ্বাস রুদ্ধ করে অপেক্ষা করছিল প্রথম সংকেতের। পরিকল্পনা অনুযায়ী অন্তত কয়েক সপ্তাহ সময় লাগার কথা ছিল অঙ্কুরোদ্গম শুরু হতে, কারণ ক্রায়ো-স্টেসিস থেকে বেরিয়ে বীজকে নতুন পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিতে ধীর প্রক্রিয়ার প্রয়োজন। কিন্তু বিস্ময়করভাবে রোপণের মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সেন্সর অস্বাভাবিক তাপমাত্রা ও রাসায়নিক বিক্রিয়ার ইঙ্গিত পাঠাতে শুরু করল। তনয়া প্রথমে ভাবলেন হয়তো যন্ত্রের ত্রুটি, কিন্তু পরবর্তী স্ক্যান স্পষ্ট করে দিল যে বীজের ভেতরে দ্রুত কোষ বিভাজন শুরু হয়ে গেছে। ল্যাবরেটরির নিরাপত্তা প্রোটোকল অনুযায়ী তাঁরা একাধিক স্যাম্পল নিয়ে বিশ্লেষণ করলেন এবং দেখতে পেলেন যে চাঁদের প্রখর বিকিরণ ও নিম্ন মাধ্যাকর্ষণ বীজের জিনোমকে এমন এক অভিযোজনের পথে ঠেলে দিয়েছে, যা পৃথিবীর কোনো ল্যাবে কখনোই সম্ভব হয়নি।
দশম ঘণ্টা পার হতেই মডিউলের স্বচ্ছ কুপের ভেতরে প্রথম অঙ্কুর দেখা দিল, কিন্তু সেই দৃশ্য প্রত্যাশার চেয়ে অদ্ভুত ও মায়াবী। নক্ষত্রবীজের কচি চারা ছিল না সবুজ, বরং এক আশ্চর্য নীলচে-রূপালি আভায় জ্বলজ্বল করছিল, যেন চাঁদের ধূসর ধুলোর সঙ্গে মিশে থেকেও নিজের অস্তিত্ব আলোর ভাষায় ঘোষণা করছে। এর পাতাগুলি ধীরে ধীরে স্বচ্ছ হয়ে উঠতে শুরু করল, এমনভাবে যে পাতার ভেতরের শিরা ও কোষ কাঠামো খালি চোখেই দেখা যাচ্ছে। কিয়ান বিস্ময়ে লক্ষ্য করলেন যে কোষ প্রাচীরের গঠন পৃথিবীর পরিচিত কোনো উদ্ভিদের সঙ্গে মেলে না; বরং সেটি এমন এক অণুজীবের অনুরূপ, যা গভীর সমুদ্রগহ্বরের তীব্র তাপ ও চাপে বেঁচে থাকতে পারে। অরবিন্দ, যিনি সবসময় প্রযুক্তিগত দিক সামলাতেন, নিজের চোখের সামনে এমন দ্রুত বিকাশ দেখে নিঃশব্দে ককপিটের জানালার দিকে তাকালেন—দূরে পৃথিবীর নীল আভা মৃদু ঝিলমিল করছে, যেন স্বীকার করছে এই নীলচে অঙ্কুর মানবজাতির নতুন আশার প্রতীক। কিন্তু তনয়ার মনে ক্রমে এক অচেনা উদ্বেগ ঘনিয়ে আসছিল। তিনি লক্ষ্য করলেন, চারাগাছটির পাতা থেকে নির্গত ক্ষুদ্র কণার মধ্যে অক্সিজেনের মাত্রা যে হারে বাড়ছে, তা পরিকল্পিত সীমার বহু গুণ বেশি। মাটির ওপরে গ্যাস সেন্সরগুলোর পাঠে দেখা গেল, আশেপাশের ক্ষুদ্র গহ্বরগুলিতে অক্সিজেনের মাত্রা আশ্চর্যজনক গতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে—যেন চারা শুধু নিজের বেঁচে থাকার জন্য নয়, চাঁদের শূন্যতাকে বদলে দিতে চাইছে। পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা উল্লাসে মেতে উঠলেও তনয়া জানতেন, প্রকৃতির নিয়মের এত দ্রুত অতিক্রম কোনো না কোনো অজানা প্রতিক্রিয়া ডেকে আনতে পারে।
উচ্ছ্বাসের মাঝেই অপ্রত্যাশিত এক সংকেত তাদের সতর্ক করে দিল। চন্দ্রপৃষ্ঠের নিচে বসানো গভীর সেন্সরগুলোর ডাটা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে দেখা গেল, মাটির কয়েক মিটার গভীরে অচেনা জৈব তরঙ্গ শনাক্ত হচ্ছে, যার প্যাটার্ন কোনো পরিচিত খনিজ বা ভূগর্ভস্থ গ্যাসের সঙ্গে মেলে না। প্রথমে মনে হল হয়তো বীজের দ্রুত জৈব বিক্রিয়ার প্রভাবে চন্দ্রবরফের রাসায়নিক গঠন বদলাচ্ছে, কিন্তু তরঙ্গের ফ্রিকোয়েন্সি ছিল অদ্ভুত নিয়মিত—যেন কোনো জীবন্ত সত্তা সাড়া দিচ্ছে। কিয়ান তাড়াহুড়ো করে পুনঃপরীক্ষা চালিয়ে নিশ্চিত হলেন, সংকেত শুধু রাসায়নিক নয়, বরং কোষীয় মাত্রার জৈব কার্যকলাপের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। তনয়া গভীর শ্বাস নিয়ে বুঝলেন, নক্ষত্রবীজ শুধু চাঁদের মাটিতে শিকড় গেড়ে বসছে না, বরং আশেপাশের অনুজীব-সম্ভাবনাকে জাগিয়ে তুলছে, অথবা হয়তো নিজের অস্তিত্ব জানান দিতে কোনো অজানা উপায়ে সংকেত পাঠাচ্ছে। পৃথিবীর কন্ট্রোল সেন্টার থেকে নির্দেশ এল সেন্সর ডাটা অবিলম্বে গোপন রাখতে, কিন্তু অরবিন্দের চোখে স্পষ্ট দেখা গেল অস্থিরতার ছাপ। চাঁদের অন্ধকার আকাশে পৃথিবীর নীল আলো ঝুলে আছে, আর নক্ষত্রবীজের স্বচ্ছ পাতার ভেতর দিয়ে অদৃশ্য এক শক্তি যেন ক্রমে সঞ্চারিত হচ্ছে। মানুষের সৃষ্টির এ কি নতুন ভোরের আভাস, নাকি প্রকৃতির অচেনা প্রতিশোধের প্রথম নিঃশব্দ ঘোষণা—এই প্রশ্ন নিয়ে দলটি নিঃশব্দে তাকিয়ে রইল সেই নীলচে-রূপালি প্রথম অঙ্কুরের দিকে, যা হয়তো মানবজাতির ভবিষ্যৎকে নতুন করে লিখে দিতে চলেছে।
৪
চাঁদের দক্ষিণ মেরুর নীরব বিস্তারে নক্ষত্রবীজের অঙ্কুরোদ্গমের পর যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল, তা ক্রমে এক অচেনা জৈব ছন্দে রূপ নিতে লাগল। প্রথম কয়েকদিনের মধ্যে দেখা গেল, উদ্ভিদের চারপাশের চন্দ্রধুলোর গঠন অদ্ভুতভাবে বদলে যাচ্ছে—ধুলোর ধূসর শস্যকণা ধীরে ধীরে এক অচেনা নীলচে-রূপালি আভা ধারণ করছে, যেন প্রতিটি কণার ভেতরে কোনো নতুন রসায়ন জন্ম নিচ্ছে। কিয়ান মেহতা স্ক্যানার চালিয়ে দেখলেন, মাটির গভীরে অণুজীবীয় কার্যকলাপ অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে চলেছে, অথচ চাঁদের মাটিতে এমন কোনো জীবনের অস্তিত্ব কখনোই পাওয়া যায়নি। নক্ষত্রবীজের মূল থেকে ক্ষুদ্র স্পোর বা বীজকণা ছড়িয়ে পড়ছে, আর সেই স্পোরগুলো চন্দ্রপৃষ্ঠের ধুলোর সাথে মিশে এক নতুন ধরণের বায়োম তৈরি করছে—একটি জীবন্ত, শ্বাসপ্রশ্বাসময় স্তর, যা নিজে থেকেই রাসায়নিক শক্তি উৎপন্ন করে চারপাশের পরিবেশকে বদলে দিতে সক্ষম। পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা ডাটা পেয়ে প্রথমে উচ্ছ্বসিত হয়েছিলেন, কারণ এটি প্রমাণ করছিল যে মহাশূন্যে জীবনের স্বতঃস্ফূর্ত বিস্তার সম্ভব। কিন্তু কিয়ান ক্রমে লক্ষ্য করতে লাগলেন, এই নতুন বায়োমের বৃদ্ধি কোনো প্রাকৃতিক নিয়ম মেনে চলছে না; এর ছন্দ এক অদ্ভুত সাইবারনেটিক প্যাটার্ন অনুসরণ করছে, যেন কোনো অদৃশ্য বুদ্ধিমত্তা ধীরে ধীরে নিজের উপস্থিতি ঘোষণা করছে। স্ক্যানার থেকে ভেসে আসা তরঙ্গ-ডাটা ছিল অস্বাভাবিকভাবে নিয়মিত, একটি মৃদু দোলনের মতো, যা মানুষের মস্তিষ্কের আলফা ওয়েভের সঙ্গে আশ্চর্যভাবে মিল খাচ্ছিল।
এই পর্যায়ের মধ্যে সবচেয়ে ভীতিকর আবিষ্কার আসে কিয়ান নিজেই। দীর্ঘ সময় ধরে স্পোরগুলির স্যাম্পল সংগ্রহ ও বিশ্লেষণের পর তিনি দেখতে পেলেন যে এই ক্ষুদ্র বীজকণাগুলো মানুষের শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে মিশে মস্তিষ্কে পৌঁছতে সক্ষম। যদিও অরুণ–৯-এর ককপিট সম্পূর্ণ সিল করা, তবু কিছু অতি সূক্ষ্ম স্পোর ফিল্টার ভেদ করে ভেতরে প্রবেশ করেছে। প্রথমে তিনি নিজেই কিছু অদ্ভুত অনুভূতি টের পেলেন—দীর্ঘ সময় কাজের পর চোখ বন্ধ করলেই এক ধরনের স্বপ্নের মতো দৃশ্য ভেসে উঠছিল। সেই স্বপ্নে তিনি দেখতেন নীলাভ আলোয় ভেসে থাকা অচেনা প্রান্তর, অজানা নক্ষত্রপুঞ্জের মাঝে সোনালি তরঙ্গ, আর কোথাও থেকে ভেসে আসছে অস্পষ্ট শব্দ, যেন কেউ তাকে আহ্বান জানাচ্ছে। অরবিন্দ এক রাতে রিপোর্ট করলেন যে তিনি এক অদ্ভুত হ্যালুসিনেশনের মধ্যে দেখেছেন পৃথিবীর মহাসাগর চাঁদের বুকে প্রবাহিত হচ্ছে। তনয়াও নিজের মধ্যে এক ধরনের অস্থিরতা অনুভব করতে লাগলেন—ঘুমের মধ্যে বারবার শুনতে পাচ্ছিলেন এক মৃদু স্পন্দন, যা নক্ষত্রবীজের অদৃশ্য দোলনের সঙ্গে মিলে যায়। কিয়ান বুঝতে পারলেন, এই স্পোরগুলির রাসায়নিক গঠন শুধু শারীরিক প্রতিক্রিয়া নয়, বরং মানুষের নিউরন সিস্টেমে সরাসরি প্রভাব ফেলছে। অজানা এক বায়োকেমিক্যাল সংকেত মস্তিষ্কের ডোপামিন ও সেরোটোনিন নিঃসরণকে বাড়িয়ে দিচ্ছে, যার ফলে স্বপ্ন ও বাস্তবের সীমানা অস্পষ্ট হয়ে পড়ছে। পৃথিবীর নিয়ন্ত্রণকক্ষ থেকে বিজ্ঞানীরা বারবার সতর্ক করলেও অরুণ–৯-এর ক্রুরা বুঝতে পারছিলেন যে এই প্রভাব কেবল মস্তিষ্কে নয়, তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও ইন্দ্রিয়ের ভারসাম্যেও আঘাত হানছে।
তনয়া অবশেষে একটি জরুরি বৈঠকে স্পষ্ট করে বললেন যে নক্ষত্রবীজ পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনা মানে এক অচিন্তনীয় বায়ো-হ্যাজার্ডের জন্ম দেওয়া। তাঁর কণ্ঠে এমন দৃঢ়তা ছিল যে কিয়ান ও অরবিন্দ মুহূর্তের জন্য নীরব হয়ে গেলেন। “আমরা যা তৈরি করেছি তা শুধু একটিমাত্র উদ্ভিদ নয়,” তিনি বললেন, “এটি এমন এক জীবন্ত কোড, যা মহাশূন্যের বিকিরণ ও চাঁদের মাটির সঙ্গে মিশে এমন কিছু সৃষ্টি করছে, যার সীমা আমরা কল্পনাও করতে পারিনি। যদি এই স্পোর পৃথিবীর বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে, তবে এর প্রভাব নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে—প্রথমে মানুষের মস্তিষ্কে, তারপর পৃথিবীর পরিবেশে।” কিয়ান তবু দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন; বিজ্ঞানীর মন তাকে বলছিল যে এই আবিষ্কার মহাবিশ্বে জীবনের রহস্য উন্মোচনের দরজা খুলে দিতে পারে। কিন্তু তিনি নিজেও স্বীকার করলেন, ক্রমবর্ধমান হ্যালুসিনেশন ও অদ্ভুত স্বপ্নের ভেতর দিয়ে যুক্তিবোধ ক্রমশ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। অরবিন্দ মহাকাশযানের জানালার বাইরে তাকিয়ে দূরে নীলাভ পৃথিবীর দিকে চাইলেন, যে গ্রহে কোটি কোটি প্রাণ অপেক্ষা করছে—কিন্তু সেই গ্রহকে রক্ষা করতে তাদের হয়তো এই অনন্য সৃষ্টির সঙ্গে নির্মম সিদ্ধান্ত নিতে হবে। চন্দ্রপৃষ্ঠে নক্ষত্রবীজের নীলচে-রূপালি আলো তখন আরও উজ্জ্বল হয়ে জ্বলছিল, যেন কোনো অদৃশ্য শক্তি তাদের প্রতিটি শব্দ শুনছে এবং নিজের পরবর্তী পদক্ষেপের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। মানবসৃষ্ট এক বীজ, যা হয়তো ইতিমধ্যেই মানুষের মনের ভেতরে শেকড় গেঁথে ফেলেছে, ধীরে ধীরে চাঁদের নিঃশব্দ অন্ধকারে নিজের জৈব ছন্দের বিকৃতি ছড়িয়ে দিতে লাগল।
৫
অরুণ-৯ মহাকাশযানটি যখন চাঁদের কক্ষপথে নক্ষত্রবীজের অঙ্কুরোদগম পর্যবেক্ষণ করছিল, তখন হঠাৎ করেই পৃথিবীর সঙ্গে সব যোগাযোগ নিস্তব্ধ হয়ে যায়। একটি নিখুঁত নীরবতা যেন সারা ক্রু-কেবিনে ছড়িয়ে পড়ে, শুধুমাত্র যন্ত্রপাতির মৃদু গুঞ্জন আর শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দ ছাড়া আর কিছু শোনা যাচ্ছিল না। কন্ট্রোল প্যানেলে থাকা আলো হঠাৎই ঝিলমিল করে নিভে যায়, আবার জ্বলে ওঠে, যেন অদৃশ্য কোনো শক্তি সেটিকে দখল করে নিয়েছে। কিয়ান তৎক্ষণাৎ রেডিও চ্যানেলগুলো একের পর এক পরীক্ষা করতে শুরু করেন, কিন্তু কোনো সাড়া মেলে না—কোনো স্যাটেলাইট রিলে, কোনো গ্রাউন্ড স্টেশন, এমনকি জরুরি ফ্রিকোয়েন্সিও একেবারে নিস্তব্ধ। এই অদ্ভুত নিস্তব্ধতার মধ্যে সেন্সরগুলো হঠাৎই অস্বাভাবিক রিডিং দেখাতে শুরু করে। চাঁদের অন্ধকার দিক থেকে এক অজানা রেডিও তরঙ্গ প্রবাহিত হচ্ছে, যার তীব্রতা প্রতি সেকেন্ডে বাড়ছে। তরঙ্গগুলোর প্যাটার্ন যেন কেবল নিছক কোনো প্রাকৃতিক কম্পন নয়, বরং কোনো সাংকেতিক বার্তা—কোনো ভাষার মতোই ছন্দময়। তনয়া, যিনি বায়ো-কম্পিউটেশন বিশ্লেষণে পারদর্শী, কম্পনগুলোর ফ্রিকোয়েন্সি ডিকোড করতে গিয়ে চমকে ওঠেন। সিগন্যালগুলো যেন কোনো জীবন্ত সত্তার স্পন্দনের মতো, একধরনের পালস, যা চাঁদের মাটির গভীরে ছড়িয়ে পড়ছে। আর এই স্পন্দনের কেন্দ্রবিন্দু স্পষ্টতই নক্ষত্রবীজ—যে বীজটি কয়েক সপ্তাহ আগে পর্যন্ত নিছক একটি জেনেটিক পরীক্ষার অংশ ছিল। কিয়ান বুঝতে পারেন, এটি শুধু একটি উদ্ভিদ নয়, বরং এমন কিছু, যা নিজের অস্তিত্ব বিস্তৃত করার জন্য চাঁদের পরিবেশকে ব্যবহার করছে।
এই সংকটের মাঝেই অরবিন্দ, যিনি মহাকাশযানের বহিঃপ্রাচীরের মেরামত কাজের দায়িত্বে ছিলেন, যান বহিরাগত সোলার প্যানেল মডিউল পরীক্ষা করতে। অক্সিজেন সাপ্লাই সিস্টেমে সামান্য ত্রুটি দেখা দিয়েছিল, যা তিনি একাই ঠিক করতে বেরিয়ে যান। ক্রু-কেবিন থেকে তনয়া ও কিয়ান তাঁকে নিয়মিত যোগাযোগে রাখার চেষ্টা করেন, কিন্তু রেডিওতে বারবার স্ট্যাটিক শব্দ ভেসে আসে, তারপর হঠাৎই লাইন সম্পূর্ণ কেটে যায়। কয়েক মিনিটের ভেতর অরবিন্দের শ্বাসপ্রশ্বাসের হার অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়, তাঁর স্যুটের মনিটরে অক্সিজেন স্যাচুরেশন দ্রুত ৯৯ থেকে ১০৫ শতাংশে পৌঁছে যায়—যা স্বাভাবিকভাবে সম্ভব নয়। কিয়ান উদ্বেগের সঙ্গে লাইফ সাপোর্ট ডেটা পর্যবেক্ষণ করতে করতে খেয়াল করলেন, অরবিন্দের হৃদস্পন্দনও এক অদ্ভুত ছন্দে ধুকপুক করছে, ঠিক সেই রেডিও তরঙ্গের মতোই। তিনি দ্রুত এয়ারলক খুলে অরবিন্দকে ভেতরে টেনে আনেন। অরবিন্দের স্যুটের ভেতর থেকে নিঃশ্বাসের সঙ্গে এক অদৃশ্য ধুলোর আস্তরণ বেরিয়ে আসে, যা যেন চাঁদের ধুলোর সাথে মিশে থাকা নক্ষত্রবীজের মাইক্রো-স্পোর। এই স্পোরগুলো অতি ক্ষুদ্র, কিন্তু সেন্সর দেখাচ্ছিল তারা জীবন্ত এবং তাদের কম্পনও রেডিও সিগন্যালের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। অরবিন্দের চোখে এক অদ্ভুত ঝলকানি দেখা দিল, যেন তিনি এমন কিছু দেখছেন যা বাস্তব নয়। তিনি মৃদুস্বরে কিছু অজানা শব্দ উচ্চারণ করতে শুরু করলেন—যা কোনো পরিচিত ভাষার নয়, বরং একধরনের প্রাচীন, স্বরলিপিময় গুঞ্জন। তাঁর মুখের কোণে হাসির মতো এক টান, কিন্তু দৃষ্টি শূন্য, যেন তিনি মহাকাশযানের দেয়াল ভেদ করে কোনো অদৃশ্য দিগন্তের দিকে তাকিয়ে আছেন।
তনয়া দ্রুত মেডিকেল স্ক্যানার চালু করে দেখলেন, অরবিন্দের রক্তে অক্সিজেন মাত্রা অস্বাভাবিকভাবে বেশি হলেও তাঁর মস্তিষ্কের কিছু অংশে অদ্ভুত বৈদ্যুতিক তরঙ্গ খেলা করছে। মস্তিষ্কের সেই তরঙ্গগুলোও ঠিক একই রেডিও প্যাটার্নের মতোই ওঠানামা করছে। যেন নক্ষত্রবীজের স্পোর তাঁর স্নায়ুতন্ত্রের ভেতর ঢুকে মস্তিষ্ককে নতুন কোনো ফ্রিকোয়েন্সিতে টিউন করছে। কিয়ান উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বললেন, “এটা শুধু সংক্রমণ নয়, এটা যেন একধরনের যোগাযোগ ব্যবস্থা। বীজটা আমাদের শরীর ব্যবহার করে বার্তা পাঠাচ্ছে।” তনয়া হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন মনিটরের দিকে, যেখানে চাঁদের অন্ধকার দিক থেকে আসা রেডিও সিগন্যাল এবং অরবিন্দের মস্তিষ্কের তরঙ্গের ওঠানামা প্রায় একেবারে অভিন্ন। হঠাৎ করেই মহাকাশযানের দেয়াল থেকে মৃদু কম্পন অনুভূত হলো, যেন কোনো অদৃশ্য সত্তা ধীরে ধীরে তাদের জাহাজের ধাতব কাঠামো স্পর্শ করছে। বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখা গেল, চাঁদের ধুলোর ওপর নক্ষত্রবীজের অঙ্কুরগুলো অদ্ভুত আলোকরেখা ছড়িয়ে দিয়েছে, যা ধীরে ধীরে জৈব আলোর মতো জ্বলে উঠছে। সিগন্যালের গতি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অরবিন্দের বিভ্রমও তীব্রতর হতে লাগল—তিনি এক অজানা গ্রহের বনভূমি, শূন্য আকাশে ভেসে থাকা অচেনা নক্ষত্র, আর অদ্ভুত জীবন্ত স্থাপত্যের কথা বলতে লাগলেন। তনয়া আতঙ্কিত গলায় বললেন, “যদি এই বীজ পৃথিবীতে ফিরিয়ে নেওয়া হয়, পুরো গ্রহটাই হয়তো এই কম্পনের মধ্যে ঢুকে পড়বে।” কিয়ান বুঝতে পারলেন, তারা শুধু বৈজ্ঞানিক বিপদের মুখোমুখি নন, বরং এমন এক জীবন্ত সত্তার সম্মুখীন হয়েছেন, যা তাদের ভাষায় ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়—একটি সত্তা, যা মহাকাশের নীরবতাকে নিজের স্পন্দনে ভরিয়ে দিচ্ছে।
৬
চাঁদের ধূসর প্রান্তরের নীচে লুকিয়ে থাকা রহস্য যেন হঠাৎ করেই জীবন্ত হয়ে উঠল। নক্ষত্রবীজের মূলে থাকা জেনেটিক কোড, যা প্রথমে নিছক একটি উচ্চতর উদ্ভিদের কোড বলে মনে হয়েছিল, অস্বাভাবিক দ্রুততায় মিউটেট করতে শুরু করল। কিয়ান যখন ডিএনএ সিকোয়েন্সারের পরবর্তী ডেটা বিশ্লেষণ করছিলেন, তিনি দেখলেন মাত্র কয়েক ঘন্টার মধ্যে ডিএনএ স্ট্র্যান্ডের গঠন বদলে যাচ্ছে—এমনকি পৃথিবীর কোনো পরিচিত জীবের মিউটেশনের হারকেও ছাপিয়ে যাচ্ছে এই পরিবর্তন। যেখানে আগে নিছক সবুজাভ অঙ্কুর দেখা গিয়েছিল, এখন সেখানে অদ্ভুত আলোকিত রেখা ছড়িয়ে পড়ছে, যেন কোনো অজানা শক্তি শিকড়ের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। অঙ্কুরগুলো একে অপরের দিকে ধীরে ধীরে এগোতে শুরু করল, যেন কোনো অদৃশ্য সংকেতের অনুসরণ করছে। এই নড়াচড়া প্রথমে কিয়ান যান্ত্রিক প্রতিক্রিয়া ভেবেছিলেন, কিন্তু তনয়া মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করে দেখলেন—অঙ্কুরগুলোর এই নড়াচড়া নিছক অঙ্গসঞ্চালন নয়, বরং সচেতন কোনো প্রাণীর মতো সমন্বিত। ল্যাবের প্রতিটি বায়ো-সেন্সর এক অদ্ভুত ছন্দময় কম্পন ধরতে শুরু করল, যা মহাকাশযানের ভেতরের ধাতব দেয়ালে মৃদু গুঞ্জনের মতো প্রতিফলিত হচ্ছিল। তনয়া স্ক্যানার থেকে আসা নতুন তথ্য দেখে আতঙ্কিত হয়ে পড়লেন—নক্ষত্রবীজের ডিএনএ-র গভীরে এমন একটি জিনোম অ্যাক্টিভ হয়েছে, যা পৃথিবীর কোনো জীবের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। বরং সেটির গঠন মিলে যাচ্ছে মহাজাগতিক অণুজীবের সেই প্রাচীন কোডের সঙ্গে, যা কোটি কোটি বছর আগে উল্কাপিণ্ডের সঙ্গে মহাকাশ থেকে পৃথিবীতে এসেছিল বলে বিজ্ঞানীরা অনুমান করেছিলেন। যেন এই বীজের ভেতর লুকিয়ে ছিল এক মহাজাগতিক স্মৃতি, যা চাঁদের মাটির কোনো অজানা উপাদান পেয়ে পুনরায় জেগে উঠেছে।
তনয়া ও কিয়ান দুজনেই লক্ষ্য করলেন, ল্যাবের অক্সিজেন চেম্বারের ভেতরে এক অচেনা পরিবর্তন ঘটছে। কন্ট্রোল স্ক্রিনে অক্সিজেনের মান স্বাভাবিক থাকলেও পরিবেশের চাপ সামান্য বেড়ে গিয়েছে, যেন কোনো অদৃশ্য গ্যাস ছড়িয়ে পড়ছে। প্রথমে হালকা ধাতব গন্ধ অনুভূত হলো, কিন্তু কয়েক মিনিটের মধ্যে সেটি রূপ নিল এক ধরনের শীতল, ধাতব-মিষ্টি সুবাসে, যা একই সঙ্গে মুগ্ধকর এবং অস্বস্তিকর। আলো-অন্ধকারের খেলায় দেখা গেল, বায়ুতে ক্ষীণ রূপালি কণাগুলো ভেসে বেড়াচ্ছে—মৃদু ঝিকমিক করা কুয়াশার মতো, যা মহাকাশযানের কৃত্রিম আলোর সঙ্গে মিশে এক অদ্ভুত আভা তৈরি করছে। কিয়ান ভেবেছিলেন এটি হয়তো চাঁদের ধুলো বা নক্ষত্রবীজের স্পোর, কিন্তু তনয়া বুঝতে পারলেন এটি আরও ভয়ংকর কিছু। তিনি বায়ো-স্ক্যানার দিয়ে কণাগুলোর রাসায়নিক গঠন পরীক্ষা করে দেখলেন, এরা শুধু অক্সিজেন নয়, বরং অজানা ধাতব-প্রোটিন যৌগ বহন করছে, যা জীবন্ত কোষের সঙ্গে সংযোগ ঘটাতে পারে। আরও বিস্ময়ের বিষয়, এই কণাগুলো ধীরে ধীরে মহাকাশযানের স্টিলের দেয়ালে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র স্ফটিক গঠন তৈরি করছে, যা জৈব ও অজৈবের সীমা ভেঙে এক নতুন ধরনের বায়োম তৈরি করছে। তনয়ার মনে হলো, যেন এই কুয়াশা তাদের চারপাশে শুধু ছড়িয়ে পড়ছে না, বরং প্রতিটি নিঃশ্বাসের সঙ্গে তাদের শরীরের ভেতর প্রবেশ করছে, ধীরে ধীরে মানবকোষকে নিজের কোডের সঙ্গে মিশিয়ে দিচ্ছে।
পরিস্থিতির ভয়াবহতা তখন আরও স্পষ্ট হয়ে উঠল যখন কিয়ান মাইক্রোস্কোপের নীচে নক্ষত্রবীজের মূল থেকে নেওয়া একটি স্যাম্পল রাখলেন। স্যাম্পলের ভেতর দেখা গেল ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অণুজীবেরা একে অপরের সঙ্গে যুক্ত হয়ে একটি জটিল নেটওয়ার্ক তৈরি করছে, যা কোনো উদ্ভিদের শিকড় নয়, বরং একধরনের স্নায়বিক টিস্যুর মতো। এই নেটওয়ার্কের মধ্য দিয়ে বৈদ্যুতিক স্পন্দন ছুটে যাচ্ছে, যেন বীজটি নিজেই চিন্তা করতে সক্ষম। তনয়া কাঁপা কণ্ঠে বললেন, “এটা পৃথিবীর কোনো উদ্ভিদ নয়… এটা কোনো বীজ নয়… এটা যেন মহাকাশের জীবন্ত কোড।” কিয়ান নীরবে মনিটরের দিকে তাকিয়ে রইলেন, যেখানে ধীরে ধীরে ডিএনএ সিকোয়েন্সারের গ্রাফ এক অচেনা ছন্দে নাচছে। ল্যাবের বাতাস তখন আরও ঘন, আরও ঠান্ডা হয়ে উঠেছে। রূপালি কুয়াশা ক্রমশ ঘন হতে হতে জানালার বাইরের মহাশূন্যের অন্ধকারকেও ঢেকে দিচ্ছে। যেন নক্ষত্রবীজের মূলে জেগে ওঠা মহাজাগতিক কোড শুধু তাদের পরীক্ষাগারকেই নয়, পুরো অরুণ-৯ মহাকাশযানটিকেই নিজের দখলে নিতে চাইছে। তনয়া অনুভব করলেন, তাঁর ত্বকের নিচে এক অদৃশ্য শীতলতা ছড়িয়ে পড়ছে—যেন রূপালি কুয়াশার সঙ্গে তাঁর শরীরও ধীরে ধীরে কোনো অচেনা সত্তায় রূপান্তরিত হচ্ছে।
৭
চন্দ্রপৃষ্ঠের নীরবতা ভেঙে এক অজানা কম্পন ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছিল। প্রথমে সেটা ছিল মৃদু, যেন দূর থেকে কোনো অচেনা ঢেউ আসছে, কিন্তু কয়েক ঘণ্টার মধ্যে অরুণ-৯ এর সিসমিক সেন্সরগুলো স্পষ্টভাবে চাঁদের গভীর স্তর থেকে উঠে আসা এক অদ্ভুত জৈবিক স্রোতের ইঙ্গিত দিল। চন্দ্রপৃষ্ঠের নিচে এতদিন যে মৃত মাটির ধারণা ছিল, তা যেন এক অদৃশ্য প্রাণস্পন্দনে জেগে উঠছে। তনয়া জানালার দিকে তাকিয়ে দেখলেন, নক্ষত্রবীজের রোপণস্থলের চারপাশের মাটি ধীরে ধীরে রঙ পরিবর্তন করছে—ধূসর বালির নিচে গাঢ় নীলচে আভা ফুটে উঠছে, যেন চাঁদের নিজস্ব রসদ মিশে নতুন জীবের জন্ম দিচ্ছে। সেন্সর দেখাল যে তাপমাত্রা সামান্য বেড়েছে, কিন্তু কোনো দৃশ্যমান উৎস নেই। কিয়ান মাটির নমুনা স্ক্যান করে বুঝতে পারলেন, চাঁদের প্রাচীন রাসায়নিক উপাদান—যার মধ্যে হাইড্রোজেন, হিলিয়াম-৩, আর লুকিয়ে থাকা বরফের কণিকা রয়েছে—তা নক্ষত্রবীজের স্পোরের সঙ্গে মিলেমিশে এক ধরনের স্বয়ংক্রিয় রাসায়নিক বিক্রিয়া শুরু করেছে। এই বিক্রিয়ার ফলাফল শুধু তাপ নয়, বরং এক জটিল জৈব যৌগ, যা চন্দ্রপৃষ্ঠে আগে কখনো শনাক্ত হয়নি। মনে হচ্ছিল, চাঁদের গভীরতর স্তরে ঘুমিয়ে থাকা কোনো প্রাচীন উপাদান নক্ষত্রবীজের মহাজাগতিক কোডের সংস্পর্শে এসে জীবন্ত হয়ে উঠেছে, আর সেই জীবনধারা ধীরে ধীরে উপরের স্তরে উঠে এসে নতুন এক ইকোসিস্টেমের বীজ বপন করছে।
কিয়ান এবং তনয়া ল্যাবের স্ক্রিনে চোখ রাখলেন, যেখানে গ্রাফগুলো ক্রমশ ভয়াবহ বার্তা দিচ্ছিল। মাত্র কয়েক ঘন্টার মধ্যে চাঁদের রেগোলিথে থাকা আর্গন এবং হিলিয়াম আইসোটোপের ঘনত্ব বদলে যাচ্ছিল, আর সেই পরিবর্তনের সাথে দেখা দিচ্ছিল অক্সিজেন-সমৃদ্ধ বায়ুমণ্ডলের প্রাথমিক চিহ্ন। কিয়ান ডেটাগুলো ক্রস-চেক করে বুঝলেন, নক্ষত্রবীজ শুধু অক্সিজেন উৎপন্ন করছে না, বরং চাঁদের মাটির গভীরতর খনিজের সঙ্গে একীভূত হয়ে এমন এক স্বয়ংসম্পূর্ণ চক্র গড়ে তুলছে, যা কয়েক মাসের মধ্যে পুরো চন্দ্রপৃষ্ঠে ছড়িয়ে পড়তে পারে। এই চক্রের মধ্যে রয়েছে ক্ষুদ্র অণুজীব, স্পোর-জাতীয় সত্তা এবং গ্যাস মিশ্রণের এক অজানা রূপ—যা ধীরে ধীরে একটি বায়ুমণ্ডল সৃষ্টি করছে। তনয়া আতঙ্কিত স্বরে বললেন, “যদি এটা অব্যাহত থাকে, চাঁদের প্রকৃতি আর আগের মতো থাকবে না। আমরা যে নীরব, শূন্য চাঁদকে চিনতাম, সেটা এক জীবন্ত গ্রহে পরিণত হবে।” কিয়ান আরও এক ধাপ এগিয়ে বললেন, “এটা শুধু পরিবর্তন নয়। নক্ষত্রবীজের কোডে যে মহাজাগতিক অণুজীব সক্রিয় হয়েছে, তারা হয়তো চাঁদকে এক নতুন বীজক্ষেত্রে পরিণত করছে—একটা সম্পূর্ণ নতুন জীববৈজ্ঞানিক পরীক্ষাগার, যেখানে পৃথিবীর কোনো আইন প্রযোজ্য নয়।” এই কথা বলেই তিনি স্যাটেলাইট ফিডে আসা নতুন ছবিগুলো দেখালেন। সেখানে দেখা যাচ্ছিল নক্ষত্রবীজের আশেপাশে কয়েক কিলোমিটার এলাকা জুড়ে মাটি অস্বাভাবিক উজ্জ্বলতায় ঝলমল করছে। আলোটা নিছক প্রতিফলন নয়, বরং একধরনের জৈব আলোকোজ্জ্বলতা, যা রাতের অন্ধকারে ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছে, যেন চাঁদের নিজের আলো জন্ম নিচ্ছে।
এই আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গেই অরুণ-৯ এর ভেতর এক অস্বস্তিকর চাপ তৈরি হলো। অক্সিজেন চেম্বারের ভেতর বাতাসের ঘনত্ব সামান্য বেড়ে গিয়েছে, এবং তাপমাত্রা একই সঙ্গে ঠান্ডা ও উষ্ণ অনুভূত হচ্ছিল—এক ধরনের দ্বৈত অবস্থা, যা মানুষের ইন্দ্রিয়কে বিভ্রান্ত করে। তনয়া অনুভব করলেন, তার নিঃশ্বাসের ভেতর এক ধাতব স্বাদ ঢুকে পড়ছে, যেন চাঁদের নতুন জন্ম নেওয়া বাতাস ধীরে ধীরে মহাকাশযানের সুরক্ষিত চেম্বার ভেদ করে ঢুকে পড়ছে। কিয়ান জানালেন, তারা যে সিল করা নমুনা সংগ্রহ করেছিলেন, সেগুলো কোনোভাবে নিজেদের মধ্যেই প্রতিক্রিয়া শুরু করেছে। নক্ষত্রবীজের স্পোর ও চাঁদের খনিজের সংযোগে সৃষ্ট এই জৈবিক স্রোত যেন এক অদৃশ্য সংকেত পাঠাচ্ছে, যা ল্যাবের যন্ত্রপাতির ওপরও প্রভাব ফেলছে। হঠাৎ করেই স্ক্রিনে ঝলসে উঠল নতুন এক ডেটা লাইন—চাঁদের দক্ষিণ মেরু অঞ্চলে, তাদের রোপণস্থল থেকে অন্তত ৩০ কিলোমিটার দূরে, একই ধরনের জৈবিক পরিবর্তনের চিহ্ন মিলেছে। তনয়া কাঁপা গলায় বললেন, “আমরা কেবল শুরু করেছি, কিন্তু চাঁদ যেন ইতিমধ্যেই জেগে উঠেছে।” কিয়ানের চোখে আতঙ্কের ঝিলিক ফুটে উঠল। তিনি হিসেব করলেন, এই গতি যদি অব্যাহত থাকে, কয়েক মাসের মধ্যেই পুরো চন্দ্রপৃষ্ঠ এক অচেনা বায়ুমণ্ডলে রূপ নেবে—এক এমন আকাশমণ্ডল যা মানবজীবনের জন্য অনিশ্চিত, অথচ এক নতুন জীবনের জন্য হতে পারে আদর্শ। সেই মুহূর্তে, জানালার বাইরে চাঁদের সাদা-ধূসর আকাশের নীচে রূপালি নীল আলো ঝলমল করে উঠল, যেন প্রাচীন মৃত গ্রহটি এক অদৃশ্য স্পন্দনে আবার প্রাণ ফিরে পাচ্ছে।
৮
বেঙ্গালুরুর ইন্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ কমপ্লেক্সের কন্ট্রোল রুমে সেই রাত যেন পৃথিবীর ইতিহাসের এক অনন্য সন্ধিক্ষণ হয়ে উঠল। বিশাল কাচের প্যানেলের ভেতরে ঝলসে ওঠা লাল আলো ও সাইরেনের কর্কশ শব্দ সবার মনকে চেপে ধরল। মিশন কন্ট্রোলের প্রধান স্ক্রিনে দেখা যাচ্ছিল চাঁদের দক্ষিণ মেরু অঞ্চল থেকে আসা লাইভ ফিড—রূপালি আভা ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছে, যেন এক অজানা জীবন্ত আলোকবৃত্ত চাঁদের মৃত পৃষ্ঠকে ঢেকে নিচ্ছে। যোগাযোগের সংকেত বারবার ভেঙে পড়ছিল; অরুণ-৯ থেকে আসা ডেটা প্যাকেটগুলো অসম্পূর্ণ, আর কখনও সম্পূর্ণ অচেনা বৈদ্যুতিক শব্দে ভরা। ড. রণদীপ সেন ঠান্ডা কণ্ঠে কম্পিউটার টার্মিনালে তাকিয়ে ছিলেন, কিন্তু চোখের ভেতর লুকিয়ে ছিল অস্থিরতার ঝড়। নক্ষত্রবীজ প্রকল্পে তিনি দশ বছরের শ্রম দিয়েছেন—এমন এক বীজের স্বপ্ন, যা মানবজাতিকে মহাকাশে অক্সিজেনের উপহার দেবে, মানুষের বসবাসের নতুন দিগন্ত খুলে দেবে। কিন্তু সেই স্বপ্ন এখন এক ভয়ঙ্কর বাস্তবতায় রূপ নিচ্ছে। সিসমিক ডেটা দেখাচ্ছিল, চাঁদের গভীরে রাসায়নিক বিক্রিয়া দ্রুততর হচ্ছে, আর নক্ষত্রবীজের স্পোর চন্দ্রপৃষ্ঠের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়ছে। একদিকে ছিল বৈজ্ঞানিক অর্জনের অবিশ্বাস্য সম্ভাবনা, অন্যদিকে মানবসভ্যতার অস্তিত্বের ঝুঁকি। প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি ডেটা লাইন যেন রণদীপের মনের মধ্যে ছুরি চালাচ্ছিল—বাঁচাবেন নাকি ধ্বংস করবেন?
অবস্থার গুরুত্ব বুঝে আন্তর্জাতিক যোগাযোগ নেটওয়ার্কে জরুরি বার্তা পাঠানো হলো। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই জাতিসংঘের মহাকাশ নিরাপত্তা পরিষদ (UN Space Security Council) এক ব্যতিক্রমী জরুরি বৈঠকের আয়োজন করল। ভিডিও কনফারেন্সের এক প্রান্তে যুক্তরাষ্ট্রের নাসা প্রধান, ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির পরিচালক, জাপানের জাক্সার প্রতিনিধি, রাশিয়ার রসকসমসের কর্মকর্তারা, আরেক প্রান্তে ভারতীয় বিজ্ঞানীরা। বৈঠকের শুরুতেই বেঙ্গালুরু থেকে সরাসরি সম্প্রচারিত হলো নক্ষত্রবীজের সর্বশেষ ডেটা: চাঁদের মাটিতে অক্সিজেনের মাত্রা গত ১২ ঘন্টায় ৩ গুণ বেড়েছে, এবং চন্দ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা ও রাসায়নিক গঠন দ্রুত বদলাচ্ছে। ড. রণদীপ বৈঠকে উপস্থিত বিশ্বনেতাদের সামনে স্পষ্ট করে বললেন, “এখনো সময় আছে নক্ষত্রবীজকে ধ্বংস করার। যদি আমরা অপেক্ষা করি, এই প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। চাঁদ হয়তো এক নতুন জীবন্ত গ্রহে পরিণত হবে, কিন্তু সেটা মানবজাতির জন্য সম্পূর্ণ অচেনা এবং বিপজ্জনক হবে।” বিপরীতে ইউরোপের এক শীর্ষ জেনেটিক বিজ্ঞানী যুক্তি দিলেন, “এটি হতে পারে মানব ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বৈজ্ঞানিক সাফল্য। আমরা যদি নক্ষত্রবীজকে ধ্বংস করি, মহাকাশে জীবনের সম্ভাবনা নিজ হাতে হত্যা করব।” যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি আরও এক ধাপ এগিয়ে সতর্ক করলেন—যদি নক্ষত্রবীজের স্পোর চাঁদে নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছড়িয়ে পড়ে, ভবিষ্যতে চন্দ্র-ঘাঁটি বা মহাকাশযানের মাধ্যমে পৃথিবীতে ফিরে আসতে পারে। প্রতিটি দেশের প্রতিনিধি নিজেদের রাজনৈতিক ও বৈজ্ঞানিক স্বার্থ নিয়ে তর্কে জড়িয়ে পড়লেন। পৃথিবীর বিভিন্ন টাইম জোনের আলো-অন্ধকারের মধ্যেও বৈঠক চলল টানা কয়েক ঘণ্টা, আর বেঙ্গালুরুর কন্ট্রোল রুমে ঘড়ির কাঁটা যেন প্রতিটি মিনিটে নতুন সংকটের ডাক দিচ্ছিল।
শেষ পর্যন্ত, তীব্র বিতর্কের পর নিরাপত্তা পরিষদ একটি কঠিন সিদ্ধান্তে উপনীত হলো। আন্তর্জাতিক ভোটাভুটিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ চাঁদের মিশন ধ্বংসের পক্ষে মত দিল। প্রস্তাব গৃহীত হলো যে, চন্দ্রবীজ-১ মিশনকে অবিলম্বে নিজস্ব ধ্বংস প্রোটোকল সক্রিয় করতে হবে। এই প্রোটোকল ছিল মিশনের গোপন ব্যাকআপ—একটি অটোমেটেড সিস্টেম যা অরুণ-৯ মহাকাশযানকে স্ব-ধ্বংসের মাধ্যমে রোপিত বীজ এবং তার আশপাশের জৈব কাঠামো সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে ফেলতে পারবে। সিদ্ধান্ত ঘোষণার মুহূর্তে কন্ট্রোল রুমে এক অদ্ভুত নীরবতা নেমে এলো। কেউ কথা বলছিল না, শুধু স্ক্রিনে ঝলসে উঠছিল লাল রঙের সতর্ক সংকেত: “DESTROY PROTOCOL – STAGE ONE READY”। ড. রণদীপ সেন চেয়ার থেকে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন। তাঁর চোখে ছিল পরাজয়ের ছায়া, কিন্তু কণ্ঠে লুকিয়ে ছিল এক অদম্য দৃঢ়তা। তিনি জানতেন, এই সিদ্ধান্ত মানবজাতির ভবিষ্যৎ রক্ষার জন্য, তবু তার ভেতরে তোলপাড় করছিল এক গভীর যন্ত্রণা। নক্ষত্রবীজ ছিল তাঁর জীবনের কাজ, তাঁর বিশ্বাসের প্রতীক—যা হয়তো মানবজাতিকে এক নতুন আকাশের দিগন্ত দেখাতে পারত। কিন্তু আজ তাকে সেই স্বপ্নের সমাধি লিখতে হবে নিজের হাতে। তিনি ধীরে ধীরে ধ্বংস প্রোটোকলের প্যানেলের দিকে এগোলেন, আঙুলের ডগা কাঁপছিল, তবু থামলেন না। স্ক্রিনে কাউন্টডাউন শুরু হতেই মনে হলো, বেঙ্গালুরুর কন্ট্রোল রুম নয়, সমগ্র পৃথিবী যেন নিশ্বাস আটকে রেখেছে।
৯
প্রেশার ডোমের ভেতরটা তখন যেন এক অচেনা, পরাবাস্তব জঙ্গল। চারদিক জুড়ে রূপালি আলো ছড়ানো লতাগুল্মের ঝিলিক, হালকা নীল কুয়াশার মতো ছড়িয়ে থাকা স্পোরের মিহি আস্তরণ, আর অদ্ভুত ফিসফিস শব্দে ভরে উঠেছে চারপাশ। তনয়া ও কিয়ান ধীরে ধীরে মেইন কন্ট্রোল রুমের দিকে এগোচ্ছিলেন, হাতে ভারী কন্টেইনমেন্ট স্যুট আর নিউক্লিয়ার ফেইল-সেইফের অ্যাক্টিভেশন চিপ। বাইরের রূপালি বনের শাখাগুলো যেন তাদের গতিবিধি অনুভব করছিল—প্রতিটি পদক্ষেপের সঙ্গে সঙ্গে অদৃশ্য শিকড়গুলো নড়েচড়ে উঠছিল, যেন কোন সচেতন প্রাণী নিজের এলাকা রক্ষা করতে চাইছে। দূর থেকে অরবিন্দের কণ্ঠস্বর শোনা গেল—কখনো পরিচিত, কখনো ভয়ঙ্কর। তিনি ধীরে ধীরে অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এলেন। তাঁর চোখ দুটো অস্বাভাবিকভাবে উজ্জ্বল, শ্বাসের সঙ্গে বেরোচ্ছে রূপালি কুয়াশা, আর ত্বকের নিচে স্পন্দিত হচ্ছে বীজের স্পোর। “তোমরা বুঝছো না,” অরবিন্দ গর্জন করে উঠলেন, “এটা ধ্বংস নয়, এটা জন্ম। নক্ষত্রবীজ আমাদের নতুন বিবর্তনের দরজা খুলে দিয়েছে। অক্সিজেনের জন্য আমরা যে স্বপ্ন দেখেছি, সেটাই আমাদের পুনর্জন্মের সোপান।” তনয়া তাঁর দিকে তাকিয়ে এক মুহূর্তের জন্য দ্বিধা করলেন—অরবিন্দ, যিনি একসময় তাঁদের সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য সহকর্মী ছিলেন, এখন যেন আর পুরোপুরি মানুষ নন। কিয়ান সাবধানে সেফটি লক খুলতে চেষ্টা করছিলেন, কিন্তু অরবিন্দ হঠাৎ ঝাঁপিয়ে পড়লেন, মানুষের সাধ্যের বাইরে অমানবিক শক্তি নিয়ে কন্ট্রোল প্যানেল থেকে চিপ ছিনিয়ে নিলেন।
কন্ট্রোল রুমে তীব্র লড়াই শুরু হলো। মাধ্যাকর্ষণহীনতার মাঝেও অরবিন্দের প্রতিটি আঘাত যেন ধ্বংসের ঢেউ তুলছিল। তাঁর হাত থেকে ছিটকে পড়া স্পোর তনয়া ও কিয়ানের স্যুটের ভিজর ঢেকে দিচ্ছিল, প্রতিটি ফোঁটা যেন মস্তিষ্কের ভেতর ঢুকে অচেনা স্বপ্ন দেখানোর চেষ্টা করছে। কিয়ান মরিয়া হয়ে সেফটি দরজা লক করতে এগোলেন, কিন্তু অরবিন্দের শক্তিতে তিনি পিছনে ছিটকে পড়লেন। “তুমি বুঝতে পারছো না,” অরবিন্দ ফিসফিস করে বললেন, “এই বীজই মহাবিশ্বের আদিম সত্তা। আমাদের রক্ত, আমাদের শ্বাস, সবকিছু এর সঙ্গে মিশে গেলে মানুষ আর সীমাবদ্ধ থাকবে না। আমরা নক্ষত্রের সন্তান হব।” তাঁর কথাগুলো যেন এক অদ্ভুত মায়া তৈরি করছিল—এক মুহূর্তের জন্য কিয়ানও অনুভব করলেন, এই রূপালি জঙ্গলের ভেতর এক অজানা শক্তির টান আছে। কিন্তু তনয়া দৃঢ় চোখে তাঁর দিকে তাকালেন। তিনি জানেন, এই স্বপ্ন যতই মুগ্ধকর হোক, বাস্তবে তা মানবজাতির জন্য ধ্বংস ডেকে আনবে। মুহূর্তের মধ্যে তিনি নিজের কন্ট্রোল প্যানেলের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়লেন, কিয়ানের দিকে চিৎকার করে বললেন, “ডিস্ট্রাকশন কোড চালু করো! এখনই!” কিয়ান কনসোলে হাত রাখতেই অরবিন্দ বন্য জন্তুর মতো গর্জন করে তাঁর দিকে ধেয়ে এলেন। তনয়া মাঝখান থেকে অরবিন্দকে ঠেকিয়ে দিলেন, কিন্তু তাঁর স্যুটের কাচে চিড় ধরতে শুরু করল, ভেতরে ঢুকে পড়ল স্পোরের ধাতব গন্ধমাখা বাতাস।
সময় যেন থেমে গিয়েছিল। অরবিন্দের চোখে অদ্ভুত উন্মাদনা, কিয়ানের হাতে কেবল কয়েক সেকেন্ড। তনয়া নিজের শেষ শক্তিটুকু দিয়ে অরবিন্দকে পেছনে ঠেলে দিলেন, তারপর ম্যানুয়াল প্যানেলের লাল বোতামে চাপ দিলেন। সাথে সাথে পুরো স্টেশনে তীব্র অ্যালার্ম বেজে উঠল, আলো নিভে গেল, আর কন্ট্রোল স্ক্রিনে ভেসে উঠল কাউন্টডাউন—“ডেস্ট্রাকশন সিকোয়েন্স ইনিশিয়েটেড।” অরবিন্দ এক বিকট চিৎকার করে তনয়ার দিকে ছুটলেন, কিন্তু বিস্ফোরণ প্রতিরোধের শক্তিশালী লকডাউন দরজা তাঁর পথ আটকে দিল। তনয়া তখন কিয়ানের দিকে তাকিয়ে একরকম শান্ত হাসি দিলেন, যেন জানেন এটাই শেষ লড়াই। বাইরে রূপালি বনের অঙ্কুরগুলো অস্থিরভাবে কাঁপতে শুরু করল, চাঁদের নীরব পৃষ্ঠে ছড়িয়ে পড়ল এক তীব্র ধাতব গর্জন। নিউক্লিয়ার ফেইল-সেইফের আলো ধীরে ধীরে লাল থেকে সাদা হয়ে উঠল, আর তনয়ার মনে কেবল একটাই চিন্তা—মানবজাতিকে বাঁচাতে হলে তাঁকেই শেষ পর্যন্ত দাঁড়াতে হবে। কাউন্টডাউনের শেষ সেকেন্ডে তিনি গভীর শ্বাস নিলেন, স্পোরের গন্ধ যেন শরীরের ভেতর ঢুকে তাকে অচেনা কোনো জগতে নিয়ে যেতে চাইছে, তবু তাঁর আঙুল দৃঢ়ভাবে লাল বোতামের ওপর চেপে রইল। তারপর চারদিক জুড়ে নক্ষত্রবীজের গর্জন, আলোর বিস্ফোরণ, আর অজানা মহাজাগতিক প্রতিধ্বনিতে চাঁদের নিঃশব্দ আকাশ কেঁপে উঠল।
১০
অরুণ-৯ মডিউলের বিস্ফোরণের পর চাঁদের নিস্তব্ধ আকাশে যে শব্দের প্রতিধ্বনি ছড়িয়ে পড়েছিল, তা পৃথিবীর স্পেস মনিটরিং স্টেশনের অ্যান্টেনায় ধরা পড়তে সময় নেয়নি। প্রথমে মনে হয়েছিল পুরো স্টেশন নিশ্চিহ্ন হয়েছে, কিন্তু বিস্ফোরণের ধোঁয়া কেটে গেলে দেখা গেল মডিউলের একাংশ এখনও টিকে আছে—জ্বলে যাওয়া ধাতব কাঠামোর ভেতরে ছায়া-ছায়া আলো। জরুরি উদ্ধারযান পৌঁছাতে যখন আরও কয়েক ঘণ্টা বাকি, তখন তনয়া ও কিয়ান ভগ্নদেহ মডিউলের সেফটি পডের ভেতর নিঃশব্দে বসে ছিলেন। তাদের স্যুটে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চিড় ধরেছে, অক্সিজেন ট্যাঙ্ক প্রায় শেষ, তবু বেঁচে আছেন—এক বিস্ময়কর সৌভাগ্যের পরিণতি। কিয়ানের চোখে তখনো লেগে আছে রূপালি বনের শেষ দৃশ্য—নিউক্লিয়ার ধ্বংসের আগুনে পুড়েও যেসব অঙ্কুর ঝলসে যাওয়ার কথা, তারা শেষ মুহূর্তে কেমন যেন এক অদ্ভুত শক্তি নিয়ে আলো ছড়াচ্ছিল। তনয়া চোখ বন্ধ করে শ্বাস নিলেন; স্পোরের ধাতব গন্ধ যেন এখনো স্যুটের ভেতরে আটকে আছে। মনে হচ্ছিল সেই অচেনা গন্ধ শরীরের প্রতিটি কোষে মিশে যাচ্ছে। “আমরা কি সত্যিই মুক্ত?” কিয়ান ফিসফিস করে প্রশ্ন করলেন। তনয়া কোনো উত্তর দিলেন না—কারণ তিনিও জানেন না, তাদের শিরায় এখনো কি নক্ষত্রবীজের অণুজীব প্রবাহিত হচ্ছে কিনা।
তাদের পৃথিবীতে ফেরার যাত্রা ছিল নিঃশব্দ আতঙ্কের এক দীর্ঘ প্রতীক্ষা। উদ্ধারযান এসে যখন তনয়া ও কিয়ানকে নিল, তখন তাদের শরীরের প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ যেন ভেতর থেকে ধুকপুক করছিল। মেডিকেল চেম্বারে প্রবেশ করার আগে জীবাণুনাশক স্নান, রক্তপরীক্ষা, ডিএনএ সিকোয়েন্সিং—প্রতিটি ধাপই ছিল এক অদৃশ্য শঙ্কার বিরুদ্ধে লড়াই। কিন্তু রিপোর্টগুলো কোনো নিশ্চিত উত্তর দেয়নি। তনয়ার রক্তে কিছু অচেনা প্রোটিন সনাক্ত হলেও সেটাকে স্পোর সংক্রমণ বলা যায় না, আবার পুরোপুরি অস্বীকারও করা গেল না। কিয়ানের শরীরে পাওয়া গেল মৃদু কোষ বিভাজনের অনিয়ম, যা বিজ্ঞানীরা ব্যাখ্যা করতে পারলেন না। বিশ্বজুড়ে সংবাদমাধ্যম উত্তেজনায় ফেটে পড়ল—“মানবজাতির পরবর্তী বিবর্তন কি শুরু হয়ে গেছে?” কেউ বলল এ শুধুই এক বৈজ্ঞানিক দুর্ঘটনা, কেউ আবার দাবি করল তনয়া ও কিয়ান আর সম্পূর্ণ মানুষ নেই, তারা নতুন এক প্রজাতির অগ্রদূত। এদিকে জাতিসংঘের মহাকাশ নিরাপত্তা পরিষদ নতুন সংকটে পড়ল। চাঁদের দক্ষিণ মেরুর দিকে পাঠানো শেষ রিকনিস্যান্স ড্রোন যে ছবি পাঠাল, সেখানে দেখা গেল বিস্ফোরণের গহ্বরের ভেতর অদ্ভুত ঝলকানি—এক ফালি রূপালি আলো, যেন ধ্বংসের ছাইয়ের নিচে এখনও জীবনের নড়াচড়া চলছে। এই ছবিগুলো আবারও প্রমাণ করল যে নক্ষত্রবীজ হয়তো পুরোপুরি ধ্বংস হয়নি, বরং নতুন কোনো রূপে জন্ম নিতে শুরু করেছে।
পৃথিবীর আকাশে তাই এখন এক অব্যক্ত প্রশ্ন ভাসছে। যদি নক্ষত্রবীজ সত্যিই বেঁচে থাকে, তবে সেই জীবনের গতি কোন পথে যাবে? এটি কি কেবল চাঁদের সীমার মধ্যে একটি নতুন ইকোসিস্টেম তৈরি করবে, নাকি কোনো অদৃশ্য পথে পৃথিবীর দিকেও ছড়িয়ে পড়বে? বিজ্ঞানীরা তনয়া ও কিয়ানকে কঠোর কোয়ারেন্টাইনে রেখেছেন, তবু তাঁদের স্বপ্নে প্রায়ই ফিরে আসে সেই রূপালি বন—নীরব অথচ জীবন্ত, অন্ধকার মহাশূন্যে অক্সিজেনের শ্বাস ছড়িয়ে দিচ্ছে। এক রাতে তনয়া জানালার ওপারে তাকিয়ে দেখলেন পৃথিবীর নীল আকাশের কিনারে অচেনা এক আলোর রেখা ভেসে বেড়াচ্ছে, ঠিক যেমনটা চাঁদের গহ্বরের ছবিতে দেখা গিয়েছিল। তিনি কিয়ানের দিকে তাকালেন; দুজনেই কোনো কথা বললেন না। মানুষের জয়-পরাজয়ের সীমা কোথায়, তা তারা নিজেরাই জানেন না। হয়তো নক্ষত্রবীজ ইতিমধ্যেই তাদের রক্তের ভেতর নীরবে বীজ বপন করেছে, হয়তো এই নীরব আলোর মধ্যেই লুকিয়ে আছে মহাবিশ্বের পরবর্তী জীবনের সূত্র। সেই মুহূর্তে তনয়ার মনে হলো, ধ্বংসের মধ্যেও জীবন সবসময় নিজের পথ খুঁজে নেয়—আর হয়তো মানুষ এখন সেই পথের একেবারে শুরুর প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে।
শেষ