ঋজু দত্ত
১
২১২০ সালের কলকাতার সকাল যেন এক মহাপ্রলয়ের পূর্বাভাস হয়ে নেমে এসেছিল। একসময় প্রাণচঞ্চল এই শহর তখন অর্ধেক ডুবে আছে গঙ্গার অশান্ত জোয়ারে। আকাশজুড়ে ঘন নীল-ধূসর মেঘের স্তর, যেন সূর্যের আলোকে গ্রাস করে নিয়েছে। লালবাজারের পুরনো রাস্তাগুলো, কলেজ স্ট্রিটের বইয়ের গলি, বউবাজারের পুরাতন অট্টালিকাগুলি—সবকিছু এখন দৃষ্টিসীমার নীচে নেমে গেছে। কেবল ছাদগুলোর কিছু অংশ, ভেসে থাকা কাঠের ঘাট ও পরিত্যক্ত ট্রামলাইন জলরাশির মধ্যে সেতুর মতো ভেসে আছে। বাতাসে ভিজে শ্যাওলার গন্ধ, মিশে আছে মরচেধরা লোহার গন্ধ, যেন শহরের প্রতিটি নিঃশ্বাসে মরণঘণ্টা বেজে চলেছে। আকাশে অস্থির ড্রোন টাওয়ারগুলো অবিরাম চক্কর দিচ্ছে, তাদের মাইক্রোফোনে ভেসে আসছে কণ্ঠস্বর—সরকারের শেষ সতর্কবার্তা: “নিম্নভূমি খালি করুন। উত্তর হ্যাবিট্যাটের দিকে সরান। অবিলম্বে।” ড্রোনের নীল আলো গঙ্গার ঢেউয়ের উপর পড়ছে, জলের সঙ্গে মিশে এক অদ্ভুত আভা তৈরি করছে। মানুষজন ছুটোছুটি করছে—কেউ কাঁচের গম্বুজে ঢোকার জন্য মরিয়া, কেউ ভাসমান নৌট্রামের জন্য অপেক্ষা করছে, কেউ আবার হাল ছেড়ে বসে আছে ধসে যাওয়া বারান্দার কিনারে। শহরটি যেন বাঁচা-মরার সীমারেখায় দাঁড়িয়ে আছে, আর প্রতিটি ঢেউ সেই সীমারেখা ক্রমশ মুছে দিচ্ছে।
এই বিশৃঙ্খলার মধ্যে দাঁড়িয়ে ইরাবতী সেন স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল গঙ্গার উত্তাল জলরাশির দিকে। একসময় এই শহরেই তার শৈশব কেটেছে—লালবাজারের ভেতরকার আঁকাবাঁকা গলি, যেখানে শীতের বিকেলে ছেলেমেয়েরা ক্রিকেট খেলত; কলেজ স্ট্রিটের সিঁড়িঘেঁষা বইয়ের দোকান, যেখানে সে প্রথম পৃথিবীর আবহাওয়ার ইতিহাস পড়েছিল; কফি হাউসের উষ্ণ আলো, যেখানে বন্ধুদের সঙ্গে বসে সে জলবায়ু পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখেছিল। আজ সেই সবকিছু কেবল স্মৃতির ভেলায় ভাসছে। ছোটবেলার যে ঘরটিতে সে একসময় বারান্দায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টির জল ধরত, তা আজ নিঃশব্দে ডুবে গেছে অচেনা গঙ্গার তলায়। বাতাসে এখনও সে খুঁজে পায় সেই পরিচিত গন্ধ—পচা কাঠ, ভিজে মাটি, আর মানুষের হাহাকার। কিন্তু ইরাবতীর চোখে জল আসে না। বিজ্ঞানী হিসেবে সে জানে, এ কেবল প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়; এ মানুষের লোভ, অজ্ঞতা আর ক্ষমতার লড়াইয়ের পরিণতি। বরফগলা হিমবাহ, অযাচিত কার্বন নিঃসরণ, অপ্রতিরোধ্য নগরায়ণ—সব মিলেই গঙ্গার এ ভয়ংকর উন্মত্ততা। বছরের পর বছর পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধির সতর্কবার্তা দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু রাজনীতি আর মুনাফার খেলায় সেই সতর্কতাকে উপহাস করা হয়েছিল। আজ সেই ভুলের মাশুল দিচ্ছে কলকাতা, আর তার মতো হাজারো শহর।
তবুও ইরাবতী জানে এই বিপর্যয়ের পেছনে লুকিয়ে আছে আরও গভীর সত্য। গঙ্গার স্রোতে ভেসে আসা কিছু ধাতব টুকরো, জলতলের অদ্ভুত নীল আলো, এবং সরকারের অস্বাভাবিক গোপনীয়তা তাকে ক্রমাগত কৌতূহলী করে তুলছে। কয়েক মাস আগে থেকেই সে লক্ষ্য করছিল—ড্রোন টাওয়ারের ঘনঘন উড্ডয়ন, গঙ্গার নিচে বিশেষ গবেষণা-যান পাঠানো, এবং গোপনে জলে ডুবসাঁতার দেওয়া কিছু অচেনা টেকনিশিয়ানের আনাগোনা। এই প্লাবনকে অনেকেই কেবল প্রাকৃতিক বিপর্যয় বলে মানছে, কিন্তু ইরাবতী অনুভব করছে এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে মানুষের গোপন কোনো প্রযুক্তি বা নিষিদ্ধ গবেষণা। সে জানে, এই শহরের মাটির নিচে, হয়তো শতাব্দী পুরনো কোনো অজানা শক্তি নিঃশব্দে জেগে উঠছে। লালবাজারের হারানো গলি আর কলেজ স্ট্রিটের ডুবন্ত বইপাড়া যেন তাকে ডাকছে—“সত্যের কাছে এসো।” তার ভেতরে এক অদ্ভুত টান কাজ করছে, যেন এই মহাপ্লাবনের গভীরে লুকিয়ে থাকা রহস্য উন্মোচন করা ছাড়া তার জীবনের আর কোনো গন্তব্য নেই। তাই সতর্কবার্তা যতই বাজুক, চারদিক যতই তছনছ হোক, ইরাবতী ধীরে ধীরে এগিয়ে চলে সেই নীল আলোর উৎসের দিকে—যেখানে হয়তো লুকিয়ে আছে মানবজাতির ভবিষ্যৎ অথবা তার চূড়ান্ত পরিসমাপ্তি।
২
উত্তর হ্যাবিট্যাট—জলরোধী গম্বুজে ঢাকা এই নবনির্মিত নগরীটি এখন ডুবন্ত কলকাতার নতুন কেন্দ্রবিন্দু। গম্বুজের ভেতরে ঢুকতেই যেন মনে হয় অন্য এক জগতে প্রবেশ করা হচ্ছে। গ্লাসের দেয়ালে বাইরের ধূসর জলরাশির ঢেউ আছড়ে পড়ছে, অথচ ভেতরে রয়েছে নিয়ন্ত্রিত আবহাওয়া, নরম আলো এবং মানুষের স্বাভাবিক জীবনের স্পন্দন। প্রাচীন শহরের সীমানা ছাড়িয়ে এই হ্যাবিট্যাটকে গড়ে তোলা হয়েছে এক বিশাল জলরোধী বৃত্তের উপর, যার নিচে গভীর পাইলিং ধরে রেখেছে সম্পূর্ণ কাঠামো। ভাসমান বাজারগুলোতে অদ্ভুত সব আয়োজন—হাইড্রোপনিক সবজি, ল্যাব-উৎপাদিত মাছ, কৃত্রিম মাংসের স্টল, এমনকি পুরনো কলকাতার ঘুগনি আর ফুচকার মতো ঐতিহ্যবাহী খাবারের দোকানও আছে। স্বয়ংক্রিয় নৌট্রামগুলো কাঁচের টানেলের ভেতর দিয়ে ভেসে চলেছে, যাত্রীদের নিয়ে এক গম্বুজ থেকে অন্য গম্বুজে পৌঁছে দিচ্ছে। পুরনো কলকাতার রাস্তার ভিড় এখানে নেই, কিন্তু প্রযুক্তির মিশেলে এক অদ্ভুত মানবিক উষ্ণতা এখনও টিকে আছে। শিশুদের হাসি, বাজারের দরদাম, নরম আলোর নিচে অ্যান্ড্রয়েড বিক্রেতাদের মৃদু কণ্ঠ—সব মিলিয়ে মনে হয় প্রকৃতির মহাপ্লাবনের মাঝেও মানুষ বেঁচে থাকার শিল্প শিখে নিয়েছে। তবু গম্বুজের দেয়ালের ওপারে যখন জলপৃষ্ঠের কালো ছায়া নড়ে ওঠে, তখন প্রত্যেকের মনেই এক অজানা ভয় ঢুকে পড়ে—গম্বুজের এক ফাটল মানেই পুরো জীবনের অবসান।
ইরাবতী সেন এই গম্বুজের ভেতর হাঁটতে হাঁটতে একদিকে বিস্মিত, অন্যদিকে অস্থির। তার চোখে এখনো পুরনো কলকাতার স্মৃতি ভাসে—রাস্তার বইয়ের গন্ধ, মেট্রোর সিঁড়ি, রাতের আড্ডা। কিন্তু সেই শহর এখন কেবল গঙ্গার গভীরে লুকিয়ে আছে। গম্বুজের কাঁচের দেয়ালে সে যখন বাইরের জলরাশির দিকে তাকায়, তখন মনে হয় অন্ধকারের গভীরে কোনো অচেনা আলো নড়ে উঠছে। এই সময়েই হাজির হয় তার সহকর্মী আদিত্য ঘোষ, এক তরুণ প্রযুক্তি উদ্যোক্তা। আদিত্যর চোখে লুকানো উত্তেজনা, কণ্ঠে চাপা গোপনীয়তা। “ইরা, তুমি যা ভাবছো, এই জল কেবল প্লাবন নয়,” ফিসফিস করে বলে সে। “আমরা জলের নিচে কিছু খুঁজে পেয়েছি। প্রাচীন মন্দিরের ধ্বংসাবশেষের মধ্যে এমন ধাতব কাঠামো, যা আমাদের আধুনিক প্রযুক্তিকেও হার মানায়।” ইরাবতীর বুকের ভেতর যেন হঠাৎ ঝড় বয়ে যায়। মাসের পর মাস ধরে সে যে অদ্ভুত ড্রোন তৎপরতা লক্ষ্য করছিল, যে গোপন সরকারি গবেষণা নিয়ে সন্দেহ করছিল, সবকিছুর উত্তর যেন এই কথার মধ্যেই লুকিয়ে। আদিত্য আরও জানায়, তারা গঙ্গার তলদেশে শৈলগৃহ সদৃশ এক গম্বুজ আবিষ্কার করেছে, যেখানে অদ্ভুত এক শক্তির তরঙ্গ মাপা গেছে—যা মানুষের জানা কোনো এনার্জি-প্যাটার্নের সঙ্গে মেলে না। এই শক্তি এতটাই প্রাচীন এবং উন্নত যে, তা হয়তো সমুদ্রপৃষ্ঠ নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম।
আদিত্যের কথায় ইরাবতীর মনে উত্তেজনা এবং ভয়ের মিশ্রণ জাগে। সে জানে, এই আবিষ্কার যদি সত্যি হয়, তবে মানব সভ্যতার ভবিষ্যৎ সম্পূর্ণ বদলে যেতে পারে। কিন্তু সে এটাও বোঝে, এ ধরনের শক্তি মানুষের লোভের হাতে পড়লে বিপর্যয় আরও ভয়ঙ্কর হবে। গম্বুজের কাঁচের দেয়ালে যখন বাইরের ঢেউ আছড়ে পড়ে, তখন সে অনুভব করে সময় যেন ক্রমশ সংকুচিত হচ্ছে। আদিত্য তাকে গোপনে এক ডাইভিং-সাবমার্সিবলে করে সেই ধ্বংসাবশেষে নামার প্রস্তাব দেয়। “আমরা যদি সত্যটা নিজের চোখে না দেখি, সরকার বা কর্পোরেট শক্তিরা এই রহস্য নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করবে,” আদিত্যর কণ্ঠ দৃঢ়। ইরাবতী জানে, এই অভিযানে বিপদ অসংখ্য—গভীর জলের বিষাক্ত শৈবাল, ভাঙা স্থাপনার ধ্বংসস্তূপ, আর অচেনা প্রযুক্তির অপ্রত্যাশিত প্রতিক্রিয়া। তবু তার ভিতরের বিজ্ঞানী সত্তা আর অদম্য কৌতূহল তাকে আটকে রাখতে পারে না। গম্বুজের আলো-আঁধারি পথে হাঁটতে হাঁটতে সে অনুভব করে, এই ডুবন্ত শহরের বুকের মধ্যে লুকিয়ে আছে এমন এক শক্তি, যা হয়তো পৃথিবীর জলবায়ুর নিয়ন্ত্রণ ফিরিয়ে দিতে পারে, আবার মানব সভ্যতাকে সম্পূর্ণ ধ্বংসও করতে পারে। গম্বুজের ভেতরের নিঃশব্দ কোলাহলে দাঁড়িয়ে ইরাবতী যেন বুঝে যায়—জলমগ্ন কলকাতার প্রকৃত রহস্য কেবল শুরু হচ্ছে।
৩
পুরনো সরকারি আর্কাইভের ভেতরকার আর্দ্র, নোনা গন্ধমাখা একটি ঘরে দাঁড়িয়ে ইরাবতী সেই মানচিত্রটি খুঁজে পায়, যা যেন অতীতের বুক চিরে উঠে এসেছে। ব্রিটিশ আমলের এই নকশাটি ছিল একটি জলপথ উন্নয়ন প্রকল্পের নথি, যা কখনো বাস্তবায়িত হয়নি। মলিন কাগজে নীল রঙের কালি ফ্যাকাসে হয়ে গেছে, কিন্তু লাল দাগ দিয়ে আঁকা গঙ্গার তলদেশের অচেনা সুড়ঙ্গের রেখা স্পষ্ট। নকশার পাশে ইংরেজি ও বাংলার মিশ্রণে লেখা কিছু সংকেতচিহ্ন চোখে পড়ে—“Underwater conduit—restricted,” “Energy core,” “Not for civilian execution.” ইরাবতীর শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে যায়। এতদিন যে প্রাচীন প্রযুক্তির সম্ভাবনার কথা আদিত্য বলছিল, তার ছায়া যেন এই নকশাতেই লুকিয়ে ছিল। এই সুড়ঙ্গ কি সত্যিই সেই শৈলগৃহের দিকে নিয়ে যায়, নাকি আরও গভীর কোনো গোপন বিপদ লুকিয়ে আছে? মানচিত্রের ধারে ধারে দেখা যায় লাল বিন্দু দিয়ে কিছু সতর্ক চিহ্ন—সেগুলি হয়তো জলচাপের বিপজ্জনক অঞ্চল অথবা তৎকালীন ব্রিটিশ সেনাদের লুকোনো প্রবেশপথ। ইরাবতীর মনে পড়ে যায় আদিত্যর সেই কথাগুলো, “আমরা যা খুঁজছি তা হয়তো মানুষের জানা প্রযুক্তির সীমা ছাড়িয়ে গেছে।” মানচিত্রটি হাতে নিয়ে সে বুঝতে পারে, এই সুড়ঙ্গই হয়তো সমুদ্রপৃষ্ঠের তাণ্ডব ঠেকানোর চাবিকাঠি, অথবা সমগ্র শহরটিকে চিরতরে গ্রাস করে নেওয়ার নিঃশব্দ ফাঁদ।
কিন্তু এই পথে যাত্রা মোটেই সহজ নয়। গঙ্গার তলদেশ এখন আর কেবল নদীর গাঢ় নীল শান্ত জল নয়, বরং বিষাক্ত শৈবাল, জৈববর্জ্য আর ধসে পড়া স্থাপনার মৃত্যুফাঁদ। ডুবন্ত ভবনগুলির ফাঁকফোকরে সৃষ্টি হয়েছে ভয়ানক ঘূর্ণি, যেখানে একবার আটকে গেলে আর উপরে ওঠা সম্ভব নয়। ড্রোন টাওয়ারের নজরদারির বাইরে যেতে হলে ইরাবতী ও আদিত্যকে রাতের অন্ধকারে গোপনে যাত্রা শুরু করতে হবে। সেই সঙ্গে রয়েছে জলদস্যুদের দাপট—প্লাবনের পরবর্তী বিশৃঙ্খলায় গড়ে ওঠা একদল সশস্ত্র লুটেরা, যারা ডুবন্ত কলকাতার প্রতিটি সুড়ঙ্গ ও পথরেখা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। তারা শুধুমাত্র প্রযুক্তি নয়, যে কোনো দুষ্প্রাপ্য জিনিসের জন্য হামলা চালাতে দ্বিধা করে না। ইরাবতীর মনে পড়ে যায় সাম্প্রতিক খবরের কথা—একটি ডাইভিং-সাবমার্সিবল দলকে পুরোপুরি নিখোঁজ করে দিয়েছিল এই জলদস্যুরা, কেবল উদ্ধার হয়েছিল ছেঁড়া পোশাক আর ভাঙা অক্সিজেন সিলিন্ডার। এই বিপদের মধ্যেই তাকে এবং আদিত্যকে মানচিত্রের সংকেত মিলিয়ে সুড়ঙ্গের প্রবেশপথ খুঁজে বের করতে হবে। সঠিক পথ না পেলে বা সামান্য ভুল করলে পুরো যাত্রা শেষ হতে পারে গভীর অন্ধকারের গহ্বরে।
তবু ইরাবতীর কৌতূহল ও দায়িত্ববোধ তাকে পিছিয়ে যেতে দেয় না। গম্বুজের নিরাপদ আলোর ভেতর থেকে বেরিয়ে এই বিপজ্জনক জলে নামার সিদ্ধান্ত নিলে যেন সে নিজের ভেতরের ভয়কেও অতিক্রম করে। মানচিত্রটি সে বারবার খুঁটিয়ে দেখে, প্রতিটি সংকেতচিহ্ন মনে গেঁথে রাখে—কোথায় প্রবল স্রোত, কোথায় ধসে পড়া টানেল, কোথায় বাতাস জমার সম্ভাবনা। তার মনে এক অদ্ভুত স্রোত বয়ে যায়—এ শুধু বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান নয়, এটি যেন তার নিজের শিকড়ের দিকে যাত্রা। গঙ্গার বুকের নিচে হয়তো লুকিয়ে আছে সেই প্রাচীন প্রযুক্তি, যা একদিন মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির সমঝোতার গল্প বলত। কিন্তু সেই প্রযুক্তি কি আজও মানবজাতির মুক্তির হাতিয়ার, নাকি ধ্বংসের সংকেত? রাতের নিস্তব্ধতায় যখন দূরে ভাসমান নৌট্রামের আলো নিভে আসে, ইরাবতী জানে সময় দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। এই নিমজ্জিত মানচিত্র কেবল অতীতের দলিল নয়, এটি ভবিষ্যতের নিয়ন্ত্রণেরও চাবিকাঠি—একটি মানচিত্র যা মানুষকে হয় বাঁচাবে, নয়তো চিরতরে ডুবিয়ে দেবে।
৪
অন্ধকার জলের তলদেশে ইরাবতীদের যাত্রা যেন এক অচেনা গহ্বরের দিকে নামার মতো লাগছিল। চারপাশের চাপা সবুজ আলো, ডুবন্ত ইট-পাথরের ধ্বংসাবশেষ, ভেসে বেড়ানো শ্যাওলার গন্ধ—সবকিছুই যেন এক অজানা সময়ের প্রমাণ বহন করছিল। সাঁতারের সময় তাদের শরীরের চারপাশে অসংখ্য ক্ষুদ্র মাছ চক্কর কেটে চলছিল, আবার হঠাৎ করে হিমশীতল স্রোতের ঝাঁপটা এসে গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল। ইরাবতীর হাতে ধরা ফ্ল্যাশলাইটের আলো যখন গভীরতার গাঢ় অন্ধকার চিরে এগিয়ে চলছিল, তখনই তারা দেখতে পেল এক অদ্ভুত ধাতব গম্বুজ। সাধারণ পাথর বা ইটের তৈরি নয়, গম্বুজটি যেন স্টিলের মতো কোনো অজানা মিশ্র ধাতুর তৈরি—যার গায়ে ঘন সবুজ শ্যাওলা লেপ্টে আছে, আর শ্যাওলার ভেতর থেকে ভেসে আসছে এক অপার্থিব নীল আলোকছটা। গম্বুজটির বক্র গায়ে হাত বুলিয়ে ইরাবতীর মনে হল এটি কেবল কোনো পুরনো ধ্বংসাবশেষ নয়, বরং এর গঠন, তার নিখুঁত বৃত্তাকৃতি, এবং তার অদ্ভুত শক্ত ধাতু যেন এক অন্যরকম উদ্দেশ্য বহন করছে। নীরবতার মাঝে শুধু জলের শব্দ, ফুসফুসের বুদবুদের আওয়াজ, আর অজানা যন্ত্রের নিঃশব্দ কম্পন যেন কান পাতলেই শোনা যাচ্ছিল।
কৌতূহল আর ভয়ের মিশ্র অনুভূতিতে ইরাবতী এগিয়ে গিয়ে গম্বুজের ধাতব দেওয়াল স্পর্শ করল। মুহূর্তের মধ্যেই অপ্রত্যাশিত এক কম্পন সারা গম্বুজজুড়ে ছড়িয়ে পড়ল—ধাতুর ভেতর থেকে যেন গুঞ্জনের মতো এক অচেনা শব্দ ভেসে এল। শ্যাওলা ঢাকা পৃষ্ঠ হালকা কাঁপতে শুরু করল, আর তাদের পায়ের নীচে বালি উড়িয়ে এক প্রবল স্রোত গম্বুজের চারপাশে ঘুরপাক খেতে লাগল। ইরাবতীর সঙ্গী আরমান তড়িঘড়ি করে ইশারা করল পিছিয়ে যেতে, কিন্তু ইরাবতী তার চোখের সামনে ধীরে ধীরে খুলে যেতে থাকা একটি বৃত্তাকার দরজা দেখে পিছু হঠল না। দরজাটি যেন নিখুঁতভাবে সিল করা ছিল—কোনো ফাঁকফোকর নেই, তবু ধাতুর ভেতরের অদ্ভুত নীল আলোর ঝলকানি তার পরিধি ধরে রেখেছিল। এক মুহূর্তের জন্য দরজার ফাঁক থেকে যেন গরম বাতাস বেরিয়ে এল, অথচ তারা ছিল গভীর জলের তলদেশে। বায়ুরোধী সেই দরজা খুলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জলের ভেতর থেকে যেন এক চাপা শ্বাস নেওয়ার শব্দ ভেসে উঠল—যেন শতাব্দী ধরে বন্ধ থাকা কোনো প্রাণ আবার জীবন্ত হয়ে উঠছে। ইরাবতীর মনে হল তারা এমন কিছু আবিষ্কার করতে চলেছে, যা মানুষের ইতিহাসকেও নতুন করে লিখতে পারে।
দরজার ওপারে প্রবেশ করতেই তারা যেন অন্য এক জগতের ভেতর চলে এল। ভেতরের বাতাস অবিশ্বাস্যভাবে শুকনো, যেন বাইরের জল কখনো এখানে প্রবেশই করেনি। ম্লান নীল আলোয় আলোকিত বিশাল গম্বুজের কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে ছিল এক অদ্ভুত যন্ত্র—একটি এনার্জি-রিঅ্যাক্টর। তার গায়ে খোদাই করা অচেনা প্রতীক আর অদ্ভুত নকশা দেখে মনে হচ্ছিল এটি ব্রিটিশদের পুরনো কোনো গোপন প্রযুক্তি নয়, বরং অনেক বেশি উন্নত কোনো সভ্যতার সৃষ্টি। রিঅ্যাক্টরটি সমুদ্রের জোয়ার-ভাটার শক্তি শোষণ করে নিজের ভেতর জমা করতে পারে, আর সেই শক্তি থেকে হয়তো কোনো এক অমোঘ শক্তিকেন্দ্র চালু রাখা সম্ভব। ইরাবতী যন্ত্রটির গায়ে হাত রাখতেই গা বেয়ে বয়ে গেল বিদ্যুতের মতো শিহরণ; যেন এই ধাতব দেহে আজও প্রবাহিত হচ্ছে এক অদৃশ্য শক্তি। চারপাশে ঝুলন্ত ধাতব পাইপ, কাচের গোলক আর অচেনা ধাতব ফলকগুলোকে দেখে মনে হচ্ছিল যেন এক মহাজাগতিক ঘড়ির ভেতর দাঁড়িয়ে আছে তারা। ইরাবতীর মনের ভেতর একদিকে ভয়, অন্যদিকে এক অসীম উত্তেজনা কাজ করছিল—যদি এই রিঅ্যাক্টর সক্রিয় করা যায়, তবে সমুদ্রের শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা হয়তো মানুষের হাতে চলে আসবে। কিন্তু সেই শক্তির পরিণতি কী হতে পারে, তা ভেবে শিউরে উঠল সে। শতাব্দীপ্রাচীন এই স্টিলের প্রাসাদে দাঁড়িয়ে ইরাবতীর মনে হল—মানুষের লোভ আর বিজ্ঞানের সীমাহীন শক্তি একসাথে মিশে গেলে পৃথিবীর অন্তর্গত রহস্যও যে কতটা বিপজ্জনক হতে পারে, তা সে আজ নিজের চোখে প্রত্যক্ষ করছে।
৫
ইরাবতীর চোখে তখনও শ্যাওলা-ঢাকা ধাতব গম্বুজের ঝলক যেন ভাসছিল, অথচ ভেতরের আবিষ্কার তাকে সম্পূর্ণ নতুন এক চিন্তার জগতে ছুঁড়ে ফেলেছিল। গম্বুজের প্রাচীন ধাতব দেয়ালের গায়ে খোদাই করা অচেনা প্রতীকগুলো নিয়ে সন্ধান চালাতে গিয়েই সে একটি পুরনো নথি খুঁজে পায়, যেটি দীর্ঘদিনের পলি আর শ্যাওলার নিচে চাপা পড়ে ছিল। জলের তলদেশ থেকে উদ্ধার করা সেই নথি শুকিয়ে পড়ার পর দেখা যায়, এটি কোনো ব্রিটিশ প্রকৌশলীর নয়, বরং তারও বহু শতাব্দী আগের প্রাচীন বঙ্গের এক অচেনা সভ্যতার। নথির পাতায় পাতায় রহস্যময় সব শব্দ, নিখুঁত গাণিতিক চিহ্ন এবং জলের গতিবিধি বোঝাতে ব্যবহৃত জটিল নকশা—সব মিলিয়ে ইরাবতীর মনে হল, এ এক অজানা প্রযুক্তির ইতিহাস, যা আধুনিক বিজ্ঞানের অনেক কিছুকেই হার মানাতে পারে। নথির শেষদিকে একটি বিশেষ যন্ত্রের উল্লেখ করা ছিল—“নীল প্রণালী”—যা সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। শব্দগুলোর তাৎপর্য বুঝতে গিয়ে ইরাবতীর চোখ বিস্ফারিত হয়ে গেল। অর্থাৎ এই সভ্যতা কেবল জোয়ার-ভাটা নয়, পুরো সমুদ্রের শক্তিকেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারত! মানুষের হাতে যদি সমুদ্রপৃষ্ঠ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা থাকে, তবে জলবায়ু পরিবর্তন, জলোচ্ছ্বাস, এমনকি উপকূলবর্তী শহরগুলোর ভবিষ্যৎও বদলে দেওয়া সম্ভব। কিন্তু এই অদ্ভুত শক্তির ইতিহাসই প্রমাণ করে যে, সেই সভ্যতা শেষ পর্যন্ত বিলুপ্ত হয়েছিল—কেননা তারা হয়তো নিজেদের শক্তিকে সামলাতে পারেনি।
রিঅ্যাক্টরের পাশে দাঁড়িয়ে ইরাবতীর মনে হচ্ছিল, গম্বুজের ভেতর বদ্ধ বাতাস যেন আরও ভারী হয়ে উঠেছে। “নীল প্রণালী” সক্রিয় করার জন্য যে ধাপগুলোর কথা নথিতে লেখা আছে, সেগুলো ভয়ঙ্করভাবে নিখুঁত, যেন প্রাকৃতিক শক্তিকে বশ মানানোর জন্যই তৈরি। নথি অনুসারে, যন্ত্রটি সক্রিয় হলে সমুদ্রের জোয়ার-ভাটার শক্তি অসংখ্য গুণে বৃদ্ধি পাবে এবং সেই শক্তিকে ব্যবহার করে নির্দিষ্ট এলাকার জলস্তর ইচ্ছেমতো বাড়ানো বা নামানো সম্ভব হবে। কিন্তু এই প্রক্রিয়ার একটি বিপজ্জনক মূল্যও ছিল—প্রাথমিক পর্যায়ে শক্তি সঞ্চারিত করতে গিয়ে শহরের একাংশকে চিরতরে জলমগ্ন করে দিতে হবে, যেন সেই ডুবে যাওয়া অংশই পুরো ব্যবস্থার ভারসাম্য রক্ষার জন্য উৎসর্গিত হয়। ইরাবতী নথি পড়তে পড়তে কেঁপে উঠল। তার মাথায় সঙ্গে সঙ্গে ভেসে উঠল কলকাতার নিম্নাঞ্চল, নদীর তীর ঘেঁষে বসবাস করা হাজারো মানুষ, অগণিত ঘরবাড়ি, স্কুল, হাসপাতাল। এই প্রযুক্তি যদি ভুল হাতে পড়ে, বা ভুলভাবে সক্রিয় হয়, তবে এক মুহূর্তেই একটি বিশাল নগরীর প্রাণকেন্দ্র চিরতরে গঙ্গার তলায় তলিয়ে যেতে পারে। তার বিজ্ঞানী সত্তা এই অসামান্য শক্তির গুরুত্ব বুঝে মুগ্ধ হচ্ছিল, অথচ মানবিক সত্তা ভয় পাচ্ছিল এই শক্তির অন্ধকার দিক নিয়ে। এমন এক শক্তি যা পৃথিবীর জলবায়ু সংকট সমাধান করতে পারে, আবার একই সঙ্গে এক মহাপ্রলয়ের কারণও হতে পারে।
আরমান আর বাকি দল গম্বুজের ভিতর আলো জ্বালিয়ে যন্ত্রের গঠন পরীক্ষা করতে শুরু করল, কিন্তু ইরাবতী তখনও নথির প্রতিটি শব্দ বিশ্লেষণ করে চলেছে। সে বুঝতে পারছিল, এখানে কেবল প্রযুক্তি নয়, মানুষের লোভ, ক্ষমতা আর প্রাকৃতিক ভারসাম্যের এক জটিল সমীকরণ লুকিয়ে আছে। নথির শেষ পাতায় এক সতর্কবার্তা স্পষ্ট করে লেখা ছিল—“প্রকৃতির চক্র ভাঙলে সে নিজেই প্রতিশোধ নেবে।” শব্দগুলো পড়ে ইরাবতীর মনে হল যেন প্রাচীন কোনো বিজ্ঞানী ভবিষ্যতের মানুষের জন্য এক শেষ সতর্কবার্তা রেখে গেছেন। গম্বুজের ভেতর তখন নিঃশব্দ যন্ত্রের মৃদু কম্পন শোনা যাচ্ছিল, যেন শতাব্দীপ্রাচীন এই প্রযুক্তি নতুন করে জেগে উঠতে চাইছে। ইরাবতী ধাতব প্রাসাদের শ্যাওলাধরা দেয়ালে হাত রেখে শপথ করল, সে এই প্রযুক্তিকে অন্ধভাবে সক্রিয় করবে না। তবু মনে এক অদ্ভুত টান কাজ করছিল—যেন “নীল প্রণালী” নিজেই তাকে আহ্বান জানাচ্ছে, তার শক্তির পুনর্জন্ম ঘটাতে। সমুদ্রের তলদেশে দাঁড়িয়ে ইরাবতী বুঝতে পারল, সভ্যতার ইতিহাস শুধু আবিষ্কারের নয়, সতর্কতার ইতিহাসও বটে; আর মানুষ যদি সেই সতর্কতা ভুলে যায়, তবে গোপন প্রযুক্তির পুনর্জন্ম এক আশীর্বাদের চেয়ে অভিশাপ হয়ে উঠতে পারে।
৬
ইরাবতী ও আদিত্য যখন সেই প্রাচীন নীল প্রণালী এবং তার ক্ষমতার উপর আরও গভীরভাবে নজর রাখে, তখন তারা বুঝতে পারে যে এটি শুধুই একটি বৈজ্ঞানিক অজানা নয়, বরং মানবজাতির ভবিষ্যত নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা রাখে। নীল প্রণালীর মাধ্যমে জলস্তরের নিয়ন্ত্রণ, সমুদ্রের ঢেউ কমানো বা বাড়ানো, এমনকি খরা ও বন্যার তীব্রতা নিয়ন্ত্রণের মতো শক্তি অর্জন সম্ভব। কিন্তু শক্তি যেমন চমকপ্রদ, তেমনি বিপজ্জনকও। সরকারের প্রতিনিধি এবং কর্পোরেট কোম্পানির শীর্ষ কর্মকর্তারা একযোগে এই আবিষ্কারের খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে ছুটে আসে। তাদের চাহিদা ভিন্ন—কেউ এটি কৌশলগত সুবিধার জন্য, কেউ ব্যবসায়িক লাভের জন্য ব্যবহার করতে চায়। আদিত্য প্রথমে এর ভয়াবহতা উপলব্ধি করে, যখন সে দেখে কিভাবে কিছু উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা মানবিক দায়িত্বকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে শুধুই শক্তি ও টাকা অর্জনের জন্য চেষ্টা চালাচ্ছে। ইরাবতী, যার মন সবসময় প্রকৃতির প্রতি কোমল এবং সহানুভূতিশীল, সে বুঝতে পারে যে এই আবিষ্কার যদি মানুষের লোভের দিকে ব্যবহার হয়, তবে তা শুধু পরিবেশের জন্য নয়, মানবজাতির জন্যও ধ্বংসাত্মক হতে পারে। তারা দুজনই বুঝতে পারছে যে তারা এমন একটি ক্রুসিয়াল সময়ের সম্মুখীন, যেখানে সিদ্ধান্ত নেওয়া মানে শুধু একটি আবিষ্কার সংরক্ষণ নয়, বরং মানবতার ভাগ্য নির্ধারণ করা।
নৈতিক দ্বিধা তাদের মধ্যে ক্রমেই চাপ সৃষ্টি করে। আদিত্য, যার মধ্যে বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদের কৌতূহল রয়েছে, সে প্রাথমিকভাবে ভাবতে শুরু করে যে এই প্রযুক্তি বিক্রি করা বা শেয়ার করা একটি সুবিশাল বৈজ্ঞানিক পদক্ষেপ হতে পারে। সে মনে করে, যদি পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে এটি ছড়িয়ে দেওয়া হয়, তবে জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ নিয়ন্ত্রণে সহায়ক হতে পারে। কিন্তু ইরাবতী তাকে সতর্ক করে যে মানুষের লোভ ও ক্ষমতার লোভ এই প্রযুক্তিকে ধ্বংসাত্মকভাবে ব্যবহার করতে পারে। তাদের আলোচনায় ক্রমশ স্পষ্ট হয় যে শক্তি যখন খারাপ হাতে যাবে, তখন তা আর কোনওভাবে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। তারা লক্ষ্য করে যে কর্পোরেট প্রতিনিধি কেবল মুনাফার কথা ভাবছে, সরকার চাইছে কৌশলগত সুবিধা, আর তাদের এই নীরব আবিষ্কারের সত্যিকার উদ্দেশ্য—প্রকৃতির সুরক্ষা—পুরোপুরি হারিয়ে যাচ্ছে। একসময় তারা স্থির হয় যে এই প্রযুক্তি যদি বাইরে প্রকাশ পায়, তবে তা একটি নতুন ধরনের দ্বন্দ্ব ও অরাজকতা সৃষ্টি করবে। এই উপলব্ধি তাদের নৈতিক অবস্থানকে জটিল করে তোলে—একদিকে মানবতার কল্যাণে কাজ করার আকাঙ্ক্ষা, অন্যদিকে বাস্তবতায় লোভ, ক্ষমতা ও স্বার্থের চাপ।
শেষপর্যন্ত, ইরাবতী ও আদিত্য সিদ্ধান্ত নেয় যে প্রকৃতি ও মানবজাতির মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করাই তাদের প্রথম দায়িত্ব। তারা বুঝতে পারে যে আবিষ্কারটি কোনও ধরনের প্রকাশ বা বিক্রয় ছাড়া সংরক্ষণ করা সবচেয়ে নিরাপদ পথ। এজন্য তারা নীল প্রণালী সংক্রান্ত সমস্ত নথি, পরিকল্পনা ও যন্ত্রাংশ নিরাপদ স্থানে লুকিয়ে রাখে এবং সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি চাপে নিজেদেরকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেয়। তাদের এই সিদ্ধান্ত ব্যক্তিগত দায়িত্ব, সাহস এবং নৈতিক দৃঢ়তার পরিচয় বহন করে। তারা জানে, পৃথিবী যদি জানত এই শক্তি আছে, তবে তা মানুষের লোভ ও স্বার্থে ব্যবহার হতে বাধ্য। তাই এই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত তাদের মধ্যেকার সম্পর্ককেও দৃঢ় করে—যারা প্রকৃতির প্রতি দায়বদ্ধ, তারা একে অপরের সাহস ও বিশ্বাসের উপর নির্ভর করতে শেখে। ইরাবতী ও আদিত্য এমন এক মানবিক হিসেব-নিকেশে দাঁড়ায় যেখানে শক্তি, নৈতিকতা, প্রেম এবং দায়বদ্ধতার সবই জড়িয়ে থাকে। তারা বোঝে যে প্রকৃতির প্রতি দায়িত্ব পালন মানে কেবল জীবন রক্ষা করা নয়, বরং মানবতার স্বাভাবিক সীমারেখা রক্ষা করা—একটি মূল্যবান, কিন্তু কঠিন দায়িত্ব, যা তাদের সমস্ত কল্পনা ও আশা, ভয় ও সাহসকে একসঙ্গে পরীক্ষায় ফেলে।
৭
শহরের নিম্নভাগের মানুষের দুঃখ, ক্ষোভ এবং অবহেলিত ইতিহাস এক সঙ্গে মিলিত হয়ে আজ একটি অপ্রতিরোধ্য শক্তিতে রূপ নেয়। তারা এমন বহুদিন ধরে নির্যাতন, উপেক্ষা ও বন্যা-ঝুঁকিতে জীবন কাটাচ্ছে যে, তাদের মধ্যে ধীরে ধীরে এক বিদ্রোহের আগুন জ্বলে ওঠে। ইরাবতী ও আদিত্য যখন শহরের দিকে নজর রাখে, তখন তারা দেখে যে জল তাদের ঘর-বারো ঢেকে দিয়েছে, পথসমূহ ভেসে গেছে, এবং মানুষরা নিজের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য সবকিছু ত্যাগ করতে প্রস্তুত। তাদের মধ্যে এমন এক উদ্দীপনা তৈরি হয়েছে যে তারা শীর্ষস্থানের সরকারের নীরবতা ও কর্পোরেট লোভের বিরুদ্ধে একযোগে দাঁড়াতে চায়। নিম্নভাগের মানুষরা শুধুমাত্র নিজেদের জন্য নয়, বরং সমগ্র শহরের জলবায়ুর ভারসাম্য রক্ষার জন্যও প্রযুক্তিটি ব্যবহার করতে চায়। তারা জানে যে নীল প্রণালীর শক্তি যদি তাদের হাতে চলে আসে, তবে এটি শুধুই নিজেদের ঘর রক্ষা নয়, বরং শহরের প্রাকৃতিক ভারসাম্য পুনঃস্থাপনের সুযোগও দিতে পারে। এই নতুন উদ্দীপনা ও আশা মানুষদের মধ্যে একত্রিত হয়ে শহরের বিভিন্ন অঞ্চলে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে, আর শহরের বুক জুড়ে নীরব বিদ্রোহের ঢেউ নেমে আসে।
এই বিদ্রোহের প্রভাবে শহরের বাতাসে এক অদ্ভুত উত্তেজনা বিরাজ করে। মানুষরা পুরনো রাস্তা ও খালে যাত্রা শুরু করে, নিজেদের হাতের সামর্থ্য এবং ছোট ছোট যন্ত্রপাতি নিয়ে সরকারী নীতি ও সেনা উপস্থিতির মুখোমুখি হয়। বিশেষ করে ভাসমান সেতুটি এই সংঘর্ষের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। এই সেতু, যা মূলত শহরের মানুষের জীবনধারার গুরুত্বপূর্ণ সংযোগস্থল, এখন এক যুদ্ধক্ষেত্রের রূপ নেয়। সরকারি সেনা সরঞ্জাম এবং সশস্ত্র বাহিনী এখানে উপস্থিত, তাদের সাথে সংঘর্ষে মানুষরা ভয়, ক্রোধ এবং সাহসের এক জটিল মিশ্রণে লড়ে। প্রতিটি ধাক্কা, প্রতিটি চিৎকার যেন সমুদ্রের সাথে মিলিত হয়ে এক বিশাল তীব্র সুর তৈরি করে। সমুদ্রও যেন তাদের বিদ্রোহের সাথে সঙ্গতি রাখতে শুরু করে—ঝড়ের ঢেউ ক্রমশ বাড়ছে, পানি স্থলভাগে ঢুকছে, সেতুতে লড়াই করা মানুষদের দিশাহীন করে তুলছে। আদিত্য এবং ইরাবতী যখন দূর থেকে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে, তারা উপলব্ধি করে যে এই বিদ্রোহ শুধুমাত্র মানুষের ক্রোধের প্রতিফলন নয়; এটি প্রকৃতির শক্তির সঙ্গে মানুষের চরম সংযোগ।
তাদের দ্বিধা এবং নৈতিকতা এখানে আরও জটিল হয়ে ওঠে। ইরাবতী মনে মনে ভাবতে থাকে, যদি এই বিদ্রোহীরাও প্রযুক্তিটির ভুল ব্যবহার করে, তবে জল এবং শক্তি তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। কিন্তু একই সঙ্গে, তিনি বুঝতে পারেন যে এই বিদ্রোহ মানুষের মৌলিক অধিকার রক্ষার জন্য অত্যাবশ্যক। মানুষরা, যারা বছরের পর বছর ক্ষতি ভোগ করেছে, তাদের মধ্যে বিদ্রোহী শক্তি যেন এক প্রাকৃতিক প্রতিফলন, এক ধরনের ন্যায়বিচারের আহ্বান। ভাসমান সেতুর সংঘর্ষ, সমুদ্রের ক্রমবর্ধমান ঝড় এবং মানুষের দমবন্ধ করা চিৎকার—এই সব মিলিয়ে শহরের আবহাওয়ায় এক অদ্ভুত নাটকীয়তা সৃষ্টি করে। ইরাবতী ও আদিত্য এই মুহূর্তে শুধুই পর্যবেক্ষক নয়, তারা বুঝতে শুরু করে যে নীল প্রণালী কেবল শক্তি নয়, বরং মানুষের আত্মবিশ্বাস, সাহস এবং প্রকৃতির সঙ্গে তাদের সম্পর্কের প্রতিফলন। তারা জানে, যদি এই বিদ্রোহ সঠিকভাবে দিকনির্দেশ না পায়, তবে শুধু মানুষ নয়, শহরের প্রাকৃতিক ভারসাম্যও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ফলে এই অধ্যায়ে মানবতার, নৈতিক দ্বিধা এবং প্রাকৃতিক শক্তির সঙ্গে সংঘর্ষের এক গভীর চিত্র ফুটে ওঠে, যা পাঠককে শহরের বন্যা, বিদ্রোহ এবং সমুদ্রের ঝড়ের ভয়াবহ বাস্তবতায় নিমজ্জিত করে।
৮
অরাজকতার মধ্যেই ইরাবতী এবং আদিত্য গভীর নীরবতায় গোপনে নীল প্রণালীর রিঅ্যাক্টর সক্রিয় করার সিদ্ধান্ত নেয়। তারা জানে, এই প্রযুক্তি চালু করা মানে কেবল শক্তির পরীক্ষা নয়, বরং শহরের ভাগ্য ও মানুষের জীবনের উপর সরাসরি প্রভাব ফেলা। গম্বুজের ভেতরে প্রবেশ করার সময় তাদের চারপাশে একটি অদ্ভুত শক্তির উপস্থিতি অনুভূত হয়—হালকা কম্পন, বাতাসে বিদ্যুতের গন্ধ, এবং নীল আলো ঝলমল করে চারপাশকে আলোকিত করছে। ইরাবতী অত্যন্ত সতর্কভাবে যন্ত্রটি চালু করে, আর সঙ্গে সঙ্গে গম্বুজে নীল আলোর এক ঝলকানি ছড়িয়ে পড়ে। সেই আলো যেন শুধু যন্ত্র নয়, পুরো শহরের ওপর নজর রাখে। বাইরে সমুদ্রের জোয়ার ক্রমশ ভয়ঙ্কর উচ্চতায় পৌঁছাচ্ছে; ঢেউয়ের গর্জন এবং বাতাসে জলবাষ্পের ঘ্রাণ ইরাবতী ও আদিত্যকে মনে করিয়ে দেয় যে তারা এমন এক শক্তির মুখোমুখি, যা মানুষ নিয়ন্ত্রণের বাইরে। তাদের হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়, কিন্তু তাদের মনোযোগ কেবল যন্ত্রের ওপর। তারা জানে, এক মুহূর্তের ভুল শহরকে ভয়ঙ্কর দুর্যোগের মধ্যে ফেলে দিতে পারে।
যন্ত্র চালু হতেই সমুদ্রের পৃষ্ঠ ক্রমশ স্থির হতে শুরু করে, একটি অদ্ভুত শান্তির অনুভূতি শহরের ওপর ছেয়ে যায়। ঢেউগুলো যেন স্থির হয়ে দাঁড়ায়, বাতাসের দমকা কমে আসে, এবং মানুষের মধ্যে সামান্য স্বস্তির সঞ্চার হয়। কিন্তু এই শান্তি দীর্ঘস্থায়ী হয় না। শহরের কিছু অংশে, যেখানে জলাধার এবং খালগুলোর ভারসাম্য ঠিকমতো কাজ করছে না, সেখানে ভয়ঙ্কর স্রোত বইতে শুরু করে। রিঅ্যাক্টরের ক্ষমতা পুরোপুরি সমানভাবে বিতরণ না হওয়ায় কিছু অঞ্চলে অতিরিক্ত চাপ তৈরি হয়, আর সেই অতিরিক্ত শক্তি নদী ও খালগুলোতে ভয়ঙ্কর ঢেউ তৈরি করে। মানুষজন হঠাৎ নিজেদের ঘর-বাড়ি, রাস্তা এবং যানবাহনের সঙ্গে যুক্ত ঝুঁকিতে দেখতে পায়। ইরাবতী এবং আদিত্য বুঝতে পারে যে, যদিও প্রযুক্তিটি আশ্চর্যজনক, কিন্তু এটি নিখুঁত নয়—প্রাকৃতিক শক্তির সঙ্গে মানুষের হস্তক্ষেপ সবসময় ঝুঁকিপূর্ণ। এই মুহূর্তে তাদের নৈতিক দ্বিধা এবং দায়বদ্ধতা আরও তীব্র হয়ে ওঠে; তারা একদিকে শহরকে বাঁচাতে চায়, অন্যদিকে নিজের ক্ষমতার সীমা বুঝে ভয় পাচ্ছে।
গম্বুজের ভেতরে দাঁড়িয়ে তারা পর্যবেক্ষণ করে, যন্ত্রের নীল আলো আর সমুদ্রের ক্রমশ পরিবর্তিত ঢেউ যেন এক অদ্ভুত দ্বৈত প্রতিফলন তৈরি করছে। ইরাবতী চিন্তায় ডুবে যায়—প্রকৃতির ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য প্রযুক্তি ব্যবহার করা উচিত, নাকি মানুষের স্বার্থে তা সীমাহীনভাবে প্রয়োগ করা উচিত? আদিত্য তাকে বুঝায় যে, এই সিদ্ধান্ত শুধুমাত্র একটি বৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্ত নয়, এটি মানবতার প্রতি একটি পরীক্ষা—যেখানে লোভ, ভয়, দায়িত্ব ও সাহস একসঙ্গে মিলিত হয়। শহরের কিছু অংশে স্রোত অব্যাহতভাবে প্রবাহিত হচ্ছে, যেখানে মানুষজন আতঙ্কিত এবং সহায়তার জন্য সাহায্য চাইছে। এই দৃশ্য তাদের মনে করিয়ে দেয় যে নীল প্রণালী কেবল শক্তি নয়, এটি মানব ও প্রাকৃতিক সম্পর্কের এক পরীক্ষা, যেখানে সিদ্ধান্তের প্রতিটি মুহূর্তে জীবন ও মৃত্যু, শান্তি ও ধ্বংসের ভারসাম্য নির্ধারিত হয়। এই অধ্যায়ে প্রযুক্তির আশ্চর্য, তার সীমাবদ্ধতা, মানুষের নৈতিক দ্বিধা এবং প্রাকৃতিক শক্তির সঙ্গে লড়াই—সবই এক সঙ্গে ফুটে ওঠে, পাঠককে শহরের ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি এবং নীল প্রণালীর রহস্যময় শক্তির মধ্যে নিমজ্জিত করে।
৯
রিঅ্যাক্টরের কেন্দ্রের দিকে তাকিয়ে ইরাবতী ও আদিত্য বুঝতে পারে যে নীল প্রণালীর স্থিতিশীলতা শুধুমাত্র প্রযুক্তিগত শক্তি দিয়ে সম্ভব নয়; এটি মানুষের প্রাণসংযোগের একটি নিখুঁত বন্ধন চায়। যন্ত্রটি এমন একটি স্তরে পৌঁছে গেছে, যেখানে মানুষের শারীরিক ও মানসিক সংযোগ ছাড়া সমুদ্র ও শহরের ভারসাম্য বজায় রাখা অসম্ভব। ইরাবতী প্রথমে থমকে যায়, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে তার অন্তরের অদম্য সাহস এবং মানুষের জন্য দায়বদ্ধতার অনুভূতি তাকে সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করে। সে জানে, যদি সে নিজেকে রিঅ্যাক্টরের সঙ্গে একীভূত না করে, তবে শহরের জলস্তর এবং নিম্নভাগের মানুষদের জীবন ঝুঁকিতে থাকবে। আদিত্য তাকে চরমভাবে বোঝানোর চেষ্টা করে, তাকে থামানোর চেষ্টা করে, কিন্তু ইরাবতীর দৃঢ়তা অবিচল। সে জানে, এই ত্যাগ শুধুমাত্র একটি প্রযুক্তি রক্ষার জন্য নয়, বরং মানুষের জীবন, শহরের অস্তিত্ব এবং প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষার এক মহৎ উদ্দেশ্য। তার চোখে শীতল দৃঢ়তা, হৃদয়ে মানুষের প্রতি সহানুভূতি এবং চেতনায় এক অদম্য সাহস—সবই যেন নীল প্রণালীর নীল আলোতে ঝলমল করে।
যখন ইরাবতী নিজেকে রিঅ্যাক্টরের সঙ্গে সংযুক্ত করে, তখন পুরো গম্বুজ নীরব হয়ে যায়। নীল আলোর ঝলকানি ক্রমশ ঘন হয়ে আসে, চারপাশে এক অদ্ভুত স্থিরতা এবং শক্তির অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ে। সমুদ্রের ঢেউ ধীরে ধীরে স্থির হতে শুরু করে, শহরের নিম্নভাগের মানুষজন নিরাপদভাবে জলমুক্ত হয়। তবে এই স্থিতি অর্জনের জন্য ইরাবতীর দেহ ক্রমশ নীল আলোতে মিলিয়ে যেতে থাকে—তার শ্বাসপ্রশ্বাস, দেহের স্পন্দন, এমনকি তার ছায়া সবই ধীরে ধীরে প্রযুক্তির সঙ্গে একীভূত হয়ে যায়। আদিত্য অবশেষে বুঝতে পারে যে ইরাবতীর ত্যাগ শুধু শহরকে বাঁচাচ্ছে না, বরং প্রযুক্তি এবং মানবতার মধ্যে এক নতুন সমঝোতার জন্ম দিচ্ছে। শহরের মানুষজন নিরাপদ হলেও তারা জানে না কে বা কী এই শান্তি এনে দিয়েছে। শুধু আদিত্যই সেই দৃশ্যের সাক্ষী—তার বন্ধু, প্রিয় মানুষ, নীরব ত্যাগের মাধ্যমে শহরকে পুনর্জন্মের এক নতুন দিকে নিয়ে গেছে।
এই অধ্যায়ের শক্তিশালী নৈরাশ্য এবং গভীর মানবিকতা পাঠককে এক অদ্ভুত আবেগের মধ্য দিয়ে নিয়ে যায়। ইরাবতীর দেহ চিরতরে নীল আলোতে মিলিয়ে গেলেও, তার আত্মার ত্যাগ শহরের মানুষকে পুনর্জন্মের শক্তি প্রদান করে। শহর যেন নতুন জীবন পেয়েছে—জলমুক্ত রাস্তা, স্থিতিশীল নদী, এবং মানুষের মধ্যে আশার এক নতুন আলো। আদিত্য দাঁড়িয়ে থাকে, চোখে জল, কিন্তু হৃদয়ে এক অদম্য শক্তি অনুভব করে। সে বুঝতে পারে যে, প্রযুক্তির চূড়ান্ত সীমা মানুষের ত্যাগ এবং মানবিক সংযোগে নিহিত। ইরাবতীর নীল আলোতে মিলিত আত্মা কেবল শক্তি নয়, বরং একটি বার্তা—যে মানবতা, সাহস এবং ত্যাগের মাধ্যমে প্রকৃতির সঙ্গে সমন্বয় সাধন করা সম্ভব। শহর পুনরায় জীবিত, মানুষ আবার স্বাভাবিক জীবন শুরু করতে পারে, আর নীল প্রণালী মানুষের অস্তিত্বে এক চিরন্তন শিক্ষার প্রতীক হয়ে থাকে। পাঠক এখানে কেবল একটি বৈজ্ঞানিক বিস্ময় দেখে না, বরং মানুষের সাহস, ত্যাগ, এবং পুনর্জন্মের এক অনন্য অভিজ্ঞতার সঙ্গে পরিচিত হয়, যা সমগ্র গল্পের নৈতিক এবং আবেগীয় শীর্ষবিন্দু হিসেবে গড়ে ওঠে।
১০
বছর কয়েক কেটে গেছে, কিন্তু ইরাবতীর স্মৃতি এখনও আদিত্যর মনে অম্লান। সে একান্ত নিঃশব্দে তার নোটবুকে লিখে রাখে ইরাবতীর গল্প—কেবল একটি ব্যক্তিগত ডায়েরি নয়, বরং একটি শিক্ষা, একটি সতর্কবাণী, যা নতুন প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিতে চায়। ইরাবতীর ত্যাগ ও নীল প্রণালীর শক্তি কেবল অতীতের একটি ঘটনা নয়, এটি মানুষের প্রকৃতির সঙ্গে সমঝোতা রক্ষার এক চিরন্তন বার্তা। নতুন প্রজন্ম যখন শহরের জলে ভিজে যায়, নদী-নালা এবং সমুদ্রের প্রবাহের সঙ্গে খেলা করে, তারা শিখেছে কেবল ভয় নয়, বরং সহাবস্থানের শিক্ষা—জলের সঙ্গে যুদ্ধ নয়, বরং তার সঙ্গে জীবনের ছন্দ মেলানো। আদিত্যর লেখা প্রতিটি শব্দ যেন মানুষের মনকে নীল আলোতে আলোকিত করে; এটি কেবল ইরাবতীর ত্যাগের কথা নয়, বরং মানুষের দায়িত্ব ও সতর্কতার কথাও মনে করিয়ে দেয়। শহরের শিশুদের নখদর্পণে সেই নীল আলোয় ঝলমল করা গঙ্গার ঢেউ যেন প্রত্যেককে শেখায় যে, প্রকৃতি আমাদের শ্রদ্ধা ও সংযমের প্রতিদান দেয়।
কলকাতা এখন আর আগের শহর নয়—এটি নতুনভাবে জীবিত, নতুনভাবে শিখেছে বাঁচতে। মানুষ এখন বুঝতে পারছে যে শহর এবং প্রকৃতি একে অপরের জন্যই প্রয়োজন। নদী, খাল, জলাধার—সবই কেবল পরিবেশ নয়, বরং মানুষের জীবিকার অংশ। শহরের প্রতিটি কোণ থেকে নতুন কৌশল এবং সৃষ্টিশীল উদ্যোগ জন্ম নিয়েছে, যেখানে পানি সংরক্ষণ, ঝড় প্রতিরোধ, এবং জলবায়ুর ভারসাম্য রক্ষা করা মানুষের দৈনন্দিন কাজের অংশ। শহরবাসী নিজেদের জীবনে ছোট ছোট পরিবর্তন এনেছে—বৃষ্টি সংরক্ষণ, নদী তীরের পরিষ্কার, এবং স্থাপনার নকশায় জলকে অন্তর্ভুক্ত করা। এই পরিবর্তন শুধু প্রযুক্তিগত নয়, বরং একটি সাংস্কৃতিক রূপ নিয়েছে। মানুষ শিখেছে যে, শক্তি মানে সবসময় নিয়ন্ত্রণ নয়; প্রকৃতির সঙ্গে সমঝোতা, দায়িত্ব এবং সংযমই প্রকৃত শক্তি। “নীল নগরী” শব্দটি এখন শুধু এক নাম নয়, বরং শহরের নতুন চেতনার প্রতীক—যেখানে প্রযুক্তি, মানবতা, এবং প্রকৃতির মধ্যে ভারসাম্য স্থাপিত হয়েছে।
গঙ্গার ঢেউ আজও নীরবভাবে নীল আলো ঝলমল করে। প্রতিটি তরঙ্গ যেন ইরাবতীর আত্মার উপস্থিতি বয়ে নিয়ে আসে, শহরের ওপর একটি সুরক্ষার চাদর মুড়ে। মানুষ যখন নদীর তীরে হাঁটে, তারা শুধুই জল দেখে না; তারা অনুভব করে এক অদৃশ্য আত্মার উপস্থিতি, যে তাদের সঠিক পথে রাখে—প্রকৃতির সঙ্গে সমঝোতায় বাঁচতে শেখায়। আদিত্যর লিখিত গল্প এবং শহরের নতুন প্রজন্মের কর্মকাণ্ড মিলিয়ে তৈরি করেছে একটি নতুন পৃথিবীর চিত্র। এটি একটি পৃথিবী যেখানে মানুষ কেবল নিজের স্বার্থের জন্য নয়, বরং জীববৈচিত্র্য, জলাধার, নদী এবং শহরের ভৌগোলিক ভারসাম্যের জন্য সচেতন। শহরের আকাশ এখন পরিষ্কার, নদীর ঢেউ ধীরে ধীরে বইছে, আর মানুষের হৃদয়ে ইরাবতীর নীরব বার্তা—সাহস, ত্যাগ এবং মানবতার শক্তি—চিরকাল ঝলমল করে। নতুন পৃথিবীর এই প্রতিশ্রুতি শুধু শিখিয়েছে কিভাবে বাঁচতে হবে, বরং দেখিয়েছে কিভাবে একটি শহর, একটি সমাজ এবং একটি প্রজন্ম প্রকৃতির সঙ্গে এক হয়ে উঠতে পারে—একটি নীল আলোয় আলোকিত শহর, যেখানে ইরাবতীর আত্মা চিরকাল পাহারা দিচ্ছে।
শেষ