অয়ন ঘোষ
অধ্যায় ১ : আগমনের রহস্য
সন্ধ্যা নামতেই গ্রামটাকে ঢেকে ফেলত এক ধরনের অদ্ভুত নিস্তব্ধতা। দূরে বাঁশঝাড়ে ঝিঁঝিঁর ডাক, পুকুরঘাটে ব্যাঙের ডাকে মাঝে মাঝে শিহরণ জাগত, কিন্তু তার বাইরে কোথাও কোনো শব্দ শোনা যেত না। এমন সময়েই গ্রামের দক্ষিণ কোণের পরিত্যক্ত ভাঙ্গাচোরা বাড়িটিতে এসে উঠলেন হেমেনবাবু। কারও সঙ্গে খুব একটা কথা না বলে তিনি সোজা সেই ভগ্নদশা বাড়িতে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিলেন। প্রথম দিন থেকেই গ্রামের মানুষের চোখে পড়ল, লোকটা যেন একটু অন্য রকম। লম্বা চওড়া গড়ন, পাকা চুলে অদ্ভুত জট, একটানা কোট পরা, আর হাতে এক চামড়ার ব্যাগ। তাকে প্রথমে দেখে গ্রামের ছেলেপুলেরা হেসেছিল—“এ তো শহরের কোনো বাবু হবেন।” কিন্তু রাত বাড়তেই হাসি মিলিয়ে গিয়ে কৌতূহল আর সন্দেহ জন্ম নিল। কেননা, সবাই দেখল অন্ধকার ঘরে তিনি একা বসে মোমবাতি জ্বালিয়ে বই পড়ছেন, জানলার ফাঁক দিয়ে সেই আলো বাইরে ছড়িয়ে পড়ছে। গ্রামের মানুষ এই দৃশ্য দেখে ভেবেই নিল, লোকটা সাধারণ কেউ নয়, নেহাতই ভূত বা তন্ত্রমন্ত্র জানা কোনো অশরীরী।
পরদিন সকালেও তার কোনো খোঁজ পাওয়া গেল না। কারও সঙ্গে আলাপ না করে তিনি সোজা পাশের খেতের ধারে হাঁটলেন, তারপর পুকুরঘাটে গিয়ে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইলেন। তার আচরণ দেখে গ্রামবাসীর কৌতূহল আরও বেড়ে গেল। গ্রামের চায়ের দোকানে গুজব শুরু হলো—“হেমেনবাবু মানুষ নয়, নিশ্চয়ই ভূত।” কেউ বলল, “কাল রাতে তার জানলার কাছে আমি এক অদ্ভুত ছায়া দেখেছি, মানুষের মতো নয়।” আবার কেউ শপথ করে বলল, “ওনার চোখ লাল হয়ে জ্বলছিল, আমি নিজের চোখে দেখেছি।” এইসব গল্পে গ্রামের মানুষ ভয়ে কেঁপে উঠল। ফলে কেউ তার বাড়ির দিকে যেত না, এমনকি পাশ দিয়ে হাঁটার সময়ও সবাই তাড়াহুড়ো করে যেত। দিন গড়াতে গুজব এমন পর্যায়ে পৌঁছাল যে শিশুরা তাকে নিয়ে ভয়ঙ্কর সব কল্পকাহিনী বানাতে শুরু করল। লোকটা যেন আসলেই কোনো অদ্ভুত অস্তিত্ব—এমনটা বিশ্বাস করতে গ্রামের আর বাকি থাকল না।
কিন্তু আসলে হেমেনবাবুর জীবনের সত্যটা ছিল একেবারেই ভিন্ন। তিনি শহরে ছিলেন একজন ভদ্রলোক, বহু বই পড়া মানুষ, যিনি স্ত্রীকে হারানোর পর জীবনের প্রতি উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছিলেন। শহরের কোলাহল তাকে দমবন্ধ করে তুলেছিল, তাই শান্তির খোঁজে তিনি গ্রামের নির্জন বাড়িটিতে থাকতে এসেছেন। কিন্তু তার নির্জন জীবনযাপন, গভীর রাতে মোমবাতি জ্বালিয়ে পড়াশোনা করা আর লোকজনের সঙ্গে মেশার অনিচ্ছাই তাকে অন্যদের চোখে রহস্যময় করে তুলল। তিনি বুঝতেই পারলেন না, তার নীরবতা আর একাকীত্ব গ্রামের মানুষের মনে এমন ভয় ঢুকিয়ে দেবে। তারা যেখানে তার মধ্যে ভূতের ছায়া খুঁজছে, তিনি সেখানে কেবল নিজের একাকিত্ব ভুলতে চাইছেন বইয়ের ভেতরে ডুবে থেকে। আর সেই ভুল বোঝাবুঝিই ধীরে ধীরে তৈরি করতে শুরু করল এক রোমহর্ষক কাহিনীর সূচনা, যেখানে মানুষ আর ভূতের ভয় এক অদ্ভুত খেলা খেলতে চলেছিল।
অধ্যায় ২ : গ্রামের গুজব
গ্রামের চায়ের দোকান ছিল খবর ছড়ানোর সবচেয়ে বড় জায়গা। ভোরের আলো ফোটার পর থেকেই সেখানে জমত চাষিদের ভিড়, আবার সন্ধ্যায় কাজ সেরে কৃষকেরা আড্ডা দিতে আসত। হেমেনবাবুর আগমন নিয়ে তাই প্রথম গুজবও জন্ম নিল এখানেই। দোকানের মালিক গণেশ একদিন বলল, “গতকাল রাতে আমি ওনার জানলার কাছে দিয়ে যাচ্ছিলাম, হঠাৎ দেখি ভেতরে অদ্ভুত লালচে আলো। মনে হলো আগুনের মতো জ্বলছে।” পাশে বসা নিতাই সাথে সাথে বলে উঠল, “আমি তো দেখেছি ওনার ছায়া জানলার কাঁচে উঠোন ভরে ফেলছে, মানুষের ছায়া এত লম্বা হয় নাকি?” মুহূর্তে চায়ের কাপের শব্দ থেমে গিয়ে সবার চোখ বিস্ফারিত হলো। তারপর থেকে প্রতিদিনই নতুন নতুন গল্প তৈরি হতে থাকল। কেউ বলল, “ওনি রাতে খাওয়াদাওয়া করেন না, ভোর পর্যন্ত শুধু বই পড়েন।” আবার কেউ দাবি করল, “আমি শুনেছি রাতের বেলায় ওনার ঘর থেকে কান্নার শব্দ আসে।” এভাবে এক একজন এক এক কথা বলতেই গ্রাম জুড়ে ছড়িয়ে পড়ল এক ধরনের অদ্ভুত ভীতি। যারা সাহসী বলত নিজেদের, তারাও ওই ভগ্নদশা বাড়ির পাশ দিয়ে গেলে গলা শুকিয়ে যেত।
শিশুদের মধ্যেও গুজব ছড়াতে দেরি হলো না। গ্রামের ছেলেরা খেলার ছলে একে অপরকে চ্যালেঞ্জ দিত—“হেমেনবাবুর বাড়ির কাছে গিয়ে উঁকি দিতে পারিস?” কারও কারও কৌতূহল এতটাই বেড়ে গেল যে সন্ধ্যা নামলে দূর থেকে তাকিয়ে দেখত তার ঘরে আলো জ্বলছে কি না। কিন্তু একবার এক ছোট ছেলে বলল, “আমি দেখেছি ওনি কারও সঙ্গে কথা বলছেন, অথচ ঘরে তো আর কেউ ছিল না।” তারপর থেকেই গুজব আরও ভয়ঙ্কর রূপ নিল। এখন সবাই বলতে লাগল, হেমেনবাবু একা থাকেন না, আসলে তিনি ভূতের সঙ্গে বসে আলাপ করেন। এমনকি রাতে কাক ডাকলেই লোকজন ভয়ে আঁতকে উঠত, ভেবে নিত—এ নিশ্চয় হেমেনবাবুর বাড়ি থেকে আসা কোনো সংকেত। গ্রামের বয়স্করাও ছোটদের ভয় আরও বাড়িয়ে দিলেন, কারণ তারাও বুঝতে পারছিলেন না আসলে ওই ভদ্রলোক কে। কেবল দূর থেকে যখন দেখা যেত তিনি ধীরে ধীরে হাঁটছেন, তখন তার ছায়া গ্রামের কুসংস্কারাচ্ছন্ন চোখে যেন এক দৈত্যাকার ভূতের মতো লাগত।
এদিকে হেমেনবাবু এসব কিছু জানতেনই না। তিনি ভেবেছিলেন গ্রামের মানুষ হয়তো তাকে কিছুটা অচেনা মনে করছে, কিন্তু সময়ের সঙ্গে সব ঠিক হয়ে যাবে। তাই তিনি নিজের মতো করে দিন কাটাতেন। সকালে উঠেই খেতের পাশে হাঁটতেন, দুপুরে বাড়িতে বসে বই পড়তেন, আর সন্ধ্যায় কখনও কখনও পুকুরঘাটে দাঁড়িয়ে আকাশের তারাগুলো দেখতেন। কিন্তু গ্রামের মানুষ তার এই নির্জন অভ্যাসকেই রহস্যের অংশ ভেবে ভীত হতে লাগল। হেমেনবাবুর মনে হচ্ছিল, এখানে এসে তিনি হয়তো শান্তি পাবেন, কিন্তু আসলে চারপাশের পরিবেশই ধীরে ধীরে তাকে আরও নিঃসঙ্গ করে তুলছিল। মানুষ কাছে আসার বদলে দূরে সরে যাচ্ছিল, আর তাদের সেই ভয়-সন্দেহ একদিন তাকে এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি দাঁড় করাবে—যেখানে মানুষ যেমন ভেবেছিল তিনি ভূত, তেমনি আসল ভূতও একদিন তাকে দেখে ভয় পাবে।
অধ্যায় ৩ : শিশুর সাহস
গ্রামের গুজব যতই ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছিল, ততই কিছু কৌতূহলী শিশুদের মনে বাড়ছিল প্রশ্ন—আসলেই কি হেমেনবাবু ভূত? সবাই ভয়ে তার বাড়ির কাছে যায় না, এমনকি বড়রাও সরে দাঁড়ায়, কিন্তু গ্রামের ছোট্ট ছেলে গোপাল একদিন ঠিক করল, সে নিজে গিয়ে সব দেখে আসবে। বয়স তার দশের বেশি নয়, কিন্তু দুষ্টুমি আর সাহসে সে সমবয়সীদের থেকে আলাদা। বিকেলের দিকে যখন রোদ একটু নরম হয়ে এসেছে আর গলির ছেলেরা মাঠে খেলে, তখন গোপাল চুপিসারে হেমেনবাবুর বাড়ির দিকে এগোল। বাড়ির চারপাশে আগাছায় ঢাকা, দরজার রঙ উঠে গেছে, জানালার কাঁচ ভাঙা, আর ভেতরে সবসময় এক অদ্ভুত অন্ধকার লেগে থাকে। তবু ভয় না পেয়ে গোপাল আস্তে আস্তে জানলার কাছে গিয়ে উঁকি দিল। ভেতরে সে যে দৃশ্য দেখল, তাতে সে প্রথমে অবাক হয়ে গেল, তারপর অকারণে হেসে উঠতে চাইল। হেমেনবাবু চেয়ারে বসে আছেন, টেবিলে এক কাপ চা রাখা, আর হাতে কবিতার বই। তিনি ধীরে ধীরে পড়ছেন, ঠোঁটে হালকা এক গুনগুন সুর। কোথায় সেই ভূতুড়ে ছায়া? কোথায় লালচে চোখ? সবকিছুই যেন স্বাভাবিক, এমনকি শান্তও বটে।
গোপাল ভেবেছিল, হয়তো ভেতরে ভয়ঙ্কর কিছু দেখতে পাবে, কিন্তু তার চোখে ধরা পড়ল এক নিঃসঙ্গ মানুষের ছবি। এত শান্তভাবে বসে কবিতা পড়ার দৃশ্য দেখে সে আর নিজের ভয়ের কারণ খুঁজে পেল না। তবু মনে মনে একটা দ্বিধা কাজ করল—সে যদি অন্যদের বলে যে হেমেনবাবু একেবারে সাধারণ মানুষ, কেউ কি বিশ্বাস করবে? গ্রামের মানুষ তো অন্ধভাবে গুজব মেনে নিয়েছে। গোপাল কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল, তারপর আস্তে পা টিপে সরে গেল। কিন্তু সরে যাওয়ার আগে তার চোখে ধরা পড়ল, হেমেনবাবু মোমবাতির আলোয় এক ধরনের অদ্ভুত ছায়া তৈরি করেছেন—সেটি দূর থেকে দেখলে সত্যিই ভয়ংকর মনে হতে পারে। গোপাল বুঝল, আসলে এই ছায়াই গ্রামের মানুষকে বিভ্রান্ত করেছে।
সেদিন রাতে গোপাল তার বন্ধুদের বলল, “আমি নিজে দেখেছি, ওনি ভূত নন। ওনি চা খাচ্ছিলেন আর কবিতা পড়ছিলেন।” কিন্তু অন্য ছেলেরা হাসতে হাসতে তাকে উড়িয়ে দিল। তারা বলল, “ভূতের আসল রূপ বোঝা যায় না, তুমি যা দেখেছ সেটা চোখে ধোঁকা।” কেউ আবার বলল, “ওই ভূত তোমাকে বোকা বানিয়েছে।” গোপাল কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল, কারণ সে জানত, ছোট্ট একজনের কথা শুনে পুরো গ্রামের বিশ্বাস বদলাবে না। তবু তার ভেতরে একটা দৃঢ় বিশ্বাস জন্মাল—হেমেনবাবু ভূত নন, বরং ভুল বোঝা এক মানুষ। কিন্তু সে জানত না, এই সত্যটা প্রমাণ করার আগেই এমন এক ঘটনা ঘটতে চলেছে যা গ্রামবাসীর ভয়কে আরও তীব্র করবে, আর হেমেনবাবুকে আরও রহস্যময় করে তুলবে।
অধ্যায় ৪ : আসল ভূতের আগমন
রাত তখন ঘনিয়ে এসেছে, চারপাশের নিস্তব্ধতা আরও ঘনীভূত হয়ে গ্রামটাকে ঢেকে ফেলেছে। দূরে কুকুরের হুঁ হুঁ ডাক আর হঠাৎ হাওয়ার ঝাপটায় নারকেল পাতার ঝিরঝির শব্দ শুনে মনে হচ্ছিল যেন অদৃশ্য কিছু নড়াচড়া করছে। এমন সময় গ্রামের দক্ষিণ দিকে বাঁশঝাড়ের ভেতর থেকে এক অদ্ভুত ছায়ামূর্তি ভেসে উঠল। সে-ই গ্রামের আসল ভূত—লম্বা জটপাকানো চুল, ফ্যাকাশে মুখ, গালের হাড় স্পষ্ট, আর হাড়গোড় বেরিয়ে থাকা হাত। গ্রামের মানুষদের সে মাঝে মাঝে ভয় দেখাত, খেতের আল ধরে হাঁটতে থাকা কারও কানে হঠাৎ শীতল ফুঁ দিত, কখনও পুকুরঘাটে কাঁদতে বসে যেত। কিন্তু এ রাতটা ছিল আলাদা, কারণ সে নতুন আগন্তুক হেমেনবাবুর কথা শুনেছে, যাকে গ্রামবাসীরা ভূত বলে ভয় পাচ্ছে। ভূত ভাবল—এ নিশ্চয়ই তার এলাকায় নতুন প্রতিদ্বন্দ্বী, তাই ভয় দেখানোর আগে তাকে পরীক্ষা করা দরকার।
আধো আলো-আঁধারির মধ্যে ভগ্নদশা বাড়ির দিকে এগোল ভূত। পায়ের শব্দহীন ভেসে যাওয়া গতি, ঠাণ্ডা হাওয়া আর চারপাশে ভৌতিক গন্ধ যেন তার আগমন ঘোষণা করছিল। বাড়ির জানলার ফাঁক দিয়ে সে দেখতে পেল হেমেনবাবু টেবিলে বসে আছেন, সামনে মোমবাতির আলোয় বই খোলা। হেমেনবাবু শান্তভাবে পড়ছেন, চোখে গম্ভীর দৃষ্টি, মাঝে মাঝে গুনগুন করে কিছু উচ্চারণ করছেন। ভূতের চোখে এই দৃশ্য আরও অদ্ভুত ঠেকল। সে চুপিসারে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতে চেষ্টা করল, কিন্তু হঠাৎ দরজার কড়কড় শব্দে ঘরের ভেতর আলো টিমটিম করে উঠল। হেমেনবাবু মুখ তুলে একদৃষ্টে তাকালেন। সেই দৃষ্টি ছিল এত গভীর, এত রহস্যময়, যেন অন্ধকার ভেদ করে কারও অন্তর পর্যন্ত পৌঁছে যেতে পারে। ভূত কেঁপে উঠল—এ চোখ মানুষের নয়!
মুহূর্তেই ভূতের শরীর কাঁপতে শুরু করল। এতদিন যাকে সে তুচ্ছ মানুষ ভেবে ভয় দেখাতে এসেছিল, তার সামনে দাঁড়িয়েই যেন নিজের অস্তিত্ব হুমকির মুখে দেখল। হেমেনবাবুর গম্ভীর ভঙ্গি, অচল দৃষ্টি আর টিমটিমে আলোয় তৈরি হওয়া বিশাল ছায়া দেখে ভূত হকচকিয়ে গেল। সে মনে মনে বিড়বিড় করল—“এ যে আমার চেয়েও ভয়ংকর!” হঠাৎ এক করুণ চিৎকার দিয়ে ভূত দৌড়ে বেরিয়ে গেল, বাঁশঝাড়ের ভেতরে মিলিয়ে গেল তার ফ্যাকাশে ছায়া। গ্রামজুড়ে কুকুররা একসাথে চিৎকার করতে শুরু করল, হাওয়া আরও শীতল হয়ে উঠল। হেমেনবাবু কিছুই বুঝলেন না, তিনি শুধু এক মুহূর্ত দরজার দিকে তাকিয়ে আবার বই পড়তে বসে গেলেন। অথচ বাইরে তখন সেই আসল ভূতের প্রথম ভয়ের অভিজ্ঞতা নিয়ে গ্রাম নতুন এক রহস্যের জন্ম পেতে চলেছিল।
অধ্যায় ৫ : ভূতের ভয়
ভোর হওয়ার আগেই সারা গ্রাম জুড়ে এক অদ্ভুত গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ল। কে যেন রাতের আঁধারে হাড়হিম করা এক চিৎকার শুনেছে, আবার কেউ বলল, বাঁশঝাড়ের ভেতর দিয়ে ছায়ার মতো কিছু পালাতে দেখেছে। সকালের আলো ফোটার আগেই এই খবর ছড়িয়ে গেল—গতরাতে নিশ্চয়ই হেমেনবাবুর বাড়িতে কোনো ভয়ংকর কিছু ঘটেছে। দোকানে, খেতের আল ধরে, এমনকি পুকুরঘাটেও সবাই সেই রহস্য নিয়ে আলোচনা করতে লাগল। এক বৃদ্ধ শপথ করে বললেন, “আমি নিজের কানেই শুনেছি, ভূতের চিৎকার ছিল ওটা।” অন্যজন যোগ করল, “যদি ভূতের চিৎকার হয়ে থাকে, তবে বুঝতে হবে, ওই ভদ্রলোক নিশ্চয়ই আসলেই ভূত—কারণ ভূতকেও তো ভড়কে দিয়েছে।” এভাবে গুজব এক নতুন রূপ নিল। এখন আর শুধু হেমেনবাবুকে ভূত ভাবা হচ্ছে না, বরং তাকে এমন শক্তিশালী অশরীরী বলা হচ্ছে, যিনি অন্য ভূতদেরও ভয় দেখিয়ে তাড়িয়ে দেন।
এদিকে আসল ভূত, যে এতদিন মানুষকে ভয় দেখিয়ে মজা পেত, সে নিজেই এখন আতঙ্কে কাঁপছে। ভোর হওয়ার আগেই সে গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে গেল, আর ফিরে তাকাল না। বাঁশঝাড়ে যেখানে সে প্রায়ই বসে থাকত, এখন সেখানে শুধু ভাঙা ডালপালা আর ঝিরঝির শব্দ ছাড়া আর কিছুই নেই। গ্রামের মানুষ একে নতুন রহস্যের প্রমাণ বলে মানল। তাদের মতে, যে ভদ্রলোককে তারা এখন পর্যন্ত সন্দেহ করছিল, তিনিই আসল রহস্যময় শক্তির অধিকারী। চায়ের দোকানে নিতাই বলল, “ভূত তো আর এমনিতেই পালায় না, কেউ যদি তাকে ভয় দেখাতে পারে, তবে সে যে সাধারণ কেউ নয়।” সঙ্গে সঙ্গে সবাই মাথা নাড়ল আর ভয়ে সরে গেল। এখন হেমেনবাবুর নামের সঙ্গে জুড়ে গেল নতুন উপাধি—“ভূতের ভূত।”
কিন্তু হেমেনবাবু এ সবকিছুই জানতেন না। তিনি ভোরবেলা উঠেই হাঁটতে বেরোলেন, পুকুরের ধারে বসে কিছু কবিতা মুখস্থ করলেন, তারপর বাড়িতে ফিরে চা বানালেন। গ্রামের লোকেরা দূর থেকে তাকিয়ে তাকে দেখে আরও ভীত হলো। কারও কারও চোখে তার একাকীত্বই যেন এক গভীর রহস্য, কারও কাছে আবার তার গম্ভীর মুখ মনে হলো অশুভ সংকেত। অথচ হেমেনবাবুর জীবনে ছিল নিঃসঙ্গতার ছাপ ছাড়া আর কিছুই না। তিনি জানতেন না, তার চারপাশের মানুষজন তার নামেই নতুন ভয়ের কাহিনী তৈরি করছে, আর সেই ভয়ই আসল ভূতকেও গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু এ গল্প এখানেই শেষ নয়, কারণ তার একাকীত্বের ভেতরেই লুকিয়ে ছিল আরও নতুন সব ভুল বোঝাবুঝির সূত্রপাত।
অধ্যায় ৬ : পালিয়ে যাওয়া ভূত
গ্রামের ভেতর খবর ছড়িয়ে পড়তে দেরি হলো না—আসল ভূত নাকি হেমেনবাবুর বাড়ি থেকে পালিয়ে গেছে। সকালের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গেই পুকুরঘাট থেকে খেত পর্যন্ত সবাই এই নতুন ঘটনায় উত্তেজিত। কেউ বলল, “গতকাল রাতেই আমি নিজের চোখে দেখেছি বাঁশঝাড়ের ভেতর দিয়ে এক ভয়ংকর ছায়া দৌড়ে পালাচ্ছে।” অন্য কেউ যোগ করল, “ওই চিৎকার তো নিশ্চয়ই ভূতের ছিল, মানুষ এমন চিৎকার করতে পারে না।” ধীরে ধীরে এই গুজব এমন পর্যায়ে পৌঁছাল যে, গ্রামের সব মানুষ একবাক্যে মেনে নিল—হেমেনবাবু কোনো সাধারণ ভূত নন, তিনি এমন এক অশরীরী শক্তি, যিনি অন্য ভূতদেরও ভয় পাইয়ে তাড়িয়ে দেন। তাদের চোখে তিনি হয়ে উঠলেন “ভূতের ভূত।”
ভূতের পালানোয় গ্রামের মানুষ যেমন আতঙ্কে আরও চুপসে গেল, তেমনি এক ধরনের অদ্ভুত কৌতূহলও জন্ম নিল। তারা দূর থেকে হেমেনবাবুকে দেখত, তিনি কেমন হাঁটেন, কেমন বসেন, এমনকি কীভাবে জানলার ফাঁক দিয়ে আলো বেরোয়। কারও কারও মনে হলো, তার প্রতিটি চলাফেরাই যেন রহস্যে মোড়া। শিশুরা এখন আর খেলতে খেলতে তার বাড়ির কাছে যেত না, বরং দূর থেকে আঙুল তুলে দেখাত আর ফিসফিস করে বলত, “ওই যে ভূতের ভূত।” গ্রামের মহিলারা সন্ধ্যার পর আর বাইরে বেরোত না, কারণ তারা ভেবেছিল, যদি হেমেনবাবু রাগ করে তবে যে কোনো অশুভ ঘটনা ঘটতে পারে। অথচ হেমেনবাবু নিজে বুঝতেই পারছিলেন না কেন চারপাশের মানুষ তাকে এভাবে এড়িয়ে চলছে। তিনি শুধু ভাবছিলেন, হয়তো গ্রামের মানুষ একটু সময় নিলে তার সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে মিশে যাবে।
কিন্তু আসল সত্যটা একেবারে ভিন্ন ছিল। হেমেনবাবুর অজান্তেই তিনি এক বিশাল ভুল বোঝাবুঝির কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছিলেন। গ্রামের মানুষ যেভাবে তার রহস্যময় চেহারা আর একাকীত্বকে ভয়ঙ্কর শক্তির প্রতীক ভেবে বসেছিল, ঠিক তেমনভাবেই আসল ভূতও ভয়ে পালিয়ে গিয়ে তার পরিচিতি আরও রহস্যময় করে তুলল। হেমেনবাবু তখনও বই হাতে বসে কবিতা পড়ছিলেন, জীবনের একাকীত্ব থেকে সামান্য শান্তি খুঁজে নিচ্ছিলেন। কিন্তু তার চারপাশে তৈরি হওয়া গুজব ও ভয়ের এই জাল ধীরে ধীরে এমন এক অবস্থার জন্ম দিচ্ছিল, যেখানে তার জন্য স্বাভাবিক মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকা প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠবে।
অধ্যায় ৭ : গ্রামবাসীর আতঙ্ক
হেমেনবাবুর নাম নিয়ে গ্রামে যত গল্প ছড়াচ্ছিল, ততই মানুষের আতঙ্ক বাড়ছিল। এখন আর কেউ তাকে শুধুই ভূত ভাবছিল না, বরং সবাই বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল—তিনি হলেন এমন এক রহস্যময় শক্তির অধিকারী, যিনি অন্য ভূতদেরও ভয় পাইয়ে তাড়িয়ে দেন। ফলে তার ভয়ে গ্রামের মানুষ প্রতিটি কাজে সতর্ক হয়ে উঠল। খেতের আল ধরে রাতের বেলা আর কেউ হাঁটত না, সন্ধ্যা নামলেই দোকানপাট তাড়াহুড়ো করে গুটিয়ে যেত। এমনকি পাশের গ্রাম থেকেও লোকেরা আসতে শুরু করল হেমেনবাবুকে একবার দেখবে বলে—তারা দূর থেকে তাকে দেখত আর কাঁপতে কাঁপতে গল্প বানাত। কেউ বলল, “আমি দেখেছি, উনি এক নিশ্বাসে মশাল নিভিয়ে দিলেন।” আবার কেউ দাবি করল, “উনি হাঁটতে হাঁটতে মাটিতে ছায়ার মতো অদ্ভুত দাগ ফেলে যান।” এসব কথা শুনে গ্রামের মানুষ আরও বিশ্বাসী হয়ে পড়ল যে হেমেনবাবু সত্যিই অতিপ্রাকৃত শক্তির অধিকারী।
কিন্তু এই ভয়ই আসলে তাদের জীবনে নানা অসুবিধা তৈরি করল। কোনো বাড়ির ছাগল হারিয়ে গেলে বলা হতো—“হেমেনবাবুর রাগ লেগেছে।” কেউ জ্বরে পড়লে বা কোনো খেত নষ্ট হয়ে গেলে বলা হতো—“ভূতের ভূতের ছায়া পড়েছে।” গ্রামে যত অঘটন ঘটত, সবই তার ঘাড়ে চাপানো হতে লাগল। ফলে সাধারণ মানুষ একদিকে তার কাছে যেতে ভয় পেত, আবার অন্যদিকে গোপনে তার কাছে প্রার্থনা করত যেন কোনো অমঙ্গল না ডেকে আনেন। হেমেনবাবু নিজে এসব কিছু টেরই পাচ্ছিলেন না, কারণ গ্রামবাসী তার সামনে এলে অদ্ভুত ভদ্রতা দেখাত, কিন্তু পিছনে গিয়ে তাকে নিয়ে ভয়ের গল্প বানাত। ধীরে ধীরে গ্রামে এমন পরিবেশ তৈরি হলো, যেখানে তার নাম উচ্চারণ করলেই সবার শরীর কেঁপে উঠত।
এই ভয় আর ভুল বোঝাবুঝির মাঝেই হেমেনবাবু দিন কাটাচ্ছিলেন নিঃসঙ্গভাবে। তিনি ভাবতেন, কেন গ্রামের মানুষ তার সঙ্গে মিশছে না, কেন কেউ তার কাছে এসে সোজাসুজি কথা বলে না। তার নিঃশব্দ জীবনযাপনকে কেন্দ্র করে গ্রামের ভেতরে তৈরি হলো এক বিশাল অন্ধকার আবহ, যেখান থেকে বের হওয়া তার পক্ষে সম্ভব হচ্ছিল না। অথচ তার নিজের কাছে জীবনটা ছিল নিছক কিছু বই, কিছু কবিতা আর এক কাপ চায়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তিনি বুঝতে পারলেন না, মানুষের মনে তৈরি হওয়া ভয় কতটা শক্তিশালী হতে পারে, আর সেই ভয়ই তাকে ধীরে ধীরে মানুষের চোখে অমানবিক এক অস্তিত্বে পরিণত করছে। ঠিক তখনই গ্রামের একদল তরুণ ঠিক করল, এতদিনের রহস্য ভেদ করার সময় এসেছে। তারা নিজের চোখে প্রমাণ করবে—হেমেনবাবু আসলে ভূত, না কি সাধারণ মানুষ।
অধ্যায় ৮ : তরুণদের সাহস
গ্রামের ভয়ের আবহের মাঝেই কিছু তরুণ ঠিক করল, আর লুকোচুরি চলবে না। তারা চায় নিজের চোখে প্রমাণ করতে হেমেনবাবু সত্যিই ভূত নাকি ভুল বোঝাবুঝির শিকার একজন মানুষ। এক রাতে তারা গোপনে পরিকল্পনা করল—সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে হেমেনবাবুর বাড়ির সামনে গিয়ে তার প্রতিটি কাজ খুঁটিয়ে দেখবে। কেউ মশাল জোগাড় করল, কেউ লাঠি হাতে নিল, আবার কেউ পকেটে গোপনে লবণ আর লোহা রাখল, কারণ তাদের বিশ্বাস ছিল এগুলো ভূত তাড়াতে কাজে লাগে। গ্রামের বয়োজ্যেষ্ঠরা তাদের বারবার সতর্ক করল, “যেও না, ওরা তো অন্য ভূতও ভয় পেয়ে পালিয়েছে।” কিন্তু তরুণদের সাহস আর কৌতূহল এতটাই প্রবল ছিল যে তারা পিছিয়ে গেল না। তাদের মনে হচ্ছিল, যদি সত্যিই কোনো রহস্য থাকে তবে তা জানতেই হবে, আর যদি সব গুজব হয় তবে গ্রামের মানুষকে ভয় থেকে মুক্তি দিতেও হবে।
রাত বাড়তেই তারা হেমেনবাবুর বাড়ির দিকে এগোল। চাঁদের আলোয় পুরনো টালির ছাউনি আর বাঁশঝাড়ের ছায়া মিলে বাড়িটিকে আরও ভৌতিক করে তুলেছিল। ভেতর থেকে আসা মৃদু আলো দেখে মনে হচ্ছিল কেউ হয়তো মন্ত্রপাঠ করছে, অথচ আসলে হেমেনবাবু বইয়ের পাতায় ডুবে ছিলেন। তরুণরা জানলার ফাঁক দিয়ে উঁকি মেরে দেখল—তিনি মোমবাতির আলোয় বসে কবিতা পড়ছেন, পাশে চায়ের কাপে ধোঁয়া উঠছে। দৃশ্যটা দেখে তারা প্রথমে হতবাক হয়ে গেল, কারণ এমন স্বাভাবিক মানুষকে তারা ভূত হিসেবে কল্পনাই করেনি। কিন্তু তাদের মনে আবারও দ্বিধা জন্মাল—হয়তো এটাই ভূতের চালাকি, সাধারণ মানুষের মতো সাজছে। তাই তারা সাহস করে দরজায় কড়া নিল।
অপ্রত্যাশিত শব্দে হেমেনবাবু একটু চমকে গেলেন, কিন্তু তৎক্ষণাৎ দরজা খুলে হাসিমুখে বললেন, “আসুন, ভেতরে আসুন।” তরুণরা একে অপরের দিকে তাকাল, ভয়ে হাত কাঁপছিল, তবু ভেতরে ঢুকল। ভেতরে গিয়ে দেখল দেয়ালে বইয়ের তাক, টেবিলের উপর কবিতার খাতা আর জানলার ধারে ছোট্ট টবের গাছ। ভূতের মতো কোনো অস্বাভাবিক কিছুই নেই। হেমেনবাবু তাদের বসতে বললেন, আর কাপে চা ঢেলে দিলেন। তারা ধীরে ধীরে বুঝতে পারল, এই মানুষটিই সেই রহস্যময় ভদ্রলোক, যাকে নিয়ে এতদিন এত ভয় আর গল্প তৈরি হয়েছিল। তরুণদের মনে তখন এক অদ্ভুত মিশ্র অনুভূতি জন্ম নিল—একদিকে স্বস্তি, অন্যদিকে গ্রামবাসীর ভুল বিশ্বাস ভাঙার দায়িত্ব।
অধ্যায় ৯ : সত্য উন্মোচনের লড়াই
তরুণরা যখন হেমেনবাবুর ঘর থেকে বেরোল, তখন রাত গভীর হয়ে এসেছে। আকাশে চাঁদ মেঘে ঢাকা, ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দে পরিবেশ ভরে আছে। তাদের চোখেমুখে তখনও বিস্ময় স্পষ্ট—যাকে তারা এতদিন ভূত ভেবেছিল, তিনি আসলে নিঃসঙ্গ এক মানুষ, যার জীবনে আনন্দ বলতে বই, কবিতা আর এক কাপ চা। বাড়ি ফিরে তারা ঠিক করল, গ্রামের সবাইকে সত্যিটা জানাবে, যাতে এই ভয়ের আবহ ভেঙে যায়। পরদিন সকালে তারা পুকুরঘাটে, হাটে, এমনকি চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করল, “হেমেনবাবু ভূত নন, উনি সাধারণ মানুষ।” তারা বিস্তারিতভাবে বর্ণনা দিল—কীভাবে তিনি তাদের স্বাগত জানিয়েছেন, কেমন বই আর কবিতা পড়ছিলেন, কীভাবে নিজের হাতে চা বানিয়ে খাইয়েছেন।
কিন্তু গ্রামের মানুষ তাদের কথা সহজে বিশ্বাস করল না। কেউ ঠাট্টা করে বলল, “ভূতের কাছে গিয়েই তো ভূতের মায়াজালে আটকে গেছ।” কেউ আবার বলল, “তোমরা বেঁচে ফিরেছ, এটাই প্রমাণ উনি সাধারণ মানুষ নন, ভূতের ভূত।” অনেকে ভয়ে কান ঝাঁকিয়ে সরে গেল, যেন হেমেনবাবুর নাম উচ্চারণ করলেই অশুভ কিছু ঘটবে। তরুণরা বুঝল, এতদিন ধরে গড়ে ওঠা ভয় আর গুজব এত সহজে ভাঙা সম্ভব নয়। তারা চেষ্টা করল যুক্তি দিয়ে বোঝাতে—“আমরা নিজের চোখে দেখেছি, ভেতরে কিছু নেই, শুধু বই আর শান্ত পরিবেশ।” কিন্তু যুক্তির চেয়ে আবেগ আর ভয় মানুষের মনে অনেক গভীরভাবে গেঁথে ছিল।
এভাবে সত্যিটা ছড়িয়ে দিতে গিয়ে তরুণরা নিজেরাই গ্রামে আলাদা হয়ে গেল। কেউ তাদের সাহসের প্রশংসা করল, আবার কেউ তাদের বিপদ ডেকে আনার দায় দিল। হেমেনবাবুর সঙ্গে তাদের সম্পর্ক এখন আরও দৃঢ় হলো, কারণ তারা বুঝেছিল—যে মানুষটিকে সবাই ভয় পাচ্ছে, তিনি আসলে নিরীহ ও একাকী। কিন্তু গ্রামবাসীর অন্ধবিশ্বাস এত শক্তিশালী যে সত্য বলেও তারা সন্দেহের চোখে দেখা হতে লাগল। তরুণরা তখন ভাবতে শুরু করল, কেবল মুখে বলা নয়, কোনো বড় ঘটনার মাধ্যমে প্রমাণ করতে হবে যে হেমেনবাবু ভূত নন। আর সেই সুযোগ আসতে দেরি হলো না—এক রাতে হঠাৎই গ্রামে নতুন বিপদ দেখা দিল।
অধ্যায় ১০ : সত্যের বিজয়
সেই রাতে হঠাৎই গ্রামে এক বড় বিপদ নেমে এল। দক্ষিণের মাঠের পাশের বাঁশঝাড়ে আগুন লেগে গেল, শুষ্ক বাতাসে মুহূর্তেই আগুন ছড়িয়ে পড়তে লাগল চারদিকে। খেতের ফসল, গৃহপালিত পশু—সবকিছু ঝুঁকির মুখে পড়ে গেল। গ্রামবাসী হকচকিয়ে গেল, কেউ পানি আনতে ছুটল, কেউ চিৎকার করতে লাগল, কিন্তু আগুন এত দ্রুত বাড়ছিল যে সবাই আতঙ্কে অস্থির হয়ে পড়ল। ঠিক তখনই গ্রামের মানুষ দেখল, যে মানুষটিকে তারা এতদিন ভূতের ভূত ভেবেছে, সেই হেমেনবাবু নির্ভীকভাবে এগিয়ে গেলেন। তিনি নিজের কুয়া থেকে পানি তোলেন, ঝাঁপি-ডালা ভরে আনেন, আর তরুণদের সঙ্গে মিলিত হয়ে আগুন নেভাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তার শান্ত অথচ দৃঢ় কণ্ঠে তিনি সবাইকে বললেন, “একসঙ্গে কাজ করলে ভয় কোনো শক্তি নয়।”
গ্রামবাসী প্রথমে দূরে দাঁড়িয়ে দেখছিল, কিন্তু ধীরে ধীরে সাহস ফিরে পেল। একে একে সবাই এগিয়ে এলো, কেউ বাঁশ কেটে আগুনের দিক রোধ করল, কেউ বালতি ভরে পানি ঢালল। কয়েক ঘণ্টার চেষ্টা শেষে আগুন অনেকটা নিয়ন্ত্রণে এল। এভাবে সারা রাত হেমেনবাবু আর গ্রামবাসী একসঙ্গে লড়ে গ্রামকে রক্ষা করল। ভোরের আলো ফুটতেই সবাই বুঝল—যাকে তারা ভূত ভেবে এতদিন দূরে সরিয়ে রেখেছিল, সেই মানুষটিই আসলে তাদের বিপদের সময়ে সবচেয়ে বড় সহায় হয়ে দাঁড়ালেন। কেউ চুপচাপ চোখ মুছল, কেউ লজ্জায় মাথা নিচু করল। তরুণরা উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলল, “এখনো কি মনে হয় উনি ভূত?” গ্রামবাসীর মনে জমে থাকা সন্দেহ তখন ভেঙে পড়তে লাগল।
ধীরে ধীরে সবার কাছে সত্যটা পরিষ্কার হলো—হেমেনবাবু ভূত নন, তিনি এক সাধারণ অথচ সাহসী মানুষ। যে ভূত আসলেই তাকে ভয় পেয়ে পালিয়েছিল, সেটাই ছিল সবচেয়ে বড় প্রমাণ। আর আজকের রাতের ঘটনায় তিনি মানুষের চোখে শুধু রহস্যময় ভদ্রলোক নন, হয়ে উঠলেন গ্রামের আপনজন। ভয়ের জায়গা নিল শ্রদ্ধা আর কৃতজ্ঞতা। হেমেনবাবু শান্তভাবে শুধু বললেন, “আমি মানুষ, আপনাদের মতোই।” তার হাসি আর সহজ কথার ভেতরেই লুকিয়ে ছিল এক মহৎ শিক্ষা—অন্ধবিশ্বাস যত শক্তিশালী হোক, সত্য আর সহমর্মিতা শেষ পর্যন্ত জয়ী হয়। সেদিন থেকে গ্রামে আর কেউ তাকে ভূত বলে না, বরং সবাই তাকে ডাকে—“আমাদের হেমেনবাবু।”