Bangla - কল্পবিজ্ঞান

লাল গ্রহের ডাক

Spread the love

অভিষেক দাশগুপ্ত


অধ্যায় ১ : অভিযানের সূচনা

তাদের যাত্রার শুরুটা যেন ইতিহাসের এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা। পৃথিবীর আকাশে ভোরের প্রথম আলো ফুটে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই বিশাল মহাকাশযানটি উৎক্ষেপণের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। কন্ট্রোল রুমের ভেতরে ব্যস্ত প্রকৌশলীরা, বিজ্ঞানীরা আর সামরিক পর্যবেক্ষকরা একসঙ্গে চূড়ান্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছিলেন। উৎক্ষেপণের স্থানটি ছিল হাজারো মানুষের ভিড়ে মুখরিত, যেন সমগ্র মানবজাতি চোখ মেলে অপেক্ষা করছে নতুন দিগন্তের। দলের ছয়জন তরুণ বিজ্ঞানী—অর্পিতা, রাহুল, নীল, মায়া, কাব্য ও আদিত্য—এই অভিযানের নেতৃত্বে। প্রত্যেকের চোখে ছিল অনাবিষ্কৃত এক পৃথিবীর স্বপ্ন, আর বুকে ছিল অদম্য সাহস। তারা জানত এই মিশন শুধু বৈজ্ঞানিক গবেষণা নয়, বরং মানবজাতির ভবিষ্যতের জন্য এক সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন। উৎক্ষেপণের মুহূর্তে পৃথিবী যেন থমকে দাঁড়াল। কাউন্টডাউনের শব্দ ধীরে ধীরে কমতে কমতে শূন্যতে পৌঁছালে বিশাল গর্জনে মহাকাশযানটি আকাশ চিরে ছুটে গেল। মাটিতে থাকা মানুষের চোখে অশ্রু, আনন্দ ও গর্বের ঝলক—কারণ আজ তারা মানব ইতিহাসের প্রথম স্থায়ী মঙ্গল অভিযানের সূচনা প্রত্যক্ষ করছে।

মহাকাশযান যখন পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ ছাড়িয়ে অজানার পথে ছুটছিল, দলের প্রত্যেক সদস্যের মনে চলছিল ভিন্ন ভিন্ন আবেগের ঝড়। জানালা দিয়ে তাকিয়ে তারা দেখল পৃথিবী ছোট হতে হতে নীলাভ গোলকের মতো ঝুলে আছে অসীম কালো মহাশূন্যে। সেই দৃশ্য তাদের হৃদয়ে অদ্ভুত টান জাগাল—কেউ কেউ চোখে জল লুকোলো, কেউ আবার দীর্ঘশ্বাস ফেলল। অর্পিতা ফিসফিস করে বলল, “আমরা কি কোনোদিন ফিরে যেতে পারব?”—তার কণ্ঠে উদ্বেগ আর বিস্ময়ের মিশেল। রাহুল তাকে আশ্বস্ত করে বলল, “ফেরার প্রয়োজন নেই অর্পিতা, আমরা যাচ্ছি গড়তে এক নতুন ঘর।” এই কথার সঙ্গে সঙ্গে সবার মনে হালকা হলেও একরাশ আশা ফিরে এল। মহাকাশযানের অভ্যন্তর ছিল অতি আধুনিক, কিন্তু শূন্য মাধ্যাকর্ষণে শরীর খাপ খাওয়ানো সহজ ছিল না। প্রথম কয়েকদিন তারা বমিভাব, মাথা ঘোরা আর অনিদ্রার সঙ্গে লড়াই করল। তবুও তারা জানত—এই কষ্ট সাময়িক, কারণ সামনে অপেক্ষা করছে এমন এক যাত্রা যা মানব সভ্যতার পথ বদলে দিতে পারে। নিঃশব্দ মহাকাশে ভেসে চলতে চলতে তারা একে অপরের সঙ্গে সম্পর্ক আরও গভীর করে তোলে। মায়া তার ল্যাপটপে মঙ্গলের মানচিত্র দেখিয়ে পরিকল্পনা করছিল, কোথায় প্রথম ক্যাম্প তৈরি করা যায়। নীল বারবার গাণিতিক হিসাব মিলিয়ে যাচ্ছিল জ্বালানি ও অক্সিজেন ব্যবহারের, যেন কোনো ভুল না হয়। আদিত্য যন্ত্রপাতির এক একটি অংশ পরীক্ষা করে নিশ্চিত হচ্ছিল, সবকিছু সঠিকভাবে কাজ করছে কিনা। আর কাব্য নিঃশব্দে নক্ষত্রের দিকে তাকিয়ে কল্পনা করছিল, একদিন মানুষ হয়তো এদেরও পাড়ি জমাবে।

অভিযানের কয়েক সপ্তাহ পর মহাকাশযান ধীরে ধীরে মঙ্গলের কক্ষপথে প্রবেশ করল। লালাভ গ্রহটি তখন জানালার ওপারে বিশাল এক অগ্নিগোলকের মতো উজ্জ্বল হয়ে উঠছিল। দলের প্রতিটি সদস্যের শরীর যেন কাঁপতে শুরু করল অজানা উত্তেজনায়। হাজার বছরের স্বপ্ন, শত শত গবেষণা আর অগণিত মানুষের পরিশ্রমের ফল তারা আজ প্রত্যক্ষ করছে। কন্ট্রোল রুম থেকে পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছিল, কিন্তু এই মুহূর্তে প্রত্যেকের মনে হচ্ছিল, তারা যেন একাই ইতিহাসের নতুন অধ্যায় লিখতে চলেছে। অবতরণের প্রস্তুতি শুরু হলো। প্রত্যেকের চোখে স্পষ্ট ভয়, আবার অদম্য কৌতূহলও। রাহুল বলল, “আমরা নামছি এমন এক জগতে, যেখানে মানুষ আগে কখনো স্থায়ীভাবে পদার্পণ করেনি।” মায়া গম্ভীর কণ্ঠে যোগ করল, “এখানেই শুরু হবে আমাদের ভবিষ্যৎ।” মহাকাশযান যখন ধীরে ধীরে মঙ্গলের পাতলা বায়ুমণ্ডল ভেদ করে নামছিল, চারপাশে লাল ধুলোর ঝড় তীব্র হতে লাগল। অবতরণের ধাক্কা সামলাতে গিয়ে সবাই একে অপরের হাত চেপে ধরল। অবশেষে মহাকাশযান লাল বালির ওপর স্থির হলো। নিস্তব্ধতার মধ্যে কেবল যন্ত্রপাতির শব্দ ভেসে আসছিল। হেলমেট পরে, ভারী স্যুটে ঢাকা ছয়জন বিজ্ঞানী একে একে দরজা পেরিয়ে পা রাখল অজানা মাটিতে। রোদ্রালোকের তীব্রতায় ঝলমল করে উঠল লাল ধুলোর দেশ। নিঃশব্দ, নির্জন, অথচ অদ্ভুতভাবে জীবন্ত। সেই মুহূর্তে তাদের মনে হলো, তারা যেন শুধু ইতিহাসের অংশ নয়, বরং মানব সভ্যতার নতুন সূর্যোদয়ের সাক্ষী।

অধ্যায় ২ : লাল ধুলোর দেশে পদার্পণ

লাল বালির সেই অজানা গ্রহে প্রথম পা রাখার মুহূর্তটিই ছিল যেন মানব সভ্যতার দীর্ঘ যাত্রার চূড়ান্ত বিজয়। দলের প্রত্যেক সদস্য ভারী স্যুট পরে, ধীর পায়ে মহাকাশযান থেকে বেরিয়ে এল। তাদের বুটের নিচে খচমচ শব্দ তুলে গুঁড়ো বালি চূর্ণ হচ্ছিল, আর চারপাশের নিস্তব্ধতা তাদের কানে এক ধরনের ভৌতিক প্রতিধ্বনি তৈরি করছিল। প্রথমে অর্পিতা ঝুঁকে মাটির একটি নমুনা তুলল, তার গ্লাভসের ভেতরে আঙুল কেঁপে উঠছিল উত্তেজনায়। মাটির সেই দানা, কোটি কোটি বছর ধরে সূর্যের আলোয় পোড়া ও বাতাসে ঘষা, আজ প্রথমবার মানুষের হাতে ধরা দিল। তাদের চারপাশে কোনো গাছপালা নেই, নেই নদীর কলকল বা বাতাসের সোঁ সোঁ শব্দ, শুধু লাল ধুলোর আস্তরণে ঢাকা এক বিস্তীর্ণ প্রান্তর। নীল দূর থেকে তাকিয়ে বলল, “এটাই আমাদের নতুন পৃথিবী, একদিন হয়তো এখানে সবুজ গাছপালা গজাবে।” মায়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “কিন্তু পথটা সহজ নয়, আমাদের প্রথমে প্রমাণ করতে হবে আমরা এখানে বেঁচে থাকতে পারি।” অবতরণের সেই প্রথম দিনে তারা নিজেদের পতাকা মঙ্গলের বুকে স্থাপন করল—এ শুধু মানবজাতির প্রতীক নয়, বরং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বপ্নের সাক্ষর।

প্রথম কাজ ছিল বেস ক্যাম্প গড়ে তোলা। মহাকাশযানের ভেতরে আনা যন্ত্রপাতি, অক্সিজেন ট্যাঙ্ক, সৌরশক্তি চালিত জেনারেটর আর কৃত্রিম ডোম একে একে স্থাপন করতে শুরু করল তারা। দিনভর অক্লান্ত পরিশ্রমে দাঁড়িয়ে গেল এক অস্থায়ী ঘাঁটি, যার ভেতরে তারা স্বাভাবিক বাতাসে শ্বাস নিতে পারবে, শরীর থেকে ভারী স্যুট খুলে বিশ্রাম নিতে পারবে। রাত নেমে এলে মঙ্গল যেন এক ভিন্ন জগতে রূপ নিল। আকাশ ভরা তারা, তার মাঝে পৃথিবী ছোট্ট নীল বিন্দুর মতো ঝিকমিক করছে। ঠান্ডা এতটাই প্রবল ছিল যে, বাইরে দাঁড়ালে কয়েক মিনিটেই শরীর জমে যাবে। ক্যাম্পের ভেতরে হিটার চালিয়ে উষ্ণতার ব্যবস্থা করা হলো। সবাই গোল হয়ে বসে শুকনো খাবার খেতে খেতে নিজেদের অনুভূতি ভাগ করছিল। আদিত্য বলল, “আজ আমরা যা করলাম, তা শুধু বৈজ্ঞানিক মিশন নয়, ইতিহাসের অংশ।” কাব্য হেসে যোগ করল, “কিন্তু ইতিহাস লিখতে হলে আগে বেঁচে থাকতে হবে। আর তার জন্য আমাদের এই নির্জন দেশে টিকে থাকার উপায় বের করতে হবে।” তারা সবাই মাথা নাড়ল। প্রত্যেকেই জানত, চ্যালেঞ্জের শুরু এখনো বাকি।

পরদিন থেকেই শুরু হলো মাটির নমুনা বিশ্লেষণ। তাদের বিশেষ যন্ত্রে দেখা গেল, মঙ্গলের গভীরে এখনও কিছুটা আর্দ্রতার অস্তিত্ব আছে। এটি তাদের জন্য ছিল আশার আলো। যদি তারা সেই জল সংগ্রহ করতে পারে, তবে অক্সিজেন উৎপাদন ও ফসল ফলানো সম্ভব হতে পারে। কিন্তু কাজ চলতে চলতে এক অদ্ভুত বিষয় নজরে এলো। প্রতিদিন রাত নামলেই ক্যাম্পের কিছু যন্ত্রপাতি হঠাৎ কাজ বন্ধ করে দিচ্ছে, আবার ভোর হতেই স্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছে। প্রথমে তারা ভেবেছিল, হয়তো তীব্র ঠান্ডার কারণে যন্ত্রের সমস্যা হচ্ছে। কিন্তু নীল বলল, “এটা কাকতালীয় হতে পারে না, প্রতিদিন একই সময়ে কেন এমন হবে?” তাদের মনে হালকা সন্দেহ জন্ম নিল। তবুও তারা আপাতত মন দিল কাজের দিকে। অর্পিতা পরীক্ষাগারে লাল মাটির ভেতর কিছু অজানা খনিজ খুঁজে পেল, যা পৃথিবীতে আগে কখনো দেখা যায়নি। মায়া তার ডেটা রেকর্ড করতে করতে থেমে গেল, মনে হলো মাটির ভেতরে যেন কোনো অদৃশ্য শক্তি ঘুরে বেড়াচ্ছে। সেই রাতে সবাই যখন ক্যাম্পের জানালা দিয়ে লাল প্রান্তরের দিকে তাকিয়ে ছিল, এক মুহূর্তের জন্য তাদের মনে হলো, দূরে কেউ যেন নড়ে উঠল। কিন্তু চারদিকে কেবল ধুলো আর অন্ধকার, জীবনের কোনো চিহ্ন নেই। তারা একে অপরের দিকে তাকিয়ে কিছু বলল না, তবে নিঃশব্দে সবার মনে জন্ম নিল এক প্রশ্ন—এই লাল গ্রহ কি সত্যিই একেবারে জনশূন্য?

অধ্যায় ৩ : অদৃশ্য উপস্থিতি

তৃতীয় রাতের অন্ধকারে ক্যাম্পের ভেতরে যেন অদ্ভুত এক শূন্যতা নেমে এলো। বাইরে লাল ধুলোয় ঢাকা প্রান্তর নিস্তব্ধ, আকাশে অসংখ্য তারা জ্বলজ্বল করছে, অথচ দলের প্রত্যেকের মনে এক অস্বস্তি কাজ করছিল। দিনের বেলায় কঠোর পরিশ্রম করে সবাই ক্লান্ত হয়ে পড়লেও রাতে ঘুম আসছিল না। হঠাৎ কাব্য চিৎকার করে উঠল—“দেখেছো, যন্ত্রটা আবার বন্ধ হয়ে গেল!” সবাই ছুটে গেল ল্যাবরুমে, দেখল পানি বিশ্লেষণের জন্য ব্যবহার করা একটি প্রধান যন্ত্র হঠাৎ বন্ধ হয়ে পড়েছে। অদ্ভুত ব্যাপার হলো, তাতে কোনো ত্রুটির সিগনাল নেই, বরং যেন কেউ ইচ্ছে করে বিদ্যুৎ সংযোগ কেটে দিয়েছে। আদিত্য দ্রুত পরীক্ষা করল, কিন্তু কিছুই বুঝতে পারল না। এরকম ঘটনা আগেও ঘটেছিল, কিন্তু এবার সবাই একইসঙ্গে প্রত্যক্ষ করল। মায়া গম্ভীর কণ্ঠে বলল, “আমাদের চারপাশে কিছু হচ্ছে, যা আমরা বুঝতে পারছি না।” তারা জানত, মঙ্গলে মানুষের ছাড়া আর কোনো জীবিত প্রাণ থাকার কথা নয়, কিন্তু তাদের ভেতরে এক অজানা ভয়ের বীজ বপন হয়ে গেল।

পরদিন সকালে পরিস্থিতি আরও অদ্ভুত হলো। ক্যাম্পের বাইরে মাটি পরীক্ষার সময় অর্পিতা হঠাৎ লক্ষ্য করল, তার পেছনে রাখা যন্ত্রপাতির একটি বাক্স কয়েক মিটার দূরে সরে গেছে। প্রথমে সে ভেবেছিল হয়তো বাতাসে উড়ে গেছে, কিন্তু মঙ্গলের বাতাস এত ভারী জিনিস সরাতে সক্ষম নয়। রাহুল এসে বলল, “তুমি কি নিশ্চিত, তুমি ওখানেই রেখেছিলে?” অর্পিতা দৃঢ়ভাবে মাথা নাড়ল। তারা দু’জন বাক্সটি টেনে আবার আগের জায়গায় রাখল। কিন্তু সেই মুহূর্তে হঠাৎ চারপাশে এক অদ্ভুত কাঁপন অনুভূত হলো, যেন মাটির ভেতর থেকে কেউ শ্বাস নিচ্ছে। সবাই ভয়ে থমকে দাঁড়াল, কিন্তু পরক্ষণেই কাঁপন থেমে গেল। সেই রাতে ক্যাম্পের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে নীল দেখল, লাল ধুলোর ওপর ক্ষীণ আলোর রেখা ভেসে বেড়াচ্ছে। যেন কোনো অদৃশ্য সত্তা চলাফেরা করছে। সে অন্যদের ডাকল, কিন্তু তারা তাকাতেই আলোর রেখা মিলিয়ে গেল। নীল বলল, “আমাদের কেউ পর্যবেক্ষণ করছে।” দলের সদস্যরা আতঙ্কিত হয়ে পড়ল, তবে কেউ মুখে স্বীকার করতে চাইলো না।

তৃতীয় রাত পেরোতেই তাদের সন্দেহ ভয়ঙ্কর বাস্তবে রূপ নিল। মাঝরাতে কন্ট্রোল রুমে বসে আদিত্য যন্ত্রপাতি পর্যবেক্ষণ করছিল। হঠাৎ মনিটরে সে এক অচেনা তরঙ্গ সিগন্যাল ধরল, যা পৃথিবীর কোনো পরিচিত বিকিরণের সঙ্গে মেলে না। তরঙ্গটি যেন ক্যাম্পের চারপাশ থেকে ছড়াচ্ছে। সে রেকর্ড করতে শুরু করল, আর ঠিক তখনই তার কানে ভেসে এলো এক অদ্ভুত শব্দ—না মানুষের, না যন্ত্রের, বরং যেন সরাসরি মস্তিষ্কে আঘাত করছে। সেই শব্দ ছিল ধীর অথচ স্পষ্ট: “তোমাদের এখানে জায়গা নেই।” ভয়ে তার শরীর কেঁপে উঠল, সে চিৎকার করে অন্যদের ডাকল। সবাই ছুটে এসে দেখল, মনিটরে তরঙ্গ সিগন্যাল স্পষ্ট রেকর্ড হয়েছে। কিন্তু শব্দটি কেবল আদিত্যই শুনতে পেয়েছিল। বাকিরা হতবাক, অবিশ্বাসী, আবার শঙ্কিত। মায়া বলল, “কেউ আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছে, কিন্তু তারা দেখা দিচ্ছে না।” রাহুল দৃঢ় কণ্ঠে বলল, “যদি এখানে কোনো অদৃশ্য সত্তা থাকে, তবে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে।” সেই মুহূর্তে তাদের বুঝতে বাকি রইল না, মঙ্গল নিস্তব্ধ নয়—বরং অজানা কেউ আছে, যারা তাদের উপস্থিতি মেনে নিচ্ছে না।

অধ্যায় ৪ : রহস্যময় গুহার সন্ধান

দলটি এখন আর আগের মতো নিশ্চিন্ত নেই। প্রতিদিনই নতুন নতুন অস্বস্তিকর ঘটনা ঘটছে, আর অদৃশ্য সেই উপস্থিতির ছায়া যেন ক্রমশ ঘনিয়ে আসছে। ঠিক তখনই নীল প্রস্তাব দিল আশেপাশের এলাকা আরও বিস্তৃতভাবে অনুসন্ধান করার, কারণ অজানা শক্তির উৎস হয়তো কাছাকাছি কোথাও লুকিয়ে আছে। এক সকালে তারা বিশেষ গাড়ি নিয়ে ক্যাম্প থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে বেরোল। লাল বালির সমুদ্রের মাঝে তারা হঠাৎ দেখতে পেল খাড়া পাহাড়ি গঠন, যার এক পাশে কালো ছায়ায় ঢাকা বিশাল ফাটল। প্রথম দেখাতেই মনে হলো এটি প্রাকৃতিক গুহা, কিন্তু কাছে যেতেই দেখা গেল এর প্রবেশপথ একেবারে নিখুঁত খিলানের মতো, যেন কোনো সচেতন সত্তা তা তৈরি করেছে। রাহুল বিস্মিত চোখে তাকিয়ে বলল, “এটা প্রাকৃতিক নয়, কোনো সভ্যতার চিহ্ন।” বাকিরা স্তব্ধ হয়ে গেল। এতদিন ধরে মঙ্গলকে জনশূন্য বলা হলেও চোখের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এই অদ্ভুত কাঠামো তাদের সমস্ত বিশ্বাস ও বিজ্ঞানকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিল।

গুহার ভেতরে প্রবেশ করার সিদ্ধান্ত সহজ ছিল না। ক্যাম্পের নিরাপত্তা ছেড়ে, অজানা এক অন্ধকারে ঢোকা মানে ছিল জীবন হাতে নিয়ে এগোনো। তবুও কৌতূহল আর দায়িত্ববোধ তাদের এগিয়ে যেতে বাধ্য করল। ভারী স্যুট পরে, হেডল্যাম্প জ্বালিয়ে তারা গুহার ভেতরে ঢুকল। শীতল বাতাস তাদের ঘিরে ধরল, যদিও মঙ্গলের পাতলা বায়ুমণ্ডলে বাতাস থাকার কথা নয়। গুহার দেয়ালে অদ্ভুত প্রতীক খোদাই করা—ত্রিভুজ, বৃত্ত আর অচেনা জ্যামিতিক নকশা, যা মানুষের তৈরি কোনো ভাষার মতো নয়, কিন্তু স্পষ্টতই পরিকল্পিত। অর্পিতা হাতে থাকা যন্ত্র দিয়ে প্রতীকের ছবি তুলে রাখতে লাগল। এক পর্যায়ে মায়া চিৎকার করে উঠল, “দেখো, এগুলো বিকিরণ ছড়াচ্ছে!” প্রতীকগুলির ভেতর থেকে ক্ষীণ আলোকরশ্মি বেরিয়ে আসছিল, আর সেই সঙ্গে যন্ত্রে প্রবল শক্তির তরঙ্গ ধরা পড়ছিল। যেন এই দেয়ালগুলো এখনো জীবন্ত, কোনো প্রাচীন প্রযুক্তির প্রতিধ্বনি। দলটির প্রত্যেকের শরীরে কাঁপুনি ধরল। মনে হচ্ছিল, তারা যেন কারও নিষিদ্ধ মন্দিরে প্রবেশ করেছে, যেখানে বহুযুগ ধরে লুকিয়ে আছে অচেনা ইতিহাস।

গুহার গভীরে এগোতেই এক চওড়া চেম্বারে পৌঁছাল তারা। চেম্বারের মাঝখানে ছিল এক বিশাল পাথরের বেদি, যার গায়েও খোদাই করা প্রতীক জ্বলজ্বল করছিল। হঠাৎ তাদের যন্ত্রপাতি একসঙ্গে বিকল হয়ে গেল—কোনো স্ক্যানার, কোনো কমিউনিকেশন ডিভাইস আর কাজ করছিল না। তখনই সবাই অনুভব করল, কারও অদৃশ্য দৃষ্টি তাদের ঘিরে ধরছে। রাহুল গম্ভীর কণ্ঠে বলল, “এটা কোনো সতর্কবার্তা।” আদিত্য ভীতসন্ত্রস্ত গলায় যোগ করল, “হয়তো আমরা এমন কিছু স্পর্শ করেছি যা স্পর্শ করা উচিত নয়।” ঠিক সেই মুহূর্তে গুহার ভেতর গর্জন তুলে প্রতিধ্বনি হলো, যেন মাটি কেঁপে উঠল। দেয়ালের প্রতীকগুলো একসঙ্গে আলো ছড়াতে লাগল, আর তাদের মস্তিষ্কে ধাক্কা দিয়ে ভেসে এলো এক অচেনা বার্তা—কোনো ভাষা নয়, তবু স্পষ্টভাবে তারা বুঝল: “এখানে তোমাদের প্রবেশাধিকার নেই।” সবাই ভয়ে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়াল, কিন্তু কোনো শব্দ বের হলো না কারও মুখ থেকে। তারা বুঝল, এই গুহা কেবল কোনো প্রাচীন নিদর্শন নয়, বরং এক অদৃশ্য সভ্যতার শক্তির কেন্দ্র, আর তাদের উপস্থিতি এখানে মোটেই স্বাগত নয়।

অধ্যায় ৫ : প্রথম যোগাযোগ

গুহার অভ্যন্তরে ঘটে যাওয়া অভিজ্ঞতার পরে দলটি ফের ক্যাম্পে ফিরে এল, কিন্তু তাদের মনে অদ্ভুত উত্তেজনা আর অশান্তি তৈরি হয়ে গেছে। রাত নেমে যখন তারা সবাই ঘুমোতে বসে, তখন হঠাৎ ক্যাম্পের চারপাশে অদৃশ্য শক্তির উপস্থিতি আরও স্পষ্ট হয়ে উঠল। হেডল্যাম্পের আলো অদ্ভুতভাবে নড়াচড়া করছিল, আর যন্ত্রপাতি মাঝে মাঝে নিজে নিজে চালু-বন্দ হয়ে যাচ্ছিল। প্রথমে সবাই ভেবেছিল এটি শুধু প্রযুক্তিগত ত্রুটি, কিন্তু যখন তাদের মনের ভেতর অজানা বার্তা পৌঁছাতে শুরু করল, তখন বোঝা গেল—এ আর কোনো সাধারণ সমস্যা নয়। বার্তাটি কোনো ভাষায় নয়, বরং একটি সরাসরি ভাবগত যোগাযোগের মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছিল: “তোমরা এখানে কেন এসেছ?” সবার শরীর কেঁপে উঠল। এতদিন গবেষণা এবং প্রস্তুতির পর, তারা প্রথমবার মুখোমুখি হচ্ছিল এক অদৃশ্য, অজানা সভ্যতার সঙ্গে।

পরবর্তী কয়েকদিনে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে ওঠে। প্রতিদিন রাতে অদ্ভুত আলো, অদৃশ্য ছায়া এবং বার্তা তাদের ঘিরে রাখে। আদিত্য প্রথমবারই ঠিক বুঝতে পারল, এই সভ্যতা তাদের অস্তিত্ব স্বীকার করছে এবং তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে চায়, তবে নিজের শরীর প্রকাশ করছে না। এক রাতে, সে হঠাৎ স্বপ্নের মতো এক ভিজ্যুয়াল দেখল—হালকা আলো, জ্যামিতিক আকার এবং শব্দহীন বার্তা যা তাকে নির্দেশ করছিল গুহার প্রতীকগুলোর অর্থ জানার দিকে। যখন সে অন্যদের জানাল, তারা শুরু করল সেই প্রতীক বিশ্লেষণ। এভাবেই বিজ্ঞানীরা বুঝতে শুরু করল, এটি কোনো স্বাভাবিক সভ্যতা নয়, বরং মঙ্গলের প্রাণের সঙ্গে সংযুক্ত এক শক্তি, যা বহু শতাব্দী ধরে অদৃশ্য রূপে টিকে আছে।

একদিন, গুহার ভিতরের একটি বিশেষ প্রতীক নীলের মনোজগতে একটি জ্বলন্ত বার্তা পাঠায়। বার্তাটি স্পষ্টভাবে বোঝাচ্ছিল: “মানুষ ধ্বংস করতে আসেনি, তবে তাদের অনুমতি চাই।” দলের প্রত্যেকের চোখে আতঙ্কের ছায়া, আবার কৌতূহলও। তারা বুঝতে পারল, মঙ্গল নিঃশব্দ নয়—এখানে বিদ্যমান শক্তি তাদের কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করছে এবং স্পষ্ট বার্তা দিচ্ছে। রাহুল বলল, “এরা আমাদের সঙ্গে কথা বলতে চাইছে, তবে তারা আমাদেরকে দেখা দিচ্ছে না।” অর্পিতা যোগ করল, “আমাদের উচিত এখন ধীরে ধীরে তাদের বোঝার চেষ্টা করা।” এই প্রথম রাতে তারা সত্যিই অনুভব করল, মঙ্গলের রহস্য শুধুই বিজ্ঞান নয়, বরং এক অদৃশ্য সভ্যতার সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের গল্প। তাদের ভেতরে জন্ম নিল এক নতুন লক্ষ্য—শান্তিপূর্ণ যোগাযোগের চেষ্টা।

অধ্যায় ৬ : অজানা ইতিহাসের উন্মোচন

প্রথম যোগাযোগের ঘটনাটি তাদের মঙ্গল অভিযানের মানচিত্র পুরোপুরি পরিবর্তন করে দিল। বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারল, তারা এক অদৃশ্য সভ্যতার সঙ্গে সরাসরি সংযুক্ত। মঙ্গলের বুকে বহু শতাব্দী ধরে এই শক্তি অবস্থান করছে, যা মানুষের চোখে অদৃশ্য হলেও এই গ্রহের প্রতিটি কণা, প্রতিটি পাহাড় ও গর্তের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। অর্পিতা দিনের বেলায় গুহা এবং প্রান্তরের অন্যান্য প্রতীক নিয়ে গবেষণা শুরু করল। সে প্রতিটি চিহ্নের ছবি তুলল, বিশেষ যন্ত্র দিয়ে বিকিরণ ও শক্তি তরঙ্গ রেকর্ড করল। ধীরে ধীরে তারা আবিষ্কার করল, এই সভ্যতা কোনো সাধারণ প্রাণী নয়—এরা পরিবেশের সঙ্গে একাকার হয়ে গেছে। নীল এবং আদিত্য প্রতীকগুলোর জ্যামিতিক প্যাটার্ন বিশ্লেষণ করতে লাগল। তারা দেখল, প্রতীকগুলোর মধ্যে লুকানো তথ্য শুধু ইতিহাস নয়, বরং প্রযুক্তি ও শক্তি সম্পর্কিত গভীর ধারণা বহন করছে।

তাদের গবেষণার মধ্যেই মায়া হঠাৎ একটি অদ্ভুত নথি আবিষ্কার করল—মাটির ভেতরে ক্ষীণভাবে খোদাই করা প্রতীক এবং চিহ্ন যা এক প্রাচীন ভাষার মতো মনে হলো। প্রতীকগুলো বিশ্লেষণ করে তারা জানতে পারল, বহু সহস্র বছর আগে মঙ্গলেও এক জ্ঞানসম্পন্ন সভ্যতা বসতি গড়েছিল। তবে পরিবেশের পরিবর্তন এবং শক্তির ক্রমবর্ধমান চাপ তাদের ভৌত দেহ হারিয়ে শক্তি-সত্তায় রূপান্তরিত করেছিল। অর্থাৎ, আজ যারা তাদের চারপাশে অদৃশ্যভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তারা সেই প্রাচীন সভ্যতারই উত্তরসূরি। রাহুল হতবাক হয়ে বলল, “তাদের অস্তিত্ব এবং ইতিহাস আমাদের কল্পনার বাইরে।” কাব্য যোগ করল, “এরা কোনো দানব নয়, বরং এই গ্রহের প্রকৃত অভিভাবক।” এই উপলব্ধি তাদের ভয় ও কৌতূহল দুই-ই বাড়িয়ে দিল।

বেশ কিছু সপ্তাহ ধরে অধ্যয়ন চালানোর পর তারা আরও একটি সত্য আবিষ্কার করল—অদৃশ্য সভ্যতার শক্তি ও মানুষের প্রযুক্তি একে অপরের সাথে জড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। আদিত্য বোঝাল, “যদি আমরা তাদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করি এবং আমাদের প্রযুক্তি ব্যবহার করি, তবে আমরা হয়তো এক যৌথ শক্তির জন্ম দিতে পারি।” অর্পিতা বলল, “তাদের সম্মান করতে হবে। যদি আমরা অহংকারে আক্রমণ করি, তারা প্রতিহত করবে।” এই উপলব্ধি দলকে একটি নতুন পরিকল্পনা দিতে লাগল—শান্তিপূর্ণ সহাবস্থায় কীভাবে মঙ্গলকে পুনর্জীবিত করা যায়। এই অধ্যায়টি ছিল মানুষের কৌতূহল ও ভিনগ্রহী সভ্যতার প্রাচীন ইতিহাসের সঙ্গে মিলনের প্রথম ধাপ। তারা বুঝতে পারল, মঙ্গল শুধুই বসতি নয়, বরং এক জীবন্ত গ্রহ, যা অতীতের স্মৃতি ও শক্তির সঙ্গে বেঁধে আছে।

অধ্যায় ৭ : দ্বন্দ্বের সূচনা

মঙ্গল অভিযানের এক নতুন অধ্যায় শুরু হলো যখন বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারল, অদৃশ্য সভ্যতা তাদের উপস্থিতি মোটেও স্বাগত জানাচ্ছে না। যত দিন যাচ্ছিল, ততই অদ্ভুত ঘটনার সংখ্যা বেড়ে চলছিল। ক্যাম্পের যন্ত্রপাতি একেবারেই অপ্রত্যাশিতভাবে কাজ বন্ধ করছিল, কখনও কখনও পুরো শক্তি সরবরাহ স্তব্ধ হয়ে যাচ্ছিল। একদিন রাতের বেলায়, ধুলোর ঝড়ের আড়ালে মাটির কিছু অংশ হঠাৎ কেঁপে উঠল। রাহুল এবং নীল মিলে দেখল, একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক যন্ত্র ভেঙে পড়েছে, আর এর চারপাশে অদৃশ্য শক্তির স্পষ্ট চিহ্ন মিলছে। তাদের মনে হলো, শুধু পর্যবেক্ষণ নয়, তাদের কার্যকলাপও এরা বাধা দিতে শুরু করেছে। আতঙ্কিত হলেও বিজ্ঞানীরা জানল, মঙ্গলের এই শক্তি সরাসরি তাদের প্রতি প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ নিচ্ছে।

দ্বন্দ্বের প্রকৃতি ক্রমশ আরও জটিল হতে লাগল। অধিগ্রহণ এবং গবেষণার উদ্দেশ্য নিয়ে দলের মধ্যে মতবিরোধ জন্ম নিল। কিছু সদস্য, যেমন অর্পিতা এবং মায়া, মনে করল—শান্তিপূর্ণ সমঝোতার চেষ্টা করা প্রয়োজন। অন্যদিকে রাহুল এবং আদিত্য বিশ্বাস করল, মানবজাতির স্বার্থে নির্দিষ্ট প্রযুক্তি স্থাপন করতে হবে, যেটা কিছুটা ঝুঁকিপূর্ণ হলেও সফল হলে বেস ক্যাম্পকে নিরাপদ করবে। এই দ্বন্দ্বের মাঝে অদৃশ্য সভ্যতা তাদের উপস্থিতি আরও প্রখরভাবে প্রকাশ করল। এক রাতে ক্যাম্পের বাইরের লাল বালির প্রান্তর হঠাৎ আলোয় ঝলমল করতে লাগল, আর যন্ত্রপাতির সতর্কতা সিগন্যাল বাজতে শুরু করল। তারা বুঝতে পারল, এই শক্তি শুধু পর্যবেক্ষণই করছে না—এরা প্রয়োজন হলে আক্রমণও করতে পারে।

দ্বন্দ্ব বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দলটি এক অজানা মানসিক চাপের মুখোমুখি হলো। ক্যাম্পের সদস্যরা নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত, আবার গবেষণার লক্ষ্যও অম্লান। নীল হঠাৎ ভাবলো, “আমাদের উচিত হয়তো সংযোগ স্থাপন করার চেষ্টা করা, তবে আমাদের আচরণ যেন আগ্রাসী না হয়।” কাব্য যোগ করল, “নাহ, যদি আমরা ভুল করি, তারা আমাদের পুরো কার্যক্রম ব্যাহত করতে পারে।” এই দ্বন্দ্ব, ভয় এবং কৌতূহলের মধ্যে তারা রাতের অন্ধকারে একসঙ্গে বসে, লাল মাটির ওপর বিশাল প্রান্তরকে দেখে ভাবছিল—এই গ্রহে মানুষের পদচারণা কি কেবল অনধিকার প্রবেশ নাকি শান্তিপূর্ণ সহাবস্থার সম্ভাবনা রয়েছে? এই অধ্যায়ে স্পষ্ট হলো, মঙ্গল শুধুই বিজ্ঞান নয়, বরং এখানে থাকা শক্তি এবং মানুষের উদ্যোগের মধ্যে এক ধরনের লড়াই শুরু হয়ে গেছে, যার ফলাফল নির্ধারণ করবে ভবিষ্যতের বসতির পথ।

অধ্যায় ৮ : সমঝোতার প্রচেষ্টা

দ্বন্দ্বের উত্তাপ ক্রমশ এমন পর্যায়ে পৌঁছালো, যেখানে দল বুঝতে পারল, আগ্রাসীভাবে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া মানে নিজেরাই বিপদে ফেলা। অর্পিতা প্রথমবার সাহস করে ভাবল, হয়তো এই অদৃশ্য সভ্যতার সঙ্গে যোগাযোগের নতুন পথ খুঁজে বের করা যায়। সে প্রস্তাব দিল, যন্ত্রপাতি ব্যবহার না করে, সরাসরি মনযোগ দিয়ে বার্তা প্রেরণ করার চেষ্টা করা হোক। মায়া ও কাব্য সঙ্গ দিল। তারা প্রতীক এবং বিকিরণ নিয়ে নোট তৈরি করল, চিহ্নগুলোর মধ্য দিয়ে অদৃশ্য সভ্যতার ভাবনা বোঝার চেষ্টা করল। প্রতিটি সন্ধ্যা তারা একে অপরের সঙ্গে আলোচনা করে প্রস্তাবনা তৈরি করল—কীভাবে তাদের উদ্দেশ্য বোঝানো যায়, যেন তারা অনুভব করে মানুষ এখানে ধ্বংস করতে নয়, বরং সহযোগিতা করতে এসেছে।

প্রথম কয়েক রাতের প্রচেষ্টা ব্যর্থ মনে হলেও, একদিন হঠাৎ আদিত্য স্বপ্নের মতো এক অদ্ভুত ভিজ্যুয়াল অনুভব করল। প্রতীকগুলোতে জ্বলজ্বল করা আলো তার মনের ভেতরে বার্তা পাঠাল—এক ধরনের স্বীকৃতি এবং আগ্রহের সংকেত। দলের সবাই অবাক, তবে এই সংকেত তাদের জন্য আশা নিয়ে আসে। নীল বলল, “এখনই আমাদের ধৈর্য দরকার। এরা আমাদের বার্তা বুঝতে শুরু করেছে।” অর্পিতা যোগ করল, “আমাদের সঠিকভাবে তাদের বোঝাতে হবে, আমরা ক্ষতি করতে আসিনি।” সেই রাতে তারা ক্যাম্পের বাইরে একটি ছোট পরীক্ষা চালাল—ছোট আলো এবং শব্দ সংকেত পাঠানো হলো, যা বিকিরণ বা শক্তির তরঙ্গের মাধ্যমে অদৃশ্য সভ্যতার কাছে পৌঁছানো চেষ্টা করা হলো। প্রতিক্রিয়া আসতে সময় লাগল, কিন্তু সকালের আলোয় তারা দেখল, প্রতীকগুলোর আলো আরও শক্তিশালীভাবে জ্বলে উঠেছে। এটি স্পষ্ট করে দিল, প্রথম বাস্তব যোগাযোগ সম্ভব হয়েছে।

দলের প্রত্যেকের মনে আশা জন্ম নিল, তবে সতর্কতাও জরুরি। তারা বুঝল, মঙ্গল এক জীবন্ত গ্রহ, যা শক্তি এবং ইতিহাসের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। সমঝোতার এই পথ ধরে তারা প্রমাণ করল, মানুষ যদি অহংকার বা লোভ ছেড়ে সম্মান এবং কৌতূহল নিয়ে এগোয়, তবে অদৃশ্য সভ্যতা সহায়ক হতে পারে। তারা দিনের বেলায় প্রতীক বিশ্লেষণ চালিয়ে গেল, রাতে বার্তা পাঠাতে লাগল, এবং ধীরে ধীরে অদৃশ্য শক্তির সঙ্গে এক রকম সেতুবন্ধন গড়ে উঠল। এই অধ্যায়টি ছিল মানুষের কৌতূহল, ধৈর্য এবং অদৃশ্য শক্তির সঙ্গে প্রথম বন্ধুত্বের গল্প—যা ভবিষ্যতের যৌথ বসতির সম্ভাবনার জন্য ভিত্তি তৈরি করল।

অধ্যায় ৯ : নতুন পথের সন্ধান

সমঝোতার প্রচেষ্টার পর ধীরে ধীরে অদৃশ্য সভ্যতা এবং মানবদলের মধ্যে একটি অদ্ভুত সেতুবন্ধন গড়ে উঠল। প্রতীক এবং বিকিরণ বিশ্লেষণের মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারল, মঙ্গলে এমন এক গোপন শক্তির উৎস রয়েছে যা মানুষের প্রযুক্তি এবং অদৃশ্য শক্তির মধ্যে সংযোগ তৈরি করতে পারে। আদিত্য এই শক্তি উৎসের অবস্থান চিহ্নিত করল—একটি প্রাচীন গুহার গভীরে, যেখানে আলো এবং শক্তির তরঙ্গ ক্রমশ সংযুক্ত হয়েছে। তিনি বলল, “যদি আমরা এখানে কাজ করতে পারি, তবে মানুষের প্রযুক্তি এবং এই সভ্যতার শক্তি একত্রে মঙ্গলকে পুনর্জীবিত করতে পারে।” দলের সবাই এই প্রস্তাবনার সঙ্গে একমত হল।

তারা বিশেষ প্রস্তুতি নিয়ে সেই গুহার ভেতরে প্রবেশ করল। প্রতিটি ধাপেই সতর্কতা অবলম্বন করল, কারণ ছোট ভুলও বিপদের কারণ হতে পারে। গুহার ভেতরে ঢুকেই তারা দেখতে পেল, মাটির ভেতর প্রাচীন চক্র এবং জ্যামিতিক নকশা এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যে, এটি শক্তি প্রবাহকে নিয়ন্ত্রণ করে। অর্পিতা এবং নীল একসঙ্গে সেই নকশা বিশ্লেষণ করতে লাগল। ধীরে ধীরে তারা বুঝতে পারল, এই চক্রের মাধ্যমে মানুষের প্রযুক্তি এবং অদৃশ্য শক্তি সরাসরি সংযুক্ত হতে পারে। আদিত্য বলল, “এটা এক ধরনের সেতু—যে কোনো অগোছালো পদক্ষেপ একে ধ্বংস করতে পারে, কিন্তু সঠিক ব্যবহার করলে আমাদের জন্য নতুন সম্ভাবনার দরজা খুলবে।”

তাদের প্রথম চেষ্টা সফল হলো। ধীর ধাপে তারা শক্তির উৎসের সঙ্গে প্রযুক্তি সংযোগ স্থাপন করল। অদৃশ্য সভ্যতা ধীরে ধীরে তাদেরকে অনুমতি দিল, নিজেদের শক্তি প্রবাহ মানবদলের ব্যবস্থার সঙ্গে মেলাতে। প্রতীক এবং বিকিরণ একত্রে কাজ করতে শুরু করল, আর মঙ্গল যেন প্রথমবারের মতো প্রাণবন্ত হয়ে উঠল। বাতাসে নরম আলো, মাটির গভীরে শক্তির দোলন, এবং ধুলোর মাঝের অদ্ভুত আলো—সব মিলিয়ে একটি নতুন দৃশ্য তৈরি করল, যা বিজ্ঞানীদের চোখে অবিশ্বাস্য মনে হলো। রাহুল বলল, “আমরা কেবল বসতি স্থাপন করিনি, আমরা মঙ্গলের সঙ্গে বন্ধুত্ব করেছি।” মায়া যোগ করল, “এখন থেকে এটি মানব এবং অদৃশ্য সভ্যতার যৌথ বসতি হতে পারে।” এই অধ্যায়ে স্পষ্ট হলো, বিজ্ঞান, কৌতূহল, ধৈর্য এবং সম্মানের মাধ্যমে নতুন পথ খোলা সম্ভব, আর মঙ্গল তাদের সেই নতুন পথের জীবন্ত সাক্ষী হয়ে উঠল।

অধ্যায় ১০ : লাল গ্রহের ডাক

অবশেষে মানবদল বুঝতে পারল, মঙ্গল শুধুই একটি শূন্য, লাল ধুলোর গ্রহ নয়—এটি এক জীবন্ত গ্রহ, যেখানে প্রাচীন অদৃশ্য সভ্যতার শক্তি এবং ইতিহাস লুকিয়ে আছে। অধ্যায়ের শুরুতে তারা ক্যাম্পে বসে প্রতীক এবং শক্তি প্রবাহের কার্যকারিতা পর্যবেক্ষণ করছিল। প্রতিটি পরীক্ষায় স্পষ্ট হয়ে উঠল, যদি মানুষের প্রযুক্তি এবং অদৃশ্য শক্তি সমন্বিতভাবে কাজ করে, তবে মঙ্গলকে মানব বসতি এবং প্রাকৃতিক ভারসাম্য দুটোই বজায় রেখে জীবনধারা গড়ে তোলা সম্ভব। দলটি আনন্দ এবং উত্তেজনায় উদ্দীপ্ত, তবে সবাই জানত, কোনোরকম অহংকার বা লোভের সঙ্গে এগোলে তারা এই fragile সংযোগকে নষ্ট করতে পারে।

একদিন সকালে, অর্পিতা এবং নীল মিলে একটি চূড়ান্ত পরীক্ষা চালাল। তারা শক্তির প্রবাহকে প্রযুক্তির সঙ্গে সম্পূর্ণভাবে সংযুক্ত করল। প্রথমবারের মতো তারা লক্ষ্য করল, বাতাসে সূক্ষ্ম তরঙ্গের সঙ্গে লাল মাটির বিকিরণ মিলিয়ে এক ধরনের উজ্জ্বল আলোর ঝিলিক সৃষ্টি করছে। ক্যাম্পের বাইরে ধুলো ঘেরা প্রান্তর যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছে। নীল বলল, “এটি কেবল বৈজ্ঞানিক অর্জন নয়, বরং একটি নবজীবনের প্রমাণ।” আদিত্য যোগ করল, “এখানেই আমরা শিখেছি, যে কোনো গ্রহকে জয় করা নয়, বরং তাকে সম্মান করা জরুরি।” রাতের আকাশে তারা দেখল, অজস্র তারা জ্বলজ্বল করছে, আর দূরে লাল আলো যেন এক অদৃশ্য সভ্যতার স্বীকৃতি পাঠাচ্ছে—এক অভিবাদন, যা মানবজাতির সঙ্গে বন্ধুত্বের প্রতীক।

শেষে, মঙ্গলে মানব বসতি কেবল প্রযুক্তির জয় নয়। এটি সমঝোতা, কৌতূহল, ধৈর্য এবং সম্মানের প্রতীক। তারা পৃথিবীতে বার্তা পাঠাল—“লাল গ্রহ ডাক দিচ্ছে, তবে তাকে জয় নয়, সম্মান করতে হবে।” অর্পিতা, রাহুল, নীল, মায়া, কাব্য ও আদিত্য একে অপরের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমরা ইতিহাসের অংশ, কিন্তু এক নতুন যুগের প্রারম্ভ করছি।” মঙ্গল আর নিস্তব্ধ নয়; এটি এখন দুই সভ্যতার যৌথ বসতির প্রতীক। মানুষের উপস্থিতি আর অদৃশ্য সভ্যতার শক্তি মিলে এক নতুন জীবনধারার সূচনা ঘটাল। অধ্যায়টি শেষ হয় এক উজ্জ্বল আলোর দৃশ্য দিয়ে—লাল গ্রহ শুধু ডাকছে না, এটি মানব ও অদৃশ্য সভ্যতার বন্ধুত্বের আহ্বান পাঠাচ্ছে, যা ভবিষ্যতের সম্ভাবনার দরজা খুলে দিয়েছে।

সমাপ্ত

1000066491.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *