অরিন্দম এবং মাধুরী দীর্ঘদিনের পরিশ্রম আর সঞ্চয়ের ফলস্বরূপ অবশেষে তাদের স্বপ্নের ফ্ল্যাটে প্রবেশ করল। শহরের ব্যস্ততম এলাকাগুলো থেকে দূরে, একটি আধুনিক কমপ্লেক্সের উচ্চতর তলার এই অ্যাপার্টমেন্ট যেন তাদের নতুন জীবন শুরু করার জন্য তৈরি করা হয়েছিল। বাইরের কোলাহল এবং ধুলো-ময়লা থেকে একেবারেই আলাদা, চারপাশে প্রশান্ত নীরবতা, সবকিছু সুন্দরভাবে সাজানো লবি, এবং প্রতিটি ফ্ল্যাটে আধুনিক সুবিধা—এগুলো সবই তাদের নতুন জীবনকে স্বাগত জানাচ্ছিল। অরিন্দম বেশ উদ্দীপনায় নতুন ফ্ল্যাটের প্রতিটি কোণ ঘুরে দেখছিল, তার চোখে আনন্দ আর সাফল্যের প্রতিফলন স্পষ্ট। মাধুরী, যদিও আনন্দিত, কিন্তু তার মনে মাঝে মাঝে এক অদ্ভুত অস্থিরতা কাজ করছিল। ফ্ল্যাটের নিখুঁত নীরবতা মাঝে মাঝে যেন তার কানে অদ্ভুত শব্দের প্রতিধ্বনি তুলে দিচ্ছিল, কিন্তু সে অজানার ভয়ে তা নিজের সঙ্গে লুকিয়ে রাখছিল। প্রতিটি সকালে সূর্যের আলো যখন জানালার মাধ্যমে ফ্ল্যাটে প্রবেশ করত, তখন মাধুরী তার কক্ষের শান্তি উপভোগ করলেও মাঝে মাঝে কিছু অদৃশ্য কিছু যেন তাকিয়ে আছে—এই অনুভূতি তাকে অচেনা চিন্তায় মুগ্ধ করত।
প্রথম ক’দিনে তারা নতুন ফ্ল্যাটে তাদের জিনিসপত্র গোছানোর ব্যস্ততায় ছিল। বই, কাপড়, রান্নার জিনিসপত্র—সবকিছু সুন্দরভাবে সাজানোর চেষ্টা চলছিল। অরিন্দমের হাতে যেমন ছিল পরিকল্পনার তালিকা, তেমনি মাধুরীর চোখে ছিল নিখুঁত সাজানোর ইচ্ছা। তারা প্রতিটি কক্ষকে একেবারে নিজের মতো করে সাজাচ্ছিল। রান্নাঘরের জিনিসগুলো গুছিয়ে রাখা, লিভিং রুমে সোফার আসন ঠিক করা, বেডরুমের কোণাকুণে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র রাখা—সবকিছুই যেন নতুন জীবনের প্রতীক। তবে রাত যখন নেমে আসত, ফ্ল্যাটের নীরবতা তখন মাধুরীর মনে অদ্ভুত এক অস্থিরতা সৃষ্টি করত। কখনো কখনো মনে হত, খোলা জানালা বা ফাঁকা করিডোরের কোনা থেকে হালকা শব্দ ভেসে আসে, যেন কেউ বা কিছু তাদের দেখছে। অরিন্দম এইসব কিছুতে মনোযোগ দিত না; সে মাধুরীর অস্থিরতা বুঝতে পারলেও তার জন্য তাকে শান্ত করার চেষ্টা করত। মাধুরী নিজেকে আশ্বাস দিত যে এটি কেবল নতুন পরিবেশের প্রভাব, কিন্তু তার অন্তরে অজান্তেই একটি অদৃশ্য ভয় জন্ম নিচ্ছিল।
ফ্ল্যাটের তৃতীয় রাতে সবকিছু সম্পূর্ণভাবে সাজানো হয়ে গেল। লিভিং রুমে টিভি, সোফা, কফি টেবিল—সবকিছু ঠিক যেমন তারা পরিকল্পনা করেছিল। রান্নাঘরের আলমারি সাজানো, বেডরুমে বিছানা মসৃণভাবে বিছানো। কিন্তু সেই রাতে মাধুরী প্রথমবার সঠিকভাবে অনুভব করল, নিখুঁত নীরবতার মধ্যে কিছু একটা অদ্ভুত। রান্নাঘরের দিকে হঠাৎ হালকা টুকটুক শব্দ, যেন কেউ হালকা পদক্ষেপ নিচ্ছে, মাধুরীর মনকে কাঁপিয়ে তুলল। সে অরিন্দমকে ডাকল, কিন্তু অরিন্দম হাসতে হাসতে বলল, “নিশ্চিন থাকো, এখানে তো আমরা ছাড়া আর কেউ নেই।” মাধুরী চুপ থাকল, কিন্তু তার মনে এক অদ্ভুত অস্থিরতা গেঁথে গেল। তারপরও তারা দুজনে নতুন ফ্ল্যাটে বসে গল্প করতে, পরিকল্পনা করতে, এবং নতুন জীবনের আনন্দে মেতে উঠল। তবে সেই রাতের নিখুঁত নীরবতা মাধুরীর মনে দীর্ঘস্থায়ী প্রশ্নের জন্ম দিল—কেন ফ্ল্যাটের এই নিখুঁত পরিবেশের মধ্যেও সে কিছু অজানা অনুভব করছে, এবং সেই অনুভূতিটি কি কখনো তাকে শান্তিতে বসতে দেবে? এই অস্থিরতার মধ্যেই নতুন জীবন শুরু হলো, যেখানে আনন্দ আর অদ্ভুত রহস্য মিলেমিশে এক অনন্য অভিজ্ঞতা সৃষ্টি করল।
~
নতুন ফ্ল্যাটের প্রথম রাতটি অরিন্দম এবং মাধুরীর জন্য এক অদ্ভুত মিশ্র অনুভূতির রাত হয়ে উঠল। দিনের সব কাজ শেষে তারা দেরিতে ঘুমোতে গিয়েছিল। অরিন্দমের ঘুম গভীর ছিল, কিন্তু হঠাৎই তাকে বিরক্ত করল মৃদু, অনিয়মিত টুকটুক শব্দ। প্রথমে সে ভাবল হয়তো বাইরে থেকে কোনো শব্দ এসেছে, কিন্তু যখন শব্দটি স্পষ্টতই ফ্ল্যাটের ভেতর থেকে—রান্নাঘরের দিকে—এসে ভেসে এল, তখন সে চমকে ওঠে। মাধুরীও একই মুহূর্তে জেগে ওঠে, এবং তাদের দুজনের চোখে অদ্ভুত আতঙ্কের ছাপ ফুটে ওঠে। প্রথমে তারা একে অপরকে বিশ্বাস দিতে চেষ্টা করল যে এটি কেবল তাদের কল্পনা বা নতুন পরিবেশের কারণে মানসিক চাপ, কিন্তু তখনই তারা স্পষ্টভাবে শুনল—কেউ হালকা হেসে উঠেছে। হাসির আওয়াজটি ছোট বাচ্চার মতন, কোমল, মিষ্টি কিন্তু অদ্ভুতভাবে রহস্যময়। ফ্ল্যাটের নিখুঁত নীরবতার মধ্যে সেই হাসি যেন আরও প্রতিধ্বনি ঘটাচ্ছিল।
অরিন্দম ধীরে ধীরে উঠে রান্নাঘরের দিকে এগোলেন, মাধুরী তার পিছুপিছু। তারা দুজনেই সতর্ক থাকছিল, প্রতিটি কোণ থেকে আসা শব্দ মনোযোগ দিয়ে শুনছিল। রান্নাঘরের লাইট খুলে চেম্বারটি পরীক্ষা করল, কিন্তু সেখানে ছিল কেবল অল্প আলোয় ঝলমলানো আলমারি, পরিষ্কার টেবিল এবং নিরবতার রাজত্ব। কোনো চিহ্ন নেই, কোনো বাচ্চা নেই, অথচ সেই হালকা হাসির প্রতিধ্বনি এখনও বাতাসে ভেসে চলছিল। মাধুরীর কণ্ঠে কেঁপে উঠা স্বরে প্রশ্ন আসে, “এটা কী হতে পারে? আমরা তো ফ্ল্যাটে একা।” অরিন্দম তাকে শান্ত করার চেষ্টা করে বলল, “কোনও ধ্বনি হয়তো প্রাচীরের প্রতিধ্বনি বা বাইরের শব্দের প্রতিফলন। ভয় পেও না।” কিন্তু মাধুরী জানত, এটি সাধারণ প্রতিধ্বনি বা শব্দের অভ্যাস নয়। শব্দটি যেন স্বাভাবিকভাবে ঘুম ভাঙিয়ে তাদের মনকে আতঙ্কিত করছিল, এবং এই রহস্যময় অভিজ্ঞতা তাদের মনে একটি অদ্ভুত অস্থিরতার বীজ রোপণ করেছিল।
রাত্রি গভীর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই অনুভূতি আরও প্রবল হয়ে ওঠে। তারা দুজনেই লিভিং রুমে বসে একে অপরকে সহানুভূতি জানাচ্ছিল, কিন্তু চোখে চোখ রেখে তারা বুঝতে পারছিল যে একরকম অদ্ভুত চাপ ফ্ল্যাটের বাতাসে ভাসছে। অরিন্দম প্রতিটি ঘরে চেক করতে থাকল, লাইট অন-অফ করল, দরজা খোলা এবং বন্ধ করল, কিন্তু কোনো মানবিক উপস্থিতি খুঁজে পেল না। মাধুরী তার কাঁপতে থাকা হাত অরিন্দমের হাতে রাখল, এবং তারা দুজনেই এক অদ্ভুত নীরবতা অনুভব করল—যেখানে হাসির সেই হালকা প্রতিধ্বনি মাঝে মাঝে বাতাসে ভেসে উঠছিল। তারা বুঝতে পারল, ফ্ল্যাটের নিখুঁত নীরবতা এবং আধুনিক সরঞ্জামের মধ্যেও কিছু অদৃশ্য রহস্য তাদের চারপাশে ঘুরপাক খাচ্ছে। সেই রাতে, নতুন জীবনের প্রথম রাতটি আনন্দের পরিবর্তে একটি রহস্যময় অভিজ্ঞতা হয়ে রইল। মাধুরী এবং অরিন্দমের মনে গভীরভাবে গেঁথে গেল সেই হাসির সুর, যা তাদের নিখুঁত শান্তির মাঝে হঠাৎ করেই এক অজানা আতঙ্কের স্মৃতি হিসেবে প্রবেশ করল, এবং তারা জানত যে এই রাতের অভিজ্ঞতা তাদের জন্য কেবল শুরু, আর এই নতুন ফ্ল্যাটের প্রতিটি দিন এবং রাতের সঙ্গে আরও গভীর রহস্য উন্মোচিত হবে।
~
পরের দিন সূর্যের আলো ফ্ল্যাটের প্রতিটি কোণ উজ্জ্বল করে তুলল, এবং দিনের আলোয় ভুতুড়ে অনুভূতিগুলো কিছুটা মন থেকে দূরে সরে গেল। অরিন্দম মাধুরীকে বোঝানোর চেষ্টা করল যে রাতের অদ্ভুত আওয়াজটি কোনো অদ্ভুত ঘটনা নয়, বরং পাশের ফ্ল্যাট থেকে আসা শব্দের প্রতিধ্বনি হতে পারে। সে ধীরস্থির কণ্ঠে যুক্তি দেখালো, “আমরা নতুন পরিবেশে খুব সংবেদনশীল হয়ে পড়েছি। পাশের ফ্ল্যাটে কেউ রান্না করছিল বা বাচ্চা খেলছিল—শব্দটা হয়তো সেখান থেকে এসেছে।” মাধুরী প্রথমে কিছুটা আশ্বস্ত হলো, এবং অরিন্দমের যুক্তির দিকে আস্থা রাখল। দিনের আলো, শহরের দূরের কোলাহল, এবং তাদের নিজের ব্যস্ততা সব কিছু মিলিয়ে তারা মনে করল যে হয়তো রাতে যা হয়েছিল তা কেবল কল্পনা। মাধুরী নিজেকে বিশ্বাস দেওয়ার চেষ্টা করল যে এটি বাস্তব নয়, শুধু মানসিক চাপ বা নতুন পরিবেশের অস্থিরতার ফল। তারা দুজনেই দিনের সব কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল—জিনিসপত্র গোছানো, বাজার করা, নতুন ফ্ল্যাটের ছোটখাটো কাজ সম্পন্ন করা—যাতে রাতের ঘটনা মনে না পড়ে।
কিন্তু রাত আসে, এবং দিনের আলোয়ে ধরা পড়া শান্তি হঠাৎ করেই ভেঙে গেল। যখন তারা ঘুমানোর জন্য বিছানায় শুয়েছিল, তখন আবার সেই অদ্ভুত আওয়াজ শোনা গেল। এবার শুধুমাত্র হালকা হাসি নয়, সঙ্গে সঙ্গে যুক্ত হল থালা-বাসনের খটখট শব্দ। শব্দগুলো এতটা স্পষ্ট যে তারা দুজনেই চোখ মেলে বসে রাত্রির নিখুঁত নিঃশব্দতা ভাঙতে লাগল। রান্নাঘরের দিকে তাকিয়ে তারা ভেবে পেল, কেউ বা কিছু যেন সরাসরি তাদের সামনে খেলছে বা হাতড়াচ্ছে। মাধুরীর হৃৎপিণ্ড দ্রুতগতিতে ধকধক করতে লাগল, এবং অরিন্দমও অদ্ভুতভাবে হতবাক হয়ে গেল। সে চেষ্টা করল নিজেকে এবং মাধুরীকে শান্ত করার জন্য যুক্তি দেওয়ার—“দেখো, হয়তো ফ্ল্যাটের নল বা পাইপের কারণে শব্দ হচ্ছে, অথবা বাতাসের প্রভাবে কোনো বাসন মুখোমুখি ধাক্কা খাচ্ছে।” কিন্তু এবার যুক্তি কাজ করল না। শব্দগুলো এত স্পষ্ট এবং জীবন্ত মনে হচ্ছিল যে কোনো সাধারণ প্রতিধ্বনি বা ব্যাখ্যা সম্ভব নয়। হাসির সুর এতটাই প্রকৃত মনে হচ্ছিল যে মনে হচ্ছিল, কেউ বা কিছু রান্নাঘরের মাঝখানেই উপস্থিত, কিন্তু চোখে তা দেখা যাচ্ছিল না।
রাতের এই অভিজ্ঞতা তাদের মধ্যে অদ্ভুত এক দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করল। অরিন্দম মাধুরীকে বোঝানোর চেষ্টা চালাচ্ছিল যে সবকিছুই যৌক্তিকভাবে ব্যাখ্যা করা যায়, কিন্তু মাধুরীর অন্তর বলছিল অন্যথা। তারা দুজনেই একত্রে লিভিং রুমে বসে চুপচাপ বসেছিল, কখনও কখনও কানে ওই অদ্ভুত খটখট এবং হাসির আওয়াজ ভেসে আসছিল। মাধুরী হালকা কণ্ঠে বলল, “আমরা একা নই, অরিন্দম। আমি অনুভব করছি কেউ বা কিছু আমাদের চারপাশে ঘুরছে।” অরিন্দম শুরুতে অস্বীকার করল, আবার যুক্তি দেখাল, কিন্তু তার নিজের চোখে এবং কানেও অনুভূতি হল—কিছু অদৃশ্য এবং অজানা সত্যিই তাদের সঙ্গে আছে। রাতটি শেষ হওয়ার সাথে সাথে তারা বুঝতে পারল যে যুক্তি দিয়ে বিষয়টি অস্বীকার করা সম্ভব নয়; ফ্ল্যাটের এই নিখুঁত নীরবতায় কিছু অদ্ভুত, অজানা উপস্থিতি তাদেরকে ঘিরে রেখেছে। এই রাতের ঘটনা তাদের মনকে এক অদ্ভুত আতঙ্ক এবং রহস্যময় কৌতূহলের মাঝে আটকে দিল, এবং তারা জানল—এই নতুন জীবন, নতুন ফ্ল্যাট, আর নতুন রাতগুলো তাদের জন্য কেবল আনন্দ নয়, বরং এক দীর্ঘ, রহস্যময় যাত্রার সূচনা।
~
পরের দিন বিকেলে মাধুরী ফ্ল্যাটের পার্শ্ববর্তী করিডোরে একটু হেঁটে গিয়েছিল, এবং সুযোগ পেয়ে পাশের ফ্ল্যাটের এক বৃদ্ধার সঙ্গে আলাপ করতে লাগল। বৃদ্ধা, যিনি বহু বছর ধরে এই কমপ্লেক্সে থাকেন, তাকে প্রথমে সতর্কভাবে দেখলেন, যেন মাধুরীর আগ্রহ অপ্রত্যাশিত কিছু বিপদ ডেকে আনতে পারে। মাধুরী বিনয়ী কণ্ঠে বলল যে সে শুধু জানতে চাচ্ছে, এই ফ্ল্যাটের ইতিহাস বা অদ্ভুত কিছু ঘটনা কি সত্যিই ঘটে। বৃদ্ধা প্রথমে কিছু বলতে অনিচ্ছুক ছিলেন, কিন্তু মাধুরীর চাহনিতে এক ধরনের আন্তরিকতা দেখেই তিনি চাপা স্বরে ফিসফিস করে বললেন, “রাতে রান্নাঘরের দিকে যেও না। এই ফ্ল্যাটে আগে এক দম্পতি থাকত। তাদের ছোট মেয়েটি রান্নাঘরেই একদিন মারা যায়—জলে দমবন্ধ হয়ে।” বৃদ্ধার চোখে গভীর দুঃখ আর ভয় দুটোই মিলিত হয়ে একটি অদ্ভুত ছাপ ফেলছিল। মাধুরীর হৃদয় দ্রুত স্পন্দিত হতে লাগল। সে বিশ্বাস করতে পারছিল না, তবে বৃদ্ধার কথায় এমন গভীর বাস্তবতার ছাপ ছিল যে তা কেবল গল্পের মতো মনে হচ্ছিল না।
বৃদ্ধা আরও বললেন, “তাদের মৃত্যু থেকে শুরু করে মাঝে মাঝে সেই ছোট মেয়েটির হেসে ওঠার মতো আওয়াজ শোনা যায়। কখনও কেউ রান্নাঘরের দিকে তাকানোর চেষ্টা করলে হালকা হাসি, থালা-বাসনের খটখট—সবই স্পষ্ট মনে হয়। কেউ আগে এ কথা বিশ্বাস করত না, কিন্তু যারা একবার শোনেছে, তারা জানে, এটি কল্পনা নয়।” মাধুরী তখন কেবল শোনার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকল। তার মন অদ্ভুতভাবে উত্তেজিত এবং ভয় পেয়ে গেল। তাকে যেন এক অদৃশ্য হাত স্পর্শ করল, ফ্ল্যাটের প্রতিটি কোণ তাকে এখন আরও অচেনা এবং রহস্যময় মনে হচ্ছিল। বৃদ্ধার চোখে সে এমন কিছু দেখল যা কেবল গল্পে হয়—একটি দীর্ঘস্থায়ী, অদৃশ্য দুঃখের ছাপ, যা সময়ের সাথে এখানে জমে আছে। মাধুরীর হৃদয় মিশ্র অনুভূতিতে ভরে গেল—ভয়, কৌতূহল, আর সহানুভূতির এক অদ্ভুত মিশ্রণ।
মাধুরী যখন ফিরে আসল, সে অরিন্দমকে সব বিস্তারিত জানাল। অরিন্দম প্রথমে অস্বীকার করল, চেষ্টা করল যুক্তি দেখানোর—“এটি কেবল একটি পুরনো গল্প, অতীতের মিথ। আমরা এখন এখানে থাকি, বাস্তবতা আমাদের নিয়ন্ত্রণে।” কিন্তু মাধুরীর চোখে দৃঢ় চেতনাটি তাকে বুঝিয়ে দিল, এটা কেবল গল্প নয়। রাতের আগের খটখট এবং হাসির আওয়াজ, যা তারা দুজনেই শোনেছিল, হঠাৎই একটি ভয়ঙ্কর বাস্তবতায় রূপান্তরিত হলো। তারা বুঝতে পারল যে, এই ফ্ল্যাটে অতীতের কোনো অন্ধকার স্মৃতি এখনও বেঁচে আছে, এবং তাদের নতুন জীবন শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই স্মৃতিগুলোও কখনো কখনো নতুনভাবে প্রকাশ পায়। মাধুরী ও অরিন্দমের মধ্যে ভীতিকর কৌতূহল জন্মালো—নতুন ফ্ল্যাটের প্রতিটি রাত্রি এখন শুধু শান্তির নয়, বরং এক অদৃশ্য, রহস্যময় উপস্থিতির সাক্ষী হয়ে ওঠার সম্ভাবনা বহন করল। এই সতর্কবার্তা তাদের মনে এক গভীর প্রভাব ফেলল, এবং তারা বুঝতে পারল যে এই নতুন জীবন শুধুমাত্র আনন্দ নয়, বরং এক দীর্ঘ রহস্যময় যাত্রার প্রারম্ভ।
~
ফ্ল্যাটে তাদের পঞ্চম রাত অরিন্দম ও মাধুরীর জন্য এক অদ্ভুত মিশ্র অনুভূতির রাত হয়ে উঠল। দিনের আলো এবং ব্যস্ততার মধ্যেও অরিন্দম এখনও বিষয়টিকে যৌক্তিকভাবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করছিল। সে নিজেকে এবং মাধুরীকেই বারবার বোঝাত যে, আগের রাতের ঘটনা কেবল কল্পনা বা বাহ্যিক শব্দের প্রতিধ্বনি—কিছুই বাস্তব নয়। কিন্তু মাধুরী নিজের অন্তরের ভয় উপেক্ষা করতে পারছিল না। তার হৃদয় প্রতিটি শব্দে দ্রুত স্পন্দিত হচ্ছিল, এবং রাতের নিখুঁত নীরবতায় সেই অদ্ভুত আতঙ্ক যেন আরও প্রকট হয়ে উঠছিল। দিনের আলোয় ফ্ল্যাটটি শান্ত, আরামদায়ক, এবং নিখুঁত মনে হলেও রাতের অন্ধকারে এটি এক অচেনা, রহস্যময় জায়গায় পরিণত হচ্ছিল। মাধুরীর চোখে অজানা, অদৃশ্য ছায়ার প্রতিফলন, তার চুলে হালকা ঠাণ্ডা হাওয়া, সবকিছু মিলেমিশে একটি ভীতিকর আবহ সৃষ্টি করছিল।
যখন রাত গভীর হল, হাসির সেই অদ্ভুত আওয়াজ আবারও শোনা গেল। এবার কেবল হালকা হাসি নয়, বরং সেখানে ফিসফিস করা শব্দও শোনা গেল—“মা, খেলবি?” শব্দটি এতটাই স্পষ্ট ছিল যে মাধুরীকে হঠাৎই মনে হলো, কেউ বা কিছু রান্নাঘরের মধ্যে তার সঙ্গে সরাসরি কথা বলছে। সে ভয়কে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিল না। অরিন্দম প্রথমে হাসি বা বাতাসের খেলা বলে বিষয়টি উপেক্ষা করার চেষ্টা করল, কিন্তু মাধুরী হাত ধরে জানালার দিকে ইঙ্গিত করল। রান্নাঘরের আলো হঠাৎ নিজে থেকেই জ্বলে উঠল, তারপর নিভে গেল। এই অদ্ভুত ঘটনা তাদের দুজনকেই হতবাক করে দিল। অরিন্দমও বুঝতে পারল যে এটি সহজে ব্যাখ্যা করার মতো নয়—কিছু অদৃশ্য শক্তি ফ্ল্যাটের ভেতরে তাদের চারপাশে ঘুরপাক খাচ্ছে, এবং এই শক্তি রাতের নিখুঁত নীরবতাকে এক অদ্ভুত আতঙ্কের আবহে পরিণত করছে।
মাধুরীর ভয়ের ছায়া শুধু রান্নাঘরের দিকে সীমাবদ্ধ ছিল না। তার মনে ধীরে ধীরে গড়ে উঠল এক গভীর অস্থিরতা, যা তার চোখের আলো এবং কণ্ঠের স্থিরতাকেও প্রভাবিত করছিল। সে শিউরে উঠছিল, প্রতিটি কণায় ভয়ে কাঁপছিল, এবং অরিন্দমের উপস্থিতি তাকে সামান্য হলেও শান্তি দিচ্ছিল। কিন্তু হাসির আওয়াজ, ফিসফিস শব্দ, এবং হঠাৎ আলো জ্বলে নেভে যাওয়ার ঘটনা তার মস্তিষ্কে গভীরভাবে দাগ কেটে দিল। এটি কেবল অস্থিরতা নয়, বরং এক অদৃশ্য, অতিপ্রাকৃত উপস্থিতির প্রমাণ, যা তাদের প্রতিটি রাতের শান্তি ছিনিয়ে নিতে পারে। অরিন্দম ও মাধুরী একে অপরের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারল, এই ফ্ল্যাটে তাদের নতুন জীবন শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একটি রহস্যময় ভয়ের ছায়া তাদের সঙ্গে থাকছে। তারা জানল, প্রতিটি রাত শুধু নিখুঁত শান্তির নয়, বরং একটি অজানা, ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার সাক্ষী হয়ে ওঠবে, এবং তাদের মনকে প্রস্তুত করতে হবে এই অদৃশ্য, অপ্রত্যাশিত উপস্থিতির মুখোমুখি হওয়ার জন্য।
~
পরের দিন অরিন্দম আর মাধুরী ঠিক করল যে তারা আর অজানা, ভয়ের অনুভূতিকে উপেক্ষা করতে পারবে না। অরিন্দম নিজের যুক্তি বা কল্পনার সীমা ছাড়িয়ে গিয়ে সত্যটা খুঁজে বের করার সিদ্ধান্ত নিল। সে ফ্ল্যাটের পুরনো কেয়ারটেকারের খোঁজ শুরু করল, যিনি দীর্ঘদিন ধরে এই কমপ্লেক্সের দায়িত্বে ছিলেন। কিছু মেসেজ এবং ফোন কলের পর অরিন্দম কেয়ারটেকারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করল। বৃদ্ধ, শীতল বাতাসের মতো ধীর কণ্ঠে, কিন্তু অভিজ্ঞ চোখে তাকে স্বাগত জানালেন। অরিন্দম সরাসরি প্রশ্ন করল, “এই ফ্ল্যাটে আগের ভাড়াটিয়াদের বিষয়ে কিছু জানেন কি? বিশেষ করে রাতের অদ্ভুত ঘটনা বা দুর্ঘটনা—যেমন ফ্ল্যাটে হাসির আওয়াজ বা খটখট শব্দ।” কেয়ারটেকারের চোখে অদ্ভুত গভীর দুঃখ ফুটে উঠল। সে বললেন, “হ্যাঁ, কিছু বছর আগে এখানে এক দম্পতি থাকত। তাদের ছোট মেয়েটি এক দুর্ঘটনায় রান্নাঘরে মারা যায়। জল ভরা পাত্রে সে দমবন্ধ হয়ে মারা গিয়েছিল। তার পর থেকে এই ফ্ল্যাটে নতুন ভাড়াটিয়া বেশিদিন থাকে না। কেউ থাকলেও রাতের নিখুঁত নীরবতায় হঠাৎ হাসির আওয়াজ এবং অদ্ভুত শব্দের কথা শোনে।” অরিন্দম প্রথমে বিশ্বাস করতে চাইছিল না, তবে বৃদ্ধের চোখের গভীরতা এবং অভিজ্ঞতার ছাপ তাকে বোঝালো যে ঘটনা সত্যিই ভয়ঙ্কর এবং বাস্তব।
বৃদ্ধ আরও বললেন, “এই ফ্ল্যাটের রান্নাঘরে যে শিশুর মৃত্যু হয়েছিল, তার স্মৃতি এখনো এখানে বেঁচে আছে। অনেক নতুন ভাড়াটিয়া এই ফ্ল্যাটে এসে প্রথম রাতেই কিছু অদ্ভুত অনুভব করে। কেউ ফিসফিস করা শব্দ শোনে, কেউ হালকা হাসির প্রতিধ্বনি। কেউ কেউ রান্নাঘরের দিকে তাকিয়ে ভাবতে শুরু করে যেন কেউ আছে। অনেকেই অতীতের এই ঘটনাকে কল্পনা বা মানসিক চাপ বলে উপেক্ষা করে, কিন্তু যারা একবার শোনে বা অনুভব করে, তারা আর সাধারণ জীবনযাপন করতে পারে না।” অরিন্দম এবং মাধুরী চুপচাপ শুনছিল। অরিন্দম বুঝতে পারল যে তার পূর্বের যুক্তি—শব্দটা পাশের ফ্ল্যাট থেকে এসেছে বা বাতাসের খেলা—সত্যি নয়। এটি কেবল একটি নিখুঁত অজানা বাস্তবতা, যা অতীতের একটি শোকময় স্মৃতিকে ফুটিয়ে তোলে। মাধুরী, যিনি ইতিমধ্যেই রাতের ভয়ের ছায়া অনুভব করছিল, তার ভয় আরও গভীর হল, এবং অরিন্দমকে দেখতে পেয়ে বোঝার চেষ্টা করল যে সত্যটি কেবল গল্প নয়, বরং এক বাস্তব অভিজ্ঞতা যা তাদের চারপাশে অদৃশ্যভাবে ঘুরপাক খাচ্ছে।
ফ্ল্যাটের অতীত অনুসন্ধান তাদের মানসিকভাবে একটি নতুন পর্যায়ে নিয়ে গেল। অরিন্দম বুঝতে পারল যে শুধুমাত্র যুক্তি বা যুক্তির ব্যাখ্যা দিয়ে তারা বিষয়টি মোকাবিলা করতে পারবে না। তারা এখন এমন একটি অবস্থায় পৌঁছেছে যেখানে অতীতের দুর্ঘটনা তাদের বর্তমান জীবনের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত হয়ে দাঁড়িয়েছে। মাধুরীকে বোঝানোও কঠিন, কারণ তার মনে ভয়ের ছায়া এতটাই প্রবল যে প্রতিটি রাতে রান্নাঘরের দিকে তাকানো বা আলো জ্বলে নেভে যাওয়ার অভিজ্ঞতা তাকে অদৃশ্য আতঙ্কে ভাসিয়ে দিচ্ছে। তারা দুজনেই বুঝতে পারল যে এই ফ্ল্যাটের রহস্য শুধু অদ্ভুত আওয়াজ নয়; এটি অতীতের একটি দুঃখময় ঘটনার ধারাবাহিক প্রকাশ, যা নতুন ভাড়াটিয়াদের মন এবং জীবনে প্রভাব ফেলছে। অরিন্দম এবং মাধুরী একে অপরের দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে উপলব্ধি করল যে, তারা এক অদ্ভুত, রহস্যময় যাত্রার মধ্যে প্রবেশ করেছে—যেখানে অতীত এবং বর্তমানের সংঘর্ষ তাদের প্রতিটি রাতকে ভীতিকর, অজানা এবং রহস্যময় করে তুলেছে।
~
রাত গভীর, ফ্ল্যাটের নিখুঁত নীরবতা যেন একটি অদ্ভুত চাপের আবহ তৈরি করছে। অরিন্দম দীর্ঘক্ষণ ভেতরে ভয়ের সঙ্গে লড়াই করেছে, কিন্তু এবার সে ঠিক করল—ভয়কে সরাসরি মোকাবিলা করতে হবে। মাধুরী যখন ঘুমোতে গিয়েছিল, অরিন্দম নিঃশব্দে উঠে রান্নাঘরের দিকে এগোল। পায়ে চুপচাপ চলা, হাতের স্পর্শে ফ্ল্যাটের কণিকায় কণিকায় ভয়ের নরম প্রতিধ্বনি—সব মিলেমিশে একটি অদ্ভুত, অচেনা অভিজ্ঞতা তৈরি করছিল। রান্নাঘরের দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে আধো আলোয়ে ভেতরের দৃশ্য যেন তার হৃদয়কে হিম করে দিল। আড়াল ও ছায়ার মধ্যে সে দেখতে পেল ছোট্ট এক মেয়ের ছায়ামূর্তি দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটির হাতে ভাঙা খেলনা, চোখে অদ্ভুত গভীরতা, এবং ঠোঁটে এক রহস্যময় হাসি, যা আনন্দের নয় বরং অজানা যন্ত্রণার ছাপ ফেলছে। অরিন্দম মুহূর্তের জন্য স্থির হয়ে গেল—ভয়, করুণা এবং বিস্ময়ের এক অদ্ভুত মিশ্রণে তার দৃষ্টি কেবল মেয়েটির দিকে আটকে থাকল।
মেয়েটির উপস্থিতি এবং অদ্ভুত হাসি অরিন্দমের হৃদয়কে চিরে দিল। সে বুঝতে পারল, এই ফ্ল্যাটের অতীত সত্যিই এখানে বেঁচে আছে, এবং তার সঙ্গে এখন সরাসরি মুখোমুখি হয়েছে। মেয়েটির চোখে এমন এক নির্দিষ্ট দুঃখের ছাপ ছিল যা অজানা অথচ স্পষ্ট, যেন সে তার কথা বলার চেষ্টা করছে কিন্তু শব্দ বের করতে পারছে না। অরিন্দমের মন কেঁপে উঠল, তার হৃদয় ভয়ে এবং করুণায় পিপাসিত। তার শ্বাস দ্রুত হয়ে যায়, এবং হাত যেন নিজেই কাঁপতে শুরু করে। সে কল্পনা করতে পারছিল যে ছোট্ট মেয়েটি যে নিঃশ্বাস, যে হাসি, তা কেবল অতীতের স্মৃতি নয়, বরং একটি অদ্ভুত বাস্তব উপস্থিতি, যা ফ্ল্যাটের প্রতিটি কোণায় বেঁচে আছে। সে মুহূর্তে নিজেকে দায়ী বোধ করল—যদি আগে তারা এই ফ্ল্যাটে আরও সতর্ক থাকত, হয়তো মেয়েটির আত্মা শান্তি পেত।
ঠিক তখন মাধুরী পিছন থেকে চিৎকার করল। তার ভয়, আতঙ্ক এবং অচেনা অনুভূতির প্রকাশ অরিন্দমকে বাস্তব জাগ্রত করল। সে হঠাৎ রক্তে রীতিমতো শীতলতা অনুভব করল যখন মাধুরী তার হাত ধরে টেনে আনে। মেয়েটির ছায়ামূর্তি অদ্ভুতভাবে অদৃশ্য হয়ে গেল, কিন্তু রান্নাঘরের বাতাস এখনও ভয়ে ভারাক্রান্ত। মাধুরী অরিন্দমকে চেপে ধরল, দুজনেই একসাথে লিভিং রুমে ফিরে এল। তারা দুজনেই গভীরভাবে শ্বাস নিল, ভয়ের সেই মুহূর্ত এবং করুণার স্মৃতি এখনো চোখে চোখে আটকে আছে। রাতের এই সরাসরি মুখোমুখি হওয়া তাদের ভয়ের অনুভূতিকে এক নতুন মাত্রা দিয়েছিল—এখন তারা জানে, ফ্ল্যাটের অতীতের ছায়া শুধুমাত্র গল্প নয়, বরং একটি বাস্তব, অদৃশ্য উপস্থিতি, যা তাদের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত। এই ঘটনা তাদের মনে এক গভীর সতর্কবার্তা এবং অজানা রহস্যের ছাপ ফেলল, যা তাদের প্রতিটি রাত এবং প্রতিটি মুহূর্তকে ভীতিকর, রহস্যময়, এবং অপ্রত্যাশিত করে তুলল।
~
ফ্ল্যাটে তাদের ভয়ের অভিজ্ঞতা ক্রমেই এক অদ্ভুত সীমায় পৌঁছেছিল। অরিন্দম এবং মাধুরী শেষপর্যন্ত ঠিক করল যে নিজেদের যুক্তি বা সাহস দিয়ে তারা আর বিষয়টি মোকাবিলা করতে পারবে না। তারা স্থানীয় এক অভিজ্ঞ পুরোহিতের খোঁজ নিল, যিনি অতিপ্রাকৃত শক্তি ও আত্মার শান্তি নিয়ে বিশেষজ্ঞ হিসেবে পরিচিত। পুরোহিত এসে ফ্ল্যাটের প্রতিটি কক্ষ পরীক্ষা করলেন, বেদী স্থাপন করলেন, এবং বিশেষ তন্ত্র-কর্মের মাধ্যমে মৃত শিশুর আত্মাকে শান্ত করার জন্য পূজা শুরু করলেন। তাদের উপস্থিতি এবং ধর্মীয় ক্রিয়াকলাপের মধ্য দিয়ে ফ্ল্যাটের বাতাসে এক অদ্ভুত শীতলতা এবং স্থিরতা নেমে এল। পূজার দিনগুলোতে অরিন্দম এবং মাধুরী মনে করলেন যেন তারা নিরাপদ, আর রান্নাঘরের হাসি বা খটখটের কোনো শব্দ শোনা যায় না। এই দিনগুলোতে ফ্ল্যাটে যেন শান্তি নেমে এসেছে—এক ধরণের ভ্রমণ, যেখানে অতীতের স্মৃতি কেবল স্মৃতি রয়ে গেছে, বাস্তব উপস্থিতি নয়।
কিছুদিন শান্তি বিরাজ করল। তারা ভাবল সবকিছু শেষ, এবং শিশুর আত্মা নিশ্চয়ই শান্তি পেয়ে গেছে। দিনের আলোয় ফ্ল্যাটের প্রতিটি কক্ষ সুন্দর, আরামদায়ক এবং নিরাপদ মনে হচ্ছিল। মাধুরী নিজের ভয়ের অনুভূতিকে শান্ত করার চেষ্টা করছিল, এবং অরিন্দমও মনে করছিল যে যুক্তি এবং বাস্তবতার জগতে সবকিছু নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু গভীর রাতে, নিখুঁত নীরবতার মধ্যে, হঠাৎই একটি অদ্ভুত চঞ্চলতা ভেসে আসে। রান্নাঘর বা জানালার দিকে তাকালেই দেখা যায়, আড়াল ও ছায়ার মধ্যে হালকা, মৃদু টুকটুক হাসির প্রতিধ্বনি। শব্দটি এতটাই প্রকৃত মনে হচ্ছিল যে মনে হচ্ছিল, শিশুর আত্মা এখনও ফ্ল্যাটে উপস্থিত—নিশ্চয়ই মুক্তি পায়নি। এই প্রতিধ্বনি শুধুমাত্র ভয়ঙ্কর নয়, বরং একটি অদ্ভুত বার্তা বহন করছে—যে শিশুটি তাদের সঙ্গে খেলতে চায়, কিন্তু পূর্ণশান্তি এখনো অধরা।
শেষ রাতের এই ঘটনার পর অরিন্দম এবং মাধুরী বোঝতে পারল যে ফ্ল্যাটের ইতিহাস কেবল অতীতের স্মৃতি নয়; এটি একটি অব্যক্ত অভিশাপ, যা নতুন ভাড়াটিয়াদের সঙ্গে এখনও যুক্ত। তারা জানে, ধর্মীয় ক্রিয়া বা পূজা আত্মাকে শান্ত করতে সাহায্য করতে পারে, কিন্তু এখানে কিছু শক্তি রয়েছে যা নিখুঁতভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। ফ্ল্যাটের জানালা দিয়ে ভেসে আসা হালকা হাসি যেন স্পষ্টভাবে বলে—“আমি আছি।” এই এক শব্দ বা প্রতিধ্বনি তাদের মনে গভীরভাবে প্রবেশ করল, যা কেবল ভয় নয়, বরং অজানা রহস্য ও অনিশ্চয়তার একটি চিরন্তন স্মৃতি হিসেবে রয়ে গেল। তারা বুঝল, এই ফ্ল্যাটে নতুন জীবন শুরু করলেও, অতীতের ছায়া এবং শিশুর অমর উপস্থিতি সবসময় তাদের সঙ্গে থাকবে, এবং প্রতিটি রাত, প্রতিটি নিঃশ্বাস, ফ্ল্যাটের অদৃশ্য উপস্থিতি তাদের সাথে খেলবে—শুধু আনন্দ নয়, বরং এক গভীর রহস্য ও ভয়ের ছায়ার মধ্য দিয়ে।
____