Bangla - রহস্য গল্প

নিখোঁজ পাণ্ডুলিপি

Spread the love

এক

অমল মুখোপাধ্যায় ছিলেন বাংলা সাহিত্যের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র, যাঁর কলমে সমাজ, মানুষ, প্রেম আর রহস্য নতুন মাত্রা পেত। দীর্ঘদিনের সাহিত্যচর্চার শেষে তিনি এক বিশাল উপন্যাসের কাজে মন দিয়েছিলেন, যার নাম এখনও প্রকাশিত হয়নি, কিন্তু সাহিত্য মহলে গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল যে এ হবে তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। অমলের বয়স বাড়ছিল, স্বাস্থ্যও তেমন ভাল ছিল না, তবু তিনি নিয়ম করে প্রতিদিন লিখতেন। তাঁর ছোট্ট পড়ার ঘরে পুরনো কাঠের টেবিলের উপর রাখা থাকত ডায়েরি, খাতা, এবং টাইপরাইটার—যেখানে শব্দগুলো যেন জীবন্ত হয়ে উঠত। আশেপাশের প্রতিবেশীরা জানতেন, রাত গভীর হলে তাঁর ঘরে আলো জ্বলত, আর কলমের খসখস শব্দ শোনা যেত। কিন্তু একদিন ভোরে, যখন গৃহকর্মী ঘরে ঢোকে, দেখে টেবিল একেবারে ফাঁকা। নেই সেই ডায়েরি, নেই শেষ খসড়া পাণ্ডুলিপি, শুধু ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কিছু সাদা কাগজ আর কলমের কালির দাগ। অমলবাবু তখনও জীবিত, কিন্তু ভীষণ অসুস্থ, আর ফিসফিস করে শুধু একটি কথাই বলছিলেন—“শেষটা যেন কেউ না জানে…”। এই অদ্ভুত পরিস্থিতি মুহূর্তের মধ্যে পরিবারকে স্তব্ধ করে দেয়, আর খবর পৌঁছে যায় বাইরের দুনিয়ায়।

অমলের লেখা নিয়ে পাঠকদের আগ্রহ ছিল আকাশচুম্বী। প্রতিটি নতুন উপন্যাস প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বইয়ের দোকানে লম্বা লাইন পড়ত, আর সাহিত্য-সমালোচকরা তাঁর লেখা বিশ্লেষণে ব্যস্ত হয়ে যেতেন। তাই যখন শোনা গেল যে তাঁর অসমাপ্ত উপন্যাসের খসড়া হঠাৎ উধাও হয়ে গেছে, তখন গোটা সাহিত্য জগৎ যেন অস্থির হয়ে উঠল। সংবাদপত্রে প্রথম পাতায় খবর ছাপা হল—“অমল মুখোপাধ্যায়ের শেষ উপন্যাস হারাল!”। সাহিত্যপত্রিকা থেকে শুরু করে টেলিভিশনের টক শো—সব জায়গায় আলোচনা শুরু হল, কে নিতে পারে এমন ঝুঁকি? প্রকাশকরা হতাশ, কারণ সেই উপন্যাসের জন্য তাঁরা মোটা অগ্রিম দিয়ে রেখেছিলেন। পাঠকরা ক্ষুব্ধ, কারণ তাঁদের আশা ভেঙে গেল। কিন্তু আলোচনার মাঝেই একটা নতুন প্রশ্ন জেগে উঠল—এটা কি সত্যিই হারিয়ে গেছে, নাকি ইচ্ছে করে গোপন করা হয়েছে? কারণ অনেকেই মনে করতেন, অমলবাবুর লেখার শেষ অধ্যায় হয়তো এমন সত্য উন্মোচন করত যা কারও কারও অস্বস্তির কারণ হতে পারত।

এদিকে, অমলের ব্যক্তিগত জীবনের রহস্যও সামনে আসতে শুরু করল। তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু, সহলেখক এবং পরিবারের সদস্যরা দাবি করলেন যে শেষ কিছু দিন তিনি ভীষণ অস্থির হয়ে উঠেছিলেন। কখনও তিনি বলতেন, কেউ তাঁর কাজ চুরি করতে চাইছে, আবার কখনও বলতেন, “শেষ অধ্যায়” লেখা হলে এক অদ্ভুত বিপদ নেমে আসবে। তাঁর স্ত্রীর মতে, অমল অনেক রাতে ঘুম ভেঙে কাগজ ছিঁড়তেন, আবার নতুন করে লিখতেন, যেন নিজের লেখা নিয়েই সন্দিহান ছিলেন। তাঁর ছেলেমেয়েরা মনে করত, তিনি বৃদ্ধ বয়সে বিভ্রমে ভুগছেন। কিন্তু সাহিত্যপ্রেমীরা বিশ্বাস করত, অমলবাবুর প্রতিটি শব্দই ইঙ্গিতবহ, তাঁর প্রতিটি খসড়া মূল্যবান। তাই যখন জানা গেল তাঁর ডায়েরিও হারিয়েছে, তখন অনেকেই ভাবল—সেখানে হয়তো গোপন সূত্র ছিল, যা উপন্যাসের ভবিষ্যৎ পাঠকে নাড়া দিতে পারত। ফলে, হারানো পাণ্ডুলিপি নিয়ে শুধু কৌতূহল নয়, এক ধরণের আতঙ্কও ছড়িয়ে পড়ল।

এইভাবে প্রথম অধ্যায় শেষ হয় এক তীব্র প্রশ্নবোধক অবস্থায়। পাঠকের মনে জন্ম নেয় নানা সংশয়—কে চুরি করল সেই খসড়া? পরিবার, প্রকাশক, না কি কোনো সাহিত্যপ্রেমী ভক্ত? নাকি অমল নিজেই সেটি কোথাও লুকিয়ে রেখেছিলেন, এক অদ্ভুত সংকেত দিয়ে? উপন্যাসের ভিতরকার সত্য কি এতটাই বিপজ্জনক ছিল যে লেখক নিজেই সেটিকে আড়াল করতে চেয়েছিলেন? এই সব রহস্যের মাঝেই সাহিত্য জগৎ প্রবল আলোড়নে ভেসে যায়, এবং পাঠকরা অপেক্ষা করতে থাকে—অমলের শেষ উপন্যাস কি কখনো আলোর মুখ দেখবে, নাকি চিরদিনের মতো হারিয়ে যাবে? এই হারানোর গল্পই শুধু নয়, এর সাথে জড়িয়ে আছে মানুষের অশেষ কৌতূহল, প্রকাশকের লোভ, এবং একজন শিল্পীর আত্মার গোপন দ্বন্দ্ব। “হারানো কপি” শুধু একটি পাণ্ডুলিপির গল্প নয়, বরং সেই অদৃশ্য উত্তেজনা, যা অমল মুখোপাধ্যায়ের অসমাপ্ত শব্দগুলোকে ঘিরে রহস্যের অন্ধকারে টেনে নেয়।

দুই

অমল মুখোপাধ্যায়ের হারানো খসড়া নিয়ে সাহিত্য জগৎ যখন তোলপাড়, তখনই হঠাৎ এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটে। এক ভোরবেলা, সামাজিক মাধ্যমের একটি জনপ্রিয় সাহিত্যভিত্তিক গ্রুপে এক রহস্যজনক পোস্ট দেখা যায়। পোস্টটির শিরোনাম—“শেষ অধ্যায়”। ভেতরে আছে পুরো একটি অধ্যায়, শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সুচারুভাবে লেখা, ঠিক যেন কোনো অভিজ্ঞ সাহিত্যিকের হাতের কাজ। কিন্তু সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হল—অধ্যায়টির ভাষা, বাক্যের ভঙ্গি, এমনকি চরিত্রদের সংলাপও অমল মুখোপাধ্যায়ের লেখার ধাঁচের সঙ্গে বিস্ময়করভাবে মিলে যায়। পড়তে শুরু করলেই মনে হয়, এ তো তাঁরই কলমের সৃষ্টি। পাঠকরা স্তম্ভিত হয়ে গেল, কারণ সবাই জানত অমলবাবু মৃত্যুর আগে উপন্যাসটি অসমাপ্ত রেখেছিলেন। তাহলে কীভাবে হঠাৎ করে তাঁর নামহীন, অজানা এই সমাপ্তি প্রকাশ পেল? অনেকেই প্রথমে ভেবেছিল, হয়তো এটা কোনো ভক্তের কল্পনা বা মজা করার চেষ্টা। কিন্তু যত বেশি মানুষ পড়তে লাগল, ততই স্পষ্ট হল—এ লেখাটি নিছক নকল নয়। কোথাও যেন তাঁর গভীর চিন্তার প্রতিধ্বনি মিশে আছে।

এই প্রকাশনার সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক মাধ্যমে তোলপাড় শুরু হল। হাজার হাজার মানুষ অধ্যায়টি শেয়ার করতে লাগল, অনেকে নিজেদের ব্লগে ও পেজে বিশ্লেষণ লিখতে লাগল। কেউ বলল, এ নিঃসন্দেহে অমলবাবুর গোপনে লেখা আসল সমাপ্তি, যা হয়তো কেউ তাঁর ব্যক্তিগত নথি থেকে চুরি করেছে। আবার কেউ বলল, অমলবাবু শেষ মুহূর্তে কাউকে ডেকে পড়িয়ে দিয়েছিলেন, আর সেই মানুষটি এখন তা প্রকাশ করেছে। কিন্তু অন্য একদল বিশ্বাস করল, এর পেছনে রয়েছে কোনো ভিন্ন চক্রান্ত। তাদের মতে, কোনো প্রতিভাবান সাহিত্যিক তাঁর স্টাইল হুবহু নকল করে একটি ভুয়া অধ্যায় রচনা করেছে, উদ্দেশ্য কেবল আলোড়ন সৃষ্টি করা। এই মতের পেছনে যুক্তি ছিল—অমল কখনো প্রকাশ্যে বলেননি যে তিনি সমাপ্তি লিখে শেষ করেছেন, বরং বরাবরই দাবি করেছিলেন শেষ অংশ অনুলিখন করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। তাহলে হঠাৎ এই পরিপূর্ণ অধ্যায় কোথা থেকে এলো? প্রশ্ন যত বাড়তে লাগল, ততই পাঠকদের মনে বিভ্রান্তি জন্ম নিল।

অধ্যায়টির বিষয়বস্তু নিয়েও বিতর্ক দানা বাঁধল। এতে গল্পের চরিত্ররা অদ্ভুত এক সমাপ্তির দিকে এগিয়ে যায়, যা একদিকে দার্শনিক, অন্যদিকে রোমহর্ষক। পাঠকেরা অবাক হয়ে দেখল, এর ভেতরে এমন কিছু প্রতীকী ইঙ্গিত আছে, যা অমল মুখোপাধ্যায়ের আগের লেখার সঙ্গে অদ্ভুতভাবে সাযুজ্যপূর্ণ। যেমন তাঁর পূর্ববর্তী এক উপন্যাসে উল্লিখিত একটি অসমাপ্ত কবিতার লাইন হুবহু উঠে এসেছে এই অধ্যায়ে, আরেক জায়গায় এসেছে তাঁর জীবনের এক ব্যক্তিগত ঘটনার প্রতিফলন। এই সূক্ষ্ম দাগগুলো দেখে অনেকেই দৃঢ়ভাবে বলল, এটা অমলেরই লেখা। কিন্তু সমালোচকদের একাংশ বলল, এসব কেবল ইচ্ছাকৃত ছদ্মাবরণ, যাতে পাঠক বিভ্রান্ত হয়। তাদের বক্তব্য—লেখকের স্বতন্ত্র হাতের ছাপকে অনুকরণ করা সম্ভব, বিশেষত যদি কেউ তাঁর সমস্ত কাজ গভীরভাবে অধ্যয়ন করে থাকে। তাই তারা মনে করল, এখানে কেউ হয়তো ইচ্ছাকৃতভাবে রহস্য তৈরি করছে। এই বিতর্ক এতটাই বেড়ে গেল যে সংবাদমাধ্যমে নিয়মিত অনুষ্ঠান হতে লাগল, যেখানে সাহিত্য সমালোচক, প্রকাশক, এমনকি আইনজীবীরাও আলোচনায় অংশ নিলেন—এটা আসল না নকল।

এভাবেই দ্বিতীয় অধ্যায়ের শেষে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে ওঠে। একটি হারানো সমাপ্তি, যা কেউ কখনো দেখেনি, হঠাৎ করেই সবার সামনে এসে হাজির হল। পাঠকরা বিভ্রান্ত—তারা বিশ্বাস করবে নাকি সন্দেহ করবে? পরিবার স্তম্ভিত, কারণ তারা শপথ করে বলল অমলবাবু শেষ লেখেননি। প্রকাশকেরা লোভে পড়ল, কারণ যদি এটি আসল হয়, তবে বই আকারে ছাপিয়ে বিশাল মুনাফা করা যাবে। কিন্তু এর মধ্যেই ভেসে বেড়াতে লাগল এক শীতল প্রশ্ন—এই অধ্যায়টির লেখক কে? যদি সত্যিই এটি অমলের লেখা হয়, তবে কোথায় ছিল এতদিন? আর যদি এটি অন্য কারো সৃষ্টি হয়, তবে সেই মানুষটির উদ্দেশ্য কী? রহস্যের জাল আরও ঘনীভূত হতে থাকে, আর পাঠকের মনে জন্ম নেয় এক অদ্ভুত আশঙ্কা—এই অদৃশ্য সমাপ্তির আড়ালে হয়তো লুকিয়ে আছে এমন এক সত্য, যা শুধু উপন্যাসকেই নয়, বাস্তবকেও কাঁপিয়ে দিতে পারে।

তিন

রহস্যজনক “শেষ অধ্যায়” প্রকাশিত হওয়ার পর গোটা সাহিত্য সমাজ যেন দুলে উঠেছে আলোড়নে। প্রকাশকের দপ্তরে সাংবাদিকদের ভিড় লেগে থাকে প্রতিদিন, ফোন বাজতে থাকে অবিরাম, আর প্রত্যেকেরই একটাই প্রশ্ন—“শেষ অধ্যায় কোথা থেকে এলো?”। প্রকাশক প্রথমে উত্তেজনায় ভরে ওঠেন, কারণ তিনি ভেবেছিলেন এটা যদি সত্যিই অমল মুখোপাধ্যায়ের লেখা হয়, তবে এটি সাহিত্য বাজারে শতাব্দীর সবচেয়ে বড় সাফল্য হবে। কিন্তু শীঘ্রই তিনি বুঝতে পারলেন, বিষয়টি এত সহজ নয়। পরিবার জোর দিয়ে বলছে অমল শেষ করেননি, অথচ পাঠকেরা বলছে, ভাষা আর ভঙ্গি এতটাই অমলের মতো যে অন্য কেউ লিখতে পারে না। সংবাদমাধ্যম প্রতিদিন নতুন নতুন প্রতিবেদন ছাপতে থাকে, কেউ তদন্ত শুরু করে কে এই লেখা অনলাইনে প্রকাশ করেছে। তবে প্রকাশকের মাথায় একটাই ভাবনা—যদি তিনি দ্রুত এই লেখার অধিকার দাবি করতে না পারেন, তবে অন্য কোনো প্রকাশনা সংস্থা বা অনলাইন প্ল্যাটফর্ম তা ব্যবহার করে ফেলবে। আর এটাই তাঁকে তাড়িত করে তোলে, যেন রহস্য সমাধানের আগে ব্যবসায়িক প্রতিযোগিতায় জয়ী হতে পারেন।

অন্যদিকে, সমালোচক সমাজ দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে। একদল সমালোচক দৃঢ়ভাবে বলেন, “এটি অমলের লেখা ছাড়া আর কিছু হতে পারে না। তাঁর প্রতিটি বাক্যে যে ছন্দ, তাঁর ব্যবহৃত প্রতীকী চিত্রকল্প—এসব হুবহু মেলে। কোনো অনুকরণকারী এত নিখুঁতভাবে তা ধরতে পারবে না।” তারা উদাহরণ টেনে দেখায়, অমলের আগের উপন্যাসগুলির চরিত্রগুলো যেভাবে পরিণতি পেত, তার ধারাবাহিকতা বজায় রয়েছে এই সমাপ্তিতেও। কিন্তু সমালোচকদের অন্য অংশ বলে, “এটা এক সুপরিকল্পিত নকল।” তাদের যুক্তি—প্রযুক্তির যুগে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা গভীর সাহিত্য বিশ্লেষণের মাধ্যমে কোনো লেখকের স্টাইল নকল করা অসম্ভব নয়। তারা ইঙ্গিত দেয়, হয়তো কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী লেখক খ্যাতি কুড়োতে এই কাজ করেছে। বিতর্ক এতটাই তীব্র হয়ে ওঠে যে সাহিত্য সাময়িকীগুলো বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করতে শুরু করে—“শেষ অধ্যায়: আসল না নকল?”। এইসব আলোচনায় সাধারণ পাঠকরাও জড়িয়ে পড়েন, প্রত্যেকে নিজের মতামত জানাতে থাকে, আর তাতে রহস্য আরও ঘনীভূত হয়ে ওঠে।

পাঠক সমাজের প্রতিক্রিয়া ছিল আরও বৈচিত্র্যময়। অনেক ভক্ত আবেগপ্রবণ হয়ে বলল, “আমরা তো জানি না লেখক কী লিখতে চাইছিলেন। কিন্তু এই সমাপ্তিই আমাদের কাছে অমলের সত্যি শেষ উপহার।” কারও কারও মতে, এমনকি যদি এটা নকলও হয়, তবুও এর মান এতটাই উচ্চ যে সেটি আলাদা করে মূল্যায়িত হওয়া উচিত। কিন্তু অন্যরা প্রবল বিরক্তি প্রকাশ করল। তাদের যুক্তি—এটা পাঠকের সঙ্গে প্রতারণা, একজন প্রয়াত সাহিত্যিকের নাম ভাঙিয়ে মুনাফা করার চেষ্টা। এই বিতর্ক সামাজিক মাধ্যমে অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি তৈরি করে। ফেসবুক, টুইটার, সাহিত্য ব্লগে একের পর এক পোস্ট, আলোচনা, লাইভ সেশন—সবখানেই একটাই বিষয় ঘুরে বেড়ায়। কেউ কেউ অমলের পুরোনো সাক্ষাৎকার ঘেঁটে খুঁজে বের করতে চাইলেন, তিনি কোনোদিন কি “শেষ অধ্যায়”-এর ইঙ্গিত দিয়েছিলেন কিনা। এর ফলে অনলাইনে অমলের লেখার পুরোনো অংশগুলো আবারও ভাইরাল হয়ে যায়, মানুষ নতুন করে পড়তে শুরু করে, আর তাঁকে ঘিরে মিথ তৈরি হতে থাকে।

এই অধ্যায়ের শেষ দিকে বোঝা যায়, রহস্য আরও গভীর অন্ধকারে ঢুকে পড়ছে। কারণ প্রতিটি পক্ষ—প্রকাশক, সমালোচক, পাঠক, এমনকি পরিবারের সদস্যরাও—নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সত্য প্রমাণ করতে চাইছে। অথচ কোনো নির্দিষ্ট প্রমাণ নেই যে লেখাটি আসল বা নকল। প্রকাশক চুপিসারে আইনজীবীদের সঙ্গে বৈঠক করছে কপিরাইট দাবির জন্য, সমালোচকেরা গোপন নথি খুঁজছে স্টাইল বিশ্লেষণের জন্য, আর পাঠকেরা আবেগে ভাসছে বা ক্ষোভে ফুঁসছে। এইসব কোলাহলের মাঝেই অনলাইনে আরও কিছু গুজব ছড়াতে থাকে—কেউ বলছে, আসল খসড়াটি এখনও কারও কাছে লুকোনো আছে, কেউ বলছে, অমল মৃত্যুর আগে অদ্ভুত এক উইল রেখে গেছেন। কিন্তু সবকিছুর পরও উত্তর মেলে না। বরং এই অমীমাংসিত প্রশ্নগুলোই সাহিত্য সমাজে এক অদৃশ্য উত্তেজনা ছড়িয়ে দেয়, যেন প্রত্যেকেই এক অজানা নাটকের অংশ হয়ে গেছে। “শেষ অধ্যায়” সত্যিই অমলের লেখা নাকি নিছক এক প্রহসন—এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায় না, তবে তার চারপাশে সৃষ্টি হয় রহস্যের এমন ঘূর্ণি, যা সবার কল্পনাকে নতুন করে আলোড়িত করে তোলে।

চার

অরিন্দম বাংলা সাহিত্যে এমফিল করছে এবং তার গবেষণার বিষয় ছিল অমল মুখোপাধ্যায়ের সাহিত্যভাষা ও চরিত্র নির্মাণ। অমলের লেখা তাঁর কাছে শুধু গবেষণার উপাদান নয়, বরং প্রেরণা ও আবেগের উৎস। ছোটবেলা থেকেই তিনি অমলের ভক্ত, প্রতিটি নতুন বই প্রকাশের পরই প্রথম কপি সংগ্রহ করার জন্য লাইনে দাঁড়াতেন। তাই যখন তিনি শুনলেন, “শেষ অধ্যায়” হঠাৎ করেই সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, আর সেটিকে ঘিরে এমন আলোড়ন তৈরি হয়েছে, তাঁর ভেতরে এক অদম্য কৌতূহল জন্ম নিল। গবেষকের স্বভাবতই তিনি ঘটনাকে শুধু পাঠকের চোখে দেখলেন না—বরং তদন্তের চোখে দেখতে শুরু করলেন। তাঁর মনে একটাই প্রশ্ন ঘুরতে থাকল—যদি সত্যিই অমলবাবু উপন্যাস অসমাপ্ত রেখেছিলেন, তাহলে এত নিখুঁত সমাপ্তি কেমন করে সম্ভব হল? নাকি লেখক কোনো সময় গোপনে গল্পটা বর্ণনা করেছিলেন? কারও কানে শোনা টুকরো টুকরো কথার ভিত্তিতে কেউ হয়তো পুরোটা দাঁড় করিয়েছে?

অরিন্দম প্রথমে অমলের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলেন। তিনি তাঁদের বাড়িতে গিয়ে দেখা করলেন, ভদ্রভাবে বললেন যে তিনি গবেষণার স্বার্থে কিছু তথ্য জানতে চান। অমলের স্ত্রী প্রথমে দ্বিধা করলেও পরে কিছুটা খুলে বললেন। তিনি জানালেন, মৃত্যুর আগে অমল ভীষণ অস্থির ছিলেন। কখনও বলতেন—“শেষটা লেখা যাবে না, লেখা হলে বিপদ আসবে”, আবার কখনও গভীর রাতে কাউকে উদ্দেশ্য করে একতরফা কথোপকথন চালাতেন, যেন চরিত্রগুলোর সঙ্গেই কথা বলছেন। পরিবারের কেউ তাঁকে শেষ অধ্যায় লিখতে দেখেনি, এমনকি কোনো কপি খুঁজেও পায়নি। অরিন্দম জিজ্ঞেস করলেন, তিনি কি কখনো কাউকে কাহিনীর পরিকল্পনা শোনাতেন? উত্তর এল—হ্যাঁ, মাঝে মাঝে ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের সঙ্গে আলাপচারিতায় গল্পের টুকরো টুকরো কথা বলতেন, কিন্তু পুরো কাহিনী কখনো বলেননি। অরিন্দমের মাথায় তখনই সন্দেহ জাগল—যদি সত্যিই কেউ সেই টুকরো কথাগুলো মনে রেখে পরে নিজের মতো করে শেষ অধ্যায় লিখে ফেলে? কিন্তু প্রশ্ন রয়ে গেল—তাহলে সেই লেখা এত নিখুঁতভাবে অমলের স্টাইলে মানানসই হল কীভাবে?

এরপর অরিন্দম সাহিত্য সমাজে ঘুরে ঘুরে তথ্য সংগ্রহ করতে শুরু করলেন। তিনি সমরেশ নামে অমলের এক পুরোনো সহকর্মীর খোঁজ পেলেন, যিনি একসময় তাঁর সঙ্গে যৌথভাবে একটি নাটক রচনা করেছিলেন। শোনা যায়, অমল নাকি তাঁকে মাঝে মাঝে কাহিনীর শেষ নিয়ে দ্বিধা, সংশয় বা ধারণা শোনাতেন। অরিন্দম দেখা করতে গেলেন সমরেশের সঙ্গে। সমরেশ বয়সে প্রবীণ, কিন্তু স্মৃতিশক্তি এখনও তীক্ষ্ণ। তিনি স্বীকার করলেন, অমল একাধিকবার গল্পের সম্ভাব্য সমাপ্তি নিয়ে আলোচনা করেছিলেন, কিন্তু প্রতিবারই ভিন্ন ভিন্ন পরিণতি বর্ণনা করতেন। একবার বলেছিলেন, গল্প শেষ হবে মৃত্যু দিয়ে, আরেকবার বলেছিলেন মুক্তির মাধ্যমে, আবার কখনও রহস্যের অন্ধকারে ফেলে রাখার কথা বলেছেন। সমরেশ মুচকি হেসে বললেন, “আসলে অমল কখনোই নিশ্চিত ছিলেন না শেষটা কেমন হবে।” অরিন্দমের সন্দেহ আরও ঘনীভূত হল—যদি কোনো শ্রোতা এসব আলোচনার টুকরো টুকরো অংশ জোড়া লাগিয়ে নিজের মতো করে একটি অধ্যায় দাঁড় করায়? তবুও তাঁর মনে অস্বস্তি রয়ে গেল, কারণ সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশিত অধ্যায়টি এতটাই সুসংহত ও পরিণত যে সেটিকে কেবল অনুমান বা অনুমিতির ফসল বলা যায় না।

অধ্যায়ের শেষে দেখা যায়, অরিন্দম নিজের অনুসন্ধানের প্রথম ধাপ শেষ করেও তেমন কিছু খুঁজে পেল না। অমলের পরিবার জানায়, শেষ অধ্যায় কেউ লেখেনি; সমরেশ বলেন, লেখক কেবল দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন, কোনো একক সিদ্ধান্তে পৌঁছাননি। অথচ সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া অধ্যায়টি নিখুঁত, সুসমন্বিত এবং পাঠকের মনে অমলীয় স্বাদ জাগিয়ে তুলছে। এ যেন একইসঙ্গে বাস্তব আর অলৌকিকের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা এক ধাঁধা। অরিন্দম রাত জেগে নোট নিলেন, পুরোনো সাক্ষাৎকার ঘেঁটে দেখলেন, আর নিজের মনে প্রশ্ন করলেন—“এটা কি সত্যিই কোনো প্রতিভাবান নকলকারীর কাজ, নাকি এর পেছনে আরও গভীর কোনো রহস্য লুকিয়ে আছে?” তাঁর অনুসন্ধান যেন এক নতুন অধ্যায়ের শুরু করে দিল, যেখানে প্রতিটি পদক্ষেপই আরও বেশি অন্ধকার ও সংশয়ের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।

পাঁচ

 কয়েকদিনের খোঁজখবরের পর তিনি জানতে পারে, অমল মুখোপাধ্যায় নিয়মিত একটি সাহিত্য ক্লাবে যেতেন—এক প্রাচীন ভাঙাচোরা ভবনের দ্বিতীয়তলার এক ছোট্ট ঘর, যেখানে শহরের সাহিত্যপ্রেমীরা সপ্তাহে একদিন মিলিত হতেন। এই ক্লাবটির ইতিহাস বেশ পুরোনো; বহু নামী লেখক তাঁদের প্রথম লেখা পাঠ করেছিলেন এখানে। অমলও ছিলেন এর সক্রিয় সদস্য, আর শেষ জীবনে তিনি প্রায় নিয়মিত সেখানে যেতেন। অরিন্দম কৌতূহল নিয়ে খোঁজ নেন, এবং জানতে পারেন যে অমল সেখানে প্রায়ই নিজের অসমাপ্ত খসড়ার কিছু অংশ পড়ে শোনাতেন। যাঁরা উপস্থিত থাকতেন, তাঁরা প্রত্যক্ষদর্শীর মতো সেই সব লেখা শুনেছেন। অরিন্দমের মনে সঙ্গে সঙ্গেই প্রশ্ন জাগল—তাহলে কি ওই শ্রোতাদের কারও মনে অমলের বর্ণিত গল্পের কাঠামো থেকে ধারণা জন্মেছিল, এবং সেই ধারণাই রূপ নিয়েছে “শেষ অধ্যায়”-এ? তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, এই ক্লাবের প্রতিটি সদস্যের সঙ্গে দেখা করতেই হবে।

সেই ক্লাবে গিয়ে অরিন্দম এক আশ্চর্য পরিবেশের মুখোমুখি হয়। ধুলোমাখা বইয়ের তাক, অন্ধকারাচ্ছন্ন হলঘর, আর পুরোনো কাঠের চেয়ারগুলো যেন অমলের স্মৃতিকে আঁকড়ে ধরে আছে। উপস্থিত প্রবীণ ও তরুণ সদস্যরা অরিন্দমকে জানালেন, হ্যাঁ, অমলবাবু প্রায়ই তাঁদের সামনে নিজের খসড়া পড়ে শোনাতেন। বিশেষ করে শেষ কয়েক মাসে তিনি যে উপন্যাসটি লিখছিলেন, তার অনেকাংশ তাঁরা শুনেছেন। প্রত্যেকেই সম্মত যে গল্পের প্রধান চরিত্র, ঘটনাপ্রবাহ ও প্রতীকী ইঙ্গিত সম্পর্কে তাঁদের মোটামুটি স্পষ্ট ধারণা আছে। তবে যখন অরিন্দম জিজ্ঞেস করলেন—“আপনাদের কেউ কি শেষটা শুনেছেন?”—তখন সবার মুখে একরকম নীরবতা নেমে এল। কেউ কেউ বলল, অমলবাবু প্রায়শই শেষটা বদলাতেন, একদিন একটি রূপ, আরেকদিন অন্যটি। আর কেউ কেউ বলল, তিনি কখনোই শেষ অংশটা পুরোপুরি পড়াননি। অরিন্দম বুঝলেন, এখানে উপস্থিত শ্রোতাদের মধ্যে কেউ আসল সত্য জানলেও, হয়তো তা প্রকাশ করছে না।

অরিন্দম প্রত্যেকের সঙ্গে আলাদা আলাদা করে কথা বলতে শুরু করলেন। একজন প্রবীণ শিক্ষক বললেন, “অমলদা একদিন খুব আবেগ নিয়ে পড়েছিলেন একটা অংশ, যেখানে প্রধান চরিত্র মৃত্যু মেনে নিতে রাজি হচ্ছিল। কিন্তু তিনি সঙ্গে সঙ্গে বললেন, না, এটা ঠিক শেষ নয়।” অন্য একজন তরুণী বললেন, “আমি শুনেছিলাম এমন একটি অংশ, যেখানে মুক্তিই ছিল আসল সমাধান।” আরেকজন আবার বললেন, “না, তিনি তো বলেছিলেন গল্পের শেষটা অস্পষ্ট থাকবে, পাঠকের মনে প্রশ্ন জাগাবে।” এতগুলো বিপরীত বক্তব্য শুনে অরিন্দম আরও বিভ্রান্ত হয়ে গেলেন। তাঁর মনে হল, অমল ইচ্ছাকৃতভাবেই ভিন্ন ভিন্ন সংস্করণ পড়ে শোনাতেন, যেন কাউকে চূড়ান্ত সমাপ্তির ধারণা না দেন। তবে এও স্পষ্ট হয়ে গেল যে, ক্লাবের কয়েকজন ঘনিষ্ঠ শ্রোতা গল্পের মূল কাঠামো ভালোভাবেই জানতেন। যদি তাঁদের মধ্যে কেউ গোপনে চেষ্টা করে থাকে, তবে সেই জ্ঞানের ভিত্তিতেই হয়তো তারা “শেষ অধ্যায়” তৈরি করতে পেরেছে। কিন্তু প্রত্যেকে মুখে অস্বীকার করল, আর কোনো দাবি করল না।

অধ্যায়ের শেষ দৃশ্যে অরিন্দম গভীর রাতে ক্লাবের ফাঁকা ঘরে বসে থাকেন। জানালার ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলো ঢুকছে, ধুলোমাখা টেবিলের ওপর এখনো পড়ে আছে অমলের রেখে যাওয়া একটি পুরোনো খাতা, যেখানে কেবল কিছু কবিতার টুকরো লেখা আছে। তিনি খাতার পাতা উল্টাতে উল্টাতে বুঝতে পারলেন, অমল শেষের ব্যাপারে এতটাই দ্বিধায় ছিলেন যে কোনো স্থায়ী রূপ কখনো দেননি। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়—যদি তিনি কখনো পূর্ণ সমাপ্তি লেখেননি, তাহলে সেই নিখুঁত অধ্যায় কোথা থেকে এলো? সাহিত্য ক্লাবের এই ছায়াময় ঘরে যেন অমলের অদৃশ্য উপস্থিতি ভাসতে থাকে, আর অরিন্দম উপলব্ধি করেন, তাঁর অনুসন্ধান এখনো শুরু মাত্র। তিনি বুঝতে পারেন, অতীতের এই ছায়াগুলোর ভেতরেই হয়তো লুকিয়ে আছে সেই রহস্যের সূত্র, যা তাঁকে পৌঁছে দেবে “শেষ অধ্যায়”-এর প্রকৃত উৎসের কাছে।

ছয়

 অরিন্দম ক্লান্ত শরীরে এক সন্ধ্যায় আবার সেই অনলাইন গ্রুপে ফিরে গেলেন, যেখানে “শেষ অধ্যায়” প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। তিনি যতবারই পড়ছিলেন, ততবারই মনে হচ্ছিল এর ভেতরে এমন কিছু আছে যা চোখ এড়িয়ে যাচ্ছে। হঠাৎই তাঁর চোখ আটকে গেল এক সূক্ষ্ম জায়গায়—অধ্যায়ের একেবারে শেষে, দৃশ্যত কোনো স্বাক্ষরের মতো একটি চিহ্ন আঁকা। সেটি অক্ষর নয়, কোনো সাধারণ প্রতীকও নয়; বরং জটিল এক বিন্যাস, দেখতে অনেকটা একটি বৃত্তের ভেতরে দাঁড়ানো তিনটি বাঁকানো রেখার মতো। আগে পাঠকেরা এটি উপেক্ষা করেছিল, হয়তো ভেবেছিল প্রিন্টিং এরর কিংবা গ্রাফিকের অংশ। কিন্তু অরিন্দমের অন্তর্দৃষ্টি বলল, এটি নিছক সাজসজ্জা নয়। তিনি সঙ্গে সঙ্গে নোট করে নিলেন, আর সেই চিহ্নের ভেতরে কী রহস্য লুকিয়ে আছে তা বোঝার চেষ্টা করতে লাগলেন। এ যেন গল্পের ভেতরে গল্পের আরেকটি স্তর, যেটি অনলাইন প্রকাশক বিশেষভাবে লুকিয়ে রেখে গেছেন।

এরপর অরিন্দম অনেক খোঁজখবর শুরু করলেন। কয়েকটি পুরোনো সাহিত্যপত্রিকা ঘেঁটে দেখলেন, এমন প্রতীক কোথাও ব্যবহৃত হয়েছে কিনা। প্রথমে কিছুই মিলল না, কিন্তু কয়েকদিন পর হঠাৎ তাঁর মনে পড়ল সমরেশের নাম—অমলের সেই পুরোনো সহকর্মী। কয়েকদিন আগে তাঁর সঙ্গে দেখা করার সময়, টেবিলের ওপর খোলা থাকা সমরেশের একটি ডায়েরির পাতায় অরিন্দম ঝলক দেখে ছিলেন ঠিক একই রকম একটি চিহ্ন। তখন তিনি এটিকে গুরুত্ব দেননি, ভেবেছিলেন হয়তো ব্যক্তিগত আঁকিবুকি। কিন্তু এখন যখন অনলাইনে প্রকাশিত অধ্যায়ের নিচে হুবহু সেই একই চিহ্ন দেখা গেল, তাঁর শরীর শিহরিত হয়ে উঠল। এটা নিছক কাকতালীয় হতে পারে না। অর্থাৎ যিনি “শেষ অধ্যায়” প্রকাশ করেছেন, তিনি হয় সমরেশ নিজে, নয়তো অন্তত তাঁকেই ইঙ্গিত করে যাচ্ছেন। এই আবিষ্কার অরিন্দমকে আলোড়িত করে দিল, কারণ এর মানে দাঁড়াচ্ছে যে রহস্যের পেছনে ব্যক্তিগত শত্রুতা, গোপন প্রতিশোধ বা অন্তরঙ্গ সম্পর্কের ছায়া কাজ করছে।

অরিন্দম আবার সমরেশের সঙ্গে দেখা করতে গেলেন, কিন্তু এবার তিনি তাঁকে সরাসরি কিছু জিজ্ঞেস করলেন না। বরং চারপাশে লক্ষ্য করলেন, তাঁর কথাবার্তায় কোনো দ্বন্দ্ব আছে কিনা। সমরেশ অবশ্য স্বাভাবিক ভঙ্গিতে কথা বললেন, বললেন তিনি কোনোভাবেই জানেন না অনলাইনে কীভাবে সেই অধ্যায় এল। তবে তাঁর কণ্ঠে এক ধরনের বিরক্তি ছিল, যেন বিষয়টি তাঁকে অস্বস্তিতে ফেলছে। অরিন্দমের মনে সন্দেহ আরও ঘনীভূত হল। তিনি বুঝলেন, যদি সমরেশের ডায়েরিতে সেই প্রতীক সত্যিই ছিল, তবে এর মানে হয় সমরেশ ইচ্ছে করে তা লিখে রেখেছিলেন কোনো ইঙ্গিত হিসেবে, নয়তো কেউ তাঁর ব্যক্তিগত লেখা থেকে প্রতীকটি চুরি করে ব্যবহার করেছে, যাতে সবাই সন্দেহ করে তাঁর দিকেই। দুটো সম্ভাবনাই ভয়ঙ্কর। একদিকে সমরেশ যদি সত্যিই জড়িত হন, তবে তাঁর হাতেই হয়তো রহস্যের চাবিকাঠি। অন্যদিকে, যদি তিনি নির্দোষ হন, তবে কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে তাঁকে ফাঁসানোর চেষ্টা করছে।

অধ্যায়ের শেষ দৃশ্যে অরিন্দম নিজের ঘরে ফিরে বসে থাকে সেই প্রতীকের ছবির দিকে তাকিয়ে। চারপাশ নিস্তব্ধ, কেবল জানালার বাইরে হাওয়া বইছে। তাঁর মনে হতে থাকে, এ প্রতীক কেবল এক ব্যক্তির গোপন স্বাক্ষর নয়, বরং অমল মুখোপাধ্যায়ের অসমাপ্ত কাহিনীর ভেতরেও হয়তো এক গুপ্ত চিহ্ন হিসেবে লুকিয়ে আছে। তিনি বারবার মনে পড়তে লাগলেন অমলের সেই রহস্যময় উক্তি—“শেষটা যেন কেউ না জানে…”। তাহলে কি অমল নিজেই এই প্রতীক কাউকে দিয়েছেন, যাতে সমাপ্তির রহস্য নিয়ন্ত্রিত থাকে? নাকি সমরেশই কোনো অদৃশ্য পরিকল্পনা নিয়ে আজ এই অচেনা স্বাক্ষরের আড়ালে দাঁড়িয়ে আছেন? এই প্রশ্নগুলোই অরিন্দমকে এক নতুন অনিশ্চয়তার পথে ঠেলে দেয়। তিনি জানেন, এখন থেকে প্রতিটি পদক্ষেপ হবে আরও বিপজ্জনক, কারণ কেউ তাঁকে ইচ্ছে করেই ভুল পথে চালিত করছে। অচেনা স্বাক্ষর যেন হয়ে উঠল রহস্যের নতুন দ্বার, যা খুললেই হয়তো সব সত্য উদ্ভাসিত হবে—অথবা আরও অন্ধকারে নিমজ্জিত করবে।

সাত

সেদিন সারাদিন অরিন্দম নানা সূত্র খুঁজতে খুঁজতে মানসিকভাবে অবসন্ন হয়ে পড়েছিলেন। ঘরে ফিরে তিনি বারবার সমরেশের ডায়েরির সেই অচেনা প্রতীকের কথা ভেবেছিলেন। বাইরে বৃষ্টি পড়ছিল, জানালার কাঁচে টুপটাপ শব্দে ঘরের নিস্তব্ধতা আরও গাঢ় হয়ে উঠছিল। ঠিক তখনই হঠাৎ ফোন বেজে উঠল। সময় তখন প্রায় রাত বারোটা। নম্বরটি সম্পূর্ণ অচেনা, কোনো নাম ভেসে উঠল না স্ক্রিনে। প্রথমে অরিন্দম একটু দ্বিধা করলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কল রিসিভ করলেন। অপর প্রান্তে কোনো স্পষ্ট কণ্ঠস্বর নয়, বরং ফিসফিস করে আসছিল অচেনা গলার শব্দ। সেই ফিসফিসে কাঁপুনি ছিল, যেন শব্দ আসছে দূর থেকে, অথবা এমন কেউ বলছে যে ইচ্ছাকৃতভাবে নিজেকে আড়াল করছে। কিছুক্ষণ নীরবতার পর কেবল একটি বাক্য শোনা গেল—“শেষটা তিনিই লিখেছেন, তবে কলম ধরেননি।” শব্দগুলো এতটা অস্পষ্ট অথচ ভেদী ছিল যে অরিন্দমের শরীরে হিম শিহরণ বয়ে গেল। তিনি কিছু প্রশ্ন করার আগেই লাইন কেটে গেল।

অরিন্দম স্তম্ভিত হয়ে ফোনের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তাঁর মনে ভেসে উঠতে লাগল অসংখ্য প্রশ্ন। “শেষটা তিনিই লিখেছেন”—কিন্তু কে? কি অমল মুখোপাধ্যায়, নাকি সমরেশ? আর যদি “কলম ধরেননি” মানে শারীরিকভাবে তিনি লেখেননি, তবে কিভাবে তাঁর নাম এই সমাপ্তির সঙ্গে যুক্ত হলো? অরিন্দম চেষ্টা করলেন লজিক খুঁজতে। হয়তো এটি ইঙ্গিত করছে যে অমল জীবিত থাকা অবস্থায় কোনোভাবে তাঁর শেষ কাহিনীর খসড়া কারও কাছে বলেছিলেন, যিনি পরে তা লিখে দিয়েছেন। কিন্তু ফোনের কণ্ঠস্বরের ভৌতিক স্বরভঙ্গি তাঁর চিন্তাকে আরও বিভ্রান্ত করল। যদি এটি নিছক একজন মজা করে করা কল হতো, তবে এত রহস্যময় ভঙ্গি ব্যবহার করার দরকার কী ছিল? তাছাড়া, বাক্যটির ভেতরে এমন এক অদ্ভুত দার্শনিক রূপক ছিল যা সহজে কেউ রচনা করতে পারে না। যেন কেউ অমলের নিজস্ব ধাঁচেই ইঙ্গিত দিচ্ছে—মৃত লেখক কাগজে লিখেননি বটে, কিন্তু তাঁর ইচ্ছা বা ধারণা অন্য কেউ পূর্ণ করেছে। অরিন্দম বুঝলেন, এই কথার ভেতরে এমন একটি সূত্র লুকিয়ে আছে, যা তাঁকে নতুন করে তদন্তের পথে নিয়ে যাবে।

পরের দিন সকালেই অরিন্দম সিদ্ধান্ত নিলেন, ফোনকলের রহস্য উদ্ঘাটন করতেই হবে। প্রথমে তিনি মোবাইল কোম্পানির এক পরিচিত টেকনিশিয়ানের কাছে গিয়ে চেষ্টা করলেন কলের উৎস খুঁজে বের করতে। কিন্তু ফল শূন্য—নম্বরটি ছিল একবার ব্যবহারযোগ্য, ভুয়া আইডি দিয়ে নেওয়া সিমকার্ড থেকে করা। অর্থাৎ কলকারী সচেতনভাবেই নিজের পরিচয় আড়াল করতে চেয়েছে। এই ব্যর্থতার পর অরিন্দমের মাথায় আসতে লাগল আরও ভয়ঙ্কর সম্ভাবনা। যদি সত্যিই এই বার্তা কোনো সাধারণ মানুষ না দিয়ে, বরং সেই সাহিত্য ক্লাবের ভেতরে লুকিয়ে থাকা কারও কাছ থেকে আসে? অথবা আরও আশ্চর্য—যদি এটি এমন কোনো কণ্ঠস্বর হয় যা আমাদের বোধগম্যের বাইরে, যা সত্যিই মৃতের আত্মা থেকে উঠে আসছে? এই চিন্তা তাঁকে আতঙ্কিত করে তুলল, তবে তিনি নিজেকে বাস্তবতায় ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করলেন। এর পেছনে নিশ্চয়ই মানুষের হাত আছে, শুধু তা খুঁজে বের করাই এখন তাঁর কাজ। তিনি নতুন করে খুঁটিয়ে পড়তে শুরু করলেন অমলের অসমাপ্ত খসড়া, খুঁজে বের করার চেষ্টা করলেন কোনো এমন ইঙ্গিত যা প্রমাণ করবে “শেষটা তিনিই লিখেছেন” কথাটির পেছনে আসল মানে কী।

অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটে এক ভীতিপূর্ণ পরিবেশে। সেদিন রাতেও অরিন্দম ঘরে বসে ছিলেন, চারপাশ অন্ধকার, কেবল টেবিল ল্যাম্পের আলোয় কাগজে লেখা শব্দগুলো স্পষ্ট। বারবার মনে হচ্ছিল, যেন কেউ তাঁর পিছনে দাঁড়িয়ে আছে। ফোনের ফিসফিসানি এখনো কানে বাজছিল। তিনি বারবার সেই বাক্যটি আওড়াচ্ছিলেন—“শেষটা তিনিই লিখেছেন, তবে কলম ধরেননি।” হঠাৎ ঘড়ির কাঁটা একটা বাজতে বাজতেই হাওয়ার ঝাপটায় জানালা খুলে গেল। বাতাসে ডায়েরির পাতা উড়ে গিয়ে মেঝেতে পড়ল, আর সেখানে স্পষ্ট হয়ে উঠল সেই অচেনা প্রতীক, যা সমরেশের ডায়েরিতেও ছিল। মুহূর্তে অরিন্দম বুঝলেন, প্রতীক আর কণ্ঠস্বর—দুটোই একই রহস্যময় সুতায় বাঁধা। কে বা কী তাঁকে এই পথে ঠেলে দিচ্ছে তা তিনি এখনো জানেন না, তবে একটি জিনিস স্পষ্ট হয়ে গেল—এটি কেবল একটি সাহিত্য রহস্য নয়, বরং এর পেছনে এমন এক অদৃশ্য শক্তি কাজ করছে, যাকে সহজ যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাবে না। আর সেই শক্তির ভেতরেই হয়তো লুকিয়ে আছে মৃত লেখকের অসমাপ্ত কাহিনীর প্রকৃত সমাপ্তি।

আট

তিনি দীর্ঘদিন ধরে নানা সূত্র খুঁজে খুঁজে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন, কিন্তু এবার তাঁর হাতে এমন একটি তথ্য এল যা গোটা রহস্যকেই অন্য মাত্রা দিল। জানা গেল, সমরেশের পুরোনো নোটবুক ও খসড়া কিছু বছর আগে গোপনে বিক্রি হয়েছিল, আর সেগুলো একদল তরুণ প্রযুক্তি উদ্যোক্তার হাতে এসে পৌঁছায়। এরা সাহিত্যপ্রেমী হলেও প্রযুক্তিকে তাদের মূল হাতিয়ার বানিয়ে ফেলেছিল। তাঁদের মধ্যে একজন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে কাজ করছিল, যিনি দাবি করেছিলেন—যদি যথেষ্ট ডেটা পাওয়া যায়, তবে কোনো লেখকের স্টাইল, টোন ও শব্দচয়ন পুরোপুরি নকল করা সম্ভব। ঠিক সেই ভাবনাতেই তাঁরা সমরেশের সমস্ত লেখা, ডায়েরি, এমনকি তাঁর অপ্রকাশিত চিঠি ও বক্তৃতা সংগ্রহ করে একটি বিশেষ অ্যালগরিদম তৈরি করে। উদ্দেশ্য ছিল কেবল পরীক্ষা-নিরীক্ষা—কীভাবে একজন মৃত লেখকের মতো লিখতে পারে একটি যন্ত্র? কিন্তু এই পরীক্ষা-নিরীক্ষা যখন সফল হয়, তখনই বেরিয়ে আসে সেই রহস্যজনক শেষ অধ্যায়, যা পরে সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। অরিন্দম শুনে অবাক হয়ে যান—এতটা কাকতালীয় ঘটনা কীভাবে সম্ভব?

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার তৈরি লেখাটি যে নিছক একটি নকল নয়, তা স্পষ্ট হয়ে যায় প্রথম পাঠেই। অরিন্দম পড়তে পড়তে আবিষ্কার করেন, এর ভেতরে এমন কিছু তথ্য, এমন কিছু চরিত্রের পেছনের গোপন সূত্র আছে যা প্রকাশ্যে কোথাও লেখা ছিল না। উদাহরণস্বরূপ, গল্পে একটি দৃশ্যে বর্ণিত হয়েছে সমরেশের শৈশবের একটি ঘটনা, যা কেবলমাত্র তাঁর ঘনিষ্ঠ পরিবার বা ডায়েরির অতি ব্যক্তিগত পাতায় পাওয়া যায়। অথচ উদ্যোক্তারা দাবি করে, তাঁরা যে ডায়েরি পেয়েছিলেন তাতে এসব লেখা ছিল না। আরও আশ্চর্যের ব্যাপার, শেষ অধ্যায়ের একটি সংলাপে এমন একটি ভবিষ্যৎ ঘটনার ইঙ্গিত আছে যা তখনো ঘটেনি, কিন্তু পরে বাস্তবে সত্যি হয়ে ওঠে। এই অদ্ভুত মিল দেখে অরিন্দমের মনে হলো—অ্যালগরিদম কি কেবল লেখকের স্টাইল নকল করেছে, নাকি তার ভেতর দিয়ে কোনো অদৃশ্য শক্তি বা স্মৃতির ছায়া ফুটে উঠেছে? তিনি গভীরভাবে অনুভব করতে লাগলেন, এর ভেতরে এমন কিছু লুকিয়ে আছে যা প্রযুক্তি দিয়ে পুরোপুরি ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়।

অরিন্দম উদ্যোক্তাদের সঙ্গে দেখা করার সিদ্ধান্ত নিলেন। তাঁদের অফিসে গিয়ে তিনি দেখতে পেলেন এক অদ্ভুত পরিবেশ—অর্ধেকটা সাহিত্য ক্লাবের মতো, অর্ধেকটা গবেষণাগারের মতো। একদিকে বইয়ের তাক ভর্তি সমরেশের পুরোনো সংস্করণ, অন্যদিকে দেয়ালে ঝুলছে ডেটা চার্ট ও অ্যালগরিদমের নকশা। উদ্যোক্তারা তাঁকে জানালেন, তাঁদের উদ্দেশ্য কখনো প্রতারণা করা নয়, বরং দেখানো—কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে কতটা মানবিক সৃষ্টিশীলতা ধরা সম্ভব। কিন্তু তাঁরাও স্বীকার করলেন, শেষ অধ্যায়টি যেভাবে বেরিয়ে এল, তা তাঁদের বোধগম্যতার বাইরে। তাঁরা কেবল অ্যালগরিদমকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, “গল্পের সম্ভাব্য সমাপ্তি লেখো।” কিন্তু যা বেরিয়ে এলো, তা যেন নিখুঁতভাবে লেখকের চিন্তা ও অন্তর্দৃষ্টি মিশে তৈরি। আরও আশ্চর্যের ব্যাপার, এক উদ্যোক্তা স্বীকার করলেন, লেখাটি তৈরি হওয়ার সময় তাঁদের সার্ভারে একটি অচেনা প্রতীক ভেসে উঠেছিল—যেটি অরিন্দম আগেই সমরেশের ডায়েরিতে ও অনলাইন পোস্টের নিচে দেখেছিলেন। এই প্রতীকের উপস্থিতি যেন প্রমাণ করছিল, এর পেছনে কেবল প্রযুক্তি নয়, আরও গভীর কোনো সংযোগ কাজ করছে। অরিন্দমের সন্দেহ আরও দৃঢ় হয়ে গেল—এখানে এক অদৃশ্য শক্তি, হয়তো সমরেশের অমোঘ ইচ্ছাশক্তি, অ্যালগরিদমের ভেতরে প্রবাহিত হয়ে কাজ করছে।

অধ্যায়ের শেষাংশে অরিন্দম এক গভীর দ্বন্দ্বে পড়ে যান। তিনি একদিকে যুক্তি দিয়ে বোঝেন, এ সবই প্রযুক্তির খেলা, নিছক অ্যালগরিদমের কৌশল। অন্যদিকে প্রতিটি নতুন সূত্র তাঁকে এমন এক অজানা অন্ধকারে নিয়ে যাচ্ছে যেখানে প্রযুক্তি আর অতিপ্রাকৃত একসাথে মিশে যাচ্ছে। যদি সত্যিই শেষ অধ্যায়টি কেবল মানুষের হাতের কাজ না হয়, তবে প্রশ্ন থেকে যায়—কে লিখল? এক যন্ত্র? নাকি যন্ত্রের ভেতর দিয়ে নিজের অসমাপ্ত কাহিনী পূর্ণ করতে চাইলেন সমরেশ নিজেই? অরিন্দম জানেন, উত্তর খুঁজে পাওয়া সহজ হবে না। তাঁর সামনে এখন কেবল দুটি পথ—একদিকে প্রযুক্তির জগৎ, যেখানে প্রতিটি রহস্যের ব্যাখ্যা হয় সংখ্যার অ্যালগরিদমে; অন্যদিকে অদৃশ্য জগত, যেখানে মৃত লেখকের ইচ্ছা হয়তো অমর হয়ে ওঠে শব্দের আকারে। রাত বাড়তে থাকলে অরিন্দম অনুভব করেন, এ রহস্য আর শুধু সাহিত্য বা প্রযুক্তি নয়—এটি হয়ে উঠছে এক ভয়ঙ্কর দার্শনিক প্রশ্ন, যেখানে কলম ধরেনি মানুষ, অথচ গল্প শেষ হয়েছে এক অচেনা হাতের ছোঁয়ায়।

নয়

অরিন্দম তখন ক্রমশ অনুভব করছেন, তাঁর তদন্ত তাকে এমন এক জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে যেখানে বাস্তব আর কল্পনার সীমারেখা মিলেমিশে যাচ্ছে। হঠাৎ করেই তিনি একটি অচেনা সূত্র পান—অমল মুখোপাধ্যায়ের জীবনে এমন একজন ছিলেন, যিনি কখনো আলোচনায় আসেননি, কখনো কারও সামনে প্রকাশ পাননি। স্থানীয় এক বৃদ্ধ বই সংগ্রাহকের কাছ থেকে তিনি শোনেন, শহরের প্রান্তে একটি পুরোনো বাড়িতে বসবাস করেন এক বৃদ্ধা, যিনি নাকি দীর্ঘদিন অমলের ছায়াসঙ্গিনী ছিলেন। কৌতূহল আর সন্দেহ মিশ্রিত অনুভূতি নিয়ে অরিন্দম এক বিকেলে সেই বাড়ির পথে পা বাড়ান। ধ্বংসপ্রায় গৃহটির ভেতরে ঢুকে তিনি দেখতে পান, এক বৃদ্ধা কাঠের দোলনায় বসে আছেন, তাঁর চোখে অদ্ভুত শান্তি, কিন্তু কণ্ঠে লুকানো অতীতের ভার। অরিন্দম নিজের পরিচয় দিয়ে উদ্দেশ্য জানাতেই বৃদ্ধার ঠোঁটে এক দীর্ঘশ্বাস ফুটে ওঠে—যেন এতদিন গোপন রাখা কথা আজ আর চেপে রাখা যাচ্ছে না।

বৃদ্ধা ধীরে ধীরে খুলে দেন অতীতের পর্দা। তিনি জানান, অমল মুখোপাধ্যায় কেবল মহান লেখকই ছিলেন না, ব্যক্তিগত জীবনে ছিলেন এক জটিল মানুষ। সাহিত্যিক জীবনের বাইরে তিনি সবসময় চেয়েছিলেন নির্ভরযোগ্য একজন শ্রোতা, একজন যিনি তাঁকে বুঝবেন কিন্তু কখনো প্রকাশ্যে আসবেন না। সেই দায়িত্ব পালন করেছিলেন এই বৃদ্ধা নারী। তাঁরা ছিলেন ঘনিষ্ঠ, কিন্তু সমাজ বা সাহিত্য জগত কখনো জানেনি তাঁর অস্তিত্বের কথা। তিনি স্মৃতির গহ্বর থেকে বললেন, মৃত্যুর কয়েক দিন আগে অমল প্রচণ্ড অসুস্থ অবস্থায় তাঁর কাছে শুয়ে থেকে অদ্ভুত এক আগ্রহ নিয়ে গল্পের সমাপ্তি শুনিয়েছিলেন। কোনো কাগজে লেখেননি, কোনো যন্ত্রে রেকর্ড করেননি—শুধু মুখে মুখে বলেছিলেন শেষ অধ্যায়ের প্রতিটি বাঁক, প্রতিটি সংলাপ, প্রতিটি আবেগ। “আমি ভেবেছিলাম তাঁর মনের ভার লাঘব করার জন্য তিনি এটা করছেন,” বৃদ্ধা চোখ ভিজিয়ে বললেন, “কিন্তু পরে বুঝলাম, তিনি যেন আমাকে এক গোপন দায়িত্ব দিয়ে যাচ্ছেন।” অরিন্দম স্তব্ধ হয়ে শুনলেন—যে সমাপ্তি খুঁজে তিনি এত ঘুরেছেন, তা আসলে মুখে মুখেই উচ্চারিত হয়েছিল।

কিন্তু এখানেই রহস্য আরও গভীর হয়ে ওঠে। বৃদ্ধা বলেন, তিনি কখনো এই কথাগুলো কাউকে জানাননি। তবুও, কীভাবে যেন সেই কাহিনী ছড়িয়ে পড়েছে, এমনকি সামাজিক মাধ্যমে রহস্যময় পোস্টের আকারে প্রকাশও পেয়েছে। তিনি অবাক হয়ে বলেন, “আমি কারও সঙ্গে ভাগ করিনি। আমি জানিই না, কীভাবে তাঁর বলা শব্দগুলো অন্য কারও কানে পৌঁছাল।” অরিন্দমের ভেতরে প্রশ্ন জেগে ওঠে—তাহলে কি সেই রাতের কণ্ঠস্বর, যে ফোনে ফিসফিস করে বলেছিল “শেষটা তিনিই লিখেছেন, তবে কলম ধরেননি,” আসলে এই সত্যেরই ইঙ্গিত দিয়েছিল? হয়তো অমল সত্যিই লিখেননি, কিন্তু তাঁর কণ্ঠের শব্দ, তাঁর শেষ বর্ণনা এক অদৃশ্য শক্তি হয়ে বাতাসে ছড়িয়ে পড়েছিল। তা যদি-বা সম্ভব হয়, কে বা কারা সেই শব্দগুলো সংগ্রহ করল? উদ্যোক্তাদের প্রযুক্তি? কোনো গোপন রেকর্ডার? নাকি সত্যিই এক অদৃশ্য তরঙ্গ, যা মানুষের বোঝার ক্ষমতার বাইরে? বৃদ্ধা অসহায়ভাবে বললেন, “আমি যতই ভাবি, ততই ভয় পাই—যেন কেউ আমার স্মৃতি চুরি করে নিয়েছে।”

অধ্যায়ের শেষাংশে অরিন্দম গভীর চিন্তায় ডুবে যান। বৃদ্ধার বলা কথাগুলো তাঁর মনে এক নতুন দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে। এতদিন তিনি ভেবেছিলেন শেষ অধ্যায়টি নিছক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার তৈরি অথবা কোনো প্রতিভাবান ছদ্মলেখকের লেখা। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, সমাপ্তিটি আসলে জন্ম নিয়েছে অমলের নিজস্ব কণ্ঠ থেকে—যা ছিল মুখে মুখে, একান্ত ব্যক্তিগত, অথচ কোনোভাবে তা বাস্তব জগতে ছড়িয়ে পড়েছে। প্রশ্ন এখন কেবল একটাই—কে সেই অদৃশ্য শ্রোতা, যে অমলের মুখের সেই শেষ বর্ণনা শোনার পর তা ধরে রাখল এবং প্রকাশ করল? অরিন্দম জানেন, উত্তর খুঁজে না পাওয়া পর্যন্ত এই রহস্য সমাধান অসম্ভব। তিনি বিদায়ের সময় বৃদ্ধার হাত চেপে ধরলেন, চোখে প্রতিশ্রুতির দৃঢ়তা—“আমি সত্যিটা খুঁজে বের করব।” আর বাড়ি ফেরার পথে তাঁর মনে হলো, তিনি যেন এক অচেনা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন, যার ওপারে অমল মুখোপাধ্যায়ের অসমাপ্ত গল্পই নয়, বরং জীবন আর মৃত্যুর সীমান্তে লুকিয়ে থাকা এক গভীর সত্য অপেক্ষা করছে।

দশ

 অরিন্দম বহুদিনের অনুসন্ধান শেষে অবশেষে সত্যের কাছাকাছি পৌঁছান। প্রতিটি সূত্র তাঁকে কখনো প্রযুক্তির পথে, কখনো মানুষের স্মৃতির পথে, আবার কখনো অদৃশ্য রহস্যের অরণ্যে নিয়ে গেছে। কিন্তু এবার সত্য যেন নিজেই উন্মোচিত হতে শুরু করে। উদ্যোক্তাদের মধ্যে একজন, যিনি এতদিন নীরব ছিলেন, হঠাৎ করেই অরিন্দমকে একটি পুরোনো টেপ রেকর্ডার দেখান। ধুলো ধরা যন্ত্রটির ভেতরে এমন কিছু লুকিয়ে আছে যা অমল মুখোপাধ্যায়ের অসমাপ্ত কাহিনীকে চিরকালের জন্য বদলে দেবে। রেকর্ডারটি চালু হতেই কেঁপে ওঠে ঘরের পরিবেশ—স্পষ্ট ভেসে আসে অমলের কণ্ঠস্বর। শ্বাসকষ্টে ভরা, ভাঙা ভাঙা স্বরে তিনি বলছেন, “আমি হয়তো আর লিখতে পারব না… কিন্তু আমার গল্প শেষ হতে পারবে না।” তারপর ধীরে ধীরে তিনি বর্ণনা করতে শুরু করেন তাঁর উপন্যাসের শেষ অধ্যায়। প্রতিটি সংলাপ, প্রতিটি আবেগ, প্রতিটি দৃশ্য তাঁর কণ্ঠে ফুটে উঠতে থাকে। যেন মৃত্যুভয়ের মুহূর্তেও তিনি চেষ্টা করেছেন নিজের সৃষ্টিকে বাঁচিয়ে রাখতে। অরিন্দম স্তব্ধ হয়ে শুনতে থাকেন—এটাই সেই শেষ অধ্যায়, যা এতদিন ধরে তিনি খুঁজছিলেন।

টেপ রেকর্ডারের আবিষ্কার যেন গোটা রহস্যকে নতুন আলোয় দাঁড় করায়। এখন স্পষ্ট হয়ে যায়, অ্যালগরিদম কেবল লেখকের স্টাইল নকল করেনি, বরং এই রেকর্ডিংয়ের শব্দকে প্রাথমিক সূত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে। উদ্যোক্তারা স্বীকার করেন, তাঁরা প্রথমে জানতেনই না যে এই কণ্ঠস্বর অমলের। তাঁরা ভেবেছিলেন এটি কোনো পুরোনো সাক্ষাৎকার বা ডিক্টেশন। তাঁরা সেই শব্দগুলোকে অ্যালগরিদমে প্রবেশ করান, যা পরে তা বিশ্লেষণ করে গড়ে তোলে নিখুঁত সমাপ্তি। কিন্তু বিস্ময় এখানেই—অ্যালগরিদমের তৈরি লেখা ও রেকর্ডিংয়ের কণ্ঠের মধ্যে এমন কিছু অংশ মিলে যায়, যা শুধুমাত্র অমলের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার সঙ্গে সম্পর্কিত, অথচ সেই অভিজ্ঞতার কথা তিনি প্রকাশ্যে কখনো লেখেননি। এর মানে দাঁড়ায়, তিনি মৃত্যুর আগে সচেতনভাবেই শেষ অধ্যায় বলে গিয়েছিলেন, হয়তো আশায় যে তাঁর সৃষ্টির কাহিনী কোনো না কোনোভাবে মানুষের কাছে পৌঁছে যাবে। কিন্তু একই সঙ্গে প্রশ্ন রয়ে যায়—এই রেকর্ডিং কীভাবে উদ্যোক্তাদের হাতে এল? কে বা কারা এতদিন এটি গোপন রেখেছিল?

অরিন্দমের ভেতরে তখন এক দ্বৈত অনুভূতি কাজ করতে থাকে। একদিকে তিনি স্বস্তি পান—অবশেষে রহস্যের উৎস খুঁজে পাওয়া গেছে। অন্যদিকে তাঁর মনে এক অজানা শূন্যতা ভর করে। এটা কি কেবল কাকতালীয়? নাকি অমল মুখোপাধ্যায় সচেতনভাবেই মৃত্যুর আগে নিজের কণ্ঠকে ভবিষ্যতের কাছে অর্পণ করেছিলেন? যদি তাই হয়, তবে তিনি যেন মৃত্যুর সীমারেখা অতিক্রম করে গেছেন, তাঁর গল্প হয়ে উঠেছে অমর। এ ভাবনা অরিন্দমকে শিহরিত করে তোলে। তিনি অনুভব করেন, এ কাহিনী কেবল একটি অসমাপ্ত উপন্যাসের সমাপ্তি নয়—এটি আসলে স্রষ্টা আর সৃষ্টির অমোঘ বন্ধনের প্রতীক। মানুষ মরে যায়, কিন্তু তার বলা গল্প বেঁচে থাকে। হয়তো অমল চেয়েছিলেন তাঁর শেষ নিশ্বাসের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর সৃষ্টি যেন নতুন প্রাণ পায়। অ্যালগরিদম কেবল সেই ইচ্ছাকে বাস্তবের আকারে নিয়ে এসেছে। এই উপলব্ধি অরিন্দমের দৃষ্টিকে আরও গভীর করে তোলে—তিনি বুঝতে পারেন, সাহিত্য কখনোই শুধু কাগজে লেখা থাকে না, তা মানুষের স্মৃতি, কণ্ঠ, এমনকি যন্ত্রের মধ্য দিয়েও নতুন জীবন খুঁজে নেয়।

অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটে এক দার্শনিক প্রশ্নের মধ্য দিয়ে। অরিন্দম রেকর্ডারটি হাতে নিয়ে একা বসে থাকেন। বাইরে তখন রাত নামছে, আকাশে অসংখ্য তারা। তিনি ভাবতে থাকেন—অমল কি সত্যিই কেবল মৃত্যুভয়ে এই শেষ অধ্যায় বলে গিয়েছিলেন, নাকি ইচ্ছাকৃতভাবে ভবিষ্যতের কাছে নিজের কাহিনী সমর্পণ করেছিলেন? তিনি কি চেয়েছিলেন মৃত্যুর পরেও নিজের গল্প অমর হয়ে উঠুক? উত্তর স্পষ্ট নয়, তবে সত্যিটা আজ আর গুরুত্বপূর্ণ নয়। কারণ গল্পটি এখন ছড়িয়ে গেছে পৃথিবীজুড়ে, লাখো পাঠকের হৃদয়ে। হয়তো এটিই লেখকের আসল সাফল্য—নিজের জীবন ফুরিয়ে গেলেও তাঁর সৃষ্টির আলো নিভে যায় না। অরিন্দম জানেন, এই রহস্য চিরকাল থেকে যাবে, হয়তো নতুন নতুন ব্যাখ্যা আসবে, কিন্তু একথা অস্বীকার করা যাবে না যে অমল মুখোপাধ্যায় তাঁর অসমাপ্ত কাহিনীকে মৃত্যুর পরেও অমর করে তুলেছেন। আর সেদিন রাতে আকাশের দিকে তাকিয়ে অরিন্দম অনুভব করেন, শব্দের শক্তি কতটা চিরন্তন—যা সময়, মৃত্যু আর বিস্মৃতির সীমানা ভেঙে মানুষের হৃদয়ে চিরকাল বেঁচে থাকে।

সমাপ্ত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *