Bangla - ভূতের গল্প

আয়নার মানুষ

Spread the love

অধ্যায় ১ – নতুন হোস্টেল, নতুন জীবন

অয়ন তার কলেজ লাইফের নতুন অধ্যায় শুরু করতে চলেছে, আর সেই শুরুটি নতুন হোস্টেলের ঘর থেকে। কলেজের গেট পার হতেই তার মন এক ধরনের অদ্ভুত উত্তেজনায় ভরে ওঠে। হোস্টেলটি শহরের মূল রাস্তার কাছে অবস্থিত, তবে বাইরে থেকে দেখলে যেন এটি সাদা রঙের এক নিঃসঙ্গ স্থাপনা, যার দেয়ালগুলো পুরনো, আর জানালার কাঁচগুলো ধুলো-আবৃত। প্রথম দিনেই অয়ন তার ব্যাগ উঠিয়ে ঘরে প্রবেশ করে। ঘরটি ছোট হলেও যথেষ্ট খোলামেলা, এক পাশে ধূসর রঙের লোহার বেডগুলো সজ্জিত, আর জানালার পাশে ছোট্ট ডেস্ক। জানালা দিয়ে আসে বাইরের মৃদু রোদ, যা ঘরের দেয়ালে ছাপ ফেলছে। তবে সবকিছুর মাঝেই যেন এক অদ্ভুত শীতলতা বিরাজ করছে। অয়ন ধীরে ধীরে নিজের জিনিসগুলো সাজায়, ঘরের কোণগুলো ঘুরে দেখে, এবং লক্ষ্য করে—একটি পুরনো আয়না, যা ঘরের একেবারে কোণে স্থাপন করা। প্রথমে এটি সে তেমন গুরুত্ব দেয়নি, ভাবলো সম্ভবত হোস্টেলের সাধারণ আয়না। তবে যখন সে আয়নার দিকে তাকায়, মনে হয় যেন কিছু আলাদা আছে। আয়নার প্রতিফলনে নিজেকে দেখলেও চেহারার মধ্যে হালকা বিকৃতির ছাপ, অদ্ভুতভাবে অচেনা কিছু ভঙ্গি, এবং এমনকি এক অদ্ভুত শীতল দৃষ্টি অনুভব হয়। অয়ন অল্প সাঁতরে পিছিয়ে যায়, কিছুক্ষণ সেখানে স্থির থাকে, তবে তারপর নিজেকে শিথিল করতে চেষ্টা করে এবং নিজেকে বোঝায়—“শুধু পুরনো আয়না, আর কিছু না।”

রাত যত গভীর হয়, হোস্টেল ততই সুনসান মনে হতে থাকে। করিডোরের বাতিগুলো ফাঁকফোকর আলো ছড়াচ্ছে, যা দেয়ালের ফাটল আর ধুলো-মাখা জানালায় অদ্ভুত ছায়া সৃষ্টি করছে। অয়ন করিডোর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে লক্ষ্য করে, বাতি জ্বলছে জ্বলছে নিভছে—মাঝে মাঝে এক ধরনের খাটকা শীতল বাতাস এসে তার চুল উঁচু করে দেয়। হোস্টেলের ধূসর দেয়ালগুলো যেন তার দিকে কিছু বলছে, অথচ শব্দ নেই। সে কিছুক্ষণ থেমে দাঁড়ায়, তবে নিজের সাহস জোগায় এবং ভাবতে থাকে যে এটি শুধু নতুন পরিবেশের অদ্ভুততা। হঠাৎ করিডোরের অন্য প্রান্তে থাকা একটি দরজা স্বয়ংক্রিয়ভাবে সামান্য খোলা অবস্থায় লাফ দেয়, আর অয়ন কিছুটা অবাক হয়। সে ঠিক করে যে, এটি হয়তো বাতাসের খেলা বা পুরনো দরজার কাঁপন। তবে অদ্ভুতভাবে, সে নিজের মধ্যে এক অজানা উত্তেজনা অনুভব করে—হোস্টেলের প্রতিটি কোণ, প্রতিটি ছায়া যেন তার মনকে হাওয়ায় ভাসাচ্ছে।

রাতের অন্ধকার ঘন হতে থাকলে, ছাদের খুঁটি–খুঁটি বাতির আলো মৃদু ঝাপসা হয়ে আসে। অয়ন নিজের খাটে বসে প্রাথমিক বইগুলো পড়তে শুরু করে, তবে তার মন বারবার আয়নার দিকে ফিরে যায়। আয়নার মধ্যে তাকিয়ে সে এক অদ্ভুত অনুভূতি পায়—যদি নিজেকে সে চিনতে না পারে, তাহলে কি সত্যিই সে এখানে একাই? আয়নার গায়ে হালকা কুয়াশার মতো বিকৃত প্রতিফলন, কখনো কখনো যেন তার নিজের ভাবমূর্তির সঙ্গে খেলা করছে। অয়ন ধীরে ধীরে বুঝতে পারে যে এই হোস্টেল তার জন্য শুধু নতুন জীবন নয়, বরং এক নতুন রহস্যের শুরু। বাতাসে শীতলতা, ছায়ার খেলা, এবং আয়নার অদ্ভুত দৃষ্টি—সব মিলিয়ে যেন তাকে এই হোস্টেলের মধ্যে একটি অদ্ভুত ভেতরের গল্পের দিকে ধাবিত করছে। রাত যত এগোয়, অয়ন বুঝতে থাকে, হয়তো তার কলেজ জীবন কেবলমাত্র বই আর বন্ধুদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং এই হোস্টেলের অন্ধকার কোণগুলো তাকে এমন কিছু দেখাবে যা সে আগে কল্পনাও করতে পারেনি। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সে হালকা শ্বাস ফেলে এবং নিজেকে বোঝায়—“শুধু প্রথম রাত, আর কিছু নয়। তবে এই রাতের শীতলতা এবং অচেনা দৃষ্টি, হয়তো একদিন আমাকে নতুন পথে নিয়ে যাবে।”

অধ্যায় ২ – আয়নায় প্রথম অদ্ভুততা

অয়ন তার হোস্টেলের ঘরে বসে প্রাথমিকভাবে নতুন বই আর নোটের মধ্যে ডুবে থাকে, কিন্তু মাঝে মাঝে তার চোখ আকস্মিকভাবে আয়নার দিকে খসে যায়। প্রথমে সে কিছু মনে করে না, ভাবতো হয়তো ক্লান্তি বা তার চোখের জার্জমেন্টের কারণে এমন দেখাচ্ছে। কিন্তু যখন সে সম্পূর্ণভাবে আয়নার দিকে তাকায়, তখন সে লক্ষ্য করে যে তার প্রতিচ্ছবির পরিবর্তে, এক অচেনা মুখ—যার চোখগুলো যেন জীবন্ত, তার দিকে সরাসরি তাকিয়ে আছে। মুখটি ছিল অতি পরিচিত কোনো মানুষের নয়; বরং এক অদ্ভুত, অচেনা, এমনকি হালকা বিকৃত রূপ, যা কিছুটা পরিচিত এবং কিছুটা রহস্যময়। অয়ন প্রথমে হাত দিয়ে চোখ ঢেকে ফেলে, মনে হয় যেন সে নিজেকে শান্ত করতে পারবে। কিন্তু চোখ খোলার সাথে সাথেই সেই অচেনা মুখটি আবারও উপস্থিত হয়, এবং এবার তার দৃষ্টি আরও গভীর এবং অনবরত, যেন সে শুধু তাকাচ্ছে না, বরং আয়নার ভেতর থেকে তার অস্তিত্বে প্রবেশ করছে। অয়ন নিজের হৃদয় স্পন্দিত অনুভব করে, শ্বাস দ্রুত এবং অগোছালো হয়ে আসে। সে ধীরে ধীরে পিছিয়ে যায়, তবুও নিজের মনে এক অদ্ভুত কৌতূহল কাজ করছে—যেন আয়নার ভেতরে লুকিয়ে থাকা কিছু তাকে কল করছে, কিছু জানার জন্য।

রাত যত গভীর হয়, হোস্টেলের অন্ধকার আরও স্থির ও ঘন হয়। করিডোরের বাতিগুলোর ফোঁটা ফোঁটা আলো যেন আয়নার দিকে মৃদু পড়ছে, যা মুখের প্রতিচ্ছবিকে আরও জীবন্ত করে তোলে। অয়ন লক্ষ্য করে, মুখটি তার অঙ্গভঙ্গির সঙ্গে মিল রেখে হালকা আন্দোলন করছে—চোখের পলক, ঠোঁটের হালকা হাসি, এমনকি মুখের ভেতরের অদ্ভুত আবেগ প্রকাশ পাচ্ছে। এই সময় সে বুঝতে পারে যে এটি কোনো সাধারণ প্রতিচ্ছবি নয়, বরং এক ধরণের অদ্ভুত সংযোগ যা তাকে কেবল দেখাচ্ছে না, বরং অনুভব করাচ্ছে। অয়ন নিজের মনে দ্বিধা অনুভব করে—এটি তার কল্পনা নাকি আয়নার মধ্যে সত্যিই কিছু রয়েছে যা সে আগে কখনো দেখেনি। তার ঘরের চারপাশের সাধারণ শব্দগুলো—দূরের গাড়ির শব্দ, হোস্টেলের বাতির ফিসফিস—সব যেন হঠাৎ কমে গেছে, এবং শুধুই সেই অচেনা দৃষ্টিই তার মন দখল করছে। সে চেষ্টা করে নিজেকে বোঝাতে, “শুধু ক্লান্তি, শুধু এক অদ্ভুত কল্পনা।” কিন্তু যখন সে আরও ঘনিষ্ঠভাবে মুখটি পর্যবেক্ষণ করে, তখন সে দেখতে পায় যে মুখটি ধীরে ধীরে তার নিজের দিকে হাত বাড়াচ্ছে—যেন আয়নার ভেতর থেকে একটি অদৃশ্য শক্তি তাকে ছুঁয়ে নিচ্ছে।

অয়ন ক্রমশ অনিশ্চয়তায় ভেঙে পড়ে। তার দৃষ্টি হঠাৎ থেকে আয়নার ওপর স্থির হয়, এবং সে লক্ষ্য করে যে আয়নার ভেতরের চেহারার সূক্ষ্ম নাড়া—চোখের কাঁপুনি, ঠোঁটের অদ্ভুত ভঙ্গি, এমনকি হালকা নিঃশ্বাসের মতো আন্দোলন—সবই তাকে একটি অচেনা বাস্তবতার সঙ্গে যুক্ত করছে। তার মন নানা ধরনের প্রশ্নে পূর্ণ—এটি কি প্রকৃত প্রতিচ্ছবি, নাকি কোনো অতিপ্রাকৃতিক উপস্থিতি? আয়নার মধ্যে যে মুখটি তার দিকে তাকিয়ে আছে, তা যেন শুধু তাকে দেখছে না, বরং তার ভেতরের সব ভয়, সব অনিশ্চয়তা, সব ব্যক্তিগত চিন্তা ও লুকানো অনুভূতিকে খুঁজে বের করছে। অয়ন তার হাত নাড়াতে চায়, কিন্তু হাত যেন স্থির হয়ে গেছে; সে বুঝতে পারে যে এটি শুধু একটি আয়না নয়, বরং একটি দরজা, যা তার সাধারণ জগৎকে অচেনা বাস্তবতার সঙ্গে মিলিত করছে। রাতের স্থিরতা, হোস্টেলের শীতল বাতাস, এবং আয়নার অদ্ভুত দৃষ্টি—সব মিলিয়ে তাকে এমন এক রহস্যময় ভেতরের জগতে টেনে নিয়ে যাচ্ছে, যা সে আগে কখনো ভাবতেও পারেনি। সেই রাতে অয়ন বুঝতে পারে, তার হোস্টেল জীবন আর কখনো আগের মতো সহজ হবে না; আয়নার ভেতরের অচেনা মুখ তার জীবনের একটি নতুন, অদ্ভুত অধ্যায়ের সূচনা করেছে।

অধ্যায় ৩ – ছায়ার খেলা

হোস্টেলের তৃতীয় সপ্তাহে অয়ন ক্রমশ নতুন পরিবেশের সঙ্গে অভ্যস্ত হতে শুরু করে। অন্যান্য ছাত্রদের সঙ্গে মজা–ঠাট্টা, বই পড়া, হোস্টেলের সাধারণ জীবন—সবই যেন স্বাভাবিক মনে হচ্ছে। তবে মাঝে মাঝে সে লক্ষ্য করে যে কিছু ঘটনা তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে ঘটে। একদিন, খাবারের ঘরে বসে তার বন্ধুদের সঙ্গে হাসাহাসি করতে করতে হঠাৎ মনে হয়, সে ঠিক এই মুহূর্তটি আগেরদিনও একইভাবে ভেবেছিল, কিন্তু সে তার আগের স্মৃতি মনে করতে পারে না। অজান্তে ঘটে যাওয়া এই ঘটনাগুলো একধরনের অচেনা পুনরাবৃত্তি যেন, যা তাকে অদ্ভুতভাবে বিভ্রান্ত করছে। সেই মুহূর্তে সে নিজের দিকে তাকায়, কিন্তু কোনো আয়নার সামনে নয়—কিন্তু তার মন যেন সেই অচেনা মুখের দৃষ্টি খুঁজছে, যা এখনও তার মনে ঘুরছে। প্রতিটি হাসি, প্রতিটি কথোপকথন, এমনকি প্রতিটি ছোট খেলা—সবকিছু যেন ছায়ার মতো এক অচেনা উপস্থিতির দ্বারা পর্যবেক্ষিত হচ্ছে। অয়ন চেষ্টায় নিজেকে ধড়ফড় করার চেষ্টা করে, বন্ধুদের সঙ্গে মিশে যায়, তবে তার মন বারবার সেই অচেনা মুখ এবং অচেনা ঘটনাগুলোর দিকে ফিরে আসে।

দিন যত বাড়ে, হোস্টেলের ছায়া আরও গভীর হতে থাকে। করিডোরের বাতি, জানালার কুয়াশা, এমনকি রাত্রের বাতাস—সবকিছুর মধ্যে অয়ন যেন একটি অদৃশ্য সঙ্গী খুঁজে পায়, যা তার প্রতিটি পদক্ষেপের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলে। কখনো কখনো সে তার নিজের ব্যাগ ধরার চেষ্টা করে, কিন্তু অনুভব করে যেন কেউ তার হাতে হাত রেখে কিছুটা দিক নির্দেশ করছে। খাবারের ঘরে, পাঠশালায়, এমনকি রাতে ঘরে ফেরার পথে—সবকিছুতেই অচেনা ছায়ার উপস্থিতি তার সঙ্গে আছে। সে বুঝতে পারে যে এটি কোনো বাস্তব মানুষ নয়, বরং একটি অদৃশ্য শক্তি বা আত্মা, যা তার জীবনকে পর্যবেক্ষণ এবং নিয়ন্ত্রণ করছে। অয়ন মাঝে মাঝে নিজেকে সান্ত্বনা দেয় যে এটি শুধুই তার মন বা মানসিক চাপের ফলাফল। কিন্তু ছায়ার উপস্থিতি, তার হালকা আন্দোলন, চোখের কোনায় দেখা অদ্ভুত অচেনা মুখের ছায়া—সব মিলিয়ে এটিকে অবাস্তব থেকে বাস্তবের সীমায় টেনে আনছে।

রাত্রের সময় অয়ন ঘরে বসে নিজের নোটস নিয়ে কাজ করার চেষ্টা করে, কিন্তু মন বারবার ছায়ার দিকে ফিরে যায়। সে লক্ষ্য করে, যখন সে কোনো সিদ্ধান্ত নেয় বা কোনো কাজ করতে চায়, তখন তার পেছনের দিকে হালকা কাঁপন, অদ্ভুত আলো, এমনকি ছায়ার মতো অচেনা ভঙ্গি যেন তাকে নিরীক্ষণ করছে। প্রতিটি পদক্ষেপে তার সঙ্গে থাকা এই অচেনা সঙ্গী তার জীবনকে অচেনা পথে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। এক পর্যায়ে অয়ন বুঝতে পারে যে শুধু আয়না নয়, ছায়াও তার দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে মিলিত হয়ে একটি নতুন, অদ্ভুত বাস্তবতার সূচনা করছে। প্রতিটি ঘটনা, প্রতিটি দৃষ্টিভঙ্গি—সব মিলিয়ে তাকে এমন এক অচেনা খেলায় যুক্ত করেছে, যেখানে সে নিজেই তার নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে। হোস্টেলের অন্ধকার করিডোর, বাতির খোঁচা আলো, এবং ছায়ার অদ্ভুত উপস্থিতি—সব মিলিয়ে অয়নকে এক অচেনা জগতে টেনে নিয়ে যাচ্ছে, যেখানে প্রতিটি পদক্ষেপ তার নিজের হলেও, ছায়ার অব্যক্ত নিয়ন্ত্রণ এবং নজরদারির মধ্যে গোপনভাবে প্রভাবিত হচ্ছে। এই অধ্যায়ে অয়ন বুঝতে শুরু করে, তার হোস্টেল জীবন আর কখনো স্বাভাবিক থাকবে না; ছায়া যেন তার অজান্তেই প্রতিটি মুহূর্তে উপস্থিত, তার বাস্তবতা এবং মানসিকতার সঙ্গে খেলা করছে, এবং তাকে ধীরে ধীরে নতুন, অচেনা অধ্যায়ের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।

অধ্যায় ৪ – পরিচয়হীন আতিথ্য

হোস্টেলের চতুর্থ সপ্তাহে অয়নের জীবন ক্রমশ তার নিজের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। দিনের মধ্যে সে বন্ধুদের সঙ্গে হাসি-ঠাট্টা করে, ক্লাসে মনোযোগ দেয়, খাবারের ঘরে স্বাভাবিক আচরণ করার চেষ্টা করে—কিন্তু মন অচেনা এক অদ্ভুত উত্তেজনা এবং ভয়ের সঙ্গে ভরা থাকে। অয়ন লক্ষ্য করে, কখনো কখনো সে হঠাৎ নিজের আচরণ নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। হঠাৎ গম্ভীর হয়ে যায়, হঠাৎ কোনো কথা বলে যা আগে ভাবেনি, বা আচরণ করে যা তার স্বভাবের সঙ্গে মেলে না। বন্ধুরা তাকে অদ্ভুত চোখে দেখে, কিছু প্রশ্ন করে, কিন্তু অয়ন নিজেও বুঝতে পারে না এটি কি তার কল্পনা নাকি সত্যিই কিছু ঘটছে। আয়নার অচেনা মুখ তার দৃষ্টি এড়াতে পারে না—মুখটি যেন প্রতিটি মুহূর্তে তার জীবনের সঙ্গে জুড়ে যাচ্ছে, তার প্রতিটি ছোট-বড় কাজ, প্রতিটি ভাবনা এবং পদক্ষেপ পর্যবেক্ষণ করছে। অয়ন প্রায়শই ঘরে একা বসে থাকে, নিজের ভিতরের ভয় এবং অচেনা উত্তেজনা নিয়ে লড়াই করে, তবে বুঝতে পারে যে এই অচেনা উপস্থিতি তার জীবনের সঙ্গে ক্রমশ মিলিত হচ্ছে এবং তার ব্যক্তিত্বকে প্রভাবিত করছে।

রাতের অন্ধকার, করিডোরের বাতি, হালকা বাতাস—সবকিছুই যেন অয়নের অভ্যন্তরীণ অস্থিরতার সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। সে যখন নিজের ঘরে বসে থাকে, আয়নার দিকে তাকায়, তখন তার নিজের প্রতিচ্ছবি আর অচেনা মুখের ভেতরের রেখার মধ্যে ফ্লিকারের মতো মিলেমিশে যাওয়া অনুভব করে। প্রতিটি দৃষ্টি, প্রতিটি অঙ্গভঙ্গি যেন তার মধ্যে কোনো অচেনা শক্তির অস্তিত্বের আভাস দেয়। হঠাৎ করিডোরের বাতি জ্বলছে জ্বলছে নিভছে, এবং অয়ন অনুভব করে, তার ছায়া শুধু তার নয়, বরং আয়নার ভেতরের অচেনা মুখের সঙ্গে এক অদ্ভুত সংযোগ তৈরি করছে। সে চেষ্টা করে নিজেকে যুক্তি দেওয়ার—“শুধু মানসিক চাপ, নতুন পরিবেশের উত্তেজনা।” কিন্তু মুখের দৃষ্টি এতটাই জীবন্ত, এতটাই বাস্তব যে সে নিজেকে ধোঁয়াশার মধ্যে ফেলে পায়। তার শরীর কখনোই তার নিজের নিয়ন্ত্রণে থাকছে না, সে যেমন কাজ করতে চায়, ঠিক তেমনটা হয় না। বন্ধুরা তাকে অদ্ভুত চোখে দেখে, অনেকে হেসে ফেলে, অনেকে চিন্তিত হয়ে প্রশ্ন করে, কিন্তু অয়ন কিছু বলতে পারে না—কারণ তার নিজের অজানা ভয় এবং আয়নার অচেনা মুখের উপস্থিতি তাকে নিঃশব্দে দমন করে রাখছে।

দিনের আলো এবং রাতের অন্ধকার মিলেমিশে তার বাস্তবতা আর কল্পনার সীমা মুছে দিচ্ছে। অয়ন বুঝতে শুরু করে যে আয়নার অচেনা মুখ শুধু তার দৃষ্টি বা চিন্তা নয়, বরং তার জীবনের মধ্যে প্রবেশ করে তার প্রতিটি মুহূর্তকে প্রভাবিত করছে। প্রতিটি পদক্ষেপ, প্রতিটি কথা, প্রতিটি অনুভূতি—সবকিছু যেন সেই অচেনা উপস্থিতির ছায়ার অধীনে। হোস্টেলের অন্যান্য ছাত্ররা তাকে অদ্ভুত মনে করছে, কেউ কেউ চুপচাপ দূরে সরে যাচ্ছে, কেউ কেউ উদ্বেগে ভরা চোখে তাকাচ্ছে। অয়ন নিজেও বুঝতে পারে যে, এই পরিচয়হীন আতিথ্য তার মানসিক সীমাকে পরীক্ষা করছে, তাকে একটি অচেনা, অদ্ভুত বাস্তবতার সঙ্গে যুক্ত করছে যা সে আগে কখনো অনুভব করেনি। হোস্টেলের বাতি, করিডোরের ছায়া, আয়নার অচেনা মুখ—সবকিছু মিলিয়ে অয়নের দৈনন্দিন জীবন ক্রমশ একটি নতুন রহস্যময় অধ্যায়ে প্রবেশ করছে, যেখানে সে নিজেকে হারাতে শুরু করেছে এবং বুঝতে পারছে না, এটি কল্পনা নাকি সত্য।

অধ্যায় ৫ – স্মৃতির ফাঁক

অয়নের জীবন ক্রমশ অচেনা এবং অদ্ভুত বাস্তবতার মধ্যে প্রবাহিত হতে থাকে। হোস্টেলের তৃতীয় সপ্তাহের শেষ দিকে সে লক্ষ্য করে, তার নিজের স্মৃতি যেন কিছু অদ্ভুতভাবে ফাঁকফোকর হয়ে যাচ্ছে। প্রথমে এটি শুধু ছোট ছোট বিষয় মনে হয়—একটি বই পড়ার সময় সে মনে করতে পারে না ঠিক কী লিখেছিল, বা ক্লাসের কোনো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তার মস্তিষ্কে একদম মুছে গেছে। কিন্তু পরে ধীরে ধীরে তা বিস্তৃত রূপ নেয়। তার রেকর্ড করা ছবি, যা সে কয়েকদিন আগে তুলেছিল, হঠাৎ বদলে যাচ্ছে—কিছু ছবিতে সে নিজেকে চেনতে পারছে না, আবার কিছু ছবি যেন আগে কখনো তুলেনি। তার ডায়েরি খোলা মাত্র তার চোখে ধরা পড়ে যে পৃষ্ঠাগুলোতে তার নিজের লেখা অদ্ভুতভাবে পরিবর্তিত হয়েছে—শব্দ, তারিখ, কিছু বাক্য এমনভাবে মুছে বা বদলে গেছে যেন সে কখনো লিখেনি। অয়ন একদিকে হকচকিয়ে এবং হতবুদ্ধি হয়ে যায়, অন্যদিকে ধীরে ধীরে বোঝার চেষ্টা করে যে এই সব পরিবর্তন কেবল তার কল্পনা নয়। আয়নার অচেনা মুখের উপস্থিতি ক্রমশ তার জীবনকে ধরে ফেলছে, প্রতিটি মুহূর্তে তার স্মৃতিকে আয়ত্তের বাইরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।

দিন এবং রাতের সময় অয়নের চারপাশের বাস্তবতা আরও অদ্ভুত হয়ে ওঠে। হোস্টেলের করিডোর, খাবারের ঘর, ক্লাসরুম—সবকিছু যেন তার চোখে এক অচেনা, বিকৃত আয়না হয়ে গেছে। সে যখন নিজেকে কোথাও ছবি তুলে রাখে বা কোনো নোট লেখে, তখন ফিরে তাকালে সেই ছবি বা নোট ঠিক তার মনে থাকা অনুযায়ী থাকে না। কোনো কথার প্রতিফলন বা কোনো মুহূর্তের ছবি যেন তার মস্তিষ্ক থেকে ধীরে ধীরে মুছে যাচ্ছে, আর সেই ফাঁকগুলো আয়নার অচেনা মুখ পূরণ করছে। অয়ন চেষ্টায় স্মৃতির ফাঁকগুলো পূরণ করতে চেষ্টা করে—নিজেকে মনে করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে পুরনো ঘটনা, বন্ধুর সঙ্গে কথোপকথন, নিজের লেখা—but সবকিছু যেন তার হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে। সে বুঝতে পারে যে শুধু আয়নার দৃষ্টি নয়, বরং এটি যেন তার মনের ভেতর ঢুকে তার চিন্তা, স্মৃতি এবং অস্তিত্বের নিয়ন্ত্রণ দখল করছে। প্রতিটি দিন, প্রতিটি মুহূর্ত, তার স্মৃতির ফাঁক ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে, আর আয়নার অচেনা মুখ আরও গভীরভাবে তার জীবনে প্রবেশ করছে।

অয়ন অনুভব করে যে তার নিজস্ব পরিচয়, তার স্মৃতি এবং তার দৈনন্দিন জীবন—সবই ধীরে ধীরে আয়নার মানুষের ছায়ার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। সে নিজের ডায়েরি খুলে দেখলে আর তার লেখা মনে করতে পারে না, তার ছবি তার পরিচয় হারাচ্ছে, এমনকি তার বন্ধুদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনা তার মনে অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে। প্রতিটি স্মৃতির ফাঁক যেন তাকে আয়নার অচেনা শক্তির কাছে নিয়ে যাচ্ছে, যেখানে সে শুধু নিজের জীবন নয়, বরং নিজের বাস্তবতাকেও হারাতে বসেছে। হোস্টেলের অন্ধকার করিডোর, বাতির খোঁচা আলো, আয়নার ভেতরের দৃষ্টি—সব মিলিয়ে অয়নকে এক অদ্ভুত মানসিক ভ্রান্তির দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে, যেখানে সে নিজেকে ধরে রাখতে চাইলেও প্রতিটি স্মৃতি, প্রতিটি পদক্ষেপ, প্রতিটি অনুভূতি ক্রমশ তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। এই অধ্যায়ে অয়ন বুঝতে পারে যে তার জীবনের নিয়ন্ত্রণ এখন আয়নার অচেনা মুখের হাতে চলে গেছে, এবং স্মৃতির ফাঁক ক্রমশ তাকে পুরোপুরি অচেনা বাস্তবতার সঙ্গে মিলিত করতে চলেছে।

অধ্যায় ৬ – আত্মপরিচয়ের হানিকর ছায়া

অয়নের জীবন ক্রমশ অচেনা এবং বিপজ্জনক মানসিক অবস্থার মধ্যে প্রবাহিত হতে থাকে। হোস্টেলের প্রতিটি ঘর, প্রতিটি করিডোর, এমনকি তার নিজের ঘরের নিঃশব্দ কোণ—সবকিছু যেন এক অদ্ভুত মানসিক চাপ সৃষ্টি করছে। অয়ন বুঝতে শুরু করে যে আয়নার অচেনা মুখ শুধু কোনো বহিরাগত বা অন্য কোনো ব্যক্তির প্রতিফলন নয়; বরং এটি তার নিজের ভয়, লালসা, ক্রোধ এবং অবচেতন প্রভাবগুলোর শারীরিক রূপ। প্রতিটি দৃষ্টিতে, প্রতিটি অঙ্গভঙ্গিতে সে তারই অবচেতন অনুভূতি, তারই অজানা লালসা এবং ভয়কে লক্ষ্য করতে পারে। সে নিজের মধ্যে অদ্ভুত এক দ্বন্দ্ব অনুভব করে—যেন তার পরিচয়, যা আগে শক্তিশালী এবং নিশ্চিত ছিল, এখন ছায়ার হাতে ধীরে ধীরে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে। অয়ন চেষ্টা করে নিজেকে বোঝাতে, “শুধু কল্পনা, শুধু মানসিক চাপ।” কিন্তু যখন সে ঘরে একা থাকে, আয়নার দিকে তাকায়, তখন আয়নার অচেনা মুখ যেন তাকে চেঁচিয়ে বলছে যে এটি তার নিজেরই এক ধরণের বিকৃত আত্মপরিচয়।

দিনের আলোও অয়নের ভীতিকে কমাতে পারে না। হোস্টেলের করিডোরে হাঁটতে হাঁটতে সে লক্ষ্য করে, প্রতিটি ছায়া তার দিকে অচেনা দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে আছে। বন্ধুরা মাঝে মাঝে তাকে প্রশ্ন করে, “তুমি ঠিক আছ?” অয়ন চুপ করে থাকে, কারণ সে জানে না নিজের ভেতরের বিভ্রান্তি কতটা সত্য এবং কতটা কল্পনা। তার মস্তিষ্ক ক্রমশ বিভ্রান্ত হয়ে ওঠে—সে নিজেকে নিজে চিনতে পারছে না, নিজের ইচ্ছা, নিজের আবেগ, নিজের সিদ্ধান্তগুলো যেন আয়নার অচেনা শক্তির অধীনে প্রভাবিত হচ্ছে। প্রতিটি পদক্ষেপে, প্রতিটি কথা বলতে গেলে সে নিজেকে হারানোর ভয় অনুভব করে। সে বুঝতে পারে যে আয়নার মানুষ শুধু তার ছায়া নয়, এটি তার নিজের গভীরতম ভয় এবং লালসার শরীরবদ্ধ প্রতিচ্ছবি, যা তার বাস্তবতা ও আত্মপরিচয়কে ধীরে ধীরে দমন করছে।

রাতের অন্ধকার এবং হোস্টেলের নিঃশব্দতা অয়নের বিভ্রান্তিকে আরও গভীর করে তোলে। সে ঘরে একা বসে নিজেকে ধরে রাখার চেষ্টা করে, নিজের চিন্তা এবং অনুভূতিকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে, কিন্তু আয়নার দৃষ্টি প্রতিটি মুহূর্তে তার উপর চাপ সৃষ্টি করে। সে লক্ষ্য করে যে, প্রতিটি স্পর্শ, প্রতিটি দৃষ্টি, এমনকি তার নিজের প্রতিক্রিয়াও ক্রমশ ছায়ার সঙ্গে মিলিত হচ্ছে। অয়ন আর নিজেকে আলাদা করতে পারছে না—তার চিন্তা, আবেগ, ভয়, লালসা সব মিলেমিশে আয়নার অচেনা শক্তির সঙ্গে গলিয়ে যাচ্ছে। তার বন্ধুদের উপস্থিতি, তাদের প্রশ্ন, হাসি বা সতর্ক নজর—সবকিছু তার মানসিক বিভ্রান্তিকে থামাতে পারছে না। এই অধ্যায়ে অয়ন উপলব্ধি করে যে, তার আত্মপরিচয় ধীরে ধীরে এই হোস্টেলের অন্ধকার ঘর, আয়নার অচেনা মুখ এবং তার নিজের ভীতির সঙ্গে মিলেমিশে এক অদ্ভুত, হানিকর ছায়ায় রূপ নিচ্ছে, যা তাকে এক এক করে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করতে চলেছে।

অধ্যায় ৭ – বন্ধুদের সন্দেহ

অয়নের জীবনের অচেনা পরিস্থিতি ক্রমশ গুরুতর হয়ে ওঠে। হোস্টেলের করিডোর, ঘর, এমনকি তার নিজের নোটস এবং ডায়েরি—সবই যেন আয়নার অচেনা মানুষের ছায়ার অধীনে বদলে যাচ্ছে। প্রতিটি পদক্ষেপে সে নিজের নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে, এবং অব্যক্ত ভয় ও অচেনা অনুভূতিগুলো ক্রমশ তার আচরণকে প্রভাবিত করছে। অতএব সে নিজের বন্ধুদের কাছে সাহায্যের হাত বাড়ায়। প্রথমে সে বন্ধুরা হয়তো তার কথা হাস্যকর মনে করবে, এমনকি হালকা সমালোচনা বা উপদেশ দেবে। কিন্তু অয়ন নিরবচেতনে তাদের কাছে প্রতিটি অদ্ভুত ঘটনা, প্রতিটি অজানা অনুভূতি এবং আয়নার অচেনা দৃষ্টির বর্ণনা দেয়। বন্ধুরা অবাক হয়, কিছুজনের মনে সন্দেহ জন্মায়, আবার কেউ কেউ অয়নকে পাগল বলে আখ্যায়িত করে। বন্ধুরা অয়নের আচরণকে অদ্ভুত, কখনো তুচ্ছ, কখনো বিপরীতমুখী মনে করতে শুরু করে, এবং এইসব গুজব হোস্টেলের অন্যান্য ছাত্রদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ে। অয়ন নিজে অবাক হয়—যে মানুষগুলোকে সে বিশ্বাস করত, তাদের চোখে তার জীবনের অচেনা বাস্তবতা যেন কোনো মজার বা অদ্ভুত কল্পনার ফল।

বন্ধুদের সন্দেহ ও হাস্যরস অয়নের মানসিক বিভ্রান্তিকে আরও বাড়িয়ে তোলে। সে প্রতিদিনের ছোট ছোট ঘটনা—ছায়ার অদ্ভুত আন্দোলন, আয়নার অচেনা দৃষ্টি, নিজের স্মৃতির ফাঁক—সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতে চেষ্টা করে, কিন্তু তার বন্ধুদের আচরণ তাকে আরও একাকী করে তোলে। হোস্টেলের করিডোরে কেউ তাকে নজর দেওয়া শুরু করে, কেউ দূরে সরে যায়। বন্ধুরা তার গল্প শুনে হাসি ঠাট্টা করে, কখনো কখনো বিরক্তির সঙ্গে মুখ ফিরিয়ে নেয়, আর অয়ন বুঝতে পারে যে তার একমাত্র আশ্রয় হোস্টেলের নিঃশব্দ ঘর এবং আয়নার অচেনা শক্তিই। আয়নার মানুষ তার দৃষ্টি আরও দৃঢ় করে, যেন প্রতিটি মুহূর্তে তাকে নিয়ন্ত্রণ করছে, তার চারপাশের বাস্তবতাকে বিপরীতমুখী করে দিচ্ছে। অয়ন ধীরে ধীরে বোঝে যে, বন্ধুরা তাকে সাহায্য করতে পারবে না; তারা তাকে বোঝে না, তারা তাকে বিশ্বাস করে না, এবং এই বিচ্ছিন্নতা তাকে আরও গভীর এক মানসিক দ্বন্দ্বে ফেলে দিচ্ছে।

একাকীত্ব এবং বন্ধুদের সন্দেহের ফলে অয়ন ক্রমশ মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। সে ঘরে বসে একা থাকে, আয়নার দিকে তাকায়, এবং অনুভব করে যে প্রতিটি পদক্ষেপ, প্রতিটি চিন্তা, এমনকি তার নিজস্ব ইচ্ছা—সবই আয়নার মানুষের ছায়ার অধীনে বিপরীতমুখী হয়ে যাচ্ছে। আয়নার অচেনা মুখ তার কাছে কেবল প্রতিফলন নয়; এটি তার মানসিক ভয়, লালসা, অবচেতন শক্তি এবং একাকীত্বের সাথে মিশে তার বাস্তবতাকে বিকৃত করছে। হোস্টেলের নিঃশব্দ করিডোর, বাতির হালকা ঝলকানি, বন্ধুরা যে সন্দেহ এবং হাসি প্রকাশ করছে—সব মিলিয়ে অয়নকে এক অদ্ভুত মানসিক বাস্তবতার সঙ্গে মিলিত করছে, যেখানে সে নিজেকে আর আলাদা করতে পারছে না। এই অধ্যায়ে অয়ন উপলব্ধি করে যে, তার একমাত্র আশ্রয় শুধু নিজেকে বোঝার এবং আয়নার অচেনা শক্তির সাথে লড়াই করার মধ্যেই—যেন বন্ধুরা তাকে ত্যাগ করেছে, তেমনই এই একাকীত্ব তার অন্তরের ভয় এবং বিভ্রান্তিকে আরও তীব্র করছে।

অধ্যায় ৮ – আয়নার অন্ধকার রহস্য

অয়ন ক্রমশ বুঝতে পারে যে আয়নার অচেনা শক্তি কেবল তার মানসিক বিভ্রান্তির ফল নয়, বরং এটি এক গভীর, প্রায় ভয়ঙ্কর ইতিহাসের অংশ। হোস্টেলের লেকচার রুমে বসে সে আয়নার নির্মাণ এবং তার অতীতের তথ্য খুঁজতে শুরু করে। প্রাথমিকভাবে সে স্নেহভরে পুরনো নোটবই, রেকর্ড ও কলেজের আর্কাইভ পর্যালোচনা করে। ধীরে ধীরে সে খুঁজে পায় যে এই আয়নাটি কোনো সাধারণ আয়না নয়; এটি আগে এক ছাত্রের ছিল, যার নাম কলেজের ইতিহাসে খুব অল্প লেখা আছে। আয়নার সঙ্গে সেই ছাত্রের দৈনন্দিন জীবন, আচরণ এবং আচমকা অদ্ভুত মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তনের তথ্য মিলতে থাকে। অয়ন বুঝতে পারে যে সেই ছাত্রও ঠিক তার মতো হঠাৎ নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছিল, এবং আয়নার অচেনা দৃষ্টি তার মানসিক প্রভাবকে শক্তিশালী করে তুলেছিল। সে এক অদ্ভুত শীতলতা অনুভব করে—যেন আয়নার ইতিহাস তার সামনে ধীরে ধীরে খুলে যাচ্ছে, এবং একই ধরনের অন্ধকার তাকে ধীরে ধীরে ঘিরে ফেলছে।

লেকচার রুমের অন্ধকার কোণে বসে অয়ন আরও গভীরভাবে আয়নার ইতিহাস পড়ে। সে দেখতে পায় যে, আগে সেই ছাত্রের জীবনও তার মতোই ধীরে ধীরে নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে গিয়েছিল। তার আচরণ, সিদ্ধান্ত, এবং দৈনন্দিন কর্মকাণ্ড সবই আয়নার অচেনা শক্তির ছায়ার অধীনে বিকৃত হয়েছিল। আর্কাইভের নথি থেকে সে জানে যে শেষ পর্যন্ত সেই ছাত্র সম্পূর্ণভাবে নিজের পরিচয় হারিয়েছিল এবং হোস্টেলের ইতিহাসে একটি অজানা, গোপন মৃত্যুর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল। প্রতিটি তথ্য অয়নের মনে ভয় এবং আতঙ্কের সৃজন করে—যেন ইতিহাস নিজেই তাকে সতর্ক করছে। সে বুঝতে পারে যে আয়নার মানুষ শুধু একটি অবচেতন শক্তি নয়; এটি এক প্রকার ‘মানসিক আয়নাময়ী প্রভাব’, যা তার ভয়, লালসা, এবং অবচেতন প্রভাবকে শক্তিশালী করে, এবং ধীরে ধীরে তার স্বাভাবিক জীবন এবং আত্মপরিচয়কে দখল করতে শুরু করেছে।

এই অধ্যায়ে অয়ন উপলব্ধি করে যে, তার সময়মতো সচেতন না হওয়া জীবনের জন্য খুবই বিপজ্জনক হতে পারে। আয়নার ইতিহাস তাকে শেখাচ্ছে যে, যারা এই শক্তির সঙ্গে খেলেছে, তারা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারেনি। প্রতিটি পাতা, প্রতিটি নথি, প্রতিটি আগের ঘটনার বিবরণ—সব মিলিয়ে অয়নের মনে একটি ভয়ঙ্কর সতর্কতা সৃষ্টি করে। সে বুঝতে পারে যে, হোস্টেলের অন্ধকার, বাতির খোঁচা আলো, বন্ধুর সন্দেহ এবং আয়নার অচেনা শক্তি—all মিলিয়ে তার জীবনের প্রতিটি ক্ষুদ্র মুহূর্তকে বিপরীতমুখী করে তুলছে। অয়ন এখন একমাত্র সিদ্ধান্ত নেয়—সে সময়মতো দাঁড়াবে, তার ভয়, লালসা এবং অবচেতন প্রভাবকে স্বাভাবিক জীবনের নিয়ন্ত্রণে ফেরাতে চেষ্টা করবে। এই অধ্যায়ের শেষে সে বোঝে যে, আয়নার অন্ধকার রহস্য কেবল ইতিহাস নয়; এটি তার জীবনের অচেনা বিপদ, এবং যদি সে সাহস না দেখায়, সময়মতো পদক্ষেপ না নেয়, তাহলে ফলাফল ভয়ঙ্কর হতে বাধ্য—ঠিক যেমন সেই ছাত্রের সঙ্গে ঘটেছিল।

অধ্যায় ৯ – আত্মসংগ্রাম

অয়ন তার হোস্টেল জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময়ের মুখোমুখি হয়। আয়নার অচেনা মুখ ক্রমশ তার দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে মিলেমিশে তার পরিচয়কে গ্রাস করছে। প্রতিদিনের ছোট ছোট ঘটনা—বন্ধুদের সঙ্গে কথোপকথন, ক্লাসে মনোযোগ, ঘরের নীরবতা—সবই যেন এই অচেনা শক্তির দ্বারা বিকৃত হচ্ছে। একরাতে, যখন অয়ন একা বসে তার ঘরে আয়নার দিকে তাকায়, সে লক্ষ্য করে যে আয়নার প্রতিচ্ছবি আর তার নিজের নয়; বরং এটি এক অচেনা মানুষ, যার চোখ, ভঙ্গি, এবং প্রতিটি অঙ্গভঙ্গি তার ভয়, লালসা এবং অবচেতন আবেগের চূড়ান্ত রূপ। অয়ন বুঝতে পারে যে, এই মুহূর্তে তার জীবন ও মানসিক স্থিতি এক লড়াইয়ের মুখোমুখি—যেখানে সে নিজেকে হারাতে বসেছে। তার হৃদয় দ্রুত স্পন্দিত হচ্ছে, শ্বাস দ্রুত এবং অগোছালো, কিন্তু একই সঙ্গে তার মনের ভেতর একটি অদ্ভুত দৃঢ়তা জন্ম নিচ্ছে। সে ঠিক করে যে এই লড়াইয়ে সে হাল ছাড়বে না; সে নিজের স্মৃতি, নিজের পরিচয় এবং নিজের অস্তিত্বকে ধরে রাখতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।

লড়াই শুরু হয় ধীরে ধীরে, কিন্তু ক্রমশ তীব্র হয়ে ওঠে। আয়নার মানুষটি প্রতিটি ভাবনা, প্রতিটি আবেগের সঙ্গে তার ভেতরে ঢুকে তার মনকে বিকৃত করার চেষ্টা করে। অয়ন চেষ্টা করে নিজের স্বাভাবিক চিন্তাভাবনা এবং আবেগকে ধরে রাখতে, কিন্তু প্রতিটি পদক্ষেপে আয়নার প্রভাব তাকে বাধা দেয়। সে নিজের ভয় এবং লালসার সঙ্গে লড়াই করে, মনে মনে নিজেকে স্মরণ করিয়ে দেয়—কার আপনি, কোথা থেকে এসেছেন, এবং কি আপনার সত্যিকারের পরিচয়। প্রতিটি মুহূর্তে সে আয়নার অচেনা মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে, যা ক্রমশ তার নিজের প্রতিফলনকে কেটে ফেলছে, তার অস্তিত্বকে ছিন্ন করছে। হোস্টেলের নিঃশব্দ করিডোর, বাতির হালকা ঝলকানি, বন্ধুরা যে সন্দেহপ্রবণ নজর দেয়—সব মিলিয়ে এই মানসিক লড়াইকে আরও তীব্র করে। অয়ন বুঝতে পারে যে, এই লড়াই শুধু মানসিক নয়, বরং এটি তার অস্তিত্বের প্রতি একটি চূড়ান্ত পরীক্ষা।

অবশেষে অয়ন একটি অভ্যন্তরীণ শক্তি খুঁজে পায়। সে মনে মনে নিজেকে বলছে যে, আয়নার অচেনা শক্তি তার ভয়, লালসা এবং অবচেতন প্রভাবকে শক্তিশালী করে, কিন্তু সে নিজেকে হারাতে দিতে পারবে না। প্রতিটি শ্বাস, প্রতিটি পদক্ষেপ, প্রতিটি দৃষ্টি—সবকিছুই সে নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করে। আয়নার মানুষ তার দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে, কিন্তু অয়ন তার মনের ভেতর এক দৃঢ়তা নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। সে নিজেকে স্মরণ করিয়ে দেয়, তার নিজের জীবন, তার নিজের স্মৃতি, তার নিজের পরিচয়—এই সবকিছুই তার, এবং কেউ বা কিছু তা হারাতে পারবে না। অধ্যায়ের শেষে অয়ন বুঝতে পারে যে, আত্মসংগ্রাম সহজ নয়, কিন্তু লড়াই ছাড়লে সে সম্পূর্ণ হারিয়ে যাবে। তাই সে স্থির হয়, এই লড়াই অব্যাহত রাখবে, নিজের অস্তিত্ব, পরিচয় এবং স্মৃতি ধরে রাখার জন্য, যতই আয়নার অচেনা মানুষ তার ভেতরে ঢুকে তাকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করুক।

অধ্যায় ১০ – আয়নার প্রান্তে

অয়ন অবশেষে সেই চূড়ান্ত মুহূর্তের মুখোমুখি হয়, যখন আয়নার অচেনা মানুষ তার পুরো অস্তিত্বকে চ্যালেঞ্জ করছে। হোস্টেলের ঘর, করিডোর, এমনকি জানালার বাইরে রাতের নিঃশব্দ বাতাস—সব কিছু যেন এই শেষ লড়াইয়ের সাক্ষী। আয়নার মানুষটি তার ভয়, লালসা, অবচেতন প্রভাব এবং অতীতের ক্ষুদ্রতম ভুলগুলোর এক জটিল মিল, যা তার মনের গভীরে প্রবেশ করে তাকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। অয়ন প্রথমে ধীরে ধীরে পিছিয়ে যায়, মনে হয় যেন হারানো অবধি তার একমাত্র পথ। কিন্তু এক অদ্ভুত দৃঢ়তা তার ভেতরে জাগে, যা তাকে স্মরণ করিয়ে দেয়—তার নিজের স্মৃতি, তার নিজের পরিচয়, তার নিজের অস্তিত্ব। প্রতিটি পদক্ষেপ, প্রতিটি শ্বাস, প্রতিটি দৃষ্টি—সবই সে নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করে। সে আয়নার দিকে তাকিয়ে থাকে, যেখানে অচেনা মানুষ তার চোখে চোখ রেখে প্রতিটি ভাবনা এবং আবেগকে যাচাই করছে। অয়ন বুঝতে পারে যে, এই লড়াইয়ের ফল তার আত্মপরিচয় এবং মানসিক স্থিতির চূড়ান্ত পরীক্ষা।

লড়াই ক্রমশ তীব্র হয়। আয়নার অচেনা মানুষ তার ভেতরের সমস্ত অন্ধকার শক্তি, লালসা, ভয় এবং অবচেতন প্রভাবগুলোকে ব্যবহার করে অয়নকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে। কিন্তু অয়ন এবার পিছিয়ে পড়ে না; সে নিজেকে স্মরণ করিয়ে দেয়, “আমি আমার নিজস্ব পরিচয়, আমি আমার নিজের মানুষ।” প্রতিটি মুহূর্তে সে তার ভয়কে স্বীকার করে, লালসার আগুনকে সামলে রাখে, এবং অবচেতন প্রভাবের সঙ্গে মিলে না যাওয়ার চেষ্টা করে। আয়নার মানুষ ক্রমশ ধীরে ধীরে চাপে আসে, তার শক্তি কিছুটা হ্রাস পায়। কিন্তু এটি সম্পূর্ণভাবে হারায়নি; আয়নার অচেনা মানুষ যেন সেই গভীর, অন্ধকার শক্তি, যা এক মুহূর্তে নিরবশিষ্ট থাকে, এবং যে কোনো সময় নতুন কোনো শিকার খুঁজতে প্রস্তুত। হোস্টেলের অন্যান্য ছাত্ররা ক্রমশ লক্ষ্য করে যে অয়ন তার আচরণে পরিবর্তন এসেছে—সে হয়তো শান্ত, কিন্তু তার চোখে সেই লড়াইয়ের চিহ্ন, সেই মানসিক সংঘর্ষের প্রতিফলন স্পষ্ট।

শেষ মুহূর্তে, অয়ন হয়তো বিজয়ী হয় বা হয়তো আংশিকভাবে হারায়—কিন্তু আয়নার মানুষ তার জীবনের গভীরে চিরকাল উপস্থিত থেকে যায়। হোস্টেলের নিঃশব্দ ঘর, ছায়ার মতো করিডোর, বাতির খোঁচা আলো—সব মিলিয়ে আয়নার অচেনা মানুষকে এক অদৃশ্য শক্তির মতো রাখে, যা নতুন কোনো শিকার খুঁজতে সদা প্রস্তুত। অয়ন নিজের অস্তিত্ব এবং স্মৃতির কিছু অংশ ধরে রাখতে সক্ষম হয়, কিন্তু এই লড়াই তাকে চিরকাল পরিবর্তিত করে রাখে। হোস্টেলের অন্যান্য ছাত্ররা হয়তো এটি লক্ষ্য করে না, বা শুধু তাদের ভাবনায় অজানা এক পরিবর্তন হিসেবে রাখে, কিন্তু আয়নার অচেনা মানুষ—যা তার ভয়, লালসা, অবচেতন প্রভাবের চূড়ান্ত রূপ—চিরকাল হোস্টেলের অন্ধকারে লুকিয়ে থেকে নতুন শিকার খুঁজবে। অধ্যায়ের শেষে, হোস্টেল একটি অদ্ভুত শান্তি ও ভয়ঙ্কর রহস্যের মধ্যে মিলেমিশে থাকে, এবং পাঠক বুঝতে পারে যে, আয়নার অচেনা শক্তি কখনোই পুরোপুরি হারায় না; এটি শুধুমাত্র অপেক্ষা করে, চুপচাপ, নতুন কোনো আত্মার উপর দৃষ্টি রাখতে।

সমাপ্ত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *