অম্বরীশ সেন
অচেনা সকালের শহর—এ যেন এক অনন্ত মরীচিকা, যেখানে প্রতিটি দিন শুরু হয় সম্পূর্ণ নতুন এক জগৎ নিয়ে। আরিয়ানের ঘুম ভাঙতেই জানালার বাইরে যে দৃশ্য ধরা পড়ে, তা কখনোই আগের দিনের সঙ্গে মেলে না। কখনো দেখা যায় রাস্তার দুই ধারে গজিয়ে উঠেছে অচেনা ভবন, আবার কখনো আগের দিনের চেনা পার্কের জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে বিশাল কাঁচের টাওয়ার। ফুটপাতের রঙিন পাথর রাতারাতি বদলে গেছে, ট্রাফিক সিগন্যালের স্থানে হঠাৎ দেখা যায় একটি হোলোগ্রাফিক স্ক্রিন, যা শহরের নতুন মানচিত্র দেখাচ্ছে। এমনকি আকাশের রঙও যেন প্রতিদিনের সকালকে আলাদা করে তুলতে চায়—কখনো হালকা বেগুনি, কখনো সোনালি, আবার কখনো অদ্ভুত নীলচে ধূসর। আরিয়ান প্রথমে ভাবে এটা হয়তো শহুরে উন্নয়নের দ্রুততা, বা সর্বাধুনিক প্রযুক্তির জাদু। ডিজিটাল বিলবোর্ড, ভিআর বিজ্ঞাপন কিংবা রাতারাতি নির্মাণকাজের বিস্ময় বলেই সে নিজেকে বুঝিয়ে দেয়। কিন্তু তার মনের গভীরে এক অদৃশ্য কৌতূহল প্রতিদিন একটু একটু করে শিকড় গাঁথতে থাকে। কেন এত দ্রুত বদলে যায় সবকিছু? কে বা কারা এই পরিবর্তনের নেপথ্যে কাজ করছে?
কিন্তু সবচেয়ে অস্বস্তিকর সত্যি ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয় যখন আরিয়ান লক্ষ্য করে, শুধু শহরের কাঠামোই নয়—মানুষের মুখও বদলে যাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী, পাশের দোকানের মালিক কিংবা রাস্তায় দেখা হওয়া কাকু—প্রতিদিনই তারা একই রকম অথচ অদ্ভুতভাবে আলাদা। কারও চোখের রঙ বদলে যায়, কারও চুলের ছাঁট, কারও কণ্ঠস্বরের টোন। অথচ কেউই যেন নিজের এই পরিবর্তন টের পায় না। আজ যে বন্ধুটি চশমা পরা, কাল তার চোখে নেই কোনো চশমা; অথচ সে যেন কালকের মতোই স্বাভাবিক কথাবার্তা চালিয়ে যায়। আরও অবাক করা বিষয় হলো, শহরের মানুষজনের মধ্যে এই পরিবর্তন নিয়ে কোনো আলোচনা নেই। যেন তারা এক অদৃশ্য নিয়ম মেনে চলে—পরিবর্তন এখানে জীবনের অংশ, প্রশ্ন করা নিষিদ্ধ। আরিয়ান যখন বন্ধুদের কাছে নিজের সন্দেহের কথা বলে, তারা অবাক হয়ে তাকালেও কিছুক্ষণের মধ্যে হাসতে হাসতে বিষয়টি এড়িয়ে যায়, যেন এটা নিছক মজা। এই নিস্পৃহতা আর উদাসীনতা আরিয়ানের মনে ভয় ঢুকিয়ে দেয়। সে বুঝতে পারে, কেবল সে-ই একমাত্র ব্যক্তি যে এই রহস্যময় বদলের ছায়া দেখতে পাচ্ছে।
প্রতিটি নতুন সকাল আরিয়ানের মনে নতুন আতঙ্কের জন্ম দেয়। সে খেয়াল করতে শুরু করে, কেবল স্থাপনা বা মুখ নয়, শহরের স্মৃতিও যেন রাতারাতি মুছে গিয়ে পুনর্লিখিত হয়। গতকাল যে ক্যাফেতে সে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিয়েছিল, আজ সেখানে খুঁজে পাওয়া যায় না সেই দোকান—কেউ মনে করতে পারে না যে সেখানে কখনো কোনো ক্যাফে ছিল। এমনকি তার মোবাইলের ছবিগুলোতেও অদ্ভুত গ্লিচ দেখা দেয়, গতকালের তোলা ছবি হঠাৎ ঝাপসা হয়ে যায়, লোকজনের মুখ অস্পষ্ট পিক্সেলে পরিণত হয়। ক্রমে তার নিজের স্মৃতিতেও ফাটল ধরতে শুরু করে; সে নিশ্চিত হতে পারে না যে আগের দিনের কোনো ঘটনা সত্যিই ঘটেছিল কিনা। তবুও চারপাশের সবাই নিশ্চিন্তভাবে দিন কাটাচ্ছে, যেন এই শহর সবসময় এমনই ছিল। এই অদ্ভুত স্বাভাবিকতার ভেতরেই লুকিয়ে আছে এমন এক রহস্য, যার উৎস অজানা, কিন্তু যার উপস্থিতি আরিয়ানের হৃদস্পন্দনের সঙ্গে সঙ্গে ক্রমশ জোরালো হয়ে ওঠে। মনে হয়, প্রতিটি নতুন সকাল আসলে তাকে ডেকে নিয়ে যাচ্ছে এক গভীর অদৃশ্য গোলকধাঁধার দিকে, যেখানে বাস্তব আর মায়ার সীমারেখা ক্রমেই মুছে যাচ্ছে।
~
শহরের আরেকটি অদ্ভুত সকালে আরিয়ানের ঘুম ভাঙতেই মনে হলো যেন বাতাসে এক অচেনা শীতলতা ভেসে বেড়াচ্ছে। জানালার বাইরে তাকাতেই সে বুঝতে পারল আজকের সকাল অন্য সব দিনের থেকেও বেশি অস্বাভাবিক। কলেজের দিকে যাওয়ার জন্য যে চেনা পথ সে প্রতিদিন ব্যবহার করে, সেই রাস্তাটি একেবারে অচেনা আকার ধারণ করেছে। কোথাও কোথাও পুরো রাস্তা যেন মুছে গিয়ে জায়গা করে নিয়েছে বিস্তীর্ণ শূন্যতা, কোথাও আবার অদ্ভুত জ্যামিতিক প্যাটার্নে নতুন লেন তৈরি হয়েছে। পরিচিত গলি, মোড়, দোকান বা ল্যাম্পপোস্টের কোনো চিহ্ন নেই, যেন রাতারাতি পুরো শহরের মানচিত্র নতুন করে আঁকা হয়েছে। আরিয়ান প্রথমে ভেবেছিল হয়তো ফোনের ম্যাপ অ্যাপ্লিকেশন তাকে সঠিক দিকনির্দেশ দেবে। কিন্তু স্ক্রিনে কোনো রাস্তার নাম দেখা গেল না, কেবল অস্পষ্ট কালো-ধূসর দাগ আর ক্রমাগত ঘুরতে থাকা একটি লোডিং আইকন। যতই সে রিফ্রেশ করুক না কেন, ম্যাপ যেন অদৃশ্য কোনো প্রাচীরের সামনে আটকে গেছে। এই প্রযুক্তিনির্ভর জীবনে হঠাৎ এমন অচলাবস্থা তাকে গভীর অনিশ্চয়তায় ফেলে দিল। চারপাশে মানুষের সংখ্যা খুব বেশি নয়, যারা আছে তারা যেন কোনো অদৃশ্য ছন্দে একঘেয়ে গতিতে চলাফেরা করছে, কারও চোখে বিস্ময় বা প্রশ্নের ছাপ নেই।
অবশেষে কলেজের রাস্তা খুঁজতে খুঁজতে আরিয়ান শহরের প্রান্তে পৌঁছায়—অন্তত তার মনে হয় এটি প্রান্ত। এখানেই সে অনুভব করে এক অদৃশ্য উপস্থিতি, যা তাকে থমকে দাঁড়াতে বাধ্য করে। সামনে দেখতে পাচ্ছে কেবল খোলা বিস্তৃত একটি সড়ক, কিন্তু কয়েক কদম এগোতেই হঠাৎ শরীর যেন অদৃশ্য কিছুর সঙ্গে ধাক্কা খেল। সে অবাক হয়ে লক্ষ্য করে, তার সামনে কোনো দৃশ্যমান বস্তু নেই, অথচ একটি অদৃশ্য কাঁচের দেওয়াল যেন তাকে আটকে রেখেছে। হাত বাড়িয়ে স্পর্শ করতেই আঙুলের ডগায় ঝলমলে এক নীলচে আলো ফুটে ওঠে—প্রথমে হালকা, পরে তীব্র হয়ে পুরো হাতজোড়া ঘিরে ধরে। মনে হলো যেন বিদ্যুৎ স্পন্দনের মতো একটি কম্পন শরীরের ভেতর বয়ে যাচ্ছে, অথচ কোনো ব্যথা নেই, আছে কেবল এক অচেনা উত্তেজনা। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই সেই আলো মিলিয়ে যায়, কিন্তু স্পর্শের উষ্ণতা থেকে যায় হাতের তালুতে। আরিয়ান আবারও দেওয়ালে হাত রাখে, এবার আর কোনো ঝলক দেখা যায় না, কেবল ঠান্ডা শূন্যতার অনুভূতি। সে চারদিকে তাকিয়ে দেখে, এই অদৃশ্য সীমারেখা এক অব্যক্ত বৃত্তের মতো পুরো প্রান্তকে ঘিরে রেখেছে। এক পা বাড়ালেই মনে হয় সে পড়ে যাবে এক অসীম শূন্যতায়। শহরের গগনচুম্বী অট্টালিকাগুলো এখান থেকে অদ্ভুতভাবে স্থির মনে হয়, যেন থেমে আছে সময়ের গণ্ডিতে। বাতাসে একধরনের নীরব গুঞ্জন শোনা যায়, যা মানুষের কানে ধরা পড়ে না, কিন্তু মনের গভীরে প্রবেশ করে অনন্ত অস্থিরতা ছড়িয়ে দেয়।
এই অদৃশ্য দেওয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে আরিয়ানের ভেতরে এক অজানা সত্য ধীরে ধীরে স্পষ্ট হতে থাকে। এতদিন ধরে যে শহরকে সে বাস্তব ভেবে এসেছে, সেই শহরের সীমানা আসলে কোনো প্রাকৃতিক ভূগোল নয়, বরং এক নিখুঁতভাবে তৈরি করা প্রোগ্রামের অংশ। তার চোখের সামনে যা কিছু দৃশ্যমান, সবকিছুই হয়তো কেবল কোডের ফল, যা প্রতিদিন নতুন করে রিসেট হয়। সে হঠাৎ নিজের শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ শুনতে পায়, যা অস্বাভাবিকভাবে জোরে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে, যেন এই সীমারেখা বাইরের জগতের সব শব্দকে আটকে দিয়েছে। আতঙ্ক ধীরে ধীরে তাকে গ্রাস করতে শুরু করে, তবু কৌতূহল তাকে পিছিয়ে যেতে দেয় না। বারবার হাত বাড়িয়ে সে এই অদৃশ্য প্রাচীরের গঠন বোঝার চেষ্টা করে, কিন্তু প্রতিবারই একই রহস্যময় শীতলতা আর ক্ষণস্থায়ী আলো তাকে হতবাক করে তোলে। এক অদ্ভুত দ্বিধা তার মনের ভেতর জন্ম নেয়—সে কি এই অদৃশ্য দেয়ালের ওপারে যেতে পারবে? নাকি এটি সেই সীমারেখা, যাকে পেরোনোর ক্ষমতা কারও নেই? শহরটা কি সত্যিই জীবন্ত, নাকি কোনো গোপন শক্তির নিয়ন্ত্রণে থাকা একটি সিমুলেশন মাত্র? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে সে অনুভব করে, তার নিজের অস্তিত্বও যেন ধীরে ধীরে অস্পষ্ট হয়ে আসছে, যেন তার পরিচয়ও এই কৃত্রিম প্রোগ্রামের গোপন কোডের অংশ।
~
রাতের শহরটা যেন দিনের তুলনায় আরও অচেনা। দিনের ঝলমলে আলো, হোলোগ্রাফিক বিলবোর্ড, আর অদৃশ্য রাস্তার গতি মিলিয়ে অন্ধকার নেমে আসতেই শহরটা রূপ নেয় এক অদ্ভুত ছায়াময় গোলকধাঁধায়। ক্যাম্পাস থেকে ফেরার পথে আরিয়ান লক্ষ্য করল, চারপাশের মানুষদের চলাফেরায় যেন এক অচেনা ছন্দ। কারও মুখে কোনো অভিব্যক্তি নেই, যেন তারা মেকানিকাল ক্রীড়নক মাত্র। আলো-আঁধারির খেলায় তাদের অবয়ব কখনো স্পষ্ট, কখনো অস্পষ্ট হয়ে ওঠে—যেন তারা অর্ধেক বাস্তব, অর্ধেক কোনো প্রোগ্রামের ছায়া। রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকা চা-ওয়ালার মুখে কোনো ভাঁজ নেই, কণ্ঠে কোনো উষ্ণতা নেই, কেবল একরকম খালি স্বর যা বারবার একই বাক্য উচ্চারণ করছে। পাশ কাটিয়ে যাওয়া লোকগুলোও অদ্ভুতভাবে নিঃশব্দ, তাদের পায়ের শব্দ নেই, শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দ নেই, শুধু শহরের মধ্যে এক অনির্বচনীয় গুঞ্জন ধ্বনিত হচ্ছে। এই গুঞ্জন শব্দ নয়, যেন মস্তিষ্কের ভেতর কোনো কোডের ফিসফিসানি। আরিয়ানের মনে হলো, এই ছায়া-মানুষরা কেবল আকারের মানুষ, তাদের ভেতর কোনো আত্মা নেই। এই অদ্ভুত নীরবতার মধ্যে দাঁড়িয়ে সে অনুভব করল, চারপাশের বাতাসও যেন স্থির হয়ে গেছে, সময় থেমে আছে এক অদৃশ্য সীমারেখার ভেতর।
হঠাৎ এক কোণ থেকে ম্লান আলো এসে পড়ল একটি পুরনো বইয়ের দোকানের দিকে, যা দিনের বেলায় সে কখনো দেখেনি। কাঠের দরজায় ধুলো জমে আছে, জানালার কাঁচে ফাটল ধরেছে, কিন্তু ভেতর থেকে আসা আলো অদ্ভুতভাবে তাকে টানল। দরজা ঠেলতেই একটি ঘণ্টার ক্ষীণ শব্দে দোকানের ভেতরের বাতাস কেঁপে উঠল। বইয়ের গন্ধে ভরা অন্ধকার ঘরে সে দেখতে পেল এক বৃদ্ধকে—ধূসর দাড়ি, কুঁচকানো চেহারা, চোখে অচেনা গভীরতা। বৃদ্ধের মুখে কোনো হাসি নেই, তবু তার চোখে একধরনের করুণা খেলা করছে, যেন তিনি আগেই জানতেন আরিয়ান এখানে আসবে। আরিয়ান কিছু বলতে না বলতেই বৃদ্ধ ধীরে ধীরে বললেন, “এখানে কিছুই স্থায়ী নয়। আমরাই কেবল ডেটা।” সেই কণ্ঠস্বরের মধ্যে এমন এক নিশ্চয়তা ছিল যা শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা স্রোত নামিয়ে আনল। আরিয়ান হতভম্ব হয়ে জিজ্ঞেস করল, “ডেটা মানে? আমরা মানুষ নই?” বৃদ্ধের ঠোঁটে ক্ষীণ হাসির রেখা ফুটল, কিন্তু কোনো উত্তর দিলেন না। বরং তাকালেন দেওয়ালের পুরনো ঘড়ির দিকে। সেই ঘড়িটি হঠাৎ গ্লিচের মতো কেঁপে উঠল—কাঁটা এগিয়ে যাচ্ছে আবার পিছিয়েও আসছে, সময় যেন নিজেই নিজের মধ্যে ধাক্কা খাচ্ছে। প্রতিটি টিকটিক শব্দ বাতাসে অদ্ভুত প্রতিধ্বনি তৈরি করছে, যা মনে হচ্ছিল বাস্তবের কাঠামোকে ভেঙে দিচ্ছে। বৃদ্ধ ফিসফিস করে বললেন, “তুমি যা দেখছ, সব কেবল কোডের খেলা। এখানে যত স্মৃতি, যত সম্পর্ক, সবই প্রোগ্রাম করা। তুমি যদি বুঝতে চাও সত্যি কী, তবে তোমাকে শিখতে হবে ভুলতে।”
বৃদ্ধের এই রহস্যময় কথাগুলো আরিয়ানের মনে এক অদ্ভুত ঝড় তুলল। তার শৈশবের স্মৃতি, কলেজের বন্ধু, প্রতিদিনের ক্লাস—সবকিছু কি তবে নিছক কোড? সে অনুভব করল বুকের ভেতর হঠাৎ এক শূন্যতা জমছে, যেন মাটির নিচ থেকে বাস্তবতার ভিত্তি সরে যাচ্ছে। দোকানের চারপাশে তাকিয়ে দেখল, শেলফের বইগুলোও যেন গ্লিচ করছে—কভার ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে, অক্ষরগুলো মিলিয়ে যাচ্ছে আবার নতুন করে গঠিত হচ্ছে। দোকানের ভেতরের আলো মুহূর্তে মুহূর্তে ম্লান ও উজ্জ্বল হচ্ছে, যেন সিস্টেমের পাওয়ার সাপ্লাই কেঁপে উঠছে। বৃদ্ধের চোখের গভীরতা যেন তাকে টেনে নিয়ে যেতে চাইছে এক অদৃশ্য সত্যের দিকে, যেখানে কোনো শরীর নেই, কেবল ডেটার স্রোত। বুকের ভেতর প্রশ্নের ভার বাড়তেই আরিয়ান এক পা পিছিয়ে গেল, কিন্তু তখনই তার মনে হলো দোকানটা আস্তে আস্তে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। বৃদ্ধের অবয়ব ক্রমশ ঝাপসা হয়ে এক ছায়ামাত্র হয়ে উঠছে, যেন তার অস্তিত্বও এই শহরের মতোই প্রোগ্রাম করা এক মরীচিকা। দোকান থেকে বেরিয়ে আসতেই চারপাশের অন্ধকার আরও ঘন হয়ে এল। আকাশের ওপর অদ্ভুত নীল রেখা জ্বলজ্বল করছে, যেন কোনো কম্পিউটার স্ক্রিনের পিক্সেল ফেটে যাচ্ছে। আরিয়ান বুঝতে শুরু করল, এই শহর আসলে হয়তো কখনোই বাস্তব ছিল না; সে হয়তো কেবল এক বিশাল সিমুলেশনের বন্দি, যেখানে সত্য আর মায়া, মানুষ আর ডেটা—সবকিছুই এক হয়ে গেছে।
~
আরিয়ান বৃদ্ধের অদ্ভুত কথাগুলো মাথায় নিয়ে সারা দিন অস্থির কাটাল। শহরের ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়েও সে যেন বারবার নিজের অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলছিল। “আমরাই কেবল ডেটা”—বৃদ্ধের সেই বাক্য যেন ধীরে ধীরে তার চেতনায় ছাপ ফেলে দিচ্ছিল। অবশেষে এক গোপন সূত্র ধরে সে পৌঁছাল শহরের প্রান্তে অবস্থিত এক নির্জন ডেটা সেন্টারের সামনে। চারপাশ অদ্ভুত রকমের নীরব—কোনও যানবাহনের শব্দ নেই, বাতাস যেন স্থির হয়ে আছে। বিশাল কালো কাচে মোড়া বিল্ডিংটির দরজা একটুও শব্দ না করেই খুলে গেল, যেন সে আসবে তা আগেই জানা ছিল। ভিতরে পা রাখতেই আরিয়ান অনুভব করল তাপমাত্রা হঠাৎ কয়েক ডিগ্রি নেমে গেছে। দেয়ালের ধাতব রঙিন পাইপগুলো থেকে একধরনের নিম্নকম্পিত শব্দ বেরোচ্ছে—একটা অজানা যান্ত্রিক নিশ্বাসের মতো। সে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এল তলঘরে, যেখানে একের পর এক বিশাল সার্ভার মেশিনের নীল আলো ঘরে এক ধরনের অলৌকিক আবহ তৈরি করেছে। প্রতি সেকেন্ডে গুনগুন করে চলা প্রসেসরের শব্দের ভেতরেও সে যেন একটি ছন্দ খুঁজে পেল—একটি অদৃশ্য হৃদস্পন্দনের মতো, যা যেন পুরো শহরের জীবন্ত থাকার প্রমাণ দিচ্ছে।
নিচতলার অন্ধকার ঘরে, সার্ভারের মাঝখানে হঠাৎ একটি পুরনো কম্পিউটার টার্মিনাল দেখতে পেল আরিয়ান। আশেপাশের মেশিনগুলো আধুনিক, কিন্তু এই টার্মিনালটা অদ্ভুতভাবে সাদাকালো পর্দা আর পুরনো কীবোর্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কৌতূহলে ভর করে সে এগিয়ে গিয়ে বসতেই স্ক্রিনে অটোমেটিকভাবে কিছু এনক্রিপটেড কোড দেখা দিতে লাগল। কোডের লাইনগুলো একটার পর একটা বদলাচ্ছে—শহরের প্রতিটি রাস্তা, প্রতিটি বিল্ডিংয়ের পরিবর্তনের সময়, আবহাওয়ার রেকর্ড, এমনকি মানুষের দৈনন্দিন কথোপকথন পর্যন্ত সেখানে সংরক্ষিত। তার চোখ আটকে গেল বারবার ঘুরে আসা একটি রহস্যময় শব্দে—“মরীচিকা 7.0”। শব্দটির চারপাশে সংখ্যাগুলো পরিবর্তিত হচ্ছে, যেন কোনও চলমান প্রোগ্রামের ভেতরেই সে ঢুকে পড়েছে। হঠাৎ একটি অচেনা লাইন স্ক্রিনে ঝলসে উঠল—“Reality Patch Initiated.” সঙ্গে সঙ্গে ঘরের আলো কেঁপে উঠল। সার্ভারের নীল আলো এক মুহূর্তে লাল হয়ে গেল, দেয়ালগুলো যেন কম্পন তুলতে শুরু করল। বাতাসের ভেতর একধরনের বৈদ্যুতিক গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল, যেন বজ্রপাতের ঠিক আগের মুহূর্ত। আরিয়ান দ্রুত কীবোর্ডে কিছু কমান্ড টাইপ করতে চাইল, কিন্তু প্রতিটি বোতাম চাপার সঙ্গে সঙ্গে অক্ষরগুলো বিকৃত হয়ে অদ্ভুত প্রতীক হয়ে ফিরতে লাগল। ঘরের ভেতর সেই যান্ত্রিক শব্দ ধীরে ধীরে মানুষের নিঃশ্বাসের মতো শোনাতে লাগল—কখনও ভারী, কখনও হালকা, যেন কোনও অদৃশ্য সত্তা ঠিক তার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে।
ঠিক তখনই, কোনও স্পিকারের সাহায্য ছাড়াই বাতাসের ভেতর ভেসে এল এক নারীকণ্ঠ—শীতল অথচ স্পষ্ট। “তুমি বাস্তব নও, আরিয়ান।” শব্দগুলো এমনভাবে প্রতিধ্বনিত হল যে মনে হল ঘরের প্রতিটি ধাতব পাইপ, প্রতিটি সার্ভার সেই বাক্য উচ্চারণ করছে। আরিয়ান স্তব্ধ হয়ে গেল। তার শিরদাঁড়ায় ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল, হৃদপিণ্ডের ধুকপুকানি সার্ভারের শব্দের সঙ্গে মিশে এক অদ্ভুত তালের সৃষ্টি করল। সে চারপাশে তাকিয়ে দেখল, দেয়ালগুলোতে একের পর এক গ্লিচের মতো লাইন তৈরি হচ্ছে—কখনও তাতে দেখা যাচ্ছে তার নিজের মুখ, কখনও আবার সেই বৃদ্ধের চোখ, যে বইয়ের দোকানে তাকে সতর্ক করেছিল। ঘরের মেঝে যেন দুলতে শুরু করল, স্ক্রিনের কোডগুলো ঘূর্ণি খেয়ে মিলে গেল এক বিশাল আলোর ঘূর্ণাবর্তে। “তুমি বাস্তব নও”—কণ্ঠটি এবার আরও কোমল কিন্তু দৃঢ় হয়ে পুনরাবৃত্তি করল, যেন কোনও অদৃশ্য প্রোগ্রাম তার অস্তিত্বের প্রতিটি স্তর মুছে দিতে চাইছে। সেই মুহূর্তে আরিয়ান বুঝতে পারল, তার চারপাশের শহরই শুধু নয়, হয়তো তার নিজের সত্তাও একটি কোডের ভেতর বন্দি, আর “মরীচিকা 7.0” সেই কোডেরই চূড়ান্ত সংস্করণ, যেখানে বাস্তবতা কেবল একটি সফটওয়্যারের মতো চলমান।
~
পরের দিন সকালটা অদ্ভুতভাবে নিস্তব্ধ ছিল, যেন শহরের প্রতিটি গলিতে কোনও অদৃশ্য অপেক্ষা জমে আছে। আগের রাতের গ্লিচ, নারীকণ্ঠের শীতল সতর্কবার্তা আর “মরীচিকা 7.0” শব্দটির ধ্বনি আরিয়ানকে ভেতর থেকে কাঁপিয়ে দিচ্ছিল। তবুও এক অজানা টানে সে ঘুরতে ঘুরতে এসে পৌঁছল এক লুকানো আর্কেডে—একটি অচেনা গলির শেষে, ধুলোমাখা শাটারের আড়ালে। বাইরে থেকে দেখতে পরিত্যক্ত, কিন্তু ভেতরে পা রাখতেই সে যেন এক অদ্ভুত সময়চক্রের ভেতরে প্রবেশ করল। দেয়ালের নিওন আলোতে পুরনো গেম কনসোলগুলো অর্ধেক অন্ধকারে জ্বলজ্বল করছিল, বাতাসে মেশানো পুরনো সার্কিটের গন্ধ। কিন্তু সবচেয়ে ভৌতিক ছিল কেন্দ্রে রাখা বিশাল স্ক্রিন, যেখানে বারবার ঝলসে উঠছিল একটিই বাক্য—“Log Out to Live.” প্রতিটি অক্ষর যেন জীবন্ত হয়ে নড়ছিল, কখনও লাল, কখনও নীল, কখনও ঝাপসা সাদা। আরিয়ান প্রথমে ভেবেছিল হয়তো এটা শুধু গেমের টাইটেল, কিন্তু পরের মুহূর্তেই সে জমে গেল। স্ক্রিনে হঠাৎ ভেসে উঠেছে তার নিজের মুখ। স্থিরচোখে তাকিয়ে থাকা সেই ছবি যেন তার প্রতিটি শ্বাসের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কাঁপছে। ছবির ঠোঁট হালকা নড়লও—কিন্তু কোনও শব্দ শোনা গেল না। এই নিঃশব্দ অঙ্গভঙ্গি তার মেরুদণ্ডে ঠান্ডা স্রোত বইয়ে দিল, যেন স্ক্রিনের ভেতরের সে-ই তাকে কোনও গোপন সংকেত দিচ্ছে।
ঠিক তখনই, আর্কেডের অন্ধকার কোণের একটি পুরনো পিনবল মেশিনের পেছন থেকে বেরিয়ে এল এক তরুণী। গাঢ় নীল হুডি পরা, চোখে অস্বাভাবিক তীব্রতা, কিন্তু চেহারায় এক ধরনের কৃত্রিম মসৃণতা যেন নিখুঁতভাবে তৈরি করা কোনো অ্যাভাটারের। সে ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে ফিসফিস করে বলল, “ওই মেসেজে বিশ্বাস কোরো না।” তার কণ্ঠস্বরে ছিল এক অদ্ভুত দ্বৈততা—মাঝে মাঝে শব্দগুলো সামান্য ইলেকট্রনিক গ্লিচের মতো ভেঙে যাচ্ছিল। “আমি নীলা,” সে নিজেকে পরিচয় করিয়ে দিল, “রিয়েল ওয়ার্ল্ড থেকে এসেছি। এই সিমুলেশনে ঢুকে যারা ফেঁসে গেছে, তাদের উদ্ধার করতে।” আরিয়ান অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। নীলা তাকে জানাল, এই শহর, এই আলো, এই রাস্তা—সবই কেবল কোড। “Log Out” বোতামটি এই সিমুলেশনের একমাত্র বেরিয়ে যাওয়ার দরজা। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই সে সতর্ক করে দিল, “লগ আউট মানেই মৃত্যু। যে এখানে থেকে ‘লগ আউট’ করেছে, সে আর রিয়েল ওয়ার্ল্ডেও ফিরতে পারে না। সে কেবল কোডের বাইরে এক শূন্যতায় মিশে যায়।” কথাগুলো যতটা ভয়ংকর, তার চোখের দৃষ্টি তার চেয়েও বেশি বিভ্রান্তিকর ছিল। নীলার প্রতিটি বাক্য যেন নিখুঁতভাবে তৈরি করা কোনও স্ক্রিপ্টের মতো শোনাচ্ছিল—নিখুঁত বিরতি, নিখুঁত শ্বাস, এমনকি চোখের পলক পর্যন্ত। আরিয়ান মনে মনে প্রশ্ন তুলল, সে কি সত্যিই কোনও উদ্ধারকর্তা, নাকি এই সিমুলেশনের আরেকটি প্রোগ্রাম মাত্র, যে তাকে আরেকটি ফাঁদে ফেলতে এসেছে?
নীলার সঙ্গে কথোপকথন যত এগোতে লাগল, সত্যি আর মিথ্যার সীমারেখা ততই ঝাপসা হয়ে উঠল। আর্কেডের আলো কখনও তীব্রভাবে জ্বলে উঠছিল, কখনও আবার ম্লান হয়ে যাচ্ছিল, যেন তাদের কথার প্রতিটি বিন্দু কোনও অদৃশ্য অ্যালগরিদম যাচাই করছে। নীলা বলল, “তুমি যতক্ষণ এই সিস্টেমে থাকবে, কোড তোমাকে মুছে দিতে থাকবে। মনে রেখো, ‘লগ আউট’ একমাত্র দরজা। কিন্তু ওটা বেছে নেওয়া মানেই এই সত্তা, এই চেহারা, এই স্মৃতি—সবকিছুর সমাপ্তি।” আরিয়ান স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে দেখল, তার ছবির চোখ হঠাৎ ঝলসে উঠল, ঠোঁট নড়ে উঠে যেন নীরব ভাষায় কিছু বলতে চাইছে। স্ক্রিনের পেছনে অস্পষ্টভাবে দেখা গেল শহরের মানচিত্র, তাতে অদ্ভুত গ্লিচের দাগ, যেখানে কিছু জায়গা ক্রমশ অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। তার মনে হতে লাগল, হয়তো পুরো শহরটাই ধীরে ধীরে মুছে যাচ্ছে, আর “লগ আউট” বোতামটাই শেষ সুযোগ। কিন্তু নীলার মুখের শীতলতা আর কণ্ঠের অনিশ্চয়তা তাকে দ্বিধাগ্রস্ত করে তুলল। সে কি নীলাকে বিশ্বাস করবে, যে বলছে মৃত্যুর মধ্যেই মুক্তি, নাকি স্ক্রিনের নিঃশব্দ ‘নিজের’ সতর্কবার্তাকে মানবে, যে হয়তো তাকে বাঁচতে বলছে? চারপাশের গেম মেশিনগুলোর আলো হঠাৎ সমস্বরে জ্বলে উঠল, যেন অদৃশ্য কোনও কাউন্টডাউন শুরু হয়ে গেছে। সেই মুহূর্তে আরিয়ান বুঝতে পারল—সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এসে গেছে, আর এই সিদ্ধান্তই হয়তো নির্ধারণ করবে সে আসলেই মানুষ, নাকি কেবল মরীচিকা 7.0-এর আরেকটি ডেটা-স্ট্রিং মাত্র।
~
শহরের ভেতর রাত যত গভীর হতে থাকে, আরিয়ানের মনের ভেতর ততই ছড়িয়ে পড়তে থাকে এক অদৃশ্য কুয়াশা। দিন গড়িয়ে সন্ধ্যা নামলেই সে যেন নিজের চিন্তার গোলকধাঁধায় হারিয়ে যায়। নীলার সতর্কবাণী আর “লগ আউট” বার্তার প্রলোভনের মধ্যেই হঠাৎ সে অনুভব করল, অনেক দিন হয়ে গেছে তার নিজের অতীতের কোনো দৃশ্য স্পষ্ট করে মনে করতে পারছে না। সে চেষ্টা করল চোখ বন্ধ করে শৈশবের আঙিনা মনে করতে—পিছনের উঠোনে লাল ফুলের গাছ, গরমের ছুটিতে ছাদে দাঁড়িয়ে বাবার সঙ্গে তারা দেখা, মা’র রান্নাঘর থেকে ভেসে আসা মশলার গন্ধ। কিন্তু যতই সে মনে করার চেষ্টা করল, ছবিগুলো ধোঁয়ার মতো মিলিয়ে যেতে লাগল। কিছুক্ষণ পর আরিয়ান বুঝল, সে যেন নিজের মস্তিষ্কের ভেতর দিয়ে হাঁটছে, যেখানে প্রতিটি দরজা খোলার আগেই অদৃশ্য হাত তা বন্ধ করে দিচ্ছে। বাবার মুখ ঝাপসা, মায়ের হাসি বিকৃত, বন্ধুবান্ধবের কণ্ঠে কেবল খালি প্রতিধ্বনি। মনে হলো, এই শহর শুধুই চারপাশের বিল্ডিং বা রাস্তার নয়, তার নিজের মনের ভেতরও একটা প্রোগ্রামের মতো কাজ করছে—যত বেশি সে অতীত খুঁজছে, তত দ্রুত তা মুছে দিচ্ছে।
নীলা এক রাতে তাকে নিয়ে গেল শহরের এক পুরনো মানচিত্র ঘরে, যেখানে দেয়ালের প্রতিটি ফাটল থেকে ক্ষীণ নীল আলো বেরিয়ে আসছিল। ঘরের ভেতর বসে সে ধীরে ধীরে বলল, “তুমি যতক্ষণ নিজের স্মৃতি আঁকড়ে ধরে আছো, ততক্ষণ এই সিস্টেম তোমাকে ধরে রাখবে। এখানে প্রত্যেকটি স্মৃতি আসলে একেকটা কোড, আর তোমার পরিচয়ই সেই কোডের সবচেয়ে শক্তিশালী পাসওয়ার্ড। যদি সত্যিকারের মুক্তি চাও, তাহলে সেই পাসওয়ার্ড মুছে ফেলতে হবে।” আরিয়ান প্রথমে অবিশ্বাসের হাসি হেসে বলল, “মানে আমি নিজের নাম, নিজের অতীত—সবকিছু ভুলে যাব? তাহলে তো আমি থাকবই না।” নীলা এক শীতল দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “বাস্তব জগতে ফিরতে হলে তোমাকে এখানকার আরিয়ানকে মুছে ফেলতে হবে। যে স্মৃতি তুমি ‘তোমার’ বলছ, সেগুলো কেবল সার্ভারে রাখা ডেটা। তুমি যাকে বাবা-মা বলছ, যাদের মুখ মনে করার চেষ্টা করছ, তারা হয়তো আদৌ ছিল না। এই শহরকে শক্তি জোগায় তোমার সেই চেপে ধরা অতীত।” নীলার কণ্ঠে ছিল না কোনো আবেগ, যেন সে শুধু এক প্রোগ্রাম করা নিয়ম উচ্চারণ করছে। আরিয়ান অনুভব করল বুকের ভেতর এক অজানা শূন্যতা জমে উঠছে। যদি এই কথাগুলো সত্যি হয়, তাহলে সে এতদিন কিসের উপর দাঁড়িয়ে বেঁচে ছিল? যাকে সে নিজের বলে জানত, সেটাই যদি মায়া হয়, তাহলে বাস্তবের সংজ্ঞাই বা কী?
সেই রাতের পর থেকে আরিয়ান ক্রমশ নিজের অস্তিত্ব নিয়ে এক অদ্ভুত দ্বন্দ্বের মধ্যে পড়ল। শহরের রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ মনে হতো—তার নামটা আসলে কী? “আরিয়ান” শব্দটা যেন কোনো গেম প্রোফাইলের ট্যাগ ছাড়া কিছু নয়। কলেজের প্রথম দিন, প্রথম প্রেম, বন্ধুবান্ধবের হাসি—সব যেন ধীরে ধীরে একধরনের ডেটা নয়েজে পরিণত হচ্ছে। সে চেষ্টা করল আকাশের দিকে তাকিয়ে বাস্তবের কোনো চিহ্ন খুঁজে পেতে, কিন্তু বুঝতে পারল, শেষবার কবে সে সত্যিকারের তারা দেখেছিল, সেটাও মনে নেই। শহরের আকাশে শুধু নীলচে ঝাপসা আলো, কোনও বাস্তব নক্ষত্র নেই। এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো, যদি সে সত্যিই নিজের স্মৃতিগুলো ছেড়ে দেয়, তাহলে হয়তো সে মুক্তি পাবে—হয়তো সেই রহস্যময় ‘রিয়েল ওয়ার্ল্ড’-এ ফিরে যাবে। কিন্তু পরের মুহূর্তেই ভয় তাকে চেপে ধরল। যদি মুক্তি মানেই মৃত্যু হয়? যদি নিজের নাম, নিজের অতীত মুছে ফেলার পর সে কেবল শূন্যতার মধ্যে ভেসে থাকে? নীলার কথাগুলো মাথায় ঘুরতে লাগল—“তুমি যতক্ষণ মনে রাখবে, ততক্ষণ আটকে থাকবে।” সে বুঝতে পারল, এই শহর থেকে বেরোতে হলে শুধু শহরের দেয়াল নয়, নিজের ভেতরের দেয়ালও ভাঙতে হবে। কিন্তু প্রশ্ন রয়ে গেল—অস্তিত্ব মুছে দিয়ে যে মুক্তি আসে, সেটাকে কি সত্যিই জীবন বলা যায়?
~
রাতটা যেন হঠাৎ করেই বাস্তবের সমস্ত নিয়ম ভেঙে দিল। আরিয়ান জেগে উঠল এক অদ্ভুত শব্দে—একটা টানা, কর্কশ গর্জন যেন আকাশের বুক চিরে নেমে আসছে। জানালার বাইরে তাকাতেই তার নিশ্বাস আটকে গেল। পরিচিত শহরটি আর আগের মতো নেই; উঁচু অট্টালিকাগুলোর গায়ে নীলচে আলো ঝলসে উঠছে, দেয়ালগুলো ভেতর থেকে গলে গিয়ে পিক্সেলেটেড দাগে ভেঙে পড়ছে। চারদিকে কেবল অসংখ্য গ্লিচ, ভবনগুলোর ফ্রেম ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে, রাস্তার ল্যাম্পপোস্টগুলো একেকটা কাঁপতে থাকা কোডের রেখায় পরিণত হচ্ছে। গাড়িগুলো হঠাৎ থেমে গিয়ে ধোঁয়ার মতো মিলিয়ে যাচ্ছে, আর মানুষগুলো—যাদের মুখ সে গত কয়েক সপ্তাহে দেখেছে—তারা একে একে ফ্লিকার করতে শুরু করল। কারও হাত নেই, কারও চোখ অদৃশ্য, কারও শরীর অর্ধেক কেটে গিয়ে একরাশ ডেটা-ডাস্টে ভেসে যাচ্ছে। বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে অদ্ভুত সিগন্যালের শব্দ, যেন হাজারো ডিভাইস একসাথে ক্র্যাশ করছে। আরিয়ান বুঝতে পারল, এই শহর তার শেষ পর্যায়ে পৌঁছে গেছে—এটা কেবল কোনও অচেনা দুর্যোগ নয়, পুরো সিস্টেমটাই ভেঙে পড়ছে। প্রতিটি ধ্বংসপ্রাপ্ত দেয়াল, প্রতিটি ফাটল যেন তাকে মনে করিয়ে দিচ্ছে, সে যাকে এতদিন বাস্তব ভেবেছিল, তা আসলে কেবল এক প্রোগ্রাম, আর সেই প্রোগ্রাম তার চোখের সামনে মৃত্যুর দিকে এগোচ্ছে।
নীলা হঠাৎ কোথা থেকে যেন ছুটে এল, তার চোখে জরুরি আতঙ্কের ছাপ। কণ্ঠে ধ্বনিত হল এক অচেনা তীব্রতা, “সময় নেই, আরিয়ান! সিস্টেম নিজেকে রিসেট করার আগে বেরোতে হবে।” চারপাশের ডিজিটাল বিশৃঙ্খলার মধ্যে সে আরিয়ানকে টেনে নিয়ে ছুটল। তারা যখন দৌড়াচ্ছিল, রাস্তা ক্রমশ অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছিল, পায়ের তলায় ফাটল ধরছিল পিক্সেলেটেড ফ্লোরে। আকাশের দিকে তাকিয়ে আরিয়ান দেখল, উপরের নীলচে গম্বুজে বিশাল এক ফাটল ধরেছে, যার ভেতর দিয়ে ফুটে উঠছে অদ্ভুত শূন্য আলো—একটা সাদা শূন্যতা, যা যেন সবকিছু গ্রাস করে নিতে চাইছে। ভবনগুলো গুঁড়িয়ে পড়ছে, মানুষগুলো গ্লিচ হয়ে এক সেকেন্ডের মধ্যে মুছে যাচ্ছে, কিন্তু কেউই চিৎকার করছে না; সবাই যেন আগেই এই সমাপ্তির জন্য প্রোগ্রাম করা ছিল। নীলা তাকে নিয়ে পৌঁছাল শহরের কেন্দ্রস্থলের দিকে, যেখানে দাঁড়িয়ে আছে একটি বিশাল কালো টাওয়ার। টাওয়ারটির গায়ে এক অচেনা আলো নাচছে, আর তার পাদদেশে ঝলমল করছে এক অসীম দরজা—অপার্থিব উজ্জ্বলতায় ভাসছে “EXIT GATE” লেখা। দরজার পাশে অদ্ভুত নীল হরফে স্পষ্ট করে জ্বলছে একটি বাক্য—“Forget to Be Free.” প্রতিটি শব্দ যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে, আরিয়ান অনুভব করল যেন দরজার আলো সরাসরি তার মনের গভীরে প্রবেশ করছে। সেই আলোতে দাঁড়িয়ে তার শরীর কেঁপে উঠল, কারণ এই লেখা যেন সরাসরি তার হৃদয়ে এক প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল: সত্যিই কি মুক্তি মানে সব ভুলে যাওয়া?
নীলা তার হাত শক্ত করে চেপে ধরে ফিসফিস করে বলল, “এটাই শেষ সুযোগ।” তার কণ্ঠে কাঁপন, তবু চোখের দৃষ্টিতে এক অদ্ভুত দৃঢ়তা। “দরজাটা পার হলেই তুমি মুক্তি পাবে। কিন্তু মনে রেখো, পা রাখার মুহূর্তেই তোমার সমস্ত স্মৃতি, তোমার নাম, তোমার অস্তিত্ব—সব মুছে যাবে।” চারপাশের বিশৃঙ্খলা তখন চূড়ান্ত রূপ নিয়েছে। টাওয়ারের পেছনে আকাশের ফাটল আরও বিস্তৃত হচ্ছে, শহরের বাকি অংশগুলো একের পর এক ভেঙে পিক্সেলের ঝড় হয়ে ঝরছে। নীলা এগিয়ে এসে আবারও বলল, “তুমি যতক্ষণ মনে রাখবে, ততক্ষণ এই মরীচিকা তোমাকে ধরে রাখবে। দরজার ওপারে কোনও পরিচয় নেই, কোনও নাম নেই—শুধু স্বাধীনতা।” আরিয়ান দরজার দিকে তাকিয়ে দেখল, সেখানে দাঁড়িয়ে আছে তার নিজের প্রতিচ্ছবি—ঠিক তার মতো, কিন্তু চোখে এক গভীর শূন্যতা। প্রতিচ্ছবিটি নিঃশব্দে হাত বাড়িয়ে ইঙ্গিত করছে, যেন বলছে, “এসো, সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে।” তার মনের ভেতর তুমুল ঝড় বয়ে গেল। এই মুহূর্তে পা বাড়ালেই সে হয়তো মুক্তি পাবে, কিংবা হয়তো চিরতরে শূন্য হয়ে যাবে। পেছনে তাকিয়ে সে দেখল শহরের শেষ আলো নিভে যাচ্ছে, রাস্তার শেষ প্রান্ত মুছে যাচ্ছে। সামনে ঝলমল করছে কেবল সেই দরজা—এক শেষ প্রশ্নের মতো, যার উত্তর তাকে একাই খুঁজে নিতে হবে।
~
আরিয়ান দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন, তার হাতে হাত, হৃদস্পন্দন জোরে বেড়ে চলেছে। ধীর গতিতে সে চারপাশের পরিবেশকে পর্যবেক্ষণ করে—দূরের আলো ঝলমলে, শহরের সব ধ্বনি হঠাৎ যেন থেমে গেছে। এই শহর, যা এখন পর্যন্ত তার পরিচিত মনে হতো, হঠাৎ করে যেন শূন্যের মধ্যে হারিয়ে গেছে। মনে হচ্ছে, প্রতিটি ভবন, প্রতিটি রাস্তাঘাট, প্রতিটি মানুষ—সবই কেবল একটি বড় ক্যানভাসের অংশ, যা কেবল তার চোখের মাধ্যমে জীবন্ত। আরিয়ান অনুভব করে, এই মুহূর্তে তার কাছে দরজা কেবল একটি পদক্ষেপ নয়; এটি মানে তার অস্তিত্বের সীমা ছাড়িয়ে যাওয়া, আত্মপরিচয়ের শেষ পরীক্ষা। সে জানে, যদি সে দরজার বাইরে যাত্রা শুরু করে, সে আর নিজেকে চিনবে না। তার হাসি, তার ব্যথা, তার বন্ধুত্ব, তার স্বপ্ন—সবই অদৃশ্য হয়ে যাবে, কেবল শূন্যের আলোই তাকে গলে খাবে। কিন্তু একই সাথে, যদি সে এই স্থানে থেমে থাকে, এই মরীচিকার শহরে আটকে থাকে, জীবন তার দিকে চেয়েও নেবে না, তাকে চিরকাল ভয়ানক এক স্থিরতায় বন্দি করবে। আরিয়ান এক দীর্ঘ শ্বাস নেয়, নিজের অতীত, বর্তমান এবং সম্ভাব্য ভবিষ্যতের ছবি মনের পর্দায় স্পষ্ট হয়ে ওঠে। প্রতিটি মুহূর্ত—হাসি, কাঁদা, প্রেম, ব্যর্থতা—সবই এক জীবন্ত স্রোতের মতো তাকে টেনে ধরে। সে লক্ষ্য করে, এই দরজা তার জন্য শুধুই এক পদক্ষেপ নয়, এটি মানে আত্মার পরিণতি, অস্তিত্বের অন্তিম অভিজ্ঞতা।
চোখ বন্ধ করে আরিয়ান গভীর শ্বাস নিয়ে নিজের ভেতরের ভয়, অনিশ্চয়তা এবং আগ্রহকে একত্রিত করে। ভেতরে এক অদ্ভুত শূন্যতা জন্মায়, যা তার সব আত্মিক সীমারেখাকে ভেঙে দেয়। সে বুঝতে পারে, যাত্রা শুরু হওয়ার মুহূর্তে তার অস্তিত্ব এক নতুন মাত্রায় প্রবেশ করবে—একটি এমন স্থান, যেখানে “আমি” এবং “তুমি” বা “এটা” আর কোনোটিই থাকবে না। ধীরে ধীরে, দরজার পাশের আলো ঝলমল করতে শুরু করে, তার চোখে যেন এক নতুন আকাশের প্রতিফলন ফুটে ওঠে। আরিয়ান অনুভব করে, এটি তার শেষ মুহূর্ত, শেষ পদক্ষেপ। কিন্তু হঠাৎ এক শান্তি আসে, এক ধরনের মুক্তির অনুভূতি, যা আগে কখনও তার মস্তিষ্কে প্রবেশ করেছিল না। সে নিজের জীবনের সব স্মৃতি, সব বেদনাকে আলিঙ্গন করে, এবং সেই সাথে সবকিছুকে ছেড়ে দেওয়ার প্রস্তুতি নেয়। দরজার আলো তার চারপাশকে ঘিরে ধরে, সমস্ত গ্লিচ, সমস্ত অস্থিরতা, সমস্ত ভৌত অভিজ্ঞতা যেন মুহূর্তের মধ্যে বিলীন হয়। আরিয়ান এক মুহূর্তের জন্য অনুভব করে, সে শুধু আরিয়ান নয়; সে এক অভিজ্ঞতা, এক স্মৃতি, এক নিঃশব্দ তত্ত্ব, যা সময় এবং স্থানকে ছাড়িয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
অবশেষে দরজা খুলে যায়, এবং আরিয়ান আলোতে হারিয়ে যায়। সেই মুহূর্তে শহরের সব গ্লিচ থেমে যায়, প্রতিটি ডিভাইস, প্রতিটি চরিত্র, প্রতিটি ক্যানভাস—সবই স্তব্ধ। কিছু সময়ের জন্য, সমস্ত স্থান ও সময় যেন এক অচেনা শান্তিতে ডুবে থাকে। এরপর ক্যামেরা ধীরে ধীরে এক খালি ঘরে যায়, যেখানে একটি ভিআর হেডসেট মাটিতে পড়ে আছে। স্ক্রিনে হঠাৎ এক লাইন ঝলসে ওঠে, যা পুরো অধ্যায়ের রহস্যকে ঘিরে এক ধাক্কা দেয়—“Simulation Terminated.” এই লাইনটি এক ধরনের নিঃশব্দ চুম্বক শক্তি নিয়ে আসছে, যা পাঠককে বোঝায় যে আরিয়ান সত্যিই এক সীমারেখার ওপরে প্রবেশ করেছে, এবং তার অস্তিত্ব, তার পরিচয়, সবই আরেকটি শূন্যতায় বিলীন হয়েছে। সেই ঘরের নিস্তব্ধতা, হেডসেটের নিঃসঙ্গতা এবং স্ক্রিনের একক লাইন মিলিত হয়ে পুরো অধ্যায়ের এক ধরণের গভীর, মেলানকোলিক এবং রহস্যময় অনুভূতি তৈরি করে, যা পাঠকের মনকে দীর্ঘক্ষণ স্পর্শ করে।
***