Bangla - প্রেমের গল্প

নদীর ধারে এক রাত

Spread the love

অমৃতা দেবনাথ


অফিসের দিনভর আনন্দ আর হৈচৈয়ের পর ধীরে ধীরে রাতের পর্দা নামছে। পিকনিকের শেষ মুহূর্তে চারপাশের হইচই যেন আলতো করে স্তিমিত হয়ে এসেছে, শুধুই গঙ্গার ঘাটের বাতাসে থেকে যাচ্ছে দিনের মিষ্টি ক্লান্তি। বড় বড় গাছের ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলো গলে এসে নদীর জলে ঝিকিমিকি ছড়াচ্ছে, মাঝে মাঝে দূরে কোনো নৌকার ঘণ্টাধ্বনি বা ট্রেনের হুইসেল শোনা যাচ্ছে। অফিসের সহকর্মীরা একজন দুজন করে নিজেদের জিনিসপত্র গুছিয়ে গাড়ির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, কেউ কেউ শেষবারের মতো গ্রুপফটো তোলার জন্য ব্যস্ত। রুদ্র দাঁড়িয়ে আছে খানিকটা দূরে, কোলাহলের ভিড় থেকে আলাদা হয়ে। সে লক্ষ্য করল, তৃষাও এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে, মুখে একটা মৃদু হাসি কিন্তু চোখে যেন অজানা এক দ্বিধা। সহকর্মীদের হাসি-ঠাট্টা ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে গেলে চারপাশের প্রকৃতি যেন নিজের চিরন্তন ছন্দে ফিরে আসে। গঙ্গার হালকা স্রোতের শব্দ, বাতাসের নোনা গন্ধ আর রাতের নরম শীতলতা মিলেমিশে তৈরি করে এক অদ্ভুত আবেশ, যা রুদ্রের মনে অজানা কিছুর সঞ্চার করে।

গাড়িগুলো একে একে ঘাট থেকে দূরে সরে যেতে থাকে। শব্দ মিলিয়ে গেলে কেবল নদীর গা ছুঁয়ে আসা বাতাস আর দূরের আলো-আঁধারি থেকে যায়। রুদ্র অনুভব করল, সে আর তৃষা একা হয়ে পড়েছে এই রাতের ঘাটে, কিন্তু এই একাকিত্ব কোনো অস্বস্তি নয়—বরং একরাশ রহস্যময় আনন্দে ভরা। তৃষা ধীরে ধীরে ঘাটের ধাপ বেয়ে নেমে আসে, তার ওড়নার কোণা বাতাসে দুলতে থাকে। চাঁদের আলোয় তার মুখের ছায়া যেন আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে, আর সেই দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে রুদ্রের বুকের ভেতর এক অচেনা উষ্ণতা ছড়িয়ে পড়ে। সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে তৃষার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকে, কিন্তু চোখে চোখ পড়তেই হঠাৎ দুজনের মধ্যেই এক অদ্ভুত সংকোচ ভর করে। কথার বদলে তারা দুজনেই হালকা হাসিতে ভাঙে সেই নিঃশব্দ মুহূর্ত। রুদ্র এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করে, “তুমি কি কারও সঙ্গে ফিরবে?” তৃষা মাথা নাড়িয়ে জানায়, “না, ভাবছিলাম একটু বসি।” এই অল্প কিছু কথার মধ্যেই যেন লুকিয়ে থাকে এক অদৃশ্য সম্মতি—এই রাতটা এখনও শেষ হওয়ার নয়।

তারা দুজন ধীরে ধীরে পাথরের ঘাটে বসে পড়ে। নদীর স্রোত তাদের পায়ের কাছে এসে মৃদু ঢেউয়ের শব্দে গান গাইছে। দূরের আলো-আঁধারিতে ভেসে থাকা শহরকে দেখে মনে হয় যেন আলাদা এক জগৎ, যেখানে সময়ের কোনও নিয়ম নেই। তৃষা চুপচাপ নদীর দিকে তাকিয়ে থাকে, রুদ্রও কথা না বলে কেবল তার উপস্থিতিকে অনুভব করে। রাতের আকাশে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য তারা আর গঙ্গার ওপর চাঁদের প্রতিফলন এক রহস্যময় আবহ তৈরি করে, যেখানে শব্দের চেয়ে নীরবতা অনেক বেশি শক্তিশালী। অফিসের পরিচিত হাসি-ঠাট্টা, কাজের চাপ বা দৈনন্দিন একঘেয়েমি এখানে এসে একেবারেই তুচ্ছ মনে হয়। দুজনের মধ্যে জমে থাকা অপ্রকাশিত অনুভূতিরা যেন নীরব নদীর মতো ধীরে ধীরে বয়ে যায়, গোপনে হৃদয়ের গভীর থেকে তাদের আরও কাছাকাছি টেনে আনে। এই এক রাতের শুরুতে রুদ্র আর তৃষা বুঝতে পারে, গঙ্গার ধারের এই অনিচ্ছাকৃত থেকে যাওয়া আসলে এক অদ্ভুত যাত্রা—যেখানে তারা দুজনেই নিজেদের অজানা আকাঙ্ক্ষার সামনে দাঁড়িয়ে পড়েছে।

গাড়িগুলোর শেষ আলোটুকু অন্ধকারের গভীরে মিলিয়ে যেতে না যেতেই ঘাটের চারপাশে নেমে আসে এক গাঢ় নীরবতা। দিনের কোলাহল আর অফিসের হাসিঠাট্টার অবশিষ্ট শব্দ যেন এক নিমিষেই গঙ্গার স্রোতের তলায় হারিয়ে যায়। কেবল মাঝে মাঝে দূরে কোনো নৌকার কাঠের চেপে ধরা শব্দ বা নদীর বুকের ঢেউয়ের মৃদু ছলাৎ ছলাৎ আওয়াজ রাতের স্তব্ধতাকে আরও স্পষ্ট করে তোলে। আকাশের ওপরে ঝুলে থাকা পূর্ণচাঁদ তার মোলায়েম আলো ছড়িয়ে দিয়েছে নদীর জলে, যেন অজানা কোনো জ্যোৎস্না-পথ আঁকছে ঘাটের পাথরের গায়ে। বাতাসের হালকা শীতলতা আর নদীর নোনা গন্ধ মিলে এমন এক আবেশ তৈরি করে, যেখানে মানুষের বলা কোনো শব্দই অপ্রয়োজনীয় মনে হয়। তৃষা পাথরের ধাপে বসে আছে, তার ওড়নার কোণা বাতাসে হালকা নড়ছে, চাঁদের আলোয় তার মুখমণ্ডলের আকার স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠছে। রুদ্র কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে সেই দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে থাকে, আর এই নিঃশব্দ রাতের অদৃশ্য আকর্ষণ তার বুকের ভেতরে এক অজানা কম্পন তৈরি করে। মনে হয় যেন গঙ্গার স্রোতও থেমে গেছে, কেবল তাদের দুজনের মধ্যে জমে থাকা গোপন অনুভূতিরা নীরবে বইছে।

তৃষা হালকা দুলে উঠছে এমন এক স্রোতে, যার অস্তিত্ব কেবল রাতের নিস্তব্ধতাই টের পায়। সে কোনো কথা বলছে না, কিন্তু তার নিঃশ্বাসের মৃদু শব্দ যেন রাতের গভীরতায় এক অদ্ভুত সুর তোলে। রুদ্র পায়ের শব্দ না করে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে, যেন এই অচেনা মুহূর্তটিকে বিরক্ত করতে চায় না। তার মনে হয়, এই নীরবতার মধ্যেই লুকিয়ে আছে বহুদিনের অপ্রকাশিত কথা—যা অফিসের ডেস্কে বসে বা দিনের ভিড়ে কোনোদিনই বলা যায়নি। গঙ্গার জল ধীরে ধীরে তীর ছুঁয়ে ফিরে যাচ্ছে, যেন প্রত্যেক ঢেউ তাদের দুজনকে অদৃশ্য কোনো সুতোর মতো বেঁধে রাখছে। রুদ্রের মনে প্রশ্ন আসে, কেন সে আজ এত অস্বাভাবিকভাবে শান্ত অনুভব করছে। তৃষার নীরব উপস্থিতি তাকে এক অচেনা টানে টেনে নিয়ে যাচ্ছে, আর সেই টান থেকে পালানোর কোনো কারণ খুঁজে পাচ্ছে না। রাতের এই নীরবতা যেন শব্দের বাইরে এক অন্য ভাষা, যা শুধু হৃদয় দিয়ে পড়া যায়। রুদ্র চুপচাপ তৃষার পাশে বসে পড়ে, অথচ কোনো কথা না বলেই যেন দুজনের মধ্যে এক নিঃশব্দ আলাপ শুরু হয়ে যায়।

সময় যেন থেমে যায় এই ঘাটের কোণে। চাঁদের আলো নদীর বুকে দীর্ঘ রুপোলি পথ তৈরি করে, যেখানে তাদের চোখের অদৃশ্য স্বপ্নেরা মিশে যাচ্ছে। তৃষা নদীর দিকে তাকিয়ে থাকে, যেন জলের মধ্যে নিজের কোনো পুরনো স্মৃতি খুঁজছে। রুদ্র তাকিয়ে থাকে তৃষার দিকে, আর নিজের ভেতরের অনাবিষ্কৃত অনুভূতিগুলোকে খুঁজে ফেরে। তারা দুজনেই জানে, এই নীরবতা শুধুই শব্দের অভাব নয়, এটি এক ধরনের অদৃশ্য প্রতিশ্রুতি—যা তাদের একে অপরের দিকে আরও কাছে টেনে আনছে। শহরের বাস্তবতা, অফিসের নিয়ম, দিনের হিসেবনিকেশ সব যেন দূরের কোনো অস্তিত্বহীন জগতে হারিয়ে গেছে। এখানে কেবল আছে গঙ্গার ঢেউ, চাঁদের স্নিগ্ধ আলো, আর দুটো হৃদয়ের অজানা আকাঙ্ক্ষা। এই অচেনা নীরবতা তাদের এমন এক জগতে নিয়ে যায়, যেখানে চোখের দৃষ্টি আর মৃদু নিঃশ্বাসই যথেষ্ট; যেখানে কোনো শব্দের দরকার নেই, কারণ প্রতিটি অনুভূতিই নিঃশব্দে নিজের কথা বলে।

চাঁদের আলোতে ভিজে থাকা গঙ্গার ঘাটে বসে রুদ্র প্রথমে হালকা কাশিতে গলা পরিষ্কার করল, যেন শব্দহীন রাতের মাঝখান থেকে কথার সেতু গড়ে তোলার সাহস খুঁজছে। তৃষা পাশ ফিরে তাকিয়ে মৃদু হাসল, সেই হাসি রুদ্রের সংকোচ কাটিয়ে দিল মুহূর্তেই। শুরুটা ছিল খুব সাধারণ—অফিসের আজকের পিকনিক নিয়ে মজার মজার ঘটনা, সহকর্মীদের হাস্যকর ভুল, কিংবা ম্যানেজারের অদ্ভুত মন্তব্য। তৃষা মাঝে মাঝে হেসে উঠছিল, আর সেই হাসির সাথে মিশে যাচ্ছিল নদীর ঢেউয়ের ছলাৎ ছলাৎ শব্দ। রুদ্র লক্ষ্য করল, তৃষার হাসির ভেতর এক ধরনের স্বচ্ছতা আছে, যা দিনের আলোতে সে কখনও খেয়াল করেনি। কথার স্রোত ছোট ছোট ঢেউয়ের মতো এগোতে লাগল—কেউ কারও গোপন কিছু প্রকাশ করছে না, কিন্তু প্রতিটি শব্দের ফাঁকেই যেন লুকিয়ে আছে অদ্ভুত এক উষ্ণতা। গঙ্গার বাতাস তৃষার চুলে খেলা করছিল, কখনও তার গাল ছুঁয়ে যাচ্ছিল, কখনও রুদ্রের দিকে হালকা ছায়া ফেলছিল। সেই বাতাসের ছন্দে তৃষার চুলের নড়াচড়া রুদ্রের মনে এক অজানা টান তৈরি করছিল, যা সে ভাষায় প্রকাশ করতে পারছিল না।

ধীরে ধীরে আলাপ গড়াল অফিসের বাইরের জগতে—রুদ্র বলল তার কলেজের দিনগুলোর কথা, প্রথমবার একা ভ্রমণের অভিজ্ঞতা, আর ছোটবেলার দুষ্টুমিগুলো। তৃষা হাসতে হাসতে মাঝে মাঝে নিজের ছোট ছোট গল্প শোনাচ্ছিল—শহরের ভিড়ে হারিয়ে যাওয়া শৈশব, পরিবারের কড়া নিয়মের আড়ালে লুকোনো তার ছোটখাটো স্বপ্নগুলো। প্রত্যেকটি বাক্যের পরের নিঃশ্বাস যেন অদৃশ্য কোনো সেতু তৈরি করছিল, যেখানে শব্দের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল দৃষ্টির বিনিময়। রুদ্র খেয়াল করল, তৃষা যখন নিজের গল্প বলে তখন তার চোখে এক অদ্ভুত উজ্জ্বলতা ফুটে ওঠে, আর সে মুহূর্তে চারপাশের গাঢ় নীরবতাও যেন আরও মায়াবী হয়ে ওঠে। রুদ্র হঠাৎ অনুভব করল, তারা যেন দুজনেই নিজের জীবনের অজানা শূন্যতা থেকে কিছুটা মুক্তি খুঁজছে, আর সেই মুক্তির দরজা খুলছে এই কথোপকথনের ফাঁকফোকরে। প্রতিটি ছোট্ট হাসি, হালকা বিরতি, কিংবা বাতাসের সাথে মিলিয়ে যাওয়া নিঃশ্বাস—সবই যেন একে অপরকে আরও কাছে ডেকে আনার গোপন ইঙ্গিত।

রাত বাড়ার সাথে সাথে কথার গতি ধীর হলেও গভীর হয়ে উঠল। তৃষার হাসির আড়ালে লুকিয়ে থাকা হালকা ক্লান্তি, রুদ্রের চোখের কোণে অচেনা মমতা—সবকিছু মিলিয়ে এক অদ্ভুত আবহ তৈরি হচ্ছিল, যা কেবল এই রাতের জন্যই সম্ভব। গঙ্গার জলের ওপর চাঁদের রুপোলি প্রতিফলন যেন তাদের প্রতিটি শব্দের সাক্ষী হয়ে ছিল, প্রতিটি অনুভূতির সাথী হয়ে। রুদ্র অনুভব করছিল, তৃষার সাথে এই ছোট ছোট আলাপ তার অন্তরের অনেক অচেনা দরজা খুলে দিচ্ছে, যেগুলো সে এতদিন বন্ধ করে রেখেছিল। তৃষার ঠোঁটে জমে থাকা অর্ধেক হাসি, বাতাসে উড়তে থাকা চুল, আর মৃদু দৃষ্টির গভীরতা তাকে অজান্তেই আরও কাছে টেনে আনছিল। কোনো প্রকাশ্য স্বীকারোক্তি ছিল না, কোনো স্পষ্ট প্রেমের কথা নয়, তবুও প্রতিটি বাক্যের মাঝখান দিয়ে বয়ে যাচ্ছিল এক অদৃশ্য অনুভূতির স্রোত—যেন গঙ্গার জলের মতোই নীরব অথচ শক্তিশালী। রুদ্রের মনে হচ্ছিল, এই কথার ফাঁকফোকরই হয়তো তাদের দুজনের সম্পর্কের আসল গল্প, যেখানে না বলা শব্দগুলোই সবচেয়ে স্পষ্ট সত্য।

গঙ্গার ঘাটের রাত আরও গভীর হয়ে এসেছে, আকাশের ওপরে ঝুলে থাকা পূর্ণচাঁদ তার সমস্ত মায়াবী আলো ঢেলে দিচ্ছে নদীর বুকে। জলের ওপর ছড়িয়ে থাকা সেই রুপোলি আভা যেন স্রোতের ভাঁজে ভাঁজে ছোট ছোট সিলভার রেখা এঁকে দিয়েছে, যা দূর থেকে দেখতে মনে হয় এক বিশাল চিত্রকরের তুলির টান। বাতাসের মৃদু শীতলতা তৃষার গায়ে লাগছে, তার ওড়নার কোণা হালকা কাঁপছে, চুলের কয়েকটা গোছা বারবার গালের ওপর এসে পড়ছে। রুদ্র পাশে বসে আছে, কিন্তু তার দৃষ্টি যেন চাঁদের আলোয় ভেসে থাকা নদীর চেয়েও বেশি আটকে গেছে তৃষার মুখে। চাঁদের নরম আলো তৃষার চোখের কোণে এক অদ্ভুত দীপ্তি এনে দিয়েছে, যা রুদ্রকে অনায়াসে টেনে নিচ্ছে এক অচেনা অনুভূতির গভীরে। সে অবচেতনভাবে তৃষার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকে, নিজের দৃষ্টি ফিরিয়ে নেওয়ার কোনো চেষ্টা না করেই। মনে হয় যেন সময় থেমে গেছে, আর এই রাতের নীরবতার মধ্যে তাদের দুজনের নিঃশব্দ শ্বাসপ্রশ্বাসই একমাত্র জীবন্ত সুর।

তৃষা প্রথমে বুঝতে পারেনি রুদ্রের দৃষ্টি এত গভীর হয়ে উঠেছে। সে নদীর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ চোখ ঘুরিয়ে রুদ্রের দিকে তাকাতেই থমকে যায়। চাঁদের আলোয় রুদ্রের চোখের মৃদু উজ্জ্বলতা আর অদ্ভুত কোমলতা তাকে এক মুহূর্তের জন্য কাঁপিয়ে দেয়। দুজনের চোখ একে অপরের সঙ্গে মিশে যায়—কোনো শব্দ নেই, কিন্তু সেই দৃষ্টির ভেতরেই যেন হাজার অপ্রকাশিত কথা বয়ে চলে। তৃষা চোখ সরিয়ে নিতে চাইলেও পারে না, যেন সেই দৃষ্টি তাকে অদৃশ্য কোনো বাঁধনে আটকে রেখেছে। তার বুকের ভেতর দ্রুত স্পন্দন, শীতল বাতাসের মধ্যে উষ্ণতার অদ্ভুত মিশ্রণ—সব মিলিয়ে মুহূর্তটি এমন তীব্র যে চারপাশের জগত যেন মিলিয়ে যাচ্ছে। নদীর ঢেউয়ের মৃদু শব্দ আর দূরের নৌকার ঘণ্টা এই নীরবতাকে ভাঙতে চাইলেও পারছে না; বরং এই শব্দগুলোই মনে করিয়ে দিচ্ছে, এই রাতের প্রতিটি মুহূর্ত কতটা অপরিবর্তনীয় ও অমূল্য।

রুদ্র ধীরে ধীরে গভীর নিঃশ্বাস নিল, যেন সেই দৃষ্টির ভিতর দিয়ে তৃষার মনের গোপন কথা পড়তে চাইছে। সে বুঝতে পারছে, এই মুহূর্ত কেবল আকর্ষণের নয়—এটি এক ধরনের স্বীকৃতি, যেখানে কোনো ভাষা বা প্রকাশের দরকার নেই। তৃষার চোখে সে দেখছে এক অজানা টান, এক অপ্রকাশিত সম্মতি, যা এই নিঃশব্দ রাতকে আরও অর্থপূর্ণ করে তুলছে। তৃষা অনুভব করল, রুদ্রের উপস্থিতি শুধু পাশের মানুষ নয়, বরং সেই নীরব সঙ্গী, যে তার ভিতরের অচেনা শূন্যতাকে পূর্ণ করতে পারে। কিন্তু একই সঙ্গে এই অনুভূতি তাদের বাস্তব জীবনের সীমাবদ্ধতাও মনে করিয়ে দিচ্ছে—অফিসের সহকর্মী হিসেবে পরিচিতি, আগামীকালের স্বাভাবিকতা, আর সামাজিক নিয়মের অদৃশ্য প্রাচীর। তবুও সেই মুহূর্তে কোনো ভয় নেই, কোনো দ্বিধা নেই—শুধু আছে চাঁদের আলোয় মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকার এক অপূর্ব তীব্রতা, যা তাদের দুজনের হৃদয়ের গভীরে চিরতরে খোদাই হয়ে থাকবে।

গঙ্গার ঘাটের নিস্তব্ধতা ধীরে ধীরে আরও ঘন হয়ে এসেছে, যেন রাতের প্রতিটি মুহূর্ত তাদের দুজনকে নিজেদের গভীরে ডুব দেওয়ার জন্য তাগিদ দিচ্ছে। চাঁদের আলো নদীর বুকে ছড়িয়ে এক শান্ত পরশ এনে দিয়েছে, আর সেই পরশের মধ্যেই তৃষা হঠাৎ তার দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে ধীর গলায় বলতে শুরু করল নিজের অতীতের কথা। শব্দগুলো বেরিয়ে এল খুব ধীরে, কিন্তু তাতে লুকিয়ে ছিল বহুদিনের জমে থাকা ভার। সে বলল শহরের একঘেয়ে দিনের কথা—প্রতিদিনের কোলাহল, কাজের চাপ, আর একই রকমের নিস্তরঙ্গ রুটিনের আড়ালে জমে থাকা নিঃসঙ্গতার অনুভূতি। ছোটবেলায় স্বপ্ন ছিল অনেক, কিন্তু জীবনের বাস্তবতা সেই স্বপ্নগুলোকে কোথায় যেন হারিয়ে দিয়েছে। তৃষা বলল কিভাবে এক সময় ভালোবেসেছিল একজনকে, যে তাকে আশার আলো দেখিয়েছিল, কিন্তু শেষমেশ অজানা কারণে সম্পর্কটা ভেঙে যায়। সেই অসম্পূর্ণ ভালোবাসা তাকে শুধু শূন্যতাই দেয়নি, দিয়েছে এক অদ্ভুত ভয়ের ছায়া—আবার কাউকে কাছে টেনে নেওয়ার ভয়। রুদ্র চুপচাপ শুনতে শুনতে বুঝতে পারছিল, তৃষার কণ্ঠের মৃদু কম্পন আর প্রতিটি নিঃশ্বাসে লুকিয়ে আছে বহু অপ্রকাশিত কষ্ট, যা এতদিন কারও সামনে সে প্রকাশ করেনি।

তৃষার কথা নদীর ঢেউয়ের সঙ্গে মিশে রাতের বাতাসে ভেসে যাচ্ছিল। রুদ্র তাকে থামাল না, কোনো সান্ত্বনামূলক শব্দও উচ্চারণ করল না, কেবল নীরবে শুনতে লাগল। তার মনে হচ্ছিল, এই মুহূর্তে তৃষার দরকার শুধুই একজন মনোযোগী শ্রোতা—কেউ যে বিচার করবে না, কেবল বোঝার চেষ্টা করবে। তৃষা বলল কিভাবে শহরের ভিড়ে থেকেও একা লাগত, কিভাবে মানুষের ভিড়ে থেকেও নিজের সঙ্গে কথোপকথনের অভাব তাকে অস্থির করে তুলত। সে স্বীকার করল, কখনও কখনও মনে হয় জীবনের অনেকটা সময় সে শুধু নিজের কষ্ট লুকোতে কাটিয়েছে, হাসির আড়ালে জমে থাকা দুঃখগুলোকে কেউ যেন না দেখতে পায় সেই চেষ্টাতেই দিনগুলো কেটেছে। রুদ্র শুনতে শুনতে নিজের ভেতরের একাকিত্বের মুখোমুখি হতে লাগল। অফিসের ব্যস্ততা, বন্ধুদের সাথে আড্ডা, সামাজিক সম্পর্ক—সবকিছুর আড়ালে যে এক গভীর শূন্যতা লুকিয়ে আছে, তা হঠাৎ করে যেন চোখে স্পষ্ট হয়ে উঠল। সে বুঝতে পারল, তৃষার গল্প শুধু তার নিজের নয়, অনেকটা তার নিজের জীবনের প্রতিফলনও বটে।

রুদ্র ধীরে ধীরে নিজের চিন্তার ভেতর ডুবে গেল। তৃষার অতীতের কষ্ট, অসম্পূর্ণ ভালোবাসা, আর একাকিত্বের যন্ত্রণা যেন তার নিজের অপ্রকাশিত অনুভূতিগুলোর দরজা খুলে দিচ্ছিল। সে মনে মনে নিজের পুরনো স্মৃতির দিকে ফিরে গেল—কত মানুষ এসেছে জীবনে, কত সম্পর্ক এসেছে আর হারিয়ে গেছে, তবুও ভিতরের শূন্যতা কখনও মুছে যায়নি। সে ভাবল, হয়তো এই রাতের অদ্ভুত সাক্ষাৎ কেবল একটি আকস্মিক মেলবন্ধন নয়, বরং তাদের দুজনের হৃদয়ের গভীরে থাকা ক্ষতগুলিকে স্পর্শ করার এক অদৃশ্য নিয়তি। তৃষার মুখে যখন চাঁদের আলো পড়ছিল, তখন তার চোখের গভীরে রুদ্র যেন দেখতে পেল সেই অজানা বেদনা, যা তার নিজের চোখের ভেতরের শূন্যতার সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। তারা দুজনেই কোনো শব্দ না বলেও বুঝতে পারছিল, এই মুহূর্তে একে অপরকে বোঝার নীরব প্রতিশ্রুতি তৈরি হচ্ছে। রাতের গাঢ় নীরবতা, নদীর মৃদু স্রোত, আর তাদের ভেতরের না-বলা কথাগুলো একসঙ্গে মিলে যেন পুরনো স্মৃতির দরজা খুলে দিয়ে তাদের হৃদয়ের গভীরে আলতো করে ছুঁয়ে যাচ্ছে।

গঙ্গার স্রোত যেন হঠাৎ করেই গভীর হয়ে উঠল। চারপাশের নীরবতার ভেতর দিয়ে বাতাসের স্নিগ্ধ শব্দ আর জলের ঢেউয়ের গোপন সুর মিশে এক অদ্ভুত মাদকতা ছড়িয়ে দিচ্ছিল। ঘাটের পাশের গাছের পাতাগুলো কাঁপতে কাঁপতে যেন নদীর গানকে সঙ্গ দিচ্ছে, আর চাঁদের আলো গঙ্গার বুকের ওপর ভেসে থাকা ঢেউয়ের মাথায় রূপোলি আঁচড় কেটে চলেছে। রুদ্র অনুভব করল, এই অচেনা রাতটা ধীরে ধীরে যেন তাদের দুজনের চারপাশে এক অদৃশ্য বৃত্ত তৈরি করছে—যেখানে বাইরের পৃথিবীর অস্তিত্ব নেই, নেই অফিসের ব্যস্ততা, নেই দিনের ক্লান্তি। তৃষা পাশেই বসে আছে, মুখে শান্ত এক ছায়া, কিন্তু সেই শান্তির ভেতর যেন লুকিয়ে আছে এক অদ্ভুত আলোড়ন। হঠাৎই হালকা বাতাস বইতে শুরু করল, নদীর ঢেউয়ের সঙ্গে মিলেমিশে ঘাটের শীতল পাথরের ওপর অদ্ভুত সুর তোলে। তৃষার কাঁধে রাখা ওড়নাটা ধীরে ধীরে বাতাসে ভেসে উঠল, চাঁদের আলোয় সেই উড়ন্ত কাপড়টা যেন সাদা মেঘের টুকরো হয়ে আকাশ ছুঁতে চাইছে।

রুদ্র হঠাৎই হাত বাড়িয়ে সেই উড়তে থাকা ওড়নাটা ধরল। আঙুলের ছোঁয়া প্রায় নিঃশব্দে তৃষার হাতে স্পর্শ করল। মুহূর্তটা এতটাই ক্ষণিক, অথচ এতটাই গভীর যে সময় যেন একেবারে থমকে দাঁড়াল। তৃষার শরীরের সামান্য কেঁপে ওঠা, শ্বাসের অচেনা ছন্দ, আর চোখের কোণে ঝলসে ওঠা হালকা বিস্ময়—সবকিছু মিলিয়ে সেই স্পর্শের মধ্যে যেন এক অনুচ্চারিত গল্প লুকিয়ে রইল। রুদ্র নিজের ভেতরে সেই অনুরণনকে চাপা দিতে চাইলেও পারল না। বাতাসে তৃষার চুলের গন্ধ, গঙ্গার জলের লবণাক্ত শীতলতা, আর রাতের অদ্ভুত নিস্তব্ধতা মিলেমিশে এক তীব্র উত্তাপে জ্বলে উঠছিল। তৃষাও অনুভব করছিল সেই অজানা টান। তার হৃদস্পন্দন যেন নদীর স্রোতের তালে তালে দ্রুত বেজে উঠছিল। অথচ কেউই মুখে একটিও শব্দ আনতে পারল না। এই নীরবতার ভেতরেই লুকিয়ে রইল এমন এক আকাঙ্ক্ষা, যা হয়তো এতদিন তাদের অচেতন মনের গভীরে ঘুমিয়ে ছিল।

সময়ের হিসেব যেন গঙ্গার ঢেউয়ের সঙ্গে ভেসে হারিয়ে গেল। চাঁদের আলোয় তৃষার মুখের হালকা ঝিলিক রুদ্রের চোখে ধরা পড়ল—সেই আলোয় মিশে আছে এক অদ্ভুত কোমলতা, যা হয়তো কথার চেয়েও অনেক বেশি স্পষ্ট। রুদ্র বুঝতে পারল, আজকের রাত শুধু একটি অফিস পিকনিকের পরে কাটানো কয়েকটা অতিরিক্ত মুহূর্ত নয়। এই রাত যেন দুজনের ভেতরের শূন্যতাকে ধীরে ধীরে পূর্ণ করে দিচ্ছে, এমন কিছু অনুভূতির দরজা খুলে দিচ্ছে যা এতদিন তারা হয়তো নিজেরাও স্বীকার করতে পারেনি। গঙ্গার স্রোত ক্রমশ গাঢ় হতে থাকল, যেন নদীও তাদের গোপন আকাঙ্ক্ষাকে আশ্রয় দিচ্ছে। রুদ্রের হাত এখনও তৃষার ওড়নার প্রান্তে আলগা করে ধরা, তৃষার চোখে এক অচেনা ঝলক, আর চারপাশের নিস্তব্ধতার ভেতর সেই স্পর্শের উষ্ণতা ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছিল। সেই মুহূর্তে তারা দুজনেই বুঝে ফেলল—আজকের রাত আর কেবল সহকর্মীর সীমায় আটকে নেই, এই রাত তাদের ভেতরের অজানা জগৎকে ছুঁয়ে দিয়েছে, এমন এক স্রোতের মতো, যা একবার শুরু হলে আর থামানো যায় না।

গঙ্গার তীরের রাত যেন আরও গাঢ় হয়ে উঠল, চারপাশের অন্ধকারে চাঁদের আলো হালকা সিলভার রেখা টেনে দিচ্ছে নদীর বুকে। ঢেউয়ের মৃদু শব্দের সঙ্গে মিশে আছে দূরের অচেনা ঘণ্টাধ্বনি, যেন সময়ের কোনও গোপন ঘোষণা। রুদ্র আর তৃষা এখনও পাশাপাশি বসে, কিন্তু এই নীরবতা আর কেবল বাইরে নয়, যেন ভেতরের এক অদৃশ্য সংলাপ হয়ে উঠেছে। বাতাসের প্রতিটি শীতল ঝাপটা তাদের শরীর ছুঁয়ে যাচ্ছে, কিন্তু তার চেয়েও বেশি স্পর্শ করছে তাদের অন্তরের গভীরে জমে থাকা অচেনা অনুভূতিগুলোকে। রুদ্র তাকিয়ে আছে তৃষার দিকে—চোখে কোনও সরাসরি প্রশ্ন নেই, তবু এক অদৃশ্য স্বীকারোক্তির দীপ্তি সেখানে স্পষ্ট। তৃষা নিজের ঠোঁট কামড়ে ধরা এক চাপা উত্তেজনা লুকানোর চেষ্টা করছে, কিন্তু তার চোখের ভাষা যেন ধরা দিচ্ছে না। কোনও শব্দ নেই, তবু সেই দৃষ্টির মধ্যে এক নিঃশব্দ ঘোষণা, যেন দুজনেই বুঝে নিয়েছে যে আজকের রাত তাদের সম্পর্কের এক অদ্ভুত বাঁক। হয়তো এ স্বীকারোক্তি আগামী দিনের নিয়ম ভাঙবে না, হয়তো এই মুহূর্ত শেষ হওয়ার পর সব আগের মতো হয়ে যাবে, তবু এই নীরবতার ভিতরেই লুকিয়ে আছে তাদের হৃদয়ের সবচেয়ে সত্যি কথা।

রুদ্রের মনে এক অদ্ভুত দ্বন্দ্বের ঢেউ খেলল। সে জানে, তৃষার চোখে যে স্বীকারোক্তির ঝিলিক, তা কেবল এক রাতের আকর্ষণ হয়তো—কাজের ব্যস্ততা আর দৈনন্দিন ক্লান্তির ফাঁকে পাওয়া এক মায়াবী থেমে থাকা মুহূর্ত। তবু সেই ঝিলিক এতটাই বাস্তব, এতটাই গভীর যে উপেক্ষা করা যায় না। তার মনে হঠাৎই ভেসে উঠল দিনের পর দিন অফিসের করিডোরে তৃষার অচেনা হাসি, কখনও চুপ করে বসে থাকার নীরবতা, কখনও হঠাৎ কোনও মজার কথা বলে ভেঙে দেওয়া দূরত্ব। হয়তো এইসব ছোট ছোট ঘটনার ভিতরেই আজকের রাতের বীজ বোনা ছিল। রুদ্র অনুভব করল, হয়তো তাদের দুজনের জীবনে এক ধরনের একাকিত্ব ছিল, যা এই নির্জন রাত তাদের কাছাকাছি এনে দিয়েছে। তৃষার চোখের গভীরতায় সেই একাকিত্বের ছায়া আরও স্পষ্ট। তার ঠোঁটে যেন এক অপ্রকাশিত কৃতজ্ঞতার মৃদু হাসি, যেন বলতে চাইছে—কেউ যদি না-ও বোঝে, এই এক রাতের সংযোগ তাদের দুজনের ভেতরের শূন্যতাকে এক অদ্ভুত পরশ দিয়ে গেছে।

তৃষাও একই দ্বিধার ভেতর দিয়ে যাচ্ছিল। তার মন জানত, আগামীকাল সকালে অফিসে ফিরে গেলে এই রাতের কোনও চিহ্ন থাকবে না। কাজের ফাইল, মিটিং, টিমের হাসি—সবকিছুর ভেতর ডুবে যাবে এই অনুভূতি। তবু তার হৃদয়ের গভীরে যে অচেনা উষ্ণতা এখন জেগে উঠেছে, তা যেন চিরকালের মতো থেকে যাবে। সে বুঝল, রুদ্রের চোখের সেই নীরব ডাক কেবল আজকের রাতের জন্য হলেও এক অমোঘ সত্যি। তাদের মধ্যে হয়তো কোনও প্রতিশ্রুতি নেই, নেই কোনও শব্দে বাঁধা প্রেমের ঘোষণা, কিন্তু এই নীরব মুহূর্তটাই যেন সবকিছু বলে দিচ্ছে। তৃষা ধীরে ধীরে নিজের মাথা একটু কাত করে গঙ্গার জলের দিকে তাকাল, যেন নদীর অনন্ত স্রোত এই নিঃশব্দ স্বীকারোক্তির সাক্ষী হয়ে থাকুক। রুদ্রও তার পাশে নীরবে বসে রইল, হাত দুটো পাথরের ঘাটে আলগা করে রাখা, কিন্তু হৃদয়ের গভীরে এক অদ্ভুত নিশ্চয়তা—যতদিন এই রাতের স্মৃতি থাকবে, ততদিন তাদের দুজনের এই নীরব স্বীকারোক্তি কোনও না কোনওভাবে বেঁচে থাকবে। চাঁদের আলো নদীর ঢেউ ছুঁয়ে দূরে মিলিয়ে গেলেও, এই এক রাতের অনুভূতি হয়ে থাকবে এক অনন্ত প্রতিধ্বনি, যা কোনও শব্দের প্রয়োজন ছাড়াই দুজনের হৃদয়ে চিরকাল বাজতে থাকবে।

গঙ্গার ধারের রাত তখন এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতায় মোড়া। চাঁদের আলো যেন আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে, নদীর বুক জুড়ে ছড়িয়ে দিচ্ছে এক মায়াবী সিলভার আভা। মাঝে মাঝে দূরে স্টেশনের হুইসেলের শব্দ ভেসে আসে, সেই শব্দে মিশে যায় কোনও অচেনা নৌকার ঘণ্টাধ্বনি, যেন দুজনকে মনে করিয়ে দিচ্ছে—সময় থেমে নেই, পৃথিবী তার নিজের ছন্দে এগিয়ে চলেছে। কিন্তু সেই বাস্তবতার ডাক যেন আজ গঙ্গার এই রাতের কাছে অচেনা। রুদ্র ও তৃষা দুজনেই অনুভব করছে, যেন এক অদৃশ্য বৃত্ত তাদের চারপাশে গড়ে উঠেছে, যেখানে বাইরের সব নিয়মকানুন, দিনের ব্যস্ততা কিংবা আগামীকালের দায়িত্বগুলো ধীরে ধীরে হারিয়ে গেছে। নদীর ঢেউয়ের শব্দ তাদের মধ্যে অদ্ভুত এক নীরবতা এনে দিয়েছে, যে নীরবতা শব্দের চেয়ে অনেক গভীর। এই মুহূর্তে যেন সময় নিজেই তাদের দিকে তাকিয়ে থেমে আছে—এক অচেনা জগতে, যেখানে শুধু দুটি মানুষের হৃদস্পন্দনই সবচেয়ে স্পষ্ট সঙ্গীত।

রুদ্র সেই মুগ্ধতায় হারিয়ে গিয়ে হঠাৎই উপলব্ধি করল, কতটা সময় কেটে গেছে। শেষ গাড়িগুলো অনেক আগেই চলে গেছে, সহকর্মীদের হাসির শব্দ মিলিয়ে গেছে বহুক্ষণ আগে। কিন্তু এই জায়গা থেকে সরার কোনও তাড়া তার নেই। তৃষার মুখে সেই শান্ত ছায়া এখনও নরম আলোয় ঝলসে উঠছে, চোখের গভীরে লুকিয়ে আছে এক অদ্ভুত কোমলতা। রুদ্রের মনে প্রশ্ন জাগে, কী এমন টান যা তাদের দুজনকে এই ঘাটে আটকে রেখেছে? হয়তো জীবনের প্রতিদিনের ক্লান্তি, হয়তো একাকিত্বের অদৃশ্য শূন্যতা—সবকিছু মিলিয়ে এই রাতকে এমন এক বাঁধনে বেঁধে ফেলেছে, যা ভাঙা যায় না। সময়ের ডাক আছে, কিন্তু তাদের চারপাশের এই রাত যেন সেই ডাকে কর্ণপাত করছে না। বাতাসের প্রতিটি শীতল ঝাপটা, নদীর প্রতিটি ঢেউ, আর আকাশের প্রতিটি তারা যেন চুপ করে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে, যেন বলছে—এখানে থাকো, যতক্ষণ পারো এই থেমে থাকা মুহূর্তের স্বাদ নাও।

তৃষা নদীর দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে বলল, “সময় কি সত্যিই এত দ্রুত চলে যায়, রুদ্র?” তার কণ্ঠে কোনও ভয় নেই, বরং এক অদ্ভুত স্বপ্নময়তা। রুদ্র উত্তর দিতে গিয়েও থেমে যায়। কী উত্তর দেওয়া যায় এই প্রশ্নের, যেখানে সময় আর বাস্তবতার হিসেব মুছে গেছে? তাদের দুজনের মধ্যে যেন এক অদৃশ্য বোঝাপড়া তৈরি হয়েছে—আজকের রাত হয়তো চিরকাল থাকবে না, কিন্তু এই মুহূর্তের অনুভূতি কোনও দিন মুছে যাবে না। তারা জানে, আগামীকাল সকালে অফিসের আলো, শহরের গুমোট গতি, আর দায়িত্বের ভার তাদের টেনে নিয়ে যাবে। তবু এই অদৃশ্য বাঁধন—যেটা আজ নদীর ধারে তাদের ঘিরে ধরেছে—সে বাঁধন আগামীকালের ভিড়েও তাদের মনে থেকে যাবে। গঙ্গার ঢেউ যেমন কখনও থেমে থাকে না, তেমনই সময়ও থেমে নেই, কিন্তু এই এক রাতের জাদু যেন সময়ের বুকেই এক অমলিন দাগ কেটে দিল। চাঁদের আলো ধীরে ধীরে কমে আসছে, নদীর স্রোত আরও গভীর হচ্ছে, আর সেই অদৃশ্য বাঁধনে বাঁধা রুদ্র ও তৃষা নীরবে অনুভব করছে—কিছু মুহূর্তের কোনও সমাপ্তি হয় না, তারা শুধু থেকে যায়, হৃদয়ের অন্দরমহলে অনন্ত প্রতিধ্বনি হয়ে।

রোদ কেবল আকাশের কোণে হালকা আভা ফেলছিল, তবুও নদীর ধারে সেই মুহূর্ত যেন অন্য জগৎ থেকে আলাদা। তৃষা ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায়, তার দৃষ্টির মাঝে এক অদ্ভুত দোলাচল, যেমন সে ঠিক জানে না এই মুহূর্তে হারিয়ে যাওয়ার বা ফিরে যাওয়ার মধ্যে কোনটিই সঠিক। নদীর ঢেউ তার পা কাছে এসে হালকা স্পর্শ করছে, যেন নদী নিজেই বিদায়ের সংকেত দিচ্ছে। রুদ্র পাশে দাঁড়িয়ে, তার চোখে কিছুটা অনিশ্চয়তা, কিছুটা নীরব আকাঙ্ক্ষা। দুজনের মধ্যে এই মুহূর্তে এমন এক অদৃশ্য কাব্যিক সম্পর্ক জন্মেছে, যা শুধুই নদী, বাতাস এবং দূরের পাহাড় ছাড়া কেউ বোঝার ক্ষমতা রাখে না। তারা জানে, গাড়ি আসতে বেশি সময় নেই, কিন্তু মন চাইছে আরও কিছুক্ষণের জন্য এই শান্তি, এই নদীর নীরবতার মাঝে হারিয়ে থাকতে। রুদ্রের হাতে থাকা চূড়ান্ত সিগারেটের ধোঁয়া হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে, আর তৃষার হাত ঢেউয়ের সঙ্গে ছায়ার মতো খেলে যাচ্ছে। সে হালকা হাসি, যা কিছুই প্রকাশ করছে না কিন্তু সবই বোঝাচ্ছে, যেন বলে—“আমরা এখন এখানে আছি, আর এই মুহূর্তটা চিরদিনের মতো মনে থাকবে।”

গাড়ির আওয়াজ দূরে কানের কোণে বাজতে থাকে, কিন্তু তৃষা আর রুদ্র যেন সেই শব্দের সঙ্গে লড়ছে না, বরং তাদের হৃদয় নিজেদের ভেতরের অনুভূতির সঙ্গে দ্বন্দ্ব করছে। রুদ্র অল্পক্ষণ চুপ থাকে, তারপর হঠাৎ ধীরে ধীরে বলতে শুরু করে, “যদি আরও কিছুক্ষণ থাকতাম, কেমন হতো, জান?” তৃষা তার চোখে মৃদু জিজ্ঞাসা জ্বালায়, হালকা হাসি দিয়ে বলে, “কিন্তু আমরা যে জায়গায় পৌঁছেছি, সেটাই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ—এখানেই আমরা।” তাদের কথায় নেই কোনও বিশদ ব্যাখ্যা, নেই কোনো হাহাকার, শুধু অনুভূতির চুপচাপ বিনিময়। নদীর পাশে থাকা সমস্ত শ্বাস, ঢেউয়ের গর্জন, বাতাসের শীতলতা—সবই যেন তাদের একরাশ আবেগের অংশ হয়ে গেছে। এই নীরবতা, এই অদৃশ্য স্পর্শ—সবই একটি মুহূর্তের জন্য স্থির হয়ে আছে, যেখানে সময়ের কোনো মানে নেই, শুধুই অনুভূতি আছে, অপ্রকাশিত কিন্তু গভীর।

শেষ মুহূর্তে, গাড়ির হুইসেল আর নকশী পথের ধ্বনি কাছে আসে, যেন তাদেরকে বাস্তব জগতে ফিরিয়ে নিয়ে আসার আহ্বান জানাচ্ছে। তৃষা ধীরে ধীরে তার ব্যাগ আঁকড়ে ধরে, আর রুদ্র তার চশমার উপরে হালকা ছোঁয়া দেয়, যেন বলছে—“আমি আবারও ফিরে আসব।” তাদের চোখে থাকে এক রাশ অনুভূতির বিপর্যয়, অনুতাপ আর প্রশান্তির এক অদ্ভুত মিশ্রণ। তারা জানে, নদীর ধারের সেই মুহূর্ত আর ফিরে আসবে না, তবে সেই অনুভূতি তাদের মধ্যে চিরকাল বেঁচে থাকবে। গাড়ির দরজা বন্ধ হওয়ার আগে রুদ্র এবং তৃষার চোখ একে অপরের সাথে শেষবারের মতো মিলিত হয়, যেন নীরবে স্বীকার করছে সব অপ্রকাশিত আবেগ, সব অনুজ্ঞাপূর্ণ মুহূর্ত। তারা ধীরে ধীরে গাড়ির ভিতরে চলে যায়, কিন্তু তাদের মনে থাকে সেই নদীর ধারে এক মিনিটের নিরবতা, যেখানে বিদায়ের ব্যথা ও উপস্থিতির আনন্দ একসাথে মিলিত হয়েছে, এবং ফেরার দ্বিধা তাদের হৃদয়ে একটি মিষ্টি দাগ রেখে যায়।

১০

শহরের আলো ধীরে ধীরে গাড়ির জানালা দিয়ে প্রবেশ করতে শুরু করল, আর কাঁচের ওপর পড়া লাইটের প্রতিফলন রুদ্র এবং তৃষার মনে বাস্তবতার আভাস এনে দিল। রাস্তার বাতি, চলন্ত যানবাহনের হালকা গর্জন, মানুষজনের ব্যস্ত পদচারণা—সবকিছু যেন তাদেরকে আবার জীবনচক্রের নিয়মে ফিরিয়ে আনল। তবে গঙ্গার ধারের সেই রাতের ছায়া এখনও তাদের মনে জাগ্রত। চাঁদের আলোয় নদীর উপর পড়া ঝিলমিল-ঝিলমিল প্রতিফলন, ঢেউয়ের নরম স্পর্শ, বাতাসের নীরব গন্ধ—সবকিছু মিশে আছে তাদের স্মৃতির পাতায়। তৃষার চোখে এখনও সেই অল্প হাসির রেখা, যা কোনো শব্দ ছাড়া রুদ্রের অন্তরে গুঁড়িয়ে যায়, আর রুদ্রের চুপচাপ দৃষ্টি, যা কোনো ভাষা ছাড়াই সমস্ত অনুভূতি প্রকাশ করে, তাদের মধ্যে এক অদৃশ্য সেতু গড়েছে। গাড়ির ভিতরে চুপচাপ থাকা এই অনুভূতির ভার অদ্ভুত, কিন্তু এতটাই মধুর যে, তা কোনো কথায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। তারা জানে, শহরের ব্যস্ততা আবার তাদের ভেঙে দিতে পারবে না; সেই রাতের নীরবতা এবং গভীর সংযোগ চিরদিনের মতো তাদের ভিতরে লুকিয়ে আছে।

রাস্তায় গাড়ি এগোতে থাকে, হালকা বাতাস জানালা দিয়ে ঢুকে তাদের চুল ছুঁয়ে যায়, আর হঠাৎ মনে হয় যেন নদীর কাছের সেই মুহূর্ত আবার জীবন্ত হয়ে উঠছে। রুদ্র হঠাৎ ধীরে ধীরে বলে, “আমরা কি সত্যিই ফিরে এলাম?” তৃষা তার দিকে তাকিয়ে অল্প হাসে, আর একটি নিঃশব্দ শব্দের মতো বলে, “হ্যাঁ, তবে আমরা এখন আর একই আমরা নই।” এই রাত শুধু একটি অভিজ্ঞতা নয়, এটি তাদের সম্পর্কের সংজ্ঞা বদলে দিয়েছে—যেখানে কোনো স্পষ্ট স্বীকারোক্তি হয়নি, তবুও বোঝা গেছে যে, তাদের মধ্যে কিছু চিরন্তন বন্ধন গড়ে উঠেছে। অফিসে, শহরের ব্যস্ত রুটিনে তারা আবার সহকর্মী, আবার পরিচিত মানুষ; কিন্তু এই রাতের স্মৃতি তাদের ভিতরে এক মধুর গোপন কাব্য সৃষ্টি করেছে। মনে হয়, তারা একে অপরকে নতুন চোখে দেখবে—একই ব্যক্তি হলেও ভেতরে নতুন সংজ্ঞা, নতুন অনুভূতি।

গাড়ি গন্তব্যে পৌঁছায়, শহরের আলো তাদের চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে, আর বাস্তবতা তাদের কোলে ফিরে আসে। তৃষা ব্যাগের হ্যান্ডেল আঁকড়ে ধরে, রুদ্র হালকা নিঃশ্বাস ফেলে, এবং তাদের চোখ এক মুহূর্তের জন্য মিলিত হয়, যেন নীরবে জানানো হচ্ছে সব অপ্রকাশিত অনুভূতি। তারা জানে, এই রাত আর পুনরায় ফিরে আসবে না, কিন্তু চিরতরে স্মৃতিতে জমে থাকা সেই অভিজ্ঞতা, সেই চাঁদের আলো, নদীর সান্নিধ্য, নিঃশব্দ হাসি এবং অনুধাবিত আকাঙ্ক্ষা—সবকিছুই তাদের ভিতরে চিরন্তন হয়ে থাকবে। শহরের আলো তাদের চোখে বাস্তবতার প্রতিফলন আনলেও, মনোর জগতে সেই রাতের ছায়া অম্লান, চিরস্থায়ী। অফিসে হয়তো সবাই দেখবে শুধু স্বাভাবিক সহকর্মী, কিন্তু এই এক রাতের স্মৃতি চুপচাপ তাদের সম্পর্কের গভীরতা এবং সংজ্ঞা বদলে দিয়েছে, যা কোনো কথায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়, এবং যা তাদের অন্তরের একটি মিষ্টি, নীরব প্রভাব হিসেবে চিরকাল থাকবে।

শেষ

1000066332.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *