অর্কপ্রভ দে
পর্ব ১: প্রথম ফোন কেনা
কলকাতার গরম দুপুরে প্রফুল্লবাবু হাঁপাতে হাঁপাতে গড়গড় করে রিকশা থেকে নামলেন। হাতে ছোট্ট একটা থলে, যার ভেতরেই লুকিয়ে আছে তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন—প্রথম স্মার্টফোন। এতদিন তিনি একটা বাটনওয়ালা ফোনেই দিব্যি কাটাচ্ছিলেন। অফিসে ফোন করা, ছেলেকে মিসড কল দেওয়া, আর দরকার হলে এক-আধটা এসএমএস—এই ছিল তাঁর জগত। কিন্তু ছেলে আর মেয়ে মিলে গত এক মাস ধরে এমন কান ঝালাপালা করে দিয়েছে যে শেষ পর্যন্ত তিনি বাধ্য হলেন। “বাবা, সবার কাছে হোয়াটসঅ্যাপ আছে, তুমি এখনও বাটন ফোন নিয়ে বসে আছো? এটা তো একেবারে প্রাগৈতিহাসিক ব্যাপার!”—ছেলের গলা এখনও তাঁর কানে বাজছে।
দোকানদারও যেন তাঁকে নিয়ে একরকম মজা করতে লাগল। মোবাইল দোকানের ঝকঝকে কাচের শোকেসে যত রঙিন ফোন সাজানো, প্রফুল্লবাবু ততই গুলিয়ে যাচ্ছিলেন। দোকানদার বলল, “দেখুন কাকু, এটা ৫জি ফোন। এইটাতে ক্যামেরা চারটা! আপনার সেলফি একেবারে ফাটাফাটি হবে।” প্রফুল্লবাবু ভুরু কুঁচকে বললেন, “সেলফি আবার কী জিনিস? নিজের ছবি নিজে তোলারও কোনো দরকার আছে?” দোকানদার হেসে উত্তর দিল, “আরে কাকু, এখন তো সবাই সেলফি তোলে। আপনি একবার নিলেই বুঝবেন, ফেসবুকে একশো লাইক আসবে।”
ফেসবুক কথাটা শুনে প্রফুল্লবাবুর বুকের ভেতরটা ধকধক করে উঠল। তিনি শুনেছেন ফেসবুকে নাকি মেয়েদের খুঁজে পাওয়া যায়। কলেজ জীবনের এক কাকিমা-সদৃশ দিদি ছিলেন, যার সঙ্গে তিনি তখন চিঠিপত্র লিখে যোগাযোগ রাখতেন। বহুদিন আগে সব হারিয়ে গেছে। মনে মনে ভাবলেন, “এই ফেসবুক জিনিসটা যদি সত্যিই লোক খুঁজে দেয়, তাহলে মন্দ কি!” কিন্তু মুখে কিছু বললেন না।
শেষ পর্যন্ত ছেলের কথামতো একটা মাঝারি দামের ফোন কিনে ফেললেন। দোকানদার হাসতে হাসতে ইনস্টল করে দিল হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুক, ইউটিউব, জিমেইল—আর কত কি। প্রফুল্লবাবু শুনে শুনে মাথা নাড়লেন, কিন্তু তাঁর ভেতরে আতঙ্ক—এত অ্যাপ তিনি সামলাবেন কীভাবে?
রিকশায় বাড়ি ফেরার পথে তিনি বারবার থলেটা উঁকি মেরে দেখছিলেন। যেন ভেতরে কোনো দুষ্টু প্রেত লুকিয়ে আছে, যে সুযোগ পেলেই লাফ দিয়ে বেরিয়ে তাঁকে খেয়ে ফেলবে। এমনকি রিকশাচালকও তাঁকে একবার দেখে হেসে ফেলল—“কাকু, নতুন ফোন কিনেছেন নাকি?” প্রফুল্লবাবু গম্ভীর মুখ করে উত্তর দিলেন, “হুঁ, কিনেছি। কিন্তু এটা যে কীভাবে চালাতে হয়, সেই শিক্ষা নিলে তবেই বাঁচব।”
বাড়ি ফিরতেই ছেলে-মেয়ে লাফিয়ে এসে ফোন কেড়ে নিল। সবাই মিলে অনাবিল উচ্ছ্বাসে ফোনের মোড়ক ছিঁড়তে লাগল। স্ত্রী দূর থেকে তাকিয়ে বিরক্ত মুখে বললেন, “শোনো, এত টাকা দিয়ে আবার কেন নতুন ঝামেলা আনলে? ওই পুরোনো ফোনে তো ভালোই চলছিল।” প্রফুল্লবাবু একগাল হেসে বললেন, “চলো দেখি, আমিও আজ থেকে স্মার্ট হয়ে গেলাম।”
কিন্তু কয়েক মিনিটের মধ্যেই তাঁর স্মার্টনেস নিয়ে প্রশ্ন উঠতে লাগল। ফোনটা চালু করেই তিনি চমকে উঠলেন—স্ক্রিনে অজস্র রঙিন আইকন। কোনটা চাপলে ফোন কল হবে, আর কোনটা চাপলে বোমা ফাটবে, তিনি কিছুই বুঝতে পারছেন না। ছেলে ব্যাখ্যা করতে করতে বিরক্ত হয়ে বলল, “বাবা, এটা ডায়লার। এখানে নাম্বার চাপতে হয়। এটা আবার ক্যামেরা, এটা গ্যালারি, এটা হোয়াটসঅ্যাপ।” প্রফুল্লবাবু অবাক হয়ে বললেন, “হোয়াটসঅ্যাপ আবার কেমন জিনিস?”
মেয়ে উৎসাহ নিয়ে বলল, “বাবা, হোয়াটসঅ্যাপ মানে বিনামূল্যে মেসেজ আর ছবি পাঠানো যায়। চাইলে ভিডিও কলও করা যায়।” প্রফুল্লবাবুর চোখ কপালে। “ছবি পাঠানো যায়? মানে কী? আমি যদি এখন তোমার মা-র ছবি তুলে পাঠাই, সেটা অন্যরা দেখতে পাবে?” মেয়ে হেসে লুটোপুটি—“না বাবা, যাকে পাঠাবে, শুধু সে-ই দেখবে।”
প্রফুল্লবাবু একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন, কিন্তু মাথার ভেতর নতুন আতঙ্ক জন্ম নিল। যদি ভুল করে অন্য কাউকে পাঠিয়ে দেন!
রাতের খাওয়ার পর তিনি একা বসে ফোনটা হাতে নিয়ে দেখছিলেন। মনে হচ্ছিল, যেন নতুন বউ এল ঘরে। স্পর্শ করলেই কেমন যেন গা ছমছম করছে। একবার ভুল করে ক্যামেরা খুলতেই নিজের মুখটা বড় করে দেখে আঁতকে উঠলেন। “হায় হায়! এই আবার কে?”—ভয়ে ফোনটা টেবিলে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন। পরে বুঝলেন, সেটা তাঁরই মুখ।
শুতে যাওয়ার আগে স্ত্রী আবার খোঁচা দিলেন—“শুনো, বেশি বাড়াবাড়ি কোরো না। কাল অফিসে গিয়ে যেন কোনো বিপদ না ঘটাও।” প্রফুল্লবাবু তখনও ফোনের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলছিলেন, “এইটাকে সামলানোই আসল যুদ্ধ হবে।”
এভাবেই শুরু হলো তাঁর নতুন জীবনের প্রথম অধ্যায়—একজন মধ্যবয়সী বাবার, যিনি অজান্তেই প্রবেশ করতে চলেছেন এক বিচিত্র ডিজিটাল দুনিয়ায়, যেখানে প্রতিদিন ঘটবে হাস্যকর বিপত্তি, আর তিনি ধীরে ধীরে শিখবেন—স্মার্টফোনের সঙ্গে টিকে থাকার আসল কৌশল।
পর্ব ২: হোয়াটসঅ্যাপ বিপর্যয়
পরদিন সকালে অফিস যাওয়ার আগে প্রফুল্লবাবু স্মার্টফোনটা হাতে নিয়ে বেশ গম্ভীর মুখে বসে ছিলেন। ছেলে-মেয়ে দু’জনই ব্যস্ত স্কুল-কলেজের প্রস্তুতিতে, কিন্তু যাওয়ার আগে মেয়েটা হেসে বলেছিল, “বাবা, আজ থেকে তুমি হোয়াটসঅ্যাপে বসকে রিপোর্ট পাঠাবে। খুব সহজ। শুধু লিখে পাঠাতে হবে।”
প্রফুল্লবাবুর ভ্রু কুঁচকে গিয়েছিল—“রিপোর্ট মানে তো কাগজে লিখে জমা দিতে হয়।” মেয়ে আবার হেসে উত্তর দিয়েছিল, “এখনকার দিনে কাগজের ঝামেলা নেই। মোবাইলেই হয়ে যাবে।”
অফিসে ঢোকার পরই শুরু হলো তাঁর দুঃস্বপ্ন। বস সকাল সকাল একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে মেসেজ করে লিখেছেন—“সকলকে আজকের প্রজেক্ট রিপোর্ট আপলোড করতে হবে।” সহকর্মীরা টিপটিপ করে সবুজ টিক দিয়ে উত্তর দিচ্ছে। কারো কারো ফাইলও চলে গেল গ্রুপে।
প্রফুল্লবাবু চশমা নামিয়ে একবার তাকালেন, তারপর ফোনটা কানের কাছে ধরে বিড়বিড় করতে লাগলেন, “এত ছোট ছোট অক্ষর, চোখেই তো কিছু বোঝা যাচ্ছে না!” পাশে বসা সহকর্মী শঙ্করবাবু হেসে বললেন, “অ্যাই প্রফুল্লদা, আপনার রিপোর্ট পাঠান না।”
তিনি অস্থিরভাবে গুগল ভয়েস চালু করে বললেন, “আজকের রিপোর্ট—” কিন্তু হঠাৎ ফোন কেমন গরম হয়ে উঠল, আর অদ্ভুত সব ইমোজি বেরোতে লাগল। সহকর্মীরা হেসে উঠল। কেউ বলল, “দেখো দেখো, প্রফুল্লদার রিপোর্ট তো শুধু ফুলপাতা!”
প্রফুল্লবাবু মাথা চুলকোতে চুলকোতে অবশেষে একবার ক্যামেরা খুললেন। ভেবেছিলেন, রিপোর্টটা ছবিতে তুলে পাঠিয়ে দেবেন। কিন্তু ফোনের ফ্রন্ট ক্যামেরা চালু হতেই হঠাৎ ক্লিক করে গেল—এবং একেবারে তাঁর নিজের টুপি পরা হাবভাবহীন সেলফি উঠে পড়ল গ্রুপে।
গ্রুপে সঙ্গে সঙ্গে টুং টাং নোটিফিকেশন শুরু হয়ে গেল—
“Nice hat sir!”
“Sir, handsome lagchen.”
“Sir, this is your report?”
প্রফুল্লবাবুর মাথায় যেন আগুন জ্বলে উঠল। তিনি প্রাণপণে ফোন থেকে ছবি ডিলিট করতে গেলেন, কিন্তু ভুল করে আবার শেয়ার করে ফেললেন। এবার একই সেলফি পরপর তিনবার গেল গ্রুপে। সহকর্মীরা হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছে।
বস তখনো কিছু বলেননি। খানিক বাদে হঠাৎই গ্রুপে মেসেজ এলো—“Mr. Pratul, this is not a modeling group. Kindly send your report, not your photos.”
প্রফুল্লবাবু লজ্জায় লাল হয়ে গেলেন। নামটা আবার ভুল করে “Pratul” লেখা হয়েছে দেখে তিনি ভেতরে ভেতরে ক্ষেপে উঠলেন, কিন্তু কিছু বলার সাহস পেলেন না।
অবশেষে পাশের সহকর্মীকে ডাকলেন—“শোনো, এই রিপোর্টটা কীভাবে পাঠাব?” শঙ্করবাবু হেসে হেসে রিপোর্টের ফাইল খুলে দিলেন, পাঠিয়ে দিলেন, আর বললেন, “এই নিন, এবার আপনার সেলফি ক্যারিয়ার শুরু হলো।”
দিনভর অফিসে তাঁকে আর কাজ করতে দেওয়া হলো না। সবাই আসতে আসতে মাথা নেড়ে বলছে, “হোয়াটসঅ্যাপ মডেল প্রফুল্লবাবু!” কেউ আবার এসে পরামর্শ দিচ্ছে, “স্যার, ইনস্টাগ্রামে অ্যাকাউন্ট খুলুন, সেখানে এইসব ছবি দিলে আরও লাইক পাবেন।”
বিকেলের দিকে বস ঘরে ডেকে পাঠালেন। প্রফুল্লবাবু ভয়ে ভয়ে ঢুকলেন। বস গম্ভীর মুখে বললেন, “প্রফুল্ল, আমি জানি আপনি নতুন ফোন শিখছেন। কিন্তু দয়া করে অফিসের গ্রুপকে ফ্যাশন শোতে পরিণত করবেন না। আগামীকাল থেকে ঠিকঠাক রিপোর্ট চাই।”
প্রফুল্লবাবু মাথা নিচু করে বেরিয়ে এলেন। বাইরে এসে দেখলেন, সহকর্মীরা আবারও চোরা হেসে তাকাচ্ছে।
বাড়ি ফেরার পথে তাঁর মন ভীষণ খারাপ। কিন্তু বাসে বসে ফোনটা খুলতেই আবার বিপত্তি। হোয়াটসঅ্যাপের ‘স্ট্যাটাস’ নামক জায়গায় তিনি কীভাবে কী চাপলেন জানেন না—নিজের সেই সেলফিটাই পুরো অফিস ও পাড়ার লোকদের কাছে চলে গেল। কয়েক মিনিটের মধ্যেই ফোন টুং টাং করে বেজে উঠল—“কাকু, কেমন হ্যান্ডসাম লাগছে!” “দাদা, নতুন ফোন নাকি?” “মেজোদি, দেখেছো প্রফুল্লদার ছবি উঠেছে?”
স্ত্রীর ফোন এল প্রথমেই। গলা কাঁপছে রাগে—“তুমি আবার ইন্টারনেটে ছবি দিচ্ছ কেন? পাড়ার সবাই আমাকে ফোন করছে!”
প্রফুল্লবাবু হাপুস নয়নে উত্তর দিলেন, “আমি কিছু করিনি গো, ফোনটাই করছে।”
রাতে খাওয়ার পর ছেলে-মেয়ে তাঁকে বসিয়ে দিল ট্রেনিং ক্লাস। মেয়ে ব্যাখ্যা করতে লাগল—“এই যে চ্যাট উইন্ডো, এখানে শুধু রিপোর্ট লিখে পাঠাবে। ছবি তুলতে গেলে এই ক্যামেরা আইকন। আর স্ট্যাটাসে কিছুই দেবে না।”
ছেলে হেসে বলল, “বাবা, তুমি তো একেবারে ভাইরাল হয়ে গেলে। আগামীকাল পাড়ার ছেলেপুলে তোমাকে ‘স্মার্টফোন স্টার’ বলবে।”
প্রফুল্লবাবু মাথা চেপে বসে রইলেন। তাঁর মনে হলো, এই ফোনটা যেন আসলেই ভূতের মতো। ভুল বাটন চাপলেই কেলেঙ্কারি। তবু ভেতরে কোথাও একটা গোপন আনন্দ কাজ করছিল—এত লোক তাঁর ছবি দেখল, এটা কি আগে কখনও ঘটেছিল?
তিনি বিড়বিড় করে বললেন, “এই হোয়াটসঅ্যাপ জিনিসটা ভয়ঙ্কর, কিন্তু মজাও আছে বটে।”
পর্ব ৩: গুগল ভয়েস কাণ্ড
হোয়াটসঅ্যাপ বিপর্যয়ের ধাক্কা সামলে নেওয়ার আগেই প্রফুল্লবাবু নতুন আরেক বিপত্তিতে জড়িয়ে গেলেন—গুগল ভয়েস সার্চ।
ছেলে-মেয়ে আগের রাতে তাঁকে বোঝাতে চেষ্টা করেছিল—“বাবা, তুমি যদি কিছু খুঁজতে চাও, শুধু বলে দিলেই হবে। যেমন ধরো, বলো—‘লাল শাড়ি’, তাহলে গুগল দেখাবে লাল শাড়ির দোকান।”
প্রফুল্লবাবুর চোখ চকচক করে উঠেছিল। তিনি মনে মনে ভেবেছিলেন, এ তো একেবারে জাদুর মতো! আগে বাজারে গিয়ে লাল শাড়ি কিনতে গেলে কত দোকানে ঘুরতে হতো, কত দরাদরি করতে হতো। এখন নাকি এক নিমিষে সব পাওয়া যাবে!
পরদিন সকালে তিনি একা বসে ফোন হাতে নিলেন। গলায় গম্ভীর ভঙ্গি এনে বললেন—“ও গুগল, লাল শাড়ি।”
ফোনে হঠাৎ এক শব্দ হলো—“ডিং!” তারপরই স্ক্রিনে খুলে গেল ইউটিউবের এক বিচিত্র ভিডিও—“Lal Shirt Dance Mix।” লাল শাড়ি তো নয়, লাল শার্ট পরে একদল ছেলে ধপাধপ নাচছে। সঙ্গে ধুমধাড়াক্কা গান।
প্রফুল্লবাবু হতভম্ব। “হায় হায়! আমি তো শাড়ি চেয়েছিলাম, শার্ট তো চাইনি!”
তিনি আবার চেষ্টা করলেন। এবার একটু জোরে বললেন—“ও গুগল, লাল শাড়ি, লাল শাড়ি।” ফোনে এবার খুলে গেল হিন্দি ছবির গান—“লাল দुपট্টে ওয়ালি।”
তিনি চমকে উঠলেন। “এইবার তো শাড়ি নয়, দোপাট্টা চলে এলো!”
এমন সময় পাশের ঘর থেকে স্ত্রী বেরিয়ে এসে বললেন, “কী গো, সকাল সকাল আবার গানের আসর বসিয়েছ নাকি?”
প্রফুল্লবাবু গলা খাঁকারি দিয়ে উত্তর দিলেন, “না না, আমি আসলে বাজার করার চেষ্টা করছিলাম।”
স্ত্রী সন্দেহভরে তাকিয়ে আবার ঘরে চলে গেলেন।
কিন্তু প্রফুল্লবাবু হাল ছাড়লেন না। তিনি এবার ফোনটা মুখের কাছে এনে ইংরেজি উচ্চারণে চেষ্টা করলেন—“রেড শাড়ি।”
ফোনের স্ক্রিনে এবার ভেসে উঠল “Ready Shadi”—বিয়ের প্ল্যানিং অ্যাপ! নানান বিয়ের অনুষ্ঠান, বিয়ের ছবি, কনের সাজসজ্জার বিজ্ঞাপন।
প্রফুল্লবাবু ভয়ে ঘামতে লাগলেন। “আরে বাবা! আমি তো এখনই বিয়ে করতে চাই না! গুগল আমায় আবার বিয়ে করিয়ে দেবে না তো?”
তিনি তড়িঘড়ি ফোন লক করে ফেললেন। মনে মনে ভাবলেন, “এ যে ভয়ঙ্কর ব্যাপার। একবার মুখ খুললেই কেলেঙ্কারি।”
বিকেলে অফিস থেকে ফেরার পথে আবারও চেষ্টা করার লোভ সামলাতে পারলেন না। বাসে বসে বললেন—“ও গুগল, কাছাকাছি ভাতের হোটেল।”
ফোনে তখনই ভেসে উঠল—“Watch Hotel—হরর মুভি।” পর্দায় অন্ধকার, ভূতের মুখ, ভৌতিক আওয়াজ। প্রফুল্লবাবু চমকে ফোনটা মাটিতে ফেলে দিলেন। বাসে সবাই তাকিয়ে আছে, কেউ কেউ হাসছে।
একজন যাত্রী কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কাকু, সিনেমা দেখছেন নাকি?” প্রফুল্লবাবু গম্ভীর মুখে বললেন, “না রে ভাই, আমি তো ভাত চাইছিলাম, ভূত পেলাম!”
বাড়ি ফিরে ছেলে-মেয়েকে ডেকে বসলেন। গম্ভীর গলায় বললেন, “তোমরা আমায় যে ভয়েস সার্চ শিখিয়েছিলে, সেটা ঠিক না। আমি শাড়ি চাইলে শার্ট আসে, ভাত চাইলে ভূত আসে। এই যন্ত্রটা ভূতের কবজায় আছে।”
ছেলে হেসে গড়াগড়ি। মেয়ে ফোনটা হাতে নিয়ে ডেমো দেখাল—“বাবা, তুমি ঠিক করে উচ্চারণ করোনি। যেমন ধরো—‘লাল শাড়ি অনলাইন।’” সঙ্গে সঙ্গে স্ক্রিনে ভেসে উঠল লাল শাড়ির দোকানের বিজ্ঞাপন।
প্রফুল্লবাবু হা করে তাকিয়ে রইলেন। “আরে, তোমার মুখে তো সঙ্গে সঙ্গে শাড়ি এলো! আমার মুখে এলে শুধু ঝাড়ি পড়ে।”
মেয়ে হেসে উত্তর দিল, “বাবা, তোমার ভয়েসে গুগলও কনফিউজ হয়ে যায়।”
স্ত্রী তখন রান্নাঘর থেকে চিৎকার করে উঠলেন, “সারা দিন এসব নিয়ে খেপামো করো না। আমার জন্য একটাও বাজার করলে না। কালকে একবার ‘গুগল গুগল’ না বলে আসলেই বাজারে যাও।”
প্রফুল্লবাবু ফোনটা টেবিলে রেখে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। মনে মনে ভাবলেন, “এই যন্ত্রটা আমায় শিখতে হবে। নইলে সবাই হাসাহাসি করবে।” কিন্তু ভেতরে কোথাও যেন এক অদ্ভুত কৌতূহলও জন্ম নিচ্ছিল। এই গুগল জিনিসটা যদি একদিন সত্যিই সব বুঝে নেয়?
তিনি বিড়বিড় করে বললেন, “আজ শাড়ি এল না, কিন্তু একদিন না একদিন গুগলকে দিয়ে নিশ্চয়ই বাজার করাব। তখন সবাই অবাক হয়ে যাবে।”
পর্ব ৪: অনলাইন অর্ডার ভুল
প্রফুল্লবাবু অনেক চেষ্টা করেও গুগল ভয়েসকে কন্ট্রোল করতে না পারায় ঠিক করলেন—এবার বাজার করবেন অনলাইন অ্যাপ দিয়ে। ছেলে-মেয়ে আগের দিনই তাঁর ফোনে একটা ‘ডেলিভারি অ্যাপ’ ইন্সটল করে দিয়েছিল। তারা বলেছিল, “বাবা, এবার তোমাকে আর হাটে বাজারে যেতে হবে না। শুধু ফোনে ক্লিক করলেই সবজি-ফল বাড়িতে চলে আসবে।”
প্রফুল্লবাবুর চোখ তখন আনন্দে চকচক করে উঠেছিল। মনে মনে ভাবলেন, “এবার তো আমিই আধুনিক মানুষ। শনি রবি আর ভিড় ঠেলাঠেলি নেই। শুধু আঙুল চাপলেই পেঁয়াজ, আলু, ডিম হাজির।”
সকালে চায়ের পেয়ালা হাতে নিয়ে তিনি ফোন খুললেন। স্ক্রিনে যতসব রঙিন ছবি—টমেটো, আলু, ফুলকপি, পেঁয়াজ। দেখে তাঁর মাথা ঘুরছিল। তিনি বিড়বিড় করে বললেন, “আরে বাবা! এ তো একেবারে হাট বসেছে ফোনের ভেতর।”
তিনি চশমা নাকের ডগায় বসিয়ে পেঁয়াজের ছবিতে চাপ দিলেন। অপশনে লেখা—“১ কেজি, ২ কেজি, ৫ কেজি, ১০ কেজি।” প্রফুল্লবাবু ভেবেছিলেন, “চল, একটু মজাই করা যাক।” তিনি চাপ দিলেন—১০ কেজি।
মনে করলেন, এটা হয়তো শুধু পরীক্ষা করার জন্য। আসল অর্ডার দিতে গেলে আবার জিজ্ঞেস করবে। তাই নিশ্চিন্ত মনে পেমেন্ট বাটনও চাপ দিলেন। হঠাৎই স্ক্রিনে লেখা এল—“আপনার অর্ডার কনফার্মড। শীঘ্রই ডেলিভারি হবে।”
প্রফুল্লবাবু আঁতকে উঠলেন। “হায় হায়! আমি তো সত্যিই কিনে ফেললাম নাকি?”
দুপুরে দরজার ঘণ্টা বেজে উঠল। বাইরে এক ডেলিভারি বয় বিশাল বস্তা নামিয়ে বলল, “স্যার, আপনার অর্ডার। ১০ কেজি পেঁয়াজ।”
স্ত্রী ছুটে এসে চিৎকার করে উঠলেন, “এ কী সর্বনাশ করেছো? ১০ কেজি পেঁয়াজ কে খাবে?”
প্রফুল্লবাবু গলা কাঁপিয়ে বললেন, “আমি ভেবেছিলাম শুধু ট্রায়াল দিচ্ছি। এরা তো আসলেই বস্তা পাঠিয়ে দিল!”
স্ত্রী চুল্লি থেকে খুন্তি হাতে বেরিয়ে এলেন। চোখ লাল, মুখ গরম। “এখন থেকে প্রতিদিন পেঁয়াজ খেয়ে মরতে হবে আমাদের? আলু-পটল বাদ!”
ছেলে হেসে গড়াগড়ি খেতে খেতে বলল, “বাবা, তুমি তো পুরো হিরো হয়ে গেছো। পেঁয়াজের স্টক করে রেখেছো, যেন বাজারে হঠাৎ দাম বেড়ে যায়।”
মেয়ে টিপ্পনি কাটল—“বাবা, তুমি তো একেবারে পেঁয়াজ ব্যবসায়ী হয়ে গেলে।”
প্রফুল্লবাবু তখন ঘামছেন। তাঁর মনে হচ্ছিল, জীবনে এত বড় অন্যায় আর কখনও করেননি।
সন্ধ্যেবেলা তিনি অফিস থেকে ফেরার সময় মাথা নিচু করে আসছিলেন। হঠাৎ প্রতিবেশী মিসেস মুখার্জি ডাক দিলেন, “প্রফুল্লবাবু, শুনলাম আপনি নাকি ১০ কেজি পেঁয়াজ এনেছেন? এক কেজি ধার পাওয়া যাবে?”
প্রফুল্লবাবুর মুখ লজ্জায় লাল হয়ে গেল। “আরে না না, আসলে ভুল হয়ে গেছে।” কিন্তু ততক্ষণে পাড়ার সবাই জানাজানি করে ফেলেছে। কেউ কেউ এসে বলছে, “দাদা, এক কেজি দাও না। কাল থেকে নাকি দাম বাড়ছে।”
শেষ পর্যন্ত প্রফুল্লবাবু বাধ্য হয়ে পেঁয়াজ বেচাকেনা শুরু করলেন। স্ত্রী রেগে কাগজে হিসেব লিখে দিলেন—“আজ এত পেঁয়াজ বেরোল, কাল এত রাখতে হবে।” বাড়ি যেন ছোটখাটো পেঁয়াজের গুদাম হয়ে গেল।
রাতে খেতে বসে স্ত্রী কড়া গলায় বললেন, “শোনো, আগামীকাল থেকে এক গ্রামও অর্ডার দেবে না। যা দরকার, আমাকে বলবে, আমি কিনব। তুমি শুধু ফোনে টিপে টিপে সর্বনাশ করবে।”
প্রফুল্লবাবু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিড়বিড় করে বললেন, “এই ফোনে হাত দিলেই মনে হয় যাদুকরী ফল আসছে। কিন্তু শেষে দেখি কেবল ঝামেলাই।”
ছেলে মজা করে যোগ করল, “না বাবা, তোমার জন্যই তো পাড়ার মানুষদের পেঁয়াজ সস্তায় মিলল। তুমি একেবারে ডিজিটাল সমাজসেবী।”
প্রফুল্লবাবু হাসবেন না কাঁদবেন, বুঝতেই পারলেন না।
কিন্তু ভেতরে ভেতরে একটা সিদ্ধান্ত পাকাপাকি হলো—এবার থেকে যেকোনো বাটনে চাপ দেওয়ার আগে তিনি তিনবার ভাববেন। তবুও মনে মনে একটা ভয় কাজ করছিল—“কাল যদি আবার কিছু ভুল অর্ডার করে ফেলি?”
এভাবেই তাঁর জীবনের চতুর্থ বিপর্যয় শেষ হলো—১০ কেজি পেঁয়াজে গোটা বাড়ি ভরে যাওয়ার স্মার্টফোন শিক্ষা।
পর্ব ৫: চার্জারের দুঃস্বপ্ন
১০ কেজি পেঁয়াজ বিপর্যয়ের পর প্রফুল্লবাবু প্রতিজ্ঞা করেছিলেন—এবার থেকে খুব সাবধানে ফোন ব্যবহার করবেন। কিন্তু ফোন নামক জিনিসটা যেন তাঁকে ছাড়তেই চাইছিল না।
সেদিন দুপুরে অফিসে বসে তিনি আবার ফোনে একটা মেসেজ পেলেন—“ডেলিভারি চার্জ ৯৯ টাকা।” প্রফুল্লবাবু অবাক। তিনি তো কিছুই অর্ডার করেননি! মাথার ভেতরেই হিসেব করতে লাগলেন। “আচ্ছা, ফোন কেনার সময় যে বলেছিল, ডেলিভারি চার্জ লাগবে—আমি ভেবেছিলাম, ডেলিভারির সাথে একটা বাড়তি চার্জার ফ্রি আসবে। এখন বুঝছি, ওরা উল্টো টাকা কেটে নিচ্ছে!”
এই ভুল বোঝাবুঝি থেকেই শুরু হলো নতুন কাণ্ড।
প্রফুল্লবাবু অফিস থেকে ফিরে এসে স্ত্রীকে বললেন, “শোনো, আমার ফোনের জন্য আবার চার্জার আসছে।”
স্ত্রী অবাক, “কোন চার্জার?”
প্রফুল্লবাবু গম্ভীর মুখে ব্যাখ্যা করলেন, “ওই যে দোকানদার বলেছিল ডেলিভারি চার্জ লাগবে। আমি ভেবেছিলাম, বাড়তি চার্জার আসবে। তো এখন মেসেজ এল—৯৯ টাকার চার্জ।”
স্ত্রী বিরক্ত হয়ে বললেন, “আবার নতুন খরচা শুরু হলো! তোমার ওই ফোনটা একদিন ভেঙে খালে ফেলে দেব।”
পরদিন দুপুরে সত্যিই দরজায় ডেলিভারি বয় এল। হাতে ছোট্ট বাক্স। প্রফুল্লবাবুর বুক ধকধক করছে। তিনি ভেবেছিলেন, সত্যিই নতুন চার্জার আসছে।
কিন্তু বাক্স খুলে দেখা গেল, ভেতরে একটা ছোট্ট প্লাস্টিকের কেবল আর একটা অ্যাডাপ্টার। ডেলিভারি বয় টাকা চাইলো—৯৯ টাকা।
প্রফুল্লবাবু খুশি হয়ে বললেন, “আরে, দেখছো? আমি ঠিকই বলেছিলাম, চার্জার এসেছে।”
স্ত্রী চোখ পাকিয়ে বললেন, “এটা আবার আলাদা কেন? ফোন কিনলে একটা চার্জার তো এসেছিল!”
প্রফুল্লবাবু ভুরু কুঁচকে বললেন, “আরে, ওইটা তো একটাই ছিল। কিন্তু আমি ভেবেছিলাম বাড়তি একটা ফ্রি আসবে। তাই অর্ডার হয়ে গেছে।”
সমস্যা শুরু হলো রাত্তিরে। ফোন চার্জ দিতে গিয়ে তিনি নতুন চার্জারটা লাগালেন। প্লাগে গুঁজতেই হঠাৎ করে কটাং করে স্পার্ক বেরোলো। আলো টিমটিম করে নিভে গেল, আর ফোনের স্ক্রিন অন্ধকার।
স্ত্রী আঁতকে উঠলেন, “হায় হায়, ফোনটা নষ্ট হয়ে গেল নাকি?”
প্রফুল্লবাবুর মুখ শুকনো। “আরে না না, একটু ঢিলা হয়ে গিয়েছিল। আমি ঠিক করে দিচ্ছি।” তিনি আবার জোড়ে চাপ দিলেন। এবার ফোন গরম হয়ে উঠল, যেন ভেতরে আগুন জ্বলছে।
ছেলে দৌড়ে এসে চার্জারটা খুলে ফেলল। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলল, “বাবা, তুমি কি জানো, নকল চার্জার কিনেছো? এগুলোতেই ফোন পুড়ে যায়।”
প্রফুল্লবাবুর মাথা ঘুরে গেল। “মানে? আমি তো ভেবেছিলাম এটা ফ্রি আসবে!”
ছেলে মুচকি হেসে বলল, “না বাবা, এটাই আসল ডেলিভারি চার্জ।”
প্রফুল্লবাবু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “আহা রে! আমি ভেবেছিলাম কোম্পানি আমাকে যত্ন করে বাড়তি চার্জার দিয়েছে। আসলে দেখছি, এরা আমার পকেটই চার্জ করছে।”
পরের দিন অফিসে গিয়ে তিনি সহকর্মীদের এই কাণ্ড বললেন। সবাই হেসে গড়িয়ে পড়ল। শঙ্করবাবু টিপ্পনি কাটল—“প্রফুল্লদা, আপনার তো এখন চার্জার কালেকশন শুরু হয়েছে। একটা বাড়িতে, একটা অফিসে রেখে দিন।”
প্রফুল্লবাবুর মুখ গম্ভীর। তিনি ভাবলেন, “না, আর না। এই ফোন আমাকে একদিন সর্বনাশ করেই ছাড়বে।”
কিন্তু মনের ভেতরে আবার একটা শিশুসুলভ আনন্দও হচ্ছিল। নতুন চার্জার হাতে নিয়ে তিনি কয়েকবার আয়নায় দেখলেন। নিজেকে যেন আধুনিক, স্মার্ট, প্রযুক্তিবান মানুষ মনে হচ্ছিল।
তবুও রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে স্ত্রীর কড়া নির্দেশ কানে বাজল—“শোনো, আগামীকাল থেকে ফোনে একটাও নতুন বাটন চাপবে না। আর কোনো ডেলিভারি এলে আমার অনুমতি ছাড়া নেবে না।”
প্রফুল্লবাবু বিছানায় শুয়ে বিড়বিড় করলেন, “এই ফোনটা আমাকে পাগল করে ছাড়বে। চার্জ তো শেষ পর্যন্ত আমাকেই দিতে হচ্ছে—পকেটের।”
পর্ব ৬: কলিং কেলেঙ্কারি
চার্জারের ঝামেলা কাটার পর প্রফুল্লবাবু ঠিক করলেন, এবার থেকে খুব সাধারণ ফিচারই ব্যবহার করবেন। আর কিছু না হোক, ফোন তো ফোন কল করার জন্যই! তাই তিনি স্থির করলেন—আজ থেকে কল করাটাই ভালোভাবে রপ্ত করবেন।
ছেলে একদিন তাঁকে ট্রেনিং দিল—
“বাবা, এইসব খুব সহজ। এইসবুজ বোতামটা চাপলেই কল ধরবে। আর এই লাল বোতামটা চাপলেই কল কেটে যাবে।”
প্রফুল্লবাবু গম্ভীর মুখে মাথা নেড়ে বললেন, “হুঁ, এতদিন বাটন ফোনে এটাই করতাম। এটা তো একই জিনিস।”
কিন্তু স্মার্টফোন আর বাটন ফোন এক জিনিস নয়—এই সত্য তিনি খুব শিগগিরই বুঝতে পারলেন।
বাজারের লাইভ সম্প্রচার
একদিন সকালে তিনি বাজার করতে গিয়েছিলেন। ব্যাগে সবজি, ডিম, আলু বোঝাই। এমন সময় স্ত্রী ফোন করলেন—
“শোনো, আলু নিয়েছ তো?”
প্রফুল্লবাবু ফোন ধরলেন। কিন্তু স্পিকার বাটন চাপতে গিয়ে ভুলে অন্য একটা বাটন চাপলেন। ফলে ফোনের ভলিউম একেবারে সর্বোচ্চে গিয়ে বাজতে লাগল।
বাজারের মাঝখানে সবাই শুনতে পেল তাঁর আর স্ত্রীর সংলাপ—
স্ত্রী (চেঁচিয়ে): “আমি তো তোমায় কতবার বলেছি, ঠিক করে দামদর করতে! এভাবে সবজিওয়ালারা ঠকাবে।”
প্রফুল্লবাবু (কেঁপে): “আরে আচ্ছা আচ্ছা, তুমি চুপ করো তো! লোকজন শুনছে।”
স্ত্রী (আরও জোরে): “শোনো, আবার যেন টমেটো নষ্ট না হয়। গতবার তিন কেজি এনে ফেলে দিয়েছিলে।”
বাজারের লোকজন হাসতে হাসতে গড়াগড়ি। কেউ বলল, “প্রফুল্লদা, আপনার তো লাইভ শো হচ্ছে।” আরেকজন যোগ করল, “দিদিকে স্পিকারে রেখে দিন না, আমরাও শিখি কিভাবে বাজার করতে হয়।”
প্রফুল্লবাবুর মুখ লজ্জায় লাল। তিনি মরিয়া হয়ে লাল বোতাম খুঁজতে লাগলেন। কিন্তু ভুল করে আবার সবুজ চাপলেন। ফলে স্ত্রী আরও জোরে শোনা গেল—
“শোনো, আজকে ফিরে এসে হাত ধুয়ে ঢুকবে। কালকে কিন্তু একেবারে ময়লা হাতে খেতে বসেছিলে।”
এবার আর হাসি চাপা গেল না। গোটা বাজার হাততালি দিয়ে উঠল। প্রফুল্লবাবু ব্যাগ হাতে প্রায় দৌড়ে বাজার থেকে বেরোলেন।
অফিসে কেলেঙ্কারি
অফিসে বসে থাকতেও তিনি একদিন বিপাকে পড়লেন। হঠাৎ ফোন এল স্ত্রীর। প্রফুল্লবাবু চুপিসারে ধরলেন, কিন্তু আবার সেই সর্বনাশা স্পিকার বাটনে চাপ দিলেন।
স্ত্রী গর্জে উঠলেন—
“শোনো, আমি আজ তোমার শার্ট ধুতে গিয়ে দেখলাম, পকেটে ভিজে যাওয়া পেঁয়াজের খোসা। এটা কীভাবে হলো?”
সহকর্মীরা তখন মিটিংয়ে বসা। হঠাৎ এই সংলাপ শুনে সবার মুখ হাঁ। বসও তাকালেন। তারপর চোরা হাসি।
প্রফুল্লবাবু তো ঘেমে নেয়ে একাকার। তাড়াহুড়ো করে কল কেটে দিলেন, কিন্তু ততক্ষণে গোটা অফিসে তাঁর নাম হয়ে গেছে—“অনিয়ন কিং।”
পাড়ার ঘটনার ঝড়
সন্ধ্যায় পাড়ার ক্লাবে বসে আড্ডা দিচ্ছিলেন। এমন সময় ফোন এল মেয়ের।
“বাবা, কালকে আমার টিউশন ফি দিতে হবে। ভুলে যেও না।”
প্রফুল্লবাবু আবারও ভুল করে স্পিকার চালু করে ফেললেন। চারপাশে পাড়ার বন্ধুরা শুনে ফেলল। কেউ ফিসফিস করে বলল, “দেখছিস, প্রফুল্লদা টিউশন ফি দিচ্ছে মেয়ের। আমরা তো এখনো টিউশন ফি বকেয়া।”
প্রফুল্লবাবু হকচকিয়ে গেলেন। তিনি আস্তে করে ফোন মুখ থেকে দূরে সরিয়ে আনলেন, কিন্তু স্পিকার তখনও বাজছে। ফলে সবার শোনার সুযোগ হলো মেয়ের শেষ লাইনটা—
“আর হ্যাঁ বাবা, দয়া করে ক্লাসের গ্রুপে সেলফি পাঠিও না।”
গোটা ক্লাব হেসে গড়াগড়ি খেয়ে পড়ল।
বাড়ি ফিরে চূড়ান্ত হট্টগোল
রাতে বাড়ি ফিরে তিনি ছেলেকে বললেন, “শোনো, এই স্পিকার জিনিসটা একেবারে অভিশাপ। আমি যতবার ফোন ধরি, ততবার সারা পৃথিবী শুনে ফেলে।”
ছেলে হেসে বলল, “বাবা, তুমি বাটনটা ভুল করে চাপ দাও। শুধু কান ঘেঁষে কথা বললেই হবে।”
প্রফুল্লবাবু গম্ভীর মুখে বললেন, “না রে, এই ফোনটা আসলেই ষড়যন্ত্র করছে। আমার যত ব্যক্তিগত কথা আছে, সব প্রকাশ করে দিচ্ছে।”
স্ত্রী টিপ্পনি কাটলেন—“ব্যক্তিগত কথা? তোমার ব্যক্তিগত কথা মানেই তো আলু-টমেটো, পেঁয়াজের খোসা আর শার্টের পকেট।”
প্রফুল্লবাবু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিড়বিড় করে বললেন, “না গো, আমি তো একেবারে রেডিও হয়ে গেছি। এবার থেকে ফোন ধরার আগেই বিজ্ঞাপন দিতে হবে—‘প্রফুল্ল লাইভ শো শুরু হতে চলেছে।’”
এভাবেই স্মার্টফোন শেখার পথে তাঁর ষষ্ঠ কাণ্ড ঘটল—
“কলিং কেলেঙ্কারি।”
যেখানে প্রতিটি কল হয়ে উঠল জনসমক্ষে সম্প্রচারিত নাটক।
পর্ব ৭: সেলফি বিপত্তি
হোয়াটসঅ্যাপ, কলিং আর চার্জারের ঝামেলার পর প্রফুল্লবাবু একটা জিনিস শিখলেন—এই ফোনটা শুধুই বিপদ। তবু ভেতরে ভেতরে তাঁর একটা কৌতূহল থেকে গিয়েছিল। বিশেষ করে সেলফি ব্যাপারটা।
ছেলে-মেয়ে প্রতিদিন কত রকম ছবি তুলে সোশ্যাল মিডিয়ায় দেয়, আর কত লাইক পায়। পাড়ার কাকিমারাও হোয়াটসঅ্যাপে নিজেদের পুজোর শাড়ির ছবি দিয়ে হইচই ফেলে দেন। প্রফুল্লবাবু মনে মনে ভাবলেন, “আমার মুখে কী দোষ আছে? আমিও যদি একটা সেলফি তুলি, কে জানে, হয়তো আমাকেও সবাই বাহবা দেবে।”
প্রথম প্রচেষ্টা
সেদিন সকালে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে তিনি ফোন হাতে নিলেন। ক্যামেরা অ্যাপ চালু করতেই হঠাৎ নিজের মুখটা পর্দায় দেখে আঁতকে উঠলেন। মুখটা এত বড়, এতটা কুঁচকানো—তিনি নিজেই চিনতে পারলেন না।
“হায় হায়! এ আবার কে?”
ভয়ে ফোন নামিয়ে ফেললেন। পরে বুঝলেন, এ তাঁরই প্রতিচ্ছবি।
তিনি আবার চেষ্টা করলেন। এ বার ক্যামেরা ঘুরে গেল উল্টোদিকে। ফলাফল—একটা বিশাল সিলিং ফ্যানের ছবি। বারবার চেষ্টা করেও শুধু ফ্যান, টিউব লাইট আর জানলার পর্দাই ধরা পড়ছিল।
পাড়ার কাকিমাদের অনুরোধ
এর মধ্যে পাড়ার ভদ্রমহিলারা তাঁকে উস্কানি দিলেন। একদিন ক্লাবে গল্প করতে করতে বললেন—
“প্রফুল্লদা, আপনারও তো নতুন ফোন হয়েছে। একদিন একটা সেলফি তুলে গ্রুপে পাঠান না। আমরা তো দেখব, আপনি কেমন লাগছেন।”
প্রফুল্লবাবুর গলা কেঁপে উঠল—“না না, আমি এসব পারব না।”
কিন্তু ভেতরে ভেতরে অহংকারে বুক ফুলে উঠল। ভাবলেন, “আচ্ছা, দেখি, আমিও যদি একবার নাম করি।”
মহা বিপর্যয়
সেদিন সন্ধ্যায় তিনি ঘরে বসে সেলফি তুলতে বসেছেন। অনেক কসরত করে অবশেষে ক্যামেরা ফ্রন্ট সাইডে ঘুরালেন। চোখ ছোট করে তাকালেন, গম্ভীর ভঙ্গিতে চিবুক উঁচু করলেন—ক্লিক!
কিন্তু হায়! ছবি ওঠেনি তাঁর মুখের। বরং আবারও উঠে গেল সিলিং ফ্যানের তিরতিরে ব্লেড।
তিনি বিরক্ত হয়ে বারবার চেষ্টা করতে লাগলেন। একবার টেবিলের কোণ, একবার জানলার গ্রিল, একবার মেঝের চাটাই—সবই ছবি হিসেবে ধরা পড়ছে, শুধু মুখটা বাদ।
শেষ পর্যন্ত ভুল করে একসঙ্গে ২৫টা ছবি তুলে ফেললেন—এবং সবকটাই অটো-সিঙ্ক হয়ে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে আপলোড হয়ে গেল!
গ্রুপে ঝড়
পাড়ার গ্রুপ তখন সরগরম।
একজন লিখল—“প্রফুল্লদা, ফ্যানের এতগুলো ছবি কেন?”
আরেকজন টিপ্পনি কাটল—“দেখো দেখো, দাদার তো আর্টিস্টিক ভাব। বিমূর্ত ফটোগ্রাফি!”
কেউ আবার যোগ করল—“এই ছবিগুলো দেখে ঘুম পাবে। একেবারে ফ্যান্টাস্টিক।”
প্রফুল্লবাবুর মাথায় হাত। তিনি মরিয়া হয়ে ছবিগুলো ডিলিট করতে গেলেন, কিন্তু ততক্ষণে সবাই সেভ করে নিয়েছে।
স্ত্রীর রাগ
স্ত্রী খবর পেয়ে ঝড়ের মতো ঘরে এলেন।
“শোনো, তোমার জন্য আমার কী লজ্জা হয়েছে জানো? পাড়ার রুমা আমাকে ফোন করে বলছে, তোমার স্বামী নাকি ফ্যানের ছবি তোলেন! তুমি আর কী সার্কাস করবে?”
প্রফুল্লবাবু হাঁটু গেড়ে মিনতি করতে লাগলেন—“শোনো গো, আমি তো চেষ্টাই করছিলাম। মুখটা উঠল না, ফ্যানটা উঠে গেল। তাতে দোষটা কোথায়?”
স্ত্রী গর্জে উঠলেন—“তুমি না হলে একদিন গোটা বাড়িকে ছবির স্টুডিও বানিয়ে দেবে।”
চূড়ান্ত টিপ্পনি
পরদিন ক্লাবে গিয়ে তিনি মাথা নিচু করে বসেছিলেন। সবাই খিলখিল করে হেসে উঠল। শঙ্করবাবু বলল, “প্রফুল্লদা, আপনার নাম রাখা উচিত—সেলফি ফ্যান।”
আরেকজন যোগ করল, “আপনার ছবিগুলো দেখে এত ঘোর লেগেছে যে, আমরা প্রায় পড়ে যাচ্ছিলাম।”
প্রফুল্লবাবু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিড়বিড় করে বললেন,
“আহা রে! আমি চেয়েছিলাম হিরো হতে, কিন্তু হলাম ফ্যান ক্লাবের সভাপতি।”
এভাবেই ঘটল তাঁর জীবনের সপ্তম বিপর্যয়—
“সেলফি বিপত্তি।”
যেখানে মুখের ছবি উঠল না, কিন্তু ফ্যানই হয়ে উঠল সেলিব্রিটি।
পর্ব ৮: গ্রুপ চ্যাটে কেলেঙ্কারি
সেলফির ফ্যান কাণ্ডে পাড়ার সবাই এখনও টিপ্পনি কাটছে। প্রফুল্লবাবু প্রতিজ্ঞা করেছিলেন—এবার আর কিছুতেই কোনো ছবি তোলা নয়। তিনি ভাবলেন, “চুপচাপ থাকাই শ্রেয়। যত বেশি চেষ্টা করি, তত বেশি কেলেঙ্কারি হয়।”
কিন্তু স্মার্টফোন নামক দানব তাঁকে ছাড়ল না। এবার নতুন বিপদ এসে ঘটল পাড়ার গণেশপূজার গ্রুপ চ্যাটে।
চাঁদার নোটিস
পাড়ার গণেশপূজা আসছে। কমিটির তরফ থেকে সবাইকে বলা হয়েছিল, খরচের হিসেব আর চাঁদার নোটিস হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে দিতে হবে। শঙ্করবাবু দায়িত্ব দিলেন প্রফুল্লবাবুকে—
“দাদা, আপনি তো এখন হোয়াটসঅ্যাপের এক্সপার্ট। আপনার হাতে যদি একবার নোটিসটা টাইপ হয়ে যায়, সবার কাছে পৌঁছে যাবে।”
প্রফুল্লবাবু ভেতরে ভেতরে ঘেমে নিলেন। কিন্তু বাইরে মুখ গম্ভীর করে বললেন, “অবশ্যই, আমি পারব।”
তিনি খাতায় লিখে নিয়েছিলেন—
“এবারের পূজার চাঁদা ৫০০ টাকা। দয়া করে আগামী রবিবারের মধ্যে জমা দিন।”
ভুল ফাইল
রাতে খাওয়ার পর তিনি ফোন হাতে নিয়ে বসে পড়লেন। মেয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল কিভাবে ফাইল অ্যাটাচ করতে হয়। কিন্তু তিনি ভুল করে গ্যালারির আরেক ফোল্ডারে ঢুকে গেলেন।
ক্লিক করে যে ফাইল পাঠালেন, সেটা নোটিস নয়—
বরং তাঁর কলেজ জীবনের পুরোনো প্রেমপত্র!
গ্রুপে ঝড়
কিছুক্ষণের মধ্যেই গ্রুপে টুং টাং শব্দ।
কেউ লিখল—“দাদা, এ কী অদ্ভুত নোটিস দিলেন?”
অন্যজন মজা করে পড়তে শুরু করল—“প্রিয় মিতা, তোমার চোখের দিকে তাকালে মনে হয় আকাশ ভিজে যাচ্ছে…”
পাড়ার ছেলেরা একে একে ইমোজি পাঠাতে লাগল—হাসি, হাততালি, লাল হার্ট!
প্রফুল্লবাবু মাথায় হাত দিয়ে বসে আছেন।
স্ত্রীর প্রতিক্রিয়া
স্ত্রীর কাছে খবর পৌঁছাতে বেশি সময় লাগল না। তিনি গর্জে ঘরে এলেন—
“শোনো, এ কী সর্বনাশ করেছো? পাড়ার গ্রুপে প্রেমপত্র পাঠাও?”
প্রফুল্লবাবু কাঁপতে কাঁপতে বললেন, “আমি তো নোটিস দিতে গিয়েছিলাম! ভুলে এইটা চলে গেল।”
স্ত্রী বিদ্রুপ করে বললেন, “ভালোই করেছো। এতদিনে পাড়ার সবাই জানল, আমার স্বামী একসময় রোমান্টিক হিরো ছিল!”
পাড়ার টিপ্পনি
পরদিন সকালে বাজারে গিয়েই বিপদ। সবাই তাঁকে দেখে খিলখিল করে হাসছে।
কেউ বলল, “দাদা, আজকাল নোটিসে বেশ কবিতা হচ্ছে।”
আরেকজন যোগ করল, “ওই প্রেমপত্রটা পড়ে আমার বউও আমাকে নতুন করে ভালোবাসতে শুরু করেছে।”
শঙ্করবাবু আবার ঠাট্টা করলেন—“প্রফুল্লদা, পূজার চাঁদা না দিয়ে যদি সবাই প্রেমপত্র জমা দেয়, তবে বাজেট মিটে যাবে।”
শেষমেশ আত্মসমর্পণ
প্রফুল্লবাবু হাপুস নয়নে বাড়ি ফিরে এলেন। ছেলেকে বললেন, “এই ফোনটা আমায় শেষ করে দেবে। আমি আর গ্রুপে কিছু পাঠাব না। শুধু পড়ব।”
ছেলে হেসে উত্তর দিল, “না বাবা, তুমি তো এখন গ্রুপের ভিআইপি। তোমার মেসেজেই সবার আসল এন্টারটেইনমেন্ট।”
প্রফুল্লবাবু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিড়বিড় করলেন—
“আহা রে! আমি চেয়েছিলাম চাঁদার হিসেব দিতে, কিন্তু দিলাম হৃদয়ের হিসেব।”
এভাবেই ঘটল অষ্টম বিপর্যয়—
“গ্রুপ চ্যাটে কেলেঙ্কারি।”
যেখানে পূজার নোটিসের জায়গায় বেরিয়ে এলো হারিয়ে যাওয়া যৌবনের প্রেমপত্র।
পর্ব ৯: রাতের ভূতের ডাক
প্রফুল্লবাবু তখন বেশ ক্লান্ত। এতদিনে স্মার্টফোন তাঁকে শিখিয়েছে—হোয়াটসঅ্যাপ বিপত্তি, গুগল ভয়েসের জাদু, পেঁয়াজের পাহাড়, চার্জারের ধোঁকা, সেলফি বিপ্লব আর প্রেমপত্রের কেলেঙ্কারি। প্রতিদিনই তিনি নতুন শিক্ষা নিচ্ছেন। তবুও তিনি ভেবেছিলেন—রাতের বেলা অন্তত শান্তি পাবেন।
কিন্তু না, ফোনটা তাঁকে রাতেও ছাড়ল না।
অদ্ভুত শব্দ
সেদিন রাত প্রায় বারোটা। সব ঘর নিস্তব্ধ, চারপাশে হালকা ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। প্রফুল্লবাবু ঘুমের মধ্যে হঠাৎ শুনলেন ফোন থেকে অদ্ভুত শব্দ—টুং টাং করে বেজে উঠছে।
তিনি আঁতকে উঠে বালিশের নিচ থেকে ফোন বের করলেন। স্ক্রিনে লেখা—“নোটিফিকেশন।”
কিন্তু অক্ষরগুলো তাঁর চোখে ধাঁধার মতো লাগছিল। মনে হলো যেন ভূতের হরফ জ্বলছে।
তিনি ভয়ে বিড়বিড় করে বললেন, “এ কী? মাঝরাতে কে ডাকছে আমাকে?”
স্ত্রীর বিরক্তি
স্ত্রী পাশে ঘুমোচ্ছিলেন। শব্দে বিরক্ত হয়ে উঠে বসলেন—
“এ আবার কী সর্বনাশ? রাতদুপুরে ফোন বাজাচ্ছো?”
প্রফুল্লবাবু গলা কাঁপিয়ে বললেন, “আমি বাজাচ্ছি না গো, ফোনটাই বাজছে। কোনো অশরীরী শক্তি হয়তো ডাকছে।”
স্ত্রী চোখ পাকালেন—“আহা, ভূত নয়, হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ। তোমার ওই বাজারের গ্রুপে কেউ হয়তো ছবি দিয়েছে।”
প্রফুল্লবাবু কুণ্ঠিত গলায় বললেন, “না না, আমি নিশ্চিত—এটা ভূতের ডাক।”
হোয়াটসঅ্যাপের অভিশাপ
আতঙ্ক নিয়েই ফোনটা খুললেন। দেখা গেল, পাড়ার গ্রুপে কেউ রাত্তিরে “গণেশপূজার আলো ঝলমলে ছবি” পাঠিয়েছে।
কিন্তু ছবিতে আলো ঝলমলে বলে তাঁর চোখে মনে হলো, অন্ধকারে ভূতের আগমন। তিনি হাঁ করে তাকিয়ে রইলেন।
স্ত্রী হেসে গড়াগড়ি—“তুমি একেবারে বাচ্চা হয়ে গেছো। ফোনের টুং টাং শব্দেই ভূত দেখছো।”
রাতের কাণ্ডকারখানা
কিন্তু ঘটনা এখানেই শেষ নয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই আবার ফোন থেকে ভৌতিক আওয়াজ—ভিডিও কলের রিংটোন।
প্রফুল্লবাবু চমকে উঠলেন—“হায় হায়, এবার তো ভূত আমায় সামনাসামনি ডাকছে!”
আসলে পাশের বাড়ির নাতনি ভুল করে ভিডিও কল দিয়েছিল। কিন্তু স্ক্রিনে হঠাৎ ঘন কালো ছবি ভেসে উঠতেই প্রফুল্লবাবুর মনে হলো, একেবারে ভূতের ছায়া।
তিনি চেঁচিয়ে উঠলেন—“বাঁচাও! ফোনে ভূত ঢুকেছে!”
ছেলে পাশের ঘর থেকে দৌড়ে এসে ফোনটা দেখে হেসে কুটিকুটি—“বাবা, এটা ভূত নয়, ক্যামেরা ঢাকা ছিল তাই অন্ধকার দেখাচ্ছে।”
প্রফুল্লবাবু লজ্জায় কুঁকড়ে গেলেন।
পাড়ার মজা
পরের দিন সকালে পাড়ায় আবার রটনা। ছেলেই নাকি ফাঁস করেছে—
“আমার বাবা রাতে ভূত দেখে ভয় পেয়ে চিৎকার করেছিলেন!”
সবাই খিলখিল করে হেসে উঠল। কেউ বলল, “প্রফুল্লদা, এবার আপনার নাম রাখা উচিত—ভূতনাথ।”
আরেকজন যোগ করল, “আপনি একা না, আপনার ফোনও ভুতুড়ে।”
শেষে প্রতিজ্ঞা
সন্ধ্যায় প্রফুল্লবাবু গম্ভীর মুখে ঘোষণা করলেন,
“আজ থেকে আমি রাত্তিরে ফোন ছুঁব না। এই যন্ত্রটা রাত হলে ভুতুড়ে হয়ে যায়। দিনের বেলা যত খুশি গণ্ডগোল করবে, কিন্তু রাতে আমি ওকে ছুটি দিলাম।”
স্ত্রী মুচকি হেসে বললেন, “তা ভালোই করেছো। অন্তত ঘুমটা শান্তিতে হবে।”
প্রফুল্লবাবু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিড়বিড় করলেন—
“আহা রে, আমি মানুষ হয়ে ভূতকে ভয় করি না, কিন্তু স্মার্টফোনের ভূতকে সামলানো বড় কঠিন।”
এভাবেই ঘটল নবম বিপর্যয়—
“রাতের ভূতের ডাক।”
যেখানে একটিমাত্র নোটিফিকেশন রাতকে ভুতুড়ে কাহিনিতে পরিণত করে দিল।
পর্ব ১০: স্মার্টফোন ক্র্যাশ কোর্স
রাতের ভূতের ডাক কাণ্ডের পর প্রফুল্লবাবুর পরিবার সিদ্ধান্ত নিল—এভাবে চলতে পারে না। একদিকে পাড়ার টিপ্পনি, অফিসের হাসাহাসি, অন্যদিকে প্রতিদিন নতুন নতুন কাণ্ডকারখানা—সব মিলিয়ে সবাই বিরক্ত।
ছেলে বলল, “বাবা, এবার তোমাকে একটা ক্র্যাশ কোর্স দিতে হবে।”
মেয়ে যোগ করল, “হ্যাঁ, না হলে তুমি ফোনের বদলে মানুষকে ক্রাশ করে দেবে।”
প্রফুল্লবাবু প্রথমে গম্ভীর মুখে বললেন, “আমি বুড়ো মানুষ। এসব আমার পক্ষে নয়।”
কিন্তু স্ত্রী কঠিন গলায় ঘোষণা করলেন, “শোনো, এবার তোমাকে শিখতেই হবে। নইলে ওই ফোন আমি খালে ফেলে দেব।”
ক্লাসের শুরু
পরদিন সন্ধ্যায় বাড়িতে পড়ার টেবিল পরিষ্কার করে বসা হলো। সামনে চেয়ার টেনে বসানো হলো প্রফুল্লবাবুকে।
ছেলে হাতে মার্কার নিয়ে বোর্ডে লিখল—“Lesson 1: On/Off।”
প্রফুল্লবাবু অবাক হয়ে বললেন, “আরে, এতদিন পর আবার স্কুলে বসা! তবে কি আমাকে আবার পরীক্ষাও দিতে হবে?”
মেয়ে হেসে উত্তর দিল, “অবশ্যই! আজ তোমাকে স্মার্টফোন এক্সাম দিতে হবে।”
প্রথম পাঠ: কল করা
ছেলে দেখাল—“বাবা, এই আইকনে চাপলে নাম্বার লেখা যায়। তারপর সবুজ বোতাম চাপলে কল হবে।”
প্রফুল্লবাবু গম্ভীরভাবে চেষ্টা করলেন। ভুল করে নাম্বারের বদলে ৫৫৫৫৫ লিখে দিলেন, আর কল চলে গেল কোথায় যেন।
ওপাশ থেকে এক অচেনা গলা উঠল—“হ্যালো, কার সঙ্গে কথা বলছি?”
প্রফুল্লবাবু ভয়ে কল কেটে বললেন, “এই যন্ত্র আমায় আবার অপরিচিত লোকের বাড়ি পাঠিয়ে দিল।”
ছেলে-মেয়ে হেসে গড়াগড়ি।
দ্বিতীয় পাঠ: ছবি তোলা
মেয়ে বলল, “বাবা, এবার সেলফি ঠিক করে তোলো।”
প্রফুল্লবাবু মাথা নেড়ে ক্যামেরা চালু করলেন। এ বারও প্রথম ছবি হলো জানলার পর্দার। দ্বিতীয় ছবি হলো চায়ের কাপের। তৃতীয় ছবিতে দেখা গেল তাঁর কপাল কাটা গেছে ফ্রেমের বাইরে।
শেষমেশ মেয়ের নির্দেশে একখানা ভালো ছবি উঠল। প্রফুল্লবাবু আনন্দে চিৎকার করে বললেন, “এই তো! আমি অবশেষে মানুষ হলাম।”
তৃতীয় পাঠ: হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহার
ছেলে গ্রুপ চ্যাট খুলে বলল, “এবার এখানে শুধু একটা ‘গুড নাইট’ লিখে পাঠাও।”
প্রফুল্লবাবু কাঁপা হাতে টাইপ করতে লাগলেন। তাঁর টাইপিংয়ের গতি এত ধীর যে, দশ মিনিটে ‘Good’ লিখতে পারলেন। তারপর ভুল করে সেন্ড চাপলেন।
ফলাফল—গ্রুপে গেল শুধু ‘Good’।
পাড়ার লোকজন সঙ্গে সঙ্গে মজা করতে শুরু করল—“Good কী দাদা? Good morning, Good evening, Good boy?”
প্রফুল্লবাবু মুখ চেপে বসে রইলেন। মেয়ে কাঁধে হাত রেখে বলল, “চিন্তা কোরো না বাবা, একদিন তুমি ঠিকই পুরো ‘Good Night’ লিখতে পারবে।”
চতুর্থ পাঠ: ভয়েস কমান্ড
এবার ছেলে বলল, “বাবা, ভয়েস সার্চ একবার ট্রাই করো।”
প্রফুল্লবাবু ভয়ভয়ে বললেন, “না রে, আবার ভূত আসবে।”
ছেলে জোর করায় তিনি ধীরে ধীরে বললেন—“লাল শাড়ি।”
অলৌকিকভাবে এবার সত্যিই লাল শাড়ির বিজ্ঞাপন বেরিয়ে এলো। প্রফুল্লবাবুর চোখ চকচক করে উঠল—“আরে, আমি সফল! এবার থেকে আমি গুগলকেও বশ করতে পারব।”
পরীক্ষার মুহূর্ত
ক্লাস শেষে ছেলে-মেয়ে ঘোষণা করল—“এবার এক্সাম।”
প্রশ্নপত্র:
১. ফোন কীভাবে অন করা হয়?
২. হোয়াটসঅ্যাপে কাকে ছবি পাঠাতে হবে, কাকে নয়?
৩. সেলফিতে মুখ আসবে, না ফ্যান?
৪. ভূতের ডাক কি সত্যিই ফোনে আসে?
প্রফুল্লবাবু গম্ভীর মুখে উত্তর দিলেন—
১. অন বোতাম চেপে।
২. বসকে ছবি নয়, শুধু রিপোর্ট।
৩. মুখ আসবে, তবে সেটা সুন্দর না হলেও চলবে।
৪. ভূতের ডাক আসে না, কিন্তু নোটিফিকেশনের ডাক আসে।
পরিবার হাততালি দিয়ে উঠল।
শেষমেশ প্রতিজ্ঞা
প্রফুল্লবাবু খুশিতে আত্মহারা। তিনি গর্বভরে ঘোষণা করলেন—
“আজ থেকে আমি স্মার্টফোনের সামনে হার মানব না। তবে রাতে একে ঘুম পাড়িয়ে রাখব। কারণ দিনের আলোয় যতই স্মার্ট হোক, রাত্তিরে এ আবার ভূত হয়ে যায়।”
স্ত্রী হেসে মাথা নাড়লেন। ছেলে-মেয়ে বলল, “বাবা, তুমি পাশ করে গেছো। আজ থেকে তুমি স্মার্টফোন গ্র্যাজুয়েট!”
প্রফুল্লবাবু বুক ফুলিয়ে বললেন,
“হুঁ, আমি বুড়ো মানুষ হলেও স্মার্টফোনের ভূতকে বশ করেছি। তবে সাবধান—আমার বশ মানলেও, ওকে কখনও অবহেলা কোরো না। নইলে পেঁয়াজের বস্তা তোমাদের দোরগোড়ায় হাজির হয়ে যাবে।”
এভাবেই শেষ হলো তাঁর শেষ বিপর্যয়—
“স্মার্টফোন ক্র্যাশ কোর্স।”
যেখানে তিনি অবশেষে শিখলেন—ভয়, লজ্জা, হাসাহাসি সব সয়ে, স্মার্টফোনের সঙ্গেই বাঁচতে হয়।
***