Bangla - ভূতের গল্প

শালবনের ছায়া

Spread the love

অনির্বাণ মুখোপাধ্যায়


পুরুলিয়ার লাল মাটির রাস্তা যেন এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতায় ভিজে ছিল। ঋত্বিক সেনগুপ্তের বাস থেকে নামতেই ধুলো মেখে গেল জুতো। কলকাতা থেকে এখানে পৌঁছতে প্রায় নয় ঘণ্টা লেগেছে—স্টেশন থেকে বাস, বাস থেকে আবার চোট্টোখাটো জিপ। চারপাশে শুধু শাল, পিয়াল, মহুয়ার গন্ধ, দূরে টিলা আর ঝকঝকে নীল আকাশ। তার ক্যামেরার ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে দাঁড়িয়েই একবার চারদিক দেখে নিল সে। মনে হচ্ছিল, এ জায়গাটার বুকের ভেতরেই লুকিয়ে আছে কোনও গল্প, যে গল্প ফোটে না শহরের আলোয়, কেবল গ্রামবাংলার অচেনা অন্ধকারেই তার রূপ খুঁজে পাওয়া যায়।

ঋত্বিকের সঙ্গে এসেছিল তৃষা—বন্ধু, সহযাত্রী আর কৌতূহলী সঙ্গী। ওর চোখে এ ভ্রমণটা শুধু ফটোগ্রাফির জন্য নয়, ভৌতিক রহস্যের জন্যও। তৃষা ছোটবেলা থেকেই অতিপ্রাকৃত কাহিনিতে আকৃষ্ট, ভূতের গল্প শুনলেই চোখে অদ্ভুত ঝিলিক আসে। বাস থেকে নেমে চারপাশ দেখে হেসে বলল, “এখানেই বোধহয় ওই ছায়াদের দেখা মেলে। রাতে বের হলে সাবধান!”

গ্রামের নাম বেলাতোর। এখানে থাকার ব্যবস্থা করেছে স্থানীয় এক স্কুলশিক্ষক, হরিপদবাবু। তাঁর বাড়িটাই গেস্টহাউসের মতো সাজানো, দুটো ছোট ঘর আর একটা উঠোন। ঋত্বিক যখন ঘরে ঢুকল, তখনই লক্ষ্য করল মাটির দেওয়ালে সাঁটা অদ্ভুত সাঁওতালি আঁকিবুঁকি, যেন কোনও উৎসবের অবশিষ্ট। হরিপদবাবু হাসতে হাসতে বললেন, “এগুলো পুরোনো সিদো-কানুর বিদ্রোহের স্মৃতি। তবে আজও শালবনের ভেতরে গেলে নাকি ওই বিদ্রোহীদের ছায়া ভেসে ওঠে।”

তৃষা কান খাড়া করে শুনছিল। সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন করল, “মানে ভূত?”
হরিপদবাবু একটু চুপ করে বললেন, “লোককথা আছে। রাতে শালবনের ভেতরে গেলে মানুষ আর ফেরা যায় না ঠিকমতো। অনেকেই বলে, বন থেকে অদ্ভুত ডাকে ডাকে—শুনলে বুক কেঁপে ওঠে।”

ঋত্বিক হেসে উড়িয়ে দিল। “সবই গাঁয়ের লোকের কুসংস্কার। আমি ক্যামেরা নিয়ে যাবো, যদি কিছু ধরা পড়ে তবে দেখব।”

সন্ধে নেমে এলো ধীরে ধীরে। আকাশে একচিলতে লাল আভা, শালপাতার ভেতর দিয়ে ঢুকে পড়ছে হাওয়ার শব্দ। গ্রামের মানুষজন তখন খুপরি ঘরে প্রদীপ জ্বালাচ্ছে। তৃষা চুপচাপ দাঁড়িয়ে দূরে তাকাল—বনের গায়ে তখন এক অদ্ভুত নীলচে ছায়া নেমে এসেছে। মনে হচ্ছিল, গাছগুলোর ফাঁক দিয়ে কেউ যেন তাকিয়ে আছে।

খাওয়াদাওয়ার পর হরিপদবাবু তাদের নিয়ে গেলেন গ্রামের প্রবীণ মানুষ, জহর মাঝির কাছে। সাঁওতালি দেহে কুঞ্চিত বলিরেখা, চোখে কেমন অদ্ভুত ঝলক। উনিই নাকি সবচেয়ে পুরনো গল্প জানেন। জহর মাঝি মাটির উঠোনে বসে মদ খাচ্ছিলেন। ওদের দেখে বললেন, “ছবিওলা বাবু, তুমি কি সেই ছায়াদের ছবি তুলতে এসেছো?”

ঋত্বিক অবাক, “ছায়াদের মানে?”
জহর মাঝি ধীরে ধীরে বলতে শুরু করলেন, “অনেক দিন আগে, সাহেবরা বন্দুক নিয়ে এই বনের ভেতরে ঢুকেছিল বিদ্রোহ দমন করতে। শালবনের বুকেই পড়েছিল কত লাশ। রক্ত মিশে গিয়েছিল মাটির ভেতরে। তখন থেকে রাত নামলেই দেখা মেলে সেই আত্মাদের। কেউ শোনে ঢোলের শব্দ, কেউ বা হাহাকার। যারা দেখে, তারা আর আগের মতো থাকে না।”

তৃষার মুখে চাপা বিস্ময়। ঋত্বিক মুচকি হেসে ক্যামেরা বের করল। “লোককথা শুনতে ভালো লাগল, কিন্তু প্রমাণ কোথায়?”

জহর মাঝির গলা থমকে গেল। চোখ ছোট করে তাকালেন। “প্রমাণ চাইলে আজ রাতেই শালবনের ভেতরে যাও। দেখবে কেমন প্রমাণ মেলে।”

রাত বাড়তে লাগল। গ্রামের ওপর নেমে এলো এক অদ্ভুত নীরবতা। চারদিকে শুধু শেয়ালের হাঁক, মাঝে মাঝে কুকুরের ঘেউ ঘেউ। তৃষা বারবার জানালার বাইরে তাকাচ্ছিল, যেন অদ্ভুত কিছুর প্রত্যাশা করছে। ঋত্বিক ক্যামেরা সাজাচ্ছিল ট্রাইপডে।

হঠাৎই দূরে, বনের ভেতর থেকে শোনা গেল ক্ষীণ ঢোলের শব্দ। টুকটাক… টুকটাক… ধীরে ধীরে যেন কাছে আসছে। তৃষা চমকে উঠল। “শোনো! এটাই তো!”

ঋত্বিক বলল, “হয়তো কোনও সাঁওতালি উৎসব হচ্ছে।”
কিন্তু সেই শব্দে ছিল অদ্ভুত শূন্যতা, যেন কারও বুকের গহ্বর থেকে আসছে। তৃষা আর থাকতে পারল না। “চল, আজ রাতেই আমরা শালবনের ভেতর যাবো।”

ঋত্বিক একবার দ্বিধা করল, কিন্তু ক্যামেরার লেন্সে আলো ফেলে বলল, “ঠিক আছে। আজই প্রমাণ জোগাড় করা যাক।”

তারা বেরোলেন মশাল হাতে। লাল মাটির পথ ধরে শালবনের দিকে হাঁটতে লাগল। যতই এগোচ্ছিল, ততই মনে হচ্ছিল অন্ধকার ঘন হয়ে আসছে। হঠাৎ একসময় সব শব্দ থেমে গেল। শুধু পাতার খসখস শব্দ, আর অদ্ভুত ঠান্ডা হাওয়া।

তৃষা হাত ধরল ঋত্বিকের। “মনে হচ্ছে কেউ আমাদের পিছু নিচ্ছে।”

ঋত্বিক ঘুরে তাকাল। পিছনে ফাঁকা পথ। তবুও বুকের ভেতর অজানা আতঙ্ক জমে উঠল। হঠাৎই ক্যামেরার ফ্ল্যাশ জ্বালাতেই—শালগাছের গায়ে যেন এক অস্পষ্ট ছায়ামূর্তি দাঁড়িয়ে রইল। অন্ধকারে মিলিয়ে গেল এক নিমেষে।

ঋত্বিক স্তব্ধ। তৃষার হাত কাঁপছে। শালবনের ভেতর তখন নিস্তব্ধতা নয়, যেন অদৃশ্য কারও নিঃশ্বাসে ভরে আছে।

শালবনের বুকের ভেতরে যে অদ্ভুত ছায়াটা মিলিয়ে গেল, তার পর থেকেই ঋত্বিক আর তৃষা দু’জনেই আর আগের মতো নিশ্চিন্ত ছিল না। ঋত্বিক ক্যামেরার স্ক্রিনে ফ্ল্যাশের পরে তোলা ছবিটা বারবার দেখে চলেছে। ঝাপসা, অস্পষ্ট, কিন্তু স্পষ্টই বোঝা যায়—একটা মানুষের মতো আকৃতি দাঁড়িয়ে ছিল গাছের গায়ে, অথচ সেখানে তো কেউ থাকার কথা নয়। ছবির প্রান্তে শালপাতার ফাঁক, তার মাঝখানে কালো এক অন্ধকার দাগ—যা মানুষের দেহের আকারে ছড়িয়ে আছে।

তৃষা ফিসফিস করে বলল, “দেখলে তো? বলেছিলাম, এখানে কিছু আছে। এটা নিছক কোনও কাকতাল নয়।”
ঋত্বিক ঠোঁট চেপে ধরল, যেন নিজের অস্থিরতা লুকোতে চাইছে। “হতে পারে আলো-আঁধারির খেলা। আমি নিশ্চিত কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি এখনও।”

কথাটা মুখে বললেও ভেতরে কাঁপন ধরেছিল। রাতের শালবন একেবারে অচেনা। দিনের বেলায় যেখানে রোদ ঝরে পড়ে মাটির উপর, সেখানে এখন শুধু অদ্ভুত ঘন অন্ধকার। গাছের গুঁড়ির আড়ালে যেন কেউ লুকিয়ে আছে, পাতার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে।

হঠাৎই কানে এলো এক ভেসে আসা সুর—মাটির ঢাকের মতো, মৃদু বাজনা। টুক… টুক… টুক…। শব্দটা যেন দূরে নয়, একেবারে সামনের দিকেই। তৃষা ভয়ে হাত ধরল ঋত্বিকের, কিন্তু কৌতূহলও কম ছিল না। ও ফিসফিস করে বলল, “চল সামনে যাই। দেখি আসলেই কী হচ্ছে।”

তারা এগিয়ে গেল ধীরে ধীরে। বাতাসে মহুয়ার গন্ধ, কিন্তু তার সঙ্গে মিশে আছে কেমন কাঁচা রক্তের মতো একটা ধাতব গন্ধ। ঋত্বিক ক্যামেরা তাক করল সামনে, ফ্ল্যাশ অন করে ছবি তুলল। আবারও ঝলসে উঠল আলো, আর তার ভিতর দেখা গেল কয়েকটা ছায়ামূর্তি। যেন লোকজন দাঁড়িয়ে আছে বৃত্তাকারে। ঢাক বাজানোর মতো ভঙ্গি একটির।

ফ্ল্যাশ নিভতেই সব অন্ধকার। চারদিক শুনশান। তৃষা হাঁপাতে লাগল। “ঋত্বিক, আমি দেখেছি… আমি স্পষ্ট দেখেছি। ওরা এখানে আছে।”

ঠিক তখনই ঝোপের ভেতর থেকে হঠাৎ এক মৃদু কণ্ঠ ভেসে এলো। ভাষা বোঝা গেল না, তবে সাঁওতালি বলেই মনে হলো। একটা স্তব্ধ, করুণ সুরে গান গাইছে কেউ। ঋত্বিকের শরীর ঠান্ডা হয়ে এলো। কণ্ঠস্বরটা যেন মাটির নিচ থেকে উঠে আসছে, কোনও অদৃশ্য গহ্বর থেকে।

তৃষা আতঙ্কে কেঁপে উঠল। “চল ফিরে যাই। এখনই!”
কিন্তু ঋত্বিক ক্যামেরা নামাল না। তার ভেতরে এক অদ্ভুত শক্তি কাজ করছে—ভয় নয়, বরং প্রমাণ সংগ্রহের অদম্য বাসনা। ও হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, “আর একটু সামনে যাই। সত্যটা না জেনে ফিরব না।”

তাদের পায়ের নিচে শুকনো পাতা চাপা পড়ে শব্দ করছে। বন আরও গভীর হচ্ছে। হঠাৎ হাওয়ার ঝাপটা এল, মশালটা কেঁপে উঠল। সেই আলোয় কয়েক সেকেন্ডের জন্য সামনে স্পষ্ট দেখা গেল—একজন অর্ধনগ্ন সাঁওতালি যোদ্ধা দাঁড়িয়ে আছে, হাতে ভাঙা বর্শা। চোখ দুটো লালচে আগুনের মতো।

তৃষা চিৎকার করে উঠল। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যেই সে মিলিয়ে গেল। বাতাসে শুধু পাতার খসখস, যেন কিছুই ঘটেনি।

ঋত্বিক হাঁটু মুড়ে বসে পড়ল। হৃদস্পন্দন এত জোরে হচ্ছিল যে মনে হচ্ছিল শালবনের নীরবতা ভেঙে যাবে। সে বুঝতে পারছিল, কোনও মায়ার ভেতর ঢুকে গেছে তারা—এ এক জগৎ, যেখানে ইতিহাসের রক্তক্ষত আজও রক্তাক্ত।

অবশেষে তৃষা জোরে টেনে ধরল তার হাত। “ঋত্বিক, এবার চল। এখনই। এর বেশি পারব না।”

দু’জনে দৌড়ে ফিরে এল গ্রামের পথে। দূর থেকে দেখা গেল গৃহস্থের প্রদীপের আলো, যেন একমাত্র আশ্রয়। হরিপদবাবু দরজায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। ওদের দেখে বললেন, “তোমরা বনে গিয়েছিলে? শুনেছিলাম তোমাদের মশালের আলো।”

ঋত্বিক কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল, “ওখানে কী আছে? কেন ওইসব ছায়া দেখা যায়?”

হরিপদবাবু দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। “জহর মাঝিকে জিজ্ঞেস করো। এই রহস্য কেবল তার কাছেই শোনা যায়। তবে সাবধান—সব রহস্য জানার জন্য নয়।”

ঋত্বিক আর তৃষা ক্লান্ত দেহ নিয়ে ঘরে ঢুকল। ক্যামেরাটা ব্যাগে রাখার আগে ঋত্বিক আবার স্ক্রিনে ছবিগুলো দেখতে লাগল। প্রতিটা ফ্রেমে ঝাপসা ছায়ামূর্তি, অর্ধেক দৃশ্যমান, অর্ধেক অদৃশ্য। যেন প্রমাণ করে দিচ্ছে—শালবনের বুক এখনও মৃতদের আশ্রয়।

কিন্তু সেই ছবিগুলোর মধ্যে একটিতে দেখা গেল আরও অদ্ভুত কিছু—ঋত্বিক আর তৃষার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে একটা ছায়া। তারা তখন জানেইনি, তাদের ভ্রমণ সঙ্গী হয়ে গেছে সেই অচেনা অদৃশ্য উপস্থিতি।

ভোরের আলো যখন পুরুলিয়ার লাল মাটির উঠোনে ছড়িয়ে পড়ছে, তখনও ঋত্বিক আর তৃষা ঠিকমতো ঘুমোতে পারেনি। সারারাত তাদের ঘরে যেন অদৃশ্য উপস্থিতি ঘোরাঘুরি করেছে। কখনও জানলার বাইরে শালপাতার খসখস শব্দ, কখনও মাটির ভেতর থেকে ভেসে আসা ঢাকের আওয়াজ—সব মিলিয়ে এক অসহ্য অস্বস্তি। ঋত্বিক বারবার ক্যামেরার ছবিগুলো দেখতে লাগল। কিন্তু যতবার দেখছে, ততই বুকের ভেতর অদ্ভুত ভয় জমছে।

সকালে তারা আবার গেল জহর মাঝির বাড়ি। ভাঙাচোরা মাটির দেওয়াল, উঠোনে মাটির হাঁড়ি আর শুকনো কাঠ। জহর মাঝি যেন আগেই অপেক্ষা করছিলেন। চোখে তাঁর ভয়ঙ্কর স্থিরতা। তিনি চুপচাপ তাদের বসতে বললেন।

ঋত্বিক দ্বিধা না করে জিজ্ঞেস করল, “গতরাতে আমরা বনে গিয়েছিলাম। ঢাকের শব্দ শুনেছি, ছায়া দেখেছি। আপনি বলেছিলেন সব জানেন। সত্যিটা আমাদের বলুন।”

জহর মাঝি একচুমুক হাড়িয়া খেলেন। তারপর গভীর গলায় বলতে শুরু করলেন—

“অনেক বছর আগে, ব্রিটিশ সাহেবেরা এখানে এল বিদ্রোহ দমন করতে। সিদো-কানুর ডাক তখন পাহাড় জুড়ে ছড়িয়ে গেছে। সাঁওতালরা একে একে জড়ো হচ্ছিল শালবনের বুকের ভেতর। তাদের হাতে ঢাক, তীর, বর্শা—কিন্তু বুকভরা সাহস। সাহেবরা বন্দুক নিয়ে ঢুকল বনে, আর শুরু হলো রক্তের খেলা। গাছের গায়ে গায়ে গুলি লেগে পড়ল অসংখ্য যোদ্ধা। মহিলারা, শিশুরাও রেহাই পায়নি। পুরো বন রক্তে ভিজে গেল।”

তৃষা নিঃশ্বাস বন্ধ করে শুনছিল। চোখে তার জল এসে গিয়েছিল।

জহর মাঝি আরও বললেন, “সেই রক্ত আজও শুকোয়নি। যাদের বুক ফেটে গিয়েছিল, তাদের আত্মা বন্দি হয়ে গেছে এ বনে। রাতে তারা জেগে ওঠে। ঢাক বাজে, গান গাওয়া হয়। তারা ন্যায় চায়, প্রতিশোধ চায়। তাই যারা এই বনে যায়, তাদের সামনে সেই ছায়ারা দাঁড়ায়।”

ঋত্বিক ঠোঁট কামড়ে চুপ করে রইল। ক্যামেরায় যা ধরা পড়েছে, তার ব্যাখ্যা এই গল্পই দিচ্ছে।

তৃষা হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, “কেউ কি কখনও ফিরে এসেছে? মানে, যাদের ওরা টেনে নিয়ে গেছে?”

জহর মাঝির চোখে তখন ভয়াবহ অন্ধকার। “ফিরেছে, কিন্তু মানুষ হয়ে নয়। তারা ফাঁকা চোখ নিয়ে ফিরে আসে। মুখে আর কোনও শব্দ নেই। শুধু ফাঁকা দৃষ্টি। গ্রামের অনেকে আজও তাদের এড়িয়ে চলে।”

ঋত্বিক আর তৃষা একে অপরের দিকে তাকাল। দু’জনেই বুঝল—এটা নিছক লোককথা নয়। এখানে ইতিহাস মিশে গেছে অতিপ্রাকৃতের সঙ্গে।

ঠিক তখনই, বাইরে হঠাৎ এক শিশুর কান্নার আওয়াজ শোনা গেল। অদ্ভুত, বুক কাঁপানো শব্দ। তৃষা ছুটে গেল দরজার কাছে। বাইরে কাউকে দেখা গেল না। শুধু বাতাসে পাতার দোল খাওয়া, আর মাটিতে পড়ে থাকা ছোট্ট পায়ের ছাপ। যেন এক শিশুই মুহূর্ত আগে সেখানে দাঁড়িয়েছিল।

জহর মাঝি ধীরে বললেন, “ওরা এখন তোমাদের চিনে নিয়েছে। এবার আর মুক্তি নেই। তোমরা যা-ই করো, শালবনের ছায়া তোমাদের পিছু নেবে।”

ঋত্বিক গলা শুকিয়ে গেল। মনে হলো, কোনও অদৃশ্য ফাঁদে আটকা পড়ে গেছে তারা।

তৃষা হাত কাঁপতে কাঁপতে বলল, “আমরা কি এখান থেকে চলে যেতে পারি? কলকাতায় ফিরে গেলে কি আর ওরা আমাদের পাবে না?”

জহর মাঝি মাটিতে চোখ রাখলেন। “বন যাদের ছোঁয়, তারা আর মুক্ত হয় না। যেখানেই যাও, ছায়া তোমাদের সঙ্গে থাকবে।”

এক অদ্ভুত নীরবতা নেমে এলো। দূরে কুকুরের ডাক শোনা গেল, যেন অদ্ভুত সতর্কবার্তা।

ঋত্বিক এবার সিদ্ধান্ত নিল। “আমাকে প্রমাণ চাই। এই ইতিহাসটা শুধু গল্প নয়, বাস্তব। আমি ছবিতে তুলে নেব। হয়তো তাতে বোঝা যাবে আসল সত্যি। আর যদি সত্যিই এই বন আমাদের ছাড়তে না চায়, তবে আমরাও পালাব না।”

তৃষা থমকে গেল। ভয় আর বিস্ময়ের মাঝখানে দাঁড়িয়ে সে বুঝতে পারছিল—ঋত্বিক এখন শুধু একজন ফটোগ্রাফার নয়, বরং এক অদৃশ্য শক্তির টানে টেনে নিয়ে যাওয়া মানুষ।

জহর মাঝি মাথা নাড়লেন। “তাহলে আজ রাতে আবার বনে যাও। তবে মনে রেখো, এবার বনের বুক খুলে যাবে। আর তার ভেতর কী আছে, কেউ জানে না।”

রাত নামতে না নামতেই বেলাতোর গ্রাম আবার নিস্তব্ধতায় ঢেকে গেল। আকাশে অর্ধেক চাঁদ, হালকা কুয়াশা ভেসে আসছে পাহাড়ের দিক থেকে। ঋত্বিক ব্যাগে ক্যামেরা গুছিয়ে নিল, ট্রাইপড, অতিরিক্ত ব্যাটারি, টর্চ—সব প্রস্তুত। তৃষা জানত, ওকে আর আটকানো যাবে না। ভয় তার বুক জুড়ে জমে ছিল, তবুও ভেতরে অদ্ভুত এক আকর্ষণও কাজ করছিল।

হরিপদবাবু দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বললেন, “আজ রাতটা অন্য রকম। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখুন, বাতাস অস্বাভাবিক ঠান্ডা। এ রাতে বনে যাবেন না।”
ঋত্বিক শান্ত গলায় উত্তর দিল, “যা দেখতে এসেছি, তা আজই দেখতে হবে। সত্যি ধরা না দিলে ফিরে যাওয়া বৃথা।”
তৃষা একবার হরিপদবাবুর চোখে তাকাল। সেখানেও অদ্ভুত আতঙ্ক, যেন তিনি জানেন রাতটা কী নিয়ে আসতে চলেছে।

শালবনের পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে তারা বুঝতে পারল, নীরবতাটা আজ আরও ঘন। পোকামাকড়ের ডাকও নেই, শুধু বাতাসের ফিসফিস। গাছের গুঁড়ি একে অপরকে ছাপিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, যেন এক অদৃশ্য প্রাচীর। ঋত্বিক ট্রাইপড বসিয়ে ক্যামেরা ঠিক করতে লাগল। তৃষা হাত মুঠো করে চেপে ধরেছে, ঠান্ডা ঘামে ভিজে গেছে আঙুল।

হঠাৎ দূর থেকে ভেসে এলো ঢোলের শব্দ—ধীর, তালে তালে। তার সঙ্গে মিলল করুণ সাঁওতালি সুর। কণ্ঠস্বরটা এত অচেনা, অথচ যেন ইতিহাসের বুক থেকে উঠে এসেছে। ঋত্বিক ফ্ল্যাশ জ্বালাতেই আলোয় ধরা পড়ল—গাছের ফাঁকে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকজন অদৃশ্য যোদ্ধা। তাদের শরীর আধখানা দৃশ্যমান, চোখ দুটো শুধু জ্বলছে অন্ধকারে। হাতে ভাঙা বর্শা, কাঁধে ঢাক।

তৃষা দমবন্ধ করে তাকিয়ে রইল। “ওরা… সত্যিই আছে।”
ঋত্বিক কাঁপা গলায় বলল, “হ্যাঁ, আর আমি প্রমাণ পেয়ে গেছি।”

কিন্তু পরক্ষণেই মাটির ভেতর কেঁপে উঠল অদ্ভুত কম্পন। যেন শত শত পায়ের শব্দ একসঙ্গে দৌড়ে আসছে। শালগাছের পাতা কাঁপতে লাগল প্রবল হাওয়ায়। ঋত্বিক বুঝল, শুধু দেখা নয়, এবার বনের বুক খুলে যাচ্ছে।

হঠাৎই এক যোদ্ধার ছায়া সামনে এগিয়ে এল। তার চোখে লাল আগুন, ঠোঁট ফেটে গলগল করে রক্ত ঝরছে। মুখ খুলে সে এক অদ্ভুত শব্দ করল—যা ভাষা নয়, কিন্তু একে একে সমস্ত গাছ প্রতিধ্বনি তুলল। সেই আওয়াজে তৃষার শরীর কেঁপে উঠল।

ঋত্বিক ক্যামেরা তুলতেই লেন্স ফেটে গেল। ফ্রেম জুড়ে শুধু অন্ধকার। সে হোঁচট খেয়ে মাটিতে পড়ে গেল। ঠিক তখনই তৃষা দেখল—তার পেছনে আরও অনেক ছায়া ভিড় করছে। নারী, পুরুষ, শিশু—সবাই যেন অদৃশ্য শরীরে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের চোখ ফাঁকা, অথচ কান্নার মতো শব্দ বেরোচ্ছে।

তৃষা চিৎকার করে উঠল, “ঋত্বিক, আর এক মিনিট থাকলে আমরা মরব!”

কিন্তু ঋত্বিক দাঁড়িয়ে রইল। বুক ফুলিয়ে ক্যামেরা তুলে ধরল, যদিও তাতে আর ছবি ধরা পড়ছে না। তার চোখে তখন এক অদ্ভুত মোহ। যেন ছায়ারা তাকে ডাকছে, টেনে নিচ্ছে নিজেদের দিকে।

এক মুহূর্তে সব আলো নিভে গেল। মশাল নিভে গিয়ে চারদিক কালো হয়ে গেল। বাতাসে তখন কেবল হাহাকার আর ঢোলের আওয়াজ।

তৃষা মরিয়া হয়ে ঋত্বিকের হাত ধরে টানল। কোনওরকমে দু’জনে ছুটে বেরিয়ে এল বনের পথ ধরে। বুক ধড়ফড় করছে, গলায় শ্বাস আটকে যাচ্ছে। পিছন থেকে ভেসে আসছিল অসংখ্য কণ্ঠের চিৎকার, যেন মৃতরা একযোগে দৌড়ে আসছে।

গ্রামের আলো দেখা মাত্রই সেই আওয়াজ থেমে গেল। হঠাৎ করেই নীরবতা নেমে এলো। কেবল দূরের কুকুরের ডাক আর বাঁশঝাড়ের সোঁ সোঁ শব্দ।

তৃষা মাটিতে বসে পড়ল। চোখে জল, শরীর কাঁপছে। “ঋত্বিক, ওরা আমাদের মেরে ফেলত। তুমি পাগল হয়ে যাচ্ছিলে। বুঝতেই পারছ না, আমরা আর স্বাভাবিক নেই।”

ঋত্বিক কাঁপা হাতে ভাঙা ক্যামেরা আঁকড়ে ধরল। লেন্স ফেটে গেলেও ভেতরে মেমরি কার্ড অক্ষত। সে ফিসফিস করে বলল, “যা দেখেছি, তা কেউ বিশ্বাস করবে না। কিন্তু প্রমাণ আমার কাছে আছে।”

তৃষা চমকে তাকাল। “কোন প্রমাণ?”
ঋত্বিক ফিসফিস করে উত্তর দিল, “ছবির ভেতর শুধু ছায়া নয়, আরও কিছু ধরা পড়েছে… যেন আমাদের পিছনে দাঁড়িয়ে আছে কেউ, একেবারে কাছাকাছি।”

তাদের না জানলেও, শালবনের সেই ছায়ারা এখন আর কেবল বনের ভেতরে নেই। তারা দু’জনের সঙ্গী হয়ে গেছে—প্রতিটি পদক্ষেপে, প্রতিটি শ্বাসে।

সকাল হতেই বেলাতোর গ্রামের উঠোনে অদ্ভুত নীরবতা নেমে এসেছিল। হাওয়া নেই, পাখির ডাক নেই—সবকিছু যেন আটকে গেছে অদৃশ্য ফাঁদে। ঋত্বিক আর তৃষা হরিপদবাবুর বাড়ির ঘরে বসেছিল, সামনে টেবিলে রাখা ঋত্বিকের ক্যামেরা। লেন্সটা ভাঙা, কিন্তু মেমরি কার্ড অক্ষত।

ঋত্বিক ল্যাপটপ খুলে ছবি ট্রান্সফার করতে লাগল। তৃষা উদ্বিগ্ন চোখে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে ছিল। প্রথম কয়েকটা ছবি আগের মতোই ঝাপসা—শালগাছ, অর্ধেক দৃশ্যমান ছায়া, বাতাসে ভেসে ওঠা আকৃতি। তারপর হঠাৎ এক ছবিতে জমে গেল দু’জনের নিঃশ্বাস।

ছবিতে দেখা গেল—ঋত্বিক ও তৃষা দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু তাদের পেছনে একটা স্পষ্ট মুখ ভেসে উঠেছে। অদ্ভুত কৃশকায় এক শিশু, চোখদুটো একেবারে সাদা। ঠোঁটে রক্তমাখা হাসি। তৃষার বুক কেঁপে উঠল। “এটা… এটা তো কাল রাতে বাইরে শোনা শিশুর কান্না!”

ঋত্বিক ঠোঁট কামড়ে ধরল। স্ক্রিনে ছবিটা বড় করে দেখা গেল—শিশুটির গলা জুড়ে দাগ, যেন কারও বর্শা বিদ্ধ করে গিয়েছিল। মুখে সেই চিহ্ন এখনও শুকোয়নি। তৃষা কেঁপে কেঁপে বলল, “ঋত্বিক, আমরা অভিশপ্ত কিছু ধরেছি।”

ঠিক তখনই ঘরের দরজা ঠক করে বন্ধ হয়ে গেল। বাইরে ঝড় ওঠেনি, তবুও দরজা এমন জোরে চাপা পড়ল যে দু’জনেই লাফিয়ে উঠল। বাতাসে ছড়িয়ে পড়ল মহুয়ার গন্ধ, কিন্তু তার সঙ্গে মিশে গেল কাঁচা রক্তের ধাতব গন্ধ। ল্যাপটপের স্ক্রিনে ছবিগুলো নিজে নিজেই স্লাইড হতে শুরু করল। প্রতিটি ছবিতেই এখন দেখা যাচ্ছে আরও নতুন মুখ—যেন আগের রাতে ক্যামেরায় ধরা পড়া ছায়ারা এখন সম্পূর্ণ দৃশ্যমান হয়ে উঠছে।

তৃষা আতঙ্কে কেঁপে উঠল। “ওরা আমাদের চিনে নিয়েছে। এখন আর আমরা পালাতে পারব না।”
ঋত্বিক চুপ করে বসে রইল, যেন কোনও অদৃশ্য জালে আটকা পড়েছে। হঠাৎই সে ফিসফিস করে বলল, “না, পালাব না। এই ছবিগুলোই ইতিহাসের সাক্ষী। ব্রিটিশরা যাদের হত্যা করেছিল, তাদের আত্মাই আজও ঘুরে বেড়ায়। আমি তাদের গল্প পৃথিবীকে দেখাব।”

তৃষা তার হাত ধরে ঝাঁকিয়ে বলল, “কিন্তু এর মূল্য দিতে হবে আমাদের জীবন দিয়ে!”

ঠিক তখন জানলার বাইরে থেকে মৃদু ঢোলের শব্দ ভেসে এলো। ভোরবেলাতেও ঢোল বাজছে—এ অস্বাভাবিক। হরিপদবাবু ছুটে এলেন দরজার কাছে। ঘরে ঢুকেই চমকে উঠলেন ছবিগুলো দেখে। কপালে হাত ঠেকালেন। “তোমরা যা করেছ, তার শাস্তি মরণ ছাড়া নেই। ওরা এখন তোমাদের ছেড়ে যাবে না।”

ঋত্বিক উঠে দাঁড়াল। “আমরা যদি চলে যাই? কলকাতায় ফিরে যাই?”
হরিপদবাবু নিরাশ গলায় বললেন, “ছায়ারা বন ছেড়ে আসতে পারে। একবার যারা তাদের চোখে পড়েছে, তারা আর মুক্ত হয় না। তোমরা যেখানে যাবে, ওরা সঙ্গী হয়ে যাবে।”

তৃষার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছিল। তার বুকের ভেতর ভয় জমে পাথর হয়ে গেছে। তবুও এক অদ্ভুত টান তাকে বেঁধে রেখেছে—যেন এই বন আর ছায়ারা তাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেছে।

ঋত্বিক দৃঢ় গলায় বলল, “তাহলে এবার আমি সবটা দেখব। আজ রাতেই শেষ সত্যটা ক্যামেরায় ধরব। যদি মরতেই হয়, তবে প্রমাণ রেখে মরব।”

হরিপদবাবু মাথা নাড়লেন। “তাহলে জহর মাঝির সঙ্গে কথা বলো। সে-ই তোমাদের শেষ পথ দেখাতে পারবে। কিন্তু মনে রেখো—ও পথ একবার ধরলে আর ফেরার উপায় নেই।”

সন্ধের আগে তারা আবার জহর মাঝির উঠোনে গেল। বৃদ্ধ তখন আগুন জ্বালিয়ে বসে আছে, হাতে মাটির হাঁড়ি। তাদের দেখে গম্ভীর গলায় বলল, “দেখছি তোমরা এখনও বেঁচে আছ। মানে ছায়ারা পুরোপুরি টেনে নেয়নি। কিন্তু সময় কম।”

ঋত্বিক সরাসরি বলল, “আমরা শেষ সত্য জানতে চাই। কেন তারা এখনও বেঁচে আছে? কেন আমাদের টেনে নিচ্ছে?”

জহর মাঝি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। “কারণ তাদের আত্মা অসমাপ্ত। তারা প্রতিশোধ চায়, মুক্তি চায়। যতক্ষণ না কেউ তাদের ইতিহাস তুলে ধরে, ততক্ষণ তারা ঘুরে বেড়াবে। তোমাদের ক্যামেরায় তাদের ধরা পড়েছে মানে তোমাদের উপর দায়িত্ব এসেছে।”

তৃষা অবাক চোখে তাকাল। “আমরা? আমরা কী করব?”

জহর মাঝির কণ্ঠে রহস্যময়তা। “তোমাদের বনের বুক পর্যন্ত যেতে হবে। যেখানে সবচেয়ে বেশি রক্ত ঝরেছিল, যেখানে সাহেবরা আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল। সেই মাটির নিচে আছে সত্য। কিন্তু মনে রেখো, সেই সত্য দেখতে গেলে তোমরা আর ফিরে নাও আসতে পারো।”

ঋত্বিক চুপ করে মাথা নাড়ল। তার চোখে তখন কোনও ভয় নেই, শুধু এক অদ্ভুত আলো। তৃষা জানল, এই যাত্রা থেকে ফেরার পথ নেই।

সন্ধে নামার আগেই ঋত্বিক আর তৃষা আবার শালবনের দিকে রওনা হলো। আকাশে হালকা কালো মেঘ জমেছে, যেন বনকেই ঢেকে রাখতে চাইছে। জহর মাঝি লাঠি হাতে তাদের সঙ্গে হাঁটছিলেন। তাঁর কণ্ঠে অদ্ভুত দৃঢ়তা—
“আজ তোমাদের যেখানে নিয়ে যাচ্ছি, সেখানে সাধারণ মানুষ কখনও যায় না। সাহেবদের রক্তক্ষেত্র সেটা। সেই মাটিই আজও বাঁচেনি।”

পথ যতই গভীরে যাচ্ছিল, বাতাস ততই ভারী হচ্ছিল। গাছের ফাঁক দিয়ে আসা আলো নিভে আসছে। তৃষার গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল, মনে হচ্ছিল কেউ যেন অদৃশ্যভাবে হাঁটছে তাদের পেছনে। ঋত্বিক বারবার ক্যামেরা তুলে ছবি তুলছিল, যদিও আলো এত কম যে ছবিগুলো অস্বচ্ছ।

হঠাৎ মাঝপথে জহর মাঝি থেমে গেলেন। আঙুল দিয়ে সামনে দেখালেন। সেখানে এক খোলা চত্বর—চারদিকে বিশাল শালগাছের ভিড়, মাঝখানে কালো মাটির দাগ। দূর থেকে মনে হলো যেন আগুনে পোড়া দাগ এখনও অটুট।
তিনি গম্ভীর গলায় বললেন, “এখানেই সাহেবরা আগুন লাগিয়েছিল। শত শত সাঁওতাল জীবন্ত জ্বলে গিয়েছিল। এই জায়গাটাই আজ অভিশপ্ত।”

ঋত্বিক ট্রাইপড বসাল। তৃষার হাত ঘামে ভিজে যাচ্ছিল। জহর মাঝি মাটিতে বসে মন্ত্রোচ্চারণের মতো কিছু বলতে শুরু করলেন। তার সঙ্গে সঙ্গে চারদিকের বাতাস ঠান্ডা হয়ে গেল। হঠাৎ মাটির ফাটল থেকে ধোঁয়া বেরোতে লাগল।

তারপর… ঢোলের শব্দ।
ধীর, তীব্র, একের পর এক আঘাত। চারদিক থেকে ভেসে এলো হাহাকার—পুরুষ, নারী, শিশুর চিৎকার যেন একসঙ্গে মিলেছে।

ঋত্বিক ক্যামেরা চালু রাখল। লেন্সের ভেতর ধীরে ধীরে গড়ে উঠল দৃশ্য—অসংখ্য ছায়া আগুনের শিখায় দৌড়চ্ছে। নারীরা শিশুদের বুকে জড়িয়ে ধরছে, পুরুষরা বর্শা উঁচিয়ে মৃত্যুর দিকে ছুটছে। তাদের শরীর আগুনে জ্বলছে, কিন্তু চোখে এখনও প্রতিশোধের ঝলক।

তৃষা ভয়ে চিৎকার করে উঠল। “ঋত্বিক, এটা আর ছবি নয়, ইতিহাসের পুনর্জন্ম!”
ঋত্বিক কাঁপা হাতে বলল, “হ্যাঁ… তারা আমাকে দেখাচ্ছে। যেন আমি তাদের গল্প লিপিবদ্ধ করি।”

হঠাৎ এক যোদ্ধার ছায়া এগিয়ে এল। হাতে ভাঙা তীর, চোখ দুটো রক্তজ্বলা। সে চিৎকার করে কিছু বলল—ভাষাটা বোঝা গেল না, তবে তার হাত ক্যামেরার দিকে ইশারা করল।
ঋত্বিক ফিসফিস করে অনুবাদ করল, যেন কানে ভেসে আসছে—“আমাদের মৃত্যু লিখে রাখো, যাতে আমরা অমর হই।”

জহর মাঝি দাঁড়িয়ে কাঁপা কণ্ঠে বললেন, “ওরা এখন তোমাদের সাক্ষী করেছে। তবে সাবধান—সাক্ষী মানেই মুক্তি নয়। যারা দেখেছে, তারা আর স্বাভাবিক থাকতে পারে না।”

ঠিক তখনই হাওয়া এত জোরে বয়ে গেল যে মশাল নিভে গেল। চারদিক অন্ধকারে ঢেকে গেল। শুধু শিখার ছায়াগুলো ভেসে উঠছিল। তৃষা হঠাৎ দেখল—তার পায়ের কাছে ছোট্ট এক শিশুর দগ্ধ দেহ পড়ে আছে, চোখদুটো সাদা, ঠোঁটে অদ্ভুত হাসি। সে কেঁপে উঠে ঋত্বিককে আঁকড়ে ধরল।

ঋত্বিকও এবার বুঝল, এই বন শুধু ইতিহাসের নয়—এ এক জীবন্ত সমাধিক্ষেত্র। প্রতিটি ছায়া, প্রতিটি আগুন এখনও শ্বাস নিচ্ছে। আর এখন তারা দু’জনের ভেতর ঢুকে পড়ছে।

দূরে বজ্রপাত হলো। সেই আলোয় কয়েক সেকেন্ডের জন্য দেখা গেল সম্পূর্ণ দৃশ্য—পুরো বন ছেয়ে গেছে হাজারো আত্মায়। তাদের চোখ শূন্য, কিন্তু চাহনি এমন ভয়ঙ্কর যে মানুষের বুক কেঁপে যায়।

জহর মাঝি কাঁপতে কাঁপতে বললেন, “আজ তোমরা যা দেখলে, কেউ বেঁচে ফিরে বলতে পারেনি। এবার থেকে তোমরাই তাদের ইতিহাসের বাহক।”

ঋত্বিক আর তৃষা কোনওমতে গ্রামে ফিরে এলো। শরীর নিস্তেজ, চোখ ফাঁকা। ল্যাপটপে ক্যামেরার ফুটেজ চালু করতেই আবার হিমশীতল বাতাস বইল। স্ক্রিনে স্পষ্ট দেখা গেল—অসংখ্য মুখ, যাদের চোখ ফাঁকা, ঠোঁটে রক্তমাখা হাসি। আর তাদের মধ্যে সবচেয়ে সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে আছে সেই সাদা চোখের শিশু।

তৃষা চোখ ঢেকে ফেলল। “এটা আমাদের ধ্বংস করে দেবে।”
ঋত্বিক ঠান্ডা গলায় উত্তর দিল, “না, এটা আমাদের অমর করে দেবে। আমরা ইতিহাসের সাক্ষী। আর তাদের ছায়া এখন আমাদের ভেতরেই বেঁচে থাকবে।”

গ্রামের সকালের বাতাস সাধারণত শান্ত থাকে—শিশুরা মাঠে খেলে, মহিলারা কুয়ো থেকে জল তোলে, পুরুষেরা খেতের পথে যায়। কিন্তু আজ বেলাতোরে এক অদ্ভুত নীরবতা। সবাই কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে আছে ঋত্বিক আর তৃষার দিকে। দু’জনেই উঠোনে বসে আছে, চোখ ফাঁকা, ঠোঁট শুকনো। যেন সারারাত ঘুম হয়নি, অথচ চোখে কোনও ক্লান্তি নেই—বরং অদ্ভুত এক শূন্যতা।

হরিপদবাবু ভোরে তাদের ঘরে ঢুকে চমকে উঠেছিলেন। টেবিলে রাখা ল্যাপটপে তখনও ফুটেজ চলছিল—আগুনে দগ্ধ যোদ্ধারা, নারী-শিশুর আর্তচিৎকার, ছায়ামূর্তিদের ফাঁকা দৃষ্টি। তিনি তাড়াতাড়ি স্ক্রিন বন্ধ করেছিলেন, কিন্তু ততক্ষণে ঋত্বিক ও তৃষার চোখে সেই দৃশ্য গেঁথে গেছে।

গ্রামের মানুষ ফিসফিস করছিল। “ওরা তো বন থেকে ফিরে এসেছে… কিন্তু মানুষ হয়ে ফিরেছে তো?”
কেউ আবার বলল, “ছায়ারা ওদের শরীরে ঢুকে গেছে।”

তৃষা দিনের বেলায়ও বারবার শুনতে পাচ্ছিল ঢোলের শব্দ। প্রথমে মনে হচ্ছিল কানে ভুল শুনছে, কিন্তু তারপর সে স্পষ্ট দেখল—ঘরের কোণে দাঁড়িয়ে আছে আগুনে দগ্ধ সেই শিশুটি। সাদা চোখে চেয়ে আছে, ঠোঁটে হাসি। তৃষা চিৎকার করে উঠল, কিন্তু হরিপদবাবু ছাড়া আর কেউ শুনল না। বাকিরা শুধু দেখল তৃষা নিজের চুল টেনে ছিঁড়ছে, যেন পাগল হয়ে গেছে।

ঋত্বিক অন্যরকম। তার চোখে আতঙ্ক নেই, বরং অদ্ভুত শান্তি। সে গ্রামবাসীদের বলল, “আমি ওদের ছবি তুলেছি। তোমাদের ইতিহাস আমি পৃথিবীকে দেখাব। ওরা আমার সঙ্গে আছে।”
তার গলায় ছিল না মানুষের কণ্ঠের উষ্ণতা, বরং শালবনের হাহাকারের ঠান্ডা প্রতিধ্বনি।

জহর মাঝি এসে দাঁড়ালেন। তাঁর চোখে গভীর দুঃখ। “আমি বলেছিলাম, ওরা একবার যার শরীরে ঢোকে, তাকে আর মুক্তি দেয় না। তোমরা এখন বনেরই অংশ।”

তৃষা কাঁদতে কাঁদতে বলল, “আমি আর পারছি না। ওরা আমার ভেতর ঢুকে যাচ্ছে। রাতে ঘুমোতে গেলেই আমি দেখি আমি আর আমি নই। আমার হাত দিয়ে ঢাক বাজছে, আমার গলায় আগুন লেগে যাচ্ছে। আমি মরে যাচ্ছি।”

ঋত্বিক শান্ত গলায় উত্তর দিল, “না, তুমি মরছ না। তুমি ইতিহাসের সঙ্গে মিশে যাচ্ছ।”
তৃষা শিউরে উঠল। সে জানল, ঋত্বিক আর আগের মানুষ নেই। ছায়ারা তাকে গ্রাস করেছে।

সেই রাতে গ্রাম অশান্ত হয়ে উঠল। কুকুরেরা একসঙ্গে হাউমাউ করে ডাকতে লাগল, মোরগ অদ্ভুত সময়ে ডাকল। মানুষজন দরজা-জানলা বন্ধ করে দিল। কিন্তু হরিপদবাবু দেখলেন, ঋত্বিক আর তৃষা নিঃশঙ্কভাবে বেরিয়ে যাচ্ছে বনের দিকে। হাতে ক্যামেরা, চোখে সেই ফাঁকা দৃষ্টি।

তিনি চিৎকার করে ডাকলেন, “যেও না! এ বার গেলে আর ফিরবে না।”
কিন্তু দু’জনেই থামল না।

শালবনের ভেতরে ঢুকতেই আবার শোনা গেল ঢোলের শব্দ। এবার শব্দটা আর দূরে নয়, একেবারে চারদিক ঘিরে ধরল। গাছের ফাঁক দিয়ে অসংখ্য ছায়া বেরিয়ে এলো। আগুনে পোড়া দেহ, ভাঙা অস্ত্র, আর্তনাদে ভরা মুখ।

তৃষা মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। চোখ দিয়ে জল গড়াচ্ছে, গলায় ভাঙা শব্দ—“আমাকে ছেড়ে দাও… আমি বাঁচতে চাই।”
এক নারী ছায়া তার ওপর ঝুঁকে পড়ল। চোখে শূন্যতা, বুকে দগ্ধ শিশুর মৃতদেহ। তৃষা হঠাৎ অনুভব করল, শিশুটার চিৎকার তার বুকের ভেতর প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।

ঋত্বিক ক্যামেরা তুলল। ফ্ল্যাশের আলোয় দেখা গেল, ছায়ারা তাকে ঘিরে দাঁড়িয়েছে। সে মৃদু হেসে বলল, “তোমরা এখন আমার। আমি তোমাদের ইতিহাস লিখে দেব।”
তখন মনে হচ্ছিল, আর সে একা মানুষ নয়, বরং মৃতদেরই একজন প্রতিনিধি।

গ্রামের দিকে ফিরে আসা সম্ভব হলো না আর। সেই রাতে বেলাতোরের মানুষ শালবনের দিক থেকে অদ্ভুত আলোর ঝলক দেখেছিল। ঢোল বাজছিল ভোর পর্যন্ত। আর ভোর হলে দেখা গেল—ঋত্বিক আর তৃষা কোথাও নেই। শুধু তাদের ক্যামেরা পড়ে আছে বনপথের মাঝখানে। লেন্সে শুকনো রক্তের দাগ।

ভোরের আলো যখন শালবনের মাথার উপর ছড়িয়ে পড়ল, তখনও গ্রামজুড়ে আতঙ্কের আবহ। কুকুরেরা অদ্ভুতভাবে চুপচাপ বসে ছিল, মোরগ ডাকেনি, আর মানুষজন গৃহের বাইরে বেরোতে সাহস পাচ্ছিল না। কেবল হরিপদবাবুই সাহস করে বনের প্রান্তে গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি খুঁজে পেলেন—ঋত্বিকের ক্যামেরা, রক্তমাখা লেন্স, আর মাটিতে টেনে নেওয়া পায়ের ছাপ।

তিনি ক্যামেরাটা গ্রামে নিয়ে এলেন। মানুষজন চারপাশে জড়ো হলো, যেন সবাই জানে ভেতরে কী আছে, তবুও দেখতে চাইছে। ল্যাপটপে মেমরি কার্ড ঢোকাতেই স্ক্রিনে ভেসে উঠল সেই ভয়ঙ্কর ফুটেজ।

প্রথমে দেখা গেল—ঋত্বিক ট্রাইপড বসাচ্ছে, তৃষা আতঙ্কে কাঁপছে। তারপর ফ্ল্যাশের ঝলক, আর অসংখ্য ছায়ামূর্তি ঘিরে ধরছে তাদের। আগুনে পোড়া মুখ, ফাঁকা চোখ, বুকফাটা হাহাকার। স্ক্রিনে তৃষার চিৎকার ধরা পড়েছে—“আমাকে ছেড়ে দাও!” তারপর দৃশ্য কেঁপে উঠল।

পরের অংশে দেখা গেল কিছু অদ্ভুত। ক্যামেরা নিজে থেকেই চলতে শুরু করল। তাতে ধরা পড়ল ঋত্বিক আর তৃষা আর মানুষ নেই—তাদের মুখ ফাঁকা, চোখে সাদা দৃষ্টি, ঠোঁটে নিস্তেজ হাসি। তারা দু’জন ছায়াদের ভিড়ে মিশে গেল। শেষ ফ্রেমে কেবল দেখা গেল ঋত্বিকের হাত বাড়ানো, যেন ক্যামেরার বাইরের দর্শকের দিকেই ডাকছে—
এসো, ইতিহাস লিখে যাও।”

গ্রামের মহিলারা বুক চাপড়ে কাঁদতে লাগল। পুরুষেরা মুখ ঢেকে ফেলল। সবাই জানল—ঋত্বিক আর তৃষা বেঁচে নেই, তারা শালবনের ছায়ার অংশ হয়ে গেছে।

কিন্তু এখানেই শেষ নয়। সেই ফুটেজের খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল। শহর থেকে কিছু মানুষ এল, গবেষক, সাংবাদিক। তারা গ্রামে এসে ল্যাপটপের স্ক্রিনে ফুটেজ দেখল। কারও চোখে বিস্ময়, কারও চোখে ভয়। একজন বলল, “এ ভিডিও প্রমাণ করে অতিপ্রাকৃত সত্যিই আছে।” আরেকজন ফিসফিস করে বলল, “না, এটা ইতিহাসের অভিশাপ।”

রাতে গবেষক দলের কয়েকজন সাহস করে বনের ভেতরে গেল। পরদিন সকালে তারা আর ফিরল না। শুধু তাদের সরঞ্জাম পাওয়া গেল বনপথে, আর ক্যামেরায় ধরা পড়ল নতুন মুখ—যেন শালবনের ছায়াদের ভিড় আরও বড় হয়েছে।

হরিপদবাবু এক গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। “আমি জানতাম, ওরা ছড়িয়ে পড়বে। বন তো আর গোপন থাকে না। একবার যদি কেউ দেখে, তবে সে-ই হয়ে যায় গল্পের বাহক।”

গ্রামের মানুষ তখন সিদ্ধান্ত নিল—কেউ আর ফুটেজ ছোঁবে না, ক্যামেরা মাটির নিচে পুঁতে রাখা হবে। কিন্তু রাতে অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটতে শুরু করল। ঘরের ভেতর ভেসে আসছিল ঢোলের শব্দ, শিশুর কান্না, আর হাহাকার। কেউ জানত, এটা ক্যামেরা থেকে আসছে, নাকি ছায়ারা এখন গ্রামেই ঘুরে বেড়াচ্ছে।

তৃষার এক আত্মীয়, যিনি দূরে থাকতেন, হঠাৎ এক রাতে স্বপ্ন দেখলেন—তৃষা এসে বলছে, “আমি এখানে আছি, কিন্তু মুক্তি চাই।” ভোরে তিনি বেলাতোরে ছুটে এলেন। এসে দেখলেন, গ্রামের পথ ফাঁকা, কিন্তু বাতাসে প্রতিটি পায়ের শব্দ প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।

ঋত্বিকের কণ্ঠও মাঝে মাঝে শোনা যাচ্ছিল—
আমি ছবি তুলেছি। এখন তোমরাই গল্প শেষ করবে।”

বেলাতোরের মানুষের বিশ্বাস ছিল, এই ছায়ারা একদিন পুরোপুরি গ্রাস করবে গ্রামটিকে। কেউ বলল, “হয়তো এভাবে ইতিহাস অমর হয়।” আবার কেউ কাঁপতে কাঁপতে বলল, “না, এভাবে অমর হওয়া মানেই মৃত্যুর পুনর্জন্ম।”

হরিপদবাবু জানতেন, শালবনের ছায়া কেবল বনেই সীমাবদ্ধ নেই। যেদিন থেকে ঋত্বিক আর তৃষা নিখোঁজ হয়েছে, সেদিন থেকেই তারা হয়ে গেছে কিংবদন্তির অঙ্গ। তাদের গল্প ছড়িয়ে পড়ছে মানুষ থেকে মানুষে, আর প্রতিটি গল্পের ভেতর ঢুকে যাচ্ছে সেই ছায়ারা।

গ্রামের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে তিনি ফিসফিস করে বললেন,
“বেলাতোরে কেউ বাঁচে না, সবাই ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে যায়।”

ফুটেজটা বেলাতোর গ্রাম ছেড়ে পৌঁছে গেল কলকাতায়। প্রথমে এক সাংবাদিকের হাতে এলো—রুদ্রনীল, যিনি গ্রাম ঘুরে রিপোর্ট করতে গিয়েছিলেন। তিনি ক্যামেরার মেমরি কার্ড নিয়ে ফিরলেন শহরে। রাতের বেলা নিজের অফিসে বসে ল্যাপটপে ফুটেজ চালালেন।

স্ক্রিনে ভেসে উঠল সেই আগুনে দগ্ধ ছায়ারা, ঢোলের শব্দে কেঁপে উঠল ঘর। প্রথমে রুদ্রনীল ভেবেছিলেন এ এক দুর্দান্ত স্টোরি, যা পত্রিকায় ছাপলে হৈচৈ পড়ে যাবে। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি বুঝলেন, ফুটেজটা কেবল চলছেই। যতবার বন্ধ করার চেষ্টা করছিলেন, আবার নিজে থেকে চালু হয়ে যাচ্ছিল। শেষ ফ্রেমে ঋত্বিকের ফাঁকা চোখে তাকানো মুখ ধরা পড়ল—
এসো, ইতিহাস লিখে যাও।”

রুদ্রনীল ভয়ে ল্যাপটপ বন্ধ করে দিলেন। কিন্তু রাতে বাড়ি ফেরার পর দেখলেন, ঘরের দেয়ালে হঠাৎই ছায়া নড়ছে। ঢোলের শব্দ আসছে কানে, অথচ চারপাশ নিস্তব্ধ। তিনি চিৎকার করে উঠলেন, কিন্তু কেউ শুনল না।

পরদিন খবরের কাগজে প্রকাশ হলো তাঁর লেখা এক ছোট্ট টুকরো—“পুরুলিয়ার শালবনের রহস্যময় ছায়া।” ছবি ছাপা হয়নি, কিন্তু লেখার মধ্যে ভয়ের দাগ স্পষ্ট। পাঠকের কৌতূহল বাড়ল। অনেকেই ভিডিওটা দেখতে চাইতে লাগল।

অল্প দিনের মধ্যেই ফুটেজ নকল হতে শুরু করল। ইউএসবি ড্রাইভে, ফোনে, সোশ্যাল মিডিয়ায়। কিন্তু যারাই সেটা চালাত, তাদের ঘরে ঢুকে পড়ত সেই ছায়ারা। কারও চোখ ফাঁকা হয়ে যেত, কেউ আবার পাগলের মতো ঢাক বাজাতে শুরু করত। হাসপাতালগুলোতে ভর্তি হতে লাগল অদ্ভুত মানসিক রোগে আক্রান্ত মানুষ।

কলকাতার কলেজ স্ট্রিটে এক বিকেলে কয়েকজন ছাত্র মিলে ফুটেজ চালাল। প্রথমে তারা হাসাহাসি করছিল। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই সবাই স্তব্ধ। স্ক্রিনে দেখা গেল, ভিডিওর ভিড়ের মধ্যে এখন নতুন মুখ—ঋত্বিক আর তৃষা নয়, বরং সেই ছাত্ররাই দাঁড়িয়ে আছে ছায়াদের পাশে। অন্যরা আতঙ্কে ল্যাপটপ বন্ধ করল, কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে। রাতে তাদের দু’জনের দেহ পাওয়া গেল হোস্টেলের ছাদে, চোখ ফাঁকা, ঠোঁটে রক্তমাখা হাসি।

গোটা শহরে গুজব ছড়িয়ে পড়ল। মানুষ বলল, “শালবনের ছায়ারা এখন কলকাতায় এসেছে।” কেউ আবার বিশ্বাস করল না, কিন্তু যাদের ঘরে ভিডিও চালানো হয়েছে, তারা বুঝল সত্যিই কিছু অদৃশ্য শক্তি ছড়িয়ে পড়ছে।

হরিপদবাবুর কাছে খবর এলো। তিনি কাঁপা কণ্ঠে বললেন, “আমি জানতাম, একদিন এটা হবে। বন কখনও সীমাবদ্ধ থাকে না। গল্প যখন ছড়ায়, তখন ছায়াও ছড়িয়ে পড়ে।”

রাত বাড়তে থাকল কলকাতায়। নানা পাড়ায় শোনা গেল অদ্ভুত ঢোলের শব্দ, জানালার কাচে ভেসে উঠল অস্পষ্ট ছায়া। কারও কারও স্বপ্নে এসে দাঁড়াল তৃষা—সাদা চোখে তাকিয়ে বলছে, “আমাকে মুক্তি দাও।” আবার কেউ দেখল ঋত্বিককে, ক্যামেরা হাতে, ডেকে বলছে, “তুমি পরের সাক্ষী।”

সেই সময় শহরের একদল গবেষক উদ্যোগ নিল। তারা বলল, “ভিডিও যদি সত্যিই অভিশপ্ত হয়, তবে সেটাকে ধ্বংস করতে হবে।” তারা একত্র হয়ে ফুটেজ নষ্ট করার চেষ্টা করল। কিন্তু প্রতিবারই মেমরি কার্ড পোড়ানোর আগেই মাটিতে পড়ে অদ্ভুতভাবে ঠান্ডা হয়ে যেত। আর রাতেই তাদের বাড়িতে আগুন লাগত—যেন শালবনের মৃতরা প্রতিশোধ নিচ্ছে।

শহরের মানুষ ধীরে ধীরে আতঙ্কিত হয়ে পড়ল। অনেক পরিবার বাড়ি ছেড়ে চলে গেল, কারও চোখের নিচে ঘুমের দাগ, কারও গলায় অজানা আতঙ্ক। সংবাদপত্রে লেখা হলো—“পুরুলিয়ার অভিশাপ কলকাতাকে গ্রাস করছে।”

কিন্তু সত্যিটা কেউ জানত না। ঋত্বিক আর তৃষা বেঁচে নেই, অথচ তাদের ছায়া বেঁচে আছে ভিডিওর ভেতরে। প্রতিটি নতুন দর্শক মানেই নতুন শিকার, নতুন বাহক।

সেই রাতে কলকাতার মাঝখানে, এক বহুতলের ছাদে কয়েকজন তরুণ-তরুণী একসঙ্গে ফুটেজ চালাল। স্ক্রিনে হঠাৎ ঋত্বিক এগিয়ে এসে তাকাল তাদের দিকে। তারপর ক্যামেরার ভেতর থেকে হাত বাড়িয়ে দিল—
তোমরাই এবার ইতিহাস লিখবে।”

এবং তারা জানল, মুক্তি আর নেই।

কলকাতার রাতগুলো ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছিল। পুরোনো শহরের অলিগলিতে শোনা যাচ্ছিল অদ্ভুত ঢোলের শব্দ, যেন দূরের পুরুলিয়ার বন থেকে ভেসে আসছে। মানুষ প্রথমে ভেবেছিল গুজব, কিন্তু ক্রমে তা বাস্তবে পরিণত হলো।

শহরের বিভিন্ন জায়গায় লোকজন দাবি করতে লাগল—তারা ছায়ামূর্তিদের দেখেছে। কোথাও লিফটের ভেতরে এক মুহূর্তের জন্য ভেসে উঠছে আগুনে দগ্ধ মুখ, কোথাও আবার রাতের বাসে জানলার কাচে প্রতিফলিত হচ্ছে শূন্য চোখ। এক সাংবাদিক অফিসে ল্যাপটপ খুলে ফুটেজ চালাতেই দেখা গেল, ভিডিওর ভিড়ের মধ্যে এখন তার নিজের মুখও যোগ হয়েছে—অর্ধেক দৃশ্যমান, ফাঁকা দৃষ্টি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

হাসপাতালগুলো ভর্তি হচ্ছিল পাগলপ্রায় মানুষে। কেউ ঢোল বাজাতে শুরু করছে বদ্ধঘরে, কেউবা বারবার আগুনে পোড়ার অনুভূতি পাচ্ছে। চিকিৎসকরা কিছুই বুঝতে পারছিলেন না। শহরের সংবাদপত্রে শিরোনাম হলো—
পুরুলিয়ার শালবন: ইতিহাস নাকি অভিশাপ?”

এদিকে বেলাতোর গ্রাম যেন আরও নিস্তব্ধ হয়ে পড়েছিল। হরিপদবাবু জানতেন, শালবনের আত্মারা এবার শহর ছাড়িয়ে আরও দূরে যাবে। তিনি বারবার মানুষকে সতর্ক করছিলেন, “ফুটেজ দেখো না, ছায়ারা ডাকছে।” কিন্তু লোভ আর কৌতূহল মানুষকে আটকাতে পারছিল না। যত বেশি মানুষ ভিডিও দেখতে লাগল, তত দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে লাগল অভিশাপ।

রাতের কলকাতার এক বহুতলের ছাদে একদল তরুণী দাঁড়িয়ে ছিল। তারা মোবাইলে সেই ভিডিও চালিয়েছিল। প্রথমে তারা হেসে উঠল, কিন্তু পরের মুহূর্তেই নিস্তব্ধ। স্ক্রিনে ঋত্বিক আর তৃষা এগিয়ে এল। তাদের চোখ সম্পূর্ণ সাদা, ঠোঁটে রক্তমাখা হাসি। তারা হাত বাড়িয়ে দিল, আর মোবাইল স্ক্রিন ভেঙে যেন অদৃশ্য ছায়া ছাদে ছড়িয়ে পড়ল। পরদিন সকালে পাওয়া গেল সেই তরুণীদের নিথর দেহ—চোখ ফাঁকা, ঠোঁটে নিস্তেজ হাসি।

এই ঘটনাগুলো ছড়িয়ে পড়তেই শহরে ভয়ঙ্কর অস্থিরতা তৈরি হলো। অনেকে শহর ছাড়ল, কেউ আবার ধর্মীয় আচার শুরু করল, কেউ আবার সরকারি নিষেধাজ্ঞার দাবি করল। কিন্তু অভিশাপ থামল না।

অবশেষে এক রাতে, কলকাতার আকাশে বজ্রপাত হলো। তখনই শহরের একাধিক জায়গায় একসঙ্গে দেখা গেল আগুনের মতো লাল আভা। লালবাজার থেকে গড়িয়াহাট, শিয়ালদহ থেকে শ্যামবাজার—সব জায়গার মানুষ শপথ করল, তারা শুনেছে ঢোলের শব্দ, যেন হাজার মৃত একসঙ্গে বাজাচ্ছে। আর আকাশের দিকে তাকাতেই দেখা গেল—অগণিত ছায়া, জ্বলন্ত দেহ, ফাঁকা চোখে ভেসে বেড়াচ্ছে।

সেই রাতে শহর থমকে গেল। বিদ্যুৎ চলে গেল বহু জায়গায়, মোবাইল নেটওয়ার্ক বন্ধ হয়ে গেল। কিন্তু ঢোলের শব্দ থামল না। মানুষের স্বপ্ন আর বাস্তব মিশে গেল একসঙ্গে। কেউ দেখল ঋত্বিক তার ঘরে দাঁড়িয়ে, ক্যামেরা হাতে, ঠান্ডা গলায় বলছে—
তুমি পরের সাক্ষী।”

তৃষার কণ্ঠও ভেসে এলো—
আমাকে মুক্তি দাও, নইলে তুমিও ছায়া হয়ে যাবে।”

কেউ মুক্তি পেল না। একবার যে চোখ ছায়ার সঙ্গে মিলল, সে আর ফিরে এল না।

শেষ পর্যন্ত সরকারি নির্দেশে ভিডিও নিষিদ্ধ করা হলো। সমস্ত কপি ধ্বংসের চেষ্টা চলল, কিন্তু কেউ বুঝতে পারল না, অভিশাপ ভিডিওতেই সীমাবদ্ধ নয়। মানুষ যত গল্প বলছে, যত আলোচনা করছে, ছায়ারা তত ছড়িয়ে পড়ছে।

বেলাতোর গ্রামের জহর মাঝি একদিন শেষবারের মতো শালবনের ভেতরে ঢুকলেন। বৃদ্ধের কণ্ঠে ছিল নিস্তেজ শান্তি। তিনি গাছের নীচে বসে বললেন, “তোমরা অমর হয়েছো। এবার আমাকেও নিয়ে যাও।”
পরদিন আর তাঁকে কেউ খুঁজে পেল না। শুধু শালবনের ভেতর থেকে ভেসে এলো আরও জোরে ঢোলের শব্দ।

কলকাতার আকাশে আজও কখনও কখনও ভেসে ওঠে সেই অদ্ভুত শব্দ, সেই শূন্য দৃষ্টি। আর মানুষ জানে, ইতিহাসের ছায়া মরে যায় না—
তারা বেঁচে থাকে, নতুন বাহক খুঁজে খুঁজে।

সমাপ্ত

WhatsApp-Image-2025-09-10-at-9.24.24-AM.jpeg

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *