Bangla - প্রেমের গল্প

আকাশের নিচে তুমি

Spread the love

সুচেতা মিত্র


অধ্যায় ১ – আগমন

শহরের কোলাহল, ধোঁয়া আর ব্যস্ত রাস্তাগুলো পেরিয়ে যখন বাসটা পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথে উঠতে শুরু করল, তিতলির বুক ভরে উঠল এক অদ্ভুত অনুভূতিতে। জানালার কাচে ঠেস দিয়ে বসা সে এতদিন যেভাবে উঁচু দালান আর গাড়ির ভিড়ের মধ্যে ডুবে থেকেছে, সেভাবে যেন এই প্রকৃতির রঙে নিজেকে কখনও মেলাতে পারেনি। পাহাড়ের গা বেয়ে উঠে আসা কুয়াশা, মাঝেমধ্যেই চোখে পড়া ছোট ছোট টিনের চালওয়ালা ঘর, আর দূরে ভেসে আসা ঝর্ণার শব্দ তাকে এক অচেনা নেশায় ভরিয়ে তুলছিল। তার মনে হচ্ছিল, যেন প্রতিটি বাঁক ঘুরতেই নতুন কোনো পৃথিবী অপেক্ষা করছে, যেখানে নেই শহরের চাপা অস্থিরতা, নেই অফিসে বসে কাটানো অবসাদময় দিন, নেই অনন্ত ব্যস্ততার শিকল। সে শহরে সবসময় চারপাশে মানুষ পেয়েছে, তবু ভিতরে এক অদ্ভুত শূন্যতা ঘিরে থাকত; কিন্তু এই পাহাড়ের পথে আসার সময় প্রথমবারের মতো সে অনুভব করল, একা হয়েও তার মন পূর্ণ হয়ে যাচ্ছে, শুধু সবুজের স্রোত আর নীল আকাশের বিস্তারে। যেন দীর্ঘদিন বন্দি থাকার পর এক মুক্ত শ্বাস নিতে পারল।

বাস থেকে নেমেই তিতলি তাকিয়ে রইল চারপাশে। হাওয়ায় কেমন এক অন্যরকম গন্ধ—তাজা, ঠান্ডা, ভিজে মাটির গন্ধ মিশে আছে পাহাড়ি ফুলের ঘ্রাণে। গ্রামটা ছোট, গুটিকতক দোকান, কয়েকটা বাঁশের ঘর, আর দূরে দাঁড়িয়ে থাকা মহীরুহ গাছের সারি। এখানে শব্দ বলতে শুধু পাখির ডাক, দূর থেকে ভেসে আসা কোনো ঢোলের আওয়াজ, কিংবা নদীর কলকল স্রোত। তার মনে হলো, শহরের প্রতিটি রাস্তায় সে যতটা হাঁটেছে, তার থেকে বেশি খুঁজে পাবে এখানে প্রতিটি নিঃশ্বাসে। সে লাগেজটা নামিয়ে দাঁড়িয়ে রইল, একটু দ্বিধা, একটু বিস্ময় নিয়ে। ছোটবেলায় গল্পের বইতে যে পাহাড়ি গ্রামের ছবি সে কল্পনা করত, বাস্তবে তা যেন আরও জীবন্ত, আরও আপন। গ্রামের শিশুরা দূর থেকে তাকে কৌতূহলী চোখে দেখছে, আর সে তাদের হাসিমুখে নিজের অজান্তেই হেসে উঠল। তিতলি বুঝতে পারল, এই জায়গা তাকে ডাকছে—শুধু বেড়াতে আসা কোনো পর্যটক হিসেবে নয়, বরং নিজের অন্তর্গত কিছু খুঁজে পাওয়ার জন্য।

সন্ধ্যার দিকে যখন সূর্য পাহাড়ের চূড়ার পেছনে হারিয়ে গেল, আকাশ রঙিন হয়ে উঠল কমলা আর বেগুনি আভায়। তিতলি দাঁড়িয়ে রইল এক টিলা থেকে নিচের দৃশ্য দেখতে—ঝর্ণার ধারা যেন রুপালি সুতার মতো গড়িয়ে পড়ছে, নদী বয়ে চলেছে নীলচে রেখার মতো, আর তার ওপরে পাখির ঝাঁক ফিরে যাচ্ছে বাসায়। এই নীরব অথচ জীবন্ত দৃশ্য তার ভেতরে এক গভীর প্রশান্তি ছড়িয়ে দিল। সে মনে মনে ভাবল, শহরে থেকে হয়তো সে কখনও এই শান্তিকে ছুঁতে পারত না, কখনও জানতে পারত না নিজের অন্তরের আরেকটা দিক আছে, যা কেবল প্রকৃতির সঙ্গে মিশেই জেগে ওঠে। অচেনা এই পাহাড়ি গ্রাম, এর নীরব আকাশ আর ভেজা মাটির গন্ধ যেন তাকে নতুন করে জন্ম দিচ্ছে। তার বুকের ভেতর জেগে উঠল একরাশ কৌতূহল—এই যাত্রা তাকে কোথায় নিয়ে যাবে, কী নতুন সম্পর্ক, কী অচেনা অনুভূতি অপেক্ষা করছে সামনে? পাহাড়ি হাওয়ায় দাঁড়িয়ে সে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল, এবার সত্যিই সে শহরের শৃঙ্খল ভেঙে নিজের মতো করে বাঁচতে শিখবে, এই অচেনা গ্রামকেই করে তুলবে নিজের খোঁজের শুরু।

অধ্যায় ২ – গাইড ছেলেটি

পরদিন ভোরে পাহাড়ি গ্রামের বাতাস যেন আরও নির্মল হয়ে উঠল। পাখির কলতান আর দূর থেকে ভেসে আসা নদীর শব্দে ঘুম ভাঙল তিতলির। জানালার বাইরে তাকিয়ে সে দেখল কুয়াশায় ঢাকা পাহাড়, যেন সাদা চাদরে মোড়া সবুজের বিশালতা। সকালের নাশতার পর সে বের হলো গ্রামের ভেতরে হাঁটতে। কিন্তু নতুন জায়গা, অপরিচিত পথ—একটু দ্বিধা তাকে আচ্ছন্ন করছিল। তখনই হঠাৎ সামনে এসে দাঁড়াল এক তরুণ, বয়সে তার কাছাকাছি, গায়ের রঙে স্বাস্থ্যকর উজ্জ্বলতা, চোখে একরাশ হাসি। ছেলেটির পরনে সাদামাটা শার্ট আর প্যান্ট, কাঁধে একটা ঝোলা ব্যাগ। সে ভাঙা বাংলায় বলল, “আপনি কি বাইরে থেকে এসেছেন? আমি অরণ্য, এখানে পর্যটকদের জন্য গাইডের কাজ করি।” তিতলি প্রথমে একটু অবাক হলেও ছেলেটির চোখের আন্তরিকতা আর কণ্ঠের সহজ সরল ভঙ্গিতে তার মন হালকা হয়ে গেল। মনে হলো, এই পাহাড়ি গ্রামে অপরিচিত হলেও সে একা নয়। অরণ্যর মুখে সেই স্বচ্ছ হাসি যেন ভোরের আলোকে আরও উজ্জ্বল করে তুলল।

অরণ্য তাকে গ্রামের চারপাশের জায়গাগুলো ঘুরে দেখানোর প্রস্তাব দিল। তিতলি প্রথমে দ্বিধায় থাকলেও, ছেলেটির প্রাণখোলা কথাবার্তা তাকে ধীরে ধীরে স্বস্তি দিল। তারা দুজনে হাঁটতে হাঁটতে গ্রামের ধানক্ষেত, বাঁশবাগান আর ছোট্ট নদীর ধারে পৌঁছাল। অরণ্য হাঁটার পথে গল্প করতে করতে জানাল কিভাবে ছোটবেলা থেকে সে এই গ্রামে বড় হয়েছে, কিভাবে প্রতিটি পাহাড়ি পথ আর গোপন ঝর্ণার সাথে তার বন্ধুত্ব। সে নদীর ধারে দাঁড়িয়ে এক চিলতে মাটির ঢিবির দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, “ওখানে একসময় আমার দাদু মাছ ধরতে যেতেন, আমি ছোটবেলায় ওঁর সঙ্গে গিয়েছি।” তার চোখে স্মৃতির আলো জ্বলে উঠল, আর তিতলি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। শহরে কখনও এমন নির্ভেজাল গল্প শোনেনি সে, যেখানে প্রতিটি শব্দে জড়িয়ে আছে প্রকৃতি আর পরিবারের গভীর বন্ধন। অরণ্যের কথায় তিতলি প্রথমবার উপলব্ধি করল, মানুষ আর প্রকৃতির সম্পর্ক কতখানি ঘনিষ্ঠ হতে পারে। অরণ্যের সরলতা, তার নিজের শেকড়ে গর্ববোধ করা মনোভাব তিতলিকে এক অদ্ভুত টানে ভাসিয়ে নিয়ে চলল।

বিকেলের দিকে যখন তারা পাহাড়ি পথ ধরে ফিরে আসছিল, তখন সূর্য নেমে যাচ্ছিল পশ্চিম আকাশে। আলো ছড়িয়ে পড়ছিল সোনালি রঙে, পাহাড়গুলো যেন আগুনের আভায় জ্বলে উঠেছিল। তিতলি থেমে দাঁড়িয়ে দৃশ্যটা দেখছিল, আর অরণ্য পাশে দাঁড়িয়ে বলল, “আপনি জানেন, পাহাড়ের প্রতিটি দিন আলাদা রঙে রঙিন হয়। কখনও সোনালি, কখনও নীলচে, আবার কখনও রূপালি। প্রতিটি দিন যেন নতুন ক্যানভাস।” তিতলির মনে হলো, এই কথাগুলো শুধু প্রকৃতির বর্ণনা নয়, বরং জীবনেরও এক গভীর শিক্ষা। শহরে সে যেটুকু সময় কেটেছে, প্রতিটি দিন তার কাছে একইরকম মনে হতো—ব্যস্ত, ক্লান্তিকর, একঘেয়ে। অথচ এখানে প্রতিটি দিন আলাদা রঙে ভরে উঠছে। অরণ্যর চোখে সেই রঙের মায়া প্রতিফলিত হচ্ছিল। তিতলি অজান্তেই তার মুখের দিকে তাকাল, আর মনে হলো এই ছেলেটির মধ্যে লুকিয়ে আছে পাহাড়ের সত্যিকারের প্রাণ। প্রথম দিনের এই পরিচয়, কিছু কথোপকথন আর একসঙ্গে কাটানো সময় যেন অদ্ভুতভাবে তার মনে এক নতুন সুরের জন্ম দিল, যা হয়তো এই পাহাড়ের হাওয়ার মতোই নিঃশব্দে তাকে ভেতর থেকে বদলে দিচ্ছে।

অধ্যায় ৩ – পাহাড়ের পথচলা

পরদিন সকালে তিতলি যখন বেরোল, আকাশে তখনও কুয়াশার চাদর ঝুলে আছে। গ্রামের সরু মাটির পথ ধরে অরণ্য এগিয়ে চলেছে আর তিতলি তার পিছু পিছু। হাওয়ার সঙ্গে ভেসে আসছে অপরিচিত গন্ধ—ভেজা মাটির, শ্যাওলার, আর অচেনা ফুলের মিষ্টি সুবাস। অরণ্য একদিকে হাঁটছে, অন্যদিকে কথা বলতে বলতে প্রতিটি বাঁক, প্রতিটি গাছের ইতিহাস শোনাচ্ছে। “এই পথটা,” সে বলল একটা মোড় দেখিয়ে, “আমাদের দাদুরা কাঠ বহন করত এই রাস্তা দিয়ে। শীতকালে বরফ জমে গেলে আমরা এখানে খেলতাম।” তার কণ্ঠে মিশে ছিল গর্ব আর ভালোবাসা। তিতলি অবাক হয়ে লক্ষ্য করল, অরণ্যের কাছে পাহাড় কেবল প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নয়, বরং বেঁচে থাকার এক অঙ্গ, এক ইতিহাস। শহরে সে পাহাড়কে কেবল ছবি বা ভ্রমণের জায়গা হিসেবে চিনত, অথচ এখানে এসে বুঝতে পারল, পাহাড়ের প্রতিটি গাছ, প্রতিটি পাথরের ফাঁকই মানুষের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। হাঁটতে হাঁটতে তারা এক ঝরনার ধারে এসে থামল। জলের শব্দ এত কাছে থেকে শুনে তিতলির মনে হলো, যেন সে একদম নতুন কোনো সুর শুনছে। অরণ্য জলে হাত ডুবিয়ে বলল, “এই ঝর্ণার পানি গ্রামকে বাঁচিয়ে রাখে। গরমকালে সবাই এখানে আসে, আর অনেকে বিশ্বাস করে এই পানিতে শরীরের সব ক্লান্তি চলে যায়।” তিতলি কিছু না বলে শুধু সেই ঝরনার দিকে তাকিয়ে থাকল—তার ভেতরে এক অদ্ভুত প্রশান্তি জন্ম নিচ্ছিল।

পথ যত গভীরে এগোতে লাগল, তিতলি তত বুঝতে লাগল শহরের কোলাহল থেকে মুক্ত হয়ে এখানে হাঁটতে হাঁটতে কতটা হালকা লাগছে তাকে। অরণ্য মাঝে মাঝেই থেমে তাকে দেখাত কোনো বুনো ফুল, কোনো লুকোনো গুহা, কিংবা পাথরের ফাঁকে জন্ম নেওয়া শ্যাওলা। প্রতিটি জিনিস সে এমনভাবে বর্ণনা করত যেন সেগুলো জীবন্ত চরিত্র, তাদেরও গল্প আছে। “দেখুন,” সে বলল একটা লাল ফুল দেখিয়ে, “এই ফুলটা কেবল বর্ষাকালে ফোটে। আমার মা বলতেন, যখন এই ফুল ফোটে তখন বুঝতে হবে বৃষ্টি এসে গেছে। যেন প্রকৃতির নিজস্ব ক্যালেন্ডার।” তিতলি হাসল, তার মনে হলো শহরে যত কৃত্রিম ক্যালেন্ডার আর ঘড়ি আছে, তবু মানুষ প্রকৃতির এ ধরনের সঙ্কেত হারিয়ে ফেলেছে। হাঁটতে হাঁটতে তাদের মধ্যে নীরবতাও তৈরি হচ্ছিল, কিন্তু সেই নীরবতায় কোনো অস্বস্তি ছিল না, বরং অদ্ভুত এক আরাম। তারা মাঝে মাঝে শুধু চোখে চোখ রেখে হাসত, আর তাতেই যেন সব কথা বলা হয়ে যেত। পাহাড়ি বাতাসে ভেসে আসা পাখির ডাক, পাতার ফাঁকে আলো খেলা করা সূর্যের রোদ তাদের সঙ্গ দিচ্ছিল। তিতলির মনে হচ্ছিল, সে যেন ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছে—যে মানুষটা শহরে সবসময় ব্যস্ততায় হারিয়ে যেত, এখন সেই মানুষটাই পাহাড়ের নিঃশব্দ সৌন্দর্যে নতুন করে বাঁচতে শিখছে।

দুপুর নাগাদ তারা একটা উঁচু টিলায় উঠল, সেখান থেকে চারপাশের দৃশ্য চোখে ধরা দিল। দূরে নীলচে পাহাড়ের সারি, নিচে সবুজ বনভূমি, আর মাঝখানে রুপালি ফিতের মতো বয়ে চলা নদী। তিতলি দাঁড়িয়ে বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল, আর অরণ্য বলল, “এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে মনে হয় পৃথিবী থেমে গেছে। শহরের মতো তাড়া নেই, শব্দ নেই। শুধু আকাশ আর পাহাড়।” তিতলি মৃদু স্বরে উত্তর দিল, “সত্যিই তাই… যেন সময়ও এখানে থেমে গেছে।” সেই মুহূর্তে দুজনের চোখ মিলল, আর তাতে এমন এক অনুভূতি জন্ম নিল যা ভাষায় বোঝানো যায় না। হয়তো এটাই সেই অদ্ভুত টান, যা তিতলি প্রথমবার অনুভব করল অরণ্যের পাশে থেকে। এই পাহাড়ি পথচলা শুধু ভ্রমণ নয়, বরং যেন এক অন্তর্গত যাত্রা, যেখানে দুজনের ভেতরের নিঃসঙ্গতা মিলেমিশে নতুন এক সুর তৈরি করছে। তিতলির মনে হলো, এই পাহাড় তাকে কেবল দৃশ্য উপহার দিচ্ছে না, বরং এমন এক সম্পর্কের বীজ বপন করছে যা ধীরে ধীরে আকাশের মতো বিস্তৃত হয়ে উঠবে।

অধ্যায় ৪ – নদীর ধারে কথোপকথন

সন্ধ্যার দিকে অরণ্য তিতলিকে নিয়ে গেল নদীর ধারে। গ্রামের এক সরু বাঁশের সেতু পেরিয়ে দুজন পৌঁছাল সবুজ ঘাসে ঢাকা নদীর তীরে। সূর্য তখন পশ্চিম আকাশে ঝুলছে, তার লালচে আভা জলের উপর পড়ে সোনালি ঝিলিক তৈরি করছে। নদীর স্রোত ধীরে ধীরে বয়ে যাচ্ছে, মাঝে মাঝে মাছ লাফিয়ে উঠছে, আর পাখির ঝাঁক উড়ে যাচ্ছে দূরে। তিতলি বসে পড়ল নদীর ধারে বড় একটা পাথরের উপর, অরণ্যও তার পাশে জায়গা নিল। প্রথমে দুজনেই নীরব ছিল, শুধু জলের শব্দ আর বাতাসের সোঁ সোঁ আওয়াজ তাদের মধ্যে সেতু তৈরি করছিল। হঠাৎ তিতলি মৃদু স্বরে বলল, “তুমি জানো অরণ্য, শহরে নদী মানে শুধু দূষণ, কংক্রিটের বাঁধ, আর ভিড়ভাট্টা। সেখানে নদীর ধারে বসে এমন শান্তি পাওয়া যায় না।” অরণ্য হাসল, তার চোখে যেন প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসার ঝিলিক খেলে গেল। সে বলল, “আমাদের কাছে এই নদী শুধু পানি নয়, জীবন। আমরা প্রতিদিন এখান থেকে জল নিই, এখানে মাছ ধরি, উৎসবে স্নান করি। নদী ছাড়া গ্রামকে কল্পনা করাই যায় না।” তিতলি তার দিকে তাকিয়ে অবাক হলো—এমন সহজ অথচ গভীরভাবে প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হওয়া সে আগে কখনও শোনেনি।

কথোপকথন ধীরে ধীরে ব্যক্তিগত জায়গায় পৌঁছাল। তিতলি বলল তার জীবনের কথা—শহরের ব্যস্ততা, প্রতিদিনের চাকরি, মিটিং, ভিড়ভর্তি লোকাল ট্রেন, আর অবিরাম কোলাহল। সে বলল, “আমার মনে হয় শহরে মানুষ বাঁচে শুধু বেঁচে থাকার জন্য, কিন্তু এখানে এসে বুঝলাম জীবন মানে শ্বাস নেওয়ার আনন্দও আছে।” অরণ্য মন দিয়ে শুনছিল, মাঝে মাঝে তার চোখে মৃদু বিস্ময় ফুটে উঠছিল। তারপর সে নিজের কথা বলতে শুরু করল—কীভাবে ছোটবেলায় বাবাকে হারিয়ে মায়ের সঙ্গেই বড় হয়েছে, কীভাবে স্কুল শেষ করে আর পড়াশোনা এগোয়নি কারণ সংসারের দায়িত্ব নিতে হয়েছে, আর গাইডের কাজ করতে করতে ধীরে ধীরে পর্যটকদের গল্প শোনা আর তাদেরকে পাহাড়ের গল্প শোনানো তার জীবনের অংশ হয়ে উঠেছে। তিতলি অবাক হয়ে শুনছিল, তার মনে হচ্ছিল এই ছেলেটির জীবন যতই সরল হোক না কেন, তবু তার ভেতরে রয়েছে এমন এক সমৃদ্ধি যা শহরে থেকে পাওয়া যায় না। সরল অথচ স্বাভাবিক জীবনের টান যেন তার বুকের ভেতর জমতে শুরু করল। দুজনেই হেসে উঠল যখন অরণ্য বলল, “আমরা হয়তো তোমাদের মতো বড় শহরে যাইনি, কিন্তু আমাদের পাহাড়, নদী আর আকাশই আমাদের সবচেয়ে বড় শিক্ষক।” তিতলির মনে হলো সত্যিই, যেটা সে এতদিন খুঁজে ফিরেছে, সেটা হয়তো এই সহজ অথচ গভীর জীবনের ভেতরেই লুকিয়ে আছে।

রাত নামতে শুরু করল, নদীর জলে চাঁদের প্রতিফলন ধরা দিল। তারা দুজন তখনও পাথরের উপর বসে, নিজেদের গল্প শেয়ার করছে। তিতলি বলল, “তুমি জানো অরণ্য, আমার মনে হয় আমি শহরে সবসময় ভিড়ের মধ্যে থেকেও একা ছিলাম। এখানে এসে তোমার সঙ্গে কথা বলে যেন সেই একাকিত্বটা অনেকটা কেটে গেছে।” অরণ্য মৃদু হেসে উত্তর দিল, “আমাদের গ্রামে মানুষ একা থাকতে জানে না। এখানে সবাই সবার। হয়তো সেই কারণেই আমরা প্রকৃতির কাছাকাছি।” এই কথাগুলো শুনে তিতলির চোখে অদ্ভুত এক উজ্জ্বলতা ফুটে উঠল। সে বুঝল, এই পাহাড়ি গ্রামে সে শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্য খুঁজে পায়নি, পেয়েছে এমন এক বন্ধুত্ব, এমন এক সম্পর্কের সম্ভাবনা যা তার শহুরে জীবনে কখনও সম্ভব ছিল না। নদীর ধারে সেই রাত যেন সময়ের বাইরে দাঁড়ানো এক মুহূর্ত হয়ে রইল—যেখানে শহরের ক্লান্তি আর পাহাড়ের সরলতা মিলেমিশে নতুন এক গল্প লিখতে শুরু করেছে, আর সেই গল্পের পাতায় তিতলি আর অরণ্য দুজনেই প্রথমবার একসঙ্গে নাম লিখল।

অধ্যায় ৫ – অচেনা টান

পরদিন সকালে পাহাড়ি গ্রামে ঘুম ভাঙতেই তিতলির মনে অদ্ভুত এক আবেশ ভর করল। জানালা খুলতেই দেখল দূরে পাহাড়ের চূড়ায় মেঘের আস্তরণ, রোদ্দুর কুয়াশার ফাঁক গলে নিচে নেমে আসছে, আর সেই আলোয় ঝলমল করছে গ্রাম। এত সুন্দর দৃশ্যের মধ্যেও তার চোখে ভেসে উঠল অরণ্যের মুখ। সে নিজেকে প্রশ্ন করল—কেন বারবার এই ছেলেটির কথা মনে পড়ছে? কয়েকদিন আগেও তো অরণ্য তার জীবনে ছিল না, অথচ এখন মনে হচ্ছে তার প্রতিটি অনুভূতি, প্রতিটি নিঃশ্বাস অরণ্যের সঙ্গেই বাঁধা। অরণ্যের হাসি, তার চোখের দীপ্তি, বা প্রকৃতির গল্প শোনানোর সময় কণ্ঠের সরলতা—সবকিছুই তিতলির মনে গভীর ছাপ ফেলে গেছে। কিন্তু সেইসঙ্গে এক অস্বস্তিও বুকের ভেতর জমছে। সে জানে, কিছুদিন পরেই তাকে ফিরে যেতে হবে শহরে, সেখানে অপেক্ষা করছে বাস্তবতা—অফিস, দায়িত্ব, ব্যস্ততা আর একই রকম কোলাহল। পাহাড়ি এই নীরবতা আর অরণ্যের সরলতা কি তবে একটুখানি স্বপ্নের মতো থেকে যাবে? তিতলি ভাবছিল, সে কি নিজেকে বিভ্রমে ফেলে দিচ্ছে? নাকি সত্যিই তার ভেতরে জন্ম নিচ্ছে এক নতুন টান, যার ব্যাখ্যা সে নিজেই খুঁজে পাচ্ছে না।

দিন যত এগোতে লাগল, অরণ্যের সঙ্গ তিতলির কাছে যেন আরও প্রয়োজনীয় হয়ে উঠল। নদীর ধারে বসে কিংবা পাহাড়ি পথ ধরে হাঁটার সময় সে খেয়াল করত, অরণ্যের উপস্থিতি তাকে একরকম স্বস্তি দিচ্ছে। কথাবার্তা নাহলেও পাশে থাকা যেন যথেষ্ট। তিতলি বুঝতে পারছিল, শহরের এত সম্পর্ক, এত ভিড়ের মাঝেও সে কখনও এমন নির্ভরতা অনুভব করেনি। অরণ্য তার জীবনে ঢুকে পড়েছে একদম অপ্রত্যাশিতভাবে, অথচ তার মনে হচ্ছিল যেন বহুদিন ধরেই সে অপেক্ষা করছিল এই ছেলেটির জন্য। তিতলি জানত, শহরে ফিরে গেলে হয়তো আর কখনও এভাবে দেখা হবে না, কিংবা দেখা হলেও সেই স্বাভাবিকতা আর থাকবে না। তবু তার মনে হচ্ছিল, অরণ্যের চোখের দিকে তাকালে সময় থেমে যায়, পৃথিবী থেমে যায়। শহরে ফেরার চিন্তা তাকে অস্বস্তি দিচ্ছিল—মনটা অকারণ কষ্টে ভরে উঠছিল। সে অনুভব করল, পাহাড়ের আকাশ যতটা বিস্তৃত, অরণ্যের সরলতা তার কাছে ততটাই গভীর। এই অনুভূতি স্বপ্ন নয়, বরং অচেনা অথচ সত্যি এক সম্পর্কের শুরু।

সেদিন সন্ধ্যায় তারা দুজন আবার নদীর ধারে গেল। আকাশে তখন চাঁদ উঠেছে, নদীর জলে তার প্রতিফলন ভেসে উঠছে। তিতলি চুপ করে বসে রইল, কিছু বলছিল না, শুধু অরণ্যের উপস্থিতি অনুভব করছিল। অরণ্য হঠাৎ মৃদুস্বরে জিজ্ঞাসা করল, “চুপ করে আছ কেন?” তিতলি কিছুক্ষণ নীরব থেকে বলল, “কিছু কিছু অনুভূতি আছে যা কথায় বলা যায় না।” অরণ্য কিছু বলল না, শুধু তার দিকে তাকিয়ে রইল, আর সেই নীরব দৃষ্টিতেই তিতলি বুঝে গেল তার ভেতরে জন্ম নেওয়া টানটা একতরফা নয়। তবু বিদায়ের কথা মনে পড়তেই বুকের ভেতর চাপা কষ্ট আরও তীব্র হয়ে উঠল। সে জানত, এই সম্পর্কের কোনো নিশ্চয়তা নেই, তবু তার মন অরণ্যের প্রতি অদ্ভুতভাবে বাঁধা পড়ে যাচ্ছে। পাহাড়ি আকাশের নিচে বসে তিতলি বুঝল, জীবনে কিছু সম্পর্ক থাকে যাদের ব্যাখ্যা নেই, থাকে শুধু অনুভূতি। আর সেই অচেনা টানই হয়তো তাকে নতুন করে চিনতে শেখাচ্ছে নিজেকে, শেখাচ্ছে ভালোবাসার প্রথম ভাষা।

অধ্যায় ৬ – গ্রামের উৎসব

গ্রামের উৎসবের সকাল থেকেই চারদিকে এক অদ্ভুত উচ্ছ্বাস ছড়িয়ে পড়েছিল। ছোট্ট পাহাড়ি গ্রামটা যেন রাতারাতি রঙে রঙিন হয়ে উঠল। উঠোনে রঙিন আলপনা, গাছের ডালে ডালে কাগজের ফুল আর রঙিন কাপড়ের সাজ, সর্বত্র এক উৎসবের আবেশ। ঢাকের শব্দ ধীরে ধীরে দূর থেকে ভেসে এসে গ্রামের প্রতিটি কোণে ছড়িয়ে পড়ছিল, বাঁশির সুর তার সঙ্গে মিলেমিশে এক ধরনের মোহময় পরিবেশ তৈরি করেছিল। তিতলি শহরের মেয়ে, সে এর আগে এমন করে কোনো গ্রামীণ উৎসবের অভিজ্ঞতা পায়নি। সবকিছু তার কাছে নতুন, সবকিছুই যেন একেবারে অন্য এক পৃথিবী। তার চোখে বিস্ময়, মনে আনন্দের ঢেউ। অরণ্য সেদিন সকালে এসে বলল, “চলো, তোমাকে আজ আমাদের উৎসবটা দেখাই।” তিতলি দ্বিধা করলেও অরণ্যের হাত ধরে বেরিয়ে পড়ল। গ্রাম জুড়ে মানুষের হাসি, আনন্দ আর কোলাহল যেন তাকে ঘিরে ধরল। মনে হচ্ছিল, সে হঠাৎ করেই কোনো লোককথার ভেতর ঢুকে পড়েছে। প্রতিটি মুখে প্রত্যাশার আলো, প্রতিটি শিশুর চোখে স্বপ্ন, আর প্রতিটি সুরে প্রকৃতির অনাবিল সৌন্দর্য মিশে ছিল। শহুরে কোলাহল থেকে আসা তিতলির কাছে এই অভিজ্ঞতা একেবারেই আলাদা—এ যেন এক অচেনা অথচ আপন স্বপ্নের রঙিন ক্যানভাস।

দিন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে উৎসবের রূপ আরও জমে উঠল। দুপুরের পর মাঠে বসেছিল লোকনৃত্য আর গান। গ্রামের তরুণ-তরুণীরা একসঙ্গে সাজসজ্জা করে নাচতে শুরু করল, ঢাকের তালে তালে তাদের পায়ের শব্দ যেন মাটির সঙ্গে একাকার হয়ে গেল। বাঁশির সুর ভেসে এলো দূর থেকে, তাতে মিলেমিশে গেল ঢোলের গর্জন। তিতলি মুগ্ধ হয়ে দেখছিল। সে অনুভব করল, জীবনে এত সরল অথচ প্রাণবন্ত আনন্দ সে কোনোদিন পায়নি। অরণ্য পাশে বসে শান্তভাবে সবকিছু দেখছিল, কিন্তু তার চোখে একটা গর্বের ঝিলিক ছিল—এ যেন তার মাটির গর্ব, তার সংস্কৃতির রঙ। তিতলি মাঝে মাঝে তার দিকে তাকাচ্ছিল। সে বুঝতে পারছিল, অরণ্যের মধ্যে যে সরলতা, যে টান আছে, তা এই গ্রাম আর এই প্রকৃতির সঙ্গেই জড়িয়ে। শহরের জাঁকজমকপূর্ণ কৃত্রিমতা আর এখানে গ্রামের মানুষের সৎ হাসি—এই পার্থক্য তাকে গভীরভাবে নাড়া দিল। উৎসবের ভিড়ের মধ্যে থেকেও সে অনুভব করছিল, অরণ্যের সঙ্গে তার দূরত্ব ক্রমশ কমে আসছে। যেন গ্রামের প্রতিটি রঙ, প্রতিটি শব্দ তাকে আরও কাছে নিয়ে আসছে অরণ্যের। সেই মুহূর্তে তার মনে হচ্ছিল, উৎসব শুধু গ্রামবাসীর নয়, তার নিজের ভেতরের উৎসবও বোধহয় নতুনভাবে শুরু হয়েছে।

সন্ধ্যা নামতেই উৎসবের রূপ পেল অন্য এক জ্যোতি। মাঠ জুড়ে জ্বলে উঠল প্রদীপ আর মশালের আলো, আকাশ ভরে গেল গান আর হাসিতে। নাচ থেমে গেলেও লোকগানের আসর বসলো, যেখানে গ্রামের প্রবীণরা পুরোনো কাহিনি আর সুর শোনাচ্ছিল। তিতলি একেবারেই নতুন জগতে এসে দাঁড়িয়েছে—এখানে নেই শহরের ভিড় বা যান্ত্রিকতা, আছে শুধু মানুষ আর তাদের সরল আনন্দ। অরণ্য তাকে ভিড় থেকে আলাদা করে নিয়ে গেল নদীর ধারে, যেখানে উৎসবের শব্দ দূর থেকে ভেসে আসছিল। নদীর জলে প্রতিফলিত হচ্ছিল প্রদীপের আলো, আর আকাশে তারার ভিড়। তিতলির মনে হচ্ছিল, এ যেন এক স্বপ্ন—যা সে কোনোদিন কল্পনাও করেনি। সে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল, হালকা বাতাসে তার চুল উড়ছিল, আর অরণ্যের উপস্থিতি তাকে ভরিয়ে দিচ্ছিল এক অদ্ভুত স্বস্তিতে। অরণ্য হঠাৎ বলল, “আজ তোমাকে এই গ্রামের আসল রূপ দেখাতে পেরে আমি খুশি।” তিতলি মৃদু হেসে শুধু বলল, “আজ মনে হচ্ছে, আমি সত্যিই অন্য এক জগতে এসে পড়েছি।” সেই মুহূর্তে তাদের চোখের দৃষ্টি মিলল, আর তিতলির মনে হলো, এই উৎসব শুধু গ্রামকে নয়, তাকে আর অরণ্যকে এক অচেনা অথচ গভীর বন্ধনে বেঁধে ফেলেছে।

অধ্যায় ৭ – আকাশের নিচে

রাতের নিস্তব্ধতায় পাহাড়ি গ্রামটা যেন অন্য এক আবেশে ডুবে গিয়েছিল। দূরে দূরে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক, মাঝে মাঝে পাহাড়ি হাওয়ার মৃদু শোঁ শোঁ শব্দ—সব মিলিয়ে এক অদ্ভুত মায়াময় পরিবেশ তৈরি হয়েছিল। অরণ্য সেদিন তিতলিকে নিয়ে গিয়েছিল পাহাড়ের উঁচু চূড়ায়, যেখানে গ্রামের আলো নিচে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিন্দুর মতো দেখা যায়, আর মাথার ওপরে কেবল অসীম আকাশ ভরা তারা। হাঁপাতে হাঁপাতে ওঠার পর যখন তারা দুজন একসঙ্গে বসে পড়ল, তখন তিতলির মনে হলো, শহরের কোলাহল, ভিড় আর যন্ত্রণা থেকে সে যেন দূরে কোথাও এসে পৌঁছেছে। এই নির্জনতায় আকাশের বিস্তার তাকে মুগ্ধ করে তুলেছিল। তার চোখে চোখে অগণিত তারা, যেন প্রতিটি আলোকবিন্দু জীবনের কোনো অচেনা গল্প বলছে। অরণ্য পাশে নীরব ছিল, কিন্তু তার উপস্থিতি তিতলিকে অদ্ভুত এক আশ্রয়ের অনুভূতি দিচ্ছিল। শব্দের প্রয়োজন ছিল না, শুধু বাতাস আর আকাশের বিস্তারই যথেষ্ট ছিল বোঝার জন্য যে দুজনের মধ্যে কেমন করে অদৃশ্য এক বন্ধন তৈরি হয়ে গেছে।

তিতলি সেই মুহূর্তে অনুভব করল, কথা না বলেও অনেক কিছু বলা যায়। অরণ্যের চোখের দিকে তাকাতেই তার মনে হচ্ছিল, সে বুঝতে পারছে তিতলির ভেতরের অস্থিরতা, তার অদ্ভুত টানাপোড়েন। শহরে ফেরার কথা ভাবলেই বুকের ভেতর এক চাপা কষ্ট জমে উঠছে, অথচ এই পাহাড়ি রাতের নিচে সব কিছু এত শান্ত, এত সহজ মনে হচ্ছে। অরণ্য তাকে কিছু জিজ্ঞেস করল না, তবু তার নীরব উপস্থিতি যেন এক অদৃশ্য আশ্বাস। চারদিকে যে নির্জনতা, তা আসলে কোনো শূন্যতা নয়, বরং গভীর এক পরিপূর্ণতা। তারাভরা আকাশের দিকে তাকিয়ে তিতলির মনে হচ্ছিল, এই মুহূর্তগুলো চিরকালের জন্য ধরে রাখতে পারলে হয়তো সে আর কিছু চাইত না। শহরের ব্যস্ত জীবনে তার কখনও এমন করে আকাশ দেখার সুযোগ হয়নি, এত নির্জনে, এত শান্তভাবে। অরণ্য হঠাৎ পাশে হাত রাখল ঘাসের ওপর, একেবারে অচেতন ভঙ্গিতে, আর তিতলির মনে হলো যেন সেই হাতের কাছাকাছি বসেই সে নিজের ভেতরের এক নতুন সত্তাকে চিনতে পারছে। তার হৃদস্পন্দন বেড়ে যাচ্ছিল, তবুও মনে হচ্ছিল এই মুহূর্তের সত্যতাকে আর কোনো শব্দ দিয়ে প্রকাশ করা সম্ভব নয়।

সময়ের হিসেব যেন হারিয়ে গিয়েছিল। পাহাড়ের চূড়ায় বসে তারা শুধু আকাশ দেখছিল—একজনের নিঃশ্বাসের সঙ্গে অন্যজনের নিঃশ্বাস মিলেমিশে যাচ্ছিল। দূরে নদীর মৃদু শব্দ ভেসে আসছিল, যেন প্রকৃতিও তাদের নীরব কথোপকথনের সাক্ষী হয়ে রইল। তিতলি বুঝতে পারছিল, অরণ্যের প্রতি তার যে অচেনা টান জন্ম নিয়েছিল, তা এখন অনেক গভীরে পৌঁছে গেছে। এটি শুধু কৌতূহল নয়, কেবল পাহাড়ি জীবনের সৌন্দর্যও নয়—এ যেন এক আশ্রয়ের খোঁজ, যেখানে তার অস্থির শহুরে জীবনটা কিছুক্ষণের জন্য হলেও শান্ত হতে পারে। অরণ্যের দৃষ্টিতে সে দেখছিল এমন এক স্নিগ্ধতা, যা তাকে অন্য কোথাও মেলেনি। সেই মুহূর্তে তাদের মধ্যে কোনো প্রতিশ্রুতি উচ্চারিত হলো না, তবুও মনে হচ্ছিল, আকাশের নিচে প্রকৃতি নিজেই দুজনকে কোনো এক নীরব বন্ধনে বেঁধে দিয়েছে। পাহাড়ের বাতাসে, আকাশের তারায়, আর হৃদয়ের স্পন্দনে—সবখানেই যেন ফুটে উঠেছিল সেই অনুচ্চারিত সম্পর্কের গভীরতা, যা কথা দিয়ে বোঝানো যায় না, শুধু অনুভব করা যায়।

অধ্যায় ৮ – দ্বন্দ্ব

সকালের আলোয় পাহাড়ি গ্রামটা সোনালি রঙে ভরে উঠেছিল। তিতলি জানলার ধারে দাঁড়িয়ে দূরের পাহাড় আর সবুজ জঙ্গল দেখতে দেখতে নিজের ভেতরের অস্থিরতা অনুভব করছিল। কয়েক দিন আগেও সে ছিল শহরের এক সাধারণ মেয়ে—কাজ, ক্লান্তি, নিরন্তর দৌড়ঝাঁপের ভেতর ঘেরা। অথচ এই কয়েক দিনে পাহাড়ি গ্রামের নীরবতা, অরণ্যের সরল হাসি আর প্রকৃতির কাছাকাছি থাকার অনুভূতি তাকে ভেতর থেকে অন্য এক মানুষ বানিয়ে ফেলেছে। তবু তার মনের গভীরে প্রশ্ন গেঁথে ছিল—এটা কি কেবল কিছু দিনের মোহ, নাকি সত্যিই নতুন এক জীবনের ডাক? শহরের জীবন তাকে যেমন ক্লান্ত করে, তেমনি বেঁধে রাখে পরিবার, দায়িত্ব আর স্বপ্নের অদৃশ্য শিকলে। পাহাড়ি গ্রামের জীবন সুন্দর, কিন্তু সহজ নয়; এ জায়গায় থেকে কি সে সবকিছু ফেলে দিতে পারবে? অরণ্যের সঙ্গ তার ভেতরে যে আবেগ জাগিয়েছে, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু সেই আবেগকে কেন্দ্র করে যদি সে নিজের জীবন পাল্টে ফেলে, তবে কি সে পরে অনুশোচনা করবে না? এই দ্বন্দ্ব তাকে ঘিরে ধরছিল প্রতিটি মুহূর্তে।

অরণ্য সেদিন তাকে নিয়ে গিয়েছিল জঙ্গলের এক পুরোনো পথে, যেখানে গাছের ফাঁক দিয়ে আকাশের নীল আলো মাটিতে ছড়িয়ে পড়ছিল। হাঁটার সময় তিতলির মনে হচ্ছিল, অরণ্যের পাশে হাঁটাটা যেন খুব স্বাভাবিক, যেন বহুদিন ধরে সে এমন করেই চলেছে। কিন্তু যতবার সে অরণ্যের দিকে তাকাত, তার মনে হতো, ছেলেটিও কিছু একটা লুকিয়ে রাখছে। অরণ্যের চোখে একধরনের নীরব টান ছিল, এক অদ্ভুত আবেগ যা কখনও কথায় প্রকাশ পায়নি, তবু স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল তার দৃষ্টিতে। তিতলি বুঝতে পারছিল, শুধু সে একা নয়, অরণ্যও হয়তো এই সম্পর্কের গভীরতা অনুভব করছে। কিন্তু দুজনেই কিছু বলছিল না—কারণ বলা মানেই হয়তো বাস্তবের মুখোমুখি হওয়া। একসময় অরণ্য থেমে গিয়ে বলল, “তুমি এখানে কিছুদিনের জন্য এসেছ, কিন্তু মনে হয় তুমি এই পাহাড়কে এমনভাবে দেখছ, যেভাবে অন্য কেউ দেখে না।” তিতলি চমকে তার দিকে তাকাল, কিন্তু কিছু বলল না। কথার বদলে তার চোখের ভেতর ভেসে উঠল সেই দ্বন্দ্ব—থেকে যাওয়ার ইচ্ছে আর ফিরে যাওয়ার বাধ্যবাধকতার টানাপোড়েন। অরণ্যের চোখেও সে একই দ্বন্দ্বের ছায়া দেখতে পেল—সে জানে তিতলি এখানে চিরদিন থাকবে না, তবু মনের গভীরে হয়তো আশা করছে কিছু অলৌকিক ঘটুক।

সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে আকাশে লালচে আভা ছড়িয়ে পড়েছিল, আর নদীর ধারে দাঁড়িয়ে তিতলি সেই দৃশ্য দেখছিল। তার মনে হচ্ছিল, প্রতিটি দিন যেন তাকে এক অদৃশ্য সুতোর মতো অরণ্যের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে, অথচ প্রতিটি মুহূর্ত তাকে আবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে শহরে ফেরার দিন ঘনিয়ে আসছে। নদীর জলে নিজের প্রতিবিম্ব দেখে তার মনে হলো, সে যেন এক দ্বিখণ্ডিত মানুষ—একদিকে শহরের মেয়ে, যার ভবিষ্যৎ পরিকল্পিত; অন্যদিকে এই পাহাড়ি জীবনের প্রতি মুগ্ধতা, যেখানে কোনো পরিকল্পনা নেই, আছে শুধু স্বাধীনতা আর আবেগ। অরণ্য কিছু দূরে দাঁড়িয়ে ছিল, নীরবে তার দিকে তাকিয়ে। তিতলি হঠাৎ অনুভব করল, তাদের নীরবতা আসলে কত কিছু বলে দিচ্ছে। শব্দের প্রয়োজন নেই—চোখের দৃষ্টিতেই স্পষ্ট যে তারা দুজনেই একই দ্বন্দ্বের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। তিতলির বুকের ভেতর হালকা ব্যথা জমে উঠল—সে জানে, কোনো সিদ্ধান্ত না নিলেও সময় তাকে টেনে নিয়ে যাবে শহরের দিকে। অথচ এই পাহাড়ি আকাশ, নদীর শব্দ আর অরণ্যের চোখের ভেতর সে যে আশ্রয় খুঁজে পেয়েছে, তা কি এত সহজে ফেলে আসা সম্ভব? সেই প্রশ্ন তাকে ভেতর থেকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছিল, আর তার উত্তর হয়তো কেবল সময়ই দেবে।

অধ্যায় ৯ – বিদায়ের ছায়া

ফেরার দিন যত এগিয়ে আসছিল, তিতলির মন ততই ভারী হয়ে উঠছিল। পাহাড়ি গ্রামের প্রতিটি সকাল, প্রতিটি বিকেল তার কাছে হয়ে উঠেছিল এক অবিচ্ছেদ্য স্মৃতি। ভোরবেলার পাখির ডাক, হালকা কুয়াশায় ঢাকা পাহাড়ের শিখর, নদীর ধারে বয়ে চলা ঠান্ডা হাওয়া—সব যেন তাকে ফিসফিস করে বলছিল, “থেকে যাও।” অথচ বাস্তব তার জন্য অপেক্ষা করছিল শহরে, যেখানে আছে দায়িত্ব, কাজ, ব্যস্ততা আর নিরন্তর দৌড়ঝাঁপ। তিতলি জানত, তাকে ফিরতে হবেই, কিন্তু তার ভেতরের মন চাইছিল একেবারেই না ফেরার। গ্রাম যেন এক অদৃশ্য ডোরে তাকে আটকে ফেলেছিল, বিশেষ করে অরণ্যের উপস্থিতি তার ভেতরের আবেগগুলোকে জড়িয়ে ধরেছিল আরও গভীরভাবে। সে যতবারই আকাশের দিকে তাকাত, তার মনে হতো পাহাড়ের চূড়ায় বসে তারা ভরা সেই রাতটা চিরকালের জন্য থেকে যাক। কিন্তু দিন ঘনিয়ে আসছিল, আর প্রতিটি মুহূর্তে বিদায়ের ছায়া দীর্ঘ হয়ে তার চারপাশে নেমে আসছিল।

অরণ্যও নীরবে সেই ছায়াকে অনুভব করছিল। সে তিতলিকে কিছুই বলছিল না, কিন্তু তার চোখে মুখে স্পষ্ট হয়ে উঠছিল এক চাপা কষ্ট। প্রতিদিনের মতো সে তিতলিকে নিয়ে ঘুরতে যেত, গল্প করত, কিন্তু আগের সেই সহজ হাসি আর প্রাণোচ্ছলতা যেন কোথাও হারিয়ে গিয়েছিল। তিতলি বুঝতে পারছিল, অরণ্য কথা না বললেও তার মনের ভেতরে এক ঝড় বয়ে যাচ্ছে। নদীর ধারে বসে যখন দুজন একসঙ্গে চুপচাপ থাকত, তখন নীরবতার ভেতর দিয়েই তাদের কথোপকথন চলত। অরণ্য হয়তো কিছু বলতে চাইত, কিন্তু কথা খুঁজে পেত না। সে জানত, তিতলি শহরে ফিরবেই, আর সে তাকে ধরে রাখতে পারবে না। তার সরল গ্রামীণ জীবনে কোনো প্রতিশ্রুতির শৃঙ্খল নেই, আর শহুরে জীবনের নিয়মতান্ত্রিক পথে তিতলির জন্য জায়গা নেই এই পাহাড়ি নিস্তব্ধতায়। তবুও প্রতিটি দিন তাকে কাছে টেনে নিতে চাইত, প্রতিটি মুহূর্তকে শেষ মুহূর্তের মতো করে বাঁচতে চাইত।

শেষ বিকেলের আলোয় যখন তিতলি একা দাঁড়িয়ে ছিল পাহাড়ের চূড়ায়, দূরে সূর্যাস্তের লাল আভা আকাশ রাঙিয়ে তুলছিল, তখন তার মনে হচ্ছিল প্রকৃতি নিজেই যেন তাকে থামিয়ে দিতে চাইছে। পাহাড়ের নীরবতা, নদীর স্রোত আর গাছের ফাঁক দিয়ে আসা হাওয়া—সব যেন বিদায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাচ্ছিল। তিতলি চোখ বুজে দাঁড়িয়ে ভাবছিল, এখানে তার সময় যদি থেমে যেত! হঠাৎ পিছন থেকে অরণ্য এসে দাঁড়াল, কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে শুধু বলল, “আগামীকাল তোমাকে ফিরে যেতে হবে।” তিতলি কোনো উত্তর দিল না, কেবল আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল। সেই মুহূর্তে দুজনেই জানল, এই সম্পর্কের কোনো নাম নেই, কোনো প্রতিশ্রুতিও নেই—তবুও এর গভীরতা এমন যে বিদায়ের ছায়া তাদের দুজনকেই চিরকাল ছুঁয়ে থাকবে। পাহাড়, নদী, আকাশ—সব যেন তাদের সাক্ষী হয়ে রইল, আর বিদায়ের আগে শেষবারের মতো নীরবতার ভেতর দিয়ে তারা একে অপরের প্রতি অচেনা অথচ চিরন্তন ভালোবাসার ভাষা খুঁজে নিল।

অধ্যায় ১০ – আকাশের প্রতিশ্রুতি

বিদায়ের সকালটা ছিল ভোরের কুয়াশায় মোড়া, যেন প্রকৃতি নিজেই চোখে জল মুছে রেখেছে। গ্রামের উঠোনে চারদিক নিস্তব্ধ, অথচ সেই নিস্তব্ধতার ভেতর লুকিয়ে ছিল এক অদ্ভুত চাপা কষ্ট। তিতলি হাতের ব্যাগ গুছিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল, অথচ মনে হচ্ছিল তার হৃদয়ের ভেতর কেউ অদৃশ্য শিকল বেঁধে দিয়েছে। পাহাড়ের হাওয়া মুখে এসে লাগছিল, কিন্তু সেই শীতলতার ভেতরেও তার শরীর কাঁপছিল অস্থিরতায়। গত কয়েকদিনের স্মৃতি—নদীর ধারে বসে গল্প করা, তারাভরা আকাশের নিচে কাটানো রাত, গ্রামের উৎসবের উচ্ছ্বাস—সব একসঙ্গে ভেসে উঠছিল মনে। তার মনে হচ্ছিল, সে যদি এই জায়গা থেকে চলে যায় তবে তার ভেতরের এক টুকরো প্রাণ হয়তো এখানেই থেকে যাবে। ব্যাগ হাতে নিয়েও তার পা যেন এগোচ্ছিল না। আর ঠিক তখনই অরণ্য চুপচাপ এসে দাঁড়াল। তার চোখে ক্লান্তি, তবুও ভেতরে অদৃশ্য এক শক্তি ছিল। তিতলি বুঝতে পারছিল, অরণ্য কিছুই বলবে না, শুধু তার চোখের ভেতর দিয়েই সেই কথা প্রকাশ পাবে।

পাহাড়ের নিচে নামার পথে যখন দুজনে পাশাপাশি হাঁটছিল, তখন এক ধরনের অদ্ভুত নীরবতা তাদের ঘিরে ধরেছিল। অরণ্যের ঠোঁট নড়ছিল না, কিন্তু তার নিঃশ্বাসের ছন্দেই যেন তিতলি শুনতে পাচ্ছিল হাজারো না-বলা কথা। নদীর ধারে এসে দুজন থেমে দাঁড়াল। চারদিকে সকালবেলার সূর্যের আলো জলে প্রতিফলিত হচ্ছিল, আকাশে উড়ে যাচ্ছিল পাখিরা। তিতলি হঠাৎ থেমে গেল, চোখ নামিয়ে নরম কণ্ঠে বলল, “হয়তো আমি ফিরে যাব, কিন্তু এই আকাশ, এই পাহাড়, এই নদীর ফাঁকে তুমি আমারই থাকবে।” কথাগুলো উচ্চারণ করার পর তার বুক কেঁপে উঠল, গলায় হালকা কাঁপন ধরা পড়ল। অরণ্য প্রথমে কিছুই বলল না, শুধু গভীর দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইল। তিতলি তার চোখে দেখল এমন এক আবেগ, যা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। চোখের কোণে জমে থাকা জল ধীরে ধীরে গড়িয়ে পড়ছিল, অথচ সেই অশ্রুতেই লুকিয়ে ছিল এক অচেনা শক্তি, এক অনন্ত স্বীকৃতি। মনে হচ্ছিল, বিদায় শুধু শরীরের দূরত্ব তৈরি করবে, কিন্তু আত্মার ভেতরে জন্ম নেওয়া সেই সম্পর্ককে কোনোদিন আলাদা করতে পারবে না।

সেদিন আকাশ ছিল একেবারে পরিষ্কার, নীল আকাশে সূর্যের আলো ঝলমল করছিল, যেন প্রকৃতি নিজেই প্রতিশ্রুতির সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিদায়ের মুহূর্তে যখন গাড়ি এসে দাঁড়াল, তিতলি অরণ্যের দিকে শেষবার তাকাল। তাদের চোখে চোখে মিলন হলো—সে দৃষ্টিতে ছিল বেদনা, অশ্রু, অথচ তার মধ্যেই লুকিয়ে ছিল এক চিরন্তন প্রতিজ্ঞা। তারা জানত, হয়তো সময় আর দূরত্ব তাদের আলাদা করবে, কিন্তু সেই আকাশ, সেই পাহাড় আর সেই নদী প্রতিদিন তাদের মনে করিয়ে দেবে এই সম্পর্কের গভীরতা। তিতলির চোখে জল ভরে উঠল, অরণ্যের ঠোঁট কেঁপে উঠল, তবু দুজনেই হাসল—একটি নীরব, অশ্রুসিক্ত হাসি। গাড়ি ধীরে ধীরে দূরে সরে যাচ্ছিল, কিন্তু পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে অরণ্যের চোখে তখনও প্রতিফলিত হচ্ছিল সেই প্রতিশ্রুতির আলো। আকাশের নিচে জন্ম নেওয়া সেই নীরব অঙ্গীকার যেন চিরদিনের মতো তাদের আত্মায় লিখে গেল—এক অদৃশ্য বন্ধন, যা সময় বা দূরত্ব কোনোদিন ভাঙতে পারবে না।

শেষ

1000065967.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *