শহরটা ছোট, অথচ তার বুকের ভেতরে লুকিয়ে আছে অগণিত অদ্ভুত গল্প। প্রতিদিন ভোরের আলো যখন কুয়াশার চাদর সরিয়ে দিয়ে বাড়ি-বাজার, রাস্তাঘাটের ওপর তার সোনালি আভা ছড়াতে শুরু করে, তখনই ডাকঘরের পুরোনো লোহার গেট খুলে ঢোকেন অবসরপ্রাপ্ত ডাকপিয়ন শম্ভু মণ্ডল। যদিও অবসরের পর তার দায়িত্ব শেষ হয়ে গেছে, তবুও আজও ভোরবেলা পুরোনো অভ্যাসে সে এসে বসে পড়ে ডাকঘরের কাঠের বেঞ্চে। নতুন প্রজন্মের ডাকপিয়নেরা ব্যাগে চিঠি সাজাতে ব্যস্ত হয়ে ওঠে আর শম্ভু তাদের দিকে তাকিয়ে মনে মনে ভাবে, এও যেন এক নেশা—চিঠির কালি, খামের ভাঁজ, আর মানুষের অগণিত গল্পের গন্ধ তার নাকে লেগে আছে আজও। সেই সকালটিও অন্য দিনের মতোই ছিল। ঝুপ করে আলো নেমে আসা পুরোনো ডাকঘরটা নিস্তব্ধ, শুধু কাগজের মড়মড়ে শব্দ আর টেবিল ঠোকাঠুকি শোনা যাচ্ছিল। শম্ভু নিঃশব্দে এক কাপ চা হাতে বসে ছিল, হঠাৎই তার চোখে পড়ল এক অদ্ভুত দৃশ্য—নতুন ডাকপিয়নের ব্যাগে চকচকে একটি নীল খাম। বাকি চিঠিগুলো ছিল সাধারণ, ম্লান রঙের, পোষ্টমার্কের দাগে ভরা, কিন্তু এই খামটি যেন সদ্য কালি লেগে বেরিয়েছে ছাপাখানা থেকে। অবচেতনে শম্ভু এগিয়ে গিয়ে খামটি হাতে তুলে নিল। তাতে বড় হরফে লেখা নাম—“অর্ণব দত্ত।”
শম্ভুর শরীরে কাঁপুনি বয়ে গেল। নামটি অচেনা নয়। পাঁচ বছর আগে এই শহরেই অর্ণব দত্ত আত্মহত্যা করেছিল—ঘরের ভেতর সিলিং ফ্যান থেকে ঝুলে থাকা তার দেহ উদ্ধার হয়েছিল পুলিশের হাতে। খবরটা তোলপাড় করেছিল গোটা শহর। অর্ণব তরুণ, মেধাবী, কিন্তু তার জীবনের ভেতরে যে দুঃখ, অন্ধকার জমে উঠছিল, সেটা কেউ বুঝতে পারেনি। তারপর একরাতে হঠাৎ করেই তার যাত্রা শেষ। শম্ভু নিজে সেই ঘটনার সাক্ষী ছিল না, কিন্তু ডাক বিভাগের লোকজনের মধ্যে অর্ণবের কথা বহুবার শোনা হয়েছে। তার বাবার নামে বহু চিঠি আসত, মা নিয়মিত বিদেশে আত্মীয়দের চিঠি পাঠাতেন। অর্ণব মারা যাওয়ার পর থেকে সেই পরিবার শহর ছেড়ে চলে গেছে, অচেনা এক শূন্যতা রেখে। অথচ আজ, পাঁচ বছর পর, শম্ভুর হাতে ধরা আছে একটি চকচকে নীল খাম, যার ওপর অর্ণব দত্তের নাম স্পষ্ট অক্ষরে লেখা। প্রথমে শম্ভু ভেবেছিল হয়তো কাকতালীয়, হয়তো নামের মিল। কিন্তু যখন সে খামের নিচে খোদাই করা পুরোনো বাড়ির ঠিকানাটি দেখল—পুরোনো লাল দোতলা বাড়ি, যেখানে অর্ণব থাকত—তখন তার বুকের ভেতর অদ্ভুত এক শীতলতা নেমে এলো।
চিঠিটি বাকি ডাকের সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়ার বদলে শম্ভু কিছুক্ষণ হাতের মুঠোয় ধরে রাখল। তার মনে হচ্ছিল, এই খামটির ভেতরে যেন শুধু কাগজ নয়, কোনো অচেনা ছায়া, কোনো নিঃশব্দ আর্তনাদ লুকিয়ে আছে। সে চারপাশে তাকাল—অন্য কেউ খেয়াল করছে কি না। ডাকঘরের ভেতরকার পরিবেশ তখনও স্বাভাবিক, সবাই নিজের কাজে ব্যস্ত। অথচ শম্ভুর মনে হচ্ছিল, পুরো ঘরটা এক অজানা শীতল অন্ধকারে ভরে উঠেছে। খামের নীল রঙ যেন তার চোখে বিদ্ধ হয়ে যাচ্ছিল, তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল অর্ণবের স্মৃতির দিকে। পাঁচ বছর আগে যাকে কবর দেওয়া হয়েছে, আজ তার নাম আবার ফিরে এসেছে ডাকঘরে। এটা কি কেবলই কোনো মজা, কারো নিষ্ঠুর খেলা? নাকি সত্যিই অর্ণব দত্তের আত্মা আজও এই শহরের গলিপথে ঘুরে বেড়াচ্ছে, আর ডাকঘরের ব্যাগে নিজের অস্তিত্বের প্রমাণ রেখে যাচ্ছে? শম্ভু বুঝতে পারছিল না, কিন্তু তার মনের ভেতরে একটা চাপা কৌতূহল, একটা ভয় আর অদ্ভুত এক টান জেগে উঠল। সে জানত, এই নীল খামের রহস্য উন্মোচন না করা পর্যন্ত তার শান্তি নেই।
–
প্রথম নীল খামটির ঘটনা যেন এক অদ্ভুত কাকতালীয় ঘটনা ভেবেছিল শম্ভু, কিন্তু কয়েকদিন যেতে না যেতেই সেই কাকতালীয় ঘটনাটি ধীরে ধীরে ভয়াবহ অস্বাভাবিকতায় রূপ নিল। একদিন নয়, দু’দিন নয়—প্রতিদিন সকালে ডাকঘরের ব্যাগে নতুন করে এসে হাজির হতে লাগল নীল খাম। অন্য সব চিঠি যেমন ডাক বিভাগের সিলমোহর আর বাইরের পোষ্টমার্ক নিয়ে আসে, এই খামগুলোতে তেমন কিছুই নেই। যেন ডাক বিভাগীয় চক্রের বাইরে কোথাও থেকে এগুলো হঠাৎ করে উদয় হয়। প্রথম কয়েকটা খাম দেখে নতুন ডাকপিয়নেরা ভাবল, হয়তো কারিগরি ভুল হয়েছে বা ডাকঘরের ভেতরেই কেউ মজা করছে। কিন্তু এক সপ্তাহ পেরোতেই তারা ভয় পেতে শুরু করল। খামগুলোর কাগজ একেবারে নতুন, তাতে কোনো ভাঁজ নেই, কোনো পুরোনো চিঠির গন্ধ নেই—বরং যেন কেউ সদ্য ছাপিয়ে রেখেছে। ব্যাগের ভেতর ঠিক সেই জায়গায় খামটি পড়ে থাকে যেখানে প্রথম নজরে ধরা পড়ে। যেন প্রেরক চাইছে প্রতিদিন সকালের শুরুতেই তার বার্তা মানুষের চোখে পড়ুক। ডাকঘরের ভেতরে ফিসফাস শুরু হলো—“কোনো ভূত-প্রেতের কাজ নাকি?” “মৃত অর্ণবের আত্মা কি ফিরে এসেছে?” কেউ সাহস করে বেশি উচ্চস্বরে এসব বলত না, কিন্তু ভেতরে ভেতরে সকলের মনে ভয় জমতে থাকল।
শম্ভু, যিনি অবসরপ্রাপ্ত হলেও প্রতিদিন ডাকঘরে এসে বসেন, প্রথমে চুপচাপ এই ঘটনাগুলো লক্ষ্য করছিলেন। তিনি জানেন, ডাক বিভাগে কাজ করতে গিয়ে অনেক অদ্ভুত জিনিসের মুখোমুখি হতে হয়—অপাঠানো চিঠি, ভুল ঠিকানার খাম, কিংবা বছর পর হারিয়ে যাওয়া বার্তা হঠাৎ আবির্ভূত হওয়া। কিন্তু এই নীল খামের ঘটনার ভেতর কিছু ভিন্নতা ছিল। প্রথমত, কোনো পোস্টমার্ক নেই, মানে এগুলো ডাকের নিয়মিত পথে আসছে না। দ্বিতীয়ত, প্রতিটি খামের কালি, লেখার ভঙ্গি যেন অর্ণব দত্তের হাতের লেখার সঙ্গে হুবহু মিলে যায়। শম্ভু নিজে অর্ণবের জীবদ্দশায় কখনো চিঠি দেখেননি, কিন্তু পুরোনো নথি ঘাঁটতে গিয়ে তার এক বন্ধুর কাছে লেখা চিঠির নমুনা তিনি দেখেছিলেন। সেই স্মৃতি হঠাৎ মনে পড়তেই শম্ভুর শরীর শীতল হয়ে এলো। অন্য ডাককর্মীরা যখন ভয়ে চিঠিগুলো এড়িয়ে চলতে শুরু করেছে, শম্ভু তখন নিঃশব্দে খামগুলো সংগ্রহ করে রাখতে লাগলেন। তার মনে এক অদম্য কৌতূহল কাজ করছিল—কে পাঠাচ্ছে এই চিঠি? কেউ কি ইচ্ছে করেই অর্ণবের নামে শহরে ভয়ের আবহ তৈরি করছে? নাকি সত্যিই মৃত্যুর পর কোনো ছায়া ফিরে এসেছে এই পৃথিবীতে, নিজের অস্তিত্বের প্রমাণ দিয়ে যেতে?
একদিন বিকেলে যখন ডাকঘর প্রায় ফাঁকা হয়ে গেছে, শম্ভু একা বসে খামগুলো হাতে নিয়ে দীর্ঘক্ষণ ভাবছিলেন। ভেতরে থাকা কর্মীরা স্পষ্ট ভয় পেতে শুরু করেছে—কেউ আর খাম স্পর্শ করতে চায় না। অথচ শম্ভুর মনে হলো, এই রহস্য উন্মোচন করা তার নিজের দায়িত্ব। কত বছর তিনি এই দপ্তরে কাজ করেছেন, কত মানুষের সুখ-দুঃখের বার্তা হাতে বয়ে এনেছেন—চিঠির সঙ্গে তার আজন্ম সম্পর্ক। তাই এমন এক অস্বাভাবিক চিঠি রহস্যময়ভাবে আসতে থাকলে তাকে এড়িয়ে যাওয়া তার কাছে কাপুরুষতা মনে হলো। নিজের পুরোনো অভিজ্ঞতার ভরসায় তিনি স্থির করলেন, এবার তাকে সত্যটা খুঁজে বের করতেই হবে। তিনি মনে মনে ভাবলেন, হয়তো কোনো অজ্ঞাত প্রেরক মানুষকে ভয় দেখিয়ে মজা নিতে চাইছে, হয়তো কোনো পুরোনো শত্রু কিংবা শহরের ভেতর লুকিয়ে থাকা কোনো অপরাধের সূত্র এই খামের আড়ালে আছে। কিন্তু যাই হোক, অর্ণবের নাম বারবার ভেসে ওঠা নিছক কাকতালীয় নয়। সেই রাতে শম্ভু বাড়ি ফিরে ঘুমোতে পারলেন না। চোখের সামনে বারবার ভেসে উঠছিল সেই অদৃশ্য প্রেরকের লেখা নীল খাম, আর মনে হচ্ছিল, খামের ভাঁজের আড়ালে যেন কোনো ছায়ামূর্তি দাঁড়িয়ে আছে, তাকে আহ্বান করছে—“এসো, খুঁজে বার করো আমার সত্য।”
–
শম্ভু ঠিক করলেন, শুধু ডাকঘরে বসে থেকে নীল খামের রহস্য ভেদ করা সম্ভব নয়। সত্যিকারের উত্তর খুঁজতে হলে তাকে ফিরে যেতে হবে অর্ণবের অতীতে—সেই পরিবার, সেই বাড়ি, আর সেই ছেলেটির জীবনের গোপন অন্ধকারে। শহরের পুরোনো লোকেরা এখনো অর্ণবের নাম শুনলে ফিসফিস করে, কেউ মুখ ফিরিয়ে নেয়, কেউ আবার দুঃখের দীর্ঘশ্বাস ফেলে। শম্ভু প্রথমে চেষ্টা করলেন অর্ণবের বাবা-মাকে খুঁজে বের করতে। বহু বছর আগেই তারা শহর ছেড়ে চলে গেছেন—অর্ণবের মৃত্যুর পর আর এই শহরে থাকা সম্ভব হয়নি তাদের পক্ষে। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, তারা কলকাতার এক আত্মীয়ের কাছে চলে গিয়েছিলেন, পরে নাকি বিদেশে চলে যান। কেউ নিশ্চিত জানে না তাদের বর্তমান ঠিকানা। কিন্তু সেই ভাঙা গল্পের টুকরো টুকরো অংশ শুনতে শুনতে শম্ভুর মনে হলো, অর্ণবের পরিবারের অদৃশ্য হয়ে যাওয়াটা যেন তার আত্মহত্যার মতোই রহস্যে ঢাকা। অর্ণব যে কলেজে পড়ত, সেখানকার পুরোনো রেকর্ড থেকে শম্ভু জানতে পারলেন, ছেলেটি পড়াশোনায় ভালো হলেও এক ধরনের মানসিক অবসাদ তাকে গ্রাস করেছিল। হঠাৎ হঠাৎ ক্লাসে না আসা, বন্ধুদের থেকে দূরে সরে যাওয়া, খাতায় অদ্ভুত আঁকিবুঁকি করা—সবই তার ভেতরে চলা এক অন্ধকার যুদ্ধের ইঙ্গিত বহন করত। কিন্তু তখন কেউ গুরুত্ব দেয়নি, সবাই ভেবেছিল কিশোর বয়সের খামখেয়ালি। আর সেই অবহেলার পরিণামই হয়তো ছিল তার সেই মর্মান্তিক মৃত্যু।
অর্ণবের বাড়ি ছিল শহরের এক প্রান্তে, পুরোনো লাল রঙের দোতলা বাড়ি। শম্ভু একদিন বিকেলে সেই বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। পাঁচ বছর কেটে গেছে, বাড়িটা এখন বন্ধ, ধুলো জমা জানালা, ভাঙা বারান্দা, আর লতাপাতা জড়ানো দেয়াল যেন সময়ের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তবুও বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে শম্ভুর মনে হলো, ভেতরে কেউ যেন নিঃশব্দে তার দিকে তাকিয়ে আছে। আশেপাশের প্রতিবেশীরা বাড়ির দিকে আঙুল তুলতেই অস্বস্তি বোধ করে। কেউ কেউ তো সোজাসুজি বলে দিল, “ওই বাড়িতে রাতে আলো জ্বলে ওঠে। জানালার ফাঁক দিয়ে দেখা যায়, কারো ছায়া এদিক-ওদিক হাঁটছে।” অথচ বাড়িটা তো বহু বছর ধরে তালাবন্ধ। শম্ভুর মনে প্রশ্ন জাগল—কেউ কি গোপনে বাড়িটা ব্যবহার করছে? নাকি মানুষের ভয় আর গুজবই এভাবে ছড়িয়ে পড়েছে? তিনি জানালার ধুলো জমা কাঁচে চোখ রাখলেন, কিন্তু অন্ধকার ছাড়া কিছুই দেখতে পেলেন না। তবুও ভেতরের বাতাসে যেন এক চাপা অস্বস্তি ভেসে আসছিল, যেন কেউ ফিসফিস করে বলছে—“আমি এখনো এখানে আছি।” শম্ভু খেয়াল করলেন, জানালার নীচে শুকিয়ে যাওয়া তুলসী গাছের পাশে একেবারে নতুন সিগারেটের ফিল্টার পড়ে আছে। তাহলে কি সত্যিই কেউ আসে এখানে রাতে?
প্রতিবেশীদের সঙ্গে কথা বলে শম্ভু জানতে পারলেন, অর্ণবের মৃত্যুর পর প্রথম দিকে কিছু মানুষ বাড়িতে আসতে দেখেছে—মাঝে মাঝে এক মধ্যবয়সী মহিলা, যাকে অর্ণবের মা বলে মনে করা হয়েছিল। পরে একেবারেই কেউ আর আসেনি। তবুও কিছুদিন ধরে লোকজন রাতে আলো জ্বলা দেখতে পাচ্ছে। কেউ বলে, এটা ভূতের কাজ, কেউ আবার বিশ্বাস করে, বাড়িটা কোনো অজানা গোপন খেলার আড্ডা হয়ে গেছে। শম্ভু, ডাক বিভাগের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থেকে জানেন—মানুষের কল্পনা প্রায়ই অদ্ভুত রঙ মাখে। কিন্তু তার অভিজ্ঞতায় এ-ও সত্যি যে, প্রতিটি গুজবের পেছনে কিছু না কিছু বাস্তব সূত্র থাকে। নীল খামের বারবার আবির্ভাব, মৃত অর্ণবের নাম, আর এই আলো জ্বলার ঘটনা—সব যেন একই সূত্রে বাঁধা। সেই রাতে বাড়ি ফেরার সময় শম্ভুর মনে হচ্ছিল, তিনি যত এগোচ্ছেন, রহস্য ততই গভীর হচ্ছে। অর্ণবের আত্মহত্যা হয়তো শুধুই ব্যক্তিগত মানসিক অবসাদের ফল ছিল না—বরং তার ছায়া আজও শহরের বুকের ভেতর লুকিয়ে আছে, নীল খামের মতোই বারবার ফিরে আসছে।
–
শম্ভু খামের সেই নীল রঙের কাগজটি হাতে নিলেই হঠাৎ অদ্ভুত এক শীতল অনুভূতি তার শরীর জুড়ে ছেয়ে গেল। প্রথমবার খামটি খুলে সে যা দেখল, তাতে তার চোখ বড় হয়ে গেল—“আমি এখনো এখানে আছি।” বাক্যটি যেন সরাসরি তার মনের ভেতরে ছেদ কেটে ঢুকে পড়ল। অর্ণবের সঙ্গে তার শেষ দেখা, কলেজের পড়াশোনার মৃদু আড্ডা, ক্যান্টিনে হেসে খেলার মুহূর্তগুলি চোখের সামনে ঘুরে গেল। কিন্তু এই বার্তা সবকিছুই ভাঙছিল, সময়ের সীমানা ভেদ করে এক অদ্ভুত বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করাচ্ছিল। শম্ভু প্রথমে ভাবল, কেউ তার সাথে মজা করছে, হয়তো কলেজের পরিচিত কেউ এই খামের মাধ্যমে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। কিন্তু ঠিক সে সময় তার মন জোরালোভাবে জানিয়ে দিল, এই শব্দগুলো সাধারণ কল্পনার বাইরে। অর্ণবের হাতের লেখা, তার চিন্তা, এমনকি তার নিঃশ্বাসের অবশিষ্ট স্পন্দনও যেন প্রতিটি অক্ষরে ঢুকে আছে। শম্ভুর চোখ বার বার বার্তাটির দিকে ফিরে যাচ্ছিল, যেন সে কোথাও কোনো লুকানো সংকেত খুঁজে পেতে চাচ্ছে।
পরদিন সকালে, ঠিক নিয়ম মতো আবার একটি খাম আসে। এইবার খামের কাগজটি আরও পুরনো এবং ক্ষীণ হয়ে আছে, প্রায় ভেঙে পড়ার উপক্রম। ধীরে ধীরে খুলে শম্ভু পড়ে—“তুমি কি সত্যিই ভেবেছিলে আমি চলে গেছি?” বাক্যটি পড়তে পড়তে শম্ভুর বুক কেঁপে উঠল। প্রতিটি অক্ষরে অর্ণবের অভাব এবং একাকিত্বের ছায়া ফুটে উঠছিল। খামের কাগজের গন্ধ, যা একটু মাটির মতো এবং আংশিক ধূসর, শম্ভুর মনকে অতীতের অন্ধকারে টেনে নিল। মনে হচ্ছিল, অর্ণব কোথাও আছেন, কিন্তু চোখে দেখা যায় না, কেবল শব্দের মধ্য দিয়ে তিনি উপস্থিত। এই বার্তাগুলো যেন তাকে কোনো রহস্যময় জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে—একটি এমন জায়গায় যেখানে মৃত্যু, স্মৃতি এবং অদ্ভুত শক্তি একত্রে মিলিত হয়েছে। শম্ভুর মনে প্রশ্ন জাগল—কে পাঠাচ্ছে এই বার্তাগুলো? কে জানে তার অন্তরের ভেতর অর্ণবের এই নিঃশব্দ আকুতি? নাকি সত্যিই কোনো অতিপ্রাকৃত ছায়া ডাকঘরে ঘুরে বেড়াচ্ছে, অর্ণবের আত্মার অনুরণন হিসেবে বার্তা পৌঁছে দিচ্ছে? এই অনুভূতি শম্ভুকে আতঙ্কিত করলেও, অন্যদিকে তাকে আরও গভীরে জানার তাগিদ দেয়।
দিনের পর দিন, খামের সংখ্যা বাড়তে থাকে। প্রতিটি খামে নতুন নতুন বাক্য, নতুন নতুন অভিব্যক্তি, যা মৃত অর্ণবের জীবনের এক অস্পষ্ট প্রতিচ্ছবি উপস্থাপন করে। কেউ হয়তো বলবে, এটি কোনো কারসাজি, কিন্তু শম্ভু জানে, কাগজের আঙুল ছোঁয়া অনুভূতি, লেখা অক্ষরের স্পন্দন এবং ব্যাকরণে যে অদ্ভুত নিখুঁততা, তা কোনো মানুষ সহজে তৈরি করতে পারবে না। সে খামগুলো সংগ্রহ করতে শুরু করে, প্রতিটি খামের দৈর্ঘ্য, কালি, কাগজের ধরন এবং লেখা ধরন লিপিবদ্ধ করে রাখে। কিন্তু যত বেশি খাম আসে, তত বেশি রহস্য বেড়ে যায়। বার্তা গুলোর মধ্যে অনেকে সরাসরি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করছে, অনেকে স্মৃতি মনে করিয়ে দিচ্ছে, আর কিছুবা শান্তির আবেদন করছে—যেন অর্ণবের আত্মা কোনো অন্তর্বাসিক শক্তি দিয়ে শম্ভুর মনকে স্পর্শ করছে। শম্ভু গভীরভাবে অনুভব করে, এই খামগুলো শুধুই কাগজ নয়; এগুলো এক জীবন্ত সংলাপ, যা সময় এবং মৃত্যু উভয়কেই অতিক্রম করে। কিন্তু সবচেয়ে ভয়ঙ্কর বিষয় হলো, প্রতিটি বার্তা তার নিজের উপস্থিতি স্বীকার করছে, এক অদৃশ্য অস্তিত্বের অস্তিত্ব, যা বলে—আমি এখনো এখানে আছি। শম্ভু বুঝতে পারছিল, এই রহস্যের অন্ত্যন্তে পৌঁছানো মানে হয়তো জীবনের বাস্তবতার সীমানা ছুঁয়ে দেখা, এবং হয়তো সে একবার যে খামের রহস্যের ভেতরে প্রবেশ করেছে, সেখান থেকে আর ফিরে যাওয়া সহজ হবে না।
–
শম্ভু যখন অর্ণবের পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে পৌঁছালো, তখন প্রথমে মনে হয়েছিল, তারা কেবল শোকাহত এবং অতীত স্মৃতির বৃত্তে আটকে আছে। সুব্রত, রীণা এবং অমিত—তিনজনেই আলাদা আলাদা ছাপ দিয়ে বসেছিলেন ছোট একটি চায়ের দোকানের কোণে, যেন দীর্ঘদিন ধরে জমে থাকা বিষাদের ধোঁয়া এখনও বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। শম্ভুর চোখে প্রথমেই ধরা পড়ল তাদের অবসাদ এবং অন্ধকার চোখের ভেতর লুকানো অজানা ব্যথা। সুব্রত, যে অর্ণবের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল, তার কণ্ঠে কেঁপে ওঠা ভাব, রীণার নীরব অথচ প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টি, এবং অমিতের অজানা অস্থিরতা—সব মিলিয়ে শম্ভুর মনে একটা অদ্ভুত আতঙ্ক এবং কৌতূহল জাগিয়ে তুলল। তারা একসময় অর্ণবের মৃত্যুর পিছনের গোপন কাহিনী খুলতে শুরু করে। শুনতে শুনতে শম্ভু বুঝতে পারল, অর্ণবের মানসিক অবসাদ কেবল একা নয়, বরং তার চারপাশের সম্পর্কের জটিলতা এবং বিশ্বাসঘাতকতার ছায়া তাকে ধীরে ধীরে ভেঙে ফেলেছিল। সুব্রত এবং অমিতের মধ্যে পুরোনো দ্বন্দ্ব, রীণার প্রতি অর্ণবের অপরিসীম ভালোবাসা এবং সেই ভালোবাসার প্রতিফলন না পাওয়ার হতাশা—সব মিলিয়ে একটি অদৃশ্য মানসিক চাপ তৈরি করেছিল, যা তার জীবনের শেষ মুহূর্তগুলোকে আরও অন্ধকারে ঢেকে দিয়েছিল।
শম্ভু যত শুনছিল, ততই তার মনে এক অদ্ভুত ভাব জাগছিল। সে বুঝতে পারল, অর্ণবের মৃত্যু কেবল ব্যক্তিগত মানসিক অবসাদের ফল নয়, বরং একটি জটিল মানবিক কাহিনীর ফলাফল। সুব্রত স্বীকার করল, সে এক সময় অর্ণবের ওপর তার দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করতে চেয়েছিল, কিন্তু ভয় এবং অহঙ্কারের কারণে তা করতে পারেনি। রীণা, যার সঙ্গে অর্ণবের সম্পর্ক ছিল সবচেয়ে গভীর, কাঁদতে কাঁদতে বলল, অর্ণবের শেষ চিঠি কখনো সে পড়েনি, কারণ তার মধ্যে ছিল সুব্রত এবং অমিতের মধ্যে লুকানো সত্যকে প্রকাশ করার ভয়। আর অমিত—যে সবসময় নিজের ইগোকে অর্ণবের বন্ধুত্বের চেয়ে বড় মনে করত—সে কেবল স্বীকার করল, তার আচরণ অনেক সময় অর্ণবকে আরও একাকী করে দিয়েছে। এই স্বীকারোক্তিগুলো শম্ভুর মনে অদ্ভুত এক রোমাঞ্চ এবং ভয় সৃষ্টি করল। মনে হচ্ছিল, সেই নীল খামের বার্তাগুলো, যা অর্ণবের নাম ধরে তাকে স্পর্শ করছে, হয়তো সেই অতীতের অপরাধবোধ এবং নির্লজ্জ দুঃখের প্রতিধ্বনি। শম্ভু ভাবল, হয়তো অর্ণবের আত্মা শান্তি খুঁজছে না, কারণ তার চারপাশের বন্ধুত্বের ভাঙা রেখাগুলো এখনও অপুরণীয়।
তারপর শম্ভু গভীরভাবে চিন্তা করতে শুরু করল—প্রতিটি বার্তা, প্রতিটি নীল খাম, হয়তো শুধু অর্ণবের মৃত্যু কাহিনী নয়, বরং একটি অদৃশ্য উপায়ে বন্ধুত্ব, বিশ্বাসঘাতকতা এবং অপরাধবোধকে জীবন্ত রাখছে। যখন সে সুব্রত, রীণা এবং অমিতের চোখের দিকে তাকালো, তখন তাদের চোখে লুকানো অপরাধবোধ এবং অশান্তি খামের বাক্যগুলোর সঙ্গে মিলে গেল। সে অনুভব করল, বার্তাগুলো কোনো অতিপ্রাকৃত শক্তির কাজও হতে পারে, যা অর্ণবের বন্ধুত্বের ভাঙা অংশগুলোকে মানুষের মনে আবার স্পন্দিত করছে। শম্ভু বুঝতে পারল, শুধুমাত্র অতীতকে খুঁজে বের করা যথেষ্ট নয়; তাকে বুঝতে হবে, এই ভাঙা সম্পর্কের রহস্য কি কোনোভাবে এখনও জীবিত এবং কি বার্তাগুলোর মধ্য দিয়ে শঙ্কা ও দুঃখ অন্যদেরও স্পর্শ করছে। সেই উপলব্ধি তাকে ভয় দেখাল, কিন্তু অন্যদিকে অনুরূপ কৌতূহলও তৈরি করল—কেন অর্ণবের মৃত্যুর সঙ্গে এই বন্ধুত্বের ছায়া এতভাবে জড়িয়ে আছে, এবং নীল খামের রহস্য কি সত্যিই অতিপ্রাকৃত, নাকি শুধু মানবিক অনুভূতির প্রতিফলন? প্রতিটি প্রশ্ন শম্ভুর মনে নতুন অগ্নি জ্বালাল, আর সে জানল, এ রহস্যের গভীরতা এখনও পুরোপুরি উন্মোচিত হয়নি।
–
শম্ভু ডাক বিভাগের পুরোনো ফাইল ঘাঁটতে বসল এবং চোখের সামনে এল এক দীর্ঘদিন ধরে ধুলো জমা ফাইলের পাহাড়। কাগজগুলোর মধ্যে অর্ণবের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কিছু নথি হঠাৎ তার নজরে আসে। সেগুলো ছিল কলেজের ভর্তি নথি, হোস্টেলের রিপোর্ট, এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ—একটি নীল খামে রাখা অদ্ভুত চিঠি। চিঠিটি অর্ণব মৃত্যুর ঠিক আগের দিন পেয়েছিল বলে তারিখে স্পষ্ট। শম্ভু ধীরে ধীরে খামের খাতা খুলে দেখল, সেখানে লেখা ছিল অক্ষরে অক্ষরে, “যতই সময় কাটুক, আমি তোমার সঙ্গে আছি।” কাগজের সঙ্গেই যেন কিছু অস্পষ্ট শক্তি লেগে আছে; চিঠির কালি, খামের নীল রঙ, এবং অক্ষরের বাঁক-ঘূর্ণ সবকিছু শম্ভুর মনে এক অদ্ভুত কম্পন জাগাচ্ছিল। প্রথমে সে ভাবল, এটি সম্ভবত কেউ প্রাঞ্জলভাবে সাজানো মজার কৌশল। কিন্তু যত বেশি সে চিঠি পর্যবেক্ষণ করল, ততই অনুভব করল, এই চিঠি কোনো স্বাভাবিক হাতে লেখা নয়। অর্ণবকে এটি এমনভাবে স্পর্শ করেছিল, যা আজও শম্ভুর হৃদয়কে কাঁপাচ্ছে।
শম্ভু তখন আরও গভীরে খুঁজতে শুরু করল। ফাইলের মধ্যে আরও কিছু নথি বেরিয়ে এল—ডাকঘরের আগের দিনের রেকর্ড, ডেলিভারি নোট, এবং দস্তাবেজে খামের বার্তা সংক্রান্ত মুদ্রিত তালিকা। বিশেষ করে, তার নজর এলো সেই খামের তারিখের দিকে। চিঠির তারিখ আজকের খামের সঙ্গে একেবারে মিলে যাচ্ছে। যেন সময়ের কোনো ফাঁক দিয়ে, অতীত থেকে বর্তমানের দিকে একই বার্তা এসে পড়ছে। শম্ভু অবাক হয়ে বলল, “এটি কি সম্ভব?” ডাক বিভাগের আর্কাইভে এমন ঘটনা বিরল, অথচ এখানে তার চোখের সামনে ঘটছে। সে মনে মনে ভাবল, হয়তো কেউ অতিপ্রাকৃত শক্তি ব্যবহার করছে, বা হয়তো কোনো রহস্যময় ব্যক্তিত্ব সময়কে চ্যালেঞ্জ করে বার্তা পৌঁছে দিচ্ছে। কিন্তু যত বেশি সে ফাইল পড়ল, ততই বুঝতে পারল, অর্ণবের মৃত্যুর সঙ্গে এই চিঠির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। চিঠির কোনো লেখকের নাম নেই, কোনো ঠিকানা নেই, শুধু বার্তা—অর্ণবের অন্তরকে স্পর্শ করার মতো সরল কিন্তু ভয়ঙ্কর অভিব্যক্তি।
শম্ভু বুঝতে পারল, ডাক বিভাগের ভিতরই রহস্যের মূল দিকটি লুকিয়ে আছে। কোনো এক অদৃশ্য হাত, যা চিঠি পাঠাচ্ছে, সময়কে ভেঙে দিচ্ছে এবং অর্ণবের মৃত্যুর পরও বার্তাগুলো প্রেরণ করছে। প্রতিটি নথি, প্রতিটি তারিখ, প্রতিটি খামের নীল রঙ—সবই যেন এক এক করে শম্ভুর চোখের সামনে এক অদ্ভুত গল্প খুলে দিচ্ছে। খামের বার্তাগুলো কেবল স্মৃতি নয়, বরং কোনো ধ্বনিময় অস্তিত্বের উপস্থিতি, যা শম্ভুকে সরাসরি সম্বোধন করছে। তার মনে প্রশ্ন জাগল, “কেউ কি সত্যিই অর্ণবকে ভুলে যেতে দিচ্ছে না, নাকি এটি তার আত্মার আকুতি?” ডাক বিভাগের এই অদ্ভুত রহস্য, খামের অতীত এবং বর্তমানের মিলন, শম্ভুকে এক নতুন স্তরের অনুসন্ধানে টেনে নিল। সে জানল, শুধু অতীতের খোঁজ করলেই হবে না—এই খাম, এই চিঠি এবং এই রেকর্ডসমূহের মধ্য দিয়ে একটি গোপন শক্তি ক্রমশই ধীরে ধীরে তার চোখের সামনে প্রকাশ পাচ্ছে। শম্ভু বুঝতে পারল, এই রহস্যের অন্তরালে প্রবেশ করলে সে হয়তো এমন সত্যের মুখোমুখি হবে, যা শুধু অর্ণবের মৃত্যুর কারণই নয়, বরং সময় এবং মানবীয় অনুভূতির সীমারেখা পরীক্ষা করছে।
–
রাতের অন্ধকারে শম্ভু অর্ণবের পুরোনো বাড়ির দিকে পা বাড়াল। রাস্তায় আলো কম, বাতাসে অদ্ভুত শীতলতা, যেন কোনো অদৃশ্য শক্তি তাকে এই পথেই টেনে নিয়ে এসেছে। বাড়ির দরজা খোলা ছিল, কিন্তু ভেতরে ঢুকতে গিয়ে শম্ভুর চোখে প্রথমেই ধরা পড়ল ঘরের নীরবতা—শূন্যতা এবং শূন্যতার মধ্যে অদ্ভুত এক ওজন। হাওয়ায় নড়ে ওঠে কাগজ, টেবিলে পড়ে থাকে একগাদা নীল খাম, প্রতিটি খামের রঙ, আকার এবং অবস্থান যেন কোনাে পরিকল্পিত প্যাটার্নে সাজানো হয়েছে। শম্ভুর মনটা তখন এক অদ্ভুত উত্তেজনা আর ভয়ের মিশ্রণে দোলা খাচ্ছিল। সে ধীরে ধীরে ভিতরে ঢুকে দেখল, ঠিক টেবিলের পাশে বসে আছে একটি ছায়ামূর্তি, যা অর্ণবের মতোই দেখতে। চশমার নীচে অচেনা অথচ পরিচিত চোখ, দাড়ি-মুখে অর্ণবের স্মৃতি, এবং তার ভঙ্গি—সবকিছু যেন শম্ভুকে অতীতের সঙ্গে বর্তমানের মধ্যে ফাঁদে ফেলে দিল। হঠাৎ ছায়ামূর্তি ধীরে ধীরে কণ্ঠ তোলে, আর শম্ভুর কানে পড়ে অর্ণবের পরিচিত কণ্ঠ, “আমি মারা যাইনি, আমি কেবল ভুলে গিয়েছিলাম কে আমি।” এই শব্দগুলো শম্ভুর দেহে এক বিশাল কম্পন জাগিয়ে দিল। সে স্থির হয়ে দাঁড়াল, যেন না শ্বাস নিতে পারছে, না কণ্ঠ উচ্চারণ করতে।
শম্ভুর মন তখন এক অদ্ভুত দ্বন্দ্বে ভেঙে পড়ল। একদিকে মনে হচ্ছিল, এটি কোনো মানসিক বিভ্রম—শুধু তার দৃষ্টি, স্মৃতি এবং অতীতের আবেগ মিশিয়ে এমন কিছু দেখাচ্ছে। অন্যদিকে, যে ছায়ামূর্তিটি তার সামনে বসে আছে, তার অদ্ভুত বাস্তবতা শম্ভুকে বিশ্বাস করতে বাধ্য করছে। ছায়ার কণ্ঠ, হাওয়ায় নড়ে ওঠা কাগজ, এবং নীল খামের অবস্থান—সব মিলিয়ে মনে হচ্ছিল, অর্ণব সত্যিই এখানে উপস্থিত। শম্ভু কল্পনা করতে পারছিল না, কীভাবে কেউ একেবারে অদৃশ্য অথচ উপস্থিত হতে পারে। সে ধীরে ধীরে ছায়ার দিকে এগিয়ে গেল, চোখে চোখ রাখল। অর্ণবের চোখে অদ্ভুত নিঃশ্বাসের ছাপ, তার কথা বলার ভঙ্গি—সবই যেন অতীত এবং বর্তমানকে একত্রিত করছে। শম্ভু বুঝতে পারল, এই মুহূর্তে সে এক অদৃশ্য জগতে প্রবেশ করেছে, যেখানে মৃত্যু, স্মৃতি এবং পরিচয় একে অপরের সঙ্গে মিলিয়ে গেছে।
ছায়ামূর্তিটি ধীরে ধীরে বলল, “আমি বেঁচে আছি, কিন্তু আমি আর সেই অর্ণব নই, যাকে তুমি চিনতে চেয়েছিলে। আমি ভুলে গিয়েছি কে আমি।” শম্ভুর বুক কেঁপে উঠল, এবং মনে হল, এই সত্যকে গ্রহণ করতে তার হৃদয় প্রস্তুত নয়। কি এটি কোনো অতিপ্রাকৃত ঘটনা, নাকি অর্ণবের মানসিক বিভ্রমের প্রতিফলন—এ প্রশ্ন শম্ভুর মনে বারবার ঘুরতে লাগল। শম্ভু ধীরে ধীরে চেয়ার ধরে দাঁড়াল, টেবিলের খামের দিকে চোখ রাখল, যেখানে প্রতিটি খাম যেন একটি নতুন ইতিহাস খুলে দিচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, প্রতিটি খামের মধ্যে অর্ণবের আত্মার কোনো অংশ সংরক্ষিত আছে, যা তাকে সময়ের বাইরে টেনে নিয়ে আসছে। রাতে বাতাসে হঠাৎ এক অদ্ভুত নীরবতা বিরাজ করল, আর শম্ভু উপলব্ধি করল, এই মুহূর্তে সে কেবল অতীতের অর্ণবের মুখোমুখি নয়, বরং সেই অজানা ছায়ার জগতের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করেছে, যেখানে বাস্তবতা এবং বিভ্রমের সীমা মিলিয়ে গেছে। শম্ভুর শরীরে কাঁপুনি, মনোরম উত্তেজনা এবং অদ্ভুত ভয়—সবই একত্রিত হয়ে তাকে জানান দিচ্ছিল, এই রাতের মুখোমুখি দেখা তার জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত।
–
শম্ভু কল্পনাও করতে পারেনি যে তার হাতে যে নীল খামের শেষ চিঠি আসবে, তা তার নিজের নামে থাকবে। সন্ধ্যার ধূসর আলোয় চিঠির কাগজ স্পর্শ করতে গিয়ে হঠাৎ সে বুঝল, প্রতিটি শব্দ যেন সরাসরি তার মনের ভেতরে প্রবেশ করছে। কালি শুকনো, নীল খামের রঙ আগের মতোই গভীর, কিন্তু এইবার বার্তাটির আঘাত আরও তীব্র। ধীরে ধীরে শম্ভু চিঠি খুলল এবং চোখে পড়ল সেই অদ্ভুত বাক্য: “এবার তোমার পালা সত্য উন্মোচনের।” শব্দগুলো পড়তে পড়তে শম্ভুর মন অচেতন উত্তেজনা এবং ভয়ের মধ্যে দোলা খেল। প্রতিটি বার্তা, প্রতিটি খাম, প্রতিটি অক্ষর—সবই যেন তাকে একটি দীর্ঘ যাত্রার শেষ সীমায় পৌঁছে দিয়েছে, যেখানে রহস্য এবং বাস্তবতার সীমানা মিলিয়ে গেছে। সে বুঝতে পারল, নীল খামের রহস্য কেবল অর্ণবের মৃত্যু বা অতীতের অনিশ্চয়তার গল্প নয়, বরং শহরের মানুষের অস্বীকার করা অপরাধবোধ, নিঃশব্দ আঘাত এবং অন্ধকার অতীতের প্রতিচ্ছবি।
শম্ভু যখন আরও গভীরে চিন্তা করতে বসল, তখন সে উপলব্ধি করল, প্রতিটি খামের মাধ্যমে একটি অস্পষ্ট অথচ শক্তিশালী বার্তা পৌঁছানো হয়েছে—মানুষের নিজের সঙ্গে, সমাজের সঙ্গে এবং অতীতের সঙ্গে তার সম্পর্কের জটিলতা। শহরের বাসিন্দারা হয়তো অজ্ঞাতসারে সেই ঘটনাগুলোকে ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করেছে, অথবা লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করেছে, কিন্তু নীল খামের মাধ্যমে সেই সব ঘটনা আবার জীবন্ত হয়ে উঠেছে। চিঠিগুলোর উৎস কি অর্ণব নিজেই, নাকি তার অপরাধবোধে জর্জরিত বন্ধুরা, তা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। কখনও মনে হতে পারে, এটি কোনো ব্যক্তিগত প্রচেষ্টা—একজন মানুষ যা ভুলে যেতে চেয়েছে, তা আবার মনে করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা। আবার কখনও মনে হয়, এটি একটি সমষ্টিগত স্মৃতি—শহরের সকল মানুষের এক অজানা চেতনায় জমে থাকা অপরাধবোধ, যা নীল খামের আকারে চিরকাল বেঁচে থাকবে। শম্ভু অনুভব করল, এই রহস্যের গভীরতা এতোটাই জটিল যে এককভাবে এটি ব্যাখ্যা করা প্রায় অসম্ভব।
শেষ চিঠির বার্তায় শম্ভু অবশেষে উপলব্ধি করল, সত্য উন্মোচনের দায় এবার তার হাতে। সে বুঝল, নীল খামের প্রতিটি অক্ষর, প্রতিটি শব্দ, শুধুমাত্র অর্ণবের কণ্ঠ নয়, বরং মানুষের মনের গোপন অতীতের এক অদৃশ্য ছায়া। এই খামগুলো তাকে শুধু অতীতের অন্ধকারে নিয়ে যাচ্ছে না, বরং ভবিষ্যতের কাছে তার নিজের দায়িত্বও স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে—যে রহস্যের মুখোমুখি হওয়া তাকে সমাজ, বন্ধুত্ব, বিশ্বাসঘাতকতা এবং মানবীয় অপরাধবোধের সীমারেখায় দাঁড় করাচ্ছে। শম্ভু ধীরে ধীরে বুঝতে পারল, নীল খামের রহস্য কোনো একমাত্র উত্তর নিয়ে শেষ হয় না। এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া—যেখানে পাঠক, প্রাপক এবং শহরের মানুষদের নিজস্ব স্মৃতি ও অপরাধবোধ বারবার প্রতিফলিত হয়। চিঠিগুলোকে শেষবারের মতো হাতের মধ্যে ধরে শম্ভু অনুভব করল, এই নীল খামের ছায়া শুধু অর্ণবের জীবনের কথা নয়, বরং শহরের মানুষের এক সমষ্টিগত ইতিহাস, যা চিরকাল বেঁচে থাকবে, প্রশ্ন তুলবে এবং কখনো পুরোপুরি শান্ত হবে না।
***