অর্ণব দত্ত
পর্ব ১ — রাতের সেতু
হাওয়ায় গন্ধ ছিলো গরম লোহা আর নদীর শ্যাওলার। কলকাতার শহরতলির পুরনো লোহার সেতুটি রাত নামার পর যেন অন্য রকম হয়ে যায়—দিনে সে কত ব্যস্ত, ট্রাক, বাস, ভ্যানগাড়ি সব মিলিয়ে এক বিশৃঙ্খলা। অথচ গভীর রাতে, হঠাৎ করেই যেন সেতুর গায়ে সময় থেমে যায়। বাতাসে ভিজে ধাতব শব্দ বাজতে থাকে, দূরে নদীর স্রোত কালো তেলের মতো ঘন হয়ে বইতে থাকে, আর হাওয়ার ফাঁক দিয়ে মনে হয়, কারা যেন অদৃশ্য পায়ে সেতুর গায়ে হাঁটছে।
অনিকেত দাঁড়িয়ে ছিলো সেতুর মাঝখানে। হাতে সিগারেট, চোখ নদীর দিকে। সে একজন সাংবাদিক, তিরিশ পেরিয়েছে, জীবন তাকে খুব একটা সহজ কিছু দেয়নি। ছোট্ট কোনো প্রাদেশিক সংবাদপত্র থেকে শুরু করে, আজ শহরের একটি প্রখ্যাত দৈনিকের ক্রাইম বিটের দায়িত্ব তার হাতে। কাজের মধ্যে শীতলতা নেই, বরং ক্রমাগত উত্তাপ, প্রতিদিনই যেন কোনো না কোনো অদৃশ্য আগুনে ঝাঁপ দেওয়ার মতো। আর আজ রাতে সে এসেছে এখানে, কারণ একটি ফোন কল তাকে টেনে এনেছে—অজানা এক পুরুষের কণ্ঠস্বর, ধীর, মাপা, অথচ অদ্ভুত এক ভয় মিশে ছিলো তাতে।
“তুমি যদি সত্যিই জানতে চাও শহরের অন্ধকার কোথা থেকে জন্ম নেয়, রাত বারোটায় সেতুর মাঝখানে দাঁড়িও। আমি আসবো।”
অনিকেত ভেবেছিলো হয়তো নিছক কৌতুক, অথবা কোনো তথ্য ফাঁস করার নাটক। কিন্তু সাংবাদিকের রক্তে যে কৌতূহল বয়ে চলে, তাকে থামানো যায় না। সে তাই এসেছে। ফোনের মানুষটি এখনো আসেনি। চারদিক প্রায় নির্জন, কেবল নদীর শব্দ আর দূরের রেললাইনে ট্রেনের ধাক্কা।
তখনই সে শুনলো—ধীরে ধীরে হেঁটে আসছে কেউ। পায়ের শব্দ লোহার সেতুর গায়ে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে, যেন অদৃশ্য কেউ এগিয়ে আসছে। অন্ধকারের ভেতর থেকে এক জনা বেরিয়ে এল—চাদর গায়ে জড়ানো, মাথায় হুড তোলা। মুখ পুরোপুরি ঢাকা, কেবল চোখ দুটো দেখা যাচ্ছে। চোখের ভেতর অদ্ভুত শূন্যতা, যেন শূন্যতার গহ্বর থেকে তাকিয়ে আছে কেউ।
অনিকেত ঠোঁট শক্ত করল।
—“আপনি-ই ফোন করেছিলেন?”
কণ্ঠস্বর ধীর।
—“হ্যাঁ। কিন্তু এখানে বেশি কথা বলা নিরাপদ নয়। শহরের প্রতিটি অন্ধকার কোণে কানের মতো কিছু আছে, যা শোনে। তুমি কি ভয় পাও না?”
অনিকেতের ভেতরে কেমন যেন ঝড় উঠল। ভয়? সাংবাদিকতা তাকে ভয় থেকে মুক্ত করেনি, বরং প্রতিটি ভয়কে আলাদা করে চিনতে শিখিয়েছে।
—“আপনি আমাকে এখানে কেন ডেকেছেন?”
লোকটা আর এক পা এগিয়ে এল। বাতাসে গন্ধটা এবার তীব্র—চেনা নয়, হয়তো রাসায়নিক কিছুর মতো।
—“কারণ তুমি একমাত্র যে পারবে এই রহস্য খুলতে। শহরের ভেতরে যাদের ছায়া নড়ে, তারা কেবল অপরাধী নয়। তারা অদৃশ্য শক্তির অংশ। গত তিন মাসে যে খুনগুলো হয়েছে, তুমি ভেবেছো সেগুলো সাধারণ ক্রাইম? ভুল করছো। এগুলো এক খেলার অংশ, যা শুরু হয়েছে অনেক আগেই।”
অনিকেতের বুকের ভেতর চাপা উত্তেজনা। সে জানতো, শহরে একের পর এক খুন হচ্ছে—পুলিশের রিপোর্টে সেগুলোকে গ্যাং ওয়ার, চাঁদাবাজির খুন বলে চালানো হয়েছে। কিন্তু খুনগুলোর মধ্যে কোনো অদ্ভুত মিল খুঁজে পাচ্ছিল না পুলিশ। প্রতিটি মৃতদেহের বুকের ওপরে কাটা দাগ, যেন চিহ্ন।
—“আপনি কে?”
লোকটা কোনো উত্তর দিলো না। সে ছোট্ট একটা খাম এগিয়ে দিলো। অনিকেত হাত বাড়িয়ে নিতেই দেখল—খামের ওপরে কেবল একটা প্রতীক আঁকা: তিনটে সমান্তরাল দাগ, তীক্ষ্ণ নখের আঁচড়ের মতো।
—“এই প্রতীকের মানে কী?”
লোকটা ধীরে পেছন ঘুরে দাঁড়াল। তার কণ্ঠস্বর এবার ফিসফিস—
—“অদৃশ্য ছায়ারা জেগে উঠেছে। তাদের থামাতে না পারলে শহর ভেসে যাবে। তোমার হাতে সময় খুব কম।”
বলেই সে সেতুর অন্ধকারের ভেতর মিলিয়ে গেলো। অনিকেত কিছুক্ষণ স্তব্ধ দাঁড়িয়ে রইল। দূরে রাতের আলোয় সেতুটি যেন কেঁপে উঠছে।
কয়েক সেকেন্ড পর হঠাৎ করেই ফোন বেজে উঠল। নিজের ফোন নয়—খামটার ভেতরে ছোট্ট একটা পুরনো নোকিয়া মোবাইল। স্ক্রিনে কোনো নম্বর নেই, কেবল “Unknown Caller” লেখা। অনিকেত দোনামনা করেও কল ধরল। ওপাশে ভারী পুরুষ কণ্ঠ, ভয়ানক শান্ত।
—“তুমি ইতিমধ্যেই ফাঁদে পা দিয়েছো, অনিকেত। এই খেলার শুরু হয়েছে। শেষ কোথায়, তুমি কল্পনাও করতে পারবে না।”
কল কেটে গেল। চারদিক নিস্তব্ধ। কেবল নদীর কালো স্রোত আর সেতুর ধাতব শরীর কাঁপতে লাগল হাওয়ায়।
অনিকেত খামটা শক্ত করে চেপে ধরল হাতে। মনে হচ্ছিল, সে এমন এক দরজা খুলে ফেলেছে যেখান থেকে আর ফেরা সম্ভব নয়। রাতের সেতু যেন তাকে ঘিরে ধরছে, প্রতিটি হাওয়ার ঝাপটা তাকে মনে করাচ্ছে—কোথাও কেউ তাকিয়ে আছে।
তার মনে হঠাৎ একটা ছবি ভেসে উঠলো—তিন মাস আগে মেয়েটির দেহ, গঙ্গার ধারে পড়ে ছিলো। বুকের ওপরে একই দাগ। তখন ভেবেছিলো স্রেফ খুন। কিন্তু আজ বোঝা গেলো—এটা খুন নয়, এক ছায়ার খেলা।
অনিকেত সিগারেটটা ফেলে দিলো নদীর দিকে। শিখার মতো আলো মুছে গেল অন্ধকারে। আর সে বুঝলো, তার জীবন আজ থেকে আর আগের মতো থাকবে না।
পর্ব ২ — অন্ধকারের মানচিত্র
রাত তখন আড়াইটা ছুঁই ছুঁই। সেতু থেকে ফিরে আসার পরও অনিকেতের শরীরের ভেতর অদ্ভুত এক টানটান উত্তেজনা ছড়িয়ে আছে। সে বসে আছে তার ছোট্ট ভাড়া-বাড়ির ঘরে, দক্ষিণ কলকাতার গলি-পথে লুকোনো পুরনো এক বাড়ি, যেখানে কড়িকাঠের জানালা দিয়ে রাস্তায় নামা আলো ধুলো কেটে ঘরে ঢোকে। টেবিলের ওপরে সে ছড়িয়ে রেখেছে সেতু থেকে পাওয়া খামটা, আর খামের ভেতরের জিনিস—একটা পুরনো নোকিয়া ফোন, তিনটি আলাদা কাগজ, আর সেই রহস্যময় প্রতীকের কালি আঁকা কাগজ।
অনিকেত ধীরে ধীরে একটা কাগজ তুলল। সেখানে কিছু নাম লেখা, হাতে কলমে লেখা যেন। নামগুলো খুব অচেনা নয়—একজন পুরনো রাজনীতিক, এক ব্যবসায়ী, এক থিয়েটার অভিনেতা, আর এক তরুণ পুলিশ অফিসার। চারজনের নাম, আর প্রতিটির নিচে লাল কালি দিয়ে আঁকা সেই একই প্রতীক—তিনটি সমান্তরাল আঁচড়।
সে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এই নামগুলোকে সে চেনে, খবরের কাগজের পাতায় বহুবার এসেছে। কিন্তু তাদের মধ্যে সম্পর্ক কী? আর প্রতীকটার মানে কী? সে বুঝতে পারছে না।
তখনই সেই পুরনো ফোনটা কেঁপে উঠল। স্ক্রিনে নম্বর নেই, কেবল “Unknown Caller”। অনিকেত গলা শুকিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও কলটা ধরল। ওপাশ থেকে এবার অন্য কণ্ঠস্বর—গভীর নয়, বরং ফিসফিসের মতো, অথচ ভয়ানক ঠান্ডা।
—“ওরা সবাই একই খেলার অংশ। আর খেলার নিয়ম হল: কেউ বেঁচে থাকতে পারবে না।”
অনিকেত চমকে উঠে চেঁচিয়ে উঠল,
—“কে আপনি? এভাবে আমাকে তথ্য দিয়ে কী লাভ? আপনি কি চান আমি খুনিদের ধরব?”
ওপাশ থেকে হাসির শব্দ।
—“খুনি? ওদের খুনি বললে ভুল হবে। ওরা খেলোয়াড়। তুমি যদি সত্যিই বোঝো, তাহলে দেখবে—শহরের মানচিত্রটা বদলে গেছে। প্রতিটি রাস্তায়, প্রতিটি অন্ধকারে কিছু চিহ্ন আছে। খুঁজে বের করো। কিন্তু মনে রেখো, তুমি একবার ঢুকেছো। বেরোবার রাস্তা নেই।”
কল কেটে গেল।
অনিকেত টেবিলে হাত দিয়ে বসে রইল। মাথার ভেতর ঝড়। সাংবাদিকতা তাকে শিখিয়েছে সূত্র খুঁজতে, কিন্তু এই সূত্রগুলো ভিন্ন। এগুলো কেবল কাগজের খবর নয়, বরং অদৃশ্য শক্তির ছায়া।
সে আবার খামটার ভেতরের দ্বিতীয় কাগজটা তুলল। সেখানে একটা অদ্ভুত মানচিত্র আঁকা। শহরের একাংশ, কিন্তু সাধারণ মানচিত্র নয়। চিহ্নগুলো রাস্তার নাম নয়, বরং প্রতীকের ছড়া। তিনটি আঁচড়, কোনো মোড়ের পাশে। পাঁচটা আঁচড়, কোনো বাজারের পাশে। লাল বিন্দু এক পুরনো সিনেমা হলের মাথায়।
অনিকেতের মনে পড়লো, ওই সিনেমা হলটার ভেতরে কয়েক সপ্তাহ আগে একটা খুন হয়েছিলো—অজ্ঞাতপরিচয় এক তরুণীকে মৃত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিলো। বুকের ওপর একই দাগ। পুলিশ তদন্ত করেছিলো, কিন্তু কোনো সূত্র পায়নি। আর আজ এই মানচিত্র প্রমাণ করছে, সবকিছুই এক জালে বাঁধা।
সে টেবিলের কোণায় রাখা নোটবই টেনে নিলো। তাতে লিখল:
১. নামের তালিকা—রাজনীতিক, ব্যবসায়ী, অভিনেতা, পুলিশ অফিসার।
২. প্রতীক—তিন আঁচড়।
৩. মানচিত্র—পুরনো সিনেমা হল, কয়েকটি নির্দিষ্ট বাজার।
তারপর সে মাথার ভেতর এক প্রশ্ন নিয়ে চুপচাপ বসে থাকল—এরা সবাই কি একে একে মরবে? আর সেটা যদি হয়, তবে তাকে এই অদৃশ্য ছায়ারা ব্যবহার করছে কেন?
রাত আরও গভীর হল। রাস্তার ওপাশে কুকুর ঘেউ ঘেউ শুরু করল। হঠাৎ দরজায় ধাক্কা। অনিকেত চমকে উঠল। এত রাতে কে আসতে পারে? সে ধীরে ধীরে দরজা খুলল। কেউ নেই। শুধু দরজার ফাঁকে গুঁজে রাখা আরেকটা ছোট খাম।
ভেতরে একটিমাত্র কাগজে লেখা:
“তুমি যদি সত্যি জানতে চাও, কাল ভোরে শিয়ালদহ স্টেশনে আসো। প্ল্যাটফর্ম নম্বর ১২।”
অনিকেত বুকের ভেতর কেমন একটা ঠান্ডা শীতলতা টের পেলো। শিয়ালদহ—শহরের নাড়ি। সেখানকার ভিড়ের ভেতর অদৃশ্য হয়ে যেতে কত সহজ। কে ডেকে নিচ্ছে তাকে সেখানে?
সে আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ল, কিন্তু চোখে ঘুম এলো না। প্রতিটি শব্দে মনে হচ্ছিল কেউ যেন তাকিয়ে আছে। প্রতিটি ছায়ায় লুকিয়ে আছে অদৃশ্য চোখ।
ভোরের আলো ফোটার আগেই অনিকেত উঠে পড়ল। ব্যাগে নোটবই, কলম, আর ক্যামেরা। খামটা পকেটে রেখে বেরিয়ে পড়ল। রাস্তার বাতিগুলো তখনো জ্বলছে, পাখিরা ডেকে উঠছে অস্থির ভোরে।
শিয়ালদহ পৌঁছে সে প্ল্যাটফর্ম ১২-এর দিকে গেলো। ভিড় ততটা নেই, কেবল কিছু যাত্রী, চা বিক্রেতা, আর হকার। প্ল্যাটফর্মের মাথায় হঠাৎ সে চোখে পড়লো—একজন নারী দাঁড়িয়ে আছে, লাল শাড়ি, চুল খোলা, চোখে কালো কাজল। সে সোজা তাকিয়ে আছে অনিকেতের দিকে।
অনিকেত থেমে গেলো। নারী ধীরে ধীরে এগিয়ে এল। ঠান্ডা কণ্ঠে বলল,
—“তুমি যেটা খুঁজছো, সেটা খবর নয়। এটা রক্তের খেলা। এখানে সত্যিই ঢুকলে আর ফিরে যেতে পারবে না।”
অনিকেত শক্ত গলায় বলল,
—“আপনি কে?”
নারী হাসল।
—“আমি সেই অদৃশ্য ছায়াদের একজন। কিন্তু আমি তোমার শত্রু নই। বরং আমি তোমাকে বাঁচাতে চাই। ওরা তোমাকে ফাঁদে ফেলছে।”
অনিকেতের চোখ বড় হয়ে গেলো।
—“কে ওরা?”
নারী মুখ ঘুরিয়ে নিলো।
—“যারা এই শহরের প্রতিটি অন্ধকারে দাগ কেটে দিয়েছে। আগামী রাতে আবার তোমার কাছে বার্তা আসবে। তার আগে কিছুতেই মানচিত্রের লাল বিন্দুগুলোতে যেও না।”
বলেই নারী ভিড়ের ভেতর মিলিয়ে গেলো। অনিকেত হকচকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল, চারপাশে মানুষের ঢেউ। তার হাতে এখনো মানচিত্রটা ধরা। লাল বিন্দুগুলো যেন হঠাৎ জ্বলজ্বল করে উঠছে।
সে বুঝলো—খেলার দ্বিতীয় অধ্যায় শুরু হয়ে গেছে।
পর্ব ৩ — রক্তের সিগন্যাল
শিয়ালদহ থেকে বেরিয়ে আসার সময় অনিকেতের মনে হচ্ছিল, শহরের প্রতিটি মুখ যেন তাকে লক্ষ্য করছে। সে জানত, ভিড়ের ভেতরে অদৃশ্য হয়ে যাওয়া সবচেয়ে সহজ কাজ। আর সেই নারী—যে নিজেকে অদৃশ্য ছায়াদের একজন বলল—কোন দিক দিয়ে মিলিয়ে গেল, সে আর খুঁজে পেল না। চারপাশে শুধু লোকজনের কোলাহল, চায়ের ভাঁড়ের শব্দ, আর রেলের হুইসেল। কিন্তু অনিকেতের মাথার ভেতর তখন একটাই প্রতিধ্বনি: “আগামী রাতে আবার বার্তা আসবে। তার আগে কিছুতেই মানচিত্রের লাল বিন্দুগুলোতে যেও না।”
কিন্তু সাংবাদিকতা মানে কেবল তথ্য নেওয়া নয়, তথ্যকে প্রশ্ন করা। কেন সে যাবে না? সেই লাল বিন্দুগুলোতেই তো সূত্র লুকিয়ে আছে।
দুপুর নাগাদ অনিকেত অফিসে পৌঁছল। সম্পাদকীয় কক্ষে গিয়ে সরাসরি বসলো কম্পিউটারের সামনে। ফাইল খুলে সে খুঁজতে লাগল শেষ কয়েক মাসের অপরাধ সংক্রান্ত রিপোর্ট। প্রতিটি খুনের জায়গা মানচিত্রে বসিয়ে দিল। কিছুক্ষণের মধ্যে আঁকাবাঁকা লাল রেখা ফুটে উঠল স্ক্রিনে। আর অবাক হয়ে দেখল—সব ঘটনাই মানচিত্রের ওই চিহ্নগুলোর আশেপাশে ঘটেছে। পুরনো সিনেমা হল, বাজার, এমনকি গুদামঘর।
তার পাশেই সহকর্মী তনিমা দাঁড়িয়ে কফির মগ হাতে।
—“আবার কীসে ডুবে আছো, অনিকেত?”
অনিকেত তাকালো না। শুধু বলল,
—“তুমি কি মনে করো, এই শহরের সব খুন কেবল গ্যাং ওয়ার?”
তনিমা মুচকি হাসল।
—“তুমি যদি এসব বলতে শুরু করো, আমাদের নিউজরুমের সবাই হাসবে। এখানে প্রতিটি খুনই কোনো না কোনো রাজনৈতিক লড়াইয়ের ফল। তুমিই বা কেন এমন ভাবছো?”
অনিকেত এক মুহূর্ত দ্বিধা করে খামের কাগজগুলো দেখাল না। এসব প্রকাশ করা এখনো নিরাপদ নয়। শুধু মাথা নাড়ল।
—“হয়তো ঠিক বলছো।”
কিন্তু তার মন বলছিল, খুনগুলোর পেছনে গভীর কোনো খেলা আছে।
সন্ধের দিকে হঠাৎ তার পকেটের ভেতর রাখা সেই পুরনো নোকিয়া ফোনটা কেঁপে উঠল। অফিসের ভিড়ের মধ্যে সে ফোনটা নিয়ে ছুটে বেরোল করিডোরে। ওপাশে আবার সেই ফিসফিস কণ্ঠ।
—“আজ রাত বারোটায় মানচিত্রের প্রথম লাল বিন্দুতে এসো। পুরনো সিনেমা হল। দেরি করলে মৃত্যু দেখবে।”
অনিকেতের গলা শুকিয়ে গেল।
—“কেন আমাকে ডাকছো? আমি তো সাংবাদিক। আমি কেন যাবো?”
ওপাশে হেসে উঠল কণ্ঠস্বর।
—“কারণ তুমিই একমাত্র যে ছায়াদের থামাতে পারবে। আর যদি না যাও, তবে কাল সকালের পত্রিকায় এমন একটা ছবি ছাপা হবে যা তুমি সারাজীবন ভোলার মতো নয়।”
কল কেটে গেল।
অনিকেত বুঝলো, এবার আর পিছু হটার উপায় নেই। রাতের অপেক্ষা ছাড়া আর কোনো রাস্তা নেই।
রাত বারোটার কিছু আগে সে পৌঁছল সেই পুরনো সিনেমা হলের সামনে। একসময় যেখানে ভিড় ভেঙে পড়ত, এখন সেটা ভাঙাচোরা এক দালান, দরজায় তালা ঝুলছে, দেওয়ালের গায়ে পলেস্তারা খসে পড়েছে। চারপাশ ফাঁকা, কেবল বাতাসের শব্দ।
সে ক্যামেরা হাতে নিলো। সাংবাদিকের স্বভাবসিদ্ধ অভ্যাস—যে ঘটনাই ঘটুক, প্রমাণ রাখতে হবে।
হঠাৎ ভেতর থেকে একটা কর্কশ শব্দ এল। তালাটা যেন ভেতর থেকে নড়ল। অনিকেত সাবধানে এগিয়ে গেল। তালাটা অদ্ভুতভাবে খুলে গেল, যেন কেউ অপেক্ষা করছিল।
ভেতরে অন্ধকার। মশার ভনভন আর ছাদের ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলো পড়ছে। অনিকেত ধীরে ধীরে হাঁটতে লাগল করিডোরে। হঠাৎ চোখে পড়ল মেঝেতে কিছু দাগ—তাজা রক্তের মতো লাল।
সে বুক ধকধক করতে করতে এগিয়ে গেল। সামনের হলে ঢুকতেই গা শিউরে উঠল। একদম মাঝখানে পড়ে আছে এক তরুণের দেহ, বুকের ওপর তিনটি সমান্তরাল আঁচড়। চারপাশে ছায়া নড়ছে, যেন দেয়ালের ভেতর থেকে কেউ তাকিয়ে আছে।
অনিকেত ক্যামেরা তোলার আগেই হঠাৎ কারো ঠান্ডা হাত তার কাঁধে পড়ল। ঘুরে দাঁড়াতেই দেখল—কালো পোশাক পরা কয়েকজন দাঁড়িয়ে। মুখ ঢাকা, কেবল চোখ দেখা যাচ্ছে।
তাদের একজন বলল,
—“খবরের মানুষ এসে গেছে। এবার খেলা শুরু হোক।”
অনিকেত দৌড়ে পালাতে চাইলো, কিন্তু দরজাগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। হলঘর যেন এক ফাঁদ। কালো পোশাকধারীরা তাকে ঘিরে ফেলছে।
ঠিক তখনই একটা তীব্র আলো ঝলসে উঠল। কারা যেন টর্চ মেরে ভেতরে ঢুকেছে। পুলিশের ইউনিফর্মের ছায়া চোখে পড়ল। কালো পোশাকধারীরা ছায়ার মতো মিলিয়ে গেল অন্ধকারে। অনিকেত হাঁপাতে হাঁপাতে দাঁড়িয়ে রইল।
একজন তরুণ পুলিশ অফিসার এগিয়ে এসে বলল,
—“আপনি সাংবাদিক অনিকেত? আপনাকে এখানেই পাওয়া গেল কেন?”
অনিকেত উত্তর দিতে পারল না। শুধু রক্তমাখা দেহটার দিকে তাকিয়ে রইল। বুকের ওপর আঁচড় যেন জ্বলজ্বল করছে।
অফিসার ঠান্ডা গলায় বলল,
—“আপনি বিপদে আছেন। এই খেলায় ঢুকলে বেরোবার রাস্তা নেই।”
অনিকেত হেসে উঠল তিক্তভাবে।
—“বেরোবার রাস্তা তো অনেক আগেই বন্ধ হয়ে গেছে।”
সে বুঝলো, অদৃশ্য ছায়াদের খেলা এখন তাকে নিয়েই এগোবে।
পর্ব ৪ — মৃতের কণ্ঠস্বর
পুরনো সিনেমা হল থেকে বের হওয়ার সময় ভোরের আলো ফুঁটে উঠেছে। পুলিশের লালবাতি জ্বলছে বাইরে, ভিড় জমেছে। দেহটা কাপড়ে ঢেকে নিয়ে যাচ্ছে ফরেনসিক দল। কিন্তু অনিকেতের চোখ এখনো আটকে আছে বুকের উপরকার তিন আঁচড়ে। যেন লালচে দাগগুলো এখনও চিৎকার করছে।
তরুণ পুলিশ অফিসার, যাকে সে রাতের শেষে দেখেছিল, তার নাম দেবজ্যোতি। অনিকেত তাকে চিনত নামমাত্র—নতুন পোস্টিং পেয়েছে শহরে। সোজা কথা বলে, কিন্তু চোখে যেন চাপা রহস্য।
দেবজ্যোতি ধীরে বলল,
—“অনিকেতবাবু, আপনি একা এখানে কীভাবে এলেন? পুলিশি অনুমতি ছাড়া এভাবে অপরাধস্থলে থাকা আপনাকে সমস্যায় ফেলতে পারে।”
অনিকেত গলা শক্ত করল।
—“আমাকে এখানে আসতে বলা হয়েছিল। এই খেলার পেছনে যা আছে, তার ছায়া আপনারা বুঝতে পারছেন না।”
দেবজ্যোতি একমুহূর্ত চুপ করে থাকল। তারপর বলল,
—“আপনি মনে করছেন শুধু খুন হচ্ছে? না। এর পেছনে এক অদৃশ্য জাল রয়েছে। কিন্তু এটাকে ধরা সহজ নয়। কারণ খুনিরা মানুষ নয়—ছায়া।”
অনিকেতের বুক কেঁপে উঠল। পুলিশের অফিসারই যদি এভাবে ভাবে, তবে রহস্যটা আরও গভীর।
অফিসে ফিরেই সে তার কেবিনে দরজা বন্ধ করল। টেবিলের ওপর মানচিত্রটা মেলে ধরল। প্রথম লাল বিন্দু—সিনেমা হল—এখন আর কেবল বিন্দু নয়, রক্তের প্রতীক। বাকিগুলো? বাজার, গুদাম, পুরনো লাইব্রেরি—সব জায়গায় কি একই খুন হবে?
সে নোটবইয়ে লিখতে লাগল। হাত কাঁপছে। তখনই পকেটের ভেতর ফোনটা কেঁপে উঠল—আবার সেই পুরনো নোকিয়া।
ওপাশে ভাঙা ভাঙা কণ্ঠস্বর। মনে হচ্ছিল যেন মৃত কেউ কথা বলছে। গলা ভাঙা, কর্কশ, কিন্তু স্পষ্ট।
—“অনিকেত, তুমি আমার মৃত্যুর সাক্ষী ছিলে। আমি শেষ বিন্দুতে পড়ে আছি। আমার শরীর চলে গেছে, কিন্তু কণ্ঠটা রয়ে গেছে। মানচিত্রের প্রতিটি বিন্দু মানে একেকটা আত্মা বাঁধা। তারা ছায়াদের হাতে বন্দি।”
অনিকেতের শরীর শিউরে উঠল।
—“তুমি কে?”
—“যাকে আজ রাতে সিনেমা হলে দেখেছো। আমি এখন মৃত। কিন্তু আমার কণ্ঠ তোমার কানে পৌঁছোচ্ছে। তোমাকে থামাতে হবে খেলা। না হলে প্রতিটি লাল বিন্দু নতুন মৃতদেহে ভরে যাবে।”
অনিকেত কাঁপা গলায় বলল,
—“কিন্তু আমি কীভাবে থামাবো?”
ফোনের ওপাশে শুধু একটাই শব্দ প্রতিধ্বনিত হলো—
—“চিহ্ন… চিহ্ন ভেঙে দাও।”
তারপর নীরবতা।
অনিকেত ফোনটা মেঝেতে ফেলে দিল। কপালে ঘাম জমেছে। মৃতের কণ্ঠস্বর—এটা কি সম্ভব? নাকি কেউ ভয় দেখাতে চাইছে? কিন্তু গলার ভেতরকার কাঁপন সত্যি ছিল, যেন আত্মা কথা বলছে।
পরদিন সন্ধ্যায় সে দেবজ্যোতির সঙ্গে দেখা করল এক চায়ের দোকানে। চারপাশে মানুষের ভিড়, ধোঁয়া, চায়ের গন্ধ। দেবজ্যোতি সরাসরি বলল,
—“আপনাকে আমি বিশ্বাস করি, অনিকেতবাবু। আপনার কাছে নিশ্চয়ই কিছু আছে যা আমাদের নেই।”
অনিকেত খামটা বের করল না, কিন্তু বলল,
—“আমার কাছে কিছু সূত্র আছে। মানচিত্র, নামের তালিকা। এগুলো মিলছে প্রতিটি খুনের সঙ্গে। কিন্তু আজ সকালে আমি মৃত মানুষের কণ্ঠস্বর শুনেছি।”
দেবজ্যোতি চোখ বড় করল।
—“মৃত মানুষের কণ্ঠস্বর?”
অনিকেত মাথা নাড়ল।
—“হ্যাঁ। সে বলেছিল, প্রতিটি বিন্দু একেকটা আত্মা বাঁধা।”
চায়ের দোকানের আলো-আঁধারিতে দেবজ্যোতির মুখ আরও কঠিন হয়ে উঠল।
—“তাহলে সত্যিই কিছু আছে যা আমাদের চোখে পড়ছে না। আমি চাই আপনি আমাকে সেই মানচিত্রটা দেখান।”
অনিকেত চুপ করে রইল। সাংবাদিকের নীতি বলে সব কিছু পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া যায় না। কিন্তু একা এগোনোও সম্ভব নয়।
ঠিক তখনই পাশের টেবিলে বসে থাকা এক ভিখিরি হঠাৎ মাথা তুলে তাকাল অনিকেতের দিকে। চোখ দুটো ভয়ানক জ্বলছে। সে ফিসফিস করে বলল,
—“চিহ্ন ভেঙো না, না হলে শহর ভেঙে যাবে।”
অনিকেতের শরীর ঠান্ডা হয়ে গেল। ভিখিরি হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল ভিড়ের ভেতরে।
দেবজ্যোতি অবাক হয়ে তাকাল।
—“আপনার পেছনে যেন ছায়া লেগে আছে।”
সেই রাতে অনিকেত ঘরে বসে টেবিলের ওপর মানচিত্রটা তাকিয়ে দেখছিল। হঠাৎ চোখে পড়ল—লাল বিন্দুগুলোকে যদি রেখা দিয়ে জোড়া হয়, তবে একটা প্রতীক ফুটে ওঠে। তিন আঁচড় নয়, বরং এক অদ্ভুত বৃত্ত, যার মাঝখানে শূন্য।
সে বুঝলো, এই খেলা শুধু খুন নয়, বরং কোনো আচার। প্রতিটি মৃত্যু একেকটা রক্তের সিগন্যাল। আর সব বিন্দু একসাথে হলে শহরের ভেতরে জেগে উঠবে এক ছায়ার দুনিয়া।
ঠিক তখনই জানালার বাইরে হাওয়া বয়ে এল। জানালা ঠক করে খুলে গেল। বাইরে দাঁড়িয়ে সেই নারী—লাল শাড়ি, খোলা চুল। ঠান্ডা গলায় বলল,
—“আমি তোমাকে বাঁচাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তুমি এবার অনেক দূর চলে এসেছো। আগামী বিন্দুটি কাল রাতেই জ্বলবে।”
অনিকেত কাঁপা গলায় বলল,
—“কোন বিন্দু?”
নারী ধীরে ধীরে ফিসফিস করে বলল,
—“লাইব্রেরি।”
বলেই মিলিয়ে গেল অন্ধকারে।
অনিকেত টেবিলে মাথা ঠেকিয়ে বসে রইল। শহরের বুক কাঁপছে। প্রতিটি রাত একেকটা নতুন খুনের প্রতিশ্রুতি। আর সে জানে, এখন আর পিছিয়ে যাওয়ার রাস্তা নেই।
পর্ব ৫ — লাইব্রেরির ছায়া
রাত সাড়ে এগারোটা। আকাশে ঘন মেঘ, চাঁদ ঢাকা। দক্ষিণ কলকাতার পুরনো লাইব্রেরি—একসময় যেখানে পাঠকের ভিড় থাকত, এখন সেখানে জড়ো হয় কেবল ধুলো আর নিস্তব্ধতা। মোড়ের মাথায় আলো জ্বলে-নিভে কাঁপছে, যেন অদৃশ্য কোনো হাত বারবার সুইচ টিপছে।
অনিকেত মানচিত্রের দিকে তাকাল। নারীটি আগের রাতে বলেছিল, পরের বিন্দু লাইব্রেরি। তার মানে এখানে কিছু ঘটতে চলেছে। হাতে নোটবই আর ছোট ক্যামেরা। বুকের ভেতরে শীতল ভয় জমছে, কিন্তু সে জানে, আর পিছিয়ে যাওয়া চলবে না।
গেটের তালা অদ্ভুতভাবে খোলা। ভিতরে ঢুকতেই পচা কাগজের গন্ধ আর ছাদের ফাটল দিয়ে পড়া বৃষ্টির জল মেঝেতে জমে আছে। দেয়ালে ধুলো জমা বইয়ের তাক—অর্ধেক ভাঙা, অর্ধেক হেলে পড়েছে। অন্ধকারের মধ্যে মৃদু আলো ফোটাচ্ছে একটি লণ্ঠন, কে যেন আগে থেকে রেখে গেছে।
অনিকেত ধীরে ধীরে ভেতরে পা বাড়াতেই সে শুনল, পাতার শব্দের মতো হালকা কিছু আওয়াজ। যেন অদৃশ্য পাঠকরা বই উল্টে যাচ্ছে। বুকের মধ্যে কাঁপন বাড়ল। সে এগিয়ে গেল। তখনই চোখে পড়ল মাঝের টেবিলে খোলা এক বিশাল বই। পাতার ওপরে লাল দাগ, শুকনো রক্তের মতো।
কাছে যেতেই দেখল, বইটিতে হাতে লেখা নাম। প্রতিটি নামের পাশে সেই ভয়ঙ্কর তিন আঁচড়ের প্রতীক। আর তালিকার শেষ নাম—অনিকেত চৌধুরী।
সে স্তব্ধ হয়ে গেল। ঠান্ডা ঘাম গড়িয়ে পড়ল কপালে।
ঠিক তখনই মৃদু শব্দে ভেসে এল ফিসফিস—
—“তুমি দেরি করে ফেলেছো।”
অনিকেত ঘুরে দাঁড়াতেই দেখতে পেল একদল কালো পোশাকধারী দাঁড়িয়ে আছে বইয়ের তাকের ফাঁক দিয়ে। মুখ ঢাকা, চোখ জ্বলছে অদ্ভুত আলোয়। তাদের একজন সামনে এসে দাঁড়াল।
—“তুমি আমাদের খেলার বইয়ে এখন লিখিত। প্রতিটি নাম মানে এক আত্মা। আজ রাতে তোমার নামও রক্ত দিয়ে সিল হবে।”
অনিকেত ক্যামেরা তুলতেই হঠাৎ বাতাস কেঁপে উঠল। টেবিলের বই নিজে নিজেই বন্ধ হয়ে গেল, আর কালো পোশাকধারীরা মিলিয়ে গেল অন্ধকারে। নিস্তব্ধতা ফিরে এল, কেবল লণ্ঠনের আলো কাঁপছে।
অনিকেত হাঁপাতে হাঁপাতে দাঁড়িয়ে রইল। হঠাৎ পিছনে কণ্ঠস্বর।
—“আমি বলেছিলাম, এখানে আসবে না।”
সেই নারী। লাল শাড়ি, খোলা চুল, চোখে গভীর অন্ধকার।
অনিকেত ক্ষীণ গলায় বলল,
—“তাহলে কেন আমার নাম ওই বইতে লেখা? আমি কে?”
নারী ঠান্ডা গলায় বলল,
—“তুমি সাক্ষী। ছায়াদের খেলায় সাক্ষী মানেই শিকার। তারা তোমাকে ধ্বংস করবে, কারণ তুমি তাদের প্রতীক ভাঙতে পারো।”
অনিকেত রাগে চিৎকার করে উঠল।
—“কিন্তু কেন আমিই? আমি তো কেবল একজন সাংবাদিক!”
নারী ধীরে এগিয়ে এল।
—“তুমি সেই রক্তের ধারাবাহিকতা ভাঙার জন্য বেছে নেওয়া মানুষ। তোমার রক্তই পারে মানচিত্রের বৃত্ত থামাতে। কিন্তু তার মানে… তোমার মৃত্যু।”
অনিকেত পিছিয়ে গেল। কণ্ঠস্বর কেঁপে উঠল।
—“তুমি কি আমার পক্ষে নাকি ওদের?”
নারী থেমে গেল। তারপর ফিসফিস করে বলল,
—“আমি একসময় ওদেরই একজন ছিলাম। অদৃশ্য ছায়াদের ভেতরে বাঁধা ছিলাম। কিন্তু আমি পালিয়ে এসেছি। এখন চাই না শহর ভেসে যাক।”
ঠিক তখনই বাইরে থেকে সাইরেন বাজল। দেবজ্যোতি লাইব্রেরির সামনে পৌঁছেছে। পুলিশের টর্চের আলো ভেতরে পড়তেই নারী মিলিয়ে গেল অন্ধকারে।
দেবজ্যোতি ছুটে এল,
—“অনিকেতবাবু! আপনি একা এখানে কেন? কী হয়েছে?”
অনিকেত কাঁপা হাতে বইয়ের দিকে দেখাল। কিন্তু টেবিলটা খালি। বই নেই, রক্তের দাগ নেই, কিছুই নেই।
দেবজ্যোতি অবিশ্বাসের চোখে তাকাল।
—“আপনি কি নিশ্চিত? এখানে তো কিছুই নেই।”
অনিকেত চুপ করে রইল। তার বুকের ভেতর ঝড় চলছে। প্রতিটি মুহূর্তে সত্যি আর মায়া মিশে যাচ্ছে।
সকালে অফিসে ফিরে অনিকেত খবর পেল—আরেকজন ব্যবসায়ীর দেহ পাওয়া গেছে বেলেঘাটা বাজারের কাছে। বুকের ওপর সেই একই তিন আঁচড়। পুলিশের রিপোর্টে লেখা, গ্যাং ওয়ার। কিন্তু সে জানে, এটা একই খেলার অংশ।
সে সম্পাদককে কিছু না বলে ডেস্কে বসে রইল। মানচিত্র খুলল। লাল বিন্দুগুলো একে একে জ্বলছে তার চোখে। আর নিজের নাম এখনও খোদাই হয়ে আছে মনের ভেতরে।
ঠিক তখনই আবার সেই পুরনো নোকিয়া কেঁপে উঠল। কল ধরতেই ভাঙা ভাঙা কণ্ঠস্বর—
—“তুমি লাইব্রেরিতে গিয়েছিলে। তুমি বই দেখেছো। এখন তোমার জীবন সময়ের ওপর দাঁড়িয়ে। পরের বিন্দু গুদামঘর। যদি সাহস থাকে, এসো। না হলে তোমার নামের পাশে রক্ত জেগে উঠবে।”
অনিকেত চুপ করে ফোনটা কানে ধরে রইল। তার ভেতরে কেবল একটাই উপলব্ধি—এই খেলা থেকে ফেরার কোনো রাস্তা নেই। ছায়াদের অদৃশ্য হাত এখন তার গলায় শক্ত করে জড়িয়ে আছে।
কিন্তু সে জানে, তাকে সত্যিটা লিখতে হবে।
পর্ব ৬ — গুদামঘরের আগুন
বিকেলের শেষ আলো মিলিয়ে গিয়েছিল। আকাশে মেঘ ঘনিয়ে আসছিল যেন শহরটার বুক চাপা দেওয়ার জন্য। অনিকেত ছোট ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে ট্যাক্সি থেকে নামল বন্দর এলাকার পুরনো গুদামঘরের সামনে। চারদিক নির্জন, শুধু দূরে বালি বোঝাই ট্রাকের গর্জন। নদীর কাদা গন্ধ আর মরচে ধরা লোহার শিকল মিলে হাড় পর্যন্ত কাঁপিয়ে দিচ্ছে।
গুদামঘরটা বিশাল, লোহার দরজা অর্ধেক ভাঙা। ভেতরে ঢুকতেই কেবল অন্ধকার আর স্যাঁতসেঁতে বাতাস। মেঝেতে ছড়ানো কার্টন, ভাঙা আসবাব, ছাদের থেকে ঝুলে থাকা মরচেধরা হুক। অনিকেত টর্চ জ্বালাতেই দেয়ালে ছায়া দুলতে লাগল।
সে জানত, ফোনের ওপাশের কণ্ঠ বলেছিল এখানেই পরের খেলা। তার বুকের ভেতরে আতঙ্ক আর কৌতূহল সমান তালে দৌড়াচ্ছে।
হঠাৎ একটা শব্দ—লোহার জিনিস মেঝেতে পড়ে যাওয়ার আওয়াজ। অনিকেত টর্চ ঘুরিয়ে দিল। দেখল, একপাশে একটা দেহ পড়ে আছে। এক তরুণ, বুকের ওপরে তিন আঁচড়। চোখ খোলা, শূন্যে তাকিয়ে।
অনিকেত ক্যামেরা তুলতেই পিছন থেকে ফিসফিস আওয়াজ।
—“তুমি আবারও দেরি করে ফেলেছো।”
সে ঘুরে দাঁড়াতেই কয়েকজন কালো পোশাকধারী তাকে ঘিরে ধরল। তাদের চোখে অদ্ভুত শীতলতা, ঠোঁটে অল্প হাসি। একজন বলল,
—“তোমার নাম বইতে লেখা আছে। এবার তোমার পালা।”
অনিকেত পালাতে চাইলো। কিন্তু দরজাটা হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল কর্কশ শব্দে। চারদিক অন্ধকার আরও ঘন হয়ে উঠল। কালো পোশাকধারীরা ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে।
ঠিক তখনই দরজার বাইরে পুলিশের সাইরেন বাজল। টর্চের আলো ঢুকে পড়তেই ছায়াগুলো মিলিয়ে গেল অদৃশ্য হয়ে। দরজা খুলে দেবজ্যোতি ঢুকে এল কয়েকজন কনস্টেবল নিয়ে।
দেবজ্যোতি চেঁচিয়ে উঠল,
—“অনিকেতবাবু! আপনি একা এখানে এলেন কেন?”
অনিকেত হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,
—“আমি দেরি করেছি… আরেকটা দেহ পড়ে আছে।”
কিন্তু চারদিকে আলো ফোটাতেই দেখা গেল মেঝেটা ফাঁকা। কোনো দেহ নেই, কোনো রক্ত নেই। শুধু ছড়ানো কার্টন।
দেবজ্যোতি অবিশ্বাসের চোখে তাকাল।
—“আপনি কি নিশ্চিত? এখানে তো কিছুই নেই।”
অনিকেত মাথা চেপে ধরল। সে নিশ্চিত ছিল দেহ দেখেছে। কিন্তু এখন যেন সব মুছে গেছে। সত্যি আর মায়া এক হয়ে গেছে।
গুদাম থেকে বেরিয়ে নদীর ধারে দাঁড়াল অনিকেত। বাতাসে লবণাক্ত কাদা গন্ধ। তার মনে হচ্ছিল কেউ তার কানে ফিসফিস করছে। হঠাৎ ফোনটা আবার কেঁপে উঠল। পুরনো নোকিয়া।
ওপাশে সেই কর্কশ কণ্ঠ—
—“তুমি প্রমাণ খুঁজছো? প্রমাণ কখনো থাকবে না। কারণ আমরা ছায়া। ছায়ার রক্ত নেই, ছায়ার দেহ নেই। কিন্তু ছায়া মানুষ মারে।”
অনিকেত ঠান্ডা গলায় বলল,
—“তোমরা আমাকে কেন টার্গেট করছো?”
—“কারণ তুমি লিখতে পারো। তোমার শব্দই পারে প্রতীক ভাঙতে। যদি তুমি লিখো, তবে খেলা থেমে যাবে। তাই তোমার নাম লাল বইতে লেখা হয়েছে।”
অনিকেত ফোন কেটে দিল। বুকের ভেতর অগ্নিগর্ভ উত্তেজনা জমেছে। সে জানে, ওরা তাকে চুপ করাতে চাইছে। কিন্তু সত্যি লিখে না গেলে শান্তি নেই।
পরদিন সকালে অফিসে বসেই সে রিপোর্ট বানাতে শুরু করল। “অদৃশ্য ছায়ার শহর”—এই শিরোনামে খসড়া লিখতে শুরু করল। সম্পাদককে না দেখিয়ে, ব্যক্তিগত নোটের মতো। সে প্রতিটি খুন, প্রতিটি প্রতীক, প্রতিটি বিন্দুর বিবরণ লিখে রাখল।
তখনই দরজার ফাঁক দিয়ে এক খাম ঢুকে পড়ল। খামের ভেতরে কেবল এক টুকরো কাগজে লেখা—
“তুমি যদি লেখো, তবে তোমার মৃত্যু দ্রুত আসবে।”
কাগজের নিচে তিন আঁচড়ের প্রতীক।
অনিকেত কাগজটা টেবিলে ছুঁড়ে ফেলল। কাঁপতে থাকা হাত থামিয়ে আবার লিখতে শুরু করল।
রাত নামতেই দেবজ্যোতি তাকে ফোন করল।
—“অনিকেতবাবু, আপনি কি আমাকে বিশ্বাস করেন?”
—“হ্যাঁ, কিন্তু কেন জিজ্ঞেস করছেন?”
—“কারণ আমারও হাতে সূত্র আছে। কালো পোশাকধারীরা কেবল অপরাধী নয়। এরা এক গোপন সংঘ, বহু বছর ধরে শহরের অন্ধকার চালাচ্ছে। প্রতিটি খুন মানে এক আচার। আপনি আর আমি একসাথে না হলে ওদের থামানো যাবে না।”
অনিকেত দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
—“তাহলে আমরা একসাথে। কিন্তু এরপর কী?”
দেবজ্যোতি ঠান্ডা কণ্ঠে বলল,
—“পরের বিন্দু পুরনো হাসপাতাল। সেখানে গেলে হয়তো আসল মুখ দেখতে পাবেন।”
রাত গভীর হলে অনিকেত একা বসে ছিল। হঠাৎ জানালার বাইরে আলো পড়ল। সে তাকাতেই দেখল সেই নারী—লাল শাড়ি, খোলা চুল, চোখে অদ্ভুত দুঃখ।
নারী ধীরে বলল,
—“তুমি লিখতে শুরু করেছো। ওরা এখন তোমাকে শেষ করতে চাইবে। মনে রেখো, হাসপাতাল মানে শুধু মৃত্যু নয়, পুনর্জন্মও। সেখানে গিয়ে যদি বাঁচতে পারো, তবে হয়তো খেলা বদলাতে পারবে।”
অনিকেত গলা শক্ত করে বলল,
—“তুমি কি আমার পাশে থাকবে?”
নারী নিঃশব্দে চোখ নামিয়ে নিল।
—“ছায়া থেকে কেউ পুরোপুরি মুক্ত নয়। আমি পারব না তোমার পাশে থাকতে। কিন্তু তুমি যদি বাঁচো, আমি মুক্ত হবো।”
বলেই মিলিয়ে গেল অন্ধকারে।
অনিকেত জানালার সামনে দাঁড়িয়ে রইল। তার বুকের ভেতর আগুন জ্বলছে। সামনে যে পথ, সেখানে মৃত্যু বা সত্য—একটিই অপেক্ষা করছে।
পর্ব ৭ — হাসপাতালের ভূতল
শহরের উত্তর দিকের পুরনো সরকারি হাসপাতালটা একসময় রোগীতে ভরে থাকত। এখন অর্ধেক ভবন ভাঙা, করিডোরে ভিজে গন্ধ, ভেতরে কেবল ইঁদুর আর অন্ধকার। রাত বারোটার সময় অনিকেত যখন হাসপাতালের গেটের সামনে পৌঁছল, চারদিকে কুয়াশা নেমে এসেছে। বাতির আলো কাঁপছে, গলিপথে ভিখিরি কাশি দিচ্ছে।
দেবজ্যোতি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল দেখা হবে, কিন্তু কোথাও দেখা গেল না। অনিকেত একা দাঁড়িয়ে, ব্যাগে নোটবই আর ক্যামেরা। বুকের ভেতর কাঁপন চলছে, তবু পা এগোল ভেতরে।
হাসপাতালের করিডোরে ঢুকতেই ভিজে দেওয়ালে ফোঁটা ফোঁটা জল পড়ছে। সিলিং থেকে ঝুলছে মরচে ধরা পাখা। হঠাৎ এক কোণের ঘর থেকে আস্তে আস্তে আলো ভেসে এল। অনিকেত টর্চ নিয়ে এগোতেই চোখে পড়ল—একটা স্ট্রেচারে ঢাকা পড়ে আছে দেহ।
স্ট্রেচারের পাশে দাঁড়ানো সাদা কোট পরা এক বৃদ্ধ ডাক্তার। চোখে মোটা চশমা, মুখে অদ্ভুত হাসি। তিনি ধীরে বললেন,
—“তুমি সময়মতো এসেছো, সাংবাদিক।”
অনিকেত থমকে গেল।
—“আপনি কে?”
বৃদ্ধ ডাক্তার হেসে বললেন,
—“আমিই ছায়াদের প্রথম রক্ষক। প্রতিটি মৃতদেহ এই হাসপাতালে আসে, আর এখান থেকেই আমরা তাদের বাঁধি প্রতীকে।”
স্ট্রেচারের কাপড় টেনে খুলে দিলেন। ভিতরে এক নারীর দেহ—চোখ খোলা, বুকের ওপর তিন আঁচড়। অনিকেত শিউরে উঠল।
ডাক্তার ধীরে বললেন,
—“তুমি যদি লিখো, প্রতীক ভাঙবে। তাই তোমাকে থামাতে হবে। এই হাসপাতালই হবে তোমার শেষ ঠিকানা।”
অনিকেত পিছিয়ে আসতে চাইলো। ঠিক তখনই করিডোর জুড়ে কালো পোশাকধারীরা ভিড় করে এল। চোখে আগুনের মতো আলো, ঠোঁটে শীতল হাসি।
হঠাৎ বাইরে থেকে ভেসে এল পুলিশের সাইরেন। দরজার ফাঁক দিয়ে ঢুকে এল দেবজ্যোতি বন্দুক হাতে।
—“পুলিশ! কেউ নড়বে না।”
কিন্তু কালো পোশাকধারীরা ছায়ার মতো মিলিয়ে গেল। বৃদ্ধ ডাক্তারও অদৃশ্য। কেবল স্ট্রেচারটা পড়ে রইল ফাঁকা।
অনিকেত হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,
—“তুমি কোথায় ছিলে?”
দেবজ্যোতি ঠান্ডা গলায় বলল,
—“আমি তোমাকে অনুসরণ করছিলাম। এখন বোঝো, এরা সাধারণ অপরাধী নয়। এরা ছায়া।”
হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে নদীর ধারে দাঁড়াল দু’জন। দেবজ্যোতি সিগারেট ধরাল। ধোঁয়া কুয়াশার ভেতর মিশে গেল।
—“অনিকেতবাবু, আমি মনে করি এরা এক গোপন সংঘ। অনেক পুরোনো, সম্ভবত শহরের সঙ্গে জন্মেছে। প্রতিটি খুন তাদের আচার।”
অনিকেত দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
—“আর এখন আমাকে তারা টার্গেট করেছে। আমার নাম বইতে লেখা।”
দেবজ্যোতি চমকে উঠল।
—“বই?”
অনিকেত তাকে লাইব্রেরির ঘটনার কথা বলল। বইয়ের নাম, নিজের নাম লেখা, মৃতের কণ্ঠস্বর—সব। দেবজ্যোতি কিছুক্ষণ চুপ করে শুনল। তারপর বলল,
—“তাহলে তুমি কেবল সাক্ষী নও, তুমি তাদের কেন্দ্রবিন্দু। তোমাকে দিয়ে তারা শেষ আচার করবে।”
অনিকেত কাঁপা গলায় বলল,
—“আর যদি আমি লিখি?”
দেবজ্যোতির চোখে ঠান্ডা আগুন।
—“তাহলে প্রতীক ভেঙে যাবে। ছায়ারা অদৃশ্য হবে।”
সেই রাতে বাড়ি ফিরে অনিকেত জানালার পাশে বসেছিল। হাওয়ায় শীতলতা, দূরে কুকুরের ডাক। হঠাৎ জানালার বাইরে আলো। সে তাকাতেই দেখল সেই নারী—লাল শাড়ি, খোলা চুল।
নারী ধীরে বলল,
—“তুমি হাসপাতালের দেহ দেখেছো। ওরা এখন আরও হিংস্র। আগামী বিন্দু নদীর ধারে। যদি সেখানে যাও, মৃত্যু অপেক্ষা করছে। কিন্তু যদি না যাও, শহর ভেসে যাবে।”
অনিকেত গলা শক্ত করে বলল,
—“তুমি আমাকে বারবার সতর্ক করছো, অথচ সাহায্য করছো না কেন?”
নারীর চোখে দুঃখ।
—“আমি পারি না। আমি একসময় ওদেরই একজন ছিলাম। আমার আত্মা এখনো বাঁধা। তুমি যদি প্রতীক ভাঙো, তবে আমি মুক্ত হবো।”
বলেই অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।
পরদিন সকালে অনিকেত অফিসে পৌঁছে সরাসরি সম্পাদকীয় রুমে গেল। সম্পাদক অবাক হয়ে তাকালেন।
—“তুমি কি ঠিক আছো? তোমার চোখে ঘুম নেই।”
অনিকেত বলল,
—“আমাকে একটা সিরিজ লেখার অনুমতি দিন। শহরের অন্ধকার নিয়ে। শিরোনাম: অদৃশ্য ছায়া।”
সম্পাদক থেমে গেলেন।
—“তুমি নিশ্চিত? প্রমাণ কোথায়?”
অনিকেত জানত, প্রমাণ নেই। ছায়ার কখনো প্রমাণ থাকে না। তবু বলল,
—“আমি সব লিখব। আর পাঠকরা নিজেরাই দেখবে।”
সম্পাদক দ্বিধা করলেন, তারপর মাথা নাড়লেন।
—“লেখা শুরু করো। কিন্তু সাবধানে থেকো।”
সন্ধেবেলা অনিকেত একা বসে লিখছিল। হঠাৎ ফোনটা কেঁপে উঠল। পুরনো নোকিয়া। ওপাশে সেই কর্কশ কণ্ঠ।
—“তুমি লিখতে শুরু করেছো। খুব সাহসী। কিন্তু আজ রাতেই নদীর ধারে আসো। না এলে শহরের আলো নিভে যাবে।”
অনিকেত ফোন নামিয়ে রাখল। বুকের ভেতর কাঁপন থেমে গেছে। তার চোখে এখন অদ্ভুত দৃঢ়তা। সে জানে, খেলার শেষের দিকে এগোচ্ছে।
রাত নামার সঙ্গে সঙ্গে নদীর ধার ঘিরে ফেলছে অন্ধকার। কুয়াশার ভেতর ছায়ারা অপেক্ষা করছে।
পর্ব ৮ — নদীর ধারে রক্তচিহ্ন
রাত তখন প্রায় বারোটা। গঙ্গার ধারে কুয়াশা নেমে এসেছে ঘন চাদরের মতো। বাতাসে শ্যাওলার গন্ধ, দূরে ঢেউ ভাঙার শব্দ, আর ভাঙা ঘাটের সিঁড়িতে জলের ঝাপটা। অনিকেত ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছিল। হাতে নোটবই আর ছোট্ট টর্চ, বুকের ভেতরে অদ্ভুত এক অস্থিরতা।
নদীর ধারের এই জায়গাটা মানচিত্রের সবচেয়ে বড় লাল বিন্দু। সে জানে, আজ রাতেই কিছু একটা ঘটবে। কিন্তু কী, তা আন্দাজ করতে পারছে না।
অনিকেত ঘাটের সিঁড়ি নামতেই হঠাৎ চোখে পড়ল জলের ওপর ভেসে থাকা সাদা কাপড়। প্রথমে ভেবেছিলো পুরনো কোনো থলে, কিন্তু কাছে যেতেই দেখতে পেল সেটা আসলে এক দেহ। মুখ ভেসে আছে জলের ওপর, বুকের ওপরে তিন আঁচড় স্পষ্ট।
সে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। বুক ধকধক করছে। তখনই পিছন থেকে কর্কশ কণ্ঠ—
—“তুমি দেরি করে ফেলেছো, আবার।”
অনিকেত ঘুরে দাঁড়াতেই কালো পোশাকধারীদের দেখা গেল। ছায়ার মতো ঘিরে আসছে। তাদের চোখে জ্বলজ্বল করছে অদ্ভুত আলো।
একজন এগিয়ে এল। ঠান্ডা গলায় বলল,
—“এবার খেলা শেষ। নদী আজ তোমার রক্ত চাইছে।”
অনিকেত টর্চ তুলে ধরতেই হঠাৎ চারপাশে বাতাস ঘুরপাক খেতে লাগল। কুয়াশার ভেতর থেকে বেরিয়ে এল সেই নারী—লাল শাড়ি, খোলা চুল।
সে চিৎকার করে উঠল,
—“না! এখনই সময় নয়।”
কালো পোশাকধারীরা মুহূর্তের জন্য থমকে গেল। নারী অনিকেতের হাত ধরে টেনে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে তুলল। দু’জনে দৌড়ে উঠতেই কালো ছায়ারা মিলিয়ে গেল কুয়াশার ভেতর।
অনিকেত হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,
—“তুমি আমাকে কেন বাঁচালে?”
নারী ঠান্ডা চোখে তাকাল।
—“কারণ এখনো তুমি বাঁচা দরকার। শেষ আচার এখনো শুরু হয়নি।”
অনিকেত গলা শুকিয়ে গেল।
—“শেষ আচার?”
নারী ধীরে বলল,
—“সব লাল বিন্দু একসাথে হলে মানচিত্র সম্পূর্ণ হবে। তখন শহর ভেসে যাবে ছায়ার জগতে। তুমি যদি লেখো, তবে প্রতীক ভেঙে যাবে। কিন্তু ততদিন পর্যন্ত তোমাকে বাঁচতে হবে।”
পরদিন সকালে অনিকেত দেবজ্যোতির সঙ্গে দেখা করল। কফির কাপ হাতে বসেছিল দু’জন। অনিকেত সব জানাল—নদীর দেহ, কালো ছায়ারা, নারীর হঠাৎ উপস্থিতি।
দেবজ্যোতি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,
—“আমি বিশ্বাস করি। কিন্তু তুমি বুঝতে পারছো না, তুমি এখন শুধু সাংবাদিক নও। তুমি এদের বিরুদ্ধে শেষ অস্ত্র।”
অনিকেত ক্লান্ত গলায় বলল,
—“কিন্তু কেন আমি?”
দেবজ্যোতির চোখে শীতল দৃষ্টি।
—“কারণ শব্দই সবচেয়ে বড় সত্য। ছায়ারা অস্তিত্ব হারাবে কেবল যদি তাদের প্রকাশ করা যায়। তুমি লিখে ফেললে, তাদের শক্তি ভেঙে যাবে।”
অনিকেত মাথা নাড়ল।
—“তাহলে আমাকে লিখতে হবে। কিন্তু আমি যত লিখছি, তারা আরও কাছে চলে আসছে।”
সেদিন বিকেলে অনিকেত বাড়ি ফিরতেই টেবিলের ওপর একটা খাম পড়ে থাকতে দেখল। খামের ভেতরে একটা ছবি—তার নিজের। কোনো এক ক্যাফেতে বসে লেখা লিখছে, পেছন থেকে তোলা। ছবির নিচে লেখা—
“আমরা সবসময় দেখি।”
অনিকেতের বুকের ভেতর শীতলতা নেমে গেল। সে জানল, তার প্রতিটি পদক্ষেপ নজরবন্দি।
রাত গভীর হলে জানালার বাইরে আবার আলো পড়ল। নারী দাঁড়িয়ে আছে। মুখে অদ্ভুত দুঃখ, চোখে চাপা ভয়।
সে বলল,
—“তুমি খুব তাড়াতাড়ি শেষ বিন্দুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছো। পরের গন্তব্য পুরনো থিয়েটার।”
অনিকেত শক্ত গলায় বলল,
—“আমি ক্লান্ত। প্রতিদিন মৃত্যু দেখতে দেখতে আমি আর পারছি না।”
নারী ধীরে এগিয়ে এসে ফিসফিস করল,
—“তুমি যদি থেমে যাও, শহর শেষ হয়ে যাবে। ছায়ারা তখন সবকিছু গ্রাস করবে। তোমার ভয়ই তাদের শক্তি। তুমি যদি শেষ অবধি দাঁড়িয়ে থাকতে পারো, আমিও মুক্ত হবো।”
অনিকেতের গলা কেঁপে উঠল।
—“তুমি আসলে কে?”
নারী চোখ নামিয়ে নিল।
—“আমি একসময় তাদের বইয়ের নামের তালিকায় ছিলাম। আমার রক্ত দিয়ে প্রতীক আঁকা হয়েছিল। আমি মরেছি, কিন্তু আত্মা আটকে আছে। তুমি লিখতে পারলেই আমি মুক্তি পাবো।”
বলেই মিলিয়ে গেল অন্ধকারে।
অনিকেত টেবিলে বসে লিখতে শুরু করল। প্রতিটি ঘটনা, প্রতিটি দাগ, প্রতিটি ছায়া শব্দে বন্দি হলো। তার হাত কাঁপছিল, কিন্তু কলম থামেনি।
হঠাৎ পেছন থেকে ঠান্ডা হাওয়া এল। সে ঘুরে তাকিয়ে দেখল—দেয়ালে তিন আঁচড়। তাজা, যেন এখনই কেউ কেটে দিয়েছে।
ফোনটা আবার কেঁপে উঠল। কর্কশ কণ্ঠ—
—“তুমি অনেক দূর চলে এসেছো। এখন শেষ খেলার জন্য প্রস্তুত হও। থিয়েটারে এসো। আর মনে রেখো, এবার ফেরার রাস্তা নেই।”
অনিকেত ফোন নামিয়ে রাখল। তার চোখে এখন আর ভয় নেই, কেবল একরাশ দৃঢ়তা।
সে জানে, পরের বিন্দুই শেষ। থিয়েটারের অন্ধকারেই হয়তো তার মৃত্যু, অথবা শহরের মুক্তি।
পর্ব ৯ — থিয়েটারের মুখোশ
শহরের মাঝখানে যে পুরনো থিয়েটারটা এখনো দাঁড়িয়ে আছে, একসময় সেখানে আলো ঝলমলে নাটকের আসর বসত। এখন কেবল ভাঙা আসন, ঝুলে থাকা মাকড়সার জাল আর ধুলো। রাত বারোটার আগে অনিকেত যখন পৌঁছল, চারপাশে অদ্ভুত নীরবতা। বাতির আলো কাঁপছিল, যেন বিদ্যুতের শিরা টানটান।
সে জানত, এটাই শেষ বিন্দু। নারীর সতর্কতা, ফোনের হুমকি—সবকিছুই তাকে এখানে টেনে এনেছে। গলির মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকা দেবজ্যোতি এগিয়ে এল। চোখে ক্লান্তি, গলায় দৃঢ়তা।
—“অনিকেতবাবু, আপনি নিশ্চিত? এটা ফাঁদ হতে পারে।”
অনিকেত কাঁপা গলায় বলল,
—“আমি জানি। তবু ঢুকতেই হবে। শহরটা যদি সত্যিই ছায়ার হাতে চলে যায়, তবে আমাদের আর কিছু থাকবে না।”
ভেতরে ঢুকতেই থিয়েটারের অডিটোরিয়ামে অদ্ভুত এক দৃশ্য। মঞ্চের ওপর টেবিল, তার চারদিকে দাঁড়ানো কালো পোশাকধারীরা। প্রত্যেকের হাতে মশাল। ছাদের ফাঁক দিয়ে আলো পড়ছে, যেন আচার শুরু হতে যাচ্ছে।
অনিকেতের চোখ আটকে গেল টেবিলের ওপরে রাখা সেই লাল বইয়ে। মোটা মলাট, রক্তে ভিজে থাকা পাতা। বইয়ের শেষ পাতায় তার নিজের নাম খোদাই করা।
একজন কালো পোশাকধারী সামনে এল। মুখ ঢাকা, কিন্তু গলায় ঠান্ডা হাহাকার।
—“আজ রাতেই শেষ আচার সম্পূর্ণ হবে। প্রতিটি বিন্দু একত্রিত হয়েছে। কেবল তোমার রক্ত বাকি।”
দেবজ্যোতি বন্দুক তুলে ধরল।
—“পুলিশ! কেউ নড়বে না।”
কিন্তু তারা হাসল। একসাথে হাত তুলতেই মশালের শিখা জ্বলে উঠল প্রবল। অডিটোরিয়াম ভরে গেল লাল আলোতে।
হঠাৎ সেই নারী উপস্থিত হল মঞ্চের একপাশে। লাল শাড়ি, খোলা চুল, চোখে জ্বলন্ত অগ্নি। সে চিৎকার করে বলল,
—“না! ওর রক্ত নয়। প্রতীক ভাঙার শক্তি ওর হাতে, কিন্তু মৃত্যু নয়।”
কালো পোশাকধারীরা হেসে উঠল।
—“তুমি তো আমাদেরই একজন ছিলে। বিশ্বাসঘাতক আত্মা।”
নারী এগিয়ে এল।
—“হ্যাঁ, আমি ছিলাম। কিন্তু আজ আমি মুক্তি চাই। আমি চাই শহর বাঁচুক।”
অনিকেত বুঝতে পারল, এটাই সেই মুহূর্ত। সে ছুটে গিয়ে লাল বইটা টেনে নিল টেবিল থেকে। বুক ধকধক করছে। বই খুলে দেখল প্রতিটি পাতায় নাম, প্রতীক, রক্তের দাগ। আর শেষ পাতায়—“অনিকেত চৌধুরী”।
সে কাঁপতে থাকা হাতে কলম বের করল। নোটবই থেকে কলম, কালো কালি। নামটার ওপর লিখে দিল একটাই শব্দ—“সত্য।”
মুহূর্তের মধ্যে অডিটোরিয়ামের আলো কেঁপে উঠল। মশালের শিখা নিভে গেল। কালো পোশাকধারীরা একে একে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল, দেহ গলে গেল অন্ধকারে।
নারীর মুখে আলো ফুটল। চোখে অশ্রু।
—“তুমি লিখেছো। তুমি প্রতীক ভেঙেছো। এখন আমি মুক্ত।”
তার দেহ ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল আলোয়।
দেবজ্যোতি হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,
—“আপনি পেরেছেন, অনিকেতবাবু। ছায়ারা শেষ।”
কিন্তু অনিকেতের বুকের ভেতর শীতলতা নামল। সে দেখল বইটা এখনো কাঁপছে। শেষ পাতায় তার নামের ওপর কালো কালি গলে রক্তে পরিণত হচ্ছে। অক্ষরগুলো জ্বলজ্বল করছে।
সে ফিসফিস করে বলল,
—“না… শেষ হয়নি। খেলা এখনো চলছে।”
ঠিক তখনই ফোনটা কেঁপে উঠল। পুরনো নোকিয়া। সে ধরতেই কর্কশ কণ্ঠস্বর—
—“তুমি ভেবেছো প্রতীক ভেঙেছো? ভুল। প্রতিটি শব্দই আমাদের শক্তি। তুমি যত লিখবে, আমরা তত জেগে উঠব। এবার শুরু হলো নতুন অধ্যায়।”
কল কেটে গেল। থিয়েটারের ভাঙা ছাদ দিয়ে বৃষ্টি নামতে শুরু করল। জল মেঝেতে গড়িয়ে বইয়ের পাতায় পড়ল। প্রতিটি ফোঁটার সঙ্গে প্রতীকগুলো আরও স্পষ্ট হয়ে উঠল।
অনিকেত বই হাতে দাঁড়িয়ে রইল। দেবজ্যোতি তার কাঁধে হাত রাখল।
—“এবার কী করবেন?”
অনিকেতের চোখে শীতল দৃঢ়তা।
—“শেষ বিন্দু এখনো বাকি। শহরের বুকের মাঝখানে। সেখানে যেতে হবে। নাহলে অদৃশ্য ছায়ারা চিরদিন বেঁচে থাকবে।”
রাতের থিয়েটার তখন ভাঙা আলোতে দাঁড়িয়ে। বাইরে বৃষ্টির শব্দ, ভেতরে বুকের ধুকপুক। অনিকেত জানত, পরের পদক্ষেপই তার জীবনের শেষ খেলা।
পর্ব ১০ — শেষ বিন্দুর রাত
থিয়েটারের রক্তমাখা বই হাতে নিয়ে অনিকেত বেরিয়ে এল ভোরের অন্ধকারে। আকাশে তখনো বৃষ্টি ঝরছে, রাস্তার আলোয় কুয়াশা কাঁপছে। বুকের ভেতর সে জানে—এখনো শেষ হয়নি। শেষ বিন্দু বাকি।
মানচিত্রের কেন্দ্রটা শহরের বুকের মাঝখানে—লালবাজার চত্বর। পুলিশের সদর দপ্তরের কাছেই। সেই জায়গাটাই আসল মঞ্চ। ওখানেই হবে ছায়াদের চূড়ান্ত খেলা।
সকালবেলায় অনিকেত ও দেবজ্যোতি একসাথে মানচিত্র খুলে বসেছিল। অফিসের জানালা দিয়ে আলো পড়ছিল টেবিলের ওপর। লাল বিন্দুগুলোকে জোড়া দিলে প্রতীক তৈরি হয়েছিল। কিন্তু মাঝখানের ফাঁকা অংশই আসল।
দেবজ্যোতি বলল,
—“তাহলে আজ রাতেই শেষ। ওরা নিশ্চয়ই ভিড় জমাবে লালবাজারের আশেপাশে। পুলিশের সামনে আচার করবে।”
অনিকেত ঠান্ডা কণ্ঠে বলল,
—“ওরা সাহস করে করবে, কারণ প্রমাণ থাকবে না। ছায়ার প্রমাণ কেউ দেখে না।”
দেবজ্যোতি চোখ নামিয়ে নিল।
—“তাহলে আমাদেরই ওদের মুখোশ খোলার দায়িত্ব।”
রাত নামতেই শহরের বুক অদ্ভুত চুপচাপ। লালবাজার চত্বরে সাধারণত যে ভিড় থাকে, আজ নেই। চারপাশ ফাঁকা, বাতিগুলো কাঁপছে।
অনিকেত বুকের কাছে সেই লাল বই চেপে রেখেছে। প্রতিটি পাতার নাম তার চোখে জ্বলছে। শেষ পাতায় নিজের নাম। তার হাত কাঁপছে, কিন্তু গলায় দৃঢ়তা।
ঠিক তখনই কর্কশ কণ্ঠ বাজল চারপাশে—কোথাও নেই, তবু সবখানেই।
—“স্বাগতম, সাংবাদিক। তুমি শেষ বিন্দুতে এসে গেছো।”
ছায়ারা একে একে বেরিয়ে এল অন্ধকার থেকে। কালো পোশাক, জ্বলন্ত চোখ। ডজনখানেক মানুষ ঘিরে ধরল পুরো চত্বর।
একজন এগিয়ে এল।
—“আজ রাতে তোমার রক্তেই মানচিত্র সম্পূর্ণ হবে। শহর ঢেকে যাবে ছায়ার দুনিয়ায়।”
অনিকেত বুক সোজা করে দাঁড়াল।
—“আমি লিখেছি। আমি সব লিখব। সত্যি প্রকাশ পাবে।”
তারা হাসল।
—“তুমি ভেবেছো শব্দ আমাদের শেষ করবে? না। শব্দই আমাদের জন্ম দেয়। প্রতিটি লেখা মানে ছায়ার আরেক জন্ম।”
ঠিক তখনই কুয়াশার ভেতর থেকে বেরিয়ে এল সেই নারী। লাল শাড়ি, খোলা চুল। তার চোখে দুঃখ আর দৃঢ়তা মিশে।
সে চিৎকার করে বলল,
—“না! প্রতিটি শব্দ জন্ম দেয়, কিন্তু সত্যি শব্দ ধ্বংসও করে। অনিকেত, বইয়ের শেষ পাতায় তোমার রক্ত নয়—তোমার সত্যি লিখো।”
অনিকেত কাঁপা হাতে বই খুলল। শেষ পাতায় নিজের নামের ওপর কলম চালাল। লিখল—“ছায়ারা মিথ্যে।”
এক মুহূর্তের মধ্যে আকাশ ফেটে গেল। চারদিকে বজ্রপাত। কালো পোশাকধারীরা চিৎকার করে মাটিতে পড়ল। দেহ গলে গেল অন্ধকারে। প্রতীকগুলো বইয়ের ভেতর থেকে মুছে যেতে লাগল।
নারীর মুখে আলো ফুটল। সে ধীরে ধীরে হাসল।
—“তুমি লিখেছো। তুমি সত্যিকে জীবিত করেছো। আমি মুক্ত।”
তার দেহ আলোয় মিলিয়ে গেল।
কিন্তু বইটা তখনো কাঁপছে। পাতাগুলো একে একে ছিঁড়ে উড়ে গেল বাতাসে। প্রতিটি পাতার নাম উড়ে মিশে গেল রাতের অন্ধকারে।
দেবজ্যোতি বন্দুক নামিয়ে অনিকেতের দিকে তাকাল।
—“আপনি পেরেছেন। শহর বেঁচে গেছে।”
অনিকেত চুপ করে দাঁড়াল। বুকের ভেতর ভয়ঙ্কর এক শূন্যতা। বইয়ের শেষ পাতায় তার নাম এখনো রয়ে গেছে। কিন্তু তার নিচে বড় বড় অক্ষরে লেখা—“সাক্ষী।”
সে বুঝল, খেলা শেষ হলেও ছায়ারা পুরোপুরি মরে যায়নি। তারা ফিরে আসবে, যতদিন শহরে অন্ধকার আছে।
ভোর হতেই লালবাজার চত্বর ভরে গেল গাড়ির হর্ন, মানুষের ভিড়। কেউ জানল না রাতের ঘটনাগুলো। শহর যেন কিছুই ঘটেনি ভেবে নতুন দিনের দিকে এগিয়ে গেল।
অনিকেত নোটবই বন্ধ করল। ডেস্কে লিখল শেষ লাইন—
“অদৃশ্য ছায়ারা চিরকাল বেঁচে থাকে। কেবল সাক্ষীরা তাদের মুখোশ দেখতে পায়।”
সে জানে, সে এখন শহরের একমাত্র সাক্ষী। আর এই সাক্ষী হওয়াটাই তার সবচেয়ে বড় অভিশাপ।
— সমাপ্ত —