শৌনক দে
অধ্যায় ১ – ঝড়ের রাতে
রাতটা ছিল অদ্ভুত অশুভ। পশ্চিম আকাশে মেঘ জমে গিয়েছিল সারাদিন, কিন্তু সন্ধ্যা নামতেই বজ্রপাতের সাথে শুরু হল তীব্র ঝড়। গাছপালা হেলে পড়ছে, গ্রামের কুঁড়েঘরের চালা একে একে খুলে উড়ে যাচ্ছে, আর বাতাসের সাথে মিশে আসছে শ্মশানঘাট থেকে ভেসে আসা শীতল গন্ধ। সেই রাতে সাধারণত গ্রামের মানুষ ঘর থেকে বের হয় না, কারণ বিশ্বাস করা হয়—শ্মশানের আত্মারা ঝড়ের সাথে বেরিয়ে আসে। কিন্তু গ্রামের ওঝা ভবানী সাধু, যার মাথায় গেরুয়া কাপড়, হাতে ত্রিশূল, চোখে রহস্যময় দৃষ্টি—সে বেরিয়েছিল এক মৃতদেহ দাহের কাজে সাহায্য করতে। হঠাৎ বজ্রের আলোয় দেখা গেল শ্মশানের এক কোণে এক সন্ন্যাসী শুয়ে আছেন, তার গায়ে ছিন্নবস্ত্র, লম্বা দাড়ি ভিজে আছে বৃষ্টিতে। ভবানী সাধু তার কাছে এগিয়ে গেল, আর দেখল সন্ন্যাসীর বুক ওঠানামা করছে ক্ষীণভাবে—তিনি প্রায় মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে। চারপাশে ভয়ঙ্কর ঝড় হলেও সন্ন্যাসীর চোখে তখন এক ভিন্ন রকম জ্যোতি, যেন মৃত্যুকে ছাড়িয়ে কিছু জানাতে চাইছেন তিনি।
সন্ন্যাসী কাঁপা হাতে তার গলার ঝোলার ভেতর থেকে বের করলেন এক কালো কাপড়ে মোড়ানো বস্তু। ভবানী সাধু প্রথমে ভেবেছিলেন এটা হয়তো সাধারন কোনো যন্ত্র বা ধর্মীয় প্রতীক। কিন্তু সন্ন্যাসীর কণ্ঠস্বর, যদিও ভাঙা আর দুর্বল, বাতাস আর বজ্রপাতকে ছাপিয়ে উঠল—“এ তাবিজ তোমার হাতে দিলাম, ওঝা… এটা মায়াবী, কিন্তু অভিশপ্ত। মনে রেখো—যা চাইবে তাই পাবে, তবে প্রতিটি ইচ্ছে পূরণের জন্য রক্ত চাইবে, প্রাণ চাইবে। মানুষের লোভের শাস্তি মানুষই দেবে।” এতটুকু বলেই তিনি এক চিৎকারের সাথে প্রাণ ছেড়ে দিলেন, আর তীব্র ঝড় যেন আরও কয়েকগুণ বাড়ল তার সাথে। ভবানী সাধু স্তব্ধ দাঁড়িয়ে রইল, তার হাতের মুঠোয় এখন কালো কাপড়ে মোড়ানো তাবিজ। বৃষ্টির ফোঁটা সেই কাপড় ভিজিয়ে দিচ্ছিল, তবুও মনে হচ্ছিল ভেতর থেকে অদ্ভুত উষ্ণতা বের হচ্ছে, যেন কোনো অদৃশ্য শক্তি জেগে আছে। সন্ন্যাসীর নিথর দেহটা একপাশে পড়ে থাকল, চারপাশে শ্মশানের আগুন আর বজ্রের আলো মিলেমিশে সৃষ্টি করল ভয়ঙ্কর দৃশ্য।
ভবানী সাধু তাবিজটাকে বুকের কাছে চেপে ধরে দ্রুত বাড়ির দিকে ফিরে গেল, যদিও তার ভেতরে অদ্ভুত দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছে। সে বহু অলৌকিক জিনিস দেখেছে জীবনে, নানা তান্ত্রিক আচার জানে, কিন্তু এরকম সতর্কবাণীভরা বস্তু কোনোদিন হাতে পায়নি। শ্মশানঘাটের ঝড়, সন্ন্যাসীর চোখের অদ্ভুত দৃষ্টি, আর মৃত্যুর আগে দেওয়া সেই বাক্য—সব মিলিয়ে তার মনে ভয় জন্মাচ্ছিল, আবার কৌতূহলও হচ্ছিল। তাবিজটা ভারী নয়, অথচ হাতের তালুতে ধরে রাখলে মনে হচ্ছিল যেন তার ভেতরে ঢেউ খেলছে অদৃশ্য শক্তি। ঝড়ে ভিজে তার গেরুয়া কাপড় জল টপটপ করে পড়ছিল, কিন্তু সে টের পাচ্ছিল না—মনে হচ্ছিল এই তাবিজের ভেতরই তার সমস্ত মনোযোগ আটকে গেছে। ঘরে ফিরে এসে সে প্রদীপ জ্বালাল, আর তাবিজটাকে আস্তে করে মাটির ওপর রাখল। কালো কাপড় খুলে দেখা গেল এক অদ্ভুত ধাতব বস্তু, গোলাকার, চারদিকে খোদাই করা অজানা চিহ্ন, আর মাঝখানে লালচে দাগ—যেন রক্তের ছাপ বহু যুগ আগে শুকিয়ে গিয়ে এখনো দগদগে হয়ে আছে। বাইরে তখনও ঝড় বয়ে চলেছে, কিন্তু ঘরের ভেতরে তাবিজের উপস্থিতি যেন আরও ভয়ঙ্কর নীরবতা তৈরি করল। ভবানী সাধু মনে মনে বলল—“এ শুধু এক অলৌকিক শক্তি নয়, এ কোনো অভিশাপ।” তার কাঁপা হাত তাবিজ থেকে দূরে সরে এল, কিন্তু তার চোখ সেখানেই স্থির হয়ে রইল, যেন তাবিজ তাকে ডাকছে। সেই মুহূর্তেই শুরু হল এক কাহিনির, যা বদলে দেবে পুরো গ্রামের ভাগ্য।
অধ্যায় ২ – প্রথম ইচ্ছে
তাবিজ পাওয়ার পর ক’দিন ভবানী সাধু সেটাকে ঘরের এক কোণে লুকিয়ে রাখল, মাটির পাত্রে চালের ভেতরে চাপা দিয়ে। প্রতিদিনের মতো রোগ-ব্যাধি দেখা, ভেষজ ওষুধ বানানো, মন্ত্র পড়ে ঝাড়ফুঁক করা—এসব কাজেই সে ব্যস্ত রইল। মাঝে মাঝে রাতে ঘুম ভাঙলে তাবিজের কথা মনে পড়ত, মনে হত যেন ওটা ঘরের অন্ধকারে শ্বাস নিচ্ছে, আর ধীরে ধীরে তার দিকে তাকিয়ে আছে। তবু সে নিজের মনকে বোঝাত, “সবই কল্পনা। সন্ন্যাসীর সতর্কবাণী কেবল ভয়ের কথা।” কিন্তু ভাগ্যের খেলা অন্যরকম। গ্রামে তখন এক বড় অসুখ ছড়িয়ে পড়েছে। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা জ্বরে ভুগছে, অনেকেই প্রায় মৃত্যুর মুখে। গ্রামের এক পরিবার তাদের একমাত্র সন্তানকে নিয়ে ভবানী সাধুর কাছে এসে কান্নাকাটি করে। ছেলেটি শুয়ে আছে নিঃশ্বাস বন্ধ হওয়ার মতো অবস্থায়, চোখ আধখোলা, ঠোঁট নীলচে। ভেষজ ওষুধে আর কোনো কাজ হচ্ছে না। অসহায় বাবা-মা হাত জোড় করে বলে উঠল—“ওঝা, তুমি না পারলে আমাদের ছেলে বাঁচবে না।” সেই মুহূর্তে ভবানী সাধুর চোখে ভেসে উঠল তাবিজ। মনে হল যেন তাবিজ তার নাম ধরে ডাকছে।
ঝড়ের রাতের সেই স্মৃতি আবার ফিরে এল তার মনে। বুক ধুকপুক করতে লাগল, কিন্তু অসহায় বাবা-মায়ের কান্না তাকে ভেঙে দিল। সে চালের ভেতর থেকে তাবিজটা বের করে আনল, কালো কাপড়ে মোড়ানো। প্রদীপের আলোয় তাবিজটাকে দেখে বাবা-মায়ের চোখে ভয় আর বিস্ময়ের ছায়া ফুটে উঠল। ভবানী সাধু তাবিজ হাতে নিয়ে চোখ বন্ধ করল, সন্ন্যাসীর সতর্কবাণী মনে করার চেষ্টা করল, কিন্তু মন্ত্রের মতো তার ঠোঁট থেকে বেরিয়ে এল প্রার্থনা—“এই শিশুকে জীবন দাও।” মুহূর্তের মধ্যে যেন হাওয়ায় অদ্ভুত গন্ধ ভেসে উঠল, শীতল বাতাস ঘর ভরিয়ে দিল। শিশুটি হঠাৎ কাশতে কাশতে উঠে বসে পড়ল, তার নীলচে ঠোঁটে রঙ ফিরে এল, চোখ বড় বড় করে খোলা। বাবা-মা বিস্ময়ে ছেলেকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল, “দেবতা, তুমি আমাদের বাঁচালে।” ভবানী সাধু হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। সত্যিই কি তাবিজ কাজ করল? সত্যিই কি এক মৃতপ্রায় ছেলেকে ফিরিয়ে আনা গেল? তার হাতের তালুতে তখনও তাবিজ উষ্ণ হয়ে জ্বলছে, যেন কোনো অদৃশ্য আগুনের সাথে যুক্ত। আনন্দের মুহূর্তে তার ভেতরের ভয় এক মুহূর্তের জন্য হারিয়ে গেল। সে মনে করল হয়তো সন্ন্যাসীর সতর্কবাণী অতিরঞ্জিত ছিল। হয়তো এ তাবিজ সত্যিই মানুষের উপকারে আসবে।
কিন্তু সেই রাতেই গ্রামে ঘটল অদ্ভুত এক ঘটনা। মাঝরাতে বজ্রপাত ছাড়াই এক প্রচণ্ড শব্দে গ্রামের উত্তর প্রান্তে সবাই ঘুম থেকে চমকে উঠল। ভোর হলে দেখা গেল, গ্রামের এক তরুণ যুবক অকারণে মারা পড়ে আছে মাঠের ধারে। তার শরীরে কোনো আঘাত নেই, কোনো অসুখের ছাপ নেই, তবুও নিথর দেহ পড়ে আছে জমিনে। পরিবার হাহাকার করে উঠল—“হঠাৎ কেন মারা গেল?” কেউ বুঝতে পারল না। কিন্তু ভবানী সাধুর মনে তখনই ধাক্কা লাগল। সন্ন্যাসীর সেই বাক্য—“প্রতিটি ইচ্ছে পূরণে প্রাণ চাইবে”—মনে গেঁথে গেল। সে আতঙ্কে ঘেমে উঠল। গত রাতে যখন সে ছেলেটিকে বাঁচানোর জন্য তাবিজে প্রার্থনা করল, ঠিক তখনই কি অন্য একজনের প্রাণ কেড়ে নিল তাবিজ? লাশ দেখে তার বুক কেঁপে উঠল। গ্রামে গুঞ্জন শুরু হল—“যে বাচ্চাটাকে মরার হাত থেকে ফিরিয়ে আনা হয়েছে, সেই রাতেই কেন অন্যজন মারা গেল?” সন্দেহ বাড়তে লাগল, কিন্তু এখনো কেউ সত্যটা জানে না। শুধু ভবানী সাধুই বুঝল, এ কেবল শুরু। তাবিজের শক্তি যতটা আশীর্বাদ, তার ভেতরে লুকিয়ে আছে ততটাই অভিশাপ। সে তাবিজকে আবার লুকিয়ে রাখল, কিন্তু বুকের ভেতরে শীতল ভয় জেগে রইল—এই প্রথম ইচ্ছে যদি একটি প্রাণ কেড়ে নেয়, তবে পরেরবার কী ঘটবে?
অধ্যায় ৩ – অদ্ভুত কাকতালীয়তা
গ্রামের লোকেরা প্রথমে ভাবল, ছেলেটির সুস্থ হওয়া এক অলৌকিক ঘটনা, আর যুবকের মৃত্যু হয়তো দুর্ভাগ্যজনক কাকতালীয় ঘটনা। কিন্তু যতই দিন যাচ্ছিল, মানুষের মুখে মুখে সেই কথাই ঘুরে বেড়াচ্ছিল—“কোনো এক অদৃশ্য সম্পর্ক আছে।” কেউ ফিসফিস করে বলছিল, “ছেলেটিকে বাঁচানোর জন্যই কি যুবকের প্রাণ গেল?” আবার কেউ বলছিল, “মৃত্যু আর জীবনের পালা তো ঈশ্বরের হাতে।” কিন্তু গ্রামের আড্ডায়, হাটের ভিড়ে, এমনকি জল আনতে যাওয়া নারীদের মাঝেও এই আলোচনা থামছিল না। একদল মানুষ ভবানী সাধুকে দেবতার সমান মানতে শুরু করল, কারণ সে যে অসম্ভবকে সম্ভব করেছে, আবার অন্যরা সন্দেহ করতে লাগল—“যদি কোনো কালো বিদ্যা দিয়ে সে এক জীবন বাঁচাতে অন্য জীবন কেড়ে নেয়?” ভবানী সাধুর নিজের মনও শান্ত ছিল না। দিনভর রোগী দেখা, ঝাড়ফুঁক করা, ভেষজ বানানো—এসবের মাঝেই তার কানে বারবার ভেসে আসত সন্ন্যাসীর মৃত্যুর আগে বলা সতর্কবাণী, যেন বাতাসে সেই বাক্য ফিসফিস করে ঘুরে বেড়াচ্ছে—“প্রতিটি ইচ্ছে পূরণে প্রাণ চাইবে।” রাতে শুতে গেলে ঘুম ভাঙত ঘন ঘন, কানে বাজত ভয়ঙ্কর বজ্রপাতের শব্দ, আর স্বপ্নে দেখা যেত সন্ন্যাসীর নিথর দেহ ভিজে পড়ে আছে শ্মশানের মাটিতে, চোখ মেলে তাকিয়ে আছে তার দিকে।
তাবিজ সে আবার মাটির পাত্রে চালের ভেতরে লুকিয়ে রেখেছিল, কিন্তু মনে হচ্ছিল তাবিজ যেন নিস্তব্ধ থেকেও জীবিত, যেন ধুকপুক করছে হৃদস্পন্দনের মতো। প্রদীপের আলোয় সেই চালের পাত্রের উপর ছায়া পড়লেই তার মনে আতঙ্ক জাগত। মাঝে মাঝে মনে হত, পাত্রের ভেতর থেকে ক্ষীণ ফিসফিসানি আসছে—অদৃশ্য কোনো কণ্ঠ তাকে ডাকছে। কিন্তু বাইরে দেখলে সাধারণ পাত্র, কোনো অস্বাভাবিকতা নেই। এই দ্বন্দ্বে পড়ে সে ভাবতে লাগল—এ কি সত্যিই অভিশপ্ত তাবিজ, নাকি তার নিজের মনই ভয় থেকে এসব কল্পনা করছে? তবু, প্রতিদিনের গ্রামীণ জীবনে অদ্ভুত সব কাকতালীয় ঘটনা ঘটতে শুরু করল। কারও অসুখ থেকে আরোগ্য লাভ ঘটছে অস্বাভাবিক দ্রুততায়, আবার একই সময়ে গ্রামের অন্য প্রান্তে হঠাৎ মৃত্যু ঘটছে কারও, যার কোনো কারণ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। মানুষ এসবকে ভাগ্যের খেলা বলে উড়িয়ে দিলেও ভবানী সাধুর মনে এক অস্থির শঙ্কা জন্ম নিচ্ছিল। সে বুঝতে পারছিল, হয়তো সত্যিই তাবিজ তার ভেতরে এক বিপজ্জনক ভারসাম্য তৈরি করছে—যেখানে জীবন ও মৃত্যুর হিসেব চুকিয়ে নিচ্ছে অদৃশ্য কোনো শক্তি।
ভবানী সাধু এই ভয়াবহ সন্দেহ দূর করতে চাইল, কিন্তু কীভাবে? যদি তাবিজ সত্যিই অভিশপ্ত হয়, তবে তার হাতে যে অপরাধের ভার জমছে, তার পরিণাম ভয়ঙ্কর হবে। আর যদি সত্য না হয়, তবে কেন এমন অদ্ভুত কাকতালীয় ঘটনাগুলো ঘটছে? দিনরাতের এই মানসিক যন্ত্রণা তাকে ক্লান্ত করে তুলছিল। সে বহুবার স্থির করেছিল তাবিজ নদীর জলে ভাসিয়ে দেবে কিংবা গভীর বনে ফেলে আসবে, কিন্তু যখনই চেষ্টা করেছে, তার মনে হয়েছে যেন অদৃশ্য কোনো বাঁধন তাকে আটকাচ্ছে। তাবিজকে ছুঁতে গেলেই হাত কেঁপে উঠত, বুকের ভেতর ধড়ফড় করত। এ যেন এক মায়ার বাঁধন, যেখান থেকে সে মুক্তি পাচ্ছে না। আর এই সময়েই গ্রামে গুঞ্জন আরও ছড়াতে শুরু করল—“ভবানী সাধুর কাছে আছে কোনো অদ্ভুত শক্তি।” কেউ কেউ তার ঘরে এসে প্রার্থনা জানাতে শুরু করল, যেন সে দেবতার মতো। অথচ ভবানী সাধু একা নিজের ভেতরে দ্বন্দ্বে জ্বলতে লাগল—সে কি সত্যিই ঈশ্বরপ্রদত্ত শক্তির ধারক, নাকি এক ভয়ঙ্কর অভিশাপের বাহক, যে একে একে নিরীহ মানুষের প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে? তার চোখে আর শান্তি নেই, কানে আর নীরবতা নেই—চারপাশে শুধু সেই অদৃশ্য সতর্কবাণীর প্রতিধ্বনি। এই অদ্ভুত কাকতালীয়তার জাল ক্রমশ আঁটসাঁট হয়ে উঠছিল, আর সে নিজেই আটকা পড়ছিল সেই অন্ধকারের ফাঁদে।
অধ্যায় ৪ – লোভের আগুন
গ্রামে কানাঘুষো যেটুকু ছিল, সেটাই একসময় পৌঁছে গেল জমিদার হরিনারায়ণ চৌধুরীর কানে। তিনি ছিলেন গ্রামের প্রভাবশালী ব্যক্তি, ধনসম্পদ আর ক্ষমতার লোভে যিনি সবসময় নতুন নতুন উপায় খুঁজতেন নিজের কর্তৃত্ব আরও বাড়ানোর জন্য। লোকজনের মুখে শোনা গেল—ভবানী সাধুর কাছে আছে এক অলৌকিক শক্তি, যা ইচ্ছে পূরণ করতে পারে। প্রথমে জমিদার বিশ্বাস করেননি, কিন্তু যখন তিনি দেখলেন মৃতপ্রায় শিশুটি অল্পদিন আগে হঠাৎ সুস্থ হয়ে উঠেছে, আর একই রাতে গ্রামের যুবক অকারণে মারা গেছে—তখন তার ভেতরে সন্দেহের সাথে সাথে লোভও জন্ম নিল। এক রাতে তিনি কয়েকজন সাঙ্গপাঙ্গকে নিয়ে ভবানী সাধুর কুঁড়েঘরে হাজির হলেন। মুখে মিষ্টি হেসে তিনি বললেন, “ওঝা, শুনেছি তোমার কাছে এক অসাধারণ জিনিস আছে। সেটা আমাদেরও কাজে লাগাতে দাও।” ভবানী সাধু অস্বীকার করতে চাইল, জানাল এটা মানুষের হাতে দেবার মতো বস্তু নয়, এতে বিপদ আছে। কিন্তু জমিদারের চোখে ছিল আগুন, ঠোঁটে হালকা হুমকি—“আমার কথা না মানলে তোমার জন্য গ্রামে জায়গা থাকবে না।” ভয়ে আর অসহায়তায় ভবানী সাধু তাবিজের কথা খুলে বলতে বাধ্য হল, তবে সতর্ক করল—“প্রতি ইচ্ছে পূরণের দাম দিতে হবে প্রাণ দিয়ে।” জমিদার হেসে উঠল, “প্রাণ তো প্রতিদিনই যায়। কিন্তু আমার ইচ্ছে পূরণ হলে এ সামান্য মূল্য কিছুই নয়।”
এরপর থেকে জমিদার নিয়মিত তাবিজ ব্যবহার করতে শুরু করল। প্রথমে তার ইচ্ছে ছিল ধন-সম্পদ—একই রাতে সে প্রার্থনা করল, “আমার ভাণ্ডার সোনা-রুপায় ভরে উঠুক।” সকালে দেখা গেল তার গুদামঘরে অজানা উৎস থেকে স্বর্ণমুদ্রা এসে জমা হয়েছে। গ্রামবাসী বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল, জমিদার উল্লাসে মাতল। কিন্তু একই সময়ে গ্রামের দক্ষিণ প্রান্তে এক বৃদ্ধ চাষি হঠাৎ প্রাণ হারালেন। কেউ কারণ খুঁজে পেল না। কয়েকদিন বাদে জমিদার চাইলো তার প্রতিদ্বন্দ্বী জমিদার হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ুক। পরদিনই খবর এল, ওই প্রতিদ্বন্দ্বী অকারণে মরে পড়ে আছে খাটের উপর। প্রতিটি ইচ্ছে পূর্ণ হচ্ছিল, আর তার বিনিময়ে কোনো না কোনো প্রাণ নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছিল। গ্রামের লোকেরা অবাক হলেও, তাদের সাহস হচ্ছিল না জমিদারের বিরুদ্ধে মুখ খোলার। ভবানী সাধু দিন দিন আতঙ্কে ডুবে যাচ্ছিল। সে জানত এই মৃত্যুগুলো নিছক কাকতালীয় নয়, বরং তাবিজের রক্তপিপাসু অভিশাপ। তবু জমিদারের লোভের কাছে সে অসহায়। রাতের পর রাত সে প্রার্থনা করত যেন জমিদার থেমে যায়, কিন্তু প্রতিবারই নতুন কোনো ইচ্ছে জমিদারের মনে জেগে উঠত—আর তাবিজ তার ভয়ঙ্কর মূল্য আদায় করত।
গ্রামে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়তে লাগল। কেউ ক্ষেতের কাজে বের হয়ে আর ফিরছে না, কেউ অকারণে বিছানায় ঘুমিয়ে থেকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যাচ্ছে। মানুষ ভয়ে কাঁপতে শুরু করল, বলাবলি চলল—“গ্রামে অভিশাপ নেমেছে।” কারও সাহস হচ্ছিল না সরাসরি জমিদারের দিকে আঙুল তুলতে, কিন্তু সবাই টের পাচ্ছিল, মৃত্যুর ছায়া যেন তাকে ঘিরেই ঘোরাফেরা করছে। ভবানী সাধুর কপালে ঘাম জমে থাকত দিনরাত। সে বুঝতে পারছিল, যদি এইভাবে চলতে থাকে তবে পুরো গ্রাম একদিন মৃত্যুপুরীতে পরিণত হবে। রাতে ঘুমের ভেতরে সে আবার শুনতে পেত সেই সন্ন্যাসীর কণ্ঠ—“এ তাবিজ লোভীদের ধ্বংস করার জন্যই সৃষ্টি।” কিন্তু সে কি কিছু করতে পারছে? তাবিজ তার হাতছাড়া হয়ে গেছে, জমিদারের লোভের আগুনে পুড়তে শুরু করেছে গোটা গ্রাম। প্রতিটি মৃত্যুর খবর শুনে সাধুর মনে হাহাকার উঠত, মনে হত এই সমস্ত রক্ত তার হাত দিয়েই ঝরছে। অথচ তার মুখ বন্ধ, তার চোখে শুধু ভয়। বাইরে থেকে মানুষ ভাবত, জমিদারের ছত্রছায়ায় সে আছে নিরাপদে, কিন্তু ভেতরে ভেতরে সে জানত, এই খেলায় সে-ও আস্তে আস্তে জড়িয়ে পড়ছে অন্ধকারের গভীর ফাঁদে। গ্রামজুড়ে মৃত্যু আর আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল, আর তাবিজের লালচে আভা যেন প্রতিদিন আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠছিল—যেন লোভের আগুনে তার অশুভ শক্তি ক্রমশ বেড়ে চলেছে।
অধ্যায় ৫ – আতঙ্কের শুরু
গ্রামের শান্তিপূর্ণ পরিবেশ যেন এক রাতের মধ্যে ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। প্রথমদিকে এক-দু’জনের মৃত্যু মানুষ হঠাৎ ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনা বলে ভেবেছিল, কিন্তু দিন গড়াতে গড়াতে যখন একে একে আরও লাশ পড়তে শুরু করল, তখন আতঙ্ক গ্রাস করল প্রতিটি ঘরকে। শ্মশানঘাটের ধোঁয়া আর ক্রন্দন যেন চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। মানুষের মনে ভয় ঢুকল—“কে জানে, আজ যে বেঁচে আছে, সে কাল সকালে থাকবে তো?” হাটের আড্ডায়, পুকুরঘাটে, এমনকি মন্দিরের প্রাঙ্গণেও মানুষ শুধু একটাই নাম ফিসফিস করে বলতে লাগল—“তাবিজ।” কিছু মানুষ কাঁপতে কাঁপতে বলত, “এটা কোনো দেবতার দান নয়, শয়তানের খেলা।” আবার কারো কারো মতে, “পিশাচই এ তাবিজে বাসা বেঁধেছে।” মৃত্যুর সঙ্গে এই রহস্যময় জিনিসটাকে যুক্ত করে তারা নিজেদের ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে লাগল। আর এইসব গুজব গ্রাম জুড়ে আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়ল।
কিন্তু যার নাম সবচেয়ে বেশি উঠতে লাগল, সে হল ভবানী সাধু। লোকেরা বলল, “যে সন্ন্যাসী মরার আগে ওর হাতে তাবিজটা দিয়েছিল, তার সঙ্গে কিছু অশুভ সম্পর্ক না থাকলে এমন হতে পারে?” কারো মতে, ভবানী ইচ্ছে করেই মানুষের জীবন বিসর্জন দিয়ে নিজের প্রভাব বিস্তার করছে। কিছু পরিবার এমনকি সরাসরি তাকে অভিশাপ দিল, বলল—“আমাদের ছেলেকে ফিরিয়ে দাও, নইলে তোমারই সর্বনাশ হবে।” রাতের আঁধারে তার কুঁড়েঘরের বাইরে পাথর ছোড়া শুরু হল, কেউ কেউ শাপ-শাপান্ত করতে লাগল। ভবানী সাধু ভিতরে বসে কাঁপতে লাগল, কারণ সে নিজেও ভেতরে ভেতরে বুঝতে পারছিল তাবিজটার সঙ্গে কিছু একটা অশুভ জড়িয়ে আছে। কিন্তু মানুষের ঘৃণা আর সন্দেহের বোঝা তাকে নিঃসঙ্গ করে তুলল। সে নিজের নির্দোষিতার কথা বলতে চাইত, কিন্তু গ্রামবাসীর চোখে এখন সে-ই আতঙ্কের মূর্তি।
অপরদিকে, মৃতদের পরিবারের কান্না আর ভয়ের পরিবেশ গ্রামে এক অদ্ভুত অশান্তি তৈরি করল। রাত নামতেই মানুষ ঘরের বাইরে পা বাড়াতে সাহস করত না। শিশুদের মা-বাবারা আঁকড়ে ধরে রাখত, যেন অদৃশ্য কোনো শক্তি হঠাৎ ছিনিয়ে নিয়ে যেতে পারে। ক্ষেতের কাজ ফেলে, দোকানপাট অর্ধেক খোলা রেখেই মানুষ দ্রুত বাড়ি ফিরত। হাটে ব্যবসা প্রায় বন্ধ হয়ে গেল, সন্ধ্যার পরে রাস্তা শূন্য হয়ে থাকত। এই ভয়ের মধ্যেই কিছু চতুর লোক লোকজনকে বোঝাতে লাগল, “এ অভিশাপ কাটাতে হলে বড় যজ্ঞ দরকার, দেবতাকে তুষ্ট করতে হবে।” কেউ কেউ আবার বলল, “তাবিজটা আগুনে পোড়াতে হবে।” কিন্তু কেউই সাহস করছিল না ভবানীর ঘরে ঢুকে সেই অভিশপ্ত জিনিসটাকে ছোঁয়ার। ফলে গ্রামটা এক অনিশ্চয়তার ঘেরাটোপে বন্দি হয়ে পড়ল—যেখানে প্রতিটি সকাল মানে ভয়, প্রতিটি রাত মানে মৃত্যুর ছায়া। আর ভবানী সাধু ধীরে ধীরে বুঝতে লাগল, এ আতঙ্ক শুধু গ্রামকেই নয়, তাকে গ্রাস করতে শুরু করেছে।
অধ্যায় ৬ – নিষিদ্ধ সত্য
ভবানী সাধু দিন-রাত ভয়ে কুঁকড়ে থাকতে থাকতে বুঝতে পারল, যদি সত্যিই তাবিজটা অভিশপ্ত হয়, তবে তাকে এর রহস্য জানতে হবে। তাই সে চুপিচুপি নিজের দাদার রেখে যাওয়া পুরনো গ্রন্থাগারে ঢুকে পড়ল। মাটির ঘরে বাঁশের তক্তার ওপর সাজানো ধুলো ধরা বইগুলো যেন বহু যুগ ধরে কারও ছোঁয়া পায়নি। একটা একটা করে বই ঘাঁটতে ঘাঁটতে তার চোখে পড়ল কিছু পুঁথি, যেখানে শ্মশানতন্ত্র, রক্তবলি, আর প্রাচীন তান্ত্রিক সাধনার উল্লেখ আছে। মৃদু আলোয় কাঁপতে থাকা প্রদীপের আলোয় পড়তে পড়তে তার শরীর ঠান্ডা ঘামে ভিজে গেল। এক পুঁথিতে লেখা ছিল—“অতৃপ্ত আত্মাদের রক্ত ও প্রাণ বলি দিয়ে বাঁধা তাবিজ, যাহাতে কামনা পূর্ণ হয়, কিন্তু প্রত্যেক কামনার বিনিময়ে প্রাণের মূল্য দাবি করে।” সেখানে স্পষ্ট উল্লেখ ছিল, বহু শতাব্দী আগে এক অন্ধকারাচ্ছন্ন তান্ত্রিক এই তাবিজ তৈরি করেছিল, যার উদ্দেশ্য ছিল শাস্তি দেওয়া। এই তাবিজ লোভী মানুষকে মোহিত করে তাদের ইচ্ছেপূরণের বিনিময়ে তাদের গ্রামকে রক্তশূন্য করে দেয়। ভবানীর বুক কেঁপে উঠল—এতদিন ধরে যা ঘটছে, সবটাই এই অভিশপ্ত ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি।
ভবানী যত পড়তে লাগল, ততই ভয় তাকে আঁকড়ে ধরতে লাগল। সেখানে বর্ণনা ছিল—তান্ত্রিকটি নাকি শ্মশানের চিতাভস্ম, মৃত শিশুর হাড় আর সাতজন কুমারীর রক্ত দিয়ে তাবিজটি গড়েছিল। তার মন্ত্রোচ্চারণে তাবিজে এক অদৃশ্য শক্তি বন্দি হয়েছিল, যে শক্তি মানুষের কামনা পূর্ণ করতে বাধ্য, কিন্তু সাথে সাথে রক্তের ক্ষুধায় তৃষ্ণার্ত হয়ে ওঠে। বলা হয়েছিল, এই তাবিজ যতবার ব্যবহার হবে, ততবার নতুন আত্মা কেড়ে নেবে, আর শেষে যে গ্রামে এটা থাকবে, সেখানকার প্রাণপ্রবাহ থেমে যাবে। ভবানীর চোখের সামনে ভেসে উঠল গ্রামের একের পর এক মৃতদেহের ছবি, শ্মশানঘাটের অদম্য ধোঁয়া, আর শোকাহত পরিবারগুলোর কান্না। তার বুক ধকধক করতে লাগল—সে কি অজান্তেই নিজের হাতে গ্রামকে ধ্বংসের পথে ঠেলে দিয়েছে? পুঁথিতে আরও লেখা ছিল, “যে ব্যক্তি এ তাবিজ ধারণ করে, তারই উপর প্রথম আঘাত আসে।” এই লাইন পড়তেই ভবানীর শরীর কেঁপে উঠল। সে বুঝতে পারল, শুধু গ্রাম নয়, সবার আগে তার নিজের জীবনও এই অভিশাপের কবলে পড়তে পারে।
রাত বাড়তে থাকল, বাইরে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাকের সাথে সাথে ভেতরের ভয় আরও ঘন হতে লাগল। ভবানী সাধু এক কোণে বসে পুঁথিটা আঁকড়ে ধরে রইল। চোখের সামনে বারবার ভেসে উঠছিল সেই অচেনা সন্ন্যাসীর চেহারা, যার শেষ কথাগুলো ছিল সতর্কবাণী। হঠাৎ তার মনে হল, সন্ন্যাসী ইচ্ছা করেই এই তাবিজটা তার হাতে তুলে দিয়ে গেছে—যেন এই গ্রামের মাধ্যমে আবার প্রমাণ হয় মানুষের লোভ কিভাবে তাদের ধ্বংসের পথে নিয়ে যায়। ভবানী নিজের ভেতরে দ্বন্দ্বে ভুগতে লাগল—সে কি তাবিজটা ধ্বংস করার চেষ্টা করবে, নাকি লুকিয়ে রাখবে? কিন্তু মনে পড়তেই লাগল গ্রামবাসীর সন্দেহভরা চোখ, তাদের অভিশাপ, আর ভয়ঙ্কর মৃত্যুগুলো। এখন সে জানে সত্য—এ তাবিজ শুধু ইচ্ছে পূরণের প্রতীক নয়, বরং রক্তের শপথে বাঁধা এক শয়তানি ফাঁদ। আর যদি এ রহস্য গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে, তবে আতঙ্ক দ্বিগুণ হবে। তার বুকের ভেতরে একটাই প্রশ্ন ঘুরতে লাগল—এই নিষিদ্ধ সত্য জেনে এখন সে কী করবে?
অধ্যায় ৭ – বিদ্রোহ
গ্রামের ভয় যখন চরমে পৌঁছল, তখন মানুষের ধৈর্যের বাঁধ ভাঙল। একে একে ঘরে ঘরে মৃত্যুর ছায়া নেমে আসছিল, আর প্রতিটি নতুন মৃত্যুই গ্রামবাসীর সন্দেহকে আরও পাকাপোক্ত করছিল—এই সর্বনাশের মূলে আছে ভবানী সাধু আর তার অভিশপ্ত তাবিজ। একদিন সন্ধ্যায়, হাট থেকে ফেরার পথে কয়েকজন যুবক চিৎকার করে উঠল—“যতক্ষণ ওই ওঝা আর তাবিজ বেঁচে থাকবে, ততক্ষণ আমাদের মৃত্যু থামবে না।” মুহূর্তেই আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়ল এই ডাক। লোকেরা হাতে লাঠি, কুড়াল, মশাল নিয়ে দল বেঁধে রাস্তায় নেমে এল। তাদের চোখে ছিল ক্ষোভ আর ভয় মেশানো উন্মত্ততা। শূন্য রাস্তায় কেবল মশালের আলো নেচে বেড়াচ্ছিল, আর গর্জন তুলছিল একটাই স্লোগান—“তাবিজ চাই, অভিশাপ ভাঙতে হবে।” কিছু বৃদ্ধ আপত্তি জানালেও তাদের গলা শোনা গেল না, কারণ জনতার গর্জন তাদের কণ্ঠ ডুবিয়ে দিল। সেই রাতে গ্রামের প্রতিটি মানুষ যেন একটি মাত্র লক্ষ্য নিয়ে একত্র হল—ওঝার ঘর ভেঙে অভিশপ্ত বস্তুটাকে ধ্বংস করা।
ভবানী সাধু ভেতরে বসে সবকিছু টের পাচ্ছিল। জানলার ফাঁক দিয়ে দেখতে পেল বাইরে শত শত মানুষ জমেছে, তাদের চোখে আগুন, মুখে রক্তপিপাসার চিহ্ন। তার বুক কাঁপতে লাগল, কারণ সে জানত এই জনতার সামনে তার যুক্তি বা সতর্কবাণী কিছুই টিকবে না। তবুও সে সাহস জোগাড় করে বাইরে বেরিয়ে এল। হাতজোড় করে কাঁপা গলায় বলতে লাগল—“আমাকে শোনো, তোমরা ভুল করছো। তাবিজ শক্তিশালী, অভিশপ্ত বস্তু। এটা কোনো সাধারণ জিনিস নয়, এটা ভাঙার চেষ্টা করলে আরও ভয়ঙ্কর বিপদ নেমে আসবে।” কিন্তু জনতার মধ্যে থেকে কেউ ব্যঙ্গ করে হেসে উঠল—“তুই-ই তো বলছিস, এটা ইচ্ছে পূরণ করে। তাহলে তোদেরই লোভে তুই আমাদের অভিশাপে ফেলেছিস।” আরেকজন চিৎকার করে উঠল—“ওর কথা শোনার দরকার নেই। যতক্ষণ তাবিজ আছে, আমাদের মৃত্যু চলবেই। ওকে বেঁধে ফেলে তাবিজ নিয়ে আসো।” মুহূর্তের মধ্যে ভিড়ের চিৎকারে বাতাস ভারী হয়ে উঠল, আর তাদের পায়ের শব্দে মাটি কেঁপে উঠতে লাগল।
ভবানী সাধু প্রাণপণে বোঝানোর চেষ্টা করল, বারবার বলল—“শোনো! তোমরা জানো না তাবিজটা কিসের দিয়ে তৈরি, কী ভয়ঙ্কর শক্তি এর ভেতরে বাঁধা। এটা শয়তানি ফাঁদ, তোমাদের লোভের পরীক্ষা। যদি তোমরা এটা ভাঙতে যাও, তবে এর ক্রোধে গোটা গ্রাম রক্তে ভেসে যাবে।” কিন্তু জনতার কানে কোনো যুক্তি পৌঁছাল না। বরং কয়েকজন এগিয়ে এসে তার দাড়ি টেনে ধরে মাটিতে ফেলে দিল। কেউ লাঠি তুলল, কেউ কুড়াল ঝাঁকাল। তাদের চোখে তখন আর ভয় ছিল না, কেবল উন্মত্ত প্রতিশোধস্পৃহা। সেই মুহূর্তে ভবানী বুঝল, সত্য জেনেও সে অসহায়। গ্রামবাসী আর তাবিজের অভিশাপ—দুটোই এখন তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে। রাতের আকাশে মশালের আগুন ঝলমল করতে লাগল, আর চিৎকার করে উঠল অসংখ্য কণ্ঠস্বর—“তাবিজ চাই! অভিশাপ ভাঙতে হবে!” ভবানী একা দাঁড়িয়ে বুঝতে পারল, এবার শুরু হতে চলেছে এক অদম্য বিদ্রোহ, যার পরিণতি গ্রামকে চিরতরে বদলে দেবে।
অধ্যায় ৮ – শেষ প্রলোভন
রাতটা ছিল অস্বাভাবিকভাবে নিস্তব্ধ, যেন পুরো গ্রাম নিঃশ্বাস বন্ধ করে অপেক্ষা করছে কোনো অজানা ঘটনার জন্য। ভবানী সাধু একা বসে ছিল তার কুঁড়েঘরের ভেতর, মাটির প্রদীপের ক্ষীণ আলোয় তাবিজটা তার সামনে রাখা। গ্রামবাসীর ক্রোধ, তাদের অভিশাপ, আর নিজের ভেতরের অপরাধবোধ তাকে গ্রাস করে ফেলেছিল। দিনের পর দিন মৃত্যু দেখে তার চোখ শুষ্ক হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু আজ রাতটা যেন আলাদা। সে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, আর নয়—এই অভিশাপের ইতি টানতেই হবে। তার মনে দৃঢ় হলো, “যা-ই হোক, কাল সকাল হবার আগেই তাবিজটা ধ্বংস করতে হবে।” কিন্তু সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ হলেও বাস্তবায়ন করা ছিল দুঃস্বপ্নের মতো কঠিন। যখনই সে হাত বাড়ায় তাবিজের দিকে, তার মনের ভেতর অদ্ভুত কণ্ঠস্বর ভেসে আসে, সেই অচেনা সন্ন্যাসীর সতর্কবাণীর মতো—“এতে যা চাইবে তাই পাবে, কিন্তু তার মূল্য তোমরা দেবে রক্তে।” সে কাঁপতে থাকে, বুক ধড়ফড় করে ওঠে, আর সেই কণ্ঠস্বর ধীরে ধীরে রূপ নেয় তার নিজের ভেতরের আকাঙ্ক্ষার শব্দে।
ভবানীর চোখ হঠাৎ জলভরা হয়ে উঠল, কারণ তাবিজটা তাকিয়ে থাকতে থাকতে তার মনে পড়ে গেল সেই দিনের কথা যেদিন তার একমাত্র সন্তানকে সে হারিয়েছিল। বহু বছর আগে, গ্রামে মহামারী ছড়িয়ে পড়েছিল। শিশুর কান্না আর শ্মশানের ধোঁয়া মিলে যেন পুরো গ্রামটাকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে দিয়েছিল। সেই মহামারীতে ভবানী নিজের ছোট ছেলেটাকে হারিয়েছিল—একদম কচি বয়সে, যে এখনও হাঁটতে শেখেনি ঠিকমতো। সেই কান্নার শব্দ, সেই নিঃসাড় মুখটা আজও তার বুক ভেদ করে বেদনার মতো রক্তক্ষরণ করত। এতদিন সে ভেবেছিল সময়ই তাকে ভুলিয়ে দিয়েছে, কিন্তু না—তাবিজের সামনে বসে থাকা মাত্রই সেই পুরনো ক্ষত আবার হাহাকার করে খুলে গেল। তার মনে হলো—“যদি পারি, একবারের জন্য হলেও যদি আমার সন্তানকে ফিরে পাই… যদি আবার তার মুখটা দেখতে পারি…” চোখের জল ঝরে পড়ল, বুকের ভেতর দম আটকে আসতে লাগল। সে জানত, এটা প্রলোভন, তবুও সেই স্বপ্ন তাকে গ্রাস করে ফেলছিল।
এই দ্বন্দ্ব তাকে যেন ছিঁড়ে ফেলছিল। একদিকে গ্রামের মুক্তি—যেখানে শত শত প্রাণ আজ বিপন্ন, প্রতিদিন নতুন মৃত্যুর হাহাকার উঠছে। অন্যদিকে তার নিজের অদম্য বেদনা, যে স্বপ্ন সে সারাজীবন বুকের ভেতরে কবর দিয়ে রেখেছিল। সে জানত, একবার যদি তাবিজের কাছে প্রার্থনা করে, তবে সন্তানের মুখ সে ফিরে পাবে, কিন্তু সেইসঙ্গে আবারও কারও প্রাণ যাবে। হয়তো নির্দোষ কোনো শিশু, হয়তো কোনো বৃদ্ধ, হয়তো তার পরিচিত কেউ। প্রদীপের আলোতে তাবিজটা যেন জ্বলজ্বল করে উঠছিল, কালো কাপড়ের ভাঁজে যেন নড়ছিল লোভের আগুন। ভবানীর হাত ধীরে ধীরে তাবিজের দিকে বাড়তে লাগল, তারপর আবার কেঁপে ফিরে এল। তার বুকের ভেতর যুদ্ধ চলতে লাগল—“আমি কি আমার ছেলেকে ফিরে পেতে চাই, নাকি পুরো গ্রামকে রক্ষা করতে চাই?” বাইরের বাতাস হুহু করে বয়ে যাচ্ছিল, জানালার ফাঁক দিয়ে আসা অন্ধকার যেন তাকে ঘিরে ধরে কানে কানে বলছিল—“একবার ডাকো, আর সবকিছু ফিরে পাবে।” সে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে গেল, দাঁত চেপে ফেলল, তবুও শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারল না। সেই রাত, সেই তাবিজ, আর সেই দ্বন্দ্ব—ভবানী সাধুর জীবনের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর প্রলোভনের সাক্ষী হয়ে রইল।
অধ্যায় ৯ – রক্তের বলি
রাতের গভীর নিস্তব্ধতায় ভবানী সাধু বুঝতে পারল, তার সামনে আর কোনো পথ খোলা নেই। তাবিজের অদ্ভুত আলো যেন তার চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছিল, একদিকে তাকে টানছিল সন্তানের মুখ দেখার অদম্য বাসনা, অন্যদিকে তাকে শাসন করছিল গ্রামকে রক্ষার দায়িত্ব। সেই অচেনা সন্ন্যাসীর সতর্কবাণী হঠাৎ আবার কানে বাজল—“মূল্য তোমরা দেবে রক্তে।” ভবানীর বুক কেঁপে উঠল, কারণ হঠাৎই সে উপলব্ধি করল, অভিশাপ ভাঙার একমাত্র পথ হলো নিজের রক্ত উৎসর্গ করা। এই অভিশপ্ত তাবিজ লোভী মানুষকে ধ্বংস করার জন্যই তৈরি হয়েছিল, আর যদি সত্যিই তাকে শেষ করতে হয়, তবে প্রলোভন ত্যাগ করে স্বেচ্ছায় প্রাণ বিসর্জন দিতে হবে। কুঁড়েঘরের চারদিকে তখন ঘন অন্ধকার, প্রদীপের শিখাও প্রায় নিভে আসছিল। তবুও ভবানী দাঁড়াল, হাত কাঁপতে কাঁপতে তাবিজটা তুলে নিল। তার চোখে তখন অদ্ভুত শান্তি—যেন বহু বছরের বোঝা নামানোর সময় এসে গেছে।
সে নিজের কপালে হাত বুলিয়ে সন্তানের কথা মনে করল। চোখের সামনে ভেসে উঠল ছোট্ট দেহটা, শ্বাস নিতে না পারার যন্ত্রণায় ছটফট করা মুখ। বুকটা ফেটে যাচ্ছিল, কিন্তু এবার সে স্থির। নিজের ইচ্ছে পূরণের মুহূর্তেই গ্রাম ধ্বংস হবে, এই সত্য তাকে নতুন শক্তি দিল। হাতে তাবিজ নিয়ে সে মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসল। মাটিতে রাখা একটা ধারালো ছুরি তুলে নিল, যেটা সে আগে যজ্ঞের সময় ব্যবহার করত। তার ঠোঁট নড়ল প্রার্থনার মতো—“হে মা, আমাকে ক্ষমা করো। আমি এই গ্রামকে রক্ষা করতে চাই, আমার সন্তানের আত্মাকেও শান্তি দিতে চাই।” চোখ বুজে সে ছুরির ধার নিজের বুকে চালিয়ে দিল। ব্যথার ঝাঁকুনি সারা শরীর কাঁপিয়ে দিল, গরম রক্ত ছিটকে বেরোল, আর সেই রক্ত তাবিজের গায়ে গিয়ে পড়তেই কালো কাপড়ের ভেতর থেকে ভয়ঙ্কর আলো বেরোতে লাগল। মুহূর্তের মধ্যে যেন পুরো ঘর কেঁপে উঠল, হাওয়া ঝড়ের মতো বইতে লাগল, আর অজানা মন্ত্রোচ্চারণের শব্দ ভেসে এল চারদিক থেকে।
গ্রামের মানুষ তখনও বাইরে উত্তেজিত ছিল, কিন্তু হঠাৎ তারা দেখল, আকাশে এক অদ্ভুত লাল আভা ছড়িয়ে পড়ল। বাতাস কাঁপতে লাগল, শ্মশানের দিক থেকে উঠল এক হাহাকারময় শব্দ, যেন শত শত অশান্ত আত্মা মুক্তি চাইছে। কয়েক মুহূর্ত পর সবকিছু নিস্তব্ধ হয়ে গেল। ভোরের আলো ফুটতেই দেখা গেল, গ্রামের মৃত্যু যাত্রা যেন থেমে গেছে—কেউ আর অকারণে মারা গেল না। মানুষ বুঝল, অভিশাপ কেটে গেছে। কিন্তু ভবানীর কুঁড়েঘরে ঢুকে তারা দেখল তার নিথর দেহ মাটিতে পড়ে আছে, বুক থেকে রক্তে ভিজে গেছে তাবিজ। অথচ তাবিজ তখন নিস্তেজ—অভিশপ্ত শক্তি হারিয়ে নিছক এক কালো পাথরের টুকরো হয়ে আছে। গ্রামবাসীরা কান্নায় ভেঙে পড়ল, যারা গতদিন পর্যন্ত তাকে অভিশাপ দিয়েছিল তারাই এবার মাথা নত করে বলল—“ওই সাধুই আমাদের রক্ষা করল।” ভবানী সাধুর প্রাণ বিসর্জনে অভিশাপ ভাঙল, গ্রাম মুক্তি পেল অশুভ শক্তির হাত থেকে। শ্মশানঘাটের অশান্ত ধোঁয়াও সেদিন থেকে থেমে গেল, আর বাতাসে ছড়িয়ে পড়ল মুক্তির নিঃশ্বাস। ভবানীর মৃত্যু যেন গ্রামকে নতুন জীবন দিল, কিন্তু সেই সঙ্গে রক্তে লেখা হয়ে রইল এক ভয়ঙ্কর শিক্ষা—লোভের মূল্য সর্বদাই মৃত্যু।
অধ্যায় ১০ – অভিশাপের ছায়া
অভিশাপ ভাঙার পর গ্রামে ধীরে ধীরে শান্তি ফিরতে শুরু করল। মৃত্যুর ভয় আর আতঙ্কে জর্জরিত মানুষের চোখে আবার আশার আলো জ্বলল। যারা এতদিন ঘর থেকে বেরোতে সাহস করত না, তারা আবার মাঠে নামল, হাটে ভিড় জমল, আর শ্মশানঘাটে যে কালো ধোঁয়া দিনরাত ভেসে বেড়াত তা মিলিয়ে গেল ভোরের আলোয়। কিন্তু গ্রামবাসীর মনে একটা অদ্ভুত শূন্যতা থেকে গেল। প্রত্যেকেই কাউকে না কাউকে হারিয়েছিল সেই অশুভ সময়ে—কেউ ভাইকে, কেউ সন্তানকে, কেউ স্বামী বা স্ত্রীকে। তাদের শোকে শান্তির আবরণ বারবার ছিঁড়ে যাচ্ছিল। ভবানী সাধুর আত্মত্যাগ নিয়ে তারা গর্ব করলেও, মনে মনে একটা অপরাধবোধও গেড়ে বসেছিল। তারা ভাবছিল, যদি তারা আগেই তার কথায় কান দিত, যদি তারা তাকে অপমান না করত, তবে হয়তো এতগুলো প্রাণ অকালে ঝরে যেত না। ভাঙা কুঁড়েঘরের সামনে দাঁড়িয়ে তারা নীরবে প্রার্থনা করল—যে মানুষটাকে তারা দোষারোপ করেছিল, সেই-ই তাদের প্রাণ বাঁচিয়ে গেছে।
কিন্তু মুক্তির মাঝেও অদ্ভুত এক অস্বস্তি ছায়ার মতো রয়ে গেল। শ্মশানঘাটের ধ্বংসস্তূপে যেখানে ভবানী সাধুর রক্ত মিশে তাবিজটা ভেঙে গিয়েছিল, সেখানে আজও বাতাসে একরকম শীতল কম্পন ছড়িয়ে থাকত। রাতে যারা সাহস করে সেখানে যেত, তারা শপথ করে বলত—চাঁদের আলোয় ভাঙা ছাইগুলো নড়াচড়া করে, যেন কোনো অদৃশ্য শক্তি এখনও শ্বাস নিচ্ছে মাটির ভেতর। কেউ কেউ দাবি করত, কানে হালকা ফিসফিসানি শোনা যায়—যেন কেউ বলে যাচ্ছে, “তুমি কী চাও… আমি দিতে পারি।” এইসব গল্প প্রথমে মানুষ কল্পনা ভেবে উড়িয়ে দিলেও, ধীরে ধীরে তারা বুঝল অভিশাপের ছায়া পুরোপুরি মুছে যায়নি। লোভের বীজ একবার জন্মালে তা মাটির নিচে দীর্ঘকাল সুপ্ত থাকে, আবার একদিন কোনো দুর্বল হৃদয়ের প্রলোভনে মাথা তোলে। গ্রামের বৃদ্ধরা তখন ছেলেমেয়েদের সতর্ক করে বলত, “শ্মশানের দিকে যেও না, তাবিজের ছাই স্পর্শ কোরো না, ওখানে এখনও অন্ধকার লুকিয়ে আছে।”
গল্প শেষ হলেও গ্রামের মানুষের জীবনে সেই অন্ধকারের ছায়া থেকে গেল, ঠিক যেন ভাঙা প্রাচীন শ্মশানের ভেতর দিয়ে বাতাস বইলে হাহাকার শোনা যায়। তারা জানত, ভবানী সাধুর আত্মত্যাগ তাদের রক্ষা করেছে, কিন্তু অভিশপ্ত তাবিজের কাহিনি চিরকাল সতর্কবাণী হয়ে থাকবে। প্রতিটি পূর্ণিমার রাতে কেউ না কেউ শপথ করে শুনত দূরের বাতাসে এক ফিসফিসানি—“লোভের ইচ্ছে কখনোই সত্যিই শেষ হয় না…” তখন তারা কেঁপে উঠত, জানত—মানুষ যতদিন লোভে অন্ধ হবে, ততদিন এই গল্প আবার জন্ম নিতে পারে। তাই গ্রাম শান্ত হলেও, তার ভেতরে চিরকাল থেকে গেল সেই শিক্ষা—অভিশাপ বাইরে থেকে আসে না, জন্ম নেয় মানুষের অন্তরের লোভ থেকেই। আর সেই লোভের ছায়া কখনোই পুরোপুরি মিলিয়ে যায় না, কেবল অপেক্ষা করে আবার কারও হৃদয়ে শেকড় গাড়ার জন্য।
শেষ