Bangla - ভূতের গল্প

নির্বাক স্কুলঘর

Spread the love

অরিত্র ভট্টাচার্য


আমাদের গ্রামের নাম হিজলতলা, চারদিকে জলাভূমি, তালডোবা, মাঝেমধ্যে ধানক্ষেতে চিলের পাখা লেগে বাতাস কেটে যায়, আর মাঝখানে বটগাছের ছায়ায় পড়েই আছে যে জিনিসটা নিয়ে এত কথা—পুরনো প্রাইমারি স্কুলঘর। টালির ছাদে শ্যাওলা, দরজায় মরচে, জানালার কাঠ নড়ে উঠলেই যেন লম্বা ককিয়ে ওঠা কান্না, আর ভেতরে ধুলো জমা বেঞ্চ-ডেস্ক যাদের ওপর আমরা কোনোদিন বসিনি, কারণ স্কুলটা বন্ধ হয়ে গেছে অনেক বছর। কেন বন্ধ, সেটা নিয়ে গ্রামের লোকের হাজার গল্প। কেউ বলে, শিক্ষক আত্মহত্যা করেছিলেন, কেউ বলে একটা মেয়ের সঙ্গে তাঁর গোপন সম্পর্ক ছিল, কেউ বলে রাতে চক ঘষার শব্দ শুনে পাগল হয়ে যান। এসব কথার সঙ্গে সঙ্গে আমরা—আমি, বাপন, শুভ, মিলন আর নীলয়—বড় হতে হতে ভয় আর কৌতূহল একই মাপে বুকের ভেতর জায়গা করে নিয়েছে। বিকেলবেলা পুকুরঘাটে বসে চায়ের ভাপ উঠলে, কথায় কথায় স্কুলঘরটা উঠে আসে। বাপন সবসময়ই বলত, “ভূত বলে কিছু নেই, কেবল বাতাসে জানালা লাফায়, চিকে ঘষা পড়ে শব্দ হয়।” শুভ তার বিপরীতে বলত, “তুই যা-ই বলিস, কাকিমার বোন যে বলেছে ব্ল্যাকবোর্ডে রাতে লেখার শব্দ শোনা যায়, সেটা কি হাওয়া?” আমরা হেসে উড়িয়ে দিলেও ভিতরে ভিতরে একটা অদ্ভুত শিরশিরে ঠান্ডা নেমে যেত। জুলাইয়ের একটা ভ্যাপসা বিকেলে সব ঠিক হল। মাঠে ফুটবল খেলার পর ঘাম শুকোতে শুকোতে আমরা বটগাছের নিচে বসে আছি। আকাশে তখন কালো মেঘের গাঢ় দেয়াল, দূরে বিদ্যুৎ চমকালে যেমন সর্বনাশের আগে সতর্কবাণী বাজে, তেমনই বুকের ভেতর এক নাম-না-জানা চাপা উত্তেজনা। মিলন হঠাৎ বলল, “চল, আজ রাতে ঢুকেই দেখি। বাজি থাকল—যে ভীতু প্রমাণিত হবে, সে এক মাসের টিফিন খরচ দেবে বাকিদের।” নীলয় চোখের চশমা খুলে ঘামে ভেজা গামছা দিয়ে মুছল, বলল, “বাজি ধরলি? ভুলে যাস না, আজ শ্রাবণী পূর্ণিমা।” আর আমি—আমি কষ্ট করে হেসে বললাম, “পূর্ণিমা হলে কী হয়? চাঁদটা অন্তত আমাদের সঙ্গে থাকবে।” ভেতরে কোথাও একটা টান। ভয়কে পকেটে কুচকে ঢোকালেও তার ধারালো প্রান্ত কাপড় ভেদ করে বারবার মনে করিয়ে দেয়, “আমি আছি।” ঠিক হল, রাত বারোটায় আমরা স্কুলঘরের সামনের বারান্দায় দাঁড়াব, তালাটি আগেই খোলা থাকে—গ্রামপঞ্চায়েতের লোকেরা বলে নাকি কেয়ারটেকার নেই, কিন্তু ভাঙা তালায় ফিটকারি ঝরে পড়ে, দেখে মনে হয় কেউ একটা নীরব চাবি দিয়ে প্রতিদিনই দরজা খোলে-মোছে। সন্ধে নামতেই বাড়ি ফিরে আমি মাকে বললাম, “বাপনদের সঙ্গে পড়তে যাব। রাত্রে একটু দেরি হবে।” মা খুন্তি হাতে তাকালেন, চোখে যেন কৌতূহল আর সন্দেহের নরম রেখা। “অনেক রাত করিস না। ভূতের গল্প শুনে এসে যেন জ্বর না ওঠে।” আমি হেসে বললাম, “ভূত নেই।” মায়ের ঠোঁটে একটা হাসি খেলা করল—যে হাসির ভেতর উপহাস নয়, আশীর্বাদও নয়, কেবল এক অনভ্যস্ত ভয়কে সামলানোর মন্ত্র। খাওয়া-দাওয়া সেরে, পকেটে একটা ছোট টর্চ, দুটো দেশলাই, আর বাপনের বাড়ি থেকে ধার করা তিনটে নতুন চক নিয়ে বেরোলাম—চকগুলো নিয়ে তেমন প্ল্যানও ছিল না, কেবল মনে হচ্ছিল ব্ল্যাকবোর্ডে যদি সত্যি সত্যি কিছু থাকে, তাহলে আমরা নিজেই কিছু লিখে দেখে নেব। রাত তখন সাড়ে এগারো। গ্রামটা অদ্ভুত নীরব। কুকুরের ডাকে দূরে কোথাও গৃহস্থালির আলো নিভে গেছে, বাতাসে কাঁচা কাঁঠালের গন্ধ লেগে আছে, আর আকাশে পূর্ণিমা—চাঁদের আলো এত উজ্জ্বল যেন ঘাসের ফাঁকে ফাঁকে রুপোর সরু রেখা টেনে দিয়েছে কেউ। আমরা পাঁচজন আলপথ ধরে এগোলাম। নীলয় বলল, “চক এনেছ?” আমি পকেট টিপে—“আছে।” শুভ ধীরে ধীরে গুনগুন করতে লাগল, “ওই যে, চাঁদের আলো…” গলা কেঁপে যায়, সে থামে। বটগাছটা সামনে দেখা গেলে বুকের ভেতর ধুপধুপ বেড়ে গেল। স্কুলঘরের দেয়ালে পলেস্তারা খসে পড়েছে, তবু ‘হিজলতলা প্রাথমিক বিদ্যালয়’—এই পাঁচটা শব্দ সুন্দর হাতে আঁকা নামফলকে টিকে আছে। যেন কেউ প্রতিদিন ভোরে উঠে নামটা পরিষ্কার করে লেখে। বারান্দার সিমেন্ট ভাঙা, খুঁটির গায়ে পুরনো পোস্টার, ‘সারস্বতী পূজা—২০০৯’, তার ওপর দিয়ে টিকটিকির লেজের আঁচড়। দরজার লোহার তালা ঝুলে আছে, কিন্তু স্পর্শ করতেই ঠক্ করে খুলে গেল—যেন দীর্ঘদিনের অভিমান থেকে সরে গিয়ে দরজাটা আমাদের স্বাগত জানাল। ভেতরে ঢুকে প্রথমেই যে গন্ধটা নাকে এলো, সেটা হল ভেজা কাঠ, ধুলো, আর একটা প্রাচীন চকের গন্ধ—যে গন্ধে শিশুদের বর্ণপরিচয় লেগে থাকে। টর্চটা জ্বালতেই আলো পুরু ধুলো কেটে সরু পথ বানিয়ে নিল। ব্ল্যাকবোর্ডটা ঠিক সামনে—কালো নয়, সময়ের ছোপে ধূসর-সবুজ। তার ওপর হালকা সাদাটে রেখা—কেউ যেন বহুদিন আগে ‘অ, আ, ই’ লেখা শুরু করে থেমে গেছে। বাপন বলল, “শুরু করব?” মিলন হেসে বলল, “প্রথমে ভয়ের উৎস খুঁজে বের করাই রুল। জানালা খোলো, হাওয়া ঢুকলে কাঠ নড়বে, শব্দ হবে—লোকেরা ভাববে ভূত।” নীলয় বলল, “যা-ই কর, বারোটায় কী হয় দেখি।” আমরা ঘড়ি দেখা শুরু করলাম। আমার হাতঘড়ির কাঁটা তখন ১১:৫৮। শুভ বলল, “শোন, একটা গল্প আছে—বারোটায় নাকি বোর্ডে চক নিজে নিজে লেখা শুরু করে, আর যে সেটা পড়ে, তার মাথায় নাকি অদ্ভুত গুঞ্জন ধরে।” বাপন মুখ বিকৃত করল, “ওসব ছেলেমানুষি।” ঘড়ির কাঁটা ১১:৫৯—বোর্ডের সামনে দাঁড়িয়ে আমরা নিঃশ্বাস আটকে আছি। বাইরে বাতাস বাড়ে, টিনের ছাদে কোথাও একটা টুপ্ করে জল পড়ে, আর বারান্দায় রাতচরা পাখির ডানার শব্দ। তারপর—বারোটা। সেই মুহূর্তটা, যখন সময় যেন পায়ের ওপর ভর দিয়ে নামল, স্কুলঘরের ভেতরে এক অদ্ভুত শীতলতা ছড়িয়ে পড়ল। যেন কেউ অদৃশ্যভাবে দরজার ফাঁক গলে ঢুকে পড়েছে। আমি টর্চের আলো বোর্ডে স্থির করে রাখলাম। কিছুই না। কেবল ধুলোয় কাঁপা কাঁপা দানা। আমরা চোখের পাতা ফেলছি না—এমন সময়, খুব ধীর, প্রায় শ্বাসের মতো ক্ষীণ, একটা ঘষা ঘষা শব্দ। যেন কাচের গায়ে নখ। না—না, এটা চক। শব্দটা বোর্ডের ডানদিকের ওপর কোণা থেকে শুরু হয়ে একটু নিচে নামে, থামে, আবার ওঠে। বাপনের মুখটা কেমন নিস্তেজ। “কে?” সে ফিসফিস করে। উত্তর নেই—শুধু সেই ঘষা শব্দ, আর আমাদের বুকের শব্দ। আমি সাহস জুগিয়ে টর্চ আরও কাছে ধরলাম—আর ঠিক তখনই আমরা দেখলাম, বোর্ডের ওপর খুব ধীরে ধীরে একটাই বাঁকানো সাদা রেখা ফুটে উঠছে। যেন কেউ ‘অ’ অক্ষরের শুরুটা টানছে। শুভ পিছিয়ে গেল, কাঁধে আমার ঠোক্কর লাগল, আলো কেঁপে উঠল। “এটা বাতাসে?” মিলন বলল, কিন্তু তার গলাতেও সন্দেহ। “বাতাস চক ধরে রাখতে পারে?” নীলয় ফিসফিস করল। আমি পকেট থেকে একটা চক বের করে বোর্ডের নিচে রেখে দিলাম। “যদি সত্যি কেউ থাকে, ধরতে দিন।” কথাটা বলতেই আমার নিজের গলার আওয়াজ অপরিচিত, কাঁপা। চকটা বোর্ডের নিচে স্থির। আমরা চুপ। বাইরের কুকুর হঠাৎ কী দেখে ডেকে ওঠে। পোকাদের টুংটাং। তারপর এক নিঃশ্বাসের সময় পেরিয়ে গেল—চকটা নড়ল। খুব সামান্য, যেন বোর্ডের পায়ের কাছে কোনো অদৃশ্য আঙুল তাকে ঠেলে দিল, আর সে লাফিয়ে উঠে এল এক ইঞ্চি। আমার টর্চের আলোতে সেটা স্পষ্ট। শুভ প্রায় চিৎকার করে ওঠার আগেই মিলন তার মুখ চেপে ধরল। “শান্ত!” বাপনের চোখে অবিশ্বাস, ক্রোধ, ভয় সব এক ফ্রেমে স্থির হয়ে আছে। সেই অদৃশ্য শক্তি যেন চকটাকে ধীর গতিতে বোর্ডের দিকে টেনে নিল, তারপর এক অমানুষিক ধৈর্যে, আমরা যতটা দেখে থাকতে পারি তার মধ্যে সবচেয়ে দীর্ঘ সময় নিয়ে, একটি বাঁক টানল। সাদা রেখা। আমরা পাঁচজন ঠিক কী দেখলাম সেটা পরে কেউ একভাবে বলতে পারিনি—কারও কাছে সেটা ‘অ’, কারও কাছে ‘আ’-এর প্রথম ডাণ্ডা, আর আমার কাছে সেটা নিছক একটা শুরু—অক্ষরের, গল্পের, ভয়ের। ঠিক তখন বাইরে হাওয়ার ঝাপটা এসে জানালার আধভাঙা কপাটকে ধাক্কা দিল, খচ্ করে আওয়াজ উঠল, আর বোর্ডের ওপর চক থেমে গেল। আমরা নিশ্বাস নিলাম। বাপন বলল, “এটা কৌশল। কেউ আছে। লুকিয়ে।” এমন দাপটের গলায় বলল যে মুহূর্তে আমাদেরও মনে হল ভেতরে সত্যিই কেউ পালিয়ে বেড়াচ্ছে। “খুঁজে বার করব।” আমরা চারদিকে টর্চ ফেললাম—ভাঙা আলমারি, টালির ছাদের কড়িবরগা, আলোয় উড়ে যাওয়া ধুলো, পায়রার নড়াচড়া—কেউ নেই। আমি বোর্ডের দিকে তাকিয়ে দেখি চকটা আবার স্থির, কিন্তু সাদা দাগটা সেখানে রয়ে গেছে। আমি হাত বাড়িয়ে ছুঁতে যাব, ঠিক তখনই খুব ক্ষীণ একটা কণ্ঠ, যেন কারও দাঁত-চাপা ফিসফিসানি, আমাদের কানে আছড়ে পড়ল—“চকটা কে নিল?” শব্দটা এত কম যে হয়তো ভুলও হতে পারে, কিন্তু পাঁচজনেরই চোখ একসঙ্গে বড় হয়ে গেল। শুভ প্রথমে কথা বলল, “কে?” কোনো উত্তর নেই—তবে বোর্ডের ধুলোয়, আলো লাগতেই আমরা স্পষ্ট দেখতে পেলাম, কয়েকটা শব্দ আঙুল দিয়ে লেখা হয় যেমন, তেমন কিছু আঁচড় ধরা পড়েছে—‘শোনো’। অক্ষরগুলো অদ্ভুত, অসম, যেন কাঁপতে কাঁপতে লেখা। বাপন দাঁত চেপে বলল, “কেউ জানালার ফাঁক দিয়ে লিখেছে।” সে জানালার দিকে দৌড়তেই আরও একবার খচ্ করে শব্দ—কিন্তু জানালার বাইরে কেবল চাঁদের আলো আর রাতের শূন্যতা। মিলন ফিরে এসে বোর্ডের দিকে তাকিয়ে বলল, “এটা যদি খেলা না হয়, তাহলে কেউ আমাদের কিছু বলতে চাইছে।” আমরা আবার গোল হয়ে দাঁড়ালাম। ঘড়িতে ১২:০৭। এই সাত মিনিটেই যেন এক যাপিত জীবনের প্রান্ত বদলে গেছে। আমি পকেট থেকে দ্বিতীয় চকটা বের করে বোর্ডের তলায় রাখলাম, আর ধীরে ধীরে বললাম, “তুমি কী বলতে চাও?” এই প্রশ্নটায় ‘তুমি’ শব্দটা এমন সহজে বেরোল যে নিজেদেরও অদ্ভুত লাগল—যেন আমরা কারও সঙ্গে সত্যিই কথা বলছি। যে-ই হোক, সে উত্তর দিতে একটু সময় নিল। তারপর টেবিলের নীচে কোথাও থেকে আস্তে আস্তে বেঞ্চের কাঠ কেঁদে উঠল, আর ব্ল্যাকবোর্ডের ঠিক মাঝখানে অতিক্ষীণ ঘষা শব্দে ফুটে উঠল আরেকটা একক, সোজা দাগ—যেন কোলন। শুরু, বিরাম, ইশারা—অথবা ডাক। আমি গলায় জমে ওঠা কাঁটার শব্দ গিলতে গিলতে ফিসফিস করে বললাম, “আমরা শুনছি।” আর ঠিক তখনই বাইরে থেকে ভেসে এল রাত্রির দমকা হাওয়া, দরজা নিজে নিজে খানিকটা খুলে গেল, আর বারান্দার অন্ধকারে যেন একটা ক্ষীণ ছায়া সরল—মুখ দেখা যায় না, কেবল সাদা শাড়ির কিনারার মতো কিছু, বা হয়তো চাঁদের আলোয় দুলতে থাকা ধুলোকণা। আমরা কারও নাম ধরে ডাকতে যাচ্ছি, এমন সময় বোর্ডের ওপর তিনটে আঁচড় টানটান করে উঠল—যেন কেউ ভীষণ তাড়াহুড়োয় লিখে উঠল, ‘শুনো’। তারপর সব থেমে গেল। ঘড়িতে ১২:১০। ওই দশ মিনিটে আমরা পাঁচজনই বুঝে গেলাম—ভয় এসে গেছে, আর সে ভয় নিছক দৌড়োতে-দৌড়োতে আমাদের ধরবে না, সে আমাদের ডেকে নেবে, বোঝাবে, একখানা গল্প খুলে দেবে—যার প্রথম লাইন আমরা আজ রাতেই পড়তে শুরু করলাম।

চক দিয়ে লেখা “শুনো” শব্দটা আমাদের সামনে তখনও কেঁপে কেঁপে দাঁড়িয়ে আছে। টর্চের আলোয় ওটা যেন ঝিলিক মেরে উঠছে, আবার মিলিয়ে যাচ্ছে। আমরা কেউ কথা বলছি না। কেবল একে অপরের নিশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছি, যেন কোনো অচেনা চাপ আমাদের বুকে বসে আছে।

বাপন হঠাৎ কাশি দিয়ে গলা পরিষ্কার করল। “কে আছিস?” তার গলা জোরালো, কিন্তু আমরা বুঝলাম সেটাই তার একমাত্র ভরসা—জোরে কথা বলে ভয় ঢেকে রাখা।

কোনো উত্তর নেই। তবে বাতাসের ভেতর যেন একধরনের শীতল স্রোত বয়ে গেল। আমাদের চামড়ার লোম খাড়া হয়ে উঠল। বাইরে দূরে কুকুরেরা ফের একবার চেঁচিয়ে উঠল, তারপর নিস্তব্ধতা।

শুভ ফিসফিস করে বলল, “আমরা চলে যাই চল। যা দেখার তো দেখে ফেলেছি।”

মিলন তার কাঁধে হাত রেখে বলল, “না রে, এখন গেলে তো বাজি হেরে যাব।” তার গলাতেও ভয়, কিন্তু চোখে কৌতূহলের আগুন।

নীলয়, যে সবসময় যুক্তি খোঁজে, এবারও বলল, “এটা কারও দুষ্টুমি। কেউ লুকিয়ে আছে এখানে। চল খুঁজি।”

আমরা পাঁচজন ভেতরে ঢুকে প্রতিটি ক্লাসঘর, আলমারি, টেবিল, বেঞ্চ সব তন্নতন্ন করে দেখতে লাগলাম। টর্চের আলো ধুলোয় ঝিলমিল করছে, কোথাও একটা পুরনো খাতা ছিঁড়ে পড়ে আছে, তাতে অর্ধেক লেখা নামের তালিকা—‘পার্থ’, ‘রিমি’, ‘সুব্রত’—তারপরই পাতা ফাঁকা। যেন কেউ ক্লাস রেজিস্টার রেখে গিয়েছিল তাড়াহুড়ো করে।

ঠিক তখনই বোর্ডের দিক থেকে আবার শব্দ এল। খচখচ করে। আমরা একসঙ্গে ঘুরে দাঁড়ালাম। চকটা নিজে নিজেই নড়ে উঠেছে, এবার ধীরে ধীরে লিখছে—

সত্যি জানো?”

আমাদের গলা শুকিয়ে গেল।

বাপন চিৎকার করে উঠল, “কে তুই? দেখাও নিজেকে!”

আবার কোনো উত্তর নেই। শুধু জানালার পাশে হঠাৎ চাপা হাসির মতো এক শব্দ। মেয়েলি নাকি পুরুষালি, বোঝা গেল না। আমরা চারদিকে আলো ফেললাম—শূন্য।

মিলন সাহস করে এগিয়ে গিয়ে বোর্ড ছুঁয়ে দিল। হাতের তালুতে সাদা গুঁড়ো লেগে গেল, একদম টাটকা চক ঘষলে যেমন হয়। সে হাত তুলে আমাদের দেখাল, “দেখেছিস? এটা বাস্তব।”

আমরা বোর্ডের নিচে তৃতীয় চকটা রেখে দিলাম। মিনিটখানেক অপেক্ষা। এবার কোনো শব্দ নেই, কেবল জানালার কপাট হাওয়ায় ঠকঠক করছে। আমরা ভাবলাম হয়তো সব শেষ। ঠিক তখনই ভেতরের এক বেঞ্চ যেন হঠাৎ নিজে নিজেই সরে গেল কয়েক ইঞ্চি। কাঠের ঘষা ঘষা আওয়াজে আমাদের বুক কেঁপে উঠল।

বেঞ্চের নিচে আলো ফেলতেই দেখা গেল—কোনো ছায়া নেই, কোনো মানুষ নেই, কিন্তু ধুলোয় একজোড়া ছোট ছোট পায়ের ছাপ। যেন ক্লাস ওয়ানের কোনো বাচ্চা সবে হেঁটে গেছে।

শুভ কেঁপে কেঁপে বলল, “ছোট বাচ্চা? এখানে?”

নীলয় কাঁপা গলায় বলল, “না রে… এ তো ভূত।”

আমরা স্থির দাঁড়িয়ে আছি। তারপর বোর্ডে আবার আঁচড়। এবার স্পষ্ট অক্ষরে ফুটে উঠল—

মাস্টারমশাই

এই শব্দটা যেন বজ্রপাতের মতো আমাদের মাথায় আছড়ে পড়ল। গ্রামের সব গুজব, সব ফিসফাস, সব কাহিনি হঠাৎ সত্যি হয়ে উঠল। কারণ আমরা জানতাম—এই স্কুলে যিনি শেষ পর্যন্ত পড়াতেন, সেই মাস্টারমশাইয়ের রহস্যমৃত্যুই তো স্কুলঘরটাকে অভিশপ্ত করে দিয়েছে।

মিলনের চোখ চকচক করে উঠল, “ওই দেখ—এখন বোঝা যাচ্ছে, ও মাস্টারমশাইয়ের আত্মা।”

বাপন দাঁত চেপে বলল, “অথবা কেউ মজা করছে। কিন্তু কে এমন মজা করবে, বল তো?”

ঠিক তখনই ঠান্ডা বাতাস বইতে শুরু করল। জানালার ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলো সরাসরি বোর্ডে এসে পড়ল। আর সেই আলোয় আমরা দেখলাম, বোর্ডে হঠাৎ আরেকটা বাক্য উঠে এসেছে—

আমাকে কে মেরেছিল জানো?”

আমরা স্থির। কোনো শব্দ বেরোচ্ছে না কারও গলা থেকে। শুধু বোর্ডটা যেন অন্ধকারে জ্বলজ্বল করছে, আর প্রশ্নটা আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে।

রাত তখন ১২:২০।
ভয়ের খেলাটা কেবল শুরু হয়েছে।

“আমাকে কে মেরেছিল জানো?”—এই লেখাটা দেখে আমাদের ভেতর যেন সমস্ত শব্দ শুকিয়ে গেল। টর্চের আলোয় বোর্ডের সেই অক্ষরগুলো স্পষ্ট, তবু মনে হচ্ছিল চোখ ঘুরলেই মুছে যাবে। শুভ হঠাৎ কেঁপে উঠল, “চল যাই… আমি আর থাকতে পারব না।”

কিন্তু বাপন ওকে শক্ত করে ধরে বলল, “না রে, এখন গেলে সত্যিই ভীরু বলবে সবাই। তাছাড়া দেখছিস না, এই আত্মা আমাদের সঙ্গেই কথা বলছে। কিছু বলতে চাইছে।”

আমি নিঃশব্দে মাথা নেড়ে বললাম, “হয়তো সত্যি। এতদিন যেটা গুজব মনে করেছি, আজ বুঝছি সে কোনো না কোনো কারণেই আমাদের ডাকছে।”

নীলয় কাঁপা গলায় ফিসফিস করল, “কিন্তু কেন আমাদের? আমরা তো কিছুই জানি না।”

ঠিক তখনই জানালার বাইরে ঝড়ের মতো এক দমকা হাওয়া এসে দরজা ধাক্কা মারল। দরজা খানিকটা খুলে গেল, আর তার ফাঁক দিয়ে যেন কারও ছায়া ভেসে এল। মুখ দেখা যায় না, শুধু বুকের কাছে ফ্যাকাশে আলো। আমরা সবাই একসঙ্গে পিছিয়ে গেলাম।

বোর্ডে আবার আঁচড় পড়ল। এবার ধীরে ধীরে উঠে এল শব্দগুলো—

শ্রেণিকক্ষে

আমরা দমবন্ধ করে তাকিয়ে আছি। বাপন টর্চ ঘুরিয়ে ক্লাসঘরের ভেতর আলো ফেলল। ডানদিকে যে বড় আলমারিটা, তার পাশে পুরনো একটা কাঠের চেয়ার পড়ে আছে। ধুলোয় ঢাকা, তবু মনে হল সদ্য কেউ বসে উঠেছিল।

মিলন ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল। চেয়ারটা ছুঁতেই ঠান্ডা একটা শিরশিরে অনুভূতি তার হাত বেয়ে নেমে গেল। সে কেঁপে উঠে পিছিয়ে এল, “মনে হচ্ছে কেউ এখানেই বসে ছিল।”

আমাদের বুক ধুকপুক করছে। আমি বোর্ডের সামনে গিয়ে ফিসফিস করে বললাম, “তুমি কী বলতে চাইছো? মাস্টারমশাইকে শ্রেণিকক্ষেই মারা হয়েছিল?”

চকের দাগ থরথর করে নড়ল, তারপর স্পষ্ট অক্ষরে ফুটে উঠল—

হ্যাঁ

আমরা স্তব্ধ। এত সরাসরি উত্তর—এবার আর সন্দেহ করার জায়গা নেই।

শুভ কেঁপে গিয়ে আমার হাত চেপে ধরল। “মানে, মাস্টারমশাইকে খুন করা হয়েছিল? আত্মহত্যা নয়?”

নীলয় এবার এক অদ্ভুত দৃঢ়তায় বলল, “তাহলেই তো সব মিলে যাচ্ছে। এতদিন সবাই বলত উনি আত্মহত্যা করেছিলেন। হয়তো সত্যিটা চাপা পড়ে গেছে।”

ঠিক তখনই বোর্ডে আবার আঁচড়। খুব তাড়াহুড়ো করে যেন লেখা হল—

সাবধান

আমরা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। কার থেকে সাবধান?

দরজার বাইরের অন্ধকার যেন আরও গাঢ় হয়ে উঠল। ঝিঁঝিঁর ডাক থেমে গেছে, চারদিক একদম নীরব। কেবল আমাদের হৃদপিণ্ডের শব্দ কানে বাজছে।

হঠাৎ স্কুলঘরের পেছনের দিকে, পুরনো লাইব্রেরি ঘর থেকে এক চাপা ধাক্কাধাক্কির আওয়াজ এল। যেন বইয়ের আলমারি উলটে পড়ছে। আমরা টর্চ নিয়ে ছুটলাম।

ভেতরে ঢুকতেই দেখলাম, সত্যিই একটা আলমারি কাত হয়ে আছে, কয়েকটা বই ছড়িয়ে পড়েছে মেঝেতে। ধুলোয় মোটা স্তর, তবু একখানা খাতার পাতা যেন আমাদের চোখে পড়ে গেল। টর্চ ফেলতেই দেখা গেল তাতে রক্তলাল কালিতে লেখা—

আমি একা ছিলাম না।

আমরা হতবাক হয়ে গেলাম।

মিলন ফিসফিস করে বলল, “মানে কী? উনি একা ছিলেন না মানে?”

ঠিক তখনই পেছন থেকে যেন এক চাপা দীর্ঘশ্বাস ভেসে এল। আমরা টর্চ ঘুরিয়ে তাকালাম—কেউ নেই।

কিন্তু বোর্ডের দিকে তাকাতেই হঠাৎ এক নতুন লাইন ফুটে উঠল—

খুনি এখনও বেঁচে আছে।

আমাদের গলা শুকিয়ে গেল। বুকের ভেতর ঢাকের মতো শব্দ বাজতে লাগল। খুনি? তবে কি গ্রামেই কেউ আছে যে মাস্টারমশাইয়ের মৃত্যু লুকিয়ে রেখেছিল?

রাত তখন ১২:৩০। আমরা বুঝলাম, ভয় শুধু অদৃশ্য নয়—এবার তা মানুষের ছায়ার সঙ্গেও মিশে আছে।

“খুনি এখনও বেঁচে আছে।”
এই শব্দগুলো ব্ল্যাকবোর্ডে ফুটে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই আমরা যেন জমে গেলাম। শব্দ থেমে গেছে, বাতাসও নিস্তব্ধ। দূরে কোথাও বাঁশঝাড়ে পেঁচার ডানা ঝাপটানোর শব্দ, কিন্তু সেটাও যেন আমাদের কানে পৌঁছোচ্ছে না।

বাপন দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “এটা যদি সত্যি হয়, তাহলে আজও সেই মানুষটা গ্রামে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কে হতে পারে?”

শুভ ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলল, “তাহলে কি আমরা বিপদে আছি? যদি সে আমাদের দেখে ফেলে?”

মিলন গম্ভীর মুখে বোর্ডের দিকে তাকাল। “যদি আত্মা এত কষ্ট করেও আমাদের সঙ্গে কথা বলছে, তবে কিছু বলতে চাইছে। হয়তো সত্যিটা উন্মোচন করাতে হবে আমাদের।”

আমরা আবার গোল হয়ে দাঁড়ালাম। আমি সাহস করে বললাম, “তুমি আমাদের বলো—খুনি কে? নাম বলো।”

বোর্ডে খানিকক্ষণ কোনো শব্দ নেই। বাতাস জমে উঠল। তারপর ধীরে ধীরে চক নড়ল। অক্ষর ভেসে উঠল—

শিক্ষক নই

আমরা একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলাম। মানে কী?

নীলয় ফিসফিস করে বলল, “মানে খুনি শিক্ষক ছিলেন না।”

মিলন বলল, “তাহলে গ্রামের অন্য কেউ? হয়তো ছাত্র? হয়তো কারও আত্মীয়?”

ঠিক তখনই বোর্ডে আবার আঁচড় উঠল। এবার মাত্র দুটো শব্দ—

অন্ধকার ঘর

আমরা হকচকিয়ে গেলাম। অন্ধকার ঘর? কোন ঘর?

বাপন টর্চ নিয়ে স্কুলঘরের করিডোরে এগিয়ে গেল। ডানদিকে একটা ভাঙাচোরা ঘর আছে, যেটা আগে সায়েন্স ল্যাব ছিল। জানালা ভাঙা, ভেতরে চাঁদের আলো ঢোকে না, একেবারে আঁধার।

আমরা পা টিপে ভেতরে ঢুকলাম। বাতাস ভিজে গন্ধে ভরা। পুরনো কাচের বোতল, টেস্ট টিউব, মরচেধরা স্ট্যান্ড, সব ছড়িয়ে আছে। হঠাৎ শুভ টর্চ ফেলতেই দেয়ালের কোণায় দেখা গেল কালচে দাগ। মেঝেতে লম্বা টেনে নেওয়া দাগের মতো।

“এটা রক্তের দাগ না?” শুভর গলা কেঁপে গেল।

আমি হাঁটু গেড়ে আলো ফেললাম। হ্যাঁ, দাগটা শুকিয়ে গাঢ় হয়ে গেছে, কিন্তু মাটির ফাটলের ভেতর এখনও লালচে ছোপ রয়ে গেছে।

ঠিক তখন পেছন থেকে শব্দ এল—কেউ যেন টেবিল ঠেলল। আমরা ঘুরে দাঁড়ালাম—কেউ নেই। কিন্তু টর্চ ফেলতেই বোর্ডে লেখা ফুটে উঠল—

সেই রাতে…”

আমরা শ্বাস বন্ধ করে তাকিয়ে আছি। ধীরে ধীরে বাকিটা লেখা হল—

সেই রাতে মাস্টারমশাই ডেকেছিলেন, আমি গিয়েছিলাম।

আমরা হতভম্ব হয়ে গেলাম। কে লিখছে এগুলো? সেই অদৃশ্য কণ্ঠস্বর? নাকি মাস্টারমশাইয়ের আত্মা নিজেই জানাচ্ছেন?

নীলয় ফিসফিস করে বলল, “মানে তিনি একা ছিলেন না। কেউ তাঁকে ডেকে এনেছিল।”

মিলন বলল, “কিন্তু কে? আর তাঁকে কেন মারা হল?”

ঠিক তখনই বাতাসে হঠাৎ শীতলতা নেমে এল। টর্চের আলো নিভে গিয়ে আবার জ্বলে উঠল। আর সেই ফাঁকে আমরা দেখলাম ঘরের শেষ কোণায় একটা অস্পষ্ট অবয়ব দাঁড়িয়ে আছে। মাথা নুয়ে আছে, হাতে যেন খাতা ধরা। মুখ দেখা যায় না, কিন্তু ছায়াটা স্পষ্ট।

শুভ চেঁচিয়ে উঠল, “ওই দেখ!”

আমরা পাঁচজন একসঙ্গে পিছিয়ে এলাম। ছায়াটা অল্প সময় স্থির থেকে মিলিয়ে গেল দেয়ালের ভেতরে।

ঠিক তখন বোর্ডে আঁচড় কেটে উঠল শেষ তিনটে শব্দ—

ওর জন্য

আমরা নির্বাক। “ও” কে? কিসের জন্য? মাস্টারমশাইকে কে ডেকেছিল, আর কেন?

রাত তখন ১২:৪৫।
আর আমরা বুঝলাম—এ রহস্যের প্রথম স্তর মাত্র খুলল।

বোর্ডে লেখা “ওর জন্য”—এই তিনটি শব্দ যেন আমাদের বুকের ভেতর পাথরের মতো বসে রইল। কার জন্য? কেন মাস্টারমশাইকে মরতে হল? অজানা এক চাপা ভয়ের সঙ্গে সঙ্গে অদ্ভুত কৌতূহল আমাদের ঠেলে নিয়ে যাচ্ছিল গভীর অন্ধকারে।

বাপন গলা নামিয়ে বলল, “যদি সত্যিই খুন হয়, তবে ওই ‘ও’ হয়তো গ্রামের কেউ। হয়তো মাস্টারমশাইকে নিয়ে অন্য কারও সঙ্গে বিরোধ ছিল।”

শুভ অস্থির হয়ে উঠল, “কিন্তু কে? আমরা তো ছোট ছিলাম তখন। কারও নাম শুনেছি কি?”

নীলয় বলল, “আমাদের দাদারা বলত, মাস্টারমশাই খুব কড়া ছিলেন। তবে ছাত্রছাত্রীদের ভেতরে একটা মেয়ে নাকি ওঁর খুব প্রিয় ছিল। সবাই ঠাট্টা করত।”

আমরা থম মেরে গেলাম। মেয়েটার নাম মনে করার চেষ্টা করতে লাগলাম। তখনই বোর্ডে আবার আঁচড় কেটে উঠল—

রিমি

আমাদের মনে ঝড় বয়ে গেল। হ্যাঁ, রিমি নামটা আমরা শুনেছি। গ্রামের এক মেয়ে, খুব ভাল পড়াশোনা করত। কিন্তু হঠাৎ করেই সে আর স্কুলে আসেনি। পরে শুনেছিলাম, ওরা নাকি গ্রাম ছেড়ে চলে গেছে।

মিলন কেঁপে উঠল, “মানে মাস্টারমশাইয়ের মৃত্যুর সঙ্গে রিমির যোগ আছে?”

বোর্ডে নতুন করে লেখা ভেসে উঠল—

ওকে বাঁচাতে গিয়ে…”

আমাদের বুক কেঁপে উঠল। ওকে বাঁচাতে গিয়ে মাস্টারমশাই মারা গেলেন? কিসের হাত থেকে বাঁচাতে?

ঠিক তখনই বাইরের করিডর থেকে পদশব্দ ভেসে এল। টর্চের আলো ফেলতেই দেখা গেল করিডরের ধুলোয় একজোড়া ভেজা পায়ের ছাপ পড়ছে—কোনো মানুষ নেই, কেবল ছাপ।

শুভ হাউহাউ করে ওঠার আগে মিলন তার মুখ চেপে ধরল। আমরা নিঃশব্দে পায়ের ছাপ অনুসরণ করতে লাগলাম। ছাপগুলো নিয়ে গেল লাইব্রেরির ভেতরে। সেখানেই ছাপ হঠাৎ থেমে গেল। যেন কেউ হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে।

ঠিক তখন মেঝেতে পড়ে থাকা সেই পুরনো খাতাটা নিজে থেকেই খুলে গেল। পাতার ওপর হাওয়া বইতে লাগল, এক জায়গায় এসে থেমে গেল। আমরা আলো ফেলতেই দেখলাম—লিখা আছে, ছাত্রী নিখোঁজ। তার নিচে কয়েকটা নাম, তার মধ্যে রিমির নামও।

নীলয় কেঁপে উঠে বলল, “মানে রিমি সত্যিই হারিয়ে গেছিল। সবাই চাপা দিয়েছে।”

ঠিক তখনই বোর্ডে নতুন আঁচড় ভেসে উঠল—

খুনি ওকে চাইত

আমরা একে অপরের মুখের দিকে তাকালাম। খুনি রিমিকে চাইত? তাই মাস্টারমশাইয়ের মৃত্যু?

বাপন দাঁত চেপে বলল, “মানে মাস্টারমশাই রিমিকে বাঁচাতে গিয়ে মারা যান। আর যিনি খুনি, তিনি এখনও বেঁচে আছেন।”

ঘরের ভেতর শীতলতা জমে উঠল। জানালার ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলো সোজা বোর্ডে এসে পড়ল। আর সেখানে ধীরে ধীরে ফুটে উঠল আরেকটি বাক্য—

আমার রক্ত এখনও শুকোয়নি।

আমরা ভয়ে হিম হয়ে গেলাম। মনে হচ্ছিল চারদিকের দেয়াল চাপা দিচ্ছে। ঠিক তখনই বাইরের বারান্দা থেকে শোনা গেল এক কর্কশ হাসি—মানুষের নয়, তবু একেবারে মানুষের মতো।

আমরা পাঁচজন বুঝলাম—এই রহস্য শুধু ভূতের নয়, এই গ্রামেই লুকিয়ে আছে তার ছায়া।

রাত তখন ১টা।
অন্ধকারের খেলা এখন রক্তাক্ত সত্যির দিকে এগোচ্ছে।

বারান্দা থেকে ভেসে আসা কর্কশ হাসিটা যেন আমাদের বুকের মধ্যে কাঁটা গেঁথে দিল। টর্চ হাতে একসঙ্গে দরজার দিকে তাকালাম, কিন্তু ফাঁকা। কেবল কুয়াশার মতো এক ধোঁয়া ঢুকে আসছে, আর হাওয়ায় ভিজে মাটির গন্ধ।

শুভ ফিসফিস করে বলল, “এটা মাস্টারমশাইয়ের আত্মা নয়… এটা অন্য কিছু।”

বাপন দাঁত চেপে এগোল, দরজার ফাঁক দিয়ে বাইরে আলো ফেলল। মাঠজুড়ে চাঁদের আলোয় হালকা কুয়াশা নেমেছে, কিন্তু কোনো অবয়ব নেই। অথচ সেই হাসিটা যেন কানে বাজছে।

ঠিক তখনই বোর্ডে আবার আঁচড় পড়ল—

খুনি খুব কাছে

আমরা একে অপরের দিকে তাকালাম। খুব কাছে? মানে এখানে? আমাদের মাঝেই কেউ? নাকি গ্রামেই কোথাও?

নীলয় গলা শুকিয়ে বলল, “এটা যদি সত্যি হয়, তবে আমরা ভীষণ বিপদে।”

মিলন ভয় সামলে বলল, “না, আমাদের ভয় দেখানো হচ্ছে। আত্মা যদি আমাদের সতর্ক করে, তবে আমরা শেষ অবধি শুনব।”

বোর্ডে এবার নতুন লাইন উঠল—

আমাকে লুকিয়ে রেখেছিল ওরা

আমরা স্তব্ধ। কে রেখেছিল? কারা লুকিয়েছে সত্যি?

ঠিক তখন করিডর দিয়ে একটানা টুপটাপ শব্দ এল, যেন ভিজে পায়ের ছাপ। আমরা টর্চ ফেলে দেখলাম, আবার সেই ছোট ছোট পায়ের ছাপ। তবে এবার অনেকগুলো একসঙ্গে, যেন ক্লাসভর্তি ছাত্রছাত্রী হেঁটে যাচ্ছে। তারা সোজা চলে গেল সায়েন্স ল্যাবের দিকে, যেখানে আমরা রক্তের দাগ দেখেছিলাম।

আমরা পিছু নিলাম। ঘরে ঢুকতেই এক ঝটকায় দরজা বন্ধ হয়ে গেল। ভেতরটা কালো অন্ধকার। টর্চের আলো কাঁপতে লাগল।

হঠাৎ দেয়ালের ফাঁক থেকে হাওয়ার মতো শব্দ ভেসে এল—একটা মেয়েলি গলা। খুব চাপা, ভাঙা ভাঙা:

“ওরা… আমাকে… বাঁচাও…”

আমরা সবাই একসঙ্গে থমকে গেলাম। শুভর চোখ বড় হয়ে উঠল, “এটা রিমির গলা?”

কেউ কিছু বলার আগেই বোর্ডে চক নড়ল। দ্রুত আঁচড়ে উঠে এল অক্ষর—

আমি এখানেই

ঘরের কোণায় আলো ফেলতেই আমরা দেখলাম, দেয়ালের ফাটল দিয়ে লালচে পানি গড়িয়ে পড়ছে। গন্ধে বোঝা গেল, সেটা পানি নয়—কোনো শুকনো রক্ত আবার ভিজে উঠেছে।

মিলন কেঁপে গিয়ে বলল, “এটা সম্ভব নয়… এত বছর পর রক্ত কীভাবে?”

ঠিক তখনই ঘরের ভেতর পুরনো টেবিলটা হঠাৎ নিজে থেকেই উলটে পড়ল। ধুলো উড়ে উঠল, আর মেঝেতে একটা পুরনো ডায়েরি গড়িয়ে এল। কাভারে লেখা—“রিমি”।

আমরা টর্চ ফেলে পড়তে শুরু করলাম। পাতার পর পাতায় লেখা তার ক্লাস নোটস, আঁকিবুঁকি। শেষ পাতায় কাঁপা হাতে লেখা একটা লাইন—

আজ রাতে মাস্টারমশাই ডেকেছেন। ভয়ে আছি। কেউ আমাদের পিছু নিয়েছে।

আমাদের শিরায় শিরায় কাঁপুনি ছড়িয়ে গেল। রিমি সেদিন রাতে মাস্টারমশাইয়ের সঙ্গে ছিল, আর কেউ তাদের পিছু নিয়েছিল।

ঠিক তখন বোর্ডে নতুন আঁচড় কেটে উঠল—

খুনি এখানেই ঘুরছে

আমরা গলা শুকিয়ে গেলাম। বাইরে থেকে আবার সেই কর্কশ হাসি শোনা গেল। এবার আরও জোরে, আরও কাছে।

রাত তখন ১:২০।
স্কুলঘরটা যেন এক ভয়ঙ্কর ফাঁদে আমাদের আটকে ফেলেছে।

দরজার বাইরে কর্কশ হাসি যেন ক্রমে ঘনিয়ে আসছে। মনে হচ্ছিল দেয়াল ভেদ করে ভেতরে ঢুকে পড়বে। আমরা কেউ নড়তে পারছিলাম না। শুধু টর্চের কাঁপা আলোয় আমাদের ঘামঝরা মুখ একে অপরকে দেখাচ্ছিল ভয়কে।

হঠাৎ সেই হাসি থেমে গেল। নিস্তব্ধতা এমন যে নিজের হৃদস্পন্দনই শোনা যাচ্ছিল। ঠিক তখন বোর্ডে নতুন আঁচড় ভেসে উঠল—

এসে গেছে

আমরা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলাম। কে এসেছে? খুনি? নাকি সেই আত্মা?

ঠিক সেই মুহূর্তে দরজার বাইরে ভারি পায়ের শব্দ। ধীরে ধীরে কাছে আসছে। আমরা নিঃশ্বাস আটকে দাঁড়িয়ে আছি। বাপন গলা নামিয়ে বলল, “কে যেন সত্যিই হাঁটছে।”

শুভর চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। সে প্রায় কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, “চল পালাই… এই বাজি, এই রহস্য—সব বাদ দে।”

কিন্তু দরজা খোলার চেষ্টা করতেই বোঝা গেল, সেটা বাইরে থেকে আটকানো। আমরা বন্দি।

মিলন কণ্ঠে অদ্ভুত দৃঢ়তা এনে বলল, “এখন আর পিছু হটার উপায় নেই। যে-ই হোক, তাকে সামনে আনতেই হবে।”

ঠিক তখন দরজার ফাঁক দিয়ে একটা ছায়া ঢুকে এল। লম্বা, কুঁজো শরীর, মুখ দেখা যায় না। শুধু দুটো চোখ জ্বলছে অন্ধকারে—কোনো জীবন্ত মানুষের মতো নয়, আবার পুরোপুরি আত্মার মতোও নয়।

আমরা পিছিয়ে গেলাম। টর্চের আলো কাঁপছিল, কিন্তু তাও অবয়বটাকে স্পষ্ট দেখা গেল। তার হাতে যেন একটা লাঠি বা রড।

সে হঠাৎ ফিসফিস করে বলল, “তোমরা কেন এসেছ?”

আমাদের গলা শুকিয়ে গেল। কেউ উত্তর দিতে পারছিল না।

তখনই বোর্ডে চক নিজের মতো নড়ল। দ্রুত লিখল—

ওই খুনি

আমাদের বুক কেঁপে উঠল। মানে এটাই সেই মানুষ? মাস্টারমশাইয়ের খুনি?

কিন্তু ছায়াটা হঠাৎ তীব্র হাসি দিয়ে উঠল। “তোমরা কিছুই জানো না। ওই শিক্ষক আমার পথে বাঁধা দিয়েছিল। মেয়েটাকে আমি চাইতাম। ওকে লুকিয়ে রেখেছিল…”

তার গলা কর্কশ, তবু স্পষ্ট। আমরা একসঙ্গে বুঝে গেলাম—এটা মানুষ। কোনো ভূত নয়। মাস্টারমশাইয়ের মৃত্যুর সত্যিকারের দায়ী।

বাপন সাহস করে টর্চ সোজা তার মুখে ধরল। আলোতে দেখা গেল—গ্রামেরই এক বৃদ্ধ। চোখে রক্তিম দৃষ্টি, দাঁতে কালচে দাগ।

শুভ চিৎকার করে উঠল, “এ তো নন্দলাল কাকা!”

আমরা স্তব্ধ। নন্দলাল—গ্রামের এক বুড়ো, যাকে আমরা প্রায়ই দেখেছি পুকুরপাড়ে বসে বিড়ি খেতে। শান্ত মানুষ বলে জানতাম। কিন্তু সে দাঁত কেলিয়ে বলল, “ও আমাকে ঠেকাতে চেয়েছিল। আর মেয়েটা—ও ছিল আমার। তাই তাকে নিয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু মাস্টারমশাই বাধা দিল। তাই…”

তার গলা কেঁপে গেল, চোখ দুটো ভয়ঙ্করভাবে জ্বলতে লাগল।

আমরা ভয়ে পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। আর বোর্ডে শেষ আঁচড় ভেসে উঠল—

সাবধান, এখনো শেষ করেনি

রাত তখন ১:৪৫।
আমরা বুঝলাম, স্কুলঘরের ভেতর যে ভয় পেয়েছিলাম, তার চেয়েও বড় ভয় সামনে দাঁড়িয়ে আছে—রক্তমাংসের খুনি, যে এখনও মুক্ত।

নন্দলাল কাকার মুখে সেই স্বীকারোক্তি শোনার পর আমরা কেউ নড়তে পারছিলাম না। তার চোখে লালচে দৃষ্টি, ঠোঁটের কোণে বিকৃত হাসি—এমন মানুষকে আমরা এত বছর ধরে কীভাবে চিনতেই পারিনি!

বাপন সাহস করে বলল, “তুমি রিমিকে কোথায় নিয়ে গিয়েছিলে? সে কোথায় এখন?”

নন্দলাল কাকা গাঢ় স্বরে হেসে উঠল। “তোমরা জানতেও পারবে না। ও আর ফিরে আসবে না। মাস্টারমশাইকে আমি শেষ করেছিলাম সেদিন রাতে। সবাই বলল আত্মহত্যা। কিন্তু আসল সত্যটা কবর দেওয়া হলো।”

আমাদের গা শিউরে উঠল। শুভ কাঁপা গলায় বলল, “তাহলে রিমি… সে কি মারা গেছে?”

নন্দলাল কাকার চোখে পাগলামি জ্বলে উঠল। “মৃত? না, ও আমার সঙ্গে আছে। আমি ওকে এমন জায়গায় রেখেছি, যেখানে কেউ খুঁজে পাবে না।”

ঠিক তখন বোর্ডে চক নিজে থেকেই নড়ল। অদৃশ্য শক্তির আঁচড়ে উঠে এল অক্ষর—

ওকে বাঁচাও

আমরা একসঙ্গে বোর্ডের দিকে তাকালাম। অর্থাৎ রিমি বেঁচে আছে? নাকি আত্মার আর্তি?

মিলন সাহস সঞ্চয় করে বলল, “তুমি মিথ্যে বলছ। রিমি এখনও সাহায্য চাইছে।”

নন্দলাল কাকা দাঁত কেলিয়ে এগিয়ে এল। হাতে ধরা লাঠিটা মাথার ওপর তুলল। আমরা আতঙ্কে পিছিয়ে গেলাম।

ঠিক তখন বাইরে থেকে এক প্রবল দমকা হাওয়া এসে দরজা ভেঙে দিল। আলো ঝলকে উঠল, আর বোর্ডে একসঙ্গে একাধিক শব্দ ফুটে উঠল—

ওকে খুঁজে বের করো। পুরনো কুয়ো।

আমরা শ্বাস আটকে তাকিয়ে আছি। পুরনো কুয়ো! হ্যাঁ, স্কুলের পেছনে এক ভাঙা কুয়ো আছে, যা বহু বছর ধরে ব্যবহার হয়নি। সবাই বলে সেখানে জলের নিচে অশরীরীরা থাকে, তাই কেউ কাছে যায় না।

নন্দলাল কাকা গর্জে উঠল, “ওটা ভুলে যাও! কেউ যদি কাছে যায়, তার পরিণতি মাস্টারমশাইয়ের থেকেও ভয়ঙ্কর হবে।”

আমরা আতঙ্কিত, কিন্তু বোর্ড যেন আমাদের ডাকছে। চক থেমে না থেকে বারবার লিখছে—

ওই কুয়োতেই সত্যি লুকিয়ে আছে।

বাপন দাঁত চেপে বলল, “আমাদের যেতেই হবে।”

নন্দলাল কাকা লাঠি তুলে আমাদের পথ আটকাল। “কেউ বাইরে যাবে না।”

ঠিক তখন শুভ হঠাৎ সাহস করে একটা বেঞ্চ টেনে তার দিকে ছুঁড়ে মারল। নন্দলাল কাকা কেঁপে উঠল, আমরা সুযোগ বুঝে দরজা দিয়ে বেরিয়ে দৌড় দিলাম।

বাইরে এসে চাঁদের আলোয় ভিজে উঠল স্কুলের পেছনের মাঠ। দূরে সেই ভাঙা কুয়ো অন্ধকার গিলে রেখেছে। আমরা দৌড়ে গেলাম তার দিকে।

পেছনে শুনতে পাচ্ছিলাম নন্দলাল কাকার কর্কশ গর্জন—“কুয়োর কাছে যেও না! ওখানেই শেষ হয়ে যাবে তোমাদের জীবন!”

আমরা দৌড় থামালাম না। বুক ধুকপুক করছে, নিশ্বাস ছুটছে, কিন্তু পা যেন টানছে অজানা শক্তি।

কুয়োর ধারে পৌঁছতেই ভিজে কাদার গন্ধ নাকে এল। চারপাশ অদ্ভুত নিস্তব্ধ। কুয়োর ভেতরে টর্চের আলো ফেলতেই দেখা গেল—অন্ধকারের ভেতর যেন এক ফ্যাকাশে মুখ জলের ওপর ভেসে উঠল।

শুভ চেঁচিয়ে উঠল, “ওটা… রিমি!”

রাত তখন ২টা।
কুয়োর ভেতর থেকে ফিসফিস করে ভেসে আসছে এক কণ্ঠ—

“আমাকে… বাঁচাও…”

কুয়োর ভেতর ভাসমান মুখটা দেখে আমাদের বুক কেঁপে উঠল। টর্চের আলোয় জলে এক ফ্যাকাশে অবয়ব উঠছে আর মিলিয়ে যাচ্ছে। শুভ কাঁপা গলায় বলল, “ওটা রিমি… বেঁচে আছে!”

কিন্তু নীলয় ধীরে মাথা নাড়ল, “না, ও জীবন্ত নয়… ও আত্মা হয়ে গেছে। কিন্তু সাহায্য চাইছে।”

কুয়োর ভেতর থেকে শব্দ এল, যেন জল ভাঙছে—আমাকে উঠাও…”

আমরা চোখে চোখ রেখে স্থির করলাম, যেভাবেই হোক কুয়োর ভেতরে নামতেই হবে। বাপন চারপাশে তাকিয়ে একটা বাঁশ পেল, শুকনো হলেও মজবুত। আমরা গামছা ছিঁড়ে বেঁধে একটা দড়ির মতো বানালাম।

মিলন বলল, “আমি নামছি।”

আমরা তাকে বাঁশে বাঁধতে লাগলাম। শুভ ফিসফিস করে বলল, “যদি ও না ওঠে?”—গলাটা কেঁপে যাচ্ছিল।

ঠিক তখনই হাওয়ার ঝাপটা এসে বোর্ডের মতো কোথা থেকে যেন একটা শব্দ কানে বাজল—সাহস করো।

মিলন নামতে শুরু করল। টর্চের আলোয় তার ছায়া কুয়োর দেয়ালে নড়ছে। আমরা ধরে রেখেছি বাঁশ, বুক ধুকপুক করছে। মিলন জলের কাছে পৌঁছতেই আচমকা এক ঠান্ডা ধোঁয়া উঠল। জলের ওপর আবার সেই মুখ ভেসে উঠল—চোখে আতঙ্ক, ঠোঁটে কাঁপা কাঁপা শব্দ— আমাকে টেনেছিলমাস্টারমশাই রক্ষা করতে গিয়ে…”

তারপর মিলনের গলায় চিৎকার। আমরা টেনে তুলতে গেলাম। দেখি, যেন অদৃশ্য কোনো হাত তাকে জলের ভেতর টেনে নিচ্ছে। আমরা মরিয়া হয়ে টানতে লাগলাম। অবশেষে মিলন উঠে এলো, ভিজে কাঁপছে, চোখ বিস্ফারিত। “আমি… আমি দেখেছি… নিচে হাড়… অনেক হাড়।”

আমরা স্তব্ধ হয়ে গেলাম। কুয়োটা আসলে লাশ লুকোনোর জায়গা। নন্দলাল কাকা শুধু মাস্টারমশাইকেই নয়, হয়তো আরও অনেককে শেষ করেছে।

ঠিক তখনই পেছন থেকে কর্কশ গর্জন—“তোমরা এখানে কী করছ?”

নন্দলাল কাকা দাঁড়িয়ে আছে, হাতে লাঠি। চোখে শয়তানি ঝলক। “তোমরা জানতেই পারো না। এ কুয়ো আমার গোপন। সবাইকে এখানে ফেলে দিয়েছি।”

আমরা আতঙ্কে জমে গেলাম। শুভ কাঁপা গলায় বলল, “রিমি কোথায়? ও কি এখানেই?”

নন্দলাল কাকা দাঁত বের করে হেসে উঠল। “হ্যাঁ, ওও এখানেই ঘুমিয়ে আছে।”

ঠিক তখন কুয়োর ভেতর থেকে প্রবল এক হাওয়ার ঝাপটা উঠল। জলের ওপর ঢেউ খেলল, আর সেই ঢেউয়ের ভেতর থেকে মাস্টারমশাইয়ের ছায়া উঠে দাঁড়াল। মুখে ব্যথার ছাপ, হাতে চক ধরা। তিনি সোজা নন্দলাল কাকার দিকে তাকালেন।

বোর্ড ছাড়া হলেও বাতাসে শব্দ ভেসে উঠল—তুই শেষ।

নন্দলাল কাকা কেঁপে গেল। হাতে ধরা লাঠি পড়ে গেল মাটিতে। সে হোঁচট খেয়ে কুয়োর ধারে এসে দাঁড়াল।

আমরা কেউ কিছু বলার আগেই, এক অদৃশ্য ধাক্কায় সে কুয়োর ভেতর পড়ে গেল। তার কর্কশ চিৎকার মিলিয়ে গেল জলের গভীরে।

আমরা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। কুয়োর ভেতর নিস্তব্ধতা। শুধু জলের ওপর হালকা ঢেউ আর রিমির কণ্ঠস্বর—ধন্যবাদ…”

রাত তখন ২:৩০।
আমরা বুঝলাম, বহুদিনের চাপা রহস্য আজ ভেসে উঠল। কিন্তু শেষটা এখনও বাকি।

কুয়োর ভেতর নন্দলাল কাকার চিৎকার থেমে যাওয়ার পর চারপাশ নিস্তব্ধ হয়ে গেল। শুধু জলের ঢেউ ধীরে ধীরে থেমে এসে আবার অন্ধকারে মিশে গেল। আমরা কেউ কথা বলছিলাম না, যেন বুকের ভেতর জমে থাকা ভয় এখনো শ্বাসরোধ করে রেখেছে।

ঠিক তখন কুয়োর গভীর থেকে ভেসে এলো এক ফিসফিসানি—আমরা মুক্ত…”
আমরা চোখ বড় করে তাকিয়ে থাকলাম। টর্চের আলোয় দেখা গেল, জলের ওপর একের পর এক ফ্যাকাশে মুখ ভেসে উঠছে। ছোট ছোট ছাত্রছাত্রী, কিছু বড়দের ছায়া, আর মাঝখানে রিমি—চোখে শান্তি, ঠোঁটে মৃদু হাসি। পাশে মাস্টারমশাই দাঁড়িয়ে আছেন, হাতে চক ধরা, যেন শেষবার বোর্ডে লিখতে প্রস্তুত।

আমরা কাঁপতে কাঁপতে নতজানু হয়ে গেলাম। আরেকবার ফিসফিস করে শোনা গেল—সত্যিটা রক্ষা করো।

তারপর ধীরে ধীরে সব মিলিয়ে গেল জলের গভীরে। শুধু চাঁদের আলো কুয়োর জলে প্রতিফলিত হতে লাগল।

আমরা হাঁপাতে হাঁপাতে স্কুলঘরের দিকে ফিরলাম। বোর্ডে তখনো একটিই শব্দ লেখা ছিল—ধন্যবাদ। যেন মাস্টারমশাই নিজে হাতে লিখে রেখে গেছেন।

শুভ কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, “ওরা মুক্ত হলো… তাই না?”
আমি মাথা নেড়ে বললাম, “হ্যাঁ। কিন্তু আমাদেরও এই সত্যিটা গ্রামে জানাতে হবে। সবাই এতদিন ধরে ভুল ভেবেছে।”

বাপন গম্ভীর গলায় বলল, “এখন থেকে এই স্কুলঘর আর অভিশপ্ত নয়। এটা ওদের কবর, ওদের মুক্তির স্মৃতি।”

ভোর হতে আর দেরি নেই। আকাশে হালকা আলো ফুটতে শুরু করেছে। আমরা পাঁচজন চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম। হঠাৎ কানে এলো কাকের ডাক, যেন অন্ধকারের পর সকালের আহ্বান।

আমরা ধীরে ধীরে স্কুলঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলাম। পেছনে তাকিয়ে দেখলাম, ভাঙা জানালার ফাঁক দিয়ে আলো এসে পড়ছে বোর্ডে, আর সেখানে আঁকা অক্ষরগুলো ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে।

গ্রামের ভেতরে ঢোকার সময়ই আমরা জানতাম—আজকের রাতের পর আর কিছু আগের মতো থাকবে না। নন্দলাল কাকার অন্ধকার সত্যি ফাঁস হয়েছে, মাস্টারমশাই আর রিমির আত্মা মুক্তি পেয়েছে, আর নির্বাক স্কুলঘর তার বোঝা নামিয়েছে।

আমরা পাঁচজন কেবল একে অপরের দিকে তাকালাম। ভয়, কৌতূহল, রহস্য—সব মিলে গেছিল এক অভিজ্ঞতায়।
মনে হচ্ছিল, আমরা কেবল একটা ভূতের গল্পের সাক্ষী নই, বরং ইতিহাসের ভুল ঠিক করার দায়ও কাঁধে নিয়েছি।

সেই দিন থেকে স্কুলঘরের ভেতরে আর কোনো রহস্যময় আওয়াজ শোনা যায়নি।
কেবল বাতাসে ভেসে আসে মৃদু চক ঘষার গন্ধ—যেন মাস্টারমশাই এখনও অক্ষর লিখে যাচ্ছেন, কিন্তু এবার আর ভয়ের জন্য নয়, মুক্তির জন্য।

সমাপ্ত

WhatsApp-Image-2025-09-06-at-8.36.09-AM.jpeg

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *