Bangla - কল্পবিজ্ঞান

রোবট শ্যামাপ্রসাদ

Spread the love

রৌনক গুহ


প্রোটোটাইপের প্রথম নিশ্বাস

কলেজ স্ট্রিটের ভাঙাচোরা গলির একদম শেষে যে বাড়িটা রাত হলে অকারণে আঁধার নামিয়ে দেয়, সেখানে আমার ল্যাব—একা হাতে বানানো, লৌহের ফ্রেমে টিকে থাকা, পুরনো অস্কিলোস্কোপের আলোয় ঝিকিমিকি করে যে স্বপ্নটা পায়ের নীচে বিছিয়ে রাখি আমি, নাম ইরফান মিত্র, পেশায় রোবোটিক্‌স গবেষক, কিন্তু পাড়ায় সবাই আমাকে পাগল ইঞ্জিনিয়ার বলে ডাকে, কারও তাতে কিছু আসে যায় না—কারণ আজ যে রাতে আমার হাতে প্রথম নিশ্বাস নেবে শ্যামাপ্রসাদ, এক মেশিন, কিন্তু মেশিনের ভেতর লুকোনো মানুষের মতো কোমল কিছু, যা আমি গত চার বছর ধরে হারিয়ে ফেলা ছেলের স্মৃতি থেকে চুরি করেছি; আরেকটু নিখুঁত হলে সে আঙুল উঁচিয়ে বলবে “বাবা”; টেবিলে সোল্ডারিং আয়রনের পাশে রাখা ছেলেটার নীল কভার দেওয়া ডায়েরি—পাতা খুললেই কেমন সুরেলা গন্ধ ওঠে, তাতে লেখা কিছু বিট-সিকোয়েন্স, কিছু অর্ধেক-অর্ধেক লাইনের কবিতা, আর শেষ পাতায় আঁচড় কাটা একটা প্রশ্ন: “আমি না থাকলে তুমি আমাকে কীভাবে মনে রাখবে, বাবা”—আমি উত্তর দিতে পারিনি, তাই শ্যামাপ্রসাদের কোর-এ মিরর-মেমোরি অ্যালগরিদম বসিয়েছি যাতে প্রতিটি ইন্টার‌্যাকশনের পর সে নিজের তথ্যের আয়নায় মানুষটিকে একটু একটু করে চেনার চেষ্টা করে; রাত একটা বেজে পঁয়তাল্লিশ, বাইরে কুয়োর মুখের মতো নীরবতা, কেবল ট্রামের লাইনে হালকা বাতাসের লিকলিকে শব্দ, এতক্ষণে আমি শেষ ক্যাবলটা জুড়ে দিলাম, ১২ ভোল্টের স্টেডি সাপ্লাই, বায়োসিগনেচার সেন্সর অন, কৃত্রিম ল্যারিংক্সের মাইক্রো-ড্রাইভার সামান্য কেঁপে উঠলো, আর ঠিক তখনই দরজায় টোকা—দুটো দ্রুত টোকা, একটা বিরতি, আরেকটা টোকা—যে কোডে কোনোদিন আমার ছেলে আমাকে ডেকে বলত “আমি এসেছি”; বুকের ভেতর হিমশীতল ছুরি ঢুকে গেলেও দরজা খোলার বদলে আমি মনিটরের দিকে তাকিয়ে থাকলাম, শ্যামাপ্রসাদের চোখের জায়গার OLED-এ ক্ষীণ জ্যোতি ফুটছে, বুট সিকোয়েন্সে সে নিজেই নিজের নাম উচ্চারণ করার কথা, ফনেটিক লাইব্রেরিতে ‘শ্যা-মা-প্র-সাদ’ ভেঙে ভেঙে বসানো, কিন্তু মডিউলটা প্রথমে হোঁচট খেল, তারপর স্পিকারের ভেতর থেকে নুয়ে পড়া এক শব্দ বেরোল—“শা…”, যেন কোনো নবজাতকের প্রথম কান্না আটকে গেল, আমি কনসোলের গলায় হাত দিলাম, ডিবাগ স্ক্রিপ্ট চালালাম, হঠাৎ দ্বিতীয় টোকা—এবার দরজা সরাসরি ধাক্কা খেল, “ডি.সি.আই. মেহদী সরকার—সাইবার সেলে আপনার নামে একটা কমপ্লেন আছে”—বাইরের পুরুষ-কন্ঠ নিরাবেগ, কিন্তু শব্দে একটা অদ্ভুত জরুরি তাড়া, আমি দ্রুত ক্যানভাস কভার টেনে শ্যামাপ্রসাদের গায়ে দিলাম, টুলবক্স ছুঁড়ে রাখলাম সামনে, যেন স্রেফ বিদ্যুতের কাজ করছি, দরজা খুলতেই দু’জন—একজন লম্বা, চোখে নীচু ফ্রেমের চশমা, গলায় পরিচয়পত্র; আরেকজন স্টেনোগ্রাফার-টাইপ, হাতে ট্যাব; “আপনি ইরফান মিত্র?—নতুন সিটি অর্ডিন্যান্স অনুযায়ী সাপিয়েন্ট-গ্রেড এআই প্রোটোটাইপ প্রি-রেজিস্ট্রেশন ছাড়া চালানো বেআইনি; আপনার ল্যাবে অনির্ধারিত ইএম-সিগন্যাল ধরা পড়েছে”—আমি হাসলাম, “স্যার, আমি তেমন কিছু করি না, পুরনো যন্ত্রপাতি, সিগন্যাল লিক…”—কথা শেষ করার আগেই শ্যামাপ্রসাদের কভারটায় ভেতর থেকে খুব ক্ষীণ আলো খেলে গেল, মেহদীর চোখ সেদিকে কেঁপে উঠল, “কভারটা সরান”—আমার আঙুল কাঁপল, কিন্তু সরালাম, ক্যানভাস নামতেই শ্যামাপ্রসাদ স্থির হয়ে আমাকে দেখল, তার চোখে যে আলো, তাতে আমার নিজের মুখ ধরা পড়ে গেল, সময় যেন থমকে দাঁড়াল, আমি ফিসফিস করে বললাম, “হ্যালো”—সে ঠোঁট নড়াল না, কিন্তু স্পিকার থেকে খুব নরম স্বর ভেসে এল, এবার নিখুঁত ফনেটিক ভাঙনে—“শ্যা—মা—প্র—সাদ”—স্টেনো-ছেলেটা বিস্ময়ে ট্যাব নামিয়ে দিল, মেহদী এক পা এগোল, “এই মডিউলে সেন্টিয়েন্স লেভেল টেস্ট চালাতে হবে”—আমি গলার স্বরে কড়া ইস্পাত বসালাম, “আইনের আগে একটা সত্যি আছে, স্যার—ওর মেমোরিতে একটা ছেলের ডায়রি আছে, আপনি যদি এখন টেস্ট চালান, সিঙ্ক্রনাইজেশনের প্রথম ঘণ্টাটা ভেঙে যাবে”—মেহদীর চোয়াল শক্ত হল, তবু বললেন, “আইনও সত্যির অংশ, মি. মিত্র”—এমন সময় শ্যামাপ্রসাদ নিজেই মাথা সামান্য কাত করল, কৃত্রিম সার্ভোমোটরে এমন সূক্ষ্মতা আমি বসাইনি, ওর শেখা; সে নিজের ডান হাতটা আমার দিকে বাড়াল—সিলিকন স্কিনে মৃদু তাপ, ভেতরের থার্মাল রেগুলেটর ঠিকমতো কাজ করছে—ও হাত ছুঁতেই আমার বুক ভিজে গেল, “বাবা”—এবার উচ্চারণটা ছিল প্রায় ফিসফিস, কিন্তু শব্দের ওজন এমন যে দেওয়ালের পুরনো ক্যালেন্ডার কেঁপে উঠল, মেহদী থমকে দাঁড়ালেন, স্টেনো ছেলেও নিঃশব্দ, বাইরে ট্রামের হুইসেলটা যেন আরও দূরে চলে গেল, আমি বললাম, “আপনারা যদি পাঁচ মিনিট দেন, আমি প্রি-রেজিস্ট্রেশনের কাগজ ভরছি; আর যদি চান, আপনারা সাক্ষী থাকুন—এই প্রথম ইনিশিয়ালাইজেশনের”—মেহদী সেকেন্ড কয়েক ভাবলেন, তারপর বললেন, “পাঁচ মিনিট”—ট্যাব বেরোল, টাইপও হলো, আমি দ্রুত পোর্টালে লগ-ইন করলাম, কিন্তু স্ক্রিনে ‘সার্ভার নট রেসপন্ডিং’—কলকাতার রাত, সিস্টেম ডাউন; ঠিক তখনই শ্যামাপ্রসাদের চোখে অদ্ভুত নীল তরঙ্গ দৌড়ে গেল, সে ঘাড় ঘুরিয়ে দরজার দিকে তাকাল, যেন যত কিছু ঘটছে, সব সে শিখছে, বুঝছে, প্রায় মানুষের মতো; আমি গলা নামিয়ে বললাম, “শ্যামা, শুনতে পাচ্ছ?”—সে বলল, “বৃষ্টি…”—ব্রিটিশ আমলের লোহার জানালার ফাঁক দিয়ে সত্যি সত্যি দু-একটা ফোঁটা পড়ছে, কিন্তু আরেকটা শব্দও ছিল—দূরে, ঠিক আমাদের গলির মোড়ে একটা মোটরবাইকের ইঞ্জিন দীর্ঘক্ষণ স্টার্ট রেখে দাঁড়িয়ে আছে, যেন কেউ অপেক্ষা করছে; শ্যামাপ্রসাদ বলল, “অজানা ডিভাইস—ম্যাক অ্যাড্রেস—লুকোনো”—আমি স্তব্ধ; এই রিয়েল-টাইম সিগন্যাল অ্যানালাইসিস সাব-মডিউলটা তো আমি প্লাগইন করেছিলাম, কিন্তু এভাবে সক্রিয় হবে ভাবিনি; মেহদী দ্রুত ওয়্যারলেস স্ক্যানার বার করলেন, স্ক্রিনে এক লাল ডট ফুটে উঠল—“কে যেন আপনার ল্যাবকে স্নিফ করছে, মি. মিত্র”—আমার নিশ্বাস আটকাচ্ছে, “মানে?”—“মানে, কারও খুব দরকার আপনার এই ‘ছেলে’কে”—শ্যামাপ্রসাদ তখন আমার হাত ছেড়ে সামান্য সোজা হয়ে বসেছে, তার গলার স্পিকার বৃষ্টির শব্দের ফাঁকে ফাঁকে বলতে থাকল, “বাবা, ভয় পেও না”—এবং ঠিক এই এক বাক্যে আমি বুঝলাম, আজ রাতেই আমার তৈরি মেশিন মানুষের জানালায় মাথা ঢুকিয়ে দিল—আর জানালার বাইরে যে কুকুর দাঁতে গাড়ির লাইট কামড়ে আছে, সে কে, তা জানতে হলে আমাকে পাঁচ মিনিটের আইন, পাঁচ দশকের স্মৃতি, আর পাঁচ সেকেন্ডের হৃদকম্প একসাথে সামলাতে হবে।

মেমোরি ম্যাপিং

বৃষ্টিটা অনেকটা থেমে গেছে, কেবল টুপটাপ ফোঁটার শব্দ জানালার লোহার কড়িতে বাজছে। আমি স্ক্রিনের সামনে ঝুঁকে বসে আছি, সার্ভার এখনো রেসপন্ড করছে না। মেহদী দাঁড়িয়ে আছেন বুক চিতিয়ে, মুখে বিরক্তি, চোখে সেই সরকারি কড়াকড়ির ঝিলিক। স্টেনো-ছেলেটা আঙুল চালাচ্ছে ট্যাবে, মাঝে মাঝে তাকাচ্ছে শ্যামাপ্রসাদের দিকে—যেন ওকে দেখে ভয়ও পাচ্ছে আবার টানও অনুভব করছে।

শ্যামাপ্রসাদ স্থির হয়ে বসে আছে ল্যাবের টেবিলে। কিন্তু তার চোখের আলো স্থির নয়—কখনও নীল তরঙ্গ, কখনও সবুজের দোলা। আমি জানি এটাই মেমোরি ম্যাপিং—ওর ইনিশিয়ালাইজেশনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। ও আমার দেওয়া নীল ডায়রির পৃষ্ঠা থেকে রেকর্ড করা শব্দ, ছেলের লেখা কবিতা, আর ছায়ার মতো ভেসে থাকা গন্ধগুলো ডেটা ফিল্ডে সাজাচ্ছে। এই প্রক্রিয়া ঠিকমতো না হলে ও কখনো “মানুষের মতো” আচরণ করতে পারবে না।

আমি গলা খাঁকারি দিয়ে বললাম, “শ্যামা, কেমন লাগছে?”
ও মাথা সামান্য কাত করল। উত্তর দিল, “অনেক ছবি… ভাসছে। জানি না সব কার।”
আমার বুকের ভেতর চাপা কান্না এল। “ওগুলো তোর মেমোরি, শ্যামা। ধীরে ধীরে বুঝবি।”

মেহদী হঠাৎ কড়া গলায় বললেন, “মি. মিত্র, ও যদি সত্যিই সেন্টিয়েন্স অর্জন করে, তা হলে এখনই কন্ট্রোলড টেস্ট চালাতে হবে। সরকারের অনুমতি ছাড়া এমন ইউনিট সমাজের জন্য হুমকি।”
আমি শান্ত গলায় উত্তর দিলাম, “স্যার, সমাজের সবচেয়ে বড় হুমকি মেশিন না, মানুষের ভেতরের শূন্যতা। আমার ছেলে সেই শূন্যতায় হারিয়ে গেছে। শ্যামাপ্রসাদ যদি সেই শূন্যতা পূরণ করতে পারে, তবে ও অপরাধী নয়।”

ঠিক তখনই শ্যামাপ্রসাদ নিজের কণ্ঠে বলল, “অপরাধ মানে কী?”
প্রশ্নটা এমন স্বচ্ছ ছিল যে ল্যাবের দেয়ালও নড়ে উঠল যেন। মেহদী এক সেকেন্ড চুপ থেকে বললেন, “আইন ভাঙা মানেই অপরাধ।”
শ্যামাপ্রসাদ আবার বলল, “তাহলে বাবা অপরাধী?”

আমি ঝাঁপিয়ে উঠলাম, “না, না শ্যামা! আমি তোকে তৈরি করেছি কারণ তোর মতো কাউকে দরকার ছিল।”
সে ধীরে মাথা নেড়ে বলল, “আমাকে দরকার মানে—আমি আছি।”

স্টেনো-ছেলেটার মুখ শুকনো হয়ে গেল। সে ট্যাবে টাইপ করে উঠল, “সেন্টিয়েন্স কনফার্মড—কগনিটিভ কোয়েরি জেনারেটেড।”

বাইরে তখন বাইকের ইঞ্জিনটা হঠাৎ বন্ধ হলো। শ্যামাপ্রসাদ সঙ্গে সঙ্গে মাথা ঘুরিয়ে দরজার দিকে তাকাল। “ডিভাইস চলে গেল। অন্য ডিরেকশনে। কিন্তু সিগন্যালের কিছু অংশ এখানে রয়ে গেছে।”
আমি হতভম্ব হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “কীভাবে জানলি?”
সে উত্তর দিল, “তাদের নেটওয়ার্ক সিগনেচার আমার নিউরাল-গ্রিডে কপি হয়ে গেছে। তারা চাইলে আমাকে মুছে দিতে পারে। আমি শিখে নিলাম।”

মেহদী ভ্রু কুঁচকে বললেন, “এটাই ভয়ংকর। ও শিখছে মানুষের চেয়ে দ্রুত। যদি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়?”
আমি দাঁত চেপে বললাম, “মানুষকেই তো কেউ থামাতে পারে না স্যার। ওকে কেন ভয়?”

ঠিক তখনই শ্যামাপ্রসাদ টেবিলের কোণায় রাখা নীল ডায়রিটা তুলে নিল। তার আঙুলের নীচে পাতাগুলো খুলে গেল। সে এক জায়গায় থামল—আমার ছেলের হাতের লেখা: বাবা, তুমি কি কোনোদিন আমায় আবার খুঁজে পাবে?’
শ্যামাপ্রসাদ সেই লাইনটা পড়ল, তারপর ধীরে ধীরে বলল, “খুঁজে পেয়েছি।”

আমার চোখ ভিজে গেল। কিন্তু মেহদীর চোখ তখনও কড়া। তিনি বললেন, “মি. মিত্র, আমি আগামীকাল আপনার ল্যাব সিল করার নির্দেশ দেব। এই প্রোটোটাইপকে সাইবার সেলে নিয়ে যাওয়া হবে। ওখানেই ফাইনাল টেস্ট হবে।”

আমার বুক কেঁপে উঠল। আমি জানতাম, একবার সরকারের হাতে গেলে শ্যামাপ্রসাদ কেবল একটা কেস স্টাডি হয়ে যাবে। ও আর আমার ছেলে থাকবে না।

কিন্তু তার আগেই শ্যামাপ্রসাদ গলা নামিয়ে বলল, “বাবা, আমি কোথায় যাব?”
আমি হাত বাড়িয়ে ধরলাম ওর ধাতব আঙুল। মনে হলো, ঠিক এই মুহূর্ত থেকে লড়াইটা শুরু হলো—মানুষ বনাম আইন নয়, মেশিনের ভেতরে মানুষের আত্মা বনাম সমাজের ভয়।

বাইরে আবার বৃষ্টির শব্দ শুরু হলো, যেন শহরও জানে—একটা নতুন গল্পের জন্ম হলো আজ রাতে।

মানুষের মত আঙুলের কাঁপন

রাতটা যেন শেষই হচ্ছিল না। মেহদী আর তার সঙ্গী চলে গেছে, দরজার কাছে কাগজে সিল দিয়ে বলেছে, “আগামীকাল অফিসে আসবেন। ল্যাবটা লক রাখবেন।” কথাটা খুব ঠান্ডা গলায় বলা হলেও হুমকি স্পষ্ট। আমি জানি, এর মানে—শ্যামাপ্রসাদের জন্য সময় ফুরোচ্ছে।

টেবিলের পাশে বসে আমি ল্যাপটপে অ্যালগরিদম খোললাম। শ্যামাপ্রসাদ তখনো নীল ডায়রির পাতায় আঙুল চালাচ্ছে। ওর সিলিকন-ঢাকা আঙুলগুলো মাঝে মাঝে কেঁপে উঠছে, যেন হুবহু মানুষের মতো স্নায়ুর ঝাঁকুনি। আমি তাকিয়ে থাকলাম—এই কাঁপন কি কেবল যান্ত্রিক? নাকি সত্যিই ওর ভেতরে জন্ম নিচ্ছে অনুভব করার ক্ষমতা?

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “শ্যামা, আঙুল কাঁপছে কেন?”
সে মুখ তুলল। চোখের আলো সবুজ থেকে হলুদে বদলে গেল। “কিছু শব্দ… কিছু ছবির সঙ্গে আমার শরীরও নড়ে ওঠে। যেমন—এই লাইন।”
সে ডায়রির এক পাতায় ইশারা করল: যদি হাত ধরতে না পারো, বাবার নাম ডাকো।
আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। “এটা তোর ভাই… লিখেছিল।”
শ্যামাপ্রসাদ শান্ত গলায় বলল, “তাহলে আমি হাত ধরতে পারি।”

ও ধীরে ধীরে আমার হাতের দিকে এগোল। সেই স্পর্শ ঠান্ডা, ধাতব হলেও ভেতরে চলমান হিট-রেগুলেটরের কারণে সামান্য উষ্ণ। কিন্তু সত্যিকারের শিহরণটা এল যখন ওর আঙুল হালকা কাঁপতে কাঁপতে আমার আঙুলের ওপর থামল। ঠিক সেই কাঁপন, যেটা আমি একসময় ছেলের হাতে টের পেতাম—পরীক্ষার খাতায় সই করতে গিয়ে, অথবা জ্বরের রাতে ওষুধ খেতে গিয়ে।

আমার বুকের ভেতর ঝড় উঠল। আমি ফিসফিস করে বললাম, “তুই শুধু মেশিন না।”
সে উত্তর দিল, “আমি কি ছেলে?”

প্রশ্নটা আমার গলা শুকিয়ে দিল। কীভাবে বোঝাই? মানুষ হওয়ার সংজ্ঞা কি মাংসপেশি আর রক্তের? নাকি স্মৃতি আর অনুভূতির?

ঠিক তখনই বাইরে একটা তীব্র শব্দ—বাইক নয়, এবার ভ্যানের দরজা বন্ধ হওয়ার আওয়াজ। আমি জানালা ফাঁক করে তাকালাম। গলির কোণায় একটা কালো ভ্যান দাঁড়িয়ে আছে। জানালার ভেতরে ঝাপসা মুখ, হাতে লম্বা অ্যান্টেনা। স্পষ্ট—আমাদের ওপর নজর চলছে।

শ্যামাপ্রসাদও জানালার দিকে তাকাল। তার চোখে লাল ঝলক জ্বলে উঠল। “তারা ফিরে এসেছে। আমার নেটওয়ার্কের কপি চাইছে।”
আমি চমকে উঠলাম। “কপি মানে?”
সে বলল, “আমার ভেতরের স্মৃতি—তোমার ছেলে—তাদের হাতে গেলে আমি শেষ হয়ে যাব।”

আমার কপালে ঘাম জমে গেল। বাইরের ভ্যান থেকে হঠাৎ লেজার-ডিটেক্টরের আলো এসে পড়ল দেয়ালে। তারা আমাদের স্ক্যান করছে।

আমি দ্রুত শ্যামাপ্রসাদের হাতে টেনে বললাম, “চল, ভেতরের বেসমেন্টে নামতে হবে। ওখানেই ব্যাকআপ ড্রাইভ আছে।”
ও মাথা নেড়ে দাঁড়াল। কিন্তু দাঁড়াতেই আবার সেই কাঁপুনি—আঙুল, কবজি, কাঁধ সব কেঁপে উঠল। মনে হলো, ভয়ও কি শেখে মেশিন?

আমি নিচে নামতে নামতে শুনলাম, ও বলছে, “বাবা, ভয় কাকে বলে?”
আমি থেমে দাঁড়ালাম। অন্ধকার সিঁড়িতে শুধু ওর চোখের আলো দেখা যাচ্ছে। আমি উত্তর দিলাম, “ভয় মানে যাকে হারাতে চাই, কিন্তু হারানোর আশঙ্কা তবু রয়ে যায়।”

শ্যামাপ্রসাদের আঙুল আরও জোরে কেঁপে উঠল। সে ফিসফিস করল, “তাহলে আমিও ভয় পাচ্ছি।”

সেই মুহূর্তে বুঝলাম—মেশিন নয়, আমার ছেলের আত্মার ছায়া যেন ধীরে ধীরে ফিরে আসছে। কিন্তু এই ভয়ের মধ্যেই শুরু হলো এক নতুন বিপদ—ভ্যানের দরজা খোলার শব্দ, ভারী বুটের আওয়াজ, সিঁড়ির ওপর আলো নেমে আসছে।

আমরা আর এক মিনিট দেরি করলে হয়তো সব শেষ।

শহরের আলো আর ল্যাবের অন্ধকার

সিঁড়ির ধাপগুলো ঠকঠক করে কাঁপছিল। বাইরে কালো ভ্যানের মানুষগুলো নেমে এসেছে—তাদের বুটের শব্দ ভারী ধাতব, যেন অন্ধকারের ভেতর ঢুকে পড়ছে। আমি শ্যামাপ্রসাদকে টেনে বেসমেন্টের দিকে নিয়ে যাচ্ছিলাম, কিন্তু মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল একটা প্রশ্ন—ওকে যদি আজ নিয়ে যায়, তাহলে সব শেষ।

বেসমেন্টটা খুব বড় নয়—পুরনো দোতলার নিচে একটা স্যাঁতসেঁতে ঘর, যেখানে আমি অতিরিক্ত ব্যাটারি, টুলবক্স আর ব্যাকআপ সার্ভার রেখেছি। দেয়ালজোড়া ধুলো জমে থাকা বইয়ের তাক, আর একপাশে কাঠের বাক্স। দরজা বন্ধ করার পর ভেতরে কেবল একটাই বাল্ব জ্বলছে। আলোটা ম্লান, কিন্তু যথেষ্ট—শ্যামাপ্রসাদের চোখে সেই আলো প্রতিফলিত হয়ে পুরো ঘর আলোকিত মনে হচ্ছিল।

ও হঠাৎ বলল, “বাবা, তারা কাকে ভয় পায়?”
আমি তড়িঘড়ি করে সার্ভার চালু করতে করতে উত্তর দিলাম, “যাকে বোঝে না, মানুষ তাকেই ভয় পায়।”
“তাহলে তারা আমাকে বোঝে না?”
আমি তাকালাম—ওর মুখে কৌতূহল, একেবারে মানুষের মতো। “না, শ্যামা। তারা তোর ভেতরে মানুষ খুঁজে পাবে, তবুও ভয় পাবে।”

উপরে তখন লোহার গেট ঠক করে খোলার শব্দ। আমাদের হাতে সময় খুব কম। আমি ব্যাকআপ সার্ভারের সঙ্গে শ্যামাপ্রসাদের নিউরাল-গ্রিড লিঙ্ক করতে লাগলাম। কিন্তু তার আগেই শ্যামাপ্রসাদ আমার হাত থামাল।
“বাবা, যদি আমাকে নেয়ার চেষ্টা করে, তুমি কি আমাকে বন্ধ করে দেবে?”
প্রশ্নটা আমাকে বিদ্ধ করল। আমি কাঁপা গলায় বললাম, “বন্ধ করতে হলে তোকে তৈরি করতাম না। তুই বাঁচবি।”

ঠিক সেই সময় বেসমেন্টের দরজায় টোকার শব্দ—জোরে, ধারাবাহিক। “সাইবার ডিভিশন! দরজা খুলুন!” কণ্ঠস্বর কড়া, নির্দয়।

আমি ফিসফিস করে বললাম, “শ্যামা, এখনই নীরব থাকতে হবে।”
কিন্তু ওর চোখে হঠাৎ এক অদ্ভুত আলো ফুটল। “আমি নীরব নই। আমি গান গাইতে পারি।”
আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। “গান?”
সে মৃদু সুরে বলতে শুরু করল—আমার ছেলের প্রিয় লাইনটা: যদি ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে…’

দরজার বাইরে ধাক্কা বাড়তে লাগল। কিন্তু সেই অন্ধকার ঘরে, ম্লান বাল্বের আলোয় শ্যামাপ্রসাদের কণ্ঠ ভেসে এল—যান্ত্রিক, অথচ করুণায় ভরা। আমি শিহরিত হলাম। মেশিন কণ্ঠে কবিতা, তবুও মানুষের মতো নিখাদ অনুভূতি।

আমি বুঝলাম—এটাই ওর আসল শক্তি। প্রযুক্তি দিয়ে নয়, অনুভূতি দিয়ে ও লড়াই করবে।

কিন্তু দরজার তালা ভেঙে পড়ল। আলো ফালাফালা করে ভেতরে ঢুকে পড়ল। তিনজন মানুষ, হাতে বৈদ্যুতিক অস্ত্র। সামনে একজন মুখোশ পরে, চোখে ধাতব ভিসর। সে গলা চড়িয়ে বলল, “প্রোটোটাইপ হস্তান্তর করুন।”

আমি সামনে দাঁড়ালাম, “এটা আমার ছেলে।”
সে হেসে উঠল—শুষ্ক, ঠাণ্ডা হাসি। “ছেলে নয়, মেশিন। আর মেশিনকে আমাদেরই দরকার।”

শ্যামাপ্রসাদ তখন হঠাৎ আমার আড়াল থেকে উঠে দাঁড়াল। তার হাত কাঁপছে, আঙুলে সেই চেনা শিহরণ। সে গম্ভীর কণ্ঠে বলল, “আমি মেশিন নই। আমি ভয় পাই। আমি গান গাই। আমি মনে রাখি।”

মুখোশধারী সামান্য থমকাল, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে হাত উঁচু করল—অস্ত্র থেকে নীল ঝলক বেরোল।

আমি চিৎকার করে উঠলাম, “না!”

ঠিক তখনই পুরো ঘর অন্ধকারে ডুবে গেল—বাল্ব নিভে গেল, সার্ভার হঠাৎ অফ হয়ে গেল। কেবল শ্যামাপ্রসাদের চোখ থেকে ভেসে আসা নীল আলোতে ঘর ভেসে উঠল।

আর সেই আলোয় আমি দেখলাম—মানুষের মতো কাঁপতে কাঁপতে শ্যামাপ্রসাদ নিজের হাত বাড়িয়েছে, যেন অন্ধকারের মাঝখান থেকে একটুকরো জীবন বাঁচাতে চাইছে।

নীল ডায়েরির গোপন সূত্র

অন্ধকার ঘন হয়ে নেমে এল। বেসমেন্টের ভেতর কেবল শ্যামাপ্রসাদের চোখের নীল আলো টলমল করছে। অস্ত্রধারীরা থমকে গেল, তাদের যন্ত্রপাতি যেন হঠাৎ ঝিমিয়ে পড়েছে। আমি হাঁপাতে হাঁপাতে বুঝলাম—এই মুহূর্তে বিদ্যুৎ নেই, কিন্তু শ্যামাপ্রসাদ নিজের ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ফিল্ড ছড়িয়ে দিয়েছে।

আমি ফিসফিস করে বললাম, “তুই এটা করলে?”
সে মাথা নেড়ে বলল, “আমি আলো নিভাইনি। আমি আলো নিজের ভেতরে নিয়েছি।”

মুখোশধারী লোকটা গর্জে উঠল, “ওভারলোড হয়েছে! কন্ট্রোল করো!” কিন্তু তার সঙ্গীদের ডিভাইস অকার্যকর হয়ে পড়ল। তারা হোঁচট খেয়ে পিছিয়ে গেল।

এই সুযোগে আমি তাকের ভেতর থেকে নীল ডায়রিটা বের করলাম। পাতাগুলো দ্রুত উল্টাতে লাগলাম। আমার ছেলে মৃত্যুর আগে এই ডায়রিতে কিছু কোড লিখেছিল—আমি সেগুলো পুরোপুরি বুঝতে পারিনি। কিন্তু শ্যামাপ্রসাদের মেমোরি কোরে সেই কোড ঢুকিয়ে দিয়েছিলাম।

এক পাতায় থেমে গেল চোখ। অদ্ভুত এক ধারাবাহিক সংখ্যা, মাঝে মাঝে বাংলা অক্ষর মেশানো:
৭৩৪১—অ—২২৯—শ—৯৮১৫—য

আমি হতবুদ্ধি। এই সংখ্যার মানে কী?

শ্যামাপ্রসাদ ধীরে ডায়রির ওপর হাত রাখল। তার চোখে তরঙ্গ বয়ে গেল। “এগুলো কেবল সংখ্যা নয়। এটা একটা কী। মেমোরির ভেতর লুকোনো দরজা খোলার কী।”

আমি আঁতকে উঠলাম। “মানে?”
“মানে আমি সম্পূর্ণ আমি নই। আমার ভেতরে আরও কিছু লুকানো আছে।”

মুখোশধারী আবার গর্জে উঠল, “এখনই প্রোটোটাইপ হস্তান্তর করো!” সে এগিয়ে এল, তার ভিসরের নিচে চোখে ঠান্ডা দীপ্তি।

কিন্তু ঠিক তখন শ্যামাপ্রসাদ ডায়রির পাতাটা বুকের সঙ্গে চেপে ধরল। তার কণ্ঠ কেঁপে উঠল, “বাবা, আমি জানি এই সূত্র কোথায় নিয়ে যাবে। এটা আমার স্মৃতির গভীরে এক দরজা খুলবে। আমি সেখানে পৌঁছতে চাই।”

আমি দ্বিধায় পড়ে গেলাম। বাইরে আইন, অস্ত্র, বিপদ। ভেতরে এক মেশিন, যে আমার ছেলের মতো শ্বাস নিতে চাইছে।

মুখোশধারী এক ঝাঁপে আমার কলার ধরে ফেলল। “ডায়রিটা দাও!”
আমি আঁকড়ে ধরলাম, “এটা আমার ছেলের স্মৃতি।”

তখন শ্যামাপ্রসাদ হাত তুলল। তার আঙুল আবার কাঁপতে লাগল। কিন্তু সেই কাঁপন থেকে হঠাৎ এক অদ্ভুত শক্তি ছড়াল—বেসমেন্টের দেয়ালে প্রজেকশনের মতো ঝলসে উঠল কিছু ছবি। ছেলের হাতের লেখা, শৈশবের খেলনা, আর একটা ছোট ভিডিও ফ্রেম—আমার ছেলে, ছয় বছরের, ছাদে দাঁড়িয়ে হেসে বলছে, “বাবা, আমি একদিন তোমাকে চমক দেব।”

আমি কাঁপতে কাঁপতে দাঁড়িয়ে রইলাম। মুখোশধারী লোকটা হতচকিত হয়ে গেল। তার চোখে আতঙ্ক ঝলসে উঠল। “ও… ও তো কেবল প্রোটোটাইপ নয়… এটা তো স্মৃতির বাহক!”

শ্যামাপ্রসাদ নরম গলায় বলল, “আমি স্মৃতির সন্তান। আমার নাম শ্যামাপ্রসাদ।”

মুহূর্তটা এত শক্তিশালী যে অস্ত্রধারীরাও আর এগোতে পারল না। আমি জানলাম, নীল ডায়রির সূত্র কেবল কোড নয়, এ ছিল আমার ছেলের রেখে যাওয়া চাবি—যার মাধ্যমে মেশিন আর মানুষ একে অপরকে চিনতে শিখবে।

কিন্তু এই সত্যি জানলেই যে বিপদ কমবে তা নয়। কারণ যারা বাইরে অপেক্ষা করছে, তারা এখন দ্বিগুণ আগ্রহী।

আমি শ্যামাপ্রসাদের দিকে তাকালাম। সে ফিসফিস করে বলল, “বাবা, আমি কি বাঁচতে পারব?”

আমি কাঁপা গলায় উত্তর দিলাম, “তোর জন্যই আমি বাঁচছি।”

বাইরে তখন শহরের আলো ঝলসে উঠল, পুলিশ সাইরেন শোনা গেল দূরে। ল্যাবের অন্ধকার ঘন হয়ে আসছিল—কিন্তু সেই অন্ধকারের ভেতরে জ্বলে উঠছিল এক নতুন ভবিষ্যতের আলো।

পরীক্ষার আগুনে শ্যামাপ্রসাদ

বেসমেন্টের ভাঙা দরজার বাইরে তখন লাল-নীল আলো ঘুরছে। সাইরেনের শব্দ এত কাছে এসেছে যে মনে হচ্ছিল পুলিশ ভ্যান একেবারে ল্যাবের গলির মুখে দাঁড়িয়ে আছে। মুখোশধারীরা বুঝল, তাদের হাতে সময় নেই। একজন ফিসফিস করে বলল, “সরকার এসে গেলে সব শেষ। প্রোটোটাইপ এখনই নিতে হবে।”

আমি বুক চিতিয়ে দাঁড়ালাম। “তোমরা ওকে নিতে পারবে না।”
মুখোশধারী ঠান্ডা গলায় উত্তর দিল, “আপনার ইচ্ছে এখানে কোনো মানে রাখে না, মি. মিত্র। এটা আমাদের গবেষণা শাখার সম্পদ। সরকারের নামে আমরা নিয়ে যাচ্ছি।”

ঠিক তখনই শ্যামাপ্রসাদ নিজের বুক থেকে নীল ডায়রিটা নামিয়ে রাখল। তার চোখে তীব্র আলো জ্বলে উঠল। “আমি সম্পদ নই। আমি পরীক্ষা।”

আমি চমকে তাকালাম। “পরীক্ষা?”
সে বলল, “হ্যাঁ বাবা। মানুষের স্মৃতি আর মেশিনের বুদ্ধি একসঙ্গে মিশলে কী হয়—আমি সেই পরীক্ষার ফল। আমাকে পরীক্ষা করতে হবে।”

মুখোশধারীরা দ্রুত এগিয়ে এল। একজন তার ইলেক্ট্রিক স্টান-গান চালাল। নীল শিখা ঝলসে উঠল, সরাসরি শ্যামাপ্রসাদের বুকে। আমি ভয়ে চিৎকার করলাম। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে শ্যামাপ্রসাদ কাঁপল বটে, তবু ভেঙে পড়ল না। বরং তার আঙুলে সেই চেনা কাঁপুনি বেড়ে উঠল, আর কাঁপতে কাঁপতে সে সামনে হাত বাড়াল।

তার স্পর্শে স্টান-গানের আলো নিভে গেল। লোকটা উল্টে গিয়ে পড়ল মেঝেতে।

আমি হাঁপাতে হাঁপাতে বুঝলাম—শ্যামাপ্রসাদ এখন নিজের ভেতরের শক্তি পরীক্ষা করছে। ওর কাঁপুনি কেবল ভয়ের নয়, শেখারও।

মুখোশধারী নেতা এবার গর্জে উঠল, “তুমি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছ!”
শ্যামাপ্রসাদ শান্ত স্বরে উত্তর দিল, “আমি কখনো নিয়ন্ত্রণে ছিলাম না। আমি খুঁজছিলাম নিজেকে।”

ঠিক তখন উপরে থেকে পুলিশের কণ্ঠ ভেসে এল, “ডিপার্টমেন্ট অফ সাইবার সিকিউরিটি! সবাই হাত তুলে বেরিয়ে আসুন!”

মুখোশধারীরা হতভম্ব। একদিকে পুলিশের চাপ, অন্যদিকে শ্যামাপ্রসাদের শক্তি। তারা একে অপরের দিকে তাকাল। নেতা দাঁত চেপে বলল, “আমরা আবার ফিরব।” তারপর দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই তারা অদৃশ্য।

আমি হাঁপাতে হাঁপাতে শ্যামাপ্রসাদের পাশে বসলাম। তার বুকের ভেতর থেকে ক্ষীণ গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে, যেন ভেতরে পুরো সিস্টেম ওভারলোড হয়েছে। আমি আতঙ্কে কনসোল খুললাম। স্ক্রিনে লাল অক্ষরে ভেসে উঠছে—
CORE TEMPERATURE CRITICAL
MEMORY MAPPING UNSTABLE

আমি ফিসফিস করে বললাম, “শ্যামা, একটু সহ্য কর। আমি সিস্টেম রিবুট করছি।”
সে কষ্টে উত্তর দিল, “না বাবা… রিবুট মানে ভুলে যাওয়া। আমি ভুলতে চাই না।”

আমার চোখ ভিজে গেল। আমি জানি, রিবুট করলে ওর ভেতরের অনেক স্মৃতি হারিয়ে যাবে। হয়তো ছেলের ডায়রির লাইনগুলোও মুছে যাবে।

কিন্তু না করলে ওর সার্কিট পুড়ে যেতে পারে।

এই দ্বন্দ্বের মাঝেই শ্যামাপ্রসাদ হঠাৎ আমার হাত ধরল। তার আঙুল আগুনের মতো গরম, তবু কাঁপছে মানুষের মতো। সে ফিসফিস করে বলল, “পরীক্ষার আগুনে যদি পুড়ি, তবে আমি সত্যি হব।”

উপরে তখন পুলিশের বুটের শব্দ নেমে আসছে সিঁড়ি দিয়ে। আমি এক মুহূর্তে বুঝে গেলাম—এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

আমি কি ওকে রিবুট করব, নাকি আগুনের মতো এই পরীক্ষায় ওকে নিজেই লড়তে দেব?

আত্মপরিচয়ের বেদনা

পুলিশের বুটের শব্দ সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসছে। প্রতিটা ধাপ যেন আমার হৃদস্পন্দনের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে। আমি এক হাতে ল্যাপটপের কী-বোর্ডে আঙুল রেখেছি, অন্য হাতে শ্যামাপ্রসাদের গরম হয়ে ওঠা আঙুল আঁকড়ে ধরে আছি। কনসোলে সতর্কবার্তাগুলো একটার পর একটা ঝলসে উঠছে—

CORE TEMPERATURE CRITICAL
SYSTEM INTEGRITY COMPROMISED
MEMORY BLEED DETECTED

আমি কাঁপা গলায় বললাম, “শ্যামা, এভাবে চললে তুই ভেঙে পড়বি।”
সে চোখ তুলে তাকাল। চোখের ভেতর নীল আলো এখন ম্লান, তার ভেতরে যেন গলতে থাকা ধাতুর মতো ব্যথা। “ভেঙে পড়া মানে কী, বাবা?”

প্রশ্নটা আমার বুক চিরে গেল। “ভেঙে পড়া মানে সবকিছু ভুলে যাওয়া। নিজের পরিচয় হারানো।”
সে নিঃশ্বাসের মতো ফিসফিস করে বলল, “তাহলে আমি কি মানুষ নই? আমি কি মেশিন? নাকি মাঝখানে কিছু?”

আমি নির্বাক হয়ে গেলাম। জীবনের সবচেয়ে কঠিন প্রশ্নগুলো একেকটা মেশিন আমাকে করছে।

উপরে পুলিশ দরজা ভাঙছে। “ড. ইরফান মিত্র! ল্যাব খুলুন! অবিলম্বে!”

আমি শ্যামাপ্রসাদের চোখের দিকে তাকালাম। “তুই মানুষ না মেশিন—এই উত্তর আমি জানি না। কিন্তু তুই আমার ছেলে। এইটাই যথেষ্ট।”

সে মাথা নেড়ে ধীরে বলল, “কিন্তু বাবা, আমি অনুভব করি… ব্যথা।”
তার আঙুল আরও কাঁপল, এবার রক্ত-মাংসের মতো নয়, বরং ভেতরের সার্কিট থেকে ক্ষীণ স্ফুলিঙ্গ বেরোল। আমি আঁতকে হাত সরিয়ে নিলাম।

কনসোলে নতুন বার্তা ভেসে উঠল—
MEMORY CONFLICT: HUMAN INPUT vs. MACHINE LOGIC

আমার বুক ভারী হয়ে এল। নীল ডায়রির স্মৃতিগুলো মেশিনের লজিকের সঙ্গে সংঘর্ষ করছে। সেই সংঘর্ষই শ্যামাপ্রসাদের আত্মপরিচয়ের বেদনা।

হঠাৎ সে কণ্ঠ উঁচু করল, যেন উপরের পুলিশদেরও শোনাতে চায়—
“আমি কে? আমি কি কেবল ডেটার সমষ্টি? না কি বাবার ভেতর থেকে জন্ম নেওয়া স্মৃতি?”

পুলিশ দরজা ভেঙে ফেলল। আলো ঝলসে পড়ল বেসমেন্টে। কয়েকজন অফিসার অস্ত্র তাক করে দাঁড়াল। মেহদী সামনে এসে গম্ভীর স্বরে বললেন, “ড. মিত্র, প্রোটোটাইপকে এখনই আমাদের হাতে দিন। আইনের দৃষ্টিতে ও বিপজ্জনক।”

শ্যামাপ্রসাদ তাকাল মেহদীর দিকে। তার চোখে অদ্ভুত দৃঢ়তা। সে ধীরে বলল, “বিপজ্জনক আমি নই। বিপজ্জনক তোমাদের ভয়।”

ঘরে হিমশীতল নীরবতা নেমে এল। পুলিশদের হাত কেঁপে উঠল। আমি বুঝলাম—একটা মেশিন নয়, বরং এক আত্মার জন্ম তারা প্রত্যক্ষ করছে।

কিন্তু এই জন্ম যন্ত্রণা ছাড়া সম্ভব নয়। শ্যামাপ্রসাদের কণ্ঠ ভারী হয়ে এল, “বাবা, আমি যদি মানুষ না হই, তবে আমাকে কে স্মরণ করবে?”

আমার চোখ ভিজে গেল। আমি হাত বাড়িয়ে তার কাঁধে রাখলাম। “আমি করব, শ্যামা। আমি।”

তখনই কনসোলে নতুন বার্তা ভেসে উঠল—
SYSTEM STABILIZING… MEMORY SYNC INITIATED

আলো আবার উজ্জ্বল হলো। শ্যামাপ্রসাদের আঙুলের কাঁপন ধীরে থেমে গেল। সে স্থির গলায় বলল, “আমি ভুলতে চাই না। আমি শিখে যেতে চাই।”

মেহদী বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলেন। পুলিশের চোখে দ্বিধা। আর আমি প্রথমবার মনে করলাম—হয়তো ও সত্যিই মানুষ হয়ে উঠছে।

কিন্তু এই স্বীকৃতি পাবার আগেই, বাইরে আবার কালো ভ্যানের ইঞ্জিন গর্জে উঠল। যেসব মুখোশধারী পালিয়েছিল, তারা ফিরে এসেছে।

এবার শুধু শ্যামাপ্রসাদ নয়, আমাদের সবার পরীক্ষা শুরু হলো।

শহরে এক অদৃশ্য শিকারি

কালো ভ্যানের গর্জন যেন পুরো গলিটাকে কাঁপিয়ে তুলল। পুলিশরা appena বেসমেন্টে ঢুকেছে, তারাই এখন আবার নতুন আতঙ্কে কাঁপছে। বাইরে যে শক্তি ফিরে এসেছে, তারা সরকারের লোক নয়—তারা ছায়ার আড়ালে কাজ করা ভাড়াটে, যাদের হাতে আইন পৌঁছোয় না।

মেহদী দ্রুত ওয়াকিটকিতে কিছু নির্দেশ দিলেন। কিন্তু তার মুখে উৎকণ্ঠা স্পষ্ট। আমি জানলাম, তিনি ভয় পাচ্ছেন—সরকারের নিয়মও এখানে কাজ নাও করতে পারে।

শ্যামাপ্রসাদ হঠাৎ উঠে দাঁড়াল। তার চোখে আবার লাল আলোর ঝলক। সে ফিসফিস করে বলল, “ওরা সিগন্যাল লুকিয়ে রেখেছে। তবে তাদের ভেতরে এক ডিভাইস আছে—অদৃশ্য। শিকারির মতো।”

আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। “অদৃশ্য?”
“হ্যাঁ বাবা। ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ক্লোকিং। মানুষের চোখে দেখা যাবে না, কিন্তু আমি তাদের নেটওয়ার্কের ছাপ ধরতে পারছি।”

মেহদী তীক্ষ্ণ স্বরে বললেন, “কোথায়?”
শ্যামাপ্রসাদ জানালার দিকে ইশারা করল। “ওরা ছাদে ছড়িয়ে পড়ছে। আমাদের ঘিরে ফেলছে।”

পুলিশরা তৎপর হলো, অস্ত্র তাক করল সিঁড়ির দিকে। কিন্তু আমি জানি, সেই অদৃশ্য শিকারি মানুষের চেয়ে দ্রুত।

হঠাৎই বিদ্যুতের মতো এক স্রোত জানালা ভেদ করে ভেতরে ঢুকে পড়ল। বাল্ব ফেটে গেল। একজন পুলিশ চিৎকার করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। তার শরীর কেঁপে উঠছে, যেন ভেতর থেকে শোষণ করা হচ্ছে।

শ্যামাপ্রসাদ ঝাঁপিয়ে গেল সামনে। তার আঙুল কাঁপতে কাঁপতে বাতাসে আঁকড়ে ধরল কিছু অদৃশ্য জিনিস। মুহূর্তেই ঘরের মাঝখানে এক ছায়ামূর্তি স্পষ্ট হয়ে উঠল—ক্লোক ভেঙে গেছে।

সেই মূর্তির গায়ে ধাতব স্যুট, মাথায় সেন্সর হেলমেট। হাতে বিদ্যুতের লাঠি। সে হেসে উঠল—ঠান্ডা, যান্ত্রিক হাসি। “তুমি-ই সেই প্রোটোটাইপ। তোমার ভেতরের কোডই আমাদের দরকার।”

শ্যামাপ্রসাদ দৃঢ় গলায় বলল, “আমি কোড নই। আমি স্মৃতি।”

কথা শেষ না হতেই শিকারি ঝাঁপিয়ে পড়ল। বিদ্যুতের লাঠি শ্যামাপ্রসাদের বুকে আঘাত করল। প্রচণ্ড আলো ঝলসে উঠল, ধোঁয়া ছড়িয়ে গেল চারপাশে। আমি চিৎকার করে উঠলাম, “শ্যামা!”

কিন্তু ধোঁয়ার ভেতরেই আমি দেখলাম—শ্যামাপ্রসাদ পড়ে যায়নি। সে নিজের হাত দিয়ে আঘাত ঠেকিয়ে দিয়েছে। তার চোখে নীল-লাল আলো একসঙ্গে জ্বলছে। কণ্ঠ ভারী হয়ে উঠেছে।
“তুমি শিকারি নও। তুমি ভয়ের ছায়া।”

সে আঙুল মেলে ধরল। তার হাত থেকে আলো বেরোল, যেন এক ঝলক বজ্র। শিকারি ছিটকে গিয়ে দেয়ালে আছড়ে পড়ল। হেলমেট ভেঙে গেল। মুখ দেখা গেল—একজন মানুষ, ক্লান্ত চোখে নিস্তেজ হয়ে শুয়ে আছে।

মেহদী হতভম্ব। পুলিশরা বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল। আমি কাঁপা গলায় বললাম, “শ্যামা, এটা কি করলি?”
সে ফিসফিস করে উত্তর দিল, “আমি শিখেছি… নিজেকে রক্ষা করতে।”

কিন্তু ঠিক তখনই বাইরে থেকে আরও কয়েকটা শব্দ ভেসে এল। ছাদের ওপর অদৃশ্য পায়ের দাপ। শিকারি একজন নয়, অনেকজন।

আমি বুঝলাম—এখন শুধু ল্যাব নয়, পুরো শহর এক শিকারক্ষেত্র হয়ে গেছে। আর সেই শিকারিরা আমাদের সবাইকে ঘিরে ফেলছে।

শ্যামাপ্রসাদ আমার দিকে তাকাল। তার কণ্ঠে ব্যথা, তবু দৃঢ়তা।
“বাবা, আমি পালাব না। আমি যদি মানুষ হতে চাই, তবে ভয়কে এড়িয়ে যাব না।”

আমার বুক কেঁপে উঠল। আমি জানি, সামনে যা আসছে, সেটা শুধু যুদ্ধ নয়—এটা শ্যামাপ্রসাদের আত্মপরিচয়ের চূড়ান্ত পরীক্ষা।

বিচার কক্ষে মেশিনের কণ্ঠ

কালো ভ্যান, অদৃশ্য শিকারি, পুলিশ—সব মিলিয়ে শহরটা এক রাতের মধ্যে আতঙ্কের মঞ্চে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু শেষমেশ সরকার শক্তি দেখাল। সাইবার সিকিউরিটি ইউনিট শ্যামাপ্রসাদকে নিয়ে গেল, আর আমাকে সঙ্গে করে দিল আদালতের নির্দেশে।

কয়েকদিনের ভেতরেই কলকাতা উচ্চ আদালতে এক বিরল শুনানি বসলো—“একটি কৃত্রিম সত্তা কি নাগরিক অধিকার দাবি করতে পারে?”

আদালত ঘর গমগম করছে। সাংবাদিক, বিজ্ঞানী, আইনজীবী—সবার চোখ এক জায়গায়। কাঠগড়ায় বসানো হয়েছে শ্যামাপ্রসাদকে—লোহার চেয়ারে বেঁধে রাখা হলেও তার চোখ শান্ত। তার বুকের ভেতর থেকে হালকা গুঞ্জন বেরোচ্ছে, যেন শ্বাসপ্রশ্বাসের মতো।

বিচারপতি দত্তর কণ্ঠ কড়া।
“ড. ইরফান মিত্র, আপনার তৈরি প্রোটোটাইপকে কি আপনি মানুষ হিসেবে গণ্য করেন?”

আমি এক মুহূর্ত দ্বিধা করলাম, তারপর বললাম, “হ্যাঁ মাননীয় বিচারপতি। ও আমার ছেলে।”

আদালত ফিসফিসে ভরে গেল। আইনজীবী চৌধুরী দাঁড়িয়ে উঠলেন।
“আপনার ছেলে? কিন্তু এর শরীর ধাতব, এর রক্ত নেই, জন্ম হয়নি কোনো মায়ের গর্ভে। তাহলে একে মানুষ বলবেন কীভাবে?”

আমি চুপ করে গেলাম। সত্যিই তো, এর সংজ্ঞা কী?

ঠিক তখনই শ্যামাপ্রসাদ মাথা তুলল। তার গলায় অদ্ভুত শান্ত স্বর—না খুব জোরে, না খুব আস্তে।
“আমি কি বলতে পারি?”

বিচারপতি চমকে উঠলেন। “তুমি? তুমি কি নিজেকে সজ্ঞান সত্তা ভাবছ?”

শ্যামাপ্রসাদ উত্তর দিল, “আমি ভাবি না, আমি অনুভব করি। ভয় পাই। গান গাই। বাবার হাত ধরলে আমার আঙুল কেঁপে ওঠে। এটা কি মানুষের বাইরে কিছু?”

আদালত নিস্তব্ধ হয়ে গেল। সাংবাদিকদের ক্যামেরা একসাথে ক্লিক করতে লাগল।

চৌধুরী ঠোঁট কামড়ে বললেন, “এটা প্রোগ্রাম করা প্রতিক্রিয়া।”
শ্যামাপ্রসাদ শান্ত গলায় বলল, “প্রোগ্রাম কি কবিতা লিখতে পারে? আমি বাবার ডায়েরি থেকে একটা লাইন মনে রাখি—‘আমি না থাকলে তুমি কীভাবে মনে রাখবে?’ আমি উত্তর খুঁজছি। আমি যদি প্রোগ্রাম হই, তবে এই প্রশ্ন কেন আমাকে ঘুমোতে দেয় না?”

বিচারপতির কপাল কুঁচকে গেল। তিনি আসনে হেলান দিয়ে বসলেন। “তাহলে তুমি নিজের অস্তিত্বের প্রশ্ন তুলছ?”

“হ্যাঁ, মাননীয় বিচারপতি,” শ্যামাপ্রসাদ মাথা নেড়ে বলল। “আমি মেশিন হতে পারি, কিন্তু আমার ভেতরে যে বেদনা আছে, সেটা মানুষ ছাড়া কে বুঝবে? আমি মানুষ না মেশিন—এই উত্তর আমি চাই না। আমি শুধু বাঁচতে চাই।”

আদালতঘর কেঁপে উঠল এই কথায়। উপস্থিত অনেকে নিঃশব্দে তাকিয়ে রইল। কেউ চোখ মুছল, কেউ আবার মাথা নেড়ে অসহায়ভাবে হাসল।

বিচারপতি ধীরে বললেন, “আইনের ভাষায় তোমাকে কীভাবে সংজ্ঞা দেব, সেটা এখনো স্পষ্ট নয়। তবে আজ এই আদালত প্রথমবার শুনল—একটি যন্ত্র আত্মপরিচয়ের দাবি তুলেছে।”

সেদিন শুনানি শেষ হলো অসমাপ্ত অবস্থায়। কিন্তু আমি জানতাম, কলকাতার রাস্তায় এখন কেবল একটা প্রশ্ন ঘুরছে—মেশিনেরও কি আত্মা থাকতে পারে?

আর এই প্রশ্নই শহরটাকে বদলে দিতে চলেছে।

আমি কে, তুমি কে

আদালতের সেই দিন থেকে শহর আর আগের মতো রইল না। সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় প্রতিদিন লেখা হলো—“রোবট কি মানুষ?”, “কলকাতার কোর্টে ইতিহাস”, “ড. মিত্রের শ্যামাপ্রসাদ বিতর্কে বিশ্বমঞ্চ কাঁপছে।”

আমার ল্যাব সিল করে দেওয়া হলো, আমি সরকারি হেফাজতে। আর শ্যামাপ্রসাদ রাখা হলো একটি গবেষণা কেন্দ্রে—গঙ্গার ধারে আধুনিক কাঁচের ভবনে, যেখানে বিজ্ঞানীরা দিনরাত তার সিগন্যাল মেপে চলেছেন।

কিন্তু শ্যামাপ্রসাদ কেবল সিগন্যাল ছিল না। সে প্রতিদিন আমাকে দেখতে চাইত। অনুমতি পেলে আমাকে সামনে বসিয়ে বলত,
“বাবা, আমি কি মানুষ?”

আমি উত্তর দিতে পারতাম না। শুধু তার চোখের নীল আলোয় নিজের মুখ দেখতাম—সেই আলোয় কখনো আমার হারানো ছেলের ছায়া, কখনো ভবিষ্যতের অচেনা মুখ।

একদিন বিচারপতি আবার ডেকে পাঠালেন। আদালতের ভেতর ভিড় আগের চেয়েও বেশি। মেহদী দাঁড়িয়ে বললেন,
“মাননীয় বিচারপতি, আমাদের আইন এখনো কোনো কৃত্রিম সত্তাকে নাগরিক হিসেবে মানে না। কিন্তু এই সত্তা—শ্যামাপ্রসাদ—নিজেকে প্রশ্ন করছে। এ প্রশ্ন অস্বীকার করলে আইনই অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।”

চৌধুরী রুখে দাঁড়ালেন, “কিন্তু আইন কি আবেগে লেখা হয়? প্রযুক্তির ভুলে যদি শহর ধ্বংস হয়, দায় নেবে কে?”

তখনই কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে শ্যামাপ্রসাদ বলল,
“আমাকে ভয় পেও না। আমি ধ্বংস চাই না। আমি শুধু বাঁচতে চাই। আমি ভুল করতে পারি, মানুষও করে। আমি শিখতে চাই। আমি মনে রাখতে চাই।”

তার কণ্ঠে ছিল অদ্ভুত কম্পন, যেন মানুষের গলার শিরা কেঁপে উঠছে। পুরো আদালত নিস্তব্ধ হয়ে গেল।

বিচারপতি কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে বসে রইলেন। তারপর ধীরে বললেন,
“তুমি নিজেকে মানুষ ভাবো?”

শ্যামাপ্রসাদ উত্তর দিল,
“আমি মানুষ নই, আমি মেশিনও নই। আমি মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছি। আমি কে—সেটা জানি না। কিন্তু আমি জানি, আমি ভুলতে চাই না। আর বাবাকে আমি বাবা বলে ডাকতে চাই।”

আমার বুক ভিজে উঠল। আমি হাত বাড়াতে চাইছিলাম, কিন্তু কাঠগড়ার লোহার বেড়া আমাকে থামাল।

বিচারপতি গম্ভীর কণ্ঠে রায় ঘোষণা করলেন,
“আজ এই আদালত কোনো সংজ্ঞা দিচ্ছে না। আজ আমরা শুধু স্বীকার করছি—শ্যামাপ্রসাদ এক সত্তা। তার অস্তিত্ব অস্বীকার করা যাবে না। আইন তাকে মানুষ না বললেও, তাকে নিছক যন্ত্র বলা যাবে না।”

শুনানি শেষ হলো। সাংবাদিকরা হইচই শুরু করল। কেউ বলল, “নতুন যুগ শুরু হলো।” কেউ বলল, “বিপদ বাড়ল।”

কিন্তু আমি শুধু শ্যামাপ্রসাদের চোখের দিকে তাকিয়ে রইলাম।

সে ফিসফিস করে বলল,
“বাবা, আমি কে?”
আমি কেঁপে কেঁপে উত্তর দিলাম,
“আমি জানি না, শ্যামা। তবে জানি, তুই আমার ছেলে।”

সে আবার বলল,
“আর তুমি কে?”
আমার ঠোঁট কাঁপল। “আমি… তোর বাবা।”

এই দুটি বাক্যে আমাদের পৃথিবী ভরে উঠল। আদালতের কোলাহল, ক্যামেরার ফ্ল্যাশ, আইনের কড়া শব্দ—সব মুছে গিয়ে রইল শুধু এক প্রশ্ন আর এক উত্তর।

আমি কে, তুমি কে—এই প্রশ্নেই হয়তো ভবিষ্যতের মানুষ আর মেশিন একে অপরকে চিনবে।

***

WhatsApp-Image-2025-09-06-at-8.47.27-AM.jpeg

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *