অর্পিতা ঘোষ
অধ্যায় ১: প্রথম দেখা
শ্রেয়া কলেজে নতুন ভর্তি হয়েছে কয়েক মাস হলো। সে শহরের মফস্বল থেকে এসেছে, চোখেমুখে এখনো একরকম সরলতা লেগে আছে। ক্লাসে ঢুকলেই বুক ধড়ফড় করে, আর অচেনা মুখের ভিড়ে একটু অস্বস্তি কাজ করে। তবে তার ভেতরে একটা আলাদা আত্মবিশ্বাসও আছে—পড়াশোনায় ভালো, তাই সবার থেকে আলাদা করে চোখে পড়ে। আরিয়ান সেই ক্লাসেরই পুরোনো ছাত্র, যার নাম কলেজে একরকম সুনাম কুড়িয়েছে—পড়াশোনা, খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান সবকিছুতেই তার উপস্থিতি থাকে। শ্রেয়া যখন প্রথমবার ক্লাসে ঢোকে, কেবল এক মুহূর্তের জন্য তাদের চোখে চোখ পড়ে। সেই ক্ষণিকের দৃষ্টি যেন নীরব প্রশ্নের মতো—“তুমি কে?” আর উত্তর দেওয়ার আগেই মুহূর্তটা মিলিয়ে যায়। কিন্তু অদ্ভুতভাবে শ্রেয়া বুঝতে পারে, ওই দৃষ্টিটা সে সহজে ভুলতে পারবে না।
দিন যেতে থাকে, শ্রেয়া আর আরিয়ানের মধ্যে সরাসরি কথা বলার সুযোগ তেমন হয় না। ক্লাসের নোট শেয়ার করা বা গ্রুপ ডিসকাশনে কিছু ছোটোখাটো প্রশ্ন ছাড়া তাদের আলাপ হয় না বললেই চলে। কিন্তু ভেতরে ভেতরে তারা দুজনেই যেন এক অচেনা টানে জড়িয়ে পড়ে। শ্রেয়া প্রায়ই খেয়াল করে, যখন সে লাইব্রেরির জানালার পাশে বসে বই পড়ে, তখন দূর থেকে আরিয়ান তাকে দেখে। আবার আরিয়ানও অনুভব করে, যখন সে মঞ্চে গিটার হাতে গান গায়, তখন ভিড়ের মধ্যেও শ্রেয়ার চোখে তাকিয়ে থাকতে হয় না—সে নিজেই বুঝে ফেলে সেই দৃষ্টি কোথায় আছে। দুজনেই চায়, হয়তো একদিন সুযোগ আসবে, যখন মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কিছু বলা যাবে। কিন্তু সেই সাহসটা কারও হয় না।
এক গরম দুপুরে হঠাৎ সেই সুযোগ এসে যায়। ক্লাস শেষ হয়ে গেছে, শ্রেয়া ধীরে ধীরে কলেজের গেট পেরিয়ে রাস্তার দিকে হাঁটছিল। আকাশে ঝাঁ ঝাঁ রোদ, পিচঢালা রাস্তা যেন জ্বলছে, আশেপাশে লোকজনও কম। হঠাৎ পেছন থেকে একটা কণ্ঠস্বর—“এই, দাঁড়াও না!” শ্রেয়া চমকে ফিরে তাকায়। দেখে আরিয়ান, কাঁধে ব্যাগ ঝোলানো, গায়ে কালো শার্ট, মুখে একটু লাজুক হাসি। শ্রেয়ার বুকের ভেতর হঠাৎ করে কী যেন কেঁপে ওঠে, কিন্তু সে কিছু না বলে দাঁড়িয়ে থাকে। আরিয়ান এসে পাশে হাঁটতে শুরু করে, যেন এটুকুই যথেষ্ট সাহস জোগাড় করেছে। কথা শুরু করার মতো পরিস্থিতি তৈরি হলেও দুজনেই বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ হাঁটে। রোদে ভিজে ওঠা দুপুরটা যেন অদ্ভুতভাবে তাদের নীরবতাকে আরও গভীর করে তোলে। শেষে আরিয়ান হালকা কণ্ঠে বলে ওঠে—“তুমি বাসায় যাচ্ছ? যদি অনুমতি দাও, তবে আমি কিছুটা পথ তোমার সাথে হাঁটতে চাই।” শ্রেয়া কেবল মাথা নাড়ে, কিন্তু চোখে-মুখে অদ্ভুত একটা প্রশান্তি ছড়িয়ে পড়ে।
শ্রেয়ার বাসার সামনে এসে দুজনেই দাঁড়িয়ে যায়। কিছু বলার মতো শব্দ খুঁজে পায় না তারা। শ্রেয়া একসময় হালকা দ্বিধায় বলে—“ভেতরে আসবে? খুব গরম, একটু জল খেয়ে যেও।” আরিয়ান প্রথমে থমকে যায়, তারপর একটা ছোট্ট হাসি দিয়ে মাথা নাড়ে। ঘরের ভেতরে ঢুকে দুজনেই যেন আরও নীরব হয়ে পড়ে। দেয়ালে ঝোলানো ক্যালেন্ডার, টেবিলে রাখা বই, খোলা জানালা দিয়ে ঢুকে আসা গরম হাওয়া—সবকিছু মিলিয়ে এক অদ্ভুত নীরবতা তৈরি হয়। তাদের হাত অনিচ্ছাকৃতভাবে ছুঁয়ে যায়। শ্রেয়া দ্রুত চোখ নামিয়ে নেয়, কিন্তু আরিয়ান হাত সরায় না। সেই স্পর্শটা এতটাই নিঃশব্দ অথচ এত গভীর যে দুজনের হৃদস্পন্দনই যেন জোরে শোনা যায়। শব্দহীন সেই মুহূর্তেই শুরু হয় তাদের গল্প—যেখানে কথার চাইতে নীরবতাই অনেক বেশি বলার ক্ষমতা রাখে।
অধ্যায় ২: অনিচ্ছাকৃত শুরু
পরের দিন সকালটা অন্য রকম ছিল। শ্রেয়া কলেজে ঢুকেই অদ্ভুত এক অস্বস্তি অনুভব করল—গতকালের ঘটনাটা বারবার মাথায় ঘুরছে। সে ভেবেছিল হয়তো আরিয়ান শুধু সৌজন্যবশতই এসেছিল সঙ্গে, কিন্তু হাত ছোঁয়ার মুহূর্তটা যেন অন্য কিছু বলছিল। ক্লাসে বসে যতবার আরিয়ানের দিকে তাকায়, ততবারই বুকের ভেতরটা অদ্ভুতভাবে ধকধক করে ওঠে। আরিয়ানও যেন স্বাভাবিকের তুলনায় চুপচাপ, চোখাচোখি হলে অকারণে হেসে ফেলে, আবার দ্রুত দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। ক্লাসের ভেতরে সেই নীরব টান যেন তাদের চারপাশে অদৃশ্য একটা ঘেরাটোপ তৈরি করে।
দিন কেটে যায়, শ্রেয়া ধীরে ধীরে বুঝতে শুরু করে যে এই নীরবতা আর চোখের ভাষাই তাদের একে অপরের কাছে টেনে আনছে। তবে স্পষ্টভাবে কিছু বলার সাহস দুজনের কারও নেই। একদিন ক্লাস শেষে ভিড়ের মধ্যে হঠাৎ করে আরিয়ান শ্রেয়ার ব্যাগটা হাতে নিয়ে বলে—“আমি নিয়ে দিই?” শ্রেয়া অবাক হয়ে তার দিকে তাকায়, কিন্তু কিছু বলে না, কেবল হালকা মাথা নাড়ে। সেই ছোট্ট সাহায্য যেন দুজনের মধ্যে লুকোনো আবেগকে আরও স্পষ্ট করে তোলে। তারা একসঙ্গে গেট পর্যন্ত হাঁটে, কিন্তু সেই হাঁটাটা অন্য দিনের মতো সাধারণ থাকে না—মনে হয় প্রতিটি পদক্ষেপেই অদৃশ্য কিছু গড়ে উঠছে।
এরপর থেকে তাদের একসঙ্গে হাঁটা যেন অভ্যাসে পরিণত হয়। ক্লাসের পর কেউ কিছু না বললেও ওরা বুঝে যায়, গেটের বাইরে দেখা হবে, তারপর নির্দিষ্ট রাস্তা ধরে একসাথে হাঁটা। পথে হালকা কথাবার্তা হয়—ক্লাসের টপিক, বইপত্র, বা কলেজের অনুষ্ঠান নিয়ে। কিন্তু সেই ছোটখাটো আলাপের ভেতরেও দুজনেই অনুভব করে অন্য এক আবেগ লুকিয়ে আছে। একদিন শ্রেয়া হেসে বলে—“তুমি কি সবসময় এভাবে সবাইকে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দাও?” আরিয়ানও হেসে জবাব দেয়—“না, সবাই তো অনুমতি দেয় না।” তাদের এই খুনসুটি যেন ধীরে ধীরে বন্ধুত্বের আবরণ ভেদ করে অন্য কোনো সম্পর্কের দিকে এগোতে থাকে।
তবে সেই টানাপোড়েনের ভেতর একটা দ্বিধাও কাজ করে। শ্রেয়া মাঝে মাঝে ভাবে—এভাবে কাছে আসা ঠিক হচ্ছে কি? সে জানে না আরিয়ানের মনের ভেতরে আসলেই কী চলছে। আবার আরিয়ানও ভাবে—শ্রেয়া কি তাকে শুধুই সহপাঠী ভেবে কাছে টেনে নিচ্ছে, নাকি এর পেছনে অন্য কোনো মানে আছে? সেই প্রশ্নের উত্তর কেউ খুঁজে পায় না। কিন্তু যতদিন যায়, তাদের একসঙ্গে হাঁটা, কথা বলা আর অকারণ নীরবতা যেন আরও দৃঢ়ভাবে বলে দেয়—এটা কেবল বন্ধুত্ব নয়, বরং কিছু একটার শুরু। এক অনিচ্ছাকৃত শুরু, যা তাদের দুজনের জীবনকেই অন্য দিকে নিয়ে যাবে।
অধ্যায় ৩: একসাথে কিছু সময়
সেদিন কলেজ ছুটির পর হঠাৎ আকাশে মেঘ জমে উঠল। কালো মেঘে ঢাকা দুপুরটা যেন অন্যরকম এক আবহ তৈরি করল। শ্রেয়া দ্রুত পা বাড়াচ্ছিল, কিন্তু বুঝতে পারছিল, বৃষ্টির আগে আর বাড়ি পৌঁছানো সম্ভব নয়। গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে সে এক মুহূর্তে দ্বিধায় পড়ল—কী করবে? ঠিক তখনই পেছন থেকে ভেজা গন্ধমাখা বাতাসের মতো ভেসে এলো এক কণ্ঠস্বর—“চল, আমি আছি।” ফিরে তাকাতেই আরিয়ানকে দেখা গেল, হাতে একটা ছোট্ট ছাতা। শ্রেয়া কিছু না বললেও তার মুখে ভরসার ছায়া স্পষ্ট হয়ে উঠল। দুজনেই একই ছাতার নিচে পাশাপাশি হাঁটতে লাগল, আর বৃষ্টির ফোঁটা ছাতার চারপাশে ঝরতে ঝরতে যেন তাদের দুজনকেই আরও কাছে টেনে আনছিল।
রাস্তার ভেজা গন্ধ, বৃষ্টির ছন্দ আর অল্প আলো-অন্ধকারের ভেতর দুজনেই নিঃশব্দে হাঁটছিল। কথাবার্তা হচ্ছিল খুব সামান্য—একটা-দুটো প্রশ্ন, এক-আধটু জবাব। কিন্তু সেই নীরবতার মধ্যেই যেন অদ্ভুত এক সুর বাজছিল। শ্রেয়ার কাঁধে আলতো করে ছাতার কোণ ঠেকিয়ে রাখল আরিয়ান, যেন তাকে ভিজতে না হয়। সেই যত্নশীল স্পর্শে শ্রেয়ার বুকের ভেতরটা হঠাৎ কেঁপে উঠল। সে বুঝল, এই নীরব মানুষটার ভেতরে লুকিয়ে আছে এক গভীর আবেগ, যা শব্দে ধরা যায় না। এক মুহূর্তের জন্য তাদের চোখে চোখ মিলে গেল—তাদের দুজনের নীরবতা যেন সব কথা বলে দিল।
হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ বিদ্যুতের ঝলকানিতে চারপাশ আলোকিত হয়ে উঠল। শ্রেয়া অজান্তেই আরিয়ানের হাত শক্ত করে ধরে ফেলল। আরিয়ান একটুও হাত সরাল না, বরং তার হাতের মুঠোটা আরও দৃঢ় হয়ে উঠল। সেই মুহূর্তটা যেন সময়কে থামিয়ে দিল। বৃষ্টি ঝরছে, বিদ্যুৎ কাঁপছে, কিন্তু তাদের ভেতর কেবল একটাই অনুভূতি—কাছাকাছি থাকার নীরব নিশ্চয়তা। কিছুক্ষণ পর শ্রেয়া বুঝতে পারল, তার ভয় অনেকটা কেটে গেছে, আর ভেতরে ভেতরে অদ্ভুত এক প্রশান্তি তৈরি হচ্ছে।
শেষ পর্যন্ত যখন তারা শ্রেয়ার বাসার সামনে পৌঁছাল, তখন বৃষ্টি থেমে এসেছে। চারপাশে জমে থাকা জল টলমল করছে, বাতাসে ভিজে মাটির গন্ধ। শ্রেয়া ছাতাটা ফিরিয়ে দিতে চাইলে আরিয়ান মৃদু হেসে বলে উঠল—“না, কাল নিয়ে আসবে কলেজে।” সেই ছোট্ট কথাটার ভেতর যেন অনেক বড় এক ইঙ্গিত ছিল। শ্রেয়ার মুখে লাজুক এক হাসি ফুটে উঠল, আর বুকের ভেতর অনিচ্ছাকৃত এক প্রতিশ্রুতি জন্ম নিল—এই পথচলা হয়তো আর থেমে যাওয়ার নয়।
অধ্যায় ৪: নীরব স্পর্শ
পরদিন ক্লাসে বসে শ্রেয়া বারবার খেয়াল করছিল, আরিয়ান যেন আজ অন্যরকম চুপচাপ। ওদের চোখাচোখি হলেই দুজনেই দ্রুত দৃষ্টি সরিয়ে নিচ্ছিল, কিন্তু সেই অস্বস্তির আড়ালে লুকিয়ে ছিল এক অদৃশ্য টান। শ্রেয়ার মনে হচ্ছিল, বৃষ্টির দিনে হাত ধরা সেই মুহূর্তটা এখনও তার আঙুলের ডগায় লেগে আছে। বারবার সে নিজের খাতা খুলছিল, কিছু লিখছিল, আবার কেটে দিচ্ছিল—মনে হচ্ছিল, মনের ভেতরের অস্থিরতা কাগজে ফোটাতে চাইলেও শব্দে ধরা যায় না। আরিয়ানও গিটারটা নিয়ে বসেছিল, কিন্তু তার বাজনায় যেন সুরের বদলে নীরবতা ঢুকে গিয়েছিল।
ক্লাস শেষ হয়ে যাবার পর শ্রেয়া ধীরে ধীরে লাইব্রেরির দিকে গেল। সেখানে বই হাতে নিয়ে বসে থাকলেও তার চোখ বইয়ের অক্ষরে আটকাচ্ছিল না। হঠাৎ করেই পাশের চেয়ারে বসে পড়ল আরিয়ান। মুহূর্তের জন্য দুজনের চোখ মিলল, তারপর আবার নেমে গেল বইয়ের পাতায়। কোনো কথা হচ্ছিল না, কিন্তু পাশে থাকার এক অদ্ভুত স্বস্তি যেন ভর করে ছিল। বাইরে বিকেলের আলো ম্লান হচ্ছিল, জানালা দিয়ে ভেসে আসা বাতাসে পাতার শব্দ বাজছিল, আর সেই নীরবতার মধ্যে যেন দুজনের বুকের ভেতরের ধুকপুকানি আরও স্পষ্ট হচ্ছিল।
একসময় বইয়ের পাতা উল্টাতে গিয়ে শ্রেয়ার আঙুল হঠাৎ আরিয়ানের হাতে ছুঁয়ে গেল। বিদ্যুতের মতো একটা শিহরণ বয়ে গেল শরীরজুড়ে। দুজনেই হাত সরিয়ে নিতে পারত, কিন্তু কেউ সরাল না। বরং হাতের মুঠোটা ধীরে ধীরে আরও দৃঢ় হয়ে উঠল। তারা কোনো কথা বলছিল না, কিন্তু সেই স্পর্শেই যেন হাজারো অপ্রকাশিত বাক্য ভেসে উঠছিল। শ্রেয়া অনুভব করছিল, তার গাল গরম হয়ে উঠছে, বুকের ভেতর অচেনা কাঁপুনি দৌড়াচ্ছে, আর তবু হাত সরানোর কোনো ইচ্ছে হচ্ছে না।
সময় যেন থমকে গেল। চারপাশে বই, নিস্তব্ধ লাইব্রেরি, আর জানালার ফাঁক দিয়ে ঢুকে আসা অচেনা আলো—সব মিলিয়ে মুহূর্তটা অসাধারণ হয়ে উঠল। দুজনের চোখ আবার মিলল, আর সেই চোখে ছিল এক নিঃশব্দ স্বীকৃতি। যেন দুজনেই একে অপরকে বলছে—“আমরা কিছু শুরু করেছি, যা আর থামানো যাবে না।” হাত ধরে থাকা সেই নীরব স্পর্শই হয়ে উঠল তাদের সম্পর্কের আসল সূচনা, যেখানে কথার প্রয়োজন নেই, কেবল অনুভূতিই যথেষ্ট।
অধ্যায় ৫: নতুন অভ্যাস
দিনগুলো একে একে গড়াতে লাগল, আর শ্রেয়া ও আরিয়ানের দেখা-সাক্ষাৎ ধীরে ধীরে নিত্যদিনের অভ্যাসে পরিণত হল। কলেজে প্রবেশ করার মুহূর্তেই তাদের চোখ একে অপরকে খুঁজে নিত, আর ছুটি হতেই তারা নির্দ্বিধায় একসঙ্গে হাঁটার জন্য বেরিয়ে পড়ত। প্রথমদিকে হয়তো দু’জনেই অস্বস্তি বোধ করত, কিন্তু এখন সেই অস্বস্তির জায়গা দখল করেছে এক অদৃশ্য স্বাচ্ছন্দ্য। শ্রেয়া অবাক হয়ে খেয়াল করছিল, আগে যেসব পথে সে একা হাঁটত, সেসব পথ যেন এখন শুধু আরিয়ানের উপস্থিতির জন্যই নতুন রঙে ভরে উঠেছে। প্রতিদিনের সেই ছোট্ট হাঁটা, অল্প কথাবার্তা, আর মাঝেমধ্যে নীরবতা—সবকিছুই এক বিশেষ অর্থ পেতে শুরু করল।
একদিন চায়ের দোকানে বসে দু’জনেই নীরবে চুমুক দিচ্ছিল। দোকানের কোণে একটা পুরোনো রেডিও বাজছিল, তাতে ভেসে আসছিল পুরোনো দিনের প্রেমের গান। শ্রেয়া চোখ তুলে তাকাতেই দেখল, আরিয়ান সরাসরি তার দিকে তাকিয়ে আছে। মুহূর্তের জন্য সে দৃষ্টি সরিয়ে নিতে চাইলেও পারল না। হঠাৎ মনে হল, এতদিন ধরে যার চোখে কেবল সহপাঠী দেখেছে, আজ সেখানে অন্য এক আলো জ্বলছে। চায়ের কাপের ধোঁয়া ভেসে আসছিল, দোকানের ভেতরের ভিড় বাড়ছিল, কিন্তু তাদের দুজনের চারপাশ যেন আলাদা এক বৃত্তে আবদ্ধ হয়ে গেল।
পরে শ্রেয়া বুঝতে পারল, এই একসাথে থাকা শুধু সামান্য আলাপচারিতা নয়, বরং একধরনের নীরব প্রতিশ্রুতি। ক্লাসে কোনো সমস্যা হলে সে অনায়াসে আরিয়ানের কাছে যায়, আর আরিয়ানও কোনো দ্বিধা ছাড়াই তার পাশে দাঁড়ায়। অনেক সময় তো একে অপরকে না ডাকলেও একসঙ্গে হয়ে যাওয়া যেন স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়াল। শ্রেয়া অনুভব করতে লাগল, সে দিন দিন আরিয়ানের উপস্থিতির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। আগে কলেজে যাওয়া ছিল শুধু পড়াশোনার জন্য, কিন্তু এখন সেখানে লুকিয়ে আছে এক নতুন আকর্ষণ, এক অদ্ভুত টান।
তাদের সম্পর্কটা বন্ধুত্ব থেকে অন্য এক দিকে মোড় নিচ্ছে—এটা দু’জনেই জানত, কিন্তু কেউ সরাসরি স্বীকার করতে চাইছিল না। তবে সেই অভ্যাসই তাদের ধীরে ধীরে আরও ঘনিষ্ঠ করে তুলছিল। আরিয়ানের হাসি এখন শ্রেয়ার দিনের সবচেয়ে প্রিয় মুহূর্ত, আর শ্রেয়ার নির্দোষ প্রশ্নগুলো আরিয়ানের জীবনের নতুন রঙ হয়ে উঠছিল। এই ছোট্ট ছোট্ট অভ্যাস, একসাথে পথ চলা, আর মনের গভীরের নীরবতা—সব মিলিয়ে তারা এক অদৃশ্য সেতু বুনে ফেলছিল, যার গন্তব্য তখনও অজানা হলেও অস্বীকার করার উপায় ছিল না।
অধ্যায় ৬: দ্বিধা আর স্বীকারোক্তি
সেপ্টেম্বারের এক বিকেলে আকাশ হঠাৎ কালো মেঘে ঢেকে গেল। ক্লাস সেদিন একটু আগেই শেষ হয়েছিল, তাই শ্রেয়া আর আরিয়ান বেরোতে গিয়ে দেখে চারদিকে হঠাৎ করে ঝড়ো হাওয়া বইছে। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই বৃষ্টি শুরু হল, ভারি ফোঁটায় রাস্তা ভিজে একাকার। শ্রেয়ার হাতে ছাতা ছিল না, আরিয়ানেরও ছিল না সেদিন। তারা দুজনেই কলেজের গেটের ছাউনি তলায় দাঁড়িয়ে রইল। চারপাশে ভিড় জমে উঠছিল, কিন্তু সেই ভিড়ের মধ্যেও দুজনকে আলাদা একটা একান্ততা ঘিরে ধরেছিল। শ্রেয়া জানত না, কীভাবে এই নীরবতাকে ভাঙবে, আর আরিয়ানও যেন অনেক কথা বুকের ভেতর জমিয়ে রেখেছে।
হঠাৎই শ্রেয়ার চোখে পড়ল, কয়েকজন সহপাঠী দূর থেকে তাদের দিকে তাকিয়ে হাসাহাসি করছে। লজ্জায় তার গাল লাল হয়ে উঠল। আরিয়ান তা লক্ষ্য করে একটু কাছে সরে এল, যেন তাকে আড়াল করে রাখছে। বৃষ্টির গন্ধে ভেসে আসা সেই মুহূর্তে শ্রেয়া নিজেকে নিরাপদ বোধ করল, তবে মনে হচ্ছিল, কিছু একটা অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে। হয়তো কথার আড়ালে যে অনুভূতি লুকিয়ে আছে, সেটা আজ প্রকাশ না করলে আর কখনো বলা হবে না।
অবশেষে সাহস সঞ্চয় করে আরিয়ান শ্রেয়ার দিকে তাকাল। চোখে ছিল একরকম তীব্র আকুলতা। সে ধীরে ধীরে বলল—“শ্রেয়া, অনেকদিন ধরে একটা কথা বলতে চাইছি… কিন্তু পারছিলাম না। জানি না, তুমি কী ভাবো… কিন্তু সত্যিটা না বললে আমার পক্ষে আর সম্ভব হচ্ছে না।” শ্রেয়া নিঃশব্দে তার দিকে তাকিয়ে থাকল, বুকের ভেতর কেঁপে উঠল অচেনা উত্তেজনায়। বৃষ্টির শব্দ যেন আরও জোরে কানে বাজছিল। আরিয়ান গলা পরিষ্কার করে নিচু স্বরে বলল—“আমি তোমাকে ছাড়া নিজের জীবন কল্পনা করতে পারি না।” কথাটা বের হতেই দুজনের চোখ একে অপরের সঙ্গে আটকে গেল।
শ্রেয়া হকচকিয়ে গেলেও চোখ সরিয়ে নিল না। তার ঠোঁটে হালকা হাসি ফুটে উঠল, আর চোখে যেন জমে থাকা আবেগ ঝিলিক দিল। সে ধীরে ধীরে বলল—“তুমি দেরি করেছ বলতে… আমি অনেক আগেই বুঝেছিলাম।” সেই মুহূর্তে বৃষ্টি যেন আরও প্রবল হয়ে উঠল, অথচ তাদের ভেতরে এক অদ্ভুত প্রশান্তি ছড়িয়ে পড়ল। নীরবতার বাঁধ ভেঙে দুজনেই স্বীকার করে নিল নিজেদের মনের কথা। সেদিন কলেজ গেটের ভিড়, ঝড়-বৃষ্টি, হাসাহাসি—সবকিছু মিলিয়ে গেল এক কোণে, শুধু রয়ে গেল দুজনের প্রথম স্বীকারোক্তি, যা তাদের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিল।
অধ্যায় ৭: প্রথম আলিঙ্গন
ভালোবাসার স্বীকারোক্তির পর দিনগুলো যেন অন্যরকম আলোয় ভরে উঠল। শ্রেয়া আর আরিয়ানের চোখে এখন আর লাজুক দৃষ্টি নেই, বরং আছে একধরনের নিশ্চিন্ত স্বস্তি। তারা এখন খোলাখুলি কথা বলে, হাসে, খুনসুটি করে, তবু সেই নীরবতা হারিয়ে যায়নি—বরং আরও গভীর হয়েছে। কলেজের ভিড়ের মধ্যে থেকেও তারা আলাদা এক জগৎ তৈরি করে নেয়, যেখানে শুধু দুজনেই আছে। শ্রেয়া মাঝে মাঝে অবাক হয়ে ভাবে, এতদিন যে অনুভূতিকে নাম দিতে পারেনি, সেটাই আসলে ভালোবাসা। আরিয়ানও অনুভব করে, জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে শ্রেয়ার উপস্থিতিই যেন তাকে সম্পূর্ণ করে তুলছে।
একদিন বিকেলে কলেজের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পর ক্যাম্পাস প্রায় ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল। আকাশে রঙিন আলো ছড়িয়ে পড়ছিল, গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে হালকা বাতাস বইছিল। শ্রেয়া আর আরিয়ান হাঁটছিল নির্জন এক করিডোর ধরে। কথার ভেতর খুনসুটি ছিল, কিন্তু মন দুজনেরই যেন অন্য কোথাও আটকে ছিল। হঠাৎ শ্রেয়া হেসে বলল—“আজ তুমি গানটা খুব ভালো গেয়েছ।” আরিয়ান মুচকি হেসে জবাব দিল—“তুমি না থাকলে এতটা ভালো লাগত না।” কথাটা শুনে শ্রেয়ার চোখে একরকম লজ্জার ঝিলিক ফুটে উঠল, আর সে চোখ নামিয়ে নিল।
ঠিক তখনই হঠাৎ বাতাসে শ্রেয়ার ওড়না উড়ে গিয়ে আরিয়ানের গায়ে লেগে গেল। দুজনেই একসঙ্গে সেটা ধরতে গিয়ে অদ্ভুতভাবে কাছাকাছি চলে এল। তাদের চোখ আবার মিলল, আর সেই চোখে ছিল শুধু নীরব আবেগ। কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই, কোনো শব্দ ছাড়াই, আরিয়ান ধীরে ধীরে শ্রেয়াকে আলিঙ্গন করল। মুহূর্তটা যেন সময়কে থামিয়ে দিল। শ্রেয়া প্রথমে অবাক হলেও পরক্ষণেই নিজের মাথাটা আরিয়ানের কাঁধে রেখে দিল। হৃদস্পন্দন দুজনের মিলেমিশে এক হয়ে গেল, আর চারপাশে শুধুই নীরব বাতাস বয়ে যেতে লাগল।
সেই প্রথম আলিঙ্গন তাদের সম্পর্ককে এক নতুন মাত্রা দিল। ভালোবাসা আর দ্বিধার মাঝের দূরত্ব যেন মিলিয়ে গেল এক নিঃশব্দ স্পর্শে। শ্রেয়া অনুভব করল, এটাই তার নিরাপদ আশ্রয়, যেখানে সে নির্ভয়ে সবকিছু বলতে পারে। আরিয়ান বুঝল, এই মানুষটাকেই সে জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে চায়। সেদিনের সেই করিডোর, সোনালি আলো আর প্রথম আলিঙ্গনের উষ্ণতা চিরদিনের জন্য তাদের মনে গেঁথে রইল, যেন অদৃশ্য এক প্রতিজ্ঞা—এ সম্পর্ক আর ভাঙার নয়।
অধ্যায় ৮: সম্পর্কের পরীক্ষা
ভালোবাসা যত গভীর হচ্ছিল, ততই চারপাশের চোখে পড়তে শুরু করল শ্রেয়া আর আরিয়ানের সম্পর্ক। কলেজের করিডোরে একসঙ্গে হাঁটলে সহপাঠীদের কানে ফিসফিসানি শোনা যেত, লাইব্রেরিতে পাশাপাশি বসলে কেউ কেউ আড়চোখে তাকাত। প্রথমদিকে তারা এসবকে গুরুত্ব দেয়নি, বরং মুচকি হেসে উড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু ধীরে ধীরে গুজবগুলো রঙ পেতে শুরু করল—কে কোথায় কাকে দেখল, কোন কথা কে শুনল—সবকিছুই অতিরঞ্জিত হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে গেল। শ্রেয়া বুঝতে পারল, শুধু ভালোবাসা থাকলেই সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা যায় না, বাইরের দৃষ্টি আর সমাজের বিচারকেও মোকাবিলা করতে হয়।
বাড়িতেও চাপ তৈরি হল। শ্রেয়ার মা কয়েকবার ইঙ্গিত দিয়ে বললেন—“কলেজে পড়াশোনার দিকে মন দাও, অন্য কিছু নিয়ে যেন ঝামেলায় না জড়াও।” যদিও সরাসরি কিছু বলেননি, তবু শ্রেয়া বুঝতে পারল, বাড়িতেও তার ঘনিষ্ঠতা নজরে এসেছে। অন্যদিকে আরিয়ানও ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের কাছ থেকে শুনতে পেল নানা প্রশ্ন—“তোমরা কি সিরিয়াস?” বা “এভাবে চলতে থাকলে পড়াশোনা নষ্ট হবে না?” এসব কথা তাদের মনে অস্থিরতা তৈরি করল। শ্রেয়া মাঝে মাঝে ভাবতে লাগল, এই সম্পর্ক কি সত্যিই টিকবে, নাকি সমাজের চাপ একদিন সবকিছু ভেঙে দেবে।
একদিন শ্রেয়া কলেজ থেকে বেরোনোর সময় হঠাৎ আরিয়ানকে এড়িয়ে সোজা চলে গেল। আরিয়ান অবাক হয়ে তার পিছু নিল, কিন্তু শ্রেয়া তখন চুপচাপ, মুখে কোনো কথা নেই। পরে যখন দুজন নির্জনে দাঁড়াল, শ্রেয়া ফিসফিস করে বলল—“আমরা কি ঠিক করছি, আরিয়ান? সবাই আমাদের নিয়ে কথা বলছে, মা-ও চিন্তিত… আমি ভয় পাচ্ছি।” আরিয়ান ধীরে ধীরে তার হাত ধরে বলল—“শ্রেয়া, ভালোবাসা কখনো ভুল হতে পারে না। আমরা যদি সত্যিই একে অপরকে চাই, তবে সবকিছুর মোকাবিলা করব একসাথে।” তার কণ্ঠে দৃঢ়তা থাকলেও চোখে ছিল মমতা, যা শ্রেয়ার ভয় কিছুটা হলেও প্রশমিত করল।
তবুও সেই দিনগুলো সহজ ছিল না। বন্ধুরা ঠাট্টা করত, পরিবার প্রশ্ন তুলত, আর চারপাশের কৌতূহলী চোখ যেন তাদের প্রতিটি পদক্ষেপ অনুসরণ করত। কিন্তু এইসব বাধার মাঝেও দুজনের ভেতরের বিশ্বাস আরও শক্ত হয়ে উঠল। তারা বুঝতে পারল, সম্পর্ক কেবল মধুর মুহূর্তের ওপর দাঁড়ায় না—বরং পরীক্ষার সময় হাত না ছাড়া, আস্থা না ভাঙা-ই আসল ভালোবাসার প্রমাণ। আরিয়ান আর শ্রেয়া সেই পরীক্ষার প্রথম ধাপেই শিখে নিল, একে অপরকে আঁকড়ে ধরা ছাড়া সামনে এগোনোর আর কোনো পথ নেই।
অধ্যায় ৯: একান্ত সময়
সপ্তাহজুড়ে টানা চাপ, গুজব আর দৃষ্টির বোঝা বহন করার পর একদিন তারা ঠিক করল, একটু নিরিবিলি সময় কাটানো দরকার। শহরের কোলাহল থেকে দূরে, কলেজের কাছেই একটা ছোট্ট লেকের ধারে বসার জায়গা আছে—সবুজ গাছপালা ঘেরা, বিকেলে খুব একটা লোকজনও আসে না। সেদিন বিকেলে শ্রেয়া আর আরিয়ান সেখানে গেল। চারপাশে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক, বাতাসে ভিজে পাতার গন্ধ, আর দূরে জলে সূর্যাস্তের প্রতিফলন—সব মিলিয়ে এক নিস্তব্ধতা নেমে এসেছিল, যেন পৃথিবীটাই দুজনের জন্য থেমে আছে।
তারা দুজনেই প্রথমে চুপচাপ বসে রইল। এতদিনের অস্থিরতা, ভয়, দ্বিধা—সব যেন বুকের ভেতরে জমে ছিল। অবশেষে শ্রেয়া ধীরে ধীরে বলল—“আমরা সত্যিই পারব তো, আরিয়ান? এত বাধা, এত প্রশ্ন…” তার কণ্ঠ কেঁপে উঠছিল। আরিয়ান তার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে উত্তর দিল—“ভালোবাসা কখনো সহজ হয় না, শ্রেয়া। কিন্তু আমি জানি, আমরা একসাথে থাকলে কোনো বাধাই বড় নয়।” তার গলায় এমন এক দৃঢ়তা ছিল, যা শ্রেয়ার চোখে জল এনে দিল। সে মুখ নামিয়ে নিল, কিন্তু তার হাত আলতো করে আরিয়ানের হাতে গিয়ে ঠেকল।
তারপর অনেকক্ষণ তারা নানা কথা বলল—ভবিষ্যতের পরিকল্পনা, স্বপ্ন, পেশা, পরিবারের প্রতি দায়িত্ব। একসময় কথার ভেতর নেমে এল গভীর নীরবতা। শ্রেয়া হালকা করে মাথা রেখে দিল আরিয়ানের কাঁধে, আরিয়ানও নিঃশব্দে তাকে আরও কাছে টেনে নিল। তাদের বুকের ভেতরের ধুকপুকানি যেন একে অপরের সঙ্গে মিশে যাচ্ছিল। সেই মুহূর্তে বাইরের দুনিয়ার সব ভয়, সব গুজব, সব সন্দেহ যেন অচেনা হয়ে গেল। কেবল ছিল তাদের নিঃশব্দ আস্থা—“আমরা আছি একে অপরের জন্য।”
সন্ধ্যার অন্ধকার নামতে শুরু করল, লেকের জলে আলোর ঝিলিক মিলিয়ে গেল, আর চারপাশের বাতাস আরও শীতল হয়ে উঠল। তবুও তারা নড়ল না, যেন সেই একান্ত মুহূর্তকে চিরদিনের জন্য আটকে রাখতে চাইছে। শ্রেয়া মনে মনে বলল, জীবনে যত ঝড়ই আসুক, এমন এক আশ্রয় পেলে সে কখনো ভয় পাবে না। আরিয়ানও অনুভব করল, এটাই তার সবচেয়ে বড় প্রতিশ্রুতি—শ্রেয়াকে নিরাপদ রাখা, তার স্বপ্নের পাশে থাকা। সেদিনের লেকপাড়ের নির্জনতা তাদের ভালোবাসাকে আরও গভীর করল, আর সম্পর্কটা যেন নতুন করে জন্ম নিল, এক অটুট বন্ধনের শপথ নিয়ে।
অধ্যায় ১০: ভালোবাসার প্রতিশ্রুতি
শীতের শুরুতে কলেজের আঙিনা ভরে উঠেছিল নানান অনুষ্ঠানে। চারদিকে ব্যস্ততা, হৈচৈ, হাসাহাসি—সবকিছুর মাঝেই শ্রেয়া আর আরিয়ান যেন নিজেদের ছোট্ট এক জগৎ তৈরি করে নিয়েছিল। এতকিছুর পরও তাদের সম্পর্ক টিকে গেছে, এই ভেবে দুজনের মনেই এক ধরনের স্বস্তি তৈরি হচ্ছিল। শ্রেয়া বুঝতে পারছিল, প্রথম আলিঙ্গন থেকে শুরু করে লেকপাড়ের নির্জন বিকেল পর্যন্ত প্রতিটি মুহূর্ত তাদের ভালোবাসাকে আরও শক্ত করে তুলেছে। আরিয়ানের চোখে যখনই তাকায়, সে স্পষ্ট দেখতে পায় একরকম দৃঢ়তা—যে যাই বলুক, এই সম্পর্ক আর ভাঙবে না।
একদিন অনুষ্ঠান শেষে কলেজ প্রায় ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল। ঠান্ডা হাওয়ায় চারপাশে সোঁদা গন্ধ ভেসে আসছিল। শ্রেয়া আর আরিয়ান হাঁটছিল মাঠের ভেতর দিয়ে, মৃদু আলোয় ভিজে ওঠা ঘাসে পা ফেলে। কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর শ্রেয়া হঠাৎ বলল—“জানি না ভবিষ্যতে কী হবে, কিন্তু একটা ভয় মাঝে মাঝে মনে হয়, আমরা যদি হারিয়ে যাই?” তার কণ্ঠে ছিল অস্থিরতা। আরিয়ান থেমে দাঁড়াল, তার চোখের দিকে সোজা তাকিয়ে ধীরে ধীরে বলল—“হারিয়ে যেতে হলে একসাথে হারাব। আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, যত বাধাই আসুক, আমি তোমার হাত কখনো ছাড়ব না।” কথাগুলো এতটাই দৃঢ় আর গভীর ছিল যে শ্রেয়ার চোখে জল এসে গেল, আর সে আলতো করে মাথা নাড়ল।
তাদের মধ্যে আর কোনো কথার প্রয়োজন ছিল না। শ্রেয়া নিঃশব্দে আরিয়ানের হাত শক্ত করে ধরে রাখল, যেন এই স্পর্শই তার সবচেয়ে বড় ভরসা। বাতাসে শীত বাড়ছিল, চারপাশে নির্জনতা নেমে এসেছিল, তবুও তারা সেখানে দাঁড়িয়ে রইল অনেকক্ষণ। তাদের ভেতরের ভালোবাসা আর বিশ্বাস যেন বাইরের ঠান্ডাকেও গলিয়ে উষ্ণ করে তুলছিল। সেদিন তারা দুজনেই বুঝল, ভালোবাসা শুধু সুন্দর মুহূর্তে নয়, বরং প্রতিজ্ঞার ভেতরে টিকে থাকে—অদৃশ্য শপথ, যা একে অপরকে আঁকড়ে ধরার শক্তি জোগায়।
ধীরে ধীরে রাত নামতে শুরু করল। আকাশে তারাগুলো ফুটে উঠল, আর মাটিতে ছায়া পড়তে লাগল। শ্রেয়া আর আরিয়ান একসাথে হাঁটতে হাঁটতে কলেজের গেট পেরিয়ে বাইরে এল। তাদের চোখে ছিল স্বপ্নের আলো, আর মনে ছিল এক অদ্ভুত শান্তি। জীবনের অনিশ্চয়তা, সমাজের প্রশ্ন, ভবিষ্যতের অজানা পথ—সবকিছুই যেন তুচ্ছ হয়ে গেল সেই প্রতিশ্রুতির কাছে। তারা জানত, এ পথ সহজ হবে না, তবুও হাত ধরাধরি করেই এগোবে। সেদিন রাতে তারা নীরবে প্রতিজ্ঞা করল—ভালোবাসা আর বিশ্বাসই তাদের একমাত্র শক্তি, আর সেটাই তাদের পথচলার আসল পরিচয় হয়ে থাকবে।




