Bangla - সামাজিক গল্প

শহরের ছাদবাগান

Spread the love

সোমা বিশ্বাস


কলকাতার ভোর আজ আর আগের মতো নয়। যে শহর একদিন মিষ্টি বাতাস, গাছগাছালি আর পদ্মফুলে ভরা পুকুরের জন্য খ্যাত ছিল, সেখানেই এখন কেবল ধোঁয়া আর ধুলোয় ভরে আছে চারপাশ। বহুতলের ছাদ থেকে তাকালে দেখা যায়—নানা রঙের গাড়ি আর বাসের ভিড়, তাদের পেছন থেকে উঠে আসা কালো ধোঁয়া একে অপরের সঙ্গে মিশে শহরকে ঢেকে দিচ্ছে ধূসর কুয়াশায়। একসময় মানুষ ভোরবেলা গঙ্গার ধারে হাঁটতে যেত, পার্কে শিশুরা খেলা করত, তরুণেরা দৌড় দিত—কিন্তু আজ সেই দৃশ্য যেন বিরল। পার্কগুলোর জায়গায় বহুতল উঠেছে, খোলা মাঠগুলোতে দোকানপাট গজিয়েছে, আর যে ক’টি গাছ বেঁচে আছে তারা যেন কেবল নিঃশ্বাস নিতে লড়াই করছে। দূষণের এই আচ্ছাদনে শহরবাসীর জীবনযাপন দিন দিন অসহনীয় হয়ে উঠছে। স্কুলগামী বাচ্চারা প্রতিদিন সকালে খোলসের মতো মাস্ক পরে বেরোয়, অথচ তাদের চোখে ভয়ের ছায়া স্পষ্ট—তারা বুঝে গেছে তাদের পৃথিবী আর আগের মতো নেই। অটোরিকশার হর্ণ, বাসের চেঁচামেচি, ট্রাফিক সিগন্যালে অবিরাম কোলাহল—সবকিছু মিলে যেন শহরটা এক অনবরত চিৎকারের ভেতর বেঁচে আছে, আর সেই চিৎকার শ্বাসের পথ রুদ্ধ করে দিচ্ছে।

এইসব পরিবর্তনের ভেতরেই থাকে অনন্যা। বয়স ত্রিশের কোঠায়, একটি বহুজাতিক সংস্থায় চাকরি করেন, কিন্তু ব্যস্ত জীবনের ভেতরেও প্রকৃতির প্রতি তার টান অটুট। ছোটবেলায় গ্রামে থাকাকালে সে মায়ের সঙ্গে বাগানে ঘুরে বেড়াত—শিউলি ফুল কুড়িয়ে আনা, লতাগুল্মে জল দেওয়া, কিংবা পুকুরপাড়ে বসে শাপলা দেখার আনন্দ তার জীবনের অমূল্য স্মৃতি। কিন্তু শহরে আসার পর সেই সবুজ আর খুঁজে পায়নি। প্রতিদিন সকালে যখন বারান্দায় দাঁড়িয়ে সে কফির কাপে চুমুক দেয়, তখন সামনে দেখা যায় কেবল কংক্রিটের অজস্র দালান আর ধোঁয়ার আস্তরণ। গাছপালার বদলে ছাদের টিন আর অ্যান্টেনা, খোলা আকাশের বদলে ধুলোমাখা কুয়াশা। অনেক সময় বাচ্চাদের কাশি শুনে তার বুক হাহাকার করে ওঠে—এই তো বয়স নয়, অথচ দূষণে তাদের শ্বাসকষ্ট হয়, রাতের ঘুম ভেঙে যায়। অনন্যা বুঝতে পারে, মানুষের এই নির্লিপ্ত জীবনযাপন প্রকৃতিকে ক্রমেই দূরে ঠেলে দিয়েছে। সবাই ভোগে ব্যস্ত, কিন্তু টের পাচ্ছে না তাদের শ্বাসের সঙ্গে ধীরে ধীরে বিষ ঢুকছে।

ঠিক এই হতাশাজনক প্রেক্ষাপটেই একদিন তার মনে জন্ম নেয় এক নতুন চিন্তা। অফিস থেকে ফেরার পথে হঠাৎ সে বহুতলের ছাদে উঠে যায়, যেখানে সাধারণত কেউ যায় না। সেখান থেকে চারপাশে তাকিয়ে সে বিস্মিত হয়—এত বিশাল ফাঁকা জায়গা, অথচ কেবল ধুলো জমে আছে, ভাঙা চেয়ার আর ফেলে দেওয়া জিনিসপত্রে ভরা। হঠাৎই তার মনে হলো—এই ফাঁকা জায়গাগুলোতেই তো আবার সবুজ জন্মাতে পারে! যদি এখানে গাছের টব রাখা যায়, ফুল ফোটানো যায়, সবজি ফলানো যায়, তবে অন্তত এই ছোট্ট পৃথিবীটুকু শুদ্ধ হাওয়ায় ভরে উঠবে। তার মনের ভেতর শৈশবের বাগানের স্মৃতি জেগে ওঠে, আর সেই স্মৃতির আলোয় সে নতুন স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। হয়তো একা তার পক্ষে পুরো শহরকে বদলানো সম্ভব নয়, কিন্তু নিজের ছাদ থেকেই তো একটা সূচনা করা যায়। অনন্যার মনে দৃঢ় বিশ্বাস জন্মায়—শহরকে যদি ফিরিয়ে আনা যায় সবুজে, তবে সেই পরিবর্তনের শুরুটা একেবারে ছোট জায়গা থেকেই হতে হবে। এভাবেই ধোঁয়ার শহরের বুক চিরে অনন্যার হৃদয়ে জন্ম নেয় এক অদম্য সংকল্প।

***

অনন্যার শৈশবের স্মৃতিগুলো সবুজের সঙ্গে গভীরভাবে মিশে আছে। গ্রামের বাড়ির উঠোনজুড়ে মায়ের লাগানো ফুল, ডালিমগাছ, আমগাছ কিংবা শাকসবজির ছোট ছোট বাগান তার কাছে ছিল এক অপার আনন্দের জায়গা। প্রতিদিন সকালে ঘুম ভাঙার পর মায়ের সঙ্গে গাছের পাতা ঝেড়ে দেওয়া, মাটির টবগুলোতে জল ঢালা আর রোদে দাঁড়িয়ে ফুল ফোটার অপেক্ষা করা তার জীবনের এক বিশেষ অধ্যায় হয়ে আছে। তখন সে জানত না গাছ কেন দরকার, কেন তাদের যত্ন নিতে হয়—শুধু জানত গাছ মানেই আনন্দ, গাছ মানেই ঘরের ছায়া, পাখির কিচিরমিচির, আর শ্বাস নেওয়ার মতো তাজা হাওয়া। সেই ছোটবেলার অভ্যাস তাকে প্রকৃতির সঙ্গে এমনভাবে বেঁধে ফেলেছিল যে শহরে এসে যখন কেবল কংক্রিট আর ধোঁয়ার ভিড় দেখল, তখন তার ভেতরে গভীর শূন্যতা জন্ম নিল। যতই সে কাজের চাপে ডুবে থাকুক না কেন, মনে হতো—কিছু একটা হারিয়ে গেছে। সেই হারানো জিনিসটা ছিল গাছের উপস্থিতি, মাটির গন্ধ আর সবুজের আলিঙ্গন।

একদিন সন্ধ্যায়, অফিস থেকে ফেরা ক্লান্ত শরীরে সে ছাদে গিয়ে দাঁড়ায়। নিচে রাস্তায় অসংখ্য গাড়ির ভিড়, অস্থির মানুষের কোলাহল, কিন্তু উপরে আকাশে একফালি চাঁদ তখন মেঘের আড়াল থেকে উঁকি দিচ্ছিল। ছাদের চারপাশে তাকিয়ে তার চোখে পড়ে ফাঁকা জায়গাগুলো—ভাঙা ইট, মরচে ধরা টিন, পুরনো চেয়ার আর ধুলোমাখা কোণ। তার মনে হয়, এ জায়গাটা নষ্ট হয়ে পড়ে আছে, অথচ এর ভেতরেই লুকিয়ে আছে এক বিশাল সম্ভাবনা। তার কল্পনায় হঠাৎই ফুটে ওঠে এক অদ্ভুত দৃশ্য—এই ছাদের জায়গাগুলোতে যদি টব সাজানো যায়, যদি গাছগুলো বড় হতে শুরু করে, তবে একদিন এখানেই তৈরি হবে এক নতুন সবুজ পৃথিবী। বাতাসে আসবে ফুলের গন্ধ, টবে লাল টমেটো ঝুলবে, তুলসীর পাতায় শিশির জমবে, আর পাখিরা ফিরে আসবে ডালপালায়। এক মুহূর্তের জন্য যেন সে গ্রামে ফিরে গেল, যেখানে সকালে শিউলি ফুল কুড়িয়ে হাতে জমা দিত। এই ছাদের ফাঁকা জায়গাগুলো তার কাছে হঠাৎই হয়ে উঠল এক অমূল্য সম্পদ—যা সে নতুন করে গড়ে তুলতে পারে।

এই উপলব্ধি অনন্যার জীবনে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে। সে জানে, কাজটা সহজ নয়—ছাদের মালিকানার নিয়ম, প্রতিবেশীদের আপত্তি, আর্থিক সীমাবদ্ধতা—সবই তাকে থামিয়ে দিতে পারে। তবুও তার মনে অদ্ভুত এক দৃঢ়তা জন্ম নেয়। শহরের দূষণ, ধোঁয়া আর ক্লান্তির ভিড়ে সে নিজের স্বপ্নটাকে আঁকড়ে ধরে। সে ভাবে—“একটা গাছই যদি শ্বাসের পথ খুলে দিতে পারে, তবে এক ছাদ ভরা গাছ কত মানুষের জীবন বদলাতে পারে!” তার চোখে ভেসে ওঠে ছোট ছোট বাচ্চারা ছাদে দৌড়ে বেড়াচ্ছে, ফুল ছিঁড়ে হাসছে, বৃদ্ধরা বসে গভীর নিশ্বাস নিচ্ছে। এটা কেবল তার ব্যক্তিগত চাহিদা নয়, বরং সমাজের জন্য এক বড় উপহার হতে পারে। সেই মুহূর্তে অনন্যা প্রতিজ্ঞা করে—যেভাবেই হোক, সে এই ছাদগুলোকে সবুজ করে তুলবেই। তার ভেতর জন্ম নেয় এক নতুন আলো, এক নতুন বিশ্বাস—যা শহরের অন্ধকারে ছড়িয়ে দিতে পারে আশার রং। এভাবেই অনন্যার মনে জন্ম নেয় তার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর স্বপ্ন—এক সবুজের স্বপ্ন, যা কেবল তার জন্য নয়, পুরো শহরের জন্য এক আশীর্বাদ হয়ে উঠতে পারে।

***

শহরের ধূসরতার মধ্যে সবুজ ফিরিয়ে আনার স্বপ্ন অনন্যাকে ভেতর থেকে তাড়িত করছিল। সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার প্রথম পদক্ষেপ নিতে গিয়ে সে দ্বিধায় পড়েছিল, কিন্তু দ্বিধা কাটিয়ে একদিন ঠিক করল—ছোট করে হলেও তাকে শুরু করতে হবে। তাই ছুটির দিনে সকালে সে বাজার থেকে কয়েকটা টব, কিছু বীজ আর নতুন মাটি কিনে আনল। টবগুলো ছাদের এক কোণে সাজিয়ে রাখল—একটিতে ধনেপাতা, একটিতে টমেটো, আরেকটিতে তুলসী আর গোলাপের চারাগাছ। প্রথম দিন যখন সে মাটি ভরল, আঙুলে কাদামাটির গন্ধ মিশল, তখনই যেন মনে হলো শৈশবের উঠোন আবার ছুঁয়ে গেল তাকে। টবে জল ঢেলে সূর্যের আলোয় দাঁড় করিয়ে রাখা গাছগুলো দেখে তার মনে জন্ম নিল এক অদ্ভুত তৃপ্তি—যেন এতদিনের খুঁজে বেড়ানো আশ্রয় সে পেয়ে গেল এই ছোট্ট চারাগুলোর ভেতর। আশপাশের লোকজন ছাদে এসে কৌতূহলভরে তাকালেও সে কোনো তোয়াক্কা করল না, কারণ সে জানত—প্রত্যেক বড় যাত্রার শুরুটা হয় ছোট পদক্ষেপ দিয়েই।

প্রতিদিন সকালে অফিস যাওয়ার আগে অনন্যা ছাদে উঠে গাছগুলো দেখতে যেত। কখনও টবে জমে থাকা অতিরিক্ত জল ফেলে দিত, কখনও মাটির ওপরে শুকনো পাতা সরিয়ে দিত। দুপুরের রোদে কিংবা সন্ধ্যার অন্ধকারে গাছগুলো কীভাবে দাঁড়িয়ে থাকে, সেই দৃশ্য তার কাছে এক আশ্চর্য আবিষ্কার হয়ে উঠল। ধনেপাতার টব থেকে প্রথম যখন ছোট সবুজ কচি পাতা বেরোল, অনন্যা যেন নিজের সন্তানের প্রথম হাঁটাচলা দেখছে—এমনই আনন্দে ভরে উঠল তার মন। টমেটোর চারা গজাতে দেরি হলেও সে ধৈর্য ধরে প্রতিদিন যত্ন নিতে থাকল। তুলসীর গাছে যখন প্রথম ছোট ছোট কুঁড়ি দেখা দিল, তখন সে বুঝল প্রকৃতি মানুষের সঙ্গে এক ধরনের নীরব আলাপ চালিয়ে যায়—যেখানে যত্ন, ধৈর্য আর ভালোবাসার বিনিময়ে গাছ তাকে ফিরিয়ে দেয় শান্তি আর আনন্দ। আর গোলাপের প্রথম কলি যখন ফোটার জন্য প্রস্তুত হলো, তখন অনন্যার চোখে জল এসে গেল। মনে হলো, তার স্বপ্নের প্রথম আলো ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে।

এই ছোট্ট বাগান অনন্যার জীবনে এক বিরাট পরিবর্তন এনে দিল। অফিসের ক্লান্তি, শহরের কোলাহল আর একঘেয়েমির ভেতর এই গাছগুলিই তার আশ্রয় হয়ে উঠল। ছাদে দাঁড়িয়ে সে অনুভব করত, ধোঁয়ায় ভরা এই শহরের মাঝেও সবুজ জন্ম নিতে পারে, যদি কেউ সত্যিই চায়। প্রতিটি গাছে সে নিজের ভালোবাসা ঢেলে দিল, আর বিনিময়ে পেল প্রশান্তির হাসি। প্রতিবেশীরা প্রথমে অবাক হয়ে দেখলেও, ধীরে ধীরে তাদের চোখেও পড়ল—অনন্যার চোখে কীভাবে এই ছোট্ট সবুজ পৃথিবী শান্তির রং আঁকছে। তাদের অনেকেই বলত—“তুমি তো বাগান করে সময় নষ্ট করছো।” কিন্তু অনন্যা জানত, সময় নষ্ট নয়, বরং এ এক বিনিয়োগ—যা একদিন তার নিজের জীবনকে বদলাবে। গাছগুলো বেড়ে উঠতে থাকল, আর অনন্যার মন ভরে উঠতে থাকল আশা আর বিশ্বাসে। সে বুঝল, প্রকৃতি সত্যিই মানুষের মনকে ছুঁয়ে দিতে পারে—শুধু কাছে টেনে নেওয়ার সাহস থাকতে হয়। এই ছোট্ট প্রথম পদক্ষেপই তার জীবনের সবচেয়ে বড় সাফল্যের ভিত্তি হয়ে উঠল।

***

যে স্বপ্নকে বুকে নিয়ে অনন্যা এতদিন পরিশ্রম করে চলেছে, তার পথ মোটেই সহজ ছিল না। ছাদের কোণে সাজানো টবগুলো যেমন তাকে আনন্দ দিত, তেমনই অন্যদের চোখে তা হয়ে উঠেছিল সন্দেহ আর বিরক্তির কারণ। প্রথমদিকে অনেকে কেবল কৌতূহল নিয়ে দেখত, কেউ হাসতো, কেউ অবজ্ঞার ভঙ্গিতে পাশ কাটিয়ে যেত। কিন্তু সময় যত গড়াল, টবের সংখ্যা যেমন বাড়ল, তেমনই প্রতিবেশীদের প্রশ্নও বাড়তে লাগল। একদিন লিফটে ওঠার সময় এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক বিরক্ত মুখে বলে উঠলেন—“মেয়ে, তুমি এসব গাছ লাগাচ্ছো, কিন্তু ছাদ যদি ভেঙে পড়ে তখন দায় নেবে কে?” অন্য এক মহিলা তাচ্ছিল্যের সুরে বললেন—“এখানে গাছ লাগালে তো মশা-মাছি বাড়বে, তারপর বাচ্চারা অসুস্থ হলে কে সামলাবে?” এমনকি কেউ কেউ সরাসরি বলত—“অযথা ঝামেলা করবে, আমাদের শান্তি নষ্ট করবে।” তাদের কাছে অনন্যার সবুজ স্বপ্নটা ছিল এক অপ্রয়োজনীয় কল্পবিলাস।

এই সবকথা শুনে প্রথমে অনন্যা ব্যথিত হয়েছিল। সে তো চেয়েছিল শহরের ধূসরতার মধ্যে একটু সবুজ ফিরিয়ে আনতে, একটু তাজা হাওয়া দিতে, অথচ মানুষ সেটাকেই অন্যভাবে নিচ্ছে। কখনও মনে হতো, সত্যিই কি সে ভুল করছে? গাছ লাগানোর ফলে কি সত্যিই ছাদের ক্ষতি হতে পারে? এক সন্ধ্যায় ছাদে দাঁড়িয়ে যখন সে গাছগুলোর দিকে তাকাল, তখন এক মুহূর্তের জন্য তার মন ভেঙে পড়ল। মনে হলো—এতো কষ্ট করে যা তৈরি করছে, তা হয়তো অন্যরা ধ্বংস করে দেবে। কিন্তু সেই মুহূর্তেই মায়ের মুখ ভেসে উঠল তার মনে। শৈশবে মা প্রায়ই বলতেন—“যদি কিছু সত্যিই ভালো হয়, তবে মানুষ একদিন তা বুঝবেই। ভালো কাজের পথে বাধা আসবেই, কিন্তু সেই বাধাই প্রমাণ করে তুমি সঠিক পথে চলেছো।” সেই কথাগুলো যেন তার কানে আবার বাজল। সে বুঝল, এই বিরোধিতা তার স্বপ্নকে ম্লান করতে দেওয়া যাবে না।

অতএব, অনন্যা দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করল—সে প্রতিবেশীদের বিরোধিতা সত্ত্বেও নিজের কাজ চালিয়ে যাবে। তাদের কটুক্তি শুনে সে আর তর্কে জড়াল না, বরং নীরবে গাছের যত্ন নিতে থাকল। প্রতিদিনের মতো জল দিল, মাটি বদলাল, চারাগুলোকে সযত্নে বড় হতে সাহায্য করল। তার চোখে ভেসে উঠল একদিনের ছবি—যেদিন এই একই মানুষরা এসে বলবে, “তুমি ঠিকই করেছো।” সে জানত, মানুষ অপরিচিত কিছু দেখলে ভয় পায়, বিরোধিতা করে, কিন্তু সময়ই সব প্রমাণ করবে। এই বিশ্বাস তাকে শক্তি জুগিয়ে গেল। অনন্যা নিজের মনে বলল—“আজ তারা আমাকে কল্পবিলাসী বলছে, কিন্তু কাল হয়তো এই গাছের ছায়ায় বসেই তারা বুঝবে প্রকৃতির আসল মূল্য।” সেই ভাবনায় সে আবার উৎসাহ ফিরে পেল, আর ধোঁয়ার শহরে তার সবুজের স্বপ্ন আরও গভীরভাবে শিকড় গাঁথতে শুরু করল।

***

সময় তার নিজের নিয়মে চলে, আর সেই সময়ের ভেতরেই অনন্যার যত্ন আর ভালোবাসায় তার ছোট্ট ছাদবাগান ধীরে ধীরে জীবন্ত হয়ে উঠল। যে টবগুলো একসময় নিছক মাটি ভরা পাত্র ছিল, সেগুলো এখন সবুজ পাতায় ভরে উঠেছে। ধনেপাতার গাছে সুগন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে, তুলসীর পাতায় সকালের শিশির জমছে, আর গোলাপ গাছের ডালে সাদা ফুল ফুটে চারপাশে মায়াময় সৌরভ ছড়িয়ে দিচ্ছে। সবচেয়ে বড় আনন্দের মুহূর্ত আসে যখন টমেটোর গাছে ছোট সবুজ ফল ধীরে ধীরে লাল হয়ে উঠতে শুরু করে। সেই দৃশ্য দেখে অনন্যার চোখে অশ্রু জমে ওঠে—এ ছিল তার প্রথম সাফল্যের প্রতীক, তার স্বপ্নের প্রথম বাস্তব রূপ। গাছের পাশে দাঁড়িয়ে সে হাত বুলিয়ে দেয় লাল টমেটোর গায়ে, যেন মায়ের মতো স্নেহে সন্তানকে আদর করছে। ছাদের কোণে বসে এই দৃশ্য দেখা ছিল তার কাছে শহরের সমস্ত কোলাহলের ঊর্ধ্বে এক শান্তির অভিজ্ঞতা।

একদিন বিকেলে পাশের ফ্ল্যাটের ছোট্ট ছেলে রুদ্র খেলতে খেলতে ছাদে উঠে আসে। হঠাৎ তার চোখে পড়ে টমেটোর গাছগুলো। গাছের ডালে ঝুলন্ত লাল টমেটো দেখে সে খুশিতে চিৎকার করে ওঠে—“ওই দেখো! টমেটো লাল হয়ে গেছে!” তার উচ্ছ্বাসে অনন্যার বুক ভরে যায় আনন্দে। রুদ্র হাত বাড়িয়ে একটা টমেটো ছুঁয়ে দেখে, যেন সে নতুন কোনো খেলনা আবিষ্কার করেছে। সেদিনই প্রথম প্রতিবেশীরা লক্ষ্য করল অনন্যার বাগান কেবল তার একার শখ নয়, বরং সবার জন্য আনন্দের উৎস হতে পারে। ধীরে ধীরে অন্যরাও আগ্রহী হতে শুরু করল। কেউ এসে জিজ্ঞেস করল—“তুমি কি বাজার থেকে চারা কিনেছো, না বীজ বপন করেছো?” কেউ আবার জানতে চাইলো—“এই মাটি কোথা থেকে এনেছো?” যারা একসময় বলত গাছ লাগালে ছাদ ভেঙে পড়বে, তারাই এসে বলল—“আরে, টমেটো তো বেশ বড় হয়েছে, এবার নিশ্চয়ই রান্নায় ব্যবহার করতে পারবে!” এই পরিবর্তন অনন্যার চোখ এড়াল না। সে বুঝল, প্রকৃতির সৌন্দর্য মানুষকে অস্বীকার করতে পারে না, শুধু সময় লাগে তাদের মনে সেই সৌন্দর্যের দরজা খুলে দেওয়ার জন্য।

অনন্যা প্রতিবেশীদের এই আগ্রহকে আরও বাড়িয়ে দিল নিজের মতো করে। সে কয়েকটি নতুন টব কিনে এনে ধনেপাতা, লঙ্কা আর তুলসীর চারা লাগাল এবং সেগুলো উপহার দিল আশপাশের ফ্ল্যাটে। যাঁরা একসময় বিরোধিতা করেছিলেন, তাঁদের হাতে গাছের টব তুলে দিয়ে অনন্যা শুধু একটি বাক্য বলল—“একটু যত্ন নিলেই দেখবেন প্রকৃতি কীভাবে আপনাকে ফিরিয়ে দেয়।” এই টবগুলো ঘরে ঘরে গিয়ে যেন নীরবে সবুজের বার্তা ছড়িয়ে দিল। কয়েকদিনের মধ্যেই দেখা গেল অনেকেই নিজস্ব বারান্দায় গাছ লাগাচ্ছেন। কেউ কেউ আবার ছাদে এসে অনন্যাকে বললেন—“আমাদেরকেও শেখাও কীভাবে টবে মাটি ভরতে হয়।” অনন্যার স্বপ্ন তখন কেবল তার একার ছিল না, ধীরে ধীরে সেটা সবার স্বপ্ন হয়ে উঠতে শুরু করল। যাঁরা তাকে একসময় কল্পবিলাসী বলেছিলেন, তারাই এখন আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইছেন—“কীভাবে গাছ লাগানো যায়?” এই দৃশ্য দেখে অনন্যার মনে হলো—প্রকৃতির প্রথম বিজয় এসে গেছে। তার যত্নের ছোট্ট ছাদবাগান শুধু ফুল আর টমেটোই দেয়নি, দিয়েছে মানুষের হৃদয়ে এক নতুন বিশ্বাস—সবুজের সঙ্গে মিলেমিশেই তৈরি হতে পারে শহরের আগামী দিনের পথ।

***

প্রথমে অনন্যার একার শখ হিসেবেই শুরু হয়েছিল এই ছাদবাগান, কিন্তু কয়েক মাসের মধ্যেই সেটা রূপ নিল এক সমষ্টিগত স্বপ্নে। বহুতলের বাসিন্দারা কেউ আগে কখনও গাছের টব হাতে নেননি, কেউ আবার শৈশবে গ্রামে গাছ লাগানোর অভিজ্ঞতা মনে করে উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। সবাই মিলে ঠিক হলো—ছাদের আলাদা আলাদা কোণে শুধু টব সাজানো থাকবে না, বরং ছাদকে একেবারে সবুজের রাজ্যে পরিণত করতে হবে। পরিকল্পনা করল তারা কাজ ভাগ করে নেবে—কেউ জল দেওয়ার দায়িত্ব নেবে, কেউ সার মেশাবে, কেউ নতুন চারা আনবে বাজার থেকে। প্রতিদিন সকালে বা সন্ধ্যায় একেকজন ছাদে উঠে এসে নিজের দায়িত্ব পালন করে চলে যায়। আর এই মিলেমিশে কাজ করার মধ্যেই তৈরি হলো এক অন্যরকম বন্ধন। আগে যেখানে প্রতিবেশীদের মধ্যে খুব একটা কথাবার্তা হতো না, সেখানে এখন গাছের আড্ডায় হাসি-ঠাট্টা, পরামর্শ আর গল্পে ভরে উঠল। বাচ্চারা গাছের চারপাশে খেলতে খেলতে শিখল—প্রকৃতিকে যত্ন করলে সে কেমন করে প্রতিদান দেয়।

ধীরে ধীরে ছাদটা শুধু শাকসবজির টবেই ভরে রইল না, বরং আরও বৈচিত্র্য যোগ হলো। কেউ রঙিন ফুলের চারা আনলেন, কেউ তুলসী ও অ্যালোভেরা লাগালেন, কেউ আবার সাহস করে আম, পেয়ারার মতো ফলগাছও বড় টবে রোপণ করলেন। চারা গজানোর আনন্দ যেন সবার হৃদয়ে আলো ছড়িয়ে দিল। সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার ছিল—এই ছাদবাগানে কখনো রাসায়নিক সার বা কীটনাশক ব্যবহার করা হয়নি। অনন্যা সবাইকে শেখাল কীভাবে রান্নাঘরের আবর্জনা দিয়ে কম্পোস্ট বানানো যায়, কীভাবে নিমপাতা ও রসুনের মিশ্রণ দিয়ে প্রাকৃতিক কীটনাশক তৈরি করা যায়। প্রথমদিকে অনেকে সন্দেহ করলেও, পরে যখন দেখল গাছ সুস্থভাবে বেড়ে উঠছে আর ফলনও হচ্ছে, তখন সবাই সেই পদ্ধতি মেনে নিল। একসময় এই ছাদের বাগান হয়ে উঠল যেন একটি পাঠশালা—যেখানে সবাই মিলে শিখছে, আবার একে অপরকে শেখাচ্ছে। প্রকৃতি ধীরে ধীরে তার আশীর্বাদ ফিরিয়ে দিতে শুরু করল—শীতের সকালে টমেটোর লাল ফলন, গ্রীষ্মের দুপুরে ধনেপাতার সুগন্ধ, আর বসন্তে গোলাপের সৌরভে ছাদ একেবারে প্রাণবন্ত হয়ে উঠল।

সবচেয়ে বড় পরিবর্তন এল যখন পাখিরা আবার ফিরে আসতে শুরু করল। শহরের কংক্রিটের মাঝে যেখানে আগে কেবল গাড়ির হর্ন আর ধুলো শোনা যেত, সেখানে এখন সকালের প্রথম রোদে ছাদের চারপাশে চড়ুই, শালিক আর কবুতরের কিচিরমিচির ধ্বনি ভেসে আসতে লাগল। ফুলের ওপর মৌমাছির ভনভনানি, বাতাসে ভেসে আসা মাটির গন্ধ—সব মিলিয়ে ছাদটা যেন ছোট্ট এক গ্রামে রূপ নিল। সকালে ছাদে উঠলেই পাওয়া যেত এক অদ্ভুত শান্তি; বাতাস হয়ে উঠেছিল আরও নির্মল, চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছিল সবুজের ঠান্ডা ছায়া। আগে যেসব মানুষ দিনের পর দিন শুধু ব্যস্ততার অজুহাতে নিজেদের খাঁচায় বন্দি হয়ে থাকতেন, তারা এখন নিয়ম করে ছাদে গিয়ে কয়েক মিনিট সবুজের সান্নিধ্যে কাটাতেন। এই সম্মিলিত প্রয়াসে অনন্যা বুঝল—সবুজ শুধু চোখের আরাম নয়, বরং মানুষের মনকেও একসাথে বেঁধে রাখার অদৃশ্য বন্ধন। শহরের ভেতরেও প্রকৃতি তার নিজের জায়গা ফিরে পেতে পারে, যদি মানুষ একসাথে তাকে ডাক দেয়। এই ছাদের বাগান আর নিছক কোনো প্রকল্প নয়, এটা ছিল তাদের জীবনের অংশ—যেখানে সবাই মিলেমিশে শ্বাস নেয়, স্বপ্ন দেখে, আর ভবিষ্যতের জন্য আশা বুনে চলে।

***

শহরের মানুষের জীবনে এক অদ্ভুত পরিবর্তন আসে সেই দিন থেকে যখন প্রথম খবরটি ছড়িয়ে পড়ে—ফলানা বহুতলের ছাদে একটি সবুজ বাগান তৈরি হয়েছে। শুরুতে সবাই ভাবছিল, এটা কি শুধুই একজন ব্যক্তির একক প্রচেষ্টা, নাকি কি এমন কিছু সম্ভব যে পুরো শহর তার প্রভাবকে অনুভব করবে। আশেপাশের মানুষ, যারা দীর্ঘদিন ধরে কংক্রিটের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে বসবাস করছিল, তারা ছাদের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়। তাদের মনে উদ্ভূত হয় এক অদ্ভুত প্রেরণা—নিজেদের ছাদেও কি সম্ভব এই সবুজের স্পর্শ? ছোট-বড়, ছেলে-মেয়ে, বৃদ্ধ-জ্যেষ্ঠ সকলেই আগ্রহী হয়ে ওঠে। কেউ কেউ চারা আনে, কেউ মাটি সাজায়, কেউ সেচের ব্যবস্থা করে। এটি শুধু গাছ লাগানো নয়, বরং একটি নতুন সংস্কৃতির জন্ম হয়—শহরের মানুষ একে অপরের সাথে মিলে কাজ করতে শিখে, সহযোগিতার অনুভূতি তৈরি হয়। প্রতিটি নতুন চারা শহরের খাতায় রঙের মতো ছড়িয়ে পড়তে থাকে।

কিছুদিনের মধ্যেই ছাদবাগান কেবল একটি বহুতলের সীমায় সীমাবদ্ধ থাকে না; আশেপাশের অনেক বাড়িতেও ছাদে গাছ লাগানো শুরু হয়। এই ছোট ছোট উদ্যোগ একত্র হয়ে শহরের আকাশেও যেন সবুজের ছোঁয়া ফেলে। শিশুদের চোখে আনন্দ, বৃদ্ধদের মুখে শান্তি, এবং যুবকদের মনে এক অদ্ভুত উদ্দীপনা ফুটে ওঠে। স্কুল থেকে ফিরে আসা ছোট্ট শিশুরা খেলার পাশাপাশি গাছের সঙ্গে সময় কাটায়, ফুল পুড়ে, পাতা স্পর্শ করে, গাছের মাঝে লুকোচুরি খেলে। এই দৃশ্যগুলো শহরের কংক্রিটের ধূসরতা ভেদ করে এক উজ্জ্বল রঙের ছোঁয়া ছড়িয়ে দেয়। শুধু তাই নয়, পরিবেশও ধীরে ধীরে কিছুটা হলেও স্বস্তি পায়; বাতাসে দূষণের মাত্রা কমে, ধুলো-মাটির আবরণ কিছুটা পাতলা হয়। মানুষ অনুভব করতে শুরু করে যে তাদের শহর শুধু বসবাসের জায়গা নয়, বরং প্রাণের জন্য একটি জীবনদায়ী স্পেস।

সবুজ ছাদের এই আন্দোলন কেবল পরিবেশগত পরিবর্তনই আনে না, বরং মানুষের মনেও পরিবর্তন ঘটায়। প্রত্যেকটি ছাদবাগান মানুষের মনে একটি নতুন আশা জাগায়—যে আশা শহরের জীবনকে শুধু কংক্রিটের আবরণে সীমাবদ্ধ রাখবে না। বৃদ্ধরা শান্তিতে বসে নিশ্বাস নেয়, তাদের চোখে অল্প আলো, অল্প হাসি ফুটে ওঠে। তরুণরা নিজেদের পরিবারের জন্য, সমাজের জন্য নতুন উদ্ভাবনার খোঁজ শুরু করে। পুরো পাড়ার মানুষ এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি পায়—প্রকৃতির সঙ্গে সংযোগ, সমবায়িক চেতনাই আসলে শহরের নতুন রং। প্রতিটি বাগান, প্রতিটি গাছ, প্রতিটি ফুল শহরের বুকে লিখে দেয় যে পরিবেশ এবং মানুষের সম্পর্ক শুধুই বসবাসের নয়, বরং প্রেম এবং যত্নেরও। দিনশেষে, যখন সূর্য অস্তাচলকে কুঁচকতে থাকে, শহরের বহুতলগুলোর ছাদগুলো এক নতুন রঙে রঙিন হয়ে ওঠে—সবুজের শোভায়, মানুষের আনন্দে এবং জীবনের নতুন আশায়।

***

অনন্যা ছাদে দাঁড়িয়ে পুরো শহরকে দেখে মনে করল, যে স্বপ্ন সে একা শুরু করেছিল, আজ তা কেবল তার নয়—এটি এখন হাজার মানুষের আন্দোলন হয়ে উঠেছে। প্রথম যখন সে একটি ছোট্ট বাগান তৈরি করেছিল, তখন অনেকেই ভাবছিল, এটি সম্ভব কি না, আর কেউ কেউ হাসিও করেছিল। কিন্তু আজ, সেই ছোট্ট উদ্যোগ ধীরে ধীরে এক বৃহৎ সচেতনতার সৃষ্টি করেছে। আশেপাশের বহুতলগুলোর ছাদগুলো এখন সবুজে ভরে গেছে; লতা-পাতা, ফুল, শাকসবজি—সব মিলিয়ে শহরের ধূসর দৃশ্যের মধ্যে যেন নতুন প্রাণ ফুটেছে। শিশুরা খেলে, বৃদ্ধরা শান্তিতে বসে, যুবকেরা আগ্রহী চোখে গাছের পাশে কাজ করে—সব মিলিয়ে এক অদ্ভুত মিলনের অনুভূতি শহরের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। অনন্যা তার চোখে জল দেখতে পায়, কিন্তু তা দুঃখের নয়, বরং আনন্দের—কারণ তার একক প্রচেষ্টা এত বড় এক প্রভাব ফেলেছে। সেই অনুভূতি তাকে অনুপ্রাণিত করে, মনে করিয়ে দেয় যে একজন মানুষও সত্যিকারের পরিবর্তনের সূত্রপাত হতে পারে, যদি সে সততা, উদ্দীপনা এবং ধৈর্যের সঙ্গে কাজ করে।

শহরের মানুষও ধীরে ধীরে বুঝতে শিখেছে যে প্রকৃতির কাছেই আছে জীবনের আসল শান্তি। দিনের শুরুতে সূর্যের আলো যখন সবুজ পাতার ওপর পড়তে থাকে, তখন শহরের কংক্রিটের কঠোরতা যেন ম্লান হয়ে আসে। মানুষ শান্তির নিঃশ্বাস টানে, প্রকৃতির স্পর্শ অনুভব করে, এবং শহরের ব্যস্ততা, শব্দ, ধুলো—সবকিছু কিছুক্ষণ হলেও পেছনে থাকে। ছোট বাচ্চাদের খেলাধুলা, ফুলের গন্ধ, গাছের ছায়া—এসব এক নতুন জীবনদায়ী রীতির জন্ম দিয়েছে শহরে। অনন্যা লক্ষ্য করে, শুধু ছাদবাগান নয়, বরং মানুষের মানসিকতাও পরিবর্তিত হচ্ছে। তারা শেখাচ্ছে, প্রকৃতির সঙ্গে মিলেমিশে থাকলে জীবনের মান আরও সুন্দর হয়। যুবকরা জ্ঞান অর্জন করছে—শহরকে কেবল বসবাসের জায়গা নয়, বরং জীবনকে সংরক্ষণ করার জায়গা হিসেবে দেখা উচিত। বৃদ্ধরা মনে মনে হাসছে, ভাবছে যে এই নতুন সবুজের ছোঁয়া তাদের জীবনের শেষ দিনের সঙ্গী হতে পারে, এবং ছোট ছোট শিশুদের চোখে উৎসাহ, কৌতূহল ও আনন্দ ফুটে উঠছে।

অনন্যা ছাদের ধারে দাঁড়িয়ে ভাবছে, এই ছোট্ট সবুজ একদিন পুরো শহরের চেহারা পাল্টে দেবে। একদিন শহরের প্রতিটি বহুতল, প্রতিটি অঙ্গন, প্রতিটি খাল, প্রতিটি রাস্তাই হবে এক বনায়নের মতো, যেখানে মানুষ এবং প্রকৃতি একসাথে শান্তিতে থাকবে। তার মনে গভীর আশার আলো জ্বলে ওঠে—যে পরিবর্তন শুরু হয়েছিল শুধু তার ব্যক্তিগত ইচ্ছা থেকে, তা আজ এক সামাজিক আন্দোলনে পরিণত হয়েছে। ভবিষ্যতের এই প্রতিশ্রুতি শুধু পরিবেশের নয়, মানুষের মানসিকতারও—শহর কেবল বসবাসের জন্য নয়, বরং জীবনধারণের জন্য, আনন্দ, শান্তি ও একত্বর জন্য স্থান হতে পারে। অনন্যা তার হাত ছড়িয়ে বাতাসের সঙ্গে মিশে থাকা গাছের পাতার দিকে তাকায়, মনে মনে শপথ করে যে সে এই আন্দোলনকে থামতে দেবে না। শহরের মানুষও তার সঙ্গে শপথ করে, তাদের প্রত্যেকের মনে অদ্ভুত দৃঢ়তা তৈরি হয়েছে—যে শক্তি একসময় পুরো শহরকে সবুজের বুকে গেঁথে দেবে, আর এই সবুজ হবে শুধু উদ্ভিদ নয়, বরং মানুষের আশা, আনন্দ, সংহতি এবং ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতির প্রতীক।

***

 

1000063395.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *