Bangla - প্রেমের গল্প

গঙ্গার ধারে শেষ সন্ধ্যা

Spread the love

সুমন্ত নায়েক


গঙ্গার ঘাটের বিকেলবেলা যেন এক রহস্যময় আঙিনার মতো ছিল, যেখানে মানুষের ভিড়, ঘাটের সিঁড়িতে বসা প্রার্থনায় নিমগ্ন বৃদ্ধা, ঘুড়ি ওড়ানো ছেলেরা, আর বাতাসে মিশে থাকা ধূপ-গঙ্গাজলের গন্ধ একসঙ্গে মিলেমিশে এক অন্য রকম আবহ তৈরি করেছিল। সেদিন সূর্যাস্তের ঠিক আগে, আকাশে রঙিন কমলা-সোনালি আভা মেখে যখন গঙ্গার শান্ত জলে প্রতিফলন তৈরি হচ্ছিল, তখনই তাদের দুজনের চোখ প্রথমবারের মতো একে অপরের সঙ্গে মিলিত হয়। ভিড়ের মধ্যে এক মুহূর্তের জন্য দুজনেই যেন সময় ভুলে যায়—চোখাচোখির সেই ক্ষণস্থায়ী টান অদ্ভুত এক নীরবতা তৈরি করে, যা চারপাশের কোলাহলের মধ্যে থেকেও কানে বাজতে থাকে স্পষ্ট সুরের মতো। মেয়েটি ঘাটের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে তার শাড়ির আঁচল সামলাচ্ছিল, আর ছেলেটি দূরে দাঁড়িয়ে কারো সঙ্গে গল্প করতে করতে হঠাৎ থেমে গিয়ে তাকিয়েছিল তার দিকে। কোন শব্দ বিনিময় হয়নি, কিন্তু চোখের ভাষা যেন সব বলে দিয়েছিল—এক অচেনা টান, এক অজানা পরিচয়ের আকাঙ্ক্ষা।

গঙ্গার ঘাটে এমন দেখা হওয়া খুব অস্বাভাবিক কিছু নয়, কিন্তু সেই দিনের বিকেলটা যেন বিশেষভাবে সাজানো ছিল শুধু এই দুজনের জন্য। চারপাশে পূজারতি মানুষ গঙ্গাজল ছিটাচ্ছে, ঢোলের মৃদু শব্দ, ধূপের ধোঁয়া আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে, তবু তাদের মনোযোগ কেবল একে অপরের মধ্যে আটকে গিয়েছিল। মেয়েটির মুখে সূর্যের শেষ আলো পড়েছিল, যা তাকে আরও রহস্যময় আর মায়াবী করে তুলেছিল। ছেলেটি ঠোঁটের কোণে একটুকরো হাসি টেনে নিল, কিন্তু সেই হাসি কোথাও পৌঁছোল না, যেন চোখের গভীরে আটকে গেল। মুহূর্তটা এতটাই ক্ষণস্থায়ী ছিল যে, যদি কেউ বাইরে থেকে দেখত, হয়তো মনে হতো নিছকই একটি কাকতালীয় দৃষ্টি বিনিময়, কিন্তু তাদের দুজনের জন্য তা ছিল অদ্ভুতভাবে গভীর—মনে হচ্ছিল যেন বহুদিন ধরে অপেক্ষা করা কারো সঙ্গে হঠাৎ দেখা হয়ে গেল। সেই ক্ষণিকের পরিচয় না থাকলেও, অনুভূতির ভারে তা হয়ে উঠল জীবনের স্মরণীয় মুহূর্ত।

সূর্য ক্রমশ নিচে নেমে যাচ্ছিল, আকাশের রঙ গাঢ় হতে শুরু করেছিল, আর গঙ্গার জলে ঢেউয়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই মুহূর্তও দুলে উঠছিল। মেয়েটি ধীরে ধীরে ভিড় ঠেলে নেমে যাচ্ছিল ঘাটের সিঁড়ি বেয়ে, তার প্রতিটি পদক্ষেপে ছেলেটির দৃষ্টি যেন অজান্তেই তাকে অনুসরণ করছিল। ছেলেটি বুঝতে পারছিল, হয়তো আর এক মুহূর্ত পরেই মেয়েটি ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে যাবে, তবু তার কাছে সেই কয়েক সেকেন্ডই যেন অনন্তকালের মতো দীর্ঘ হয়ে উঠছিল। অচেনা মানুষ, অচেনা দৃষ্টি, অথচ হৃদয়ের ভেতরে হঠাৎ জন্ম নেওয়া এক মধুর কৌতূহল—কে এই মেয়ে? কোথা থেকে এলো? আবার দেখা হবে তো? সেইসব প্রশ্ন ছেলেটির মনে অস্থিরতা তৈরি করছিল। মেয়েটি শেষবারের মতো ফিরে তাকাল, এক মুহূর্তের জন্য চোখ আবার মিলল, তারপরই সে ভিড়ের সঙ্গে মিলিয়ে গেল। গঙ্গার শান্ত জলে আকাশের রঙ আরও গাঢ় হলো, চারপাশে ভিড়ের গুঞ্জন বাড়ল, অথচ তাদের মধ্যে জন্ম নেওয়া সেই ক্ষণস্থায়ী দৃষ্টি আর অদ্ভুত টান রয়ে গেল অমলিন—যেন এই শহরের অন্তহীন ভিড়েও কেউ একজন কাউকে খুঁজে পাওয়ার অঙ্গীকার করে দিয়েছে।

সেই প্রথম দেখা হওয়ার কয়েকদিন পরেই আবার তাদের চোখাচোখি হয়েছিল হঠাৎই, একই ঘাটের অন্য এক প্রান্তে। এবার আর শুধু দৃষ্টি বিনিময় নয়, দু’জনেই নিজেদের অদ্ভুত টানকে এড়িয়ে যেতে পারেনি। ভিড়ের ফাঁকে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটি সাহস সঞ্চয় করে এগিয়ে গিয়ে কথা বলেছিল, আর মেয়েটিও এক মৃদু হাসি দিয়ে কথোপকথনের সূচনা করেছিল। কী আশ্চর্য, এতদিনের অচেনা-অচেনি মুহূর্তেই যেন এক অদ্ভুত স্বাচ্ছন্দ্য এসে বসেছিল তাদের মধ্যে। খুব সাধারণ কিছু প্রশ্ন—“আপনি এখানে প্রায়ই আসেন?”, “আজ সূর্যাস্তটা বেশ সুন্দর না?”—এর মধ্য দিয়েই শুরু হয়েছিল এক নতুন সম্পর্কের প্রথম ইট। ঠিক তখনই মেয়েটির ফোনে এক কল আসে, সে কথা শেষ করে নম্বরটা ছেলেটির সঙ্গে ভাগ করে নেয় একেবারেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে, যেন তাদের দেখা হওয়ারই কথা ছিল, আর নম্বর বিনিময় কেবল সেই কাহিনির স্বাভাবিক অগ্রগতি। ছেলেটিও তার নম্বর লিখে দিল মেয়েটির ফোনে, আর তারপরই ভিড়ের মাঝখানে দু’জনের হাসি অদ্ভুত এক আলোয় ভরিয়ে দিল সন্ধ্যাকে।

ফোন নম্বর আদান–প্রদানের পর শুরু হলো নিয়মিত আড্ডা, প্রথমে হোয়াটসঅ্যাপে ছোট ছোট মেসেজে, তারপর রাত জাগা ফোনালাপে। খুব তাড়াতাড়িই তারা বুঝে ফেলল—তাদের কথাবার্তা যেন এক অন্তহীন নদীর মতো, যার কোনো শেষ নেই। বই, সিনেমা, গান থেকে শুরু করে ছোট ছোট শখ—সবকিছুতেই তারা খুঁজে পেত মিল, আর কোথাও কোথাও অমিল থাকলেও সেখান থেকেই জন্ম নিত মজার তর্ক। কয়েকদিন বাদেই ঠিক হলো, তারা একসঙ্গে হাঁটতে যাবে গঙ্গার পাড়ে। সন্ধের পর, বাতাসে হালকা শীতলতা, নদীর ধারে ফুরফুরে বাতাস—সবকিছু যেন তাদের বন্ধুত্বের কাহিনিকে আরও স্পষ্ট করে তুলল। তারা হাঁটতে হাঁটতে নিজেদের কথা বলছিল, একে অপরের জীবন নিয়ে, ছোটখাটো স্মৃতি, স্বপ্ন আর ভবিষ্যতের পরিকল্পনা নিয়ে। মাঝেমধ্যেই থেমে যেত, গঙ্গার দিকে তাকিয়ে থাকত, তারপর আবার আলাপ শুরু হতো। সেই প্রথম হাঁটা ছিল নিঃশব্দে এক প্রতিশ্রুতি—এ বন্ধুত্ব সহজে মুছে যাবে না।

হাঁটার পর তারা বসেছিল ঘাটের কোণের পুরনো এক চায়ের দোকানে। কাগজের ভাঁজ করা কাপ, চায়ের গন্ধে ভেসে আসা আদা আর লেবুর মিশ্রিত সুবাস, আর চারপাশে বসা ছাত্রছাত্রীদের হৈ-হল্লা—সবকিছু মিলে জায়গাটা যেন হয়ে উঠেছিল এক অদ্ভুত সাক্ষীর মতো। ছেলেটি বলেছিল, “এই চায়ের স্বাদ কিন্তু একেবারে আলাদা, হয়তো গঙ্গার হাওয়ায় এর গন্ধ মিশে যায়,” মেয়েটি হেসে উত্তর দিয়েছিল, “তাহলে তো গঙ্গাও আমাদের বন্ধুত্বের সঙ্গী হয়ে গেল।” কথার মাঝেই তাদের চোখে আবার সেই অচেনা উজ্জ্বলতা ফুটে উঠল—এবার আর শুধু একবার দেখা নয়, বরং প্রতিদিনের সঙ্গী হওয়ার শুরু। গঙ্গার শান্ত জল, দোকানের ম্লান আলো আর কাপে গরম চায়ের ধোঁয়া—সবকিছু যেন একসঙ্গে সাক্ষী হয়ে রইল এই নতুন বন্ধুত্বের জন্মের। সেদিন থেকে তাদের প্রতিটি আড্ডা, প্রতিটি হাসি, প্রতিটি গল্পে গঙ্গা ছিল নীরব অথচ চিরন্তন সাক্ষী, যে নদী শুধু শহরকেই নয়, এদের দুজনের সম্পর্ককেও ধীরে ধীরে বয়ে নিয়ে চলছিল।

দিনগুলো যেন গঙ্গার জলের মতোই বয়ে যাচ্ছিল—শান্ত অথচ গভীর স্রোত নিয়ে। প্রথম আলাপ, তারপর বন্ধুত্ব, আর এখন সেই বন্ধুত্বের ভেতরে যেন নিঃশব্দে জন্ম নিচ্ছিল এক নতুন অনুভূতি। তারা প্রায় প্রতিদিনই দেখা করত, কখনও সন্ধ্যাবেলায় ঘাটে বসে, কখনও শহরের ভিড় এড়িয়ে নির্জন চায়ের দোকানে। দুজনের মধ্যে কথার ভাণ্ডার যেন শেষ হতো না, অথচ মাঝে মাঝে তারা শুধু নীরবে বসেও থাকত, গঙ্গার দিকে তাকিয়ে, আর সেই নীরবতাই হয়ে উঠত সবচেয়ে গভীর আলাপ। মেয়েটি যখন চুপচাপ নদীর দিকে তাকিয়ে থাকত, ছেলেটি তার মুখের কোণে খেলা করা আলোছায়া দেখে মুগ্ধ হয়ে যেত। আবার ছেলেটি যখন গম্ভীর স্বরে কোনো কথা বলত, মেয়েটি তার চোখের ভেতর খুঁজে পেত এক ধরনের কোমল নিশ্চয়তা। অদ্ভুতভাবে, কোনো ঘোষণা ছাড়াই, তাদের সম্পর্কের রূপ পাল্টে যাচ্ছিল—বন্ধুত্বের মৃদু আবরণ ভেদ করে ভেতর থেকে উঁকি দিচ্ছিল প্রেমের আলো।

সেই আলো আরও স্পষ্ট হলো এক সন্ধ্যায়। সূর্যাস্তের ঠিক পর, আকাশে গাঢ় লাল আভা মিশে যাচ্ছিল, আর গঙ্গার ঢেউ সেই আলোয় রঙিন হয়ে উঠছিল। তারা দুজন পাশাপাশি বসেছিল ঘাটের পুরনো সিঁড়িতে। চারপাশে কোলাহল থাকলেও, যেন এক অদৃশ্য বলয় তাদের চারপাশে নীরবতা তৈরি করেছিল। মেয়েটির শাড়ির আঁচল হাওয়ায় উড়ে এসে ছেলেটির হাতে ছুঁয়ে গেল, আর অচেতনে ছেলেটি তার হাতটা সামলে দিল। সেই মুহূর্তেই দুজনের চোখে চোখ পড়ল, আর কথাহীন এক স্বীকারোক্তি যেন প্রবাহিত হলো। মেয়েটি লজ্জায় চোখ নামিয়ে নিলেও, তার ঠোঁটের কোণে ছিল এক অদ্ভুত হাসি—যা কোনো বন্ধুত্বের সীমার মধ্যে আটকে রাখা যায় না। ছেলেটিও আর দ্বিধা করল না, আলতো করে তার হাত ধরে রাখল, যেন সেই মুহূর্তে প্রতিজ্ঞা করল, এই সম্পর্ক আর কখনো আলগা হবে না। গঙ্গার ঢেউয়ের মতোই তাদের মনের ভেতরও জন্ম নিল নতুন ঢেউ—অচেনা অথচ পরিচিত, ভয়মিশ্রিত অথচ আনন্দে ভরা এক প্রেমের ঢেউ।

এরপর থেকে তাদের প্রতিটি সাক্ষাৎ যেন ভিন্ন রঙে রঙিন হয়ে উঠল। আগের মতো আড্ডা চলত, কিন্তু এখন তার মধ্যে ছিল লুকোনো স্পর্শ, গোপন দৃষ্টি আর এক ধরনের অস্বীকারহীন আকাঙ্ক্ষা। তারা হাঁটতে হাঁটতে অজান্তেই একে অপরের হাত ধরে ফেলত, চায়ের দোকানে বসে মেয়েটি হেসে তার চুলে হাত দিত, আর ছেলেটি নিঃশব্দে সেই মুহূর্ত জমিয়ে রাখত নিজের মনে। কখনও নদীর ধারে নৌকার আলো দেখতে দেখতে তারা ভবিষ্যতের স্বপ্ন নিয়ে কথা বলত—কোথাও ঘুরতে যাওয়া, নতুন জীবনের কল্পনা, অথবা কেবল একসঙ্গে থেকে প্রতিদিনের সুখ ভাগ করে নেওয়া। গঙ্গা, যে এতদিন ছিল তাদের বন্ধুত্বের সাক্ষী, এবার হয়ে উঠল তাদের প্রেমেরও নীরব সঙ্গী। নদীর ঢেউ যেমন নিরন্তর ভেঙে আবার নতুন সুর তোলে, তেমনি তাদের মনেও প্রতিদিন নতুন নতুন অনুভূতির সুর বাজতে লাগল। তারা জানত না সামনে কী অপেক্ষা করছে, কিন্তু এই মুহূর্তে তারা নিশ্চিত ছিল—প্রেমের এই যাত্রা থেমে যাওয়ার নয়, বরং নদীর মতোই তা বয়ে যাবে অন্তহীন পথে।

প্রেমের প্রথম দিনগুলোতে যেমন সবকিছু রঙিন মনে হয়, তেমনই কিছুদিন পরেই সেই রঙে আসে হালকা ধূসর ছায়া। তাদের সম্পর্কেও ধীরে ধীরে সেই ছায়া দেখা দিল। একদিন গঙ্গার ঘাটে দেখা হওয়ার কথা থাকলেও মেয়েটি হঠাৎ দেরি করে এলো, আর ততক্ষণে ছেলেটি নিজের ভেতরে অস্থির হয়ে উঠেছিল। অপেক্ষা করতে করতে তার মনে জমে উঠেছিল অজানা সন্দেহ আর রাগ, যেন প্রত্যাশার ভারই তার ধৈর্যকে ভেঙে দিয়েছে। মেয়েটি এসে হাসিমুখে সব স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলেও ছেলেটি সেই মুহূর্তে কথার আঘাতে তাকে কষ্ট দিয়ে ফেলল। “সময়টা যদি আগে বলতে, তবে আমাকে ঘণ্টাখানেক এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে হতো না,” তার গলায় জমে থাকা অভিমান ভারি হয়ে বেরিয়ে এলো। মেয়েটি প্রথমে চুপ করে রইল, কিন্তু কিছুক্ষণ পর তার চোখে ভেসে উঠল আহত দৃষ্টি। সে ধীরে বলল, “সবসময় কি আমি ইচ্ছে করে তোমায় কষ্ট দিই? তুমি কেন বুঝতে পারো না, আমারও কিছু অসুবিধা হতে পারে?” আর এই কথার পরই সম্পর্কের মসৃণ ক্যানভাসে আঁচড় কাটল ভুল বোঝাবুঝির প্রথম রেখা।

সেই দিন থেকে তাদের কথোপকথনে অদ্ভুত এক অস্বস্তি ঢুকে পড়ল। একসময় যে আড্ডায় শুধু হাসি আর খুনসুটি থাকত, সেখানে এখন নীরবতা এসে জায়গা করে নিল। তারা দুজনেই একে অপরকে ভালোবাসত, কিন্তু প্রত্যাশার ভার, অভিমান আর না বোঝার যন্ত্রণা তাদের মনকে অশান্ত করে তুলল। ফোনে কথা বলার সময়েও হঠাৎ হঠাৎ নীরব হয়ে যেত, মেয়েটি ভাবত ছেলেটি কি আর আগের মতো আগ্রহী নয়, আর ছেলেটি ভাবত মেয়েটি কি তার অনুভূতিকে আর গুরুত্ব দিচ্ছে না। এই অল্প কিছু ভুল বোঝাবুঝি যেন তাদের ভেতরের ভালোবাসার স্বচ্ছতাকে ঘোলা করে দিল। গঙ্গার ধারে বসলে যেখানে আগে নিরবতা মানেই ছিল মনের মিলন, এখন সেই নিরবতা হয়ে উঠল অস্বস্তির প্রতীক। দুজনের চোখে চোখ পড়লেও সেখানে আর আগের মতো আলোর ঝলক থাকত না, বরং লুকিয়ে থাকত প্রশ্ন আর অপরাধবোধ। নদীর জলের মতোই তাদের মনেও অস্থির ঢেউ উঠতে লাগল।

এক সন্ধ্যায় তারা আবার গঙ্গার ঘাটে দেখা করল, চেষ্টা করল সব স্বাভাবিক করতে, কিন্তু কথার মাঝেই আবার ভুল বোঝাবুঝির জাল তাদের জড়িয়ে ফেলল। মেয়েটি বলল, “তুমি সবসময়ই তোমার দৃষ্টিভঙ্গিতে বিষয়গুলো দেখো, কিন্তু একবারও ভেবে দেখো না আমার জায়গা থেকে।” ছেলেটি রাগ চেপে বলল, “তাহলে তুমি কি বোঝাতে চাইছ, আমি শুধু নিজেকেই ভাবি?” কথাগুলো ছিল রাগের মুহূর্তের ফল, কিন্তু সেই আঘাত তাদের সম্পর্ককে আরও দুর্বল করে দিল। গঙ্গার ধার দিয়ে তখন হালকা বাতাস বইছিল, কিন্তু তাদের মন যেন ভারী হয়ে উঠেছিল। নদীর জলে চাঁদের প্রতিফলন হঠাৎ ঢেউয়ে ভেঙে গিয়েছিল, আর সেই ভাঙনের মতোই তাদের সম্পর্কেও তৈরি হয়েছিল প্রথম ফাটল। তারা দুজনেই ভেতরে ভেতরে জানত, এই ভালোবাসা এত সহজে ভাঙার নয়, কিন্তু সেই রাতটিতে দুজনেই চুপচাপ ঘরে ফিরেছিল—একজন অভিমানে, আরেকজন না বোঝার যন্ত্রণায়। গঙ্গা যেন সেদিনও নীরব সাক্ষী হয়ে রইল, শুধু এবার তার জলের অস্থিরতাই প্রতিফলিত করল তাদের সম্পর্কের টানাপোড়েন।

দূরত্ব কখনোই সহজ নয়, বিশেষ করে যখন মন ভরা থাকে স্মৃতিতে। ছেলেটি আজ একা বসে আছে গঙ্গার ধারে, যেখানে এক সময় তারা দুজন মিলে হাঁটত, চায়ের দোকানে বসে গল্প করত, আর শুধু নদীর দিকে তাকিয়ে একে অপরের সঙ্গ উপভোগ করত। নদীর ঢেউয়ের ধীরে ধীরে ভাঙা–গড়া সুরে আজ তার কানে আসে পুরোনো দিনের প্রতিধ্বনি—মেয়েটির হাসি, চোখে সেই খোলা উজ্জ্বলতা, আর হাতের হালকা স্পর্শ। মনে পড়ে সেই প্রথম দেখা, যখন চোখাচোখি হয়ে নীরব সুরের মধ্যেই জন্ম হয়েছিল অদ্ভুত টান। এরপর বন্ধুত্বের দিনগুলো, আড্ডা, ফোন কল, হাঁটা, আর গঙ্গার ধারে চায়ের কাপ—সবকিছু যেন একটি মধুর স্বপ্ন হয়ে আজও তার মনে ভেসে উঠছে। চোখের কোণে জমে ওঠা উজ্জ্বলতা আর হৃদয়ের গভীর অনুভূতি একত্রে তাকে স্মৃতির জগতে টেনে নিয়ে যাচ্ছে, যেখানে কোনো রাগ, কোনো অভিমান নেই, শুধু এক অজানা শান্তি আর আনন্দের ঢেউ।

কিন্তু স্মৃতির সাথে আজকের বাস্তবতা মিলছে না। মেয়েটির সাথে যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে, তা হৃদয়কে অস্থির করে তুলছে। প্রতিটি স্মৃতি তাকে আনন্দ দেয়, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে দেয় ব্যথার স্পর্শ—কেন তারা আবার একই জায়গায় নেই, কেন কথার মাঝেই তর্ক, কেন চোখে চোখ পড়ার পরিবর্তে দৃষ্টিভঙ্গি মিলছে না। ছেলেটি নদীর ধারে বসে ভাবছে, কীভাবে একসময় তাদের সম্পর্ক এত মসৃণ ছিল, আর আজ কেন এটি অচেনা হয়ে গেছে। তার হাত দিয়ে অজান্তে গঙ্গার ঠান্ডা জল স্পর্শ করছে, এবং নদীর ঢেউয়ের ভাঙন যেন তার মনকে প্রতিফলিত করছে—পুরোনো আনন্দ ভেঙে ছুঁয়ে যাচ্ছে দূরত্বের ব্যথা। প্রতিটি ঢেউ তাকে মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, যা কিছু তারা একসাথে পেয়েছিল, তা শুধু স্মৃতিতেই রয়ে গেছে। কিন্তু সেই স্মৃতি আজও তাকে ধাক্কা দেয়, যেন ভালোবাসার উষ্ণতা আর দূরত্বের শীতলতা একসাথে হাড়ে হাড়ে অনুভূত হচ্ছে।

স্মৃতির আলোছায়া এতটাই শক্তিশালী যে, ছেলেটি এখন নিজের হৃদয়ের ভেতর অনন্তকাল ধরে সেই মুহূর্তগুলো আবার জীবন্ত করতে চায়। সে ফিরে পেতে চায় সেই হাসি, সেই চোখে চোখ, সেই হাতের আলতো ছোঁয়া—যা কখনো তাকে ভরা আনন্দ দিয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা তাকে বারবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে, প্রেমের এই পর্যায়ের মধ্যে দূরত্ব কতটা শক্তিশালী হতে পারে। গঙ্গার ধারে বসে সে নিজের কল্পনায় মেয়েটিকে কাছে নিয়ে আসে, তাদের পুরোনো আড্ডা, তাদের প্রথম হাঁটা, প্রথম চা—সব কিছু আবার জীবন্ত করার চেষ্টা করে। আর সেই সময়েই সে বুঝতে পারে, সম্পর্ক যতই দূরে সরে গেল, স্মৃতি ও ভালোবাসার আলোছায়া কখনো মুছে যায় না। দূরত্বের যন্ত্রণা যতটা তীব্র হোক না কেন, স্মৃতির আলো তাদের হৃদয়কে আলোকিত রাখে, এবং এই আলোর মধ্যে দিয়েই সে বিশ্বাস রাখে—যদি কখনো তারা আবার মুখোমুখি হয়, সেই ভালোবাসা আবারও নদীর মতো প্রবাহিত হবে, নতুন উচ্ছ্বাস আর আশা নিয়ে।

দূরত্ব এবং ভুল বোঝাবুঝির দিনগুলো কেটে গেছে, কিন্তু ছেলেটি এবং মেয়েটি দুজনই অনুভব করছিল—তাদের মধ্যকার সংযোগ এখনও সম্পূর্ণ ভাঙেনি। ফোনে ছোট ছোট বার্তা আর নীরব প্রতীক্ষার মধ্যেই তারা বুঝে উঠেছিল, একবার অন্তত তাদের মুখোমুখি দেখা দরকার—যে দেখা হবে শুধুই তাদের অনুভূতির জন্য, যা বলতে গিয়ে বাক্যগুলো ভাঙবে, চোখে চোখ পড়বে, এবং হয়তো হৃদয় থেকে হৃদয় পর্যন্ত সরাসরি পৌঁছাবে। প্রথমে দুজনেই দ্বিধা বোধ করেছিল। কখনো মনে হয়েছিল, দেখা হলে আবার অভিমান নতুন করে জন্ম নেবে, আবার দূরত্বের ব্যথা তীব্র হবে। কিন্তু এই অজানা আকর্ষণ আর স্মৃতির মধুর স্মৃতিচারণ তাদের থামতে দেয়নি। তারা ফোনে এক অদ্ভুত নীরবতায় চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছালো—একবার আবার মুখোমুখি দেখা হবে, আর সেই দেখা হবে গঙ্গার ধারে, সূর্যাস্তের ঠিক সময়।

তারিখ ঠিক হওয়ার পর দিনগুলো কেটে গেল অস্থিরতায়। ছেলেটি প্রতিদিন গঙ্গার সীমানা, ঘাটের সিঁড়ি, নদীর ঢেউ—সবকিছু মনে করছিল যেন সে আগেই জানত, মেয়েটি কোথায় আসবে, কখন আসবে। তার মন একদিকে ভয় আর সন্দেহে ভরা—যদি মেয়েটি এসে না দাঁড়ায়, যদি আগের অভিমান আবার জন্ম নেয়, যদি কথা বলতে গিয়ে সব ভাঙে? তবু এই ভয়কে অজান্তেই প্রতিহত করছিল এক অদ্ভুত আকর্ষণ, এক ধরনের আকাঙ্ক্ষা, যা বলছিল—এই দেখা ছাড়া আর কোনো শান্তি নেই। মেয়েটিও তার ঘরে বসে বারবার ঘড়ির কাঁটা ঘুরতে দেখছিল, প্রতিটি মুহূর্তে নিজেকে প্রশ্ন করছিল, দেখা হলে কি তারা আগের মত স্বাভাবিক হতে পারবে, কি তারা আবার হাসতে পারবে, কি তারা আবার হাত ধরতে পারবে। দুই হৃদয়ই অস্থির ছিল, কিন্তু সেই অস্থিরতায় জন্ম নিচ্ছিল এক নতুন আশা—যে আশা বলছিল, যদি তারা একবার আবার মিলে যায়, হয়তো আগের ভুল বোঝাবুঝির ফাটলগুলোও পূরণ হয়ে যাবে।

শেষ দেখা নির্ধারিত দিনে, সূর্যাস্তের আগমুহূর্তে তারা দুজনই পৌঁছে গেল ঘাটে। নদীর পানি যেন সোনালী আলোয় ঝলমল করছে, বাতাসে হালকা শীতলতা, আর চারপাশে মানুষের ভিড় ধীরে ধীরে কমতে শুরু করেছে। দুজনেই কিছুটা অস্বস্তি বোধ করছিল, চোখে ছিল ভয়ের ছাপ, হৃদয়ে ছিল ব্যথা, অথচ সেই একই সাথে ছিল আকর্ষণ, যে আকর্ষণ যা তাদের আবার একত্রিত করতে চেয়েছিল। প্রথমে কিছুক্ষণ তারা নীরব থেকেছিল, শুধু নদীর দিকে তাকিয়ে। তারপর ছেলেটি ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল, মেয়েটির চোখে চোখ রেখে বলল, “আমরা কি সব ভুলে আবার শুরু করতে পারি?” মেয়েটি সামান্য হেসে উত্তর দিল, “আমি চাইতাম এই দিনটা আসুক।” সেই মুহূর্তে, সূর্যাস্তের সোনালি আলো তাদের চারপাশে ঢেকে দিল, আর নদীর ঢেউ যেন এক অদ্ভুত স্বর নিয়ে তাদের আবেগের প্রতিফলন ঘটাচ্ছিল। দুই হৃদয় আবার একে অপরের দিকে টান পেল, আবারও অনুভব করল সেই অদ্ভুত স্নিগ্ধতা—ভয়, দুঃখ, অভিমান থাকা সত্ত্বেও আকর্ষণ এবং ভালোবাসার শক্তি সব কিছুকে জয় করে।

সূর্য যখন ধীরে ধীরে পশ্চিমের আকাশে নামতে শুরু করল, তখন গঙ্গার ধারে দেখা হলো তাদের। নদীর জলের ওপর পড়া রঙিন আভা যেন তাদের দুজনের অনুভূতিকে আরও গভীর করে তুলছিল। চারপাশে ভিড় ছিল কম, বাতাসে হালকা শীতলতা, আর নদীর ঢেউগুলো শান্ত, অথচ প্রত্যেক ঢেউ যেন তাদের হৃদয়ের প্রতিধ্বনি। তারা একে অপরের দিকে তাকিয়ে কিছু বলল না, শুধু চোখের ভাষা দিয়েই বোঝানোর চেষ্টা করল—কতটা মন ভাঙা, কতটা আকাঙ্ক্ষা, কতটা অনিশ্চয়তার ভেতর দিয়ে এসেছে এই মুহূর্ত। মেয়েটির চোখে অশ্রুর ক্ষুদ্র দৃষ্টি, ছেলেটির চোখে অনুরোধের মৃদু কম্পন—সবকিছু মিলিয়ে সেই মুহূর্তকে অচেনা, অথচ পরিচিত করে তুলল। গঙ্গার ধারে সেই নীরবতা যেন সব শব্দকে হারিয়ে দিয়েছে, শুধু দুই হৃদয়ের ধ্বনি, যা কোনো কণ্ঠস্বর ছাড়াই একে অপরের কাছে পৌঁছে যায়।

তাদের হাঁটা আর কথা বলা থেমে গেছে; শুধু নদীর ঢেউয়ের সঙ্গে মিশে থাকা বাতাস তাদের শরীরের প্রতিটি স্পর্শে প্রবাহিত হচ্ছে। ছেলেটি ধীরে ধীরে এগিয়ে এল, মেয়েটির হাতের ওপর আলতো ছোঁয়া দিয়ে বলল, “আমি ভেবেছিলাম আমরা হয়তো আর কখনো একে অপরকে খুঁজে পাব না।” মেয়েটি চোখ নামিয়ে রাখলেও, তার অশ্রু ভিজে থাকা চোখে ঝলমল ছিল এক অদ্ভুত শান্তি—যেমন কষ্টের মধ্যেও আবার আশা জন্ম নিচ্ছে। তারা জানত, এই নীরব সাক্ষাৎ তাদের জন্য শেষ দেখা নয়, কিন্তু ঠিক এই মুহূর্তে তারা একে অপরের ভেতরের অনুভূতি গভীরভাবে উপলব্ধি করছিল। আকাশে লালচে সূর্যাস্তের আলো তাদের মুখে প্রতিফলিত হচ্ছে, যেন চারপাশের প্রকৃতি ও সময়ও তাদের আবেগকে স্বীকৃতি দিচ্ছে। কোনো কথার প্রয়োজন নেই, কোনো ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই—শুধু চোখের ভেতর প্রতিফলিত সেই অদ্ভুত টানই সবকিছু বোঝাচ্ছিল।

নদীর ধারে তাদের এই নীরব মিলন যেন দীর্ঘক্ষণ স্থায়ী হলো। দুই হৃদয়ের মধ্যে জমা ব্যথা, অভিমান, দূরত্বের যন্ত্রণা—সব মিলেমিশে এখন এক শান্ত আলো হিসেবে ভেসে উঠল। ছেলেটি বুঝতে পারল, কষ্ট যতই গভীর হোক, ভালোবাসার শক্তি সবকিছু জয় করতে পারে। মেয়েটিও অনুভব করল, তাদের মধ্যে যত ভাঙন ঘটেছে, এই নীরব মিলন সেই ফাটলগুলো ধীরে ধীরে মেরামত করছে। সূর্য ডোবার সাথে সাথে আকাশ গাঢ় হয়ে আসছে, নদীর জলের প্রতিফলন ধীরে ধীরে হালকা কমছে, কিন্তু তাদের চোখে চোখে থাকা অনুভূতি সেই আলো শেষ না হওয়া পর্যন্ত রয়ে যাবে। তারা জানত, জীবন কখনো সহজ নয়, সম্পর্ক কখনো নিখুঁত নয়, কিন্তু এই নীরব সন্ধ্যার মধ্য দিয়ে তারা আবার একে অপরের কাছে ফিরে এসেছে—পুরোনো কষ্ট, অভিমান, দূরত্ব সবকিছু মুছে দিয়ে, শুধু ভালোবাসার আলোর মাঝে দাঁড়িয়ে। সেই গঙ্গার ধারের শেষ সন্ধ্যা হয়ে উঠল তাদের সম্পর্কের নতুন সূচনা, যেখানে নীরবতা, চোখের ভাষা, আর নদীর ঢেউ—সবকিছু মিলিয়ে সৃষ্টি করল এক অনন্য মধুর মুহূর্ত।

গঙ্গার ধারের সেই নীরব মিলন শুধু শান্তি আর স্মৃতির আলোর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকল না। যেমন নদীর ঢেউ কখনো শান্ত থাকে না, তেমনি তাদের আবেগও ধীরে ধীরে অস্থির হয়ে উঠল। ছেলেটি মেয়েটির দিকে তাকিয়ে অনুভব করল, কতদিন ধরে জমে থাকা অভিমান, অভিযোগ, আশঙ্কা—সব কিছুর ভার একসাথে মনের ভেতরে চাপে রেখেছিল। মেয়েটিও অনুভব করল, কথাবার্তা না বললেও, চোখের ভাষা আর নীরব স্পর্শে ছেলেটির অন্তর্গত যন্ত্রণা তার ভেতরে প্রবাহিত হচ্ছে। হঠাৎই কথার বাঁধ ভেঙে যায়। ছেলেটি বলল, “তুমি জানো না, আমি কতবার নিজেকে সামলেছি, কিন্তু এখন আর পারছি না। আমার মনে হচ্ছে, সব কিছুই ফেটে পড়ছে।” মেয়েটি এক মুহূর্ত থেমে, তারপর তার কণ্ঠও কম্পিত হয়ে উঠল, “আমিও ঠিক একইরকম, আমার মন কাঁপছে, অথচ আমি কিছু বলতে পারছিনা।” এই একসাথে আবেগের বিস্ফোরণ তাদের চোখের অশ্রু, হৃদয়ের স্পন্দন, আর শব্দের কম্পন—সবকিছু একত্রে মিশিয়ে দিয়েছিল এক মধুর, অচেনা, অথচ অদ্ভুতভাবে পরিচিত অনুভূতিতে।

কিছুক্ষণ ধরে তারা শুধু দাঁড়িয়ে থাকল, একে অপরের দিকে তাকিয়ে, নীরবতার মধ্য দিয়ে সব অনুভূতি প্রতিফলিত হচ্ছিল। কিন্তু এই নীরবতাও শেষ হলো। হঠাৎ ঝগড়া শুরু হলো—অভিমান আর অভিযোগ মিশে। ছেলেটি বলল, “তুমি সবসময় নিজের মতো ভাবছো, আমার জায়গা ভাবছো না।” মেয়েটি উত্তরে বলল, “তুমি কি ভাবছো, আমি তোমার অনুভূতি বুঝি না? আমি তো সবসময় চেষ্টা করেছি।” এই ছোট ছোট কথার মধ্যেই জমে থাকা সব অনুভূতি বেরিয়ে এলো, এক ঝড়ের মতো। অশ্রু ঝরছে, গলার কম্পন, হাতের স্পর্শ—সব মিলেমিশে তারা নিজেদের আবেগকে ছাপিয়ে দিচ্ছিল। এবং তারপর, হঠাৎই দুজনেই কাঁদতে কাঁদতে আলিঙ্গন করল। সেই আলিঙ্গনে ছিল শুধু অভিমান নয়, ছিল চিরদিনের ভালোবাসা, যা কোনো কথায় বলা সম্ভব নয়। নদীর ঢেউয়ের মতোই তাদের আবেগ ঝরছিল, ভাঙছিল, আবার মিশে যাচ্ছিল একসাথে—অভিমান, অভিযোগ, ভালোবাসা—সবকিছুর মিলন একটিমাত্র আলিঙ্গনে।

তারপর আসে সত্যের মুহূর্ত। আবেগের ঝড় কিছুটা থেমে গেল, এবং দুজন চুপচাপ একে অপরের চোখে তাকালো। ছেলেটি ধীরে বলল, “ভালোবাসি, সত্যিই ভালোবাসি। কিন্তু হয়তো আমাদের একসাথে থাকা সম্ভব নয়। এই দূরত্ব, এই পরিস্থিতি, সবকিছু আমাদের বাধা দিচ্ছে।” মেয়েটিও কণ্ঠে কম্পন নিয়ে স্বীকার করল, “হ্যাঁ, আমি জানি। আমি ওকে সবসময় চাই, কিন্তু জীবন মাঝে মাঝে আমাদের প্রমাণ করে—ভালোবাসা থাকলেই সব ঠিক হবে না।” এই স্বীকারোক্তিতে চোখে অশ্রু, হৃদয়ে যন্ত্রণা, অথচ একই সাথে ছিল শান্তির এক আলোকছায়া। তারা বুঝল, ভালোবাসা শুধুই হৃদয়ের অনুভূতি নয়; কখনো কখনো বাস্তবতার বাধার মধ্যেও দাঁড়িয়ে থাকতে হয়, তা স্বীকার করতে হয়। নদীর ধারে সেই মুহূর্তটি হয়ে উঠল আবেগের এক বিস্ফোরণ—ঝগড়া, কান্না, আলিঙ্গন, স্বীকারোক্তি—সবকিছু মিলিয়ে, যা তাদের সম্পর্ককে এক নতুন দিক দেখালো। তাদের ভালোবাসা যে এত গভীর, এত সত্য, তা বোঝা গেল, কিন্তু সেই ভালোবাসা আর সবসময় একে অপরের সঙ্গে থাকতে পারবে না—এই সত্যও স্পষ্ট হয়ে উঠল।

সূর্য যখন ম্লান আলো নিয়ে আকাশের নীচে নামতে শুরু করল, তখন গঙ্গার ধারে সেই নীরবতা আরও গভীর হয়ে উঠল। নদীর ঢেউ তীরে এসে ভাঙছে, আর প্রতিটি ঢেউ যেন তাদের অন্তরের কথা বোঝে। দুজনেই জানত—এবারের দেখা হয়তো শেষ, আর এই শেষ দেখার মুহূর্তে সমস্ত অনুভূতি, সমস্ত আবেগ, সমস্ত ভালোবাসা একসাথে ভেসে আসছে। তারা একে অপরের দিকে তাকিয়ে কিছু বলল না, শুধু চোখের ভাষা দিয়েই বোঝানোর চেষ্টা করল—কতটা ভালোবাসা, কতটা ব্যথা, কতটা নীরব আকাঙ্ক্ষা। ছেলেটির হাত ধীরে ধীরে মেয়েটির হাতে পড়ল, আলতো স্পর্শে, যেন বলতে চাচ্ছে—“যদিও আমরা ছিন্ন, কিন্তু তুমি আমার হৃদয়ে চিরকাল থাকছ।” মেয়েটিও তার হাত ধরল, নিজের অশ্রু চেপে ধরে, কিন্তু চোখের ভেতর স্পষ্ট ছিল—প্রতিটি স্পর্শের মধ্যেই বিদায়ের কষ্ট, প্রতিটি মৃদু আলোর ঝলকে জমে থাকা স্মৃতির প্রতিফলন। গঙ্গার ধারে নদীর ঢেউয়ের ভাঙন যেন তাদের সম্পর্কের প্রতীক হয়ে উঠল—শক্তিশালী, অপ্রতিরোধ্য, কিন্তু একসময়ে ভেঙে পড়া অবধারিত।

হাত ধরা থেকে ধীরে ধীরে ছেলেটি তার হাত সরাল। সেই ক্ষণ ছিল সবচেয়ে কঠিন, সবচেয়ে কষ্টকর। অশ্রু ঝরে যাচ্ছিল, কিন্তু কেউ কিছু বলল না; শুধু চোখে চোখে কথা বলা হলো। নদীর হালকা হাওয়ায় তাদের চুল এলোমেলো হয়ে উঠল, আর আকাশে গাঢ় লালচে রঙ যেন তাদের আবেগের প্রতিফলন ঘটাচ্ছিল। ছেলেটি কিছুক্ষণ মেয়েটির দিকে তাকিয়ে ছিল, মনে মনে সেই সব স্মৃতি মনে করছিল—প্রথম দেখা, প্রথম হাঁটা, চায়ের দোকানে বসে গল্প, নীরব হাঁটাহাঁটি, সবকিছু যা তাদের মিলিত করেছিল। মেয়েটিও একরকম অনুভব করছিল, হৃদয়ে ব্যথা, অথচ মুখে অদ্ভুত শান্তি। এই নীরবতার মধ্যেই বিদায় নেওয়া হলো—কোনো শব্দ ছাড়া, কোনো কণ্ঠস্বর ছাড়া, শুধুই চোখ, স্পর্শ, এবং নদীর ধীর সুর। এই মুহূর্তে তারা বুঝতে পারল, ভালোবাসা থাকলেই সবকিছু সমাধান হয় না; কখনো কখনো ভালোবাসার মধ্যেও বিদায়ের প্রয়োজন হয়, নীরব, শান্ত, এবং প্রভাবশালী।

শেষবারের জন্য তারা একে অপরের হাত ছেড়ে দিল। ছেলেটি ধীরে ধীরে পেছনে হেঁটে গেল, আর মেয়েটি নদীর ধারে দাঁড়িয়ে তাকে দেখছিল, যেন এই শেষ দৃষ্টিটিই চিরকাল হৃদয়ে রাখবে। নদীর ঢেউ যেমন অবিরাম ভাঙে, তেমনি তাদের সম্পর্কও অবসান ঘটে গেল—কিন্তু তার মধ্যে থাকা স্মৃতি, ভালবাসা, অভিমান, সমস্ত আবেগ একটি অদৃশ্য সেতু হিসেবে রয়ে গেল। বাতাসে কেবল নদীর স্রোতের শব্দ, পাতার ছোঁয়া, আর দূরের হাঁসের ডাক—এই নীরব সাক্ষীর মতো তাদের বিদায়ের মুহূর্তে উপস্থিত। তারা জানত, তারা আর একে অপরের কাছে ফিরে আসতে পারবে না, কিন্তু সেই নীরব বিদায় তাদের হৃদয়ে এক গভীর প্রশান্তি রেখেছিল—যা কখনো মুছে যাবে না। গঙ্গার তীরে দাঁড়িয়ে, চোখে অশ্রু, হৃদয়ে স্মৃতি, তারা দুজন আলাদা পথে হেঁটে গেল, কিন্তু মন থেকে মন কখনো আলাদা হয়নি। এই নীরব বিদায়ই তাদের সম্পর্কের চূড়ান্ত অধ্যায় হয়ে রয়ে গেল—একটি প্রেমের গল্প যা সমাপ্ত হলেও স্মৃতির আলোছায়ায় চিরকাল জ্বলতে থাকবে।

১০

গঙ্গার ধারে সেই শেষ সন্ধ্যার পর তাদের জীবন আলাদা পথে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল, কিন্তু হৃদয়ের গভীরে সেই স্মৃতি চিরকাল অম্লান হয়ে রয়ে গেল। ছেলেটি শহরের ব্যস্ত জীবনে নিজেকে হারিয়ে ফেললেও, মাঝে মাঝে নদীর ধারে দাঁড়িয়ে থাকা মুহূর্তগুলো তার মনে ঘুরে আসে—মেয়েটির চোখের সেই গভীরতা, হালকা স্পর্শ, নীরব আলিঙ্গন, এবং শেষ বিদায়ের নীরবতা। কাজের ব্যস্ততা, বন্ধুবান্ধবের মাঝে হাসি, এমনকি নতুন বন্ধুত্বও তাকে কখনো সেই স্মৃতিকে মুছে দিতে পারল না। প্রতিটি সন্ধ্যায়, যখন সূর্য ধীরে ধীরে আকাশের ধারে নামতে শুরু করে, সে অজান্তে সেই নদীর ধারের দৃশ্য কল্পনা করে। মনে হয়, নদীর জলের প্রতিটি ঢেউ যেন ছেলেটির অন্তরের প্রতিফলন, যা চুপচাপ ভাঙে আর আবার নতুন করে তৈরি হয়। সেই ঢেউয়ের মধ্যে ভেসে আসে স্মৃতির প্রতিটি অংশ—প্রথম দেখা, বন্ধুত্বের শুরু, প্রেমের উষ্ণতা, এবং শেষ বিদায়ের যন্ত্রণা। গঙ্গার প্রতিটি স্রোত যেন তার জন্য একটি কাহিনী বলে—যে কাহিনী কখনো শেষ হয়নি, শুধু সময়ের আবরণে লুকিয়ে আছে।

মেয়েটিও তার জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে সেই স্মৃতিকে সঙ্গে নিয়ে চলেছে। কখনও কলকাতার ব্যস্ত সড়কে হাঁটতে হাঁটতে, কখনও বাসের জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতে তাকাতে, তার চোখে ভেসে আসে গঙ্গার সেই সোনালি সন্ধ্যা। তার মনে পড়ে কেমন করে ছেলেটির হাত তার হাতে ধরা ছিল, কতোটা অদ্ভুত নীরবতা এবং সংযোগ সেই মুহূর্তে অনুভূত হয়েছিল। সম্পর্কের শেষ মুহূর্তের ব্যথা কখনো ভুলে যায়নি, কিন্তু সেই ব্যথার সঙ্গে মিশে আছে এক অমোঘ শান্তি—যে শান্তি বলে দেয়, ভালোবাসা শুধুমাত্র থাকা বা দেখা নয়, কখনো কখনো হৃদয়ের মধ্যে চিরস্মৃতি হয়ে থাকতেও পারে। মেয়েটি বুঝেছে, এই স্মৃতি তার জীবনের অংশ, যা কখনো হারাবে না। প্রতিটি নদীর ঢেউ তার মনে প্রতিফলিত হয়, যেন বলছে—“যদি তুমি ধীরে ধীরে ভেসে যেও, সেই ভালোবাসা তোমার ভেতর চিরকালই বাঁচবে।” এই উপলব্ধি তার অন্তরকে শক্তি দেয়, ব্যথাকে কোমল করে দেয়, আর স্মৃতিকে একটি মধুর সুর হিসেবে পরিণত করে।

যত দিন যাচ্ছে, গঙ্গা নিজেই যেন তাদের প্রেমের সাক্ষী হয়ে রয়ে গেছে। নদী অবিরাম বয়ে যাচ্ছে, সময়ের স্রোতে সবকিছু বদলাচ্ছে—মানুষ আসে, যায়, স্মৃতি তৈরি হয়, হারায়, আবার নতুন করে জন্মায়। কিন্তু তাদের শেষ দেখা, নীরব বিদায়, এবং চোখে চোখে থাকা সংযোগ—সবকিছু নদীর বুকে খোদাই হয়ে রয়ে গেছে। প্রতিটি ঢেউ, প্রতিটি বাতাসের সোঁদা ঘ্রাণ, প্রতিটি সূর্যাস্তের আলো যেন তাদের স্মৃতিকে জীবন্ত রাখে। ছেলেটি এবং মেয়েটি আলাদা পথে এগোচ্ছিলেও, গঙ্গার ধারে সেই মুহূর্ত তাদের মন-মগজে চিরকাল থাকবে—যে মুহূর্ত যেখানে ভালোবাসা, ব্যথা, নীরবতা এবং স্মৃতি একসাথে মিলিত হয়েছিল। জীবন চলতে থাকবে, নতুন গল্প জন্মাবে, কিন্তু সেই শেষ সন্ধ্যার চিরস্মৃতি তাদের অন্তরকে ছুঁয়ে যাবে প্রতিটি ঝাপসা আলো, প্রতিটি ঢেউ, প্রতিটি নীরব বাতাসের মধ্য দিয়ে। গঙ্গার ধারে প্রেমের সেই অধ্যায় শেষ হলেও, হৃদয়ে তার ছাপ চিরকাল বেঁচে থাকবে—অমোঘ, অনবদ্য, চিরস্মৃতি হয়ে।

****

1000063368.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *