Bangla - ভূতের গল্প

বরফঘরে আলো

Spread the love

সুবর্ণ সাহা


অধ্যায় ১: পাহাড়ি শহরের গল্প

উত্তরবঙ্গের ছোট্ট পাহাড়ি শহরটির নাম মানুষজন খুব একটা জানে না, অথচ তার বুকজুড়ে ইতিহাসের চাপা স্তর জমে আছে বছরের পর বছর ধরে। চা-বাগানের মাঝখানে, খরস্রোতা নদীর ধার ঘেঁষে আর কুয়াশায় ঢাকা বনানীর ভেতর দিয়ে ছোটো রাস্তাগুলো ছড়িয়ে আছে। পাহাড়ি হাওয়ায় ভেসে আসে কাঠের গন্ধ, আর মাটির ভেতর থেকে উঠে আসা একধরনের আর্দ্র শীতলতা মানুষকে অচেনা এক আতঙ্কে আবদ্ধ করে রাখে। শহরের বাসিন্দারা দিনের বেলা যতটা সরগরম থাকে, রাত নামলেই ততটাই নিস্তব্ধ হয়ে যায়। তবে এই নিস্তব্ধতার ভেতরে আছে এক অদ্ভুত শূন্যতা—যেটাকে তারা বরাবরই এক পুরনো ভবনের নামের সঙ্গে জুড়ে দেয়। সেটি হলো পাহাড়ি শহরের উপকণ্ঠে দাঁড়িয়ে থাকা সেই পুরনো বরফঘর। বহু বছর আগে এক ব্যবসায়ী পরিবার এটি তৈরি করেছিল, শীতলীকরণের জন্য বরফ সংরক্ষণ করে রাখার জায়গা হিসেবে। কিন্তু সময়ের স্রোতে ব্যবসা ভেসে যায়, মালিক পরিবার শহর ছেড়ে অন্যত্র চলে যায়, আর বিশাল পাথরের দেয়াল ঘেরা বরফঘর পড়ে থাকে পরিত্যক্ত।

এই বরফঘর নিয়ে গল্পের শেষ নেই। লোকেরা বলে, চাঁদনি রাতে দূর থেকে দেখা যায় ভেতরে একরাশ আলো জ্বলছে। কেউ বলে, সেই আলো আসলে অদৃশ্য প্রেতাত্মার উপস্থিতি। আবার কেউ কেউ বলে, পাহাড়ি ডাকাতরা বা আধুনিক চোরাকারবারিরা নাকি এখনও ওই বরফঘরকে গোপন আস্তানা হিসেবে ব্যবহার করে। শহরের চায়ের দোকান থেকে মাছবাজার পর্যন্ত এই আলো নিয়ে আলোচনা থেমে থাকে না। স্কুলপড়ুয়া ছেলেরা একে অপরকে সাহস দেখানোর নামে বাজি ধরে—কে বরফঘরের কাছাকাছি যেতে পারবে, আর কে পারে না। অথচ অবধি কোনো মানুষই সাহস করে ভেতরে পা রাখেনি। শুধু কয়েকজন পথিক বলেছে, গভীর রাতে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় তারা কান পেতে শুনেছে ভেতরে ফিসফিস, যেন অদৃশ্য কারো কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে। এ কথাগুলো শহরের বয়োজ্যেষ্ঠরা বিশেষ পাত্তা দেয় না, তারা বলে—এ সবই কুসংস্কার। কিন্তু বাজারে ভিড় জমলে, আড্ডায় মশলা বাড়াতে সবাই এই আলো নিয়েই গল্প বলে। গল্পের ভেতর মিলেমিশে যায় অজানা আতঙ্ক, লোককথার ছায়া আর বাস্তবের কল্পনা।

যারা এই শহরে বছরের পর বছর ধরে বসবাস করছে, তাদের জন্য বরফঘরের আলো একপ্রকার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে—যেনো তা শহরের রাতের স্বাভাবিক দৃশ্যের অংশ। কিন্তু একই সঙ্গে এটি রহস্যের পর্দা জিইয়ে রেখেছে, যা বাইরে থেকে আসা মানুষদের মনে ভয়ের সঙ্গে সঙ্গে কৌতূহলও জাগায়। অচেনা পর্যটকেরা পাহাড় ঘুরতে এসে স্থানীয়দের মুখে যখন বরফঘরের গল্প শোনে, তখন তাদের চোখে বিস্ময় ছাপিয়ে ওঠে। শহরের বৃদ্ধরা মাঝে মাঝে ভুরু কুঁচকে বলেন—“ওই আলো ভালো নয়, যা বোঝার তা বোঝো।” আর গৃহিণীরা সন্তানদের রাতে বাইরে যেতে মানা করার অজুহাত হিসেবে এই বরফঘরের গল্পকেই টেনে আনে। এভাবেই শহরের সংস্কৃতি, কথোপকথন আর ভয়মিশ্রিত কল্পনার ভেতরে বরফঘরের আলো ক্রমশ কিংবদন্তি হয়ে ওঠে। তবু এই গল্পের কোথাও একটা শূন্যতা থেকে যায়—আসলে আলোটা কোথা থেকে আসে? কে বা কী সেটা জ্বালায়? শহরের মানুষ জানে না, হয়তো জানতে চায়ও না। তারা আলোকে ঘিরেই বাঁচতে শিখেছে। অথচ ভবিষ্যতের জন্য এ আলোই হতে চলেছে এক অচেনা দরজা, যেখান দিয়ে গল্প প্রবেশ করবে আরও অন্ধকার গভীরতার দিকে।

অধ্যায় ২: কৌতূহলী ছাত্র

অঞ্জন শহরের কলেজের ইতিহাস বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। তার বয়স মাত্র কুড়ি, কিন্তু মনের ভেতর অদম্য কৌতূহল আর অজানাকে জানার নেশা। শৈশব থেকেই সে পুরনো ধ্বংসাবশেষ, মন্দিরের ভগ্নপ্রাচীর, কিংবা লোককথায় ভরা জায়গার প্রতি এক অদ্ভুত আকর্ষণ অনুভব করত। অন্যরা যখন বইয়ের বাইরে গল্পে মন দিত না, তখন অঞ্জন লাইব্রেরিতে ঘুরে ঘুরে পুরনো দলিল পড়ত, স্থানীয় ইতিহাস খুঁজে বের করত, কিংবা শহরের প্রবীণ মানুষদের সঙ্গে বসে তাঁদের কাছ থেকে শোনার চেষ্টা করত হারিয়ে যাওয়া দিনের কাহিনি। তার মনে হতো, ইতিহাস শুধুই পাঠ্যবইয়ের বিষয় নয়, বরং আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে আছে—অচেনা স্থাপত্যে, পুরনো গলিতে, কিংবা ভৌতিক কাহিনির ভেতরে। এই কারণেই যখন কলেজে প্রথম সে বরফঘরের গল্প শোনে, তার রক্ত যেন হঠাৎ গরম হয়ে ওঠে। বন্ধুরা যখন বিষয়টিকে নিছক মজা হিসেবে নেয় বা ভয়ে এড়িয়ে যায়, তখন অঞ্জনের চোখে ঝিলিক ধরে—যেন সে অপেক্ষা করছে রহস্যের দরজা খুলে দেওয়ার জন্য।

বন্ধুরা তাকে নানা ভাবে সাবধান করতে চেয়েছিল। কলেজ ক্যান্টিনে আড্ডার সময় যখন বরফঘরের আলো প্রসঙ্গ আসে, তখন কেউ বলে—“ওই আলো নাকি যারা ভেতরে ঢোকে, তাদের গিলে ফেলে।” আবার কেউ হেসে বলে—“সেটা সব ভূতের গল্প, এসব সিরিয়াসলি নিও না।” তবুও আশেপাশে যখন-তখন গল্প শুনে অঞ্জনের মনে কৌতূহল ক্রমশ বেড়েই চলল। তার বন্ধু রাহুল একদিন খুব সিরিয়াস হয়ে বলল—“তুই যদি ওখানে ঢোকিস, তোর কিছু একটা খারাপ হবেই। শহরের কত মানুষ অদৃশ্য হয়ে গেছে, তার খবর তো তোকে বলেছি।” কিন্তু অঞ্জন এসবকে কুসংস্কার বলে উড়িয়ে দিল। সে ভাবল, হয়তো শহরের মানুষ ভয়কে নিজেদের রক্ষাকবচ বানিয়েছে, আর হয়তো আলোটি আসলে কোনো বৈজ্ঞানিক কারণেই হচ্ছে—কোনো প্রাকৃতিক গ্যাসের প্রতিফলন, বা ভাঙা কাচে পড়া আলোর খেলা। সে মনে মনে ঠিক করল, কেউ না গেলেও সে একদিন যাবেই, এবং বরফঘরের ভেতরের রহস্য উদ্ঘাটন করবেই। কৌতূহল তার কাছে কেবল কৌতূহল নয়, বরং জেদে পরিণত হয়েছিল।

এরপর থেকে অঞ্জন বরফঘরের আশেপাশে প্রায়শই যাওয়া শুরু করল। দূর থেকে সে পুরনো স্থাপত্যের ছায়া লক্ষ্য করত, কুয়াশার ভেতরে অদৃশ্য হয়ে যাওয়া তার গাঢ় দেয়ালগুলোর দিকে তাকিয়ে ভাবত—ভেতরে কী লুকিয়ে আছে? অনেক রাতে হোস্টেলের জানলা দিয়ে যখন পাহাড়ি বাতাসে আলো টিমটিম করে জ্বলতে দেখত, তার বুকের ভেতর এক অদ্ভুত টান অনুভব করত। সে গোপনে খাতায় নোট করতে শুরু করল—শহরের মানুষের মুখে শোনা গল্প, আলো জ্বলার সময়, এমনকি ভেতর থেকে পাওয়া অদ্ভুত শব্দের বিবরণ। যেন সে কোনো গবেষণা করছে, এক অনাবিষ্কৃত রহস্যের খোঁজে। তার বন্ধুরা বলত—“তুই একদিন এই নেশায় সর্বনাশ করবি।” কিন্তু অঞ্জনের ভেতরে ভয় নেই, আছে শুধু অদম্য আগ্রহ। ইতিহাসের ছাত্র হিসেবে তার বিশ্বাস—অতীত যত ভয়ঙ্করই হোক, তার মুখোমুখি হওয়াই মানুষের আসল দায়িত্ব। তাই এক রাতে, যখন কুয়াশা আরও ঘন হয়ে শহর ঢেকে ফেলবে, যখন চারপাশ নিস্তব্ধ হবে, তখন সে বরফঘরের দরজার ভেতর প্রবেশ করবে—এই সিদ্ধান্তে অঞ্জন অটল হয়ে ওঠে। সে জানত না, তার এই কৌতূহলই একদিন তাকে নিয়ে যাবে অন্ধকার এক যাত্রায়, যেখান থেকে আর ফিরে আসার পথ থাকবে না।

অধ্যায় ৩: নিষিদ্ধ জায়গার পথে

সন্ধেটা ছিল অস্বাভাবিক। সারাদিন আকাশ মেঘে ঢাকা ছিল, কিন্তু সন্ধ্যা নামতেই ঝোড়ো হাওয়া শুরু হয়। পাহাড়ি শহরের সরু রাস্তাগুলোতে বাতাস যেন শিস বাজিয়ে ছুটছিল, মাঝে মাঝে দূরের গাছপালার মাথা দুলে উঠে হঠাৎই যেন কোনো অচেনা সুর বাজিয়ে দিচ্ছিল। দোকানপাট আগেভাগেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, বাজারের চা-স্টলগুলোতেও আর ভিড় নেই। মানুষজন দ্রুত ঘরে ঢুকে গা ঢাকা দিয়েছে, যেন এই সন্ধ্যায় বাইরে থাকা মানেই কোনো অশুভ ছায়ার মুখোমুখি হওয়া। এমন সময়েই অঞ্জন বেরিয়ে পড়ে, বুকের ভেতর অদ্ভুত এক আলোড়ন নিয়ে। হোস্টেলের রুম থেকে গোপনে বেরিয়ে সে পা বাড়ায় শহরের উপকণ্ঠের দিকে, যেখানে পাহাড়ের পাদদেশে দাঁড়িয়ে আছে সেই বহু পুরনো বরফঘর। পথে হাঁটার সময় তার মনে হচ্ছিল, যেন প্রতিটি বাতাসে কেউ ফিসফিস করে কিছু বলতে চাইছে। কিন্তু সে থেমে যায়নি। তার মনে এখন ভয় থেকে বেশি কাজ করছে কৌতূহল আর জেদের মিশ্রণ। “আজ যদি না যাই, তবে আর কখনো সাহস হবে না”—নিজেকে সে এভাবেই বোঝাচ্ছিল।

বরফঘরের কাছাকাছি আসতেই চারপাশের পরিবেশ যেন আরও বেশি ভারী হয়ে উঠল। দূরে কুয়াশায় ঢেকে যাওয়া পাহাড় অদ্ভুত ছায়া তৈরি করছিল, আর সেই ছায়ার ভেতরে বরফঘরের কালো দেহরেখা যেন অস্বাভাবিকভাবে বড় হয়ে উঠছিল। দরজার সামনে পৌঁছেই অঞ্জনের মনে হলো, তার গা ঠান্ডায় কাঁপছে, কিন্তু সেটা কেবল আবহাওয়ার ঠান্ডা নয়, বরং ভেতর থেকে আসা অজানা আতঙ্কের ঠান্ডা। বরফঘরের দরজা ভাঙা, মরচে ধরা তালা এখনো ঝুলছে, তবে সেটি তালাবদ্ধ নয়—শুধু চিহ্ন হিসেবে পড়ে আছে। দরজার কাঠে শ্যাওলা জমে গেছে, আঙুল দিয়ে ছুঁতেই যেন তা গলে গিয়ে স্যাঁতসেঁতে হয়ে ওঠে। হাওয়া বয়ে গেলে দরজাটা নিজেই কাঁপতে থাকে, এবং প্রতিবার কাঁপুনির সঙ্গে সঙ্গে ভেতর থেকে একরাশ আলো ফাঁক দিয়ে বাইরে এসে পড়ে। অঞ্জন এক মুহূর্তের জন্য থমকে দাঁড়াল। চোখ কুঁচকে সে ভেতরের দিকে তাকাতে চেষ্টা করল। হ্যাঁ, আলো সত্যিই আছে—কোনো কল্পনা নয়। আলোটা টিমটিম করছে, যেন পুরনো কোনো লণ্ঠন বা প্রদীপের শিখা, কিন্তু এমন আলো তো এত বছর বন্ধ জায়গা থেকে বেরোনোর কথা নয়। তার বুকের ভেতর ঢিপঢিপ শব্দ উঠল, কিন্তু কৌতূহল যেন তাকে ঠেলে আরও কাছে নিয়ে গেল।

দরজার একদম সামনে এসে দাঁড়িয়ে অঞ্জন গভীর শ্বাস নিল। বাতাসের গন্ধে কেমন যেন পুরনো ধুলো আর পচে যাওয়া কাঠের গন্ধ মিশে আছে, কিন্তু তার ভেতরেও এক অচেনা শীতলতা লুকিয়ে আছে। মনে হলো, এক অদৃশ্য শক্তি দরজার ওপারে বসে তার দিকে তাকিয়ে আছে। হাওয়া আরও জোরে বইতে শুরু করল, যেন বরফঘরকে ঘিরে এক ভয়াল সুর বাজছে। আকাশে বাজ পড়ল, আর বিদ্যুতের ক্ষণিক আলোয় অঞ্জন দেখতে পেল বরফঘরের দেওয়ালে অদ্ভুত সব দাগ, যেগুলো দূর থেকে রক্তের মতো লালচে লাগছিল। তার কানে তখনো ভেসে আসছিল দরজার ফাঁক দিয়ে টিমটিম আলো ঝিকমিক করার শব্দ, যেন প্রতিটি ঝলক একটা ফিসফিসানি বয়ে আনছে। সে শেষবারের মতো পেছনে তাকাল—রাস্তা একদম ফাঁকা, কেবল কুয়াশার ধোঁয়ায় ঢেকে থাকা পথ আর দূরের নিস্তব্ধ পাহাড়। তার মনে হলো, এখনই যদি সে পিছিয়ে যায়, তাহলে হয়তো এই রহস্য কোনোদিনও জানা হবে না। বুক ঠুকে সাহস জোগাড় করে অঞ্জন আস্তে আস্তে দরজার ভেতরে হাত রাখল, আর ঠেলে দিল—ভেতর থেকে ভাঙা দরজা কড়কড়ে শব্দ করে সরে গেল। সেই শব্দ পাহাড়ের নীরবতায় যেন বজ্রপাতের মতো ছড়িয়ে পড়ল, আর মুহূর্তে চারপাশ আরও অন্ধকার হয়ে এল। অঞ্জনের চোখ তখন শুধুই নিবদ্ধ ছিল ভেতরের সেই আলোয়, যে আলো তাকে অচেনা এক জগতে ডাকছিল, নিষিদ্ধ এক দরজার ওপারে।

অধ্যায় ৪: ভেতরের শীতল অন্ধকার

ভেতরে পা রাখতেই অঞ্জন বুঝতে পারল, বাইরের ঠান্ডা আর ভেতরের ঠান্ডার মধ্যে বিশাল তফাৎ। বাইরের হাওয়ার শীতলতা ছিল স্বাভাবিক, কিন্তু এই ভেতরের ঠান্ডা যেন দেহের ভেতর গেঁথে যাচ্ছে, হাড়ের মজ্জা পর্যন্ত জমে যাচ্ছে। তার নিঃশ্বাস মুহূর্তেই কুয়াশায় রূপ নিল, যেন সে শীতের রাতে বরফাচ্ছন্ন কোনো উপত্যকায় এসে পড়েছে। অথচ বাইরে তো এখনো শরৎকাল, এমন হিমশীতল পরিবেশ হওয়ার কথা নয়। দেয়ালগুলোতে হাত ছুঁতেই সে টের পেল পাথরগুলো ভেজা, যেন সদ্য বরফে মোড়া হয়েছিল। অদ্ভুতভাবে সাদা সাদা দাগ ছড়িয়ে আছে চারদিকে, দূর থেকে দেখতে যেন দেয়ালে বরফ জমে আছে। মেঝেতে হাঁটতেই তার পায়ের শব্দ কেমন যেন প্রতিধ্বনি তুলল, আর প্রতিটি পদক্ষেপের পর মেঝে থেকে উঠতে লাগল ধোঁয়াটে কুয়াশা, যেন বরফ গলে গিয়ে শ্বাস ছাড়ছে। অঞ্জনের বুক ধকধক করছিল, তবুও তার চোখ খুঁজছিল সেই আলোর উৎস। অথচ আলোটা একেবারেই বোঝা যাচ্ছিল না—কোথাও কোনো প্রদীপ বা বাতি নেই, তবুও ঘরের গভীর অন্ধকারে এক টিমটিমে, ছড়িয়ে পড়া আলো চারপাশে নাচছে।

অঞ্জন ধীরে ধীরে ঘরের ভেতরে এগোতে লাগল। বাতাসের ভেতর ছিল অদ্ভুত এক গন্ধ—পচে যাওয়া কাঠ, ভিজে মাটি, আর তার সঙ্গে যেন আরও কিছু অচেনা কিছুর গন্ধ, যা চেনা যায় না, কিন্তু মনকে অস্বস্তি আর আতঙ্কে ভরিয়ে তোলে। কানে ভেসে আসছিল হালকা ফিসফিসানি, কিন্তু কাছে গিয়ে দেখল কিছু নেই। দেয়ালের এক কোণে সাদা দাগগুলো হাতের তালু দিয়ে ছুঁয়ে দেখতেই তার মনে হলো, সেগুলো সাধারণ দাগ নয়, বরং অনেকটা মানুষের হাতের ছাপের মতো। যেন কেউ ভেতরে থেকে প্রাণপণ ভাবে বেরোনোর চেষ্টা করেছে, আর হাতের চাপে দেয়ালে চিহ্ন রেখে গেছে। তার বুকের ভেতর কেমন যেন শূন্যতা তৈরি হলো, কিন্তু চোখ ফেরানো গেল না। আলো ক্রমশ ঘরের ভেতরে তাকে টেনে নিচ্ছিল, প্রতিটি পদক্ষেপে তার মনে হচ্ছিল যেন মেঝের কুয়াশা তার গোড়ালি আঁকড়ে ধরছে, তাকে আটকে রাখছে। হঠাৎই কানে ভেসে এল এক ঠান্ডা শব্দ—কড়কড়ে আওয়াজ, যেন পুরনো কাঠে কেউ চাপ দিল। অঞ্জন দ্রুত ঘুরে তাকাল, আর মুহূর্তেই জমে গেল।

পেছনের দরজা নিজে থেকেই বন্ধ হয়ে গেছে। কোনো মানুষ নেই, তবুও দরজাটা ধীরে ধীরে কড়মড় শব্দ তুলে বন্ধ হলো, আর শেষে এক প্রচণ্ড শব্দে ঠাস করে লেগে গেল। অঞ্জনের হৃদস্পন্দন হঠাৎই কানে বাজতে লাগল, তার নিঃশ্বাস আরও ভারী হয়ে উঠল। সে দ্রুত দৌড়ে গিয়ে দরজা ঠেলল, কিন্তু দরজা আর নড়ল না। যেন অদৃশ্য কোনো শক্তি দরজার ওপার থেকে ঠেলে রেখেছে। সে হাত দিয়ে ধাক্কা দিতে লাগল, মুষ্টি দিয়ে পেটাতে লাগল, কিন্তু কোনো শব্দ বাইরে পৌঁছালো কি না তা সে জানত না। কেবল নিজের প্রতিধ্বনি, নিজের আতঙ্কমিশ্রিত শ্বাসের শব্দই বারবার ফিরে আসছিল কানে। হঠাৎ আবার আলোটা জ্বলে উঠল, এবার আরও তীব্রভাবে। মনে হলো, ঘরের ভেতরের কুয়াশা আলোয় ভরে যাচ্ছে, আর সেই আলো আসলে তাকে ডাকছে, কাছে টানছে। তার শরীর ভয়ে কাঁপছিল, কিন্তু তার চোখ আলো থেকে সরানো যাচ্ছিল না। যেন আলো এক অদৃশ্য বাঁধনে তাকে আটকে ফেলেছে, আর অন্ধকার, শীতলতার এই ভেতরে সে ক্রমশ টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এক অজানা গভীরতার দিকে।

অধ্যায় ৫: পুরনো যন্ত্র আর কণ্ঠস্বর

অন্ধকারে আলো-আঁধারি চোখের অভ্যেস তৈরি হতেই অঞ্জন বুঝতে পারল, বরফঘরের গভীরে রয়েছে বহু পুরনো, মরচে ধরা যন্ত্রপাতি। এগুলোই একসময় বরফ তৈরির কাজে ব্যবহার করা হতো—বড় বড় ধাতব ট্যাংক, মোটা লোহার পাইপ, আর চাকার মতো গোলাকার যন্ত্র। বহু বছর আগে ব্যবহারের ছাপ যেন এখনও টিকে আছে, যদিও সেগুলো এখন মরচেতে খাওয়া, ভেঙে পড়ার মতো অবস্থা। কিন্তু সবচেয়ে অস্বাভাবিক ব্যাপার হলো—এই মরচে ধরা যন্ত্রগুলো থেকে যেন আস্তে আস্তে গুনগুন শব্দ ভেসে আসছে, এক ধরনের কম্পন যা বাতাসে মিশে অঞ্জনের শরীর কাঁপিয়ে দিচ্ছিল। তার মনে হলো, যন্ত্রগুলো যেন আবার চালু হয়ে গেছে, অথচ এখানে কোনো বিদ্যুৎ নেই, নেই কোনো জীবিত মানুষ। যন্ত্রগুলোর পাশে দাঁড়িয়ে তার বুকের ভেতর শীতলতা আরও বেড়ে গেল। সে হাত বাড়িয়ে একটিকে ছুঁতেই টের পেল, ধাতব শরীরের ভেতর দিয়ে একধরনের অদ্ভুত কম্পন বইছে। যেন সেই যন্ত্র বহু বছর মৃত থাকার পরেও এখনো নিঃশ্বাস নিচ্ছে, অথবা কোনো অদৃশ্য শক্তি তাকে সচল রেখেছে।

অঞ্জনের কানে তখন অন্য এক অদ্ভুত আওয়াজ পৌঁছতে শুরু করল। প্রথমে মনে হলো, বাতাসের স্রোতে খসে পড়া পাতার শব্দ, কিন্তু ধীরে ধীরে সেটা শব্দ নয়, বরং স্পষ্ট কণ্ঠস্বর হয়ে উঠতে লাগল। খুব নিচু স্বরে ফিসফিসানি ভেসে আসছিল—যেন একাধিক মানুষ একসঙ্গে কিছু বলছে, কিন্তু কোনো শব্দ আলাদা করে বোঝা যাচ্ছে না। সে চারদিকে তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করল, শব্দটা কোথা থেকে আসছে। যন্ত্রের ভেতর থেকে? নাকি দেয়ালের ওপাশ থেকে? কিন্তু ঠিক তখনই ফিসফিসানির ভেতর কান্নার মতো শব্দ মিশে গেল। করুণ আর হৃদয় বিদারক কান্না, যেন কেউ ভিতরে আটকা পড়ে কাঁদছে, মুক্তি চাইছে। অঞ্জনের শিরদাঁড়া ঠান্ডা হয়ে গেল। সে কাঁপা কাঁপা চোখে অন্ধকারের দিকে তাকাল, যেখানে আলো অস্পষ্ট ছায়া তৈরি করছে। হঠাৎই মনে হলো, ছায়াগুলো নড়ছে—যেন কেউ হেঁটে বেড়াচ্ছে অন্ধকারে, কিন্তু চোখে ধরা পড়ছে না। তার বুকের ভেতর থেকে তখন একটাই অনুভূতি আসছিল—সে একা নয়, এই বিশাল শীতল ঘরের ভেতরে আরও কেউ আছে, যারা দৃষ্টির বাইরে থেকে তাকে লক্ষ্য করছে।

তার মনে পড়ল শহরের মানুষের মুখে শোনা সেই গুজবগুলো—বরফঘরে ঢোকার পর আর কেউ ফিরে আসে না, আর ভেতরে থেকে ভেসে আসে অদ্ভুত শব্দ। হয়তো সেই শব্দই সে এখন শুনছে। এক মুহূর্তের জন্য অঞ্জনের ইচ্ছে হলো দৌড়ে গিয়ে দরজা ভেঙে বেরিয়ে আসতে, কিন্তু দরজা তো আগেই বন্ধ হয়ে গেছে। কণ্ঠস্বরগুলো তখন আরও স্পষ্ট হচ্ছিল, কখনো যেন কেউ তার নাম ধরে ডাকছে, আবার কখনো করুণ মিনতি করছে। “আমাদের বাঁচাও…”—শব্দটা যেন কানে স্পষ্ট ভেসে এলো। অঞ্জন কেঁপে উঠল, ঠোঁট শুকিয়ে গেল। সে বুঝতে পারছিল না, এই শব্দ তার কল্পনা, নাকি সত্যিই কারও আত্মা এখানে বন্দি হয়ে আর্তনাদ করছে। তার চোখের সামনে তখন যন্ত্রগুলোর মরচে ধরা গায়ে আলো খেলে যাচ্ছিল, আর মনে হচ্ছিল সেই আলোই শব্দের সঙ্গে মিলিয়ে তাকে অদৃশ্য এক সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করাচ্ছে। অঞ্জন তখন নিশ্চিত হলো—সে এখানে একা নেই, এবং যাদের উপস্থিতি সে টের পাচ্ছে, তারা মানুষ নয়, কিন্তু অচেনা কোনো অস্তিত্ব, যাদের চিৎকার আর ফিসফিসানি এখন এই বরফঘরের দেয়াল ভেদ করে তাকে ঘিরে ফেলেছে।

অধ্যায় ৬: আলোর উৎস

অঞ্জনের চোখে আলোর ঝলকানি ধরা পড়ল বরফঘরের একপাশে, যেখানে মেঝের সঙ্গে লাগোয়া একটি সঙ্কীর্ণ সিঁড়ি নেমে গেছে নিচে। অন্ধকারের গভীরতায় ডুবে থাকা সেই সিঁড়িটা যেন তাকে আহ্বান করছিল। বুক ধড়ফড় করলেও কৌতূহলের টানে সে ধীরে ধীরে সিঁড়ির ধাপ নামতে শুরু করল। প্রতিটি ধাপের সঙ্গে তার পায়ের শব্দ অস্বাভাবিকভাবে প্রতিধ্বনি তুলছিল, যেন পুরো বরফঘর কাঁপছিল সেই শব্দে। নিচের দিক থেকে শীতল বাতাস আরও প্রবল হয়ে আসছিল, গায়ে হিম লাগাচ্ছিল, তবুও অঞ্জন আলো হারানোর ভয়ে দ্রুত পা চালাল। অবশেষে সিঁড়ি শেষ হয়ে যখন সে মাটিতে পা রাখল, তখন সামনে যে দৃশ্যটা চোখে পড়ল, তাতে তার নিঃশ্বাস আটকে গেল। একটি পুরনো লণ্ঠন মাঝখানে রাখা, কিন্তু সেটি একেবারে নিখুঁতভাবে জ্বলছে। এত বছর ধরে বন্ধ বরফঘরে বিদ্যুৎ নেই, মানুষ নেই, বাতাস ঢোকার উপায় নেই—তাহলে লণ্ঠনটা কে জ্বালাল? কে এর তেল ভরে রাখল? আলো একটানা জ্বলছে, অথচ চারপাশে কোনো মানুষ নেই।

অঞ্জন ধীরে ধীরে লণ্ঠনের দিকে এগিয়ে গেল। লণ্ঠনের কাঁচে শ্যাওলা জমে আছে, লোহার দেহ মরচে ধরা, তবুও এর ভেতরে আগুন অদ্ভুতভাবে স্থির হয়ে টিমটিম করছে। আলোয় চারপাশে ছায়া তৈরি হয়েছে, কিন্তু সেই ছায়াগুলো অস্বাভাবিক। এগুলো স্থির নয়, বরং নড়ছে, কাঁপছে, যেন অদৃশ্য মানুষ আলো ঘিরে হাঁটছে। কখনো মনে হচ্ছিল কেউ সিঁড়ি বেয়ে নামছে, কখনো মনে হচ্ছিল কেউ দরজার দিকে যাচ্ছে, আবার কখনো একসঙ্গে কয়েকটা ছায়া একে অপরের ভেতর দিয়ে মিশে যাচ্ছে। অঞ্জনের শিরদাঁড়া ঠান্ডা হয়ে গেল। সে চারদিকে তাকাল—ঘরে কেউ নেই, শুধু লণ্ঠন আর সেই নড়মান ছায়ারা। হঠাৎই মনে হলো, এক ছায়া থেমে তার দিকে ঘুরে তাকাল। আলোয় তার চোখে পড়ল মানুষের মতো অবয়ব, কিন্তু শরীর নেই, শুধু দুলতে থাকা অন্ধকার। অঞ্জন ভয়ে একপা পিছিয়ে গেল, অথচ চোখ সরাতে পারল না। লণ্ঠনের প্রতিটি আলো ছায়াগুলোকে আরও স্পষ্ট করছিল, যেন তারা এক অদৃশ্য জগত থেকে বেরিয়ে আসছে।

একসময় অঞ্জনের কানে আবার ভেসে এলো সেই অদ্ভুত ফিসফিসানি। এবার শব্দ আরও স্পষ্ট—“আমরা এখানে… আমরা বন্দি…”। চারপাশে ছায়ারা যেন শব্দের সঙ্গে তাল মিলিয়ে হাত নড়াচ্ছিল, কারও হাত উপরে উঠছিল, কারও পা ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছিল। মনে হচ্ছিল, লণ্ঠনের চারপাশে অদৃশ্য মানুষের ভিড় জমেছে, আর তারা আলো ঘিরে অদ্ভুত নৃত্য করছে। কান্না, হাসি, ফিসফিস আর চিৎকার—সব মিলিয়ে যেন এক ভয়াবহ সিম্ফনি তৈরি হলো। অঞ্জনের শরীর ঘামে ভিজে যাচ্ছিল, কিন্তু ঘামটা ঠান্ডায় সঙ্গে সঙ্গে জমে যাচ্ছিল। সে বুঝতে পারল, লণ্ঠনটা শুধু আলো নয়, এটি এক ধরনের ফাঁদ—এক রহস্যময় আলোকস্তম্ভ, যেটা এই বরফঘরের ভেতরকার ছায়াদের একত্রিত করে রেখেছে। হয়তো যারা আগে এখানে ঢুকেছিল, তাদের আত্মা এখন এই ছায়ায় রূপান্তরিত হয়েছে। অঞ্জনের বুক ধড়ফড় করতে লাগল—সে নিজেকে প্রশ্ন করল, তাহলে কি সেও এখন এই আলোয় বন্দি হয়ে যাবে? কিন্তু প্রশ্নের উত্তর আসার আগেই চারপাশের ছায়ারা একযোগে তার দিকে এগিয়ে আসতে শুরু করল, আর আলোটা অস্বাভাবিকভাবে তীব্র হয়ে তার চোখ ঝলসে দিল।

অধ্যায় ৭: হারানোদের ছায়া

অঞ্জনের চোখ ধীরে ধীরে আলোয় অভ্যস্ত হয়ে উঠতেই সে যা দেখল, তাতে তার বুকের ভেতর থেকে ঠকঠক শব্দ বেরিয়ে এল। চারপাশে যত ছায়া নড়ছিল, তাদের অবয়ব একে একে স্পষ্ট হতে শুরু করল। মুখ নেই, চোখ নেই, তবুও শরীরের ভঙ্গি থেকে বোঝা যাচ্ছিল তারা মানুষ ছিল—একসময়ে হয়তো বাজারে ঘুরেছে, চায়ের দোকানে বসেছে, কিংবা পাহাড়ি রাস্তায় হাঁটাহাঁটি করেছে। অঞ্জনের মনে পড়ল শহরের বহু পুরনো গল্প—যুবক হঠাৎ উধাও হয়ে গেছে, কোনো দিন বাড়ি ফেরেনি; কাঠের ব্যবসায়ী একদিন মাল নিয়ে গিয়েছিল, আর খুঁজে পাওয়া যায়নি; এমনকি এক বিদেশি ভ্রমণকারীও নাকি হঠাৎ নিখোঁজ হয়েছিল। শহরবাসী ভেবেছিল ডাকাতি, বা পাহাড়ি দুর্ঘটনা। কিন্তু এই ছায়াদের ভিড় দেখে অঞ্জনের মনে হলো, তারা সবাই এখানে এসে আটকা পড়েছে। তার বুক কেঁপে উঠল—যদি এরা হারানো মানুষদের আত্মা হয়, তাহলে এদের মুক্তি কেন হলো না? কেন তারা আজও বরফঘরের অন্ধকারে ঘুরে বেড়াচ্ছে? অঞ্জন অনুভব করল, প্রতিটি ছায়া যেন তার দিকে হাত বাড়াচ্ছে, যেন সাহায্য চাইছে, অথবা হয়তো তাকে টেনে নিতে চাইছে তাদের দলে।

একসময় চারপাশে ফিসফিসানি স্পষ্ট হয়ে উঠল। কেউ যেন কাঁদছে—“আমরা ফিরে যেতে চাই… আমাদের ঘরে…”; কেউ যেন রাগে গর্জে উঠছে—“আমাদের বন্দি করেছে… আমাদের মুক্তি নেই…”। অঞ্জনের শরীর ঠান্ডায় জমে যাচ্ছিল, কিন্তু তার মস্তিষ্কে ভেসে উঠছিল এক ভয়াবহ সত্য—যারা শহরে হারিয়ে গিয়েছিল, তারা আসলে মরে যায়নি, বরং এই বরফঘর তাদের গিলে নিয়েছে। ছায়াদের ভিড় ঘন হয়ে উঠছিল, কেউ তার কাঁধে হাত রাখার চেষ্টা করছিল, কেউ তার জামার কোঁচা ধরতে চাইছিল। অঞ্জন আতঙ্কে কেঁপে উঠল, কিন্তু তার মনে হলো, তারা হয়তো ক্ষতি করতে চাইছে না। তাদের শরীরহীন হাতগুলো কেবল একটা আর্তি বহন করছিল। তারা অঞ্জনের কাছে চাইছিল স্বীকৃতি—যেন কেউ তাদের অস্তিত্বকে চিনে নিক, কেউ যেন শহরে গিয়ে বলুক, তারা নিছক নিখোঁজ হয়নি, তারা এখানে বন্দি হয়ে আছে। অঞ্জনের মনে হলো, ছায়ারা তাকে এক অদ্ভুত দায়িত্ব চাপিয়ে দিচ্ছে।

কিন্তু সেই মুহূর্তেই এক শীতল স্রোত অঞ্জনের শরীর ঘিরে ধরল। লণ্ঠনের আলো হঠাৎ কাঁপতে শুরু করল, আর ছায়াদের ভিড় আরও বিক্ষিপ্তভাবে নড়তে লাগল। অঞ্জন বুঝল, ছায়ারা যেমন তাকে কাছে ডাকছে, তেমনই এক অদৃশ্য শক্তি তাকে টেনে নিচ্ছে এই অন্ধকারের গভীরে। প্রতিটি ছায়ার ভেতরে সে দেখতে পেল হারানো মুখ—কেউ হয়তো তার বয়সী ছাত্র, কেউ শহরের বয়স্ক মানুষ, কেউ আবার একেবারেই অপরিচিত। তারা সবাই মিলেমিশে যেন এক বিশাল শূন্যতা তৈরি করেছে, যেখানে অঞ্জনকেও গিলে নেওয়ার হুমকি আছে। ছায়ারা হাত বাড়িয়ে তার আঙুল ছুঁতে লাগল, আর অঞ্জন অনুভব করল এক অদ্ভুত শীতলতা তার শিরায় ছড়িয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছিল, যদি সে একটু দেরি করে, তাহলে তার শরীরও মুছে যাবে, আর সেও এই ছায়াদের ভিড়ে মিশে যাবে—একজন নতুন হারানো মানুষ হয়ে। অঞ্জনের শ্বাস দ্রুত হয়ে উঠল, হৃদস্পন্দন কানে তালা লাগিয়ে দিচ্ছিল। এই বরফঘরের শীতল অন্ধকারে দাঁড়িয়ে সে বুঝল, এটা শুধু একটা পুরনো জায়গা নয়, বরং একটা ফাঁদ—যেখানে প্রতিটি হারানো মানুষ একদিন ছায়ায় রূপান্তরিত হয়েছে, আর এখন তার পালা ঘনিয়ে এসেছে।

অধ্যায় ৮: পালানোর চেষ্টা

অঞ্জনের শরীর ঘামে ভিজে উঠেছিল, অথচ সেই ঘাম মুহূর্তের মধ্যে বরফ হয়ে যাচ্ছিল হাড়কাঁপানো ঠান্ডায়। ছায়াদের হাত থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে সে হঠাৎই দৌড়তে শুরু করল। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে আসতেই চারপাশে প্রতিধ্বনি তুলল তার পায়ের শব্দ, কিন্তু সেই প্রতিধ্বনি যেন কোনো অচেনা ভাষায় ফিসফিস করে উঠছিল। অঞ্জন বুঝতে পারছিল না সে কোন দিকে যাচ্ছে, কেবলই চেষ্টা করছিল মূল দরজার কাছে পৌঁছাতে। কিন্তু প্রতিবারই যখন সে কোনো করিডর ধরে দৌড়াত, তখনই আবার সেই লণ্ঠনের আলো চোখে পড়ত। যেন পুরো বরফঘরটা তার সঙ্গে নিষ্ঠুর খেলা খেলছে, তাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে একই জায়গায় এনে ফেলছে। একবার এক দেয়ালের ধারে গিয়ে সে হাত বুলিয়ে দেখল—দেয়ালটা ঠান্ডায় কাঁপছিল, যেন ভেতর থেকে কোনো শীতল প্রাণ দম বন্ধ করে নিঃশ্বাস ফেলছে। অঞ্জন দম নিতে পারছিল না, বুকের ভেতর যেন বরফ জমে উঠছিল।

সে ছুটে চলল আরও দ্রুত, কিন্তু প্রতিটি মোড় একই রকম—ভাঙা যন্ত্রপাতি, মরচে ধরা লোহার পাইপ, আর সাদা দাগে ভর্তি দেয়াল। আলো ক্রমশ তীব্র হয়ে উঠছিল, তার চোখ ঝলসে যাচ্ছিল, অথচ অন্ধকারও সমান শক্তিতে ঘিরে ধরছিল তাকে। তার মনে হচ্ছিল, লণ্ঠনের আলো কেবল নীচেই নয়, পুরো বরফঘরজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। যেখানে সে যায়, সেখানেই সেই আলো পৌঁছে যায়। দৌড়াতে দৌড়াতে হঠাৎ সে অনুভব করল, তার নিঃশ্বাস আর বেরোচ্ছে না—প্রতিটি শ্বাস জমে যাচ্ছে ঠান্ডায়, মুখ দিয়ে বরফের কুয়াশা বেরোচ্ছে। গলার ভেতর ব্যথা হচ্ছিল, যেন জমে যাওয়া কণা ভেতরটা চিরে দিচ্ছে। অঞ্জন আতঙ্কে চিৎকার করতে চাইল, কিন্তু তার গলা থেকে কেবলই কর্কশ শব্দ বেরোল, যেন বরফ চাপা পড়ে আছে। তখনই পেছন থেকে ভেসে এল সেই একই ফিসফিসানি—“তুই পালাতে পারবি না… এখানে সবাই থেকে যায়…”। সে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল, ছায়াদের ভিড় আবার তার পিছু নিয়েছে। তারা ধীরে ধীরে তার দৌড়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগোচ্ছিল, কিন্তু অদৃশ্য কোনো বাঁধা যেন তাদের গতিকে আটকে দিচ্ছিল, অথচ তাদের উপস্থিতি অঞ্জনের বুকের ভেতর হিমেল ছুরির মতো ঢুকে যাচ্ছিল।

অবশেষে সে এক করিডরের শেষে এসে এক ফাঁকা দরজার ফাঁক দেখতে পেল। বুকের ভেতর আশা জেগে উঠল—হয়তো এটাই সেই দরজা, যেখান দিয়ে সে ঢুকেছিল। সে ঝাঁপিয়ে গিয়ে দরজাটা ঠেলতে লাগল, কিন্তু দরজা নড়ল না। মরচে ধরা কাঠের ফাঁক দিয়ে কেবল ঠান্ডা বাতাস ঢুকছিল, আর তাতেই তার আঙুল জমে যাচ্ছিল। সে সমস্ত শক্তি দিয়ে দরজা ঠেলতে লাগল, ঘাম আর ঠান্ডা মিলেমিশে শরীর নিস্তেজ হয়ে আসছিল। এসময় আলো এতটাই তীব্র হয়ে উঠল যে তার চোখ অন্ধকারে আর মানিয়ে নিতে পারল না। চারপাশে যেন কেবল সাদা কুয়াশার ঢেউ, আর সেই কুয়াশার ভেতর থেকে ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসছিল আরও অগণিত ছায়া। তারা হাত বাড়িয়ে ছিল, ঠান্ডা নিঃশ্বাস তার ঘাড়ে লাগছিল। অঞ্জন মরিয়া হয়ে দরজায় ধাক্কা দিতে থাকল, কিন্তু বুঝতে পারল—এই বরফঘরের পথচিহ্ন মানুষের হাতে তৈরি নয়, এটি যেন কোনো দুষ্ট শক্তির গোলকধাঁধা। যে এখানে ঢোকে, সে যতবারই পালানোর চেষ্টা করুক না কেন, আলো আর ছায়া তাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এই বরফঘরের শীতল কারাগারে বন্দি করে রাখে। অঞ্জনের চোখ ঝাপসা হয়ে আসছিল, হাত অসাড় হয়ে যাচ্ছিল, অথচ ভেতরে একটাই অনুভূতি কাজ করছিল—যদি এখনই বেরোতে না পারে, তবে চিরতরে সেও হারানোদের একজন হয়ে যাবে।

অধ্যায় ৯: আলোয় বিলীন

অঞ্জনের শরীর তখন ক্লান্তিতে ভেঙে পড়ার উপক্রম। ঠান্ডা তার হাড়ের ভেতর ঢুকে গেছে, নিঃশ্বাস টেনে নিতে গেলে মনে হচ্ছিল বরফ কণা ফুসফুস ছিঁড়ে ফেলছে। তবুও শেষ চেষ্টা হিসেবে সে দরজার দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ল। হাতের তালু রক্তাক্ত হয়ে উঠল কাঠে আঘাত করতে করতে, কিন্তু কোনো শব্দ বাইরে পৌঁছাল না। মনে হচ্ছিল, দরজার ওপারে কোনো জগতই নেই, যেন বরফঘর নিজেই তার চারপাশে এক অদৃশ্য দেয়াল তৈরি করেছে। হতাশায় অঞ্জনের গলা ফেটে গেল, আর সে শেষবারের মতো প্রাণপণে চিৎকার করে উঠল—একটা আর্তনাদ, যা কেবল প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে এলো। প্রতিধ্বনির শব্দেই তার বুক কেঁপে উঠছিল, যেন এক অচেনা শক্তি তাকে বিদ্রূপ করছে। ঠিক তখনই আলোটা হঠাৎ দপ করে জ্বলে উঠল, আর চারপাশের প্রতিটি কোণা সাদা শূন্যতায় ভরে গেল। অঞ্জন চোখ বন্ধ করলেও আলো ভেদ করে ভেতরে ঢুকে যাচ্ছিল, মস্তিষ্ককে অসাড় করে তুলছিল।

আলোয় ভেসে যেতে যেতে অঞ্জন হঠাৎ অনুভব করল, তার শরীর কাঁপছে, কিন্তু ঠান্ডা বা ভয় নয়—এটা যেন বিলীন হওয়ার কাঁপুনি। তার হাত ধীরে ধীরে স্বচ্ছ হয়ে আসছে, আঙুলগুলো ভেঙে বরফের ধুলোয় মিশে যাচ্ছে। বুকের ভেতর থেকে হাড়গোড় ভেঙে গিয়ে এক ধরনের নরম কুয়াশার মতো বেরিয়ে আসছে। সে নিজের পা নড়াতে চাইছিল, কিন্তু বুঝতে পারল তার পা নেই—শুধু সাদা আলোয় গলে যাওয়া একরাশ ছায়া। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, ব্যথা সে পাচ্ছিল না; বরং মনে হচ্ছিল, কোনো এক অজানা শক্তি তাকে টেনে নিচ্ছে নিজের মধ্যে, সমস্ত যন্ত্রণা, ভয় আর প্রতিরোধ ধীরে ধীরে নিঃশেষ করে দিচ্ছে। তার চারপাশে অসংখ্য ছায়া জড়ো হয়ে তাকে ঘিরে ধরল, তাদের হাতগুলো আর্তির মতো বাড়ানো নয়—বরং যেন তারা তাকে স্বাগত জানাচ্ছে। ফিসফিসানি এবার আর আর্তনাদ নয়, বরং এক বিষণ্ণ সুরে ভেসে এলো—“নতুন একজন এল…”।

অঞ্জনের চিৎকার থেমে গিয়েছিল, মুখ খোলা থাকলেও গলা থেকে কোনো শব্দ বেরোচ্ছিল না। পুরো শরীর আলোয় গলে গিয়ে কেবল তার চেতনা এক অদ্ভুত ভারহীনতায় ঝুলছিল। বাইরে বাজারের মানুষ হয়তো এখনো গল্প করছে বরফঘরের আলো নিয়ে, হয়তো আবারও কেউ আসবে কৌতূহল নিয়ে। কিন্তু সেই মুহূর্তে অঞ্জন বুঝতে পারল—এখন থেকে সেও সেই আলো আর ছায়ার অদ্ভুত খেলায় বন্দি হয়ে গেল। তার অস্তিত্ব মিলিয়ে গেল সাদা ঝলকানির ভেতর, কেবল এক অচেনা প্রতিধ্বনি থেকে গেল, যা হয়তো ভবিষ্যতে কোনো নতুন আগন্তুকের কানে ভেসে যাবে। শেষবারের মতো তার মনে একটিই চিন্তা এলো—সে আলোয় বিলীন হচ্ছে, কিন্তু হয়তো এই শহরের কাছে সে চিরকাল নিখোঁজ হিসেবেই থাকবে। তারপর অঞ্জনের চেতনা ভেঙে গিয়ে সম্পূর্ণভাবে আলোয় মিলিয়ে গেল, আর বরফঘর আবার আগের মতো নিশ্চুপ হয়ে গেল, কেবল বাইরে থেকে দেখা যাচ্ছিল সেই টিমটিমে অদ্ভুত আলো।

অধ্যায় ১০: নতুন গুজব

পরের দিন ভোরে পাহাড়ি শহরের আকাশ ছিল ঘন কুয়াশায় ঢাকা। হাটখোলা থেকে চায়ের দোকান, আবার কলেজের উঠোন—সব জায়গাতেই একই খবর ঘুরছিল, “অঞ্জন বাড়ি ফেরেনি।” সন্ধ্যা পর্যন্ত বাড়ির লোক তাকে খুঁজে না পেয়ে পুলিশের কাছে খবর দেয়, কিন্তু শহরের মানুষ ইতিমধ্যেই আন্দাজ করে নিয়েছিল কী ঘটেছে। কেউ কেউ বলছিল, অঞ্জন নাকি আগের রাতে বরফঘরের দিকেই গিয়েছিল। তার বন্ধুরাও অস্বীকার করতে পারেনি; বরং এক বন্ধু তো স্বীকারই করে ফেলল—অঞ্জন বহুদিন ধরেই বরফঘরের আলো নিয়ে কথা বলছিল, আর বলেছিল, একদিন সে ভেতরে ঢুকবেই। খবরটা রটে যেতেই লোকজনের মনে ভয় আর কৌতূহল মিশে উঠল। শহরের বড়রা আবারও আগের মতো সতর্ক করে দিতে শুরু করল—“বরফঘরের কাছে যেও না, ওটা শয়তানের জায়গা।” অথচ এই সতর্কবার্তাই যেন কিশোরদের আরও উৎসুক করে তুলল। অঞ্জনের নিখোঁজ হওয়ার কাহিনি মুহূর্তের মধ্যে লোককথায় রূপ নিল।

সন্ধ্যা নামতেই কয়েকজন লোক সাহস করে বরফঘরের সামনে দাঁড়িয়ে রইল। হাওয়ায় পাতার কাঁপুনি, কুয়াশায় আড়াল হয়ে থাকা ভাঙা দরজা, সব মিলিয়ে জায়গাটা যেন আরও ভুতুড়ে হয়ে উঠেছিল। ঠিক তখনই তারা দেখল—ভেতর থেকে আলো বেরোচ্ছে। কিন্তু এ আলো সেই আগের টিমটিমে ঝলকানি নয়, বরং আরও তীব্র, যেন কারও উপস্থিতি শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। “দ্যাখ, আলো বেড়েছে!”—একজন ফিসফিস করে উঠল। আরেকজন বলল, “এবার নতুন কেউ ভেতরে গেছে, তাই এমন হচ্ছে।” ভয়ে তাদের আর কাছে যাওয়ার সাহস হলো না। হাটের ভিড়ে খবর ছড়িয়ে পড়ল আগুনের মতো—বরফঘরের আলো নাকি দিন দিন বাড়ছে। কেউ দাবি করল, সে নাকি ভেতরে অঞ্জনের চিৎকার শুনেছে; আবার কেউ বলল, জানালার ফাঁক দিয়ে ভেতরে এক নতুন ছায়া নড়তে দেখেছে। সেই ছায়ার ভঙ্গি নাকি একেবারে অঞ্জনের মতো—পাতলা গড়ন, হাতে বই ধরার ভঙ্গি, যেন কোনো ছাত্রের অবয়ব আলোয় টলে উঠছে।

শহরের লোকেরা আলোচনায় আরও মগ্ন হয়ে পড়ল। কেউ বলল, বরফঘরটা আসলে একটা অভিশপ্ত জায়গা যেখানে ঢুকলেই মানুষ আলোতে মিশে যায়। কেউ যুক্তি দিল, ওটা আসলে পুরনো আত্মাদের কারাগার, আর অঞ্জন এখন তাদের সঙ্গী হয়ে গেছে। আবার কেউ ভীত কণ্ঠে বলল, হয়তো একদিন আলো এত বেড়ে যাবে যে পুরো শহরই এর ভেতরে টেনে নেবে। পুলিশ কিছুদিন খোঁজখবর চালাল, কিন্তু কোনো হদিস মিলল না। অঞ্জনের নাম যোগ হয়ে গেল হারানোদের তালিকায়, আর শহরের কাহিনিতে সে হয়ে উঠল নতুন এক ছায়া। বাচ্চারা রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে গল্প শোনে—“বরফঘরের ভেতরে অঞ্জন আছে, সে ডাকছে।” দোকানের আড্ডায় লোকজন আঙুল দিয়ে বরফঘরের দিক দেখিয়ে বলে—“ওখানে আর যাস না।” এভাবেই অঞ্জনের নিখোঁজ হওয়ার গল্প শহরের নতুন গুজব হয়ে ছড়িয়ে পড়ল, আর প্রতিটি আলো ফোটার রাতে লোকজন আতঙ্কে কাঁপতে কাঁপতে ভেবে নিল—বরফঘরের ভেতরে এখন নতুন এক ছায়া যোগ হয়েছে, যে অঞ্জনের মতোই তরুণ, কৌতূহলী, আর আলোয় বিলীন হয়ে চিরকালের মতো বন্দি।

শেষ

1000063337.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *