অতনু হালদার
সকালবেলার শান্তিনিকেতন সবসময়ই আলাদা এক আবহ তৈরি করে রাখে। সূর্যের সোনালি আলো যখন গাছপালার পাতার ফাঁক দিয়ে মাটিতে ছড়িয়ে পড়ে, তখন গোটা গ্রামটাই যেন এক অদৃশ্য ক্যানভাসে আঁকা হয়ে ওঠে। এলিসা সেই সকালেই পৌঁছেছিল এই মাটির শহরে, তার বহু প্রতীক্ষিত ফটোগ্রাফি প্রজেক্ট নিয়ে। ইউরোপের একটি নামকরা ফটোগ্রাফি ম্যাগাজিন তাকে বেছে নিয়েছিল ভারতবর্ষের গ্রামীণ শিল্প, প্রকৃতি ও মানুষের হাসিমুখ তুলে ধরার জন্য। সে আগে বহু বই ও নথিতে পড়েছে শান্তিনিকেতন নিয়ে—রবীন্দ্রনাথের প্রতিষ্ঠিত এই জায়গার সংস্কৃতি, রঙ, মাটির গন্ধ, শিল্প ও গানের গল্প। কিন্তু বাস্তবে সেই সকালেই প্রথমবার সে হাঁটছিল লাল মাটির পথ ধরে। চারপাশে সোনাঝুরির গাছ, যার পাতার ঝিরঝির শব্দ বাতাসকে যেন আরো কবিতার মতো করে তুলছিল। তার হাতে ক্যামেরা, কাঁধে ব্যাগ—সবকিছু প্রস্তুত। কিন্তু তার ভেতরে এক অদ্ভুত উত্তেজনা কাজ করছিল, যা শুধু নতুন জায়গায় আসার কারণে নয়, বরং এক অচেনা দেশ, অচেনা মানুষ, আর একেবারে নতুন অভিজ্ঞতার দরজা খোলার কারণে। হাঁটতে হাঁটতে সে খেয়াল করলো, গ্রামের মানুষজন তাকে দেখে অবাক হলেও কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে, কেউ কেউ হাসছে। এলিসা চেষ্টা করছিল তাদের সেই হাসি ক্যামেরায় বন্দি করতে, যেন হাসিটাই হয়ে ওঠে ভাষার সেতুবন্ধন।
ঠিক সেই সময়েই দূর থেকে ভেসে এলো এক সুর—এক গভীর অথচ মাটির গন্ধমাখা গলা, যা সে আগে কখনো শোনেনি। গানের সুরে ছিল এক অদ্ভুত টান, এক ধরনের খোলা মনের আর্তি, যার মধ্যে ভক্তি, প্রেম আর মুক্তির অনুসন্ধান মিশে ছিল। এলিসা থেমে দাঁড়াল। চারপাশের সব শব্দ যেন এক মুহূর্তে থেমে গেল। পাখির ডাক, হাওয়ার শব্দ, মানুষের চলাফেরা—সবকিছু যেন পেছনে মিলিয়ে গেল, আর সামনে রইলো কেবল সেই সুর। সে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল সেই দিকেই, মাটির ধুলো উড়িয়ে তার পা মিশে গেল পথে। রাস্তার মোড় ঘুরতেই সে দেখতে পেল এক তরুণ, প্রায় তিরিশ বছরের কাছাকাছি বয়স, গায়ে কমলা রঙের খোলা কাপড়, হাতে একটি দোতারা, আর চোখ বন্ধ করে সে গাইছে বাউলের গান। চারপাশে কিছু গ্রামের লোক দাঁড়িয়ে শুনছিল, কেউ কেউ হাততালি দিচ্ছিল, কিন্তু তার কণ্ঠস্বর যেন সবকিছুকে ঢেকে দিচ্ছিল। এলিসা একেবারে মন্ত্রমুগ্ধের মতো দাঁড়িয়ে পড়ল। সে গান বুঝতে পারছিল না, কারণ ভাষা ছিল তার অচেনা, কিন্তু তবুও সেই সুর সরাসরি তার হৃদয়ে প্রবেশ করছিল। মনে হচ্ছিল, এই গান শুধু কানে শোনা যায় না, এটা শিরায় শিরায় বয়ে যায়, আত্মাকে ছুঁয়ে যায়।
রুদ্র নামের সেই বাউল তরুণ গান শেষ করে যখন চোখ খুললো, তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা বিদেশিনীকে দেখে প্রথমে একটু অবাক হয়ে গেল। এলিসা তাড়াহুড়ো করে হাসল, যেন অচেনা ভাষায় কথা না বলতে পারলেও হাসিই তার সবচেয়ে বড় অস্ত্র। তার গলায় ঝোলানো ক্যামেরা সে হাতে তুলে নিল এবং রুদ্রের দিকে তাকিয়ে ছবি তোলার ভঙ্গি করলো। রুদ্র প্রথমে কিছুটা দ্বিধায় ছিল, কিন্তু এলিসার চোখের উচ্ছ্বাস আর আগ্রহ দেখে ধীরে ধীরে মৃদু হেসে উঠলো। সেই হাসির মধ্যেই ছিল সহজ-সরল এক উষ্ণতা। দু’জনের মধ্যে কোনো শব্দ বিনিময় হলো না, তবুও এক অদৃশ্য সেতু গড়ে উঠলো। এলিসা ক্যামেরায় ক্লিক করতে লাগল, আর রুদ্র আবার গাইতে শুরু করলো—এইবার যেন সে শুধু এলিসার জন্যই গাইছে। চারপাশের লোকজনের কোলাহল, গ্রামের ব্যস্ততা, ধুলো মাখা পথ সবকিছু মিলিয়ে এক মুহূর্ত তৈরি হলো, যা সময়কে থামিয়ে দিল। এলিসার মনে হলো, হয়তো এই পথচলার শুরুতেই সে এমন এক সঙ্গীকে পেয়ে গেছে, যে তাকে ভাষার সীমা ছাড়িয়ে জীবনের আরেকটি সত্য দেখাতে চলেছে। তার বুকের ভেতর যেন ঢেউ তুলছিল এক অদ্ভুত স্পন্দন, যার নাম সে জানে না, কিন্তু অনুভব করতে পারছে গভীরভাবে—সেটাই ছিল রুদ্রের গান।
***
রুদ্রের গান শোনার সেই প্রথম মুহূর্তের পর থেকেই এলিসার মনে এক অদ্ভুত আকর্ষণ তৈরি হয়েছিল। সে জানতো না কেন, কিন্তু তার ক্যামেরার লেন্সের ভেতরে সে ক্রমাগত খুঁজতে লাগলো সেই হাসিমাখা মুখ আর দোতারার ছোঁয়া। সে যতবার রাস্তায় হাঁটতো, তার কানে ভেসে আসতো গ্রামীণ সুর, আর তার চোখ স্বাভাবিকভাবে সেই দিকেই ঘুরে যেত। কিন্তু সমস্যা হলো, এলিসা বাংলা একেবারেই জানে না, আর রুদ্রও ইংরেজি বলতে পারে না। তাদের মধ্যে যেন এক বিশাল দেয়াল দাঁড়িয়ে ছিল, যা ভেঙে এগোনো কঠিন। একদিন বিকেলে এলিসা হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেল সেই একই মাঠে যেখানে রুদ্র গাইছিল। লোকজনের ভিড় খুব বেশি ছিল না, কয়েকজন গ্রামবাসী বসে গান শুনছিল। এলিসা এবার সামনে বসে গেল, চোখ মেলে শুধু তাকিয়ে রইলো রুদ্রের দিকে। তার দৃষ্টিতে ছিল প্রশংসা আর গভীর কৌতূহল। রুদ্র গান থামিয়ে একবার তাকালো তার দিকে, চোখে পড়লো বিদেশিনী ফটোগ্রাফারের ক্যামেরা প্রস্তুত, যেন প্রতিটি মুহূর্ত সে ধরে রাখতে চাইছে। রুদ্রের মনে হলো—এই মেয়েটি শুধুই ছবি তুলছে না, সে যেন গানের ভেতর ঢুকতে চাইছে, বুঝতে চাইছে এমন কিছু, যা ভাষা দিয়ে বোঝানো যায় না।
তবুও রুদ্র সহজে কাছে আসতে পারছিল না। তার ভেতরে ছিল দ্বিধা। গ্রামের মানুষের কৌতূহলী দৃষ্টি, বিদেশিনীকে ঘিরে চাপা গুঞ্জন—সবই তাকে অস্বস্তি দিচ্ছিল। সে ভেবেছিল, হয়তো এলিসা কেবল পর্যটক, ছবির জন্য এসেছে, তারপর চলে যাবে। এই ধরনের মানুষ সে আগেও দেখেছে। অনেক সময় গ্রামে বিদেশি আসতো, ছবি তুলতো, আর ফিরে গিয়ে সেই ছবি বিক্রি করতো, অথচ গ্রামের মানুষের গল্প কিংবা দুঃখ কেউই জানতো না। তাই রুদ্র চায়নি এলিসাকে সহজে বিশ্বাস করতে। কিন্তু একইসাথে তার চোখে যে নিষ্পাপ উচ্ছ্বাস, যে একাগ্রতা, তা তাকে অস্বস্তির পাশাপাশি নাড়িয়ে দিল। এলিসা বুঝতে পারলো, রুদ্র দ্বিধায় আছে। তাই সে কোনো প্রশ্ন করার চেষ্টা করলো না, কোনো শব্দও উচ্চারণ করলো না। কেবল ক্যামেরার ভেতর দিয়ে তাকিয়ে সে হাসলো, যেন বোঝাতে চাইলো—“আমি শুধু দেখতে এসেছি, শুনতে এসেছি, তোমার সত্যিটাকে ধরতে চাইছি।” রুদ্রও একটু হেসে জবাব দিল, খুব সামান্য, কিন্তু সেই ছোট্ট হাসিতেই যেন দূরত্ব একটু কমে এলো।
দিন কেটে যেতে লাগলো। এলিসা প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে সেই রাস্তায় হেঁটে আসতো। কখনো রুদ্র তাকে দূর থেকে দেখে নিত, কখনো এলিসা এসে তার গান শোনার সময় পাশে বসতো। তাদের মধ্যে কোনো ভাষা বিনিময় হতো না, অথচ প্রতিটি দৃষ্টিতে, প্রতিটি অঙ্গভঙ্গিতে একধরনের সম্পর্ক তৈরি হচ্ছিল। এলিসা হাত তুলে অভিবাদন জানাতো, রুদ্র মাথা নেড়ে হাসতো। কখনো কখনো রুদ্র গান গাওয়ার সময় চোখ মেলতো এলিসার দিকে, যেন সে-ই শ্রোতা। এলিসা ক্যামেরা তুলতে তুলতে অনুভব করতো, এ যেন কেবল ছবি নয়—এ যেন জীবনের অন্য এক রঙ ধরা পড়ছে লেন্সে। তবুও দূরত্ব ছিল অটুট। সে কথা বলতে চাইতো, প্রশ্ন করতে চাইতো, কিন্তু ভাষা তার পথ আটকাতো। অন্যদিকে রুদ্রও চায়নি তাড়াহুড়ো করে কোনো বন্ধন তৈরি করতে। তাই তাদের সম্পর্ক দাঁড়িয়ে রইলো এক অদ্ভুত সীমারেখায়—কথাহীন আগ্রহ আর অদ্ভুত দূরত্বের মাঝখানে। তবুও প্রতিদিনের দেখা, প্রতিদিনের হাসি, আর প্রতিদিনের দৃষ্টি বিনিময় তাদের ভেতরে বুনে তুললো এক অদৃশ্য সুতোর বন্ধন, যা তারা কেউই ভাঙতে পারলো না।
***
এলিসার দিনগুলো শান্তিনিকেতনে ধীরে ধীরে অন্য রকম ছন্দ পেতে শুরু করলো। সে প্রতিটি সকালকে ব্যবহার করতো গ্রাম ও প্রকৃতিকে লেন্সে ধরে রাখার জন্য। লাল মাটির পথে ছেলেমেয়েদের খেলা, গরুর গাড়ি নিয়ে যাওয়া কৃষক, ধুলো মাখা গাছের তলায় বসে থাকা বৃদ্ধদের আলাপ—সবকিছু তার কাছে নতুন আর আশ্চর্যজনক। কিন্তু এর ভেতরেও রুদ্র ছিল তার ক্যামেরার অন্যতম প্রিয় বিষয়। এলিসা লক্ষ্য করলো, রুদ্র শুধু গান গায় না, তার চোখে, তার দেহভঙ্গিতে, এমনকি তার নীরবতাতেও একধরনের গল্প লুকিয়ে আছে। সে যতবার ক্যামেরার শাটার টিপতো, ততবার মনে হতো তার লেন্সের ভেতর দিয়ে রুদ্রের ভেতরের এক অদৃশ্য জগৎ ফুটে উঠছে। একদিন সকালের আলোয়, সোনাঝুরির ছায়া মাটিতে যখন সোনালি রঙের নকশা এঁকে রেখেছিল, এলিসা রুদ্রকে গান গাওয়ার সময় চুপচাপ ক্যামেরায় ধরে ফেললো। সেই ছবিতে রুদ্রের চোখ বন্ধ, ঠোঁটে এক অদ্ভুত শান্তির রেখা, দোতারার তারে সূর্যের আলো খেলে যাচ্ছে—দৃশ্যটা এতটাই অপার্থিব ছিল যে এলিসা শ্বাস আটকে রেখেছিল কয়েক সেকেন্ড। সে বুঝতে পারলো, ক্যামেরার মাধ্যমে শুধু দৃশ্যই ধরা পড়ছে না, ধরা পড়ছে রুদ্রের আত্মার এক টুকরো অংশ।
কিন্তু ছবির এই খেলা একদিন নতুন মোড় নিলো। এলিসা সাধারণত ছবিগুলো নিজের ল্যাপটপে রেখে দিত, মাঝে মাঝে গ্রামের শিশুদের দেখাত, আর তারা হেসে উঠতো নিজেদের দেখে। কিন্তু রুদ্রকে সে কখনো ছবি দেখায়নি, হয়তো ভেবেছিল সে বুঝবে না ছবির মূল্য, অথবা লজ্জা পাবে। তবে এক বিকেলে, যখন গ্রাম প্রায় নিস্তব্ধ, কেবল হাওয়ার শব্দ ভেসে আসছিল, এলিসা সাহস করে রুদ্রকে ডেকে ল্যাপটপ খুলে দিল। স্ক্রিনে ভেসে উঠলো রুদ্রর গান গাওয়ার সময়ের কিছু ছবি—কখনো চোখ বন্ধ, কখনো মুখে হাসি, কখনো আবার গভীর চিন্তায় ডুবে থাকা। রুদ্র প্রথমে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। নিজের মুখ, নিজের ভঙ্গি, নিজের সত্তা এত সুন্দরভাবে কখনো সে দেখেনি। ছবিগুলো দেখে তার মনে হলো—যেন নিজের অজানা দিকগুলোও ধরা পড়ে গেছে এই বিদেশিনীর ক্যামেরায়। সে ধীরে ধীরে ছবিগুলো স্পর্শ করতে লাগলো, যেন সেই ছবির ভেতর দিয়ে নিজের সত্যিকে ছুঁতে চাইছে। এলিসা তার প্রতিক্রিয়া দেখে চুপচাপ হাসলো, আর সেই হাসিতে কোনো গর্ব ছিল না, ছিল শুধু আন্তরিক আনন্দ। রুদ্র চোখ তুলে একবার তাকালো তার দিকে, সেই দৃষ্টিতে এক অদ্ভুত আত্মীয়তার অনুভূতি জেগে উঠলো, যেন তারা দু’জন হঠাৎ করেই কাছাকাছি চলে এসেছে।
এরপর থেকে গান আর ছবি হয়ে উঠলো তাদের সবচেয়ে বড় সেতু। রুদ্র যখন গান গাইতো, এলিসা তার ছবি তুলতো, আর প্রতিটি ছবিতে সে খুঁজে পেত গানের ভেতরের অনুভূতি। অন্যদিকে রুদ্র যখন ছবিগুলো দেখতো, তখন তার মনে হতো এই বিদেশিনী শুধু একজন ফটোগ্রাফার নয়, সে এক শ্রোতা, যে তার গানকে বোঝে ভিন্নভাবে। তাদের ভাষার সীমা তখন তুচ্ছ হয়ে গেল, কারণ ছবির ভাষা আর গানের ভাষা দুটোই একসাথে তৈরি করলো এক অদ্ভুত সংলাপ, যা শব্দ ছাড়াই সব বলে দেয়। কখনো রুদ্র এলিসার ক্যামেরার দিকে হাত তুলে মৃদু হাসতো, যেন বলতে চাইছে—“তুমি আমার গানকে ধরতে পেরেছ।” আর কখনো এলিসা ক্যামেরা নামিয়ে শুধু তার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতো, যেন তার ভেতরের আলোকে বুঝতে চাইছে। ধীরে ধীরে তারা দু’জনেই বুঝতে পারলো—তাদের এই সম্পর্ক শুধু দেখা বা শোনার নয়, এটা এক গভীর বোঝাপড়ার শুরু। এলিসার লেন্স আর রুদ্রর গান মিলেমিশে তৈরি করলো এমন এক বন্ধন, যা গ্রামীণ বাতাসের মতোই অদৃশ্য অথচ অনিবার্য।
***
সন্ধ্যার মৃদু আলোয় শান্তিনিকেতনের পল্লিগাঁও যেন নতুন রঙে সেজে উঠল। পাকা মাটির রাস্তায় ছোট ছোট প্রদীপ জ্বলছে, চারপাশে তালের, খেজুরের ও কদমগাছের ছায়া নেচে উঠছে সেই আলোয়। গ্রামের মানুষজন, ছোট থেকে বড়, সবাই আসছে জমায়েতে—কারও হাতে মাটির কলসি, কারও হাতে তালপাতার হাতপাখা। এলিসার কাছে এ ছিল একেবারেই নতুন অভিজ্ঞতা। রুদ্র তাকে বলেছিল, “আজ বাউল সন্ধ্যা, এসো, আমাদের গান শোনো।” সেই আহ্বান তার কৌতূহল বাড়িয়ে তুলেছিল। শাড়ি-পরা মহিলারা, ধুতি-পাঞ্জাবি পরা পুরুষেরা, সবাই একটি বৃত্ত তৈরি করে বসেছে। মাঝখানে খোলা মঞ্চ—মাটি দিয়েই বানানো, কিন্তু তাতে সাজানো ঢোল, একতারা, খমক, দোতরা, আর কিছু কারুকার্যময় যন্ত্র। এলিসা মুগ্ধ হয়ে চারপাশে তাকাচ্ছিল, আর চোখ রাখছিল রুদ্রর দিকে, যে তখন সাদা ধুতি ও রঙিন গামছা পরে নিজের একতারার তার টানছিল। তার চোখে যেন অন্যরকম এক আলো, এক অন্তর্মুখী আগুন, যা এলিসাকে গভীরভাবে আকৃষ্ট করছিল। এই পরিবেশে এসে ভাষার বাধা যেন আর ততটা বড় মনে হচ্ছিল না। এলিসা অনুভব করছিল, এই সন্ধ্যায় কিছু একটা তার জীবনে বদলে যাবে।
গান শুরু হতেই চারদিকের পরিবেশ যেন নতুন প্রাণ পেল। ঢোলের তাল ধীরে ধীরে বাড়তে লাগল, তার সঙ্গে মিলিয়ে একতারা ও দোতরার সুর বাজতে লাগল। রুদ্র যখন গাইতে শুরু করল, এলিসার মনে হল, সে যেন বুঝতেই পারছে প্রতিটি শব্দ, যদিও বাংলার ভাষা তার অচেনা। তার কণ্ঠে ছিল এক অদ্ভুত শক্তি, একদিকে গভীর, অন্যদিকে কোমল। সেই গানে ভেসে আসছিল জীবনের সরলতা, ভালোবাসা, মানুষ আর প্রকৃতির একাত্মতা। গ্রামীণ মহিলারা তালি দিচ্ছিল, কেউবা নাচছিল, আর ছেলেমেয়েরা গানের তালে দৌড়াচ্ছিল চারপাশে। এলিসা তার ক্যামেরা বের করে মুহূর্তগুলো ধরে রাখার চেষ্টা করল। লেন্সের মধ্যে দিয়ে সে যখন রুদ্রকে দেখল, মনে হল সে কেবল একজন গায়ক নয়, বরং এক জীবন্ত শিল্পকর্ম, যার মধ্যে দিয়ে একটি সংস্কৃতি, একটি দার্শনিকতা, একটি অদ্ভুত গভীরতা প্রবাহিত হচ্ছে। হঠাৎ তার মনে হল, এই ছবি শুধু একটি প্রজেক্টের অংশ নয়, তার নিজের আত্মারও অংশ হয়ে উঠছে। রুদ্রও গান গাইতে গাইতে একবারের জন্য চোখ তুলে এলিসার দিকে তাকাল। সেই মুহূর্তে তাদের মধ্যে ভাষাহীন এক আলাপ চলল, যেখানে সুর, দৃষ্টি আর আবেগই ছিল প্রধান সেতুবন্ধন।
সন্ধ্যার গানের শেষ পর্বে, সব বাউল গায়ক-গায়িকা মিলে একটি সমবেত গান শুরু করল। মাটির গন্ধ, প্রদীপের আলো, আর চারপাশের মানুষের উল্লাস মিলেমিশে তৈরি করল এক জাদুকরী পরিবেশ। এলিসা ক্যামেরা নামিয়ে রাখল, শুধু চোখ দিয়ে দেখতে লাগল। তার মনে হচ্ছিল, এ অভিজ্ঞতা ছবি বা লেখায় পুরোপুরি ধরা যাবে না, এটাকে অনুভব করতে হয়। গানের তালে গ্রাম্য মেয়েরা নেচে উঠল, আর রুদ্রর গলায় যেন উঠে এল আকাশ ভরা যন্ত্রণার সঙ্গে মুক্তির সুর। এলিসার চোখ ভিজে উঠল অজান্তে। এই প্রথমবার সে অনুভব করল, শিল্প শুধু বাহ্যিক রূপ নয়, এটা আত্মার সেতুবন্ধন। অনুষ্ঠান শেষ হলে রুদ্র ধীরে ধীরে তার একতারা নামিয়ে রাখল, আর এলিসার দিকে তাকিয়ে হাসল। ভাষা তাদের মধ্যে এখনও দূরত্ব তৈরি করে রাখছিল, কিন্তু সেই হাসি বলছিল অনেক কিছু—”তুমি বুঝেছো, আমি তোমাকে বুঝেছি।” এলিসা মৃদু মাথা নাড়ল। তার মনে হল, এই বাউল সন্ধ্যা কেবল একটি সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞতা নয়, বরং তার জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সন্ধ্যাগুলোর একটি। সে জানত, এই রাতের পর তাদের বন্ধন আর আগের মতো থাকবে না, কিছু একটা গভীর, অদৃশ্য শক্তি তাদের দু’জনকে আরও কাছে টেনে নিচ্ছে।
***
শান্তিনিকেতনের সকালের আলোয় এলিসা আবারও বেরিয়েছিল ক্যামেরা হাতে। গ্রামীণ পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে সে দেখল রুদ্র তার প্রিয় পিপুলগাছের নিচে বসে একতারা টানছে। হাওয়ায় ধুলো উড়ছিল, কিন্তু সেই ধুলোর ভেতরেই যেন লুকিয়ে ছিল মানুষের গল্প, মানুষের যন্ত্রণা আর আনন্দের কণ্ঠস্বর। এলিসা কাছে গিয়ে বসতেই রুদ্র গান থামাল। তার চোখে একরাশ মমতা, তবে কিছুটা দ্বিধাও। তারপর ধীরে ধীরে সে বলতে শুরু করল তার জীবনের গল্প, ভাঙা ইংরেজি আর অধিকাংশ বাংলা শব্দে। এলিসা একাগ্র মনোযোগ দিয়ে শুনছিল, আর প্রয়োজনে ছোট ছোট অঙ্গভঙ্গি বা চোখের ভঙ্গি দিয়ে বুঝে নিচ্ছিল। রুদ্র বলছিল, কিভাবে তার বাবা ছিলেন একজন কৃষক, কিন্তু জমি ধীরে ধীরে বন্ধক রাখতে রাখতে আর ফেরত আনতে পারেননি। আর্থিক সংকটে পরিবার ভেঙে পড়লেও গানই ছিল তার একমাত্র ভরসা। ছোটবেলা থেকেই মেলা, হাটে সে গাইত, আর মানুষজন তার গানের ভেতর নিজেদের দুঃখকথা খুঁজে পেত। সেই গানই তার কাছে ছিল প্রতিবাদও, আবার আশ্রয়ও। এলিসা তার নোটবুকে শব্দে শব্দে লিখে নিচ্ছিল, যেন এই গল্প তার ক্যামেরার ছবির মতোই অমর হয়ে থাকে।
গ্রামের বাস্তবতাও রুদ্র খুলে বলছিল। সে বলছিল, কিভাবে চাষীরা বছরের পর বছর খরার ভয়ে ভোগে, কিংবা কখনও অতিবৃষ্টিতে ধান নষ্ট হয়ে যায়। কিভাবে গ্রামে অনেকে শহরে চলে যায় জীবিকার খোঁজে, আবার কেউ কেউ গরিবি সইতে না পেরে চুপচাপ হারিয়ে যায়। কিন্তু এই কষ্টের ভেতরেও বেঁচে থাকে আশার আলো। রুদ্র বলছিল, গানই সেই আলো জ্বালিয়ে রাখে। বাউলগান মানে শুধু আধ্যাত্মিকতা নয়, বরং মাটির মানুষের কণ্ঠ, যা জীবনের প্রতিটি বাঁকে এক নতুন সাহস দেয়। এলিসা শুনতে শুনতে বারবার তার ক্যামেরা তুলছিল—রুদ্রর চোখের গভীরতা, গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে আসা আলো, কিংবা দূরে মাঠে কাজ করা কৃষকের দৃশ্য। এই সবকিছুই যেন গল্পের সঙ্গে মিলেমিশে এক বিশাল ক্যানভাস তৈরি করছিল। রুদ্র মাঝে মাঝে তার গানও শুরু করছিল, যেন কথার সঙ্গে সুরের মেলবন্ধন ঘটছে। সেই সুরে এলিসা অনুভব করল, যদিও সে ভাষাটা পুরোপুরি বোঝে না, তবুও আবেগের ঢেউ তার ভেতরে পৌঁছে যাচ্ছে। তার মনে হচ্ছিল, এই গল্পগুলো কেবল শব্দ নয়, এগুলো হলো একেকটা হৃদস্পন্দন, যা মানুষের বেঁচে থাকার স্বর।
শেষ বিকেলের দিকে যখন আলো নরম হয়ে এল, তখন এলিসা ও রুদ্র পাশাপাশি বসেছিল। এলিসা তার নোটবুকের পাতা উল্টে দেখাল—বাংলা-ইংরেজি মিশিয়ে লেখা, আর পাশে তার আঁকা ছোট ছোট স্কেচ, কখনও গাছের, কখনও রুদ্রর মুখের, আবার কখনও গ্রামীণ কোনো দৃশ্যের। রুদ্র অবাক হয়ে দেখল, কিভাবে এক বিদেশি মেয়ের চোখে তার গ্রামের ছবি ধরা পড়েছে। সে মৃদু হেসে বলল, “তুমি তো আমাদের গল্প বুঝছো।” এলিসা উত্তর দিল ইংরেজিতে, কিন্তু সেই চোখের দৃষ্টিতেই বোঝা গেল—হ্যাঁ, সে সত্যিই বোঝে। রুদ্র তখন ধীরে ধীরে বলল, “গল্প মানে শুধু শব্দ নয়, গল্প মানে গান, ছবি, মাটির গন্ধ—সব মিলিয়ে এক ভাষা।” এলিসা মাথা নাড়ল, আর তার চোখে ভেসে উঠল এক অদ্ভুত আলো। সে বুঝতে পারল, এই অভিজ্ঞতা কেবল একটি প্রজেক্ট নয়, বরং তার জীবনের এক গভীর শিক্ষণ। রুদ্রর গল্প, গ্রামের বাস্তবতা, আর সেই গান—সবকিছু মিলে যেন এক নতুন ভাষা তৈরি করল, যেটা না বাংলা, না ইংরেজি, বরং হৃদয়ের ভাষা। আর সেই ভাষায় তারা দুজনই সমানভাবে একে অপরকে বুঝতে পারছিল। এলিসা মনে মনে জানল, এ গল্প তার ক্যামেরার লেন্সে নয়, তার হৃদয়ে চিরকাল বেঁচে থাকবে।
***
দুপুরের সূর্যের আলো যখন ধীরে ধীরে নরম হয়ে এল, তখন শান্তিনিকেতনের গ্রামীণ মাঠ ভরে উঠেছিল শিশুদের হাসি আর যুবকদের হুল্লোড়ে। এলিসা ক্যামেরা নিয়ে সেখানে পৌঁছে গিয়েছিল—সে চেয়েছিল গ্রামের ছেলেমেয়েদের খেলা আর আনন্দের ছবি তুলতে। মাঠে তখন লাট্টু ঘোরানো, দড়ি টানাটানি আর কাবাডির মতো খেলাগুলো চলছিল। ধুলো উড়ে চারদিকে ঝাপসা পরিবেশ তৈরি করছিল, কিন্তু সেই ধুলোতেও যেন ছিল এক রকম উজ্জ্বলতা। এলিসা মুগ্ধ হয়ে চারদিকে তাকাচ্ছিল, তার ক্যামেরা ব্যস্ত ছিল হাসি আর দৌড়ঝাঁপ ধরে রাখতে। ঠিক তখনই রুদ্র হঠাৎ পেছন থেকে এসে তার ক্যামেরার লেন্সের সামনে হাত নেড়ে মজা করল। এলিসা চমকে উঠলেও পরে হেসে ফেলল, আর রুদ্রর এই মজার ভঙ্গি মুহূর্তেই তার মন হালকা করে দিল। তারা মাঠের ধারে বসে খেলা দেখছিল, মাঝে মাঝে একে অপরকে তাকিয়ে হাসছিল, যেন ভাষার প্রয়োজন নেই—চোখের ভঙ্গি, হাতের ইশারাই সব কিছু বোঝাতে যথেষ্ট। এলিসা কখনও রুদ্রর হাসিতে ভরে উঠছিল, আবার কখনও তার গানের সুরে মুগ্ধ হচ্ছিল, আর রুদ্র বিস্মিত হচ্ছিল কিভাবে এক বিদেশিনী মেয়ে এত সহজে গ্রামের এই সরল আনন্দকে নিজের মধ্যে টেনে নিচ্ছে।
মাঠের খেলায় যখন গ্রামবাসীরা এলিসাকে ডাকল, সে প্রথমে দ্বিধা করলেও পরে সাহস করে যোগ দিল। রুদ্র তাকে প্রায় জোর করেই দড়ি টানাটানির খেলায় নিয়ে গেল। গ্রামের মেয়েরা এলিসাকে তাদের দলে নিল, আর রুদ্র ছিল প্রতিদ্বন্দ্বী দলে। শুরু হলো টানাটানি—এলিসার মুখ লাল হয়ে উঠল, চুল এলোমেলো, কিন্তু চোখে হাসির ঝিলিক। রুদ্র বারবার তার দিকে তাকিয়ে মজা করছিল, আর এলিসা হেসে ক্যামেরা নামিয়ে খেলা চালিয়ে যাচ্ছিল। শেষে হেরে গেল রুদ্রর দল, আর এলিসার দল জিতে উঠল উল্লাসে। সবাই হেসে লুটোপুটি খেল, আর সেই হাসির ভেতরে ভাষার কোনো প্রয়োজন রইল না। রুদ্র হেসে বলল বাংলায়, “আজ তুমি জিতেছো।” এলিসা শব্দটা পুরোপুরি বুঝতে না পারলেও তার কণ্ঠের সুরে অর্থটা স্পষ্ট হয়ে গেল। তারপর তারা একসাথে মাঠের ঘাসে বসে, ধুলো ঝেড়ে, গল্প করার চেষ্টা করল। এলিসা ইংরেজিতে ছোট ছোট বাক্য বলছিল, রুদ্র ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে উত্তর দিচ্ছিল, মাঝে মাঝে হাত দিয়ে ভঙ্গি দেখিয়ে বোঝাচ্ছিল। সেই অসম্পূর্ণ কথোপকথনের ভেতরেই জন্ম নিচ্ছিল এক সম্পূর্ণ বোঝাপড়া। হাসি, ঠাট্টা, মজার খেলাধুলা—সব মিলিয়ে তাদের সম্পর্কের মধ্যে নতুন এক উষ্ণতা তৈরি হচ্ছিল।
বিকেলের আলো যখন ধীরে ধীরে কমে এল, তখন মাঠ ফাঁকা হয়ে গেল। এলিসা আর রুদ্র তখনও বসেছিল মাঠের ধারে, হাতে ধুলো মাখা ঘাসের শাখা। বাতাসে শিমুল ফুলের লাল পাপড়ি উড়ছিল, আর সেই দৃশ্যকে আরও সিনেমাটিক করে তুলছিল। এলিসা ক্যামেরা তুলল, রুদ্রকে ফ্রেমে আনল, আর বলল ছোট্ট করে, “Smile।” রুদ্র বোঝেনি, কিন্তু তার দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিক হাসি ফুটে উঠল। সেই হাসি ছিল অকৃত্রিম, কোনো ভান ছাড়া—যেন বন্ধুত্ব, ভালোবাসা আর বিশ্বাস সব একসাথে মিশে গেছে। এলিসা সেই মুহূর্তে বুঝল, এ শুধু ফটোগ্রাফি প্রজেক্ট নয়, এ তার জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান অভিজ্ঞতা। রুদ্রও উপলব্ধি করল, এই বিদেশিনী মেয়েটি তার জীবনে এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এসেছে—যেখানে খেলা, গান, হাসি আর চোখের ইশারাই এক অদ্ভুত ভাষা তৈরি করেছে। তারা দুজনই চুপচাপ বসে রইল, মাঠের শেষ আলো উপভোগ করল, আর তাদের চোখে এক অনুচ্চারিত প্রতিশ্রুতি ঝলমল করছিল—ভাষা যত বাধা দিক না কেন, হাসি আর খেলাধুলাই তাদের বন্ধনকে আরও শক্ত করে তুলবে।
***
শান্তিনিকেতনের আকাশ সেদিন ছিল নীলাভ, হাওয়ায় হালকা শিউলি ফুলের গন্ধ মিশে ছিল। এলিসা তার ক্যামেরা নিয়ে রুদ্রর সঙ্গে বেরিয়েছিল। তারা হাঁটছিল গ্রামের সরু পথ ধরে, দু’পাশে কাশফুলের দোল আর দূরে সোনাঝুরির গাছের ছায়া। হঠাৎ রুদ্র থেমে গেল। তার চোখে যেন এক অন্যরকম আলো, সে একতারা হাতে তুলে নিল। এলিসা অবাক হয়ে দেখল, রুদ্রর মুখের গাম্ভীর্য বদলে গেছে—যেন সে নিজেই এক প্রবাহমান স্রোতে ডুবে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে সে শুরু করল এক বাউল সুর, যার প্রতিটি শব্দ এলিসা বুঝতে পারছিল না, কিন্তু সেই কণ্ঠের ভেতর থেকে ভেসে আসা অনুভূতি তার হৃদয়কে কাঁপিয়ে দিচ্ছিল। গান শেষ হলে রুদ্র কিছুটা ভাঙা ইংরেজি, কিছুটা বাংলা আর অনেকটা অঙ্গভঙ্গিতে বোঝাতে লাগল—“বাউল মানে শুধু গান নয়, এটা হলো প্রেমের ভাষা, এটা হলো বিশ্বাসের যাত্রা, এটা হলো ভেতরের দরজা খুলে দেওয়ার শক্তি।” এলিসা চোখ বড় বড় করে শুনছিল, তার হাতে ধরা ক্যামেরা যেন কেঁপে উঠছিল আবেগে। সে বোঝার চেষ্টা করছিল কীভাবে রুদ্রর এই গান মানুষকে কেবল আনন্দই দেয় না, বরং মাটির সঙ্গে, আকাশের সঙ্গে, আর একে অপরের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক গড়ে তোলে।
তারা একটি পুকুরপাড়ে বসল। চারপাশে নীরবতা, শুধু ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। রুদ্র আবারও গান ধরল, এবার আরও গভীর সুরে। এলিসা তার ক্যামেরা দিয়ে রুদ্রকে ফ্রেমবন্দি করল—একতারা হাতে, চোখ আধো বন্ধ, আর মুখে এক অদ্ভুত শান্তির ছায়া। সে ছবিগুলো তুলছিল, কিন্তু বারবার মনে হচ্ছিল, এই অনুভূতিকে ক্যামেরার লেন্সে বন্দি করা সম্ভব নয়। তবু চেষ্টা করছিল, কারণ তার মনে হচ্ছিল, রুদ্রর গানই তার প্রজেক্টের মূল প্রাণ। রুদ্র গান থামিয়ে এলিসার দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি ছবি তোলো, কিন্তু ভেতরের ছবি কীভাবে ধরবে?” এলিসা তখন মৃদু হেসে ক্যামেরা বুকে চেপে ধরে বলল, “এই লেন্স শুধু চোখে দেখে না, হৃদয়েও শোনে।” যদিও কথাগুলো রুদ্র পুরোপুরি বুঝল না, কিন্তু এলিসার চোখের দৃষ্টি তাকে বুঝিয়ে দিল যে মেয়েটি তার গানের মূল সত্যটা উপলব্ধি করতে শুরু করেছে। সেই মুহূর্তে তারা দু’জন এক অদৃশ্য সেতুতে দাঁড়াল—ভাষার বাঁধা ভেঙে অনুভূতির ভাষা দিয়ে তৈরি হলো এক গভীর সম্পর্ক।
সন্ধ্যা নামল ধীরে ধীরে, আকাশে চাঁদের আলো পড়তে শুরু করল। তারা হাঁটছিল আবার, এবার নীরবে। রুদ্র হঠাৎ থেমে দাঁড়াল, আঙুল তুলে আকাশ দেখাল, তারপর বুকের উপর হাত রেখে বলল, “প্রেম।” আবার চোখের দিকে তাকিয়ে হাত দুটি জোড় করে বলল, “আস্থা।” শেষে বুকের ভেতরে একতারা চেপে ধরে চোখ বন্ধ করে বলল, “দরজা খুলে দাও।” এলিসা প্রথমে কিছুটা বিভ্রান্ত হলেও মুহূর্তের মধ্যে বুঝতে পারল—এটাই বাউলের দর্শন, এটাই রুদ্র তাকে শেখাচ্ছে। সে তখন ক্যামেরা নামিয়ে মৃদু হেসে মাথা নাড়ল, যেন বলতে চাইছে, “আমি শিখছি।” রুদ্র তখন হেসে উঠল, আর সেই হাসি ছিল মুক্তির মতো, সুরের মতোই স্বচ্ছ। এলিসার মনে হলো, সে আজ কেবল একজন গায়ককেই নয়, বরং একজন দার্শনিককে আবিষ্কার করেছে। তার ছবি, তার লেখা, সবকিছুই যেন নতুন অর্থ পেল এই বাউল দর্শনের ভেতর দিয়ে। রাতের আকাশে জোনাকি জ্বলছিল, আর তাদের দু’জনের নীরবতায় বাউলের সুর লুকিয়ে ছিল। এলিসা অনুভব করল, এ শুধু একটা প্রজেক্ট নয়, এ তার আত্মার যাত্রা—যেখানে গান, প্রেম, আস্থা আর খোলা দরজা তাকে এক নতুন জীবনের শিক্ষা দিচ্ছে।
***
শরতের নীল আকাশের নিচে শান্তিনিকেতনের পথ যেন আরও রঙিন হয়ে উঠেছিল। এলিসা হাতে ক্যামেরা আর রুদ্র কাঁধে একতারা নিয়ে বেরিয়েছিল সকাল সকাল। তাদের পরিকল্পনা ছিল—গ্রামের বিভিন্ন কোণে ঘুরে দেখা, ছবি তোলা আর গান সংগ্রহ করা। কিন্তু এর মাঝেই জন্ম নিল এক নতুন খেলা—সোনাঝুরি খোঁজার খেলা। রুদ্র বলেছিল, “এই গাছের নিচে সোনাঝুরি ঝরে পড়ে, এ শুধু ফুল নয়, এ হলো সৌন্দর্যের প্রতীক।” এলিসা সেই কথাটা পুরোপুরি বোঝেনি, কিন্তু চোখে মুগ্ধ দৃষ্টি নিয়ে খুঁজতে শুরু করল হলুদ ঝরে পড়া ফুলগুলো। কখনও মাঠের ধারে, কখনও মাটির রাস্তায় তারা দুজন খুঁজে ফিরছিল ছোট্ট হলুদ ফুল, যা হাওয়ায় উড়ে এসে কোথাও পড়ে আছে। এলিসার কাছে এটা ছিল এক নতুন অভিযাত্রা, যেন ক্যামেরার লেন্সে বন্দি করার মতো এক খোলা খেলা। আর রুদ্রর কাছে এটা ছিল জীবনের প্রতীক—যা খুঁজতে হয়, পেতে হয়, আবার হারাতেও হয়। দুজনের হাসি, অঙ্গভঙ্গি আর সেই খোঁজের উত্তেজনা মিলেমিশে তাদের ভেতরে এক অদ্ভুত ঘনিষ্ঠতা তৈরি করছিল।
তাদের ঘোরার পথে এলিসা ক্যামেরায় বন্দি করছিল গ্রামের মানুষের মুখ, গরুর গাড়ি, নদীর ধারে খেলা করা বাচ্চা কিংবা বাজারের ভিড়। প্রতিটি ছবির ভেতরে সে খুঁজছিল এক ধরনের গল্প, যা শুধু দৃশ্য নয়, অনুভূতিও বহন করে। রুদ্র এই সময় গান গাইছিল, কখনও তাকে থামিয়ে বলছিল, “এই গান হলো মাটির কথা, এই গান হলো মানুষের কষ্ট।” এলিসা সেই গান শোনার সময় ক্যামেরা নামিয়ে রাখত, কারণ লেন্সে ধরা সম্ভব নয় এমন অনুভূতি তার ভেতর জাগ্রত হচ্ছিল। হঠাৎ কখনও তারা সোনাঝুরি গাছের নিচে এসে দাঁড়াত, মাটিতে পড়ে থাকা ফুল হাতে তুলে নিত, একে অপরের দিকে তাকিয়ে হেসে দিত। এলিসা মজা করে বলল, “Found it!” রুদ্র হাসল আর বলল বাংলায়, “সোনাঝুরি শুধু খুঁজে পাওয়ার নয়, এটাকে অনুভব করতে হয়।” এলিসা ভাষাটা না বুঝলেও, তার চোখে রুদ্রর দৃষ্টি দেখে বোঝা যাচ্ছিল সে কিছু গভীর কথা বলছে। তারা খুঁজতে খুঁজতে বুঝতে পারছিল, সোনাঝুরি তাদের কাছে কেবল ফুল নয়, বরং একে অপরকে জানার, বোঝার আর কাছাকাছি আসার একটি প্রতীকী পথ।
বিকেল নামল, আলো নরম হয়ে এল। এলিসা আর রুদ্র তখন বসেছিল এক সোনাঝুরি গাছের নিচে। চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে হলুদ ফুল, আর আকাশে লালচে রঙ মাখা আলো পড়ছে। এলিসা ক্যামেরা তুলল, রুদ্রর ছবি তুলল ফুলের মেঘের মধ্যে। তারপর নিজের চোখে সেই ছবিটা দেখে বলল ধীরে ধীরে, “This is our Sonajhuri.” রুদ্র হয়তো শব্দটা পুরোপুরি বুঝল না, কিন্তু তার হাসি আর একতারা বাজানোর সুরে স্পষ্ট হলো—সে বোঝে এই খেলার গভীর মানে। দু’জনেই চুপচাপ বসে রইল, ফুল কুড়িয়ে হাতে ঘষে দেখছিল, যেন জীবনকেই ছুঁয়ে দেখছে। সোনাঝুরি খোঁজার সেই খেলা তাদের শেখাল—ভাষা যতই ভিন্ন হোক না কেন, খোঁজ আর আবিষ্কারের আনন্দ সর্বজনীন। আর সেই আনন্দই তাদের বন্ধনকে আরও দৃঢ় করল, একে অপরকে আরও কাছে নিয়ে এল। এলিসা অনুভব করল, তার প্রজেক্ট আর ছবি নয়, আসল যাত্রা হলো এই মানুষটিকে, এই মাটিকে আর এই ফুলের মতো সরল সৌন্দর্যকে খুঁজে পাওয়া। আর রুদ্রও বুঝল, এই বিদেশিনী মেয়েটি কেবল এক পর্যটক নয়, বরং তার জীবনের সোনাঝুরির মতো এক বিশেষ উপস্থিতি, যে তাকে গান আর জীবনের নতুন অর্থ খুঁজে নিতে সাহায্য করছে।
***
সেদিন বিকেলটা ছিল অন্য সব দিনের থেকে কিছুটা আলাদা। এলিসা এবং রুদ্র দু’জনেই ভেবেছিল তারা আবারো মাঠে কিংবা নদীর ধারে গিয়ে গল্প করবে, গান গাইবে কিংবা ছবি তুলবে, কিন্তু গ্রামের পরিবেশ হঠাৎই বদলে গেল। এক বয়স্ক মানুষ, যিনি গ্রামে রক্ষণশীলতার প্রতীক হিসেবে পরিচিত, তিনি এলিসাকে রুদ্রের সাথে হাসি-ঠাট্টা করতে দেখে বিরক্ত হলেন। তাঁর মতে, গ্রামের মেয়েরা ছেলেদের সাথে মেলামেশা করলে সেটা অশোভন, আর বিদেশিনী এলিসার উপস্থিতি যেন তাঁর দৃষ্টিতে আরও অশান্তি বয়ে আনে। রুদ্র কিছুটা অপ্রস্তুত বোধ করল, কারণ সে গ্রামীণ নিয়ম জানত, কিন্তু এলিসা এই সংস্কৃতির সূক্ষ্ম টানাপোড়েন বোঝেনি। হঠাৎ সেই বৃদ্ধ লোকের কঠিন কণ্ঠে বলা কয়েকটি কথা বাতাসে ছড়িয়ে পড়ল—“আমাদের গ্রামের ছেলে-মেয়েরা কি আর কোনো কাজ পায় না? দিনরাত এই রঙিন বিদেশিনীর সঙ্গে সময় কাটানো? এটা আমাদের সংস্কৃতির সাথে মানায় না।” এলিসা তার কথার গভীরতা না বুঝলেও রুদ্রের মুখ দেখে বুঝল, কিছু একটা ভুল হয়েছে। সে হতবাক চোখে রুদ্রের দিকে তাকাল, আর রুদ্রের চোখে এক ধরনের দ্বন্দ্ব স্পষ্ট হয়ে উঠল—একদিকে এলিসার সরল আনন্দ, আরেকদিকে গ্রামীণ রীতিনীতির চাপ। সেই মুহূর্তে তাদের মাঝে অদৃশ্য এক দেয়াল তৈরি হল, যেন তারা দুজনেই একে অপরকে বুঝতে চাইলেও কথার বাঁধনে আটকে যাচ্ছে।
কিছুক্ষণ তারা একে অপরের সাথে কথা বলল না, শুধু নীরবতার মধ্যে হাঁটতে লাগল। এলিসার মনে প্রশ্ন জমতে থাকল—রুদ্র কি লজ্জিত? নাকি সে চায় না আর তার সাথে এতটা খোলাখুলি সম্পর্ক রাখুক? অন্যদিকে রুদ্রের মনে দ্বন্দ্ব—সে কি এলিসাকে বোঝাবে যে গ্রামের নিয়ম এভাবে কঠিন? নাকি এলিসার সাথে তার বন্ধনই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ? সেই সন্ধ্যায়, যখন সূর্য ডুবে গিয়ে আকাশ লালচে রঙে রাঙিয়ে তুলছিল, তখন তারা দুজনেই চুপচাপ বসেছিল নদীর ধারে। এলিসা তার ক্যামেরা বের করল, ছবি তুলতে চাইল, কিন্তু তার চোখে সেই আগের ঝলক আর ছিল না। রুদ্র এই পরিবর্তন লক্ষ্য করল, আর তার হৃদয়ে ব্যথা লাগল। সে হঠাৎ একটি বাউল গান গাইতে শুরু করল—“মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি, মানুষ না চিনলে মানুষের মতন রবি।” এই গান যেন এলিসার চোখ খুলে দিল। সে বুঝল, রুদ্র তাকে দূরে সরাচ্ছে না, বরং সমাজের জটিলতাকে বোঝাতে চাইছে। এলিসা ধীরে ধীরে ক্যামেরা নামিয়ে রুদ্রের চোখের দিকে তাকাল, আর একটা হালকা হাসি দিল। কিন্তু সেই হাসির আড়ালে লুকানো ছিল এক ধরনের প্রশ্ন—“তুমি কি আমাকে বুঝতে দিচ্ছো, নাকি দূরে ঠেলে দিচ্ছো?”
অবশেষে রাতের আকাশে যখন তারা ফুটল, তখন তাদের মধ্যকার নীরবতা ভাঙল। রুদ্র এলিসার দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি যদি আমার গান শোনো, তুমি বুঝবে, আমাদের সমাজের এই বাঁধনও ভাঙা যায়। হাসি আর গানে অনেক শক্তি আছে, এলিসা।” এলিসা কিছুক্ষণ চুপ করে রইল, তারপর সে নিজের ভাষায় ধীরে ধীরে বলল, “আমাদের বন্ধন যদি সত্যি হয়, তবে এই ভুল বোঝাবুঝি ভেঙে যাবে।” এরপর তারা দুজনেই আবার গাইতে শুরু করল—এবার রুদ্রের কণ্ঠে বাংলার বাউল সুর, আর এলিসার কণ্ঠে হালকা ইংরেজি গুনগুন। একসাথে দুই ভাষা, দুই সুর মিলেমিশে এক আশ্চর্য সঙ্গীত তৈরি করল, যা কেবল তাদের নয়, আশেপাশের নীরব প্রকৃতিকেও ছুঁয়ে গেল। মনে হল, সেই গানই যেন তাদের বন্ধনের সেতু, যা ভুল বোঝাবুঝিকে ভেঙে আবারো একত্রে বাঁধল। এভাবে গান ও হাসির মাধ্যমে তারা নিজেদের ভেতরের টানাপোড়েন মুছে ফেলল, আর একে অপরকে নতুন করে আবিষ্কার করল—আরও গভীরভাবে, আরও আন্তরিকভাবে।
***
প্রকল্পের শেষ দিন এলিসার মনে অদ্ভুত এক ভারী অনুভূতি জন্ম দিল। তার ক্যামেরার মেমোরি কার্ডে গ্রামের শত শত ছবি—হাসি, খেলা, গান, বাউলের সুর, শিশুর দৌড়ঝাঁপ, বৃদ্ধের মুখের ভাঁজে লুকানো অভিজ্ঞতা—সব জমা হয়েছে। কিন্তু তার চোখে জমেছে অদৃশ্য কিছু—রুদ্রর সাথে কাটানো মুহূর্তগুলোর ঝিলিক, যেগুলো কোনো ক্যামেরাই বন্দি করতে পারে না। সকালে যখন সে মাঠে হাঁটছিল, তখন গ্রামের মানুষজন তাকে ঘিরে নিল, কেউ বলল—“ফিরেও আসবেন, মেমসাহেব।” কেউ আবার তার হাতে রাখল একটি গাছের চারা, যেন প্রতীকী উপহার। এলিসা হেসে বলল, “আমি ফিরে আসব, অবশ্যই।” কিন্তু ভেতরে সে জানত, আজকের দিনটা এক সমাপ্তি এবং নতুন শুরুর দিন। এদিকে রুদ্রর মনেও এক অদ্ভুত দ্বিধা—সে কি এলিসাকে থামিয়ে বলবে, “যেও না”? নাকি শুধু গান দিয়ে তার প্রতি অনুভূতি প্রকাশ করবে? সে নীরবে এলিসার পাশে গিয়ে দাঁড়াল, হাতে রাখা ছিল একটি বাঁশি। সে বাজাতে শুরু করল এক মাটির সুর, যেটা গ্রামের বাতাসের সাথে মিশে গিয়ে এলিসার হৃদয় ছুঁয়ে দিল। এলিসা ক্যামেরা নামিয়ে ফেলল, আর শুধু মন দিয়ে সেই সুর শুনতে লাগল। যেন এই বাঁশির প্রতিটি ধ্বনিতে লেখা আছে—বিদায় নয়, বরং চিরস্থায়ী বন্ধনের প্রতিশ্রুতি।
দুপুরের পর তারা দুজনে হাঁটতে বেরোল গ্রামের কাঁচা পথে। চারপাশে ধুলোমাখা রাস্তা, খেতের সবুজ, পাখির ডাক—সবকিছু যেন হঠাৎই আরও জীবন্ত হয়ে উঠল। এলিসা ছবি তুলছিল, কিন্তু তার লেন্সের ভেতর দিয়ে সে শুধু দৃশ্য নয়, অনুভূতি ধরছিল। হঠাৎ রুদ্র বলল, “তুমি জানো, আমাদের ভাষা আলাদা হলেও আমাদের গান সবসময় মিলিয়ে গেছে।” এলিসা একটু হেসে উত্তর দিল, “হ্যাঁ, ছবি আর গান—দুটোই মানুষের অন্তরের ভাষা। সেগুলো অনুবাদ করতে হয় না।” তারা যখন সোনাঝুরি গাছের নিচে এসে দাঁড়াল, তখন বাতাসে শুকনো পাতার ঝরঝর শব্দে এক ধরনের বিদায়ের আবহ তৈরি হল। এলিসা হাত বাড়িয়ে রুদ্রর হাত ধরল, যেন ভাষার বাইরে গিয়ে আরেকটি প্রতীকী প্রতিশ্রুতি দিল। রুদ্র কিছু না বলে তার ব্যাগ থেকে একটি পুরনো নোটবুক বের করল, যেটাতে সে গ্রামের গান লিখত। সে সেটি এলিসার হাতে তুলে দিয়ে বলল, “এখন এগুলো তোমার।” এলিসার চোখ ভিজে উঠল—সে বুঝল, এই উপহার কেবল একটি নোটবুক নয়, বরং তাদের বন্ধনের এক অমূল্য স্মারক। ক্যামেরা, গান, হাসি আর বন্ধুত্বের মিলনে তারা বুঝল—দেশ, সংস্কৃতি কিংবা ভাষা কোনো বাধা নয়, বরং ভিন্নতাই তাদের এক করেছে।
সন্ধ্যায়, যখন এলিসার বিদায়ের সময় এল, গ্রামের প্রান্তে জমে গেল এক মেলামেশার আসর। শিশুরা গাইল লোকগান, মহিলারা নাচল, আর রুদ্র শেষবারের মতো তার গলা মেলাল বাউলের সুরে। এলিসা সবকিছু রেকর্ড করল, কিন্তু তার মনে হচ্ছিল ক্যামেরা অপ্রয়োজনীয়—কারণ এই মুহূর্তের গভীরতা শুধুই হৃদয়ে আঁকা সম্ভব। বাস যখন ধুলো উড়িয়ে আসল, তখন এলিসা ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল। সে রুদ্রর দিকে তাকাল, তাদের চোখে চোখে যেন এক অঘোষিত প্রতিজ্ঞা বিনিময় হল—ফিরে আসা কিংবা দূরে থাকলেও, তারা দুজনেই একে অপরকে খুঁজে পাবে গান আর ছবির ভেতর। বাসের জানালা দিয়ে বিদায়ের হাত নাড়তে নাড়তে এলিসা ভাবল—“আমাদের বন্ধন মাটির মতো, যতই দূরে যাই না কেন, সে শিকড় ধরে রাখবে।” আর রুদ্র, গ্রামের মাটিতে দাঁড়িয়ে, বাঁশিতে আবারো এক মৃদু সুর তুলল, যেটা বাতাসে ভেসে গিয়ে এলিসার হৃদয় ছুঁয়ে দিল। এইভাবেই গল্পের শেষ অধ্যায়ে স্পষ্ট হল এক সত্য—ভাষা বা দেশের পার্থক্য কোনো বন্ধনকে আটকাতে পারে না। গান, হাসি আর ছবির বাঁধনে গড়া সম্পর্ক চিরকালীন, যা সময় আর দূরত্বের সব সীমা অতিক্রম করে বেঁচে থাকে।
___