Bangla - প্রেমের গল্প

নদীর ধারে শেষ বিকেল

Spread the love

অদ্রিজা চক্রবর্তী


শরতের দুপুরটা ছিল অন্যরকম, বাসটা যখন কাঁচা রাস্তা ছেড়ে গোসাইপুরের চৌমাথায় এসে থামল, তখন চারদিকের আলো এক অদ্ভুত নরম সোনালি রঙে ঢেকে গেছে, যেন সূর্য নিজেকে ধীরে ধীরে ভাঁজ করে ফেলছে; শহরের ধুলোভরা গলিপথে এতদিন কাটিয়ে আসা ইলা মাথা উঁচু করে শ্বাস নিল, মনে হলো বুকের ভেতর যেন অচেনা এক স্বচ্ছ বাতাস জমে যাচ্ছে, যার সঙ্গে মিশে আছে কাঁচা ধানের গন্ধ, মাটির ভিজে গন্ধ, আর কোথাও অদৃশ্যভাবে ভেসে আসা কাশফুলের পরাগ; হাতে ছোট্ট ব্যাগ, ভেতরে ক্যামেরা, ডায়েরি, আর কয়েকটা বই—এবারের সফরটা নাকি নিছক অবকাশ নয়, ইলা বলেছিল নিজেকে, ‘এটা কাজের জন্যও’, কিন্তু আসলে সে জানত যে শহরের চাপে আর ক্লান্তির ভেতর থেকে পালিয়ে আসার একটা অজুহাত খুঁজছিল অনেকদিন; মামাবাড়িতে পুজোর ছুটিতে আসবে, সেই কথাটাই সে ধরে ফেলল, যেন হঠাৎ করে এই গ্রাম তাকে ডাকছিল বহুদিনের মতো; পিচঢালা রাস্তাটা ছেড়ে ডানদিকে কাঁচা পথ, দুপাশে আমগাছ, পাখির ডাক, দূরে কোথাও শালিকের ঝাঁক ভেসে যাচ্ছে, আর রোদ ছায়ার খেলা ইলাকে একেবারে থমকে দিল—সে ক্যামেরা বের করল, ক্লিক করতে গিয়েই খেয়াল করল আলোটা এক মুহূর্তেই পাল্টে যায়, ফ্রেমে যেমন দেখা যায়, চোখে তেমনটা থাকে না, এই তার বড় শিক্ষা, তবুও শাটার চাপল, যেন মুহূর্তটুকু আটকে রাখা যায়; হঠাৎ চোখে পড়ল নদীর ঘাট, মাটির সিঁড়ি নেমে গেছে, জলে সোনালি আভা, আর সেখানে বাঁধা একটা সাদা নৌকা, নৌকার দড়ি খুলছে এক যুবক, গায়ে সাদা ময়লা জামা, কাঁধে নীল গামছা, চোখে অদ্ভুত শান্তি; ইলা দাঁড়িয়েই দেখছিল, যুবক হঠাৎ ঘুরে তাকাল, চোখে চোখ মিলতেই এলোমেলো হাওয়া যেন বলে উঠল—তুমি এখানে এসেছ? কিছু না বলে ইলা হাঁটতে শুরু করল মামাবাড়ির দিকে, কিন্তু পা যেন আলগা হয়ে গিয়েছিল, কানে নদীর শব্দ লেগেই রইল; সন্ধ্যায় বারান্দায় বসে মামা-মামী ব্যস্ত ছিলেন অতিথির আপ্যায়নে, খাওয়াদাওয়া, গল্পগাছা চলছিল, কিন্তু ইলার মনে পড়ছিল ঘাটের সেই নৌকার কথা; সে হঠাৎ ক্যামেরা নিয়ে বেরোল, হাওয়া ঠাণ্ডা, আকাশে লালচে আলো; ঘাটে গিয়ে দাঁড়াতেই দেখা গেল সেই যুবক, এবার নৌকোটা কুলে লাগাচ্ছে, পাশে দাঁড়িয়ে মুচকি হেসে বলল, “পার হবে?” ইলা অবাক হয়ে গেল, এত সহজ প্রশ্ন, তবু উত্তর দিতে দেরি হলো; মাথা নাড়তেই সে নৌকায় উঠে পড়ল, বসতেই গা ঘেঁষে এল ঠাণ্ডা জল, তীর ছেড়ে নৌকা ভেসে গেল ধীরে ধীরে; দুপাশে কাশফুলের সমুদ্র, বাতাসে উড়ছে রোঁয়া, যেন হাজার সাদা পাখি উড়ে গেছে আকাশে; যুবক বলল, “আমার নাম রুদ্র, এখানে প্রাইমারির মাস্টারি করি, ফাঁকে নৌকা চালাই”, ইলা চুপচাপ শুনল, তারপর বলল, “আমি ইলা, শহরে থাকি, জানালার কাচের ভেতর আটকে ছিলাম এতদিন”; কথাগুলো যেন হাওয়ার সঙ্গে মিশে গেল, নৌকার খোল ভেঙে জলের শব্দ শুনতে শুনতে তারা দুজন বুঝল, অচেনা হয়েও কতটা চেনা হয়ে ওঠা যায়; ওপারে গিয়ে ছোট্ট মন্দিরে আরতির আলো উঠেছে, শাঁখ বাজছে, ঢাকের তালে নদী নেচে উঠছে, ইলা ক্যামেরা তুলতে গিয়েই থেমে গেল, আলোটা যে চোখের ভেতরেই বেশি সুন্দর; ফেরার সময় নৌকা যখন তীরে লাগল, ইলার আঙুল এক মুহূর্তের জন্য রুদ্রর হাতে ছুঁয়ে গেল, আর সেই ছোঁয়া ছিল নিঃশব্দ প্রতিশ্রুতির মতো, যদিও কেউ কিছু বলেনি; তীরে ওঠার সময় রুদ্র হেসে বলল, “কাল বিকেলে কাশমাঠে আলো ভালো পড়বে, গেলে ছবিটা পাবে”, ইলা শুধু মাথা নাড়ল, কিন্তু মনে হলো তার ভেতরে কোথাও একটা অদৃশ্য নোঙর নেমে গেছে; রাতে মামাবাড়ির বিছানায় শুয়েও সে ঘুমোতে পারছিল না, বারবার মনে হচ্ছিল নদীর গুঞ্জন বারান্দা পেরিয়ে তার কানে ঢুকছে, অচেনা এক ডাক—যার কোনো ভাষা নেই, তবু যার সাড়া দেওয়া থেকে সে নিজেকে আটকাতে পারল না।

সকালটা প্রথমে কুয়াশার মতো ধোঁয়াটে ছিল, তারপর রোদের পাতলা সুতো গাছের ফাঁক দিয়ে নামতে নামতে গোসাইপুরকে এমনভাবে স্পষ্ট করে দিল যে ইলার মনে হলো সে যেন বহুদিনের পরিচিত এক জায়গাকে নতুন করে চিনছে; মামিমা ভাতের হাঁড়িতে ভাত তুলে দিতে দিতে বললেন, “দুপুরে ফিরবে তো, মা? আজ কুমোরপাড়ায় ঠাকুরের রং পড়বে, ছবি তুলতে পারিস”, ইলা মাথা নেড়ে হেসে জানাল দাওয়ায় রাখা ছোট ব্যাগটা তুলে নিল, ভেতরে ক্যামেরা, অতিরিক্ত ব্যাটারি, একটা নীল রুমাল, আর ডায়েরি; বাড়ির সামনের সরু গলিটা পেরোতেই বাতাসে কচি ধানের গন্ধ, দূরে কোথাও মুরগির ডাকে ভাঙা একঘেয়েমি, আর তার চেনা নদীর সোঁদা; সে সোজা ঘাটের দিকে হাঁটল, মাঝে মাঝে থেমে তারিখ-ক্যালেন্ডারের মতো মনে মনে গুনল—আজ দ্বিতীয় দিন, কিন্তু সময় যেন লম্বা হয়ে গেছে; ঘাটে পৌঁছে দেখল রুদ্র ইতিমধ্যেই সেখানে, নৌকার গা মুছছে, কাঁধে সেই চেনা নীল গামছা, চোখে একধরনের অবিচল মনোযোগ—যেন প্রতিটা কাজে তার নিজের মতো করে প্রার্থনা আছে; ইলা কাছে যেতেই রুদ্র মুখ তুলে হালকা হাসল, “আজ নদী খুব শান্ত, আলোও নরম, যদি ওঠো, ওপারের মন্দিরে আরতিটা ঠিক সূর্য ঢলবার সময় পড়বে, ছবি পাবে ভালো”, ইলা বলল, “গতকাল ছবি তুলতে গিয়েও থেমে গিয়েছিলাম, মনে হয়েছিল না তুললেই বরং ছবি থেকে যায়”, রুদ্র মাথা নাড়ল, “দেখা আর ধরা দুই আলাদা; কখনো দেখা থাকাই যথেষ্ট”; নৌকায় বসতে বসতে ইলা লক্ষ্য করল জলের রং আজ কালচে-সবুজ, ওপরটা সোনালি, ভেতরে নিঃশব্দ ঢেউ, যেন মন খারাপ করেছে আবার হাসছেও, এসব পড়তে পড়তেই নৌকা একটানে সরে গেল; দুপারে কাশফুলের সারি এখনও উড়ছে, কিন্তু বাতাসে আজ একটা আলস্য, যেন দুপুরের ঘুমের পর কারও হাই ফেলা; রুদ্র হালকা গলায় বলল, “শহরে তোমাদের সময় কি এমন ধীরে যায়?” ইলা হেসে বলল, “উল্টো, আমরা সময়কে পিছন থেকে ঠেলা দিই আর সামনে থেকে ধাক্কা খাই, ঘুম নেই, শব্দ আছে, একা থাকলে কানে ইয়ারফোন, ভিড়েও ইয়ারফোন, যেন নিজেকে শুনতে না পাওয়ার জন্য নিজেই বর্ম পরে থাকি”, রুদ্র চুপ করে শুনল, তারপর বলল, “এখানে আরতির সময় ধুপের গন্ধটা নদীর গায়ে লেগে ভেসে যায়, ওই গন্ধে মানুষ নিজের স্বরটা একটু স্পষ্ট শোনে”; ওপারে পৌঁছতেই কাঁচা সিঁড়ির ওপরে ছোট্ট শিবমন্দির, আরো একটু দূরে বটগাছ, পাতায় পাতায় নরম আলো; আরতির ঘণ্টা তখনও শুরু হয়নি, ইলা কাঠে বসা পুরনো পেতলের ঘণ্টায় হাত রাখতেই শীতল ধাতুতে তার আঙুলের উষ্ণতা লাগল, মনে হলো তার নিজস্ব দুলুনির সঙ্গে নদীর শ্বাসপ্রশ্বাস জুড়ে যাচ্ছে; সে ক্যামেরা বার করে ফ্রেম কষল—সিঁড়ি, নদী, ডুবন্ত সূর্য, ধূপের ধোঁয়া, কিন্তু রুদ্র পাশে এসে ফিসফিসিয়ে বলল, “দেখে নাও প্রথমে, আলোটা নড়ে যাবে, তারপর শাটার টিপো”, ইলা কাঁধ নামিয়ে এক মুহূর্ত নিঃশব্দে দাঁড়াল, সত্যিই দেখল—ধোঁয়ার সরু রেখা কেমন ধীরে ওঠে আর হঠাৎ বাতাসে ছড়িয়ে যায়, জলে প্রতিফলন একবার স্পষ্ট, একবার ঝাপসা, মন্দিরের ঝোলানো প্রদীপের সোনালি আগুন কেমন মৃদু, তারপর হঠাৎ উজ্জ্বল; সেই দেখার পর যখন সে ছবি তুলল, টুং করে ঘণ্টা পড়ার মতো তার ভেতরও একটা স্বচ্ছ শব্দ হয়ে উঠল, যেন অন্যমনস্কতার বোতাম বন্ধ হয়ে গেছে; আরতি শুরু হতেই গ্রামের মেয়েরা শাঁখ তুলল, সাদা শাঁখের শব্দ নদীর গায়ে পড়ে লেগে গেল ইলার ত্বকে, এই প্রথম সে বুঝল কিছু শব্দ শোনা যায় না, তবু শরীরে ছাপ ফেলে; রুদ্র মৃদু স্বরে মন্ত্রোচ্চারণ করা এক বুড়ো পুরোহিতের দিকে তাকিয়ে বলল, “ও পড়তে জানে কম, কিন্তু উচ্চারণে বিশ্বাস আছে, তাই শব্দটা মনে লাগে”, ইলা বলল, “বিশ্বাসের ছবি কখনও তুলতে পারব?” রুদ্র বলল, “তোলার দরকার নেই, বিশ্বাস মানুষ নিজেই বহন করে, তুমি শুধু এমন ফ্রেম বানাও যেখানে তার ভেতরটা জায়গা পায়”; আরতি ফুরোলে দুজনে মন্দিরের পাশের সিঁড়িতে বসে রইল, ইলা ক্যামেরা ব্যাগে রেখে দিল, ডায়েরির একটা পাতায় আজকের তারিখ লিখে খুব ছোট করে নোট করল—‘আলোকে ছুঁয়ে দেখা হলো’; রুদ্র হঠাৎ বলল, “আজ স্কুলে বাচ্চারা নদী-নিয়ে ছবি আঁকছিল, সবাই নীল আর সাদা দিয়ে নদী বানাচ্ছে, একজন একটা কালো রেখা দিয়ে বলল—এটা নদীর ভেতরের রাত, আমরা চোখে দেখি না”, ইলা চোখ বড়ো করে বলল, “তোমরা তাহলে প্রতিদিন কবিতার মধ্যে বাঁচো”, রুদ্র হেসে বলল, “কবিতারও তো ভাত লাগে, তাই পড়াই, আর নদী দেখাই”; একটু পরেই সে জিজ্ঞেস করল, “কলকাতায় ফেরার কথা বলেছিলে কবে?” ইলা বলল, “মেসেজ এসেছিল, কাজ শুরু করতে হবে এক সপ্তাহের মধ্যে, রিপোর্টিং-এ যোগ দেব, ছবিও লাগবে, আমার মনে হচ্ছে যাওয়া মানে শুধু যাওয়া থাকবে না, কিছু রেখে যেতে হবে”, রুদ্র মাথা নেড়ে বলল, “সব জায়গা থেকে সবকিছু নিয়ে যাওয়া যায় না, কিছু রেখে যেতে হয় যাতে ফিরে আসার রাস্তা খোলা থাকে”; সেই কথা শুনে ইলার বুকের ভেতর হালকা আওয়াজ হলো, যেন কাঁচা বাঁশি প্রথম সুর তুলল, নাম না-জানা সুর, তবু খুব পরিচিত; তারা নৌকায় নামল, ফিরে আসার পথে নদীর গায়ে একটুখানি ঢেউ উঠল, রুদ্র দড়ি আলগা করে দিল, ছোট্ট নড়াচড়াতেই নৌকা সরে গেল তীরের দিকে, আর ইলা বুঝল, এতটা সহজ হওয়ার মধ্যে যে সৌন্দর্য আছে, তা শহরে সে ভুলে গিয়েছিল; ফেরার কুলে পৌঁছে রুদ্র বলল, “একবার কুমোরপাড়ায় গেলে ভালো, আজ চক্ষুদান হবে ঠাকুরমুখে, খড়ের ওপর কাদা বসবে, চোখের কালোটা প্রথম পড়ার মুহূর্তটা খুব নরম”, ইলা বলল, “চোখের কালো বসলে কি মূর্তি চোখ মেলে?” রুদ্র বলল, “আমাদেরই চোখ মেলে, মূর্তি তো একই থাকে”; তারা একসঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে কুমোরপাড়ার দিকে গেল, সরু গলির দুপাশে খড়ের গন্ধ, কাদা, তালপাতার পাখা, আর নরম আলো; ইলা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখল—এক বৃদ্ধ কারিগর কী দুর্দান্ত ধৈর্যে তুলির ডগায় একবিন্দু কালো তুলছে, তারপর মাতৃমুখের ভেজা কাদায় সেই বিন্দুটি ছুঁইয়ে দিল, মুহূর্তখানেক থামল, যেন শ্বাস ধরে আছে, তারপর আরেক বিন্দু, এভাবে দুই চোখ পূর্ণ হওয়ার সাথে সাথে চারপাশের কর্মব্যস্ততা এক মুহূর্ত থমকে গেল, যেন কেউ ভিতরে ভিতরে মন্ত্র পড়ছে—জেগে ওঠো; ইলা না চাইলেও ক্যামেরা তুলল, কারণ এই দেখতে-থাকা আর ধরে-রাখার মাঝের পুলটা আজ তাকে ডেকে নিয়েছে, শাটার ক্লিকের মধ্যে সে শুনল নিজের কিছু কথা—“আমি হারিয়ে ফেলিনি, আমি খুঁজে পাচ্ছি”; রুদ্র পাশে দাঁড়িয়ে মাটির গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে বলল, “এই সময়টা আমার প্রিয়, কারণ নতুন মুখের সঙ্গে মানুষের পুরোনো বিশ্বাস মিলেমিশে একরকম শান্তি বানায়”—ইলার ইচ্ছে করল বলে, “আমার প্রিয় হয়ে উঠছে তুমি”, কিন্তু সে বলেনি, বললে হয়তো কৃত্রিম শোনাতো, তাই নিঃশব্দের ভেতরে শব্দ রেখে দিল; কুমোরপাড়া থেকে বেরোতেই সূর্য ঢলে পড়েছে, আকাশে রঙ বদলাচ্ছে, কাশফুলে হালকা নীল ছায়া, তারা দুজনে আবার ঘাটের দিকে হাঁটল, পথে ইলা বলল, “আমি শহরে প্রায়ই ঘুমোতে পারি না, মাথার ভেতর খবর, ছবি, আর নিজেরই অগোছালো ভাবনা গুলিয়ে থাকে”, রুদ্র বলল, “আজ রাতটা গাঢ় হবে, নদী তোমাকে ঘুম পাড়াবে, ইয়ারফোন খুলে রাখো, শব্দ লাগবে না”; ইলা হঠাৎ বলল, “তুমি এত সহজ করে কথা বলো কীভাবে?” রুদ্র হাঁটতে হাঁটতে কাঁধ ঝাঁকাল, “নদী আমাকে শিখিয়েছে; জল বেশি নাড়া দিলে ঘোলা হয়, ছেড়ে দিলে তলানি নেমে গিয়ে জল পরিষ্কার হয়”; ঘাটে এসে দুজন অনেকক্ষণ চুপ করে বসে রইল, মাঝনদীতে দুটো নৌকা ধীরে চলল, দূরে একটা বক ঝাঁপিয়ে জলের ওপর থেকে কিছু তুলে নিয়ে উড়ে গেল, সূর্য জল কেটে টুকরো টুকরো হয়ে পড়ল, ইলা ভাবল—শহরে এভাবে বসার সময় সে কখনোই রাখেনি, এখানে সময় যেন দয়া করছে, নিজেকে সময় দিয়ে দিচ্ছে; বিদায় নেওয়ার আগে রুদ্র বলল, “কাল বিকেলে কাশমাঠে একটু আগে যেতে পারো, আলো পড়ে যাবে নরমভাবে, বাতাসও আজকের চেয়ে কম থাকবে, আর তুমি চাইলে আমি স্কুলে বাচ্চাদের দিয়ে ‘নদী বাঁচাও’ পোস্টার বানাতে বলছি, তুমি যদি একটু দেখো”, ইলা হেসে বলল, “আমি আসব, পোস্টার বানানোর সময় আমার নিজের কথাও মনে পড়বে—শহরে নদী আছে, কিন্তু চোখে পড়ে না”, রুদ্র মাথা নেড়ে বলল, “যা চোখে পড়ে না, কখনও কখনও সেটা বেশি কাছের”; বাড়ি ফিরতে ফিরতে ইলা অনুভব করল তার হাঁটার ছন্দ বদলে গেছে—পা যেন মাটিতে একটু ধীরে পড়ছে, শ্বাস একটু গভীর, চোখে একটু বেশি আলো; মামাবাড়ির বারান্দায় পৌঁছে সে ডায়েরি খুলে তাড়াতাড়ি লিখল—“আজ দেখলাম, তারপর তুললাম; দেখার ভাষা ছিল, তোলারও ছিল; দুটোই আমি”, নীচে খুব ছোট করে যোগ করল—“রুদ্র নদীর মতো কথা বলে”; রাতে খাওয়া শেষ করে যখন খাটে শুল, ইয়ারফোনটা বালিশের পাশে রেখে জানলা খুলে দিল, বাইরে থেকে নদীর গন্ধ এল, দূরের কোন্‌ ঘাটে কে যেন শাঁখ বাজাল, আর এক অদ্ভুত কোমল অন্ধকার তার চোখে নেমে এল—এতদিনের ভিতরে জমে থাকা শব্দ-ছায়া-আঁধার ধীরে ধীরে ছেঁকে গেল, ইলা বুঝল আজ সে সত্যিই ঘুমোবে, আর ঘুম ভাঙলে সকালের আলোয় তার ভেতরের কুয়াশাটাও হয়তো একটু কমে যাবে; ঘুমের আগে শেষবার সে ভাবল—ফিরে যেতেই হবে, কিন্তু আজ থেকে শহরের ভেতরেই একটা নদী থাকবে, যেটার নাম হয়তো উচ্চারণ করা যায় না, কিন্তু যার ধারে বসে সন্ধ্যেবেলা সে একটা ছোট আরতি করবে নিজের মতো করে, খুব চুপচাপ, শুধু নিজের কাছে।

দুপুরের রোদ নরম হয়ে এলেই গোসাইপুরের রাস্তা যেন একটু থমকে দাঁড়ায়, ইলা সেদিন মামাবাড়ির উঠোনে বসে ক্যামেরার লেন্স মুছছিল, তারপর হঠাৎ মনে হলো—আজকে রুদ্রর কথামতো কাশমাঠে যেতে হবে, আলো নাকি অন্যরকম হবে; ভেতরে ভেতরে একটা অকারণ উত্তেজনা জমে ছিল, যেন কোনো প্রমাণ ছাড়াই সে জানে আজকের দেখা অন্যরকম হবে, তাই খুব তাড়াহুড়ো করে ব্যাগ গুছিয়ে বেরিয়ে গেল; গ্রামটার ভেতরের সরু মেঠোপথ ধরে যেতে যেতে সে টের পেল শরতের বাতাস কেমন নরম আর হালকা, ধানের খেতে চিকচিক করা রোদ একরকম উষ্ণতা ছড়াচ্ছে, কানে দূরের বাউলের গানের সুর ভেসে আসছে, আর সেই সুরের ভেতরে মিশে আছে নদীর গন্ধ—যেন এ জায়গাটার প্রতিটা মুহূর্তই তার জন্য অপেক্ষা করে আছে; কাশফুলের মাঠের কাছে পৌঁছে সে দেখল, দূরে রুদ্র দাঁড়িয়ে আছে, হাতে একটা বাঁশি, বাচ্চাদের পড়ানো শেষ করে সোজা এখানে এসেছে, তার চোখে সেই আগের মতো নির্ভার শান্তি; দুজন একসঙ্গে হাঁটতে শুরু করল, কাশফুলগুলো তাদের দুপাশে মাথা নেড়ে যেন কোনো গোপন কথা বলছে, বাতাসে সাদা তুলো ভেসে গিয়ে ইলার চুলে আটকে যাচ্ছিল, সে একটুখানি অস্বস্তিতে হাত তুলতেই রুদ্র খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে তার কপাল থেকে কয়েকটা রোঁয়া আলগা করে দিল—স্পর্শটা এতটাই নির্লিপ্ত অথচ যত্নশীল যে ইলা কিছু বলতে পারল না, শুধু মনে হলো তার ভেতরের এক শহুরে ব্যস্ততা হঠাৎ করে থেমে গেছে; হাঁটতে হাঁটতে ইলা বলল, “আমি যখন ক্যামেরা দিয়ে ফ্রেম করি, তখনই ভয় হয়—যদি এই মুহূর্তটা হারিয়ে যায়?” রুদ্র একটু হেসে বলল, “মুহূর্ত কখনো হারায় না, ও নিজেই পথ চিনে ফিরে আসে, শুধু আমরা চিনতে পারি কি না, সেটাই আসল কথা”; কথার ফাঁকে দুজনেই শৈশবের গল্পে চলে গেল—ইলা বলল কিভাবে ছোটবেলায় তার মা তাকে বই পড়ে শোনাতেন, আর রুদ্র বলল নদীর ধারে বৃষ্টিভেজা দিনে কেমন খেলত; দুজনেই হাসছিল, আর সেই হাসির ভেতরে অদ্ভুত এক পরিচিতির স্রোত বয়ে যাচ্ছিল; হঠাৎ ইলার মনে পড়ল, সে যে শহরে একসময় এমন কারও সঙ্গে হাঁটত, যে তার কথার ভেতর ঢুকত না, শুধু বাইরে শুনত, আর এখন এক অচেনা মানুষ কী সহজেই তার ভেতরের নীরবতা ছুঁয়ে ফেলছে; কাশফুলের ভেতর দিয়ে বাতাস যখন বইছিল, ইলা হঠাৎ থেমে গেল, তার চোখে জল চিকচিক করছিল, কিন্তু সে কথা ঢাকল হেসে, বলল, “এই মাঠের রঙটা ধরে রাখতে পারব তো?” রুদ্র বলল, “রঙ ধরে রাখতে হয় না, রঙ আমাদের ভেতরে থেকেই যায়, যেমন আজকের আলো থাকবে তোমার চোখে, ছবির প্রয়োজন নেই”; ফেরার সময় তারা দুজন একেবারে চুপ করে হাঁটল, শুধু পায়ের শব্দ আর বাতাসের হালকা গুঞ্জন শোনা যাচ্ছিল; গ্রামটার মোড়ে পৌঁছে রুদ্র হঠাৎ বলল, “কাল স্কুলে পুজোর আগের দিন, বাচ্চাদের দিয়ে রঙের কাজ করব, যদি আসো, তারা খুশি হবে”, ইলা মাথা নেড়ে বলল, “আসবই”; তারপর বিদায় নিয়ে আলাদা পথে হাঁটতে গিয়ে ইলার মনে হলো—সে জানে না এ সম্পর্ক কোথায় যাবে, কিন্তু এতটুকু নিশ্চিত যে এ ভ্রমণ আর নিছক ছুটি নয়, এর ভেতরে কোনো নামহীন স্রোত তৈরি হয়েছে; মামাবাড়িতে ফেরার পর বারান্দায় বসে যখন সে ডায়েরি খুলল, লিখল—“আজ বাতাসে নিজেরই কণ্ঠস্বর শুনলাম, রুদ্রর কথা যেন নদীর প্রতিধ্বনি, সে বলে যায় আর আমি নিঃশব্দে সাড়া দিই”; লেখা শেষে সে কাশফুলের একটা ডগা পাতার মধ্যে রেখে দিল, যেন এ দিনের সিলমোহর, তারপর দীর্ঘক্ষণ জানালার বাইরে তাকিয়ে রইল, নদীর সোঁদা গন্ধ বারবার তার ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে কানে বাজছিল, আর সে ভাবছিল—এই অচেনা সম্পর্ক কি সত্যিই কোনো মোড় আনতে চলেছে তার জীবনে?

সকাল থেকেই গ্রামে এক ধরনের উৎসবের ব্যস্ততা, পুজোর আগের দিন বলে চারিদিকে কেমন যেন একটা উচ্ছ্বাস মাখানো গন্ধ, উঠোনে আলপনা কাটা হচ্ছে, নারকেল কুচি কাটা হচ্ছে, আর ইলা মামাবাড়ির জানলার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে দেখছিল—সবকিছু একসঙ্গে নড়ছে, অথচ কোনো অস্থিরতা নেই, শহরে থাকলে এতগুলো শব্দ মিলে যেত কেবল গর্জনে, কিন্তু এখানে প্রতিটা শব্দের আলাদা অস্তিত্ব আছে, প্রতিটা আওয়াজের একটা নির্দিষ্ট জায়গা; দুপুরের ভাত শেষ করে সে ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে বেরোল, ঠিক করল রুদ্র যেটা বলেছিল সেটা দেখতে যাবে—স্কুলে বাচ্চারা রঙের কাজ করছে, ওরা পোস্টার বানাবে, নদী বাঁচাও নিয়ে; স্কুলে ঢুকতেই ইলার চোখে পড়ল খোলা উঠোন, মাটিতে বসে ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা হাতে রঙতুলি নিয়ে মগ্ন হয়ে আছে, কারও পোস্টারে নীল নদী, কেউ গাছ এঁকেছে, কেউ আবার কাশফুল, আবার এক বাচ্চা কেবল একটা কালো রেখা টেনে বলছে—এটা হলো নদীর রাত; ইলা অবাক হয়ে দেখছিল, ওদের ছবির ভেতরে কেমন সহজ অথচ গভীর সত্যি লুকিয়ে আছে, তার মনে হলো এই বাচ্চারাই আসলে শিল্পী, ওরা নদীকে দেখে যেমন, ওরাও নদীকে সেইভাবে আঁকে; রুদ্র তখন ক্লাসরুম থেকে বেরিয়ে এসে বলল, “এসো, ওরা তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিল, তুমি ক্যামেরা নিয়ে দাঁড়ালে ওরা আরও উৎসাহ পাবে”, ইলা মাটিতে বসে এক বাচ্চার পোস্টারে লাল রঙ দিয়ে সূর্য আঁকতে সাহায্য করল, হাত কাদামাখা হয়ে গেল, কিন্তু সেটা নিয়ে তার কোনো পরোয়া নেই, সে যেন এই মুহূর্তে পুরোপুরি ভেসে গেছে; বাচ্চারা তাকে প্রশ্ন করছে, “দিদি শহরে নদী আছে?” ইলা হেসে বলছে, “আছে, তবে তোমরা যেমন দেখছ, তেমন স্পষ্ট দেখা যায় না”, ওরা আবার হাসছে, কৌতূহলী চোখে তাকাচ্ছে, আর তার ভেতরে ভেতরে একটা অদ্ভুত ব্যথা জমে উঠছে—সে হঠাৎ অনুভব করছে, শহরে থেকে সে কতটা অন্ধ ছিল।

কাজ শেষ হলে রুদ্র তাকে ডাকল—“চলো, একটু উঠোনে বসি”, তারা দুজনে একটা বড় পেয়ারা গাছের নিচে বসল, গ্রামের কোনো বুড়ি এসে গুড় আর চিঁড়ে দিয়ে গেল, ইলা হাতে নিয়ে খেতে খেতে বলল, “এখানে সবকিছু কেমন সহজ, অথচ কতখানি গভীর, আমি ভেবেছিলাম গ্রাম মানেই স্রেফ একরকম নিস্তরঙ্গতা, অথচ এখানে দেখছি আসলে চলার ভেতরে একরকম শান্তি আছে”; রুদ্র হাসল, “তুমি তো শহরের মানুষ, নিস্তরঙ্গতা তোমাদের ভয় দেখায়, কিন্তু শান্তি তোমাদের কাছে অচেনা”; ইলা একটু ভেবে বলল, “আমার জীবনে শান্তি খুব কম, বরং আমি একটা ভদ্র নিঃসঙ্গতা বেছে নিয়েছিলাম, যেন নিজের একা থাকা নিয়ে কারও কাছে জবাবদিহি করতে না হয়”, রুদ্র শান্ত স্বরে উত্তর দিল, “নিঃসঙ্গতা ভালো, যদি জানো কবে সেটা ভাগ করে নিতে হয়, না হলে সে-ই তোমাকে গ্রাস করে”; ইলা কিছুক্ষণ চুপ করে রইল, মনে হচ্ছিল রুদ্রর প্রতিটা কথাই সরাসরি তার ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে, সে ভেবেছিল শহরে এক সম্পর্ক ছিল, যেটা তাকে ভেঙে দিয়েছিল, কিন্তু আজ বুঝছে সম্পর্ক না থাকলেও কেউ আসলে সঙ্গ দিতে পারে—কেবল বোঝার মাধ্যমে, কেবল উপস্থিত থাকার মাধ্যমে।

সন্ধের দিকে তারা আবার নদীর ঘাটের দিকে হাঁটতে বেরোল, কাশমাঠের ভেতর দিয়ে বাতাস আজ অন্যরকম, যেন থমথমে, শীত নামার আগের নিস্তব্ধতা, ইলা বলল, “তুমি কি কখনো শহরে যেতে চেয়েছ?” রুদ্র একটু থেমে বলল, “চেয়েছি, কিন্তু এখানে আমার শিকড়, নদী ছাড়া আমি বাঁচতে পারব না, শহরে হয়তো অনেক কিছু আছে, কিন্তু নদীর নিশ্বাস নেই”; ইলা মৃদু হেসে বলল, “শহরে নিশ্বাস নেই, শুধু শ্বাসরোধ আছে”, কথাটা বলেই সে অবাক হলো—সে এতটা স্পষ্ট কখনো বলেনি আগে, মনে হলো কথাটা সে নিজেও বুঝতে পারল না, রুদ্র মাথা নেড়ে বলল, “তাহলে তো তুমি নদীর জন্যই এসেছ, এই ভিড় থেকে পালিয়ে”; ঘাটে এসে তারা দুজন মাটির সিঁড়িতে বসে রইল, সূর্য ডোবার আগের শেষ আলো জলে নেমে আসছে, বাতাসে কাশফুলের গন্ধ ঘনীভূত হয়ে উঠছে, আর নদীর বুক থেকে ভেসে আসছে একটা অদৃশ্য সুর—ইলার মনে হলো এই সুরই হয়তো প্রেমের প্রথম নাম, যেটা উচ্চারণের দরকার হয় না, শুধু অনুভবের দরকার হয়।

ফেরার সময় ইলা বুঝল, তার ভেতরে একটা অদ্ভুত টান জমে গেছে, সে জানে এই সম্পর্ক কোনো ঘোষণা দিয়ে শুরু হয়নি, কিন্তু তার প্রতিটা মুহূর্তই যেন নিঃশব্দে বাঁধন গড়ে তুলছে; বাড়ি ফিরে যখন সে ডায়েরি খুলল, লিখল—“আজ নিস্তরঙ্গতা আর শান্তির পার্থক্য শিখলাম, শান্তির ভেতরে একজন মানুষকে খুঁজে পেলাম, যে নদীর মতো কথা বলে, ধীরে ধীরে আমার ভেতরের শূন্যতা ভরে যাচ্ছে”—তারপর ডায়েরির পাতায় একটা শুকনো পেয়ারা পাতার টুকরো আটকে দিল, যেন এ দিনের নীরব সাক্ষ্য, তারপর জানালার বাইরে তাকিয়ে দেখল—আকাশে চাঁদ উঠছে, আলো নেমে আসছে নদীর বুক জুড়ে, আর সেই আলোতেই সে বুঝল, প্রেম আসলে বড়ো কোনো ঘটনা নয়, প্রেম নিঃশব্দে চলে আসে, কারও না কারও চোখ দিয়ে, কোনো নদীর গন্ধ দিয়ে, কিংবা কোনো এক অচেনা মানুষের কথার ভেতর দিয়ে।

দুপুরের শেষে আকাশটা হঠাৎ বদলে গেল, কাশফুলের মাথায় যে আলতো আলো পড়ছিল তা একটানে ধূসর হয়ে গেল, যেন দূরে কেউ গুছিয়ে রাখা ছায়াগুলো একসঙ্গে খুলে দিয়েছে, ইলা তখন মামাবাড়ির বারান্দা থেকে নেমে ঘাটের দিকে হাঁটছিল, হাতে ক্যামেরা, কাঁধে ছোট ব্যাগ, মনটা আশ্চর্যরকম হালকা; প্রথমে ঝিরঝিরে বাতাস, তারপর মেঘের ভেতর দিয়ে চওড়া ছায়া নেমে আসা, তারপর এক নিমেষে ঝোড়ো হাওয়া, ডানদিকে শালগাছের মাথা দুলে উঠল, ধানের খেতে ঢেউয়ের ভিতর ঢেউ, আর মুহূর্তের মধ্যে আকাশ খুলে দিল—টপটপ করে বড়ো বড়ো ফোঁটা, ইলা প্রথমে ভেবেছিল দাঁড়িয়ে ছবি তুলবে, বৃষ্টির এই প্রথম ধাক্কাটা ধরে রাখবে, কিন্তু ফোঁটাগুলো বড়ো হয়ে আসতেই ক্যামেরার সামনে এক তির্যক জলরেখা টেনে দিল, সে তাড়াতাড়ি ব্যাগের মুখ বন্ধ করে দৌড়তে শুরু করল, মাথায়, কাঁধে, গলায় বৃষ্টির ঠাণ্ডা, আবছা দৃষ্টির ভেতর দিয়ে দেখতে পেল রুদ্র উল্টোদিক থেকে ছুটে আসছে, কাঁধে নীল গামছা, চোখে দৃঢ়তা—যেন বৃষ্টি তার সমসাময়িক, প্রতিপক্ষ নয়; দুজনের দেখা হলো কাশমাঠের কিনারে, রুদ্র বলল, “চলো, এইদিকে—ওখানে একটা গোয়ালঘর আছে, ছাদে ফুটো আছে, কিন্তু ঝড়টা কেটে যাওয়া পর্যন্ত টিকবে”, ইলা কোনো প্রশ্ন করল না, কাদায় পা ডুবে যেতে যেতে দুজনে দৌড়ে ঢুকে পড়ল আধোঅন্ধকার ঘরটায়, উপর থেকে পুরনো টিনের ছাদে বৃষ্টির কড়া শব্দ, ফোঁটা ফোঁটা জল পড়ছে জায়গায় জায়গায়, ইলা ব্যাগটা বুকে চেপে ধরল, রুদ্র গামছা দিয়ে ব্যাগের জল মুছিয়ে দিল, তারপর খুব সাবধানে ক্যামেরার বডি মুছে ফিল্টার খুলে দেখে আবার লাগাল, তার হাতের ভঙ্গিটা ছিল অতটা ধীর আর যত্নশীল যে ইলা অনুভব করল, কেউ হয়তো প্রথমবার তার কাজকে ঠিক কাজের মতোই ধরে দেখছে, কোনো বাড়তি নরম হাহুতাশ নয়, কোনো বাড়তি জানাশোনা নয়, বরং নিখুঁত দায়িত্ব; বৃষ্টির গন্ধে ভিজে ছিল গোয়ালঘর, খড়ের গন্ধ, গরুর পুরোনো নিশ্বাস, কাদামাটির সোঁদা, ইলা কাঁধ জড়িয়ে দরজার ফাঁকায় দাঁড়াল, বাইরে নদী তীব্র রঙে গাঢ় হয়ে উঠছে, জলে বৃষ্টির বলল ফুটে ওঠা আর মুছে যাওয়া, যেন কারও অস্থির হৃদস্পন্দন; রুদ্র পাশে এসে দাঁড়াতেই সে হঠাৎ বলল, “এই বৃষ্টি দেখতে আমার ভয় লাগে না, তবু এর মধ্যে এক ধরনের অনিবার্যতা আছে, যেন যা এসে পড়েছে তাকে ঠেলে সরানো যায় না”, রুদ্র একটু থেমে বলল, “আমার বাবা নৌকো চালাতেন, এমন এক বর্ষার রাতে নৌকো ভেঙে গিয়েছিল, তিনি ফেরেননি, তখন মনে হয়েছিল নদী নিষ্ঠুর, পরে বুঝেছি নদী শুধু নদী—তার কাজ বয়ে যাওয়া, আমাদের কাজ বুঝে নেওয়া কোন স্রোতে কীভাবে দাঁড়াতে হয়”; কথাটা ইলার মনে বিদ্যুতের মতো আঁচড় কেটে গেল, সে কেমন যেন নরম হয়ে পড়ল, বলল, “আমি শহরে একটা সম্পর্কে ছিলাম, সব ছিল—কফিশপ, সিনেমা, হেঁটে যাওয়া, তবু আজ ফিরে দেখলে দেখি ওইসব ছবিতে আমি নেই, আমার জায়গায় একজন ভালো মেয়ে আছে, ভদ্র, কম কথা বলে, বেশি মানিয়ে চলে—ওই ছবিগুলোতে আমার নিজের চোখ নেই”, রুদ্র কিছু বলল না, পাশে দাঁড়িয়ে শুধু বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর খুব আস্তে বলল, “নিজেকে ভুলে গেলে সম্পর্ক থাকে, মানুষ থাকে না; তুমি যেমন ছবি তুলতে গিয়ে কখনো দেখাকে প্রাধান্য দাও, তেমনি নিজের ভেতরের দেখাটাকেও প্রাধান্য দাও, না হলে শাটার চলবে, ফ্রেম হবে, কিন্তু কোনো আলোই তোমার থাকবে না”; ইলা হাসল, চোখে জল জমছিল কিনা বোঝা গেল না, কারণ দরজার ওপার থেকে বৃষ্টি এসে গায়ে পড়ছিল, সে বলল, “আজ মনে হচ্ছে আমার ভেতরের শব্দগুলো একটু থেমে গেছে, বৃষ্টি যেমন হঠাৎ দমকে আসে, তেমনই হঠাৎ ছেড়ে দেবে”, রুদ্র মাথা নাড়ল, “সবকিছু আসে আর যায়, আমরা তার মাঝের নীরবতা চিনতে শিখি”, এতটা সহজ কথায় এতটা বড়ো শিক্ষা ইলা এই প্রথম পেল, সে ভাবল শহরে এতদিন নিজের ভেতরের নীরবতা থেকে সে কীভাবে পালিয়ে গেছে—ইয়ারফোন লাগিয়ে, ব্যস্ততা দিয়ে, অনন্ত বিজ্ঞপ্তি দিয়ে; বৃষ্টির ঝাঁকুনি ধীরে ধীরে কমে এলো, ছাদের ফুটো দিয়ে পড়া জলরেখাগুলো পাতলা হয়ে গেল, দরজার ওপারে নদী মৃদু আলোয় আরেকটু স্থির, কাশফুল ভিজে নুয়ে পড়েছে, দূর আকাশে একটা বিদ্যুৎরেখা টেনে এনে কোথাও গিয়ে মিলিয়ে গেল—এমন সময় রুদ্র বলল, “আজ রাতে নদী ভারী ঘুম দেবে, কাল সন্ধের আরতিটা একটু বড়ো করে হবে, পাড়ার লোকেরা শাঁখ আনবে, ঢাক পড়বে, এসো, আলোর দিকে থাকার অভ্যেস বানাও, আলোকে কাছে ডাকতে পারলে অন্ধকার আর ততটা ভয় দেখায় না”, ইলা মৃদু মৃদু মাথা নাড়ল, মনে হলো কেউ তার কাঁধে হাত রেখেছে—রেখেনি, তবু রেখেছে; তারা বেরিয়ে এলে কাদা জলে হাঁটু অবধি ছপছপ, রাস্তায় কোথাও কোথাও ছোট ছোট পুকুর বানিয়ে রেখেছে বৃষ্টি, আকাশের রঙে তামাটে নরমতা, বাতাসে ধুপের মতো ভেজা গন্ধ, ইলা হাঁটতে হাঁটতে বলল, “তুমি কীভাবে এত সহজ কথা বলো, শুনলেই মনে হয় সত্যি”, রুদ্র হেসে বলল, “আমি কঠিন কথা বলতে পারি না, বলতে গেলেই জড়িয়ে যায়, ছোটবেলা থেকে জল আমাকে শিখিয়েছে—যা বলা দরকার, সেটাই বলো, বাকিটা ছেড়ে দাও”, ইলা জিজ্ঞেস করল, “তোমার কি কখনো মনে হয়নি এই গ্রাম ছেড়ে বেরোতে?” রুদ্র বলল, “মনে হয়েছিল, কিন্তু আমি জানি আমি যদি নদী ছেড়ে যাই, আমার ভেতরের স্রোত শুকিয়ে যাবে; শহরে আমি কাজ করতে পারি, লিখতে পারি, শিখতে পারি, কিন্তু নিশ্বাসের সঙ্গে জল মিশবে না—তাই থেকেছি; থাকা সবসময় কষ্টের নয়, কখনো কখনো থাকা-ই পথ”, ইলা বুঝতে পারল, থাকার মধ্যেও একধরনের যাত্রা আছে—যা চোখে পড়ে না, কিন্তু স্রোতের দিক বদলে দেয়; ঘাটের কাছে এসে তারা কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়াল, জলের ওপর একটা লম্বা কাঠের টুকরো ভাসতে ভাসতে দূরে গেল, ইলা মনে মনে দেখল তার পুরোনো ক্লান্ত মুখটাও যেন ওই কাঠের মতো ভেসে যাচ্ছে, মাথা হালকা, কাঁধ নরম, সে বলল, “কাল আমি আসব, আলোর দিকে থাকা শেখার জন্যও, আর তুমি থাকলে সেই আলোর গায়ে একটা নিঃশব্দ ভরসা পেয়ে যাই”, রুদ্র শুধু বলল, “আমি থাকব; নদী থাকলে আমিও থাকি”; বিদায় নিতে গিয়ে ইলা হঠাৎ টের পেল রুদ্রের জামায় বৃষ্টির তাজা গন্ধ এখনও লেগে আছে, সে খুব চুপচাপ চোখ নামিয়ে নিল, কারণ এই ছোট ছোট গন্ধই মানুষকে সবচেয়ে বেশি নাড়া দেয়, আর এই নাড়ার ভাষা শুনতে হলে নিজের ভিতরের শব্দকে নামিয়ে আনতে হয়; বাড়ি ফেরার পথে মাটির গন্ধ আরো গাঢ়, তালপাতার ছাওনি থেকে বৃষ্টির শেষ ফোঁটা টুপটুপ পড়ছে, মামাবাড়ির বারান্দায় উঠতেই মামিমা বললেন, “ভিজেছিস তো মা, গরম জল রেখেছি”, ইলা হেসে বলল, “ভিজেছি, তবে ভালো লেগেছে”; ঘরে ঢুকে সে প্রথমে ক্যামেরা মুছে শুকনো কাপড়ে মোড়াল, তারপর ডায়েরি খুলে লিখল—“আজ বৃষ্টির ভিতর দাঁড়িয়ে শিখলাম ভয় আর ভিজে যাওয়া আলাদা জিনিস; ভয় কল্পনার, ভিজে যাওয়া অভিজ্ঞতার; আজ রুদ্র যখন আমার ক্যামেরা মুছিয়ে দিল, বুঝলাম কেউ কেউ আসে তোমার কাজকে সুরক্ষিত করতে, তোমাকে নয়, তোমার ভেতরের আলোকে”, লেখা শেষে সে ব্যাগ থেকে নদীর ধারে কুড়োনো ছোট্ট একটা মসৃণ শঙ্খ বের করে টেবিলে রাখল, কানের কাছে ধরল, ভেতর থেকে খুব সূক্ষ্ম একটা শোঁ শোঁ শব্দ উঠল—বৃষ্টির পর নদীর নিশ্বাসের মতো, ঘুম নামিয়ে আনার মতো, আর সে বুঝল আজ রাতে তার আর ইয়ারফোন লাগবে না, জানালা খুললেই ওই শব্দ আসবে; শোবার আগে নিজেকেই বলল, “কাল সন্ধের আরতিতে যাব; আলোর সামনে দাঁড়ালে যে অন্ধকারটাকে চিনতে পারি, তার নামও আমি জানব”—এভাবে সে ধীরে ধীরে ঘুমের ভেতরে ঢুকে গেল, বাইরে তখন দূর আকাশে বৃষ্টির শেষ পাতলা রেখা মিলিয়ে যাচ্ছে, আর নদী নিঃশব্দে নিজেকে ভাঁজ করে নিয়ে পরদিনের আলোকে স্বাগত জানানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে।

সন্ধ্যা নামতেই গোসাইপুরের ঘাট যেন অন্য কোনো জগতে রূপ নিল, ইলা মামাবাড়ি থেকে বেরোনোর সময়ই দূর থেকে শাঁখের শব্দ কানে এলো, রাস্তায় লোকজন দল বেঁধে যাচ্ছে, কারও হাতে ধূপ, কারও হাতে প্রদীপ, কারও হাতে ফুলের ঝুড়ি; বাতাসে ধূপ-ফুল-মাটির গন্ধ মিশে এক অদ্ভুত মাদকতা তৈরি করেছে, ইলার মনে হলো এত আলো, এত শব্দ অথচ কোথাও কোনো তাড়াহুড়ো নেই, প্রতিটা শব্দ যেন সঠিক জায়গায় থেমে থেমে উঠছে, শহরে থাকলে এ রকম হলে সে নিশ্চয়ই হাঁপিয়ে উঠত, কিন্তু এখানে সবকিছুতেই যেন একটা নিঃশব্দ শৃঙ্খলা আছে; ঘাটের সিঁড়ি বেয়ে নামতেই সে দেখল নদীর বুকজুড়ে অসংখ্য প্রদীপ দুলছে, কেউ জল ছুঁয়ে প্রদীপ ভাসাচ্ছে, কেউ আবার নদীর দিকে মুখ করে প্রণাম জানাচ্ছে, নদী যেন সেই আলো নিজের বুকে নিয়ে একরকম আশ্বাস ফিরিয়ে দিচ্ছে, তার বুক কেঁপে উঠল—এমন দৃশ্য আগে সে কোনোদিন দেখেনি; সে ব্যাগ থেকে ক্যামেরা বার করল, কিন্তু শাটার চাপতে গিয়েই হাত থেমে গেল, মনে হলো এই মুহূর্তটা লেন্সে ধরে ফেললে ছোট হয়ে যাবে, অথচ চোখে রেখে দিলে ভেতর ভরে যাবে, তাই সে শুধু তাকিয়ে থাকল।

রুদ্র তখন ঘাটের একপাশে দাঁড়িয়ে পুরোহিতকে সাহায্য করছে, হাতের ইশারায় লোকজনকে সঠিক জায়গায় বসাচ্ছে, প্রদীপে তেল দিচ্ছে, আরতির শব্দ বাড়তেই নদীর জলে যেন আলোর ঢেউ উঠল, শাঁখের গর্জন বুক ভরিয়ে দিল, ঢাকের তালে চারপাশ কেঁপে উঠল, ইলা অনুভব করল নদী এখন কেবল নদী নয়, নদী যেন এক বিশাল দেহ—যার হৃদস্পন্দন এই আলো, এই শব্দ, এই বিশ্বাস; তার চোখে জল এসে গেল, কিন্তু সেটা কান্না নয়, বরং অদ্ভুত শান্তির অশ্রু, যা সে কোনোদিন নিজের জীবনে খুঁজে পায়নি; রুদ্র পাশ থেকে এসে বলল, “আজ ছবি তোলনি?” ইলা মাথা নেড়ে বলল, “না, মনে হলো তোলা মানে ছোট করা, না তুললেই বরং ভেতরে রয়ে যাবে”; রুদ্র মৃদু হেসে বলল, “সব ছবিই ফ্রেমে রাখতে হয় না, কিছু ছবি মনে রাখলেই সবচেয়ে সত্যি হয়”, তার চোখে এমন এক সহজ সত্যি ছিল যে ইলা মনে মনে বলল—কেউ কেউ যেন আলোর মতোই জন্মায়, তারা কেবল আলো ছড়ায়, কোনো দাবি করে না।

আর্তি শেষ হলে নদীর সিঁড়িতে বসে দুজনে চুপ করে রইল, চারপাশের লোকজন ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছে, কিন্তু নদী আর আলো যেন এখনও জেগে আছে, ইলা তখন হঠাৎ বলল, “আমাকে শহরে ফিরতে হবে, ফোন এসেছে, আগামী সপ্তাহেই কাজে যোগ দিতে হবে”, তার গলায় হালকা কম্পন ছিল, যেন এই কথাটা সে উচ্চারণ করতে চায়নি, রুদ্র শান্ত গলায় বলল, “ভালো খবর তো, তোমার চোখের সঠিক জায়গা, এটাই তোমার প্রয়োজন”, ইলা অবাক হয়ে তাকাল, “তুমি খুশি হলে?” রুদ্র মাথা নাড়ল, “অবশ্যই, তুমি যে নিজের আলো খুঁজছ, সেটা শহরেই হোক বা নদীর ধারে, আলো তো আলোরই মতো থাকবে”; ইলা বলল, “কিন্তু মনে হচ্ছে কিছু রেখে যাচ্ছি”, রুদ্র বলল, “সবকিছু নিয়ে যাওয়া যায় না, কিছু রেখে যেতেই হয়—যাতে ফেরার একটা কারণ থাকে”, এই কথাটা শুনে ইলা বুঝল সে যা অনুভব করছে রুদ্র সেটা আগেই বুঝে ফেলেছে, অথচ কোনো শব্দে চাপিয়ে দেয়নি, কেবল নদীর মতো নিঃশব্দে বয়ে নিয়ে গেছে।

দূরে জেলে নৌকোর আলো জ্বলতে শুরু করেছে, অন্ধকার নদীর বুকজুড়ে ছোট ছোট তারার মতো ছড়িয়ে পড়ছে, ইলা তাকিয়ে বলল, “এই দৃশ্য শহরে থেকে কখনো দেখতে পাইনি”, রুদ্র উত্তর দিল, “শহরে আলো আছে, কিন্তু সেই আলো কেবল জ্বলবার জন্য, এখানে আলো থাকে জ্বলার পরেও”; ইলার মনে হলো এ কথাগুলো ঠিক তার নিজের জীবনের মতো—সে এতদিন ভিড়ের মধ্যে থেকেও কোনো আলো খুঁজে পায়নি, অথচ এখানে এসে আলো তার ভিতরেই জেগে উঠেছে; তারা কিছুক্ষণ নিঃশব্দে বসে রইল, নদীর ঢেউ টুপটুপ করে ঘাটে এসে পড়ছিল, সেই শব্দ যেন কারও ফিসফিসানি—কোনো বিদায়ের আগে নিঃশব্দ আলাপ।

ফেরার পথে ইলা বারবার পেছনে তাকাচ্ছিল, আলো ধীরে ধীরে নদীর বুকে মিলিয়ে যাচ্ছে, কাশফুলে চাঁদের হালকা রূপালি ছায়া পড়ছে, বাতাসে ঠাণ্ডার আভাস আসছে, সে হাঁটতে হাঁটতে ভাবল—বিদায় আসবে, কিন্তু এ বিদায় হয়তো শেষ নয়, বরং আরেক শুরু; মামাবাড়িতে ফিরে শুয়ে পড়ার আগে ডায়েরি খুলল, লিখল—“আজ চোখ ভরে আলো দেখলাম, কিন্তু ছবিতে ধরিনি, কারণ ছবির সীমার বাইরে থেকেও কিছু থাকে, বিশ্বাস, অনুভব, অশ্রু—সবচেয়ে সত্যি ছবি আসলে চোখেই থাকে; রুদ্র বলল রেখে যেতে হয়, আমি আজ থেকে রাখছি, যাতে একদিন ফিরে আসতে পারি”—পাতার ভাঁজে সে আরতির প্রদীপ থেকে নেওয়া একটা ছোট শুকনো ফুল চেপে রাখল, তারপর জানালার বাইরে তাকিয়ে দেখল—দূরে নদীর বুক থেকে এখনও আলো ভেসে আসছে, নিভে যায়নি, হয়তো কোনোদিন নিভবেও না।

ভোরের আলো তখনও পুরোপুরি মাটি ছুঁয়েছে বলে মনে হয় না, গ্রামটা কুয়াশার চাদরে ঢাকা, দূরের তালগাছের মাথা যেন আধো ঘুমে দুলছে, ইলা বারান্দায় বসে গরম চা খাচ্ছিল, হঠাৎ ফোনে কল এলো—কলকাতার এডিটর, গলায় স্পষ্ট চাপা তাগিদ, “আগামীকাল থেকেই তোমাকে মাঠে নামতে হবে, রিপোর্টিং আর ফটো—সব একসঙ্গে চাই, পুজোর স্পেশাল ইস্যু, দেরি হলে চলবে না”, ইলার বুকের ভেতরটায় হঠাৎ কেমন শূন্য শূন্য লাগল, সে জানত এই কল আসবেই, তবুও মুহূর্তটা এলে বুকটা ধপাস করে নেমে গেল, চায়ের কাপে ঠোঁট ছুঁয়েও তার স্বাদ পেল না, মামিমা দূরে দাঁড়িয়ে শুধু বললেন, “কী হলো?”—ইলা হেসে বলল, “কিছু না, কাজে ফিরতে হবে”, কিন্তু তার নিজের কানে হাসিটা ফাঁপা শোনাল।

দুপুরে সে ঠিক করল রুদ্রকে খবর দেবে, তাই ক্যামেরা ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল, স্কুলের উঠোনে পৌঁছে দেখল বাচ্চারা টিফিন শেষে খোলা মাঠে খেলছে, রুদ্র একটা গ্রুপকে নদী বোঝাচ্ছে—চড়াইভাটা কীভাবে আসে, কোন মৌসুমে মাছ বাড়ে, কচুরিপানার ভেসে থাকা কেন ভালো নয়, ইলা কিছু দূরে দাঁড়িয়ে দেখছিল, বাচ্চাদের মুখে নিষ্পাপ কৌতূহল, রুদ্রর গলায় সহজ স্বর, যেন জ্ঞান নয়, গল্প শুনছে সবাই; ওদের খেলা থেমে গেলে ইলা সামনে গিয়ে দাঁড়াল, রুদ্র চুপ করে তাকাল, ইলা এক নিঃশ্বাসে বলে ফেলল, “আমি কাল ভোরের বাসে ফিরছি”, চারপাশে এক মুহূর্তের জন্য সব শব্দ যেন থেমে গেল, পাখির ডাকও ক্ষীণ হয়ে এলো, বাচ্চারা পাশের গলিপথে ছুটে গেল, মাঠ ফাঁকা হলো, শুধু দুজন মানুষ দাঁড়িয়ে রইল এক অদ্ভুত নীরবতার ভেতরে।

রুদ্র খুব শান্ত গলায় বলল, “ভোর ভালো সময়, বাড়ি ফেরা সবসময় ভোরেই ভালো, তখন আলোও পরিষ্কার, পথও ফাঁকা”, ইলা চুপ করে রইল, তারপর বলল, “আমি আবার আসব… যদি পারি”, কথাটা বলার সময় তার নিজের বুক কেঁপে উঠল, সে জানত এই প্রতিশ্রুতি অনিশ্চিত, তবুও মুখে বেরিয়ে এলো, রুদ্র শুধু মাথা নাড়ল, “এখানে নদী থাকবে, আমিও থাকব, তুমি যদি আসো, নদীর মতোই হবে, সময় নিয়ে আসবে, নিয়ে যাবে”, কোনো আবেগের ঝড় নয়, শুধু এক সহজ ঘোষণার মতো শোনাল, আর ইলার চোখে জল এসে গেল।

সে ব্যাগ থেকে ডায়েরির একটা পাতায় রুদ্রর নাম্বার লিখে রাখল, নাম্বার বিনিময় হলো, কিন্তু নাটকীয় কিছুই ঘটল না, কেবল একটা কাগজের টুকরো, তবু ইলা জানত এই সংখ্যাগুলো তার কাছে অনেক বেশি—হয়তো মনে রাখার থেকেও বেশি, সে সেই কাগজটা ডায়েরির ভাঁজে চাপা দিল, যেন কোনো তাবিজ, শহরে নিয়ে যাবে, কিন্তু আসলে ফেলে যাবে এখানেই।

বিকেলের আলো একটু নরম হতেই ইলা কাশমাঠে একা হাঁটতে গেল, তার মন ভারী হচ্ছিল, মনে হচ্ছিল প্রতিটা কাশফুল যেন বিদায়ের পতাকা ওড়াচ্ছে, সে হাঁটতে হাঁটতে একগুচ্ছ কাশ ছিঁড়ে নিল, পাতার ভেতরে রাখল, তারপর ডায়েরির পাতায় চেপে দিল—মনে হলো কোনো অদৃশ্য টিকিট কেটে রাখছে, হয়তো ফেরার টিকিট, হয়তো ফেরা হবে না, কিন্তু প্রতিবার পাতাটা খোলার সঙ্গে সঙ্গে সে এই আলো, এই গন্ধ, এই বাতাস পাবে, যা শহরের দেয়াল ভেদ করে তার কাছে ফিরে আসবে।

মাঠের একপাশে দাঁড়িয়ে সে দেখল আকাশে মেঘ জমছে, পাখিরা ফিরে যাচ্ছে, সূর্য ধীরে ধীরে নীচে নামছে, তখন হঠাৎ বুঝল—বিদায় কখনো সরাসরি এসে নামে না, সে আগে থেকেই তার ছায়া পাঠায়, বাতাসকে ভারী করে দেয়, আলোকে ম্লান করে দেয়, আর আমাদের ভেতরে এক অদ্ভুত অস্থিরতা তৈরি করে, যেন শরীর জানে, শব্দ জানে, অথচ আমরা মুখে কিছু বলি না।

ফেরার সময় পথে রুদ্রর সঙ্গে দেখা হলো না, সে জানত কাল সকালেই দেখা হবে, নইলে আর হবে না, তবু মনে হলো এই অনুপস্থিতিই হয়তো সবচেয়ে সত্যি উপস্থিতি, কারও না থাকাটাও অনেক সময় তার থাকার প্রমাণ হয়ে ওঠে; মামাবাড়ির বারান্দায় বসে সে রাত নামা পর্যন্ত অপেক্ষা করল, কানে কাশফুলের গন্ধ লেগে রইল, মাথার ভেতরে নদীর শব্দ ধাক্কা মারল, কিন্তু তার ডায়েরির পাতায় শুধু একটা বাক্য লিখল—“বিদায় আসছে, কিন্তু এ বিদায় হয়তো শুরু”—তারপর লম্বা লম্বা অক্ষরে লিখল রুদ্র নামটা, যেন অক্ষরের ভেতরও নদীর স্রোত বইছে, আর সেই স্রোতের দিকে তাকিয়ে সে নিঃশব্দে প্রতিজ্ঞা করল—শহরে গিয়েও প্রতিটা আলোকে সে আজকের আলো দিয়ে মাপবে, প্রতিটা নীরবতায় সে নদীর প্রতিধ্বনি খুঁজবে।

সন্ধের ঠিক আগেই গ্রামে হঠাৎ গুজব ছড়িয়ে পড়ল—উজান থেকে নদীর জল বাড়ছে, ছোট্ট বাঁকে দর্জির দোকান জলে ডুবে যাচ্ছে, ইলা তখন মামাবাড়ির বারান্দায় বসে ডায়েরি লিখছিল, হঠাৎ শুনল হইচই, রাস্তায় ছুটোছুটি, কেউ বাঁশ টানছে, কেউ দড়ি, কেউ চেঁচাচ্ছে “জল উঠছে”, সে তাড়াতাড়ি ক্যামেরা কাঁধে ঝুলিয়ে ছুটে বেরোল, রাস্তায় দেখা হলো রুদ্রর সঙ্গে, তার চোখে কোনো আতঙ্ক নেই, শুধু একরকম স্থির তৎপরতা, যেন নদীর সঙ্গে এ লড়াই বহুবার সে খেলেছে; দুজন একসঙ্গে দৌড়ে পৌঁছাল দর্জির দোকানের কাছে, দেখল দোকান অর্ধেক জলে ডুবে গেছে, তাকের ওপর রাখা রঙিন কাপড় ভিজে নষ্ট হতে বসেছে, কয়েকজন লোক বাঁশ দিয়ে ঠেকিয়ে রেখেছে, কিন্তু স্রোত এমন জোরে আসছে যে সবাই হিমশিম খাচ্ছে।

রুদ্র এক ঝটকায় গামছা খুলে কোমরে বাঁধল, তারপর দড়ি কাঁধে ফেলে নেমে গেল জলে, বুক অবধি জল, ফেনা ভরা স্রোত, ইলার মনে হলো এক মুহূর্তে তাকে টেনে নিয়ে যাবে নদী, সে চিৎকার করল, “সাবধানে!” কিন্তু রুদ্র ফিরে তাকাল না, শুধু একটা হাত তুলে ইশারা করল, যেন বলল—আমি পারব; তার চোখে অদ্ভুত এক দৃঢ়তা, ইলা ক্যামেরা তোলার চেষ্টা করল, কিন্তু হাত কেঁপে যাচ্ছিল, লেন্সে ফোকাস করতে পারছিল না, মনে হচ্ছিল চোখের জল আর বৃষ্টির ফোঁটা একসঙ্গে মিশে ঝাপসা করে দিচ্ছে দৃষ্টি; রুদ্র দড়ির এক প্রান্ত খুঁটির সঙ্গে বেঁধে নৌকার মতো ভেসে থাকা তাক ধরে টেনে আনল, লোকজন হাত বাড়িয়ে কাপড়ের বাণ্ডিলগুলো তুলল, ইলা কেবল নিঃশ্বাস আটকে দেখছিল, এই মানুষটাকে নদী কেমন সহজে বন্ধু করে নিয়েছে, যে নদী তাকে একসময় বাবা হারিয়েছিল, সেই নদীর বুকেই সে আজ অন্যদের রক্ষা করছে।

এক মুহূর্তে রুদ্রর পা হড়কে গেল, স্রোত তাকে কাত করে টেনে নিতে চাইল, ইলার গলা থেকে আতঙ্কের চিৎকার বেরিয়ে এলো, সে এক পা এগোতেই দুই গ্রামবাসী তাকে ধরে ফেলল—“আপা, কাছে যেও না!”; তার বুকের ভেতর ততক্ষণে যেন শূন্য হয়ে গেছে, কিন্তু রুদ্র আবারও ভারসাম্য ফিরে পেল, দড়ি আঁকড়ে দাঁড়াল, যেন নদীর বুকে সে নিজেই একটা শিকড়; অবশেষে সব কাপড় বাঁচানো হলো, দোকানদার কেঁদে কেঁদে ধন্যবাদ দিল, লোকজন হইচই করে উঠল, রুদ্র কেবল মাথা নাড়ল, চোখে কোনো অহংকার নেই, শুধু ক্লান্ত শান্তি।

রাত নেমে এলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে, লোকজন ঘরে ফিরল, দোকানের দরজা বাঁশ দিয়ে আটকানো হলো, ইলা দাঁড়িয়ে রইল এখনও হাঁপাতে হাঁপাতে, ক্যামেরা বুকে চাপা দিয়ে, তার ভেতরটা যেন থরথর করছে; রুদ্র কাদা ভেজা গামছা নিংড়ে এসে দাঁড়াল তার সামনে, চোখে অদ্ভুত শান্তি, সে বলল, “শহরে যদি ছবি ছাপাও, এই রাতটার কথা লিখো, কিন্তু নাম লিখো না, নদী বলে লিখো, আমি নামহীন থাকতে চাই”, ইলা তার দিকে তাকিয়ে রইল, কথাটা এত গভীর ছিল যে উত্তর দেওয়া গেল না, শুধু মনে হলো সত্যিই এই মানুষ আসলে নদী, কোনো আলাদা অস্তিত্ব নয়।

মামাবাড়িতে ফেরার পর রাতে ইলা ঘুমোতে পারছিল না, শুয়ে শুয়েই বারবার কানে ভেসে আসছিল জলের শব্দ, তার ডায়েরি খুলে লিখল—“আজ নদী রুদ্রকে টানতে চেয়েছিল, কিন্তু রুদ্র নদীকেই বশ মানাল, আর আমি শিখলাম সাহস মানে ভয়হীনতা নয়, ভয়ের ভেতর দাঁড়িয়েও কাজ করে যাওয়া”—পাতার ভাঁজে সে ভিজে কাশফুলের একটা শুকনো ডগা চেপে রাখল, যেন রাতটার সাক্ষী, তারপর অন্ধকারে জানালা খুলে দিল, বাইরে দূরে নদী স্রোত বেয়ে চলেছে, জলে চাঁদের আভা, বাতাসে ভেজা কাপড়ের গন্ধ, আর তার বুকের ভেতরে এক অদ্ভুত শান্তি নেমে এলো, এতদিন পরে সে প্রথমবার এত গভীর ঘুম পেল, কোনো ইয়ারফোন নয়, কোনো শহরের শব্দ নয়, শুধু নদীর নিশ্বাসই আজ তাকে ঘুম পাড়াল।

শেষ বিকেলটা যেন সত্যিই শেষ হয়ে আসছিল, আকাশে রঙের খেলা অন্যদিনের মতো দীপ্ত ছিল না, সূর্য সোনালি আভা মেখে নামছিল ধীরে ধীরে, আর তার ভেতরে একধরনের ছাইরঙা অস্বস্তি জমে যাচ্ছিল, যেন আলো জানে এ দিনের বিদায়ের ওজনটা অন্যরকম; ইলা সকালে থেকেই জানত—এটাই তার শেষ দিন গোসাইপুরে, কাল ভোরেই ফিরতে হবে শহরে, কাজ ডাকছে, তবু সারাটা দিন তার মনে হচ্ছিল এই গ্রাম, এই নদী, এই মানুষগুলো তাকে এক অদৃশ্য সুতোয় বেঁধে রেখেছে, সে কতবার ডায়েরির পাতায় লিখে ফেলতে চাইছিল কিছু শেষ কথা, কিন্তু লিখতে গেলেই মনে হচ্ছিল লিখলে যেন বিদায়টা সত্যি হয়ে যাবে, তাই চুপ করে ছিল।

সন্ধের আগে ঘাটের সিঁড়িতে গিয়ে বসতেই রুদ্র এল, হাতে একটা ছোট্ট শঙ্খ, চোখে সেই অচল শান্তি, তবু আজ যেন দৃষ্টিতে কিছু বেশি গম্ভীরতা, সে এসে ইলার হাতে শঙ্খটা তুলে দিয়ে বলল, “নদীর তলা থেকে পেয়েছি, ধুয়ে রেখেছিলাম, যখন শহরের শব্দে ভয় পাবে, এটা কানে ধরো, নদীর নিশ্বাস শুনতে পাবে, তখন বোঝা যাবে একা নও”—ইলার গলা আটকে গেল, সে শঙ্খটা হাতে নিয়ে যেন বুকের কাছে চেপে ধরল, বলল, “আমি চাই তুমি কখনও গ্রাম ছেড়ে যেও না, আবার চাই তুমি একদিন শহরের ভিড়ের ভেতর আমার পাশে হাঁটো”—নিজেই অবাক হলো কথা বলে, দুই বিপরীত ইচ্ছে একইসঙ্গে বেরিয়ে এলো, রুদ্র কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “ইচ্ছেরও নদী আছে, দুই তীর দুটো সত্যি, মাঝখানে স্রোত চলে, আমরা কেবল তার ওপর ভেসে থাকি”—এই একটুখানি কথায় ইলার চোখ ভিজে গেল, সে আর কথায় কিছু বলতে পারল না, মনে হলো এই অল্প কথাই তার জীবনের সবচেয়ে বড়ো উত্তর।

আকাশের রঙ ধীরে ধীরে সোনালি থেকে লালচে, তারপর বেগুনি, তারপর একেবারে গাঢ় হতে লাগল, মাঝনদীতে সূর্য ভাঙা সোনার মতো ভেসে যাচ্ছে, বাতাসে কাশফুলের মৃদু দুলুনি, দূরে মন্দির থেকে শাঁখের শেষ আওয়াজ ভেসে আসছে, ইলা ভাবল—এই মুহূর্তের ভেতরে যেন সবকিছু থেমে গেছে, শুধু তাদের দুজনের নিঃশব্দ উপস্থিতি থেকে যাচ্ছে, কোনো শব্দ নেই, কোনো প্রতিশ্রুতি নেই, অথচ এই অস্পর্শের ভেতরেই এত তীব্র অনুভব জমে আছে যে সেটা কোনো ভাষায় বলা যায় না।

রুদ্র বলল, “ফিরে যাওয়া মানে হারিয়ে ফেলা নয়, তুমি যদি সত্যিই অনুভব করো, এই নদী, এই আলো, এই গন্ধ তোমার সঙ্গে যাবে, তোমাকে ফিরিয়ে আনবে”—ইলা শুধু মাথা নাড়ল, তারপর আস্তে বলল, “তুমি থাকো”—এবার আর অন্য কোনো বাক্য খুঁজে পেল না, কারণ তার মনে হচ্ছিল শব্দ যত বাড়বে, সত্যি তত হালকা হয়ে যাবে; রুদ্র তার দিকে তাকাল, চোখে সেই অদ্ভুত স্বচ্ছতা, যেন কিছু না বলেও সব বলে দিল।

বিদায়ের সময় তারা একে অপরের খুব কাছে দাঁড়াল, কিন্তু ছুঁলো না, দুজনের মাঝখানের বাতাস যেন নরম হয়ে উঠেছিল, হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যেত, তবু কেউ বাড়াল না, ইলা অনুভব করল এই অস্পর্শই আসলে সবচেয়ে শক্তিশালী বাঁধন—যা হয়তো প্রতিদিনের আলাপের থেকেও স্থায়ী, প্রতিশ্রুতির থেকেও গভীর; সে চোখ নামিয়ে শঙ্খটা আঁকড়ে ধরল, কাশফুল-চাপা ডায়েরির পাতার মতো এটাও তার বিদায়ের সাক্ষ্য হয়ে রইল।

ফেরার পথে দুজনই আর কিছু বলল না, কেবল হাঁটার শব্দ, দূরের পাখির ডাক আর নদীর নিশ্বাস একসঙ্গে মিশে এক অদ্ভুত সুর তুলল; ইলার মনে হলো এই নীরব সুরই আসল প্রেম—যেখানে শব্দের দরকার হয় না, ছোঁয়ারও দরকার নেই, শুধু থাকা যথেষ্ট, আর সেই থাকা-টুকুই তার জীবনের সবচেয়ে বড়ো আলো।

ভোর এখনও পুরোপুরি ফোটেনি, কুয়াশা মাটির গায়ে নেমে আছে, চারপাশে যেন সাদা ধোঁয়ার স্তর, মামিমার ডাক শুনে ইলা উঠে পড়ল, ছোট্ট ব্যাগটা আগেই গুছিয়ে রেখেছিল, ক্যামেরা, ডায়েরি, দুটো জামা, আর এক গুচ্ছ শুকনো কাশফুল—সবকিছু যেন অদ্ভুতভাবে ভারী লাগছিল, অথচ ব্যাগের ওজন প্রায় নেই; ভোরের বাস ধরতে বেরোতেই চারপাশের গ্রাম ঘুমিয়ে আছে, কেবল দূরে কারও গলায় আজানের মতো ভেসে আসছে শাঁখের আওয়াজ, বাতাসে ধান আর মাটির গন্ধ, যেন বিদায়কেও নরম করে দিতে চাইছে; রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে ইলা জানত, আজ আর রুদ্রকে হয়তো দেখা হবে না, কারণ সে বিদায়টাকে হালকা করে দিতে চাইছে, তবু মন অস্থির, পা একবার ঘাটের দিকে মোড় নিতে চাইছিল, কিন্তু সময় নেই—বাস ছেড়ে দেবে।

বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছে জানালার পাশে বসতেই তার বুকের ভেতর ধপধপ শব্দ, চাকার ঘর্ষণে মাটির ধুলো উড়ে উঠল, বাস ধীরে ধীরে এগোতে শুরু করল, জানলার কাঁচ খোলা, কুয়াশা ঢুকে আসছে ভেতরে, ইলা একবার তাকাল নদীর দিকে, আর ঠিক সেই মুহূর্তে দেখল—ঘাটের মোড়ে রুদ্র দাঁড়িয়ে আছে, দূরত্ব এত বেশি যে বোঝা যায় না সত্যিই সে হাত তুলল কি না, কিন্তু ইলার মনে হলো তার হাত উঠেছে, সেই এক অদৃশ্য ইশারাই যেন সবচেয়ে গভীর বিদায়; ইলা চোখ ভিজে আসা আটকাতে পারল না, ডায়েরি থেকে চাপা দেওয়া কাশফুলের ডগাটা বের করে বুকের কাছে চেপে ধরল, যেন এটুকুই সেতু হয়ে থাকুক শহরের ভিড় আর নদীর শান্তির মধ্যে।

বাস সেতুর ওপর উঠল, নিচে নদী ভোরের আলোয় ম্লান, তবু স্রোতের ভেতর এক ধরনের স্থিরতা, ইলা জানল—নদী তাকে ছেড়ে দিচ্ছে না, বরং সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছে; সে ব্যাগ থেকে ছোট্ট শঙ্খটা বের করে কানে ধরল, ভেতর থেকে শোঁ শোঁ শব্দ উঠল, যেন ভোরের নদীর নিশ্বাস, তার বুকের ভেতরের শূন্যতা ধীরে ধীরে ভরে উঠল; সে চোখ বন্ধ করল, মনে হলো পাশে রুদ্র বসে আছে, কিছু বলছে না, শুধু নিঃশব্দে উপস্থিত, যেমন ছিল এতদিন।

শহরের প্রথম ভিড় চোখে পড়তেই ইলার বুকটা আবার ভারী হলো, রাস্তার মোড়ে ট্রাফিক সিগন্যাল, হর্ন, মানুষের দৌড়ঝাঁপ—সব আগের মতো, অথচ আজ তার ভেতরে অন্য এক ছন্দ, শহরের কোলাহলের ভেতরেও সে নদীর গন্ধ পাচ্ছে, শঙ্খের শব্দ শুনছে, কাশফুলের দুলুনি দেখছে; সে জানত, এখন থেকে প্রতিটা ছবি তোলার সময়, প্রতিটা আলো ধরার সময়, প্রতিটা শব্দ শুনতে গিয়েও সে নদীর প্রতিধ্বনি খুঁজবে, রুদ্রর কণ্ঠ খুঁজবে, আর এই খোঁজা-টুকুই তাকে বাঁচিয়ে রাখবে।

ডায়েরি খুলে সে দ্রুত লিখল—“নদীর ধারে শেষ বিকেল কোনো শেষ নয়, এটা কেবল শুরু, কারণ নদী যেমন থামে না, তেমনই অনুভবও থামে না, তারা কেবল রূপ পাল্টায়; আমি ফিরছি, তবু ফিরে যাচ্ছি না, কারণ আমার ভেতরে একটা ঘাট তৈরি হয়েছে, যেখানে প্রতিদিন সন্ধ্যায় আরতি হবে, প্রদীপ ভাসবে, আর আলো নদীর মতোই বুক ভরিয়ে দেবে”—পাতাটা লিখে সে ভাঁজ করে ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখল, যেন প্রতিটা বিদায়েরও একটা ঘর থাকে।

বাস এগোতে লাগল, পেছনের দৃশ্য মুছে যেতে লাগল, তবু ইলা জানত, গোসাইপুর তার ভেতরে রয়ে যাবে, নদী তার চোখের ভেতর দিয়ে বয়ে যাবে, আর সেই মানুষের শান্ত দৃষ্টি তার জীবনের মোড় চিরকালের মতো বদলে দেবে—এক অদৃশ্য স্রোত হয়ে, যা থামানো যায় না।

***

WhatsApp-Image-2025-09-05-at-5.33.01-PM.jpeg

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *