উৎসব তরফদার
১
গ্রামের উত্তর প্রান্তে ভাঙাচোরা ইটের দেয়ালের আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে সেই অদ্ভুত জমিদারবাড়ি—যেন সময়ের আঘাতে ক্ষয়ে যাওয়া এক প্রাচীন স্মারক। একসময় এখানে ছিল উজ্জ্বল আলো, অতিথিদের কোলাহল, শঙ্খধ্বনি আর ঢাকের তালে উৎসবের জোয়ার। আজ সবই ম্লান হয়ে গেছে। পুরু দরজায় মরচে, জানালার শিক ভাঙা, ঘাস-লতাপাতা ক্রমে ঢেকে ফেলেছে সিঁড়ির পাটাতন। দিনের বেলায়ও ভেতরে ঢোকার সাহস করে না কেউ, কারণ ভাঙা ছাদের ফাঁক দিয়ে আলো এলেও, ঘরগুলোতে যেন চাপা অন্ধকার জমে থাকে। অথচ এই অন্ধকারের মাঝেই আছে সেই রহস্যময় বাগান—যা এখনো গ্রামজুড়ে লোককথার বিষয়। বাড়ির পিছনের দিক থেকে শুরু হয়েছে এক বিশাল বাগান, যেখানে আজ আর নিয়মিত যত্ন হয় না, শুধু বুনো ঝোপঝাড়ে ভরে উঠেছে চারপাশ। কিন্তু সেই বাগানের এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে জবাগাছগুলো, যাদের নিয়ে প্রচলিত আছে ভয়ংকর এক কাহিনি।
লোকমুখে শোনা যায়—প্রতিদিন রাতে, বিশেষ করে পূর্ণিমা আর অমাবস্যার রাতে, হঠাৎই ফোটে লাল জবা। দিনের আলোয় গাছ শুকনো আর কুঁচকে যাওয়া মনে হলেও, রাত নামলেই যেন প্রাণ ফিরে পায়। বাতাসে দুলতে দুলতে লাল জবার পাপড়িগুলো যেন রক্তে রঙিন হয়ে ওঠে, আর তখনই অলৌকিক ঘটনা ঘটে। কেউ কেউ বলেছে, তারা চোখের সামনে দেখেছে—ফুলের কিনারা থেকে টপটপ করে রক্ত ঝরছে, মাটির উপর লালচে দাগ জমে উঠছে। এমনকি মাটিতে ছিটে থাকা সেই লাল তরলকে অনেকেই আসল রক্ত ভেবে ভয় পেয়ে ছুটে পালিয়েছে। গ্রামের বয়স্কদের দাবি, এই জবা আসলে অভিশপ্ত, এর পাপড়িতে জমে আছে অতীতের এক নারীর কান্না আর মৃত্যুর চিহ্ন। কাহিনি অনুযায়ী, শতবর্ষ আগে এক জমিদারের স্ত্রী এই বাগানে রহস্যজনকভাবে প্রাণ হারান, আর সেই থেকেই তাঁর অশান্ত আত্মা জবাগাছে আশ্রয় নিয়েছে। ফলে যখনই রাত গভীর হয়, জবাফুলে তাঁর রক্তের প্রতিফলন ফুটে ওঠে। অদ্ভুত ব্যাপার হলো—এমন দৃশ্যের কথা সবাই শোনালেও, প্রত্যক্ষদর্শীরা খুব কম। যারা দেখেছে, তারা আবার স্পষ্টভাবে কিছু বলতে পারে না; কেবল আতঙ্কিত দৃষ্টিতে বলে—“ওই বাগানে রাতে যেও না, ওখানে অভিশাপের ছায়া।”
এই ভয়ের আবহেই প্রথমবার কানে আসে শশাঙ্ক বাবুর। তিনি গ্রামে স্কুলশিক্ষক, পড়াশোনা করেছেন শহরে, পরে গ্রামে ফিরে এসেছেন নিজের গ্রামকেই গড়ে তুলতে। মানুষ তাঁকে মান্য করে, কারণ তিনি শিক্ষিত এবং যুক্তিবাদী। কুসংস্কারের কথা শুনে হাসতে হাসতে বোঝান—“সবই তো কাকতাল, প্রকৃতির নিয়ম। ফুল থেকে রক্ত ঝরবে, এটা কি কখনো সম্ভব?” কিন্তু যখন বারবার ছাত্রছাত্রীদের মুখে, গ্রামের মহিলাদের ফিসফাসে, এমনকি বৃদ্ধদের ভয়ভরা চোখে একই গল্প শুনতে পেলেন, তখন তাঁর মনেও কৌতূহল জন্মাল। বিশেষ করে একদিন তাঁর ছাত্রী কমলা কাঁপা গলায় বলল—সে নিজ চোখে দেখেছে লাল ফুলের পাপড়ি থেকে রক্ত পড়তে। কমলার ভয়ংকর বর্ণনা শুনে শশাঙ্ক প্রথমবার ভাবলেন—লোককথা কি তবে নিছক কল্পনা নয়? তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, একদিন নিজেই যাবেন সেই জমিদারবাড়ির বাগানে। যদিও ভেতরে ভয় চেপে বসেছিল, তবু যুক্তি আর সত্য জানার তাগিদ তাঁকে টানছিল। সেই রাত থেকেই “রক্তজবা ফুল”-এর রহস্যের দিকে তাঁর যাত্রা শুরু হলো।
২
সকালের পড়াশোনার সময়টা অন্য দিনের মতোই চলছিল। ছোট ছোট বাচ্চারা মাটির মেঝেতে বসে পাঠ নিচ্ছে, কেউ কেউ অক্ষর কষছে, কেউ আবার গুনগুন করে কবিতা আওড়াচ্ছে। শশাঙ্ক বাবু চক দিয়ে বোর্ডে লিখছিলেন, হঠাৎ লক্ষ্য করলেন এক কোণে বসা কমলার চোখে অদ্ভুত ভয়ের ছায়া। সাধারণত মেয়েটি চঞ্চল, পড়াশোনায় ভালো, কিন্তু সেদিন অস্বাভাবিক চুপচাপ। তিনি কাছে গিয়ে নরম গলায় জিজ্ঞেস করলেন, “কি রে কমলা, শরীর খারাপ নাকি?” কমলা ইতস্তত করে তাকাল, তারপর একসময় যেন হঠাৎ সিদ্ধান্ত নিয়ে বলল, “শিক্ষক মশাই, আমি… আমি দেখেছি।” শশাঙ্ক ভুরু কুঁচকে বললেন, “কি দেখেছিস?” কমলা কাঁপা কাঁপা গলায় জানাল, আগের রাতে সে তার বান্ধবীর বাড়ি থেকে ফিরছিল। পথটা জমিদারবাড়ির পাশ দিয়েই। ঠিক তখনই চাঁদের আলোয় সে দেখেছে—পুরনো বাগানের জবাগাছে ফুল ফুটেছে, আর সেই ফুল থেকে টপটপ করে লাল কিছু পড়ছে। কমলার বর্ণনায় সে শব্দ ব্যবহার করল—“রক্ত।” তার কথা শুনে শ্রেণিকক্ষে এক মুহূর্তের জন্য ফিসফিসানি পড়ে গেল, আর বাকি ছাত্রছাত্রীরা ভয়ে চোখ বড় বড় করে তাকাল।
প্রথমে শশাঙ্ক এই কাহিনি শুনে বিরক্তির সুরে বললেন, “এসব বাজে কথা! ফুল থেকে রক্ত ঝরবে? এটা তো কেবল কুসংস্কার। আলো-আঁধারির খেলা, চোখের ভুল।” তিনি বোঝাতে চাইলেন, গ্রামে যেভাবে গুজব ছড়ায়, তাতে নির্দোষ ফুলকেও অভিশপ্ত করে তোলা যায়। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হলো—নিজের মুখে যুক্তির ব্যাখ্যা দিলেও মনের ভেতর কেমন অস্বস্তি জমে রইল। কারণ, কমলার চোখের ভীতি কোনো বানানো নাটক নয়। সে যদি মিথ্যে বলত, তার মুখে এমন শিউরে ওঠা আতঙ্ক থাকত না। দুপুরে স্কুল ছুটি হলে শশাঙ্ক মাঠের ধারে বসে একা ধূমপান করতে করতে ভাবলেন—লোককথা যদিও কুসংস্কার, তবু প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে টিকে থাকা গল্পের পেছনে কি তবে কোনো অদেখা সত্য লুকিয়ে আছে? তাঁর মনের মধ্যে তর্ক চলতে লাগল—একদিকে শিক্ষকের যুক্তিবাদ, অন্যদিকে এক কিশোরীর সরল অথচ দৃঢ় বিশ্বাস। তিনি নিজের কাছে নিজেই হাসলেন, “ফুল থেকে রক্ত ঝরে? অসম্ভব!” অথচ সেই অস্বস্তি ঘাড় ছেড়ে নামতে চাইছিল না।
সন্ধ্যা নামতেই তাঁর কৌতূহল বেড়ে গেল বহুগুণ। গ্রামের আকাশে চাঁদের আলো ছড়িয়েছে, বাতাসে যেন অন্যরকম গুমোট অনুভূতি। চারপাশে জনমানুষ কমে এলে তাঁর ভেতরে এক অদ্ভুত টান জেগে উঠল। তিনি নিজেকে বোঝাতে চাইলেন—শিক্ষক হিসেবে তাঁর কর্তব্য শুধু ক্লাস নেওয়া নয়, গ্রামের অন্ধবিশ্বাস দূর করাও। তাই এই গুজব যদি ভেঙে দিতে হয়, তবে তাঁকেই প্রমাণ করতে হবে যে রক্তঝরা জবা নিছক মিথ্যে। ঠিক করলেন, আজ রাতেই যাবেন জমিদারবাড়ির বাগানের সামনে। তবে মনে মনে ভয়ও কাজ করছিল—কারণ এই বাগানের চারপাশে যে লোককথা এত বছর ধরে ছড়িয়ে আছে, তা নিছক গুজব হলে কেনই বা কেউ সেখানে রাতে যায় না? খাওয়া শেষ করে তিনি নির্জন পথ ধরে হাঁটতে লাগলেন, হাতে কেরোসিনের লণ্ঠন। আকাশে মেঘের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসা চাঁদ যেন তাঁকে কেবল আরও শিহরণ দিচ্ছিল। দূর থেকে যখন জমিদারবাড়ির কালো অবয়ব চোখে পড়ল, তাঁর পায়ের গতি শ্লথ হয়ে গেল। বুকের ভেতর ধকধক শব্দে কান ঝালাপালা হচ্ছিল। কিন্তু যুক্তির কাছে ভয় হার মানল—একবার না গেলে সত্য উদ্ঘাটন হবে না। শশাঙ্ক বুঝলেন, কৌতূহল তাঁকে টেনে এনেছে এক অভিশপ্ত বাগানের দিকে, যেখানে হয়তো অপেক্ষা করছে ভয়াবহ এক অভিজ্ঞতা।
৩
রাতটা ছিল ভৌতিকভাবে শান্ত। গ্রামের মাটির পথ ধরে শশাঙ্ক যখন জমিদারবাড়ির দিকে এগোচ্ছিলেন, তখন দূরে কেবল ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক আর মাঝে মাঝে শেয়ালের হুক্কাহুয়া ছাড়া আর কোনো শব্দ শোনা যাচ্ছিল না। আকাশে পূর্ণিমার আলো ছড়িয়ে পড়েছিল, কিন্তু সেই আলোতে চারপাশের নির্জনতা আরও প্রকট হয়ে উঠেছিল। লণ্ঠন হাতে তিনি জমিদারবাড়ির ফটকের সামনে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ দ্বিধা করলেন। ভাঙাচোরা দরজার ফাঁক দিয়ে বাগানের গাঢ় অন্ধকার যেন তাঁকে ভেতরে ডেকে নিচ্ছিল। একসময়ের আভিজাত্যের চিহ্ন আজ কেবল শূন্যতা আর শীতল নীরবতায় ভরা। বুকের ভেতর অদ্ভুত এক আতঙ্ক জমে উঠলেও, কৌতূহল যেন তাঁকে আরও জোরে টানছিল। গভীর নিঃশ্বাস নিয়ে তিনি ভেতরে ঢুকে পড়লেন। চারপাশে জঙ্গলাকীর্ণ ঘাস আর অচেনা গন্ধে ভরা বাতাস; মনে হচ্ছিল শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে সময় এখানে থেমে আছে। ধীরে ধীরে তিনি যখন বাগানের ভেতর এগোলেন, তখন চাঁদের আলোয় চোখে পড়ল সেই জবাগাছগুলো। গাছের পাতাগুলো ঝরে গেছে প্রায়, শুকনো ডালগুলো হাড়ের মতো বেরিয়ে এসেছে, কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে কয়েকটি লাল ফুল টলটল করে ফুটে আছে।
প্রথমে মনে হলো হয়তো চাঁদের আলোয় ফুলগুলো লালচে রঙে বেশি ঝলমল করছে। কিন্তু মিনিট খানেক দাঁড়িয়ে থাকতে না থাকতেই শশাঙ্কের চোখে ধরা পড়ল এমন এক দৃশ্য, যা তাঁর সমস্ত যুক্তিবাদকে মুহূর্তে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করাল। জবা ফুলের পাপড়ি থেকে আসলেই টপটপ করে কিছু ঝরছে—তরল, আঠালো আর লালচে। তিনি বিস্ময়ে দেখলেন সেই তরল মাটিতে পড়ছে, আর জমে গাঢ় লাল দাগ হয়ে উঠছে। আলো-আঁধারির খেলা নয়, এ দৃশ্য একেবারেই স্পষ্ট। তাঁর কাঁধে কাঁপুনি বয়ে গেল, শরীর ঠান্ডা হয়ে এলো। মনের ভেতর কেবল একটাই প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে লাগল—এটা কি সত্যিই রক্ত? ভয়ে পা পিছিয়ে গেলেও তিনি চোখ ফেরাতে পারলেন না। যুক্তিবাদী মন বলল, “না, এটা কোনো প্রাকৃতিক রাসায়নিক প্রতিক্রিয়া, হয়তো গাছের রসের সঙ্গে মাটির খনিজ মিশে এমন রঙ তৈরি হয়েছে।” কিন্তু চোখ যা দেখছে, সেটাকে অস্বীকার করার শক্তি তাঁর ছিল না। এক সময় মনে হলো ফুলগুলো যেন অদ্ভুত আলো ছড়াচ্ছে, চাঁদের আলোয় নয়—নিজস্ব কোনো ভেতরের আলোয়। পুরো বাগানটা অচেনা লাল আভায় ঢেকে গেল। মুহূর্তে তাঁর মনে হলো তিনি একা নন, কারও উপস্থিতি আছে আশেপাশে। ঘাড়ের পেছনে অজানা শীতল বাতাসের ছোঁয়া পেয়ে তিনি শিউরে উঠলেন।
তবুও ভয়কে সরিয়ে শশাঙ্ক চেষ্টা করলেন বৈজ্ঞানিকভাবে সবটা বোঝার। তিনি লণ্ঠন নামিয়ে মাটিতে ঝুঁকে পড়লেন, আঙুলের ডগায় ছুঁয়ে দেখলেন লাল তরলটাকে। আঠালো আর উষ্ণ, গন্ধটা তীব্র লোহার মতো—যেন রক্তেরই গন্ধ। হঠাৎ তাঁর বুকের ভেতর প্রবল ধকধকানি শুরু হলো। শরীর কাঁপলেও মনের ভেতর এক অদ্ভুত দৃঢ়তা জন্ম নিল—যদি এটা সত্যিই রক্ত হয়, তবে এর উৎস খুঁজতে হবে। তিনি খেয়াল করলেন, ফুলের ডাঁটায় অদ্ভুত কালচে দাগ, যা সাধারণ গাছে দেখা যায় না। আশপাশে শুকনো পাতার স্তূপ থেকে যেন ফিসফিস শব্দ আসছে, কিন্তু কোনো মানুষ নেই। তখন তাঁর মনে পড়ল কমলার ভীত মুখ, গ্রামের মানুষের কুসংস্কার আর সেই শতবর্ষ আগের অভিশাপের গল্প। হঠাৎ মনে হলো ফুলের লালচে রঙে মিশে আছে অচেনা কোনো কান্না, কোনো আর্তি। এক মুহূর্তের জন্য তাঁর মনে হলো, গাছগুলো যেন মানুষের মতো নিঃশ্বাস নিচ্ছে। ভয় আর কৌতূহলের লড়াই তাঁকে তটস্থ করে রাখল। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে তাঁর উপলব্ধি হলো—এ রহস্য কোনো সাধারণ প্রাকৃতিক ঘটনা নয়, এখানে লুকিয়ে আছে অতীতের কোনো কালো ইতিহাস। আর সেই ইতিহাসকে ভেদ না করা পর্যন্ত, এই গ্রাম, এমনকি তিনি নিজেও শান্তি পাবেন না।
৪
গ্রামের বাতাসে এক অদ্ভুত ভারী নিস্তব্ধতা নেমে এসেছিল, যেন আকাশের প্রতিটি তারা তাকিয়ে আছে সেই পুরনো জমিদারবাড়ির দিকে। শশাঙ্ক বাবু, যিনি নিজেকে সবসময় যুক্তিবাদী মনে করেন, এবার কৌতূহলের টানে বাগানের গোপন রহস্য আরও গভীরভাবে অনুসন্ধান করতে চাইলেন। তাই তিনি একদিন সরাসরি খোঁজ নিলেন গ্রামের প্রাচীনতম মানুষ হরিপদ মালির। হরিপদ সারা জীবন এই বাগানেই কাজ করেছে—জমিদারের সময়ে সে ছিল এক তরুণ মালি, আর আজ ভগ্নদেহ, রোদে পোড়া মুখ, কুঁচকে যাওয়া হাত-পা, কিন্তু চোখে আছে এক রহস্যময় ঝিলিক। শশাঙ্ক তাকে প্রশ্ন করলেন—“হরিপদ কাকা, এই বাগানে রাতে যে অদ্ভুত ঘটনা ঘটে, তা কি তুমি জানো?” হরিপদ অনেকক্ষণ চুপ করে রইল, শুধু ধোঁয়া ছেড়ে বিড়ি টানতে লাগল। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল—“বাবু, সব কথা সবার জানার নয়। জমিদারবাড়ির গাছপালা যেমন সোজা নয়, তেমনি এর ইতিহাসও আঁকাবাঁকা। তবে শোনো, এই বাগান একসময় জমিদার অনন্তনারায়ণের অহংকার ছিল। তিনি এক এক করে বিরল গাছপালা এনেছিলেন বিদেশ থেকে, কেবল দেখানোর জন্য, কেবল প্রমাণ করার জন্য যে তিনিই গ্রামের আসল ক্ষমতাধর।” হরিপদ বলার সময় তার কণ্ঠস্বর কেঁপে উঠছিল, আর যেন বহুদিন ধরে জমে থাকা ভয়ের ছায়া তার মুখে স্পষ্ট হয়ে উঠল।
শশাঙ্ক বাবু মন দিয়ে শুনছিলেন। তিনি বুঝলেন, শুধু ফুলের অদ্ভুততা নয়, এর পেছনে জমে আছে গ্রামীণ ইতিহাসের অন্ধকার অধ্যায়। হরিপদ আবার বিড়ির টান দিল এবং আস্তে করে বলল—“জমিদার অনন্তনারায়ণ ছিলেন এক অদ্ভুত মানুষ। ক্ষমতা ছিল তার নেশা, অহংকার ছিল তার খাদ্য। শখ করে তিনি এই লাল জবা গাছ লাগান, তবে শখের মধ্যেও ছিল এক ধরনের অশুভ গোপন উদ্দেশ্য। লোককথায় শোনা যায়, তিনি কোনো এক ব্রাহ্মণ পণ্ডিতকে দিয়ে তন্ত্রসাধনা করাতেন এই গাছে। বলা হত, রক্ত না দিলে গাছ বাঁচে না। গ্রামের মানুষরা বিশ্বাস করে, জমিদারের লোভ আর অমানবিকতা মিশে গেছে এই বাগানের মাটিতে। তাই এখনও রাতে ফুল ফুটলে তার পাপড়ি থেকে রক্ত ঝরে।” শশাঙ্ক এমন কাহিনি শুনে ভ্রূ কুঁচকালেন। তিনি জানেন, এগুলো নিছক কুসংস্কারও হতে পারে, কিন্তু হরিপদের চোখে ভয় এবং তার কণ্ঠে কাঁপন যেন অন্য ইঙ্গিত দিচ্ছিল। তবে হরিপদ হঠাৎ কথার গতি থামিয়ে বলল—“আমি বেশি কিছু বলব না, বাবু। শুধু বলি—রাতে বাগানে বেশি যেও না। চোখ যা দেখে, সব সময় তা বিশ্বাস করা উচিত নয়।”
শশাঙ্ক বাবু আরও জানতে চাইলে হরিপদ আর কোনো উত্তর দিল না, শুধু মাথা নীচু করে নীরবে বিড়ি ফুঁকতে লাগল। তার গলার স্বর বদলে গিয়েছিল, যেন ভয় এবং গোপনীয়তার দেয়াল তৈরি করে ফেলল। শশাঙ্কের মনে প্রশ্ন জমতে লাগল—এমন কী আছে এই বাগানে, যা গ্রামবাসী বলতেও ভয় পায়? কেন হরিপদ, যে এত বছর এই বাগান চেনে, সরাসরি সত্যটা বলতে চাইল না? তিনি নিজের অন্তরে দৃঢ় সংকল্প করলেন—যেভাবেই হোক, এই রহস্য তাকে উদ্ঘাটন করতেই হবে। যুক্তি এবং বিজ্ঞানের আলোয় তিনি খুঁজে বের করবেন অন্ধকারের ভেতরে লুকিয়ে থাকা সত্য। কিন্তু হরিপদের সতর্কবাণী তার কানে ভেসে বেড়াচ্ছিল—“চোখ যা দেখে, সব সময় তা বিশ্বাস করা উচিত নয়।” সেই কথাটা তার হৃদয়ে অদ্ভুত একটা কাঁপন জাগিয়ে তুলল, যেন অদৃশ্য হাত ছুঁয়ে দিয়ে গেল ভবিষ্যতের বিপদের ইঙ্গিত।
৫
শশাঙ্ক বাবুর কৌতূহল ধীরে ধীরে যেন এক অবসেশনে রূপ নিচ্ছিল। তিনি দিনে স্কুলের কাজ শেষ করেই সন্ধ্যার পর বসে পড়তেন গ্রাম সংলগ্ন পুরনো লাইব্রেরি বা গ্রামের প্রবীণদের অন্দরমহলে, যেখানে এখনও ছড়িয়ে আছে জমিদার অনন্তনারায়ণ রায়ের স্মৃতি ও গল্প। গ্রামে পুরনো দলিল, ভেজা নথি, হলুদ হয়ে যাওয়া সংবাদপত্রের কেটে রাখা অংশ—এসব তিনি যত্ন করে সংগ্রহ করতে শুরু করলেন। গ্রামের বয়স্ক মানুষরা প্রথমে মুখ খুলতে চাইত না, কিন্তু ধীরে ধীরে তাঁর আন্তরিকতা আর অনুসন্ধিৎসা দেখে কয়েকজন অল্প অল্প করে বলতে শুরু করল। তারা জানাল, অনন্তনারায়ণ শুধু জমিদারই ছিলেন না, ছিলেন ভয়ের প্রতীক। জমিদারের শোষণের কাহিনি মানুষ আজও ভুলতে পারেনি। অতি সামান্য কর না দিতে পারলে প্রজাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হত, মহিলাদের অপমান করা হত প্রকাশ্যে, আর তরুণদের জোর করে টেনে নেওয়া হত জমিদারের খেয়াল-খুশি পূরণের জন্য। শশাঙ্ক বাবু এসব শুনে আঁতকে উঠলেন—কেমন করে মানুষ এতটা নিষ্ঠুর হতে পারে! তাঁর মনে হচ্ছিল, এ বাগান, এ বাড়ি, এ ফুল—সবকিছু যেন ইতিহাসের আঁধারে জমে থাকা কান্না আর ক্রোধের প্রতীক হয়ে আছে।
এই অনুসন্ধানের মধ্যেই তিনি আবিষ্কার করলেন এক ভয়ংকর গল্প। হরিপদ কাকু তো সরাসরি বলতে চাননি, কিন্তু গ্রামের আরেক প্রবীণ, অচ্যুত মাস্টার, একদিন গোপনে জানালেন এক নারীর অকাল মৃত্যুর কথা। কথিত আছে, জমিদারের নজর পড়েছিল এক গরিব কৃষকের স্ত্রীর ওপর। সেই নারী ছিল অপরূপা—লম্বা চুল, শ্যামলা গায়ের রং, চোখে যেন অদ্ভুত দীপ্তি। জমিদার নাকি জোর করে তাকে প্রাসাদে আনার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু নারী নিজের সম্মান রক্ষার জন্য আত্মহত্যা করে বসেননি, বরং এক অদ্ভুত দুর্ঘটনায় তাঁর মৃত্যু ঘটে বাগানের জবাগাছের পাশে। কেউ বলে জমিদারের লোকেরা তাকে হত্যা করে গাছে ঝুলিয়ে দেয়, কেউ বলে তিনি লজ্জা ও অপমানে নিজেই গলায় দড়ি দেন, আবার কেউ বলে—গাছের গোড়ায় রক্তের দাগ সেই ঘটনার পর থেকে আর মুছে যায়নি। অচ্যুত মাস্টারের গলা কেঁপে উঠছিল যখন তিনি বলছিলেন, “ওই রাতের পর থেকেই লাল জবা ফুলের পাপড়িতে রক্ত ঝরতে শুরু করে। গ্রামে যত বিদ্বান, তান্ত্রিক, পণ্ডিত এসেছেন, কেউই ব্যাখ্যা দিতে পারেননি। মানুষ শুধু ভয়ে গুটিয়ে গিয়েছে।” শশাঙ্ক বাবু শিউরে উঠলেন, কারণ হঠাৎ তাঁর মনে পড়ল কমলা নামের মেয়েটি যে প্রথম তাঁকে এই ঘটনার কথা বলেছিল। ছোট্ট ছাত্রীটির কণ্ঠে যে আতঙ্ক তিনি শুনেছিলেন, তার শিকড় হয়তো এই অতীতের রক্তাক্ত অধ্যায়ে গেঁথে আছে।
শশাঙ্ক বাবু গভীর রাতে তাঁর পড়ার টেবিলে বসে নথিগুলো উলটে-পালটে ভাবছিলেন। প্রতিটি শব্দ যেন তাঁকে অন্ধকারে ঠেলে দিচ্ছিল। অনন্তনারায়ণের নিষ্ঠুরতা, প্রজাদের কান্না, আর সেই রহস্যময় নারীর মৃত্যুর ঘটনাটি একসঙ্গে মিশে যেন বর্তমানেও জীবন্ত হয়ে উঠছিল। তিনি ভাবলেন—মানুষের রক্ত আর অশ্রু যে মাটিতে মিশে যায়, সে মাটি কোনোদিন কি নিরীহ থাকে? হয়তো সেই ব্যথা, সেই অবমাননা আজও এই ফুলের ভেতর দিয়ে প্রকাশ পাচ্ছে। কিন্তু বৈজ্ঞানিক মন তাঁকে টেনে নিল অন্য পথে—হয়তো কোনো বিশেষ প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া, হয়তো কোনো রাসায়নিক বিক্রিয়া মাটির সঙ্গে মিশে গিয়ে ফুলকে এভাবে অস্বাভাবিক করেছে। কিন্তু একবার আবারও মনে পড়ল অচ্যুত মাস্টারের চোখের ভয়ার্ত দৃষ্টি, তার গলা কাঁপা স্বর—যেন সেই নারী এখনও ঘুরে বেড়াচ্ছেন বাগানের লাল ফুলের ভেতরে, তাঁর রক্তাক্ত আত্মচিহ্ন রেখে গেছেন প্রতিটি পাপড়িতে। শশাঙ্ক বুঝলেন, অতীতের ছায়া শুধু ইতিহাস নয়, তা যেন বর্তমানেও শ্বাস নিচ্ছে, বেঁচে আছে, আর তাঁকে ডেকে নিয়ে যাচ্ছে এক গভীর অন্ধকার রহস্যের দিকে।
৬
জমিদার অনন্তনারায়ণের ইতিহাস ঘেঁটে যতই সামনে আসছিল, শশাঙ্ক বাবুর মনে ততই তৈরি হচ্ছিল এক অন্ধকার ছবি। তবে এবার তিনি জানতে পারলেন এক নতুন নাম—পদ্মাবতী। গ্রামজুড়ে ফিসফাস শোনা যায়, পদ্মাবতী ছিলেন জমিদারের স্ত্রী, তবে অন্য নারীদের মতো অসহায় নয়। তিনি ছিলেন শিক্ষিতা, স্নিগ্ধ মুখশ্রী আর অসাধারণ সৌন্দর্যের অধিকারিণী। কিন্তু শুধু সৌন্দর্যই তাঁকে গ্রামের লোকের মনে অমর করেনি, তিনি ছিলেন দয়ালু, মানবিক এবং অত্যন্ত সাহসী। প্রজাদের কষ্ট তিনি হৃদয় দিয়ে অনুভব করতেন, তাঁদের পাশে দাঁড়াতেন, কখনও গোপনে সাহায্য করতেন, কখনও প্রকাশ্যে জমিদারের বিরোধিতা করতেন। গ্রামের বহু বৃদ্ধ আজও বলেন—“ও বউঠানই ছিলেন আমাদের একমাত্র ভরসা।” পদ্মাবতী যেমন স্নেহে গৃহস্থালি সামলাতেন, তেমনি জমিদারের দম্ভের সামনে দাঁড়িয়ে বলতে পারতেন—অন্যায় সহ্য করা যাবে না। তাঁর এই সাহসই একসময় কাল হয়ে দাঁড়ায়।
লোককথা অনুসারে, একদিন অনন্তনারায়ণ প্রকাশ্যে প্রজাদের উপর নিষ্ঠুরতা চালাচ্ছিলেন। তখন পদ্মাবতী প্রতিবাদ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন—“মানুষের রক্তের উপর রাজত্ব টেকে না, তুমি একদিন অভিশপ্ত হবে।” এই কথাই নাকি জমিদারের আত্মসম্মানে আঘাত করেছিল, এবং সেই থেকেই শুরু হয়েছিল স্ত্রীকে অপমান ও যন্ত্রণার খেলা। জমিদারের অন্দরমহলে পদ্মাবতীকে বন্দি করে রাখা হত, তাঁর খাবারে অস্বস্তিকর জিনিস মেশানো হত, তাঁকে ঘরের বাইরে যেতে দেওয়া হত না। গ্রামের মানুষ দূর থেকে শুধু কান্নার শব্দ শুনতে পেতেন। শশাঙ্ক বাবু এই সমস্ত কথা শুনে আতঙ্কিত হয়ে পড়লেন। তিনি বুঝতে পারলেন, পদ্মাবতী শুধু স্বামীকেই নয়, গোটা অন্যায়ের সাম্রাজ্যকেই চ্যালেঞ্জ করেছিলেন। কিন্তু সেই সাহসী কণ্ঠস্বরের মূল্য তাঁকে চোকাতে হয়েছিল জীবন দিয়ে। এক অমাবস্যার রাতে, প্রবল ঝড়বৃষ্টির মধ্যে, পদ্মাবতীর মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছিল জমিদারবাড়ির বাগানে—ঠিক জবাগাছের নিচে। কারও মতে তিনি আত্মহত্যা করেছিলেন, কারও মতে তাঁকে গলা টিপে হত্যা করে ফেলে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সত্যটা কেউ জানত না। শুধু জানা যায়, সেই রাত থেকেই বাগানের জবাগাছ অদ্ভুতভাবে রক্তাক্ত হয়ে ওঠে।
প্রবীণরা বলেন, পদ্মাবতীর মৃত্যুর রাতে আকাশ কালো হয়ে গিয়েছিল, বজ্রপাত হচ্ছিল অবিরাম, আর গ্রামের মানুষ ভয়ে ঘরে লুকিয়ে ছিল। হঠাৎ বাগান থেকে শোনা যায় অস্বাভাবিক আর্তচিৎকার, সঙ্গে কাঁপতে থাকা মাটির শব্দ। যারা জানলার ফাঁক দিয়ে তাকিয়েছিল, তারা বলেছিল—জবাগাছের ডালপালা অদ্ভুত আলোয় কাঁপছিল, আর হঠাৎই ফুল ফুঁটে উঠছিল একে একে, যার প্রতিটি পাপড়ি থেকে ঝরে পড়ছিল টগবগে রক্ত। সেই থেকে গ্রামে বিশ্বাস জন্মায়—পদ্মাবতীর অশান্ত আত্মা বাগানে বন্দি হয়ে আছে, আর প্রতিটি জবা ফুল তাঁর রক্তাক্ত কান্নার প্রতীক। কেউ বলেন, তিনি ন্যায় চাইছেন, কেউ বলেন, অভিশাপ দিচ্ছেন। শশাঙ্ক বাবু যখন এই গল্প শুনলেন, তাঁর শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা স্রোত নেমে গেল। যুক্তিবাদী মন বলল—এ সবই অতিরঞ্জিত লোককথা। কিন্তু অন্যদিকে তাঁর হৃদয়ের গভীর থেকে উঠে এল এক অস্বস্তিকর সত্য—যদি পদ্মাবতীর আত্মা সত্যিই অশান্ত থাকে? যদি সেই জবাফুলের রক্ত আসলে তাঁর দুঃখের চিহ্ন হয়? শশাঙ্ক বুঝলেন, “রক্তজবা ফুল”-এর রহস্য উন্মোচন করতে হলে তাঁকে শুধু বৈজ্ঞানিক চোখেই নয়, ইতিহাস আর মানবিকতার আলোতেও দেখতে হবে। পদ্মাবতীর গল্প তাঁর মনে স্থায়ী হয়ে গেল, যেন এই রহস্যের মূল চাবিকাঠি তিনিই।
৭
পদ্মাবতীর মৃত্যুর পর গ্রামজুড়ে যেন এক অদ্ভুত অশুভ ছায়া নেমে এলো। সেই রাত থেকে শুধু জমিদারবাড়ির বাগান নয়, পুরো গ্রামই হয়ে উঠল ভয়ের আবহে মোড়ানো। শশাঙ্ক বাবু পুরনো নথি আর লোককথার খণ্ডাংশ মিলিয়ে যখন অতীতের এই অধ্যায় জানলেন, তাঁর শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেল। প্রথমে গ্রামে শুরু হয়েছিল হঠাৎ হঠাৎ অসুখের প্রকোপ। শিশুরা জ্বরে ভুগে মারা যাচ্ছিল, তরুণরা দুর্বলতায় কাজ করতে পারছিল না। তারপর এল খরা, খেতের ফসল শুকিয়ে গেল অকালেই। কিছুদিনের মধ্যেই শুরু হল দুর্ভিক্ষ, গ্রামে খাদ্যাভাবে মানুষ একে একে প্রাণ হারাতে লাগল। সেই সঙ্গে জমিদারের অত্যাচারও কমেনি, বরং তিনি লোকজনকে বিশ্বাস করাতে চাইলেন—এই দুর্দশা নাকি প্রজাদের পাপের ফল। কিন্তু গ্রামের মানুষ বুঝতে পারছিল, আসল কারণ অন্য কিছু। তারা ফিসফিস করে বলত, “পদ্মাবতীর আত্মা শান্তি পাচ্ছে না, তাঁর রক্তই সিঞ্চিত করছে সেই জবাগাছ। তাই এই অভিশাপ।” শশাঙ্ক কল্পনায় ভেসে উঠতে দেখলেন—পদ্মাবতীর রক্তাক্ত মুখ, তাঁর কান্না, আর সেই কান্নার সঙ্গে মিশে যাওয়া গ্রামের অজস্র শোকগাথা।
বৃদ্ধরা বলেন, সেই সময়কার গ্রাম যেন ছিল এক মৃত্যুর রাজ্য। রাত নামলেই অদ্ভুত আওয়াজ শোনা যেত জমিদারবাড়ির দিক থেকে—কখনও নারী কণ্ঠের হাহাকার, কখনও মাটিতে রক্ত পড়ার মতো শব্দ। যারা সাহস করে বাগানের কাছ দিয়ে যেত, তারা দেখত ভেজা লালচে মাটি আর বাতাসে লুকিয়ে থাকা এক চাপা কান্না। ধীরে ধীরে মানুষের মনে বিশ্বাস জন্মাল যে, পদ্মাবতীর রক্তে সিঞ্চিত জবা আসলে অভিশপ্ত। তার প্রতিটি পাপড়ি যেন মানুষের দুর্দশার বার্তা নিয়ে আসে। শিশুমৃত্যু ঘটলে বলা হত—“আজ রক্তজবা ফুটেছিল।” খরার দিনে লাল ফুল ঝলমল করলে মনে হত—“অভিশাপ আবার ছড়াচ্ছে।” আর কেউ মারা গেলে লোকেরা বলত—“পদ্মাবতীর অভিশাপ মাটি গিলে নিল।” এই বিশ্বাস এতটাই গভীর হয়ে উঠেছিল যে, জমিদারের শাসন থেকেও বেশি ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছিল ফুলের সেই অলৌকিক উপস্থিতি। মানুষ জমিদারকে ঘৃণা করলেও তাঁকে সহ্য করত, কিন্তু রক্তজবার ভয়ে গ্রামের রাস্তায় রাতের পর কেউ বেরোতে সাহস করত না।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেক কিছু বদলেছে—জমিদারি প্রথা উঠে গেছে, অনন্তনারায়ণের পরিবার ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে, কিন্তু রক্তজবার কাহিনি বেঁচে থেকেছে লোকের মুখে মুখে। শশাঙ্ক যতই ইতিহাস পড়ছিলেন, বুঝতে পারছিলেন—অভিশাপের গল্পকে নিছক কুসংস্কার বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কারণ এই কাহিনি কেবল ফুলের অলৌকিকতার নয়, এটি মানুষের যন্ত্রণা, মৃত্যুর শোক আর অবিচারের বিরুদ্ধে এক প্রতীকী প্রতিবাদ। পদ্মাবতীর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে যে দুর্যোগ নেমে এসেছিল, তা হয়তো কাকতালীয়, হয়তো প্রাকৃতিক কারণ, কিন্তু মানুষের বিশ্বাসে তা রূপ নিয়েছিল অভিশাপে। এই বিশ্বাসই শতবর্ষ ধরে গ্রামে বেঁচে আছে, আর আজও মানুষ বলে—“রাতে ওই বাগানে যেও না, রক্তজবার অভিশাপ তোমাকে গ্রাস করবে।” শশাঙ্ক বুঝলেন, এ কাহিনি শুধু ইতিহাস নয়, বরং গ্রামীণ মনস্তত্ত্বের গভীরে বোনা এক দগদগে ক্ষত। আর সেই ক্ষত থেকেই জন্মেছে রক্তজবার রক্তাক্ত কিংবদন্তি, যা তাঁকে এখন টেনে নিয়ে যাচ্ছে রহস্যের গভীর অতলে।
৮
দিন যত এগোচ্ছিল, শশাঙ্কের ভেতরের অস্থিরতা ততই বাড়ছিল। শুধু গল্প শুনে আর আন্দাজ করে চলা তাঁর স্বভাবের সঙ্গে যায় না। তিনি জানতেন, পদ্মাবতীর মৃত্যু নিছক কাকতাল নয়—এটা আসলে এক সুপরিকল্পিত অপরাধ। সেই সত্যটা খুঁজে বের করার জন্য তিনি আবারও ফিরে গেলেন নথির ভেতরে। জমিদারবাড়ির পুরনো দলিল, ম্লান হয়ে যাওয়া চিঠি, এমনকি গ্রামপঞ্চায়েতের আর্কাইভে পড়ে থাকা রিপোর্ট—সব তিনি ধৈর্য ধরে ঘেঁটে দেখলেন। সেখানে পাওয়া গেল কয়েকটি চাঞ্চল্যকর সূত্র। একটি চিঠিতে, যা সম্ভবত পদ্মাবতীর বোন লিখেছিলেন, উল্লেখ ছিল—“দিদিকে অনন্তনারায়ণ আর সহ্য করতে পারছে না। ওর প্রতিবাদ এখন খোলাখুলি অপমান হয়ে দাঁড়িয়েছে।” আরেকটি রিপোর্টে লেখা—অমাবস্যার রাতে পদ্মাবতী অস্বাভাবিকভাবে নিখোঁজ হন, পরদিন তাঁর দেহ পাওয়া যায় জমিদারবাড়ির বাগানে। শশাঙ্কের মনে আর কোনো সন্দেহ রইল না—এটা নিছক দুর্ঘটনা নয়, বরং এক পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড।
এই সূত্রগুলো নিয়ে তিনি আবার হরিপদ কাকুর কাছে গেলেন। বহুদিনের আলাপে হরিপদ তাঁকে বেশ আপন করে ফেলেছিলেন, কিন্তু এতদিন মূল সত্য গোপন রেখেছিলেন। সেদিন রাতে শশাঙ্ক যখন প্রমাণগুলো সামনে রাখলেন, হরিপদ দীর্ঘক্ষণ চুপ করে রইলেন। তাঁর মুখে তখন প্রবল দ্বন্দ্ব—কথা বলবেন কি বলবেন না। অবশেষে তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “আমার দাদু ছিলেন জমিদারবাড়ির মালি। সেই রাতেই তিনি সবকিছু দেখেছিলেন।” শশাঙ্ক উৎকণ্ঠিত হয়ে শুনতে লাগলেন। হরিপদ জানালেন, ঝড়-বৃষ্টির সেই ভৌতিক রাতে তাঁর দাদু বাগানে ছিলেন। হঠাৎই তিনি শুনতে পান পদ্মাবতীর চিৎকার। দাদু ছুটে গিয়ে দেখেন, জমিদারের দুই বিশ্বস্ত দারোয়ান তাঁকে গলা টিপে ধরেছে, আর অনন্তনারায়ণ পাশে দাঁড়িয়ে হেসে বলছেন—“আজ থেকে তোমার প্রতিবাদের ইতি।” পদ্মাবতীর প্রাণ তখনই শেষ হয়ে যায়, আর তাঁর দেহটাকে জবাগাছের গোড়ায় ফেলে রাখা হয়। দাদু দূর থেকে তা দেখলেও, ভয়ে এবং চাকরি হারানোর ভীতিতে কিছু বলতে পারেননি। এই ঘটনার পর থেকেই তিনি ভেঙে পড়েন, আর মৃত্যুর আগে নাতি হরিপদকে সব বলে যান।
শশাঙ্ক স্তব্ধ হয়ে গেলেন। এতদিন যা লোককথা ভেবে এসেছিলেন, হরিপদের মুখে তা যেন জ্বলজ্যান্ত ইতিহাস হয়ে উঠল। তিনি বুঝলেন, পদ্মাবতীর আত্মা মুক্তি পায়নি, কারণ তাঁর মৃত্যু ছিল অন্যায়, নিষ্ঠুর এবং অসম্মানজনক। গ্রামের মানুষ যে রক্তজবার পাপড়িতে রক্ত ঝরতে দেখে, তা আসলে পদ্মাবতীর অসমাপ্ত চিৎকার, তাঁর ন্যায়ের দাবি। অভিশপ্ত বাগান আসলে এক নারীর অশান্ত আত্মার প্রতীক হয়ে আছে। শশাঙ্কের হৃদয় কেঁপে উঠল—এখন তাঁর দায়িত্ব আরও বেড়ে গেল। শুধু রহস্য উদ্ঘাটন করলেই চলবে না, তাঁকে কোনোভাবে পদ্মাবতীর আত্মাকে শান্তি দিতে হবে। তাঁর মৃত্যুর সত্য সবাইকে জানাতে হবে, যাতে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে চলা এই অভিশাপ একদিন মুছে যায়। তবে শশাঙ্ক এটাও জানতেন, সত্য প্রকাশের পথ সহজ নয়। কারণ ভয়, অন্ধকার আর অভিশাপের কাহিনি এত গভীরভাবে মানুষের মনে গেঁথে গেছে যে, সত্যিটাকে তুলে ধরতে হলে তাঁকে লড়তে হবে গ্রামবাসীর বিশ্বাস, ভীতি আর সময়ের সঙ্গে।
৯
শশাঙ্ক বহুদিন ধরে পদ্মাবতীর মৃত্যুর সত্যতা উদ্ঘাটনের চেষ্টা করছেন, কিন্তু প্রত্যেকবারই মনে হয়েছে, শেষ সত্যটি যেন তাঁকে এড়িয়ে যাচ্ছে। গ্রামবাসীরা ভয়ে বাগানের দিকে তাকাতে চায় না, আর হরিপদর স্বীকারোক্তিও তাঁকে আরও দ্বিধাগ্রস্ত করে তুলেছে। তবু শশাঙ্কের মনে হচ্ছিল, পদ্মাবতীর আত্মা এখনও মুক্তি পায়নি বলেই এই ভয়ের আবহ, এই অশান্তি অটল আছে। এক রাতে তিনি স্থির করলেন—এবার সরাসরি মুখোমুখি হতে হবে আত্মার সঙ্গে। অনেক ভেবে তিনি সঙ্গে নিলেন কিছু পুরনো মন্ত্রপাঠের বই, যা তিনি শহরের এক গ্রন্থাগার থেকে সংগ্রহ করেছিলেন। লোককথা বলছে, ধ্যান আর মন্ত্রের সংমিশ্রণে আত্মার সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়। তিনি জানতেন, ভয় আছে, বিপদও আছে, কিন্তু সত্য জানার একমাত্র পথ এটাই। মধ্যরাতের পর, চাঁদের আলো যখন বাগানকে অদ্ভুত নীলাভ আলোয় ঢেকে দিল, শশাঙ্ক আস্তে আস্তে প্রবেশ করলেন। চারপাশে কেবল ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দ, আর শুকনো পাতার খসখসানি। তিনি একটি পুরনো অশ্বত্থ গাছের নীচে আসন পেতে বসলেন, চোখ বন্ধ করে ধ্যান শুরু করলেন। বুকের ভেতর অদ্ভুত কাঁপুনি হলেও তিনি শান্ত থাকার চেষ্টা করলেন।
ক্রমশ মন্ত্রপাঠ গভীর হতে থাকল, আর তাঁর মন অদ্ভুত এক স্তরে প্রবেশ করল। হঠাৎ তিনি অনুভব করলেন বাতাসের তাপমাত্রা নেমে যাচ্ছে, যেন শীতল বরফি হাওয়া তাঁকে ঘিরে ধরেছে। চোখ খুলতেই দেখলেন—চারপাশে কুয়াশা জমেছে, আর সেই কুয়াশার মাঝেই ধীরে ধীরে এক নারীমূর্তি স্পষ্ট হয়ে উঠছে। শশাঙ্ক প্রথমে ভেবেছিলেন, চোখের ভ্রম, কিন্তু পরক্ষণেই বুঝলেন—এ কোনো ভ্রম নয়। তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে আছেন পদ্মাবতী। লম্বা কেশ ছড়িয়ে আছে কাঁধে, চোখে অদ্ভুত বেদনা, ঠোঁটে কষ্টের রেখা। তাঁর সাদা শাড়ি বাতাসে দুলছে, অথচ আশপাশে বাতাস নেই। শশাঙ্কের শরীর অবশ হয়ে এলেও তিনি স্থির থাকার চেষ্টা করলেন। পদ্মাবতী প্রথমে কিছু বলেননি, শুধু গভীরভাবে শশাঙ্কের চোখের দিকে তাকালেন। সেই দৃষ্টিতে যেন শতাব্দীর দুঃখ, অবিচার আর অশান্তি জমে আছে। তারপর কণ্ঠস্বর ভেসে এলো—এক ভয়ার্ত অথচ স্পষ্ট স্বর, “আমার মৃত্যু হঠাৎ হয়নি, আমায় হত্যা করা হয়েছিল। আমার রক্তের দাগ এখনও এই মাটির গভীরে রয়ে গেছে। আমি ন্যায় চাই, ন্যায়বিচার ছাড়া আমি মুক্তি পাব না।”
শশাঙ্ক শিহরিত হয়ে গেলেন। এতদিন ধরে তিনি প্রমাণ জোগাড় করলেও, এই প্রত্যক্ষ উচ্চারণ তাঁর মনের সব দ্বিধা সরিয়ে দিল। পদ্মাবতী বললেন—“আমার হত্যাকারীরা শুধু আমাকে মেরে ফেলেনি, আমার আত্মাকেও অশান্ত করে রেখেছে। যতদিন না সত্য প্রকাশ পাবে, এই বাগান থাকবে অভিশপ্ত। মানুষ ভয় পাবে, গাছপালা কাঁদবে, আর রাত হবে আতঙ্কে আচ্ছন্ন। তুমি যদি সত্যিই সাহসী হও, তবে এই অন্ধকার উন্মোচন করো। আমাকে ন্যায় দাও।” কথাগুলো শেষ হতেই পদ্মাবতীর মূর্তি ধীরে ধীরে কুয়াশার ভেতরে মিলিয়ে গেল। বাগানের নিস্তব্ধতা আবার ফিরে এল, কিন্তু শশাঙ্ক জানলেন—এই রাত আর তাঁর জীবনে কখনো ভোলার নয়। তিনি যেন এক অদৃশ্য অঙ্গীকার করে ফেললেন পদ্মাবতীর কাছে। কেবল রহস্য উন্মোচন নয়, এবার তাঁর কর্তব্য হয়ে দাঁড়াল আত্মার মুক্তির ব্যবস্থা করা। বাগান ছেড়ে ফেরার সময় তাঁর চোখে ভয় নয়, বরং এক দৃঢ় সংকল্পের আগুন জ্বলছিল—তিনি সত্য উদ্ঘাটন করতেই হবে, নইলে এই অন্ধকার চিরকাল গ্রামকে গ্রাস করে রাখবে।
১০
সকালের রোদ যখন গ্রামকে সোনালি আলোয় ঢেকে দিয়েছিল, শশাঙ্ক তখন গ্রামবাসীদের ডেকে পাঠালেন বটতলার ময়দানে। বহুদিন ধরে গুজব, ভয় আর অভিশাপের ছায়ায় মানুষজন এখানে জমায়েত হতে চায়নি, কিন্তু শশাঙ্কের অনুরোধে সবাই কৌতূহল নিয়ে হাজির হলো। চোখেমুখে ছিল ভীতি আর দ্বিধা—কেউ ভাবছিল, হয়তো আবার কোনো অলৌকিক ঘটনা ঘটতে পারে। শশাঙ্ক ধীর কণ্ঠে বলতে শুরু করলেন, কীভাবে তিনি নানা সূত্র ঘেঁটে পদ্মাবতীর মৃত্যুর সত্য উদ্ঘাটন করেছেন। তিনি ব্যাখ্যা করলেন—পদ্মাবতীকে গ্রামের জমিদার নিজের লালসার ফাঁদে ফেলতে চেয়েছিলেন, আর যখন তিনি তা অস্বীকার করেন, তখন ষড়যন্ত্র করে নির্মমভাবে তাঁকে হত্যা করা হয়। শশাঙ্ক শুধু কথায় থামলেন না; তিনি সেই সময়কার নথি, জমিদারের আমলের পুরনো কাগজপত্র, আর হরিপদের দাদুর শোনা প্রত্যক্ষ ঘটনার বর্ণনা হাজির করলেন। তাঁর প্রতিটি প্রমাণ এতটাই স্পষ্ট ছিল যে, উপস্থিত কারো সন্দেহ রইল না। গ্রামবাসীরা নিঃশব্দে শুনতে শুনতে কেঁপে উঠল, কারণ এতদিন যে পদ্মাবতীর আত্মাকে ভয় দেখিয়ে অভিশাপ বলা হয়েছিল, সেটি আসলে ছিল অন্যায়ের প্রতিবাদ। শশাঙ্ক দৃঢ় কণ্ঠে বললেন, “অভিশাপ বলে কিছু নেই, অন্যায় আর অবিচারের প্রতিধ্বনি প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে ভয় হয়ে ফিরে আসে। আমরা যদি সত্যকে স্বীকার করি, তবে ভয় ভেঙে যাবে।” তাঁর কণ্ঠে দৃঢ়তা ছিল, আর সেই দৃঢ়তার সঙ্গে যেন গ্রামের দীর্ঘদিনের অন্ধকার কেঁপে উঠল।
গ্রামবাসীরা তখন বুঝতে পারল—যে মেয়েটিকে এতদিন ‘ভূত’ বলে আতঙ্ক ছড়ানো হয়েছিল, সে আসলে ছিল এক সাহসী নারী, যিনি অন্যায়ের কাছে মাথা নত করেননি। সেই উপলব্ধি গ্রামে গভীর আলোড়ন তুলল। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাই সিদ্ধান্ত নিল, পদ্মাবতীর স্মৃতিকে সম্মান জানাতে হবে। সন্ধ্যা নামতেই গ্রামের বয়স্করা মন্দিরে গিয়ে শঙ্খ বাজাল, পুরোহিত পূজার আয়োজন করলেন, আর পদ্মাবতীর নামে প্রথমবারের মতো প্রদীপ জ্বালানো হলো। নারীরা তাঁর উদ্দেশে অঞ্জলি দিল, যেন তিনি আজও তাঁদের সাহসের প্রতীক হয়ে আছেন। গ্রাম্য ছেলেমেয়েরা প্রথমবার শশাঙ্কের কাছে এসে বলল, “আমরা আর ভয় পাব না, দাদা।” পূজার মন্ত্রোচ্চারণে, ধূপ-ধুনোর গন্ধে, আর গ্রামবাসীর চোখের জল মিশে এক আশ্চর্য পরিবেশ তৈরি হলো। যেন দীর্ঘ অন্ধকারের পর ভোর এসে দাঁড়িয়েছে। শশাঙ্ক চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখছিলেন—মানুষেরা কীভাবে নিজেদের ভয়ের শৃঙ্খল থেকে মুক্তি নিচ্ছে। তাঁর চোখে ভেসে উঠল পদ্মাবতীর আবির্ভাবের সেই রাতের দৃশ্য, যখন তিনি বলেছিলেন—“ন্যায় চাই।” শশাঙ্ক মনে মনে বললেন, আজ তাঁর সেই ন্যায়ের শপথ পূর্ণ হলো।
সেই রাতের পর থেকে বাগান আর অশুভ বা ভয়ের জায়গা রইল না। ভোরের শিশিরে ভিজে যখন গাছের পাতায় আলো ঝলমল করত, দেখা যেত জবা ফুল ফুঁটছে উজ্জ্বল লাল হয়ে। কিন্তু আর কখনো সেই ফুলের পাপড়ি থেকে রক্ত ঝরেনি। বরং মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করল—এগুলো পদ্মাবতীর আত্মার শান্তির প্রতীক। ধীরে ধীরে গ্রামের মানুষ সন্ধ্যায় বাগানে হাঁটতে যেতে লাগল, শিশুরা খেলতে শুরু করল, আর কারো মুখে আর ‘অভিশাপ’ শব্দটা শোনা গেল না। শশাঙ্ক প্রমাণ করলেন, ভয় কুসংস্কারের ফল, আর অভিশাপ কেবল ইতিহাসের অন্যায়ের রূপ। পদ্মাবতীর নাম আর আতঙ্কের প্রতীক নয়, হয়ে উঠল সাহস আর মর্যাদার প্রতীক। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গ্রামবাসীরা তাঁকে লোকগাথায় রূপ দিল, গান বাঁধল, বলল—“যে মেয়ে অন্যায়ের সামনে মাথা নোয়ায়নি, তার আশীর্বাদেই আজ গ্রাম শান্ত।” শশাঙ্ক জানতেন, তাঁর কাজ শেষ হয়নি—যে সমাজ সত্যকে চেপে রাখে, সে সমাজ বারবার অন্ধকারে ডুবে যায়। কিন্তু অন্তত এই গ্রামে তিনি প্রমাণ করে গেলেন, অন্যায়ের ওপর আলো ফেলা গেলে, মুক্তির পথও খুঁজে পাওয়া যায়। আর সেই আলোই চিরকালের মতো পদ্মাবতীর আত্মাকে মুক্তি দিল, আর গ্রামের ভয়কে সাহসে রূপান্তরিত করল।
শেষ