Bangla - প্রেমের গল্প

অপরাহ্নের ঘরবন্দি

Spread the love

সুদীপ্তা পাল


অফিসের ভেতর তখন এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা। সারাদিনের ব্যস্ততা, কিবোর্ডের শব্দ, টেলিফোনের রিং, সহকর্মীদের কথাবার্তার ভিড় মিলিয়ে সন্ধ্যা নামার সাথে সাথেই যেন হঠাৎ করেই স্তব্ধ হয়ে গেছে। ফ্লোরের আলো ঝলমল করছে ঠিকই, কিন্তু তার ভেতরে যেন কেবল শূন্যতার প্রতিধ্বনি। একে একে সবাই বাড়ির পথে পা বাড়িয়েছে, শুধু অরিন্দম আর রূপসা টেবিলে শেষ কিছু ফাইল গুছিয়ে নিল। অরিন্দম সবসময় কাজ শেষ করে তারপরেই অফিস ছাড়তে চায়, কোনো অপূর্ণতা তার ভালো লাগে না। রূপসা অবশ্য তাড়াহুড়ো করছিল, কারণ তার এক বান্ধবীর সঙ্গে বাইরে দেখা করার পরিকল্পনা ছিল। তবুও শেষ মুহূর্তের এক ইমেইল জবাব দিতে গিয়ে সে আটকে গেল। দু’জনেই প্রায় একসাথে চেয়ার ছাড়ল, আর অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে লিফটের দিকে এগোল।

লিফটের সামনে দাঁড়িয়ে তারা দুজনেই যেন কাকতালীয়ভাবে পাশাপাশি এসে দাঁড়াল। অরিন্দমের হাতে ছোট্ট ল্যাপটপ ব্যাগ, চশমার ফাঁক দিয়ে ক্লান্ত চোখে তাকিয়ে ছিল সে। রূপসার হাতে একটা ফাইল আর মোবাইল ফোন, হালকা বিরক্ত মুখে স্ক্রিনে নোটিফিকেশন যাচাই করছিল। দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গেই দুজন একসাথে ভেতরে ঢুকে পড়ল। ভেতরে আর কেউ নেই, চারপাশে কেবল ঠান্ডা ইস্পাতের দেয়াল আর হালকা গুঞ্জন। দরজা বন্ধ হতেই অরিন্দম অটোমেটিকভাবে লিফটের বোতাম টিপল। তারা দুজনেই আলাদা কোণে দাঁড়িয়ে গেল, যেন চোখাচোখি এড়িয়ে যেতে চাইছে। অফিসে একসাথে কাজ করলেও তাদের সম্পর্ক কখনো খুব খোলামেলা হয়নি—শুধু প্রয়োজনমতো কথা, তার বেশি কিছু নয়। তাই এই নিস্তব্ধ যাত্রাটা একটু অস্বস্তিকর লাগছিল।

লিফট কয়েক সেকেন্ড চলল, তারপর হঠাৎ ঝাঁকুনি দিয়ে থেমে গেল। আলো নিভল না, কিন্তু বাতাস যেন ভারি হয়ে উঠল। দুজনেই এক মুহূর্ত হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। রূপসা প্রথমেই প্রতিক্রিয়া দিল—“কি হলো আবার?” তার কণ্ঠে ছিল বিরক্তি আর অল্প ভয়ের মিশ্রণ। অরিন্দম সঙ্গে সঙ্গে বোতাম টিপল, একবার নয়, বারবার—কিন্তু কোনো সাড়া নেই। ইন্টারকম চাপল, তাতেও কোনো সাড়া মিলল না। লিফট যেন জীবন্ত কোনো খাঁচার মতো বন্ধ হয়ে রইল তাদের চারপাশে। রূপসা কপালে হাত রেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলল, আর অরিন্দম গম্ভীর মুখে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে রইল। বাইরের পৃথিবীটা যেন মুহূর্তের জন্য তাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল।

প্রথম কিছু মিনিট কেটে গেল নীরবতায়। শুধু লিফটের ভেতরের বাতাসের হালকা আওয়াজ আর দুজনের নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছিল। অরিন্দম সামান্য নড়েচড়ে দাঁড়াল, কিন্তু কোনো কথা বলল না। রূপসা মোবাইল বের করে দেখল—সিগন্যাল নেই। বিরক্তিতে ঠোঁট কামড়ে সে মোবাইলটা ব্যাগে ফিরিয়ে রাখল। তারপর দুজনের মধ্যে সেই চিরচেনা অস্বস্তিকর নীরবতা আরও ঘনীভূত হয়ে উঠল। যেন দুজনেই একে অপরকে কিছু বলতে চাইছে, কিন্তু শব্দ খুঁজে পাচ্ছে না। বাইরে রাত গভীর হচ্ছে, আর লিফটের ধাতব খাঁচায় আটকে থাকা দুই সহকর্মী বুঝতে পারছে—এ যাত্রা হয়তো সহজে শেষ হবে না। সেই মুহূর্তে তারা জানত না, এই অপ্রত্যাশিত আটকে পড়া তাদের জীবনেই এক নতুন অধ্যায়ের দরজা খুলে দেবে।

লিফটটা থেমে যাওয়ার পর যেন পুরো পৃথিবী গাঢ় নীরবতায় ডুবে গেল। বাইরের শহরের কোলাহল, গাড়ির হর্ন, অফিসের কোলাহল—সব যেন এক নিমেষে দূর অদৃশ্য হয়ে গেল। ভেতরে কেবল একটা চাপা গুমোট পরিবেশ, যেটা প্রতি সেকেন্ডে আরও ভারী হয়ে উঠছে। রূপসা প্রথমে একটু আতঙ্কিত হয়ে মোবাইল বের করেছিল, ভাবছিল হয়তো দ্রুত কোনো সাহায্য পাওয়া যাবে। কিন্তু স্ক্রিনে একটাও সিগন্যাল নেই দেখে বিরক্তির সঙ্গে ভয়ের ছাপও স্পষ্ট হয়ে উঠল তার চোখে। সে ফোনটা উপরে তোলে, এক কোণা থেকে আরেক কোণায় ঘুরে ঘুরে চেষ্টা করে—কোনো লাভ নেই। অরিন্দম meanwhile ঠান্ডা মাথায় বোতাম টিপছে বারবার, একবার জরুরি অ্যালার্ম, আবার লিফটের ডোর ওপেন বোতাম, কিন্তু প্রতিবারই শুধু যান্ত্রিক এক অচল প্রতিক্রিয়া। তার কপালে ঘাম জমে উঠতে শুরু করেছে, যদিও সে চশমার আড়ালে চোখের উদ্বেগ লুকিয়ে রাখছে।

সময়ের সাথে সাথে সেই নীরবতা যেন আরও দমবন্ধ হয়ে উঠল। ধাতব দেয়ালের চারদিকে নিস্তব্ধতা এমনভাবে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল যে মনে হচ্ছিল তাদের দুজনের নিঃশ্বাসই কেবল শোনা যাচ্ছে। রূপসা হালকা বিরক্ত গলায় বলল, “এখনও কেন কেউ বুঝতে পারল না? সিকিউরিটির লোকজন কি ঘুমিয়ে আছে নাকি?” তার কণ্ঠের ভেতরে ভয়ের সঙ্গে একরাশ রাগ মিশে গেল। অরিন্দম শান্ত গলায় উত্তর দিল, “সম্ভবত মেইন লাইন ডাউন হয়েছে, হয়তো কয়েক মিনিটের মধ্যে তারা খেয়াল করবে।” কিন্তু তার কণ্ঠেও সেই অচেনা শঙ্কার স্পন্দন ধরা পড়ল, যা রূপসার চোখ এড়াল না। তারা দুজনেই বুঝতে পারছিল, কয়েক মিনিটের বিষয়টা হয়তো দীর্ঘ হতে চলেছে।

একই স্থানে দাঁড়িয়ে থাকা আরও অস্বস্তিকর হয়ে উঠছিল। রূপসা একসময় দেয়ালের সঙ্গে হেলান দিয়ে দাঁড়াল, হাত ভাঁজ করে চোখ বন্ধ করল কিছুক্ষণের জন্য। কিন্তু সেই নিস্তব্ধতা তাকে শান্ত করতে পারল না, বরং মনে হচ্ছিল দেয়ালের ওপাশে অন্ধকারের দমবন্ধ চাদর ছড়িয়ে আছে। অরিন্দম পকেট থেকে একটি সিগারেট বের করে নিল, কিন্তু সাথে সাথেই আবার ভাঁজ করে রেখে দিল। সে জানত, এখানে ধোঁয়া আরও শ্বাসরোধী করে তুলবে, তবুও অস্থিরতার মুহূর্তে তার পুরোনো অভ্যাস মাথাচাড়া দিয়ে উঠছিল। একে অপরের দিকে সরাসরি তাকানো থেকেও যেন তারা বিরত থাকছিল। দুজনের মাঝের সেই নীরবতা অদ্ভুত, যেখানে শব্দের অভাবের মধ্যেও অসংখ্য অপ্রকাশিত প্রশ্ন ভাসছিল—কেউ কারো সামনে মুখ খুলতে চাইছে না, অথচ ভেতরে ভেতরে জমে উঠছে অস্থিরতা।

প্রতি মিনিট যেন একেকটা ঘণ্টার মতো লম্বা হয়ে যাচ্ছিল। বাইরের সাহায্যের কোনো চিহ্ন নেই, মোবাইল ফোন কার্যত অকেজো, লিফটের বোতাম অচল। এই অবস্থায় রূপসা হালকা ঝিমঝিম অনুভব করল, আর অরিন্দম স্বভাবসিদ্ধ গাম্ভীর্যে দাঁড়িয়ে থাকলেও তার মনে হচ্ছিল—এভাবে নিস্তব্ধতার ভেতর বেশি সময় আটকে থাকা দুজন মানুষকে অদ্ভুতভাবে কাছাকাছি এনে দেয়। শব্দের অভাব যেন তাদের মধ্যে থাকা অদৃশ্য দেয়াল ভাঙার প্রথম ধাপ হয়ে উঠছে। নিস্তব্ধতা বাইরে যতই ভয়ের হোক, ভেতরে সেটা ধীরে ধীরে অচেনা এক সংযোগ তৈরি করতে শুরু করেছে, যদিও দুজনের কেউ এখনো তা স্বীকার করার জন্য প্রস্তুত নয়।

সময় ধীরে ধীরে গড়াতে লাগল, অথচ লিফটের ভেতরে পরিস্থিতি আরও গুমোট হতে শুরু করল। ছোট্ট ঘরের মধ্যে বাতাস যেন ক্রমেই ভারী হয়ে উঠছে, প্রতিটি নিঃশ্বাসে যেন শ্বাসরুদ্ধতা বাড়ছে। প্রথমে দু’জনের নীরবতা কেবল অস্বস্তির ছিল, কিন্তু সময় যত এগোল, সেই নীরবতা যেন অদ্ভুত চাপের রূপ নিল। রূপসা কপালে ভাঁজ ফেলে চোখ বন্ধ করে একবার দীর্ঘশ্বাস ফেলল, তারপর হঠাৎ নিজেই নীরবতা ভাঙার চেষ্টা করল। এমন পরিস্থিতিতে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকা যে আরও অসহনীয় হয়ে উঠছিল, সেটা বুঝতে পারছিল সে। তাই আলাপ শুরু করার অজুহাত হিসেবে অফিসের ছোটখাটো গল্পই সামনে আনল—“আজ আবার মিটিংয়ে সমীরদা কি অসহ্য বকবক করছিল না? মনে হচ্ছিল মিনিটের ভেতর ঘুমিয়ে পড়ব।” তার কণ্ঠে বিরক্তির সঙ্গে মজা মেশানো ছিল, যেন পরিস্থিতির ভারি পরিবেশকে হালকা করার চেষ্টা করছে।

অরিন্দম তখনও দেয়ালের দিকে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। তার চোখের দৃষ্টি সোজা নয়, বরং ভেতরে কোথাও আটকে আছে। রূপসার প্রশ্নের জবাবে সে হালকা গলায় শুধু বলল, “হ্যাঁ… উনি একটু বেশি টেনে নিয়ে যান।” কথাটা বললেও গলায় তেমন উচ্ছ্বাস নেই, যেন কেবল শূন্যতা পূরণ করার জন্য বলা। রূপসা ভ্রু কুঁচকে তার দিকে তাকাল, তারপর আবার নিজেই হেসে বলল, “আপনি সবসময় এমন শুকনো উত্তর দেন। সত্যি বলতে কি, আপনার সাথে কথা বললে মনে হয় যেন কাগজের দেওয়ালে ঠোক্কর মারছি।” কথাটায় হালকা খুনসুটি থাকলেও এর আড়ালে ছিল একরাশ কৌতূহল। অফিসে প্রতিদিন এই মানুষটাকে দেখলেও, তার ভেতরের আবেগ-অনুভূতি নিয়ে রূপসা কোনোদিন নিশ্চিত হতে পারেনি। আজ সেই বন্ধ জায়গার ভেতর দাঁড়িয়ে এক অচেনা টান টের পাচ্ছিল সে।

গরমটা যেন মুহূর্তে আরও বেড়ে উঠছিল। রূপসা হাতের পাখা বানিয়ে মুখের সামনে দোলাতে লাগল, আবার মোবাইল বের করে স্ক্রিনে সময় দেখল। মিনিটগুলো কেবল বাড়ছে, আর সঙ্গে সঙ্গে অস্বস্তি জমে উঠছে। বিরক্তি চেপে রাখতে না পেরে সে আবার বলল, “একটা কথা বলি, আপনি কি ইচ্ছে করেই সবসময় চুপচাপ থাকেন? নাকি মানুষের সঙ্গে কথা বলতে আপনার ভালো লাগে না?” তার কণ্ঠ এবার একটু ধারালো, যেন বারবার নীরবতা ভাঙার চেষ্টা করতে করতে অধৈর্য হয়ে উঠেছে। অরিন্দম এক মুহূর্ত দ্বিধায় থেকে উত্তর দিল, “কথা বলতে খারাপ লাগে না… শুধু, সবসময় মনে হয় বলার মতো কিছু নেই।” তার স্বর নিচু হলেও তাতে ছিল একরাশ ক্লান্তি, আর রূপসা বুঝতে পারল—এই মানুষটার ভেতরে এমন কিছু আছে, যা এতদিন সে কখনো খুঁজে দেখেনি।

দু’জনের মধ্যে সেই সামান্য কথোপকথন যেন নিস্তব্ধ ঘরের গাঢ় অন্ধকারে ছোট্ট আলোর রেখা হয়ে ফুটে উঠল। অস্বস্তি এখনো আছে—গরম, শ্বাসরুদ্ধকর বাতাস, বোতাম না সাড়া দেওয়া লিফট—সব মিলে পরিস্থিতি সহজ হয়নি। তবুও, কথা বলার মধ্যে একটা অদ্ভুত স্বস্তি তৈরি হচ্ছিল। রূপসা মাঝে মাঝে ঠাট্টা করছিল সহকর্মীদের নিয়ে—কে কাকে গোপনে পছন্দ করে, কে সবসময় বসের সামনে তোষামোদ করে—এইসব মজার প্রসঙ্গ তুলে ধরে হাসির আবহ আনতে চাইছিল। অরিন্দম তাতে কেবল ছোট ছোট উত্তর দিচ্ছিল, কিন্তু তার গলায় লুকোনো এক অচেনা উষ্ণতা অনুভব করছিল রূপসা। যেন এই প্রথমবার সে অরিন্দমের ভেতরের একটা ভিন্ন দিক দেখতে পাচ্ছে, যেটা এতদিনের আনুষ্ঠানিক সম্পর্কের আড়ালে ঢাকা ছিল। লিফটের নিস্তব্ধ দেয়ালের ভেতর সেই অস্বস্তির আড়াল থেকেই ধীরে ধীরে নতুন এক সেতু গড়ে উঠতে শুরু করল।

রূপসা বেশ কিছুক্ষণ ধরে কথা চালিয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু বারবার অরিন্দমের ছোট ছোট উত্তর তাকে বিরক্ত করছিল। লিফটের গুমোটে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে তার মনে হচ্ছিল, অরিন্দম যেন ইচ্ছে করেই দূরত্ব তৈরি করছে, যেন এক অদৃশ্য দেয়াল তুলে রেখেছে তাদের মাঝখানে। একসময় বিরক্তি চেপে রাখতে না পেরে রূপসা সরাসরি প্রশ্ন ছুড়ে দিল—“আপনি সবসময় এতো চুপচাপ থাকেন কেন? সবাই যখন কথা বলে, হাসাহাসি করে, তখনও আপনাকে দেখি এক কোণায় বসে থাকতে। কি এত লুকোনো আছে আপনার ভেতরে?” প্রশ্নটা ছিল অপ্রত্যাশিত, সরাসরি, আর অরিন্দমকে এক মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ করে দিল। সে কিছুক্ষণ চোখ নামিয়ে রাখল, যেন নিজের ভেতরের দরজা খোলার আগে শেষবারের মতো ভেবে নিচ্ছে।

অবশেষে অরিন্দম মুখ তুলল, তার গলায় অচেনা এক গভীরতা। “চুপ করে থাকাটা সবসময় ইচ্ছাকৃত নয়,” সে ধীরে ধীরে বলল। “ছোটবেলা থেকেই একা থাকতে শিখেছি। বাবা-মা দুজনেই চাকরিজীবী ছিলেন, দিনের বেশিরভাগ সময় বাসা ফাঁকা থাকত। তখন বই আর নীরবতাই ছিল সঙ্গী। অনেক চেষ্টা করেছি মিশতে, মজে যেতে অন্যদের ভিড়ে, কিন্তু প্রতিবারই মনে হয়েছে আমি যেন আলাদা। তাই হয়তো অভ্যাস হয়ে গেছে—শব্দের ভেতর থেকেও নিঃশব্দকে বেছে নেওয়ার।” কথাগুলো বলতে বলতে তার চোখে ভেসে উঠল একরাশ ক্লান্তি, আর সেই ক্লান্তি যেন নিস্তব্ধ লিফটের বাতাসে ছড়িয়ে পড়ল। রূপসা চুপ করে শুনছিল, এতদিন যে মানুষটাকে রহস্যময় মনে করত, তার ভেতরের ফাঁকফোকরগুলো হঠাৎ যেন উন্মোচিত হয়ে উঠছিল তার সামনে।

রূপসা ধীরে ধীরে সোজা হয়ে দাঁড়াল, হাত ভাঁজ করে অরিন্দমের দিকে তাকাল। এই মানুষটা যে এমন খোলামেলা উত্তর দিতে পারে, সেটা সে কল্পনাই করেনি। অফিসে যতটা সংযত, নির্লিপ্ত আর কঠোর বলে মনে হয়, বাস্তবে ভেতরে যে এত একাকীত্ব লুকিয়ে আছে, তা ভাবতেও পারেনি। সে হালকা স্বরে বলল, “কিন্তু এত নীরবতায় কি ভালো থাকা যায়? মানুষ তো কথা বলেই বাঁচে, হাসাহাসির ভেতর দিয়েই স্বস্তি খুঁজে নেয়।” অরিন্দম কিছুক্ষণ চুপ রইল, যেন সঠিক শব্দ খুঁজছে। তারপর বলল, “হয়তো… কিন্তু যাদের সঙ্গে নিজের সত্যি ভাগ করে নিতে পারি না, তাদের ভিড়ে থেকেও কেবল ফাঁকা লাগে। তখন কথা বলাটাও অভিনয় মনে হয়। তাই চুপ করে থাকা সহজ।” তার কণ্ঠে কোনো আড়াল ছিল না, বরং এক অদ্ভুত স্বচ্ছতা, যা রূপসাকে নিরবধি করে দিল।

কথার সেই প্রবাহে লিফটের গুমোট অন্ধকার যেন কিছুটা সরে গেল। রূপসা বুঝতে পারল, অরিন্দম শুধু নীরব কোনো মানুষ নয়, বরং তার ভেতরে জমে আছে অনেক অপ্রকাশিত গল্প, অনেক না-বলা যন্ত্রণা। হয়তো সে সেসব প্রকাশ করার সাহস পায়নি এতদিন, কিংবা কেউ তাকে শোনার জায়গা দেয়নি। আজ হঠাৎ অচল লিফটের চার দেওয়ালে দাঁড়িয়ে রূপসাই হয়ে উঠেছে সেই শ্রোতা। আর এই অবস্থার ভেতর দাঁড়িয়ে রূপসা অনুভব করল, তাদের মাঝে তৈরি হওয়া কথার এই সেতুতে অস্বস্তি আর নিস্তব্ধতার জায়গা নেই। যেন কথার ফাঁদে ধরা পড়ে অরিন্দম অবশেষে নিজের সত্যিকারের মানুষটাকে সামনে নিয়ে এল—একটা মানুষ, যে কেবল কাজের নিখুঁততায় নয়, নীরবতার আড়ালেও বাঁচতে শিখেছে। আর এই উপলব্ধিই হয়তো তাদের সম্পর্ককে অন্য এক মাত্রার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

লিফটের নিস্তব্ধ দেয়ালের ভেতর অরিন্দমের গলা ধীরে ধীরে নরম হয়ে উঠল। রূপসার হঠাৎ করা প্রশ্ন যেন তার ভেতরের জমে থাকা কথাগুলিকে মুক্তি দিল। সে জানাল, কলেজে পড়ার সময় সে স্বপ্ন দেখত একজন গবেষক হওয়ার, বড় কোনো প্রতিষ্ঠানে কাজ করার, কিন্তু একসময় বাস্তবের চাপে সেই স্বপ্নগুলো ধীরে ধীরে ভেঙে গেল। বাবা-মায়ের মধ্যে সম্পর্ক ভালো ছিল না, ছোটবেলা থেকেই ঝগড়া, দোষারোপ আর দূরত্বের মধ্যে সে বড় হয়েছে। তার কথা বলতে বলতে চোখের কোণে এক ঝলক আড়ষ্টতা খেলা করল, যেন লিফটের সঙ্কীর্ণ আলো তার স্মৃতির অন্ধকারটুকু হঠাৎ দৃশ্যমান করে দিয়েছে। রূপসা চুপ করে শোনে, বোঝে—অরিন্দম যে একরাশ একাকীত্ব বয়ে বেড়াচ্ছে, সেটা শুধু অফিসের নীরবতা নয়, জীবনের প্রতিটি কোণেই তার প্রতিফলন।

কিছুক্ষণ নীরবতা ভাঙল রূপসার হাসি দিয়ে, কিন্তু সেই হাসি চাপা যন্ত্রণার। সে নিজের কথা বলতে শুরু করল—শৈশবের ভাঙন, বাবা-মায়ের আলাদা হয়ে যাওয়া, একা মায়ের সংসার চালানোর লড়াই। স্কুলে টিফিনে বন্ধুদের সঙ্গে ভাগাভাগি করার মতো কিছু না থাকা, উৎসবগুলোতে অন্যদের সাজগোজ দেখে নিজের ভেতরে জমে থাকা হাহাকার, সবকিছু যেন ছবির মতো ভেসে উঠল। সে বলল, কতবার সে ভেবেছে অন্যরকম কোনো জীবনে জন্ম নিলে হয়তো এত লড়াই করতে হতো না। কিন্তু সেই লড়াইই তাকে আজকের জায়গায় দাঁড় করিয়েছে—একমাত্র মায়ের সাহসে আর নিজের জেদে। অরিন্দম মন দিয়ে শুনছিল, চোখের ভেতর কোনো এক অদ্ভুত মমতা জমতে লাগল।

ধীরে ধীরে দুজনের কথোপকথন গভীর হতে লাগল, যেন বহুদিনের পরিচিত। অরিন্দম স্বীকার করল, অফিসে যতটা চুপচাপ থাকে, আসলে তার ভেতরে প্রতিদিন কত শব্দের ঝড় বয়ে যায়। স্বপ্নভঙ্গের কষ্ট, পরিবারের ভাঙন, আর নিজের প্রতি অদ্ভুত এক অসহায়তা। রূপসা তাকে থামাল না, বরং বলল, “সবাই কোনো না কোনোভাবে ভাঙা গল্প বয়ে নিয়ে চলে, শুধু আমরা লুকিয়ে রাখি।” কথাটা শুনে অরিন্দমের মনে হলো, হয়তো এই প্রথম কেউ তাকে সত্যি বোঝার চেষ্টা করছে। লিফটের গুমোট ঘরে বাতাস ভারী থাকলেও দুজনের কণ্ঠস্বরেই যেন এক ধরনের হালকা বাতাস বয়ে যাচ্ছিল।

সেই মুহূর্তে তারা আর সহকর্মী থাকল না, হয়ে উঠল জীবনের দুই যাত্রী, যাদের ভাগ্য আজ একসঙ্গে আটকে দিয়েছে এই ঘরবন্দি স্থানে। রূপসার চোখে চোখ রেখে অরিন্দম বুঝল—কথা বলা শুধু সময় কাটানো নয়, এটা যেন একে অপরের বুকে জমে থাকা অন্ধকার ভাঙার চাবিকাঠি। দুজনেই অনুভব করছিল, অতীতের ব্যথাগুলো ভাগ করে নেওয়ার মধ্যেই যেন তারা নতুন করে শ্বাস নিতে পারছে। লিফটের দেয়াল যদিও চারপাশে অচল বন্দিশের মতো, কিন্তু ভেতরে খুলে যাচ্ছিল স্মৃতির জানালা, যার ভেতর দিয়ে তারা একে অপরের অচেনা অথচ গভীর জগতে প্রবেশ করতে শুরু করেছে।

কথোপকথনের মাঝখানে রূপসার প্রশ্নটা যেন হঠাৎই বিদ্যুতের ঝলকানির মতো নেমে এল। তার স্বর নরম হলেও কথার ধার এতটা স্পষ্ট যে অরিন্দম এক মুহূর্তের জন্য দম আটকে গেল। “তাহলে কি এই নিস্তব্ধতার আড়ালেই আপনি সব লুকিয়ে রাখেন? না কি অন্য কিছু?”—এই প্রশ্নে যেন তার ভিতরের অদৃশ্য পর্দাগুলো একে একে কেঁপে উঠতে লাগল। লিফটের ভেতরে আলো সামান্য দপদপ করছিল, সেই অস্থির আলোয় অরিন্দমের মুখে অস্বস্তি আরও স্পষ্ট হয়ে উঠল। সে চুপচাপ ব্যাগ থেকে একটা সিগারেট বের করল, আঙুলে পাক খাওয়াতে লাগল, যেন ধোঁয়ার আড়ালে কিছু লুকোতে চায়। কিন্তু আগুন ধরানোর মতো পরিস্থিতি নেই, আর হাতও কাঁপছিল অদ্ভুতভাবে। মুহূর্তটা ঘন হয়ে এল—দুজনেই বুঝছিল, এই প্রশ্নের উত্তর এত সহজে দেওয়া সম্ভব নয়।

রূপসা তার দিকে তাকিয়ে রইল, চোখে এক ধরনের চ্যালেঞ্জ আর কৌতূহল মেশানো দৃষ্টি। “আপনি কি সবসময় পালিয়ে যেতে চান?”—তার চোখ যেন কথার থেকেও বেশি উচ্চারণ করছিল। অরিন্দম সিগারেটটা ঠোঁটে নিলেও জ্বালাল না, শুধু একটা দীর্ঘ শ্বাস টেনে আবার চুপ করে গেল। মনে হলো, ছোট একটা কক্ষে বাতাস হঠাৎ গরম হয়ে উঠেছে, যেমন চাপা আগুন নিভে গিয়ে ধোঁয়া ছড়ায়। রূপসার মুখে তখন হালকা হাসি, কিন্তু হাসির আড়ালে এক অদ্ভুত তীক্ষ্ণতা। সে যেন বুঝতে চাইছিল, অরিন্দমের চুপচাপ থাকা আসলে নিরপেক্ষতা নয়—বরং ভেতরের কোনো অমীমাংসিত যন্ত্রণার ছায়া। অরিন্দম ঠান্ডা গলায় বলল, “সব কথা বলার মতো জায়গা বা সময় হয় না।” কিন্তু এই উত্তর যে অর্ধেক, সেটা দুজনেই বুঝতে পারল।

লিফটের ভেতরে সেই অস্বস্তি ছড়িয়ে পড়তে লাগল। দুজনের মধ্যে দূরত্বটা যেমন হঠাৎ বেড়ে গেল, তেমনি আবার অদ্ভুতভাবে আরও কাছে এনে ফেলল। রূপসার মনে হলো, অরিন্দমের ভেতরে এমন কিছু জমে আছে যা সে কখনোই অফিসে টের পায়নি। সহকর্মী হিসেবে চেনা মানুষটা যেন একেবারে নতুন রূপে ধরা দিচ্ছে। তবুও এই মুহূর্তে সে অরিন্দমকে ছেড়ে দিতে চাইলো না। বরং তার নীরবতার ভেতর থেকে সত্যিটা টেনে আনতে ইচ্ছে হলো। “কখনও কি মনে হয়, এইসব না বলা কথাই আপনাকে আটকে রেখেছে?”—তার গলা নরম হলেও দৃঢ় ছিল। প্রশ্নটা শুনে অরিন্দম নিচের দিকে তাকাল, সিগারেটটা আঙুলে ভেঙে ফেলল, আর বলল না কিছুই।

বাইরে হয়তো কেউ জানতেও পারছে না, লিফটের ভেতরে সময় থমকে গিয়ে দুই মানুষের মানসিক টানাপোড়েন কেমন করে জমাট বাঁধছে। প্রতিটা সেকেন্ড যেন দীর্ঘ হচ্ছে, নিস্তব্ধতাই শব্দ হয়ে উঠছে। অরিন্দমের অস্বস্তি আর রূপসার কৌতূহল মিলেমিশে একটা অনিবার্য চাপ তৈরি করছিল। হয়তো এই ঘন মুহূর্তই তাদের সামনে আসল সত্যটা উন্মোচন করবে, অথবা আরও গভীর নীরবতায় ঢেকে দেবে। কিন্তু এক জিনিস স্পষ্ট হয়ে উঠছিল—এমন টানাপোড়েন শুধু লিফটের যান্ত্রিক অচলাবস্থার কারণে নয়, বরং তাদের মনের ভেতরকার আবদ্ধ দ্বন্দ্বের প্রতিফলন। সেই সিগারেটের না-জ্বালানো আগুনের মতোই, তাদের সম্পর্কেও জমে উঠছিল এক অদৃশ্য উত্তাপ, যা ধীরে ধীরে ভেতরের সত্যকে প্রকাশ করার দিকে এগোচ্ছিল।

লিফটের গুমোট নীরবতার ভেতর হঠাৎ রূপসার গলা শোনা গেল—“আপনি কি কখনো কাউকে ভালোবেসেছেন?” প্রশ্নটা এত সরলভাবে ছুঁড়ে দেওয়া হলেও তার ওজন ছিল অসাধারণ। অরিন্দম প্রথমে ভেবেছিল অন্য কোনো বিষয়ে উত্তর দেবে, কথাকে এড়িয়ে যাবে। সে ভ্রু কুঁচকে একবার চারপাশে তাকাল, যেন কোথাও অন্য কোনো বিকল্প খুঁজছে। কিন্তু ছোট্ট ঘরে সরে যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। এক অদ্ভুত অস্বস্তি জমে উঠল তার মুখে, ঠোঁট নড়ল, কিন্তু শব্দ বের হলো না। রূপসার চোখ তখন একদম স্থির, যেন সে প্রস্তুত অরিন্দমের সব অস্বীকার ভেদ করে সত্যিটা শোনার জন্য।

অরিন্দম একসময় নিচু গলায় বলল, “এমন প্রশ্নের উত্তর সবসময় দেওয়া যায় না।” কথাটা যেন নিজের সুরক্ষার জন্য তৈরি একটা প্রাচীর। কিন্তু সেই প্রাচীর টিকল না বেশিক্ষণ। রূপসা চুপ করে থাকল, শুধু তার দৃষ্টি আরও গভীর হয়ে উঠল। অরিন্দমের বুকের ভেতর জমে থাকা অস্বীকার ভাঙতে শুরু করল, যেমন দীর্ঘদিন বন্ধ থাকা দরজা একসময় হালকা চাপেই খুলে যায়। ধীরে ধীরে সে স্বীকার করল, “হ্যাঁ, করেছি… কাউকে ভালোবেসেছিলাম। কিন্তু বলার সাহস পাইনি। অনেকদিন হয়ে গেছে।” তার গলার স্বর কেঁপে উঠছিল, যেন প্রতিটি শব্দের ভেতর গোপন ব্যথা জমে আছে।

রূপসার ভেতরেও তখন অদ্ভুত আলোড়ন। প্রশ্নটা করার সময় সে বুঝেছিল, উত্তর যাই হোক, সেটা দুজনের সম্পর্কের সীমারেখা বদলে দেবে। কিন্তু অরিন্দমের স্বীকারোক্তি শোনার পর তার মনে হলো, এই মানুষটা শুধু অফিসে চুপচাপ সহকর্মী নয়, সে ভেতরে ভেতরে এমন এক আবেগ বহন করছে, যা দীর্ঘদিনের অস্বীকারে চাপা পড়ে গেছে। রূপসার চোখ অরিন্দমের চোখে আটকে গেল, সেখানে কোনো দোটানা নেই, বরং এক নিঃশব্দ স্পষ্টতা। যেন দুজনেই বুঝতে পারছিল—এই কথার ইঙ্গিতটা আর আড়াল করার কিছু নেই। লিফটের গুমোট পরিবেশও হঠাৎ এক অন্যরকম উষ্ণতায় ভরে উঠল, যেখানে অস্বীকারের দেয়াল ভেঙে দুজনের মধ্যে নতুন এক সেতু তৈরি হচ্ছে।

অরিন্দম তখন আর চোখ ফেরাল না। রূপসার দৃষ্টি সরাসরি তার ভেতরের সত্যকে স্পর্শ করল। মুহূর্তটা দীর্ঘ হলেও ভেতরে জমে থাকা ভার যেন হালকা হয়ে এলো। দুজনের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকা, বাইরের পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন সেই কয়েক সেকেন্ড যেন অনেকগুলো না-বলা কথা, দীর্ঘদিনের নিঃশব্দ আকুলতাকে প্রকাশ করে দিল। বাইরে হয়তো লিফট এখনও অচল, কিন্তু ভেতরে এক নিস্তব্ধ যাত্রা শেষ হয়ে নতুন কিছু শুরু হলো। অস্বীকারের চাদর সরে গিয়ে স্বীকারোক্তির আলো জ্বলে উঠল, আর সেই আলোর দিকে দুজনেই নিঃশব্দে এগিয়ে গেল।

লিফটের ভেতর হঠাৎ নেমে এল এক চাপা নীরবতা। অরিন্দমের স্বীকারোক্তির পর যেন দুজনেই নিজের ভেতরে ডুবে গেল। আলোটা মাঝে মাঝে দপদপ করে নিভে উঠছিল, চারপাশে গুমোট অন্ধকার আরও ঘন হচ্ছিল। রূপসার চোখে তখন এক অদ্ভুত দ্বিধা, ঠোঁট নড়ছিল, কিন্তু শব্দ আসছিল না। অরিন্দমও বুঝছিল, এই মুহূর্তে যা ঘটছে তা সাধারণ কোনো আলাপচারিতা নয়—এ যেন দুজনের হৃদয়ের ভারী দরজার কাছে এসে দাঁড়ানো। নিস্তব্ধতায় শুধু দুজনের শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ প্রতিধ্বনি তুলছিল, আর সেই প্রতিধ্বনিই যেন ভেতরের দ্বন্দ্বকে আরও প্রকট করে তুলছিল।

রূপসা অবশেষে নিজের ভিতরের দ্বিধা ভাঙল। খুব আস্তে, প্রায় ফিসফিস করে সে বলল, “তাহলে আমিও বোধহয় একই ভুল করেছি।” কথাটা উচ্চারণ করার সঙ্গে সঙ্গে তার কণ্ঠস্বর কেঁপে উঠল, যেন বুকের ভেতর থেকে জমে থাকা কোনো ভারী বোঝা হঠাৎ বেরিয়ে এল। অরিন্দম প্রথমে বিস্মিত চোখে তাকাল, তারপর অনুভব করল, এ শুধু স্বীকারোক্তি নয়—এ যেন দুজনের জীবনের দীর্ঘ নীরবতার ভেতর জমে থাকা অভিমান, না-বলা অনুভূতির এক নিঃশব্দ প্রতিধ্বনি। রূপসার চোখে হালকা আর্দ্রতা জমে উঠেছিল, যদিও সে মাথা নিচু করে রেখেছিল, যেন অরিন্দমের চোখে পড়তে না দেয়।

সেই মুহূর্তে লিফটের অন্ধকার ঘর যেন অদৃশ্য এক শক্তিতে ভরে উঠল। মনে হচ্ছিল, তাদের চারপাশের দেয়ালগুলো শুধু ধাতব নয়, বরং অনেকগুলো না-বলা কথা আর চাপা আবেগে গড়া। রূপসার স্বীকারোক্তি শোনার পর অরিন্দম বুঝতে পারল—এই সম্পর্কের টানাপোড়েন শুধু তার ভেতরে ছিল না, রূপসার মনেও বহুদিন ধরে লুকোনো অনুভূতি ছিল। সেই অনুভূতি প্রকাশ করার সাহস সে কখনো পায়নি, হয়তো অফিসের নিয়ম, সমাজের চোখ, অথবা নিজের ভয় তাকে থামিয়ে রেখেছিল। কিন্তু আজ, এই বন্ধ লিফটের অচল সময়ে, হৃদয়ের দরজা খুলে দেওয়ার মতো সাহস সে অর্জন করল।

অরিন্দম ধীরে ধীরে মাথা তুলল, তার চোখ সরাসরি রূপসার দিকে গিয়ে স্থির হলো। কোনো শব্দ ছিল না, কিন্তু দৃষ্টির ভেতরেই যেন হাজারো বাক্য লুকিয়ে ছিল। রূপসা অনুভব করল, অরিন্দমের দৃষ্টি তাকে এক অদৃশ্য আশ্বাস দিচ্ছে—যা এতদিন আটকে রাখা হয়েছিল, তা আর লুকোনোর প্রয়োজন নেই। চারপাশ অন্ধকার হলেও ভেতরে আলো জ্বলে উঠল, একে অপরের স্বীকারোক্তিতে। লিফটের অচলাবস্থার মতোই তারা হয়তো বাইরের পৃথিবীর কাছে অদৃশ্য, কিন্তু নিজেদের কাছে তারা এখন নতুনভাবে দৃশ্যমান। হৃদয়ের সেই ভারী দরজা, যা এতদিন ধরে বন্ধ ছিল, অবশেষে খুলে গেল—নিঃশব্দে, অথচ গভীরভাবে।

লিফটের নিস্তব্ধ ঘরে এতক্ষণ যে চাপা টানাপোড়েন জমে উঠেছিল, হঠাৎ তা আর বাঁধ মানল না। রূপসা প্রথমে হেসে ফেলল—অদ্ভুত এক হাসি, যার ভেতরে ক্লান্তি, অভিমান আর লুকোনো আনন্দ সব একসাথে মিশে ছিল। অরিন্দম অবাক হয়ে তাকাল, যেন বুঝতে পারছিল না এই মুহূর্তে হাসির মানে কী। তারপর সেও হেসে ফেলল, কিন্তু সেই হাসির ভেতরে ছিল দীর্ঘদিনের চাপা যন্ত্রণা মুক্ত হওয়ার স্বস্তি। দুজনের চোখে চোখ পড়তেই হঠাৎই জমে থাকা কথাগুলো বেরিয়ে এলো—কে কাকে এড়িয়ে চলেছে, কেন চুপ করে থেকেছে, কতদিন ধরে না-বলা অনুভূতি বুকের ভেতরে চাপা পড়ে আছে। প্রতিটি বাক্য যেন জমে থাকা আগ্নেয়গিরির লাভার মতো বেরোতে লাগল, থামানো যাচ্ছিল না আর।

কথার ভেতরে শুধু কোমলতা ছিল না—ছিল রাগও, ছিল অভিমানও। রূপসা অভিযোগ করল, “আপনি সবসময় এত চুপচাপ থাকেন, অথচ বোঝেন না আমারও কিছু বলার ছিল।” অরিন্দমও থেমে থাকল না, তার কণ্ঠে প্রথমবার এক ঝলক তীব্রতা শোনা গেল, “আর আপনি কি ভেবেছেন আমি বুঝি না? আমি শুধু ভয় পেতাম, এই স্বীকারোক্তি হয়তো আমাদের দূরে সরিয়ে দেবে।” কথার পর কথায় দুজনের কণ্ঠ উঁচু হতে লাগল, আবার হঠাৎ থেমে গিয়ে হাসিতে ভেঙে পড়ল। এই অস্থির ওঠানামার ভেতরে তারা টের পাচ্ছিল—আসলে আবেগই তাদের সত্যিকারের ভাষা, যা এতদিন চাপা পড়ে ছিল।

একসময় রূপসার চোখে জল এসে গেল, কিন্তু সেই জল শুধু দুঃখের ছিল না, বরং এক অদ্ভুত মুক্তির। অরিন্দম হাত বাড়াতে চেয়েছিল, থমকে গেল, আবার সাহস করে ছুঁয়ে দিল রূপসার আঙুল। মুহূর্তটা বিদ্যুতের মতো কেঁপে উঠল, কিন্তু কেউ আর পিছু হটল না। নিস্তব্ধ লিফটের ভেতরে হাসি, অশ্রু আর না-বলা ভালোবাসার এক বিস্ফোরণ ছড়িয়ে পড়ল। তারা দুজনেই বুঝল, বাইরের পৃথিবী হয়তো তাদের জন্য একই রকম থাকবে না, কিন্তু এই মুহূর্ত—এটা একেবারেই আলাদা, একেবারেই সত্য।

ঠিক তখনই বাইরে থেকে শব্দ এলো—মেকানিকের ডাক, লোহার রডে আঘাতের ঠকঠক আওয়াজ। কারও গলা ভেসে এলো, “ভয় পাবেন না, আমরা বের করছি!” কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, অরিন্দম আর রূপসা কেউই চাইল না সেই মুহূর্ত এত তাড়াতাড়ি ভেঙে যাক। তাদের মনে হচ্ছিল, লিফট যদি আরও কিছুক্ষণ আটকে থাকে, তবে হয়তো আরও কিছু না-বলা কথা বলা যাবে, আরও কিছু হৃদয়ের বাঁধ ভাঙবে। বাইরের দুনিয়া প্রবল উৎসাহে তাদের মুক্ত করার চেষ্টা করছে, অথচ ভেতরে তারা দুজনেই একে অপরের বাঁধনেই মুক্তি খুঁজে পাচ্ছিল। এই ঘরবন্দি আবেগের বিস্ফোরণ তাদের জীবনের সবচেয়ে সত্য, সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মুহূর্ত হয়ে উঠল।

১০

হঠাৎ লিফটের ভেতরে ঝাঁকুনি লাগল। তারপর ধীরে ধীরে আলো জ্বলে উঠল, যন্ত্রের গর্জন শোনা গেল। অরিন্দম আর রূপসা একইসঙ্গে তাকাল একে অপরের দিকে—দুজনের চোখেই অদ্ভুত এক দোটানা। দরজা ফাঁক হতেই বাইরের উজ্জ্বল আলো ভেতরে ঢুকে পড়ল, যেন এতক্ষণকার ঘন অন্ধকারকে মুছে দিল। করিডোরে দাঁড়িয়ে ছিল কয়েকজন নিরাপত্তারক্ষী আর টেকনিশিয়ান, স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে তারা বলল, “আপনারা ঠিক আছেন তো?” রূপসা আর অরিন্দম একসঙ্গে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল, কিন্তু তাদের ভেতরের অনুভূতি অন্য কিছু বলছিল। বাইরের জগৎ আবার নিজের নিয়মে ফিরিয়ে নিচ্ছে, অথচ তারা জানত, ভেতরে যা ঘটেছে তা আর আগের মতো নিছক অফিসের দিনের অংশ হয়ে থাকবে না।

তারা লিফট থেকে বেরিয়ে এলো ধীরে ধীরে, যেন পা টানতে টানতে। চারপাশে সাধারণ কোলাহল, লোহার গন্ধ, ব্যস্ত পদচারণা—সবকিছুই স্বাভাবিক, কিন্তু তাদের ভেতরে তৈরি হয়েছিল অন্যরকম এক অস্বাভাবিকতা। রূপসা একবার অরিন্দমের দিকে তাকাল, ঠোঁটে হালকা হাসি, কিন্তু সেই হাসির আড়ালে জমে ছিল অসংখ্য না-বলা কথা। অরিন্দম চোখ ফিরিয়ে নিলেও, তার ভেতরের আবেগ চাপা দেওয়া যাচ্ছিল না। মনে হচ্ছিল, দরজা খুলে গেলেও তাদের দুজনের মধ্যে তৈরি হওয়া গোপন ঘরটা এখনও অটুট, যেখানে তারা নিজেদের সত্যিকারের রূপে একে অপরকে চিনেছে।

অফিস ভবনের বাইরে হালকা বাতাস বইছিল। কয়েক ঘণ্টার ঘরবন্দির পর এই মুক্তি কারও কাছে স্বস্তি এনে দেয়, কিন্তু অরিন্দম আর রূপসার কাছে সেটা ছিল এক মিশ্র অনুভূতি। বাইরের পৃথিবী তাদের আবার ‘সহকর্মী’ আখ্যা দিতে প্রস্তুত, কিন্তু তারা জানে—এই কয়েক ঘণ্টায় তৈরি হওয়া সম্পর্ক ভেতরে ভেতরে অন্য কিছুতে রূপ নিয়েছে। হয়তো কোনো স্পষ্ট প্রতিশ্রুতি নেই, হয়তো আগামী দিনের ভিড়ে তারা আবার দূরে সরে যাবে, কিন্তু এই মুহূর্ত থেকে তারা আর কেবলমাত্র সহকর্মী নয়। একে অপরকে তারা এমন এক আলোয় দেখেছে, যেটা খুব কম মানুষই পায়—আবেগ, স্বীকারোক্তি আর মুক্তির আলোয়।

অরিন্দম গাড়ি ডাকতে গেল, রূপসা পেছনে দাঁড়িয়ে রইল। দুজনেই বুঝছিল, কিছু কথা বলা দরকার ছিল, কিন্তু বাইরের কোলাহলে তা আর বলা গেল না। বিদায়ের সময় শুধু একটুকরো দীর্ঘ দৃষ্টি—যার ভেতরে ছিল অগণিত প্রতিশ্রুতি, আবার ভয়ও। দরজা খুলে গেছে, লিফট আবার কাজ করছে, জীবনও আবার আগের নিয়মে চলবে। কিন্তু দুজনেই জানে, এই ঘরবন্দি বিকেল তাদের সম্পর্ককে চিরতরে বদলে দিয়েছে। বাইরের পৃথিবী হয়তো কিছুই বুঝবে না, কিন্তু তাদের ভেতরে তৈরি হওয়া আলো আর অন্ধকারের মিশ্রণ নতুন এক যাত্রার সূচনা করে গেছে—নিঃশব্দ, অথচ গভীর।

শেষ

1000062246.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *