পৌলমী দে
১
গ্রামের মাঠ যেন হঠাৎ করেই এক টুকরো উৎসবের স্বর্গে রূপ নিল। চারদিকে উড়ছে রঙিন পতাকা, বাতাসে মিশে আছে ভাজা মিষ্টির গন্ধ আর মাটির প্রদীপের কাঁচা মাটির সুবাস। বার্ষিক পূজার মেলা—যেটার জন্য ছোট-বড়, ধনী-গরিব সবার মনেই অপেক্ষার ছাপ। সন্ধ্যা নামতেই মাঠ ভরে উঠেছে ভিড়ে, শিশুদের হাসির কলরব, ঢোলের তালে তালে নাচ, আর দোকানিদের ডাকাডাকিতে চারপাশ যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে। আলো-আঁধারের খেলা চলতে চলতে মেলার প্রতিটি কোণে মানুষের ভিড় বাড়তে লাগল, ঠিক যেন গ্রামের প্রতিটি ঘর থেকে সবাই আজ একসাথে বেরিয়ে পড়েছে। এই আনন্দের আবহের মাঝেই মাটির প্রদীপ নিয়ে বসেছে রাহুল—গ্রামের এক সাদাসিধে ছেলে, যার জন্য এই মেলাটা শুধু আনন্দ নয়, পরিবারের বেঁচে থাকার একমাত্র ভরসা।
রাহুল ছোট্ট টেবিলের ওপরে সারি সারি প্রদীপ সাজিয়ে বসে। প্রতিটি প্রদীপ তার নিজের হাতে তৈরি, মাটি কেটে, শুকিয়ে, তারপর আগুনে পুড়িয়ে শক্ত করেছে। সোনালি-লালচে রঙে ঝলমল করছে প্রদীপগুলো, যেন অন্ধকারে আলোর বীজ হয়ে আছে। প্রদীপের টুকটাক আলো ভিড়ের মাঝে ছোট্ট এক আশ্রয় তৈরি করেছে, যেখানে দাঁড়ালে মনে হয় পৃথিবী হঠাৎ শান্ত হয়ে গেছে। রাহুলের চোখে সেই আলোয় প্রতিফলিত হচ্ছে এক ধরনের স্বপ্ন—সে জানে, যত বেশি প্রদীপ বিক্রি হবে, তত বেশি ওষুধ কিনতে পারবে বাবার জন্য, তত বেশি চালে-ডালে ভরে উঠবে ঘরের হাঁড়ি। তবুও তার চোখে কোনো দুঃখ নেই, আছে কেবল এক অদ্ভুত দীপ্তি, যেন এই আলো শুধু প্রদীপেই নয়, তার মনেও জ্বলছে। গ্রামের মানুষ তাকে চেনে, জানে তার পরিশ্রমের কথা, তাই কেউ কেউ প্রদীপ কিনতে এসে তার কাঁধে হাত রেখে বলে, “তুই আলো জ্বালাস রে রাহুল, তোর মতো ছেলেদের জন্যই তো গ্রাম বেঁচে আছে।”
মেলার ভিড়ে দাঁড়িয়ে রাহুল মাঝে মাঝে চারদিকে তাকায়। কিশোর বয়সের চঞ্চলতা তার ভেতরে লুকোনো থাকলেও, আজকের রাতে সে যেন বেশি দায়িত্ববান হয়ে উঠেছে। মেলায় আসা বাচ্চাদের হাতে রঙিন বেলুন দেখে তার নিজের শৈশবের কথা মনে পড়ে যায়—তখন সেও বন্ধুদের সাথে দৌড়ে বেড়াত, বেলুন কিনত, মিষ্টির দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে লোভাতুর চোখে তাকিয়ে থাকত। কিন্তু সময়ের পালা বদল তাকে খুব দ্রুত বড় করে দিয়েছে। এখন সে জানে, আনন্দ আর খেলার জায়গা তার জীবনে কম, পরিবারের দায়ই প্রধান। তবুও, ভিড়ের ভেতর থেকে এক ধরনের আনন্দ ধীরে ধীরে তাকে ভিজিয়ে দেয়। মানুষের হাসি, আলোর ঝলক, প্যান্ডেলে ভেসে আসা ঢাকের আওয়াজ—সবকিছু তাকে মনে করিয়ে দেয়, জীবন কষ্টে ভরা হলেও তার মাঝেও আলো খুঁজে পাওয়া যায়।
রাত বাড়তে থাকে, আর ভিড় জমে আরও বেশি। প্রদীপগুলো একে একে বিক্রি হয়ে যায়, আর প্রতিটি প্রদীপ হাতে নিতে নিতে মানুষজন হাসে, যেন তারা অন্ধকারে একটা আশ্বাস খুঁজে পায়। রাহুল চুপচাপ তাকিয়ে থাকে তাদের মুখের দিকে, আর ভাবে—আলো শুধু প্রদীপে নেই, আলো আছে মানুষের ভেতরেও। তার নিজের জীবন যতই কঠিন হোক না কেন, এই আলো বিক্রি করার মাঝেই সে এক অদ্ভুত শান্তি খুঁজে পায়। মেলার চারপাশ তখন আলোয় ভরে উঠেছে, ছোট ছোট প্রদীপ যেন তারা হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে মাটির বুকে। সেই আলোয় রাহুলের হৃদয় ভরে ওঠে নতুন এক আশায়—যেমন প্রতিটি প্রদীপ অন্ধকার দূর করে, তেমনই হয়তো কোনো একদিন তার জীবনের অন্ধকারও দূর হবে। আজকের এই রাতটা শুধু একটা মেলার রাত নয়, বরং রাহুলের জীবনের এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা, যেখানে সে নিজের হাতে বানানো প্রদীপের ভেতরেই খুঁজে নেয় ভবিষ্যতের আলো।
২
শহরের কোলাহল, ট্রাফিকের হর্ন, নীয়ন আলো আর বহুতলের কংক্রিট থেকে হঠাৎ করে গ্রামের নিরিবিলি সবুজে এসে পড়া অনন্যার কাছে একেবারে নতুন অভিজ্ঞতা। মামার আমন্ত্রণে সে প্রথমবার গ্রামে এসেছে, আর ট্রেন থেকে নামার মুহূর্তেই তার চোখ ভরে ওঠে অপরিচিত অথচ মায়ামাখা দৃশ্যে—দূর দূর পর্যন্ত ধানের ক্ষেত, কাঁচা রাস্তার ধুলো, আর তাল-খেজুর গাছের মাথায় শালিকপাখির ডাক। অনন্যা, যে এতদিন কেবল বইয়ে পড়েছে গ্রামীণ জীবনের গল্প, এখন সরাসরি সেই জীবনের স্পর্শ পাচ্ছে। শহরে অভ্যস্ত চোখে প্রথমে সবকিছু একটু অদ্ভুত লাগলেও, ধীরে ধীরে সেই অদ্ভুততা রূপ নেয় কৌতূহলে। মামার বাড়ির উঠোনে পৌঁছেই সে দেখে ছায়া-ঢাকা আমগাছ, পাশে বাঁধানো কুয়ো, আর গরুর খুঁটি—এসব তার কাছে অচেনা হলেও অদ্ভুত এক টানে ভরে ওঠে মনে। গ্রামের মানুষের সরলতা আর আন্তরিকতা দেখে তার মনে হয়, শহরে কখনও এত খোলামেলা হাসি দেখেনি।
সন্ধ্যা নামতেই গ্রামে শুরু হয় সেই প্রতীক্ষিত বার্ষিক পূজার মেলা। মামা-মামী আর আত্মীয়দের সাথে অনন্যাও যায় মেলা দেখতে। চারদিকে আলোর ঝলকানি, ঢোলের আওয়াজ, মিষ্টির গন্ধ, খেলনার দোকানের ভিড়—সব মিলিয়ে গ্রামের মেলা যেন ছোট্ট এক জগৎ। অনন্যার চোখে বিস্ময়ের আলো, প্রতিটি কোণ সে আগ্রহভরে দেখে। সে ভাবে, শহরের দামী শপিংমল হয়তো বড় আর ঝকঝকে, কিন্তু গ্রামের মেলার উষ্ণতা আর প্রাণবন্ত পরিবেশের কাছে সেটা যেন ফিকে। কাঁচা মাটির গন্ধ তার মনে গভীর একটা টান জাগায়, যেন শিকড়ের কাছে ফিরে আসছে। শিশুদের দৌড়ঝাঁপ, বয়স্কদের আড্ডা, মেয়েদের হাসি-ঠাট্টা—সবকিছু তাকে অদ্ভুতভাবে স্পর্শ করে। ভিড়ের ভেতর সে নিজেকে খুঁজে পায় এক নতুন মানুষের মতো, যাকে চারপাশের আনন্দে সহজেই ভাসিয়ে নিয়ে যায়।
মেলার মাঝেই হঠাৎ তার চোখে পড়ে এক আলাদা দৃশ্য। ভিড়ের এক পাশে, আলো-আঁধারের খেলা করা ছোট্ট এক টেবিলে বসে আছে এক কিশোর। টেবিলের ওপরে সারি সারি মাটির প্রদীপ সাজানো, আর প্রদীপের টুকটুক আলো যেন তাকে ঘিরে এক রহস্যময় আবহ তৈরি করেছে। কিশোরটির গায়ের পোশাক সাধারণ, তবুও তার মুখে এমন এক শান্ত দীপ্তি, যা মেলার কোলাহল থেকে আলাদা হয়ে চোখে পড়ে। অনন্যা প্রথমে কেবল কৌতূহল থেকে তাকিয়েছিল, কিন্তু ধীরে ধীরে তার মনে হল, এই ছেলেটির ভেতরে যেন অন্যরকম কিছু আছে। প্রদীপ বিক্রি করার সময় ছেলেটির চোখের মায়ায় এক ধরনের উষ্ণতা আছে, যেন সে কেবল প্রদীপই দিচ্ছে না, আলোও বিলিয়ে দিচ্ছে মানুষের মনে। অনন্যা নিজের অজান্তেই দাঁড়িয়ে পড়ে সেই টেবিলের সামনে।
এই মুহূর্তে সময় যেন থেমে যায় অনন্যার কাছে। চারপাশের কোলাহল মিলিয়ে গিয়ে কেবল শোনা যায় প্রদীপের মৃদু টুকটুক শব্দ আর হাওয়ায় ভেসে আসা কাঁচা মাটির গন্ধ। তার মনে হয়, সে যেন হঠাৎ করেই অন্য এক জগতে প্রবেশ করেছে—যেখানে নেই শহরের কোলাহল, নেই ভিড়ের ধাক্কাধাক্কি, আছে কেবল সরলতা আর আলো। আলোর ফেরিওয়ালা ছেলেটি মাথা তুলে তাকাতেই অনন্যার চোখ তার চোখের সাথে মিলিত হয়। চোখের সেই দৃষ্টিতে কোনো কথা নেই, কিন্তু আছে এক অদ্ভুত টান, এক নীরব সংযোগ। অনন্যার হৃদয় হঠাৎ কেঁপে ওঠে—এটা কী? কেবল কৌতূহল, নাকি জীবনের এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা? সে বুঝতে পারে না। কিন্তু নিশ্চিতভাবে জানে, আজকের রাতটা শুধু মেলার রাত নয়, বরং এমন এক মুহূর্ত, যা তার মনে চিরকাল জ্বলতে থাকবে প্রদীপের মতোই।
৩
রাহুল তখন মন দিয়ে প্রদীপ সাজাচ্ছিল। প্রতিটি প্রদীপের তলাটা যেন সমান হয়, শিখা যেন ঠিকঠাক জ্বলে, সেই খেয়াল রাখছিল সে। তার আঙুলে লেগে থাকা মাটির গন্ধ, কপালে জমে থাকা ঘাম, আর চারপাশের ভিড়ের শব্দ—সব মিলিয়ে তার মনে হচ্ছিল সে যেন অন্য জগতে কাজ করছে। এমন সময় হঠাৎ করেই ভিড়ের ফাঁক দিয়ে এক জোড়া নরম চোখ এসে থেমে যায় তার টেবিলের সামনে। রাহুল প্রথমে খেয়ালই করেনি, কিন্তু একসময় যখন হাত বাড়িয়ে একটি প্রদীপ তুলে ধরল, তখনই সেই প্রদীপের আলো এসে পড়ল অনন্যার মুখে। অনন্যা যেন হঠাৎ থেমে যায়। আলোয় ভেসে ওঠা তার চেহারায় এক অদ্ভুত মায়া তৈরি হয়—গায়ের রঙে এক উজ্জ্বল দীপ্তি, চোখে বিস্ময়ের ঝলক, আর ঠোঁটে অচেতন এক মৃদু হাসি। রাহুলও চমকে ওঠে, কারণ এতদিন প্রদীপ সে অনেককে দিয়েছে, কিন্তু এই প্রথম মনে হলো, প্রদীপের আলো যেন শুধু অন্ধকার দূর করছে না, বরং কারও অন্তরে গোপনে আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে।
মুহূর্তটা ছিল নিস্তব্ধ অথচ পূর্ণ। চারপাশের কোলাহল, হাসি, ডাকাডাকি সব মিলিয়ে যেন তাদের কাছে হারিয়ে গেল। রাহুলের হাতে থাকা প্রদীপটা যেন সেতু হয়ে দাঁড়াল তাদের দুজনের মাঝখানে। শিখার দপদপে আলো অনন্যার চোখে প্রতিফলিত হয়ে উঠল, আর সেই প্রতিফলন রাহুলের মনে এক অজানা আলো জ্বালাল। সে অনুভব করল, মেয়েটি হয়তো শহর থেকে এসেছে, হয়তো তার জগত অনেক আলাদা, তবুও তার চোখে যে বিস্ময় আর প্রশান্তি ফুটে আছে, সেটা এমনই, যা প্রদীপের মতো সরল অথচ দীপ্তিময়। অনন্যা চুপচাপ তাকিয়ে থাকল, মনে হচ্ছিল সে কিছু বলতে চাইছে, অথচ কথাগুলো গলায় আটকে যাচ্ছে। তাদের মাঝের এই নীরবতা আসলে নীরবতা ছিল না, বরং কথার বাইরেও এক অদৃশ্য সংলাপ চলছিল।
অনন্যার মনে হচ্ছিল, এ দৃশ্যটা কেবল কোনো প্রদীপ কেনা-বেচার মুহূর্ত নয়, বরং এর ভেতরে লুকিয়ে আছে এক গভীর তাৎপর্য। শহরে সে অনেক আলো দেখেছে—বিদ্যুতের বাতি, সাজানো আলোকসজ্জা, নীয়নের ঝলকানি—কিন্তু এই ছোট্ট মাটির প্রদীপে যে আলো, তাতে অন্যরকম উষ্ণতা আছে। আর এই আলো রাহুলের চোখের ভেতরও যেন জ্বলে উঠছে। অনন্যা অনুভব করল, তার বুকের ভেতর একটা অজানা স্রোত বইছে। সে আগে কখনও এমন টান অনুভব করেনি। হয়তো এটাই প্রথমবার, যখন সে বুঝল—কখনও কখনও চোখের দৃষ্টি এমন কিছু বলে দেয়, যা ভাষায় বলা সম্ভব নয়। আর রাহুলও ঠিক একই অনুভূতি পেল। তার মতো এক সাধারণ ছেলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা শহরের সেই মেয়েটি হঠাৎই তার কাছে অমূল্য হয়ে উঠল। প্রদীপের আলোয় ভেসে থাকা সেই মুখ তার মনে গভীর ছাপ ফেলল, যা সে কোনোদিন ভুলতে পারবে না।
সময়ের মাপকাঠিতে হয়তো এটা কয়েক মুহূর্তের বেশি কিছু নয়, কিন্তু তাদের দুজনের মনে এর প্রভাব স্থায়ী হয়ে গেল। প্রদীপের শিখা তখনও দপদপ করছিল, বাতাসের হালকা ঝাপটা তাকে কাঁপিয়ে তুলছিল, তবুও সে নিভছিল না। যেন শিখাটি বলছিল—আলো টিকে থাকবে, যত ঝড়ই আসুক। সেই মুহূর্তে অনন্যা আর রাহুল দুজনেই বুঝল, এ কেবল একটা দেখা নয়। এটা এক সূচনা—নিঃশব্দ, নিরাভরণ, অথচ শক্তিশালী এক সংযোগের সূচনা। তারা কেউই মুখে কিছু বলল না, তবুও তাদের নীরবতার ভেতরে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল প্রথম প্রেমের কোমল সুর। রাহুল প্রদীপটা এগিয়ে দিল, অনন্যা হাত বাড়িয়ে নিল, আর সেই ছোঁয়ায় যেন তাদের ভেতরে জন্ম নিল এক নতুন আলো—যা সময় যতই কেটে যাক, তারা ভুলতে পারবে না।
৪
মেলার ভিড়ের ভেতরে দাঁড়িয়ে অনন্যা যেন দ্বিধায় কেঁপে উঠছিল। সে কি কেবল চুপচাপ একটা প্রদীপ নিয়ে চলে যাবে? না কি কিছু কথা বলবে এই ছেলেটির সঙ্গে, যে প্রদীপের আলোয় তার মনে এক অদ্ভুত টান জাগিয়েছে? নিজের ভেতরে চলা এই দ্বন্দ্ব সে সামলে উঠতে না উঠতেই আচমকা বলেই ফেলল, “তুমি কি নিজেই বানাও এগুলো?” প্রশ্নটা শুনে রাহুল প্রথমে একটু চমকে তাকাল। শহরের মেয়েরা সাধারণত প্রদীপ কিনতে আসে না, তাদের পছন্দ থাকে রঙিন আলো বা দামী সামগ্রীতে। কিন্তু অনন্যার চোখে ছিল কৌতূহল আর আন্তরিকতা। রাহুলের ঠোঁটে অচেতন এক হাসি ফুটে উঠল। মাথা নেড়ে সে শান্ত গলায় বলল, “হ্যাঁ, সবগুলোই আমার হাতে বানানো। মাটি কেটে, শুকিয়ে, তারপর আগুনে পুড়িয়ে—যা বানাই, সেটাই সাজিয়ে রাখি।” তার গলায় কোনো অহংকার ছিল না, বরং গর্ব মেশানো এক সাদাসিধে গর্ব, যা অনন্যাকে অবাক করল। শহরের ব্যস্ত জীবনে সে এমন সহজ অথচ গভীর আত্মবিশ্বাস খুব কমই দেখেছে।
অনন্যা আরও কিছু বলতে চাইছিল, কিন্তু কীভাবে শুরু করবে বুঝে উঠতে পারছিল না। তবু সাহস করে বলল, “তোমার প্রদীপগুলো অন্য রকম মনে হচ্ছে। শুধু আলো জ্বালানোর জন্য নয়, যেন অন্য কিছু আছে এর ভেতরে।” কথাটা শুনে রাহুলের চোখে হঠাৎ এক ঝলক দীপ্তি ফুটে উঠল। সে নরম স্বরে বলল, “প্রতিটি প্রদীপ অন্ধকার দূর করে, যেমন মানুষও মানুষের জীবনে আলো হয়ে আসে।” এই এক কথাতেই অনন্যা যেন থমকে গেল। এত সহজ, অথচ এত গভীর! শহরে সে অনেক পড়াশোনা করেছে, অনেক বড় বড় মানুষের বক্তৃতা শুনেছে, তবু এমন সরল অথচ হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া কথা কেউ কোনোদিন বলেনি। তার মনে হলো, এই সাধারণ গ্রামের ছেলে যেন জীবনকে ভিন্নভাবে দেখে—সেই দৃষ্টিটাই তাকে আকৃষ্ট করছে। প্রদীপ হাতে নিয়েও অনন্যা শুধু আলো নয়, রাহুলের কথাগুলো শুনে অনুভব করল ভেতরের অন্ধকারও যেন একটু একটু করে মুছে যাচ্ছে।
রাহুল জানত না, তার এই কথাগুলো এতটা প্রভাব ফেলতে পারে। সে তো শুধু তার নিজের অনুভূতি বলেছিল—যেটা ছোটবেলা থেকেই শিখেছে মা-বাবার কাছ থেকে। তার কাছে প্রদীপ মানে কেবল একটা জিনিস নয়, বরং প্রতীক—আশার, সাহসের, ভালোবাসার প্রতীক। হয়তো এ কারণেই প্রদীপ বানানোর সময় সে ভেতর থেকে এক ধরণের শান্তি খুঁজে পায়। অনন্যার চোখে সেই অনুভূতি পড়তে পেরে তার বুকের ভেতরও এক অদ্ভুত আলো জ্বলে উঠল। সে অনুভব করল, এই মেয়েটি শহর থেকে আসলেও তার ভেতরে একধরনের সত্যতা আছে, যে সত্যতা তাকে অন্য সবার থেকে আলাদা করে তুলেছে। অনন্যা তাকিয়ে রইল প্রদীপের শিখার দিকে, তারপর ধীরে ধীরে বলল, “তুমি কি সবসময় এমন ভাবো? মানুষের ভেতরেও আলো আছে?” রাহুল হেসে বলল, “হ্যাঁ, শুধু খুঁজে নিতে হয়। কেউ কারও জীবনে এক মুহূর্তের জন্যও আলো হতে পারে।”
এই কথাগুলো যেন অনন্যার হৃদয়ে গভীরভাবে গেঁথে গেল। শহরে তার জীবন ছিল আরামদায়ক, কিন্তু প্রায়ই একাকিত্বে ভরা। বন্ধু ছিল, আড্ডা ছিল, কিন্তু সেই সম্পর্কগুলোতে উষ্ণতা কম। অথচ এখানে, এক মেলার রাতে, এক সাধারণ ছেলের মুখে পাওয়া কয়েকটি বাক্য তার ভেতরে এক নতুন অনুভূতি জাগাল। সে বুঝল, আলো শুধু বিদ্যুতের নয়, আলো আসলে সেই অনুভূতি যা এক মানুষ অন্য মানুষের হৃদয়ে জ্বালায়। আর সেই আলোই হয়তো প্রথমবারের মতো তার ভেতরে প্রবেশ করছে। অনন্যা প্রদীপটা শক্ত করে ধরে রাখল, যেন শুধু মাটির প্রদীপ নয়, বরং জীবনের নতুন এক অর্থ সে নিজের হাতে তুলে নিয়েছে। তাদের দুজনের মাঝখানে নীরবতা ভেসে উঠল, তবে সেই নীরবতা অস্বস্তিকর ছিল না—বরং আলোর মতোই উষ্ণ, কোমল আর নির্মল। এই মুহূর্তে তারা দুজনেই অনুভব করল, কিছু সম্পর্ক ভাষাহীন হয়েও কতটা গভীর হতে পারে।
৫
গ্রামের পূজার মেলার রাত মানেই এক অদ্ভুত মায়ার আবহ। চারপাশে ঢাকের তালের ধ্বনি, মিষ্টির দোকান থেকে আসা গরম জিলিপির মিষ্টি গন্ধ, আর নানা বয়সের মানুষের ভিড় পুরো মাঠটিকে উজ্জ্বল আর প্রাণবন্ত করে তোলে। শিশুদের হাসির শব্দ, নাগরদোলার চিৎকার, আর বাঁশি বিক্রেতার সুরে ভেসে বেড়ায় উৎসবের সুরভি। অনন্যা মুগ্ধ চোখে চারপাশে তাকায়, তার শহুরে জীবনে এই সরল অথচ গভীর আনন্দের স্পর্শ ছিল না। এদিকে রাহুল ব্যস্ত তার প্রদীপের দোকানে, কিন্তু ভিড়ের মাঝে সে খেয়াল করে—কেউ একজন তার দিকে বারবার তাকাচ্ছে। আলো আর ছায়ার মিশেলে অনন্যার মুখখানি তার চোখে ধরা পড়ে, আর সেই চাহনির ভেতরে এক অনুচ্চারিত আহ্বান লুকিয়ে থাকে। রাহুলের মনে হয়, এই রাতটা যেন অন্য সব রাতের থেকে আলাদা, যেন ভাগ্য তার সামনে এক নতুন গল্পের প্রথম পাতা খুলে দিয়েছে।
অনন্যার মনে হচ্ছে মেলার উচ্ছ্বাস তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে এমন এক জায়গায়, যেখানে শুধু আনন্দ আর আলো ভাসছে। মামার সঙ্গে ঘুরতে ঘুরতে সে হঠাৎ করেই আবার রাহুলের দোকানের সামনে এসে দাঁড়ায়। প্রদীপের ঝিকিমিকি আলো যেন তার কৌতূহল আরও বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু এবার শুধু দোকান নয়, তার চোখ খুঁজে বেড়ায় রাহুলকে। ভিড় ঠেলে রাহুল যখন তার দিকে এগিয়ে আসে, তাদের দৃষ্টি আবার মিলিত হয়, আর মুহূর্তেই চারপাশের সমস্ত শব্দ যেন থেমে যায়। রাহুলের চোখে ভরসা আর সরলতার ছাপ দেখে অনন্যার মনে এক অদ্ভুত প্রশান্তি আসে। প্রদীপের আলো যেন শুধু অন্ধকার দূর করছে না, তাদের হৃদয়ের ভেতর জমে থাকা অজানা আবেগও উজ্জ্বল করে তুলছে। অনন্যার ভেতরে যে নতুন কাঁপুনি জন্ম নিচ্ছে, সে তা প্রকাশ করতে পারছে না, তবে বুঝতে পারছে—এই মেলার রাত তার জীবনে অন্যরকম জায়গা করে নেবে।
ভিড়ের ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে তারা দুজন একসাথে গিয়ে দাঁড়ায় গ্রামের পুরনো পুকুরের ধারে। পুকুরের চারপাশে মাটির প্রদীপ সাজানো, আর মাঝেমাঝে ভেসে চলেছে আলোর ছোট ছোট তরঙ্গ। অনন্যার মনে হয়, প্রদীপগুলো যেন মানুষের মনের আশা নিয়ে ভেসে চলেছে অজানার পথে। রাহুল হাতে কয়েকটা প্রদীপ তুলে দিয়ে বলে, “এসো, ভাসাই। যত প্রদীপ জ্বলবে, তত স্বপ্নও আলো পাবে।” অনন্যা মুগ্ধ হয়ে তার হাত থেকে প্রদীপ নেয়, পানির ভেতরে আলতো করে নামিয়ে দেয়। প্রদীপগুলো ভেসে উঠতেই জলের ওপর আলো নাচতে থাকে, আর সেই আলোর প্রতিফলনে তাদের মুখ দুটো আরও কাছে আসে। রাহুলের কণ্ঠে একরাশ বিশ্বাস, অনন্যার চোখে একরাশ বিস্ময়, আর সেই মুহূর্তে তাদের মাঝে গড়ে ওঠে এক নীরব বন্ধন। প্রদীপ ভাসানোর এই সহজ রীতি তাদের কাছে হয়ে ওঠে এক গভীর প্রতীক—যেন অন্ধকার ভেদ করে তারা একে অপরের জীবনে আলো ছড়িয়ে দেবে।
রাত বাড়তে থাকে, ঢাকের শব্দ আরও জোরালো হয়, আকাশে রঙিন আলোয় ভরে ওঠে আতশবাজির ঝলক। কিন্তু মেলার সমস্ত কোলাহল থেকে আলাদা হয়ে রাহুল আর অনন্যা দাঁড়িয়ে থাকে পুকুরের ধারে। প্রদীপ ভাসানোর পর দুজনেই নীরবে দাঁড়িয়ে থাকে, কিন্তু তাদের চোখের ভাষা বলে দেয় অনেক কিছু। অনন্যার মনে হয়, তার শহরের ব্যস্ততা, কোলাহল, আর কংক্রিটের ভিড়ের ভেতরও সে এই সরল অথচ গভীর মুহূর্তকে খুঁজে বেড়াবে। রাহুলও ভাবে, হয়তো সে কেবল একজন আলোর ফেরিওয়ালা, কিন্তু আজ তার প্রদীপে আলো জ্বালানো মেয়েটি যেন তার জীবনে এক নতুন আলো হয়ে এসেছে। তারা দুজনেই কিছু বলেনি, তবুও মনে হলো প্রদীপের মতোই তাদের হৃদয় একে অপরের মনের অন্ধকার ভেদ করে আলো ছড়িয়ে দিয়েছে। এই রাত শুধু মেলার রাত নয়, এটি এক নতুন সম্পর্কের প্রথম রাত—এক অদৃশ্য বাঁধন, যার সুতোগুলো এখনো কোমল, অথচ আলোয় ভরপুর।
৬
মেলার উচ্ছ্বাস ধীরে ধীরে মিইয়ে আসছে, কিন্তু অনন্যা আর রাহুলের মনে তার রেশ থেকে গেছে। পরদিন দুপুরে অনন্যা মামার বাড়ির উঠোনে বসেছিল, তার সঙ্গে ছিল শহর থেকে আসা কয়েকজন বন্ধু ও আত্মীয়। তারা গ্রামের আবহে মজা পাচ্ছিল বটে, কিন্তু মনোভাবে একটা অদৃশ্য দেয়াল টেনে রেখেছিল। গ্রামের সরলতা তাদের কাছে কৌতূহলের বিষয় হলেও, তাতে একধরনের অবহেলা মিশে ছিল। অনন্যা প্রথমে খেয়াল করেনি, কিন্তু যখন রাহুল সবার জন্য কয়েকটা প্রদীপ নিয়ে হাজির হলো, তখনই সেই দেয়ালটা যেন হঠাৎ চোখে পড়লো। রাহুল আন্তরিক হাসি দিয়ে বলেছিল—“এগুলো আপনারা পূজার রাতে জ্বালাতে পারেন, আলো অনেক দূর পর্যন্ত যাবে।” কিন্তু তখনই এক আত্মীয় ঠোঁট বাঁকিয়ে ফিসফিস করে বলল, “এ তো স্রেফ প্রদীপওয়ালা, এর সঙ্গে এত ঘনিষ্ঠতা কেন?” আরেকজন মজা করে যোগ করল, “শহরের মেয়ের সঙ্গে গ্রামের প্রদীপ ফেরিওয়ালার বন্ধুত্ব? এ বড় অদ্ভুত জুটি!” হাসির আড়ালে লুকোনো তাচ্ছিল্য যেন বাতাসকেও ভারী করে তুললো।
অনন্যা ভেতরে ভেতরে কেঁপে উঠলো। তার চোখে একরাশ রাগ জমলো, কিন্তু সে বাইরে কিছু বললো না, কারণ জানত তার প্রতিবাদ করলে ব্যাপারটা আরও জটিল হয়ে যাবে। অথচ নীরব থাকলেও তার চোখে সেই অস্বস্তি, সেই ব্যথা স্পষ্ট ফুটে উঠেছিল। রাহুলও কথাগুলো শুনেছিল, তবে তার প্রতিক্রিয়া ছিল নিস্তব্ধ। তার মুখের হাসিটা নিভে গেল, কণ্ঠে কোনো শব্দও এলো না। সে জানত, তাদের জগত সত্যিই আলাদা—একজন শহরের আরাম-আয়েশ, বই, পড়াশোনার মধ্যে বড় হচ্ছে, আর সে বড় হচ্ছে মাটির গন্ধ, শ্রম, আর দায়বদ্ধতার মধ্যে। মেলার রাতে যে আলো তারা একসাথে ভাসিয়েছিল, তা হঠাৎ করে যেন ম্লান হয়ে এলো এই কথাগুলোর আঁধারে। তবু রাহুল নিজের অভিমান গোপন করে মাথা নিচু করে চলে গেল, যেন নিজের জগতে ফিরে যাচ্ছে—সেই জগতে যেখানে স্বপ্নও বাস্তবের অভাবের কাছে হেরে যায়।
অনন্যা সারাদিন অস্থির ছিল। সে বুঝতে পারছিল, তার বন্ধুরা যেটাকে কৌতুক করে দেখছে, তার কাছে সেটাই হয়ে উঠছে গভীর অনুভূতির উৎস। রাহুলের সরলতা, তার কথার আন্তরিকতা, আর চোখের সেই বিশ্বাসী দৃষ্টি অনন্যার মনে এমন ছাপ ফেলেছিল, যা কোনো শহুরে চাকচিক্য দিয়ে মাপা যায় না। কিন্তু তার চারপাশের মানুষগুলো সেই সরলতাকে অবজ্ঞা করছে। একসময় তার মনে ক্ষোভ জমে উঠলো—কেন তার নিজের জগত এমন একটা দেয়াল দাঁড় করিয়েছে? সে ভাবলো, হয়তো তার বন্ধুদের চোখে রাহুল কেবল একজন প্রদীপ বিক্রেতা, কিন্তু তার কাছে রাহুল যেন প্রদীপের মতোই—অন্ধকারের মধ্যে আলো জ্বালিয়ে দেওয়া এক আলোকবর্তিকা। অনন্যার ভেতরে জন্ম নিল এক নিঃশব্দ প্রতিজ্ঞা, যদিও মুখে কিছু বলল না, তার দৃষ্টি যেন বলে দিচ্ছিল—সে এই অপমান মেনে নেবে না।
রাহুলও নিজের ভেতরে লড়াই চালাচ্ছিল। সে জানতো, এই কষ্টকে জয় করা সহজ নয়। কিন্তু সে এটাও জানতো, অনন্যার চোখে যে রাগ আর কষ্ট ফুটে উঠেছিল, সেটা শুধুই তার জন্য। হয়তো সে প্রতিবাদ করতে পারেনি, কিন্তু তার নীরবতার মধ্যেই ছিল এক দৃঢ় অবস্থান। রাহুলের মনে একদিকে আত্মসম্মানের ক্ষত, অন্যদিকে অনন্যার নীরব সমর্থন। সে ভাবলো, “হয়তো আমাদের জগত আলাদা, কিন্তু আলো তো সবার জন্য সমানভাবে জ্বলে। প্রদীপ যেমন অন্ধকার আর আলোয় ভেদ করে না, আমরাও একে অপরকে আলাদা চোখে দেখতে পারি না।” তবুও তার ভেতরে একটা শঙ্কা কাজ করতে লাগলো—এই ব্যবধান কি সত্যিই পেরোনো সম্ভব? নাকি তাদের সম্পর্ক কেবল মেলার রাতের মতোই ক্ষণস্থায়ী আলো, যা উৎসবের শেষে নিভে যাবে? সেই প্রশ্নের উত্তর তখনও অজানা ছিল, তবে দুজনের হৃদয়ের ভেতরেই আলো আর আঁধারের এক গভীর দ্বন্দ্ব শুরু হয়ে গিয়েছিল।
৭
রাতের মেলার আলো যেন হঠাৎ নিভে গেছে রাহুলের জীবনে। সে বাড়ি ফিরতেই চোখে পড়ে তার বাবার জীর্ণ শরীর আরও কেমন যেন কুঁকড়ে গেছে। বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে ওষুধের গন্ধ আর কাশির শব্দ, যা ঘরের নীরবতাকে আরও ভারী করে তুলছিল। মাটির ঘরে তেলচিটে কেরোসিন বাতি মিটমিট করছিল, আর তার ম্লান আলোয় রাহুলের মা চুপচাপ বসে বাবার কপালে ভিজে কাপড় চাপাচ্ছিলেন। রাহুলের বুকটা হাহাকার করে উঠলো—সেদিন রাতে প্রদীপ ভাসানোর সময় সে যে স্বপ্নের আলোয় ভেসেছিল, এখানে এসে তা যেন মুছে গেলো। বাস্তবতার অন্ধকার, দারিদ্র্যের আঁকশি, আর বাবার শারীরিক যন্ত্রণা মিলেমিশে এক শূন্যতা তৈরি করলো, যেখানে আশার আলো টিমটিম করতে থাকলো। সে বুঝতে পারলো, সংসারের বোঝা তার কাঁধে আরও বাড়ছে, আর হয়তো তার জীবনও এই অনন্ত অন্ধকারের ভেতরেই ডুবে যাবে।
বিছানার পাশে বসে বাবার হাতটা ধরলো রাহুল। শুষ্ক, কৃশ হাত যেন মাটির প্রদীপের মতোই ভঙ্গুর। বাবা ক্ষীণ স্বরে বললেন, “তোকে ছাড়া সংসারটা আর টিকবে না রে, রাহুল। এই প্রদীপই আমাদের আশা।” কথাগুলো শুনে রাহুলের বুক কেঁপে উঠলো। হঠাৎ মনে হলো, তার বাবা কেবল একজন মানুষ নয়, যেন তার ভেতরে জমে থাকা অন্ধকারকে সরিয়ে আলোর কথাই বলছেন। কিন্তু রাহুলের মনে প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে লাগলো—“এই প্রদীপের আলো কি যথেষ্ট? অনন্যার মতো কারও জীবনে আলো জ্বালাতে পারবো আমি? নাকি আমার অক্ষমতা, দারিদ্র্য আর কষ্টই আমাকে গ্রাস করবে?” বাইরে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শোনা যাচ্ছিল, আর সেই নিস্তব্ধতার মধ্যে তার এই প্রশ্নগুলো আরও তীব্র হয়ে উঠছিল।
রাহুলের মনে পড়লো অনন্যার চোখের সেই দৃষ্টি—যেদিন তার বন্ধুরা তাকে অবজ্ঞা করেছিল, আর সে নীরব থেকেও চোখের ভাষায় প্রতিবাদ জানিয়েছিল। সেই দৃঢ় দৃষ্টিই ছিল তার ভরসা। কিন্তু এখন যখন বাবার কাশিতে পুরো ঘর কেঁপে উঠছে, তার মনে হলো—অনন্যা এক জগতের, আর সে একেবারেই অন্য জগতের। তাদের মাঝের ব্যবধানটা যেন এই মুহূর্তে আরও গভীর হয়ে উঠলো। অনন্যা শহরে ফিরে গেলে হয়তো এই প্রদীপের আলো তার কাছে কেবল স্মৃতি হয়ে থাকবে, কিন্তু রাহুল জানে, তার জীবনের প্রতিটি দিন লড়াই, প্রতিটি রাত অনিশ্চয়তার আঁধারে ভরা। তবুও সে মেনে নিতে পারলো না যে, তার জীবনের কষ্ট মানেই অন্ধকার। তার ভেতরের এক কোণে এখনো একটা প্রদীপ টিমটিম করে জ্বলছিল—যেন বলছিল, আলো সবসময় অন্ধকারকে হারাতে পারে, যদি তাকে জ্বালিয়ে রাখা যায়।
সেই রাতেই রাহুল চুপচাপ বারান্দায় বসে রইলো। আকাশে তারারা জ্বলছিল, কিন্তু তার মনে হচ্ছিল, প্রতিটা তারা যেন তাকে প্রশ্ন করছে—“তুই কি হাল ছাড়বি?” বাতাসে শিউলি ফুলের গন্ধ ভেসে আসছিল, আর সে মাটির প্রদীপ বানানোর অভ্যাস করা হাতগুলো শক্ত করে মুঠো করলো। হ্যাঁ, তার কাঁধে সংসারের বোঝা আছে, বাবার অসুখ আছে, দারিদ্র্য আছে, কিন্তু তবুও সে জানে, প্রতিটি প্রদীপের ভেতরেই লুকিয়ে থাকে নতুন সূর্যের প্রতিশ্রুতি। অনন্যার প্রতি তার টান কেবল স্বপ্ন নয়, বরং আলো জ্বালানোর একটা কারণ। সে হয়তো জানে না ভবিষ্যৎ কী, কিন্তু তার ভেতরে জন্ম নিলো এক নীরব শপথ—অন্ধকার যতই ঘন হোক, সে প্রদীপ জ্বালানো থামাবে না। অনন্যা থাকুক বা না থাকুক, তার আলোর পথ চলা চলতেই থাকবে।
৮
শরতের বিকেলটা ছিল নরম আলোয় ভরা, আকাশে হালকা সাদা মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছিল। অনন্যা সেদিন এক অজানা কৌতূহল নিয়ে মামার বাড়ি থেকে বের হলো। চারপাশে কেউ টের না পেলেও, তার বুকের ভেতরে গোপন এক উত্তেজনা জমে উঠেছিল—আজ সে রাহুলের সঙ্গে দেখা করবে। গ্রামের মাঠ পেরিয়ে, কাশবনের সরু পথ ধরে এগিয়ে এলো সে। বাতাসে কাশফুল দুলছিল, আর সেই দৃশ্য অনন্যার মনে এক অদ্ভুত প্রশান্তি এনে দিল। রাহুল সেখানে অপেক্ষা করছিল, তার হাতে কিছু নতুন মাটির প্রদীপ। অনন্যাকে দেখে তার চোখে যে আলো ফুটলো, সেটা যেন প্রদীপের আলোর থেকেও উজ্জ্বল। প্রথমে কেউ কথা বললো না, কেবল নীরবতায় ভেসে বেড়ালো সেই দীর্ঘ প্রতীক্ষিত অনুভূতি। যেন তাদের দুজনের হৃদয় একই ছন্দে বেজে উঠছিল, আর সেই ছন্দই ভরে তুলছিল চারপাশের নিস্তব্ধ বিকেলকে।
অনন্যা আলতো করে প্রদীপগুলোর দিকে তাকালো, তারপর হেসে বললো, “তুমি কি সারাজীবন এভাবেই প্রদীপ বিক্রি করতে চাও?” প্রশ্নটা ছিল সহজ, কিন্তু তাতে মিশে ছিল গভীর কৌতূহল। রাহুল প্রথমে একটু থেমে গেল, তারপর ধীরে ধীরে বললো, “আমি শুধু প্রদীপ বিক্রি করতে চাই না, অনন্যা। আমার স্বপ্ন হলো একদিন আমি এমন আলো তৈরি করব, যা শুধু ঘর জ্বালাবে না—মানুষকে নতুন জীবন দেখাবে। প্রদীপ কেবল মাটি আর তেল দিয়ে তৈরি হয় না, এটা মানুষের ভরসার প্রতীক। আমি চাই, আমার আলো মানুষকে আশা দিক, অন্ধকার ভেদ করে বাঁচার শক্তি দিক।” কথাগুলো বলতে বলতে তার চোখে এমন এক দৃঢ়তা ফুটে উঠলো, যা অনন্যাকে বিস্মিত করলো। সে বুঝলো, রাহুল কেবল দরিদ্র গ্রামের এক ছেলে নয়, বরং তার ভেতরে আছে এক আলোকিত স্বপ্নদ্রষ্টা।
অনন্যার বুকটা ভরে উঠলো এক অদ্ভুত আবেগে। শহরে থেকে সে অনেক বড় বড় স্বপ্নের কথা শুনেছে, কিন্তু রাহুলের স্বপ্নের সরলতা আর দৃঢ়তায় যে গভীরতা আছে, তা আগে সে কখনো অনুভব করেনি। কিছুক্ষণ চুপ থেকে সে বললো, “তোমার এই স্বপ্নটা আমি বিশ্বাস করি, রাহুল। হয়তো আমাদের জগৎ আলাদা, হয়তো মানুষ আমাদের বোঝে না, তবুও আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি—আমি সবসময় তোমার ওপর বিশ্বাস রাখব।” কথাগুলো শুনে রাহুলের চোখ ভিজে উঠলো। এতদিন সে ভেবেছিল, তার স্বপ্ন হয়তো খুব ছোট, কিংবা দারিদ্র্যের আঁধারে তা একদিন নিভে যাবে। কিন্তু অনন্যার সেই নিঃশর্ত বিশ্বাস তার মনে এক নতুন শক্তি জাগালো। তার মনে হলো, প্রদীপের আলো যেমন বাতাসে টিকে থাকে ভরসার কারণে, তেমনি তার স্বপ্নও টিকে থাকবে অনন্যার এই বিশ্বাসে।
বিকেলের আকাশ তখন রঙ বদলাচ্ছিল, সূর্যাস্তের লালচে আভা কাশবনের গায়ে লেগে গিয়েছিল। দুজনেই চুপচাপ বসে ছিল, তবে তাদের নীরবতা ছিল ভরপুর কথায়। রাহুল অনন্যার দিকে তাকিয়ে বললো, “হয়তো দূরত্ব একদিন আমাদের আলাদা করবে, কিন্তু আমি প্রতিজ্ঞা করছি, যতদিন শ্বাস থাকবে, আমি এই আলো জ্বালিয়ে রাখব।” অনন্যা হেসে মাথা নেড়ে বললো, “আর আমি প্রতিজ্ঞা করছি, দূরত্ব যতই হোক, আমি তোমার সেই আলোয় ভরসা রাখব।” মুহূর্তটা ছিল স্বপ্ন আর বাস্তবের মেলবন্ধন—যেখানে এক দরিদ্র প্রদীপ বিক্রেতা আর এক শহুরে মেয়ের হৃদয় একই স্বপ্নের আলোয় জড়িয়ে গেল। আকাশের লালচে আভা যেন তাদের প্রতিজ্ঞার সাক্ষী হয়ে রইল, আর কাশফুলগুলো হাওয়ায় দুলে যেন তাদের ভালোবাসার গান গেয়ে উঠলো।
৯
গ্রামের বার্ষিক পূজার মেলা শেষ হয়ে এসেছে। চারদিকের কোলাহল, আলোর ঝলক আর ঢাকের তালে ভরা সেই উৎসব যেন ধীরে ধীরে নিভে আসছে। মাঠে যেখানে রঙিন আলো আর মানুষের ভিড়ে সরগরম ছিল, সেখানে এখন কেবল ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে খালি কাগজের মোড়ক, ভাঙা খেলনা আর মাটির ধুলো। অনন্যা দাঁড়িয়ে ছিল সেই মাঠের এক কোণে, যেখানে কয়েক দিন আগেই সে প্রথম রাহুলকে দেখেছিল প্রদীপ হাতে। মনে হচ্ছিল, যেন এই মেলা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের দুজনের সময়ও ফুরিয়ে আসছে। পরদিনই তাকে শহরে ফিরে যেতে হবে, ফিরে যেতে হবে সেই ব্যস্ত জীবনে যেখানে প্রতিদিন হাজারো শব্দ, মানুষ আর স্বপ্নের ভিড়, অথচ সেই ভিড়ে নেই রাহুলের সরল হাসি কিংবা তার স্বপ্নের কথা। এই ভাবনাতেই অনন্যার বুক ভারী হয়ে এলো, চোখের কোণে অজান্তেই জমে উঠলো জল।
রাহুল সেই মাঠে প্রদীপ গুটিয়ে নিচ্ছিল। প্রতিটি প্রদীপ যেন তার কাছে শুধু মাটির জিনিস নয়, স্মৃতির টুকরো। একেকটা প্রদীপে সে যেন খুঁজে পাচ্ছিল অনন্যার সঙ্গে কাটানো মুহূর্তগুলো—প্রথম দেখা, প্রদীপ ভাসানো, কিংবা কাশবনের সেই বিকেল যখন তারা দুজন একে অপরকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। প্রদীপ গুছাতে গুছাতে হঠাৎই তার মনে হলো, এই আলোগুলো নিভে গেলেও তার ভেতরে যে আলো জ্বলে উঠেছে, তা কি কখনো নিভবে? সে জানত, অনন্যাকে যেতে হবে, আর এই বিদায় কোনো সাধারণ বিদায় নয়, এটা হয়তো এক অনন্ত অপেক্ষার শুরু। রাহুলের চোখেও জল এসে গেল, কিন্তু সে মাথা নিচু করে রাখলো, যেন অনন্যা তার দুর্বলতা টের না পায়।
বিকেলের শেষে তারা দুজন মাঠের এক পাশে গিয়ে দাঁড়াল। চারপাশে তখন প্রায় নিস্তব্ধতা, শুধু দূর থেকে শোনা যাচ্ছিল গরুর গাড়ির চাকার শব্দ আর গ্রামের কুকুরের ডাক। অনন্যা চুপচাপ রাহুলের দিকে তাকালো। চোখে ভেসে উঠছিল না বলা অনেক কথা—অভিমান, ভালোবাসা আর অদ্ভুত এক ভরসা। রাহুল আলতো করে বললো, “তুমি শহরে চলে যাচ্ছো, আমি জানি হয়তো আমাদের জগত আলাদা। কিন্তু একটা কথা মনে রেখো, এই আলো, এই প্রদীপ, সবসময় তোমার সঙ্গে থাকবে।” অনন্যা তখন আর চোখের জল আটকে রাখতে পারলো না। সে কাঁপা গলায় বললো, “প্রথম প্রেমের আলো কখনো নিভে না, রাহুল। দূরত্ব যতই হোক, আমি তোমার স্বপ্নে বিশ্বাস রাখবো।” কথাগুলো বলতে বলতে তাদের দুজনের চোখে জল জমে উঠলো, কিন্তু সেই জলের ভেতরেই লুকিয়ে ছিল অটল প্রতিজ্ঞা।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো, আকাশে একে একে জ্বলে উঠলো তারা। সেই তারাদের আলোয় তারা দুজন দাঁড়িয়ে রইলো নীরবে, যেন সময় থমকে গেছে। বিদায়ের মুহূর্তে তারা কোনো প্রতিশ্রুতি লিখিতভাবে দিল না, কোনো শপথ কাগজে লিখলো না—শুধু চোখের ভাষায় একে অপরকে বললো, এই টান, এই ভালোবাসা কখনো নিভবে না। অনন্যা ধীরে ধীরে পা বাড়ালো শহরে ফেরার পথে, আর রাহুল দাঁড়িয়ে রইলো অন্ধকার মাঠের মাঝে প্রদীপ হাতে। চারপাশের আলো ম্লান হয়ে আসছিল, কিন্তু তাদের ভেতরের আলো উজ্জ্বল হয়ে উঠছিল আরও বেশি। কারণ তারা দুজনেই জানতো—এটা কোনো শেষ নয়, এটা কেবলই নতুন শুরু। মেলার মতোই জীবনেরও উৎসব আসে যায়, কিন্তু প্রথম প্রেমের আলো একবার জ্বলে উঠলে, তা কখনো নিভে যায় না।
১০
শীতের হাওয়া বইছে চারদিকে, গ্রামের মাঠ আবার ভরে উঠেছে রঙিন আলোয়। পূজার মেলা শেষ হয়ে অনেকদিন পেরিয়ে গেছে, কিন্তু রাহুলের জীবনে সেই রাতগুলোর স্মৃতি এখনো তাজা। আজ সে আবার বসেছে তার ছোট্ট দোকানে, সাজাচ্ছে সারি সারি মাটির প্রদীপ। একসময় এগুলো কেবল ছিল সংসারের রুটি-রুজির ভরসা, বাবার ওষুধ কেনার উপায়। কিন্তু আজ তার চোখে প্রদীপ মানে শুধু ব্যবসা নয়, বরং আলোর এক প্রতীক—যা মানুষের জীবনে নতুন আশা জাগায়। প্রদীপ সাজাতে সাজাতে তার চোখের দৃষ্টি উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, কারণ সে জানে এই আলো শুধু গ্রামের মাটির ঘরগুলোতে নয়, কারও হৃদয়েও জ্বলে উঠেছে। সেই হৃদয়, যে শহরের ভিড়ের মধ্যে থেকেও তার প্রদীপের আলোকে মনে রেখেছে।
রাহুলের হাত কাদা মাখে, কিন্তু তার কল্পনা ভেসে যায় অনেক দূর। প্রতিটি প্রদীপ সে যত্ন করে বানায়, যেন প্রতিটিতে লুকিয়ে আছে এক টুকরো স্বপ্ন। একসময় মনে হতো, এই মাটির প্রদীপ এতই ভঙ্গুর যে একটু হাওয়াতেই ভেঙে যায়, নিভে যায়। কিন্তু এখন সে বুঝেছে, আসল আলো প্রদীপে নয়—মানুষের ভেতরে। অনন্যা যখন তার চোখে চোখ রেখে বলেছিল, “প্রথম প্রেমের আলো কখনো নিভে না,” তখন থেকেই সে বিশ্বাস করতে শিখেছে যে তার প্রদীপগুলো শুধু অন্ধকার দূর করে না, মানুষের ভেতরের ভরসাও জাগিয়ে তোলে। তার ভেতরের আত্মবিশ্বাস যেন বেড়ে উঠেছে বহুগুণ। সে আর শুধু প্রদীপ ফেরিওয়ালা নয়, সে যেন আলোর ফেরিওয়ালা।
এদিকে শহরের ব্যস্ত কোলাহলের ভিড়ে অনন্যা রাতের বারান্দায় বসে আকাশের দিকে তাকায়। চারদিকে গাড়ির শব্দ, নীয়ন বাতির ঝলকানি, বই আর পড়াশোনার চাপ—সবকিছুর ভিড়েও তার চোখে ভেসে ওঠে গ্রামের সেই পুকুর, কাশবনের পথ, আর রাহুলের হাতে ধরা জ্বলন্ত প্রদীপ। মাঝে মাঝে চোখ বুজলেই সে কল্পনায় দেখতে পায়, রাহুল তার মাটির প্রদীপ সাজাচ্ছে, আর সেই প্রদীপের আলো কোনোভাবে শহরের এই অন্ধকার কোলাহলকেও আলোকিত করছে। তখন তার ঠোঁটে মৃদু হাসি খেলে যায়। সে জানে না ভবিষ্যৎ কেমন হবে, দূরত্ব কতটা বাড়বে, কিংবা সমাজ কী ভাববে, কিন্তু একটাই বিশ্বাস তার ভেতরে অটল হয়ে আছে—রাহুলের সেই আলো চিরদিন জ্বলে থাকবে। এই বিশ্বাসেই তার প্রতিদিনের ক্লান্তি, কোলাহল আর দৌড়ঝাঁপের ভেতরও এক আশার আলো জ্বলে ওঠে।
সময় গড়ায়, জীবনের গল্পও এগোয়। হয়তো রাহুল এখনো প্রতিদিন কাদা কেটে প্রদীপ বানায়, আর অনন্যা বইয়ের ভিড়ে ডুবে থাকে শহরে, কিন্তু তাদের সম্পর্কের আলো নিভে যায়নি। বরং প্রদীপের শিখার মতোই তা ছোট হলেও স্থির, ভঙ্গুর হলেও উজ্জ্বল। রাহুল জানে, তার মাটির প্রদীপের আলো কোনো এক শহরের ঘরে প্রতিদিন কল্পনায় জ্বলে ওঠে, আর অনন্যা জানে, তার প্রতিশ্রুতি রাহুলকে শক্তি দেয় প্রতিটি অন্ধকার জয় করতে। তারা দুজনেই আলাদা পথে হাঁটে, তবু এক অদৃশ্য আলো তাদের বাঁধন তৈরি করে রাখে। আর সেই আলোই তাদের প্রেমকে অমলিন করে তোলে—একদম প্রদীপের শিখার মতো, যা কখনো নিভে যায় না, যতই হাওয়া বইতে থাকুক না কেন।
___