১
শান্তিপুর গ্রাম যেন একদিকে শান্ত, অন্যদিকে ভয়ঙ্কর রহস্যে মোড়া। গ্রামটি ছোট, কিন্তু চারদিকে বিস্তৃত ধানক্ষেত, ঘনবনের মাঝখানে পেঁচানো কাঁচা রাস্তা আর দিগন্তজোড়া নীরবতা যেন একে আরও রহস্যময় করে তুলেছে। দিনের বেলায় এই গ্রাম প্রাণচঞ্চল—কৃষকের হালচাষ, বাচ্চাদের খেলা, মহিলাদের কুয়োয় ভিড় জমা, আর বিকেলের পর আড্ডায় মেতে ওঠা যুবকরা। কিন্তু রাত নামলেই অন্য ছবি। গ্রামের মানুষদের মুখে একটা অনবরত ফিসফিস—সোনালি পালকির গল্প। বহু প্রজন্ম ধরে চলা এই কাহিনি এতটাই শক্তভাবে গ্রামের মাটিতে গেঁথে গেছে যে তা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে সাহস পায় না কেউ। গল্পটা হলো, মধ্যরাতের অন্ধকারে কেবল একবার দেখা যায় অদ্ভুত এক সোনালি পালকি। মাটির রাস্তার ধুলোয় যেন আলো ঝরে পড়ে, অথচ আশ্চর্য ব্যাপার, পালকি বহন করার মতো কোনো মানুষ চোখে পড়ে না। ভেতরে বসে আছে কেউ, না শূন্য—তা বোঝা যায় না। শুধু বাতাস কেঁপে ওঠে, শোনায় রূপার ছোট ঘণ্টার আওয়াজ, আর মুহূর্তেই ভয়ের স্রোত গ্রামবাসীর শরীর জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। শিশু থেকে বৃদ্ধ—সকলেই জানে, যে একবার এই পালকিকে চোখে দেখে, তার আর রক্ষা নেই। সাত দিনের মধ্যেই অকারণে তার মৃত্যু ঘটে, যেন কারও অদৃশ্য হাত তার ভাগ্যের রেখা কেটে দেয়।
এই গল্পের উৎপত্তি কেউ জানে না, কিন্তু প্রতিটি পরিবারের লোকের মুখে এ নিয়ে আলাদা আলাদা স্মৃতি আছে। কেউ বলে, তার দাদু একবার দূর থেকে সোনালি আলো দেখে এক সপ্তাহের মাথায় নিঃশব্দে মারা যান। কারও মতে, তাদের পাড়ার এক কিশোরী অকারণে অসুস্থ হয়ে পড়ে, তারপর হঠাৎ মারা যায়, আর তার আগের রাতে দেখা গিয়েছিল সেই পালকি। মজার ব্যাপার হলো, গ্রামবাসীরা যদিও ভয় পায়, তবুও এই কাহিনির মধ্যে যেন এক ধরনের টান থাকে। শিশুরা রাতে শুতে যাওয়ার আগে মায়েদের কাছে অনুরোধ করে—“মা, আবার শোনাও অশরীরীর পালকির গল্প।” আর মা ভয় দেখাতে গিয়েও নিজের গলা কাঁপতে টের পান। কিশোর-যুবকদের দল আড্ডার সময়ে হাসাহাসি করে বলে—“এসব মিথ্যা, কেউ কোনোদিন দেখলে প্রমাণ দিক।” কিন্তু যখন গভীর রাতে বাতাস ভারী হয়, কুকুরেরা একসাথে হাউ হাউ করে ওঠে, বা দূরের বাঁশবনে হঠাৎ হাওয়া হু হু করে বয়ে যায়, তখন তাদের বুক কেঁপে ওঠে। গল্পটা যেন কেবল গল্প নয়, অদৃশ্য এক আতঙ্কের ছায়া, যা পুরো গ্রামকে রাতে পেঁচিয়ে ধরে। দিনের আলোতে গ্রামবাসীরা এ নিয়ে হালকা ঠাট্টা করতে পারে, কিন্তু সূর্য অস্ত গেলে, প্রতিটি মানুষ যেন সেই কাহিনির ভেতর বেঁচে থাকে।
শান্তিপুর গ্রামের বৃদ্ধরা বলেন, এই অভিশাপ থেকে রক্ষা পাওয়ার একমাত্র উপায় হলো পালকি এড়িয়ে চলা। তারা সন্তানদের সাবধান করে দেয়, “রাতে কাঁচা রাস্তায় যেও না, বিশেষ করে পূর্ণিমার রাতে।” আর পূর্ণিমার রাতে তো গ্রামের দৃশ্য একেবারেই অন্য রকম—আলোয় ঝলমল ধানক্ষেত, পুকুরের জলে চাঁদের প্রতিফলন, কিন্তু তার মাঝেই বাতাসে অদ্ভুত এক শীতলতা ভেসে বেড়ায়। এ সময় সবাই ঘরে দরজা বন্ধ করে বসে থাকে। তবু গ্রামে কিছু দুষ্টু ছেলে আছে যারা জানালার ফাঁক দিয়ে আকাশের দিকে তাকায়, মন চায় যদি এক ঝলক দেখা যেত সেই পালকি। কিন্তু তাদের মা-বাবা আতঙ্কে চিৎকার করে ডেকে আনে। এইভাবেই গল্পটা ভয় এবং আকর্ষণের দ্বন্দ্বে বেঁচে আছে বহু বছর ধরে। শান্তিপুরের বাইরে হয়তো এই কাহিনি লোকেরা মিথ্যা বলে উড়িয়ে দেবে, কিন্তু গ্রামের মানুষদের কাছে এটি কেবল লোককথা নয়, বরং বাস্তবের মতোই সত্যি। তারা বিশ্বাস করে, গ্রামের প্রতিটি অলি-গলিতে, প্রতিটি নিঃশব্দ রাতে এই অশরীরীর পালকি উপস্থিত থাকে, অপেক্ষা করে তার নতুন শিকার বেছে নেওয়ার জন্য। আর এভাবেই শান্তিপুর গ্রাম দিনশেষে এক গভীর অদ্ভুত কাহিনির অন্ধকার ছায়ায় আচ্ছন্ন থাকে—যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে পৌঁছে দেয় ভয় এবং বিস্ময়ের এক চিরন্তন উত্তরাধিকার।
২
রামলাল পুরোহিত শান্তিপুর গ্রামের সবচেয়ে শ্রদ্ধেয় মানুষদের একজন। বয়স তার পঁচাত্তর পেরিয়েছে, মাথার সব চুল সাদা, কপালে চিরকাল চন্দনের দাগ, চোখে গভীরতা আছে বটে, কিন্তু সেই গভীরতার ভেতরে যেন এক অদৃশ্য আতঙ্ক লুকিয়ে থাকে। গ্রামে যখনই কোনো মঙ্গলকাজ হয়, পূজা-পাঠ হয়, বা কারও জীবনে বিপদ আসে, তখন প্রথমে যাঁর কাছে দৌড়ে যায় মানুষ, তিনি রামলাল। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো, অশরীরীর পালকির গল্প উঠলেই তাঁর মুখ অন্য রকম হয়ে যায়। বাইরে থেকে তিনি যতটা দৃঢ় হয়ে বলেন, “এসব কুসংস্কার, ভয়ের কিছু নেই,” ভেতরে ভেতরে তাঁর হাত কেঁপে ওঠে। কারও কাছে প্রকাশ করেন না, কিন্তু একা হাঁটার সময়, বিশেষত রাতের বেলায় মন্দির থেকে ফেরার সময়, তাঁর ঠোঁট নড়ে ওঠে মন্ত্রপাঠে। কখনো শ্রীমন্ত্র, কখনো শিবের নাম, কখনো আবার অচেনা কোনো গোপন মন্ত্র, যা হয়তো তিনি তাঁর গুরু থেকে শিখেছিলেন বহু বছর আগে। যেন তিনি জানেন, গ্রামের অদৃশ্য ভয়টিকে শুধুই বিশ্বাস বা অবিশ্বাস দিয়ে এড়িয়ে যাওয়া যায় না।
তাঁর জীবনের সঙ্গে এই কাহিনির যোগ আসলে বেশ গভীর। প্রায় চল্লিশ বছর আগে তিনি তখন তরুণ ব্রাহ্মণ। এক অমাবস্যার রাতে, গুরুদেবের বাড়ি থেকে ফেরার পথে তিনি প্রথমবার দেখেন সোনালি পালকিকে। কাঁচা রাস্তায় এক অদ্ভুত আলো ঝলমল করছিল, চারপাশ নিস্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল, এমনকি ঝিঁঝিঁ পোকার আওয়াজও মিলিয়ে গিয়েছিল। রামলাল থমকে দাঁড়িয়েছিলেন—ভয়ে নয়, বিস্ময়ে। তিনি স্পষ্ট দেখেছিলেন পালকি, কিন্তু তাকে বহন করার মতো কোনো মানুষ ছিল না। সেই সময়ই তিনি চোখে পড়েন এক ছায়ামূর্তি—সোনালি শাড়ি, কিন্তু মুখটা যেন ঘন কুয়াশার আড়ালে ঢাকা। তাঁর মনে হয়েছিল, মূর্তিটি যেন তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে, অথচ চোখ নেই, মুখ নেই—শুধু এক শূন্যতা। সেই রাতটা যেন আজও তাঁর মনে খোদাই হয়ে আছে। আশ্চর্যের বিষয় হলো, অন্যদের মতো তাঁর মৃত্যু হয়নি সাত দিনের মধ্যে। কিন্তু তাঁর গুরুদেব পরদিনই তাঁকে বলেছিলেন, “তোমার জীবনের উদ্দেশ্য ভিন্ন। তুমি কেবল দর্শক নও, এই রহস্যের রক্ষক।” সেই থেকে রামলাল জানেন, পালকির রহস্য কেবল মিথ নয়, এর সঙ্গে আছে এক অভিশাপ, এক অসমাপ্ত আত্মার কাহিনি, যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে চলেছে।
তবে গ্রামের সামনে তিনি কখনো এসব স্বীকার করেন না। কারণ তিনি জানেন, যদি সত্যিটা বলে দেন, তবে ভয়ে গ্রামবাসী একেবারেই দিশেহারা হয়ে পড়বে। তিনি বরং মানুষকে বোঝান, “ভগবানের ভক্তি রাখো, ভয় কোরো না।” অথচ ভিতরে ভিতরে তিনি সবচেয়ে বেশি ভয় পান। প্রতিদিন সন্ধ্যা নামলেই তাঁর বুকের ভেতরে চাপা উত্তেজনা জমে ওঠে, তিনি মনে করেন আজ যদি আবার পালকি দেখা দেয়? মন্দির থেকে বাড়ি ফেরার পথে তাঁর চোখ চারপাশে ঘোরে—ধানক্ষেত, বাঁশবন, নদীর ধারে অন্ধকার গাছের ছায়া। আর এই অন্ধকারেই মাঝে মাঝে তিনি কানে পান ঘণ্টাধ্বনি, যা বুকে কাঁপুনি ধরায়। ঘরে ফিরে দরজা বন্ধ করে তিনি বসেন প্রাচীন গ্রন্থের সামনে, যেখানে তাঁর গুরু লিখে দিয়েছিলেন কিছু মন্ত্র—যদি কখনো পালকির অভিশাপ থামানোর সময় আসে। রামলাল বুঝতে পারেন, গ্রামে সবাই ভয়ে বাঁচলেও, একমাত্র তাঁরই কাঁধে আছে এই রহস্যের ভার। এ যেন এক অদৃশ্য দায়, যা থেকে তিনি মুক্তি পান না, যত বয়সই হোক না কেন।
৩
শান্তিপুর গ্রামের শিবু ছিল অন্য সবার থেকে আলাদা। বয়স তার বাইশ–তেইশ, রক্তে ছিল সাহস আর কৌতূহল। ছোটবেলা থেকেই সে ভুত-প্রেতের গল্প শুনে হাসত, মাকে বলত—“এ সব দাদু-ঠাকুমার বানানো কথা।” স্কুলে পড়ার সময়েও সে সবসময় যুক্তি খুঁজত, কুসংস্কার ভাঙতে চাইত। তাই গ্রামে যখন অশরীরীর পালকির গল্প নিয়ে আড্ডা জমত, শিবু প্রথমেই বলত, “এসব কেবল ভয় দেখানোর জন্য বানানো কাহিনি। কারও মৃত্যু হলে সবাই দায় চাপিয়ে দেয় পালকির ওপর।” তার বন্ধুদের মধ্যে অনেকেই ভয়ে ভয়ে এসব গল্প মানত, কিন্তু শিবু কটাক্ষ করে বলত, “একটা পালকি চলবে, অথচ কেউ টানছে না—এ আবার হয় নাকি!” তার কথা শুনে গ্রামের প্রবীণরা রেগে যেত, কিন্তু ভিতরে ভিতরে ভয়ও পেত—কারণ শিবুর এই অবিশ্বাস, তার অহঙ্কার হয়তো তাকে বিপদের মুখে ঠেলে দেবে।
একদিন গ্রামের মেলা থেকে ফেরার পথে, সন্ধ্যার পর আড্ডা জমল পুকুরের ধারে। বাতাসে ভেসে আসছিল নাগরদোলার শব্দ, শাঁখ বাজনার আওয়াজ মিলিয়ে যাচ্ছিল রাতের আঁধারে। বন্ধুদের মধ্যে একজন ভয়ে বলল, “আজ পূর্ণিমা রাত, পালকি বেরোবে না তো?” শিবু তৎক্ষণাৎ হেসে উঠল, গলা চড়িয়ে বলল, “আরে এসব বাজে কুসংস্কার! আজ রাতেই আমি দাঁড়িয়ে থাকব সেই রাস্তায়, দেখে নেব পালকি কেমন করে আসে। যদি দেখি, প্রমাণ করব—ভয় পাওয়ার কিছু নেই।” তার কণ্ঠে ছিল দৃঢ়তা, কিন্তু বন্ধুদের চোখে পড়েছিল অন্য কিছু—কৌতূহলের সঙ্গে একরাশ অজান্তে ডেকে আনা বিপদ। সবাই তাকে থামাতে চাইলো, বলল, “না রে শিবু, এভাবে খেলা কোরো না। এ গল্প কেউ বানায়নি, সত্যি।” কিন্তু শিবু তাদের উড়িয়ে দিল। তার মনে হলো, ভয়কে ভয় না দেখালে কুসংস্কার কখনও ভাঙবে না। সে বিশ্বাস করল, শুধু তারাই গ্রামকে ভয়ে আটকে রেখেছে, আর সে-ই হবে প্রথম ব্যক্তি, যে সাহস দেখিয়ে প্রমাণ করবে সব ভুয়া।
কিন্তু সাহসের এই ঘোষণা আসলে ছিল অদৃশ্য এক ফাঁদের দড়ি, যা শিবুকে টেনে নিল অন্ধকারের গভীরে। সেই রাতেই সিদ্ধান্ত নিল সে, একা দাঁড়িয়ে থাকবে গ্রামের শেষ প্রান্তের সেই কাঁচা রাস্তায়, যেখানে নাকি পালকিকে দেখা যায়। মেলার হুল্লোড় শেষে সবাই যখন ঘরে ফিরছিল, শিবুর বুকের ভেতর তখন অদ্ভুত উত্তেজনা কাজ করছিল—একদিকে সাহস আর যুক্তির তাগিদ, অন্যদিকে লুকিয়ে থাকা এক অনুচ্চারিত ভয়, যা সে নিজেও স্বীকার করতে চাইল না। আকাশে তখন পূর্ণিমার আলো, চারদিক নিস্তব্ধ হয়ে আসছে, কেবল দূরে বাঁশবনে হাওয়া হু হু করে বয়ে যাচ্ছে। শিবু পা বাড়াল সেই অভিশপ্ত পথে, তার বন্ধুদের সতর্কবার্তা উপেক্ষা করে। সে বুঝতেই পারল না, যুক্তি দিয়ে যাকে অস্বীকার করেছে, সেই অশরীরীর পালকিই তাকে আহ্বান জানাচ্ছে—এক নিষ্ঠুর খেলার দিকে, যেখানে জিত বা হার বলে কিছু নেই, আছে কেবল অমোঘ পরিণতি।
৪
শিবুর বুকের ভেতর যেন ঢোল বাজছিল। চারদিক নিঝুম, শুধু দূরের বটগাছের ফাঁক দিয়ে ঝড়ের হুহু শব্দ ভেসে আসছিল। গ্রামের মানুষজন অনেক আগেই ঘরে ঢুকে গেছে, কেউ আর বাইরে নেই। কিন্তু শিবু এক অদম্য জেদে দাঁড়িয়ে ছিল সেই পুরনো কাঁচা রাস্তায়। মেঘের ফাঁক গলে হঠাৎ যখন চাঁদের আলো নেমে এল, সে দেখতে পেল—দূরে কোথাও এক ম্লান আলোর রেখা ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। প্রথমে ভেবেছিল মেলা থেকে ফেরত কোনো দল হবে, হয়তো কারও হাতে লণ্ঠন। কিন্তু আলোটা স্থির নয়, টিমটিম করে ওঠে আর নিভে যায়। ঠিক তখনই তার কানে ভেসে এলো ঘণ্টাধ্বনি—মৃদু অথচ স্পষ্ট, যেন একসাথে অনেকগুলো মন্দিরের ঘণ্টা বাজছে। শিবুর শরীরের লোম খাড়া হয়ে উঠল। সে জানত, এ সেই শব্দ, যেটা শৈশব থেকেই গল্পের মধ্যে শুনে এসেছে। সে চোখ কুঁচকে তাকাল, আর তখনই দেখতে পেল সেই সোনালি রঙের আভা—মাঝরাতে ঝলমল করছে পালকির শরীর, ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে তার দিকে।
শিবুর চোখে অবিশ্বাস, তবু পা যেন মাটিতে গেঁথে গেল। পালকিটা এখন বেশ কাছে এসে গেছে। সে দেখতে পাচ্ছে সোনালি খোদাই, লাল রঙের মখমলি পর্দা, যেন কোনো রাজপরিবারের জিনিস। কিন্তু তার চেয়েও ভয়ের ব্যাপার—পালকিটা একাই ভাসছে! কোনো মানুষ নেই, কোনো কাঁধ নেই, তবু পালকি ভেসে যাচ্ছে রাস্তার ওপর দিয়ে। ঘণ্টাধ্বনি আরও জোরে বাজতে লাগল, আর হঠাৎ ঝড়ের হাওয়া যেন থমকে দাঁড়াল চারপাশে। শিবুর মনে হল, সে স্বপ্ন দেখছে। তার বুকের ভেতর ভয় আর কৌতূহলের লড়াই চলছিল। সে চিৎকার করে বন্ধুদের ডাকতে চাইল, কিন্তু গলা দিয়ে কোনো শব্দ বের হলো না। তার দু’চোখ আটকে গেল পালকির দরজায়, যেখানে লাল পর্দার আড়াল থেকে যেন কারও ছায়া নড়ছে। পর্দার ফাঁক দিয়ে হালকা আলো বেরিয়ে আসছে, যেন ভিতরে কেউ বসে আছে—কিন্তু কে? শিবুর বুকের ভেতর শীতল স্রোত বয়ে গেল।
পালকি যখন তার একেবারে কাছে এসে দাঁড়াল, তখন সময় যেন থেমে গেল। সে শুনতে পাচ্ছিল নিজের হৃদস্পন্দন, গলার শুকনো শব্দ, আর পালকির ভেতর থেকে আসা এক অদ্ভুত নিঃশ্বাসের আওয়াজ। সে আর কিছু বুঝতে পারছিল না, শুধু দাঁড়িয়ে ছিল স্তব্ধ হয়ে। হঠাৎ লাল পর্দা এক ইঞ্চি সরে গেল, আর ভিতরে থেকে যেন দুটি আগুনের মতো চোখ তার দিকে তাকাল। সেই দৃষ্টি এক মুহূর্তে শিবুর শরীর অবশ করে দিল। সে কাঁপতে কাঁপতে পিছিয়ে গেল, কিন্তু পা যেন নড়ছে না। পালকিটা আবার ধীরে ধীরে এগোতে শুরু করল, ঘণ্টাধ্বনি ক্রমশ দূরে চলে গেল, আর মেঘের আড়াল থেকে আবার চাঁদের আলো নেমে এল। তখনই শিবু হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল, তার নিঃশ্বাস দম বন্ধ হয়ে আসছিল। বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের লড়াইয়ে সে হার মানল। আজ সে নিজ চোখে দেখে ফেলেছে সেই রহস্যময় অশরীরীর পালকি—যেটা শুধু গল্প নয়, ভৌতিক বাস্তব। শিবুর মনে হল, এ দৃশ্য তার জীবনকে চিরদিনের জন্য বদলে দেবে।
৫
শিবু সেই রাতের পর আর আগের মতো ছিল না। পালকির ভেতর যে এক ঝলক সে দেখেছিল, তা যেন তার চোখের পাতা জুড়ে গেঁথে গেছে। সোনালি শাড়ি পরা এক অচেনা বধূ, যার চোখে কোনো রঙ নেই, মুখে কোনো অভিব্যক্তি নেই—শুধু শূন্যতা। যেন এক মৃত মূর্তি তাকিয়ে আছে জীবিতের দিকে। সেই দৃষ্টি একবার মাত্র দেখেও শিবুর বুক কেঁপে উঠেছিল, আর তারপর থেকে সে নিজেকে আর সামলাতে পারছিল না। ভোর হতেই তাকে গ্রামের পথের ধারে অজ্ঞান অবস্থায় পাওয়া গেল। বন্ধুরা ভেবেছিল ক্লান্তি বা ভয় তাকে অচেতন করেছে, কিন্তু ঘরে ফিরিয়ে আনার পর থেকেই শিবুর শরীর ভেঙে পড়তে শুরু করল। তার চোখ কোটরের ভেতর ঢুকে গেল, মুখে রক্তের লাল আভা মিলিয়ে গিয়ে সাদা হয়ে উঠল। দিনের পর দিন তার জ্বর বেড়ে চলল, গা কাঁপতে লাগল। ডাক্তার আনলেও কোনো ফল হলো না, ঔষধে সামান্য উপশম হয়, কিন্তু কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই আবার অসুস্থ হয়ে পড়ে। গ্রামের বৃদ্ধেরা নিঃশব্দে মাথা নাড়তে লাগল, তারা জানত—অশরীরীর পালকি যার চোখে ধরা দেয়, সে আর বাঁচে না।
ধীরে ধীরে এই কাহিনি ছড়িয়ে পড়ল শান্তিপুরের প্রতিটি ঘরে। চায়ের দোকানে, পুকুরঘাটে, ক্ষেতের আল ধরে কাজ করতে করতে সবাই একই কথা বলতে লাগল—“শিবুর কপাল ফুটা, বাঁচানো যাবে না।” কারও কারও চোখে করুণা, কারও চোখে ভয়ের ছায়া। বাচ্চারা রাতে বিছানায় শুয়ে শুয়ে মাকে আঁকড়ে ধরে বলত, “মা, পালকি এলে কি আমরাও মারা যাব?” আর মায়েরা ঠোঁট কামড়ে চুপ করে যেত, কারণ তাদের নিজেরও উত্তর জানা ছিল না। একমাত্র রামলাল পুরোহিত এই কাহিনির গভীরতা অনুভব করলেন। তিনি বহু বছর আগে এই একই পালকির ছায়ায় এক ঘনিষ্ঠ মানুষকে হারিয়েছিলেন। তাই যখন শিবুর অসুস্থতার খবর পেলেন, তার ভেতরে ভয়ের শীতল স্রোত বয়ে গেল। লোকজনের সামনে তিনি বললেন—“এ সব কুসংস্কার, ডাক্তার দেখাও।” কিন্তু রাতের বেলায় নিজের ঘরে বসে তিনি কপালে চন্দন মেখে, মন্ত্রপাঠ শুরু করলেন। কারণ তিনি জানতেন—এ কোনো সাধারণ অসুখ নয়, এ এক অভিশাপ, যে একবার ছায়া ফেলে, তাকে মৃত্যুর পথে টেনে নিয়ে যায়।
শিবুর দিন কাটতে লাগল মৃত্যুর ছায়ায় মোড়া এক অদ্ভুত যন্ত্রণায়। রাতে ঘুমের ভেতর সে চিৎকার করে ওঠত, যেন কেউ তাকে ডাকছে। সে বলত, “ও বধূ আমাকে হাত বাড়িয়ে ডাকছে, তার চোখে আলো নেই, কিন্তু আমি তার কাছে টেনে যাচ্ছি।” তার মা-বাবা কেঁদে কেঁদে পুরোহিতকে অনুরোধ করল—“ওকে বাঁচান, আপনি কিছু করুন।” রামলালও চেষ্টা করলেন, শিবুর বিছানার পাশে প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখলেন, শাস্ত্র থেকে মন্ত্র পড়ে জল ছিটালেন। কিন্তু কিছুতেই কাজ হলো না। প্রতিটি দিনের শেষে শিবু আরও দুর্বল হয়ে পড়তে লাগল। গ্রামের লোকেরা দূর থেকে শিবুর বাড়ির দিকে তাকাত, কেউ আর ভেতরে আসতে সাহস করত না। সবাই ফিসফিস করে বলত—“ওর ওপর অশরীরীর ছায়া পড়েছে, ও আর বাঁচবে না।” আর শিবু, বিছানায় শুয়ে, চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকত অন্ধকারের দিকে, যেন মৃত্যুর ছায়া প্রতিদিন তাকে আরেকটু কাছে টেনে নিচ্ছে। এভাবেই শান্তিপুর গ্রাম শিবুর অবশ্যম্ভাবী পরিণতির জন্য অপেক্ষা করতে লাগল, আর রামলাল মনে মনে প্রস্তুত হচ্ছিলেন—অশরীরীর পালকির অভিশাপকে একদিন হয়তো তাকে সামনাসামনি মোকাবিলা করতেই হবে।
৬
রাত গভীর হয়ে এসেছে। ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক আর দূরের বাঁশবাগানের সোঁ সোঁ শব্দে চারপাশ ভরে উঠেছে। পারুল বৌদি উঠোনে প্রদীপ জ্বালিয়ে বসে ছিলেন, আর সামনে বসে ছিলেন রামলাল পুরোহিত। শিবুর অসুস্থতার পর থেকে গ্রামের মহিলারা প্রায়ই তাঁর কাছে ভিড় জমাত, কারণ সবার মনে ভয়—পালকি যে কারও ঘরে আসতে পারে। সেদিন পারুল বৌদি কান্নাজড়ানো গলায় বললেন, “পুরোহিতমশাই, সত্যি কি পালকি এত খারাপ? কেন সে নির্দোষ মানুষকে টেনে নেয়?” রামলাল কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন। তাঁর চোখ যেন অতীতের অন্ধকারে হারিয়ে গেল। তারপর ধীরে ধীরে তিনি বলতে শুরু করলেন সেই কাহিনি, যা শুধু কয়েকজন বয়স্ক মানুষই জানত। বহু বছর আগে শান্তিপুর গ্রামে এক জোতদারের মেয়ে ছিল—নাম মনোরমা। রূপে-গুণে সে ছিল অতুলনীয়, গ্রামের লোকেরা তাকে দেখেই বলত, “মনে হয় স্বয়ং দেবী নেমে এসেছে।” তার বিয়ের দিন ঠিক হয়েছিল কাছের গ্রামের এক প্রতাপশালী জমিদারের ছেলের সঙ্গে। বিয়ের দিন মধুমাখা আনন্দে গ্রাম ভরে গিয়েছিল, কিন্তু সেই সুখ বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি।
সেই রাতেই ঘটে যায় অদ্ভুত এক ঘটনা। মনোরমাকে সোনালি পালকিতে চড়ে শ্বশুরবাড়ির উদ্দেশে রওনা করানো হয়। চারপাশে ঢোল-করতালের শব্দ, আতশবাজির ঝলকানি, আর মানুষের ভিড়ে চারিদিক মাতোয়ারা হয়ে উঠেছিল। কিন্তু গ্রামের সীমানা ছাড়ানোর আগেই হঠাৎ এক ঝোড়ো হাওয়া বয়ে গেল, আর অদ্ভুতভাবে পালকিটা থেমে গেল মাঝরাস্তায়। বহনকারীরা আতঙ্কে চিৎকার করে উঠল—কারণ তারা অনুভব করেছিল, পালকি অস্বাভাবিকভাবে ভারী হয়ে গেছে। লোকজন ছুটে এলে দেখা গেল, মনোরমা নিস্তেজ হয়ে বসে আছে। তার গলায় সোনার মালা জ্বলজ্বল করছে, শরীরে বিয়ের সাজ অটুট, কিন্তু মুখের রঙ সাদা হয়ে গেছে, নিঃশ্বাস নেই। চিকিৎসক ডেকে আনা হলেও সবাই বলল, তার মৃত্যু কয়েক ঘণ্টা আগেই হয়ে গেছে। কেউ বুঝতে পারল না, কীভাবে বিয়ের আনন্দঘন মুহূর্তে হঠাৎ তার প্রাণ চলে গেল। তখন থেকেই মানুষ বলতে লাগল—মনোরমার অকালমৃত্যু কোনো সাধারণ ঘটনা নয়, কোনো অশুভ শক্তির ছায়া এসে তার জীবন কেড়ে নিয়েছে।
কিন্তু এখানেই শেষ হয়নি সেই কাহিনি। সেদিন থেকে শুরু হয় অভিশপ্ত পালকির ইতিহাস। মনোরমার মৃতদেহ সেই সোনালি পালকিতে শ্বশুরবাড়ির পথে নিয়ে যাওয়া হলেও, পথে একের পর এক অদ্ভুত দুর্ঘটনা ঘটতে থাকে। কারও গায়ে আগুন ধরে যায়, কারও কানে অজানা শব্দ বাজে, আর যারা পালকির ছায়ার কাছে আসে, তারা একে একে অস্বাভাবিকভাবে মারা যেতে থাকে। লোকেরা বিশ্বাস করতে শুরু করে, মনোরমার আত্মা মুক্তি পায়নি। তার হৃদয়ে যে বিয়ের স্বপ্ন ছিল, তা পূর্ণ হয়নি, তাই সে অভিশপ্ত হয়ে প্রতি রাতে সেই পালকিতেই ঘুরে বেড়ায়। এখনো যখন রাত গভীর হয়, সোনালি পালকি রাস্তা দিয়ে যায়, ঘণ্টাধ্বনি বাজে—তখন মানুষ ভাবে, মনোরমার নিঃশ্বাসই যেন ভেসে আসছে। রামলাল গম্ভীর গলায় বললেন, “এই হলো সত্যি, পারুল। সেই বধূর আত্মা শান্তি পায়নি, তাই সে অন্যদের টেনে নেয় নিজের অভিশপ্ত পথে।” পারুল বৌদি আতঙ্কে আঁতকে উঠলেন, আর প্রদীপের কাঁপা আলোতে রামলালের চোখে ভেসে উঠল এক অনিবার্য শঙ্কা—যদি মনোরমার অভিশাপ থামানোর কোনো উপায় না পাওয়া যায়, তবে শান্তিপুর গ্রামও হয়তো একদিন সম্পূর্ণ গ্রাস হয়ে যাবে।
৭
শিবুর অসুস্থতা যেন পুরো গ্রামকে গ্রাস করে নিল। প্রতিদিন শিবুর বাড়ি থেকে কান্নার শব্দ ভেসে আসত, আর সেই শব্দ শুনে গ্রামবাসীর বুক কেঁপে উঠত। সবাই জানত, ওর দিন গোনা শুরু হয়ে গেছে। কেউ কেউ সাহস করে ওর খবর নিতে গেলেও বেশিক্ষণ থাকতে পারত না; ঘরের ভেতরে যেন এক অদৃশ্য শীতলতা বিরাজ করত, যা মানুষকে ভয়ে আচ্ছন্ন করে দিত। ধীরে ধীরে লোকজন শিবুর বাড়ির দিকেই আর যেত না। প্রত্যেক সন্ধ্যায় সূর্য ডোবার আগে সবাই দ্রুত ঘরে ফিরে আসত, দরজা-জানালা শক্ত করে আটকে দিত। রাস্তাঘাট ফাঁকা হয়ে যেত, যেন গ্রাম এক মৃত নগরীতে পরিণত হয়েছে। মাটির ঘরের ভেতরে কুপি বা প্রদীপ জ্বালিয়ে মানুষ রাত কাটানোর চেষ্টা করত, কিন্তু বাইরে সামান্য শব্দ হলেই সবাই শিউরে উঠত। ঝড়ের রাতে বা হাওয়ার দমক লাগলেই মনে হতো পালকি চলে যাচ্ছে রাস্তায়, ঘণ্টার ধ্বনি কানে বাজছে।
শিশুদের ঘুম পাড়ানোর জন্য পারুল বৌদি প্রায়ই ভূতের কাহিনি শোনাতেন। তিনি বলতেন, “কোনোদিন জানলা দিয়ে বাইরে তাকাতে নেই, বাইরে অশরীরীর পালকি গেলে চোখে পড়তে পারে।” কিন্তু গল্প বলতে বলতেই তাঁর নিজের গলা কেঁপে উঠত, হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে যেত। শিশুরা মায়ের গলা আঁকড়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়ত, আর তাদের মনে দুঃস্বপ্ন ঘুরে বেড়াত। প্রতিটি পরিবার আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছিল—কে জানে পরের রাত কার ঘরে মৃত্যু এসে দাঁড়াবে! গ্রামে কাজকর্মে ভাটা পড়ল, মাঠে কৃষকেরা আর মন দিয়ে কাজ করতে পারছিল না, তাদের চোখ বারবার আকাশের দিকে যেত—কখন সূর্য ডুববে আর অন্ধকার নামবে। মেলা, গীত, গানের আসর সব থেমে গেল, লোকেরা নিজেদের ঘরে গুটিয়ে থাকাই নিরাপদ মনে করল।
এই ভয়ের আবহাওয়া গ্রামকে নতুন করে এক সত্য উপলব্ধি করাল—যা এতদিন তারা নিছক গল্প ভেবেছিল, তা আসলে এক ভয়ঙ্কর বাস্তব। কেউ আর কুসংস্কারের যুক্তি দাঁড় করাতে সাহস পেল না, কারণ শিবুর শরীরের প্রতিটি পরিবর্তনই ছিল পালকির অভিশাপের প্রমাণ। বৃদ্ধেরা একে অপরকে চুপিসারে বলত, “আমরা অভিশপ্ত, পালকি থেকে কেউ বাঁচাতে পারবে না।” মহিলারা প্রতিরাতে সন্তানদের মাথায় হাত বুলিয়ে মন্ত্র জপ করত, যেন অশরীরী ছায়া ঘরে না ঢোকে। আর রামলাল পুরোহিত, যিনি এতদিন গল্পটিকে শুধু কুসংস্কার বলে এড়িয়ে যেতেন, তিনিও বুঝলেন যে গ্রামবাসীর বিশ্বাস ভ্রান্ত নয়। শান্তিপুর যেন এক অজানা অশুভ শক্তির আঁকড়ে ধরা পড়েছে। এভাবে অন্ধকারে মোড়ানো গ্রাম রাতের পর রাত কাটাতে লাগল, প্রতিটি ভোর যেন নতুন করে আশীর্বাদের মতো মনে হতো—কারণ ভোর মানেই তারা আরেকটি রাতকে পেরিয়ে এসেছে জীবিত অবস্থায়।
৮
শিবুর দুর্বল দেহের প্রতিটি নিঃশ্বাস যেন গ্রামবাসীর বুকের ভেতর কাঁপন তুলছিল। কিন্তু তার বন্ধুরা—রঘু, কেশব আর মদন—চুপ করে বসে থাকতে পারছিল না। ছোটবেলা থেকে একসাথে খেলাধুলা করা, নদীতে সাঁতার কাটা, মেলায় ঘোরা—সব স্মৃতি তাদের বুক ভারী করে তুলছিল। তারা জানত, যদি সত্যিই সাত দিনের মধ্যে শিবুর মৃত্যু ঘটে, তবে তা শুধু এক বন্ধুকে হারানোর শোক নয়, বরং গ্রামকে অশুভ শক্তির সামনে আত্মসমর্পণ করিয়ে দেবে। এক ঝড়ো সন্ধ্যায়, তিন বন্ধু সাহস সঞ্চয় করে রামলাল পুরোহিতের দ্বারস্থ হলো। প্রদীপের ম্লান আলোয় পুরোহিতের ঘরে ঢুকতেই তাদের শরীর কেঁপে উঠল, কারণ বাইরে তখন ঝড়ের দমকে বাঁশবাগান থেকে অদ্ভুত শব্দ ভেসে আসছিল। রঘু কাঁপা গলায় বলল, “পুরোহিতমশাই, আমরা জানতে চাই—এই অভিশাপ কি সত্যিই ভাঙা যায় না?” কেশব আর মদন তার কথার সঙ্গে সায় দিয়ে মাথা নেড়ে দাঁড়াল।
রামলাল তাদের দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকালেন। তাঁর চোখে ভয়ের সঙ্গে সঙ্গে এক ধরনের অদ্ভুত দৃঢ়তাও ফুটে উঠল। তিনি ধীরে ধীরে বললেন, “যে আত্মা অসময়ে মারা যায়, তার তৃষ্ণা অমিট থেকে যায়। মনোরমা যে বধূর রূপে মারা গিয়েছিল, তার প্রাণের হাহাকার আজও মুক্তি পায়নি। তাই সে অশরীরী হয়ে প্রতিরাতে পালকিতে ঘোরে, আর যে কেউ তাকে দেখে ফেলে, সে তার শূন্যতার মধ্যে টেনে নেয়।” মদন হতভম্ব হয়ে জিজ্ঞাসা করল, “তাহলে উপায় কি নেই? আমরা কি কিছু করতে পারব না শিবুকে বাঁচাতে?” রামলাল নিঃশ্বাস ফেললেন, তারপর বললেন, “উপায় আছে, কিন্তু সহজ নয়। এই আত্মাকে মুক্তি দিতে হবে। মন্ত্রপাঠ, সাধনা আর সবচেয়ে বড় কথা—সত্য প্রকাশ। যে সত্য লুকানো আছে, তাকে আলোয় আনতে হবে। যতদিন না মনোরমার অকালমৃত্যুর প্রকৃত কারণ উন্মোচিত হয়, ততদিন সে শান্তি পাবে না।”
বন্ধুরা একে অপরের দিকে তাকাল। ভয়ের সঙ্গে সঙ্গে তাদের চোখে ফুটে উঠল সংকল্পের ছাপ। রঘু দৃঢ় গলায় বলল, “পুরোহিতমশাই, আমরা সবকিছু করব। শুধু বলুন কীভাবে শুরু করতে হবে।” রামলাল মাথা নেড়ে জানালেন, প্রথমেই তাদের খুঁজে বের করতে হবে সেই কাহিনির আসল সত্য—মনোরমা কীভাবে মারা গিয়েছিল, আর কেন সেই রাত থেকে পালকি অভিশপ্ত হয়ে উঠল। “সাধনা আর মন্ত্রপাঠ আমি করব,” তিনি বললেন, “কিন্তু তোমাদের কাজ হবে অতীতের দরজা খুলে দেখা। গ্রামের পুরোনো মানুষদের সঙ্গে কথা বলো, নথি খুঁজে বের করো। সত্যকে চাপা দিয়ে রাখা হয়েছে বহু বছর, তাকে তোমাদের আলোয় আনতে হবে।” তিন বন্ধু গম্ভীর মুখে সম্মতি জানাল। তাদের মনে হলো, ভয়কে জয় করার এটাই একমাত্র পথ। পালকির রহস্য ভাঙতে হলে তাদের অতীতের গোপন অন্ধকারের মুখোমুখি হতে হবে। আর সেই মুহূর্তেই শান্তিপুর গ্রামের ভাগ্যের চাকা নতুন করে ঘুরতে শুরু করল।
৯
শান্তিপুর গ্রামের সেই রাত যেন মৃত্যুর আগে নিস্তব্ধতার মতো নেমে এসেছিল। আকাশে চাঁদ মেঘের আড়ালে লুকিয়ে ছিল, চারপাশে শুধু অন্ধকারের রাজত্ব। তবু গ্রামের কয়েকজন যুবক—রঘু, কেশব, মদন আর আরও দু’জন—রামলালের সঙ্গে সাহস করে বেরিয়ে পড়েছিল। সবার হাতে প্রদীপ, কারও হাতে ত্রিশূল, আবার কেউ জপমালা আঁকড়ে ছিল। তারা গ্রামের মাঝের সেই পুরোনো কাঁচা রাস্তার ধারে এসে দাঁড়াল, যেখানে প্রায়ই পালকির দেখা মেলে। রামলাল মাটিতে কুশ ও গঙ্গাজল ছড়িয়ে এক ক্ষুদ্র বৃত্ত তৈরি করলেন, আর সবাইকে ভেতরে দাঁড়াতে বললেন। তিনি গম্ভীর গলায় মন্ত্রপাঠ শুরু করলেন—“ॐ শান্তি, ॐ মুক্তি…” সেই মন্ত্রের ধ্বনি নিস্তব্ধ রাতে অদ্ভুতভাবে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল। যুবকেরা ভয়ে কাঁপছিল, তবু বুকের ভেতরে একটা অদৃশ্য শক্তি জন্ম নিচ্ছিল। তারা জানত, আজকের রাতেই সিদ্ধান্ত হবে—পালকির অভিশাপ ভাঙা যাবে কি না। সময় যেন স্থির হয়ে ছিল, তারপর হঠাৎই বাতাসে অদ্ভুত শীতলতা ছড়িয়ে পড়ল।
মধ্যরাত পেরিয়ে গেলে সেই চেনা শব্দ ভেসে এলো—টং টং ঘণ্টাধ্বনি, ধীরে ধীরে কাছে আসছে। যুবকেরা দম বন্ধ করে তাকিয়ে রইল, দূর থেকে সোনালি আলো ঝিকমিক করতে লাগল। মুহূর্তের মধ্যেই তারা দেখতে পেল—সোনালি পালকি ভেসে আসছে শূন্যে, যেন কারও অদৃশ্য কাঁধে ভর করে চলেছে। রঘুর গলা শুকিয়ে গেল, কেশব কাঁপতে কাঁপতে মদনের হাত ধরল, তবু কেউ পালাল না। রামলাল মন্ত্রপাঠ চালিয়ে গেলেন, আর প্রদীপের শিখা হঠাৎ দুলে উঠল প্রবল বাতাসে। পালকি এসে থামল তাদের সামনে, আর লাল পর্দা ধীরে ধীরে সরতে লাগল। ভেতরে তখন তারা স্পষ্ট দেখতে পেল মনোরমার ছায়া। সোনালি শাড়ি, কপালে সিঁদুর, গলায় হার—সব আছে, কিন্তু মুখে এক অসহায় কান্নার ছাপ। তার চোখ যেন অশ্রুভেজা, ঠোঁটে যেন এক চিরন্তন আর্তি জমে আছে। সেই দৃষ্টি যুবকদের বুক বিদীর্ণ করে দিল। তারা বুঝল, এ কেবল ভয়ের আত্মা নয়—এ এক বন্দী আত্মা, যে মুক্তি চাইছে।
রামলাল তখন এগিয়ে গিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে ডাক দিলেন, “মনোরমা, তোমার কষ্ট আমরা জানি। তুমি যে অভিশপ্ত হয়ে এই গ্রামে ঘুরে বেড়াচ্ছ, তা তোমার ইচ্ছা নয়, তোমার বেদনার ফল। আজ আমরা সবাই মিলে তোমাকে মুক্তি দিতে চাই।” তিনি গঙ্গাজল ছিটাতে ছিটাতে মন্ত্র পড়তে লাগলেন, “ॐ মুক্তি, आत्मার শান্তি, পরিত্রাণ দাও।” মুহূর্তেই বাতাস ভারী হয়ে উঠল, পালকির ভেতর থেকে হাহাকার ভেসে এল, যেন শত শত বছরের চাপা কান্না একসাথে মুক্তি চাইছে। মনোরমার ছায়া হঠাৎ কেঁপে উঠল, তার চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল, ঠোঁটে মৃদু কাঁপন দেখা গেল। যুবকেরা প্রদীপ উঁচু করে দাঁড়াল, তারা দেখল সেই ছায়া ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে আসছে। সোনালি পালকির ঝিলমিল আলো নিভতে শুরু করল, আর ঘণ্টাধ্বনি মিলিয়ে গেল দূরে। রাতের আঁধারে এক অদ্ভুত নীরবতা নেমে এলো—এবার যেন সত্যিই শান্তি ফিরে এসেছে। রামলাল মাটিতে বসে প্রণাম করলেন, আর বললেন, “আজ মনোরমার আত্মা মুক্ত হলো।” গ্রামের যুবকেরা শ্বাস ছাড়ল, তাদের চোখে ভয়ের বদলে ভোরের আলো ফুটে উঠল। শান্তিপুরের সেই রাত এক নতুন ইতিহাস লিখল—ভয়ের নয়, মুক্তির ইতিহাস।
১০
রাতের সেই ভৌতিক মন্ত্রপাঠ আর পালকির সামনে দাঁড়িয়ে থাকা গ্রামবাসীরা ভেবেছিল, হয়তো সবকিছুর ইতি ঘটল। রামলালের ঠোঁট থেকে ছুটে আসা প্রতিটি মন্ত্রকণ্ঠ যেন আকাশে ঢেউ তুলেছিল, আর মনোরমার আত্মা ধীরে ধীরে পালকির ভেতর থেকে মিলিয়ে গেল। মুহূর্তে বাতাস থেমে গিয়ে আবার ঝড়ের মতো প্রবাহিত হল, যেন আকাশ-পৃথিবী কেঁপে উঠল সেই মুক্তির সন্ধিক্ষণে। সবাই বিস্ময়ে দেখল, সোনালি পালকিটি কাঁপতে কাঁপতে দাঁড়িয়ে আছে, তারপর হঠাৎ করেই অদৃশ্য হয়ে গেল। গ্রামের অন্ধকার রাতটাও যেন একটু আলো পেল, চারিদিকে শান্তির আবহ ছড়িয়ে গেল। শিবু, যে এতদিন মৃত্যুর ছায়ায় ভুগছিল, তার চোখে আবার প্রাণের আভা ফুটল, শরীরের দুর্বলতা কিছুটা সরে গেল। গ্রামবাসীরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল, কিন্তু কারও অন্তরে কোথাও যেন সন্দেহের কাঁটা বিঁধে রইল—এ কি সত্যিই মুক্তি, নাকি আরও গভীর কোনো অভিশাপের সূচনা?
পরদিন সকালের আলোয় শান্তিপুর গ্রাম আবার জমে উঠল। পাখিদের ডাক, মানুষের হাঁকডাক—সবকিছু যেন নতুন জীবনের বার্তা নিয়ে এল। কিন্তু সেই শান্তির মধ্যে লুকিয়ে ছিল এক অদ্ভুত শিহরণ। গ্রামের কয়েকজন ছেলে সকালে নদীর ধারে মাছ ধরতে গিয়ে বিস্মিত হয়ে দেখল, কাদামাটির মধ্যে অর্ধেক ডুবে আছে ভাঙা এক সোনালি পালকি। পালকির কাঠে ফাটল, কাপড়ে ছেঁড়া দাগ, আর অলঙ্কারে ম্লান আভা। খবর ছড়িয়ে পড়তে দেরি হল না—সকালের ভিড় জমে গেল নদীর ঘাটে। সবাই হতবাক, কারণ এতদিন যে পালকিকে তারা কেবল রাতের আঁধারে দেখত, সেটি এবার দিনের আলোয় ধরা দিয়েছে। মানুষের চোখে ভয় আর বিস্ময় একসাথে জমাট বাঁধল। কেউ কেউ বলল, “মনোরমার আত্মা মুক্তি পেলেও তার পালকি এখানে রয়ে গেছে। এর মানে অভিশাপের শেষ হয়নি।” আবার কেউ ফিসফিস করে বলল, “এ হয়তো আমাদের সতর্ক করার চিহ্ন। আত্মারা মাঝে মাঝে ফিরে আসে।”
সন্ধ্যার পর গ্রামে আবারও অস্বস্তির আবহ ছড়িয়ে পড়ল। কেউ আর নিশ্চিন্তে থাকতে পারল না। দরজার ফাঁক দিয়ে বাতাস ঢুকলে মনে হত পালকির ঘণ্টাধ্বনি বাজছে। নারীরা শিশুদের কোলে নিয়ে কেঁপে উঠত, পুরুষেরা আতঙ্কে নদীর ধারে যেতে সাহস করত না। শিবু সুস্থ হলেও তার মুখে স্থায়ী এক ছায়া পড়ে গেল—যেন মৃত্যুর সঙ্গে মুখোমুখি হবার স্মৃতি তাকে ছেড়ে যাচ্ছিল না। রামলাল পুরোহিত গ্রামের মন্দিরে প্রদীপ জ্বালিয়ে প্রার্থনা করলেন, কিন্তু তাঁর মনেও শঙ্কা ঘুরপাক খেতে লাগল। তিনি জানতেন, যে আত্মা একবার পৃথিবীতে অভিশাপ হয়ে ঘুরে বেড়ায়, তাকে সম্পূর্ণ মুক্তি দেওয়া এত সহজ নয়। ভাঙা পালকির আবির্ভাব যেন এক ইঙ্গিত—শান্তিপুরের রাতগুলোতে হয়তো আবারও সোনালি আলো জ্বলে উঠবে। গ্রামবাসীরা প্রশ্নের উত্তর পেল না—মনোরমার কাহিনি সত্যিই শেষ হলো, নাকি নতুন অধ্যায়ের সূচনা মাত্র? এই রহস্যই গ্রামকে ঘিরে রাখল, মুক্তি আর অভিশাপের সীমারেখায় টানটান করে দাঁড় করিয়ে দিল প্রতিটি প্রাণকে।
***