Bangla - ভূতের গল্প

জলকুমারীর ডাক

Spread the love

অন্ধকার নেমে এসেছে গ্রামের উপর, চারদিকে নিস্তব্ধতা আর ঝিঁঝিঁর ডাক ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। আকাশে তখন অর্ধচন্দ্র, তার আলোয় গাঢ় ছায়ার মতো ঘিরে আছে তালগাছ আর বাঁশঝাড়। গ্রামের মাঝখানে পুরোনো সেই পুকুর, যেটি নিয়ে নানা কাহিনি প্রচলিত থাকলেও এতদিন কেউ বিশেষ গুরুত্ব দেয়নি। কিন্তু সেদিন রাতে হঠাৎ করেই অদ্ভুত কিছু ঘটে। প্রথমে ভেবেছিল হয়তো চাঁদের প্রতিফলন, কিন্তু দেখা গেল পুকুরের তলদেশ থেকে অস্বাভাবিক নীল আলো উঠছে—ধীরে ধীরে জলের উপরিতলে ছড়িয়ে পড়ছে। আলো এতটাই অচেনা আর মায়াবী ছিল যে গ্রামের লোকেরা ভয়ে দূরে দাঁড়িয়ে নিঃশ্বাস বন্ধ করে তাকিয়ে রইল। বাতাস যেন হিম হয়ে গেল, পুকুরপাড়ের কুকুরগুলো হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল, আর দূরের গাছগুলো কেঁপে উঠল অদ্ভুত এক কম্পনে। কেউ কেউ মনে করল এ যেন কোনো দেবীর আবির্ভাব, আবার কেউ ফিসফিস করে বলল—এটা অশুভ সংকেত।

এরপর ঘটল সেই ঘটনাটি, যা আজও তাদের কাঁপিয়ে তোলে। নীল আলোর ভেতর থেকে এক মধুর অথচ শিরদাঁড়া শীতল করে দেওয়া নারী কণ্ঠ ভেসে এলো—“এসো…”। সেই ডাক যেন কারও অন্তরের গভীরে প্রবেশ করল, মনকে এক অদ্ভুত টানে টেনে নিলো। গ্রামের পুরুষ-মহিলা, এমনকি শিশুদেরও মনে হলো, কেউ যেন তাদের হাত ধরে ডেকে নিচ্ছে। কণ্ঠে ছিল এক অচেনা আকর্ষণ, আবার মৃত্যুর হিমশীতলতা। অনেকেই আতঙ্কে চোখ বন্ধ করে মাটিতে শুয়ে পড়ল, কেউবা মন্ত্র জপতে লাগল। কিন্তু কজন তরুণ দাঁড়িয়ে রইল স্থির হয়ে, যেন তারা কণ্ঠের মায়ায় ধীরে ধীরে পুকুরের দিকে টেনে নেওয়া হচ্ছে। বৃদ্ধারা কাঁদতে কাঁদতে চিৎকার করে উঠল, “ওইদিকে যাস না! এটা পাপিনী কন্যার আত্মা!”। আর পুকুরের জলে তখন ঢেউ উঠছিল না, অথচ আলো আরও তীব্র হয়ে উঠছিল, যেন কারও শূন্য চোখ জলের নিচ থেকে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে।

সেদিন রাতে আর কেউ সাহস করেনি পুকুরের কাছে যেতে। সবাই ভয়ে ঘরবন্দি হয়ে রইল, জানলার ফাঁক দিয়ে দূর থেকে আলো দেখল। রাত কেটে গেল ভয়ের ঘোরে, কেউ ঘুমোতে পারল না, আবার কেউ গ্রামের এক কোণে অগ্নিকুণ্ড জ্বেলে বসে রইল একসাথে। সকালের আলো ফোটার পর যখন সবাই পুকুরপাড়ে গেল, তখন জলের তলা স্বাভাবিক, কোনো আলো নেই, কোনো চিহ্ন নেই। তবে মাটিতে কিছু জায়গায় দেখা গেল ভেজা পায়ের ছাপ—যেন কেউ গভীর রাতের অন্ধকারে পুকুরের দিকে এগিয়েছিল। প্রশ্ন জাগল—সে কে? কোথায় গেল? গ্রামের মানুষ বুঝল, এই পুকুর আর শুধু একটা জলাশয় নয়—এখন তার ভেতরে লুকিয়ে আছে ভয়ঙ্কর এক রহস্য, আর সেই রহস্যের প্রথম ডাক তারা নিজের কানে শুনেছে। তাদের মনে গেঁথে রইল সেই মায়াবী কিন্তু ভয়ংকর শব্দ—“এসো…”।

ভোরের আলো ফোটার কিছুক্ষণ পরেই গ্রামের লোকেরা আবার পুকুরপাড়ে জড়ো হলো। আগের রাতের নীল আলো আর নারীকণ্ঠের ভয়ংকর স্মৃতি তখনও তাদের মনে তাজা, কেউ মুখ খুলে বলছিল না কিছু, কেবল কৌতূহল আর ভয়ের টানেই যেন সবাই পা টেনে টেনে এসেছিল। পুকুরের জল স্বাভাবিক ছিল, কোথাও আলো নেই, কোথাও কোনো ঢেউ নেই—কিন্তু হঠাৎই ভেসে উঠল এক নিথর দেহ। প্রথমে অনেকে বিশ্বাস করতে চাইলো না, ভেবেছিল হয়তো কোনো গাছের ডাল বা শুকনো কাঠ ভেসে এসেছে, কিন্তু কাছে গিয়ে দেখা গেল, সে এক তরুণ—বয়স আঠারো-উনিশের বেশি নয়। দেহ অক্ষত, কোথাও কোনো আঘাতের চিহ্ন নেই, চামড়ায় আঁচড় বা কাটা নেই, যেন সে শান্তভাবে ঘুমিয়ে আছে। কিন্তু যখন একজন সাহস করে তার মুখ ঘুরিয়ে দিল, তখন ভিড়ের মধ্যে চাপা চিৎকার ছড়িয়ে পড়ল। তার চোখ দুটো সম্পূর্ণ ফাঁকা, শূন্য গহ্বরের মতো, যেন কেউ সযত্নে তার প্রাণবিন্দু কেড়ে নিয়েছে। শরীর ছিল ঠান্ডা, ঠোঁট সামান্য ফাঁক করা, আর মুখে ছিল এক অদ্ভুত নিঃশব্দ যন্ত্রণার ছাপ।

গ্রামজুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল মুহূর্তেই। কেউ বলল—“এটা নিঃসন্দেহে দেবীর অভিশাপ, আমরা রাতের ডাক অগ্রাহ্য করেছি।” আবার কেউ বলল—“ওই ডাক যার কানে গিয়েছে, সে আর বাঁচবে না।” বয়স্করা মনে করল, বহু পুরনো শাপ এখনও এই পুকুরে বেঁচে আছে, আর সেই শাপ আবার সক্রিয় হয়ে উঠেছে। কিছু মহিলা কান্নায় ভেঙে পড়ল, কারণ তারা চিনে ফেলল, মৃতদেহটি পাশের গ্রামের মদন দাসের ছেলে। সে আগের রাতে ঘরে ফিরেছিল না, সবাই ভেবেছিল হয়তো বন্ধুদের সঙ্গে কোথাও গেছে। এখন তার নিথর দেহ পড়ে আছে পুকুরপাড়ে, আর চোখ দুটি শূন্য গহ্বরের মতো ফাঁকা। হরিদাস পণ্ডিত এসে মন্ত্রপাঠ শুরু করলেন, ধূপ-ধুনো জ্বালালেন, সবাইকে বললেন, “পুকুরের দেবী রুষ্ট, ওনাকে সন্তুষ্ট না করলে আরও প্রাণ যাবে।” তার গলা কেঁপে যাচ্ছিল, অথচ ভেতরে ভেতরে তিনিও ভয়ে ভেঙে পড়েছিলেন। অনেকেই মৃতদেহ স্পর্শ করতে চাইলো না, কেউ এগিয়ে এসে কাপড় দিয়ে ঢেকে দিল। নিস্তব্ধতার মধ্যে শুধু শোনা যাচ্ছিল মহিলাদের কান্না আর ভয়ে কাঁপা ফিসফিসানি।

যে পুকুর একসময় ছিল গ্রামের গর্ব, জলসেচ আর মাছ ধরার উৎস, সেটাই এখন মৃত্যুর আতঙ্কে পরিণত হলো। কেউ আর কাছে যেতে রাজি হলো না, সন্ধ্যা নামার আগেই সবাই ঘরে ঢুকে গেল। লোকেরা পুকুরকে এড়িয়ে চলতে লাগল, রাতে তার দিকের বাতাস থেকেও দূরে থাকতে চাইল। আর সবচেয়ে বেশি আতঙ্কে ছিল তরুণেরা, কারণ সবাই বলল—“জলকুমারীর ডাক তরুণদের জন্য, ও-ই তাদের টেনে নিয়ে যায়।” অমলা, বিধবা নারী, সবার সামনে এসে বলল, “আমি বলেছিলাম, এ ডাক মরণডাক, কেউ বিশ্বাস করল না। আজ দেখলে ফল।” তার চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল, কারণ তার নিজের স্বামীর মৃত্যু হয়েছিল ঠিক এভাবেই বহু বছর আগে। গ্রামবাসীরা তখন বুঝল, এই রহস্য শুধু কোনো কুসংস্কার নয়—এখানে কিছু আছে, যা তাদের বোঝার বাইরে। আর তাদের মনে গভীরভাবে গেঁথে রইল সেই ভয়ানক দৃশ্য—এক তরুণের নিথর দেহ, কিন্তু চোখ দুটো শূন্য, যেন আলো, স্বপ্ন, জীবন সবকিছুই কেড়ে নিয়েছে কোনো অদৃশ্য শক্তি।

রঞ্জন ছোট থেকেই গ্রামের লোকদের ভেতরে কুসংস্কার দেখে এসেছে—কখনো ডাইনির ভয়, কখনো শাপগ্রস্ত গাছের কথা, কখনো আবার মৃতদের আত্মা নিয়ে লোককথা। কিন্তু সে ছিল অন্য ধাঁচের মানুষ। গ্রামের মাঠে কাজ করতে করতে, ফসলের বেড়ে ওঠা দেখে, প্রকৃতির নিয়ম-কানুন খেয়াল করে সে সবসময় ভাবত—এ পৃথিবীতে সবকিছুরই কোনো না কোনো কারণ আছে, যা চোখে দেখা যায় না কিন্তু বোঝা যায়। সেই কারণেই যখন পুকুরে প্রথমবার নীল আলো দেখা গেল আর তার পরেই শূন্য চোখের তরুণের দেহ ভেসে উঠল, তখন রঞ্জন ভয় না পেয়ে প্রশ্ন করতে শুরু করল। সে মনে করল—হয়তো জলের নিচে কোনো বিশেষ ধরনের খনিজ আছে যা আলো ছড়াচ্ছে, কিংবা কোনো জীবজন্তুর জৈব-আলোক বিচ্ছুরণ। গ্রামের লোকেরা যখন গুজব রটাতে ব্যস্ত, সে একাই পুকুরপাড়ে দাঁড়িয়ে ভেবে যাচ্ছিল সম্ভাব্য ব্যাখ্যা। তবু, তার মনে গভীরের কোথাও একটা অজানা শীতলতা কাজ করছিল, যা সে স্বীকার করতে চাইছিল না।

রঞ্জনের যুক্তিবাদী মন তাকে বারবার টেনে নিয়ে যাচ্ছিল রহস্যের কেন্দ্রে। সে মৃত তরুণের নিথর দেহ দেখে বলেছিল—“দেহে কোনো আঘাত নেই, কোনো ডুবে মরার লক্ষণও নেই। শুধু চোখ নেই! এটা ভূতের কাজ নয়, এর পিছনে অন্য কিছু আছে।” তার কথা শুনে গ্রামের লোকেরা বিরক্ত হয়ে উঠেছিল। তারা বলেছিল, “তুই দেবীকে অস্বীকার করিস, তোর ওপরই সর্বনাশ নামবে।” এমনকি পণ্ডিত হরিদাসও সতর্ক করে দিয়েছিলেন, “কুসংস্কার বলে উড়িয়ে দিস না রঞ্জন, দেবী রুষ্ট হলে তুই-ই হবে পরের শিকার।” কিন্তু রঞ্জন এসব কানে তোলেনি। তার ভেতরে জেদ আর কৌতূহল মিশে গিয়ে তৈরি হয়েছিল এক অদ্ভুত টান। প্রতিদিন মাঠের কাজ সেরে সে ফিরে আসত পুকুরপাড়ে, বসে থাকত জলপাড়ে, লক্ষ্য করত কেমন করে বাতাস বয়, কেমন করে জল নড়ে ওঠে। রাতে যখন সবাই ভয়ে ঘরবন্দি হয়ে যায়, তখনও তার ইচ্ছে করত একবার পুকুরের দিকে যেতে—নিজের চোখে দেখতে, সেই আলো আসলে কোথা থেকে আসে।

তবে রঞ্জনের যুক্তিবাদী মন যতই জোর করুক, তার ভিতরের মানুষটিকে অস্বীকার করা যাচ্ছিল না। মাঝে মাঝে সে রাতের নিস্তব্ধতায় যেন কানে ক্ষীণ স্বরে শুনতে পেত—“এসো…”। সেই ডাক ভেসে আসত কোথা থেকে যেন, একেবারে মনের ভেতরে গেঁথে যেত। তখন তার শরীর কেঁপে উঠত, অথচ মন চিৎকার করে বলত—না, এটা বিভ্রম, এ কেবল ভয়ের প্রভাব। কিন্তু যতই সে অস্বীকার করত, ততই কৌতূহল বাড়ত, আর মনে প্রশ্ন জাগত—যদি সত্যিই কোনো অদৃশ্য শক্তি থাকে, তবে সেটা কী? দেবীর অভিশাপ নয় যদি, তবে কি এর পেছনে লুকিয়ে আছে মানুষের অজানা কোনো রহস্য, কোনো ইতিহাস? ঠিক সেই দ্বন্দ্বেই দিন কাটতে লাগল রঞ্জনের—একদিকে ভয় আর কণ্ঠের অদ্ভুত টান, অন্যদিকে যুক্তির আলো। আর সে জানত, একদিন না একদিন তাকে অবশ্যই নামতে হবে এই রহস্যের গভীরে।

অমলার জীবনের কাহিনি যেন গ্রামে এক অলিখিত সতর্কবার্তা হয়ে ছড়িয়ে ছিল। বছর দশেক আগে, ঠিক এই পুকুরেই তার স্বামী গোপাল অদ্ভুতভাবে মারা গিয়েছিল। সেদিনও নাকি রাত গভীরে পুকুরের জলে দেখা গিয়েছিল সেই অস্বাভাবিক নীল আলো, আর ভেসে এসেছিল এক নারীর কণ্ঠস্বর। গ্রামের অনেকেই তখন ঘটনাটাকে নিছক কাকতালীয় ভেবে উড়িয়ে দিয়েছিল, কেউ কেউ বলেছিল গোপাল নিজেই অসতর্ক হয়ে পুকুরে নেমে ডুবে গেছে। কিন্তু অমলা নিজের চোখে দেখেছিল সেই আলোর ঝলকানি আর শুনেছিল সেই কণ্ঠের ডাক। তার স্বামীকে আর বাঁচানো যায়নি, সকালে মিলেছিল নিথর দেহ, কিন্তু চোখদুটো ছিল শূন্য, একেবারে আজকের ঘটনার মতো। সেই থেকেই অমলার জীবনে নেমে এসেছিল অন্ধকার—যৌবন বয়সে স্বামীর মৃত্যু, সমাজের তিরস্কার, আর একাকী জীবনযাপন। লোকেরা তাকে অপয়া বলে দূরে সরিয়ে দিয়েছিল, উৎসব-অনুষ্ঠান থেকে বঞ্চিত করেছিল, যেন তার ছোঁয়া পেলেই সর্বনাশ নেমে আসে। তবু অমলার চোখে লেগে ছিল সত্যিকারের আতঙ্ক, এক অভিজ্ঞতার ভর, যা অন্য কেউ বোঝে না।

এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখে অমলার ভিতরের ভয় যেন আবার নতুন করে জেগে উঠল। পুকুরপাড়ে শূন্য চোখের তরুণের নিথর দেহ দেখে সে কেঁপে উঠল, তার বুক ভেঙে কান্না বেরিয়ে এলো। সে চিৎকার করে বলল, “আমি বলেছিলাম, এই ডাক মৃত্যুর ডাক, কিন্তু কেউ বিশ্বাস করেনি। তোমরা সবাই আমাকে অপয়া বলেছ, কিন্তু আজ দেখলে—যে ভয় আমি বছরের পর বছর বয়ে বেড়াচ্ছি, সেই ভয় আবার ফিরেছে।” গ্রামের লোকেরা তার দিকে অস্বস্তিকর দৃষ্টিতে তাকাল। কেউ বিশ্বাস করতে চাইলো না যে ঘটনাটা তার বলা মতো সত্যি হতে পারে, আবার কেউ মনে মনে ভয়ে শিউরে উঠল—যদি সত্যিই এই পুকুরে কোনো অশুভ শক্তি বাস করে? অমলার কান্না ছিল না শুধু শোকের, ছিল অসহায়ের, সমাজচ্যুত এক নারীর আকুতি। সে জানত, যতবার এভাবে নীল আলো ফুটে উঠবে, ততবার নতুন করে কেউ না কেউ প্রাণ হারাবে। অথচ মানুষ তাকে দূরে ঠেলে দিয়ে নিজেদের কুসংস্কারে শান্তি খুঁজতে চাইবে।

অমলার শোক শুধু ব্যক্তিগত ক্ষতির নয়, তা যেন সমগ্র গ্রামকে ঘিরে থাকা এক অদৃশ্য মৃত্যুর ছায়ার সঙ্গে মিশে গিয়েছিল। সে একা রাত কাটাত নিজের কুঁড়েঘরে, কিন্তু প্রতিটি রাতে সেই ডাক তার কানে ভেসে আসত—কখনো স্পষ্ট, কখনো অস্পষ্ট। সমাজ তাকে অপয়া মনে করলেও সে জানত, তার চোখে দেখা আতঙ্ক, তার কানে শোনা সেই ভয়ংকর কণ্ঠই আসল সত্য। আর যখন রঞ্জন তাকে প্রশ্ন করল—“এ আলো, এ কণ্ঠ সত্যিই কি তোমার স্বামীর মৃত্যুর রাতে ছিল?”—তখন অমলা চোখ মেলে তাকাল, আর তার শূন্য দৃষ্টি যেন সবকিছু বলে দিল। সে ফিসফিস করে উত্তর দিল, “হ্যাঁ, আমি শুনেছি… আমি দেখেছি… আর আজও সেই ডাক আমার বুকের ভেতর কাঁপিয়ে দেয়।” গ্রামবাসীরা তাকে যতই অগ্রাহ্য করুক, তার শোকের ভেতর লুকিয়ে ছিল সেই ভয়ানক ইঙ্গিত, যা প্রমাণ করছিল—এ রহস্য বহু পুরনো, আর তার ছায়া থেকে কেউ পালাতে পারবে না।

সন্ধ্যা নামতেই গ্রামের চৌহদ্দি জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল এক অদ্ভুত টানটান পরিবেশ। হরিদাস পণ্ডিত, গ্রামের সবচেয়ে পুরনো পুরোহিত, যিনি আজন্মকাল ধরে নানা পূজা-পার্বণ, যজ্ঞ আর শাস্ত্রপাঠের মাধ্যমে গ্রামবাসীর ভরসার প্রতীক হয়ে থেকেছেন, তিনিই এবার পুকুরপাড়ে যজ্ঞ আয়োজনের উদ্যোগ নিলেন। তাঁর বিশ্বাস—এ কোনো সাধারণ ঘটনা নয়, বরং রুষ্ট জলের দেবীর অভিশাপ। গ্রামবাসীরা ভয়ে এবং অন্ধবিশ্বাসে ইতিমধ্যেই মাথা নত করেছিল। তারা মনে করেছিল, পুকুর থেকে ভেসে ওঠা অক্ষত দেহ আর সেই ফাঁকা চোখ মানেই দেবীর ক্রোধ। তাই হরিদাস পণ্ডিত যখন ঘোষণা করলেন যে আজ রাতে যজ্ঞের মাধ্যমে দেবীর শান্তি প্রার্থনা করতে হবে, তখন গ্রামের পুরুষ-মহিলা, বুড়ো-বুড়ি, এমনকি ছোট্ট শিশুরাও ধীরে ধীরে জড়ো হয়ে এল পুকুরপাড়ে। দূর থেকে দেখা যাচ্ছিল, ধূপ-ধুনোর ধোঁয়া সাপের মতো পাক খেয়ে আকাশের অন্ধকারে মিলিয়ে যাচ্ছে, আর তার ফাঁকে ফাঁকে বাজছে শঙ্খের গম্ভীর ধ্বনি। মাটিতে রঙিন আলপনা আঁকা হয়েছিল, তার ওপর সাজানো ছিল অর্পিত নৈবেদ্য—নারকেল, ফল, ফুল আর ঘি। আগুন জ্বলে উঠতেই তার আলোয় দেখা গেল হরিদাস পণ্ডিতের চোখে ভয়ের ঝিলিক, যদিও তিনি বাহ্যিকভাবে শান্ত ও দৃঢ় ভঙ্গিতে মন্ত্রোচ্চারণ করতে শুরু করলেন। সবাই নিঃশ্বাস ফেলে সেই দৃশ্য দেখছিল, যেন এই পূজা তাদের সমস্ত অশান্তি মুছে ফেলবে।

যজ্ঞ যখন পূর্ণ গতিতে চলছিল, তখন বাতাসে এক অদ্ভুত গন্ধ ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল—না ছিল সেটা ধূপের, না অগ্নির, বরং এক ধরনের শীতল, ভিজে গন্ধ, যেন পুকুরের গভীর থেকে কাদা আর পচা শেওলার মিশ্রণে উঠে আসছে। গ্রামবাসীরা ধীরে ধীরে অস্থির হয়ে উঠল। কেউ কেউ চোখ বড় বড় করে একে অপরের দিকে তাকাল, কেউ ফিসফিস করে বলল—“এ কি দেবীর উপস্থিতির সংকেত?” কিন্তু তার আগেই ঘটল অপ্রত্যাশিত এক ঘটনা। যজ্ঞকুণ্ডের জ্বলন্ত অগ্নিশিখার মাঝখান থেকে হঠাৎ এক বিকট শব্দে শিখা হেলে পড়ল, যেন কোনো অদৃশ্য শক্তি তাকে নিভিয়ে দিতে চাইছে। হরিদাস পণ্ডিত কণ্ঠ জোরে মন্ত্রপাঠ শুরু করলেন, তাঁর কণ্ঠ কাঁপছিল, তবু শ্লোক থামলেন না। গ্রামের মহিলারা একসঙ্গে কেঁদে উঠল, শিশুরা মায়ের আঁচলে মুখ লুকিয়ে ফেলল। এমন সময় দূরের পুকুর থেকে ভেসে এলো সেই পরিচিত ডাক—মৃদু, গলা ভাঙা, অথচ শীতল এক স্বর, যেন মৃত কেউ জলের গভীর থেকে আহ্বান জানাচ্ছে। ডাকটা এত অমানবিক, এত অচেনা যে কারও শরীরের লোম খাড়া হয়ে উঠল। বাতাসে যেন এক শীতল শ্বাস ছড়িয়ে পড়ল, আগুনের চারপাশের ধূপকাঠি হঠাৎ একসঙ্গে নিভে গেল, আর কুয়াশার মতো কিছু একটা ধীরে ধীরে চারপাশ ঘিরে ফেলল।

এবার হরিদাস পণ্ডিতের গলাতেও ভয়ের কম্পন স্পষ্ট হয়ে উঠল। তাঁর কপালে ঘাম জমে গিয়েছিল, তবু তিনি একাগ্রচিত্তে মন্ত্র পাঠ চালিয়ে গেলেন। কিন্তু প্রতিটি মন্ত্র উচ্চারণের সাথে সাথে পুকুরপাড়ের নিস্তব্ধতা যেন আরও ঘন হতে লাগল, যেন বাতাস নিজেই শ্বাস বন্ধ করে আছে। হঠাৎ করে পুকুরের জলে এক অদ্ভুত আলো জ্বলে উঠল—নীলচে, ভয়ানক এক দীপ্তি, যা পানির উপর ভেসে ভেসে উঠছিল এবং জলের ঢেউয়ের সঙ্গে যেন তাল মিলিয়ে নাচছিল। আলোটা যেন জীবন্ত, পুকুরপাড়ে উপস্থিত প্রত্যেকের দিকে তাকিয়ে আছে, তাদের ভেতর থেকে ভয়ে জমাট বাঁধা চিৎকার বের করতে চাইছে। সবাই হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইল, কেবল হরিদাস পণ্ডিত কাঁপা কণ্ঠে বলে উঠলেন—“ওই যে… ওই তো দেবী ক্রুদ্ধ হয়েছেন।” কিন্তু তাঁর কথার মাঝেই আবার সেই ডাক ভেসে এল—এবার আরও কাছে, আরও তীব্র, যেন সরাসরি কানে কেউ ফিসফিস করছে। হঠাৎ ঠাণ্ডা বাতাসের ঝাপটা এসে যজ্ঞের আগুন সম্পূর্ণ নিভিয়ে দিল। গ্রামবাসীরা চিৎকার করে ছুটতে শুরু করল, আর চারপাশে ছড়িয়ে পড়ল এক শীতল ভয়ের স্রোত, যেন অদৃশ্য হাত তাদের বুক চেপে ধরছে। হরিদাস পণ্ডিত স্থির দাঁড়িয়ে রইলেন, কিন্তু তাঁর চোখে দেখা গেল অসহায় আতঙ্ক—যেন তিনিও বুঝতে পেরেছেন, এই পূজা হয়তো দেবীর শান্তি আনতে পারল না, বরং আরও গভীর অন্ধকারকে জাগিয়ে তুলল।

রাত্রি নেমেছিল অদ্ভুতভাবে ভারী হয়ে। গ্রামজুড়ে তখন সবাই যজ্ঞের ব্যর্থতার শীতল স্মৃতি নিয়ে ভয়ে আচ্ছন্ন। পুকুরপাড়ে যাবার কথা কেউ মুখেও উচ্চারণ করছিল না, অথচ রঞ্জনের ছোট ভাই নিখিল—যে ছিল চঞ্চল, কৌতূহলী আর খানিকটা বেপরোয়া—হঠাৎ সেদিকেই হাঁটতে বেরিয়ে গেল। তার বয়স খুব বেশি নয়, মাত্র ষোলো বছর, মাথায় সবসময় খেলা করত নানা প্রশ্ন। কেন পুকুরে আলো জ্বলে ওঠে, কেন বারবার ফাঁকা চোখের লাশ ভেসে ওঠে, আর কেন মানুষ ভয় পেয়ে দেবীর নাম নেয়? হয়তো এসব ভাবতেই সেদিন গভীর রাতে সে চুপিসারে উঠোন থেকে বেরিয়ে এল। চারপাশ তখন অন্ধকারে ঢাকা, দূরে কেবল ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শোনা যাচ্ছিল। পুকুরের দিকে এগোতেই হঠাৎ থমকে দাঁড়াল সে—মৃদু এক স্বর যেন ভেসে আসছে জলের দিক থেকে। সে শোনে, কেউ ডাকছে—“এসো…”। ডাকটা যেন মিষ্টি, অথচ ভৌতিক, যেন মৃত কোনো আত্মার কণ্ঠ তাকে টেনে নিচ্ছে। নিখিল এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেলেও কৌতূহল তাকে আটকাতে পারল না। সে ধীরে ধীরে পুকুরের ধারে গিয়ে দাঁড়াল, দেখল জলের উপর আবার সেই নীল আলো ভাসছে, যেন তার জন্য অপেক্ষা করছে। তার চোখ ধাঁধিয়ে গেল, শরীর শিহরে উঠল, অথচ এক অদৃশ্য শক্তি যেন তাকে ঠেলে দিচ্ছিল আরও কাছে যাওয়ার জন্য।

সেই রাতের পরে নিখিল আর বাড়ি ফিরল না। ভোর হতেই গ্রামজুড়ে কান্না আর চিৎকার ছড়িয়ে পড়ল। গ্রামের লোকজন ছুটে এসে দেখল, পুকুরের জলে নিখিলের নিথর দেহ ভেসে উঠেছে। শরীর অক্ষত, কোথাও কোনো আঘাত নেই, কিন্তু চোখ দুটো সম্পূর্ণ ফাঁকা, যেন ভিতরের সমস্ত প্রাণশক্তি কেউ টেনে নিয়েছে। গ্রামবাসীরা আতঙ্কে হতবাক হয়ে গেল। কেউ কেউ বলতে লাগল—“দেবীর ক্রোধ এবার কিশোরদের ওপর পড়ল।” কারও কারও ধারণা, যজ্ঞ ব্যর্থ হয়েছিল, তাই দেবী আরও ক্ষিপ্ত হয়েছেন। নিখিলের দেহ পুকুরের ধারে তুলতেই বাতাস যেন হঠাৎ ভারী হয়ে উঠল, কুকুরেরা একসঙ্গে হাউমাউ করে ডাকতে শুরু করল, আর মানুষের বুকের ভেতর এক অদ্ভুত শূন্যতা জমে গেল। হরিদাস পণ্ডিত মুখ গম্ভীর করে বললেন—“এবার আর দেরি করলে চলবে না, দেবীকে সন্তুষ্ট করতেই হবে।” কিন্তু রঞ্জন তখন সব শোনার মতো অবস্থায় ছিল না। সে দৌড়ে গিয়ে ভাইয়ের নিথর দেহ জড়িয়ে ধরল, বুক ভিজিয়ে দিল কান্নায়। সে চিৎকার করে উঠল—“এটা দেবীর অভিশাপ নয়, এটা কোনো রহস্য, কোনো অমানবিক শক্তি আমাদের সঙ্গে খেলা করছে।” কিন্তু তার কণ্ঠে বিশ্বাসের চেয়ে বেশি ছিল যন্ত্রণা, ছিল শোকের বোবা আর্তনাদ।

রঞ্জনের ভেতরটা যেন ভেঙে গেল। যে ভাইয়ের সঙ্গে সে মাঠে কাজ করত, যে ভাই তাকে অনুসরণ করে প্রতিটি কাজে ছায়ার মতো ঘুরে বেড়াত, হঠাৎ সে নেই—কেবল ফাঁকা চোখের এক লাশ। গ্রামবাসী তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করল, কিন্তু কেউই তার যন্ত্রণার গভীরতা বুঝতে পারল না। রঞ্জন বারবার ভাবতে লাগল, যদি সে আগেভাগে নিখিলকে বোঝাত, যদি রাতে তাকে চোখে চোখে রাখত, হয়তো এই ভয়ঙ্কর পরিণতি হতো না। সেই শোকে তার ভিতরের সাহস যেন আরও প্রবল হয়ে উঠল। সে প্রতিজ্ঞা করল, যেভাবেই হোক, সে এই রহস্যের মূলে পৌঁছবে। দেবীর নাম করে অন্ধবিশ্বাসে ঢেকে রাখা এই ভয়ের আবরণ সে আর মানতে পারল না। নিখিলের মৃত্যু তার কাছে হয়ে উঠল শেষ সতর্কবার্তা—এখন যদি সত্য উদ্ঘাটন না করে, তবে আরও প্রাণ যাবে, আরও চোখ চিরকালের জন্য শূন্য হয়ে যাবে। সেই শোকে, সেই রাগে, রঞ্জনের চোখে এক নতুন জেদ জন্ম নিল, আর গ্রামের লোকেরা যখন আবার দেবীর পূজার আয়োজনের কথা বলছিল, তখন রঞ্জন একলা দাঁড়িয়ে মনে মনে শপথ করল—সে ভাইয়ের মৃত্যুর প্রতিশোধ নেবে সত্য উন্মোচনের মাধ্যমে, ভয় বা অভিশাপের গল্পে নয়।

রাত্রির অন্ধকারে গ্রাম নিস্তব্ধ হয়ে ছিল, কেবলমাত্র দূরের বাঁশঝাড়ে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক মাঝে মাঝে ভেসে আসছিল। চারদিকের এই স্তব্ধতার মাঝেই রঞ্জন বসেছিল বাড়ির উঠোনে, ভাই অমলের মৃত্যুর শোক এখনো তার বুকের ভেতর জ্বলন্ত আগুনের মতো জ্বলে চলেছে। অমল ছিল তার প্রাণের থেকেও প্রিয়, একসাথে শৈশব কাটানো, খেলার মাঠে ছুটোছুটি, পুকুরে সাঁতার কাটা—সবকিছু যেন এখন হঠাৎ ভেঙে পড়া স্বপ্নের মতো ফিকে হয়ে গেছে। অমলের নিথর দেহকে যখন পুকুর থেকে তুলে আনা হয়েছিল, চারপাশের মানুষজন কাঁদছিল, কেউ কেউ আবার ফিসফিস করে বলছিল—“এ তো জলকুমারীর কাজ, আর কাকে নেবে কে জানে!” সেই মুহূর্তে রঞ্জনের ভেতরকার মানুষটা যেন দু’ভাগে ভাগ হয়ে গেল—একটা অংশ শোকে পাথর হয়ে রইল, আরেকটা অংশ জেদে আগুন হয়ে উঠল। সে তখনই বুঝে নিল, ভয়ের কাছে মাথা নত করে বসে থাকা তার কাজ নয়, ভাইয়ের মৃত্যুর প্রতিশোধ না হয়ও, অন্তত সত্যটা বের করে আনা তার দায়িত্ব। মানুষের মুখে শোনা গল্পের আড়ালে যে অদৃশ্য অন্ধকার লুকিয়ে আছে, তাকে সামনে না আনলে তার মনের শান্তি আসবে না।

পরদিন সকালেই রঞ্জন গ্রামের মন্দিরে গিয়ে শপথ নিল। সে পুরোহিতের সামনে মাথা নত করে বলল—“আমি রঞ্জন, অমলের ভাই, আজ দেবতার সামনে প্রতিজ্ঞা করছি, জলকুমারীর রহস্য আমি উদঘাটন করব। ভয় যত বড়ই হোক, মিথ যত গভীরই হোক, আমি থামব না।” মন্দিরের ঘন্টাধ্বনি তখন বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছিল, আর সেই ধ্বনি যেন তার মনের দৃঢ় সংকল্পকে আরও পোক্ত করে তুলছিল। গ্রামের মানুষরা কেউ তাকে সাহস দিচ্ছিল, কেউ আবার শঙ্কিত চোখে তাকাচ্ছিল, কারণ তারা জানত এই পথে পা দেওয়া মানেই মৃত্যু ডেকে আনা। কিন্তু রঞ্জন তখন ভয়ের সীমা অতিক্রম করেছে, তার ভেতরে এক অনমনীয় শক্তি জন্ম নিয়েছে। সে খাওয়া-দাওয়া কমিয়ে দিল, প্রতিদিন সন্ধ্যার পর পুকুরের ধারে গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকত, যেন সেই রহস্যময় সত্তাটির ছায়া দেখতে পায়। মাঝে মাঝে তার মনে হতো অমলের শেষ মুহূর্তের ডাক সে শুনতে পাচ্ছে, কেউ যেন তাকে পানির গভীরে ডেকে নিয়ে যাচ্ছিল। এসব ভাবনা তার ঘুম কেড়ে নিচ্ছিল, কিন্তু ভয় নয়, বরং অদ্ভুত এক শক্তি তাকে এই পথে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল।

দিন গড়াতে থাকল, শোক ধীরে ধীরে রঞ্জনের ভেতরে শক্তিতে রূপ নিল। এখন তার চোখের সামনে ভেসে উঠত না শুধু অমলের মৃত্যুর ছবি, বরং গ্রামের সেই সব নাম-না-জানা মৃতদের মুখ, যারা বছরের পর বছর ধরে জলকুমারীর টানে প্রাণ হারিয়েছে। রঞ্জন বুঝল, এটি শুধু তার ব্যক্তিগত লড়াই নয়, বরং পুরো গ্রামের মুক্তির প্রশ্ন। যদি সে সত্যটা বের করতে পারে, তবে আর কেউ অমলের মতো প্রাণ হারাবে না। সেই ভাবনা তার সংকল্পকে আগুনের মতো প্রজ্বলিত করল। অন্ধকার রাতে, চাঁদের আলোয় যখন পুকুরের জলে অদ্ভুত নীলাভ আভা খেলা করত, তখন রঞ্জন বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত, যেন জলকুমারীকে বলছে—“এসো, এবার আমি প্রস্তুত।” তার ভেতরের ভয় পুরোপুরি রূপান্তরিত হলো ক্রোধে আর শপথে। ভাইয়ের মৃত্যু তাকে ভেঙে দেয়নি, বরং তাকে বানিয়েছে যোদ্ধা। গ্রামের লোকেরা হয়তো এখনও বিশ্বাস করে জলকুমারীর কাছে হার মানা ছাড়া উপায় নেই, কিন্তু রঞ্জন বিশ্বাস করে প্রতিটি রহস্যেরই উন্মোচন আছে। তাই সে ঘোষণা করল নিজের ভেতরকার দৃঢ়তায়—“যতক্ষণ না আমি সত্যটা জানতে পারছি, আমি হার মানব না।” আর সেই শপথের মুহূর্তে, চারদিকের নিস্তব্ধতা যেন কেঁপে উঠল, আকাশের কালো মেঘের ফাঁক দিয়ে একরাশ চাঁদের আলো এসে তার মুখে পড়ল, যেন অজানা শক্তি তাকে আশীর্বাদ দিচ্ছে আগামীর ভয়ঙ্কর লড়াইয়ের জন্য।

অমলার মুখে বহুদিনের জমে থাকা এক রহস্যের কাহিনি ধীরে ধীরে ভেসে উঠল, যেন সেই গল্পের প্রতিটি শব্দে মিশে ছিল শতাব্দীর গোপন যন্ত্রণা। সে বলল, এই পুকুর কোনো সাধারণ জলাশয় নয়। অনেক আগে, তখনও গ্রামের এত ঘরবাড়ি হয়নি, মাঠ আর বনজঙ্গল ঘিরে এখানে ছোট্ট এক সম্প্রদায় বাস করত। সেই সময় এই গ্রামে বাস করত এক অদ্ভুত সুন্দরী কন্যা—নাম তার পদ্মাবতী। তার রূপের জাদুতে গ্রাম যেমন মুগ্ধ হয়েছিল, তেমনি তার সরল মনের নিষ্পাপতায় সবাই তাকে আশীর্বাদ দিত। কিন্তু সেই সৌন্দর্য একদিন কাল হয়ে দাঁড়াল। গ্রামের বাইরের এক ধনী জমিদারের ছেলে তার প্রতি নজর দিল। সে প্রতিশ্রুতি দিল ভালোবাসার, বিয়ের, একসাথে সুখী জীবনের স্বপ্ন। পদ্মাবতী বিশ্বাস করেছিল, কিন্তু প্রতারণাই তার প্রাপ্য হল। বিয়ের দিন ঘনিয়ে আসতেই সেই যুবক পিছিয়ে গেল, আর গোপনে অন্যত্র বিয়ে করল। পদ্মাবতীর মনে তখন শুধুই অপমান, ক্ষোভ আর অগাধ যন্ত্রণা। সেদিন রাতে গ্রামের মানুষ নাকি দেখেছিল—পদ্মাবতী সবার অগোচরে চলে গিয়েছিল এই পুকুরের ধারে, আর তার পরদিন ভোরে মিলেছিল তার দেহ, ভেসে ছিল নীল জলের উপরে। অনেকেই বলেছিল, সে নিজে ডুবে প্রাণ দিয়েছে, আবার কেউ বলেছিল, প্রতারণার শোকে পাগল হয়ে জলে ঝাঁপ দিয়েছিল। কিন্তু অমলার কণ্ঠে গল্পটা এখানেই শেষ হয়নি।

সে ফিসফিস করে বলল, পদ্মাবতীর আত্মা কখনও মুক্তি পায়নি। তার বুকভরা প্রতারণার যন্ত্রণা আর অপূর্ণ আকাঙ্ক্ষা তাকে বেঁধে রেখেছে এই পুকুরে। গ্রামজুড়ে তখন থেকেই গুজব ছড়ায়—প্রতি পূর্ণিমার রাতে বা বিশেষ অন্ধকারে পদ্মাবতীর আত্মা নীল আলো হয়ে ভেসে ওঠে পুকুরের জলে। তার কণ্ঠ ভেসে আসে, “এসো…”, যেন সে কাউকে টেনে নিয়ে যেতে চায় নিজের শূন্যতার অন্ধকারে। যাদের টানে নিয়ে যায়, তাদের শরীর পাওয়া যায় বটে, কিন্তু চোখ থাকে ফাঁকা, কারণ পদ্মাবতীর আত্মা নাকি তাদের আত্মাকে ছিনিয়ে নেয়। এভাবে সে ধীরে ধীরে প্রতিশোধ নিচ্ছে, যেন মানুষকে শাস্তি দিচ্ছে পুরুষের বিশ্বাসঘাতকতার জন্য। অমলার স্বামী গোপালও নাকি এক রাতে সেই কণ্ঠ শুনে টেনেছিল পুকুরের দিকে। অমলা কাঁদতে কাঁদতে বলল, “আমি সেই ডাক শুনেছিলাম, আমি দেখেছিলাম জলে নীল আলো। আমার স্বামীও ফিরেছিল, কিন্তু তার চোখ তখন ফাঁকা। আমি জানি, সে আর বেঁচে ছিল না।” গ্রামবাসীরা ভয়ে একে অপরের মুখের দিকে তাকাল, কেউ কেউ আবার অমলার কথায় আস্থার সঙ্গে মাথা নেড়ে সম্মতি দিল।

এই কাহিনি শুনে রঞ্জনের বুকের ভেতর যেন আগুন জ্বলে উঠল। পদ্মাবতীর গল্প তার কাছে নিছক গ্রাম্য লোককথা নয়, বরং সত্যের আড়ালে ঢাকা কোনো ভৌতিক অভিশাপ। সে অনুভব করল, নিখিলের মৃত্যু, অন্যদের শূন্য চোখের দেহ—সবকিছু যেন এই পুরনো কাহিনির সঙ্গেই মিলে যাচ্ছে। কিন্তু রঞ্জনের মনের ভেতর দ্বন্দ্ব তৈরি হল। সে একদিকে গ্রামবাসীর মতোই শিউরে উঠছে ভয়ংকর সত্য শুনে, অন্যদিকে তার বিজ্ঞানমনস্ক মন বলছে—এ রহস্যেরও কোনো যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা আছে। তবুও, অমলার চোখে যে আতঙ্ক, যে সত্যের ভার, তা উপেক্ষা করার ক্ষমতা তার নেই। পদ্মাবতীর অসমাপ্ত গল্প যেন আজও গ্রামটিকে জড়িয়ে রেখেছে শূন্যতার এক জালে। রঞ্জন সিদ্ধান্ত নিল, সে এই রহস্য ভেদ করবেই। কিন্তু ভেতরে কোথাও একটা ফিসফিস কণ্ঠও তাকে যেন টেনে নিচ্ছিল—“এসো…”—এবার হয়তো সেই ডাক শুধু পুকুরের জলে নয়, তার নিজের আত্মার ভেতরেও অনুরণিত হতে শুরু করেছে।

অমাবস্যার রাত, চারদিকে কালো অন্ধকারে আকাশ ঢেকে আছে। গ্রামজুড়ে নিস্তব্ধতা, শুধু মাঝে মাঝে দূরে শেয়ালের ডাক ভেসে আসছে। ঠিক এমন এক রাতে রঞ্জন একা পা বাড়াল পুকুরের দিকে। গ্রামের সবাই তাকে নিবৃত্ত করেছিল—কেউ বলেছিল, “আজ অমাবস্যা, আজকের রাতই সবচেয়ে ভয়ঙ্কর,” আবার কেউ কেঁদে মিনতি করেছিল, “ওখানে যেও না, তুমি আর ফিরতে পারবে না।” কিন্তু রঞ্জনের চোখে তখন আর ভয় ছিল না, ছিল শুধু শোক আর এক জেদী সংকল্প। নিখিলকে হারানোর পর তার ভেতর থেকে মৃত্যু ভয় মুছে গেছে। সে জানে, যদি সত্যিটা আজ না খুঁজে বের করে, তবে এই মৃত্যু-অভিশাপ থামবে না। ধীরে ধীরে সে এগোল, কাঁধে শুধু একটা লণ্ঠন, কিন্তু পুকুরের কাছে পৌঁছতেই বাতাস যেন অকারণে হিম হয়ে গেল। নিস্তব্ধতার ভেতরে হঠাৎ সে টের পেল—কেউ যেন অপেক্ষা করছে ওখানে। পুকুরপাড়ে গিয়ে দাঁড়াতেই জলের তলা থেকে হঠাৎ ঝলকে উঠল সেই ভৌতিক নীল আলো। আলোটা একেবারে অন্ধকারকে ভেদ করে রঞ্জনের মুখে এসে পড়ল, আর তার বুক কেঁপে উঠল।

এরপর ঘটল সেই মুহূর্ত, যা সে এতদিন গল্পে শুনেছে, ভয়ে কল্পনা করেছে, অথচ চোখে কখনও দেখেনি। পুকুরের জলের ভেতর থেকে ধীরে ধীরে ভেসে উঠল এক নারীমূর্তি। লম্বা চুল ভেসে আছে জলের উপরে, পরনে ভেজা শাড়ি, মুখশ্রীতে এক ভৌতিক মায়া। তার চোখদুটো কিন্তু জীবিতের চোখ নয়—ফাঁকা, গভীর, যেন এক অতল অন্ধকার। তার ঠোঁট নড়ে উঠল, আর শীতল বাতাসে ভেসে এলো সেই চিরচেনা ডাক—“এসো…”। শব্দটা এত মায়াবী, এত টানটান, যেন মানুষের আত্মাকে অদৃশ্য শিকলে বেঁধে ফেলতে পারে। রঞ্জন অনুভব করল তার পা যেন নিজের অজান্তে এগোতে চাইছে জলের দিকে। শরীরের ভেতরে ভয় চেপে বসছে, আবার কোনো অদ্ভুত শক্তি টেনে নিয়ে যাচ্ছে তাকে পুকুরে নামতে। তার নিঃশ্বাস ভারী হয়ে এলো, কপালে ঘাম জমল, কিন্তু মন বলছিল—যদি একবার সে ভেতরে ডুবে যায়, তবে আর ফিরে আসতে পারবে না। তবুও চোখ সরাতে পারছিল না সেই নারীমূর্তি থেকে। পদ্মাবতীর আত্মা কি এটাই? সেই প্রতিশোধপরায়ণ কন্যা, যে প্রতারণার শোকে আত্মহত্যা করেছিল, আর এখনো প্রতিটি পুরুষকে শূন্য করে দিচ্ছে? নাকি এ এক ভয়ঙ্কর ভ্রম, জলের অদৃশ্য শক্তির খেলা?

রঞ্জন দাঁতে দাঁত চেপে দাঁড়াল, নিজের মনের উপর নিয়ন্ত্রণ আনতে চেষ্টা করল। সে মনে করল নিখিলের ফাঁকা চোখ, অমলার কান্না, গ্রামের ভীত মুখগুলো। “না, আমি হারব না,” সে নিজেকে বলল। কিন্তু নারীমূর্তি যেন আরও কাছে এগিয়ে এল, তার ভেজা হাত বাড়িয়ে দিল জলের উপর থেকে, ঠোঁট থেকে আবারও ভেসে এলো—“এসো…”। সেই ডাকের সঙ্গে সঙ্গে আশেপাশের বাতাস কাঁপতে লাগল, গাছের ডালপালা কেঁপে উঠল, লণ্ঠনের আলোও হঠাৎ নিভে গেল। অন্ধকারের মধ্যে শুধু রইল সেই নীল আলো আর সেই নারীর ফাঁকা দৃষ্টি। রঞ্জনের বুক ধড়ফড় করতে লাগল, শরীরের ভেতর হিম স্রোত বয়ে গেল, তবুও সে চোখ সরাল না। সে জানত, এই রাতই তার ভাগ্যের রাত—হয় সে সত্যিটা খুঁজে পাবে, নয়তো আরেকটা নিথর লাশ হয়ে ভেসে উঠবে ভোরের আলোয়। তার কান প্রায় বন্ধ হয়ে আসছিল, অথচ সেই একটাই শব্দ বারবার বাজছিল চারপাশে, তার মাথার ভেতরেও প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল—“এসো… এসো… এসো…”। আর রঞ্জন বুঝল, সে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে মৃত্যুর ডাকের সামনে।

১০

অমাবস্যার সেই রাতে রঞ্জন দাঁড়িয়ে ছিল পুকুরপাড়ে, এক অদৃশ্য লড়াইয়ের কেন্দ্রে। সামনে জলের ভেতর থেকে উঠে আসা নারীমূর্তি, তার চোখে ফাঁকা গহ্বর, ঠোঁটে ভেসে আসছে মায়াবী টান—“এসো…”। শব্দটা কেবল কানে নয়, মনের গভীরে গেঁথে যাচ্ছিল, যেন রঞ্জনের আত্মাকে টেনে নিতে চাইছে অদৃশ্য শিকলে বেঁধে। তার পা ধীরে ধীরে এগোতে শুরু করল, মনে হল যেন শরীর আর নিজের নিয়ন্ত্রণে নেই। কিন্তু বুকের ভেতর কোথাও নিখিলের চিৎকার প্রতিধ্বনিত হল, তার ভাইয়ের ফাঁকা চোখের দৃষ্টি সামনে ভেসে উঠল। সেই যন্ত্রণা, সেই ক্ষত তাকে এক মুহূর্তের জন্য হলেও নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ ফিরিয়ে দিল। রঞ্জন দাঁতে দাঁত চেপে মাটিতে পা গেঁথে দিল, ফিসফিস করে বলল—“না, আমি আর কাউকে হারাব না।” জলের উপর নীল আলো আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠল, যেন তাকে গ্রাস করতে চায়, কিন্তু রঞ্জন বুকের ভিতর থেকে বের করল প্রতিরোধের শক্তি।

হঠাৎ করেই তার মনে পড়ল অমলার বলা পদ্মাবতীর কাহিনি। প্রতারণায় ভেঙে পড়া সেই তরুণীর আত্মা, যে কখনও মুক্তি পায়নি, আজও প্রতিশোধের তৃষ্ণায় অন্ধকারে ঘুরে বেড়াচ্ছে। রঞ্জন বুঝতে পারল, ভয় বা ঘৃণা দিয়ে এই আত্মাকে ঠেকানো যাবে না। পদ্মাবতীর আত্মা চাইছে স্বীকৃতি, চাইছে কেউ তাকে বুঝুক, তার যন্ত্রণা মেনে নিক। সে জোরে বলে উঠল—“তুমি প্রতিশোধ নিচ্ছ, কারণ তোমার কষ্ট কেউ বোঝেনি। কিন্তু এত বছর ধরে তুমি শুধু মৃত্যু ছড়াচ্ছ। তোমার কি মুক্তি চাই না? তোমার কি শান্তি চাই না?” তার কণ্ঠ বাতাসে প্রতিধ্বনিত হল, আর মুহূর্তের জন্য মনে হল পুকুরের জলে আলোটা কেঁপে উঠল। নারীমূর্তি থেমে গেল, তার বাড়ানো হাত হালকা কাঁপতে লাগল, আর চোখের ফাঁকা গহ্বরে যেন এক বিন্দু ব্যথা, এক ফোঁটা দুঃখের ছায়া দেখা দিল। ডাকটা আবার শোনা গেল, কিন্তু এবার তা আগের মতো শীতল ছিল না, বরং কেঁদে ওঠা এক অসহায়ের মতো—“এসো…”। রঞ্জনের বুক কেঁপে উঠল, কিন্তু সে হাত বাড়িয়ে বলল—“আমি আসব না মৃত্যুর টানে, আমি চাই তুমি শান্তি পাও। তুমি মুক্ত হও।”

গ্রামজুড়ে ভোরের প্রথম আলো ফুটতে শুরু করল, আর সেই মুহূর্তে পুকুরের জলে হঠাৎ প্রচণ্ড আলো ঝলসে উঠল। রঞ্জন চোখ বন্ধ করে ফেলল, মনে হল চারপাশের বাতাসই কেঁপে উঠল। আবার চোখ মেলতেই দেখল—নারীমূর্তি ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে, যেন কুয়াশার মতো গলে যাচ্ছে নীল আলোয়। শেষ মুহূর্তে তার ঠোঁটে ভেসে উঠল এক হালকা হাসি, চোখের শূন্যতা যেন ভরে উঠল শান্তির আভায়। তারপর সব অন্ধকার নিভে গেল, পুকুর ফিরে পেল নিস্তরঙ্গ নীরবতা। রঞ্জন হাঁপাতে হাঁপাতে দাঁড়িয়ে রইল, বুক ভরে শ্বাস নিল, আর বুঝল—আজ এক দীর্ঘ অভিশাপ ভেঙে গেছে। পদ্মাবতীর আত্মা মুক্তি পেয়েছে, গ্রামের ওপর থেকে সরে গেছে মৃত্যুর ছায়া। তবুও তার ভেতরে প্রশ্ন রয়ে গেল—সে কি সত্যিই আত্মাকে মুক্ত করল, নাকি কেবল নিজের কল্পনায় একটা উত্তর খুঁজে নিল? পুকুর তখন শান্ত, কিন্তু রঞ্জনের বুকের ভেতর প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল এক ভয়াবহ প্রশ্ন—এই শান্তি কি স্থায়ী, নাকি অন্ধকার আবারও ফিরবে অন্য কোনো রাতে, অন্য কারও জন্য? তার চোখে জল ভরে উঠল, আর নিখিলের শূন্য দৃষ্টি মনে পড়তেই সে কেঁপে উঠল। মুক্তি নাকি মৃত্যু—এই উত্তর হয়তো চিরকালই অন্ধকারে ঢাকা থেকে যাবে।

শেষ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *