Bangla - রহস্য গল্প

অশোকের গোপন বৃত্ত

Spread the love

শ্রাবনী চৌধুরী


পুরনো পাণ্ডুলিপি

কলকাতার এক বর্ষাস্নাত দুপুর। ঝমঝম বৃষ্টি পড়ছে বাইরের ছাদে, জানালার কাঁচে জল জমে তৈরি হচ্ছে ছোট ছোট রেখা। ইতিহাসবিদ অন্বেষা সেন বসে আছেন তাঁর ব্যক্তিগত পাঠকক্ষে, চারদিক জুড়ে বই আর পাণ্ডুলিপির স্তূপ। এই ঘরেই তিনি লিখেছেন তাঁর সর্বাধিক বিক্রিত বই “মৌর্যদের ছায়া”।

অন্বেষা একজন প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ, যিনি মৌর্য সাম্রাজ্যের উপর দীর্ঘদিন গবেষণা করছেন। তাঁর গবেষণার বিষয়বস্তু মূলত সম্রাট অশোক এবং কলিঙ্গ যুদ্ধের পর তাঁর পরিবর্তিত মনোভাব। কিন্তু আজকের দিনটা অন্যরকম। আজ তাঁর হাতে এসেছে এমন এক প্রাচীন পাণ্ডুলিপি, যা তাঁর গোটা বিশ্বাসব্যবস্থাকে নাড়িয়ে দিতে পারে।

এই পাণ্ডুলিপিটি তিনি পেয়েছেন বারাণসীর এক পুরনো জাদুঘরের পরিচালক ডঃ সমরেশ মুখার্জীর মাধ্যমে। একজন সন্ন্যাসী এই পাণ্ডুলিপিটি রেখে যান এবং বলে যান— “এটা শুধুমাত্র সত্যের অনুসন্ধানকারীর হাতে পৌঁছাক।”

পাণ্ডুলিপিটি সংস্কৃত ও প্রাকৃত ভাষায় লেখা, তাম্রপাতের উপর খোদাই করা অক্ষরে। অন্বেষা ধৈর্য ধরে প্রতিটি শব্দ অনুবাদ করছেন। হঠাৎ একটি নাম তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করে— “নব গুহ্য পুরুষ”, অর্থাৎ “Nine Hidden Men”।

তিনি থমকে যান। তাঁর রক্ত জমে আসে। এতদিন এই “নাইন আননোন মেন” ছিল শুধুই একটি পৌরাণিক গুজব। কিছু পশ্চিমা লেখক এবং কন্সপিরেসি থিওরিস্ট দাবি করতেন যে অশোক এমন নয়জন বিদ্বানকে নিযুক্ত করেছিলেন যাঁরা জ্ঞানের গভীরতম রহস্য রক্ষা করতেন। অন্বেষা কখনও এই গল্পকে গুরুত্ব দেননি— এখন পর্যন্ত।

পাণ্ডুলিপিতে লেখা রয়েছে—

“যুদ্ধের পরে, যখন অশোক বোধি লাভ করিলেন, তিনি নিযুক্ত করিলেন নয়জন গুহ্য পুরুষ। তাঁহাদের কায়িক অস্তিত্ব লোপ পাইয়াছে, কিন্তু তাহারা জ্ঞানরক্ষা করিতেছেন শতাব্দীর পর শতাব্দী।”

এই তথ্য তাঁকে হতবাক করে দেয়। এই পাণ্ডুলিপির সত্যতা যদি প্রমাণিত হয়, তবে ইতিহাসের বইগুলো নতুন করে লেখা হবে।

তিনি তৎক্ষণাৎ ফোন করেন তাঁর সহযোগী গবেষক দিব্যজ্যোতি ঘোষকে।

“দিব্য, তোমাকে একবার আসতে হবে। একটা চমকপ্রদ জিনিস পেয়েছি।”

“এই বর্ষায়?” দিব্যর কণ্ঠে অবাক ভাব। “কি এমন চমকপ্রদ?”

“অশোক আর নাইন আননোন মেন— তুই বিশ্বাস করিস?”

ফোনের ওপারে নীরবতা। তারপর দিব্যর স্বর চাপা উত্তেজনায় কাঁপে— “পাঁচ মিনিটে আসছি।”

দিব্যজ্যোতি পৌঁছে গেলে অন্বেষা পাণ্ডুলিপিটি তাঁর সামনে রেখে দেন। দুজনে মিলে আবার পাঠ শুরু করেন। পাণ্ডুলিপির শেষ অংশে আরও একটি তথ্য মেলে— এক বিশেষ স্থান এবং চিহ্ন সম্পর্কে, যা এই গোপন গোষ্ঠীর কার্যকলাপের সূত্র দিতে পারে।

“সিংহচিহ্নের তলায়, যেখানে তিন নদী একত্র হয়, সেখানে রহস্য রক্ষিত। রক্ষা করিতেছে ‘প্রথম পুরুষ’। বাকিরা ছায়ার মধ্যে।”

অন্বেষা চিন্তা করে— “তিন নদী একত্র হয়? ত্রিবেণী সঙ্ঘম? নাকি প্রয়াগরাজ?”

দিব্য বলেন, “প্রয়াগরাজেই গঙ্গা, যমুনা আর সরস্বতীর সঙ্গম। ওখানেই হয়তো কিছু আছে। আর সিংহচিহ্ন?”

অন্বেষা তাঁর ডেস্ক থেকে অশোক স্তম্ভের ছবি বের করেন— জাতীয় প্রতীক। চারটি সিংহ একসাথে।

“এটাই সেই চিহ্ন। হয়তো এই পাণ্ডুলিপি বলছে, প্রথম গোপন পুরুষের অবস্থান এখনও ভারতেরই কোথাও, হয়তো প্রয়াগরাজে।”

এই প্রথমবারের মতো অন্বেষা বুঝতে পারেন, এটি শুধুই ইতিহাস নয়— এটি একটি রহস্য। এমন রহস্য, যা তাঁকে নিয়ে যেতে পারে ইতিহাসের গভীরে, সময়ের অতল গহ্বরে।

তিনি সিদ্ধান্ত নেন— তাঁরা প্রয়াগরাজে যাবেন। সত্য উদঘাটন করতেই হবে।

প্রয়াগে পদার্পণ

প্রায় এক সপ্তাহ পরে, অন্বেষা সেন ও দিব্যজ্যোতি ঘোষ পৌঁছলেন প্রয়াগরাজ। শহরটি তাদের কাছে আগেও পরিচিত ছিল, কিন্তু এবার তাঁদের উদ্দেশ্য আলাদা—এই শহরের বুকে লুকিয়ে থাকা ইতিহাসের গভীর এক রহস্যের খোঁজ।

ট্রেন থেকে নামার সময়ই অন্বেষার চোখে পড়ে কিছু স্থানীয় মানুষ প্রাচীন ধ্বংসাবশেষের ছবি তুলছেন এক পুরনো ঘাটের ধারে। দিব্য বলল, “দেখছ? শহরের প্রতিটি ইট যেন ইতিহাসের গল্প বলে।”

অন্বেষা মাথা নাড়লেন। “এবার সেই গল্পের মধ্যে লুকিয়ে থাকা সত্যটাকেই খুঁজে বার করতে হবে।”

তাঁরা উঠলেন একটি ছোট হেরিটেজ হোটেলে, যেটা শহরের প্রাচীন অংশে অবস্থিত। হোটেলের নাম বোধি নিবাস, একসময়ের জমিদারবাড়ি, এখন রূপান্তরিত গেস্ট হাউস। এখানকার কেয়ারটেকার অশোককুমার পাণ্ডে, বয়স পঁচাত্তরের কাছাকাছি, তবু চোখে-মুখে অদ্ভুত দীপ্তি।

পাণ্ডে কাকু কৌতূহলী হয়ে প্রশ্ন করলেন, “আপনারা ইতিহাসবিদ, না রহস্যপ্রেমী?”

অন্বেষা হেসে উত্তর দিলেন, “দুটোই। আমরা একটা পুরনো তাম্রলিপি অনুসরণ করে এসেছি, যেটা বলছে প্রয়াগরাজে গোপনে কিছু সংরক্ষিত আছে। বিশেষ করে, একটা ‘প্রথম পুরুষ’…”

পাণ্ডে কাকু মুখে আঙুল দিয়ে চাপা স্বরে বলেন, “আপনারা যদি সত্যিই অনুসন্ধান করতে চান, তবে অক্ষয়বট এর নিচে যান। সেখানে কিছু প্রাচীন চিহ্ন রয়েছে, যা আজও বোঝা যায় না। স্থানীয়রা বলে, কেউ কেউ মাঝেমধ্যে সেখানে যায়, আবার ফিরে আসে বদলে গিয়ে।”

“বদলে গিয়ে?” দিব্যজ্যোতির কণ্ঠে উদ্বেগ।

“হ্যাঁ,” পাণ্ডে কাকু বলেন, “যেন তাদের মনোজগতে কিছু পরিবর্তন ঘটে যায়। কেউ বলে কিছু অলৌকিক দৃশ্য দেখে, কেউ বলে অতীত দেখতে পায়। এ যেন সময়ের সীমানা পেরিয়ে যাওয়া।”

রাতটা অস্বস্তিকর কাটে। অন্বেষা শুয়ে শুয়ে ভাবে— কী এমন শক্তি এই শহরের বুকে চাপা পড়ে আছে, যা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে অদৃশ্য?

পরদিন সকালেই তাঁরা বের হন অক্ষয়বটের দিকে। অক্ষয়বট হলো প্রয়াগের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত একটি পৌরাণিক বটগাছ, যা নিয়ে বহু কাহিনি প্রচলিত। কথিত আছে, এটি স্বয়ং বিষ্ণুর আশীর্বাদে জন্ম নিয়েছে।

অক্ষয়বটের নিচে গিয়ে তাঁরা দেখতে পান একটি পাথরের চত্বর, মাঝখানে একটি ছোট পাথরের চৌকোনা ফলক। তার উপরে খোদাই করা চিহ্ন— ঠিক সেই চিহ্ন যা পাণ্ডুলিপিতে ছিল: একটি চারসিংহের প্রতিকৃতি।

অন্বেষার গা শিউরে ওঠে। দিব্য ছবি তোলে। ফলকের আশেপাশে ছোট ছোট লিপি খোদাই করা, প্রাচীন ব্রাহ্মী লিপিতে।

“এই অংশটা আমি নেব,” অন্বেষা বলেন। “তুই সন্ন্যাসীদের আশ্রমটা খুঁজে দেখ। পাণ্ডে কাকু বলেছিল, মাঝে মাঝে এক সন্ন্যাসী এখানে আসেন যিনি এই জায়গার ইতিহাস জানেন।”

দিব্য চলে গেলে, অন্বেষা একমনে ফলকটি পর্যবেক্ষণ করতে থাকেন। খোদাইয়ের মধ্যে হঠাৎই একটি ছোট বৃত্তের আকারে কিছু লেখা দেখতে পান। তিনি তার উপরে ধুলো ঝেড়ে পড়তে পারেন—

“প্রথম পুরুষ, অমর রক্ষক। যিনি জ্ঞান রক্ষা করেন, তিনি এখানেই আছে। দেখা হয় তাকে— যখন চারটি উপাদান মেলে।”

চারটি উপাদান? অন্বেষা ভাবেন— এটি কি শাস্ত্রীয় উপাদান? পৃথিবী, জল, বায়ু, অগ্নি?

ঠিক তখনই হঠাৎ ঝড় শুরু হয়। বটগাছের পাতা উড়তে থাকে, পাথরের ফলকের ওপর অদ্ভুত আলো পড়ে। অন্ধকারের মধ্যে যেন কিছুটা চঞ্চলতা।

আর ঠিক তখনই, তিনি দেখতে পান— গাছের পেছনে এক বৃদ্ধ দাঁড়িয়ে আছেন। সাদা পোশাক, দীর্ঘ দাড়ি, হাতে একটি কাঠের দণ্ড। তাঁর চোখে এক অপার্থিব দৃশ্য।

তিনি ধীরে ধীরে এগিয়ে আসেন অন্বেষার দিকে।

“আপনি… কে?” অন্বেষা জিজ্ঞেস করেন।

বৃদ্ধ বলেন, “আপনি যাকে খুঁজছেন, তিনি সত্যিই আছেন। কিন্তু তাঁকে দেখতে হলে আপনাকে হারাতে হবে কিছু, যা খুব মূল্যবান।”

“কী হারাতে হবে?” অন্বেষার কণ্ঠ কাঁপছে।

বৃদ্ধ বলেন, “আপনার অতীত। কারণ কেউই বর্তমান রেখে অতীত ছুঁতে পারে না।”

বৃদ্ধ পেছন ফিরে চলে যান, হারিয়ে যান অন্ধকারের মধ্যে।

অন্বেষা বোঝেন, এই অনুসন্ধান শুধু ইতিহাসের নয়, আত্মারও।

সন্ন্যাসীর সন্ধান

প্রয়াগের অক্ষয়বটের নিচে অন্বেষার দেখা সেই রহস্যময় বৃদ্ধ যেন এক ছায়ার মতো মিশে গিয়েছিলেন বাতাসে। অন্যদিকে, দিব্যজ্যোতি তখন শহরের অন্য প্রান্তে, পুরনো আশ্রম ও গ্রন্থাগারগুলির খোঁজে বেরিয়েছেন।

তিনি গিয়ে ওঠেন গৌরীধাম আশ্রমে— এক পুরাতন সন্ন্যাসী সংঘ যেখানে এখনো সংস্কৃত চর্চা চলে। সেখানে মঠাধ্যক্ষ স্বামী কৃপালানন্দজী প্রায় আশি পেরিয়ে গিয়েছেন, কিন্তু স্বর যেমন দীপ্ত, তেমনি চোখে স্পষ্ট বোধ।

দিব্য যখন তাঁর সামনে পাণ্ডুলিপির কপি ও সেই সিংহচিহ্নের ছবি রাখেন, তখন স্বামীজির মুখে এক ধীর হাসি ফুটে ওঠে।

“তুমি আসবে জানতাম,” তিনি বলেন, “অন্বেষা দেবীও এসেছেন, তাই তো?”

দিব্য হতভম্ব। “আপনি জানলেন কী করে?”

স্বামীজী বলেন, “এই যে অশোকের নাইন আননোন মেন— ওরা গোপন থাকলেও ইতিহাসের প্রহরী হিসেবে কেউ না কেউ বারবার জন্ম নেয়। এ জন্মে সেই দায়িত্ব তোমাদের ওপর পড়েছে।”

দিব্য প্রশ্ন করে, “এই ‘নব গুহ্য পুরুষ’ কি সত্যিই বাস্তবে ছিলেন? নাকি কেবল কিংবদন্তি?”

স্বামীজী উঠে দাঁড়িয়ে একটি কুঠুরি খুলে আনেন। ভেতর থেকে বার করেন একটি প্রাচীন তালপাতার পুঁথি। তারপর বলেন, “এই পুঁথি শুধু একটি কপি নয়, মূল পাণ্ডুলিপির অংশ। এখানে উল্লেখ আছে প্রথম ‘গুহ্য পুরুষ’-এর নাম: অভয় দত্ত। তিনি ছিলেন যুদ্ধসংক্রান্ত জ্ঞান ও কৌশলের রক্ষক।”

দিব্য চোখ বড় করে বলে, “যুদ্ধ? অথচ অশোক তো যুদ্ধবিরোধী হয়েছিলেন!”

“ঠিকই,” স্বামীজী বলেন, “তবে নব গুহ্য পুরুষদের কাজ ছিল জ্ঞান সংরক্ষণ করা— ব্যবহার নয়। তারা জ্ঞানকে লুকিয়ে রাখতেন যেন তা অপব্যবহারে না পড়ে। অভয় দত্ত ছিলেন এক অসাধারণ প্রতিভা, যাঁর রচনা আজকের আধুনিক স্ট্র্যাটেজি বইকেও হার মানায়।”

পুঁথির এক অংশে লেখা ছিল—

“অভয়, যিনি প্রথম পুরুষ, অমর আকারে থাকবে প্রয়াগে, অক্ষয় বটের ছায়ায়। সময় তাঁকে নাড়াতে পারে না। তিনি জ্ঞান দেবেন শুধুমাত্র সত্যের অনুসন্ধানকারীদের।”

দিব্য জিজ্ঞেস করে, “এমন কেউ এখনো জীবিত থাকতে পারেন?”

স্বামীজী বলেন, “অমর মানে সবসময় দেহে নয়। কখনও চিন্তায়, কখনও দৃষ্টিতে। তবে তুমি ও অন্বেষা যদি সত্যিই প্রস্তুত হও, তবে তিনি প্রকাশ পাবেন।”

“কী করতে হবে আমাদের?” দিব্য জানতে চায়।

“তোমাদের চারটি উপাদান একত্র করতে হবে: মাটি, জল, বায়ু, আগুন। কিন্তু কেবল বস্তু হিসেবে নয়— এই উপাদানগুলোর প্রতীকী দিকও আছে। একত্র করতে হবে চারটি গুণ: স্থিতি, বিশুদ্ধতা, চেতনা, আর উষ্ণতা।”

দিব্য এই বার্তা সঙ্গে নিয়ে ফিরে আসে হোটেলে। অন্বেষাকে সব খুলে বলে। দু’জনেই বুঝে যায়, এ শুধু এক ইতিহাসের খোঁজ নয়, এক অভ্যন্তরীণ অভিযাত্রা।

তাদের সামনে এখন চারটি ধাপ:

স্থিতি (মাটি) — একজন প্রাচীন ভূমিসংগ্রাহক বা গুহাচিত্রবিশারদের খোঁজ।

বিশুদ্ধতা (জল) — গঙ্গার কোনো তীরবর্তী নিগূঢ় তীর্থ বা জলাশয়ের সন্ধান।

চেতনা (বায়ু) — এমন স্থান যেখানে মানুষ ধ্যান বা অন্তর্জ্ঞান লাভ করে।

উষ্ণতা (আগুন) — আত্মত্যাগ বা বলিদানের প্রতীক কোনো স্মৃতিসৌধ।

অন্বেষা বলে, “আমাদের যাত্রা এখন চার ভাগে বিভক্ত। এবং প্রতিটি পথই এক নতুন রহস্যের দুয়ার।”

দিব্য মৃদু হাসে, “এই তো সত্যিকারের ইতিহাস— যেখানে মানুষ বইয়ের পাতা নয়, নিজেকে উল্টে পড়ে।”

স্থিতির ছায়ায়

প্রয়াগে একরাত বিশ্রামের পর, অন্বেষা ও দিব্যজ্যোতি তাদের অভিযাত্রার প্রথম ধাপের দিকে এগিয়ে চলল—“স্থিতি” বা মাটি। স্বামী কৃপালানন্দজীর কথামতো, তাদের খুঁজে বের করতে হবে এমন একজনকে, যিনি ভূমির গভীর ইতিহাস জানেন। অন্বেষার মনে পড়ে এক প্রবীণ প্রত্নতত্ত্ববিদের কথা— প্রফেসর গিরিধারী কুলস্থ। তিনি বহুদিন ধরে বিন্ধ্যাচলের গুহা ও খোদাইচিত্র নিয়ে কাজ করেছেন, এবং এখন থাকেন মির্জাপুরের কাছে একটি পাহাড়ি গ্রামে।

তারা পৌঁছাল সেই গ্রামে, নাম দেওধারা। আশেপাশে ঘন জঙ্গল, দূরে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে উঠে যাওয়া মাটির পথ। গ্রামের শেষে এক পুরনো কুঁড়েঘর—সেইখানেই থাকেন প্রফেসর কুলস্থ, যিনি এখন প্রায় নির্জন জীবনযাপন করছেন।

অন্বেষা তাঁকে চিঠি লিখেছিলেন আগেই, কিন্তু এমন প্রত্যুত্তর পায়নি। আজ দরজায় টোকা দিতেই খোলা হয়।

প্রবীণ, শীর্ণকায় মানুষটি চোখে মোটা চশমা, হাতে একটি কাঠের লাঠি।

“তোমরা অন্বেষা আর দিব্য, তাই তো?” তিনি বলেন।

“আপনি আমাদের চিনলেন কী করে?” অন্বেষা অবাক।

“যখন কেউ সত্যের খোঁজ করে, তার পায়ের শব্দ অনেক দূর থেকে শোনা যায়,” মৃদু হাসি দিয়ে বলেন কুলস্থ।

তাঁদের বসতে দিয়ে, কুলস্থ একটি কাপড় মোড়ানো চৌকোনা বাক্স বের করেন। ভিতরে রয়েছে কয়েকটি প্রাচীন খোদাইচিত্র, যেগুলি তিনি বিন্ধ্যগিরি অঞ্চলের গুহা থেকে সংগ্রহ করেছিলেন।

“এই খোদাইচিত্রগুলো আজ থেকে প্রায় ২৩০০ বছর আগের,” তিনি বলেন, “ঠিক অশোকের সময়কাল। কিন্তু একটাতে এমন কিছু আছে যা কেউ বোঝেনি।”

তিনি একটিকে সামনে আনেন। সেখানে আঁকা এক মানুষের মূর্তি—সে দাঁড়িয়ে আছে চারটি চক্রের সামনে: মাটি, জল, বায়ু, আগুনের প্রতীক। কিন্তু সবচেয়ে লক্ষণীয় বিষয়টি হলো—চতুর্দিকে চারটি ভাষায় একটি বাক্য লেখা:

“স্থিরতা সৃষ্টির মূল। যে স্থির, সে সহনশীল, সে ধারক।”

অন্বেষা বলে ওঠেন, “এই তো আমাদের প্রথম উপাদানের ইঙ্গিত! স্থিতি মানে কেবল স্থির মাটি নয়, স্থির মন, ধৈর্যও।”

কুলস্থ বলেন, “এই চিত্রের পাশে আরেকটি গুহায় এক সাদা পাথরের বেদি আছে, যার নিচে আমি কিছু খুঁজে পেয়েছিলাম… কিন্তু এক রহস্যময় শ্বাসরোধী ঘ্রাণে গুহার গভীরে প্রবেশ করা যায় না।”

তারা ঠিক করে সেই গুহায় যাওয়া হবে। স্থানীয় গাইডের সহায়তায় তারা পৌঁছায় সেই জায়গায়—পাথরের কাঁটায় ঘেরা সরু পথ, ভিতরে আঁধার।

ভেতরে ঢুকেই অন্বেষার বুক চেপে আসে, যেন সময় আটকে দিয়েছে গুহার বাতাসকে। এক অদ্ভুত ভিজে মাটির গন্ধ, এবং সেই কথিত “শ্বাসরোধী ঘ্রাণ” সত্যিই যেন কিছু বলে।

তবে দিব্য একটি ছোট মুখোশ ব্যবহার করে ভিতরে ঢোকে। কিছু সময় পরে সে চিৎকার করে ডাকে—“অন্বেষা! এখানে এসো!”

অন্বেষা সাহস করে এগিয়ে গিয়ে দেখে, একটি মার্বেলের বেদির নিচে একটি ছোট কুপ। দিব্য সেখানে খুঁজে পেয়েছে একটি ধাতব চাকতির মতো কিছু—পিছনে খোদাই করা একটি চিহ্ন: চার ভাগ করা চক্র, যার একটিতে শুধু মাটির দানা আঁকা।

এটি সেই স্থিতির প্রতীক।

সঙ্গে একটি বাক্য খোদাই করা:

“প্রথম গুণ পাওয়া গেল—এখন দ্বিতীয় উপাদান চাই, যা বিশুদ্ধ করে শরীর ও আত্মা।”

তারা বুঝে যায়, এই পদক্ষেপ সফল। প্রথম গুণ—স্থিতি—তারা অর্জন করেছে।

বাইরে এসে অন্বেষা আকাশের দিকে তাকিয়ে বলেন, “প্রথম ধাপ শেষ, কিন্তু এবার আমাদের নামতে হবে জলের গভীরে।”

বিশুদ্ধতার জলে

প্রথম উপাদান “স্থিতি” পাওয়ার পর অন্বেষা ও দিব্যজ্যোতির মনে আরও একধাপ এগিয়ে যাওয়ার উত্তেজনা। এবার তাদের লক্ষ্য—দ্বিতীয় উপাদান: জল, যার প্রতীক—বিশুদ্ধতা।

স্বামী কৃপালানন্দজী বলেছিলেন, এই উপাদান খুঁজে পেতে হবে এমন এক তীর্থে, যেখানে শরীর নয়—আত্মা ধুয়ে যায়। অন্বেষা অনেক গবেষণার পর ঠিক করলেন, তাদের যেতে হবে উত্তরপ্রদেশ ও বিহার সীমান্তের এক অতি প্রাচীন স্থান—চম্পারণ জেলার কাছে অবস্থিত নীলগিরি সরোবর। কথিত আছে, এই হ্রদটি অতীতে একটি প্রাচীন আশ্রমের অন্তর্ভুক্ত ছিল, যেখানে ঋষিরা আত্মশুদ্ধির জন্য স্নান করতেন।

যাত্রা শুরু হলো। ঘন বৃষ্টির মধ্যে তাঁরা পৌঁছাল সেই একাকী হ্রদের পাড়ে। আশেপাশে ঝোপঝাড়ে ভরা, জনমানবশূন্য পরিবেশ। কিন্তু হ্রদের জল অদ্ভুতভাবে স্বচ্ছ—যেন আয়নার মতো নিজের ভেতরে সবকিছু প্রতিফলিত করে।

পাড়ে বসে থাকা এক বৃদ্ধা তাঁদের দিকে তাকিয়ে বলেন, “জলের কাছে গেলে নিজের সব অসত্য ফেলে যেতে হয়।”

দিব্য প্রশ্ন করে, “আপনি কে?”

বৃদ্ধা উত্তর দেন না, শুধু একটি কবিতার মতো বাক্য আওড়ান—

“যে দেখে নিজেকে, সে দেখে পথ। যে শোনে নীরবতা, সে পায় উত্তর।”

তাঁরা ধীরে ধীরে হ্রদের জলে পা রাখেন। মুহূর্তেই দু’জনের শরীরে কাঁটা দেয়—জল ঠান্ডা, কিন্তু স্পর্শে যেন বিদ্যুৎ। জলের মধ্যে দাঁড়িয়ে তারা অনুভব করে, যেন চারপাশ নিঃশব্দ। পাখির ডাক, বাতাসের শব্দ—সব মিলিয়ে নিঃশব্দ হয়ে গেছে।

অন্বেষা বলে ওঠেন, “এটা শুধুই জল নয়। এটা স্মৃতি টানে।”

তার চোখের সামনে হঠাৎ ভেসে ওঠে এক পুরনো দৃশ্য—তার ছেলেবেলা, যখন সে প্রথম ইতিহাস বই হাতে নিয়েছিল। নিজের বাবার সঙ্গে বাগানে বই পড়ছিল সে। তার মনে পড়ে যায়, সেই প্রথম জিজ্ঞাসা করেছিল, “ইতিহাস মানে কি কেবল রাজা-রানির কাহিনি?”

বাবা বলেছিলেন, “না, ইতিহাস মানে মানুষের সত্যের সন্ধান।”

দিব্যও অনুভব করে এক দৃশ্য—তার প্রথম প্রেম, তার বিশ্বাসঘাতকতা, তার একাকীত্ব। সে ভাবে, “আমি সত্যিই প্রস্তুত তো এই পথের জন্য?”

ঠিক সেই মুহূর্তে, হ্রদের মাঝখানে একটি নীল পাথরের স্তম্ভ ভেসে ওঠে। হ্রদের নিচে এতদিন তা ঢাকা ছিল। অন্বেষা জলে ভিজে এগিয়ে যায়, দেখতে পায় সেই স্তম্ভের গায়ে খোদাই করা আরেকটি চিহ্ন—এক ফোঁটা জল, যার ভেতরে চন্দ্রাকৃতি।

সঙ্গে লেখা:

“শুদ্ধ নয় যে, সে জ্ঞান ধারণ করতে পারে না। দ্বিতীয় উপাদান তোমরা পেয়েছ—জল, যা সবকিছু শোষণ করে, কিন্তু কিছুই ধরে না।”

চিহ্নের নিচে একটি ধাতব চাকতি পাওয়া যায়, যা প্রথম চাকতির সঙ্গে একেবারে মিলে যায়। এবার দ্বিতীয় ভাগটি পূর্ণ—চাকতির দ্বিতীয় ভাগ জুড়ে দেওয়া যায়।

অন্বেষা চমকে ওঠে। “এগুলো হয়তো পুরো চাকতি হয়ে একটা দরজা খুলবে। কোথায়, সেটা এখনো অজানা।”

বৃদ্ধা তখন আবার বলে ওঠেন, “তোমাদের পরবর্তী পথ হাওয়া—যেখানে শব্দ থেমে যায়, কেবল চেতনা বাঁচে। পাহাড়ের উপর, ধ্যানের আসনে, সে পথ।”

অন্বেষা ও দিব্যজ্যোতি বুঝে যায়, তৃতীয় উপাদান—বায়ু বা চেতনা—তাদের অপেক্ষা করছে।

তারা শুকনো কাপড়ে দ্বিতীয় ধাতবচাকতি মুড়ে ব্যাগে রাখে। পিছনে ফিরে দেখে—বৃদ্ধা নেই।

চেতনার ধ্বনি

অন্বেষা ও দিব্যজ্যোতির সামনে এখন তৃতীয় উপাদান—বায়ু, যার প্রতীক চেতনা। এবার তাদের গন্তব্য হিমালয়ের এক প্রাচীন ধ্যানস্থল, নাম—ধৌলগিরি আশ্রম। লোকমুখে শোনা যায়, এই আশ্রমে এমন এক সাধক ধ্যান করেন যিনি দশ বছর ধরে কথা বলেননি, শুধু শ্বাসের স্পন্দনে অনুভব করেন পৃথিবীকে।

তারা রওনা দেয় উত্তরাখণ্ডের দিকে। পাহাড়ি রাস্তা, কুয়াশায় ঢাকা সরু ট্রেল, কোথাও পাথরের খাড়া দেয়াল। তবু অন্বেষা ও দিব্যর মনে ভয় নেই—তারা জানে, সত্যের পথ সহজ নয়।

তিন দিনের ট্রেকের পর তারা পৌঁছায় আশ্রমের দরজায়। সেখানকার প্রধান সন্ন্যাসী—স্বামী নির্শব্দানন্দ—এক উঁচু পাথরের চাতালে বসে আছেন, চোখ বন্ধ, নিঃশব্দে ধ্যানস্থ। তাঁর সামনে বসে আছেন কয়েকজন ভক্ত, সবাই নীরব।

অন্বেষা ও দিব্য ভয়ে ভয়ে এগোয়। কাউকে কিছু বলার সুযোগ নেই—সবাই কথা বলা নিষিদ্ধ।

তাদের হাতে থাকা ধাতবচাকতির দুটি অংশ তারা মাটিতে রাখে। এক সন্ন্যাসী চোখ ইশারায় বলে, তাদের বসতে হবে। তারা বসে পড়ে। সময় থেমে যায়।

চার ঘণ্টা, পাঁচ ঘণ্টা…
দিনের আলো মুছে গিয়ে রাত আসে।

হঠাৎ, বাতাসে এক হালকা শব্দ—বাঁশির মতো কিছুর ধ্বনি—শুরু হয়। মনে হয় যেন বাতাসই কথা বলছে।

স্বামী নির্শব্দানন্দ চোখ খুলে তাঁদের দিকে তাকান। তার চোখের দৃষ্টি যেন কোনো শব্দের চেয়েও তীব্র।

তিনি একটি পাতা বাড়িয়ে দেন—তাতে লেখা:

“চেতনা শব্দে নয়, নৈঃশব্দ্যে বাস করে। তুমি শুনতে পারো, যদি শুনতে চাও।”

এরপর তিনি এক হাতে ইঙ্গিত করেন আকাশের দিকে। সন্ন্যাসীরা বুঝে যান, ওঁরা ‘ভবিষ্যৎ বাহক’। তাঁরা দু’জনকে নিয়ে যান আশ্রমের পেছনে এক পাহাড়চূড়ার গুহায়।

সেখানে, পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে হাওয়া এমন প্রবল যে মনে হয় পুরো পৃথিবী দুলে যাচ্ছে। কিন্তু গুহার মধ্যে এক জায়গায় বাতাস নেই—সেই স্থানে চক্র আঁকা। সেখানে রাখা আছে একটি ধাতব স্তম্ভ, তাতে খোদাই করা বায়ুর প্রতীক—এক সর্পিল রেখা।

চিহ্নের নিচে লেখা:

“তৃতীয় গুণ: চেতনা, যা গতি ও শান্তিকে একসাথে ধারণ করে। এই স্তম্ভে একবার নিঃশ্বাস রাখো, নিজের ভেতরের শব্দ শুনবে।”

দিব্য এগিয়ে গিয়ে নিঃশ্বাস ফেলতেই বাতাস স্তম্ভের ফাঁক দিয়ে বয়ে যায়—একটা সুর তৈরি করে, যেন কোনো প্রাচীন গান।

একটা তীক্ষ্ণ আলো ভেসে ওঠে স্তম্ভের ফাঁকে—আরেকটি ধাতবচাকতি! তারা এটিকে আগের দুই অংশের সঙ্গে জুড়ে দেয়।

তিনটি অংশ একসাথে হয়ে এখন এক বিশালাকার বৃত্ত তৈরি করেছে, যার তিনটি ভাগ সম্পূর্ণ। চতুর্থ ও শেষ উপাদান—আগুন বা উষ্ণতা—বাকি।

স্বামী নির্শব্দানন্দ এবার কিছু বলেন না, শুধু এক পাথরের খোদাই দেখান, যেখানে লেখা:

“শেষ পথ রক্তে লেখা—যেখানে বলিদান ঘটে, সেখানেই উষ্ণতার জন্ম।”

তারা বুঝে যায়, এবার তাদের নামতে হবে এমন এক ইতিহাসে, যেখানে রক্ত ঝরেছে, কিন্তু উদ্দেশ্য ছিল শুদ্ধ।

আগুনের প্রতিজ্ঞা

তিনটি উপাদান—স্থিতি, জল, বায়ু—পাওয়ার পর অন্বেষা ও দিব্যজ্যোতির যাত্রা পৌঁছেছে চূড়ান্ত ধাপে। শেষ উপাদান: আগুন, যার প্রতীক উষ্ণতা। স্বামী নির্শব্দানন্দের ইঙ্গিত অনুসারে, এই উপাদান এমন এক স্থানে লুকানো আছে যেখানে বলিদান ঘটেছে, কিন্তু উদ্দেশ্য ছিল পবিত্র।

অন্বেষা গভীর গবেষণার পর ঠিক করে, তাদের যেতে হবে উদয়গিরি—উড়িষ্যার সেই প্রাচীন পাহাড় যেখানে সম্রাট অশোকের দিগ্বিজয়ের পর প্রথম অনুশোচনার পাথরে (Edicts) খোদাই হয় “ধর্ম বিজয়ের” বাণী। সেখানে রক্ত ঝরেছিল, কিন্তু তাতেই জন্ম হয়েছিল করুণা, শান্তি ও আত্মশুদ্ধির।

তারা ট্রেনে কটক পৌঁছে, সেখান থেকে গাড়িতে উদয়গিরির দিকে রওনা দেয়। জায়গাটি এখন পর্যটনকেন্দ্র, কিন্তু গভীর রাত হলে পাহাড়ের নিচের গুহাগুলো হয়ে ওঠে নিঃসঙ্গ, রহস্যময়।

এক বৃদ্ধ তপস্বী তাঁদের গাইড হন। তিনি বলেন, “তোমরা যা খুঁজছ, তা শুধু চোখে দেখা যায় না। আগুন চোখে জ্বলে, কিন্তু সত্যের আগুন হৃদয়ে।”

তারা গুহার ভেতর প্রবেশ করে। এক গুহার দেওয়ালে স্পষ্ট খোদাই—সম্রাট অশোকের অনুশোচনার ঘোষণা:

“বিজয়ে নয়, শান্তিতে আমি গৌরব খুঁজেছি।”

তার নিচে আছে এক গোপন খাঁজ, যা ধুলোর নিচে ঢাকা ছিল। অন্বেষা হাতে থাকা ধাতবচাকতির তিনটি অংশ সেখানে বসিয়ে দেয়। হঠাৎ ঘষঘষ শব্দ করে খাঁজ খুলে যায়—ভেতরে এক অন্ধকার কক্ষ, আর তার মাঝে রাখা ধূপধুনার মতো ধোঁয়া ওঠা পাথরের পাত্র।

ধীরে ধীরে সেই পাত্র থেকে আগুনের লাল আভা ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে।

দিব্য বলে, “এটা কি আগুন? না আত্মার প্রতিচ্ছবি?”

অন্বেষা এগিয়ে গিয়ে পাত্রের পাশে একটি ফলক দেখে, যেখানে খোদাই:

“উষ্ণতা সৃষ্টি হয় আত্মোৎসর্গে। যেখানে নিজের ইচ্ছা পুড়িয়ে সত্যকে স্থান দেওয়া হয়, সেখানেই জন্ম নেয় জ্ঞান।”

পাত্রের নিচে পাওয়া যায় চাকতির চতুর্থ ও শেষ অংশ—তাতে আঁকা আগুনের শিখা।

চারটি অংশ একত্র করে তারা তৈরি করে সম্পূর্ণ একটি গোল চাকতি—এর মাঝখানে অদ্ভুত এক খোদাইচিহ্ন: নবগ্রহের মতো সাজানো নয়টি বিন্দু।

অন্বেষা চমকে ওঠে, “এটা তো নাইন আননোন মেন-এর প্রতীক! তারা এই চারটি উপাদান দিয়ে তৈরি করেছিল এক প্রাচীন জ্ঞানসূত্র—এক যন্ত্র, যা সত্যদর্শন ঘটাতে পারে।”

গাইড তখন ফিসফিস করে বলে, “তোমাদের যাত্রা শেষ নয়—এটা তো শুরু। এখন তোমাদের যেতে হবে সেই স্থানে, যেখানে এই যন্ত্রটি রাখা হয়েছিল—কোশল জনপদের গোপন গ্রন্থাগার।”

দিব্য বলে, “কোশল! এখনকার ফৈজাবাদ বা অযোধ্যা।”

অন্বেষা তখন বুঝে যায়, তাদের এই যন্ত্র নিয়ে যেতে হবে সেই পুরনো রাজধানীতে, যেখানে এককালে নাইন আননোন মেন-দের গোপন সভা বসত।

কোশলের গোপন গ্রন্থাগার

চারটি উপাদান—স্থিতি, জল, বায়ু, ও আগুন—সম্পূর্ণ হওয়ার পর অন্বেষা ও দিব্যজ্যোতি এখন যাত্রা করছে ভারতের এক প্রাচীন জনপদে—কোশল। আজকের অযোধ্যা, যা একসময় শুধু ধর্ম বা রাজনীতির কেন্দ্র ছিল না, বরং ছিল গোপন জ্ঞানের আধার।

স্বামী নির্শব্দানন্দ যে ‘গোপন গ্রন্থাগার’-এর কথা বলেছিলেন, তা কোনও সরকারি রেকর্ডে নেই। অন্বেষা বহু পুরাতাত্ত্বিক পত্রিকা ঘেঁটে খুঁজে বের করে এক obscure reference: কোশলের দক্ষিণ প্রান্তে, সরযূ নদীর ধারে একটি প্রাচীন গুহা-মন্দিরে খোদাই করা আছে ‘নবলোক’ নামক একটি চিহ্ন। কিংবদন্তি অনুযায়ী, সেখানেই একসময় “নাইন আননোন মেন” নিজেদের গোপন সভা বসাতো।

তারা পৌঁছে অযোধ্যা। জনবহুল শহরের গণ্ডি পেরিয়ে দক্ষিণে চলে আসে একটি পরিত্যক্ত প্রান্তরে, যেখানে বহু প্রাচীন ইঁটের ধ্বংসাবশেষ। সূর্য তখন অস্ত যাচ্ছে। অন্বেষার চোখ পড়ে একটি দগদগে ইঁটের গায়ে খোদাই চিহ্নে—নয়টি বিন্দু, ঘূর্ণাবর্তে সাজানো। সেই প্রতীক যে তারা আগেও দেখেছে চাকতির কেন্দ্রে।

পাথরের নিচে খোঁড়াখুঁড়ি করে বের হয় একটি সরু গুহার পথ। বাতাস ঠান্ডা, ভেতরে নেমে গেলে শুধু শোনা যায় নিজেদের নিঃশ্বাস।

গুহার শেষ মাথায় তারা দেখে এক বিশাল গোল কক্ষ, মাঝখানে একটি মঞ্চ। চারদিকে দেয়ালে খোদাই—

“যে চারে পথ খোলে, সে নবের দিকে যায়। যে নয় জানে, সে ইতিহাস নয়, ভবিষ্যৎ লেখে।”

মঞ্চের মাঝে রয়েছে এক আধখোলা গোল খাঁজ। অন্বেষা চার উপাদানের সংযুক্ত ধাতবচাকতি সেই খাঁজে রাখে।

হঠাৎ শব্দ—গুড়গুড় করে মাটি কাঁপে।

মেঝের নিচ থেকে উঠে আসে একটি ধাতব অভিজ্ঞান যন্ত্র। দেখতে একটি জ্যোতির্বিজ্ঞানের প্রাচীন যন্ত্রের মতো—তাতে চার দিকের চিহ্ন (পৃথিবী, জল, বায়ু, আগুন), এবং মাঝখানে ঘূর্ণায়মান কাচের গোলক, যাতে ধরা পড়ে এক মায়াবী চিত্র।

দিব্যজ্যোতি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে বলে, “এটা কি একধরনের পুরানো প্রজেকশন ডিভাইস?”

যন্ত্রটি হঠাৎ আলো ছড়ায়। মেঝেতে ভেসে ওঠে এক মানচিত্র—ভারতের নয়টি জায়গা, প্রতিটিতে জ্বলছে একটি লাল বিন্দু। অন্বেষা অবাক হয়ে বলে, “এটা কি নবজ্ঞান রক্ষাকারীদের অবস্থান?”

তাদের সামনে ভেসে ওঠে এক বাক্য:

“নবচক্র আবার জাগবে, যদি উত্তরাধিকারী প্রস্তুত থাকে।”

এরপর আরেকটি বার্তা—সম্রাট অশোকের এক অলিখিত আদেশ, যা সম্ভবত শুধু নাইন আননোন মেন-দের জন্য ছিল:

“একদিন কেউ আসবে, যিনি নবচক্রকে পুনরুজ্জীবিত করবেন। তার কাজ হবে জ্ঞানকে সুরক্ষিত রাখা, অন্ধকারের আগমন ঠেকানো।”

অন্বেষার গলায় কাঁপন। “আমরা কি সেই উত্তরাধিকারী? না, আমরা শুধু বাহক?”

দিব্যজ্যোতি বলে, “হয়তো দুটোই। সত্যকে বহন করাই কখনও কখনও সত্য গড়ার প্রথম ধাপ।”

অন্ধকারের দূতেরা

নয়টি লাল বিন্দু—নবচক্রের অবস্থান। অন্বেষা ও দিব্যজ্যোতি জানে, তাদের এখন সেই স্থানগুলির খোঁজে যেতে হবে। তবে কেবল অনুসন্ধান নয়, তাদের বুঝতে হবে কেন এই চক্র আজও সক্রিয়, এবং কে বা কারা চেষ্টা করছে একে ধ্বংস করতে।

তারা প্রথমে যায় কলকাতার কাছে মায়াপুর, যেখানে গঙ্গার তীরে একটি পুরাতন তাম্রলিপি বিদ্যালয় ছিল। সেখানকার আর্কাইভ ঘেঁটে তারা পায় ১৮৪৭ সালের একটি রিপোর্ট—“মায়াপুর ষড়যন্ত্র”, যেখানে বলা হয়েছিল এক রহস্যময় গোষ্ঠী কিছু প্রাচীন পাণ্ডুলিপি চুরি করে নিয়েছিল, যেগুলোর বিষয় ছিল “মানবচেতনার নিয়ন্ত্রণ”।

অন্বেষা বিস্মিত। “তবে কি কেউ নবচক্রের জ্ঞানকে অস্ত্র বানাতে চায়?”

এরপর তারা যায় নাসিক, যেখানে একটি গুপ্ত পাহাড়ি কুঠিরে পাওয়া যায় এক ধাতব পাত্র—ভেতরে নাইন আননোন মেনের প্রতীক। আর তার পাশে ছিন্নভিন্ন এক কাগজ, লেখা—

“তৃতীয় বৃত্ত ভেঙে গেছে। সময় এসেছে অন্ধকারকে জাগ্রত করার।”

দিব্যজ্যোতি বলে, “তবে কি কেউ চক্রের প্রতিটি কেন্দ্রে গিয়ে ধ্বংস করছে প্রাচীন জ্ঞান?”

অন্বেষা সন্দেহ করে এক রহস্যময় গোষ্ঠীকে—অভিজ্ঞান দ্যাবহ (Abhijñāndhyābha), এক আধুনিক সংগঠন যারা দাবি করে যে “সত্যের নামে ভ্রান্ত জ্ঞান ছড়িয়ে মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে” এবং তারা সেই জ্ঞান মুছে ফেলতে চায়।

এমন সময় তারা পায় এক গোপন বার্তা—এক হ্যাকার প্রেরিত, যার নাম ‘Vashishta7’। সে জানায়, নবচক্রের ছয়টি কেন্দ্র ইতিমধ্যে আক্রান্ত। শুধু তিনটি বাকি—তাদের একটি তক্ষশীলা, আজকের পাকিস্তানের একটি শহরে।

কিন্তু সীমান্ত পেরনো কঠিন। হঠাৎ এক সহায়তার হাত বাড়ায় ভারত সরকারের একটি গোপন গবেষণা শাখা—AGNI (Advanced Governance of National Intelligence)। AGNI জানায়, তারা বহু বছর ধরেই এই নবচক্রের বিষয়ে জানে, কিন্তু কিছুর অভাব ছিল—উত্তরাধিকারী।

AGNI তাদের দেয় এক প্রাচীন মানচিত্র ও কোডেড স্ক্রল, যাতে লেখা ছিল—

“যেখানে নয় মিলেছে, সেখানেই দশম জেগে উঠবে। দশম নয় একজন, নয়টি জ্ঞান একত্র করলে সেই প্রকাশ হবে।”

অন্বেষা ভাবে, “তবে কি কেউ নয়টি কেন্দ্রে পৌঁছে যদি জ্ঞান পুনরুদ্ধার করে, তবে দশম চক্র, অর্থাৎ সমগ্র জ্ঞানের কেন্দ্র, খুলে যাবে?”

তারা সিদ্ধান্ত নেয়—তারা যা-ই হোক, এখন আর থামা নেই।

কিন্তু যেই মুহূর্তে তারা এই সিদ্ধান্ত নেয়, AGNI সদর দফতরে বিস্ফোরণ ঘটে।

দৃশ্যের শেষ লাইনে দেখা যায়, একজন মুখ ঢাকা ব্যক্তি বলছে:

“চক্র খুলবে না, চক্র জ্বলে উঠবে। অন্ধকারই একমাত্র সত্য।”

তক্ষশীলার ছায়া

AGNI সদর দফতরে বিস্ফোরণের পর চারদিকে শুধু ধোঁয়া, কংক্রিটের ধ্বংসস্তূপ আর নিঃশব্দ চিৎকার। অন্বেষা ও দিব্যজ্যোতি অলৌকিকভাবে বেঁচে যায়—একটি ভূগর্ভস্থ করিডোরে আশ্রয় নিয়ে।

বাইরে বেরিয়ে তারা দেখে গোটা ভবন ধ্বংস। পুলিশ ও সংবাদমাধ্যম ঘটনাকে “গ্যাস লিক” বলেই চালিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু তারা জানে, এটি পরিকল্পিত হামলা—অভিজ্ঞান দ্যাবহ-এর ইশারা।

AGNI’র একজন আহত কর্মকর্তা, কোডনেম “ভারদ্বাজ”, তাদের হাতে তুলে দেয় এক অমূল্য বস্তু—একটি তক্ষশীলার স্ক্রল। এতে লেখা একটি রহস্যময় শ্লোক:

“যে দেখে শূন্যে, তার চোখ জ্বলে;
যে রাখে শূন্য বক্ষে, তার হৃদয় জ্ঞান পায়।”

ভারদ্বাজ ফিসফিস করে বলে, “তোমাদের যেতে হবে তক্ষশীলা—শেষ তিন চক্রের একটি ওখানেই। কিন্তু সাবধান, ওরা ওখানেই অপেক্ষা করছে।”

তক্ষশীলা আজ পাকিস্তানে, রাওয়ালপিন্ডি জেলার কাছে। অন্বেষা ও দিব্যজ্যোতি ভিসা নিয়ে সীমান্ত পার হওয়া অসম্ভব জানে, তাই তারা যোগাযোগ করে এক প্রাচীন ইতিহাস গবেষক ও প্রাক্তন সাংবাদিক আলতাফ সাদিক-এর সঙ্গে, যিনি তক্ষশীলার ধ্বংসাবশেষ নিয়ে গবেষণা করেন।

আলতাফ জানেন, পাহাড়ের ঢালে একটি গুহা আছে, যার খোঁজ অধিকাংশ পর্যটকই জানে না। সেই গুহার মধ্যেই ছিল প্রাচীন তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ের গুপ্তাগার, যেখানে রাখা ছিল জ্ঞানচক্রের একটি কেন্দ্র।

তারা ছদ্মবেশে পাকিস্তান প্রবেশ করে, আলতাফের সাহায্যে পৌঁছায় সেই গুহা।

ভেতরে প্রবেশ করতেই তারা দেখে প্রাচীন দেয়ালে খোদাই করা—এক চক্র, যার চারপাশে নয়টি রেখা, আর তার মাঝে লেখা:

“চক্র নয়, আত্মা। শরীর নয়, দৃষ্টি।”

গুহার মেঝেতে রয়েছে ছাই। অন্বেষা সেখানে খুঁজে পায় এক ভস্মীভূত ধাতব বাক্স, যার পাশে ছড়ানো কিছু ছেঁড়া কাগজ। একটি কাগজে লেখা—

“তিনটি কেন্দ্র ধ্বংস। অন্ধকার পূর্ণ হতে চলেছে। দশম চক্র খুললেই সমাপ্তি।”

হঠাৎ গুহার ছায়া থেকে বেরিয়ে আসে মুখঢাকা দুই ব্যক্তি। তারা বলে, “তোমরা খুব দেরি করেছ। আমরা নব নয় চাই না, আমরা চক্র শেষ করতে চাই।”

অন্বেষা ও দিব্যজ্যোতি পালিয়ে গুহার গভীরে চলে যায়। সেখানেই তারা দেখতে পায় প্রাচীন এক গোলক যন্ত্র—অর্ধেকটা ধ্বংস, তবুও এক অদ্ভুত আলোকরশ্মি ছড়িয়ে দিচ্ছে।

দিব্যজ্যোতি সেই গোলকে হাত রাখতেই তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে দশম চক্র-এর প্রতীক—এক নক্ষত্ররূপী চিহ্ন।

দৃশ্যপট পাল্টে যায়।

সে দেখতে পায় ভবিষ্যৎ—বিশ্ব জুড়ে জ্ঞান বিনাশের আগুন, ভুয়ো তথ্যের বন্যা, ইতিহাসকে বিকৃত করে ক্ষমতা দখলের খেলা।

কিন্তু একই সঙ্গে দেখতে পায় এক রশ্মি—এক চক্র, যেটি যদি পূর্ণ হয়, তবে জ্ঞান আবার আলোকিত করবে পৃথিবীকে।

দৃশ্য থেমে যায়। যন্ত্র নিস্তব্ধ।

অন্বেষা বলে, “আমরা শুধু ইতিহাস উদ্ধার করছি না। আমরা ভবিষ্যৎ বাঁচানোর জন্য লড়ছি।”

হিমালয়ের নীচে

অন্বেষা ও দিব্যজ্যোতি যখন তক্ষশীলার রহস্যময় গুহা থেকে ফিরে আসছিলেন, তখন তাদের মনে গুঞ্জরিত হচ্ছিল নবজ্ঞান চক্রের শেষ দুটি কেন্দ্র কোথায় লুকিয়ে থাকতে পারে। যন্ত্রের মানচিত্রে স্পষ্ট ছিল, একটির অবস্থান হিমালয়ের গুহার অন্তরালে, অন্যটি আবার ছিল সমুদ্রের তলে — দ্বারকার ধ্বংসপ্রাপ্ত শহরের অধীনে। এই দুই স্থানের সন্ধান পেতে হলে তাদের ভীষণ কঠিন পথ পাড়ি দিতে হবে।

বাড়ি ফেরার পথে তারা গোপনে আলতাফ সাদিকের সঙ্গে যোগাযোগ করে। আলতাফ তাঁদের জানায়, হিমালয়ের সেই গুহা যেটা হাজার বছর ধরে অজানা থেকে গিয়েছিল, সেখানে পৌঁছানোর পথ বর্ণময় কিন্তু বিপদে পরিপূর্ণ। তাছাড়া, স্থানীয় গ্রামগুলোতে এখনও পুরনো কুসংস্কার ও ভয়ের ছায়া বিরাজ করে, যেগুলো নাইন আননোন মেন-এর জ্ঞান রক্ষার ইতিহাসের গোপন অংশ।

অন্বেষা ও দিব্যজ্যোতি তাই প্রস্তুত হয় পরবর্তী যাত্রার জন্য। তারা ছুটে চলেন উত্তর দিকে, হিমালয়ের এক প্রত্যন্ত গ্রাম “মন্দারখানি”। ছোট্ট গ্রামটি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা হলেও, এখানকার মানুষদের মুখে এক ভীতির ছায়া ছিল। তাদের কাছে নবজ্ঞান চক্রের কথা আলোচনা করলেই পুরোনো ভয় আর বিশ্বাসের মিশ্রণ দেখা যায়।

গ্রামের প্রবীণদের সঙ্গে কথোপকথনের সময় তারা জানতে পারে, বহু প্রজন্ম আগে এক ঋষি এখানে এসেছিলেন। সেই ঋষি ছিলেন নবজ্ঞান রক্ষকদের বংশধর। তিনি গুহার ভেতরে গোপনীয়তা বজায় রাখতে নিয়ম করেছিলেন, যাতে কেউ সহজেই সেখানে প্রবেশ করতে না পারে। ঋষির নাম ছিল মহানন্দ। গ্রামবাসীরা বিশ্বাস করত তিনি আজও গুহার মধ্যে আত্মার মতো উপস্থিত আছেন, যারা দুষ্ট শক্তিকে বিরত রাখতে সাহায্য করেন।

অন্বেষা ও দিব্যজ্যোতি গ্রামের স্থানীয় এক বৃদ্ধের হাত ধরে সেই গুহার দিকে রওনা হয়। পথ দীর্ঘ, হিমশীতল বাতাসে থরথর করে শরীর। পাহাড়ি রাস্তা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। গাছপালা পাতাগুলো বাতাসে গাঢ় শব্দ করে।

দুপুরের সময় তারা পৌঁছায় গুহার মুখে। গুহার মুখ ছিল চোখে অদৃশ্য যেন, বরফে ঢাকা। প্রবেশ পথ সংকীর্ণ, এবং গুহার ভেতর অন্ধকার, কেবল মোমবাতি আর ফ্ল্যাশলাইটের আলোয় পথ দেখছিলেন তারা।

ভেতরে ঢুকে অন্বেষা ও দিব্যজ্যোতি দেখতে পান প্রাচীন দেয়ালে খোদাই করা আছে নানা চিত্র ও বর্ণমালা, যেগুলোকে তারা আগেও কোথাও দেখেননি। দেয়ালের আঁকাবাঁকা রেখাগুলো যেন গানের মতো বাজছিল, যেখানে বিদ্যার সুর বেজে উঠছিল অচেনা ভাষায়।

গুহার গভীরে প্রবেশ করার পর তারা দেখতে পান এক বিশাল পাথরের মঞ্চ। মঞ্চের ওপর এক পুরানো ধাতব বাক্স রাখা, যা বেষ্টিত এক অদ্ভুত আলো দ্বারা। বাক্সের গায়ে খোদাই করা ছিল “নবজ্ঞান চক্রের অন্তিম দ্বার”।

অন্বেষা দম বন্ধ করে বাক্স খোলার চেষ্টা করেন। তাদের আশ্চর্য হলো, বাক্সটি ছিল এক জটিল ধাতব খাঁচায় আবদ্ধ, যেটা খুলতে হলে প্রয়োজন ছিল তাদের আগে পাওয়া চারটি ধাতব চাকতি এবং কোডেড সংকেত।

তারা একত্রিত করে সেই যন্ত্রাংশগুলো, আর সেই সঙ্গে স্মৃতির গভীরে থাকা কোড মোডিউল প্রয়োগ করে। ধীরে ধীরে বাক্স খুলে গেল, এবং তার ভেতর থেকে ঝলমল এক আলোর রশ্মি বেরিয়ে এল, যা পুরো গুহাকে আলোকিত করল।

বাক্সের ভিতরে ছিল একটি বিশেষ অংকন—নবজ্ঞান চক্রের একটি সংকেত, যেটা আগের যন্ত্রের সাথে যুক্ত হয়ে তৃতীয় মাত্রায় পৌঁছেছে। সেই সংকেতে লুকানো ছিল চক্রের শক্তি এবং জ্ঞানের সমষ্টি, যা সমগ্র নবচক্রের কার্যকারিতা নিয়ন্ত্রণ করতো।

কিন্তু সেই সময়, গুহার বাইরে হঠাৎ অন্ধকার ছড়িয়ে পড়ল। মুখ ঢাকা কয়েকজন ব্যক্তি ঢুকে পড়ল গুহায়। তারা ছিলেন “অভিজ্ঞান দ্যাবহ”-এর গুপ্তযোদ্ধা, যারা নবজ্ঞান চক্র ধ্বংস করতে sworn প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।

তারা চক্রের অন্তিম দ্বারকে ধ্বংস করতে এসেছিল।

এক মহাযুদ্ধ শুরু হলো গুহার ভেতরে। অন্বেষা, দিব্যজ্যোতি ও বৃদ্ধ ঋষি মহানন্দ ঐ যোদ্ধাদের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করলেন। মোমবাতি থেকে আগুন, লাঠি থেকে ছুরি—সব কিছুই যুদ্ধের অস্ত্র।

অন্বেষার মনে হচ্ছিল, এই যুদ্ধে তারা শুধু নিজেকে রক্ষা করছে না, বরং ইতিহাস ও মানবতার ভবিষ্যৎ বাঁচাচ্ছে।

বৃদ্ধ ঋষি মহানন্দ তাঁর প্রাচীন তন্ত্রমন্ত্র উচ্চারণ করলেন, যার ফলে গুহার দেয়ালগুলো থেকে আলোকরশ্মি ছড়াতে শুরু করল, যা যুদ্ধের অন্ধকারকে কিছুটা হালকা করল।

শেষ মুহূর্তে, অন্বেষা ও দিব্যজ্যোতি নির্ধারিত সংকেত অনুযায়ী ধাতব চক্রটি গুহার মধ্যকার যন্ত্রে স্থাপন করলেন। যন্ত্রটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে সক্রিয় হয়ে উঠল, এবং একটি ঝলমলানো আলোতে গুহাটিকে ঘিরে দিল।

মুখ ঢাকা আক্রমণকারীরা হতবাক হয়ে ছুটে গেল, আর গুহায় ফিরে আসে শান্তি।

অন্বেষা বুঝতে পারলেন, নবজ্ঞান চক্রের এই অংশটি রক্ষা পেলেও যুদ্ধ এখনও শেষ হয়নি। তাদের সামনে অপেক্ষা করছে দ্বারকার সমুদ্রের তলদেশে অবস্থিত শেষ কেন্দ্র।

তিনি বললেন, “এখন আমাদের শেষ যাত্রার জন্য প্রস্তুত হতে হবে। ইতিহাসের এই গোপন দরজা খুলে দিতে হলে, আমাদের সাহস আর জ্ঞানের সঙ্গে লড়তে হবে অজানাকে।”

দিব্যজ্যোতি তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে বললেন, “আমরা থামবো না। যত কঠিন পথই আসুক, সত্যের জ্বালা আমাদের পথপ্রদর্শক।”

শীতের হিমশীতল বাতাসে গুহা থেকে বেরিয়ে আসা তাদের পা ভারী হলেও মন শক্ত। তারা জানতেন, শেষ যাত্রাটি হবে সবচেয়ে বিপজ্জনক, যেখানে শুধু শারীরিক শক্তিই নয়, আত্মার জোরই হবে তাদের একমাত্র আশ্রয়।

দ্বারকার গোপন সমুদ্র তলস্থ গুহা

হিমালয়ের বরফ জমে থাকা গুহা থেকে ফিরে এসে, অন্বেষা ও দিব্যজ্যোতির মন কেবল একটাই জায়গায় স্থির—দ্বারকার ধ্বংসপ্রাপ্ত শহরের গভীরে লুকানো গোপন গুহায়। নবজ্ঞান চক্রের শেষ কেন্দ্র সেই সমুদ্রের তলে নিহিত। সেই কেন্দ্র খুঁজে পেতে হলে তাদের ঝুঁকির সাগর পাড়ি দিতে হবে, যেখানে ইতিহাস আর আধুনিকতার সংঘর্ষ লুকিয়ে আছে।

তারা পুনরায় আলতাফ সাদিকের সাথে যোগাযোগ করলো, যিনি পাকিস্তানের বাইরে থেকে তাঁদের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন। আলতাফ জানালেন, দ্বারকার ধ্বংসাবশেষের নিচে এক গুহা রয়েছে, যেটি এখনও খুব কম মানুষই প্রবেশ করেছে। গুহার মুখের প্রবেশদ্বারে হাজার বছরের পুরোনো প্রাচীন লিপি খোদাই করা আছে, যা নবজ্ঞান চক্রের সংরক্ষণের প্রমাণ বহন করে।

সীমানা পেরোনোর ঝুঁকি উপেক্ষা করে, অন্বেষা, দিব্যজ্যোতি ও আলতাফ পাকিস্তানের সীমান্ত পেরিয়ে পৌঁছালেন দ্বারকার ধ্বংসপ্রাপ্ত স্থান।

তাদের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল এক বিস্ময়কর দৃশ্য—সমুদ্রের নিচে অনেকটাই ধ্বংসস্তূপ, যেখানে পুরাতন মন্দিরের কিছু অংশ, প্রাচীন স্থাপত্য এবং সেই সঙ্গে আধুনিক গবেষণাগারের ছোট ছোট অবশিষ্টাংশ।

তারা সাঁতার কাটতে সক্ষম এক দল ডাইভার ও আর্কিওলজিস্টের সঙ্গে যোগাযোগ করল, যারা তাদের জন্য বিশেষ সুরক্ষা ও গাইডেন্সের ব্যবস্থা করলেন।

গভীর সমুদ্রের নিচে প্রবেশ করার আগে, অন্বেষা একটি গভীর শ্বাস নিলেন—“এখানে ইতিহাস নিঃশ্বাস ফেলে, আর আমরা সেই নিঃশ্বাস ধরতে যাচ্ছি।”

তারা ঢুকল সমুদ্রের তলদেশের গুহায়। গুহার ভিতর অদ্ভুত এক শান্তি, কিন্তু একের পর এক শিলাগুলো থেকে প্রতিধ্বনি হচ্ছিল ইতিহাসের কণ্ঠস্বর। গুহার দেয়ালে খোদাই করা ছিল নাইন আননোন মেনের বিভিন্ন প্রতীক ও সংকেত, যা তাদের যাত্রাকে আরও কঠিন করে তোলে।

তারা খুঁজে পেল এক ধাতব বাক্স, যেটা ছিল নাইন আননোন মেনের শেষ ও সবচেয়ে শক্তিশালী জ্ঞানের সংরক্ষক। বাক্সের উপরে একটি কোড ছিল, যা আগের অধ্যায়ে পাওয়া সংকেতের সাথে মিল ছিল।

দিব্যজ্যোতি দ্রুত কোড ডিকোড করতে শুরু করলেন। কোডের ভেতরে ছিল এমন তথ্য যা নবজ্ঞান চক্রের সম্পূর্ণ গোপনীয়তা প্রকাশ করে—কিভাবে সম্রাট অশোক নবজ্ঞানকে মানবজাতির কল্যাণে ব্যবহার করতেন, এবং কিভাবে সেই জ্ঞান ভুল পথে গেলে বিপর্যয় ডেকে আনবে।

তাদের বুঝতে পারলেন, নবজ্ঞান চক্র শুধুমাত্র প্রাচীন বিদ্যা নয়, এটি একটি শক্তিশালী ক্ষমতা, যা যদি সঠিক হাতে না পড়ে, তবে তা ভয়ংকর পরিণতি ডেকে আনতে পারে।

হঠাৎ, গুহার গভীরে ধ্বনি এল—এক ধরনের সংকেত, যা অন্যায় উদ্দেশ্যে জ্ঞানকে হাতিয়ার করার চেষ্টা করছে এমন কাউকে সতর্ক করার জন্য ছিল।

তারা বুঝতে পারলেন, অভিজ্ঞান দ্যাবহ-এর দল আবারও তাদের অনুসরণ করছে এবং শেষবারের মতো চক্রটি ধ্বংস করার চেষ্টায় রয়েছে।

তারা দ্রুত সেই ধাতব বাক্সটি নিয়ে প্রস্তুতি নিলেন। কিন্তু গুহার এক প্রান্ত থেকে প্রবাহিত পানি হঠাৎ বেড়ে গেল এবং গুহার কিছু অংশ স্লিপারির হয়ে ওঠে।

দিব্যজ্যোতি সতর্ক করে বললেন, “এখানে ধীরে ধীরে চলতে হবে, একটু ভুল আমাদের শেষ করতে পারে।”

তারা গুহার গভীরে প্রবেশ করলে দেখতে পেলেন, গুহার কেন্দ্রে অবস্থিত ছিল একটি প্রাচীন যন্ত্র—একটি গোলকাকার যন্ত্র যা নবজ্ঞান চক্রের শক্তিকে ধারণ করে।

অন্বেষা যন্ত্রের স্পর্শে অনুভব করলেন সেই শক্তির নিঃশ্বাস, যা ছিল মানব ইতিহাসের এক অনন্য গোপনতা।

কিন্তু সে সঙ্গে সেই মুখ ঢাকা ছায়ারা পুনরায় তাদের সামনে আসল, যারা নবজ্ঞান চক্রের জ্ঞানকে ধ্বংস করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।

এক চরম সংঘর্ষ শুরু হলো গুহার ভেতরে। জল ঢুকে পড়া, শিলাগুলো পড়ে যাওয়ার আওয়াজ, আর তাদের চিৎকার—সব মিলিয়ে সৃষ্টি করেছিল এক ভয়ঙ্কর যুদ্ধক্ষেত্র।

তাদের সাহস ও জ্ঞান দিয়ে লড়াই করেও ছায়ারা শেষ পর্যন্ত তাদের ঘিরে ফেলে।

এক মুহূর্তে, অন্বেষা বুঝতে পারলেন, তারা শুধু নিজেদের জন্য নয়, সমগ্র মানবতার জন্য লড়াই করছে। সেই শক্তি ধরে রাখতে হবে, যতই বিপদ আসুক।

দিব্যজ্যোতির সহযোগিতায়, অন্বেষা সেই গোলকের মধ্যে ধাতব বাক্সটি স্থাপন করলেন। যন্ত্রটি জ্বলে উঠল অদ্ভুত এক আলোতে, যা ছায়াদের কিছুটা পরাস্ত করল।

আসলে, নবজ্ঞান চক্রের শক্তি ছিল ঐক্য ও বিশ্বাসের প্রতীক। যতক্ষণ তা একত্রিত থাকবে, ততক্ষণ অন্ধকার কখনো জয়ী হতে পারবে না।

যুদ্ধের পর, ছায়ারা পালিয়ে গেলেও অন্বেষা জানতেন, এই লড়াই শেষ নয়। নবজ্ঞান চক্রের রহস্য এখনও পূর্ণরূপে উন্মোচিত হয়নি।

তারা গুহা থেকে বেরিয়ে সমুদ্রের নীল জলরাশির দিকে তাকালেন। ইতিহাস ও রহস্যের এই যাত্রা কেবল শুরুর পথে।

অন্বেষা বললেন, “আমাদের এখন ফিরে যেতে হবে, জ্ঞানের প্রতিটি টুকরো সংরক্ষণ করতে।”

দিব্যজ্যোতি সম্মত হলেন, “সত্যের পথে অন্ধকার যতই আসুক, আমাদের সাহসই হবে দীপ।”

তারা জানতেন, ইতিহাসের এই রহস্যের যাত্রা মানুষের চিন্তাকে বদলে দেবে, এবং সম্ভবত একটি নতুন যুগের সূচনা করবে।

 

নবজ্ঞান চক্রের জটিলতা ও ষড়যন্ত্র

দ্বারকার গুহার বিপদসীমা পেরিয়ে ফিরে আসার পর অন্বেষা, দিব্যজ্যোতি ও আলতাফ বুঝতে পারলেন নবজ্ঞান চক্রের রহস্য শুধু প্রাচীন ইতিহাস নয়, বরং আধুনিক সমাজের গোপন ষড়যন্ত্রের কেন্দ্রে আছে। এই শক্তি যারা নিয়ন্ত্রণ করে, তারাই বিশ্বের বিভিন্ন ক্ষমতাকে চালিত করে।

অন্বেষার মনে হচ্ছিল, সম্রাট অশোকের সেই নাইন আননোন মেন শুধু ইতিহাসের পাতায় নয়, বরং আজকের আধুনিক প্রযুক্তি, তথ্য ও শক্তির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। এই জ্ঞানের ব্যবহারে হয়তো কেউ চাইছে পৃথিবীর নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার চক্রান্ত।

তারা তিনজনের লক্ষ্য এখন শুধু গোপন জ্ঞান উদ্ধার নয়, বরং বুঝতে হবে কে এই শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করছে, এবং তাদের উদ্দেশ্য কি।

অল্টাফের সংগ্রহ করা তথ্য থেকে তারা জানতে পারে, আধুনিক সময়ে “অভিজ্ঞান দ্যাবহ” নামক গোপন সংঘের হাত রয়েছে এই নাইন আননোন মেনের জ্ঞানে। এই গোষ্ঠী অন্ধকার শক্তির প্রতিনিধিত্ব করে, যারা নিজেদের স্বার্থে মানবজগতের নিয়ন্ত্রণ চায়।

অন্বেষা ও তার সঙ্গীরা বুঝলেন, তাদের নিরাপত্তা ঝুঁকিতে রয়েছে। তাই তারা দেশের বাইরে, একটি নির্জন পাহাড়ের কুটিরে গোপনে তথ্য বিশ্লেষণ শুরু করলেন।

তাদের হাতে ছিল ধাতব বাক্স, গুহার দেয়ালে খোদাই করা লিপি, আর কোডেড সংকেত যা নতুন যুগের গোপন প্রযুক্তি নির্দেশ করে।

তাদের গবেষণার প্রথম অংশ ছিল ধাতব বাক্সের মধ্যে থাকা সংকেত ব্যাখ্যা করা। কোডগুলো ছিল এক ধরণের প্রাচীন গাণিতিক সূত্র, যা আজকের আধুনিক কম্পিউটার এনক্রিপশনের পূর্বসূরী।

দিব্যজ্যোতি দিন-রাত পরিশ্রম করে সেই সূত্রকে বিশ্লেষণ করলেন, আর ধীরে ধীরে তারা জানতে পারলেন, নবজ্ঞান চক্র শুধুমাত্র বিদ্যার সংগম নয়, বরং তা নিয়ন্ত্রণ করে পৃথিবীর চারটি প্রধান শক্তি—শক্তি, তথ্য, অর্থ, এবং সময়।

এই চার শক্তির মধ্যে সামঞ্জস্য বজায় রাখাই ছিল নাইন আননোন মেনের প্রকৃত উদ্দেশ্য।

কিন্তু আধুনিক যুগে, “অভিজ্ঞান দ্যাবহ” এই চক্রের ভারসাম্য নষ্ট করার চেষ্টা করছে। তারা চার শক্তির মধ্যে একটি নিয়ে একচেটিয়া আধিপত্য স্থাপন চাইছে—তাই তারা জ্ঞানের বিতরণ বন্ধ করে দিতে চাইছে।

এই বুঝতে পেরে, অন্বেষা চিন্তিত হলেন। তিনি বললেন, “আমাদের কাজ শুধু গবেষণা নয়, আমাদের বাধা দিতে হবে যারা এই শক্তিকে ভুল পথে ব্যবহার করতে চায়।”

অল্টাফ জানান, তাদের তথ্য ফাঁস হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, তাই তারা তাদের অবস্থান গোপন রাখতে হবে।

একদিন, দিব্যজ্যোতি তাঁর ল্যাবের কম্পিউটারে হঠাৎ একটি সাইবার আক্রমণের সন্ধান পায়। কেউ তাদের গবেষণা তথ্য চুরি করার চেষ্টা করছে।

এমন সময় অন্বেষার স্মৃতিতে ভেসে উঠে সেই মুখঢাকা ছায়াদের মুখ। “অভিজ্ঞান দ্যাবহ” তাদের এত কাছে এসে গেছে।

সতর্ক হয়ে, তারা তাদের ল্যাব সরিয়ে নিয়ে যায় একটি আরও নিরাপদ স্থানে। কিন্তু তাদের জানিয়ে দেয়ার সময় নেই।

তারা গোপনে পরিকল্পনা করল, নবজ্ঞান চক্রের শক্তি পুনরায় সুরক্ষিত করতে হবে। এর জন্য তাদের প্রয়োজন হবে ইতিহাসের সব সঠিক তথ্য সংগ্রহ ও প্রচার করার, যাতে সাধারণ মানুষও জানে এই শক্তির গুরুত্ব।

একসাথে, তারা সিদ্ধান্ত নিলেন নবজ্ঞান চক্রের সঠিক ইতিহাস ও তথ্যগুলি সাধারণ মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিতে।

কিন্তু কীভাবে?

অন্বেষা একটি পুরানো দৈনিক পত্রিকা ও অনলাইন ব্লগ শুরু করার কথা ভাবলেন, যেখানে নবজ্ঞান চক্রের তথ্য নিয়ে আলোচনা হবে, আর গোপন ষড়যন্ত্র নিয়ে সতর্ক করবে।

তবে, তাদের সামনে আরেক বড়ো বাধা ছিল—“অভিজ্ঞান দ্যাবহ” তাদের ব্লগ ও সংবাদ মাধ্যম বন্ধ করে দিতে চাইবে।

এই জন্য তাদের লাগবে শক্তিশালী মিত্র, যারা সাইবার নিরাপত্তা, সাংবাদিকতা ও সমাজ সচেতনতার ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ।

অল্টাফ তাঁর যোগাযোগের মাধ্যমে কিছু গবেষক ও সাংবাদিকের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। তারা সবাই সম্মত হলেন এই মহৎ কাজের জন্য।

একসাথে, তারা গোপন একটি নেটওয়ার্ক গড়ে তুললেন, যেখানে নবজ্ঞান চক্রের তথ্য নিরাপদে রাখা হবে, এবং প্রচার করা হবে সত্যি ইতিহাস ও বিজ্ঞানের আলোকে।

তাদের কাজ শুরু হলো—গোপনে তথ্য সংগ্রহ, বিশ্লেষণ, প্রকাশনা তৈরি ও সাইবার নিরাপত্তা জোরদার।

কিন্তু কাজ যতই এগোতে লাগল, তাদের ওপর চাপ ততই বেড়ে গেল।

একদিন রাতের বেলায়, অন্বেষার বাড়ির বাইরে কেউ পর্যবেক্ষণ করতে শুরু করল। একটি অজানা গাড়ি দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল তার সামনে।

অন্বেষা ও দিব্যজ্যোতি দ্রুত বুঝতে পারলেন, তাদের জীবন বিপদে।

তারা নিজেদের নিরাপত্তার জন্য পরিকল্পনা করল, তথ্য রক্ষা ও নিজেদের সুরক্ষায় কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার।

এই সময়, অন্বেষা তার ছোট্ট নোটবুকে লিখে রাখলেন—

“ইতিহাসের প্রতিটি সত্য যে লুকিয়ে থাকে, তা একদিন আলো পায়। কিন্তু তার জন্য সাহস, সত্যনিষ্ঠা ও একতা দরকার।”

তারা জানত, নবজ্ঞান চক্রের শক্তি শুধুমাত্র তাদের হাতে নয়, মানবতার সবার অধিকার। তাই তারা এই শক্তিকে রক্ষা করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।

পরবর্তী দিনগুলোতে তাদের অভিযান আরো জোরালো হলো। তারা দেশ-বিদেশের নানা স্থান থেকে তথ্য সংগ্রহ করে, গোপন বৈঠকে ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনা নষ্ট করল।

অন্বেষা বুঝতে পারলেন, এ যুদ্ধ শুধুমাত্র জ্ঞান ও ইতিহাসের জন্য নয়, বরং মানুষের স্বাধীনতা ও ভবিষ্যতের জন্য।

তারা একসাথে বললেন—

“নবজ্ঞান চক্রের শক্তি আমাদের হাত ধরে জ্বলবে, আর অন্ধকার কখনো জয়ী হতে পারবে না।”

এইভাবেই নবজ্ঞান চক্রের রহস্য এক এক করে উন্মোচিত হলো, আর তাদের জীবন হয়ে উঠল ইতিহাস ও সত্যের কঠিন যুদ্ধে অবিচল।

নাইন আননোন মেনের শেষ উত্তরাধিকারী

নবজ্ঞান চক্রের প্রতি অন্বেষা, দিব্যজ্যোতি এবং আলতাফের গবেষণা ক্রমশ গভীরতর হচ্ছিল। তারা জানতেন, নাইন আননোন মেনের জ্ঞান শুধু একটা গোপন গোষ্ঠী বা শক্তি নয়, বরং সেই শক্তির ধারক ছিলেন নির্দিষ্ট কেউ, যাদের উত্তরাধিকার হিসেবে ঐ জ্ঞান হস্তান্তরিত হয়। কিন্তু এদের ঠিক কারা? তারা কোথায়?

এক সন্ধ্যায়, অন্বেষার টেবিলে পড়ে থাকা এক প্রাচীন খোদাই করা পাথরের টুকরো তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করল। টুকরোর ওপর ছিল সূক্ষ্ম লিপি, যা পূর্ববর্তী অধ্যায়ে খুঁজে পাওয়া কোডের সঙ্গে মিল ছিল। দিব্যজ্যোতি দ্রুত তা ব্যাখ্যা করতে শুরু করল, আর দেখতে দেখতে তাদের সামনে উঠে এল এক অপ্রত্যাশিত সত্য।

নাইন আননোন মেনদের মধ্যে একজন, যিনি অন্যদের থেকে আলাদা ছিলেন, তিনি ছিলেন ‘শেষ উত্তরাধিকারী’। তিনি জীবিত ছিলেন না, বরং একটি গোপন দীক্ষিত সম্প্রদায়ের নাম। সেই সম্প্রদায় আজও পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে বিস্তৃত, যারা প্রাচীন বিদ্যাকে রক্ষা ও সংরক্ষণ করে আসছে।

তাদের নাম ছিল “অন্তরীক্ষ”, যারা বহুকাল ধরে মানব সভ্যতার সুরক্ষায় কাজ করছে, কিন্তু নিজেদের পরিচয় গোপন রেখে। এই সম্প্রদায়ের সদস্যরা বিশেষ ধরনের শিক্ষায় প্রস্তুত, যাদের হাত ধরেই নাইন আননোন মেনের জ্ঞান যুগ থেকে যুগে পরিপালিত হয়েছে।

অন্বেষা ও তাঁর দল বুঝতে পারল, অন্তরীক্ষের অনুসন্ধান ছাড়া নবজ্ঞান চক্রের পূর্ণ রহস্য কখনোই উন্মোচিত হবে না। অন্তরীক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করাই হবে তাদের পরবর্তী বড়ো মিশন।

তাদের তথ্য অনুসারে, অন্তরীক্ষের কেন্দ্র ছিল এক দুর্গম পাহাড়ি এলাকায়, যা একেবারে গোপন এবং প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধকতায় ঘেরা। সেখানে পৌঁছানো সহজ নয়, কারণ অন্তরীক্ষের সদস্যরা নিজেদের সুরক্ষায় একাধিক স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা করেছে।

তারা তিনজন পরিকল্পনা করল, পাহাড়ি অঞ্চলে যাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি শুরু করার।

এরই মধ্যে, আলতাফ এক গোপন সূত্র থেকে জানতে পারল যে “অভিজ্ঞান দ্যাবহ” অন্তরীক্ষের সন্ধানে রয়েছে, কারণ অন্তরীক্ষের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন হলে নবজ্ঞান চক্রের ক্ষমতা তাদের হাত থেকে সরিয়ে নেয়া সম্ভব।

তাই তাদের সময় সীমিত, শীঘ্রই কাজ শেষ করতে হবে।

অন্বেষা ভাবলেন, ইতিহাসের চেয়ে আজকের বাস্তবতা বেশি কঠিন। কিন্তু সেই কঠিন সময়েই সাহস দরকার।

পাহাড়ের যাত্রায়, তারা যে বাঁধা পেরোলেন তা ছিল মাটির নিচে লুকানো চতুর্থ মাত্রার বিপদ।

এক রাত্রি, যখন তারা ক্যাম্পে ছিল, তাদের এক অচেনা ব্যক্তির সঙ্গে সাক্ষাৎ হলো। ওই ব্যক্তি নিজেকে পরিচয় দিলেন “দীপঙ্কর”, একজন প্রাচীন তন্ত্রজ্ঞ এবং অন্তরীক্ষের একটি শাখার প্রেরিত দূত।

দীপঙ্কর তাদের বললেন, “আমি আপনাদের সাহায্য করতে এসেছি, কারণ নবজ্ঞান চক্রের ভারসাম্য রক্ষায় অন্তরীক্ষের সাথে সংযোগ অত্যন্ত জরুরি।”

দীপঙ্করের সঙ্গে তারা পাহাড়ি অঞ্চলের গোপন পথ ধরে যাত্রা শুরু করলেন।

পাহাড়ের পথ দীর্ঘ ও ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। বহুবার শিলাভঙ্গ ও বন্যপ্রাণীর ভয় পেয়ে তারা থেমে গেলেও দীপঙ্করের দিকনির্দেশনায় এগিয়ে গেলেন।

অবশেষে, এক প্রাচীন গুহার মুখোমুখি এলেন, যেখানে অন্তরীক্ষের গোপন কেন্দ্র ছিল।

গুহার প্রবেশদ্বারে ছিল আরেকটা কৌশলী সংকেত, যা দিব্যজ্যোতি দ্রুত ডিকোড করলেন।

গুহার ভিতরে প্রবেশ করলে দেখতে পেলেন বিশাল এক লাইব্রেরি, যেখানে হাজার হাজার অমর পাণ্ডুলিপি, প্রযুক্তি ও দর্শনের প্রাচীন গ্রন্থ সংরক্ষিত।

এখানেই তারা প্রথম অন্তরীক্ষের প্রধানের সাক্ষাৎ পেলেন—এক ব্যক্তি যার মুখাবরণে ছিল শান্তি ও গম্ভীরতার মিশ্রণ। তিনি বললেন, “আমরা সময়ের নিয়ন্ত্রক, যারা ইতিহাসের ক্ষয়রোধ করে নবজ্ঞান রক্ষা করি।”

তিনি জানালেন, নবজ্ঞান চক্রের প্রত্যেক শক্তি সঠিক ব্যালেন্সে থাকতে হবে, নাহলে মানবজাতির জন্য তা বিপদ ডেকে আনবে।

অন্বেষা জিজ্ঞাসা করলেন, “তবে ‘অভিজ্ঞান দ্যাবহ’ কেন এই ব্যালেন্স ভাঙার চেষ্টা করছে?”

প্রধান উত্তর দিলেন, “তারা চায় আধিপত্য; একের ওপর আর এক শক্তি স্থাপন করে পুরো পৃথিবী নিয়ন্ত্রণ করতে।”

এখানেই অন্বেষা বুঝলেন, যুদ্ধের আসল ক্ষেত্রই হবে এই শক্তির ভারসাম্য রক্ষা। অন্তরীক্ষের সহায়তায় তারাই সেই যুদ্ধের মুখোমুখি হতে পারবে।

তারা তিনজন অন্তরীক্ষের সদস্যদের প্রশিক্ষণে অংশ নিলেন, যেখানে প্রাচীন বিদ্যা ও আধুনিক প্রযুক্তির সংমিশ্রণে শক্তি অর্জনের শিক্ষা দেওয়া হচ্ছিল।

প্রশিক্ষণে তাদের শিখানো হল কিভাবে নাইন আননোন মেনের গোপন শক্তিকে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে হয়, যাতে তা কেবল সৃষ্টির কল্যাণ হয়।

কিন্তু এই প্রশিক্ষণ চলাকালীনই, তাদের কাছে একটি ভয়ের বার্তা আসে—“অভিজ্ঞান দ্যাবহ” অন্তরীক্ষের গোপন কেন্দ্র খুঁজে পেয়ে তাদের ওপর আক্রমণের পরিকল্পনা করছে।

অন্তরীক্ষের প্রধান বললেন, “এখন আমাদের একত্রিত হয়ে নিজেদের রক্ষা করতে হবে। ইতিহাসের স্বপ্ন আমাদের হাতে।”

সেই রাতেই, অন্তরীক্ষের গুহায় হামলার প্রস্তুতি শুরু হলো।

অন্বেষা, দিব্যজ্যোতি, আলতাফ ও দীপঙ্কর একসাথে যুদ্ধের কৌশল রচনা করলেন।

তারা জানতেন, এটি শুধু শারীরিক যুদ্ধ নয়, বরং তথ্য ও জ্ঞানের যুদ্ধ।

পরের দিন ভোরবেলা, “অভিজ্ঞান দ্যাবহ” এর গুপ্ত সৈন্যরা এসে উপস্থিত হলো।

সেদিন গুহার ভিতরে বিস্ফোরণ, দৌড়ঝাপ, যুদ্ধে ইতিহাস ও আধুনিকতার সংঘর্ষ ঘটলো।

অন্বেষা এবং তাঁর সঙ্গীরা কেবল অস্ত্রেই নয়, তাদের গোপন বিদ্যা ও প্রযুক্তির সাহায্যে যুদ্ধ করছিলেন।

তাদের সাহস, একতা ও বিদ্যা মিলিয়ে অন্ধকার শক্তিকে প্রতিহত করল।

যুদ্ধ শেষে অন্তরীক্ষের প্রধান বললেন, “এই বিজয় ইতিহাসের জন্য, মানবতার জন্য।”

অন্বেষা অনুভব করলেন, নবজ্ঞান চক্রের সত্যিকার যাত্রা এখান থেকেই শুরু। তাদের হাতে পৃথিবীর ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে।

এই অধ্যায় শেষে তারা অঙ্গীকার করল, নাইন আননোন মেনের জ্ঞান পৃথিবীর কল্যাণে ব্যবহার করবে, আর কেউ যাতে এই শক্তি অন্যায়ের জন্য ব্যবহার করতে না পারে তা নিশ্চিত করবে।

নবজ্ঞান চক্রের উন্মোচন ও নতুন সূচনা

নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম ও গোপন অনুসন্ধানের পর, অন্বেষা, দিব্যজ্যোতি, আলতাফ এবং অন্তরীক্ষের সদস্যরা দাঁড়ালেন এক অতি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে। নবজ্ঞান চক্রের পূর্ণ রহস্য তাদের হাতের মুঠোয়, আর এই শক্তির সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে মানবজাতির জন্য নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে—বা বিপদ সৃষ্টি হবে।

তারা জানতেন, ইতিহাসের চেয়ে বড়ো এক যুদ্ধ এখন শুরু হতে চলেছে। এটি হবে জ্ঞানের, আদর্শের, এবং নৈতিকতার যুদ্ধ। এই যুদ্ধের ফলাফল নির্ধারণ করবে পৃথিবীর ভবিষ্যৎ কেমন হবে।

নবজ্ঞান চক্র: চারটি শক্তির সামঞ্জস্য

প্রথমেই তারা নবজ্ঞান চক্রের মূল চারটি শক্তির গভীরতা বুঝতে শুরু করল—শক্তি, তথ্য, অর্থ, এবং সময়। এই চার শক্তির সঠিক ভারসাম্য রক্ষা না হলে মানব সভ্যতা অচিরেই ধ্বংসের মুখে পড়বে।

শক্তি — যা শুধু সামরিক বা শারীরিক শক্তি নয়, বরং জৈবিক ও প্রাকৃতিক শক্তির নিয়ন্ত্রণও।

তথ্য — আধুনিক প্রযুক্তি ও জ্ঞানের উৎস, যা মানুষকে শক্তিশালী করে।

অর্থ — সম্পদ, যা রাষ্ট্র, প্রতিষ্ঠান, এবং ব্যক্তির ক্ষমতার মাপকাঠি।

সময় — যা হয়তো সবচেয়ে জটিল, কারণ সময়ের ধারনা ও নিয়ন্ত্রণ মানব জীবনের গতিপথ নির্ধারণ করে।

অন্বেষা মনে করলেন, নবজ্ঞান চক্রের প্রকৃত শক্তি এখানেই—এই চারটি উপাদানের মধ্যে ভারসাম্য, যা নিয়ন্ত্রণ করলে পৃথিবীকে শান্তির পথে নিয়ে যাওয়া সম্ভব।

তাদের গবেষণার মাধ্যমে তারা জানতে পারল, ইতিহাসের বহু ধ্বংস ও সংঘাত আসলে এই ভারসাম্য ভাঙার ফল। আর নবজ্ঞান চক্র সেই ভারসাম্য রক্ষার জন্যই গড়ে উঠেছিল।

গোপন গোষ্ঠীর ঐতিহাসিক সংগ্রাম

অন্তরীক্ষের প্রধান তাদের বুঝালেন, ইতিহাসের নানা যুগে নাইন আননোন মেনরা তাদের দায়িত্ব পালন করেছেন এই ভারসাম্য রক্ষায়। তারা বিভিন্ন সভ্যতায় গোপনে কাজ করেছেন, কখনো শক্তির অপব্যবহার প্রতিহত করে, কখনো সঠিক তথ্য ছড়িয়ে দিয়ে।

তাদের অনেকেই আত্মত্যাগ করেছেন, কেউ গোপনে থেকে গেছে, কেউ আবার ইতিহাস থেকে অদৃশ্য হয়ে গেছে।

তারা জানালেন, নবজ্ঞান চক্রের ইতিহাস শুধু ভারতীয় উপমহাদেশের নয়, পৃথিবীর নানা প্রান্তের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে।

অন্বেষা বুঝতে পারলেন, তার কাজ শুধুমাত্র ইতিহাসবিদ হিসাবে নয়, বরং বর্তমান যুগের গার্ডিয়ান হিসেবেও।

“অভিজ্ঞান দ্যাবহ”—অন্ধকারের শত্রু

“অভিজ্ঞান দ্যাবহ” গোষ্ঠীটি ছিল নবজ্ঞান চক্রের সবচেয়ে বড়ো শত্রু। তারা চেয়েছিল চার শক্তির মধ্যে শুধু একটি নিজের হাতে নিয়ে পৃথিবীর একচেটিয়া শাসক হওয়া।

তারা বুদ্ধিমত্তা ও শক্তি দিয়ে বিশ্বের নানা অংশে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করেছে। তাদের হাত ছিল অর্থনীতির বড় বড় প্রতিষ্ঠান, রাজনীতির গোপন শক্তি, এবং আধুনিক প্রযুক্তির নিয়ন্ত্রণ।

এই গোষ্ঠীর উদ্দেশ্য ছিল শুধুমাত্র নিজের স্বার্থ, মানুষের কল্যাণ তাদের কাছে অপ্রাসঙ্গিক।

অন্বেষা ও তার দল জানতেন, এই গোষ্ঠীকে রুখতে হবে, না হলে পৃথিবী বড়ো এক অন্ধকারের মধ্যে হারিয়ে যাবে।

মানুষের সঙ্গে সত্যিকার যোগাযোগের প্রয়াস

অন্বেষা, দিব্যজ্যোতি, আলতাফ ও অন্তরীক্ষের সদস্যরা বুঝতে পারলেন, গোপনে যুদ্ধের পাশাপাশি দরকার মানবসমাজের সঙ্গে সৎ যোগাযোগ।

তারা একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজন করলেন যেখানে নবজ্ঞান চক্রের ইতিহাস, গুরুত্ব, এবং ভবিষ্যৎ দিশা নিয়ে আলোচনা হবে।

এই সম্মেলনে তারা বিশ্বের নানা দেশের পণ্ডিত, বিজ্ঞানী, সামাজিক কর্মী, রাজনীতিবিদ এবং সাধারণ মানুষকে আমন্ত্রণ জানালেন।

সম্মেলন ছিল এক বিশাল মঞ্চ যেখানে জ্ঞান ও সত্যের প্রচার হলো। অন্বেষার বক্তৃতা দর্শকদের মন ছুঁয়ে গেল—তিনি বললেন,

“নবজ্ঞান চক্র শুধু অতীতের ইতিহাস নয়, এটা আমাদের সবার দায়িত্বের নাম। আমাদের যদি জ্ঞান, শক্তি, অর্থ ও সময়ের ভারসাম্য রাখতে না পারি, তাহলে আমরা আমাদের ভবিষ্যতকে নিরাপদ রাখতে পারব না।”

অভিজ্ঞান দ্যাবহের চক্রান্ত ও বিপত্তি

সম্মেলনের আগেই “অভিজ্ঞান দ্যাবহ” তাদের পরিকল্পনা শুরু করল। তারা প্রচেষ্টা করল সম্মেলন বাতিল করতে, অনলাইন ও অফলাইন আক্রমণ চালাতে।

কিন্তু অন্তরীক্ষের সদস্যরা এবং অন্বেষার দল সতর্ক ছিল। তারা সম্মেলনকে আরও শক্তিশালী করার জন্য গোপনে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করল।

এক গভীর রাতে, সম্মেলনের স্থানটিতে এক বর্ণাঢ্য হ্যাকিং আক্রমণ শুরু হলো। তথ্য ও যোগাযোগ ব্যবস্থায় বিশাল ধাক্কা দেওয়া হলো।

তবে অন্তরীক্ষের প্রযুক্তিবিদরা তা প্রতিহত করলেন, আর সঙ্গে সঙ্গে তথ্যের কপি অন্য সার্ভারে সংরক্ষণ করলেন।

অন্বেষা বুঝলেন, আধুনিক যুগে জ্ঞানের যুদ্ধ শুধু অস্ত্র বা শক্তির লড়াই নয়, এটি তথ্য, প্রযুক্তি ও বিশ্বাসের লড়াই।

একটি নতুন যুগের সূচনা

সম্মেলনের শেষ দিনে, অন্বেষা, দিব্যজ্যোতি এবং আলতাফ তাদের গবেষণার সব তথ্য পেশ করলেন।

তারা জানালেন নবজ্ঞান চক্রের প্রকৃত লক্ষ্য—শান্তি ও সমতা প্রতিষ্ঠা, যেখানে শক্তি, তথ্য, অর্থ ও সময় সবার জন্য সমানভাবে থাকবে।

তারা বললেন, এই নতুন যুগের জন্য দরকার হবে সাহসী মানুষ, যারা সত্য ও ন্যায়ের পথে অটল থাকবে।

সম্মেলনের প্রতিক্রিয়া ছিল অভূতপূর্ব। বিশ্ব জুড়ে মানুষের মধ্যে নতুন সচেতনতা জন্ম নিল।

ব্যক্তিগত সংগ্রাম ও জয়

এই কঠিন যাত্রায় অন্বেষার জীবনে আসে এক অপ্রত্যাশিত মোড়। “অভিজ্ঞান দ্যাবহ” তাঁকে বিভিন্ন সময় ভয়-ভীতি দেখিয়েছে, কিন্তু তিনি কখনো দমন হননি।

নিজের পরিবার থেকে দূরে থেকেও তিনি একবাক্যে লড়াই চালিয়ে গেছেন।

দিব্যজ্যোতি ও আলতাফও নিজের দায়িত্ব পালন করেছেন নিঃস্বার্থভাবে।

তারা বুঝতে পেরেছেন, ব্যক্তিগত আত্মত্যাগ ছাড়া বিশ্ব বদলানো যায় না।

শেষ মিশন: চূড়ান্ত সত্যের উন্মোচন

সম্মেলনের পর, অন্তরীক্ষের প্রধান জানালেন একটি গোপন মিশনের কথা—নবজ্ঞান চক্রের গোপন শক্তি পুনরুদ্ধার করে তা সবার জন্য উন্মুক্ত করা।

এই শক্তি হোক শুধু একটি গোপন গোষ্ঠীর জন্য নয়, বরং মানুষের কল্যাণে ব্যবহার হবে।

তারা একটি মহা প্রকল্প শুরু করল—“জ্ঞান বৈদ্যুতিক বিশ্বমঞ্চ”, যেখানে নবজ্ঞান চক্রের গোপন তথ্য, প্রযুক্তি ও দর্শন থাকবে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত।

অন্বেষা ও তার সঙ্গীরা জানলেন, এই উদ্যোগই হবে নবজ্ঞান চক্রের সত্যিকার বিজয়।

ভবিষ্যতের আভাস

অন্বেষা পাহাড়ের এক চূড়ায় দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকালেন।

তিনি ভাবলেন, ইতিহাস যেমন লেখা হয়েছে, ঠিক তেমনি নতুন ইতিহাস গড়ে তোলা হবে।

“নবজ্ঞান চক্র এখন শুধু গোপন নয়, এটি মানুষের মাঝে বেঁচে থাকবে।”

তিনি জানতেন, যুদ্ধ শেষ হয়নি, কিন্তু নতুন আশা এবং নতুন শক্তি হাতে রয়েছে।

বিশ্ব বদলানোর সংগ্রাম নতুনভাবে শুরু হয়েছে।

 

 

 

 

1000016717.jpg

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *