অর্ঘ্যদীপ চ্যাটার্জী
এক
শ্মশানের রাতের অন্ধকারে যে ভয়ঙ্কর নীরবতা ছড়িয়ে থাকে, সেটাই যেন কালিকেশ তান্ত্রিকের সাধনার উপযুক্ত আবাস। চাঁদের আলো নেই, আকাশে ছড়ানো মেঘে মাঝে মাঝে বিদ্যুতের ঝলকানি দেখা দিচ্ছে, আর সেই ক্ষণিক আলোকেই উন্মোচিত হচ্ছে পুড়ে যাওয়া কাঠ, ছাই, হাড়গোড়, আর সদ্য নির্বাপিত চিতার ধোঁয়া। মৃতদেহের গন্ধ তখনও বাতাসে ভাসছে, কুকুর আর শেয়ালের হিংস্র ডাক শ্মশানের চারদিক থেকে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। এই ভয়াবহ পরিবেশের মাঝেই আগুনের সামনে বসে আছে কালিকেশ, গায়ে কেবল লাল রঙের কাপড়, কপালে সিঁদুরের টানা রেখা, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা। তার চোখদুটো অদ্ভুত উন্মত্ততায় জ্বলছে, ঠোঁটে নিঃশব্দ মন্ত্রের আওয়াজ। মাঝে মাঝে তার কণ্ঠে ভেসে ওঠা ভৈরব মন্ত্রের গর্জন শ্মশানের নিস্তব্ধতা ভেঙে দেয়, আর মোমবাতির ক্ষীণ আলোয় তার ছায়া যেন দ্বিগুণ আকারে বিকৃত হয়ে দেয়ালে নেচে বেড়ায়। চারদিকে যেন এক অতৃপ্ত শক্তির উপস্থিতি অনুভূত হতে থাকে। এইসবই কালিকেশের বহু বছরের সাধনার অংশ—সে জানে এই রাত তার কাছে বিশেষ, কারণ আজ সে প্রথমবার দেবীর কাছে তার গভীরতম ইচ্ছা প্রকাশ করবে।
কালিকেশের অতীত ছিল একেবারেই আলাদা। একসময় সে গ্রামে প্রখ্যাত সাধক হিসেবে পরিচিত ছিল—মানুষের অসুখ সারাত, পুজো-আর্চা করত, দেবতার কাছে প্রার্থনা জানাত। কিন্তু ধীরে ধীরে তার মনে জন্ম নেয় ভয়ংকর লালসা—ক্ষমতার প্রতি আসক্তি, মৃত্যু জয়ের ইচ্ছা। সে বুঝতে পারে, মানুষ তাকে যতই সম্মান করুক, তার ভেতরের তৃষ্ণা মেটে না। সেই কারণেই সে আজ এই পথে। একসময়ের সৎ সাধক আজ শ্মশানের অন্ধকারে বসে তন্ত্রমন্ত্র উচ্চারণ করছে, হাতে মানুষের হাড় দিয়ে বানানো খাপর, যার ভেতরে গরম তেল জ্বলছে। কালিকেশ মন্ত্রের সঙ্গে সঙ্গে নিজের রক্তের কয়েক ফোঁটা সেই আগুনে ফেলে দেয়, আর শপথ করে—“আমি অমর হবো। মৃত্যু আমার কাছে আসবে না। চামুণ্ডা আমাকে আশীর্বাদ দেবে।” তার চোখে তখন উন্মত্ত আগুন, ঠোঁটে পাগলামির হাসি। মন্ত্রোচ্চারণ চলতে থাকে, আর বাতাসে এক অদৃশ্য ভয়ের ছায়া আরও ঘন হতে থাকে। মনে হয় শ্মশানের মৃতেরা জেগে উঠেছে, যেন তারা প্রত্যেকেই তার সাধনার সাক্ষী।
এই রাতেই কালিকেশ প্রথমবার উচ্চারণ করে তার অহংকারভরা আকাঙ্ক্ষা—“আমি অমর হতে চাই।” শ্মশানের আগুন তার সামনে জ্বলতে থাকে, চারপাশের নিস্তব্ধতা যেন সেই ঘোষণা শুনে কেঁপে ওঠে। দূরে কোথাও হঠাৎ শকুনের ডাক, বাতাসে দপ করে উড়ে ওঠা আগুনের শিখা, আর কালিকেশের উন্মত্ত দৃষ্টি—সব মিলিয়ে দৃশ্যটা অস্বাভাবিক ভয়ংকর। মনে হয়, দেবী নিজেই যেন তার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন, তার লোভী মনের গভীরতা যাচাই করছেন। কালিকেশ এক মুহূর্তের জন্যও ভয় পায় না; বরং তার বুকের ভেতরে অহংকার ফুলে ওঠে। সে ভাবে, দেবী যদি তাকে আশীর্বাদ দেন, তবে মৃত্যু নামক নিয়ম সে ভেঙে দিতে পারবে। আর যদি না-ও দেন, তবে সে দেবীকে বাধ্য করবে তার শক্তি দিয়ে। এই ভাবনাই তাকে ভয়ঙ্কর করে তোলে। তার কণ্ঠ আরও তেজী হয়ে ওঠে, মন্ত্র যেন বজ্রের মতো আছড়ে পড়ে রাতের আকাশে। শ্মশানের আগুনের শিখা হঠাৎ উঁচু হয়ে ওঠে, আর কালিকেশ হাত উঁচিয়ে ঘোষণা করে—“আজ থেকে আমি মৃত্যুকে অস্বীকার করছি। আজ থেকে আমি হবো অমর।” সেই ঘোষণা শ্মশানের বাতাসে প্রতিধ্বনি তুলতে তুলতে মিলিয়ে যায়, কিন্তু তার ভেতরের পাগলামি স্থায়ী হয়ে বসে যায়। এই রাত থেকেই তার সাধনা এক নতুন মোড় নেয়—ভক্তি থেকে অহংকারে, ভয় থেকে লোভে, আর ভক্তের পথ থেকে এক নিষ্ঠুর পথিকের দিকে যাত্রা শুরু করে কালিকেশ।
দুই
শ্মশানের ভয়াবহ রাতগুলো কাটতে কাটতে একদিন কালিকেশ তান্ত্রিক তার দীর্ঘ ধ্যানের মধ্যে প্রবেশ করেছিল এমন এক স্তরে, যেখানে শরীর-মন-সমস্ত ইন্দ্রিয়ের সীমা অতিক্রম করে কেবল অদৃশ্য শক্তির উপস্থিতি অনুভব করা যায়। সেই রাতে আকাশ ছিল মেঘাচ্ছন্ন, বাতাসে পচা দেহের দুর্গন্ধ, আগুনের ছাই উড়ছিল চারদিকে। শ্মশানের মাঝখানে বসে কালিকেশ চোখ বন্ধ করে মন্ত্রোচ্চারণে ডুবে গিয়েছিল। তার চারপাশে অদ্ভুত শব্দ শোনা যাচ্ছিল—কোথাও যেন কারও কান্না, কোথাও দূরে শিয়ালের হুক্কাহুয়া, আবার কোথাও বাতাসে ভেসে আসছিল ধাতব ঝনঝন শব্দ। দীর্ঘক্ষণ ধ্যান করার পর হঠাৎ সে অনুভব করল চারপাশের অন্ধকার আরও ঘন হয়ে এসেছে। চোখ বন্ধ করেও সে দেখতে পেল ভয়ংকর এক আলোকচ্ছটা ছড়িয়ে পড়ছে, যেন দাউদাউ করে জ্বলতে থাকা আগুনের মধ্য থেকে কারও আবির্ভাব ঘটছে। কালিকেশের বুক ধড়ফড় করে উঠল, তবু সে চোখ খোলেনি। আর তখনই শোনাল বজ্রপাতের মতো এক গর্জন—সেই গর্জনই ছিল চামুণ্ডার ডাক।
চোখ মেলে কালিকেশ দেখতে পেল, শ্মশানের আগুনের ভেতর থেকে উদ্ভাসিত হয়েছে এক ভয়ঙ্করী দেবীর রূপ। তাঁর চুলগুলো ছড়িয়ে আছে আকাশ ছুঁয়ে, চোখ দুটো রক্তজ্বালা, গলায় হাড়ের মালা, হাতে খড়্গ আর খাপর। তাঁর পদতলে যেন হাজার মৃত আত্মা কাঁদছে। কালিকেশ প্রথমে বিস্মিত, তারপরই তার মধ্যে আনন্দের ঢেউ বয়ে গেল। এ তো সেই দেবী, যাকে পাওয়ার জন্য সে এতদিন সাধনা করেছে! দেবী গম্ভীর কণ্ঠে বললেন—“কালিকেশ, তোর সাধনা বৃথা যায়নি। তুই যা চাইছিস, অমরত্ব—তা আমি তোকে দিতে পারি।” কালিকেশের চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, বুক ফুলে উঠল অহংকারে। সে হাত জোড় করে চিৎকার করে উঠল—“হে মা! আমি আপনার পায়ের কাছে অমরত্ব চাই! মৃত্যুর স্পর্শ যেন আমাকে আর না ছুঁতে পারে!” দেবীর ঠোঁটে ফুটল এক রহস্যময় হাসি। তিনি বললেন—“অমরত্ব সহজ নয়। তার জন্য দিতে হবে অর্ঘ্য।” কালিকেশ প্রথমে ভেবেছিল কয়েকটা ছাগ বা মোষ বলি দিলেই হবে, তাই দ্রুত বলে উঠল—“হে মা, আমি পশুবলি দেবো। শত শত প্রাণী বলি দিয়ে আপনার সন্তুষ্টি অর্জন করব।” কিন্তু দেবী হঠাৎ প্রচণ্ড বজ্রপাতের মতো কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠলেন—“না! পশুর রক্ত আমার অর্ঘ্য নয়। আমি চাই মানুষের রক্ত, মানুষের প্রাণ। মানববলি—এই একমাত্র পথ।”
দেবীর সেই নির্দেশ শুনে কালিকেশের বুকের ভেতর কেঁপে উঠল, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে তার অহংকার ও লোভ তাকে গ্রাস করল। সে ভয় পেলেও আনন্দে মত্ত হয়ে উঠল—কারণ দেবী তাঁকে অমরত্বের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। সে বুঝল, এ এক ভয়ংকর শর্ত, কিন্তু তার জন্য সে পিছিয়ে যাবে না। তার মনে হলো, একজন মানুষ মারা গেলে কী-ই বা আসে যায়? গ্রামের লোকেরা তো তাকে যেকোনোভাবেই ভয় করে, তাদের মধ্যে কাউকে বলি দেওয়া তার পক্ষে কঠিন হবে না। দেবীর চোখে সে যেন সেই মুহূর্তে উন্মাদ ভক্তি আর লালসার মিশ্রণ দেখতে পেল। দেবী আবার বললেন—“মানুষের জীবন হলো সর্বোচ্চ অর্ঘ্য। যে ভক্ত তার প্রিয়কে আমার পায়ে সমর্পণ করতে পারে, কেবল তাকেই আমি অমরত্ব দান করি। সাহস আছে তোকে?” কালিকেশের ঠোঁটে ভেসে উঠল বিকৃত হাসি। সে মাথা নত করে বলল—“হে মা, আমি যে কোনো অর্ঘ্য দিতে প্রস্তুত। আমি অমর হবো, মৃত্যুকে জয় করব, আর পৃথিবীর মানুষ আমার সামনে মাথা নত করবে।” দেবী তখনও তার দিকে ভয়াবহ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন, যেন তাঁর চোখে আগুন জ্বলছে। আর কালিকেশ, যার মনে একসময় ভক্তির স্রোত বয়ে যেত, আজ সেই ভক্তির জায়গা দখল করেছে এক অসীম অহংকার আর রক্তপিপাসু উচ্চাকাঙ্ক্ষা। সেই রাতেই তার ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হয়ে গেল—সে মানুষ থেকে ধীরে ধীরে এক ভয়ংকর দৈত্যে রূপ নিতে শুরু করল, যার একমাত্র লক্ষ্য দেবীর জন্য মানববলি আর নিজের জন্য অমরত্ব।
তিন
চামুণ্ডার অলৌকিক আবির্ভাবের পর দিনগুলোতে গ্রাম জুড়ে যেন এক অদ্ভুত অশান্তি ছড়িয়ে পড়ল। আগে যে গ্রামে সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে মানুষজন দাওয়ায় বসে গল্প করত, ভাটপুকুরে ছেলেরা খেলাধুলো করত, গৃহস্থরা নিশ্চিন্ত মনে ঘরের কাজে মগ্ন থাকত—সেই গ্রামেই হঠাৎ অদ্ভুত ভয়ের ছায়া নেমে এল। প্রথমে শুরু হলো পশুরা হঠাৎ করে হারিয়ে যাওয়া দিয়ে। কারও উঠোন থেকে ছাগল উধাও, কারও গোয়ালঘর থেকে গরু অদৃশ্য, আবার কারও খোঁয়াড় থেকে হাঁস-মুরগি রাতারাতি মিলিয়ে যায়। গ্রামবাসীরা ভাবতে লাগল, হয়তো চোর এসেছে, কিংবা শেয়াল-ভালুকের উপদ্রব। কিন্তু শিগগিরই তারা টের পেল, ব্যাপারটা এত সহজ নয়। কারণ একদিন সকালে দেখা গেল, মাঠের মাঝখানে কাটা পশুর দেহ পড়ে আছে, চারপাশে ছড়ানো রক্ত। আরেকদিন ধানক্ষেতে পাওয়া গেল গলা ছেঁড়া এক ছাগল, যার চোখ যেন আতঙ্কে বিস্ফোরিত। এমন ভয়ংকর দৃশ্য আগে তারা কখনও দেখেনি। ভোরবেলায় গ্রাম থেকে শ্মশানের দিকে গেলে অদ্ভুত আওয়াজ শোনা যেত—কখনও গম্ভীর মন্ত্রোচ্চারণ, কখনও ভৌতিক হাসি, আবার কখনও এমন শব্দ, যেন কেউ কেঁদে চলেছে। গ্রামবাসীরা রাতে আর বাইরে বেরোতে সাহস করত না। বাড়ির দরজা-জানালা বন্ধ করে শিউরে কেঁপে শুয়ে থাকত।
এই ভয়ের মাঝেই গ্রামে বড় হতে থাকা এক তরুণী মেঘলার দিকে কালিকেশ তান্ত্রিকের চোখ পড়ল। মেঘলা ছিল অদ্ভুত নির্দোষ, কোমল ও পবিত্র মনে ভরপুর। প্রতিদিন ভোরে নদীর ঘাটে গিয়ে জল আনে, তারপর গ্রামমন্দিরে প্রদীপ জ্বালিয়ে দেবীর কাছে প্রার্থনা করে। তার সৌন্দর্যে যেমন স্নিগ্ধতা, তেমনি তার ভক্তিতে ছিল একরকমের নির্মল আলো, যা গ্রামের মানুষকে মুগ্ধ করত। কালিকেশ প্রথমে দূর থেকে তাকাত, কিন্তু ধীরে ধীরে তার দৃষ্টি ভয়ঙ্কর হয়ে উঠল। সে জানত দেবী চামুণ্ডা মানববলি চান, আর মেঘলার মতো নির্দোষ প্রাণ সেই অর্ঘ্যের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত। গ্রামে গুজব ছড়িয়ে পড়তে লাগল—“কালিকেশ মেঘলার দিকে কেমন নজর দিচ্ছে!” কেউ সাহস করে মুখে কিছু বলতে পারত না, কারণ কালিকেশকে সবাই ভয় করত। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শ্মশান থেকে আসা আওয়াজে গ্রামবাসীরা আরও ভয় পেতে লাগল। বাচ্চারা রাতে কাঁদত, বুড়োরা আতঙ্কে হুঁশ হারাত, আর মহিলারা একে অপরকে ফিসফিস করে বলত—“কোনও অশুভ কিছু ঘটতে চলেছে।” গ্রামের পরিবেশ এমনভাবে ভয়াবহ হয়ে উঠল, যেন প্রতিটি বাতাসে আতঙ্ক ছড়িয়ে আছে।
এই অবস্থায় এগিয়ে এলেন ধানেশ মাঝি। তিনি ছিলেন গ্রামের সবচেয়ে প্রবীণ মানুষদের একজন, ধর্মভীরু এবং দেবীর অটল ভক্ত। তিনি অনেক কিছু চোখে দেখেছেন, অনেক কাহিনি শুনেছেন। সেদিন সন্ধ্যায় গ্রামপ্রাঙ্গণে কিছু মানুষ ভয়ে একত্রিত হলে ধানেশ দৃঢ় কণ্ঠে বললেন—“এটা সাধারণ চোর-ডাকাতির কাজ নয়। আমি শ্মশান থেকে আসা আওয়াজ শুনেছি। ওটা মানুষের কণ্ঠ নয়, তান্ত্রিকের কণ্ঠ। কালিকেশ কিছু অশুভ শক্তির পথে হাঁটছে।” তাঁর এই কথায় অনেকেই শিউরে উঠল। কেউ কেউ প্রতিবাদ করল—“না দাদু, কালিকেশ তো একসময় দেবতার পূজারি ছিল, সে কি করে এমন অশুভ কাজে জড়াবে?” ধানেশ তখন গম্ভীরভাবে বললেন—“অহংকার মানুষকে কোথায় নিয়ে যায়, তুমি কি জানো? আমি দেখছি, ওর ভেতরে লালসা জন্ম নিয়েছে। দেবীর নামে ও এখন ভয়ংকর শক্তি ডাকছে। এইভাবে চলতে থাকলে শুধু পশুর প্রাণ যাবে না, মানুষের প্রাণও যাবে।” ধানেশের কথা শোনার পর গ্রামবাসীরা একে অপরের দিকে তাকিয়ে ভয়ে কাঁপতে লাগল। প্রত্যেকেই বুঝতে পারল, তাদের গ্রামের শান্তি অচিরেই ভেঙে পড়তে চলেছে, আর মেঘলা—যে সবার প্রিয়—তার জীবনে নেমে আসছে অজানা বিপদ। গ্রামের রাতগুলো আরও দীর্ঘ হয়ে উঠল, প্রতিটি নিস্তব্ধতা ভরল ভয়, আর প্রতিটি বাতাসে যেন মৃত্যু ও আতঙ্কের গন্ধ ভেসে এল।
চার
মেঘলা ছিল গ্রামটার সবচেয়ে সরল অথচ সবচেয়ে আলোকিত প্রাণী। ছোটবেলা থেকেই সে ভক্তিময় জীবনের ভিতরে বেড়ে উঠেছে। তার মা-বাবা না থাকলেও গ্রামের মানুষই তাকে আপন করে নিয়েছিল, বিশেষত মন্দিরের পুরোহিত কাশীনাথের স্ত্রী সরলা তাকে মা-এর স্নেহে মানুষ করেছিলেন। সকালবেলায় যখন প্রথম আলো মাটিকে ছুঁয়ে যায়, মেঘলাকে দেখা যায় খালি পায়ে, সাদা শাড়ি পরে, হাতে তামার প্রদীপ নিয়ে মন্দিরমুখো হতে। তার চোখে এক অদ্ভুত নির্মলতা—যেন কোনও পাপ বা কুটিলতা তার চেতনায় স্পর্শই করতে পারেনি। দেবীকে সে মা বলেই মানত, আর তার ভক্তি ছিল এমন আন্তরিক যে গ্রামের বৃদ্ধারা বলত, “মেঘলার চোখের ভক্তি একদিন দেবীকে মাটিতে নামাবে।” প্রতিদিন সে গঙ্গাজল দিয়ে মন্দিরের সিঁড়ি ধোয়, প্রদীপ জ্বালায়, আর দেবীর সামনে মাথা নোয়ায়। ভক্তির সেই আলো তার চারপাশকে পরিশুদ্ধ করত, অনেকেই বলত যে মন্দিরে মেঘলার উপস্থিতি যেন আশীর্বাদের মতো। কিন্তু তার এই নিষ্পাপ সরলতা যে একদিন তাকে সর্বনাশের দিকে ঠেলে দেবে, সে তো কল্পনাও করেনি।
অন্যদিকে, গ্রামের অন্ধকার কোণায়, সেই রহস্যময় তান্ত্রিক ক্রমে তার খেলা সাজাচ্ছিল। বহুদিন ধরে সে নাকি সাধনা করছে, এবং তার বিশ্বাস, মহাশক্তির অধিকারী হতে হলে মানববলিই একমাত্র উপায়। গ্রামে অনেক মুখই ছিল, কিন্তু তান্ত্রিকের নজর থেমেছিল মেঘলার উপর। সে জানত, নিষ্পাপ আত্মার বলি সবচেয়ে শক্তিশালী। মেঘলার ভক্তি, তার নিষ্কলুষতা, আর দেবীর প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা যেন এক অদ্ভুত আলোকবলয় তৈরি করেছে—এমন আত্মাই নাকি অশুভ যজ্ঞের জন্য শ্রেষ্ঠ। রাতের অন্ধকারে, যখন মেঘলা প্রদীপ নিভিয়ে মন্দির থেকে বাড়ি ফিরত, তখন দূরে দাঁড়িয়ে থেকে তান্ত্রিক তাকে লক্ষ্য করত। তার মনে কুটিল হাসি—সে যেন নিশ্চিত জানত যে মেয়েটি দেবীর জন্য জীবন উৎসর্গ করতে চাইলেও কখনও বুঝবে না যে তার অজান্তে তাকে অন্য এক অশুভ দেবতার কাছে বলি দেওয়া হচ্ছে। ধীরে ধীরে সে গ্রামজুড়ে গুজব ছড়াতে লাগল—দেবী রুষ্ট, দেবীর শান্তির জন্য বলি চাই। গ্রামের মানুষ ভয় পেতে শুরু করল, আর এই ভয়কে অস্ত্র করে তান্ত্রিক নিজেকে চালিত করছিল। কিন্তু মেঘলা কিছুই জানত না, সে তো নিজের মতো মন্দিরের আশ্রয়ে মগ্ন হয়ে দিন কাটাত।
এদিকে, শুভায়ন আর দীপের নজরও ধীরে ধীরে মেঘলার দিকে পড়ছিল। গ্রামের অদ্ভুত ঘটনাবলি, রাতের বাঁশির সুর, হঠাৎ করে ছায়ামূর্তি দেখা দেওয়া—সবকিছুর মাঝেই মেঘলা যেন আলাদা হয়ে দাঁড়াত। তার ভক্তি যেমন ছিল সত্য, তেমনি তাকে ঘিরে ছিল এক রহস্যের আভা। শুভায়ন মেঘলার সরল কথাবার্তা দেখে একসময় আবেগপ্রবণ হয়ে উঠেছিল—সে অনুভব করত মেয়েটি যেন আলোতে গড়া, অথচ আলোই তাকে বিপদের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। দীপ ছিল বাস্তববাদী, কিন্তু তাও সে বুঝতে পারছিল যে মেঘলাকে কেন্দ্র করেই রহস্যটা জড়িয়ে আছে। তাদের মনে প্রশ্ন জাগতে লাগল—গ্রামমন্দিরের এই নিরপরাধ পূজারিণীকে কি সত্যিই কেউ ব্যবহার করছে? নাকি অশুভ শক্তি নিজের ইচ্ছেতেই তাকে টেনে নিচ্ছে? গ্রামের মানুষ যেমন ভয়ে তান্ত্রিকের কথা বিশ্বাস করতে শুরু করেছে, তেমনই মেঘলার জন্য তাদের মনে এক গোপন শঙ্কাও জন্মাচ্ছিল। কিন্তু মেঘলা তখনও অনবগত, নিজের সরলতায় ভরা হৃদয়ে দেবীর মায়ের রূপকেই খুঁজে ফিরছিল। ঠিক তখনই অদৃশ্য ছায়া ঘনিয়ে আসছিল তার জীবনের চারপাশে—আর সেই ছায়া একদিন তাকে শিকার করতে উদ্যত হবে।
পাঁচ
স্বপ্ন আর বাস্তবের মাঝখানে দাঁড়িয়ে যেন মেঘলা বুঝতেই পারছিল না সে কোথায় আছে। চারদিক কেবল অন্ধকার, কিন্তু সেই অন্ধকারের মাঝখান থেকে জ্বলে উঠল এক অলৌকিক আলো। ধূপের গন্ধ, শঙ্খধ্বনি আর ঢাকের মতো এক অদ্ভুত শব্দ তাকে ঘিরে ধরল। হঠাৎই দেখা দিলেন চামুণ্ডা দেবী—মহাশক্তির প্রতীক, দৃষ্টিতে কঠোরতা, কিন্তু সেই কঠোরতার ভেতরে মাতৃত্বের স্নেহও লুকিয়ে আছে। দেবীর চুল উড়ছে ঝড়ের মতো, চোখদুটি অগ্নিশিখার মতো জ্বলছে, আর তাঁর গলায় ঝুলছে রুদ্রমালা। মেঘলার বুক কেঁপে উঠল, সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল, কপালে হাত জোড় করে প্রণাম করল। দেবী যেন এক অলৌকিক কণ্ঠে বললেন—“তোমার জীবন বিপদের মুখে, চারদিক থেকে অশুভ শক্তি তোমাকে গ্রাস করতে চাইছে। কিন্তু ভয় কোরো না। সত্য ভক্তকে আমি কখনো একা ফেলে দিই না। বিশ্বাস রেখো, আমার ছায়া সবসময় তোমার সঙ্গে আছে।” দেবীর সেই কণ্ঠে ভরসা থাকলেও মেঘলার চোখে ভেসে উঠল রক্ত, আগুন আর এক অদ্ভুত ছায়ামূর্তি। দেবী যেন সতর্ক করলেন—“মানুষের লোভ যখন পূজার নামে রক্ত চায়, তখন সেই পূজা আর আমার নয়। কালিকেশ যে অন্ধকারের পথে হাঁটছে, তার ফল ভয়ঙ্কর। সে চায় মানববলির মাধ্যমে আমার শক্তি পেতে, কিন্তু মনে রেখো, আমি রক্তলোলুপ নই, আমি সত্য আর ধর্মের রক্ষক।” হঠাৎই সেই স্বপ্নে বজ্রপাতের মতো আলো ঝলসে উঠল, আর দেবী অদৃশ্য হয়ে গেলেন। মেঘলা ঘাম ভিজে বিছানা থেকে উঠে বসে রইল, বুক ধড়ফড় করছে। ভোরের আলো আসার আগে সে বুঝতে পারল—এক অদৃশ্য বিপদ তার দিকে ধেয়ে আসছে।
এদিকে কালিকেশের অবস্থা যেন আরও ভয়ানক হয়ে উঠছে। একসময় গ্রামের মানুষ তাকে গুরুজনের মতো মানত, কিন্তু এখন সে যেন অশুভ শক্তির পিশাচে পরিণত হচ্ছে। তার চোখে ভক্তির বদলে জ্বলছে লোভ, আর মস্তিষ্কে কেবল একটাই চিন্তা—কীভাবে দেবীর প্রসাদ হিসেবে পরম শক্তি অর্জন করা যায়। নিজের ঘরে বসে সে কালো ধোঁয়ায় ভরা প্রদীপ জ্বালাচ্ছে, রক্তমাখা মাটিতে অদ্ভুত চিহ্ন আঁকছে, আর বারবার মন্ত্র জপ করছে। সে বিশ্বাস করে, মানববলি ছাড়া দেবী কখনো তার সামনে অবতার হয়ে আসবেন না। দিনরাত সেই ভ্রান্ত বিশ্বাসে সে আরও অন্ধ হয়ে পড়ে। মেঘলার স্বপ্নের কথা যদি সে জানত, হয়তো আরও ক্ষিপ্ত হয়ে উঠত। সে এখন গ্রামের নিরপরাধ মানুষদের দিকে তাকিয়ে আছে বলির পাঁঠা হিসেবে। তার কল্পনায় রাতের আঁধারে মন্দিরের অগ্নিশিখার সামনে কারও রক্ত পড়ছে, আর সেই রক্তের ধোঁয়া মিলিয়ে যাচ্ছে দেবীর গলদেশে। অন্ধকার তাকে গ্রাস করেছে—যেখানে ধর্ম নেই, আছে কেবল ভয় আর হিংসা। কালিকেশ ভাবে, দেবীর কৃপা মানে শক্তি, আর শক্তি মানেই মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা। এই ক্ষমতার নেশাতেই সে মানুষকে হুমকি দিচ্ছে, বলছে—“দেবীর জন্য তোমাদের রক্ত চাই, না দিলে অমঙ্গল আসবে।” গ্রামের নিরীহ মানুষ আতঙ্কে তার কথা মানতে বাধ্য হচ্ছে, কেউ কেউ আবার গোপনে দেবীর কাছে প্রার্থনা করছে যেন এই অশুভ শক্তির হাত থেকে তারা মুক্তি পায়। কিন্তু কালিকেশের বিশ্বাস এতই অন্ধ যে সে আর কোনো যুক্তি শুনতে রাজি নয়। তার দৃষ্টি এখন কেবল বলির রাতের দিকে—যেখানে সে ভাবে দেবী তাকে অনন্ত শক্তি দেবেন।
মেঘলার মনে দেবীর সতর্কবাণী গভীরভাবে দাগ কেটে গেল। দিনভর সে কাজকর্মে ব্যস্ত থাকলেও মনে হচ্ছিল কেউ তাকে পেছন থেকে নজর রাখছে। রাত নামলেই বুক ধড়ফড় করছিল, মনে হচ্ছিল কালিকেশ তার ওপর নজর দিচ্ছে। সে স্বপ্নে বারবার দেবীর সেই অগ্নিময় দৃষ্টি আর মাতৃসুলভ কণ্ঠ শুনতে পেত—“ভয় কোরো না, আমি আছি।” কিন্তু সেই সান্ত্বনার পাশাপাশি আতঙ্কও বাড়ছিল। গ্রামের কজন মহিলাকে সে গোপনে বলল তার স্বপ্নের কথা, সবাই শিউরে উঠল। তারা জানল, কালিকেশের আসল উদ্দেশ্য কেবল পূজা নয়, কিছু ভয়ঙ্কর কুকর্ম। ধীরে ধীরে গ্রামে গুজব ছড়িয়ে পড়ল—“গুরুজি নাকি বলি দিতে চান।” এতে মানুষ আতঙ্কিত হলেও কেউ মুখ খুলতে সাহস পেল না। কারণ কালিকেশের হাতে ছিল ভয়, অশুভ মন্ত্র আর প্রভাব। কিন্তু মেঘলার মনে দ্বন্দ্ব চলতে থাকল—সে কি শুধু ভয়ে পালাবে, নাকি দেবীর ওপর ভরসা রেখে লড়বে? স্বপ্নে দেবীর সতর্কবাণী তাকে যেন এক নতুন শক্তি দিল। সে স্থির করল, যদি কালিকেশ সত্যিই মানববলি দিতে চায়, তবে তাকে আটকাতেই হবে। হয়তো তার জীবন বিপদে পড়বে, কিন্তু দেবীর ছায়া তাকে রক্ষা করবে—এই বিশ্বাস তার ভেতরে জেগে উঠল। এইভাবেই অন্ধকার রাতের মধ্যে আলো আর ছায়ার যুদ্ধ শুরু হল—একদিকে মেঘলার বিশ্বাস, অন্যদিকে কালিকেশের অন্ধ লালসা। আর গ্রামের মাটিতে তৈরি হতে থাকল এক ভয়ঙ্কর সংঘাতের ভূমি, যেখানে শেষ পর্যন্ত দেবীর সতর্কবাণী সত্যি হবে কি না, সেটাই হয়ে উঠল সবার অজানা প্রশ্ন।
ছয়
অমাবস্যার অন্ধকার যেন পুরো গ্রামকে গ্রাস করে নিয়েছিল সেদিন। কালিকেশ শ্মশানের শুকনো জমিতে অস্থায়ী যজ্ঞমঞ্চ গড়ে তুলেছিল, শুকনো কাঠ, পশুর মাথার খুলির ওপর লাল সিঁদুর মাখিয়ে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল। বাতাসে ধোঁয়া আর মরা কাঠের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছিল। অশনি সংকেতের মতো দূরে কোথাও পেঁচার ডাক শোনা যাচ্ছিল, যেন সে-ও এ রাতের সাক্ষী। কালিকেশ চিৎকার করে একের পর এক মন্ত্র পড়তে শুরু করল—তার চোখ উন্মত্ত, গলায় সাপের মতো শ্লোক গর্জে উঠছিল। যজ্ঞমঞ্চের চারপাশে কালো কাপড় জড়ানো কয়েকজন সঙ্গী মশাল হাতে দাঁড়িয়ে, যেন আগুনের আলোর ভেতরে ছায়া হয়ে উঠছে। গ্রামের মানুষ ভয়ে দূরে দাঁড়িয়ে ছিল; কারো হাতে তেল-জ্বলা প্রদীপ, কারো মুখে বিড়বিড় করে নাম জপা। তারা জানত, এ রাত ভয়ানক, কারণ কালিকেশ ঘোষণা করেছিল—বলির আয়োজন ছাড়া দেবী প্রসন্ন হবেন না। হঠাৎই দেখা গেল মেঘলাকে টেনে হিঁচড়ে আনা হচ্ছে—তার গায়ে ছেঁড়া শাড়ি, চোখ ভয়ে স্থির হয়ে গেছে। চিৎকার করে মুক্তি চাইতে চাইতে সে বারবার বলছিল, “আমায় ছাড়ো, আমি কিছু করিনি!” কিন্তু তার আর্তনাদ চারদিকের ভয়ংকর মন্ত্রোচ্চারণের মধ্যে মিলিয়ে যাচ্ছিল। চারপাশের মানুষ ভয়ে জমে গিয়েছিল; কেউ সামনে আসতে পারছিল না। সবার চোখে আতঙ্ক, আবার অজানা কৌতূহল—কি হবে এখন?
কালিকেশ আগুনের সামনে বসে গলায় ছুরি ঝোলাল, হাত উঠিয়ে ঘোষণা করল—“দেবী চান রক্ত, এই রক্ত দিয়েই শাপমোচন হবে। এই মেয়েই আজ দেবীর কাছে অর্ঘ্য।” তার গলায় যেন এক অমানবিক উন্মাদনা, চারপাশের শিষ্যরা একসঙ্গে গলা মেলাল মন্ত্রে। আগুনের লেলিহান শিখা তখন আকাশ ছুঁতে চাইছে, যেন স্বয়ং রাক্ষসেরা এসে উপস্থিত হয়েছে। মেঘলা হাঁপাতে হাঁপাতে কাঁদছিল, তার মুখ শুকিয়ে কাঠ। চোখে ভয় জমে গিয়েছিল—কিন্তু সেই ভয়ের ভেতরেও একরকম আশা ছিল, হয়তো কেউ তাকে বাঁচাবে। সেই মুহূর্তে গ্রামের মানুষরা ভয়ে একপাশে দাঁড়িয়ে ছিল, কারো হাত কাঁপছিল, কারো চোখ নামানো। তারা জানত কালিকেশকে বাধা দেওয়া মানে নিজের প্রাণ দেওয়া। তবুও ধানেশ মাঝির বুকের ভেতর এক অদ্ভুত সাহস সেদিন জেগে উঠেছিল। ভিড়ের মধ্যে থেকে সে হঠাৎ গলা চড়াল—“এটা পাপ! দেবী হিংসা চান না। দেবী তো মা, মা কখনো সন্তানকে বলি চান না। তোমরা অন্ধ হয়ে যাচ্ছ!” তার গলা চারদিকে ছড়িয়ে পড়তেই একটা মুহূর্তের জন্য মন্ত্রপাঠ থমকে গেল। কালিকেশ রাগে লাল হয়ে উঠল, চোখের মণি কাঁপছিল। সে চিৎকার করে বলল, “চুপ কর! তুই দেবীর বিরুদ্ধাচরণ করছিস? তুই কি মৃত্যুকে ডেকে আনতে চাইছিস?” আগুনের আলোয় ধানেশের মুখ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল—সাহসী, দৃঢ়, অথচ কাঁপছে ভেতর থেকে। তার চারপাশে কয়েকজন লোক ইতস্তত করছিল, কেউ মাথা নেড়ে ফিসফিস করে বলছিল—“ধানেশ ঠিকই বলছে, মা তো হত্যার সাধনা চান না।”
গ্রামের লোকেদের মনে দ্বিধার স্রোত বয়ে যাচ্ছিল। একদিকে কালিকেশের ভয়, অন্যদিকে ধানেশের কথার সত্যতা। মেঘলা তখন কাঁপতে কাঁপতে ধানেশের দিকে তাকাল, যেন অন্ধকারের মধ্যে এক আলোর রেখা পেয়েছে। কালিকেশ তার ছুরি উঁচু করল, শিষ্যদের আদেশ দিল—ধানেশকে ধরে আনতে। কিন্তু লোকেরা আর আগের মতো অন্ধ আনুগত্য দেখাতে পারছিল না। ধানেশ আবার গলা চড়িয়ে বলল—“আজ যদি আমরা চুপ থাকি, কাল তোমাদের মেয়ে, বোন, স্ত্রী—যে কাউকে টেনে নিয়ে আসবে। দেবীর নামে মানুষ হত্যা হচ্ছে, আমরা সবাই পাপী হয়ে যাচ্ছি।” তার গলা যেন গ্রামের নিস্তব্ধ আকাশ ছিঁড়ে বেরিয়ে আসছিল। ভিড়ের মধ্যে কয়েকজন তখন সাহস পেতে শুরু করল। মশালের আলোয় সবার চোখে প্রতিবাদের ঝিলিক ফুটে উঠছিল। কালিকেশ দাঁতে দাঁত চেপে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল, কিন্তু হঠাৎ চারপাশের ভিড় থেকে প্রতিবাদের শব্দ উঠতে শুরু করল—“না, এ অন্যায়! এটা পাপ!” মেঘলার কণ্ঠে আবার কান্নার সুর, কিন্তু এবার সেই কান্না একা নয়—গ্রামের মানুষের ভয় ভাঙতে শুরু করেছে। কালিকেশ বুঝতে পারল, তার হাত থেকে নিয়ন্ত্রণ সরে যাচ্ছে। অমাবস্যার রাতের ঘোর অন্ধকারে মশালের আলোয় তখন এক যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল—ভয় আর প্রতিবাদের যুদ্ধ, পাপ আর সত্যের যুদ্ধ। আর তার মাঝেই দাঁড়িয়ে ধানেশ মাঝি, এক সাধারণ মানুষ, যিনি দেবীর নামে হিংসার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে বললেন—“মা রক্ষা করেন, মা হত্যা করেন না।” সেই উচ্চারণ যেন চারদিকের অন্ধকার কেটে আলো হয়ে ছড়িয়ে পড়ল।
সাত
কালিকেশের চোখ তখন রক্তে ভরা, তার কণ্ঠে মন্ত্রের বজ্রধ্বনি গর্জে উঠছে—“ওঁ কালী মহাকালী, রুদ্ররূপিণী, রক্তপানিনী!” ঘরের চারপাশে প্রদীপের আলো টলমল করছে, কালো ধোঁয়া আকাশে পাক খাচ্ছে, আর মেঘলা ভয়ে থরথর করে কাঁপছে। সে জানে, কয়েক মুহূর্তের মধ্যে তার দেহে খড়্গ নামবে, আর তান্ত্রিকের ক্রোধ ও তৃষ্ণা মেটাতে হবে তার প্রাণ দিয়ে। মেঘলার চোখ ভিজে গেছে অশ্রুতে, ঠোঁট কাঁপছে—কিন্তু তবুও বুকের ভেতরে এক আশ্চর্য শক্তি জেগে উঠছে, মনে হচ্ছে কিছু একটা ঘটবে। ঠিক সেই মুহূর্তে আকাশে বজ্রপাতের প্রচণ্ড গর্জন শোনা গেল, ঘরের সমস্ত প্রদীপ একসাথে নিভে গেল, শুধু ধূপের গন্ধে ভরা ঘন অন্ধকারে সাদা আলো ঝলসে উঠল। তীব্র ঝড়ের শব্দে ছাদের খড়ের ফাঁক থেকে বাতাস ঢুকে হু হু করে বইতে লাগল। কালিকেশের হাত থমকে গেল, খড়্গ উঁচু করে সে মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। মেঘলার চোখ হঠাৎ বিস্ফারিত হয়ে উঠল—তার সামনে ঘন অন্ধকার ছিঁড়ে লাল আভায় ভরা এক ভয়ংকর নারীমূর্তি জেগে উঠেছে। তাঁর রক্তাভ চক্ষু আগুনের মতো জ্বলছে, কপালে চন্দ্রকলা, জিহ্বা বাইরে বেরোনো, হাতে খড়্গ আর অন্য হাতে খাপর। চারপাশে যেন পৃথিবী কেঁপে উঠল, ঝড়ের সঙ্গে বাজ পড়তে লাগল একের পর এক। চামুণ্ডা দেবী, মৃত্যু ও ধ্বংসের ভয়ংকর রূপে, যেন নিজেই নেমে এসেছেন এই বলির আচার থামাতে।
কালিকেশ মুহূর্তের জন্য স্তম্ভিত হয়ে গেল, তার ঠোঁট শুকিয়ে এল, তবুও নিজের মন্ত্রপাঠ থামালো না। সে গর্জে উঠল—“তুমি আমার শক্তির অবতার, আমি তোমাকে আহ্বান করেছি, আজ তুমি আমার শত্রু হয়ে দাঁড়ালে কেন?” কিন্তু দেবীর রক্তাভ দৃষ্টির সামনে তার সাহস মুহূর্তে ম্লান হয়ে গেল। দেবীর খড়্গ বাতাসে ঝলসে উঠল, আর তার বজ্রকণ্ঠে প্রতিধ্বনি হলো—“অধর্মে আহ্বান করলে আমি আসি শাস্তি দিতে, আমি রক্ষা করি ধর্মকে, পাপের বলি আমি গ্রহণ করি না।” দেবীর সেই কণ্ঠস্বর চারদিক কাঁপিয়ে দিল, ঘরের বাইরে পাখিরা হঠাৎ উড়ে গেল, গাছপালা কাঁপতে লাগল। মেঘলা, যে মুহূর্ত আগে নিজের মৃত্যু নিশ্চিত ভেবেছিল, এখন তার অন্তরের গভীরে এক অদ্ভুত শান্তি অনুভব করছে। তার চোখ ভিজে গেল মুক্তির আনন্দে, বুকের ভেতর সাহস ফিরে এল। কালিকেশ মরিয়া হয়ে নানা মন্ত্রোচ্চারণ শুরু করল, তার গলা রুদ্ধ হয়ে আসছে, চুল এলোমেলো হয়ে গেছে, মুখে ঘাম আর ভয়ের রেখা স্পষ্ট। সে দেবীকে বুঝাতে চাইল যে সে বহু বছর ধরে সাধনা করেছে, বহু আত্মাহুতি দিয়েছে, আর এখন সে দেবীর শক্তি অর্জনের অধিকারী। কিন্তু দেবীর অগ্নিসদৃশ হাসি তাকে ভস্ম করে দিতে লাগল। মেঘলার বাঁধন হঠাৎ শিথিল হয়ে গেল, যেন অদৃশ্য কোনো শক্তি দড়ি ছিঁড়ে দিয়েছে। সে ধপ করে মাটিতে বসে পড়ল, শ্বাস নিতে লাগল হাপরের মতো। দেবী তার দিকে তাকালেন না, তাঁর চক্ষু স্থির হয়ে আছে তান্ত্রিক কালিকেশের ওপর।
এই মুহূর্তে যেন সময় থমকে গেছে। বজ্রপাতের আলোয় দেবীর অবয়ব প্রতিবার ভেসে উঠছে—তাঁর রক্তমাখা খাপর ঝরে পড়া রক্তে পূর্ণ হচ্ছে, তাঁর খড়্গ থেকে স্ফুলিঙ্গ বেরোচ্ছে, আর তাঁর মুখের হাসি ভয়ংকর অথচ স্নিগ্ধ। কালিকেশের ভেতরের দম্ভ ভেঙে পড়ল, সে হাঁটু গেড়ে মাটিতে বসে পড়ল, কাঁপা গলায় বলতে লাগল—“আমায় ক্ষমা করো, মহাদেবী! আমি ভুল করেছি। আমি কেবল শক্তি চেয়েছিলাম, কিন্তু পথ ভুলে গেছি।” দেবীর কণ্ঠস্বর বজ্রের মতো আঘাত করল—“যে শক্তি কেবল নিজের স্বার্থে চায়, সে ধ্বংস ছাড়া কিছু পায় না। তুমি নারীহত্যার ষড়যন্ত্র করেছ, তোমার সাধনা কলুষিত হয়েছে। আজ তোমার অবসান।” এর সঙ্গে সঙ্গে দেবী খড়্গ উঁচিয়ে ধরলেন, এক ঝলক আলোয় কালিকেশের গলা থেকে জীবনশক্তি বেরিয়ে এল। তার শরীর ছটফট করতে লাগল, মুখে আতঙ্ক জমে গেল, আর কিছুক্ষণের মধ্যে সে নিথর হয়ে পড়ল মাটিতে। ঘরে হঠাৎ নিস্তব্ধতা নেমে এল, শুধু বাইরে ঝড়ের শব্দ ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে এলো। মেঘলা বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল দেবীর দিকে, তার ঠোঁট কাঁপছিল প্রণাম জানাতে। দেবীর চক্ষু তখন কোমল হয়ে এল, রক্তাভ আভা স্নিগ্ধ আলোয় পরিণত হলো। তিনি মেঘলার মাথায় হাত রাখলেন, এক অদ্ভুত আশীর্বাদের উষ্ণতা তার শরীর ভরিয়ে দিল। এরপর দেবীর রূপ ধীরে ধীরে আলোয় মিলিয়ে গেল, ঝড় থেমে চারদিকে শান্তির আভা ছড়িয়ে পড়ল। মেঘলা নিঃশ্বাস ফেলে মাটিতে শুয়ে পড়ল, যেন জীবনের নতুন আলো তাকে ঘিরে ধরেছে। সেই মুহূর্তে তার মনে হলো—যতই অন্ধকার নেমে আসুক, দেবী সর্বদা তাঁর ভক্তকে রক্ষা করেন, আর সত্যের ওপর মিথ্যার জয় চিরকাল অবশ্যম্ভাবী।
আট
কালিকেশ তখনো নিজের অহংকারে দাঁড়িয়ে ছিল, যেন তার শক্তির কাছে দেবীও একদিন নতি স্বীকার করবেন। চারপাশে ধূপের ধোঁয়া ঘূর্ণি তুলে উঠছিল, মন্ত্রোচ্চারণে অগ্নিকুণ্ড থেকে শিখা জ্বলছিল আরও উঁচু হয়ে। গ্রামের মানুষ দূর থেকে আতঙ্কে তাকিয়ে ছিল, যেন এক অমানবীয় দৃশ্যের সাক্ষী হচ্ছে তারা। কালিকেশের কণ্ঠ গর্জে উঠল—“ভক্তি মানে আত্মসমর্পণ, ভক্তি মানে শক্তি অর্জন, আর শক্তি অর্জনের একমাত্র পথ হলো রক্তের উৎসর্গ।” তার চোখ লাল আগুনের মতো জ্বলছিল, হাতে খড়্গ, যা সে অসংখ্য বলিদান দিয়ে পূজিত করেছিল। সেই মুহূর্তে দেবীর রূপ যেন আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠল—মুখ থেকে যেন বজ্রপাতের দ্যুতি ছড়িয়ে পড়ল, আর তাঁর তেজস্বী কণ্ঠ প্রতিধ্বনিত হলো—“ভক্তি মানে কি হত্যা? অমরত্ব মানে কি রক্ত?” দেবীর প্রশ্ন যেন মহাকাশ কাঁপিয়ে দিল। কালিকেশ প্রথমে প্রতিবাদ করার চেষ্টা করল, তার বুক ফুলে উঠল অহংকারে—“তুমি আমাকে পরীক্ষা করতে এসেছ, কিন্তু আমি যে রক্তের স্রোতে আমার অমরত্ব গড়ে তুলেছি, তা ভাঙবে না!” সে মন্ত্রোচ্চারণ শুরু করল, হাতের খড়্গ আকাশের দিকে তুলে ধরে যেন আবারও তার ভয়ঙ্কর শক্তি আহ্বান করতে চাইছে। কিন্তু ঠিক তখনই দেবীর চোখের দৃষ্টি পড়ল তার উপর। সেই এক দৃষ্টি যেন সহস্র সূর্যের আলো, যা তার সমস্ত অন্ধকারকে চূর্ণ করে দিল। কালিকেশ হঠাৎ অনুভব করল, তার মন্ত্রের শব্দ গলায় আটকে যাচ্ছে, উচ্চারণ যেন ভেঙে ছাই হয়ে যাচ্ছে, খড়্গের ভার যেন তার নিজের হাতেই অসহনীয় হয়ে উঠেছে।
সে এক পা পিছিয়ে গেল, কিন্তু অহংকার তখনো তার ভেতরে লড়াই করছিল। “না, আমি অমর! আমি অদম্য!” সে গর্জে উঠল, কিন্তু সেই গর্জন মুহূর্তের মধ্যেই করুণ আর্তনাদে রূপ নিল। দেবীর তেজস্বী আভা তাকে ঘিরে ফেলল, যেন আগুনের বলয়। তার মন্ত্রশক্তি আর কাজ করছিল না—যে শব্দে এতকাল ভয় জাগানো হতো, তা এখন বাতাসে মিলিয়ে নিস্তব্ধতায় পরিণত হয়েছে। তার চোখে আতঙ্ক নেমে এলো, ঠোঁট কাঁপতে শুরু করল, বুকের ভেতরে ভয়ঙ্কর এক ভার অনুভব করল। খড়্গ তার হাত থেকে ফসকে পড়ে গেল মাটিতে, ঝনঝন শব্দে প্রতিধ্বনিত হলো। সেই শব্দ যেন কালিকেশের সমস্ত অহংকারকে ভেঙে চূর্ণ করল। মাটিতে পড়ে থাকা অস্ত্র যেন মৃতদেহের মতো নিস্তব্ধ। গ্রামের মানুষ যারা দূর থেকে এই দৃশ্য দেখছিল, তাদের মুখে বিস্ময়ের ছাপ ফুটে উঠল। তারা বুঝতে পারল, সত্যিই দেবীর শক্তি কেবল ধ্বংস নয়, বরং অহংকারকে বিনাশ করাই তাঁর প্রকৃত মহিমা। কালিকেশ হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল, তার চোখে এখন আর আগুন নেই, আছে শুধু পরাজয়ের লজ্জা। দেবী আবারও প্রশ্ন করলেন—“তুমি যে অমরত্ব চাইলে, তা কি মানুষের দুঃখ আর রক্ত দিয়ে পাওয়া সম্ভব? ভক্তি যদি হৃদয়ের আলো না হয়, তবে সে অন্ধকারের আর এক রূপ মাত্র।”
দেবীর সেই বাণী যেন কালিকেশের অন্তরে বজ্রাঘাত করল। এতদিন সে ভেবেছিল শক্তি মানেই আধিপত্য, মানেই জয়, কিন্তু আজ বুঝল শক্তি মানে বিনয়, শক্তি মানে আত্মসমর্পণ। তার চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল, কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে এল। চারপাশের আগুন হঠাৎ নিভে গেল, ধোঁয়ার ঘন কুণ্ডলী ভেসে উঠে মিলিয়ে গেল আকাশে। কালিকেশের ভেতরের ভয়ঙ্কর দানব যেন ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। দেবীর আভা ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে আসছিল, কিন্তু তাঁর চোখে সেই অগ্নিময় দৃষ্টি তখনো জ্বলছিল। কালিকেশ মাটিতে হাত রেখে মাথা নত করল, যেন সমস্ত অহংকারের ভার মাটির কাছে সমর্পণ করছে। গ্রামের মানুষ হঠাৎ হর্ষধ্বনি করে উঠল, যেন তাদের বুকের ভেতরে জমে থাকা আতঙ্ক মুক্ত হয়ে গেছে। তারা বুঝল, দেবী কেবল ধ্বংসের প্রতীক নন, তিনি শুদ্ধির প্রতীক। কালিকেশ সেই মুহূর্তে বুঝতে পারল, তার অমরত্বের স্বপ্ন মিথ্যে ছিল। মানুষ তাকে ভয় পেয়ে সরে গিয়েছিল, কিন্তু কেউ তাকে ভক্তি করেনি। দেবীর সামনে দাঁড়িয়ে সে প্রথমবার অনুভব করল সত্যিকার ভক্তির মানে—যেখানে রক্ত নয়, ভালোবাসা আর আত্মসমর্পণই চূড়ান্ত শক্তি। তার অহংকার ধুলোয় মিশে গেল, আর দেবীর দৃষ্টিতে জ্বলজ্বল করছিল এক অনন্ত বার্তা—যে অহংকার শেষ পর্যন্ত পতনের দিকে নিয়ে যায়, আর বিনয়ই মানুষকে মুক্তি দেয়। এইভাবে কালিকেশের দীর্ঘদিনের শক্তির আসন ভেঙে পড়ল, আর ভক্তির আসল মানে নতুন করে ধ্বনিত হলো গ্রামের আকাশে।
নয়
মেঘলার শরীর অক্ষত থাকাটা যেন অলৌকিক ঘটনার মতোই হয়ে উঠল। যে মুহূর্তে গ্রামের মানুষরা ভেবেছিল রক্তপাত ছাড়া দেবী সন্তুষ্ট হবেন না, সে মুহূর্তে মেঘলার দেহে এক বিন্দু আঘাত না লাগা তাদের বিশ্বাসকে নড়বড়ে করে দিল। বাতাস থমকে গেল, চারদিকে নিস্তব্ধতা নেমে এলো। গ্রামের বৃদ্ধেরা, যারা এতদিন ধরে এই রক্তবলির প্রথাকে অটল বিশ্বাস বলে মেনে চলেছিলেন, তাঁরাও একে একে হতভম্ব হয়ে পড়লেন। তারপর ধীরে ধীরে সেই নিস্তব্ধতার ভেতর থেকে শোনা গেল গ্রামের মানুষদের হাঁপিয়ে ওঠা নিঃশ্বাস, বিস্ময়ের ফিসফিসানি, আর মেঘলার মুখে জমে থাকা শান্ত হাসি। সে দাঁড়িয়ে আছে দৃঢ় ভঙ্গিতে, চোখে এক অদ্ভুত আলোর দীপ্তি, যেন সে নিজেই এক প্রতীক—ত্যাগ, ভালোবাসা আর সত্যিকারের ভক্তির রূপক। এই দৃশ্য দেখে গ্রামের মানুষরা আর নিজেদের ধরে রাখতে পারল না। একে একে তারা হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল, দেবীর প্রতি প্রণাম জানাল, যেন এই মুহূর্তে তারা বুঝে গেছে—দেবী কোনো রক্ত চান না, দেবী চান মানুষের অন্তরের বিশুদ্ধতা, সেই ভালোবাসা যা ভয় নয়, বরং মমতার পথ দেখায়।
ঠিক তখনই যেন বাতাসে প্রতিধ্বনিত হলো এক অনাহত বাণী—দেবীর কণ্ঠস্বর, যিনি বললেন, “সত্যিকারের ভক্তি ভয় ও রক্তে নয়, ভালোবাসা আর ত্যাগেই আমার সন্তুষ্টি।” গ্রামের প্রত্যেকটি মানুষ যেন এই বাক্য হৃদয়ে গভীরভাবে উপলব্ধি করল। তারা বুঝতে পারল, এতদিন তারা অন্ধ বিশ্বাস আর কুসংস্কারের শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়ে ছিল। মেঘলার সাহস আর ধানেশ মাঝির প্রার্থনা সেই শৃঙ্খল ভেঙে দিয়েছে। সেই প্রার্থনা আর মন্ত্রোচ্চারণ গ্রামের শিক্ষায় পরিণত হলো—এক নতুন আলো, যা প্রতিটি শিশুর ভবিষ্যৎকে আলোকিত করবে। মানুষদের চোখে জল এসে গেল, কারণ তারা দেখল যে দেবী সত্যিই তাদের আশীর্বাদ করছেন, তবে তা আর রক্তক্ষয়ী উৎসবের মাধ্যমে নয়, বরং জীবনের সত্য, শান্তি ও সহমর্মিতার মাধ্যমে। গ্রামের মহিলারা, যারা এতদিন চুপচাপ রক্তবলির ভয়াবহতায় আতঙ্কিত হয়ে থেকেছে, তারা বুক ভরে শ্বাস নিল। পুরুষরা, যারা নিজেদের শক্তি দিয়ে প্রথাকে টিকিয়ে রেখেছিল, তারা মাথা নিচু করে বুঝে নিল নিজের ভুল। ধীরে ধীরে মানুষদের মুখে নতুন এক প্রতিজ্ঞা উচ্চারিত হতে লাগল—তারা আর কখনো ভক্তির নামে কাউকে বলি দেবে না, দেবীর আরাধনা হবে গান, ফুল, আর ধূপের গন্ধে, রক্ত নয়।
ধানেশ মাঝি সামনে এসে দাঁড়ালেন। তাঁর বয়সের ভারে নুইয়ে পড়া শরীর এখন যেন দীপ্ত হয়ে উঠেছে। তিনি হাত জোড় করে আকাশের দিকে তাকিয়ে দেবীর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন। তাঁর কণ্ঠ কেঁপে উঠল, তবে সেই কণ্ঠের মধ্যে ছিল দৃঢ়তা—“আমরা বুঝেছি মা, আমরা ভুল করেছি। আমাদের ভক্তি যদি রক্তে নয়, ভালোবাসায় হয়, তবে আমরা সেই পথেই হাঁটব। আমরা আমাদের সন্তানদের শিখিয়ে দেব ভক্তির আসল অর্থ। আমরা আর অন্ধ হব না।” তাঁর এই প্রার্থনা গ্রামের প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে গেঁথে গেল। সবাই মিলে সেদিন এক অঙ্গীকার করল যে আর কখনো এই গ্রামে রক্তবলির মতো নৃশংসতা হবে না। শিশুরা হাসল, নারীরা চোখ মুছল, পুরুষরা পরস্পরের কাঁধে হাত রাখল। গ্রামের আকাশে উঠল নতুন ভোরের আলো, যেন প্রকৃতিও সাক্ষী হয়ে রইল এই পরিবর্তনের। সেই রাতের ঘটনাই হয়ে উঠল এক নতুন শিক্ষার সূচনা—যে শিক্ষা বলছে, দেবীর কাছে সবচেয়ে বড় উৎসর্গ হলো ভক্তির বিশুদ্ধতা, ভালোবাসার শক্তি, আর ত্যাগের মহিমা। মেঘলা সেই পরিবর্তনের প্রতীক হয়ে উঠল, ধানেশ মাঝি সেই শিক্ষার প্রবক্তা হয়ে রইলেন। আর দেবীর বাণী, যা ভয়কে ভেঙে ভালোবাসার আলো জ্বালাল, তা চিরকাল গ্রামে প্রতিধ্বনিত হতে থাকল—মুক্তির আসল প্রাপ্তি হলো ভক্তির হৃদয় থেকে, না যে রক্তের বেদি থেকে।
দশ
শেষ রাতের শ্মশানের দৃশ্য যেন এক অদ্ভুত মহাকাব্যের পরিসমাপ্তি। আকাশে কালো মেঘের আস্তরণ, চারদিকে শ্মশানের চিতা থেকে আসা ছাই-গন্ধ, আর দূরে দূরে জ্বলন্ত প্রদীপের আলোয় এক ভয়ঙ্কর অথচ মহিমান্বিত পরিবেশ। মেঘলা তখনো কাঁপতে কাঁপতে দেবীর সামনে দাঁড়িয়ে, চোখ ভিজে উঠেছে অশ্রুতে। দেবী যেন আর সাধারণ কোনো মূর্তি নন, তাঁর চেহারায় ফুটে উঠেছে মহাশক্তির আভাস। তাঁর কণ্ঠস্বর গর্জনের মতো আকাশ ছিঁড়ে বেরিয়ে এলো—“আমার কাছে একমাত্র অর্ঘ্য হলো অহংকার বিসর্জন।” সেই মুহূর্তে গ্রামের মানুষরা যেন সমষ্টিগতভাবে কেঁপে উঠল, যেন তাদের বুকের ভিতরে কেউ অদৃশ্য হাত দিয়ে স্পর্শ করল। কালিকেশ, যিনি এতদিন শক্তি আর ক্ষমতার গর্বে সবার উপর আধিপত্য বিস্তার করতে চাইতেন, দেবীর সেই ঘোষণা শুনে প্রথমে চিৎকার করে উঠলেন। তাঁর চোখ রক্তাভ, মুখে ভয়ের ছাপ, তবু তিনি শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত নিজের দম্ভ ছাড়তে চাননি। কিন্তু দেবীর দৃষ্টি যখন তাঁর দিকে স্থির হলো, মনে হলো সেই অগ্নিদৃষ্টি কোনো মানুষ সহ্য করতে পারবে না। হঠাৎই তাঁর শরীর থরথর করে কাঁপতে লাগল, আগুনে ধরা শুকনো পাতার মতো তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন, আর কিছুক্ষণের মধ্যেই তাঁর শরীর ভস্ম হয়ে ধুলায় মিশে গেল। এক জীবন্ত উদাহরণ, অহংকারের শেষ কী ভয়াবহ পরিণতি হতে পারে।
মেঘলার শরীর তখনো অবশ হয়ে আছে, কিন্তু ধীরে ধীরে দেবীর কণ্ঠস্বর তাঁর বুকের গভীরে আশার আলো জ্বালিয়ে দিল। দেবী বললেন—“যে ভক্তি করে, সে আমার কাছ থেকে কখনো শূন্য ফিরে যায় না।” মেঘলা হঠাৎ অনুভব করল, যে যন্ত্রণার বোঝা এতদিন সে বয়ে বেড়াচ্ছিল, হঠাৎই তা লাঘব হয়ে গেছে। তাঁর মনে হলো, এক অদৃশ্য হাত তাঁর মাথায় স্নেহভরে আশীর্বাদ করছে। গ্রামের মানুষরা, যারা এতদিন ভয়ে কিংবা কুসংস্কারে অন্ধ ছিল, তারা বুঝতে পারল—শক্তি মানে ধ্বংস নয়, শক্তি মানে আত্মসমর্পণ, শক্তি মানে মঙ্গল। শ্মশানের গম্ভীর পরিবেশে সেই রাতে মানুষের মনে নতুন এক শিক্ষা জন্ম নিল। ছাইয়ের স্তূপের পাশে দাঁড়িয়ে সবাই অনুভব করল, মানুষ যত বড়ই হোক না কেন, দেবতার সামনে সে কেবল এক ক্ষুদ্র সত্তা। দেবীর বাণী ছড়িয়ে পড়ল প্রতিটি হৃদয়ে—“অহংকার সর্বনাশ ডেকে আনে, ভক্তি মুক্তি দেয়।” মেঘলার অশ্রু তখন আনন্দের অশ্রু, কারণ সে জানল, তার মুক্তি হয়েছে, তার ভোগান্তির অবসান ঘটেছে।
ধীরে ধীরে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করল। আকাশের কালো মেঘ সরে গিয়ে সোনালি রোদ যেন এক নতুন দিনের বার্তা নিয়ে হাজির হলো। শ্মশানের আগুন তখন নিভে আসছে, ছাইয়ের উপর ভোরের শিশির পড়ছে, যেন প্রকৃতিও শুদ্ধ হয়ে উঠছে। গ্রামবাসীরা একে একে দেবীর মন্দিরের দিকে এগোতে লাগল, মাথা নিচু করে, হৃদয়ে নতুন প্রতিজ্ঞা নিয়ে। তারা বুঝল, এই শিক্ষা শুধু কালিকেশের জন্য নয়, তাদের সবার জন্য। অহংকারের বোঝা ঝেড়ে ফেলে, ভক্তির পথেই তারা মুক্তি খুঁজে পাবে। মেঘলা সেই পথে প্রথম যাত্রী, তার আত্মা হালকা হয়ে গেছে, তার চোখে আর ভয় নেই, আছে শুধু এক প্রশান্ত আলো। শ্মশানের ধুলোয় কালিকেশের অস্তিত্ব মিলিয়ে গেলেও দেবীর বাণী অমর হয়ে রইল—অহংকার যেখানে শেষ, সেখানেই শুরু ভক্তির প্রকৃত শক্তি। গ্রামের মানুষরা নতুন করে জন্ম নিল, আর দেবী যেন স্বয়ং তাঁদের হৃদয়ের গভীরে আসন গ্রহণ করলেন। সেই রাতের অভিজ্ঞতা চিরকাল তাঁদের মনে থাকবে, দেবীর সেই অর্ঘ্যের অর্থ জীবনের প্রতিটি মোড়ে তাঁদের পথপ্রদর্শক হয়ে থাকবে।
___
				
	

	


