Bangla - ভূতের গল্প

পোড়া বাড়ির আলো

Spread the love

অর্ণব মুখার্জি


পর্ব ১ — নতুন স্কুলশিক্ষক

বর্ষার শেষে যে ভেজা গন্ধ মাটির ভেতর পর্যন্ত ঢুকে থাকে, সেই গন্ধ নিয়েই অরিন্দম প্রথম দিন গ্রামে পা রাখল। ছোট্ট স্টেশন, নামটি শিলালিপির মতো খসে পড়া বোর্ডে, প্ল্যাটফর্মে দু-একটা কেরোসিনের ল্যাম্প টিমটিম করছে, আর দূরে শালগাছের রেখা এমনভাবে দাঁড়িয়ে আছে যেন কারও পুরোনো হাতের লেখা— থরথর করে, তবু পড়া যায়। কলকাতা থেকে ট্রেনে নামার পর একটা ভাঙা টেম্পো তাকে স্কুল পর্যন্ত পৌঁছে দিল। স্কুল বলতে ইট-সিমেন্টের দুটো দোচালা ঘর, সামনের মাঠে ঘাস বুনোভাবে উঠে এসেছে, তালগাছের ছায়া পড়ে লম্বা কালচে দাগ। প্রধান শিক্ষক ছুটিতে; সাময়িক দায়িত্বে থাকা ক্লার্কটি, নাম হারাধন, পাতলা গলার লোক, কথায় কথায় ‘এই তো’ বলে থামে। “এই তো, মাস্টারমশাই, বাসস্থানের ব্যবস্থা করা আছে। একটু নির্জন, কিন্তু ভাড়া কম। আমাদের পঞ্চায়েতের দেউলি-বাড়ি।— এই তো, কাছেই।”

দেউলি-বাড়ি বলতেই অরিন্দম কোনও প্রাসাদ ভাবেনি, তবে যে যেটুকুই কল্পনা করেছিল, তার চেয়েও কম, আর ভয়ংকর কম। দিনের আলোয় তা বোঝা গেল না। দুপুরের আলোর দৌরাত্ম্যে সবই নিরীহ লাগে: চৌধুরীর পুরোনো দেউলি, একতলা, চারদিক খোলা উঠোন, সিমেন্টের ফাটলে ঘাস, উত্তর দিকে কালো হয়ে যাওয়া এক দেওয়াল— যেটাকে হারাধন ‘রং নষ্ট’ বলে হেসে উড়িয়ে দিল। ভেতরে ঢুকেই একটা শুষ্ক গন্ধ, ধোঁয়া-ধোঁয়া, যেন বহুদিন আগে কেউ এখানে আগুন জ্বালিয়ে রেখে চলে গিয়েছিল, আর গন্ধটি সিমেন্টের রন্ধ্রে রন্ধ্রে নেমে গিয়ে নিজের আশ্রয় খুঁজে নিয়েছে। “পানির ট্যাঙ্ক আছে, বাথরুম ঠিকঠাক। রান্না আপনাকেই… এই তো, এক-দুটো ছেলেপুলি কাজে আসে।” হারাধনের ‘এই তো’র ফাঁকে ফাঁকে অরিন্দম বিছানার জন্য একটা খাট, একটা টেবিল, একটা চেয়ার দেখে নিল। তালা-চাবি নিয়ে, কাগজে সইসাবুদ করে, বেলা গড়িয়ে বিকেলের দিকে এল। হারাধন চলে যাওয়ার সময় দরজার কাছে থেমে বলল, “শুনবেন না, মাস্টারমশাই… গ্রামের লোক কুসংস্কারে ভোগে। এই তো, সবাই বলবে— দেউলি-বাড়ি নাকি পোড়া বারি, ভূতের বারি— এসবই গাঁয়ের কথা। ভয় পাবেন না।”

ভয় পাওয়ার কোনও কারণও অরিন্দম দেখতে পেল না। ডিগ্রি কলেজ থেকে পাশ করে কিছুদিন কোচিং সেন্টারে পড়িয়ে যা সঞ্চয় হয়েছিল, তাতে শহরে টেকা মুশকিল। তাই এই গ্রাম্য স্কুলের চাকরি পেয়েই হাত বাড়িয়ে ধরেছিল। গ্রাম দূরে, শহরের লোকজনের দৃষ্টি এড়ানো, নিজের মতো করে কয়েকটা কবিতা, নোট, আর বইয়ের সঙ্গে কাটিয়ে দেওয়া— এইসব ভাবতেই তার ভালো লাগছিল। উঠোনে দাঁড়ালে পশ্চিমে ধানক্ষেত দেখা যায়, সোনালি রঙের নিরিখে ঢেউ ওঠা, বাতাসে আঙ্গুল চালালে যেমন খয়েরি ধুলো উঠে আসে, সেইরকম একটা নরম দাওয়াল ধুলো তার হাত-মুখে বসে। একটা শালিক জানলার বারান্দায় এসে একবার তাকাল, তারপরে উড়ে গেল। সবই শান্ত, নীরব, মোলায়েম।

শান্তির আড়ালে কেমন যেন আরেকটা স্তর থাকে— যা প্রথমে বোঝা যায় না। সন্ধ্যে নামার সঙ্গে সঙ্গে সেই স্তর একটু একটু করে মুখ দেখাতে লাগল। পাড়ার মুদি, প্রসন্নবাবু, বন্ধ দোকানের শাটারের ফাঁকে থেকে বললেন, “মাস্টারমশাই, ওই বারিতে উঠলেন?… আচ্ছা, সাহস আছে আপনার। রাত্তিরে যদি কিছু— মানে কিচ্ছু— শুনতে পান, ভাববেন না, কুকুর। এই গ্রামে অনেক কুকুর।” কথাটা রসিকতার ভঙ্গিতে বলা হলেও অরিন্দম মুখে হাসল, ভিতরে একটু থেমে গেল। প্রসন্নবাবু আবার বললেন, “একসময় ওখানে দাসগুপ্তদের থাকা ছিল। খুব সুখি পরিবার, কেষ্টো-ঠাকুরের মানত দিত। তারপর এক রাতে আগুন লাগল— মানুষ বলল, শার্ট সার্কিট; কেউ কেউ বলল, কারও শত্রুতা। কে জানে! পাঁচজনের মধ্যে তিনজন গেল। বাকি দুজন শহরে চলে যায়। বাড়িটা পঞ্চায়েত নিয়ে নিল। বারণ করে কি করবেন… লোকের কথা তো রইলই।”

লোকের কথা! কথা মানুষের মতোই— মাঝরাতে দরজায় নক করে, জানলার কাঁচে নিশ্বাস ফেলে, ধুলোয় অক্ষর আঁকে। অরিন্দম রাতে বাড়ি ফিরতে ফিরতে দেখল, আকাশে প্রায় তারাই নেই, মেঘগুলো কোনো অদৃশ্য হাতে ধুয়ে তুলে শুকোতে দেওয়া হয়েছে। শালবনের দিক থেকে বাতাস আসে, শুকনো পাতায় খসখস করে, আর বাড়ির ফাঁকফোকর দিয়ে সেই শব্দ ঢুকে বিছানার নিচে, বাক্সের কোণে, দেওয়ালের আড়ালে জমে থাকে। রান্নাঘরে কাঠকয়লা নেই; সে আজ সহজেই রুটি-ডাল খেয়ে নিল পাড়ার হোটেলে, জলের কল চালিয়ে একবার মুখ ধুয়ে বারান্দায় বসে থাকল। দূরে মাঠে ঝিঁঝিঁ ডাকছে, ঘাসের ফাঁকে কোথাও একটা ব্যাঙ থপ করে উঠে আবার গর্তে পড়ল— এমন তুচ্ছ শব্দও আজ কেমন স্পষ্ট লাগে।

ঘরের ভেতরটা, দিনের তুলনায়, এখন অস্বস্তিকর বেশি। তেলের দেওয়ালে ফাটলের রেখা কেমন ধোঁয়াটে। সিলিং ফ্যান টলে টলে কে-একজনের নিঃশ্বাসের মতো শব্দ তুলছে। দেওয়ালের উত্তর কোণে, যেখানে ‘রং নষ্ট’ বলেছিল হারাধন, কাছে গিয়ে দেখতে পেল কালো রং শুধু রং নয়— সেঁধিয়ে থাকা পোড়ার ছাপ। আঙুল দিয়ে ছুঁতেই ধুলো মাখা কালচে গুঁড়ো উঠে এল। গন্ধটা তখনই তাকে টের পাওয়াল: পুড়ে যাওয়া কাপড়ের গন্ধ, পুড়ে যাওয়া কাঠের গন্ধ— আর তার মধ্যে অদ্ভুত মিষ্টি একটা গন্ধ, যেন গলিতে কাউকে রসগোল্লা ছাঁকা হচ্ছে। অরিন্দম নিজেকে ধমকাল— রসগোল্লার গন্ধ পোড়ার সঙ্গে আসবে কেন! হয়তো পাশের কারখানার গন্ধ উড়ে এসেছে। এই গ্রামে কোনো কারখানা নেই— মনে পড়তেই সে একটু হেসে ফেলল, নিজের ভীরু কল্পনা শুনে।

ছোট চৌকির ওপরে ঘড়িটা রেখেছে। পুরোনো, দেউলি-বাড়ির সঙ্গেই পাওয়া, গোল মুখ, কাঁচটা খানিকটা আঁচড়ানো। সময় থমকে আছে ২:১৭-তে। পেছনে ঘুরিয়ে দিল, কয়েকবার টিকটিক করে আবার থেমে গেল। তার মনে হল, যেন এই বাড়ির সময় ওই মুহূর্তেই আটকে গেছে— যে মুহূর্তে আগুন বেড়ে উঠেছিল, যে মুহূর্তে কারও চিৎকার গলায় আটকে গিয়ে বাতাসে ঝুলে ছিল। সে নীরবে ঘড়িটা আড়াল করে দিল কাগজের ঢাকনায়, আলো নিভিয়ে রেখে দিল বারান্দার ল্যাম্পটা টিমটিম করতে।

রাতে বিছানায় শুয়ে চোখ বুজলে শহরের স্মৃতি এসে পড়ে— কলেজ স্ট্রিটের ভিজে কাগজের গন্ধ, মহল্লার চায়ের দোকানে ফুটবল নিয়ে তর্ক, বন্ধুরা যে আড্ডায় এখনো বসে, সেখানে কী কথা উঠছে— এসব ভেবে ভেবে একটা তন্দ্রা এল। তন্দ্রা মানেই ইচ্ছের নজরে থাকা আর না-থাকার মাঝামাঝি জায়গা। ঠিক তখনই মনে হল, খুব দূর থেকে কারও পায়ের শব্দ আসছে— থেমে থেমে, কাদায় ভিজে ওঠা স্লিপারের টাপাটাপ। সে কান পেতে শোনে; মিনিটখানেক পরে বুঝল— না, বাতাসে পাতার খসখস, তেমনই। একটু পরেই আবার একটা ধোঁয়া-গন্ধ প্রবল হয়ে উঠল, যেন রান্নাঘরে কেউ লুকিয়ে আগুন ধরিয়েছে। উঠে রান্নাঘর পর্যন্ত গিয়ে দেখল, সব ঠান্ডা, কড়াই উলটো করে রাখা, দেওয়ালে একটা ফাঁক দিয়ে গোধূলির শেষ আলোকরেখা চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে। দরজা-জানলা ঠিকঠাক বন্ধ করে সে ফিরে এসে শুয়ে পড়ল।

বাড়ির চারদিকে যে নীরবতা, তা নীরবতার অভিধানে পড়া শব্দ নয়— এ এক জ্যান্ত জিনিস। মাঝে মাঝে কোথাও যেন দমকা ঘুমঘুম আওয়াজ, যেন বাড়িটাই ঘুমোকা আর স্বপ্ন দেখে। সেই স্বপ্নের অতি তলায় অরিন্দম শুনতে পেল— না, শব্দ নয়— একটি স্থিতি। যেমন আগুন জ্বলতে জ্বলতে যখন নিভতে বসে, তখন কয়লার গায়ে যে উষ্ণতা থাকে, যাকে ছুঁতে গেলে আঙুলে পোড়া লাগে না, তবে তাপটা টের পাওয়া যায়— তেমনই এক উষ্ণ স্থিরতা। তার মনে হল, এই বাড়ি কিছু একটা অপেক্ষা করছে। কিসের? কাদের? নিজের ভেতরের হাস্যকর প্রশ্ন নিজেই আড়াল করে আবার চোখ বুজল সে।

ভোরের ঘুম আসার আগে একবার বাইরের উঠোনে তাকাল। কুয়াশা নামেনি, কিন্তু হালকা একটা সাদা পর্দা ঝুলছে যেন। দূরে নিস্তরঙ্গ ধানক্ষেত, ঝিঁঝিঁর ডাকে ধার টানা সুর, আর বারান্দার সিমেন্টে পুরোনো দাগগুলি হঠাৎ যেন আকৃতি নিচ্ছে— এক নেটওয়ার্ক, এক মানচিত্র, যেখানে পোড়া-খসে-পড়া রেখাগুলো মিলেমিশে একটি পুরোনো ঘরের ছায়া বানাচ্ছে। সে চোখ ঘষে আবার তাকাল— কিছুই নেই, শুধু ফাটা সিমেন্ট।

সকালে স্কুলে গিয়ে দুই-একজন সহশিক্ষকের সঙ্গে আলাপ হলো। বাংলা পড়ান সুনন্দা-দিদি, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা, কাঁধে শাড়ির আঁচল জড়িয়ে রাখেন; তিনি সাবধানে জিজ্ঞেস করলেন, “কোথায় থাকছেন?” দেউলি-বাড়ির নাম শুনেই মুখে একটুখানি খিটখিটে ছায়া। “খুবই… মানে, একটু… তাকিয়ে থাকবেন, রাতে। দরজার নিচে পানি ঢুকতে পারে। ইঁদুরও আছে। আর,” একটু থেমে, “যদি কিছু দেখেন, বই পড়বেন। বইয়ের ভেতরে জ্বালা কম।” কথাটার অদ্ভুত দার্শনিক ভঙ্গিতে অরিন্দম হেসে মাথা নাড়ল। সুনন্দা-দিদি আবার বললেন, “শুনেছি, সেদিন রাতটার কথা— যে রাতে— থাক, স্কুলে এসব কথা মানায় না।”

সেদিন বিকেলে ফেরবার সময় আকাশ সিসার মতো ভারী। পথের ধারে কাঁচা নালা, তার পাশে কচুরিপানা। এক বাচ্চা ছেলে, কপালে ঘাম, খালি পায়ে হাঁটতে হাঁটতে অরিন্দমকে দেখল, কিছু বলতে গিয়ে থেমে গেল। “বাড়িতে যাবেন?”— মাথা নেড়ে ‘হ্যাঁ’। ছেলেটা তার দিকে চেয়ে রইল, যেন কোনও মাপ নিচ্ছে। তারপর হঠাৎ হেসে দৌড়ে চলে গেল। হাওয়ায় কোথা থেকে হালকা একটা শুষ্ক দগ্ধ গন্ধ আবার ভেসে এল, অরিন্দম পথ হাঁটতে হাঁটতে উপলব্ধি করল— এই গন্ধটি সময় বাছাই করে আসে, যখন দিব্যি একটা দিন রাতের দিকে ঢলে পড়ে, আর মানুষ নিজের ভিতরের শব্দ একটু একটু করে শুনতে পায়।

বাড়িতে ফিরে চাবি ঢুকিয়ে কপাট ঠেলে ধরতেই একটা শোঁ শোঁ করে বায়ুর শব্দ উঠল, যেন দীর্ঘদিন বন্দি কেউ একটু ছুটে এল। বারান্দায় ব্যাগ রেখে, হাত-মুখ ধুয়ে সে ঘরের ভিতরে এল। দেওয়া-নেওয়া সেরকম কিছু নেই; তবে আজ সে দরজার চৌকাঠ, জানলার কপাট, দেওয়ালের কালো দাগ— এই সবকিছুর দিকে একটু বেশি খুঁটিয়ে তাকাল। ঘড়িটা খুলে টেবিলের ড্রয়ারে রেখে দিল— ২:১৭ যেন যেন তাকিয়েই থাকে। রান্নাঘরে স্টোভ সাজিয়ে রাখল, শুকনো ডাল ভিজিয়ে রেখে দিল— আজ রাতটা যেমন-তেমন কাটুক, কাল থেকে নিয়ম হবে।

রাত বাড়তে লাগল। দূরে কোথাও কুয়োর দড়ি কড়মড় করে উঠল, তারপর থেমে গেল। অরিন্দম বই খুলল— রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধ, যে-কোনও দুঃসময়ে আশ্রয়ের মতো। শব্দগুলো শান্তির মতো, সিল্ক-কাপড়ের মতো; তাদের ভেতর ঢুকে পড়লে বাইরের শব্দ গায়ে এসে লাগলেও চামড়া ভেদ করতে পারে না। সে দু-পাতা পড়ে চশমা নামাতে যাবে, ঠিক তখন বাড়ির কোথাও একটা কাঠের তক্তা মুচড়ে উঠল— তীব্র নয়, একটুখানি, যেন পুরোনো বাড়ির স্বাভাবিক কাঁপুনি। সে মাথা নাড়ল, বইয়ে চোখ রাখল। মিনিটখানেক বাদে আবার— খুব মৃদু, কেমন যেন কপাটে হাত বুলানোর শব্দ। ‘ইঁদুর,’ মনে মনে বলল, ‘ইঁদুরই তো।’ তারপরেই, যেন নিমেষের জন্য, সারা বাড়ির এয়ারে একধরনের উষ্ণতা কাটল— দু-সেকেন্ড বা তিন— এমন কিছু, যা শব্দ নয়, আলো নয়, স্রেফ উপস্থিতি।

অরিন্দম বইয়ের পাতায় আঙুল রেখে স্থির হয়ে রইল। সে জানে, ভয়কে নাম দিলে ভয় বাড়ে। তাই নাম না দিয়ে, তাকে ‘বাতাস’ বলেই চালিয়ে দিল। বই বন্ধ করল না, আলো নেভাল না, দরজা-জানলা ঠিকঠাক আছে কি না আরেকবার দেখে এসে বিছানায় শুয়ে পড়ল। বালিশের পাশে ধাতব গ্লাসে জল, টেবিলে প্রবন্ধের বই, ড্রয়ারে থেমে থাকা ঘড়ি— ২:১৭। বাইরে ঝিঁঝিঁ সেই একই একগুঁয়েভাবে গাইছে, আর আকাশে মেঘগুলো চেয়ারের পিঠে চাপানো ভেজা কাপড়ের মতো ভারী।

ঘুম নামল ধীরে ধীরে। ঘুম নামার আগে পর্যন্ত সবই নিয়মমাফিক, সবই ব্যাখ্যায় ধরা— শুধু একটাই জিনিস ব্যাখ্যা চাইল না: বারান্দার ভেজা সিমেন্টে যে হালকা কালচে রেখা সে দেখেছিল দরজা লাগানোর সময়, ঠিক মানুষের হাতের পাঁচ আঙুলের মতন ছাপ— সেটি যদি সত্যিই স্রেফ কোনও বৃষ্টির দাগ হয়, তবে কেন সে দরজা বন্ধ করার আগেই ভেতর দিক থেকে দেখা গেল? আর যদি তা দাগ না-হয়… তবে কার হাত?

পর্ব ২ — জানলার আলো

রাত কেটে ভোর আসতে অরিন্দমের ঘুম ভাঙল মোরগের ডাকের সঙ্গে। জানলার ফাঁক দিয়ে হালকা সোনালি আলো ঢুকছে, ধুলো ভাসছে আলোর রেখায়। বিছানার ধারে বসে কিছুক্ষণ গা ম্যাজে, যেন শরীরের ভিতরে ক্লান্তি জমে আছে। গতরাতের দাগ— বারান্দার ভিজে সিমেন্টে হাতের মতো কালচে ছাপ— মনে পড়ে অস্বস্তি হল। সকালে উঠে গিয়ে দেখল, ছাপটা শুকিয়ে মিলিয়ে গেছে। মনে হল, হয়তো রাতের অন্ধকারে চোখ ভুল করেছে। তবু মন থেকে সন্দেহ গেল না।

স্কুলে পৌঁছেই রুটিনমতো ক্লাস নিল। ছাত্ররা অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে থাকে, যেন নতুন শিক্ষক নয়, কোনও পুরোনো কাহিনির চরিত্র তাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। টিফিনের সময় সুনন্দা-দিদি বললেন, “কাল রাতে বাড়ি কেমন লাগল?”
অরিন্দম স্বাভাবিক ভঙ্গিতে উত্তর দিল, “ভালোই। তবে ঘড়িটা কাজ করে না।”
সুনন্দা-দিদি একটু থেমে বললেন, “ঘড়িটা ২:১৭ তেই থেমে আছে তো?”
চোখ কপালে উঠল অরিন্দমের। সে জিজ্ঞেস করল, “আপনি জানলেন কীভাবে?”
দিদি আর কিছু বললেন না, শুধু চশমার কাচ মুছে নিলেন।

বিকেল নাগাদ আকাশে অদ্ভুত এক মেঘ জমল। শালবনের ওপর দিয়ে কালো ছায়া নেমে এল। অরিন্দম যখন বাড়ি ফিরছে, তখন চারদিকের নীরবতা কেমন যেন ঘন হয়ে উঠেছে। দূরে একটা কাক ডাকছে, তাও যেন গলা বন্ধ হয়ে আসা চিৎকারের মতো।

বাড়িতে ঢুকে কিছু রান্না করার চেষ্টা করল। কেরোসিনের চুল্লিতে ডাল বসিয়েই বাইরে উঠোনে গেল হাত ধোয়ার জন্য। ফেরার সময় আচমকা খেয়াল করল, উত্তর দিকের দেয়ালের ভেতর দিকটা হালকা আলোয় ঝিলমিল করছে। কাছে গিয়ে দেখল, আলো নয়— যেন দেওয়ালের ভেতর কোনও দপদপে ছায়া নড়ছে। মুহূর্তেই আলো মিলিয়ে গেল।

রাত নামতেই অদ্ভুত সব শব্দ আসতে শুরু করল। আগে ঝিঁঝিঁর ডাক, তারপর কাঠের তক্তার কড়মড়। অরিন্দম নিজেকে বোঝালো— পুরোনো বাড়ির স্বাভাবিক ব্যাপার। বই নিয়ে বসলো, আলো জ্বেলে রাখতে। কিন্তু ঠিক তখনই, ঘরের জানলা দিয়ে এক টুকরো আলো ভেতরে পড়ল। আলোটা হলুদ নয়, সাদা নয়— একধরনের দগ্ধ কমলা আভা।

অরিন্দম ধীরে ধীরে উঠে জানলার কাছে গেল। বাইরে তাকাতেই বুক কেঁপে উঠল। উঠোনের মাঝখানে যেন একটা অগ্নিবলয় জ্বলছে। তার মধ্যে থেকে শিশুর হাসির শব্দ ভেসে আসছে— খিলখিল, নির্মল, অথচ ভয়ঙ্কর। চোখের সামনে কোনও মানুষ নেই, তবুও হাসি ছড়িয়ে পড়ছে পুরো আঙিনায়।

সে জানলার কপাট বন্ধ করে দিল তড়িঘড়ি। বুকের ভেতর কাঁপুনি, ঘাম ভেঙে যাচ্ছে। কিন্তু পরক্ষণেই খেয়াল করল, জানলার কাঁচে একটুকরো দপদপে আলো এখনও আটকে আছে। যেন বাইরের আগুন কাঁচ ভেদ করে ভেতরে ঢুকে পড়তে চাইছে।

ঘরে ফিরে আসতেই পেছন থেকে ফিসফিস শোনাল— খুব ক্ষীণ, কিন্তু স্পষ্ট:
“আমাদের বাঁচাও…”

অরিন্দম ঘুরে দাঁড়াল। ঘরে কেউ নেই। শুধু দেওয়ালের কালচে দাগটা আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, যেন নতুন আগুনে আবার দগ্ধ হয়েছে।

সে চোখ বুজে মন্ত্রমুগ্ধের মতো বিছানায় বসে রইল। বাইরে আলো ধীরে ধীরে নিভে গেল, শিশুর হাসি মিলিয়ে গেল। কিন্তু দেওয়ালের দাগ যেন আরও গাঢ়, আরও জীবন্ত হয়ে উঠল।

সেই রাতে ঘুম আসেনি। ভোরের প্রথম আলোয় সে স্থির করল, আগামীকাল গ্রামে কারও কাছ থেকে পুরো ঘটনার ইতিহাস জানতে হবে। এই বাড়ির সঙ্গে যে শুধু আগুন নয়, আরও কিছু জড়িয়ে আছে— সেটা এখন অস্বীকার করা যায় না।

পর্ব ৩ — গ্রামের গল্প

ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গেই অরিন্দম বুঝে গেল, আজ আর বসে থাকার সময় নেই। গতরাতের জানলার আগুন, শিশুর হাসি, আর দেওয়ালের ফিসফিস— এগুলো কেবল দুঃস্বপ্ন নয়, কোনও বাস্তব ঘটনার প্রতিধ্বনি। গ্রাম সম্পর্কে আরও জানতে হবে।

সকালে স্কুলে যাওয়ার পথে সে প্রসন্নবাবুর দোকানের সামনে থামল। প্রসন্নবাবু চায়ের কেটলি নামাচ্ছিলেন, গরম ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপ সাজিয়ে রাখছিলেন। অরিন্দম হঠাৎ বলেই ফেলল,
— “প্রসন্নদা, ওই দেউলি-বাড়িতে আসলে কী হয়েছিল?”
প্রসন্নবাবু প্রথমে কিছু না বলে চা ঢালতে লাগলেন। তারপর ধীরে ধীরে বললেন,
— “সব জানতেই হবে? ভালো না, মাস্টারমশাই। যেটুকু জানলেই চলে, সেটা জেনে থাকুন। রাত্তিরে আগুন লাগল, কয়েকজন মারা গেল— এইটুকুই।”

অরিন্দম চুপ করে রইল। কিন্তু চোখের দিকে তাকাতেই প্রসন্নবাবু মুখ ফিরিয়ে নিলেন। মনে হল, তিনি আরও কিছু জানেন, যা বলতে চাইছেন না।

স্কুলে গিয়ে বাংলা পড়ানো সুনন্দা-দিদির কাছে আবার সাহস করে জিজ্ঞেস করল। সুনন্দা-দিদি চশমার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে একটু ইতস্তত করলেন। তারপর আস্তে বললেন,
— “এমন কথা স্কুলে মানায় না, তবু আপনি যেহেতু ওই বাড়িতে থাকেন, জানাই। সেই রাতে দাসগুপ্তদের বাড়িতে দুর্ঘটনা হয়নি— অনেকেই বলে ওটা পরিকল্পিত আগুন। গাঁয়ের জমি নিয়ে বিরোধ ছিল। দাসগুপ্তরা পুজো করত, দান করত— অনেকে তা সহ্য করতে পারত না। আগুনে স্বামী-স্ত্রী, তাদের ছোট মেয়ে পুড়ে যায়। শুধু বড় ছেলে আর দিদি শহরে পালিয়ে বেঁচে যায়।”

অরিন্দম স্তব্ধ হয়ে শুনছিল। তারপর ধীরে বলল,
— “কিন্তু আমি… আমি রাত্তিরে হাসির শব্দ শুনেছি। আগুনের আভা দেখেছি। ওরা এখনও আছে।”

সুনন্দা-দিদি মুখ নামিয়ে নিলেন। “আমরা যারা এখানে থাকি, তারা জানি। রাতে কেউ ওই বাড়ির দিকে তাকায় না। ওরা নাকি প্রতি রাতেই সেই আগুন বাঁচে— আবার মরে, আবার কাঁদে। অসমাপ্ত মৃত্যুর যন্ত্রণা মানুষকে ছাড়ে না।”

অরিন্দমের মেরুদণ্ড বেয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল।

বিকেলের দিকে সে আবার প্রসন্নবাবুর দোকানে গেল। এবার দোকানে দু-একজন চা খাচ্ছিল। তাদের মধ্যেই একজন, দাড়ি-পাকা কৃষক, নাম রঘুনাথ, হঠাৎ কথার ফাঁকে বলে উঠল,
— “ওই পোড়া বাড়ি নিয়ে গল্প করলে ভালো না। ওখানে যাদের আত্মা আছে, তারা শোনে। যারা বেশি খোঁজ নেয়, তাদের জীবনেও আগুন লাগে।”

অরিন্দম একমনে শুনছিল। রঘুনাথের চোখে একটা ভয়, আর সেই ভয়ের আড়ালে গোপন সত্যি।

সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার সময় শালবনের ফাঁক দিয়ে বাতাস বইছিল। আকাশে চাঁদ ওঠেনি, অথচ বাড়ির উত্তর দিকটা হালকা আলোয় ঝলমল করছে। অরিন্দম স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। মনে হল, যেন সেই পরিবার আবার উঠোনে দাঁড়িয়ে আছে, তাদের ছায়া ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে আসছে।

দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতেই বুকের ভেতর অদ্ভুত কাঁপুনি জেগে উঠল। দেওয়ালের দাগটা আরও প্রশস্ত হয়েছে। কাছে গিয়ে তাকাতেই হঠাৎ ভেসে এল শিশুর কণ্ঠস্বর,
— “আমাদের গল্প শোনো…”

অরিন্দম পিছিয়ে এল। চোখে জল চলে আসছে। এখন আর কোনও সন্দেহ নেই— এই বাড়ি শুধু ইট-পাথরের নয়, এর ভেতরে জমে আছে অসমাপ্ত এক ইতিহাস।

কিন্তু সেই ইতিহাস যদি প্রকাশ না করা যায়, তবে কি আত্মারা কখনও মুক্তি পাবে?

পর্ব ৪ — দগ্ধ কণ্ঠস্বর

রাত যত গভীর হয়, পোড়া বাড়ির ভেতরের নিস্তব্ধতা ততই অস্বাভাবিক হয়ে ওঠে। প্রথম দিকে মনে হয়েছিল, স্রেফ পুরোনো বাড়ির কড়িকাঠ নড়ে ওঠার শব্দ, টিনের চালের কড়মড়ানি। কিন্তু গত কয়েক রাতে বারবার একই অভিজ্ঞতা অরিন্দমকে বুঝিয়ে দিয়েছে— এখানে যা ঘটছে, তা কেবল কাঠ-পাথরের ফিসফিসানি নয়।

সেদিন রাতেও অরিন্দম বই নিয়ে বসেছিল। টেবিলের উপর লণ্ঠনটা হালকা দপদপে আলো ছড়াচ্ছিল। বাইরে ঝিঁঝিঁ ডাকছে, মাঝে মাঝে দূরে কুকুরের হাউমাউ। সবকিছু স্বাভাবিক। হঠাৎ কোথা থেকে যেন একটা চাপা কান্নার শব্দ কানে এল। প্রথমে সে ভেবেছিল হয়তো গ্রামের কোনও গৃহস্থের ঝগড়া বা মেয়েমানুষের কান্না। কিন্তু শব্দটা আসছে একেবারে ঘরের ভেতর থেকে— দেওয়ালের কালো দাগের দিক থেকে।

অরিন্দমের বুক ধকধক করছে। কান পেতে শোনার চেষ্টা করল।
“আম্মা… পানি দাও… খুব জ্বলছে…”
শিশুর গলার মতো শব্দ। তার পরেই এক নারীকণ্ঠ— করুণ, কাঁপা—
“ভগবান, আমাদের বাঁচাও… বাঁচাও…”

অরিন্দমের চোখ স্থির হয়ে গেল। দেওয়ালের কালচে দাগটা যেন দপদপ করছে, আগুনের আঁচের মতো। লণ্ঠনের আলোতে সেটা আরও স্পষ্ট। শব্দ বাড়তে লাগল— কেউ যেন ছটফট করছে, কেউ চিৎকার করছে, আবার কারও গলা হঠাৎ থেমে যাচ্ছে।

সে কাঁপতে কাঁপতে জানলার দিকে এগোল। জানলা খুলে বাইরে তাকাতেই বুকের ভেতর রক্ত হিম হয়ে গেল। উঠোনে যেন এক মুহূর্তের জন্য পুরো আগুন জ্বলে উঠল— ঘন লেলিহান শিখা, তার মধ্যে দিয়ে মানুষ দৌড়চ্ছে, বাচ্চারা কাঁদছে, একজন পুরুষ ছুটে গিয়ে জানালায় ধাক্কা মারছে। কিন্তু শব্দ নেই— শুধু কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে দেওয়ালের ভেতর থেকে।

অরিন্দম চোখ মুছল। আবার তাকাতেই দেখল উঠোন খালি, কেবল শিউলি গাছের ছায়া পড়েছে। কোথাও কোনও আগুন নেই।

বিছানায় এসে বসে পড়ল। মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে, ঘাম ভিজে গা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ করেই খুব কাছে, ঠিক কানের পাশে, ফিসফিস করে উঠল এক কর্কশ গলা—
“তুমি কি আমাদের দেখতে পাচ্ছ?”

অরিন্দম ঝাঁকিয়ে উঠল, যেন কেউ বুকের ভেতর হাত ঢুকিয়ে ধরেছে। চারপাশে কেউ নেই, শুধু লণ্ঠনের শিখা দুলছে। তার ঠোঁট শুকিয়ে গেছে। কাঁপা গলায় বলল,
— “তোমরা কারা?”

দেওয়ালের ভেতর থেকে ধীরে ধীরে উত্তর এল—
“আমরা যারা অসমাপ্ত আগুনে রয়ে গেছি… মুক্তি চাই।”

অরিন্দম চোখ বন্ধ করল। বুকের ভেতর ভয় আর সহানুভূতি মিশে এক অদ্ভুত টান জন্ম দিল। মনে হল, এরা শত্রু নয়, বরং মুক্তির জন্য চিৎকার করছে।

রাত কেটে গেলে ভোরের প্রথম আলোয় সে স্থির করল— আর চুপ করে থাকা যাবে না। এই আগুনের ইতিহাস, এই আত্মাদের ব্যথা তাকে বুঝতে হবে।

সকাল হলেই সে ঠিক করবে, কার কাছে গেলে সত্যিটা জানা যাবে। কারণ আর এক রাত এই পোড়া বাড়িতে, দগ্ধ কণ্ঠস্বর শুনে, নিশ্চুপ বসে থাকা তার পক্ষে আর সম্ভব নয়।

পর্ব ৫ — অসমাপ্ত রাত

দিনের বেলায় সবকিছুই এত নিরীহ মনে হয়। স্কুলের মাঠে ছেলেপুলে ছুটোছুটি করছে, দূরে তালগাছের ছায়া পড়েছে, গ্রামের রোদে সব যেন স্বাভাবিক। অথচ অরিন্দমের ভেতরে একটা অস্বস্তি সারা দিন ধরে রয়ে গেল। গত রাতের কান্নার শব্দ, দেওয়ালের দগ্ধ ফিসফিসানি— এগুলোকে কি সত্যিই উপেক্ষা করা যায়?

দুপুরে সুনন্দা-দিদি আবার সতর্ক করলেন। “বাড়িতে একা থাকবেন না রাতে। অন্তত লণ্ঠন জ্বালিয়ে রাখবেন।” তার চোখের ভেতরে অরিন্দম ভয়ের ছায়া স্পষ্ট দেখতে পেল। তবু সে কিছু বলল না।

সন্ধের দিকে আকাশে কালো মেঘ জমল। বাতাসে কেমন একটা ধোঁয়া-ধোঁয়া গন্ধ। অরিন্দম বাড়ি ফেরার পথে লক্ষ্য করল, গ্রামবাসীরা তাকে কেমন সন্দিগ্ধ চোখে দেখছে। যেন সে অজান্তেই এমন এক অঞ্চলে পা দিয়েছে, যেখানে মানুষ যাবার সাহস করে না।

রাত নামল। লণ্ঠন জ্বেলে বই নিয়ে বসেছিল অরিন্দম। চেষ্টা করছিল মনোযোগ সরাতে। কিন্তু যত রাত গড়াচ্ছিল, বাড়ির চারদিক কেমন যেন ঘন অন্ধকারে চেপে আসছিল। যেন দেওয়ালগুলো সরে এসে তাকে বন্দি করছে।

একসময় বাতাস থেমে গেল। ঝিঁঝিঁ ডাকও নেই। হঠাৎ হাহাকার ভেসে এল— প্রবল, যন্ত্রণাভরা। অরিন্দম বুকের ভেতর কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়াল। দেওয়ালের দাগ থেকে এবার শুধু কান্না নয়, একসঙ্গে কয়েকটি কণ্ঠস্বর বেরিয়ে আসছে। শিশু, নারী, পুরুষ— সবাই একসঙ্গে সাহায্য চাইছে।

তারপর হঠাৎ জানলার কাঁচ লাল আভায় ভরে উঠল। অরিন্দম এগিয়ে গিয়ে জানলা খুলতেই দমবন্ধ করা দৃশ্য!

উঠোনের মাঝখানে লেলিহান আগুন জ্বলছে। সেই আগুনের মধ্যে একটা পুরো পরিবার ছটফট করছে। মেয়ে বাচ্চা কাঁদছে, মা তাকে বুকে জড়িয়ে ধরেছে, পুরুষ লোক জল খুঁজতে দৌড়াচ্ছে। আগুনে ভিজে গেছে আকাশ পর্যন্ত। আর সেই আগুনের মধ্যেই তাদের দগ্ধ মুখ— ভয়ে ও যন্ত্রণায় বিকৃত।

অরিন্দম হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। শব্দ যেন বাস্তব। কান্না, চিৎকার, সাহায্যের আর্তি— সব স্পষ্ট। যেন সে ফিরে গেছে সেই অভিশপ্ত রাতে।

কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হল— প্রতিবেশী গ্রামের কোনও মানুষ এ শব্দ শুনছে না, যেন পোড়া বাড়ির ভেতরেই এই দৃশ্য আটকে আছে।

অরিন্দম টের পেল, এ দৃশ্য শুধু সে-ই দেখছে। আর সেই পরিবার প্রতিদিন, প্রতি রাতে একই রাতকে আবার বাঁচছে। তাদের মৃত্যু শেষ হয়নি— প্রতিদিন নতুন করে ঘটছে।

সে জানলার ধারে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে বলল,
— “আমি কীভাবে সাহায্য করব?”

কিন্তু তার কথার উত্তর এল না। আগুনের শব্দ আরও তীব্র হল, আর চিৎকার ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল। চোখের সামনে আগুন হঠাৎ নিভে গেল, উঠোন আবার ফাঁকা।

অরিন্দম কাঁপতে কাঁপতে দরজা বন্ধ করে বিছানায় এসে বসল। বুকের ভেতর একটা ভয়ংকর উপলব্ধি দানা বাঁধল— এই বাড়িতে রাত কখনও শেষ হয় না। প্রতিদিন একই আগুন আবার জ্বলে ওঠে।

অসমাপ্ত রাত। যা শুধু মৃত্যুকে পুনরায় বাঁচায়, মুক্তি দেয় না।

সে জানল, এবার আর চুপ করে থাকা যাবে না। আগামীকাল তাকে অতীতের সত্যিটা খুঁজতেই হবে। না হলে এই আগুন তাকে গ্রাস করবে।

পর্ব ৬ — মুক্তির আহ্বান

সকালের আলোয় চারপাশ সবকিছু যেন আবার নতুন। অথচ অরিন্দমের চোখের নীচে গাঢ় কালো দাগ, সারারাত না-ঘুমোনো ক্লান্তি মুখে ছাপ ফেলেছে। জানলার পাশে দাঁড়িয়ে যখন ধানক্ষেতের দিকে তাকাল, তখন মনে হচ্ছিল— গ্রামের সকালটা কত সহজ! মোরগ ডাকে, বাচ্চারা স্কুলে যায়, মহিলারা কুয়ো থেকে জল তোলে— আর তার ভেতরে জমে আছে সেই দগ্ধ পরিবারের রাত, যে রাত বারবার পুনর্জন্ম নেয়।

আজ আর দেরি করা যাবে না। সত্যি জানতেই হবে।

বেলা গড়িয়ে স্কুল শেষে অরিন্দম সরাসরি রঘুনাথের কাছে গেল। রঘুনাথ কৃষিজমির কাজ শেষ করে গামছা কাঁধে ফেলেছিল। অরিন্দম তাকে আলাদা ডেকে বলল,
— “কাকু, ওই পোড়া বাড়ির সত্যি ইতিহাসটা আমাকে বলুন। আমি জানি, আপনি সব জানেন।”

রঘুনাথ প্রথমে চুপ করে থাকলেন। তারপর ধীরে ধীরে বললেন,
— “মাস্টারমশাই, আপনি অন্য লোকের মতো নন। আপনার চোখে ভয় আছে, কিন্তু তার চেয়ে বেশি আছে খোঁজার ইচ্ছে। শোনেন তবে। সেই রাতে দাসগুপ্তরা শুধু দুর্ঘটনায় মরেনি। ওটা ছিল পরিকল্পিত আগুন। গ্রামের কিছু প্রভাবশালী লোক চেয়েছিল দাসগুপ্তদের জমি দখল করতে। আর তাই অন্ধকার রাতে তাদের ঘরেই আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।”

অরিন্দমের বুকের ভেতর কেঁপে উঠল।
— “তাহলে এতোদিন সবাই চুপ করে রইল কেন?”
রঘুনাথের কণ্ঠ ভারী হয়ে উঠল,
— “ভয়। যারা আগুন লাগিয়েছিল, তারাই পরের দিন কীর্তন, শবযাত্রা, পঞ্চায়েত সব নিয়ন্ত্রণ করল। কেউ মুখ খোলেনি। আর ধীরে ধীরে লোকের মুখে ‘ভূতের বাড়ি’ নামটা ছড়িয়ে গেল।”

অরিন্দম স্তব্ধ হয়ে শুনছিল। মনে হচ্ছিল, দেওয়ালের কালো দাগটা যেন তার সামনে আরও স্পষ্ট হয়ে উঠছে।

সেদিন রাতে বাড়ি ফিরে আর বিছানায় শোয়া হল না। সে লণ্ঠন হাতে বসে রইল, যতক্ষণ না ঘড়ির কাঁটা থেমে থাকা সময়— ২:১৭— ঘনিয়ে এল। ঠিক তখনই আবার সেই কান্না, সেই চিৎকার। কিন্তু আজ অরিন্দম ভয় পেল না।

সে দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে দৃঢ় গলায় বলল,
— “আমি তোমাদের গল্প শুনেছি। আমি জানি, তোমাদের মৃত্যু অন্যায়। যদি সত্যিই কিছু করতে হয়, আমি চেষ্টা করব। কিন্তু কীভাবে তোমাদের মুক্তি দেওয়া যায়, বলো।”

মুহূর্তের জন্য নিস্তব্ধতা। তারপর যেন হাওয়ার ভেতর দিয়ে ফিসফিস ভেসে এল—
“সত্যি প্রকাশ করো… আমাদের অসমাপ্তি শেষ করো…”

অরিন্দম বুকের ভেতর এক অদ্ভুত দৃঢ়তা অনুভব করল। ভয় কেটে গিয়ে জায়গা নিল সহানুভূতি। সে জানল, তাকে কোনওভাবে গ্রামের সামনে সত্যিটা তুলে ধরতে হবে।

কিন্তু সত্যি প্রকাশ করলেই কি আত্মারা মুক্তি পাবে? নাকি তাদের যন্ত্রণার আগুন আরও তীব্র হয়ে উঠবে?

রাতভর সে সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে গেল।

পর্ব ৭ — সত্য উদ্ঘাটন

গ্রামের মানুষজন দিনের আলোয় যতটা সহজ আর নিরীহ লাগে, অরিন্দম টের পেল অন্ধকার নামলেই তাদের মুখের আড়ালে জমে থাকে এক অদৃশ্য ভয়। সত্যিটা জানার সংকল্প সে করেই ফেলেছে, তাই এড়িয়ে যাওয়া আর সম্ভব নয়।

স্কুল থেকে ফেরার পথে সে সুনন্দা-দিদির কাছে গেল। দীর্ঘদিন এই গ্রামে থাকার অভিজ্ঞতা তাঁর।
— “দিদি, আমি জানি ওই আগুনটা দুর্ঘটনা ছিল না। কে দায়ী?”
সুনন্দা-দিদি গম্ভীর চোখে তাকালেন, তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
— “সবাই জানে, কিন্তু কেউ মুখ খোলে না। তখনকার গ্রামপ্রধান মহাদেব সাঁতরা আর তার সঙ্গীরা দাসগুপ্তদের জমি চাইত। দাসগুপ্তরা মানেনি। জমি নিয়ে ঝামেলা একদিনে শেষ হয়নি। তারপরই এ ঘটনা।”

অরিন্দম স্তব্ধ হয়ে শুনল।
— “তাহলে ওরা এখনো বেঁচে আছে?”
— “হ্যাঁ। মহাদেবের ছেলে এখনো পঞ্চায়েতে ক্ষমতাশালী। তাই কেউ কিছু বলে না। যারা বলেছিল, তারা শাস্তি পেয়েছে। কেউ পাগল, কেউ গুম হয়ে গেছে।”

এই কথাগুলো শুনে অরিন্দমের মনে হল, ভূতের ভয়ের চেয়েও ভয়ঙ্কর এই জীবিত মানুষগুলো, যারা দোষ চাপা দিয়ে রেখেছে এতদিন।

রাতে পোড়া বাড়িতে ফিরে সে বারান্দায় বসে ডায়েরিতে লিখতে লাগল সবকিছু। তার ইচ্ছে— কোনওভাবে বাইরে জানানো, সত্যি প্রকাশ করা। কিন্তু গ্রামের ভেতরেই যখন শাসন সেই পরিবারগুলোর হাতে, তখন সে একা কতদূর পারবে?

মধ্যরাতে আবার সেই সময় এলো— ২:১৭। হঠাৎ দরজার কাছে টুপটাপ শব্দ। বাইরে বেরিয়েই দেখল উঠোনে আগুন নয়, বরং তিনটে ছায়া দাঁড়িয়ে আছে— মা, বাবা আর ছোট মেয়ে। তাদের মুখে দগ্ধ যন্ত্রণার ছাপ, চোখে গভীর অনুনয়।

অরিন্দম কেঁপে উঠলেও এবার পিছু হটল না।
— “আমি জানি তোমাদের সঙ্গে অন্যায় হয়েছে। আমি মহাদেবদের নাম ফাঁস করব। যদি এটাই মুক্তি দেয়, আমি করব।”

হঠাৎ মাটির নিচ থেকে কেমন এক দপদপে আলো উঠল। যেন আত্মারা মুহূর্তের জন্য কৃতজ্ঞতা জানাল। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই শিশুটির ছায়া ফিসফিস করে বলল,
— “সত্যি বললেও হবে না। আমাদের বেঁধে রাখা আছে… কারও মন্ত্রে।”

অরিন্দম চমকে গেল। শুধু হত্যাই নয়, এখানে আরও কিছু আছে— তন্ত্র, অভিশাপ, অশরীরী বাঁধন।

সে বুঝল, শুধু সত্যি প্রকাশ করলেই হবে না। তাকে আরও গভীরে যেতে হবে।

গ্রামের বাইরে পুরোনো কবরখানার কাছে, যেখানে লোকজন যায় না, সেখানে হয়তো লুকোনো আছে এই অভিশাপের উত্তর।

অরিন্দম জানল, তাকে সেই পথেই এগোতে হবে।

পর্ব ৮ — তান্ত্রিকের ছাপ

গ্রামের উত্তর প্রান্তে একটা জায়গা আছে, যেটাকে সকলে এড়িয়ে চলে। বটগাছের ছায়ায় ঘেরা, ভাঙা শিলালিপির পাশে বিস্তৃত কবরখানা। কেউ মেলা বা পূজা ছাড়া সেখানে যায় না। অরিন্দম বহুদিন ধরে ও জায়গার কথা শুনছিল— বিশেষত রাতে, যখন বাড়ির ছায়ারা ফিসফিস করে উঠত, বারবার এক অদ্ভুত নাম উচ্চারণ করত, যা সে স্পষ্ট শুনতে পেত না।

এক বিকেলে সাহস সঞ্চয় করে সে বেরিয়ে গেল। সঙ্গে শুধু একটা লণ্ঠন আর ডায়েরি। আকাশে তখন মেঘ, বাতাসে ধুলো উড়ছে। পথটা ক্রমশ ফাঁকা হতে হতে শেষমেশ পৌঁছল এক নির্জন জায়গায়, যেখানে মাটির ওপর কবরের পুরোনো চিহ্ন ছাড়া আর কিছু নেই।

কবরখানার ভেতর ঢুকতেই শরীরের লোম খাড়া হয়ে গেল। হাওয়ার ভেতর ধোঁয়ার মতো গন্ধ, আবার কোথাও শুকনো রক্তের মতো কষাটে ভাব। লণ্ঠনের আলো ফেলে অরিন্দম লক্ষ্য করল, কয়েকটা সমাধির ওপরে অদ্ভুত দাগ খোদাই করা— গোল বৃত্ত, তার মধ্যে ত্রিকোণ, আর কেটে রাখা মন্ত্রের মতো কিছু চিহ্ন।

হঠাৎ পেছনে ফিসফিস শব্দ ভেসে এল। সে ঘুরে তাকাতেই দেখল, কবরের ওপর কুয়াশার মতো ছায়া জমছে। ছায়ার মধ্যে অস্পষ্ট মুখ— সেই পরিবার! মা, বাবা, আর ছোট মেয়ে। তারা ইশারায় তাকে ডাকল।

অরিন্দম সাহস করে কাছে গেল। সঙ্গে সঙ্গেই মাটির ওপরের খোদাইগুলো জ্বলজ্বল করে উঠল লালচে আলোয়। বাতাস ভারী হয়ে উঠল, যেন কবরখানার ভেতর কেউ প্রাচীন মন্ত্র পড়ছে।

একটা কণ্ঠস্বর ভেসে এল— কর্কশ, অথচ গভীর।
“তাদের মৃত্যু শুধু আগুনে হয়নি। আমি তাদের বেঁধে রেখেছি, যেন তারা চিরকাল এই যন্ত্রণা ভোগ করে।”

অরিন্দম কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল,
— “কে তুমি?”

কবরখানার কোণ থেকে একটা ভাঙা শিলার গায়ে অগ্নিদাগ দেখা দিল। তার ভেতর থেকে যেন উঠে এল এক ছায়ামূর্তি— লম্বা, কঙ্কালসার, চোখে আগুনের লেলিহান ঝলক। কণ্ঠস্বর আবার গর্জে উঠল,
“আমি সিদ্ধেশ্বর তান্ত্রিক। এই গ্রাম একসময় আমার ছিল। দাসগুপ্তরা আমার শক্তিকে অস্বীকার করেছিল, তাই তাদের আমি অভিশাপ দিয়েছিলাম। আগুনে তারা মরেছে, কিন্তু শান্তি পায়নি। যতদিন না আমার মন্ত্র ভাঙবে, তারা মুক্তি পাবে না।”

অরিন্দম স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তার মনের ভেতর একদিকে ভয়, অন্যদিকে রাগ জমে উঠল। সে বলল,
— “তুমি তো মৃত! তবে তোমার মন্ত্র এখনও টিকে আছে কেন?”

ছায়ামূর্তির চোখে যেন উপহাসের ঝিলিক।
“অমঙ্গলের জন্য মৃত্যু কোনো শেষ নয়। আমি বেঁচে আছি এই কবরের মাটিতে, এই অভিশপ্ত দাগে। কেউ যদি মুক্তি দিতে চায়, তাকে আগুনের মধ্য দিয়ে অগ্নিযজ্ঞ সম্পূর্ণ করতে হবে।”

কথা শেষ হতেই ছায়ামূর্তি মিলিয়ে গেল, কিন্তু বাতাসে জ্বলন্ত কাঠের মতো গন্ধ ছড়িয়ে রইল।

অরিন্দমের মাথা ঘুরছিল। এখন সে জানে, আত্মাদের মুক্তি শুধু সত্যি প্রকাশে সম্ভব নয়। তাকে সেই তান্ত্রিকের মন্ত্র ভাঙতে হবে, এক বিপজ্জনক অগ্নিযজ্ঞের মধ্য দিয়ে।

বাড়ি ফেরার পথে আকাশে বজ্রপাত হচ্ছিল। অরিন্দম মনে মনে বলল—
“যদি সত্যিই মুক্তি দিতে হয়, তবে আমি সেই যজ্ঞ করব। যেভাবেই হোক।”

পর্ব ৯ — অগ্নিযজ্ঞ

ঝড়ের পরের দিন থেকেই অরিন্দম প্রস্তুতি নিতে শুরু করল। তান্ত্রিকের ফিসফিস কণ্ঠস্বর, কবরখানার জ্বলন্ত দাগ, আর সেই পরিবারের নিঃশেষ না-হওয়া আর্তনাদ তাকে আর শান্ত থাকতে দিচ্ছিল না। গ্রামবাসীর সঙ্গে আলোচনা করার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু সবাই এড়িয়ে গেল। কেউ কেউ স্পষ্ট বলে দিল,
— “মাস্টারমশাই, আগুনের খেলা করতে যাবেন না। ওই শক্তির সঙ্গে লড়তে গেলে মানুষ টিকতে পারে না।”

কিন্তু অরিন্দম জানত, আর পিছোনো যাবে না। প্রতিরাতে আগুনে ছটফট করা সেই পরিবারকে দেখে সে অনুভব করেছে— এরা মুক্তি চায়। যদি সে কিছু না করে, তবে এই চক্র অনন্তকাল চলতে থাকবে।

সন্ধের দিকে সে গ্রামের বাইরের পুরোনো শ্মশানে গেল। শুকনো কাঠ, কিছু তেল, ধূপ, আর নিজের সাহস— এতটুকুই তার কাছে ছিল। সেখানে পৌঁছে চারদিক অদ্ভুতভাবে নিস্তব্ধ হয়ে গেল, যেন বাতাস পর্যন্ত শ্বাস বন্ধ করে অপেক্ষা করছে।

শ্মশানের মাঝখানে সে কাঠ সাজিয়ে রাখল। কবরখানায় দেখা অগ্নিচিহ্ন আঁকতে আঁকতে তার শরীর কেঁপে উঠছিল, তবু হাত থামাল না। মন্ত্র সে জানে না, শুধু বুকের ভেতর থেকে বেরিয়ে এল প্রার্থনা—
“যা অশুভ, তা নিভে যাক। যাদের মৃত্যু অসমাপ্ত, তারা আলো পাক।”

ঠিক তখনই হাওয়ার ঝাপটা উঠল। বাতাসে যেন কারও হাহাকার। কাঠে হঠাৎ আগুন ধরে গেল— অরিন্দম আগুন দেয়নি, তবু লেলিহান শিখা উঠল। আগুনের মধ্যে থেকে সেই পরিবারের ছায়া ভেসে উঠল— মা, বাবা, আর ছোট মেয়ে। তারা অগ্নিবলয়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে, মুখে যন্ত্রণার ছাপ, তবে চোখে এক ঝলক আশা।

অরিন্দম মাটিতে বসে হাত জোড় করে ডাকল,
— “তোমাদের মুক্তি চাই।”

হঠাৎ কানে গর্জন ভেসে এল— সেই তান্ত্রিকের কর্কশ কণ্ঠ।
“তুমি পারবে না! এই আগুন আমার, এই মৃত্যু আমার। যজ্ঞ অসমাপ্ত থাকবেই।”

শিখার ভেতর থেকে বিশাল এক ছায়া উঠে এল। কঙ্কালসার দেহ, চোখে লাল জ্যোতি। আগুন যেন তার হাত থেকে ছড়িয়ে পড়ছে। বাতাস এত ভারী হয়ে গেল যে অরিন্দম হাঁপাতে লাগল।

তবু সে স্থির রইল। বুকের ভেতর থেকে বেরোল কবিতার মতো শব্দ— নিজের শিখানো ছাত্রদের নাম, নিজের পড়া বইয়ের লাইন, রবীন্দ্রনাথের প্রার্থনা, মায়ের শেখানো মঙ্গলগান। শব্দগুলো আগুনের সঙ্গে মিশে এক অদ্ভুত ছন্দ তৈরি করল।

তান্ত্রিকের ছায়া তীব্র হয়ে উঠল, কিন্তু সেই মুহূর্তে শিশুটির ছায়া এগিয়ে এসে অরিন্দমের হাত ধরল। হাতটা ঠান্ডা, অথচ কাঁপছে না। চোখে অনন্ত যন্ত্রণার পরেও ঝলক খেলল মুক্তির।

আগুন হুহু করে বেড়ে উঠল। চারপাশ অন্ধকার হয়ে গেল, শুধু শিখার ভিতর আলো।

শেষ মুহূর্তে অরিন্দমের মনে হল— সে আর একা নয়। এই আগুনে সে-ও জড়িয়ে গেছে। হয়তো নিজের জীবন দিয়েই তাকে যজ্ঞ সম্পূর্ণ করতে হবে।

অগ্নিবলয়ের মধ্যে ডুবে গিয়ে সে শুধু একটাই কথা বলল,
— “মুক্তি।”

তারপর আগুন সবকিছু ঢেকে নিল।

পর্ব ১০ — আলো না অন্ধকার

অগ্নিশিখার ভেতরে ঢুকে পড়ার পর সময় যেন অর্থহীন হয়ে গেল। অরিন্দম অনুভব করল, তার চারপাশে হাজারো কান্না, চিৎকার, দগ্ধ শরীরের গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে। আগুনের প্রতিটি শিখা যেন অতীতের প্রতিটি যন্ত্রণার রূপ ধরে তার দিকে ঝাঁপিয়ে আসছে। তবু ভয় নয়— বুকের ভেতরে এক অদ্ভুত দৃঢ়তা তৈরি হচ্ছিল।

সে দেখল— মা শিশুকে আঁকড়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছেন, চোখে অনন্ত অনুনয়। বাবা ছটফট করছে, মুখে রক্তাক্ত যন্ত্রণা। শিশুর কণ্ঠস্বর আবার ভেসে এল—
— “আমাদের ফিরিয়ে দাও আলোয়…”

অরিন্দম হাত জোড় করে ডেকে উঠল,
— “তোমাদের আমি মুক্তি দিচ্ছি। যে অন্যায় তোমাদের উপর হয়েছে, তা আমি বলব, লিখব, সবাইকে জানাব। আর এই যজ্ঞ আমি শেষ করব।”

শিখার ভেতরে বজ্রপাতের মতো শব্দ হল। কবরখানায় দেখা সেই তান্ত্রিক ছায়া গর্জে উঠল—
— “অসম্ভব! অভিশাপ কখনও ভাঙবে না।”

অরিন্দম বুকের ভেতর থেকে মন্ত্র জানত না, কিন্তু নিজের সত্যিটাই উচ্চারণ করল।
— “সত্যিই মন্ত্র। অন্যায় ভাঙার শক্তি অন্য কিছুর নেই।”

এই কথাগুলো উচ্চারণ করতেই শিখার ভেতর এক বিস্ময়কর পরিবর্তন ঘটল। আগুনের লেলিহান শিখা সাদা আলোয় পরিণত হল। যন্ত্রণাভরা মুখগুলো ধীরে ধীরে শান্ত হলো। মা শিশুর কপালে চুমু দিলেন, বাবা হাত বাড়ালেন আকাশের দিকে। তাদের মুখে অদ্ভুত প্রশান্তি ছড়িয়ে পড়ল।

তান্ত্রিকের ছায়া ছটফট করতে লাগল, ভেসে আসছিল তার গর্জন—
— “না… না… এভাবে হবে না…”

কিন্তু মুহূর্তের মধ্যেই আলো তাকে গ্রাস করল। ছায়া ভেঙে গেল কণামাত্রে, অদৃশ্য হয়ে গেল অন্ধকারে।

অরিন্দমের চোখ ঝাপসা হয়ে এল। শরীর কেঁপে উঠছিল, তবু সে দেখল— সেই পরিবার ধীরে ধীরে আলোয় মিলিয়ে যাচ্ছে। যাওয়ার আগে শিশুটি তার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসল। সেই হাসির মধ্যে কোনও ভয় ছিল না, ছিল শুধু মুক্তির দীপ্তি।

শিখা নিভে গেল। চারদিক আবার নিস্তব্ধ। শুধু বাতাসে গন্ধ— পোড়া কাঠ নয়, বরং ধূপের মতো শান্ত গন্ধ।

অরিন্দম মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। কতক্ষণ পর চোখ খুলল জানে না। ভোরের আলো ছড়িয়ে পড়েছে, শালবনের পাতায় শিশির ঝলমল করছে। পোড়া বাড়ির আঙিনায় কোনও ছায়া নেই, কোনও কান্না নেই।

সেদিন থেকে গ্রামের মানুষ খেয়াল করল— পোড়া বাড়ি আর রাতে আলো জ্বলে ওঠে না। শিশুর হাসি বা কান্নার শব্দ আর শোনা যায় না। বাড়িটা নিঃশব্দ, সাধারণ এক ধ্বংসাবশেষ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

কিন্তু অরিন্দম?

কেউ বলে, সে সেদিন যজ্ঞে মারা গিয়েছিল। কেউ বলে, তাকে ভোরে শ্মশানের ধারে অচেতন অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল। আবার কারও মতে, সে বেঁচে ছিল, স্কুলে পড়াতও, কিন্তু তার চোখে তখন চিরকালীন এক দূরের আলো— যেন অন্য কোথাও তার অর্ধেক রয়ে গেছে।

গ্রামে এখনো গল্প চলে— পোড়া বাড়ির অভিশাপ শেষ হয়েছে, কারণ এক অচেনা শিক্ষক নিজের প্রাণ দিয়েছিল মুক্তির জন্য।

কিন্তু যারা খুব ভোরে বাড়ির কাছে দিয়ে যায়, তারা শপথ করে বলে— কখনও কখনও জানলার ভেতর থেকে এক পুরুষের ছায়া দেখা যায়। হাতে খাতা-কলম, চোখে এক অদ্ভুত প্রশান্তি।

তাহলে কি অরিন্দমও সেই পোড়া বাড়ির অংশ হয়ে গেল?
নাকি সত্যিই আলো তাকে বাঁচিয়ে দিল?

উত্তর আজও কেউ জানে না।

সমাপ্ত —

WhatsApp-Image-2025-09-01-at-1.31.38-AM.jpeg

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *