Bangla - তন্ত্র

অগ্নি-মুদ্রার রহস্য

Spread the love

কলকাতার পুরনো শহরের অলিগলি পেরিয়ে যখন গঙ্গার ধারের কাছাকাছি এক মন্দিরের ভগ্নাবশেষে প্রত্নতত্ত্ব খনন শুরু হয়, তখন সৌরভ সেনগুপ্ত তার গবেষক দলকে নেতৃত্ব দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। ভোরের আলোয় ভেজা গম্ভীর মন্দিরপ্রাঙ্গণটিতে শূন্য নীরবতা নেমে ছিল, শুধু কাকের ডাক আর হাওয়া বয়ে যাওয়া পাতার শব্দ ছাড়া। সৌরভ ছিলেন ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক, বহুদিন ধরে প্রাচীন মুদ্রা ও শিলালিপি নিয়ে কাজ করছেন, তবে এ রকম গোপন শক্তির গুজব জড়ানো কোনো নিদর্শন তিনি হাতে পাননি। খননের কাজ এগোতে এগোতে যখন মাটির গভীরে পাথরের স্তূপ সরানো হলো, হঠাৎই কারও হাতের আঘাতে ধাতব আওয়াজ বেজে উঠল। সবাই থমকে দাঁড়াল, আর সৌরভ ধীরে ধীরে নিচু হয়ে সেই মাটির ফাঁক থেকে এক অদ্ভুত মুদ্রা তুলে নিলেন। মুদ্রাটি সোনালি রঙের হলেও বয়সের ভারে অন্ধকারে ঢেকে গেছে, আর তার গায়ে খোদাই করা এক অজানা দেবতার মুখাবয়ব স্পষ্ট হয়ে ওঠে। মুদ্রার চারদিকে সূক্ষ্ম অক্ষরে খোদাই করা মন্ত্রচিহ্ন যেন কোনো পরিচিত লিপির নয়, একেবারে অচেনা ও রহস্যময়। সৌরভের বুকের ভেতর এক অদ্ভুত শিহরণ বইতে লাগল, যেন এই নিদর্শন তার শিরায় আগুনের মতো ঢুকে পড়ছে।

দিন গড়িয়ে সন্ধ্যা নামতেই মন্দিরের চারপাশে আলো-আঁধারির খেলা শুরু হলো, আর গবেষণা দলের সদস্যরা খনন শেষে একে একে ফিরে যেতে লাগলেন। সৌরভ মুদ্রাটি হাতে নিয়ে আরও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলেন, এমন সময় মন্দিরের প্রধান সেবাদার তিলোত্তমা দেবী এসে দাঁড়ালেন তার সামনে। তার বয়স পঞ্চাশের কোঠায় হলেও অস্বাভাবিক শান্ত মুখ আর অদ্ভুত দৃষ্টিতে মনে হচ্ছিল, তিনি যেন বহু প্রাচীন কোনো গোপন জ্ঞানের অধিকারী। তিনি মৃদু হাসি দিয়ে বললেন, “প্রাচীন মন্দিরের বুকে যা লুকোনো থাকে, সবকিছু বাইরের আলোয় আনার নয়, অধ্যাপক মশাই।” সৌরভ একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনি কি এই মুদ্রার বিষয়ে আগে থেকেই জানতেন?” তিলোত্তমা দেবী কিছুক্ষণ চুপ থেকে ধীরে বললেন, “আগুনে স্পর্শ করলে তার আসল শক্তি প্রকাশ পায়। কিন্তু সাবধান হোন—প্রতিটি শক্তিরই একটা মূল্য আছে।” তার কণ্ঠস্বর এতটাই গভীর ও দ্ব্যর্থবোধক ছিল যে সৌরভের মনে হলো তিনি যেন মুদ্রাকে অনেক আগে থেকেই চেনেন, হয়তো নিজেই এর রক্ষক।

সেই রাতে সৌরভ মুদ্রাটি নিজের টেবিলে রেখে বসে পড়লেন নোটবই ও পুরনো শিলালিপির খাতা নিয়ে। ঘরে কেবলমাত্র একটি প্রদীপ জ্বলছিল, তার মৃদু আলোয় মুদ্রার গায়ে আঁকা অচেনা অক্ষরগুলো ঝিলমিল করছিল। কৌতূহলে তিনি হঠাৎ মুদ্রার কাছে প্রদীপের শিখা এগিয়ে দেন, আর ঠিক সেই মুহূর্তেই মুদ্রাটি যেন শ্বাস ফেলতে শুরু করে—তপ্ত ধাতব গায়ে হালকা জ্যোতি ছড়িয়ে পড়ে, আর পরক্ষণেই এক অজানা মন্ত্রধ্বনি বাতাসে ভেসে ওঠে। শব্দটা স্পষ্ট নয়, তবে তীব্র প্রতিধ্বনি হয়ে বারবার কানে বাজতে লাগল। সৌরভ প্রথমে ভেবেছিলেন হয়তো কল্পনা করছেন, কিন্তু কয়েক মুহূর্ত পরই চারপাশের দেয়ালে প্রতিধ্বনি হতে লাগল, যেন ঘরটাই কোনো গোপন মন্দিরে রূপান্তরিত হয়েছে। হঠাৎ প্রদীপের শিখা দ্বিগুণ উঁচু হয়ে উঠল, আর মুদ্রার ভেতর থেকে একরাশ উষ্ণ আলো ছড়িয়ে পড়ল। ভয়ে ও বিস্ময়ে কাঁপতে কাঁপতে সৌরভ মুদ্রাটি টেবিলে ফেলে দিলেন, আর সঙ্গে সঙ্গে সব শান্ত হয়ে গেল—কেবলমাত্র তার কপালে ঘাম জমে উঠল, আর বুকের ভেতর এক অজানা আতঙ্ক জমে রইল।

পরদিন সকালে মন্দিরে আবার গেলে তিলোত্তমা দেবী দূর থেকে তার দিকে তাকিয়ে মৃদু মাথা নাড়লেন, যেন তিনি আগেই বুঝে গেছেন সৌরভ মুদ্রার আসল রহস্য ছুঁয়ে ফেলেছেন। তিনি কাছে এসে ফিসফিস করে বললেন, “আপনি যা শুনেছেন, তা কেবল শুরু। এই মুদ্রা সাতজন তান্ত্রিকের আত্মাকে বেঁধে রেখেছে। তাদের অমরত্বের চাবি এখানেই লুকিয়ে আছে। কিন্তু মনে রাখবেন—যে এই শক্তিকে নিজের জন্য ব্যবহার করতে চাইবে, সে শেষমেশ আগুনেই ভস্ম হবে।” তার চোখের গভীরতায় ভয়ানক সতর্কবার্তা লুকিয়ে ছিল, তবুও তার ঠোঁটের কোণে অদ্ভুত এক হাসি খেলা করছিল। সৌরভ হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন—তিনি বুঝতে পারলেন এই মুদ্রা শুধু প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন নয়, বরং এমন এক রহস্যের দ্বার যা তাকে নিয়ে যাবে মৃত্যুর অগ্নিশিখার সীমান্তে। এবং হয়তো এই প্রথমবার তিনি অনুভব করলেন, গবেষণা নয়, বরং এক ভয়ংকর খেলায় তিনি প্রবেশ করতে চলেছেন, যেখানে সত্য আর মিথ্যার সীমারেখা দাউদাউ করে জ্বলতে থাকবে।

সৌরভ যখন প্রাচীন মুদ্রাটি সংগ্রহ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারে ফিরলেন, তখন তাঁর মনে ছিল হাজারো প্রশ্ন। সেদিন রাতেই, সবাই চলে যাওয়ার পর, তিনি মুদ্রাটিকে আরও গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করার জন্য ল্যাবে বসে রইলেন। প্রথমে তিনি মুদ্রাটিকে সাধারণ আলোয়, পরে আলট্রাভায়োলেট ল্যাম্পের নিচে পরীক্ষা করলেন। দেখা গেল, মুদ্রার ভেতরে সূক্ষ্ম খোদাই করা কিছু চিহ্ন রয়েছে, যা স্বাভাবিক চোখে ধরা পড়ে না। সেই চিহ্নগুলো দেখতে অদ্ভুত লিপির মতো, যেগুলো পরিচিত কোনো প্রাচীন ভাষার সাথেও মেলে না। তাঁর মনে হলো মুদ্রাটির গায়ে লুকোনো রহস্য কেবল দৃশ্যমান নয়, হয়তো শ্রাব্যও হতে পারে। এভাবেই কৌতূহল তাঁকে বাধ্য করল এক অদ্ভুত পরীক্ষার দিকে—তিনি মুদ্রাটিকে একটি ছোট আগুনের শিখায় রাখলেন। মুহূর্তের মধ্যে মুদ্রাটি লালচে হতে শুরু করল এবং হঠাৎ চারপাশে প্রতিধ্বনির মতো শব্দ ছড়িয়ে পড়ল। প্রথমে মনে হলো যেন ল্যাবের দেয়ালে তাঁর নিজের নিশ্বাস ফিরে আসছে, কিন্তু আসলে তা ছিল না—বরং এক অদ্ভুত, ঘন প্রতিধ্বনি, যার মধ্যে ছিল অচেনা সুর, যেন কোনো প্রাচীন মন্ত্র গোপনে উচ্চারণ করছে কেউ। সৌরভ স্তম্ভিত হয়ে বসে রইলেন। তাঁর চারপাশের যন্ত্রপাতি কেঁপে উঠল, টেবিলের কাঁচের জারগুলো হালকা দুলতে লাগল, আর জানালার বাইরে থেকে আসা বাতাসও যেন ভেতরের এই প্রতিধ্বনির সাথে এক হয়ে গিয়েছিল।

এই অস্বাভাবিক ঘটনার ব্যাখ্যা খুঁজে বের করতে সৌরভ সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর সহকর্মী ঋতাভরী মুখার্জিকে ফোন করলেন। ঋতাভরী ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সহকারী অধ্যাপক, এবং প্রাচীন সভ্যতার প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন নিয়ে গবেষণার জন্য পরিচিত। তিনি সৌরভের হঠাৎ উত্তেজিত কণ্ঠ শুনে প্রথমে অবাক হলেও পরদিন সকালেই ল্যাবে চলে এলেন। সৌরভ তাঁকে আগের রাতের অভিজ্ঞতা বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করলেন। প্রথমে ঋতাভরী এই দাবিকে অতি কল্পনাপ্রসূত ভেবে হেসে উড়িয়ে দিলেন, কিন্তু মুদ্রাটির গায়ে খোদাই করা অদ্ভুত প্রতীকগুলো দেখার পর তিনিও কৌতূহলী হয়ে উঠলেন। তাঁরা দু’জনে আবার পরীক্ষা চালালেন—এইবার আগুনে মুদ্রাটি রাখার সঙ্গে সঙ্গেই ঋতাভরীও প্রতিধ্বনি শুনতে পেলেন। শব্দটি এতই অদ্ভুত ছিল যে বোঝা যাচ্ছিল না এটি কোনো ভাষা, না কি প্রকৃতির গোপন সুর। ঋতাভরীর চোখে বিস্ময় জমে উঠল—তিনি বুঝতে পারলেন যে মুদ্রাটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে এমন এক প্রাচীন শক্তি, যা কেবল দৃশ্যমান জিনিস দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাবে না। মুদ্রার চারপাশে যেন অদৃশ্য শক্তির তরঙ্গ তৈরি হচ্ছিল, এবং তা মানুষকে এক অদ্ভুত ভয়ের পাশাপাশি আকর্ষণের মধ্যে ফেলছিল।

এরপর শুরু হলো তাঁদের যৌথ গবেষণা। ঋতাভরী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচীন আর্কাইভ ঘেঁটে মুদ্রার প্রতীকের মিল খুঁজতে লাগলেন। সৌরভ meanwhile পদার্থবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে প্রতিধ্বনির বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা খুঁজছিলেন। তাঁরা আবিষ্কার করলেন যে প্রতীকগুলো কিছুটা হলেও প্রাচীন ভারতীয় তান্ত্রিক মুদ্রায় দেখা যায়, তবে সেগুলোর মধ্যে আবার মিশ্রিত রয়েছে অজানা কিছু লিপি, যেগুলো হয়তো কোনো বিলুপ্ত সভ্যতার অংশ। প্রতিধ্বনির রহস্য আরও গভীর হলো যখন তাঁরা লক্ষ্য করলেন, প্রতিবার মুদ্রাটি গরম করলে প্রতিধ্বনির ধ্বনি ভিন্ন হয়। কখনও শোনা যায় মন্দিরের ঘণ্টার মতো ধ্বনি, কখনও সমুদ্রের গর্জন, আবার কখনও অস্পষ্ট মানবকণ্ঠের মতো আওয়াজ। ঋতাভরী লক্ষ্য করলেন প্রতিধ্বনির সুরের ভেতরে কোনো গাণিতিক ছন্দ আছে—যেন এক ধরণের কোড, যা ডিকোড করলে হয়তো মুদ্রার প্রকৃত উৎস জানা যাবে। সৌরভের বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ বলছিল, এই ধ্বনি কেবল প্রাকৃতিক প্রতিধ্বনি নয়, বরং কোনো অদৃশ্য শক্তি বা শক্তিক্ষেত্রের সাথে যুক্ত। তাঁরা ধীরে ধীরে উপলব্ধি করলেন, মুদ্রাটি হয়তো কেবল একটি প্রত্নবস্তু নয়, বরং কোনো প্রাচীন সভ্যতার ‘চাবি’, যা হারিয়ে যাওয়া জ্ঞানের দরজা খুলে দিতে পারে।

রাত গভীর হতে থাকল আর তাঁদের গবেষণা আরও রহস্যময় হয়ে উঠল। সৌরভ ও ঋতাভরী দুজনেই অনুভব করতে লাগলেন, প্রতিবার মুদ্রাটি প্রতিধ্বনি তুললে তাঁদের চারপাশের পরিবেশ বদলে যাচ্ছে। ল্যাবের বাতাস যেন ভারী হয়ে উঠছে, আর অদৃশ্য কোনো চোখ তাঁদের দিকে তাকিয়ে আছে বলে মনে হচ্ছে। মাঝে মাঝে আলো নিভে গিয়ে আবার জ্বলে উঠছিল, যন্ত্রপাতির সুইগুলো অস্বাভাবিকভাবে নড়ছিল, এবং জানালার বাইরে থেকেও অদ্ভুত ছায়া যেন ভেসে আসছিল। এই অভিজ্ঞতা তাঁদের দুজনের মনেই ভয় এবং কৌতূহলকে আরও উসকে দিল। ঋতাভরী বললেন—“সৌরভ, এটা কেবল বিজ্ঞানের বিষয় নয়। এর সঙ্গে ইতিহাস, আধ্যাত্মিকতা এবং হয়তো নিষিদ্ধ শক্তিরও যোগ রয়েছে।” সৌরভ চুপ করে মাথা নাড়লেন, কারণ তিনিও একই অনুভূতি পাচ্ছিলেন। মুদ্রাটি কেবল কোনো মৃত সভ্যতার অবশিষ্ট নয়, বরং এক জীবন্ত শক্তি, যা এখনো প্রতিধ্বনির মাধ্যমে নিজের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। এই উপলব্ধি তাঁদের গবেষণাকে নতুন পথে নিয়ে গেল—তাঁরা সিদ্ধান্ত নিলেন মুদ্রার উত্স খুঁজে বের করতে হবে, এবং হয়তো সেই উত্সের সন্ধানে তাঁদের যাত্রা এক ভয়ঙ্কর ও অজানা দিগন্তে পা বাড়াবে।

মন্দিরের পাশের অন্ধকার গলিটি যেন এক অদ্ভুত রহস্যের গর্ভে লুকিয়ে ছিল, যেখানে দিনের আলো ঢুকলেও ছায়া কাটত না। সেই গলির ধারে প্রতিদিন সন্ধ্যার পর শোনা যেত ভিক্ষুক শঙ্খনাথের অদ্ভুত ছড়া—“আগুনে জাগে অক্ষর, রক্তে লেখা শপথ।” গ্রামের মানুষজন শঙ্খনাথকে তেমন পাত্তা দিত না, অনেকে তাকে পাগল বলেই ভাবত, আবার অনেকে মনে করত সে কোনো অশুভ শক্তির কবলে পড়েছে। তার গলার স্বর যেন কাঁপতে কাঁপতে হাড় কাঁপানো শীতল হাওয়া বয়ে আনত, আর অন্ধকার গলির ছায়া যেন প্রতিটি শব্দকে গ্রাস করে ভৌতিক সুরে ফিরিয়ে দিত। কিন্তু সেই রাতে সৌরভ যখন মন্দিরে প্রদীপ দিতে গিয়ে গলির ভিতর দিয়ে ফিরছিল, হঠাৎ তার কানে ভেসে এল শঙ্খনাথের সেই ছড়ার নতুন রূপ—“আগুনে জাগে অক্ষর, রক্তে লেখা শপথ, শতাব্দী পেরিয়েও সে আবার জাগবে, ছায়ার সাথে ছায়া মিলে।” এই কথাগুলো যেন তার বুকের ভেতরে অজানা এক শীতলতার ঢেউ ছড়িয়ে দিল। সৌরভের মনে হতে লাগল, এই ছড়ার ভেতরে শুধু পাগলামি নেই, বরং কোনো প্রাচীন সত্য চাপা পড়ে আছে, যা হয়তো মন্দিরের সঙ্গেই জড়িয়ে আছে। তার চোখে যেন এক মুহূর্তের জন্য দেখা গেল শঙ্খনাথের মলিন চোখদুটো রক্তিম হয়ে উঠেছে, আর ঠোঁটে একটি বাঁকা হাসি খেলে গেছে, যা মানুষের নয়, বরং কোনো অশুভ শক্তিরই প্রতিচ্ছবি।

সেই রাতেই সৌরভ ঘরে ফিরে গভীর ঘুমে ঢলে পড়ল, কিন্তু তার ঘুম ছিল না শান্ত, বরং এক অদ্ভুত দুঃস্বপ্নে ভরপুর। স্বপ্নের মধ্যে সে নিজেকে দেখতে পেল এক শ্মশানের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে, চারপাশে আগুনের আলোয় ছায়ারা নাচছে। সেই ছায়াদের মধ্যে একজন স্পষ্ট হয়ে উঠল—এক লম্বা, কৃশকায় মানুষ, যার চোখ জ্বলজ্বল করছে অদ্ভুত লাল আলোয়। তার শরীরে ছিল গাঢ় লাল তিলক, আর গলায় ঝুলছিল হাড়ের মালা। সে নিজেকে পরিচয় দিল বীরেশ্বর নামে, যে একশো বছর আগে এক ভয়ঙ্কর তান্ত্রিক ছিল। তার কণ্ঠস্বর গম্ভীর অথচ বিষাক্ত, “আমি বেছে নিয়েছিলাম অমরত্বের পথ। আগুন ও রক্তের মিশ্রণে জন্ম নিয়েছিল মুদ্রা, যা মানুষের সময়কে ভেঙে দিতে পারে। আমি আমার শরীরকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়েছিলাম, কিন্তু তার বিনিময়ে আমার আত্মা বন্দি হয়ে আছে এই অন্ধকারের গোলকধাঁধায়। এখন আমি ছায়া হয়ে আছি, কিন্তু আবারও আলোয় ফিরব, কারণ প্রতিটি শপথের সময় আছে, আর তোমার রক্তেই সেই শপথ পূর্ণ হবে।” সৌরভ ভয়ে চিৎকার করতে চাইল, কিন্তু গলা থেকে কোনো শব্দ বের হল না। মাটির নিচ থেকে যেন হাড়গোড়ের শব্দ উঠছিল, আর শ্মশানের আগুন হঠাৎ নীল হয়ে ছড়িয়ে পড়ছিল চারদিকে।

হঠাৎ করে স্বপ্নের ভেতরেই সৌরভের কানে শঙ্খনাথের ছড়াটি বাজতে শুরু করল, কিন্তু এবার তা স্পষ্টতই বীরেশ্বরের কণ্ঠস্বরের সঙ্গে মিশে গেল—“আগুনে জাগে অক্ষর, রক্তে লেখা শপথ।” সৌরভ যেন দেখতে পেল তার নিজের হাত কেটে যাচ্ছে অদৃশ্য কোনো ছুরির আঘাতে, আর রক্ত ফোঁটা ফোঁটা করে মাটিতে পড়ছে। সেই রক্ত মাটিতে পড়তেই লাল অক্ষরে একটি মুদ্রা আঁকা হয়ে উঠল, যার প্রতিটি রেখা থেকে আগুনের শিখা বেরোচ্ছে। সেই অগ্নিমুদ্রার ভেতর থেকে আবার ভেসে উঠল বীরেশ্বরের ছায়া, এবার আরও ভীতিকর রূপে। তার মুখের চামড়া যেন খসে পড়ছে, কিন্তু চোখে লাল আগুন স্থির। সে হাত বাড়িয়ে সৌরভকে ডেকে নিচ্ছে, “এসো, তোমার শরীরই হবে আমার নতুন আশ্রয়।” সৌরভ প্রাণপণে পিছিয়ে আসতে চাইছে, কিন্তু চারপাশের শ্মশান যেন তাকে ঘিরে ফেলছে, প্রতিটি ছায়া তার হাত ধরে টেনে নিচ্ছে আগুনের দিকে। তার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল, বুক ধড়ফড় করতে করতে সে অনুভব করল যেন মৃত্যু তার খুব কাছেই এসে গেছে। কিন্তু হঠাৎই তার চোখ খুলে গেল, সে দেখল সে ঘরে শুয়ে আছে, শরীর ভিজে গেছে ঠান্ডা ঘামে। কিন্তু বিস্ময়ের বিষয়, তার হাতের কব্জিতে সত্যিই এক ছোট্ট আঁচড় কেটে আছে, আর সেখান থেকে শুকনো রক্তের দাগ লেগে রয়েছে।

সৌরভ ভয়ে হতভম্ব হয়ে বসে পড়ল, কিন্তু সেই ভয়কে সরিয়ে দিয়ে তার মধ্যে জন্ম নিল এক প্রবল কৌতূহল। এই কি কেবল স্বপ্ন ছিল? যদি তাই হয় তবে শরীরে এই আঁচড়ের দাগ এলো কীভাবে? শঙ্খনাথের ছড়ার ভেতরে যে রহস্য লুকিয়ে আছে, তা কি আসলেই বীরেশ্বরের অমরত্বের সাধনার সঙ্গে যুক্ত? আর কেনই বা সেই তান্ত্রিক এখন তার স্বপ্নে এসে উপস্থিত হচ্ছে? সৌরভ বুঝতে পারছিল, মন্দিরের গলির অন্ধকার, শঙ্খনাথের ছড়া আর বীরেশ্বরের ছায়া—সবকিছুর মধ্যে অদৃশ্য এক সুতোয় গাঁথা সম্পর্ক রয়েছে। ভোর হতে না হতেই সে জানল, তার জীবন আর আগের মতো সাধারণ থাকবে না। হয়তো কোনো প্রাচীন অভিশাপের ছায়া তার ওপর নেমে এসেছে, অথবা কোনো অজানা শক্তি তাকে বেছে নিয়েছে। জানালার বাইরে ভোরের আলো ফুটলেও, সৌরভের মনে হচ্ছিল অন্ধকারের ছায়া এখনো তার ঘর ছেড়ে যায়নি। তার বুকের ভেতরে কেবল প্রতিধ্বনি হয়ে বাজতে লাগল সেই অমোঘ ছড়া—“আগুনে জাগে অক্ষর, রক্তে লেখা শপথ।”

কলকাতার অভিজাত বেলভিউ রোডের এক বিশাল অট্টালিকায় বাস করেন অগ্নিদেব মুখোপাধ্যায়—শহরের বিখ্যাত সংগ্রাহক, ব্যবসায়ী এবং ধনকুবের। তাঁর ব্যক্তিত্বের চারপাশে রয়েছে এক অদ্ভুত রহস্যময়তা; কেউ তাঁকে শিল্পপতি বলে, কেউ বা তাঁকে অদ্ভুত খেয়ালখুশির মানুষ মনে করে। তবে যেটুকু সত্য, তা হলো তিনি সারা পৃথিবী থেকে দুর্লভ জিনিস সংগ্রহ করার নেশায় মগ্ন। প্রাচীন গ্রন্থ থেকে শুরু করে পুরোনো অস্ত্রশস্ত্র, রাজদরবারের অলঙ্কার, এমনকি অদ্ভুত পাথর বা প্রত্নবস্তু—যা-ই হোক, অগ্নিদেবের সংগ্রহশালায় তার জায়গা হয়েছে। এই সংগ্রহ তাঁকে একদিকে খ্যাতি দিয়েছে, অন্যদিকে এক অস্বস্তিকর সুনামও—কারণ অনেকেই বলে থাকেন যে তাঁর ধনদৌলতের অন্তরালে রয়েছে এক অন্ধকার দিক, যেখানে লোভ ও নির্দয়তা মিশে আছে। একদিন সকালবেলায় কলকাতার একটি নামী ইংরেজি সংবাদপত্রে সাংবাদিক সিদ্ধার্থ ঘোষের লেখা একটি দীর্ঘ প্রতিবেদন প্রকাশিত হলো, যেখানে বীরভূম জেলার এক প্রত্যন্ত গ্রামে খুঁজে পাওয়া এক রহস্যময় মুদ্রার কথা লেখা আছে। এই মুদ্রা নাকি পাল যুগের সময়কার, এবং তাতে অদ্ভুত এক লিপি খোদাই করা আছে, যা ইতিহাসবিদদের কাছেও অচেনা। অগ্নিদেব যখন এই রিপোর্ট পড়লেন, তাঁর রক্ত যেন হঠাৎ উষ্ণ হয়ে উঠল—চোখ দুটো তীক্ষ্ণ আগুনে জ্বলে উঠল। তিনি জানতেন, এমন এক মুদ্রা তাঁর সংগ্রহকে শুধু সম্পূর্ণ করবে না, বরং তাঁকে ইতিহাসের পাতায় অমর করে তুলবে।

অগ্নিদেব তৎক্ষণাৎ তাঁর বিশ্বস্ত সহকারীকে দিয়ে সাংবাদিক সিদ্ধার্থ ঘোষের সঙ্গে যোগাযোগ করালেন। সিদ্ধার্থ প্রথমে খানিকটা দ্বিধা করলেও, অগ্নিদেবের নাম শুনে রাজি হয়ে গেলেন সাক্ষাৎকারে। বেলভিউ রোডের সেই বিশাল বাড়ির দরজা দিয়ে ঢোকার পর সিদ্ধার্থ যেন এক অন্য জগতে প্রবেশ করলেন। চারপাশে কাঁচের আলমারিতে সাজানো দুর্লভ মূর্তি, প্রাচীন গ্রন্থ, রাজদরবারের রত্নখচিত তলোয়ার, মগধযুগের পিতলের বাটি—সবকিছুই যেন জাদুঘরের মতো। অগ্নিদেব গম্ভীর ভঙ্গিতে সিদ্ধার্থকে বসতে বললেন, এবং খুব শান্ত গলায় প্রশ্ন করলেন—“তুমি যে রিপোর্টটা লিখেছ, সেখানে যে সৌরভ নামের ছেলেটার কথা উল্লেখ করেছ, যে ওই মুদ্রাটা খুঁজে পেয়েছে—তার সঙ্গে কি তোমার যোগাযোগ আছে?” সিদ্ধার্থ প্রথমে কিছুটা আশ্চর্য হয়ে গেলেন, কিন্তু তারপর সৎভাবে বললেন যে, হ্যাঁ, সৌরভের সঙ্গেই তিনি সরাসরি কথা বলেছিলেন এবং ছবি তুলেছিলেন। অগ্নিদেবের ঠোঁটে এক রহস্যময় হাসি ফুটে উঠল। তিনি তাঁর বিশেষ ধনসম্পদ নিয়ে যে রকম উন্মত্ত হয়ে ওঠেন, সেই একই উন্মাদনা চোখেমুখে ফুটে উঠল। তিনি বললেন—“তাকে বলো, আমি সেই মুদ্রার বিনিময়ে বিশাল অঙ্কের টাকা দিতে রাজি আছি। যেকোনও দাম—শুধু ওটা আমার হাতে চাই।” সিদ্ধার্থ কিছুটা দ্বিধা নিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন—“কিন্তু যদি সে রাজি না হয়?” অগ্নিদেব তখন হালকা হেসে, ঠান্ডা অথচ ভয়ার্ত কণ্ঠে বললেন—“সবাই শেষ পর্যন্ত রাজি হয়, যদি সঠিক উপায়ে বোঝানো যায়।”

যখন সৌরভের কাছে এই প্রস্তাব পৌঁছল, সে প্রথমে অবিশ্বাস করেছিল। এত টাকা পেয়ে কেউ নিশ্চয়ই খুশি হতো, কিন্তু সৌরভের মনে তখন অন্যরকম টানাপোড়েন। এই মুদ্রা কেবল অর্থের প্রতীক নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে ইতিহাস, এক অমূল্য ধন, এবং হয়তো কোনও অজানা রহস্য। তাই যখন অগ্নিদেব মুখোপাধ্যায় সরাসরি সৌরভের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে মুদ্রাটি কিনে নেওয়ার প্রস্তাব রাখলেন, সৌরভ সোজাসুজি অস্বীকার করল। শান্ত অথচ দৃঢ় কণ্ঠে সে বলল—“এটা বিক্রির বস্তু নয়, এটা আমার দায়িত্ব। আমি চাই এটা সঠিক গবেষকদের হাতে পৌঁছাক, যারা এর প্রকৃত তাৎপর্য উদ্ধার করতে পারবে।” অগ্নিদেব প্রথমে ভান করলেন উদারতার, তিনি বললেন—“তুমি যদি চাই, আমি গবেষকদের আনতে পারি, আমি নিজেই এর সঠিক দেখভাল করব। তোমার আর কোনও চিন্তা করার দরকার নেই।” কিন্তু সৌরভ অবিচল থাকল। তার চোখে ছিল এক ধরনের সততা, যা দেখে অগ্নিদেবের ভেতরে জমে থাকা লোভ যেন ক্রমশ রক্তে ফুটতে শুরু করল। তাঁর ভদ্রতার মুখোশ খসে পড়তে লাগল, আর সৌরভ হঠাৎ অনুভব করল যে এই মানুষের চোখে এক ভয়ংকর অন্ধকার লুকিয়ে আছে।

অগ্নিদেবের আসল রূপ তখন প্রকাশ পেল। তাঁর গলা আরও কর্কশ হয়ে উঠল, মুখে হিংস্রতা ফুটে উঠল। তিনি বললেন—“তুমি বুঝতে পারছ না, তোমার হাতে যে জিনিসটা আছে, তার মূল্য কতটা। তুমি জানো না এর শক্তি কীরকম। আমি টাকা দিচ্ছি, তুমি নাও আর চুপচাপ বস্তুটা আমার হাতে দাও।” সৌরভ অবিচলভাবে জবাব দিল—“আমাকে ভয় দেখিয়েও লাভ হবে না। আমি জানি, এই মুদ্রা কোনও ব্যক্তির লোভ মেটানোর জন্য নয়।” অগ্নিদেব তখন আর নিজেকে সামলাতে পারলেন না। চোখে ক্রোধ, কণ্ঠে গর্জন, তিনি চিৎকার করে উঠলেন—“আমাকে কেউ না বলতে পারে না! আমি যেটা চাই, সেটা আমি নেবই। স্বেচ্ছায় দাও, না হলে জোর করে নিয়ে নেব।” সেই মুহূর্তে সৌরভ যেন উপলব্ধি করল, সামনে যে মানুষটা দাঁড়িয়ে আছে, সে শুধু ধনী সংগ্রাহক নন, সে এক দানব, যার ভেতরে লুকিয়ে আছে সীমাহীন লোভ আর ক্ষমতার নেশা। চারপাশের বাতাস হঠাৎ ভারী হয়ে উঠল, সৌরভের মনে এক ভয় ঢুকে গেল, কিন্তু তার সাহস ভাঙল না। সে দৃঢ় কণ্ঠে বলল—“তাহলে আপনাকে থামাতে অন্য উপায় খুঁজে নিতে হবে।” অগ্নিদেবের মুখ তখন ক্রোধে বিকৃত হয়ে উঠেছে, আর সেই রূপ দেখেই সৌরভ জানল—এই লড়াই এখন শুধু মুদ্রাকে কেন্দ্র করে নয়, বরং এক অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম। এই লড়াইয়ের ফলাফল নির্ধারণ করবে কে জয়ী হবে—সততা না লোভ।

ঋতাভরীর হাতের কাঁপুনি থামছিল না যখন তিনি সেই প্রাচীন লিপির ভাঁজ মেলে ধরলেন। পুরনো খয়েরি কাগজে আগুনে দগ্ধ দাগ, অচেনা অক্ষরের জটলা, আর প্রান্তে শিবলিঙ্গের পাশে আঁকা সূক্ষ্ম অগ্নিচিহ্ন—সবকিছুই যেন লুকিয়ে রেখেছিল এক অমোঘ রহস্য। তিনি ধীরে ধীরে উচ্চারণ করছিলেন বাক্যগুলো, চোখ ভরা বিস্ময় নিয়ে। সেখানে লেখা ছিল—“অগ্নি-মুদ্রার মালিক মৃত্যুকে জয় করে, তবে তার আত্মা চিরকাল আগুনে বন্দি।” কথাগুলো পড়তে পড়তেই তাঁর শরীরের লোম খাড়া হয়ে উঠল। এতদিন যে তাবিজটিকে তিনি নিছক এক শক্তির প্রতীক ভেবেছিলেন, তা আসলে ছিল এক শাপগ্রস্ত অভিশাপ। যে একে অর্জন করবে, সে মৃত্যুকে পরাজিত করলেও শান্তি পাবে না, বরং তার আত্মা জ্বলন্ত অগ্নিশিখায় বন্দি হয়ে থাকবে অনন্তকাল। এই সত্য প্রকাশের মুহূর্তে কক্ষে উপস্থিত সবার মুখে আতঙ্কের ছায়া নেমে এলো। অগ্নি-মুদ্রা তাদের হাতে থাকা মানে তারা নিজেদের অজান্তেই এমন এক শক্তির দ্বার খুলে ফেলেছে, যেখান থেকে ফিরে আসা হয়তো আর সম্ভব নয়।

সৌরভের বুকের ভেতর ভারী হয়ে এলো এই সত্য শুনে। তিনি এতদিন ভেবেছিলেন অগ্নি-মুদ্রা কেবল প্রাচীন শক্তির এক আশ্চর্য প্রতীক, যা মানুষকে সাময়িকভাবে রক্ষা করতে পারে বা অশুভ শক্তিকে প্রতিহত করতে সক্ষম। কিন্তু আজ তিনি বুঝলেন এর আসল রূপ কত ভয়ঙ্কর। অমরত্বের লোভ বহু যুগ ধরে মানুষকে প্রলুব্ধ করেছে, কিন্তু এর মাশুল যে আত্মার চিরন্তন কারাবাস, তা কেউই হয়তো কল্পনা করতে পারেনি। তাঁর মনে পড়ল, গত কয়েকদিন ধরে তিনি যে অদ্ভুত স্বপ্ন দেখছিলেন—অগ্নিশিখার মধ্যে কারো অচেনা ছায়া হাতছানি দিচ্ছে—সেটা নিছক কল্পনা ছিল না। হয়তো সেটাই ছিল এই অভিশপ্ত মুদ্রার সতর্কবার্তা, যা তাঁরা বুঝতেই পারেননি। তিনি কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, “আমরা ভীষণ বিপদে পড়ে গেছি… মুদ্রাটা কেবল শক্তি নয়, এটা মৃত্যুর ফাঁদ।” তাঁর কথায় ঋতাভরী ও অন্যরা চুপচাপ মাথা নেড়ে সম্মতি দিলেন, যেন কারও কিছু বলার ছিল না। অগ্নি-মুদ্রার লোভ যে বিপজ্জনক, তা সকলের হৃদয়ে গেঁথে গেল সেই মুহূর্তে।

ঋতাভরী এক গভীর নিঃশ্বাস নিয়ে বললেন, “এখন আমাদের কাছে দুটো পথ খোলা। এক—আমরা এই মুদ্রাকে নিজেরা রাখব এবং তার শক্তিকে ব্যবহার করার চেষ্টা করব, যার মানে আমরা ধীরে ধীরে তার অভিশাপে আটকে যাব। দুই—আমরা এটাকে ধ্বংস করার চেষ্টা করব, যদিও এর ফলে আমাদের নিজেদের জীবনও ঝুঁকির মুখে পড়বে।” কথাগুলো শোনামাত্র ঘরে ভারী নীরবতা নেমে এলো। কেউই সাহস করে উত্তর দিতে পারছিল না। অগ্নি-মুদ্রা একদিকে অদ্ভুত ক্ষমতার উৎস, অন্যদিকে চিরন্তন যন্ত্রণার ফাঁদ। এমন দ্বন্দ্বের মধ্যে মানুষ কীভাবে সঠিক পথ বেছে নেবে? সৌরভ জানতেন, এই সিদ্ধান্ত ভুল হলে তাদের সকলের জীবনে চরম অশান্তি নেমে আসবে। ইতিমধ্যে মুদ্রার উপস্থিতি ঘরে এক অদৃশ্য আগুনের মতন ছড়িয়ে পড়ছিল। সবাই অনুভব করছিল, যেন চারপাশের বাতাস ধীরে ধীরে উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। হঠাৎই ঘরের প্রদীপের শিখা স্বাভাবিকের চেয়ে উঁচু হয়ে উঠল, যেন লিপির উচ্চারণে প্রাচীন অভিশাপ আবার জেগে উঠছে।

সেই মুহূর্তে সৌরভ উপলব্ধি করলেন, তাঁরা আর সাধারণ মানুষ নন, বরং অভিশপ্ত এক যাত্রার যাত্রী হয়ে উঠেছেন। তিনি বললেন, “এই লিপি কেবল সতর্কবার্তা নয়, এটা আমাদের জন্য শেষ সুযোগ। মুদ্রা যতক্ষণ আমাদের কাছে আছে, আমরা হয়তো বেঁচে থাকব, কিন্তু ধীরে ধীরে আমাদের আত্মা দগ্ধ হয়ে যাবে। আমরা যদি এখনই কোনও উপায় না খুঁজি, তবে নিশ্চিতভাবে আমরা সবাই অগ্নিশিখায় বন্দি হব।” তাঁর কথায় ভয় মিশে থাকলেও দৃঢ়তা ছিল। ঋতাভরী চোখ বন্ধ করে মন্ত্রের শেষ অংশটি পড়লেন, যেখানে লেখা ছিল—“আগুনে জন্ম, আগুনে মৃত্যু, আর আগুনেই মুক্তি।” এর মানে দাঁড়াচ্ছে, এই অভিশাপের সমাধানও আগুনের ভেতরেই লুকিয়ে আছে। কীভাবে, তা এখনও রহস্য। তবে এটা পরিষ্কার হয়ে গেল যে তারা যে মন্ত্রের উন্মোচন করেছে, সেটাই হবে তাদের ভবিষ্যতের নিয়ামক। ঘরে উপস্থিত প্রতিটি মানুষের মুখে সেই ভয় আর কৌতূহলের ছাপ স্পষ্ট হয়ে উঠল—তারা এখন এমন এক সত্যের সামনে দাঁড়িয়ে আছে, যেখান থেকে পালানোর কোনো পথ নেই। তাদের যাত্রা এখন কেবল শুরু হয়েছে, আর সামনে যে আগুনের দেয়াল অপেক্ষা করছে, তা পেরোনোর সাহস কি তাদের মধ্যে আছে?

অগ্নিদেব মুখোপাধ্যায় তার প্রাসাদের ভেতর প্রবেশের আগে সৌরভ ও ঋতাভরীকে এক অদ্ভুত নীরবতার মধ্যে দাঁড় করিয়ে রাখলেন। চারদিক অন্ধকার, শুধু দূরে আগুনের মতো জ্বলজ্বলে আভা, যেন আকাশ থেকে নেমে আসা কোনো প্রাচীন শক্তি তার চারপাশকে ঘিরে রেখেছে। বিশাল লোহার দরজা ধীরে ধীরে খুলে গেল, আর ভেতরে দেখা দিলো এক ভয়ংকর অথচ রাজকীয় আভিজাত্যে ভরা অট্টালিকা। দেয়ালের প্রতিটি অংশে খোদাই করা আছে পুরনো মন্ত্র, শিলালিপি, আর দেবদেবীর অর্ধেক গলে যাওয়া প্রতিমা। ভেতরে প্রবেশ করতেই সৌরভের গা শিরশির করে উঠলো—এখানে কেবল প্রাসাদ নয়, এক বিশালতর রহস্যের আধার। সারা ঘরে ছড়িয়ে আছে শীতল ধোঁয়া, বাতাসের গায়ে ধাতব স্বাদ, আর মোমবাতির আলোয় ঝিলমিল করছে রক্তলাল গালিচা। ঋতাভরীর চোখ স্থির হলো সিঁড়ির ধাপে রাখা অদ্ভুত পিতলের প্রদীপে—সেখানে শিখার মতো আগুন জ্বলছে, কিন্তু আগুন নিঃশব্দ, কোনো উষ্ণতা নেই, শুধু এক মৃত আভা। অগ্নিদেব বললেন, “এই প্রাসাদের ভেতর আমি যুগের পর যুগ ধরে শক্তি সঞ্চয় করেছি। এখানে প্রতিটি ইট, প্রতিটি পাথর আমার কাছে শিষ্য আর সৈনিকের মতো। আজ তোমরা সেসব চোখে দেখবে, যা সাধারণ মানুষের চোখে দেখা নিষিদ্ধ।”

সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে উঠতে সৌরভ লক্ষ্য করলো, দেয়ালের কোণে কোণে রাখা আছে কাচের বাক্স। প্রতিটি বাক্সের ভেতর অদ্ভুত রঙের মুদ্রা—রক্তবর্ণ, নীলাভ, সবুজাভ, আবার কিছু মুদ্রা অদ্ভুতভাবে আলো ছড়াচ্ছে। অগ্নিদেব বললেন, “এগুলো হলো তান্ত্রিক মুদ্রা—প্রতিটি একেকজন শক্তিশালী সাধকের, যারা একসময় মৃত্যুকে জয় করার জন্য নিজেদের আত্মা এই মুদ্রায় বেঁধেছিল। আমি বছরের পর বছর ধরে এই মুদ্রাগুলো সংগ্রহ করেছি। তোমরা যা দেখছো, তা এই পৃথিবীর অর্ধেক রহস্য উন্মোচন করে। কিন্তু আমার হাতে সবগুলো এলেই আমি মৃত্যুকে চিরতরে জয় করতে পারবো।” ঋতাভরী কাঁপা কণ্ঠে বললো, “কিন্তু মৃত্যুকে হারানো কি সম্ভব? মানুষ কি জন্ম-মৃত্যুর সীমার বাইরে যেতে পারে?” অগ্নিদেব এক হাসি দিলেন—সেটা আনন্দের নয়, বরং নিষ্ঠুরতার। “মানুষ পারে না, কিন্তু তান্ত্রিক পারে। মৃত্যু হচ্ছে এক প্রহরী, যে দরজা পাহারা দেয়। আমি সেই দরজার তালা খুলতে শিখেছি। এখন শুধু দরজার চাবিগুলো একত্র করা বাকি। এই মুদ্রাগুলোই সেই চাবি।”

তারা তিনজনে একটি বিশাল হলঘরে পৌঁছালো, যার মাঝখানে আছে এক বিশাল ধাতব কুঠুরী। অগ্নিদেব হাত তুলে এক অদ্ভুত মন্ত্র পড়লেন, আর কুঠুরীর দরজা গমগম শব্দে খুলে গেল। ভেতরে দেখা গেল এক ভাণ্ডার, যেখানে সারি সারি সোনালি ও রূপালি মুদ্রা স্তূপ হয়ে আছে, যেন শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে কেউ লুকিয়ে রেখেছে। সেসব মুদ্রা থেকে এক অদ্ভুত আলো ছড়াচ্ছে—না সূর্যের আলো, না চাঁদের আলো, বরং মৃত মানুষের আত্মার মতো ম্লান অথচ প্রখর। সৌরভ বুঝলো, এ শুধু ধনভাণ্ডার নয়, বরং আত্মার কারাগার। প্রতিটি মুদ্রার ভেতর থেকে সে যেন একেকটা হাহাকার শুনতে পাচ্ছে, মৃত সাধকদের আত্মা চিৎকার করছে। ঋতাভরীর মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল, সে ফিসফিস করে বললো, “এগুলো কেবল বস্তু নয়… এরা জীবন্ত।” অগ্নিদেব গম্ভীর কণ্ঠে জবাব দিলেন, “হ্যাঁ, জীবন্ত—কিন্তু বন্দি। আর এই বন্দিত্বের মাধ্যমেই আমি তাদের শক্তি নিয়ন্ত্রণ করি। যেদিন সব মুদ্রা আমার হাতে আসবে, সেদিন আমি নিজেই এক জীবন্ত অমর শক্তিতে পরিণত হবো। মৃত্যু তখন আমার সামনে হাঁটু গেড়ে দাঁড়াবে।”

কিন্তু সেই সময় সৌরভ ও ঋতাভরী দু’জনেই এক অদ্ভুত দমবন্ধ করা অনুভূতি পেল। মনে হলো, প্রাসাদের দেয়ালগুলো একে একে সরে আসছে, যেন শ্বাসরোধ করে ফেলবে। দূরে কোথাও এক অচেনা বাঁশির সুর বাজতে লাগলো, যা এক অন্ধকারের সঙ্গীতের মতো ধীরে ধীরে তাদের আত্মায় ঢুকে যাচ্ছে। সৌরভের মনে হলো, এই বাঁশি কোনো জীবন্ত মানুষের বাজানো নয়, বরং মুদ্রার ভেতর বন্দি আত্মাদের। ঋতাভরী তার হাত শক্ত করে ধরলো, আর দু’জনেই অনুভব করলো—তারা এক ভয়ংকর ষড়যন্ত্রের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। অগ্নিদেব তখন উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা করলেন, “তোমরা সাক্ষী থাকো, এই রাত থেকে আমার মহাপথচলা শুরু হলো। মৃত্যু আর আমার মধ্যে কোনো ফারাক থাকবে না। আমি হবো মৃত্যুরও প্রভু।” তার চোখ তখন জ্বলছে, চারদিকে আগুনের আভা নেচে উঠছে, প্রাসাদের ভেতর হাহাকার ছড়িয়ে পড়ছে। সৌরভ বুঝলো—এ শুধু একটি প্রাসাদ নয়, বরং এক জীবন্ত দুঃস্বপ্ন, আর অগ্নিদেবের হাতে যদি সব মুদ্রা এসে যায়, তবে পৃথিবী আর কখনো স্বাভাবিক থাকবে না। ঋতাভরী নিঃশব্দে প্রার্থনা করলো—কোনো এক অলৌকিক শক্তি যেন তাদের পথ দেখায়, কারণ তারা এখন এমন এক খেলায় নেমেছে, যেখানে হার মানে মৃত্যু নয়, বরং অমর আতঙ্ক।

সন্ধ্যার পর থেকেই কলকাতার আকাশে অস্বাভাবিক অশান্তি ঘনীভূত হচ্ছিল। কালো মেঘে ঢেকে গিয়েছিল শহরের অর্ধেক, আর বজ্রপাত যেন শহরের পুরনো প্রাচীরগুলোকে বারবার চমকে দিচ্ছিল। থিয়েটারের রিহার্সাল শেষ করার পর সবাই যখন বাড়ি ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছিল, তখন হঠাৎ প্রবল ঝড় শুরু হলো। জানালার কাচ ভেঙে পড়ার মতো শব্দ হচ্ছিল, আলো বারবার নিভে আসছিল, আর সেই অন্ধকারের ফাঁকে ফাঁকে যেন কারও নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছিল। ঠিক তখনই নাট্যমঞ্চের দিক থেকে এক অদ্ভুত আলো দেখা গেল। আগুনের লেলিহান শিখা হঠাৎ করেই থিয়েটারের ভেতরে ফুটে উঠল, যেন অজানা কারও উপস্থিতি তাকে ডেকে এনেছে। সবাই আতঙ্কিত হয়ে ছুটে বেরোতে চাইলো, কিন্তু মঞ্চের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা লাল শাড়ির নারীমূর্তি স্থির চোখে তাকিয়ে ছিল সেই আলোয়। আলো ক্রমশ ঘন হয়ে আগুনের মতো রূপ নিল, আর তার ভেতর থেকে বেরিয়ে এল তান্ত্রিক বীরেশ্বর। তার শরীর অর্ধেক বাস্তব, অর্ধেক ছায়া—যেন মৃত আর জীবিতের মাঝখানে ঝুলে থাকা এক সত্তা। তার মুখে বিকট হাসি, আর হাতে এক প্রাচীন লাঠি, যার মাথায় আগুন জ্বলছে।

বীরেশ্বরের আবির্ভাব থিয়েটারের সবাইকে স্তব্ধ করে দিল। তিনি দাঁড়িয়ে সোজা গম্ভীর কণ্ঠে ঘোষণা করলেন, “আমি এই নাট্যমঞ্চের আসল মালিক, আর তোমাদের লুকানো শক্তির উৎস—মুদ্রা—আমাকেই ফিরিয়ে দিতে হবে।” তার কণ্ঠস্বর বজ্রপাতের সঙ্গে মিশে যেন আরও ভয়ঙ্কর শোনাচ্ছিল। চারদিকে শুধু গর্জন, হাওয়া আর আগুনের গন্ধ। অরুণ, অর্ণব আর বাকিরা হতভম্ব হয়ে একে অপরের দিকে তাকাল। তারা জানতো, এই মুদ্রার সঙ্গে অদ্ভুত এক অভিশাপ জড়িয়ে আছে, কিন্তু তান্ত্রিক নিজে এভাবে ফিরে আসবে তা কল্পনাতেও আনেনি। তার চোখের দৃষ্টি যেন ছিদ্র করে দিচ্ছিল চারপাশের অন্ধকারকে, আর আগুনের ভেতর থেকে ছায়া হাত বাড়িয়ে দিচ্ছিল। লাল শাড়ি পরা নারীমূর্তিটি ধীরে ধীরে মঞ্চ থেকে সরে গিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল, যেন তার উপস্থিতি এই ডাকে সাড়া দিচ্ছে। তখনই সন্দেহ ঘনীভূত হলো—থিয়েটারের গোপন অভিভাবক তিলোত্তমা দেবী কি সত্যিই বীরেশ্বরকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছেন? তার স্নিগ্ধ অথচ রহস্যময় হাসি, যা প্রায়ই রিহার্সাল-এর সময় মঞ্চে দেখা যেত, আজ যেন আগুনের আড়াল থেকে ভেসে আসছে।

ঝড়ের আওয়াজের ভেতরে বীরেশ্বর ধীরে ধীরে থিয়েটারের কেন্দ্রস্থলে এগিয়ে গেলেন। তার চলাফেরা আধা-পদক্ষেপ, আধা-ভাসমান, যেন মাটিতে পুরোপুরি স্পর্শই করছেন না। তার চারপাশে অদৃশ্য শক্তি ঘূর্ণি তুলে ছড়িয়ে পড়ছিল, আর সেই শক্তির টানে আলোর ফোকাস ভেঙে ভেঙে পড়ছিল। থিয়েটারের পুরনো মঞ্চ, যার ওপর বহু নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে, হঠাৎ করেই কাঁপতে শুরু করল। সবাই ভয়ে ছুটে বেরোবার চেষ্টা করলেও দরজা যেন নিজে থেকেই বন্ধ হয়ে গেল। কাঠের দরজায় অদ্ভুত আঁকিবুঁকি ফুটে উঠল, যা আগুনের শিখার সঙ্গে জ্বলজ্বল করছিল। বীরেশ্বর উচ্চস্বরে মন্ত্রোচ্চারণ করতে শুরু করলেন। তার প্রতিটি শব্দ যেন বাতাসে ধাক্কা তৈরি করছিল। কাগজপত্র উড়ে যাচ্ছিল, চেয়েগুলো ভেঙে পড়ছিল, আর মঞ্চের ওপর আঁধার আরও ঘন হয়ে উঠছিল। অরুণ মনে মনে উপলব্ধি করল, এই যুদ্ধ আর শুধু বাস্তবের নয়, বরং অদৃশ্য শক্তির সঙ্গে শুরু হয়ে গেছে। আর তিলোত্তমা দেবী হয়তো সেই শক্তির পথপ্রদর্শক। সে চোখ মেলতেই দেখল, মঞ্চের অন্ধকার কোণে যেন কারও ছায়া দুলে উঠল—নারীর ছায়া, যিনি বীরেশ্বরের দিকে হাত বাড়িয়ে ইঙ্গিত করছেন।

সবাই যখন আতঙ্কে স্তব্ধ, তখন বীরেশ্বর আবার ঘোষণা করলেন—“যদি মুদ্রা আমার কাছে না ফেরানো হয়, তবে এই মঞ্চ অভিশাপে জ্বলে যাবে। কারও আত্মা শান্তি পাবে না।” তার কণ্ঠে প্রতিশোধ আর অগ্নির সুর বাজছিল। তিনি চারদিকে আগুনের বৃত্ত সৃষ্টি করলেন, যা ধীরে ধীরে পুরো থিয়েটারকে ঘিরে ফেলছিল। ছায়া আর বাস্তব মিশে গিয়ে এক ভয়াবহ বিভ্রম তৈরি করছিল। কেউ কেউ দেখছিলেন তিনি মানুষের মতো, কেউ দেখছিলেন তিনি কেবল ছায়া আর আগুনের রূপে জ্বলজ্বল করছেন। তিলোত্তমার গোপন উপস্থিতি তখন আরও প্রকট হয়ে উঠল। তার সুরেলা কণ্ঠ, যা বহুবার রিহার্সাল-এর সময় অজানা ভাবে ভেসে আসত, এবার আগুনের সঙ্গে মিশে স্পষ্ট শোনা গেল—“শক্তি যার, নিয়ন্ত্রণও তার।” মনে হলো তিনি বীরেশ্বরকেই সমর্থন করছেন। থিয়েটারের সবাই ভয়ে, বিভ্রান্তিতে কাঁপতে লাগল। কারও চোখে জল, কারও ঠোঁটে প্রার্থনা। কিন্তু বীরেশ্বরের মুখে শুধু নিষ্ঠুর তৃপ্তির ছায়া ফুটে উঠছিল। তিনি যেন জানেন, এ যুদ্ধে তিনি অজেয়, কারণ ছায়া, আগুন আর অদৃশ্য শক্তির মিলন তার নিয়ন্ত্রণেই আছে। কিন্তু এর মাঝেও এক অদ্ভুত প্রশ্ন দাঁড়িয়ে রইল—তিলোত্তমা দেবী সত্যিই কি তার সহায়ক, নাকি অদৃশ্য কোনো খেলার অংশ? এই সন্দেহ আর আতঙ্কের মধ্যেই অধ্যায় শেষ হয়, রেখে যায় এক অমোঘ অন্ধকারের ইঙ্গিত।

মন্দিরের ভগ্নপ্রায় করিডোর ধরে এগোতে এগোতে সৌরভ ও ঋতাভরী অনুভব করছিলেন, যেন অদৃশ্য কারও দৃষ্টি তাদের উপর নিবদ্ধ। সন্ধ্যার আলো ইতিমধ্যেই স্তিমিত হয়ে আসছিল, আর পুরনো মশালের ক্ষীণ আলোয় দেখা যাচ্ছিল ছাদ থেকে ঝুলে থাকা বাদুড়, দেওয়ালে ছোপ ছোপ স্যাঁতসেঁতে দাগ। তাদের পদক্ষেপে ধুলো উড়ে গুহার মতো প্রতিধ্বনি তুলছিল, আর সেই শব্দই যেন দম বন্ধ করে দিচ্ছিল। ঠিক সেই সময় ঋতাভরীর চোখ পড়ে করিডোরের ডান দিকের দেওয়ালে অস্বাভাবিক এক খাঁজে। হাত বোলাতেই অনুভব করলেন, সেই অংশটা ফাঁপা। সৌরভ দ্রুত টর্চের আলো ফেলতেই দেখা গেল, সেখানে শৈব প্রতীক খোদাই করা পাথরের দরজার মতো কিছু লুকোনো আছে। একসঙ্গে চাপ দিতেই সেই প্রাচীন দরজা কেঁপে উঠল, আর হঠাৎ গম্ভীর শব্দ তুলে ধীরে ধীরে সরে গেল ভেতরের দিকে। তাদের সামনে খুলে গেল এক গোপন কক্ষ—যেন শতাব্দী ধরে বাইরের জগত থেকে লুকিয়ে থাকা এক অচেনা দুনিয়া।

ভেতরে ঢুকতেই দু’জনেরই দম বন্ধ হয়ে এল, কারণ চারদিকের দেওয়াল জুড়ে ছিল প্রাচীন শিলালিপি। অদ্ভুত এক গন্ধ ছড়িয়ে ছিল কক্ষে—কাঠ, ধূপ আর পোড়া মোমের মিশ্রণ। দেওয়ালে খোদাই করা অক্ষরগুলো তাম্রালিপির মতো মনে হচ্ছিল, কিছুটা সংস্কৃত, কিছুটা প্রাকৃত ভাষার ছাপ। সৌরভ ঝুঁকে টর্চের আলোয় পড়তে চেষ্টা করলেন, আর ধীরে ধীরে শব্দগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠল—“অগ্নি-মুদ্রার রক্ষক সাতজন, তাদের আত্মা মুক্ত হবে শেষ যজ্ঞে।” প্রথমে এর অর্থ বুঝতে না পারলেও ঋতাভরীর মস্তিষ্কে ঝড় বইতে লাগল। তিনি শিলালিপির পাশের প্রতীকগুলোর দিকে তাকালেন—সাতটি ভিন্ন ভিন্ন মুখাবয়ব খোদাই করা, প্রতিটি মুখে এক অদ্ভুত গাম্ভীর্য ও যন্ত্রণার ছাপ। আর সেই মুখগুলির মধ্যে একটি আশ্চর্যরকম পরিচিত লাগছিল, যেন দেবীর মূর্তিতে দেখা সেই তিলোত্তমা দেবীর সাদৃশ্য। ঋতাভরী শিহরিত হয়ে বললেন, “সৌরভ, তুমি কি বুঝতে পারছ? তিলোত্তমা দেবীও সেই সাত রক্ষকের একজন।” কথাটা শুনে সৌরভ চমকে উঠলেন। তাদের চোখের সামনে যেন ইতিহাসের পর্দা ভেদ করে উঠে এল—একসময় দেবী শুধু পূজিত রূপে ছিলেন না, তিনি ছিলেন অগ্নি-মুদ্রার রক্ষাকারী আত্মাদের অন্যতম।

কক্ষের ভেতর আরও কিছু বিস্ময়কর জিনিস ছিল। এক কোণে পাথরের স্তম্ভের উপর রাখা ছিল একটি ক্ষুদ্র অগ্নিকুণ্ডের অবশেষ, যেন এখানে বহু বছর আগে কোনো গোপন যজ্ঞ হয়েছিল। মেঝেতে ছিল কয়েকটি পোড়া কাঠ, আর তার উপর ছাইয়ের স্তূপ। সৌরভ ছাই সরাতে গিয়ে দেখতে পেলেন কিছু প্রাচীন ধাতব মুদ্রা, যার গায়ে অদ্ভুত চিহ্ন খোদাই। সেই চিহ্নগুলো যেন আগুনের শিখার মতো নৃত্যরত, আর স্পর্শ করতেই মনে হচ্ছিল গরম হয়ে উঠছে। ঋতাভরী সেগুলো হাতে নিতে সাহস পেলেন না, কিন্তু তিনি লক্ষ্য করলেন দেওয়ালের খোদাইয়ের এক অংশে লিখা আছে—“যজ্ঞ সম্পূর্ণ হলে রক্ষকদের আত্মা অগ্নির সাথে মিলিত হবে, আর তখন মুদ্রার প্রকৃত শক্তি প্রকাশিত হবে।” এই লিপি যেন ইঙ্গিত করছিল এক ভয়ংকর সত্যের দিকে। হয়তো এই মন্দিরের উদ্দেশ্য ছিল শুধু দেবীর পূজা নয়, বরং এক অমর অগ্নি-শক্তির পাহারা দেওয়া। আর সেই পাহারা দিতে গিয়ে সাতজন নির্বাচিত রক্ষক নিজেদের জীবন বিসর্জন দিয়েছিলেন। তিলোত্তমা দেবীও তাদের মধ্যে ছিলেন, কিন্তু তিনি কেন এই যজ্ঞের সঙ্গে যুক্ত হলেন, সেই রহস্য আরও গভীর হয়ে উঠল।

দু’জনেই নিঃশব্দে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন কক্ষে, চারপাশের প্রতিটি প্রতীকের ভেতরে লুকোনো অর্থ বোঝার চেষ্টা করতে করতে। শীতল হাওয়া বইছিল, অথচ কোথা থেকে আসছিল সেই হাওয়া তা বোঝা যাচ্ছিল না। হঠাৎ কক্ষের ভেতরে আগুনের মতো কমলা আভা ছড়িয়ে পড়ল, যেন মশালগুলো নিজেরাই জ্বলে উঠল। দেওয়ালে খোদাই করা সাতটি মুখ যেন জীবন্ত হয়ে উঠল, আর তাদের দৃষ্টি পড়ল সৌরভ ও ঋতাভরীর উপর। আতঙ্কে ঋতাভরী সৌরভের হাত শক্ত করে ধরলেন। মুহূর্তের জন্য তারা অনুভব করলেন, যেন এই কক্ষ কোনো নির্জন স্থান নয়—বরং এখানে এখনো রক্ষকদের আত্মারা বন্দি রয়েছে, মুক্তির অপেক্ষায়। সেই মুহূর্তে সৌরভের মনে পড়ল শিলালিপির বাক্য—“শেষ যজ্ঞে মুক্তি।” এর মানে কি তারা নিজেরাই সেই যজ্ঞ সম্পূর্ণ করার জন্য নিয়তিবদ্ধ? আর যদি তা-ই হয়, তবে তাদের সামনে যে বিপদ অপেক্ষা করছে, তা কি সাধারণ কোনো পূজা নয়, বরং জীবন-মৃত্যুর সীমারেখায় দাঁড়িয়ে এক ভয়ংকর পরীক্ষার মতো? কক্ষের নিস্তব্ধতা যেন উত্তর দিল—হ্যাঁ। তারা ইতিহাসের এমন এক ফাঁদে আটকা পড়েছে, যেখানে সময়, আত্মা আর দেবশক্তি মিলেমিশে তৈরি করেছে অগ্নি-মুদ্রার রহস্য, আর সেখান থেকে আর ফিরে আসার পথ নেই।

অগ্নিদেবের যজ্ঞমণ্ডপ সেই রাতে এক অলৌকিক ভয়ে মোড়া হয়ে উঠেছিল। শ্বেতপাথরের মন্দির-প্রাসাদের আঙিনায় ছড়িয়ে থাকা মুদ্রার স্তূপ চারদিকে জ্বলজ্বল করছিল অগ্নিশিখার আলোয়। লালচে আগুনের চারদিকে সাজানো হয়েছিল তাম্রপাত্র, অশ্বথডাল, কালো ঘৃত এবং রক্তমাখা কুশাগ্রাস—যেন এক অদ্ভুত মৃত্যুর আহ্বান। অগ্নিদেবের চোখে তখন এক অমানুষিক দীপ্তি, ঠোঁট নড়ে চলেছে এক অচেনা মন্ত্রে, যার প্রতিটি ধ্বনি যেন অন্ধকারকে আরও গাঢ় করে তুলছিল। তাঁর চারপাশে দাঁড়িয়ে শিষ্যরা কাঁপছিল ভয়ে, কেউ কেউ আবার উন্মাদ আনন্দে হাত উঁচিয়ে মন্ত্রোচ্চারণে সঙ্গ দিচ্ছিল। আকাশে কালো মেঘ জমে উঠছিল, যেন দেবতারা এই ভীষণ যজ্ঞ থামাতে চান। কিন্তু অগ্নিদেবের হাত থেকে ছিটকে পড়া মুদ্রা একে একে আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়তেই আগুনের শিখা হঠাৎ বহুগুণে উঁচু হয়ে উঠে এক প্রলয়ের রূপ নিতে শুরু করল। মুদ্রার প্রতিটি ঝনঝন শব্দ মনে হচ্ছিল যেন রক্তের আর্তনাদ, প্রতিটি জ্বলন্ত সোনালি মুদ্রা আগুনে গলে গিয়ে তৈরি করছিল অদ্ভুত আকার—মাঝে মাঝে মনে হচ্ছিল খুলি, কখনও মনে হচ্ছিল মানবমুখ। যজ্ঞমণ্ডপের গন্ধে তখন শুধু পুড়ন্ত ধাতু নয়, মানুষের অস্থিমজ্জার মত এক বিভীষিকাময় গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছিল।

যজ্ঞমন্ত্র ক্রমশ তীব্র হচ্ছিল, আর সেই তীব্রতার মাঝেই আচমকা এক বজ্রধ্বনি ফেটে পড়ল। সবাই চমকে উঠে তাকাতেই দেখা গেল, অগ্নিশিখার মধ্য দিয়ে প্রবল আকারে আবির্ভূত হয়েছে বীরেশ্বর। তাঁর চোখদুটি যেন নীল বিদ্যুৎ, কণ্ঠস্বর পাহাড়ভাঙা বজ্রপাতের মতো—“তোমাদের জীবন দিয়েই আমার অমরত্ব নিশ্চিত হবে।” সেই মুহূর্তে যজ্ঞমণ্ডপের পরিবেশ কেঁপে উঠল, শিষ্যরা আতঙ্কে ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে, আর কেউ কেউ অদ্ভুত এক মন্ত্রবলে নিস্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল যেন বীরেশ্বরের ইশারায় প্রাণহীন পুতুলে পরিণত হয়েছে। বীরেশ্বরের শরীর থেকে ছড়িয়ে পড়ছিল এক কালো আলো, যা যেন যজ্ঞশিখাকে নিয়ন্ত্রণ করছে। অগ্নিদেব হাহাকার করে বললেন—“না, এটা আমার যজ্ঞ! এই মুদ্রা আমার শক্তি, আমার অমরত্ব!” কিন্তু তাঁর কণ্ঠস্বর মিশে গেল বীরেশ্বরের অট্টহাস্যে। অগ্নিদেব আগুনে নতুন মুদ্রা ছুঁড়ে দিয়ে চেষ্টা করছিলেন আগুনের নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেতে, কিন্তু প্রতিবারই সেই আগুন যেন বীরেশ্বরের ইশারায় তাঁর বিরুদ্ধে ফিরে আসছিল। বাতাস ভারী হয়ে উঠেছিল মৃত্যু আর রক্তের গন্ধে, মন্দিরের দেয়ালে ঝুলে থাকা দেবদেবীর মূর্তিগুলোও যেন কাঁপছিল, চোখ থেকে ছুটে আসছিল রক্তবিন্দু।

সংঘর্ষ শুরু হল এক ভয়ঙ্কর রূপে। অগ্নিদেব আগুনের জাদু ছুঁড়ে মারলেন, শিখা থেকে উঠে এল অগ্নিসর্প, যা আছড়ে পড়ছিল বীরেশ্বরের শরীরে। কিন্তু প্রতিবারই সেই সর্পগুলো কালো অদৃশ্য শক্তির ঘূর্ণিতে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছিল। বীরেশ্বর নিজের হাতে আকাশের বজ্র ডেকে এনে মন্দির প্রাঙ্গণে আছড়ে দিচ্ছিলেন, আর প্রতিটি বজ্রপাতে পাথরের স্তম্ভ ভেঙে গুঁড়িয়ে যাচ্ছিল। মুদ্রাগুলো ছড়িয়ে পড়ছিল চারদিকে, কেউ সেগুলো হাতে নিলে মুহূর্তেই তার শরীর গলে রক্তে পরিণত হচ্ছিল। অগ্নিদেব ক্রমশ উন্মত্ত হয়ে উঠছিলেন, তাঁর চোখ থেকে আগুনের স্ফুলিঙ্গ বের হচ্ছিল। তিনি চিৎকার করে বললেন—“এই মুদ্রা আমার আত্মা, এই যজ্ঞ আমার জয় নিশ্চিত করবে!” আর তখনই হঠাৎ দেখা গেল, মুদ্রার স্তূপ থেকে এক রক্তস্রোত বেরিয়ে মন্দিরের মেঝেতে ছড়িয়ে পড়ছে। সেই রক্তস্রোত যেন জীবন্ত, বয়ে গিয়ে শিষ্যদের টেনে নিচ্ছিল অগ্নিশিখার দিকে। আতঙ্কে মানুষ চিৎকার করতে লাগল, কিন্তু তাদের চিৎকার মুহূর্তেই দমে গেল যখন তারা আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়ে ছাই হয়ে গেল।

শেষ মুহূর্তে মন্দির আর প্রাসাদ একসঙ্গে যেন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হতে শুরু করল। অগ্নিদেব এক চূড়ান্ত মন্ত্র উচ্চারণ করলেন, তাঁর শরীর থেকে বেরিয়ে এল এক বিশাল আগুনের গোলক, যা আছড়ে পড়ল বীরেশ্বরের দিকে। মুহূর্তের জন্য মনে হল বীরেশ্বর গায়েব হয়ে গেছেন। কিন্তু ধোঁয়ার আস্তরণ কাটতেই দেখা গেল তিনি দাঁড়িয়ে আছেন, তাঁর ঠোঁটে বিজয়ের হাসি। তিনি হাত তুলে সমস্ত আগুন নিজের ভেতর টেনে নিলেন, আর মুদ্রার স্তূপ হুহু করে গলে গিয়ে এক গভীর খাদে ডুবে গেল। অগ্নিদেব হাঁটু গেড়ে বসে পড়লেন, চোখে হতাশা আর ভয়ের ছায়া। বীরেশ্বর ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে বললেন—“অমরত্ব রক্ত দিয়ে কেনা যায় না, জীবন দিয়ে কেনা যায় না। তুমি যা করেছ, তার শাস্তি এই প্রাসাদই দেবে।” সঙ্গে সঙ্গে প্রাসাদের ভেতর থেকে গম্ভীর গর্জন উঠল, স্তম্ভগুলো ভেঙে পড়তে লাগল, ছাদ ধসে যেতে লাগল। আগুন, ধোঁয়া আর রক্তের স্রোতে পুরো জায়গাটা অচেনা নরকে পরিণত হল। আর সেই নরকের ভেতর দাঁড়িয়ে বীরেশ্বর যেন আরও প্রবল, আরও ভীষণ হয়ে উঠলেন—যেন রক্তের যজ্ঞ সত্যিই তাঁকেই অমর করে তুলেছে।

সন্ধ্যার ঘন অন্ধকারে চারদিক নিস্তব্ধ হয়ে উঠেছিল, যেন প্রকৃতি নিজেই শ্বাস আটকে রেখেছে এই মহাযজ্ঞের পরিণতি দেখার জন্য। সৌরভের হাত কাঁপছিল, তবে তার দৃষ্টি দৃঢ়, চোখে আগুনের মতো প্রতিজ্ঞা। চারপাশে মশাল জ্বলছিল, আগুনের আলোয় তিলোত্তমা দেবীর মুখ শান্ত অথচ গভীর রহস্যময় মনে হচ্ছিল। তাঁর চোখে যেন যুগের পর যুগ ধরে জমে থাকা শূন্যতা আর জ্ঞানের দীপ্তি একসঙ্গে ফুটে উঠেছিল। বীরেশ্বর দাঁড়িয়ে ছিলেন এক অদ্ভুত হাসি মুখে, হাতে তলোয়ারের মতো দীপ্ত অগ্নি-মুদ্রা। তিনি ঘোষণা করলেন, “যা প্রাপ্য, তা আজ আমি নেবই। এ মুদ্রার শক্তি দিয়ে অগ্নিকে আমি আমার দাস করব।” তাঁর কণ্ঠে অহংকারের ঝংকার, কিন্তু তাতে এক ধরনের আতঙ্কও লুকিয়ে ছিল। অগ্নিদেবের উপস্থিতি তখন পুরো স্থানকে কাঁপিয়ে তুলেছিল। চারপাশে বাতাসের তীব্র স্রোত, আকাশে বজ্রপাতের গর্জন, যেন দেবতা নিজে অবতীর্ণ হয়েছেন রোষে। সৌরভ গভীর নিঃশ্বাস নিয়ে মন্ত্রপাঠ শুরু করলেন। তাঁর ঠোঁট থেকে এক অদ্ভুত ছন্দ বেরোচ্ছিল—যা তিলোত্তমা দেবীর কণ্ঠে শেখানো প্রাচীন মন্ত্রের প্রতিধ্বনি। প্রতিটি শব্দের সঙ্গে আগুন দাউদাউ করে বেড়ে উঠছিল, বাতাস আরও ভারী হয়ে আসছিল। তিলোত্তমা শান্ত কণ্ঠে বললেন, “স্মরণ রেখো সৌরভ, আগুন নিয়ন্ত্রণ করা যায় না, শুধু সঠিক পথে পরিচালিত করা যায়। তোমার সাহসই আজকের রায় দেবে।”

হঠাৎই বীরেশ্বর সামনে ঝাঁপিয়ে পড়লেন, তাঁর চোখ লাল জ্বলে উঠছিল। অগ্নিদেব যেন তাঁর সঙ্গে একাত্ম হয়ে তাঁর চারপাশে অগ্নিগোলক ছুঁড়ে দিতে লাগলেন। সৌরভ কষ্টে মন্ত্রপাঠ চালিয়ে যাচ্ছিলেন, শরীর কাঁপছিল তীব্র উত্তাপে। কিন্তু তাঁর মুঠোয় ছিল সেই অভিশপ্ত মুদ্রা—যার ভেতরে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে লুকানো ছিল অগ্নির গোপন শক্তি। এক মুহূর্তে চারপাশের সব আলো ম্লান হয়ে গেল, যেন শুধু সেই মুদ্রাই দীপ্ত হয়ে উঠল। সৌরভ মুদ্রাটিকে দৃঢ়ভাবে আকাশের দিকে তুলে ধরে হাঁক দিলেন, “অগ্নি তোমার উৎসে ফিরে যাও!” সঙ্গে সঙ্গেই আগুনে ঢেউ খেলে উঠল, যেন আগুন নিজেই পথ খুঁজছে মুক্তির জন্য। বীরেশ্বর চিৎকার করে বললেন, “না! এটা আমার! আমি অগ্নির অধিপতি!” তাঁর কণ্ঠ গর্জন তুলল, কিন্তু তার ভেতরে আতঙ্কও লুকানো ছিল। অগ্নিদেব যেন ক্রোধে ফেটে পড়লেন, তাঁর জ্বলন্ত শরীর চারদিকে আগুনের স্রোত ছড়িয়ে দিল। মাটিতে দাঁড়ানো প্রতিটি মানুষ কাঁপতে লাগল, গাছগুলো দাউদাউ করে জ্বলতে শুরু করল, আকাশ যেন অগ্নিময় হয়ে উঠল। তিলোত্তমা দেবী শান্ত দৃষ্টিতে বললেন, “যার যোগ্যতা নেই, সে কখনও অগ্নিকে নিজের করতে পারে না।”

সৌরভের শরীর তখন ঘামে ভিজে যাচ্ছিল, শ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসছিল। তবুও তাঁর চোখে এক অদম্য দৃঢ়তা জ্বলজ্বল করছিল। মন্ত্রের শেষ অংশে এসে তিনি এক গভীর চিৎকার দিয়ে মুদ্রাটিকে দাউদাউ করে জ্বলতে থাকা আগুনে নিক্ষেপ করলেন। মুহূর্তের মধ্যে আগুন যেন ফেটে পড়ল, যেন আগুন নিজেই মুক্তি পেল শতাব্দীর বাঁধন থেকে। শিখাগুলো আকাশ ছুঁয়ে গেল, গর্জে উঠল বজ্রপাত, আর সেই আগুনের ভেতরে বীরেশ্বর ও অগ্নিদেব একসঙ্গে গ্রাস হয়ে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। তাদের চিৎকার, ক্রোধ, আর শপথ আগুনে মিলিয়ে গিয়ে শুধু এক অদ্ভুত শূন্যতা রেখে গেল। সৌরভ হাঁটু গেড়ে বসে পড়লেন, তাঁর মুখে ক্লান্তির ছাপ, কিন্তু চোখে বিজয়ের আভা। চারপাশে আগুন কিছুক্ষণের মধ্যেই শান্ত হতে শুরু করল, বাতাস ঠান্ডা হয়ে গেল, আর চারদিকে এক আশ্চর্য নীরবতা নেমে এল। তিলোত্তমা দেবী তখন এগিয়ে এসে মৃদু কণ্ঠে বললেন, “অগ্নি-মুদ্রার অভিশাপ চিরতরে শেষ হলো। আজ থেকে মানুষ মুক্ত হলো সেই শৃঙ্খল থেকে।” তাঁর কণ্ঠে যেন যুগ যুগ ধরে সঞ্চিত শান্তির সুর ছিল। চারপাশের মানুষ নিঃশ্বাস ফেলে কেঁদে উঠল, কেউ কেউ হাত জোড় করে প্রণাম করল।

কিন্তু প্রকৃতির নীরবতার মধ্যেই অদ্ভুত এক শব্দ শোনা গেল—মাটির ভেতর থেকে আসা এক ঝিলমিল ধ্বনি। সৌরভ বিস্মিত হয়ে তাকালেন। অগ্নি শান্ত হলেও মাটির নিচে মৃদু আলো জ্বলজ্বল করছিল, যেন মুদ্রার টুকরো এখনও অটুট রয়ে গেছে। তিলোত্তমা দেবীর চোখে তখন এক গভীর রহস্যের আভা দেখা গেল। তিনি মৃদুস্বরে বললেন, “সবকিছু শেষ হয় না কখনও। অগ্নি কেবল ঘুমিয়েছে। তার ঝিলিক মাটির ভেতরে বেঁচে আছে—সময় এলেই আবার জেগে উঠবে।” সৌরভের মনে এক শীতল শিহরণ বয়ে গেল। তাঁর হাত তখনও কাঁপছিল, মনে হচ্ছিল তিনি শুধু একটি যুদ্ধ শেষ করলেন, কিন্তু প্রকৃত লড়াই হয়তো এখনও বাকি আছে। তিলোত্তমা দেবী ধীরে ধীরে আকাশের দিকে তাকিয়ে চোখ বন্ধ করলেন, যেন তিনিও জানেন—এই ইতিহাস এখানেই থেমে গেল না, ভবিষ্যতে আরও এক অগ্নিপরীক্ষা অপেক্ষা করছে। চারদিকে তখন শুধু শান্তির আবহ, ভস্মের গন্ধ, আর মাটির নিচে লুকিয়ে থাকা অগ্নির ঝিলিক—যা সাক্ষী হয়ে রইল মানুষের সাহস, অভিশাপের সমাপ্তি, এবং এক নতুন রহস্যের সূচনার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *