Bangla - রহস্য গল্প

ছায়ার খুনী

Spread the love

অনিন্দ্য মিত্র


কলকাতার রাতের নিস্তব্ধতা সবসময়ই এক অদ্ভুত রকমের সৌন্দর্য বহন করে—কোথাও ল্যাম্পপোস্টের ম্লান আলো, কোথাও অটোর হর্নের টুংটাং, আবার কোথাও গলির মোড়ে ভাজাভুজির গন্ধ মিশে থাকা বাতাস। কিন্তু সেই রাতে শহরের হৃদস্পন্দন যেন থমকে গিয়েছিল এক ভয়ঙ্কর দৃশ্যের সামনে। সঞ্জয়, একজন সাধারণ ট্যাক্সিচালক, রাত সাড়ে দশটার দিকে তার গাড়ি নিয়ে ধর্মতলার মোড়ে দাঁড়িয়ে যাত্রী খুঁজছিল। দিনের চাপে তার চোখে লালচে আভা, শরীর ক্লান্ত, কিন্তু টাকার অভাবে আরও কিছু সময় গাড়ি চালানোর লোভ সামলাতে পারল না। ঠিক তখনই সে দেখতে পেল, রাস্তার অপর পাশে এক অচেনা লোক হঠাৎ করে ধপাস করে পড়ে গেল। প্রথমে ভেবেছিল লোকটা হয়তো মদ খেয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়েছে, কিন্তু কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই রাস্তায় ছড়িয়ে পড়া লালচে তরল দেখে তার শরীর শীতল হয়ে উঠল। হৃদপিণ্ড কেঁপে উঠল—ওটা তো রক্ত! কিন্তু কীভাবে? কারা করল এটা? চোখ তুলে তাকাতেই সে অদ্ভুত কিছু লক্ষ্য করল—একটি ল্যাম্পপোস্টের আলোয় দীর্ঘ এক ছায়া যেন নড়ছে, মানুষের মতো গড়ন, কিন্তু মুখ নেই, কোনো বাস্তব আকার নেই, শুধু এক অদ্ভুত অন্ধকার মূর্তি। যেন আলোর মধ্যে থেকেও অন্ধকার তৈরি করেছে নিজের অস্তিত্ব। সঞ্জয়ের গলা শুকিয়ে এল, শরীর জমে গেল, সে বুঝতে পারল না এটা মানুষ, নাকি তার চোখের ধোঁকা। কিন্তু ভয়ে চিৎকার দেওয়ার আগেই সেই ছায়া ধীরে ধীরে গলির অন্ধকারে মিলিয়ে গেল, আর পেছনে পড়ে রইল নিথর দেহ আর রক্তের দাগ।

খবর পেয়ে কিছুক্ষণের মধ্যে ঘটনাস্থলে পুলিশ আসে। মোড়ের চারপাশে ভিড় জমে যায়—মানুষ কৌতূহল নিয়ে গুজব ছড়াতে শুরু করে। “চুরি-ডাকাতি হবে হয়তো,” কেউ বলে, আবার কেউ ফিসফিস করে, “না না, খুন হয়েছে, কিন্তু খুনি তো চোখেই পড়েনি।” ইন্সপেক্টর অরিন্দম সেন, যিনি ঘটনাস্থলের দায়িত্বে ছিলেন, চারপাশে তাকিয়ে সন্দেহজনক কিছু খুঁজতে লাগলেন। মৃতদেহ এক পুরুষের, বয়স আনুমানিক চল্লিশ, গলায় গভীর কাটা দাগ—কোনও ধারালো অস্ত্রের কাজ। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, চারপাশে একটিও অস্ত্র নেই, নেই কোনো ফিঙ্গারপ্রিন্ট বা লড়াইয়ের চিহ্ন। ফরেনসিক দলের লোকেরা তন্নতন্ন করে জায়গাটা খুঁজেও কিছু পেল না। কেবলমাত্র রক্তে ভিজে থাকা পিচঢালা রাস্তা আর মানুষের আতঙ্কগ্রস্ত দৃষ্টি। সঞ্জয় কাঁপতে কাঁপতে নিজের দেখা কথা জানায়—“স্যার, আমি কাউকে দেখি নি… শুধু একটা ছায়া নড়ছিল… অদ্ভুত ছায়া।” অরিন্দম প্রথমে বিষয়টিকে পাত্তা দেননি, ভেবেছিলেন হয়তো আতঙ্কের কারণে ভুল দেখেছে। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে আরও দু’জন প্রত্যক্ষদর্শী একই কথা বলল—“মানুষ নয়, শুধু ছায়া।” পুলিশের চোখে এই সাক্ষ্যগুলো ছিল অযৌক্তিক, কিন্তু শহরের বাতাসে এক অজানা ভয়ের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল।

রাত যত গভীর হতে লাগল, ঘটনাটা ততই রহস্যে জড়িয়ে পড়ল। সঞ্জয় গাড়ি চালাতে পারছিল না, বারবার মনে হচ্ছিল সেই ল্যাম্পপোস্টের আলোতে নড়তে থাকা ছায়াটাকে। তার বুকের ভেতর কাঁপুনি চলতেই থাকল—এমন কিছু কি সত্যিই সম্ভব? পুলিশ মৃতদেহ মর্গে পাঠাল, রিপোর্টের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল, আর ঘটনাস্থলে গুঞ্জন ছড়াতে লাগল—“ছায়ার খুনী নাকি ফিরে এসেছে।” শহরের অচেনা গলি, পুরনো ভবনের অন্ধকার জানলা, আর ল্যাম্পপোস্টের নিচের জমে থাকা ছায়াগুলো যেন হঠাৎ জীবন্ত হয়ে উঠল মানুষের মনে। কলকাতার ব্যস্ত নগরী, যেখানে প্রতিদিনই নতুন খবর তৈরি হয়, সেই শহরে এবার জন্ম নিল এক নতুন ভয়ের গল্প—এক খুনি, যে মানুষ নয়, এক ছায়া। আর এই খুনের প্রথম সাক্ষী হয়ে গেল এক সাধারণ ট্যাক্সিচালক, যে জানে না, তার দেখা সেই রাতই হয়তো তাকে চিরদিনের জন্য দুঃস্বপ্নের বন্দি করে রাখবে।

অরিন্দম সেনের জীবন যেন সবসময় যুক্তি আর শৃঙ্খলার মধ্যে বাঁধা ছিল। কলকাতা পুলিশের ইন্সপেক্টর হিসেবে তিনি বছরের পর বছর নানা জটিল কেস সমাধান করেছেন, কখনও রাজনৈতিক চাপ, কখনও ভয়ানক অপরাধী—সবকিছুই সামলে নিয়েছেন নিজের ঠান্ডা মাথা আর বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে। তিনি বিশ্বাস করতেন, অপরাধ কখনও রহস্যময় হয় না, শুধু মানুষ খুঁজে পায় না সঠিক সূত্র। তাই যখন ধর্মতলার প্রথম খুনের ঘটনাটি তার হাতে আসে, তিনি এটিকে আর পাঁচটা সাধারণ খুনের মতোই ভেবেছিলেন। অজানা আততায়ীর হাতে এক ব্যক্তির মৃত্যু—হতে পারে ব্যক্তিগত শত্রুতা, হতে পারে চুরি ডাকাতির ব্যর্থ চেষ্টা। কিন্তু তদন্ত শুরু করতেই তিনি ধীরে ধীরে বুঝলেন, এই কেসটা অন্যরকম। প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য যখন বারবার তার কানে বাজতে লাগল—“খুনি মানুষ ছিল না, শুধু একটা ছায়া”—তখন তার ভ্রু কুঁচকে গেল। তিনি এই ধরনের কুসংস্কার বা কল্পনাকে পাত্তা দিতেন না। তার কাছে অপরাধ ছিল মানবীয়, যুক্তিসঙ্গত, প্রমাণ-ভিত্তিক। ছায়া দিয়ে খুন হয় না—এটাই তার বিশ্বাস। তবুও প্রথম রাতের রিপোর্ট তার ভেতরে খানিকটা অস্বস্তি জাগিয়ে তুলেছিল। মৃতদেহের গলায় গভীর কাটা দাগ, কিন্তু অস্ত্র নেই। আশেপাশের সিসিটিভি ফুটেজ পরীক্ষা করা হল, তাতে কেবলমাত্র ল্যাম্পপোস্টের নিচে এক অদ্ভুত ছায়ার ঝলক ধরা পড়ল—মানুষ নয়, আবার আলোছায়ার খেলা বলেও মনে হয় না। যুক্তি আর বাস্তবতার ফাঁক দিয়ে অরিন্দমের মনে যেন এক ফোঁটা সন্দেহ ঢুকে পড়ল।

এরপর দ্বিতীয় খুনটি ঘটল মাত্র পাঁচ দিনের মাথায়, শহরের আরেক প্রান্তে। এবার শিকার হলেন এক কলেজ অধ্যাপক, যিনি নিরিবিলি গলির মধ্যে নিজের বাড়ি ফিরছিলেন। ঘটনাস্থলে গিয়ে অরিন্দমের চোখ কপালে উঠল—একই কায়দা, গলার ওপর ধারালো অস্ত্রের মতো কাটা, রক্তে ভিজে থাকা শরীর, আর আশেপাশে অস্ত্র বা আক্রমণের কোনো চিহ্ন নেই। সাক্ষীরা এবারও একই কথা বলল—“ছায়া।” এক বৃদ্ধা মহিলা কাঁপা গলায় বললেন, “আমি স্পষ্ট দেখেছি, আলোটা নিভে গিয়েছিল হঠাৎ, তারপর একটা ছায়া লম্বা হয়ে বেরিয়ে এল, আর লোকটা মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।” অরিন্দম এবার বিরক্ত হয়ে উঠলেন। তিনি জানতেন, মানুষের চোখ প্রায়ই ভয় বা আতঙ্কে বিভ্রম সৃষ্টি করে। কিন্তু যখন তিনি ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ রুদ্র বসুর সঙ্গে রিপোর্ট আলোচনা করলেন, তখনই তার ধৈর্য ভেঙে গেল। রুদ্র জানালেন, আঘাতটি এমনভাবে দেওয়া হয়েছে যেন অস্ত্র শরীরের ভেতরে গিয়ে আবার মিলিয়ে গেছে—কোনও প্রমাণ ফেলে যায়নি। আরও অদ্ভুত বিষয় হল, মৃতদেহের চারপাশে আলোর প্রতিফলন বা ছায়ার কোণ স্বাভাবিক নিয়ম মানছে না। যেন কেউ ইচ্ছে করে আলোকে বিকৃত করেছে। বিজ্ঞানমনস্ক অরিন্দম নিজের মাথায় হাত চাপড়ালেন—কীভাবে সম্ভব? তিনি নিজেকে বোঝালেন, হয়তো অপরাধী প্রযুক্তি ব্যবহার করছে, হয়তো লেজার বা বিশেষ ধরনের অস্ত্র, কিন্তু এর কোনো প্রমাণ তিনি পাচ্ছিলেন না। রাতে ঘরে ফিরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে তিনি নিজেকেই প্রশ্ন করলেন—তিনি কি ধীরে ধীরে সেই “ছায়ার গল্পে” বিশ্বাস করতে শুরু করছেন?

অরিন্দমের ভেতরে দ্বন্দ্ব বাড়তেই থাকল। তিনি একদিকে নিজেকে বোঝাতে চাইছিলেন যে সবকিছুর ব্যাখ্যা বিজ্ঞানে আছে, অন্যদিকে খুনের ধারাবাহিকতায় যে আতঙ্ক তৈরি হচ্ছিল, তাতে তার নিজের যুক্তিবাদী মনও নড়ে উঠছিল। তৃতীয় খুনের খবর যখন এল, তখন তিনি আর ঠান্ডা মাথায় থাকতে পারলেন না। শহরের মানুষ আতঙ্কে ভুগছে, পত্রিকায় প্রতিদিন শিরোনাম হচ্ছে “ছায়ার খুনী।” কমিশনারের চাপ বাড়ছে, দ্রুত সমাধান আনতে হবে। অরিন্দম নিজের টেবিলে বসে চুপচাপ মৃতদেহের ছবি আর রিপোর্ট একের পর এক উল্টে যাচ্ছিলেন। প্রতিটি মুখ যেন তার চোখের দিকে তাকিয়ে আছে, বলছে—“তুমি এখনও সত্যটা খুঁজে পেতে পারোনি।” তিনি জানতেন, এটা আর সাধারণ খুন নয়। এটা শহরের অন্ধকারে জন্ম নেওয়া এক নতুন রহস্য, যার শিকড় হয়তো বহু পুরোনো। আর অরিন্দম, যিনি কখনও অদৃশ্য জিনিসে বিশ্বাস করেননি, তাকেই এবার সত্যি খুঁজে বের করতে হবে সেই ছায়ার আড়ালে লুকোনো খুনীকে। নিজের অস্বস্তি, নিজের সংশয়, নিজের ভয়কে পেরিয়ে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন—এই যুদ্ধ কেবল আইন বা যুক্তির নয়, এটা তার নিজের ভেতরের বিশ্বাসেরও পরীক্ষা।

ঈশা মুখার্জি ছোটবেলা থেকেই ভিন্নধর্মী ছিল। অন্যরা যখন সাধারণ খবর বা বিনোদন পাতায় মন দিত, তখন সে খুঁজে বেড়াত অপরাধ, রহস্য আর শহরের অন্ধকার গল্প। তার বিশ্বাস ছিল—প্রত্যেক শহরের বুকে কিছু অজানা ইতিহাস চাপা পড়ে থাকে, যেগুলো আলোয় আনতে পারলেই বোঝা যায়, সভ্যতার চকচকে আবরণের নিচে কতটা ক্ষতচিহ্ন লুকিয়ে আছে। একটি জনপ্রিয় সংবাদমাধ্যমের ক্রাইম রিপোর্টার হিসেবে কাজ করতে গিয়ে সে বহু খুন, আত্মহত্যা, দুর্নীতির খবর কভার করেছে, কিন্তু “ছায়ার খুনী”-র ঘটনা তাকে অন্যরকম এক শিহরণে আচ্ছন্ন করল। প্রথম খুনের দিন থেকেই সে ঘটনাস্থলে ছিল, মানুষের আতঙ্কিত চোখ আর ফিসফিসে গুজব শুনেছিল, কিন্তু দ্বিতীয় খুনের পরে বিষয়টা তার কাছে ব্যক্তিগত এক অনুসন্ধানে রূপ নিল। পুলিশের উপর ভরসা করলে শুধু সরকারি সংস্করণ পাওয়া যাবে, তাই সে ঠিক করল নিজের মত করে সত্যটা খুঁজে বের করবে। রাত জেগে ডেস্কে বসে পুরোনো সংবাদপত্র, পুলিশ ফাইল আর আর্কাইভ ঘাঁটতে শুরু করল। শহরের পুরনো খবরের ভেতরে সে এমন কিছু অমীমাংসিত খুনের রেকর্ড পেল, যেগুলোর প্যাটার্ন একেবারে বর্তমান ঘটনার মতো—গলায় কাটা দাগ, অস্ত্রহীন হত্যাকাণ্ড, আর সাক্ষীরা সবাই বলেছে তারা “অদ্ভুত ছায়া” দেখেছে। সময়ের ব্যবধান ছিল কয়েক বছর, কখনও দশ বছর, কখনও আরও বেশি, কিন্তু ঘটনাগুলো একই ছন্দে ঘটেছে। ঈশার ভেতরে শীতল স্রোত বয়ে গেল—এটা কোনও সাধারণ সিরিয়াল কিলারের কাজ নয়, এর শিকড় অনেক গভীরে।

দিনে অফিসের কাজ চালিয়ে গেলেও রাতে ঈশা যেন এক যোদ্ধার মতো অন্ধকার কাহিনির অনুসন্ধান চালাত। সে জানত, পুলিশ কখনও তাকে তথ্য দেবে না, বরং তার পিছু নেবে যদি বুঝতে পারে সে নিজের মতো তদন্ত করছে। তাই পুলিশ হেডকোয়ার্টারের ভেতরের একজন পুরোনো পরিচিত ক্লার্ককে কাজে লাগিয়ে সে কিছু অমীমাংসিত কেস ফাইল হাতে পেয়ে গেল। ফাইলগুলোর পাতায় সময়ের গন্ধ, পুরোনো টাইপরাইটারের দাগ, আর তদন্তকারীদের ক্লান্ত মন্তব্য। প্রত্যেক জায়গায় একই মন্তব্য চোখে পড়ল—“প্রমাণের অভাব, অজানা হত্যাকারী, মামলার অগ্রগতি বন্ধ।” ঈশা বারবার চোখ বুলিয়ে একই ধাঁধার মুখোমুখি হতে লাগল। একটা সময় তার মনে হল, হয়তো এই শহরের বুকে এমন এক অদৃশ্য ইতিহাস আছে, যেটা সবাই ইচ্ছে করে চাপা দিয়ে রেখেছে। সে নিজের নোটবুকে তারিখ, জায়গা আর ভিকটিমদের নাম লিখে একটা চার্ট বানাতে শুরু করল। চমকপ্রদভাবে খেয়াল করল, খুনগুলো শহরের একই ধরণের জায়গায় ঘটেছে—পুরনো গলি, ধ্বংসপ্রায় বাড়ি, ল্যাম্পপোস্টের নিচে, যেখানে আলো আর অন্ধকারের খেলা তীব্র। এই সূত্রগুলো তাকে বুঝিয়ে দিল, ছায়ার খুনী শুধু এলোমেলোভাবে আঘাত করছে না, বরং শহরের নির্দিষ্ট অন্ধকার কোণগুলো বেছে নিচ্ছে। তার ভেতরে সাংবাদিকের কৌতূহল আরও বেড়ে উঠল—কেন এই জায়গাগুলো? কেন এই সময়গুলো?

রাত বারোটার পরও যখন ঈশার ডেস্কের ল্যাম্প জ্বলছিল, তখন তার চোখে ক্লান্তি এলেও মনে উজ্জ্বল হয়ে উঠছিল এক ভয়ংকর সম্ভাবনা। কলকাতার পুরনো ইতিহাস, বিশেষ করে ঔপনিবেশিক আমল থেকে শুরু করে স্বাধীনতার প্রথম দিক পর্যন্ত, নানা অন্ধকার কাহিনি আর অভিশপ্ত কিংবদন্তি লুকিয়ে রেখেছে। পুরোনো পুলিশ রিপোর্ট, স্থানীয় লোককথা আর গ্রন্থাগারের আর্কাইভ একসাথে মেলাতে গিয়ে ঈশা আঁচ করতে শুরু করল যে এই “ছায়ার খুনী” হয়তো শহরের অতীতেরই কোনও প্রতিশোধ বা অভিশাপের সঙ্গে যুক্ত। তার মনে হতে লাগল, হয়তো বহু বছর আগে ঘটে যাওয়া অন্যায়ের শিকার কেউ বা কিছু আজও শহরের অন্ধকারে বেঁচে আছে, ছায়া হয়ে, এবং নির্দিষ্ট মানুষদের শাস্তি দিচ্ছে। কিন্তু এগুলো কেবল অনুমান। তাকে আরও গভীরে নামতে হবে, আরও প্রমাণ খুঁজতে হবে। জানলার বাইরের হালকা হাওয়া তার চুল উড়িয়ে দিচ্ছিল, দূরে শহরের গাড়ির হর্ন শোনা যাচ্ছিল, কিন্তু সেই মুহূর্তে ঈশা অনুভব করল সে একা নয়। যেন শহরের অন্ধকার তাকে দেখছে, কেউ তার খোঁজখবর রাখছে। বুকের ভেতরে কেঁপে উঠল ভয়, তবুও তার চোখে দৃঢ় সংকল্প জ্বলে উঠল—যে করেই হোক, সে এই রহস্যের শিকড় বের করবে, কারণ এই গল্প শুধু খুনের নয়, এই গল্প কলকাতার ইতিহাসের অন্ধকার স্তরের।

কলকাতার খুনের রহস্য যখন তীব্র অন্ধকার ঘনিয়ে তুলছে, ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ ডঃ রুদ্র বসু তার পরীক্ষাগারে বসে শেষ মৃতদেহটির উপর গবেষণা করছিলেন। টেবিলের উপর ছড়ানো কাগজপত্র, রিপোর্ট, আর মাইক্রোস্কোপের নীচে রাখা স্যাম্পল যেন রাতকে আরও গভীর করে তুলেছিল। অদ্ভুত এক শিহরণ তার শরীরে বয়ে গেল যখন তিনি আবিষ্কার করলেন—মৃতদেহে কোনো ছুরির দাগ নেই, কোনো আঘাতের চিহ্ন নেই, অথচ শরীরের কোষগুলো ভেতর থেকে ভেঙে পড়েছে যেন আলো আর ছায়ার এক অদ্ভুত লড়াই সেখানে সংঘটিত হয়েছিল। রিপোর্টে পরিষ্কার দেখা গেল যে রক্ত জমাট বাঁধার ধরনও স্বাভাবিক নয়—এ যেন শরীরের ভেতরে আলোর প্রতিসরণে সৃষ্ট অদৃশ্য আঘাত। তিনি হতবাক হয়ে ভাবতে লাগলেন, এই ধরণের ক্ষয় বিজ্ঞান যেভাবে ব্যাখ্যা করে, তার কোনো সূত্রেই ফিট হচ্ছে না। হাড়ের উপর অচেনা ছায়ার মতো চিহ্ন, যা কোনো অস্ত্র বা হাতের তৈরি হতে পারে না। রুদ্রের চোখে ভয়ের ঝিলিক ফুটে উঠলেও, বিজ্ঞানী সত্তা তাকে আটকে রাখল—কোনো না কোনো যৌক্তিক কারণ নিশ্চয়ই আছে, তবে এখনও তা অজানা।

অন্যদিকে, ইন্সপেক্টর অরিন্দম সেন, যুক্তিবাদী এবং দৃঢ়চেতা মানুষ, রিপোর্ট হাতে নিয়ে বসে রুদ্রের কথা শুনছিলেন। কিন্তু তার মনের ভেতর দ্বন্দ্ব বেড়ে উঠতে লাগল। তিনি জানেন, কোনো অপরাধী মানুষ ছাড়া আর কিছু হতে পারে না। মানুষই এই শহরে খুন করছে, মানুষই আতঙ্ক ছড়াচ্ছে—এটাই তার বাস্তববাদী মনকে শান্তি দেয়। কিন্তু প্রতিটি খুনে প্রত্যক্ষদর্শীরা একই কথা বলছে—তারা খুনিকে দেখেনি, দেখেছে শুধু এক অদ্ভুত ছায়া। আর এখন ফরেনসিক রিপোর্টও যেন সেই কথাই ইঙ্গিত করছে, যদিও কোনো সরাসরি প্রমাণ নেই। রুদ্র বলছিলেন, “অরিন্দম, তুমি দেখছো তো? আলোর নিয়ম অনুযায়ী ছায়া এভাবে শরীরকে ক্ষতবিক্ষত করতে পারে না। এটা বিজ্ঞানের বাইরে কিছু।” অরিন্দম বিরক্ত হয়ে উত্তর দিলেন, “রুদ্র, অতিপ্রাকৃত কিছু নেই। সব কিছুর ব্যাখ্যা আছে। তুমি শুধু সেটা খুঁজে পাচ্ছো না।” দু’জনের মধ্যে উত্তপ্ত বিতর্ক শুরু হলো—একজন বিজ্ঞানের অদ্ভুত সীমান্তে দাঁড়িয়ে শঙ্কিত, অন্যজন দৃঢ়ভাবে বিজ্ঞানের ভেতরেই উত্তর খুঁজতে মরিয়া। এই দ্বন্দ্ব যেন কেসটিকে আরও রহস্যময় করে তুলল।

রাত নামতেই কলকাতার অন্ধকার গলিতে নতুন আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়তে লাগল। প্রত্যেকটি আলোয় মোড়া রাস্তাও যেন এক অদৃশ্য ছায়ার ফাঁদ হয়ে উঠছে। অরিন্দম আর রুদ্র দু’জনেই তাদের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এগিয়ে চলেছেন—একজন মনে করেন ছায়া শুধু মানুষের মানসিক বিভ্রম, অন্যজন মনে করেন এই খুনগুলো বিজ্ঞানের নিয়মের বাইরে কোনো অচেনা শক্তির কাজ। কিন্তু তদন্ত যত এগোচ্ছে, ঘটনাগুলো ততই তাদেরকে প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করাচ্ছে। বিজ্ঞানের যুক্তি কোথাও গিয়ে থেমে যাচ্ছে, আবার অজানা শক্তির প্রমাণও ধরা দিচ্ছে না। এই দ্বন্দ্বে অরিন্দমের ভেতরে প্রথমবারের মতো এক অস্থিরতা জন্ম নিতে শুরু করল—যদি সত্যিই এর পেছনে এমন কিছু থাকে যা বিজ্ঞানও বোঝাতে পারে না? আর রুদ্র, যিনি সবসময় বিজ্ঞানের ভেতরেই উত্তর খুঁজে পান, তিনি নিজেও ভিতরে ভিতরে অনুভব করতে লাগলেন—হয়তো মানুষের তৈরি ছায়া নয়, কলকাতার অন্ধকার ইতিহাস থেকে উঠে আসছে এমন এক শক্তি, যা কেবল রক্ত দিয়ে বেঁচে থাকে।

ঈশার মনে তখন কেবল একটাই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে—এই সব খুন কি সত্যিই কোনো মানুষের কাজ, নাকি এমন কিছু যা মানুষকে অতিক্রম করে যায়? অরিন্দম এবং রুদ্র দুজনেই তাকে দূরে থাকার পরামর্শ দিয়েছিল, কিন্তু তার কৌতূহল আগুনের মতো দাউ দাউ করে জ্বলছিল। এক রাতে অফিসের পুরোনো আর্কাইভ ঘাঁটতে ঘাঁটতে তার চোখে পড়ে এক নাম—অভিজিৎ মুখার্জি। একসময় তিনি প্রেসিডেন্সির খ্যাতনামা অধ্যাপক ছিলেন, ইতিহাস আর লোকগাথার উপর তাঁর দখল ছিল অসাধারণ। তবে কয়েক বছর আগে অদ্ভুত কারণে চাকরি ছেড়ে নিঃসঙ্গ জীবনে চলে যান। লোকজন বলে, তিনি নাকি এমন কিছু গবেষণা করেছিলেন যা বিজ্ঞান মানতে চায় না। ঈশা খুঁজে বের করল তাঁর ঠিকানা—উত্তর কলকাতার এক ভাঙাচোরা বাড়ি, যেখানে বাতাসও যেন ইতিহাসের ধুলো বয়ে আনে। সন্ধ্যার পর সেই বাড়িতে পৌঁছে ঈশা কড়া নাড়তেই দরজা খুলে দাঁড়ালেন এক বৃদ্ধ, চোখে মোটা চশমা, চুল পেকে সাদা, মুখে এক অদ্ভুত স্থিরতা। তিনি যেন অনেক দূরের সময় থেকে এসে দাঁড়িয়েছেন বর্তমানের দরজায়।

অভিজিৎ মুখার্জি প্রথমে কথা বলতে চাননি। তিনি বললেন, সাংবাদিকেরা নাকি শুধু গল্প খুঁজতে আসে, সত্য খোঁজে না। কিন্তু ঈশার চোখের তীব্রতা, তার কণ্ঠের কৌতূহল, তাঁকে ধীরে ধীরে খুলে দিল। ধূলোমাখা টেবিলের ওপর রাখা পুরনো চা-দাগ ধরা ডায়েরি খুলে তিনি বললেন, “কলকাতার ছায়া খুনীর গল্প নতুন নয়। এই শহরের জন্মলগ্ন থেকেই অন্ধকারের সাথে তার এক অদ্ভুত সম্পর্ক। ব্রিটিশ আমলে এখানে নাকি এক হত্যাকারী ছিল—যাকে কেউ দেখতে পেত না। শুধু খুনের সময় দেখা যেত এক অস্বাভাবিক ছায়া, যে আলোকে অমান্য করে চলাফেরা করত। অনেকেই বিশ্বাস করত, সে একজন অভিশপ্ত মানুষ—যে নিজের প্রতিশোধের জন্য মৃত্যুর পরেও থামতে পারেনি।” অভিজিৎ বিরতি নিলেন, যেন স্মৃতির ভার তাঁকে চেপে ধরেছে। ঈশা অবাক হয়ে শুনছিল, কারণ যা তিনি বলছেন, তা একেবারেই আজকের খুনগুলির সঙ্গে মিলে যায়। “এই কিংবদন্তির নাম ছিল ছায়ার খুনী,” অভিজিৎ আবার বললেন, “সে নাকি প্রতি কিছু বছর পরপর ফিরে আসে, শহরের অন্ধকারে নতুন করে রক্তের দাগ আঁকতে।”

ঈশার মাথায় তখন হাজারো প্রশ্ন ভিড় করছে। এটা কি কেবলই লোককথা, নাকি সত্যি কোনো ইতিহাসের ছায়া আজও শহরের উপর ভর করে আছে? সে অধ্যাপককে প্রশ্ন করে—“আপনি কি মনে করেন আজকের ঘটনাগুলি সেই কিংবদন্তিরই পুনরাবৃত্তি?” বৃদ্ধ চোখ তুলে তাকালেন, দীর্ঘক্ষণ চুপ করে রইলেন, তারপর বললেন, “আমি বিশ্বাস করি, কিছু গল্প কুসংস্কার নয়, বরং ইতিহাসের অন্য রূপ। আর ইতিহাস যখন ভুলে যাওয়া হয়, তখন সে ছায়া হয়ে ফিরে আসে।” ঘরের অন্ধকারে তাঁর কণ্ঠ যেন আরও ভারী হয়ে উঠেছিল। ঈশা অনুভব করল, বাইরে হয়তো কলকাতার রাস্তায় গাড়ির শব্দ, দোকানের কোলাহল শোনা যাচ্ছে, কিন্তু এই চার দেওয়ালের ভেতরে সে যেন এক প্রাচীন অন্ধকারে আটকে গেছে। অভিজিৎ মুখার্জির চোখে ভয়ের সঙ্গে মিশে ছিল এক অদ্ভুত নিশ্চিতি—যেন তিনি জানেন, ছায়ার খুনী আবার ফিরে এসেছে। আর তখনই ঈশার মনে হল, এই গল্পের মধ্যে হয়তো লুকিয়ে আছে সেই সূত্র, যা পুলিশের সব বৈজ্ঞানিক প্রমাণ ব্যর্থ হলেও সত্যকে প্রকাশ করতে পারে। সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো, কিন্তু তার ভেতরে দোলা দিচ্ছিল এক নতুন উপলব্ধি—এই খুন থামাতে হলে শুধু অপরাধী নয়, ইতিহাসের অন্ধকারের সঙ্গেও তাকে লড়তে হবে।

কলকাতার দক্ষিণের এক অভিজাত অঞ্চলে রাতের অন্ধকারে ঘটল পরবর্তী ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড। শহরের নামী ব্যবসায়ী অরূপ সেনগুপ্ত নিজের দোতলা বাড়িতে অতিথিদের বিদায় দিয়ে ফিরছিলেন, এমন সময় বাগানের ভেতর থেকে ভেসে এল অদ্ভুত এক শব্দ। কয়েক মুহূর্ত পরেই নিরাপত্তারক্ষীরা চিৎকার করে দৌড়ে আসে—তারা শুধু দেখে অরূপ মাটিতে লুটিয়ে পড়েছেন, চোখ ফাঁকা হয়ে গেছে, যেন জীবনের সমস্ত আলো নিভে গেছে তার ভিতরে। চারপাশে আর কিছু নেই, শুধু এক মুহূর্তের জন্য দেখা এক অস্বাভাবিক ছায়া, যা আলো-অন্ধকারের নিয়ম ভঙ্গ করে চলাফেরা করছিল। নিরাপত্তারক্ষীরা আতঙ্কে অস্পষ্টভাবে বর্ণনা দেয়, কিন্তু প্রত্যেকের মুখ থেকে একই শব্দ বেরিয়ে আসে—“ওটা মানুষ ছিল না… কেবল এক ছায়া।” সংবাদমাধ্যমে খবর ছড়িয়ে পড়তেই শহর উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। নাগরিকরা আতঙ্কিত, পুলিশের ওপর চাপ বাড়তে থাকে। অরিন্দম সেন নিজের যুক্তিবাদী মনকে যতই শক্ত করতে চান না কেন, তিন-তিনটে ঘটনায় প্রত্যক্ষদর্শীরা একই বর্ণনা দেওয়ায় তিনিও টালমাটাল হয়ে পড়েন। নিজের অফিসে বসে তিনি একাধিকবার ভিডিও ফুটেজ, প্রতিবেদন আর সাক্ষীদের জবানবন্দি ঘাঁটেন, কিন্তু সব প্রমাণ হাত ফসকে যায়—কোথাও ছায়ার কোনো সুনির্দিষ্ট ছাপ নেই। তবু ঘটনাগুলোর নিখুঁত মিল অস্বীকার করা যায় না।

অন্যদিকে ঈশা মুখার্জি তার অনুসন্ধান চালিয়ে যাচ্ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন পথে। পুলিশের অগ্রগতির বাইরে গিয়ে সে পুরনো ফাইল, কোর্টের নথি আর সংবাদপত্র ঘাঁটতে থাকে। হঠাৎই তার সামনে এসে পড়ে এক বিস্ময়কর সংযোগ—তিনজন ভিকটিমই একসময় একই কারাগারে বন্দি ছিল। অপরাধের ধরণ আলাদা হলেও প্রত্যেককে অবাক করা কাণ্ডে জামিন বা ক্ষমা পেয়ে ছাড়া হয়েছিল। ব্যবসায়ী অরূপ সেনগুপ্ত এক আর্থিক কেলেঙ্কারিতে ধরা পড়লেও প্রমাণের অভাবে ছাড়া পায়; আগের ভিকটিম ট্যাক্সিচালককে ব্ল্যাকমেইলের মামলায় ধরা হয়েছিল কিন্তু অজ্ঞাত কারণে মুক্তি পায়; আর দ্বিতীয় ভিকটিমকে এক রাজনৈতিক সংযোগের মাধ্যমে বাঁচানো হয়। ঈশা বুঝতে পারে, এরা সবাই কোনো না কোনোভাবে আইন বা ন্যায়ের চোখ এড়িয়ে বেঁচে গেছে। তখনই তার মনে প্রশ্ন জাগে—যদি সত্যিই কিংবদন্তির মতো কোনো ছায়া প্রতিশোধ নিচ্ছে, তবে এর লক্ষ্যবস্তু কেবল তারা-ই, যারা অপরাধী হয়েও শাস্তি থেকে বেঁচে গিয়েছে? আর যদি তা-ই হয়, তবে শহরের আরো কত মানুষ এর তালিকায় আছে? এই আবিষ্কার ঈশার ভেতরে এক শিহরণ জাগায়।

অরিন্দমের সঙ্গে এই তথ্য ভাগ করতে গিয়ে ঈশা প্রথমে পুলিশের তীব্র প্রতিবাদ ও অবিশ্বাসের সম্মুখীন হয়। কিন্তু রুদ্র বসুর ফরেনসিক রিপোর্টের অসঙ্গতি, প্রত্যেক সাক্ষীর একরকম বর্ণনা, আর সবচেয়ে বড়ো কথা—ঈশার খুঁজে পাওয়া ইতিহাস—সব মিলিয়ে অরিন্দম আর অস্বীকার করতে পারেন না যে এই কেস সাধারণ নয়। রাতভর বসে তিনি শহরের মানচিত্রে খুনগুলোর অবস্থান চিহ্নিত করতে থাকেন, যেন কোনো অদৃশ্য প্যাটার্ন খুঁজছেন। রুদ্র এখনও বিজ্ঞানের নিয়মের বাইরে কিছু মানতে রাজি নয়, তবু সে-ও অস্বীকার করতে পারে না মৃতদেহে পাওয়া আলোর অস্বাভাবিক প্রতিফলন। একদিকে পুলিশের চাপ, অন্যদিকে জনমতের ভয়, আর তার মাঝেই অরিন্দমের মনের ভেতর জন্ম নেয় এক অদ্ভুত টানাপোড়েন—সে জানে, যুক্তিবাদের সীমা আছে, কিন্তু অযৌক্তিককে বিশ্বাস করাও বিপজ্জনক। ঈশা তাকে বোঝাতে চেষ্টা করে—“কিংবদন্তি যতই কুসংস্কার মনে হোক না কেন, ইতিহাসের মধ্যে অনেক সময় সত্যি লুকিয়ে থাকে।” আর ঠিক সেই মুহূর্তে খবর আসে—চতুর্থ একটি নাম নতুন করে জড়িয়ে পড়েছে, যিনি একই কারাগারের প্রাক্তন বন্দি। শহর নিঃশ্বাস আটকে অপেক্ষা করতে থাকে—ছায়ার পরবর্তী শিকার কে?

তদন্ত যত গভীরে প্রবেশ করছে, ততই রহস্য ঘনীভূত হচ্ছে। ঈশার খোঁজাখুঁজি আর অরিন্দমের জেদি যুক্তিবাদী অনুসন্ধানের মিলনবিন্দুতে উঠে আসে এক পুরনো নাম—অমরেশ দত্ত, এক তরুণ গবেষক, যাকে বিশ বছর আগে এক বিতর্কিত মামলায় হঠাৎ গ্রেপ্তার করা হয় এবং সেই সময়ের ক্ষমতাশালী লোকদের চাপে তাকে জেলে বন্দী করে রাখা হয়। রুদ্র বসুর ফরেনসিক রিপোর্টে পাওয়া অস্বাভাবিক তথ্য আর ঈশার পুরনো ফাইল ঘেঁটে পাওয়া সংবাদক্লিপিং মিলে একটি নতুন পথের ইঙ্গিত দেয়। জানা যায়, জেলের ভেতরেই এক রাতে রহস্যজনক পরিস্থিতিতে অমরেশ দত্ত মারা যায়, অথচ তার মৃত্যুর কারণ নিয়ে তখন কোনো পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট প্রকাশ হয়নি। অরিন্দম বুঝতে পারে, বর্তমানের খুনগুলো শুধুমাত্র বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনার ফল নয়, বরং শহরের অতীতে চাপা পড়ে থাকা অন্যায়ের প্রতিধ্বনি। এদিকে শহরে জনমত তৈরি হচ্ছে—মানুষ ফিসফিস করে বলছে, “ছায়ার খুনী” সেই অমরেশ দত্তের প্রতিশোধপরায়ণ আত্মা, যে মৃত্যুর পরেও শান্তি পায়নি। কিন্তু অরিন্দমের মন তা মানতে নারাজ। তার বিশ্বাস, এই কিংবদন্তিকে কাজে লাগাচ্ছে কোনো মানুষ, যার উদ্দেশ্য হয়তো প্রতিশোধ, অথবা ভয় দেখিয়ে শহরে এক অদৃশ্য শক্তির আধিপত্য কায়েম করা।

ঈশা সাংবাদিক হিসেবে মানুষের অভিজ্ঞতা সংগ্রহ করতে গিয়ে আরও চমকপ্রদ তথ্য খুঁজে পায়। স্থানীয়রা মনে করে, সেই তরুণ গবেষক নিরপরাধ ছিল, কিন্তু তার বিরুদ্ধাচরণই তাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। তারা বলে, অমরেশ এক সময় কলকাতার অন্ধকার ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করছিল—বিশেষত প্রাচীন লোককথা, অভিশাপ, আর শহরের অদৃশ্য রহস্য নিয়ে। তার গবেষণা নাকি এমন সত্য উদ্ঘাটন করেছিল, যা অনেক ক্ষমতাশালী ব্যক্তির অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এ কারণে তার বিরুদ্ধে মিথ্যে অভিযোগ আনা হয় এবং কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ঈশার কাছে যত প্রমাণ জমতে থাকে, ততই মনে হয় অমরেশের মৃত্যু স্বাভাবিক ছিল না—এটা ছিল পরিকল্পিত হত্যা। ফলে তার দৃষ্টিতে “ছায়ার খুনী” হয়তো সেই হত্যারই প্রতিশোধ নিচ্ছে, সে আত্মা হোক বা মানুষ। অন্যদিকে অরিন্দম যুক্তি দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করে—আত্মার গল্পগুলো শুধুই মানুষের কুসংস্কার; প্রকৃত সত্য হচ্ছে কেউ অমরেশের মৃত্যুর পর সেই কিংবদন্তিকে কাজে লাগাচ্ছে। তবুও বারবার ঘটতে থাকা খুন, সাক্ষীদের চোখে ছায়ার প্রতিচ্ছবি, আর বৈজ্ঞানিকভাবে ব্যাখ্যাতীত প্রমাণ—সব মিলিয়ে অরিন্দম নিজেও দ্বন্দ্বে পড়ে যায়।

তদন্তের চাপ আরও বাড়তে থাকে যখন অরিন্দম আর ঈশা খুঁজে বের করে যে সাম্প্রতিক খুন হওয়া প্রত্যেকজন কোনো না কোনোভাবে সেই প্রাচীন ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিল। তারা হয় অমরেশের মামলার বিচার প্রক্রিয়ায় সক্রিয় ছিল, নয়তো এমন কোনো ব্যক্তি ছিল যারা তাকে মিথ্যে মামলায় ফাঁসানোর ষড়যন্ত্রে সহযোগিতা করেছিল। মানে, প্রতিটি খুন আসলে একটি সুপরিকল্পিত প্রতিশোধের কাহিনী। এখন প্রশ্ন—এটা কে করছে? সত্যিই কি কোনো অশরীরী শক্তি ছায়া হয়ে বেরিয়ে এসেছে, নাকি একজন মানুষ ছায়ার মুখোশ পরে পুরনো অন্যায়ের বিচার করছে? শহরজুড়ে ভয়ের বাতাস ছড়িয়ে পড়ে—রাতের পর রাত মানুষ ভাবে, তাদের চারপাশের অন্ধকারে হয়তো সেই ছায়া ঘুরে বেড়াচ্ছে। পুলিশের উচ্চ মহল অরিন্দমকে চাপ দিতে থাকে, দ্রুত খুনিকে ধরতে হবে, নইলে জনমতের ঝড় সামলানো অসম্ভব হবে। কিন্তু অরিন্দম জানে, সত্য উদ্ঘাটনের আগে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব নয়। তার মনে দৃঢ় ধারণা জন্মায়—এই সব রহস্যের শিকড় লুকিয়ে আছে সেই পুরনো কারাগার আর অমরেশ দত্তের অজানা মৃত্যুর কাহিনিতে। আর ঠিক তখনই গল্প নতুন মোড় নেয়—যেন সময় নিজেই তাদের পেছনে টেনে নিয়ে যাচ্ছে অতীতের অন্ধকারে, যেখানে “ছায়ার খুনী”-র রহস্যের প্রকৃত উত্তর লুকিয়ে আছে।

ঈশা সেই রাতে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করতে বেরিয়েছিল। অরিন্দম সেন তাকে একাধিকবার সাবধান করেছিল একা বের না হতে, কিন্তু সাংবাদিক হিসেবে তার মনে হয়েছিল, সত্যটা খুঁজে বের করা শুধু পুলিশের কাজ নয়, তারও দায়িত্ব। রাস্তা প্রায় ফাঁকা, কেবল মাঝে মাঝে দূর থেকে হর্নের শব্দ ভেসে আসছে। কলকাতার পুরনো গলির সেই নির্জন পরিবেশে একটা অস্বস্তিকর শীতলতা নেমে এসেছিল। হঠাৎ করেই ঈশার মনে হল, তার চারপাশের বাতাস যেন ভারী হয়ে গেছে, কোনো অদৃশ্য সত্তা নিঃশব্দে তাকে অনুসরণ করছে। সে নিজের ছায়ার দিকে তাকাল, কিন্তু হঠাৎই দেখতে পেল—অন্ধকারে একটা চলমান ছায়া যেন মাটির নিয়ম মানছে না। কেবল আলো থেকে নয়, বরং শূন্য থেকে জন্ম নিচ্ছে সেই অন্ধকার অবয়ব। এক মুহূর্তে তার হৃদস্পন্দন দ্রুত হয়ে উঠল, হাতের কলম আর খাতাও কেঁপে উঠল। সে বুঝতে পারল, যে গল্প এতদিন শোনা যাচ্ছিল—‘ছায়ার খুনি’—তা হয়তো নিছক কল্পকাহিনি নয়, সত্যিই তার সামনে উপস্থিত।

ছায়াটি ধীরে ধীরে আকার নিচ্ছিল, আর ততই স্পষ্ট হচ্ছিল যে এটি কোনো অলৌকিক সত্তা নয়, বরং মানুষের মতোই কেউ। কিন্তু তার চলাফেরা এতটাই অস্বাভাবিক—কখনও হঠাৎ ঝাপসা হয়ে যাওয়া, আবার কখনও আলোর সঙ্গে একেবারে মিশে যাওয়া—যে মনে হচ্ছিল সে প্রকৃতির কোনো নিয়ম মানে না। ঈশা মরিয়া হয়ে পালানোর চেষ্টা করলেও, ছায়াটি তার পথ রোধ করে দাঁড়াল। ঠিক সেই মুহূর্তে সে খুনির চোখে তাকাল, আর যেন জমে গেল। চোখ দুটো ছিল শূন্য, প্রাণহীন, এমন এক অন্ধকার যা তাকে ভিতর থেকে গিলে নিচ্ছে। কোনো রাগ, কোনো আনন্দ, কোনো দয়া নেই—শুধু শূন্যতা। সেই চোখে তাকিয়ে ঈশা যেন বুঝতে পারল, এ কোনো সাধারণ অপরাধীর চোখ নয়; এ এক যন্ত্রণার, অভিশাপের, আর অজানা রহস্যের প্রতীক। তার শরীর কেঁপে উঠল, ঠান্ডা ঘামে ভিজে গেল তার কপাল। খুনি এগিয়ে এল, কিন্তু কোনোভাবে ঈশা শেষ মুহূর্তে একপাশে সরে গিয়ে প্রাণে বাঁচল। ছায়াটি যেন মিলিয়ে গেল রাতের আঁধারে, রেখে গেল শুধু একটা জমাটবাঁধা ভয়ের স্মৃতি।

অল্পের জন্য বেঁচে গিয়ে ঈশা রাস্তার একপাশে বসে হাপাচ্ছিল। তার মনে হচ্ছিল, শরীর ভেঙে পড়েছে, তবু মাথার ভেতর ভেসে উঠছিল সেই চোখের দৃশ্য। সে জানত, সাংবাদিকতার কৌতূহলই তাকে এখানে এনেছিল, কিন্তু আজ সে আর নিছক কৌতূহলী নয়—সে সরাসরি মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছে। ভয় আর বিস্ময়ের মাঝখানে দাঁড়িয়ে ঈশা অনুভব করল, ঘটনাটা হয়তো বিজ্ঞানের বাইরে নয়, কিন্তু এর ভেতর লুকিয়ে আছে এমন এক ভৌতিক উপস্থিতি, যা মানুষকে ভেঙে দিতে পারে। সে জানত, অরিন্দম সেন এখনো মনে করে এ কেবল এক বাস্তব মানুষ, যে ছায়ার কিংবদন্তিকে ব্যবহার করছে। কিন্তু ঈশা নিজের চোখে দেখে এসেছে—যে-ই হোক না কেন, তার ভেতরে মানুষের স্বাভাবিক আবেগ নেই। খুনির চোখে যে শূন্যতা সে দেখেছে, তা তাকে বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছিল—এই লড়াই কেবল পুলিশের তদন্ত নয়, এক অদৃশ্য অন্ধকার শক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর যুদ্ধ। ঈশা বুঝল, এ যাত্রা থেকে তার আর ফিরে আসা নেই; এখন সে শুধু সত্য উন্মোচনের জন্য নয়, নিজের অস্তিত্ব রক্ষার জন্যও লড়াই করছে।

অরিন্দম ও ঈশার ধৈর্যশীল তদন্ত ধীরে ধীরে এক অদ্ভুত সত্য উন্মোচন করে। এতদিন যে রহস্যময় “ছায়া”কে কেবল একটি লোককথা বা আত্মার প্রতিশোধ হিসেবে ধরা হচ্ছিল, তার আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে এক রক্তমাংসের মানুষ। খুঁজে পাওয়া যায় সূত্র—পুরনো কারাগারের আর্কাইভ, ধুলো জমা সরকারি নথি, আর ভুলে যাওয়া ফরেনসিক রিপোর্ট। সেখানেই উঠে আসে এক নাম—অমিতাভ চট্টোপাধ্যায়, এক সময়ের উজ্জ্বল ফরেনসিক ল্যাব টেকনিশিয়ান। বিশ বছর আগে শহরের নামকরা গবেষককে হত্যা মামলায় তাকে দায়ী করা হয় এবং বরখাস্ত করা হয় এক বিতর্কিত তদন্তের পর। নিজের নির্দোষ প্রমাণ করতে না পেরে ধীরে ধীরে সে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। কিন্তু অদ্ভুত বিষয় হলো, তার পদক্ষেপগুলো ঠিক কিংবদন্তির “ছায়া খুনী”-র মতোন সাজানো। পুলিশ ও সংবাদমাধ্যমের চোখে তা কেবল ভয় জাগানো নাটক মনে হলেও, অরিন্দম বুঝতে পারে—এখানে লুকিয়ে আছে পরিকল্পিত প্রতিশোধ আর বিকৃত ন্যায়বোধের মিলিত রূপ।

ঈশা আরও গভীরে খোঁজ নিয়ে জানতে পারে, অমিতাভ কেবল প্রযুক্তিগত দক্ষতায়ই পারদর্শী ছিলেন না, আলো-অন্ধকারের প্রতিসরণ, অপটিক্যাল ইলিউশন, এমনকি মানুষের চোখে বিভ্রম সৃষ্টির নানা কৌশলেও তার বিশেষ জ্ঞান ছিল। চাকরি হারানোর পর বছরের পর বছর সে এই দক্ষতাকে অন্যভাবে কাজে লাগায়—শহরের ভেতর ভূতের মতো ঘুরে বেড়ানো, আলোর প্রতিফলন ও ছায়ার বিকৃতি ব্যবহার করে নিজের শরীরকে ভৌতিক রূপে উপস্থাপন করা। সে যেন ধীরে ধীরে বিশ্বাস করতে শুরু করে, সে আর কেবল অমিতাভ নয়, সে-ই আসল “ছায়া”। মানুষের ভয়কে অস্ত্র করে তুলেই সে প্রতিশোধের সাম্রাজ্য গড়ে তোলে। তার শিকাররা সেইসব মানুষ, যারা অতীতে গবেষকের মৃত্যুর ঘটনায় জড়িত ছিল কিংবা কোনোভাবে ন্যায়বিচারকে বিকৃত করেছিল। প্রতিটি হত্যাই শুধু রক্তক্ষয় নয়, ছিল একধরনের প্রতীকী বার্তা—যেন পৃথিবীকে জানানো যে অবিচার কখনও চাপা পড়ে না। কিন্তু অরিন্দম ও ঈশার চোখে ধরা পড়ে, প্রতিটি হত্যার পেছনে নৃশংস কৌশলের পাশাপাশি আছে গভীর মানসিক ভাঙন, যা অমিতাভকে মানুষের সীমানা থেকে ঠেলে দিয়েছে আধা-দানবীয় অন্ধকারে।

তদন্ত যত অগ্রসর হয়, অরিন্দমের ভেতরে এক ভয়ংকর উপলব্ধি জন্ম নেয়—এ খুনি আর স্রেফ মানুষ নেই, বরং সে নিজের তৈরি মুখোশের ভেতর ডুবে গিয়ে নিজেকে “ছায়া” বলে বিশ্বাস করতে শুরু করেছে। তার হাঁটা, দৌড়, এমনকি শ্বাস নেওয়ার ভঙ্গিতেও যেন মানুষের ছায়ার বিকৃত প্রতিফলন। শহরের ভীত-সন্ত্রস্ত মানুষরা তাকে আত্মা বা শয়তান ভাবলেও, প্রকৃত সত্য হলো অমিতাভ ধীরে ধীরে নিজের অস্তিত্বের ভেতরেই বন্দী হয়ে পড়েছে। এক সময়কার বিজ্ঞান আর যুক্তিবাদ এখন তার কাছে কেবল ভয় সৃষ্টি করার হাতিয়ার। ঈশা তার চোখে সেই অদ্ভুত শূন্যতা দেখতে পায়—এক গভীর অন্ধকার, যেখানে আর মানুষের কোনো স্বপ্ন বা বেদনা নেই, কেবল এক অবসন্ন প্রতিশোধের ক্ষুধা। অরিন্দম জানে, যদি দ্রুত তাকে থামানো না যায়, তবে এই “ছায়া” শহরের কিংবদন্তি থেকে বাস্তব দুঃস্বপ্নে রূপ নেবে। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়—কোনো মানুষ যখন নিজের মুখোশের আড়ালে দানবে পরিণত হয়, তখন কি তাকে শুধরে আনা সম্ভব, নাকি শেষ পর্যন্ত তাকে নিঃশেষ করা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না? এই দ্বন্দ্ব নিয়েই শুরু হয় শেষ লড়াইয়ের পূর্বাভাস।

রাতের শহর নেমে এসেছে অদ্ভুত এক নিরবতায়। বাতাসে টানটান উত্তেজনা, আর প্রতিটি গলি-ঘুপচিতে যেন লুকিয়ে আছে অদৃশ্য চোখ। অরিন্দম আর ঈশা অনেক দিনের ক্লান্তি, ভীতি আর সন্দেহ নিয়ে প্রস্তুত হয়েছে শেষ লড়াইয়ের জন্য। পুলিশের সহযোগিতা সীমিত, কারণ কারও পক্ষে বিশ্বাস করা কঠিন যে খুনি আসলেই “ছায়া” হয়ে শহরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তবুও অরিন্দম জানে, এবার ফাঁদ পাততেই হবে—কারণ প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের পর খুনি আরও শক্তিশালী হয়ে উঠছে। তারা পুরনো কারাগারের ভগ্নপ্রায় অংশে লুকিয়ে থাকে, যেখানে প্রথম গবেষকের মৃত্যু হয়েছিল। ভৌতিক আলো-ছায়ার খেলা, ভাঙা জানালা দিয়ে ভেতরে আসা চাঁদের আলো আর অন্ধকার মিলেমিশে জায়গাটাকে আরও রহস্যময় করে তোলে। ঈশা চারদিকে ক্যামেরা আর লুকোনো সেন্সর বসিয়েছে, আর অরিন্দম গোপনে আগ্নেয়াস্ত্র আর দড়ির ফাঁদ তৈরি করেছে। মুহূর্তগুলো কাটছিল যন্ত্রণার মতো ধীরগতিতে, যতক্ষণ না হঠাৎ শীতল বাতাসের ঝাপটা আর এক অদ্ভুত শব্দ শোনা গেল—ছায়া ফিরে এসেছে।

আলোর প্রতিফলন ভেঙে-চুরে তার শরীরকে আরও অদ্ভুত করে তুলেছে। প্রথমে মনে হয় যেন দেয়ালের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে, আবার পরক্ষণেই দেখা যায় মানুষের মতো এক অদ্ভুত অবয়ব। তার চোখে সেই ভয়ংকর শূন্যতা—যেন জীবনের সবটুকু হারিয়ে গেছে, শুধু প্রতিশোধ আর অন্ধকারই বাকি আছে। ঈশা চমকে ওঠে, কিন্তু অরিন্দম স্থির থাকে। সে জানে, আতঙ্কের মুহূর্তে ভয় দেখিয়েই এই খুনি তার আধিপত্য বিস্তার করেছে। এবার ভয়কে ভাঙতে হবে। খুনি ভয়ানক শক্তি নিয়ে আক্রমণ করে—তার শরীরের চলাফেরা এত দ্রুত, এত অস্বাভাবিক যে মনে হয় বাস্তব আর অলীকতা মিশে গেছে। ঈশা অল্পের জন্য বেঁচে যায়, কিন্তু তার ক্যামেরাগুলো অন্ধকারে খুনির প্রতিটি পদক্ষেপ ধরে রাখতে শুরু করে। অরিন্দম তীব্র লড়াইয়ে নামে, তার প্রতিটি আঘাত যেন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই। দড়ির ফাঁদ একসময় খুনির পা আটকে ফেলে, আর আলোতে ধরা পড়ে যায় তার মুখোশ—এক প্রাক্তন ফরেনসিক কর্মী, যে বহু বছর আগের অন্যায়ের বোঝা নিয়ে “ছায়া” হয়ে উঠেছে। কিন্তু লড়াই তখনও শেষ হয়নি, কারণ সেই মুহূর্তে খুনি যেন অতিপ্রাকৃত শক্তি নিয়ে আরও ভয়ংকর হয়ে ওঠে, নিজের ভাঙা মানসিকতার সঙ্গে মিশে অর্ধেক মানুষ, অর্ধেক দানবে পরিণত হয়।

শেষে প্রচণ্ড সংঘর্ষ আর লড়াইয়ের পর অরিন্দম আর ঈশা মিলে তাকে বশে আনে। পুলিশের দল এসে পৌঁছায়, আর তাকে গ্রেফতার করা হয়। কিন্তু মৃত্যুর আগে খুনি এক অদ্ভুত হাসি হেসে বলে যায়, “তোমরা ভাবছো ছায়া শেষ? আমি একা নই… আরও ছায়া আছে।” তার কণ্ঠে অদ্ভুত ঠাণ্ডা শীতলতা, যেন সেই কথার মধ্যে কোনো অজানা সত্যি লুকিয়ে আছে। তার দেহ মাটিতে নিথর হয়ে পড়লেও শহরের বাতাসে ভেসে বেড়াতে থাকে সেই কথার প্রতিধ্বনি। ঈশা ভয়ে আর অস্বস্তিতে অরিন্দমের দিকে তাকায়, আর অরিন্দম চুপচাপ জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকে। দূরে অন্ধকারে হঠাৎ হাওয়ার সঙ্গে নড়েচড়ে ওঠে কোনো এক গলির ছায়া—কেউ বলে সেটা কেবল বাতাসের খেলা, আবার কেউ ভাবে ছায়ারা এখনও বেঁচে আছে। শহর আবারও যেন অদৃশ্য আতঙ্কে ঢেকে যায়, গল্প শেষ হয় খোলা প্রান্তে, যেখানে আলো আর অন্ধকারের লড়াই অনন্তকাল ধরে চলতেই থাকে।

1000060005.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *