স্পন্দন ভট্টাচাৰ্য
অধ্যায় ১:
শহরের প্রান্তে বা কোনো গ্রামীণ মেলায় উৎসবের সেই দিনটা ছিল একেবারেই আলাদা। চারপাশ যেন আলো, রঙ আর সুরের মিশেলে এক অনন্য আবহ তৈরি করেছিল। রাস্তার দু’পাশে সাজানো হয়েছিল সারি সারি আলপনা, আকাশ ভরে উঠেছিল রঙিন কাগজের ঝালর আর লণ্ঠনের আলোয়। মানুষের ভিড় ক্রমশ বাড়ছিল—কেউ দোকান ঘুরছে, কেউ প্যান্ডেলে ঢুকে ঠাকুর দেখছে, কেউ আবার হইচই করে রঙিন মেলায় হারিয়ে যাচ্ছে। অয়ন, সদ্য গ্র্যাজুয়েট হয়ে ওঠা এক তরুণ, সেই ভিড়ের মধ্যেই হাঁটছিল। উৎসব তার কাছে শুধু আনন্দের উপলক্ষ নয়, বরং একটু নিঃশ্বাস নেওয়ার মুহূর্ত। চাকরি খোঁজার চাপ, শহরের প্রতিযোগিতার হাহাকার, আর সংসারের নানান জটিলতা থেকে সামান্য মুক্তি খুঁজতে সে এসেছিল এ উৎসবে। ভিড়ের মাঝে তার চোখ হঠাৎই থেমে গেল—একটি মেয়েকে দেখল সে। মেয়েটি পরেছিল হালকা হলুদ রঙের সালোয়ার, যার গলায় সূচিকর্ম করা নকশা উৎসবের আলোর মতো ঝলমল করছিল। মেয়েটির হাসি ছিল অদ্ভুত প্রাণবন্ত, যেন আশেপাশের কোলাহল থামিয়ে দিতে পারে। অয়ন বুঝল না কেন, কিন্তু চোখের দৃষ্টি এক মুহূর্তে আটকে গেল তার উপরেই।
মায়া, মেয়েটির নাম, আসলে এসেছিল তার একদল বান্ধবীর সঙ্গে। উৎসব মানে তার কাছে মুক্তি, আনন্দ, আর চারপাশের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যাওয়া। ছোট ছোট স্টল ঘোরা, মিষ্টির দোকান থেকে রসগোল্লা চেখে দেখা, কিংবা বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে হইচই—এসবই তার প্রিয়। তবে ভিড়ের ভেতরে সে যেমন স্বাভাবিক ছিল, তেমনই তার চোখও একসময় আটকে গেল—অযাচিতভাবে অয়নের উপর। প্রথমে একধরনের কৌতূহল, তারপর যেন এক অদ্ভুত চিন্তার আভাস। অয়নের চোখে একধরনের সহজ সরলতা ছিল, যা শহুরে অনেক যুবকের চোখে দেখা যায় না। অয়ন ভিড়ের মাঝে মায়ার দিকে তাকিয়েছিল, আর মায়াও সেটা টের পেয়েছিল। তাদের চোখের সংযোগটা বেশি লম্বা হয়নি, তবুও অদ্ভুত এক শিহরণ তৈরি করেছিল দুজনের ভেতরে। কিছুক্ষণের জন্য আশেপাশের সব শব্দ, কোলাহল, আলো—সবকিছু যেন হারিয়ে গিয়েছিল, কেবল সেই দৃষ্টি বিনিময়ের মুহূর্তটাই বেঁচে ছিল।
ভিড়ের ঠেলায় একসময় তারা আরও কাছে চলে এলো। একটি ছোট্ট খেলনার স্টলের সামনে, যেখানে রঙিন বেলুনে ভরে উঠেছিল চারপাশ, সেখানেই তাদের কথোপকথনের শুরু। প্রথমে কিছু সাধারণ বাক্য—“এটা কি দাম?” “খুব ভিড় হচ্ছে না?”—এইসব সামান্য বিষয় নিয়ে। তবে কথার স্রোত ধীরে ধীরে সহজ হয়ে গেল। দুজনেই হাসছিল, যেন বহুদিনের পরিচিত বন্ধু। মায়ার হাসি আর অয়নের মজার মন্তব্য পরিবেশটাকে আরও হালকা করে তুলল। উৎসবের কোলাহল তাদের আলাপচারিতাকে আড়াল করেনি; বরং সেই আবহেই তাদের বন্ধুত্বের সূচনা হল। দুজনেই মনে মনে টের পেল—এই অচেনা ভিড়ের মাঝে, রঙিন উৎসবের আবেশে, এক অচেনা মানুষ হঠাৎই কাছে এসে গেল। সেই মুহূর্তে হয়তো তারা জানত না ভবিষ্যতে কী হবে, কিন্তু বুঝেছিল—এই দেখা কেবল এক দিনের জন্য নয়, বরং কোনো গল্পের শুরু।
অধ্যায় ২:
উৎসবের দ্বিতীয় দিন সকাল থেকেই শহরের গলি ও মাঠ ভরে উঠেছিল মানুষের ভিড়ে। চারপাশে বাজছিল ঢাক, কাঁসর আর মাইকের তীব্র সুর। মেলা প্রাঙ্গণের একপাশে সাজানো হয়েছিল হস্তশিল্পের স্টল, অন্যপাশে মিষ্টি আর ঝালমুড়ির দোকান। বাচ্চারা ঘুরছিল নাগরদোলায়, তরুণরা অংশ নিচ্ছিল বিভিন্ন প্রতিযোগিতায়। অয়ন সেদিন বন্ধুরা সঙ্গে নিয়ে ঘুরছিল—তবে ভিড়ের মাঝেও তার মনে হচ্ছিল মায়ার হাসি যেন এখনও কানে বাজছে। সেই আগের দিনের হঠাৎ দেখা, ছোট কথোপকথন আর অদ্ভুত দৃষ্টি বিনিময়, সব যেন অয়নের ভেতরে নতুন কৌতূহল জাগিয়ে তুলেছিল। মায়া এদিকে তার বান্ধবীদের সঙ্গে বসেছিল মঞ্চের সামনে, যেখানে নাচ ও গান চলছিল। উজ্জ্বল রঙের আলোর নিচে মেয়েটির মুখে খেলে যাচ্ছিল আনন্দ আর উচ্ছ্বাস। দুজনেই জানত না তারা আবার দেখা করবে কিনা, কিন্তু উৎসবের ভিড় যেন তাদের অদৃশ্যভাবে একে অপরের দিকে টেনে নিচ্ছিল।
সন্ধ্যার দিকে একে অপরের সঙ্গে আবার দেখা হয়ে গেল। গ্রাউন্ডে চলছিল লোকনৃত্য প্রতিযোগিতা—যেখানে স্থানীয় ছেলেমেয়েরা দল বেঁধে নাচছিল। অয়ন মজা করে ভিড়ের পাশে দাঁড়িয়ে হাততালি দিচ্ছিল, আর মায়া তার বান্ধবীদের সঙ্গে মেতে উঠেছিল একই ভিড়ে। হঠাৎ এক মুহূর্তে দুজনের চোখ আবার মিলল। এবার আর অচেনা ভিড় নয়, বরং একধরনের চেনা টান কাজ করল। মায়া এগিয়ে গিয়ে বলল—“আপনি আবার এখানে!” অয়ন হেসে জবাব দিল—“হ্যাঁ, উৎসব যে শেষ হচ্ছে না, আমিও তাই ফিরে আসলাম।” কথার ভঙ্গি এতটাই স্বাভাবিক ছিল যে দুজনেই হেসে ফেলল। ভিড়ের মাঝে, বাজনার আওয়াজে, নাচের উন্মাদনায় তাদের আলাপ জমে উঠল। তারা বলছিল কোন গান পছন্দ, কোন স্টল মজার, কার নাচ ভালো লাগল। সাধারণ এই আলাপচারিতা তাদের সম্পর্কের ভেতর অদ্ভুত এক স্বস্তি এনে দিল, যেন তারা হঠাৎ করেই পরিচিত হয়ে উঠেছে।
কিছুক্ষণ পর তারা ভিড় থেকে সরে গিয়ে মেলার এক কোণে বসে পড়ল—যেখানে ছিল ঝালমুড়ি আর চায়ের দোকান। কাগজের ঠোঙায় ভাগাভাগি করে খেতে খেতে আলাপ এগোতে লাগল। মায়া বলল সে ছোটবেলা থেকেই এই উৎসবে আসে, প্রতিটি বছর তার কাছে নতুন লাগে। অয়ন বলল সে অনেকদিন পর এসেছে, কারণ কাজের চাপে আগের মতো সময় পায়নি। তাদের কথোপকথনের মধ্যে দিয়ে ধীরে ধীরে প্রকাশ পেল দুজনের স্বভাব—অয়ন একটু শান্ত, ভেবে কথা বলে; মায়া প্রাণবন্ত, মুহূর্তকে জড়িয়ে ধরতে ভালোবাসে। একসময় হালকা মজার ছলে তারা একে অপরের পছন্দের খাবার, গান, এমনকি রঙ সম্পর্কেও জানতে লাগল। মায়া অবাক হয়ে দেখল, তার মতো অয়নও লাল রঙ ভালোবাসে, আর অয়ন অবাক হয়ে বুঝল, মায়া তার মতোই মিষ্টির চেয়ে ঝাল খাবার বেশি পছন্দ করে। সেই মুহূর্তে মনে হল, এ যেন কেবল কাকতাল নয়, বরং এক অদৃশ্য মিলনবিন্দু। বন্ধুত্বের বীজ তখনই মাটিতে পড়েছিল, উৎসবের হাসি, আলো আর ভিড়ের মাঝেই তাদের সম্পর্ক নতুন রূপ নিতে শুরু করল।
অধ্যায় ৩:
উৎসবের ভিড় দিন দিন যেন আরও জমজমাট হয়ে উঠছিল, আর সেই ভিড়ের মাঝেই অয়ন আর মায়ার বন্ধুত্বও অদ্ভুতভাবে গভীর হতে লাগল। প্রথম দিনের হালকা আলাপ, দ্বিতীয় দিনের মেলার আড্ডা—সব মিলিয়ে তারা একে অপরের সান্নিধ্যে অভ্যস্ত হয়ে উঠছিল। তবে এই অভ্যস্ততা যেন শুধু বন্ধুত্বের সীমায় আটকে থাকছিল না, তার ভেতরে এক অচেনা আবেগের রঙ ঢুকে যাচ্ছিল। ভিড়ের মধ্যে হেঁটে যাওয়ার সময় মায়া যখন হঠাৎ অয়নের জামার হাতা টেনে ধরে বলল—“সাবধানে হাঁটুন, না হলে ঠেলাঠেলিতে পড়ে যাবেন”—তখন সেই হালকা স্পর্শ অয়নের শরীরে এক অদ্ভুত কাঁপুনি নামিয়ে দিল। আবার অন্যদিকে, মঞ্চে কারও গান শোনার সময় অয়নের চুপচাপ মগ্ন হয়ে থাকা, কিংবা মাঝেমধ্যে তার অন্যমনস্ক হাসি দেখে মায়ার মনে হচ্ছিল—এই মানুষটা সত্যিই আলাদা। তাদের দৃষ্টি বারবার একে অপরের দিকে ফিরছিল, হয়তো অযাচিতভাবে, কিন্তু প্রত্যেকবারই যেন নতুন করে কিছু বলছিল।
এক সন্ধ্যায়, পূর্ণ আলোকসজ্জার মধ্যে, প্যান্ডেলের সামনে অয়ন আর মায়া একসঙ্গে দাঁড়িয়েছিল। ভিড়ের উচ্ছ্বাসে তারা মাঝে মাঝে একে অপরের গায়ে হেলান দিচ্ছিল, যদিও সেটা নিছকই ভিড় ঠেলাঠেলির জন্য, কিন্তু ভেতরে ভেতরে দুজনেই অনুভব করছিল—এই স্পর্শ যেন কোনো অচেনা জাদু তৈরি করছে। মায়ার চোখে তখন উজ্জ্বল দীপ্তি, সে মজা করে বলছিল—“আপনি খুব সিরিয়াস, সবকিছু এত ভেবে করেন কেন?” অয়ন হেসে বলেছিল—“কারণ হয়তো আমি সহজে কাউকে আমার ভেতরে ঢুকতে দিই না।” মায়া তার কথার মধ্যে কিছু একটা ভিন্নতা টের পেল। অয়নকে শুধু উৎসবের সঙ্গী মনে হচ্ছিল না, বরং তার ভেতরে এক রহস্যময় গভীরতা দেখা দিচ্ছিল। অয়নের দিক থেকেও একই অনুভূতি কাজ করছিল—মায়ার চঞ্চলতা, তার প্রাণবন্ত হাসি, আর প্রতিটি মুহূর্তকে আপন করে নেওয়ার ভঙ্গি অয়নকে এমনভাবে আকর্ষণ করছিল যে, সে বুঝে উঠতে পারছিল না এটা কেবল বন্ধুত্ব নাকি অন্য কিছু।
মেলার শেষ রাতে তারা একসঙ্গে প্যান্ডেলের বাইরে দাঁড়িয়ে আতশবাজির খেলা দেখছিল। আকাশজুড়ে রঙিন আলো ফুটে উঠছিল, আর সেই আলোয় একে অপরের মুখ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। মায়া হঠাৎ নিঃশব্দে অয়নের দিকে তাকাল, অয়নও তাকাল মায়ার দিকে—দুজনের চোখে তখন কোনো কথা ছিল না, তবু সব কিছু বলা হয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ মায়ার হাত অয়নের হাতে ছুঁয়ে গেল—কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই, নিছকই স্বাভাবিকতার ছলে—কিন্তু সেই ছোট্ট ছোঁয়াতেই যেন এক অনিবার্য টান স্পষ্ট হয়ে উঠল। মায়া চোখ ফিরিয়ে নিলেও তার ঠোঁটে লাজুক হাসি খেলে গেল, আর অয়ন মনে মনে অনুভব করল—এই সম্পর্ক আর শুধু চেনা বন্ধুত্ব নয়, বরং এক অচেনা আবেগের দিকে এগোচ্ছে। উৎসবের ভিড়, আলো আর সুরের মাঝেই তাদের সম্পর্কের ভেতর ঢুকে পড়েছিল নতুন এক অনুভূতির বীজ, যা তারা কেউই অস্বীকার করতে পারছিল না।
অধ্যায় ৪:
উৎসবের শেষ রাতটা যেন চারপাশকে একেবারে অন্যরকম করে তুলেছিল। আকাশজুড়ে ঝলমলে আলো, চারদিকে বাজছিল ঢাকের তালে তালে গান, আর ভিড়ের উচ্ছ্বাসে মেলা মাঠ ভরে উঠেছিল প্রাণচাঞ্চল্যে। কোথাও নাগরদোলা ঘুরছে, কোথাও শিশুদের হাসির কোলাহল, কোথাও আবার আলোকসজ্জার ঝলকানি মঞ্চের দিকে সবাইকে টেনে নিচ্ছে। অয়ন আর মায়া ভিড়ের মাঝেই হাঁটছিল পাশাপাশি। তাদের মধ্যে আগের দিনের সেই অচেনা দ্বিধা যেন অনেকটা কমে গিয়েছিল। কথা বলার ভঙ্গি আরও স্বাভাবিক হয়ে উঠছিল, মাঝে মাঝে তারা একে অপরকে খোঁচা মারছিল, আবার কখনো নিছক নীরব থেকেও শুধু চারপাশ উপভোগ করছিল। মেলার কোলাহলের মাঝেই তাদের বন্ধুত্ব যেন অন্য এক স্তরে পৌঁছেছিল। অয়ন যখন মাঝে মাঝে মায়ার দিকে তাকাত, তখন আলোর ঝলকানিতে মেয়েটির মুখে এক অদ্ভুত দীপ্তি ফুটে উঠছিল, যা তাকে বিভোর করে তুলছিল। আর মায়া বুঝতে পারছিল, অয়ন যতই চুপচাপ থাকুক, তার ভেতরের আবেগ চোখের ভাষায় স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মেলা মাঠে ভিড় কমে এলো। মানুষ ধীরে ধীরে বাড়ি ফিরছিল, তবে মূল মঞ্চের সামনে তখনও গান আর নাচ চলছিল। অয়ন আর মায়া ভিড় এড়িয়ে একপাশে দাঁড়িয়ে পড়ল। দুজনেই যেন নিঃশব্দে কিছু বলতে চাইছিল, কিন্তু শব্দে তা প্রকাশ করতে পারছিল না। উৎসবের সুরের সঙ্গে যেন তাদের ভেতরের নীরব আবেগও বেজে উঠছিল। মায়া হালকা করে বলল—“এত আলো, এত শব্দ, অথচ আমার মনে হচ্ছে আমরা যেন একেবারে আলাদা জগতে আছি।” অয়ন মৃদু হেসে বলল—“হয়তো সত্যিই তাই।” তাদের চোখ আবার একে অপরের দিকে আটকে গেল। সেই মুহূর্তে মেলার চারপাশের সবকিছু যেন দূরে সরে গেল, শুধু রয়ে গেল দুজনের নিঃশব্দ আকর্ষণ। মায়ার হাত তখন তার ওড়নার কোণা সামলাচ্ছিল, অয়ন একটু দ্বিধা করেও তার হাত ধরল। প্রথমে যেন অপ্রস্তুত নীরবতা, তারপর মায়ার ঠোঁটে হালকা হাসি ফুটে উঠল। সেই ছোট্ট স্পর্শই ছিল প্রাথমিক সেতু, যেখানে তাদের সম্পর্ক আর শুধু কথায় সীমাবদ্ধ থাকল না।
মধ্যরাতে আতশবাজি শুরু হল। আকাশজুড়ে রঙিন আগুনের ফুলকি ছড়িয়ে পড়ল, মঞ্চ থেকে ভেসে আসছিল সুরেলা গান, আর মেলা মাঠে আলো-আঁধারির খেলায় দুজনের মুখ আরও কাছে এসে গেল। অয়ন মায়ার হাত শক্ত করে ধরে রাখল, আর মায়া কোনো প্রতিবাদ করল না। বরং তার চোখে তখন একধরনের স্বীকৃতি জ্বলছিল, যেন সেই মুহূর্তের প্রতিটি স্পর্শকে সে নিজের মতো করে গ্রহণ করছে। তাদের শরীর একে অপরের কাছে এগিয়ে এল—কোনো জোরাজুরি নয়, বরং এক অদৃশ্য আকর্ষণে। একে অপরের গায়ে হেলান দেওয়া, আঙুলের ফাঁকে আঙুল মিশিয়ে রাখা—এই ছোট ছোট অঙ্গভঙ্গিই যেন নীরব ভাষায় তাদের আবেগ প্রকাশ করে দিচ্ছিল। উৎসবের রাত, তার রঙিন আলো আর নাচগানের আবেশ, তাদের দুজনকেই এমন এক অনুভূতির ভেতর ডুবিয়ে দিল যেখানে বন্ধুত্ব ধীরে ধীরে গাঢ় হয়ে প্রেমের ছোঁয়া নিতে শুরু করল। সেই রাতটিই ছিল তাদের সম্পর্কের নতুন বাঁক—একটা নীরব প্রতিশ্রুতি, যা শব্দে বলা সম্ভব নয়, শুধু অনুভবে টের পাওয়া যায়।
অধ্যায় ৫:
উৎসবের দিনগুলো শেষ হতে হতে অয়ন আর মায়ার ভেতরে যে আবেগ জন্ম নিচ্ছিল, তা স্পষ্ট হয়ে উঠতে লাগল। তারা দুজনেই একে অপরের কাছে থাকতে চাচ্ছিল, অথচ সেই ইচ্ছেটি প্রকাশ করতে গিয়ে এক ধরনের দ্বিধাও তাদের গ্রাস করছিল। বন্ধুত্বের ছায়া যে এখন রঙ বদলে অন্য কিছুর দিকে এগোচ্ছে, তা দুজনেই বুঝতে পারছিল, কিন্তু শব্দে বলার সাহস পাচ্ছিল না। অয়ন মাঝে মাঝে ভাবত, এই টান কি কেবল মুহূর্তের আবেগ, নাকি সত্যিই দীর্ঘস্থায়ী হবে? অন্যদিকে মায়ার মনেও প্রশ্ন জন্মাচ্ছিল—এ সম্পর্কের গভীরতা কতদূর যেতে পারে? তবু যখন তারা একসঙ্গে থাকত, তখন এসব দ্বিধা ভেসে যেত, কারণ তাদের দৃষ্টি, তাদের হাসি, আর ছোট ছোট অঙ্গভঙ্গিই যেন সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিচ্ছিল। ভিড়ের মধ্যে মায়া অচেনা ভাবে অয়নের বাহু ধরে ফেলত, কিংবা অয়ন কথার মাঝেই মায়ার চোখের দিকে তাকিয়ে থমকে যেত—এইসব ছোট্ট মুহূর্তই প্রমাণ করছিল যে আকর্ষণ দিন দিন গভীর হচ্ছে।
একদিন বিকেলে তারা মেলার বাইরে একটু নিরিবিলি মাঠে বসেছিল। চারপাশে তখন হালকা বাতাস বইছিল, দূরে শোনা যাচ্ছিল ঢাক-ঢোলের শব্দ। দুজনেই চুপচাপ বসে ছিল, যেন কেউ কিছু বলার জন্য সঠিক শব্দ খুঁজছে। মায়া হঠাৎ বলল—“আমার মনে হচ্ছে এই উৎসবটা এবার অন্যরকম।” অয়ন একটু থেমে জিজ্ঞেস করল—“কেন বলো তো?” মায়া হেসে উত্তর দিল—“কারণ এবারের উৎসবে আমি শুধু গান-নাচ-আনন্দ পাইনি, পেয়েছি একজন সঙ্গীও।” অয়ন মৃদু হেসে নিলেও তার চোখে তখন একরাশ অনিশ্চয়তা ভাসছিল। সে ভেবেছিল, হয়তো এই সম্পর্কটা কেবল উৎসবের সময়ের জন্যই থাকবে, কিন্তু মায়ার কথায় যেন নতুন এক প্রত্যাশা জন্ম নিল। তাদের মধ্যে আকর্ষণ এতটাই স্বাভাবিক হয়ে উঠেছিল যে, নীরবতার ভেতরও তারা একে অপরকে বুঝতে পারছিল। মায়া হালকা করে তার চুল কানের পেছনে সরিয়ে নিল, আর অয়ন অজান্তেই তার হাতের দিকে তাকিয়ে রইল। সে মুহূর্তে শব্দের চেয়ে অনেক বেশি কথা বলছিল তাদের দৃষ্টি।
কিন্তু আকর্ষণের সঙ্গে সঙ্গে দ্বিধাও চলছিল সমান তালে। তারা দুজনেই জানত, সম্পর্কের এই নতুন ধাপ সহজ নয়। সমাজ, পরিবার, এমনকি নিজেদের ভেতরের ভয়—সবকিছুই মাঝে মাঝে বাঁধা হয়ে দাঁড়াচ্ছিল। অয়ন ভাবছিল, সে কি খুব দ্রুত এই অনুভূতিকে গ্রহণ করছে? মায়াও দ্বিধায় ভুগছিল, কারণ তার মনে হচ্ছিল অয়নের মতো শান্ত, ভদ্র একজন মানুষকে কি সে সত্যিই তার আবেগ দিয়ে বোঝাতে পারবে? তবে এসব জটিলতা সত্ত্বেও তারা একে অপরের দিকে টান অনুভব করছিল—যা স্বাভাবিক, সংবেদনশীল এবং মানবিক। মেলার মাঠে আবার যখন ভিড়ের মধ্যে হাত ছুঁয়ে গেল, তখন তারা আর হাত সরিয়ে নিল না। বরং সেই স্পর্শকে তারা স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করল, যেন এটা ঠিকই হওয়া উচিত। তাদের হাসি, দৃষ্টি আর নীরবতার মাঝেই তৈরি হচ্ছিল নতুন এক বোঝাপড়া—আবেগ আর আকর্ষণকে অস্বীকার না করে বরং ধীরে ধীরে তাকে আপন করে নেওয়ার বোঝাপড়া। দ্বিধা ছিল, কিন্তু সেই দ্বিধার ভেতর দিয়েই তারা শিখছিল কিভাবে সম্পর্ককে প্রাকৃতিকভাবে বেড়ে উঠতে দেওয়া যায়।
অধ্যায় ৬:
উৎসবের শেষ প্রান্তে এসে অয়ন আর মায়ার সম্পর্ক যেন নতুন মাত্রা পেল। প্রথম কয়েকদিনের হালকা আলাপ আর দ্বিধাগ্রস্ত দৃষ্টির জায়গায় এখন তৈরি হয়েছে গভীর বোঝাপড়া। তারা একে অপরের জীবনের ছোট ছোট গল্প ভাগ করতে শুরু করল—শৈশবের মজার ঘটনা, পরিবারের অভ্যাস, এমনকি কিছু কষ্টের স্মৃতিও। অয়ন মায়াকে বলল কিভাবে সে ছোটবেলায় একা একা মাঠে ঘুরত, আর কেবল বইয়ের ভেতরেই খুঁজত তার আনন্দ। মায়া হেসে বলল, তার জীবনে কখনো একা থাকার সুযোগ হয়নি, কারণ বন্ধু আর আত্মীয়দের ভিড়ে সে সবসময়ই ঘেরা ছিল। ভিন্ন ভিন্ন অভিজ্ঞতার ভেতর থেকেও তারা একে অপরের ভেতর মিল খুঁজে পেল। মনে হলো, যেসব জায়গায় একজন অপূর্ণ, অন্যজন সেখানে পূর্ণতা আনে। এই ভাগাভাগি আর আন্তরিকতার ভেতরেই তাদের বন্ধুত্ব গভীর থেকে গভীরতর হতে লাগল।
এক সন্ধ্যায় তারা মেলার ভিড় এড়িয়ে পাশের নদীর ধারে চলে গেল। আকাশে তখন অর্ধচন্দ্র, জলে প্রতিফলিত হচ্ছিল আলো, আর দূরে ভেসে আসছিল ঢাক-ঢোলের শব্দ। সেই নিরিবিলি পরিবেশে তাদের কথোপকথন আরও খোলামেলা হয়ে উঠল। মায়া বলল—“তোমার সঙ্গে কথা বললেই মনে হয় আমি যেন অনেকটা হালকা হয়ে যাচ্ছি।” অয়ন ধীরে উত্তর দিল—“আমারও তাই মনে হয়। হয়তো এ কারণেই তোমাকে এত কাছে টানছে।” দুজনের চোখ একে অপরের দিকে নিবদ্ধ হল, আর সেই দৃষ্টির ভেতর এমন কিছু ছিল যা কোনো শব্দে প্রকাশ করা যায় না। অয়ন তার হাত বাড়িয়ে মায়ার আঙুল ছুঁয়ে দিল, মায়া এক মুহূর্ত চমকে উঠলেও হাত সরাল না। বরং সেই ছোঁয়াকে যেন স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করল। তারা দীর্ঘ সময় হাত ধরে বসে রইল, কিছু বলল না, কিন্তু নীরবতার ভেতরেই চলল হাজারো কথোপকথন। এই মুহূর্তে তাদের শারীরিক সংযোগ কোনো জোরপূর্বক ছিল না, বরং একে অপরকে স্বস্তি দেওয়ার, নিজের ভেতরের আবেগ ভাগ করে নেওয়ার এক প্রাকৃতিক মাধ্যম হয়ে উঠেছিল।
এরপর থেকে তাদের আচরণেও এক ধরনের সহজাত ঘনিষ্ঠতা দেখা দিতে লাগল। ভিড়ের মধ্যে চলার সময় মায়া অয়নের হাতে ভর করে হাঁটত, আর অয়নও অবচেতনভাবে তাকে আগলে রাখত। একসঙ্গে হাসি-মজা, আবার হঠাৎ করে নীরব হয়ে যাওয়া—সবকিছুর ভেতরেই এক অদ্ভুত বোঝাপড়া তৈরি হচ্ছিল। তারা জানত, সম্পর্কের এই ধাপ আর শুধুমাত্র বন্ধুত্বের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এখন একে অপরের স্পর্শ, দৃষ্টি, এমনকি নিঃশ্বাসও তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। তবে এই গভীর সংযোগ কোনো তাড়াহুড়ো করে আসেনি, বরং সময়ের সঙ্গে, বিশ্বাসের ভেতর দিয়ে, আর আবেগের স্বাভাবিক প্রবাহেই তৈরি হয়েছে। অয়ন আর মায়া দুজনেই অনুভব করছিল—এই সংযোগই তাদের সম্পর্ককে আরও দৃঢ়, আরও আন্তরিক করে তুলছে। উৎসবের দিনগুলো হয়তো শেষ হয়ে আসছে, কিন্তু তাদের ভেতরে জন্ম নেওয়া এই সম্পর্ক যেন এক নতুন সূচনার ইঙ্গিত দিচ্ছিল।
অধ্যায় ৭:
উৎসবের আনন্দে দিনগুলো একের পর এক গড়িয়ে যাচ্ছিল, আর সেইসঙ্গে অয়ন ও মায়ার সম্পর্কও ক্রমশ গভীর হয়ে উঠছিল। তবে যতটা তারা কাছে আসছিল, ঠিক ততটাই ভেতরে ভেতরে এক ধরনের দ্বিধা তাদের পেয়ে বসছিল। মায়া কখনো অনুভব করত, অয়ন তার দিকে এমনভাবে তাকাচ্ছে যেন সমস্ত ভিড়ের মাঝেও সে শুধু তার অস্তিত্বই খুঁজে পাচ্ছে। এই দৃষ্টি তাকে একদিকে আকর্ষিত করত, অন্যদিকে অস্থিরও করে তুলত। অয়নও বুঝতে পারছিল, তাদের সম্পর্ক এখন বন্ধুত্বের গণ্ডি ছাড়িয়ে অনেক দূরে চলে এসেছে, কিন্তু সেই নতুন জায়গাটির দায়িত্ব কতটা সে নিতে পারবে, তা নিয়ে দ্বিধায় ভুগছিল। ভিড়ের মাঝে দাঁড়িয়ে হাত ধরার সাহস তারা পাচ্ছিল, কিন্তু একইসঙ্গে মনে হচ্ছিল, এ স্পর্শের সীমারেখা কোথায় টানা উচিত। এভাবেই আনন্দের মাঝেই তাদের ভেতরে টানাপোড়েন শুরু হলো—একদিকে আকর্ষণ, অন্যদিকে সেই আকর্ষণের দায়ভার।
এক রাতে মেলার ভিড় কিছুটা পাতলা হলে তারা দুজন একসঙ্গে হেঁটে যাচ্ছিল। আলো-আঁধারির খেলায় অয়ন হঠাৎ করে মায়ার হাত ধরে ফেলল। মুহূর্তের জন্য মায়া অবাক হলেও সে হাত ছাড়াল না। কিন্তু পরক্ষণেই তার ভেতরে দ্বিধা কাজ করল। মনে হলো, তারা কি খুব দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে? সে হালকা গলায় বলল—“অয়ন, আমাদের একটু ভেবে এগোনো উচিত, তাই না?” অয়ন থমকে দাঁড়াল। তার মনে হচ্ছিল, মায়া তাকে প্রত্যাখ্যান করছে। কিন্তু মায়া চোখের দিকে তাকিয়ে বলল—“আমি তোমার কাছ থেকে দূরে যেতে চাই না, তবে আমরা যেন একে অপরকে বোঝার আগেই তাড়াহুড়ো না করি।” এই কথার মধ্যে লুকিয়ে ছিল এক ধরনের আশ্বাসও—সে অয়নকে চাইছে, কিন্তু ধৈর্যের সঙ্গে চাইছে। অয়ন ধীরে মাথা নেড়ে সম্মতি দিল। তবে ভেতরে ভেতরে তারও একটা অস্থিরতা জন্ম নিল। আকর্ষণকে নিয়ন্ত্রণ করা সহজ নয়, বিশেষত যখন তারা একে অপরের এতটা কাছে।
এরপর থেকে তাদের আচরণে সূক্ষ্ম পরিবর্তন দেখা দিল। আগের মতো অবাধে হাত ধরা বা কাছে আসা যেন একটু সীমাবদ্ধ হয়ে গেল। তারা দুজনেই একে অপরের চোখে দ্বিধা দেখতে পাচ্ছিল, কিন্তু সেই দ্বিধার ভেতরেও আকর্ষণের ঝিলিক লুকানো ছিল না। মাঝে মাঝে নীরবতার ভেতর তারা বুঝতে পারত, ভেতরে ভেতরে দুজনের মনই কাছে আসতে চাইছে। তবে এখন তারা শিখছিল—কীভাবে সেই আকর্ষণকে প্রাকৃতিকভাবে সামলাতে হয়, কীভাবে সীমারেখা টেনে একে অপরকে সম্মান জানাতে হয়। মায়া অয়নকে বলেছিল—“সম্পর্কের সৌন্দর্য কেবল কাছে আসায় নয়, সঠিক দূরত্ব বজায় রাখাতেও।” এই বাক্যটি অয়নের মনে গভীরভাবে দাগ কাটল। সে বুঝল, আবেগ ও শরীরের টানই সবকিছু নয়; বরং সঠিক সময়, সঠিক উপলক্ষ আর পরস্পরের প্রতি সম্মানই আসল। তাদের ভেতরের কনফ্লিক্ট তাই শুধু বিভ্রান্তি নয়, বরং এক নতুন শিক্ষা হয়ে উঠল—কিভাবে টানাপোড়েনের মাঝেও সম্পর্ককে রক্ষা করা যায়, এবং কিভাবে ভালোবাসা তাড়াহুড়ো নয়, বরং ধৈর্য আর বোঝাপড়ার ভেতর দিয়েই পূর্ণতা পায়।
অধ্যায় ৮:
উৎসবের শেষ রাতটি ছিল ভিন্ন রকম। চারদিকে আলো ঝলমল করছে, আকাশে আতশবাজি ফুটছে, মানুষজনের আনন্দ যেন একসাথে আকাশে মিলেমিশে গিয়েছিল। কিন্তু এই ভিড়ের মাঝেও অয়ন আর মায়া এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা অনুভব করছিল। তারা দুজনেই জানত, আজ কিছু একটা বদলে যাবে। এতদিনের হাসি, আলাপ, ছোট ছোট স্পর্শ—সবকিছু মিলে তাদের ভেতরে যে আবেগ জমে উঠেছে, তা আর লুকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। মঞ্চের দিকে না তাকিয়ে দুজনেই বসেছিল মাঠের এক কোণে, যেখানে কেবল বাতাসের হালকা ছোঁয়া আর দূরে বাজতে থাকা সংগীত ছাড়া অন্য কোনো শব্দ ছিল না। অয়ন দ্বিধাগ্রস্ত কণ্ঠে বলল, “মায়া, আমি জানি না কীভাবে বলব, কিন্তু মনে হচ্ছে যদি আজ না বলি, তাহলে হয়তো কোনোদিন আর সাহস পাব না।” তার চোখে ভয়ও ছিল, আবার একরাশ দৃঢ়তাও।
মায়া চুপ করে অয়নের দিকে তাকিয়ে রইল। তার বুকের ভেতরে তখন ঢেউ খেলে যাচ্ছিল। সেও বুঝতে পারছিল যে কথাটা আসতে চলেছে, কিন্তু সেটা শোনার পর কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানাবে, তা নিশ্চিত ছিল না। অয়ন ধীরে ধীরে বলল—“তুমি আমার কাছে কেবল বন্ধু নও। তোমার সঙ্গে সময় কাটাতে কাটাতে বুঝেছি, আমি তোমাকে ভিন্নভাবে দেখি। ভিড়ের মাঝেও শুধু তোমাকেই খুঁজে পাই। আমি চাই না এই উৎসবের সাথেই তোমাকে হারাতে।” কথাগুলো শুনে মায়ার বুক কেঁপে উঠল। এতদিন যে আবেগ সে নিজের ভেতরে লুকিয়ে রেখেছিল, তা যেন এক ঝলকে বাইরে বেরিয়ে আসতে চাইছিল। মায়া মৃদু হাসি দিয়ে উত্তর দিল—“অয়ন, আমিও তোমাকে ঠিক একইভাবে অনুভব করি। ভেবেছিলাম এটা হয়তো কেবল উৎসবের আবেগ, কিন্তু যত দিন যাচ্ছে, বুঝতে পারছি তোমাকে ছাড়া আমার দিন কল্পনা করাও কঠিন।”
এই স্বীকারোক্তির মুহূর্তে যেন চারপাশের সবকিছু থেমে গেল। আতশবাজির আলো আকাশ ভরিয়ে তুলছিল, আর তাদের চোখে প্রতিফলিত হচ্ছিল সেই আলো। তারা দুজনেই অনুভব করল, এই সম্পর্কের সৌন্দর্য শুধু শারীরিক আকর্ষণে সীমাবদ্ধ নয়; বরং আবেগ, বোঝাপড়া আর মানসিক সংযোগই তাদের একত্রিত করেছে। অয়ন মায়ার হাত আলতো করে ধরে বলল—“তুমি কি আমার সঙ্গে এই যাত্রায় থাকতে চাও, উৎসবের দিনগুলো ছাড়িয়ে?” মায়া চোখ নামিয়ে নিল, কিন্তু তার হাত ছাড়ল না। শান্ত গলায় বলল—“হ্যাঁ, তবে মনে রেখো, এই সম্পর্ক কেবল আনন্দের জন্য নয়, দায়িত্বেরও। আমরা একে অপরের প্রতি যতটা অনুভূতি রাখি, ততটাই সম্মানও রাখতে হবে।” এই কথাগুলো শুনে অয়ন যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। তাদের স্বীকারোক্তি শুধু আবেগ প্রকাশই নয়, বরং এক ধরনের অঙ্গীকারও হয়ে উঠল—যে তারা একে অপরকে কেবল আজ নয়, আগামীতেও একইভাবে ধরে রাখতে চায়। উৎসবের রাত তাই তাদের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিল, যেখানে বন্ধুত্ব আর রোমান্স এক হয়ে জন্ম দিল এক গভীর, অটুট সম্পর্কের।
অধ্যায় ৯:
উৎসবের শেষ প্রহর বাকি, চারদিকে ধীরে ধীরে ভিড় পাতলা হয়ে আসছিল। গান, ঢাকের শব্দ দূরে মিলিয়ে যাচ্ছিল, কেবল বাতাসে ভেসে থাকছিল আনন্দের রেশ। অয়ন ও মায়া হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেল এক নিরিবিলি জায়গায়, যেখানে আলো কম, কেবল চাঁদের মৃদু আভা আর আকাশভরা তারার ঝিকিমিকি ছিল তাদের সঙ্গী। এতদিনের দ্বিধা, অস্থিরতা, আর অপ্রকাশিত টান যেন একসাথে জমে উঠে এ রাতেই ভেঙে গেল। তারা দুজনেই জানত, এ মুহূর্ত কেবল শরীরের কাছে আসার জন্য নয়, বরং আবেগ, বিশ্বাস আর একে অপরকে সম্পূর্ণভাবে গ্রহণ করার জন্য। অয়ন মায়ার দিকে তাকাল—চোখে কোনো তাড়াহুড়ো নেই, বরং একরাশ শ্রদ্ধা আর কোমলতা। মায়া একবার চোখ নামালেও অনুভব করল, তার ভেতরে যে আবেগ জমে আছে, তা আর আটকে রাখা সম্ভব নয়।
তাদের প্রথম স্পর্শ ছিল নীরব অথচ শক্তিশালী। অয়ন ধীরে মায়ার হাত ধরল, আর মায়া তার আঙুলের মাঝে হাত রাখতেই যেন ভেতরে ভেতরে সব বাঁধন খুলে গেল। এ স্পর্শে কোনো তাড়াহুড়ো ছিল না, বরং ছিল আশ্বাস—“আমি আছি, তুমি নিরাপদ।” ধীরে ধীরে তারা আরও কাছে এলো, বাতাসের নীরবতা ভেঙে গেল তাদের নিঃশ্বাসের ভারে। প্রথম আলিঙ্গন যেন দুজনের ভেতরে জমে থাকা সব দ্বিধা মুছে দিল। মায়া অনুভব করছিল, অয়নের বুকে মাথা রাখতেই যেন তার সমস্ত ভয় মিলিয়ে যাচ্ছে। আর অয়ন বুঝতে পারছিল, মায়াকে আঁকড়ে ধরার মধ্য দিয়েই সে তাকে শুধু নিজের নয়, বরং জীবনের অংশ হিসেবে গ্রহণ করছে। তাদের চোখের দৃষ্টি, হাতের ছোঁয়া, আর শরীরের কাছে আসা—সবই যেন একে অপরের ভেতরের আবেগকে আরও প্রবলভাবে প্রকাশ করছিল।
সেই রাতের মিলন তাই ছিল না কোনো হঠাৎ আসা কামনার ফল, বরং দীর্ঘদিনের বিশ্বাস, বোঝাপড়া আর ভালোবাসার এক প্রাকৃতিক বিস্তার। তারা যখন একে অপরের আরও গভীরে ডুব দিল, তখন বুঝল এই সম্পর্ক কেবল আনন্দের জন্য নয়; এটি একটি দায়বদ্ধতা, যেখানে শারীরিক ঘনিষ্ঠতা আর মানসিক সংযোগ একসাথে মিলেমিশে গেছে। মায়া ধীরে বলল—“অয়ন, আমি জানি না ভবিষ্যতে কী আছে, কিন্তু আজ আমি তোমার কাছে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে বিশ্বাস করে সমর্পণ করছি।” অয়নও উত্তর দিল—“আমি তোমাকে কেবল শরীর দিয়ে নয়, মন দিয়ে ভালোবাসি। তুমি আমার কাছে কেবল একজন মানুষ নও, তুমি আমার জীবনের প্রতিচ্ছবি।” সেই রাত তাদের সম্পর্ককে এমন এক জায়গায় নিয়ে গেল, যেখান থেকে আর ফিরে আসা সম্ভব নয়। এটি ছিল তাদের আবেগের পূর্ণতা, যেখানে শারীরিক মিলন কেবল এক মাধ্যম হয়ে উঠল গভীর ভালোবাসা ও বিশ্বাস প্রকাশের। উৎসব শেষ হয়ে গেলেও, এই রাত তাদের জীবনের নতুন অধ্যায় হয়ে রইল—যেখানে তারা কেবল দুজন মানুষ নয়, বরং একে অপরের পরিপূর্ণতা হয়ে উঠল।
অধ্যায় ১০:
সকালটা ছিল অদ্ভুত শান্ত। উৎসবের কোলাহল থেমে গেছে, মেলার মাঠ খালি হয়ে পড়েছে, কেবল বাতাসে রয়ে গেছে রাতের আলো আর গানের স্মৃতি। গ্রামের পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে মায়া ও অয়ন দুজনেই অনুভব করছিল, যেন এক বিশাল পরিবর্তন তাদের ভেতরে ঘটে গেছে। উৎসবের দিনগুলোতে যত রঙ, আলো আর শব্দে তারা ডুবে ছিল, এখন সবকিছু নিস্তব্ধ হলেও তাদের হৃদয়ের ভেতরে তৈরি হয়েছে এক নতুন সুর। মায়ার মনে হচ্ছিল, অয়নের দিকে তাকালেই যেন গত কয়েকদিনের প্রতিটি মুহূর্ত সিনেমার মতো চোখের সামনে ভেসে উঠছে—প্রথম দেখা, প্রথম হাসি, অপ্রত্যাশিত আলাপ, দ্বিধার টানাপোড়েন, আবেগের স্বীকারোক্তি আর গভীর সংযোগ। সে বুঝল, এই সম্পর্ক কেবল উৎসবের আবেগ নয়, বরং তার নিজের জীবনের অমূল্য অংশ হয়ে গেছে। অয়নও মৃদু হাসি দিয়ে মায়ার দিকে তাকিয়ে বলল, “মায়া, আজ সকালের সূর্যটা যেন অন্য রকম লাগছে। হয়তো এই কারণেই, তুমি আছো আমার পাশে।” এই কথাগুলোতে কোনো নাটকীয়তা ছিল না, বরং ছিল গভীর সত্য।
তাদের মধ্যে তখন এক ধরনের স্থিরতা জন্ম নিয়েছিল। গত রাতের আবেগময় ঘনিষ্ঠতা যেন তাদের সম্পর্ককে শুধু কাছাকাছি আনেনি, বরং একে অপরের প্রতি এক অদৃশ্য দায়িত্ববোধও জাগিয়ে তুলেছিল। মায়া অয়নকে বলল, “আমাদের পথ কি কেবল উৎসব পর্যন্তই ছিল? নাকি তার পরেও আছে?” অয়ন উত্তর দিল, “আমি চাই আমাদের পথ এখানেই শেষ না হোক। আমি চাই আমরা একসঙ্গে আগামী দিনের প্রতিটি সকালকে স্বাগত জানাই।” এই কথায় মায়ার চোখ ভিজে উঠল। এতদিনের দ্বিধা, ভয়, অনিশ্চয়তা যেন সকালের আলোয় গলে গিয়ে স্বচ্ছ হয়ে গেল। তারা বুঝতে পারল, যে সম্পর্ক বিশ্বাস ও শ্রদ্ধার ভিত্তিতে গড়ে ওঠে, তা উৎসবের ক্ষণিক আনন্দের মতো ক্ষণস্থায়ী হয় না; বরং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরও স্থায়ী, আরও দৃঢ় হয়ে ওঠে। সেই সকালে, মেলার মাঠের নিরিবিলি প্রান্তে দাঁড়িয়ে তারা নীরবে একে অপরকে প্রতিশ্রুতি দিল—এ সম্পর্ককে তারা কেবল স্মৃতিতে সীমাবদ্ধ রাখবে না, বরং জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ে লালন করবে।
সূর্য তখন ক্রমশ ওপরে উঠছিল, চারদিকে আলোর ছটা ছড়িয়ে পড়ছিল, আর নতুন দিনের শুরু ঘোষণা করছিল। অয়ন ও মায়া হাঁটছিল পাশাপাশি, আর তাদের ভেতরে ভেতরে তৈরি হচ্ছিল এক নতুন অধ্যায়। তারা জানত সামনে অনেক প্রশ্ন, অনেক বাধা আসবে, কিন্তু সেই সবকিছুর মুখোমুখি হওয়ার শক্তি তারা একে অপরের ভেতরে খুঁজে পেয়েছে। এ উৎসব তাদের কেবল আনন্দ দেয়নি, দিয়েছে ভালোবাসার নতুন সংজ্ঞা। তারা অনুভব করল, প্রথম দেখা থেকে আজকের সকাল পর্যন্ত প্রতিটি মুহূর্ত তাদের গড়ে তুলেছে, শিখিয়েছে, আর নতুন এক জীবনের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিয়েছে। এ সকাল তাই শুধু উৎসব-পরবর্তী সকাল নয়; এটি ছিল তাদের যৌথ যাত্রার প্রথম ভোর, যেখানে প্রতিটি আলো, প্রতিটি নিশ্বাসে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল প্রতিশ্রুতি—তারা একে অপরের। উৎসব ফুরোলেও আবেগ ফুরোয়নি, বরং শুরু হলো এমন এক সম্পর্কের, যা সময়ের সঙ্গে আরও গভীর, আরও অবিচ্ছেদ্য হয়ে উঠবে।
শেষ