Bangla - রহস্য গল্প

শঙ্খের অভিশাপ

Spread the love

প্রাচীন মন্দির খননের সকালে সূর্যের প্রথম কিরণ ভোরের কুয়াশার মধ্য দিয়ে মাটির ওপরে পড়ে। অধ্যাপক সৌম্য সেনগুপ্ত, যিনি দেশের এক নামকরা প্রত্নতত্ত্ববিদ, একাগ্রভাবে খননক্ষেত্রের দিকে এগোচ্ছিলেন। তার সঙ্গে ছিলেন সহকারী অরণ্য দত্ত, যিনি সৌম্যের পাশে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণার কাজ করতেন। মাটির স্তর একের পর এক সরানো হচ্ছিল, আর ধুলোমাখা খণ্ডকোণ থেকে প্রাচীন কালকার নানা নিদর্শন উঠে আসছিল। হঠাৎ অরণ্য একটি অস্বাভাবিক আকৃতির বস্তু অনুভব করলেন। তার হাতের মুঠোয় ধরা পড়ল এক অলঙ্কৃত শঙ্খ, যার গায়ে খোদাই করা প্রতীকগুলো যেন কেবল সময়ের সাক্ষী হয়ে রয়ে গেছে। শঙ্খের উপর ক্ষীণ লালচে দাগ, যা প্রথমে কেবল মাটির দাগ মনে হলেও, যখন সূর্যের আলোতে ঝলমল করছিল, তখন তা যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে। সৌম্য এবং অরণ্য দু’জনেই মিশ্র অনুভূতিতে ভুগছিলেন—একদিকে প্রত্নতত্ত্বের উত্তেজনা, অন্যদিকে একটি অজানা ভয় তাদের মনে ঢেউ তুলছিল।

শঙ্খটি যখন মাটির কোলে ধীরে ধীরে উঠে আসল, তৎক্ষণাৎ স্থানীয় পুরোহিত অদ্বৈত গুহ উপস্থিত হলেন। তিনি গ্রামের অজস্র তন্ত্র, দেবদেবীর কাহিনী, এবং অভিশপ্ত বস্তুগুলোর গল্প জানতেন। অদ্বৈত তাঁর কণ্ঠে সতর্কতা এনে বললেন, “এটা দেবতার অভিশপ্ত শঙ্খ। একে বাজানো যাবে না, অন্যথায় ধ্বংসের সম্ভাবনা সৃষ্টি হবে।” কিন্তু সৌম্য তার জ্ঞান এবং বিজ্ঞানমনস্ক দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলেন। তিনি ভাবলেন, “এ ধরনের সতর্কতা তো প্রত্নতত্ত্বে প্রচলিত, কিন্তু বাস্তবতার সঙ্গে এর মিল নেই। শঙ্খ কেবল একটি প্রত্নবস্তু, যা আমাদের ইতিহাসের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করবে।” অদ্বৈতের সতর্কতা তার কানে প্রবেশ করলেও, তিনি তা কেবল অন্ধ বিশ্বাসের অংশ হিসেবে নিলেন। অরণ্য কিছুটা দ্বিধান্বিত হলেও সৌম্যের দৃঢ়তার প্রভাবে চুপচাপ পাশে দাঁড়িয়ে থাকলেন।

শঙ্খটি খননের পর সৌম্য তার গবেষণাগারে নিয়ে যান। গ্লাভস পড়ে সে শঙ্খটি ঘুরিয়ে দেখলেন, প্রতিটি খোদাই যেন একটি অজানা কাহিনী বলছিল। ক্ষীণ লালচে দাগটি বিশ্লেষণ করার জন্য মাইক্রোস্কোপে দেখা হলো, কিন্তু কোন রকম রক্ত বা জৈব উপাদান পাওয়া যায়নি। এই বিশ্লেষণ সৌম্যকে আরও নিশ্চিত করল যে এটি কেবল ধাতুর নিদর্শন। কিন্তু সন্ধ্যায়, যখন গবেষণাগারটি নীরব, তখন অরণ্য খেয়াল করলেন শঙ্খটি যেন নিজেই অল্প অল্প শব্দ করতে শুরু করেছে—একধরনের অতৃপ্ত আহ্বান, যা কোন ল্যাবরেটরির সরঞ্জামের মাধ্যমে বোঝা যাচ্ছিল না। সৌম্য বিজ্ঞানকে প্রধান্য দিতেই ব্যস্ত ছিলেন, কিন্তু অরণ্যের মনে প্রথমবারের মতো শঙ্কা জন্ম নিল। মাটির নিচে কত গোপন ইতিহাস লুকিয়ে আছে, তা কখনও কখনও মানব বোধের সীমা ছাড়িয়ে যায়—এমনই একটি রহস্যময় আহ্বান তাদের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল।

অরণ্য দত্তের কৌতূহল আগের চেয়ে আরও তীব্র হয়ে উঠেছিল। রাতের গভীর নিস্তব্ধতা যখন পুরো শহর ঘুমে ডুবে ছিল, তখন তিনি একাগ্রচেতনে গবেষণাগারের মধ্যে শঙ্খটির দিকে এগিয়ে গেলেন। প্রতিটি পদক্ষেপে যেন তার মনে এক অজানা উত্তেজনা আর ভয় কাঁপছিল। তিনি জানতেন, অধ্যাপক সৌম্য কখনও অনুমতি দিতেন না, কিন্তু কৌতূহল আর বিজ্ঞানমনস্ক মনকে থামানো কঠিন। ধীরে ধীরে তিনি শঙ্খটি হাতে নিলেন। তার স্পর্শে যেন ধাতুর ঠান্ডা শক্তি এক অদৃশ্য জোড়ায় আচ্ছন্ন করল তাকে। অরণ্য গভীর নিশ্বাস নিয়ে শঙ্খটি বাজাতে শুরু করল। প্রথম শব্দের ধ্বনি নীরব রাতের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ল। শব্দটি এমন ছিল যে বাতাস যেন ভারী হয়ে উঠল, এবং গবেষণাগারের দেয়ালগুলি অদৃশ্যভাবে কম্পিত হতে লাগল। অরণ্য নিজের কানে শোনার সঙ্গে সঙ্গে অনুভব করল, এটি শুধুমাত্র একটি শব্দ নয়; এটি যেন একটি প্রাচীন আহ্বান, যা মাটির গভীরে লুকিয়ে থাকা শক্তিকে জাগিয়ে তুলেছে।

পরের ভোরে খননস্থলের কাছে ছড়িয়ে পড়ল এক ভয়ঙ্কর খবর—গ্রামের পরিচিত রাখালকে অদ্ভুতভাবে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে। তার মুখে ছিল ভয়ের ছাপ, কিন্তু শরীরে কোনো আঘাত বা ক্ষতচিহ্ন ছিল না। গ্রামের মানুষজন একে অস্বাভাবিক ভাবতে শুরু করল। কেউ কেউ বলছিলেন, “অভিশাপ শুরু হয়েছে,” আবার কেউ সন্দিহান চোখে দেখছিলেন, যেন তারা দেখছিলেন যে কোন অদৃশ্য চোখ তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে মন্দিরের চারপাশে চুপচাপ আতঙ্কের বীজ বোনা হতে লাগল। অরণ্য নিজেই কিছুটা অবাক হয়েছিল; সে বুঝতে পারছিল যে তার কৌতূহল হয়তো এক ভয়ঙ্কর ফলাফল ডেকে এনেছে, কিন্তু অন্যদিকে তাকে এক অজানা উত্তেজনা ঘিরে ধরছিল—এটি এমন কিছু যা তার বিজ্ঞানমনস্ক বোধকে চ্যালেঞ্জ করছিল। গ্রামের বয়োজ্যেষ্ঠরা বলছিলেন যে, প্রাচীন শঙ্খের আওয়াজ যখন বাতাসে মিশে যায়, তখন সেটি দেবতার অভিশাপের রূপ নেয় এবং যে কেউ তা শুনবে, তার ভাগ্যে অশুভ ঘটনা ঘটতে বাধ্য।

অরণ্য নিজের মধ্যে দ্বিধার স্রোত অনুভব করছিল। একদিকে, সে শঙ্খের রহস্য উন্মোচনের জন্য উদগ্রীব, অন্যদিকে, রাখালের অকাল মৃত্যু তাকে সতর্ক করতে চেষ্টা করছিল। অধ্যাপক সৌম্য যখন ঘটনাটি জানতে পারলেন, তিনি প্রথমে বিশ্বাস করতে পারলেন না। বিজ্ঞান এবং যুক্তি তাকে বলছিল, “এটা শুধুই সম্ভাব্য দৈবিক ঘটনার সমষ্টি,” কিন্তু ভয়ের বাতাবরণ, গ্রামবাসীর ফিসফিসানি, এবং অদ্ভুত রহস্যময় ঘনত্ব তাকে স্তব্ধ করে দিল। সেই রাত থেকে অরণ্য প্রতিনিয়ত শঙ্খটির দিকে তাকিয়ে থাকল, যেন তার মধ্যে লুকিয়ে থাকা শক্তি কোন মুহূর্তেই হঠাৎ জাগ্রত হতে পারে। মাটির গভীরে লুকানো প্রাচীন শক্তি, যা শুধুমাত্র এক শব্দে তার প্রভাব ছড়িয়েছে, এখন পুরো অধ্যায় জুড়ে একটি অদৃশ্য আতঙ্কের ধারা সৃষ্টি করেছিল—যা আগামী দিনে আরও বিপজ্জনক ও অজানা ঘটনাগুলোর সূচনা ঘটাবে।

খননস্থল ও রহস্যময় ঘটনার খবর শুনে সাংবাদিক অনন্যা মুখার্জী গ্রামে পা রাখলেন। তিনি মূলত একটি রিপোর্টের খোঁজে এসেছিলেন—প্রাচীন মন্দির, শঙ্খের আবিষ্কার, এবং রাখালের অকাল মৃত্যু—সবকিছুই তাঁর কৌতূহল জাগিয়েছিল। তার জীবনযাত্রা শহরের ব্যস্ততার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, এবং সাংবাদিকতা তাঁর কাছে শুধু তথ্য সংগ্রহের মাধ্যম নয়, বরং সত্য উদঘাটনের হাতিয়ারও ছিল। গ্রামের পথে ঢুকতেই তিনি লক্ষ্য করলেন যে স্থানীয় মানুষজনের চোখে আতঙ্ক এবং সন্দিহান দৃষ্টির ছাপ রয়েছে। ফিসফিসানির শব্দ যেন চারপাশে ঘুরপাক খাচ্ছিল। অনন্যা স্বাভাবিকভাবে যুক্তিবাদী এবং বাস্তববাদী, তাই প্রথমে তিনি স্থানীয়দের ভয়কে কেবল পুরনো কুসংস্কারের ফল মনে করলেন। তবে হেঁটে হেঁটে খননস্থলের দিকে এগোতে গিয়ে তিনি লক্ষ্য করলেন যে মাটির গর্ত থেকে উঠে আসা শঙ্খটির উপস্থিতি, এবং সেই সঙ্গে অরণ্য ও সৌম্যের তীব্র মনোযোগ, কোনো সাধারণ ঘটনার ইঙ্গিত দিচ্ছিল না। তিনি বুঝতে পারলেন, এ সংবাদ কভার করার জন্য শুধু তথ্য সংগ্রহ যথেষ্ট নয়—তিনি যেন এক অদ্ভুত রহস্যের মধ্যে প্রবেশ করেছেন।

খননস্থলে পৌঁছে অনন্যা সৌম্য এবং অরণ্যের সঙ্গে পরিচিত হলেন। সৌম্য তাকে স্বাগত জানালেন, তবে তার চোখে একটি গভীর চিন্তার ছাপ ছিল, যেন তিনি জানতেন অনন্যার আগমন কেবল তথ্যসংগ্রহ নয়, বরং শঙ্খের রহস্যের সাথে একটি নতুন সংযোগ ঘটাবে। অনন্যা প্রাথমিকভাবে সতর্ক ছিলেন, কিন্তু তাঁর সাংবাদিকি আগ্রহ তাকে হঠাৎ ভয়ের মাঝেও প্রবেশ করতে বাধ্য করল। সে খননস্থলের প্রতিটি কূপ, মাটির স্তর, এবং শঙ্খের খোদাই খুঁটিয়ে দেখল। অরণ্য তাকে সতর্ক করতে চাইলেন, কিন্তু অনন্যার যুক্তিবাদী মন ভয়কে পাত্তা দেয়নি। সে ভাবছিল, “সবকিছুই যৌক্তিক ব্যাখ্যা পাবে, শুধু পর্যবেক্ষণ এবং বিশ্লেষণ যথেষ্ট।” কিন্তু রাতের অদ্ভুত শব্দ, হালকা কম্পন, এবং ছায়ার অস্বাভাবিক আন্দোলন তাঁকে প্রথমবারের মতো অস্বস্তিতে ফেলল। প্রতিটি শব্দ যেন একটি অদৃশ্য শক্তির ইঙ্গিত দিচ্ছিল, যা মানুষের চোখে দেখা যায় না কিন্তু অনুভূতিতে স্পর্শ করে।

রাত গভীর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অনন্যা খননস্থলে থাকতে লাগল। সে লক্ষ্য করল, গ্রামের চারপাশে বাতাসের গতিবেগ হঠাৎ পরিবর্তিত হচ্ছে, মাটির নীচ থেকে যেন এক অদৃশ্য চাপ উঠছে। শঙ্খের উপস্থিতি, যা দিনের আলোতে কেবল প্রত্নতাত্ত্বিক আকর্ষণ দেখিয়েছিল, রাতের আঁধারে যেন জীবন্ত হয়ে উঠছে। অনন্যা তাঁর মনকে যুক্তির আড়ালে রেখে চুপচাপ স্থির দাঁড়ালেন, কিন্তু অচেনা ভয় তাঁর শরীরে কম্পন সৃষ্টি করল। সৌম্য তাকে বুঝালেন যে শঙ্খটি শুধুমাত্র একটি বস্তু নয়; এটি একটি প্রাচীন শক্তির বহক, যা সঠিক বা ভুল ব্যবহারে জীবন বা মৃত্যুর গতি পরিবর্তন করতে পারে। অনন্যা প্রথমবার বুঝতে পারল যে তাঁর সাংবাদিকি মিশন কেবল সংবাদ সংগ্রহ নয়, বরং এক অজানা রহস্যের সঙ্গে মুখোমুখি হওয়া। মাটির গভীর থেকে উঠে আসা সেই আহ্বান, যা অরণ্য রাতের অন্ধকারে বাজিয়েছিল, এখন অনন্যার প্রতিটি পদক্ষেপের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত, এবং তিনি প্রথমবারে উপলব্ধি করলেন, সত্য উদঘাটনের জন্য কখনও কখনও যুক্তির বাইরে যেতে হয়—যেখানে ভয় এবং কৌতূহল একে অপরের সঙ্গে মিশে যায়।

ক্ষণিকের জন্য মন্দিরের প্রাচীরের ধ্বংসাবশেষের মাঝে নীরবতা নেমে আসে, যেন চারপাশের বাতাসও অদৃশ্যভাবে রুদ্ধ। গ্রামের পুরোহিত অদ্বৈত গুহ, যিনি বহু বছর ধরে এই অঞ্চলের তন্ত্র ও প্রাচীন দেবতার ইতিহাসের সাথে পরিচিত, খননস্থলে প্রবেশ করলেন। তার চোখে গভীর সতর্কতার ছাপ, আর হাতের যন্ত্রপাতি ছাড়াই সে উপস্থিত হয়েছেন যেন এক অভিজ্ঞ রক্ষক। অদ্বৈত মাটির নিচ থেকে উদ্ধার হওয়া শঙ্খের দিকে চেয়ে ধীরে ধীরে বললেন, “এই শঙ্খটি কেবল প্রত্নবস্তু নয়, এটি প্রাচীন এক যজ্ঞের অংশ। বিশ্বাস করা হয়, এক সময়ের রাজা মন্দির লুণ্ঠন করতে এসে এই শঙ্খ বাজিয়েছিল। তখন দেবতার অভিশাপ নেমে আসে, আর শঙ্খটি রক্তপিপাসু শক্তির আশ্রয়স্থল হয়ে ওঠে।” তাঁর কণ্ঠে শুধু সতর্কতা নয়, এক ধরনের ইতিহাসের গন্ধও লেগে ছিল। অদ্বৈত আরও বললেন যে, শঙ্খকে পুনরায় মাটির নিচে ফিরিয়ে না দিলে অদৃশ্য শক্তি ধীরে ধীরে মানুষের দুনিয়ায় প্রভাব ফেলতে শুরু করবে, যা কেবল অমর্যাদাকর নয়, বরং প্রাণঘাতী হতে পারে। তিনি অনুরোধ করলেন, “এটি মানুষের কৌতূহল বা বিজ্ঞানের পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য নয়, বরং স্বাভাবিক নিয়মের সাথে মিল রেখে মাটির গভীরে রেখে দিতে হবে। আমাদের ইতিহাসে এমন বহু অভিশপ্ত নিদর্শন আছে, যা মানুষের হস্তক্ষেপে বিপদ ডেকে আনতে পারে।”

কিন্তু অধ্যাপক সৌম্য সেনগুপ্ত, যিনি দীর্ঘদিন ধরে প্রত্নতত্ত্বের গুণমান ও বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলেন, অদ্বৈতের কথায় বিশেষ গুরুত্ব দেননি। তিনি নিজেকে যুক্তি এবং বাস্তবতার প্রতি অনুগত মনে করতেন। সৌম্য ধীরে ধীরে বললেন, “অদ্বৈত বাবু, আমি আপনার সতর্কতাকে সম্মান করি। কিন্তু আমাদের কাছে যা আছে, তা শুধুমাত্র একটি প্রাচীন শঙ্খ, যা আমাদের ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং শিল্পকলার সাথে সংযোগ স্থাপন করছে। দেবতার অভিশাপ বা রক্তপিপাসু শক্তি—এসব কেবল কিংবদন্তি। আমাদের কাজ হলো তথ্য সংগ্রহ, বিশ্লেষণ এবং সংরক্ষণ। আমরা কেবল অতীতের নিদর্শনকে উপলব্ধি করছি, কোনো অদৃশ্য শক্তিকে উত্থাপন করছি না।” তার কথায় একটি দৃঢ়তা ছিল, যা দেখাল যে তিনি বিশ্বাস এবং ভয়কে যুক্তির চেয়ে ছোট মনে করেন। কিন্তু সেই দৃঢ়তার মধ্যেও অদ্ভুত এক উত্তেজনা এবং অজানা ভয়ের ছায়া ছিল।

অদ্বৈত ধীরে ধীরে তাঁর চোখে কঠোর সতর্কতার ছাপ নিয়ে বললেন, “আপনি চাইলে যুক্তি এবং বিশ্লেষণ দেখাতে পারেন। কিন্তু একটি কথা মাথায় রাখুন—যে বস্তুটি শিখরে পৌঁছায়নি, সেটি আপনাকে প্রলোভন দেখাতে পারে। শঙ্খ শুধু ধাতু নয়; এটি প্রাচীন যজ্ঞের শক্তির বহক, যা মানুষের ইচ্ছার বাইরে কাজ করে। যদি এটি মাটির নিচে না ফেরানো হয়, আমরা এক অদৃশ্য বিপদের সূচনা করতে পারি। যজ্ঞের সময় এই শঙ্খের আওয়াজই অভিশাপের সূচনা করেছিল, আর আজও সেই আওয়াজে শক্তি লুকিয়ে আছে। আমার অনুরোধ, এটিকে স্থানান্তরিত না করে প্রাচীন অবস্থায় রেখে দিন।” সৌম্য অদ্বৈতের কথায় একটি অন্তর্দ্বন্দ্ব অনুভব করলেন, যদিও তিনি তা স্বীকার করতে নারাজ। গ্রামে নীরবতা, রাখালের অকাল মৃত্যু এবং শঙ্খের রহস্যময় উপস্থিতি—সবকিছু একত্রিত হয়ে সৌম্যের যুক্তিবাদী মনকে ছোট করে দেয়। তিনি বুঝতে পারলেন যে, ইতিহাস এবং কিংবদন্তি কখনও কখনও একসাথে মিশে এমন এক রহস্য তৈরি করতে পারে, যা কেবল বাস্তবতার সীমা দিয়ে বোঝা সম্ভব নয়। তবে তার বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি তাকে এখনও সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করছিল—কীভাবে শঙ্খের শক্তি পরীক্ষা এবং সংরক্ষণ করা যায়, এবং কেন এটি প্রকৃত অভিশাপের প্রতীক হতে পারে।

গ্রামের শান্তি আর নীরবতা ধীরে ধীরে ভেঙে পড়তে শুরু করল। রাখালের অকাল মৃত্যুর পর, এই মুহূর্তে আরও দুটি অদ্ভুত ঘটনা সংঘটিত হলো। প্রথমে গ্রামের একজন মধ্যবয়স্ক লোককে জঙ্গলের মাঝে ঝুলন্ত অবস্থায় পাওয়া গেল। তাঁর শরীরের অবস্থান দেখেই বোঝা যাচ্ছিল যে মৃত্যুর কারণ প্রাকৃতিক নয়; যেন কোনো অদৃশ্য শক্তি তাঁকে ধাক্কা দিয়ে মৃত্যুর প্রান্তে পৌঁছে দিয়েছে। তার মুখে ভয়ের এমন ছাপ ছিল, যা চোখের মধ্যে একটি জীবন্ত আতঙ্কের দাগ রেখে গিয়েছিল। গ্রামের মানুষজন দৌড়ে সেখানে পৌঁছালেন, কেউ কান্নায় ভেঙে পড়লেন, কেউ চমকে দাড়ালেন। অরণ্য এবং সৌম্য ঘটনাস্থলে পৌঁছে মৃতদেহটি ঘিরে দাঁড়ালেন। সৌম্য, যিনি এতদিন যুক্তিবাদী এবং বাস্তববাদী ছিলেন, এবার স্বীকার করতে বাধ্য হলেন যে তাঁর বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণও এই অদ্ভুত ঘটনাকে পুরোপুরি ব্যাখ্যা করতে পারছে না।

কিছু ঘন্টা পর, আরেকটি মৃত্যু সংবাদ ছড়িয়ে পড়ল—গ্রামের আরেকজন যুবক পানিতে ডুবে মারা গিয়েছেন। কিন্তু আশ্চর্যজনক বিষয় হলো, তাঁর শরীরে কোনো আঘাতের চিহ্ন নেই। চোখের ভয়, মুখের উত্তেজনা, এমনকি হাত-পা সব কিছুই বলে দিচ্ছিল যে মৃত্যু এক অদৃশ্য এবং অব্যক্ত শিকারের কাজ। গ্রামের লোকেরা একে একে খননকাজ বন্ধ করার দাবি তুলতে লাগল। তারা বলল, “এই অভিশাপ আমাদের গ্রামে নেমে এসেছে। যতক্ষণ পর্যন্ত শঙ্খ মাটির নিচে ফেরানো হয়নি, এই মৃত্যু থামবে না।” অরণ্য হতবাক হয়ে দেখছিলেন, কারণ ঘটনাগুলি যৌক্তিক ব্যাখ্যা থেকে অনেক দূরে চলে গেছে। সৌম্য নিজেই ধীরে ধীরে দ্বিধায় পড়লেন। তিনি অনুভব করলেন, হয়তো তিনি এক অদৃশ্য শক্তির সঙ্গে লড়াই করছেন—একটি শক্তি যা ইতিহাসের বই বা বিজ্ঞান সরঞ্জামের মাধ্যমে বোঝা সম্ভব নয়।

সন্ধ্যায়, খননস্থলের চারপাশে মৃদু অন্ধকার নেমে আসল। সৌম্য মাটির দিকে তাকিয়ে ভাবলেন—অভিশাপ কি সত্যিই বাস্তব? তিনি জানতেন, ইতিহাস এবং কিংবদন্তি মাঝে মাঝে বাস্তবের সঙ্গে মিলিত হয়ে একটি ভয়ঙ্কর সত্য উদঘাটন করতে পারে। গ্রামের মানুষজনের আতঙ্ক, অদ্ভুত মৃত্যুর পরিধি, এবং শঙ্খের রহস্যময় উপস্থিতি সব মিলিয়ে তাঁকে একটি কঠিন সিদ্ধান্তের মুখোমুখি করল। তিনি অরণ্যের দিকে তাকালেন, এবং সেই দ্বিধা তাকে বোঝাল যে, কখনও কখনও বৈজ্ঞানিক যুক্তি এবং কৌতূহলই সবচেয়ে বড় বিপদের কারণ হতে পারে। রাতের নীরবতা, হালকা বাতাসে শঙ্খের উপস্থিতি, এবং গ্রামের চারপাশে ভয়ের ছায়া—সবকিছু মিলিয়ে এক অদৃশ্য পরিধি সৃষ্টি করেছে, যা তাকে বাধ্য করল ভাবতে যে, হয়তো এ অভিশাপ কেবল কিংবদন্তি নয়, বরং বাস্তব।

অরণ্য দত্ত, যিনি শঙ্খ বাজানোর পর থেকে সবচেয়ে বেশি দ্বিধা অনুভব করেছিলেন, এখন পর্যন্ত নিজের কৌতূহল এবং বৈজ্ঞানিক মনোবলকে যুক্তির আড়ালে ধরে রেখেছিলেন। তিনি বারবার বলতেন, “এ সব কাকতাল, প্রমাণ নেই। যা ঘটেছে, তার সবকিছুকে যৌক্তিকভাবে ব্যাখ্যা করা যায়।” গ্রামের অদ্ভুত মৃত্যুর পরও, তিনি নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, কোনো অতিপ্রাকৃত শক্তি নেই, এবং সব ঘটনা কেবল ঘটনাচক্রের ফল। সৌম্য এবং অনন্যা বারবার সতর্ক করেছেন, কিন্তু অরণ্য অটল ছিলেন—তার জন্য শঙ্খ একটি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন, এবং এটি নিয়ে অতিরিক্ত ভয় শুধুই অন্ধ বিশ্বাস। সে নিজের যুক্তিবাদী মনকে শক্ত করে ধরে রেখেছিল, এবং রাতের নীরবতা, বাতাসের অদ্ভুত গতিবেগ, কিংবা গ্রামের মানুষের আতঙ্ক তাকে প্রভাবিত করতে পারেনি। তার চোখে এটি ছিল এক গবেষণামূলক পরীক্ষা, যেখানে ভয়কে শুধু প্রাকৃতিক ব্যাখ্যার আড়ালে রাখা যায়।

কিন্তু সেই রাতের কথা ভিন্ন ছিল। অরণ্য নিজের তাঁবুর পাশে বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। হালকা বাতাসে শঙ্খ থেকে যেন এক অদ্ভুত কম্পন ছড়িয়ে পড়ছিল। তিনি প্রথমে তা উপেক্ষা করার চেষ্টা করলেন, কিন্তু হঠাৎ তাঁবুর বাইরে ছায়ামূর্তির একটি অদ্ভুত দোলন লক্ষ্য করলেন। ছায়াটি স্থির নয়, বরং ক্রমশ নড়াচড়া করতে লাগল, যেন কেউ অদৃশ্যভাবে তাঁকে ঘিরে রেখেছে। অরণ্য প্রথমে নিজেকে ধমক দিলেন, মনে মনে ভাবলেন, “এটি শুধুই চোখের খেলা। রাতের ছায়া, বাতাসের দোলা—সবই যৌক্তিক।” কিন্তু তার হৃদস্পন্দন দ্রুত বেড়ে যেতে লাগল। ছায়ামূর্তিটি তাঁকে ক্রমশ ঘিরে ধরছিল, এবং অরণ্যের মনে ভয় ভাঙা শুরু করল। তিনি উপলব্ধি করলেন যে, যুক্তি এবং বাস্তববাদ কখনও কখনও যথেষ্ট নয়, বিশেষত যখন একটি অদৃশ্য শক্তি মানুষের মন এবং দৃষ্টিকে প্রভাবিত করতে সক্ষম।

রাতের অন্ধকারে অরণ্য অনুভব করলেন যে, কেউ বা কিছু তাকে ক্রমশ তাড়া করছে। তাঁর প্রতিটি পদক্ষেপে অনুভূত হল এক অদৃশ্য চোখের দৃষ্টি, যা তাকে শ্বাসরুদ্ধ করছিল। তাঁবুর মধ্যে ফিরে আসার চেষ্টা করেও সে শান্তি পাননি। তার যুক্তিবাদী মন ধীরে ধীরে ভেঙে যেতে লাগল, এবং সে নিজেকে প্রশ্ন করতে থাকল—কী সত্যিই এই শঙ্খের সঙ্গে কোনো অতিপ্রাকৃত শক্তি জড়িত? বা সবকিছু কি কেবল তার কল্পনাশক্তির খেলা? কিন্তু যে অনুভূতি তাঁকে ঘিরে ধরেছিল, তা যৌক্তিক ব্যাখ্যার সীমা অতিক্রম করছিল। অরণ্য প্রথমবারে স্বীকার করলেন যে, তার অস্বীকার এবং যুক্তিবাদ তাকে রক্ষা করতে পারছে না। অন্ধকার, ছায়া, এবং শঙ্খের আওয়াজ—সবকিছু মিলিয়ে তাকে এক এক অজানা আতঙ্কের মধ্যে ঠেলে দিয়েছে, যা শুধু রাতের মধ্যেই তার শক্তি ও বিশ্বাসকে পরীক্ষা করছে। এই অভিজ্ঞতা অরণ্যের জন্য এক নতুন ধাক্কা—যেখানে কৌতূহল এবং যুক্তি এখন এক অদ্ভুত ভয়ঙ্কর বাস্তবতার সঙ্গে মুখোমুখি।

খননস্থলের রাতের নীরবতা এখনও গ্রামজুড়ে ভয় সৃষ্টি করছিল। সাংবাদিক অনন্যা মুখার্জী, যিনি এখন শুধু সংবাদ সংগ্রাহক নয়, বরং রহস্যের অজ্ঞাত শক্তি বোঝার জন্য গবেষকও হয়ে উঠেছেন, শঙ্খটির গায়ে খোদাই করা অদ্ভুত চিহ্নগুলো খুঁটিয়ে বিশ্লেষণ করতে শুরু করলেন। তার চোখে প্রতিটি রেখা, প্রতিটি অচেনা প্রতীক যেন এক অদ্ভুত ভাষার আভাস দিচ্ছিল। চিহ্নগুলোর মধ্যে কিছু অংশ চেয়ে দেখলেই মনে হচ্ছিল যে এটি কেবল শিল্পকলার নিদর্শন নয়, বরং একটি প্রাচীন লিপি, যা কয়েক শতাব্দী আগে কোন গোপন রাজবংশের দ্বারা ব্যবহার করা হত। অনন্যা নিজেই অবাক হলেন যে, এই লিপিটি কোনো সাধারণ ধর্মীয় বা সাংস্কৃতিক প্রতীক নয়, বরং এতে একটি শক্তিশালী বার্তা লুকানো রয়েছে। তিনি ধীরে ধীরে সেই লিপির অর্থ উদ্ঘাটনের চেষ্টা করলেন। কয়েক ঘন্টার গবেষণার পর অনন্যা বুঝতে পারলেন, লিপিতে লেখা আছে—“যে বাজাবে, সে আহ্বান করবে মৃত্যুর দূতকে।” এই বাক্যটি তাকে প্রথমে বিমর্ষ করল। তার যুক্তিবাদী মন ভাবল, “এটি কেবল একটি গোপন রহস্যময় বার্তা, যা প্রাচীন রাজবংশের ভয় এবং বিশ্বাসের সঙ্গে সম্পর্কিত।” তবে লিপির শৈলী এবং সতর্কতার ধরণ তাকে বুঝিয়ে দিল যে, এটি কোনো সাধারণ কিংবদন্তি নয়; এটি শঙ্খটির শক্তির সূচক, যা কেবল বাজানো নয়, বরং একটি অদৃশ্য প্রভাব সৃষ্টি করতে সক্ষম।

অনন্যা আরও গভীরে যাচ্ছিলেন, আর প্রতিটি চিহ্ন এবং প্রতিটি রেখা তার মনে আতঙ্কের সূচনা করছিল। তিনি লক্ষ্য করলেন যে, শঙ্খের গায়ে থাকা চিহ্নগুলি কোনোভাবে মানুষের মানসিক অবস্থার সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে পারে। মানসিকভাবে অস্থির বা দুর্বল যে কেউ যখন এই শব্দের সংস্পর্শে আসে, তখন তার ভয় বৃদ্ধি পায়, এবং সেই ভয়ের মধ্য দিয়ে মৃত্যু বা বিপদ ডেকে আনা সম্ভব। তিনি বুঝতে পারলেন, শুধু শঙ্খ বাজানো নয়, বরং শঙ্খের আওয়াজ মানুষের মানসিক ভয়কে উদ্দীপিত করছে, এবং সেই আতঙ্কের প্রবাহই মৃত্যুর ঘটনাকে প্ররোচিত করছে। এটি শুধু অদ্ভুত এবং অতিপ্রাকৃত নয়; বরং মনোবিজ্ঞান এবং অতীতের ইতিহাসের মিলিত প্রভাব। অনন্যা চিন্তিত হলেন, কারণ এভাবে শুধু অরণ্য নয়, সৌম্য এবং গ্রামের মানুষজনও এই প্রভাবের শিকার হতে পারেন। তার যুক্তিবাদী মন এবং গবেষণার দক্ষতা এখন তাকে এক অদ্ভুত দ্বিধায় ফেলল—যেখানে বাস্তব এবং অতিপ্রাকৃত একে অপরের সঙ্গে মিলিত হয়ে এক অদৃশ্য শক্তি তৈরি করেছে।

রাতের অন্ধকারে, অনন্যা শঙ্খের গায়ের চিহ্নগুলো আরও ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করলেন। তার ধারণা পরিষ্কার হয়ে উঠল—শঙ্খের আওয়াজ নিজেই একটি আহ্বান, যা মানুষের ভয়কে শক্তিতে রূপান্তরিত করছে। তিনি বুঝতে পারলেন যে, শঙ্খের প্রভাব একদিকে অদৃশ্য, কিন্তু প্রায়শই দৃশ্যমান মৃত্যুর ঘটনার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। তার বিশ্লেষণ সৌম্য এবং অরণ্যের জন্যও একটি নতুন দিক উন্মোচন করল—যদি এই শঙ্খটি ব্যবহার বন্ধ না করা হয়, তবে আরও মৃত্যুর পরিধি বৃদ্ধি পাবে। অনন্যা জানতেন যে, এটি কেবল একটি গবেষণামূলক বিশ্লেষণ নয়; এটি তাদের সবার নিরাপত্তার সঙ্গে সম্পর্কিত। শঙ্খের লিপি এবং তার অর্থ বোঝার সঙ্গে সঙ্গে গ্রামজুড়ে আতঙ্ক এবং মৃত্যুর কারণও আরও স্পষ্ট হয়ে উঠল। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, শঙ্খের গোপন শক্তি শুধুমাত্র জানা যায়নি, বরং তার মোকাবিলা করতে হবে—যদি না এভাবে প্রাচীন রহস্য এবং মানুষের জীবন এক অদ্ভুত বিপদে নিমজ্জিত হয়।

অধ্যাপক সৌম্য সেনগুপ্ত, যিনি এতদিন যুক্তি এবং বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের নামে সবকিছুকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছিলেন, এখন নিজের ভিতরের দ্বন্দ্বের কাছে অবাক হয়ে যাচ্ছিলেন। মাটির নিচ থেকে উদ্ধার হওয়া শঙ্খ এবং তার ধ্বনির কারণে ঘটে যাওয়া অদ্ভুত মৃত্যুর ঘটনা, তাঁর মনকে অচেনা ভয় এবং বিভ্রান্তির মধ্যে ফেলে দিয়েছিল। বিজ্ঞান তাকে বলে, “এ সব অযৌক্তিক। মৃত্যু বা অদ্ভুত ঘটনা কেবল পারস্পরিক সম্পর্কের ফল হতে পারে। কোনো অতিপ্রাকৃত শক্তি নেই।” কিন্তু যখন তিনি গ্রামের নতুন দুটি মৃত্যুর খবর শুনলেন, এবং অনুভব করলেন গ্রামের মানুষজনের চোখে ভয়ের ছাপ, তখন সৌম্যের যুক্তি তার নিজের শক্তিকে হারাতে লাগল। তিনি বুঝতে পারলেন, যে বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ তাঁর দীর্ঘ গবেষণার ভিত্তি, তা হয়তো এমন অদৃশ্য শক্তির মোকাবিলা করার জন্য যথেষ্ট নয়। সেই রাতের অন্ধকারে, গবেষণাগারের নিস্তব্ধতা, বাতাসের হালকা কম্পন, এবং শঙ্খের ধ্বনির মৃদু সাড়া—সবকিছু মিলিয়ে সৌম্যের মনে এক গভীর শঙ্কার সৃষ্টিকল।

এই দ্বন্দ্বের মাঝে সৌম্য সিদ্ধান্ত নিলেন শঙ্খটি লুকিয়ে রাখার। তিনি মনে করলেন, যদি এটি নিরাপদ স্থানে রাখা যায়, তবে হয়তো অদ্ভুত ঘটনার বিস্তার রোধ করা সম্ভব হবে। তাই তিনি শঙ্খকে একটি কুয়োর মধ্যে গোপন করলেন, যেখানে আলো বা মানুষের সরাসরি সংস্পর্শ নেই। কিন্তু ঠিক সেই সময়ে তিনি অনুভব করলেন, অদ্ভুত ছায়া যেন তাঁর পিছু ছাড়ছে না। গবেষণাগারের প্রতিটি কোণে, প্রতিটি কোণায় ছায়ার অদ্ভুত দোলন, হালকা কম্পন, এবং অচেনা ধ্বনি—সবকিছু সৌম্যের যুক্তিবাদী মনকে ধীরে ধীরে প্রভাবিত করতে শুরু করল। তিনি বুঝতে পারলেন, শুধু শঙ্খ লুকানো যথেষ্ট নয়; এর প্রভাব তার চারপাশের পরিবেশ এবং মানুষের মনেও প্রবেশ করছে। বিজ্ঞান তাকে বলছে, সবকিছু ব্যাখ্যা করা যায়, কিন্তু অভিজ্ঞতা তাকে অন্যভাবে বুঝাচ্ছে—যে অদৃশ্য শক্তি আছে, তা কেবল শঙ্খের মাধ্যমে নয়, বরং মানুষের ভয়কে ধরেও কার্যকর হচ্ছে।

রাত দীর্ঘ হতেই সৌম্যের দ্বন্দ্ব আরও গভীর হলো। তিনি নিজের যুক্তিবাদী চিন্তাকে শক্ত করার চেষ্টা করলেন, কিন্তু অদ্ভুত ছায়া, হঠাৎ শব্দ, এবং শঙ্খের উপস্থিতি তাকে থামিয়ে দিতে লাগল। তার মনে এক অদ্ভুত ভয় জন্ম নিল—যেন কোনো অদৃশ্য চোখ ক্রমশ তার দিকে তাকিয়ে আছে, এবং যে কোনো মুহূর্তে তা তার জীবনকে স্পর্শ করতে পারে। গ্রামবাসীর মৃত্যুর পরিধি, অরণ্য এবং অনন্যার আতঙ্ক, এবং শঙ্খের রহস্যময় শক্তি—সব মিলিয়ে সৌম্যকে তার স্বাভাবিক যুক্তি এবং বিশ্বাসের মধ্যে আটকে দিল। তিনি অনুভব করলেন, কখনও কখনও বিজ্ঞানও মানুষের সীমারেখা অতিক্রম করতে পারে না, এবং বাস্তবের সঙ্গে অতিপ্রাকৃত মিশে গেলে যুক্তির স্থান ক্ষীণ হয়ে পড়ে। শেষপর্যন্ত, সৌম্য বুঝতে পারলেন যে, তার দ্বন্দ্ব কেবল শঙ্খের কারণে নয়, বরং নিজের ভিতরের ভয় এবং অজানা শক্তির সামনে তার নিয়ন্ত্রণ হারানোর প্রতিফলন।

ঝড়ের রাতে গ্রামের আকাশে অন্ধকার ঘনিয়ে আসছিল। বজ্রপাত এবং বৃষ্টি যেন এক অদ্ভুত সঙ্গীতের মতো পরিবেশকে ঘিরে ধরেছিল। অরণ্য দত্ত, যিনি এতদিন পর্যন্ত যুক্তি এবং বাস্তবের প্রতি অটল ছিলেন, সেই রাতে নিজের কৌতূহলকে জয়ী করতে উদ্যত হলেন। তিনি মনে করলেন, “যদি আমি প্রমাণ করতে পারি যে এই শঙ্খের সব গল্প কেবল মিথ, তাহলে সকলের ভয়কে যৌক্তিক দৃষ্টিকোণ থেকে ভেঙে দিতে পারব।” তাই তিনি ধীরে ধীরে শঙ্খটি হাতে নিলেন এবং একটি একা নিঃশব্দ মুহূর্তে বাজাতে শুরু করলেন। প্রথম কয়েকটি সুর উচ্চস্বরে বাজতেই চারপাশে অদ্ভুত কম্পন ছড়িয়ে পড়ল। বাতাস ভারী হয়ে গেল, মাটির স্তর যেন কম্পিত হল, এবং ঝড়ের সাথে মিলিত আওয়াজে চারপাশে অদ্ভুত একটি সঙ্কেত সৃষ্টি হলো। অরণ্য নিজেই প্রথমবার অনুভব করলেন যে, শঙ্খের আওয়াজ কেবল শব্দ নয়; এটি যেন মাটির গভীর থেকে উঠে আসা একটি শক্তির আভাস, যা মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে তার চারপাশের পরিবেশকে বদলে দিতে সক্ষম।

হঠাৎ ঝড়ের আওয়াজের মধ্যে এক অদ্ভুত ছায়ামূর্তি তাঁবুর ভেতরে প্রবেশ করল। অরণ্যের চোখে প্রথমে বিশ্বাসে বাধা এল—ছায়া যেন মানুষ বা প্রাণীর মতো নয়, বরং এক অদৃশ্য এবং আতঙ্কময় শক্তির অবতার। তিনি চেষ্টা করলেন তাকাতে, কিন্তু তাঁর দৃষ্টিপাতে ছায়া ধীরে ধীরে ঘন হয়ে উঠল। বাতাসে বাজানো শঙ্খের শব্দের সঙ্গে মিলিত হয়ে এটি যেন অরণ্যের মনোবল এবং সংবেদনশীলতাকে চূর্ণ করে দিল। অরণ্য চিৎকার করতে চাইলেও শব্দ বের হয়নি; তার শরীর ক্রমশ অদ্ভুতভাবে স্থির হয়ে গেল। ঝড়ের মধ্যে, বজ্রপাতের আলোর সঙ্গে মিলিত এই ছায়া অরণ্যকে ধীরে ধীরে নিজের সঙ্গে নিয়ে গেল। কিছু মুহূর্তের মধ্যেই তিনি নিখোঁজ হয়ে গেলেন; তাঁর শরীর আর খুঁজে পাওয়া গেল না।

গ্রামে সেই রাতের পরিপ্রেক্ষিতে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল। গ্রামের মানুষজন, যারা আগে শুধু ফিসফিস করে শঙ্খের অভিশাপ নিয়ে আলোচনা করতেন, এখন সরাসরি দেখলেন যে, একটি প্রাচীন শক্তি সত্যিই তাদের মধ্য দিয়ে কাজ করছে। বৃষ্টি, বজ্রপাত, এবং ঝড়ের শব্দের সাথে মিলিত শঙ্খের ধ্বনি যেন গ্রামজুড়ে মৃত্যুর ছাপ ফেলল। কেউ কেউ চিৎকার করে বললেন, “অভিশাপ সত্যিই আমাদের গ্রামে নেমেছে। যে বাজায়, সে ধ্বংসের মুখে!” সৌম্য এবং অনন্যা, যারা এতদিন যুক্তিবাদে বিশ্বাস করতেন, তারা এখন বুঝতে পারলেন যে, শঙ্খ শুধুমাত্র একটি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন নয়, বরং এক অদৃশ্য শক্তির বহক। রাত শেষে ঝড় থামলেও গ্রামে নীরবতা ও ভয় নেমে এল। অরণ্যের অদ্ভুত নিখোঁজ হওয়া, শঙ্খের আওয়াজের রহস্যময় প্রভাব, এবং গ্রামের মানুষের আতঙ্ক—সব মিলিয়ে চূড়ান্ত রাতটি একটি অবিস্মরণীয় আতঙ্কের স্মৃতি হয়ে রইল, যা শঙ্কা, রহস্য এবং মৃত্যুর ছায়ায় গ্রামকে আবদ্ধ করেছিল।

গ্রামের মানুষজন দীর্ঘদিনের আতঙ্ক এবং মৃত্যুর ছায়ার মধ্যে নিঃশ্বাস ফেলছিল। অদ্ভূত ঘটনা, অরণ্যের অদ্ভুত নিখোঁজ হওয়া, এবং শঙ্খের রহস্যময় শক্তি—সবকিছু মিলিয়ে একটি গভীর সঙ্কট তৈরি করেছিল। সেই পরিস্থিতিতে অদ্বৈত গুহ, গ্রামের প্রাচীন পুরোহিত এবং শঙ্খের ইতিহাসে অভিজ্ঞ ব্যক্তি, সকলকে একত্রিত করলেন। তিনি জানালেন, শঙ্খকে আর মাটির নিচে ফিরিয়ে দেওয়া বা গোপন রাখা সম্ভব নয়। এটি একটি প্রাচীন যজ্ঞের শক্তি বহন করছে, যা মানুষের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে অতিরিক্ত ভয় এবং মৃত্যু ডেকে আনতে পারে। তাই তিনি নির্দেশ দিলেন যে শঙ্খটিকে আগুনে নিক্ষেপ করা হবে, যাতে তার শক্তি ধ্বংস হয়ে যায় এবং গ্রামে শান্তি ফিরে আসে। গ্রামের মানুষজন, যারা এতদিন আতঙ্কে ভুগছিল, শঙ্খটি ধ্বংসের সিদ্ধান্তে এক অদ্ভুত রকমের আশা দেখতে পেল। সৌম্য এবং অনন্যা এই কাজে উপস্থিত ছিলেন, হৃদয়ে এক মিশ্র অনুভূতি—একটি অংশে ভয়, অন্য অংশে স্বস্তি, এবং অবশেষে আশা যে সবকিছু শেষ হতে যাচ্ছে।

অদ্বৈতের নির্দেশে, একটি বড় আগুনের স্তূপ তৈরি করা হলো। শঙ্খটি কৌতূহলী এবং সতর্ক হাতে আগুনে ফেলা হলো। মুহূর্তের মধ্যেই আগুনের লালচে শিখায় ধাতু উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বাতাসে ধোঁয়ার সাথে মিলিত ধ্বনি এবং হালকা কম্পন ছড়িয়ে পড়ল। কিন্তু অদ্ভুতভাবে, ধীরে ধীরে চারপাশের বাতাস শান্ত হয়ে যেতে লাগল। ঝড়ের মত উত্তেজনা, ছায়ার অদ্ভুত দোলন, এবং আগের রাতের আতঙ্ক—সবই হঠাৎ থমকে গেল। গ্রামের মানুষজন মনে করল, অবশেষে অভিশাপের শেষ হয়েছে। সবাইকে যেন এক অদ্ভুত স্বস্তি ভর করে দিল। অরণ্য নিখোঁজ হওয়ার ভয়, গ্রামের মৃত্যুর পরিধি, এবং শঙ্খের ধ্বনির জটিলতা— এই অনুভূতি যেন হঠাৎ ফিকে হয়ে গেছে। সৌম্যও ধীরে ধীরে বিশ্বাস করতে লাগলেন যে, ইতিহাস এবং কিংবদন্তির সঙ্গে যুক্ত এই ধাতব নিদর্শন কেবল একটি বিপদজনক অঙ্গ ছিল, যা ধ্বংসের পর আর মানুষের ওপর প্রভাব ফেলতে পারবে না।

কিন্তু অনন্যা মুখার্জী, যিনি শঙ্খের লিপি এবং অতীতের রহস্যগুলোর বিশ্লেষণ করেছিলেন, শেষ দৃশ্যে কিছু লক্ষ্য করলেন যা অন্যদের চোখে পড়েনি। আগুনে ফেলা শঙ্খটি সম্পূর্ণভাবে পুড়ে যায়নি। আগুনের মধ্যেও ক্ষীণভাবে কিছু অংশ অক্ষত থেকে গেছে। আর সেই অংশ থেকে শুনতে পাচ্ছিলেন ক্ষীণ শব্দ—এক ফিসফিস, যা অল্প অল্প করে বলছিল: “আহ্বান এখনও শেষ হয়নি…” অনন্যার হৃদয় দ্রুত ধাক্কা খেল। তিনি বুঝতে পারলেন যে, অভিশাপের সমাপ্তি কেবল একটি ছায়া, এবং শঙ্খের শক্তি এখনও ঘুমোচ্ছে, অপেক্ষা করছে পুনরায় জাগরণের জন্য। সৌম্য এবং অন্যান্যরা শান্ত মনে করে ফিরলেও, অনন্যার চোখে এক অদ্ভুত সতর্কতা জন্ম নিল। তিনি জানতেন, গ্রামে যে অতীতের রহস্য এবং মৃত্যুর ছায়া ছিল, তা হয়তো একদিন আবার ফিরে আসবে। সমাপ্তি হয়তো ঘটে গেছে, কিন্তু শঙ্খের অদৃশ্য আহ্বান—যা এখনও ক্ষীণভাবে ফিসফিস করছে—প্রমাণ দিচ্ছে যে সত্যিকার যুদ্ধ, রহস্য এবং ভয় এখনও শেষ হয়নি। সেই রাতের শেষ মুহূর্তে অনন্যার মনে হলো, এ গল্পের প্রকৃত সমাপ্তি নয়; এটি কেবল একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা, যেখানে মানব কৌতূহল, আতঙ্ক, এবং প্রাচীন শক্তির মধ্যে সম্পর্ক চিরকাল ধরে থাকবে।

____

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *