অনিন্দিতা ঘোষ পাল
১
প্রান্তি ছিল গ্রামের একেবারে সাধারণ মেয়ে। কাঁচা মাটির ঘর, উঠোনে মাটির চুলা, আর সারাদিন খাটুনি খাটা বাবা-মা—এই ছিল তার বেড়ে ওঠার পরিবেশ। তবে তার মধ্যে এক অন্য রকম প্রাণ ছিল। চারপাশের মেয়েরা যখন মাঠের ধারেই লাজুক হয়ে বসে থাকত বা পুতুল নিয়ে খেলত, তখন প্রান্তি ছেলেদের সঙ্গে দৌড়ঝাঁপ করতে বেশি ভালোবাসত। স্কুল থেকে ফিরে বইখাতা ফেলে দিয়ে ছুটে যেত পাড়ার মাঠে। সেখানে ফুটবল খেলছিল বড় ছেলেরা, তার চোখে পড়ল বলটা কীভাবে এপাশ-ওপাশ দৌড়চ্ছে, ছেলেরা কেমন মন দিয়ে তাড়া করছে। প্রথমবারের মতো তার মনে হল, “এই খেলাটার মধ্যে যেন এক যাদু আছে।” মনে হল, ফুটবলের ওই গোল বলটার ভেতরেই পৃথিবীর সব আনন্দ লুকিয়ে আছে। তার পা যেন নিজে থেকেই ছুটে যেতে চাইছিল, সে চাইলেও থামাতে পারল না।
প্রথমে ছেলেরা তাকে পাত্তা দিল না। “মেয়েরা আবার ফুটবল খেলবে নাকি?”—এমন কথা শুনে প্রান্তির বুক কেঁপে উঠেছিল। তবুও সে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল না। মাঠের এক কোণে পড়ে থাকা ছেঁড়া বলটা তুলে নিয়ে আস্তে আস্তে নিজেই কিক মারতে শুরু করল। বলটা যখন একটু দূরে গড়িয়ে যেত, সে ছুটে গিয়ে আবার মারত। সূর্য ডুবে লালচে আলো পড়ার সময়ও সে খেলা থামাত না। তার চোখে-মুখে যে আনন্দ ঝলমল করত, তা দেখে মাঠের ছেলেদেরও কৌতূহল হচ্ছিল। তারা মজা করে বলত, “এই তো দেখি, ফুটবলার মেয়েটা আসছে।” প্রান্তি এসব কথা শুনত, কিন্তু পাত্তা দিত না। তার ভেতরে এক অদম্য টান তৈরি হচ্ছিল—যা তাকে বল আর মাঠ থেকে আলাদা করতে পারছিল না।
কয়েকদিন এভাবে খেলার পর, একদিন সে সাহস করে ছেলেদের মূল খেলায় ঢুকে পড়ল। প্রথমে ছেলেরা প্রতিবাদ করল, বলল, “তুই গিয়ে পুতুল নিয়ে খেলা কর।” কিন্তু প্রান্তি থামল না। বলটা যখন তার পায়ের কাছে এলো, তখন সে জোরে লাথি মারল আর অবাক হয়ে দেখল বলটা সোজা গোলের দিকে গড়িয়ে যাচ্ছে। সবাই হতবাক! কেউই ভাবেনি, একটা মেয়ে এভাবে বল মারতে পারে। যদিও গোল হলো না, তবু মুহূর্তটা তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিল। সেই সময় তার শরীর কাঁপছিল, কিন্তু বুকের ভেতর ছিল এক অজানা উচ্ছ্বাস। সে বুঝে গেল—এটাই তার খেলা, এটাই তার স্বপ্ন। আর সেই স্বপ্ন এত সহজে ছেড়ে দেওয়ার মতো নয়।
এরপর থেকে প্রান্তির দিনচর্যা পাল্টে গেল। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত তার মাথায় শুধু ফুটবল ঘুরপাক খেত। স্কুলে পড়ার ফাঁকেও খাতার পাতায় আঁকত বলের ছবি। মাঠে গেলে ছেলেরা কখনও তাকে নিয়ে হাসাহাসি করত, কখনও অবহেলা করত, কিন্তু সে সেসবকে আর গুরুত্ব দিত না। তার চোখে তখন শুধু ছিল সেই গোল বলটা, যেটা যেন তাকে ডাকছিল। এক অদ্ভুত কৌতূহল তাকে গ্রাস করেছিল—সে জানতে চাইত কেমন করে বলটা আকাশে উঠে আবার মাটিতে নামে, কেমন করে একটা টিম মিলে খেললে জেতা যায়। ধীরে ধীরে তার ভেতরে জন্ম নিল এক অদম্য আগ্রহ, যা তাকে অন্য সব মেয়েদের থেকে আলাদা করল। সেই ছোট্ট গ্রামে, যেখানে মেয়েদের জীবন কেবল সংসার আর রান্নাঘরে আটকে থাকে, সেখানে প্রান্তি বুঝতে শুরু করল—তার পৃথিবী অনেক বড়, আর সেই পৃথিবী তাকে পায়ের নিচে বল নিয়ে জয় করতে হবে।
২
প্রথম কয়েকদিন ছেলেদের সঙ্গে প্রান্তির মাঠে যাওয়া কেবল কৌতূহলেই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে তা অভ্যাসে পরিণত হলো। প্রতিদিন বিকেলে স্কুল ছুটি হয়ে গেলে বা বাড়ির কাজ শেষ করার পর সে দৌড়ে মাঠে চলে যেত। সেখানে বলের পিছু ছুটতে ছুটতে সময় কেটে যেত। তবে তার এই খেলা চোখ এড়াল না গ্রামের মানুষদের। মাঠের পাশ দিয়ে যে সব মহিলা বা বয়স্ক লোকজন যেত, তারা কপাল কুঁচকে তাকাত। কেউ ফিসফিস করে বলত, কেউ আবার প্রকাশ্যেই বলে ফেলত, “মেয়েরাও আবার ফুটবল খেলতে যায় নাকি? এ সব কি মানায়?” প্রান্তি প্রথমদিকে এসব কথায় ভেঙে পড়ত, কিন্তু পরে নিজের কান বন্ধ করার মতো শক্তি খুঁজে পেল। তবে গ্রামের গোঁড়ামি তাকে ছাড়ল না। ধীরে ধীরে সেই সমালোচনা বেড়ে গিয়ে তার বাবা-মায়ের কানেও পৌঁছে গেল।
গোপাল, প্রান্তির বাবা, সারাদিন মাঠে কাজ করে ক্লান্ত হয়ে ঘরে ফিরতেন। গ্রামবাসীর নানা মন্তব্য শুনতে শুনতে তার মাথা গরম হয়ে উঠল। এক সন্ধ্যায় তিনি রাগে-গলায় ডাকলেন, “প্রান্তি! তোকে কতবার বলেছি, ছেলেদের সঙ্গে খেলতে যাস না। মেয়েমানুষের এসব মানায় না।” প্রান্তি ভয়ে কেঁপে উঠল, কিন্তু সাহস করে বলল, “বাবা, আমি তো শুধু বলটা নিয়ে খেলি, এতে দোষ কী?” গোপাল আরও ক্ষেপে গিয়ে উত্তর দিলেন, “দোষ নেই? গ্রামে সবাই বলছে, আমার মেয়ে নাকি ছেলেদের সঙ্গে মাঠে গিয়ে লাফায়-ঝাঁপায়! মানুষের মুখ বন্ধ করতে পারবি?” তার কণ্ঠে ক্ষোভের সঙ্গে সঙ্গে এক অদ্ভুত অসহায়তাও ছিল। তিনি আসলে মেয়ে খেলছে বলে কষ্ট পাননি, বরং সমাজের কথার ভার তাকে চেপে ধরেছিল।
গ্রামের মহিলারাও ছাড়েনি। তারা সুবর্ণা, প্রান্তির মায়ের কানে কানে নানা কথা বলত। কেউ বলত, “তোমার মেয়ে তো একেবারে ছেলেদের মতো হয়ে যাচ্ছে।” আবার কেউ বলত, “মেয়েকে সামলাও, না হলে কালকে মানুষজন আঙুল তুলবে।” সুবর্ণা মমতাময়ী মা হলেও সমাজের ভয়ে তিনি অস্থির হয়ে পড়তেন। একদিন রান্না করতে করতে তিনি প্রান্তিকে বললেন, “মা, খেলাধুলা মন্দ নয়, কিন্তু সবাই তো ভালো চোখে দেখে না। তুই একটু সাবধানে খেলবি, ঠিক আছে?” প্রান্তি মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু বলল না। তার মনে হচ্ছিল, মা-বাবা তাকে বোঝে না। সে খেলায় যে আনন্দ খুঁজে পায়, যে মুক্তির স্বাদ পায়, তা বোঝানো তার পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ছিল।
ধীরে ধীরে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠল। গ্রামের কাকা-চাচারা চায়ের দোকানে বসে বলাবলি করত, “এখন তো মেয়েরা ছেলেদের মাঠ দখল করে নিচ্ছে, কালকে না আবার ছেলেদের মতো আচরণ শুরু করে।” এসব কথা কানে এলে প্রান্তির বুক ধকধক করত, কিন্তু চোখে জল আসত না। বরং এক ধরনের অদ্ভুত জেদ তৈরি হতে লাগল—সে ভাবতে লাগল, “আমি যদি খেলা না করি, তবে আমি নিজেকে মিথ্যে প্রমাণ করব। আমি যদি লড়াই করি, তবে হয়তো একদিন সবাই বুঝবে।” তবে তখনও তার বয়স অল্প, সমাজের এই চোখরাঙানি কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে, তা পুরোপুরি বুঝতে পারেনি। কিন্তু ভেতরে ভেতরে এক কিশোরীর মনে নতুন এক বিদ্রোহ জন্ম নিচ্ছিল—যে বিদ্রোহ তাকে ধীরে ধীরে তার স্বপ্নের পথে এগিয়ে নিয়ে যাবে, যত বাধাই আসুক না কেন।
৩
সন্ধ্যা নামলে প্রান্তির বাড়ি যেন আরও নীরব হয়ে উঠত। মাঠ থেকে ফিরে এসে সে বসত উঠোনে, চুপচাপ, ভাঙা বলটা বুকে চেপে। সারাদিনের খেলাধুলার আনন্দ তখনও তার শরীরে লেগে থাকত, কিন্তু বাবার রাগী মুখ আর গ্রামের মানুষের কটুকথা সেই আনন্দকে গ্রাস করত। বুকের ভেতরে হাহাকার জমা হতো—সে কেন শুধু মেয়ে বলে খেলার অধিকার হারাবে? সেই সময় সুবর্ণা, তার মা, নিঃশব্দে তার পাশে এসে বসতেন। হাতের তালু দিয়ে মেয়ের চুলে হাত বুলিয়ে দিতেন। তিনি সমাজের কথায় ভীত ছিলেন, কিন্তু মেয়ের স্বপ্নের আলো তিনি স্পষ্টই দেখতে পাচ্ছিলেন। প্রান্তির দৃষ্টি যখন দূরের অন্ধকারে স্থির হতো, সুবর্ণা মৃদু স্বরে বলতেন, “মন খারাপ করিস না মা, সব স্বপ্নই সহজে পূরণ হয় না।” তার সেই নরম গলায় লুকানো স্নেহে প্রান্তি কিছুটা হলেও স্বস্তি খুঁজে পেত।
এক রাতে বাবার সঙ্গে ঝগড়ার পর প্রান্তি কাঁদতে কাঁদতে ঘরের কোণে বসেছিল। গোপাল কঠোর ভাষায় বকেছিলেন, যেন তার খেলাধুলা পুরো পরিবারকে লজ্জায় ফেলে দিচ্ছে। সুবর্ণা তখন চুপচাপ রান্না শেষ করে মেয়ের পাশে এসে বসেন। কিছুক্ষণ কিছু না বলে তিনি মেয়ের কাঁধে হাত রাখেন। প্রান্তি ফুঁপিয়ে উঠে বলে, “মা, আমি কি তবে কিছুই করতে পারব না? আমি কি শুধু রান্না-সংসারেই বন্দি থাকব?” সুবর্ণা প্রথমে চুপ থাকেন, যেন ভেতরে ভেতরে সাহস জড়ো করছেন। তারপর ধীরে ধীরে বলেন, “দেখ প্রান্তি, মেয়েদের জন্য পথ সবসময়ই কঠিন হয়। কিন্তু কঠিন পথেই মানুষ সত্যিকারের শক্তি খুঁজে পায়। যদি তোর মনে সত্যিই ফুটবল খেলার স্বপ্ন থাকে, তবে তোকে লড়াই করতেই হবে। সমাজ কি বলছে, তা নিয়ে ভাবলে স্বপ্ন কোনোদিন পূরণ হয় না।” সেই প্রথমবার প্রান্তির মনে হল, কেউ আছে যে তাকে বুঝতে পারে, তার মায়ের চোখের ভেতরে সে এক নীরব সাহস দেখতে পেল।
এরপর থেকে সুবর্ণা গোপনে মেয়েকে সাহস দিতে লাগলেন। গোপাল রাগারাগি করলে তিনি মাঝেমধ্যেই তাকে বোঝানোর চেষ্টা করতেন, যদিও সবসময় সফল হতেন না। তবে মেয়ের পাশে দাঁড়াতে তিনি কখনও কুণ্ঠিত হননি। প্রান্তি মাঠ থেকে ফিরে এলে মা তাকে জিজ্ঞাসা করতেন, “আজ কটা গোল দিলি?” মায়ের এই প্রশ্নে তার ভেতরের সব দুঃখ যেন গলে যেত। এমনকি কখনও কখনও তিনি মেয়ের জন্য লুকিয়ে পুরোনো কাপড় দিয়ে বল বানিয়ে দিতেন, যাতে প্রান্তি বাড়ির আঙিনায়ও অনুশীলন করতে পারে। প্রতিবেশীরা এসব টের পেলে খারাপ কথা বলবে জেনেও, তিনি থামেননি। কারণ তিনি জানতেন, প্রান্তির হাসির মধ্যেই তার নিজের বেঁচে থাকার মানে লুকিয়ে আছে।
মায়ের এই নীরব সমর্থন ধীরে ধীরে প্রান্তিকে ভেতর থেকে শক্ত করে তুলল। আগে সে সমাজের চোখরাঙানি শুনে ভেঙে পড়ত, বাবার রাগী চাহনিতে ভয় পেত। কিন্তু এখন সে বুঝতে শুরু করল, তার মায়ের মতো কেউ একজন যদি পাশে থাকে, তবে পৃথিবীর হাজারটা বাঁধাও তাকে দমাতে পারবে না। একদিন সন্ধ্যায়, মা যখন মাটির চুলায় রুটি সেকছিলেন, প্রান্তি হঠাৎ মাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “মা, আমি একদিন খেলোয়াড় হব। আমি প্রমাণ করব যে মেয়েরাও পারে।” সুবর্ণা চুপচাপ মেয়ের কপালে চুমু খেয়ে বললেন, “হ্যাঁ মা, তুই পারবি। শুধু ভয় পেলে চলবে না।” সেই কথাগুলো যেন প্রান্তির বুকের ভেতরে বজ্রপাতের মতো বাজল, আর তাকে দিল নতুন শক্তি। তখনই সে প্রতিজ্ঞা করল—যত বাধাই আসুক, স্বপ্নের পিছু সে ছাড়বে না, কারণ মায়ের বিশ্বাসই তার আসল জ্বালানি।
৪
গ্রামের মাঠে প্রতিদিন বিকেলে যেমন ভিড় জমত, তেমনি এক কোণে দাঁড়িয়ে থাকতেন রহিম কাকা। বয়স পঞ্চাশ পেরিয়েছে, চেহারায় বয়সের ছাপ স্পষ্ট, তবে চোখে এখনো এক অদ্ভুত দীপ্তি। ছোটবেলায় তিনি নিজেও ফুটবল খেলতেন, এমনকি জেলার হয়ে নাম করবার সুযোগও এসেছিল, কিন্তু দরিদ্র সংসারের টানে ও বাবার অকালমৃত্যুর কারণে সব ছেড়ে দিতে হয়েছিল। সেই থেকে তিনি মাঠে বসে অন্যদের খেলা দেখেই সন্তুষ্ট থাকতেন। গ্রামের ছেলেরা তাকে খুব সম্মান করত, কারণ ফুটবল নিয়ে তার জ্ঞান অনেক গভীর ছিল। প্রান্তি যখন ছেলেদের সঙ্গে মাঠে নামা শুরু করল, তখন থেকেই রহিম কাকার চোখ তার উপর পড়ল। প্রথমে ভেবেছিলেন, এও হয়তো কৌতূহলবশত খেলা করছে, কিছুদিন পর নিজেই সরে যাবে। কিন্তু দিন যত গড়াল, তিনি লক্ষ্য করলেন—এই মেয়েটার চোখে অন্যরকম তৃষ্ণা আছে। অন্য ছেলেরা যখন খেলায় ঢিলেমি করে, তখন প্রান্তি অদ্ভুত মনোযোগ দিয়ে খেলছে।
একদিন খেলার পর প্রান্তি যখন একা মাঠে থেকে গেল, পুরোনো ছেঁড়া বলটা নিয়ে কিক মারার অনুশীলন করছিল, রহিম কাকা এগিয়ে এলেন। তিনি কিছুক্ষণ নীরবে মেয়েটিকে দেখলেন, তারপর বললেন, “তোর পায়ে জোর আছে রে, জানিস?” প্রান্তি অবাক হয়ে তাকাল। গ্রামে এর আগে কেউ তার খেলাকে এভাবে স্বীকৃতি দেয়নি। লজ্জা পেয়ে বলল, “কাকা, আমি তো স্রেফ খেলি। কিছু জানি না।” রহিম কাকা হেসে বললেন, “এই খেলা কেবল বল মারার নয়, এটার নিয়ম-কানুন আছে, কৌশল আছে। তুই চাইলে আমি তোকে শিখিয়ে দিতে পারি।” প্রান্তির চোখে বিস্ময় আর আনন্দ একসাথে ফুটে উঠল। এতদিন সে কেবল নিজের ইচ্ছেমতো দৌড়াত, বল মারত, কিন্তু কেউ যে তাকে গাইড করতে পারে, তা ভাবেনি। সে মাথা নাড়ল, “শিখতে চাই কাকা, খুব চাই।” রহিম কাকা তার চোখের ভেতরে সেই ক্ষুধা চিনে ফেললেন—এটা আর পাঁচটা শিশুর মতো খেলাধুলার শখ নয়, এটা সত্যি এক স্বপ্নের শুরু।
এরপর থেকে শুরু হলো এক গোপন অধ্যায়। প্রতিদিন ভোরবেলা, যখন গ্রাম এখনো ঘুমিয়ে থাকে, প্রান্তি চুপিসারে ঘর থেকে বেরিয়ে মাঠে যেত। সেখানে রহিম কাকা অপেক্ষা করতেন হাতে এক পুরোনো বল নিয়ে। তিনি তাকে শেখাতেন কীভাবে ঠিকমতো পাস দিতে হয়, কীভাবে ড্রিবল করতে হয়, কীভাবে শরীরের ভারসাম্য রাখতে হয়। প্রান্তি ঘেমে একেবারে ভিজে যেত, হাঁপাতে হাঁপাতে মাটিতে বসে পড়ত, তবু থামত না। তার চোখে তখন শুধু একটাই লক্ষ্য—আরও ভালো খেলা। রহিম কাকা মাঝে মাঝে তার পায়ের দিকে তাকিয়ে বিস্মিত হতেন, এত দ্রুত শেখার ক্ষমতা আর এত দৃঢ়তা তিনি গ্রামের কোনো ছেলের মধ্যেও পাননি। তিনি জানতেন, সমাজের বাধা সহজ হবে না, কিন্তু ভেতরে ভেতরে তিনি ঠিক করেছিলেন—এই মেয়েটিকে তিনি হারাতে দেবেন না।
দিন যেতে যেতে রহিম কাকা হয়ে উঠলেন প্রান্তির পথপ্রদর্শক, একজন গুরু, যিনি শুধু খেলার কৌশলই নয়, মানসিক শক্তিও শেখালেন। তিনি প্রায়ই বলতেন, “শুধু মাঠে খেলে জেতা যায় না রে প্রান্তি, মাথার ভেতরেও জেতা লাগে। মানুষ তোকে নিয়ে হাসবে, বিদ্রূপ করবে, তুই যদি ওদের কথায় কাঁপিস, তবে খেলোয়াড় হবি না। খেলোয়াড়ের সবচেয়ে বড় শক্তি হলো আত্মবিশ্বাস।” প্রান্তি মন দিয়ে প্রতিটি কথা মনে রাখত। সমাজ তখনও তার দিকে কটুকাটুভাবে তাকাত, বাবা মাঝে মাঝে বকাঝকা করতেন, কিন্তু রহিম কাকার প্রতিটি সকালবেলার প্রশিক্ষণ তার ভেতরের আগুনকে আরও জ্বালিয়ে তুলত। প্রান্তি বুঝতে শুরু করল, সে আর একা নেই—তার পাশে একজন আছে, যিনি তার স্বপ্নকে সত্যি করার প্রথম আলো দেখিয়েছেন। এবং সেই আলো তাকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট।
৫
মনির ছিল প্রান্তিরই সমবয়সী, একই স্কুলের ছাত্র। তবে মনিরের স্বভাবটা ছিল দুষ্টুমি আর আত্মবিশ্বাসে ভরা। গ্রামের ছেলেদের মধ্যে সে ভালো খেলোয়াড় হিসেবে পরিচিত ছিল। মাঠে নামলেই সবাই চিৎকার করে উঠত, “মনির বলটা নে, গোল কর।” সেই সুনামই তাকে মনে মনে গর্বিত করে তুলেছিল। তাই যখন দেখল প্রান্তি প্রতিদিন মাঠে এসে খেলার চেষ্টা করছে, তখন সে তা মোটেই ভালো চোখে নেয়নি। প্রায়ই হেসে বলত, “মেয়েরাও আবার ফুটবল খেলতে নামে নাকি? তুই তো গোলমেলে হয়ে যাচ্ছিস।” অন্য ছেলেরা হেসে উঠত, প্রান্তি চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকত। তার চোখেমুখে কষ্ট ফুটে উঠলেও মনির তা পাত্তা দিত না। তার বিশ্বাস ছিল, মেয়েরা কখনও ছেলেদের সঙ্গে খেলতে পারবে না। ফুটবল তার কাছে ছেলেদের গর্ব, আর প্রান্তি যেন সেই গর্বের জায়গায় চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছে।
এক বিকেলে স্কুল শেষে বড় ম্যাচের আয়োজন হয়েছিল। গ্রামের ছেলেরা দুই দলে ভাগ হয়ে খেলতে নামল। প্রান্তি সেদিন দর্শক হয়ে মাঠের পাশে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু খেলা চলাকালীন হঠাৎ বলটা গড়িয়ে এসে তার পায়ের সামনে পড়ল। মুহূর্তের জন্য মাঠ থমকে গেল। সবার চোখে অবাক দৃষ্টি—“এবার দেখো কী করে!” মনিরও দূর থেকে তাকিয়ে ছিল। প্রান্তি যেন এক অদৃশ্য শক্তিতে ভর করে বলটাকে নিয়ন্ত্রণে নিল। দৌড়াতে দৌড়াতে ড্রিবল করতে করতে সে সরাসরি গোলপোস্টের দিকে ছুটল। প্রতিপক্ষের দুই ছেলেকে কাটিয়ে হঠাৎই সে জোরে লাথি মারল। বলটা বাতাস কেটে গোলপোস্টের ভেতরে ঢুকে গেল। মুহূর্তেই মাঠে এক ধরনের স্তব্ধতা নেমে এলো। তারপর সবাই একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল। মনির হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তার চোখে পড়ল প্রান্তির মুখে সেই আত্মবিশ্বাসের দীপ্তি, যা সে কখনও কোনো মেয়ের মধ্যে দেখেনি।
সেই দিন থেকেই মনিরের ভেতরে বদল আসতে শুরু করল। প্রথমে নিজের অহংকারে আঘাত পেয়েছিল, ভাবছিল, “আমি কি এতটাই খারাপ খেলেছি যে এক মেয়ে আমাকে হারিয়ে দিল?” কিন্তু রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তার মধ্যে অন্যরকম অনুভূতি জন্ম নিল। সে বুঝতে পারল, প্রান্তি শুধু শখের বশে খেলছে না, সে সত্যিই খেলাটা বোঝে এবং খেলাটাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য লড়ছে। পরদিন মাঠে যখন প্রান্তি এল, মনির আর আগের মতো হাসাহাসি করল না। বরং খেলা শুরুর আগে কাছে গিয়ে বলল, “তুই খেলতে জানিস বটে। কাল তো দারুণ গোল দিলি।” প্রান্তি অবাক হয়ে তাকাল। এতদিন যে ছেলেটা তাকে নিয়ে বিদ্রূপ করেছে, সে আজ প্রশংসা করছে! ধীরে ধীরে দু’জনের মধ্যে দূরত্ব কমতে লাগল। মনির মাঝেমধ্যেই তাকে বল পাস করতে লাগল, কখনও কৌশল শেখাতে লাগল।
দিনের পর দিন তাদের প্রতিযোগিতা বন্ধুত্বে রূপ নিল। মাঠে তারা যেন দু’জন প্রতিদ্বন্দ্বী, একে অপরকে হারিয়ে দিতে চায়; কিন্তু মাঠের বাইরে তারা হয়ে উঠল একে অপরের ভরসা। প্রান্তি তার ভেতরের ভয়, সমাজের বাঁধা—সব কিছু শেয়ার করত মনিরের সঙ্গে। মনির তখন বলত, “তুই খেলতে থাক, বাকি আমি দেখব। একদিন গ্রামের সবাই বুঝবে।” মনিরের এই সমর্থন প্রান্তির আত্মবিশ্বাস আরও বাড়িয়ে দিল। আর মনির নিজেও বুঝল, প্রতিভার কোনো লিঙ্গ নেই—মেয়েরাও চাইলে মাঠে সমানভাবে লড়তে পারে। সে ধীরে ধীরে প্রান্তির জন্য ঢাল হয়ে দাঁড়াল। যখনই কেউ খোঁচা দিত, সে সামনে এসে বলত, “প্রান্তি আমাদের দলে আছে, আর ও সেরা খেলোয়াড়।” এভাবেই একসময়ের প্রতিদ্বন্দ্বী মনির, হয়ে উঠল প্রান্তির সবচেয়ে কাছের বন্ধু এবং সহযোদ্ধা, যে তাকে স্বপ্নের পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করবে।
৬
শীতের ভোরে গ্রামের স্কুলের মাঠে বড় আয়োজন চলছিল। আন্তঃগ্রাম ফুটবল প্রতিযোগিতা—এমন একটা দিন, যার জন্য আশেপাশের গ্রামের ছেলেরা বছরের পর বছর অপেক্ষা করত। ছোট ছোট বাঁশের খুঁটি গেঁড়ে সাজানো হয়েছিল মাঠ, চারপাশে ঝোলানো হয়েছিল রঙিন পতাকা। দর্শক আসনের মতো জায়গায় জড়ো হতে লাগল গ্রামের মানুষ। চায়ের দোকান থেকে শুরু করে বাজারের আড্ডা—সবখানেই আলোচনার বিষয় একটাই, কোন দল জিতবে আর কোন ছেলের গোল সবচেয়ে আলোড়ন তুলবে। এই প্রতিযোগিতায় মেয়েদের অংশগ্রহণের নিয়ম ছিল না, কিন্তু প্রান্তির স্কুলের ক্রীড়া শিক্ষক যখন তার খেলা দেখলেন, তখন আর আটকাতে পারলেন না। অনেক ঝামেলার পর অবশেষে তাকে দলে নেওয়া হলো, যদিও এর বিরোধিতা ছিল তীব্র। অনেকে সরাসরি বলল, “ছেলেদের প্রতিযোগিতায় মেয়েকে নামালে স্কুলের নাম খারাপ হবে।” কিন্তু প্রান্তির অদম্য ইচ্ছে, রহিম কাকার গোপন প্রশিক্ষণ আর মনিরের সমর্থন—এসব মিলে তাকে সেই সুযোগ এনে দিল।
প্রথম ম্যাচের দিন মাঠে নামার আগে প্রান্তির বুক ধুকপুক করছিল। চারপাশ থেকে ফিসফিসানি শোনা যাচ্ছিল—“দেখো, মেয়ে নেমেছে! এখন হাসির খোরাক হবে।” কেউ কেউ আবার ঠাট্টা করে বলছিল, “একটা ধাক্কা খেলে কেঁদে চলে যাবে।” এই সব মন্তব্য তার কানে আসছিল, কিন্তু আজ সে ভাঙল না। চোখ বন্ধ করে মনে মনে মায়ের সেই কথাটা আওড়ে নিল—“মনে যদি স্বপ্ন থাকে, তাতে লড়াই করতেই হয়।” বাঁশির শব্দ হতেই খেলা শুরু হলো। শুরুতে তার পা কাঁপছিল, কিন্তু বলটা পায়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে ভয় কেটে গেল। রহিম কাকার শেখানো ড্রিবল, পাস, দৌড়—সব যেন স্বতঃস্ফূর্তভাবে বেরিয়ে এলো। মাঠের দর্শকরা অবাক হয়ে দেখল, এই ছোট্ট মেয়েটি কেমন দক্ষতার সঙ্গে ছেলেদের ফাঁকি দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। প্রথমার্ধেই সে দুর্দান্ত এক শট নিল, বলটা গোলপোস্টের একেবারে উপরের কোণে গিয়ে লাগল। গোলরক্ষক কিছুই করতে পারল না। মাঠে মুহূর্তের জন্য নীরবতা, তারপর চারদিক থেকে বিস্ময়ের গুঞ্জন।
প্রান্তির সেই গোল যেন পুরো ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দিল। যারা এতক্ষণ তাকে নিয়ে হাসাহাসি করছিল, তারা এখন চুপ করে গেল। প্রতিপক্ষ দলও হঠাৎ চাপ অনুভব করতে শুরু করল। মনির দৌড়ে এসে তাকে হাত চাপড়ে বলল, “দারুণ খেললি, চালিয়ে যা।” দ্বিতীয়ার্ধে আরও আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠল প্রান্তি। বল দখলের লড়াইয়ে সে ছেলেদের মতোই শক্তি আর গতি দেখাল। দর্শক আসনে বসা মহিলারাও অবাক হয়ে একে অপরের দিকে তাকালেন। গ্রামের বাচ্চারা খুশিতে হাততালি দিতে লাগল। খেলার শেষদিকে প্রতিপক্ষ দল সমতায় ফিরতে চেষ্টা করলেও প্রান্তির নেতৃত্বে তার দল জয়ের মুখ দেখল। ম্যাচ শেষ হতেই মাঠে ছুটে এল ছোট ছোট ছেলেরা, তারা প্রান্তির নাম ধরে চিৎকার করতে লাগল। সেই মুহূর্তে প্রান্তির চোখ ভিজে গেল, কিন্তু এবার আনন্দে।
তবে এই জয় শুধু এক ম্যাচের জয় ছিল না—এটা ছিল সমাজের চোখে প্রথম ধাক্কা। গ্রামপ্রধান ও কিছু রক্ষণশীল মানুষ মুখ গোমড়া করে মাঠ ছাড়লেন, কিন্তু তারা আর আগের মতো করে প্রান্তিকে উপহাস করতে পারলেন না। রহিম কাকা দূর থেকে দাঁড়িয়ে সব দেখছিলেন, তার চোখে গর্বের ঝিলিক। গোপাল, প্রান্তির বাবা, দর্শকের ভিড়ের মধ্যে ছিলেন; তিনি মুখে কিছু বললেন না, তবে ভেতরে ভেতরে কেমন যেন গর্ব আর দ্বিধার মিশ্রণ খেলে গেল। প্রান্তি বুঝল, তার পথ এখনও সহজ হবে না—সমাজের বাধা, পরিবারের দ্বিধা, সবই রয়ে গেছে। কিন্তু আজকের জয় তাকে প্রমাণ করে দিল, যদি সাহস নিয়ে মাঠে নামা যায়, তবে স্বপ্ন কোনোদিন অচিন্তনীয় থাকে না। প্রথম প্রতিযোগিতায় তার এই সাফল্য যেন নতুন এক অধ্যায়ের দরজা খুলে দিল, যেখানে প্রতিটি পা তাকে তার স্বপ্নের আরও কাছে নিয়ে যাবে।
৭
প্রথম প্রতিযোগিতার সেই জয়ের আনন্দটুকু বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। খেলা শেষ হওয়ার কিছুক্ষণ পরেই গ্রামের প্রান্তে বসা মাচায় ডেকে পাঠানো হলো প্রান্তিকে। চারপাশে জড়ো হয়েছিল গ্রামপ্রধান, কিছু রক্ষণশীল কাকা-চাচা আর কয়েকজন মহিলাও। সবাই গম্ভীর মুখে তাকিয়ে ছিল তার দিকে। প্রান্তি ভেবেছিল হয়তো তার খেলার প্রশংসা করা হবে, হয়তো গ্রামের ছেলে-মেয়েরা তাকে উদাহরণ হিসেবে দেখবে। কিন্তু যা ঘটল তা একেবারেই উল্টো। গ্রামপ্রধান চশমা নামিয়ে কড়া গলায় বললেন, “তুই কি ভাবিস, মেয়ে হয়ে ছেলেদের মতো মাঠে নামবি আর বল লাথি মারবি? এভাবে গ্রামের নাম খারাপ করিস কেন?” তার গলায় ছিল ঘৃণা আর অবজ্ঞা। পাশ থেকে আরেকজন কাকা ঠোঁট উলটে বলল, “আজ তো গোল দিলি, কালকে কি হবে? মেয়েরা মাঠে নামলে গ্রাম হাসির খোরাক হবে। আমাদের সমাজে এসব মানায় না।” চারপাশে গুঞ্জন চলতে লাগল, কেউ কেউ খোলাখুলি সমর্থন জানাল এই কথার, আর মহিলাদের মধ্যে কেউ কেউ মাথা নিচু করে নীরব রইলেন।
প্রান্তির গলা শুকিয়ে এলো। তার চোখে তখনও ছিল খেলার আনন্দের ঝলক, কিন্তু সেসব ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে গেল অপমানের আঘাতে। সে ভেবেছিল সবাই খুশি হবে, কিন্তু এখানে যেন তাকে অপরাধীর মতো দাঁড় করানো হয়েছে। এক মহিলা সরাসরি বলে উঠলেন, “একটু লজ্জা থাকা ভালো। মেয়েদের জায়গা রান্নাঘরে, মাঠে নয়।” কথাটা শুনে প্রান্তির বুকটা যেন ভেঙে গেল। তার হাতে ধরা ছিল ফুটবলের জুতো, হঠাৎ মনে হলো এগুলো যেন ভারী হয়ে গেছে। সে নীরবে মাথা নিচু করল, ঠোঁট কাঁপছিল, কিন্তু কোনো প্রতিবাদ বেরোলো না। ছোট ছোট ছেলেরা যারা তার খেলা দেখে উচ্ছ্বসিত হয়েছিল, তারা দূরে দাঁড়িয়ে ভয়ে কিছু বলতে পারল না। রহিম কাকা ভিড়ের মধ্যে ছিলেন, তিনি কিছু বলতে চেয়েও চুপ করে রইলেন, কারণ তিনি জানতেন, এই মুহূর্তে সরাসরি প্রতিবাদ করলে প্রান্তিকে আরও অপমানিত হতে হবে।
সেই রাতে প্রান্তি বাড়ি ফিরে বিছানায় মাথা গুঁজে কাঁদল। তার বাবাও কিছু বলেননি, শুধু মুখ গোমড়া করে চুপচাপ খাওয়া শেষ করে ঘরে চলে গিয়েছিলেন। মায়ের কাছে এসে সে কেঁদে ফেলল, বলল, “মা, আমি কি ভুল করছি? আমি কি সত্যিই গ্রামকে লজ্জা দিচ্ছি?” সুবর্ণা তার চোখ মুছে দিলেন, কিন্তু মুখে কিছু বললেন না, কারণ তিনি জানতেন এই মুহূর্তে প্রান্তির কষ্ট কমানোর মতো কোনো সহজ উত্তর নেই। তবে তিনি আলতো করে মেয়ের মাথায় হাত রাখলেন, যেন নীরবে জানিয়ে দিলেন—“তুই ভুল করছিস না।” তবুও সেই অপমানের শব্দগুলো বারবার কানে বাজছিল—“লজ্জা… মানায় না… গ্রামের নাম খারাপ…”। প্রান্তি বারবার মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল, সে এইসব কথার কাছে হার মানবে না। কিন্তু অশ্রু ভেজা বালিশে শুয়ে থাকা অবস্থায় বুকের ভেতর যে ব্যথা জমে যাচ্ছিল, সেটি আর লুকানো যাচ্ছিল না।
পরদিন সকালেই মাঠে যেতে মন চাইছিল না তার। মনে হচ্ছিল সবাই তাকিয়ে আছে, সবাই হয়তো হাসছে বা ঠাট্টা করছে। তবু, ভেতরে একটা জেদ কাজ করছিল। রহিম কাকার ডাক শোনার পর সে ধীরে ধীরে মাঠে পা রাখল। কাকা শুধু হাসিমুখে বললেন, “যা শুনেছিস, মনে রেখিস—এগুলো তোর নয়, এরা নিজেদের ভয় ঢাকতে তোর ওপর চাপাচ্ছে। তুই যতই বড় হবি, ততই ওদের চোখে কাঁটা হবি। কিন্তু ভয় পাস না।” প্রান্তি চুপ করে বলটা তুলে নিল, জুতোর ফিতে বাঁধল, আর দৌড়াতে শুরু করল। প্রতিটি পদক্ষেপে যেন মনে মনে বলছিল—“হ্যাঁ, আমায় অপমান করা হয়েছে। হ্যাঁ, আমায় লজ্জা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আমি হাল ছাড়ব না।” মাঠের ঘাসে দৌড়াতে দৌড়াতে তার চোখের কোণ আবার ভিজে উঠল, কিন্তু এবার সেটা ছিল প্রতিজ্ঞার অশ্রু। সেই অপমানের ক্ষত তাকে ভেঙে দেয়নি, বরং আরও শক্ত করেছে। সে বুঝে গেল, লড়াই শুধু মাঠের প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে নয়, বরং সমাজের চোখরাঙানির বিরুদ্ধেও।
৮
গোপাল সারাদিন মাঠের ধারে কাজ করছিলেন। যদিও তিনি কখনো প্রকাশ্যে যাননি, তবু দূর থেকে প্রায়ই দেখতেন প্রান্তি বল নিয়ে দৌড়াচ্ছে। প্রথমে বিরক্ত লাগত, মনে হতো সমাজ যা বলছে, তা-ই ঠিক—“মেয়েদের এসব মানায় না।” কিন্তু ধীরে ধীরে তিনি বুঝতে শুরু করেছিলেন, মেয়ের ভেতরে একটা আলাদা আগুন আছে। একদিন যখন প্রান্তি প্রতিযোগিতায় দারুণ খেলে ফিরল, তখন গোপাল চুপচাপ বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। গ্রামের মানুষ তাকে কটু কথা বলছিল, কেউ বলছিল, “তোর মেয়ে গ্রামের ইজ্জত নষ্ট করছে।” তবুও গোপালের বুকের ভেতরে অদ্ভুত একটা গর্ব জেগে উঠেছিল। তিনি চাইছিলেন চিৎকার করে বলতে—“ও আমার মেয়ে, ও আমার গর্ব।” কিন্তু ঠোঁটের কোণ নড়লেও কথাগুলো আর বেরোলো না। কারণ চারপাশে সমাজের চোখরাঙানি, আত্মীয়স্বজনের খোঁচা আর নিজের ভেতরের দ্বন্দ্ব তাকে কাবু করে রেখেছিল।
রাত গভীর হলে গোপাল শুয়ে থাকতে থাকতে নানা কথা ভাবছিলেন। মনে হচ্ছিল, একদিকে মেয়ের চোখের স্বপ্ন—যেটা তিনি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন, অন্যদিকে সমাজের ভয়—যেটা প্রতিদিন তাকে কুরে কুরে খাচ্ছে। প্রান্তির মা সুবর্ণা বারবার ইশারায় বুঝিয়ে দিয়েছেন যে মেয়েকে দমিয়ে রাখলে তার স্বপ্ন ভেঙে যাবে। কিন্তু গোপাল ভাবতেন, “যদি সমাজ আমাকে একঘরে করে? যদি মেয়েকে নিয়ে কেউ বাজে কিছু বলে?” আবার সঙ্গে সঙ্গে মনে হতো, “আমি কি এতটাই দুর্বল? আমার নিজের মেয়ে যদি লড়াই করে, আমি কি তার পাশে দাঁড়াতে পারব না?” এই টানাপোড়েন তাকে প্রতি রাতে তাড়িয়ে বেড়াত। তিনি প্রায়শই গ্রামের মিটিংয়ে গিয়ে নীরব থাকতেন। বাইরে থেকে শক্ত, রক্ষণশীল ভঙ্গি রাখলেও ভেতরে ভেতরে প্রান্তির প্রতিটি খেলা, প্রতিটি দৌড় তাকে অদৃশ্যভাবে গর্বিত করত।
একদিন বিকেলে, গ্রামের কয়েকজন লোক সরাসরি গোপালের কাছে এসে দাঁড়াল। তারা বলল, “তোর মেয়েকে সামলে নে। না হলে তোকে সমাজচ্যুত করা হবে।” কথাটা যেন বজ্রাঘাতের মতো নেমে এলো। গোপালের বুকের ভেতর ক্ষোভ জমল, কিন্তু তিনি মুখে কিছু বললেন না। শুধু ভেতরে ভেতরে লড়াই চলতে লাগল। রাতে খাওয়ার সময় প্রান্তিকে হাসিমুখে জুতো পরিষ্কার করতে দেখে তিনি কেঁপে উঠলেন। মেয়ের চোখে যে আলো, সেটা কোনো ভয় দিয়ে নিভিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়—তিনি সেটা বুঝতে পারছিলেন। কিন্তু একইসঙ্গে তিনি জানতেন, সমাজের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো মানে ঝড়ের মুখোমুখি হওয়া। সেই রাতে তিনি ঘুমোতে পারেননি। বিছানায় এপাশ-ওপাশ করতে করতে তিনি ভাবছিলেন—একজন বাবা হিসেবে কি তাঁর দায়িত্ব শুধু সমাজের নিয়ম মানা, নাকি মেয়ের স্বপ্নকে রক্ষা করা? এই প্রশ্ন বারবার মাথায় ধাক্কা মারছিল।
অবশেষে একদিন সকালে গোপাল সিদ্ধান্তের মোড়ে দাঁড়ালেন। প্রান্তি মাঠে যাওয়ার আগে তাকে ডেকে বসালেন। কিছুক্ষণ চুপচাপ তাকিয়ে থেকে বললেন, “তুই খেলতে চাইছিস, তাই না?” প্রান্তি প্রথমে ভয়ে থেমে গেল, তারপর মাথা নিচু করে ধীরে ধীরে বলল, “হ্যাঁ, বাবা।” গোপাল দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তিনি জানতেন এই কথার মানে কী—সমাজের সঙ্গে সংঘর্ষ, আত্মীয়দের চাপ, এমনকি নিজের ভেতরের ভয়ের সঙ্গে লড়াই। কিন্তু তিনি হঠাৎ মেয়ের দিকে তাকিয়ে দেখলেন তার চোখের আগুন, তার দৃঢ়তা। সেই মুহূর্তে গোপাল বুঝলেন, মেয়েকে দমিয়ে রাখা মানে শুধু তাকে ভেঙে দেওয়া নয়, বরং বাবার নিজের ভেতরকার গর্বকে হত্যা করা। তিনি আস্তে করে বললেন, “যা করতে চাইছিস, কর। আমি আছি।” প্রান্তি অবাক হয়ে বাবার দিকে তাকাল, চোখে জল এসে গেল। গোপালের বুক হালকা হয়ে গেল, মনে হলো বছরের পর বছর জমে থাকা দ্বন্দ্ব যেন এক ঝটকায় মিটে গেল। সমাজের ভয় এখনও আছে, কিন্তু মেয়ের স্বপ্নের সামনে তা তুচ্ছ হয়ে গেল। সেই দিন থেকে গোপাল শুধু বাবা নয়, হয়ে উঠলেন প্রান্তির নীরব ঢাল।
৯
আন্তঃগ্রাম ফাইনালের দিন সকাল থেকেই পুরো গ্রাম উত্তেজনায় ভরপুর ছিল। মাঠের চারপাশে মানুষের ঢল নেমেছে। ছেলেদের খেলা দেখার জন্য যেমন ভিড় হয়, আজ তেমনি কৌতূহল জমে উঠেছে, কারণ প্রান্তিও মাঠে নামছে। অনেকের চোখে বিদ্রূপ, অনেকের চোখে অবিশ্বাস, আবার কেউ কেউ কেবল দেখতে এসেছে কী করে এক মেয়ে মাঠে টিকে থাকে। প্রান্তির দল শুরুতেই চাপে পড়ে যায়। প্রতিপক্ষ শক্তিশালী, তারা দাপট দেখাচ্ছিল প্রতিটি আক্রমণে। দর্শকদের মধ্যে কেউ কেউ মজা করে বলছিল, “দেখো, মেয়েকে নিয়ে দল নামালে এমনই হবে।” গ্যালারিতে বসে থাকা প্রান্তির বাবা গোপাল বারবার হাত মুঠো করছিলেন, মুখে কোনো কথা বেরোচ্ছিল না, কিন্তু তাঁর চোখে দপদপ করে আগুন জ্বলছিল। প্রান্তি মাঠে দৌড়াতে দৌড়াতে সেসব কটূক্তি কানে পেলেও মনকে শক্ত করে রেখেছিল। তার চোখ শুধু বলের দিকে, তার মন শুধু খেলায়—সেই মুহূর্তে সে আর গ্রামের এক মেয়ে নয়, সে একজন ফুটবলার।
খেলার প্রথমার্ধে প্রতিপক্ষ একের পর এক আক্রমণে এগিয়ে গেল। স্কোরবোর্ডে তারা ১-০ তে এগিয়ে। প্রান্তির দলের ছেলেরা হতাশ হয়ে পড়েছিল, কেউ কেউ ফিসফিস করে বলছিল, “ওকে দলে নিলে এমনই হবে।” প্রান্তির বুকটা হালকা কেঁপে উঠল, মনে হলো এই সব কথা যেন তার পায়ের শক্তি কেড়ে নিচ্ছে। কিন্তু তখনই সে মায়ের কথা মনে করল—“মনে যদি স্বপ্ন থাকে, তাতে লড়াই করতেই হয়।” সে নিজের মনে বলল, “না, আমি হাল ছাড়ব না।” রহিম কাকার দেওয়া প্রশিক্ষণের প্রতিটি টিপস তার মাথায় ভেসে উঠল। কিভাবে পাস ধরতে হবে, কিভাবে জায়গা তৈরি করতে হবে, আর সবচেয়ে বড় কথা, কিভাবে ভয়কে জয় করতে হবে। দ্বিতীয়ার্ধে মাঠে নামার আগে প্রান্তি দলের সবার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমরা হারিনি। এখনও সময় আছে। লড়াই করো।” তার কণ্ঠে অদ্ভুত দৃঢ়তা ছিল, যা দলের অন্য খেলোয়াড়দেরও জাগিয়ে দিল।
শেষ দশ মিনিটে খেলার উত্তেজনা চরমে পৌঁছাল। প্রতিপক্ষ রক্ষণভাগ শক্ত করে রেখেছিল, সময় কাটানোর চেষ্টা করছিল। দর্শকদের গলা ফাটিয়ে উৎসাহ দেওয়া হচ্ছিল দুই দলকেই। প্রান্তি তখন যেন পুরোপুরি অন্য এক মানুষ। বল যখন তার পায়ে এলো, সে কোনো দ্বিধা না করে এগিয়ে গেল। প্রতিপক্ষের দু’জন ডিফেন্ডার তাকে আটকে দেওয়ার চেষ্টা করল, কিন্তু প্রান্তি চমৎকার ড্রিবল করে দু’জনকেই পেছনে ফেলে দিল। তখন পুরো মাঠে এক অদ্ভুত গুঞ্জন বয়ে গেল। মুহূর্তের জন্য সবাই নিঃশ্বাস আটকে তাকিয়ে রইল। গোলপোস্ট থেকে মাত্র ক’ফুট দূরে পৌঁছে গেল প্রান্তি, গোলরক্ষক সামনে দাঁড়িয়ে। সেই মুহূর্তে তার মনে হলো পুরো জীবন যেন এই এক কিকের মধ্যে এসে মিশেছে। সে চোখ বন্ধ না করেই বলটাকে জোরে শট করল। বল বাতাস কেটে গোলপোস্টে ঢুকে গেল। আর সঙ্গে সঙ্গে মাঠ গর্জে উঠল করতালিতে।
শেষ বাঁশি বাজার পর পুরো মাঠে হৈচৈ লেগে গেল। প্রান্তির দল ১-১ থেকে সমতায় ফিরে এসে আত্মবিশ্বাস পেল এবং শেষ কয়েক মিনিটে দারুণ লড়াই চালাল। অবশেষে অতিরিক্ত সময়ে আরেকটি গোল করে জয় ছিনিয়ে নিল। কিন্তু সেই প্রথম গোল, সেই সমতার মুহূর্ত—সেটাই আসল টার্নিং পয়েন্ট হয়ে থাকল। খেলা শেষ হতেই দর্শকরা উঠে দাঁড়িয়ে প্রান্তির জন্য করতালি দিতে লাগল। কেউ কেউ অবিশ্বাসের চোখে তাকাল, কেউ কেউ গর্বে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। গ্রামের মহিলারাও প্রথমবার মেয়ের খেলায় হাততালি দিল। গোপাল চোখ মুছে ফেললেন, যেন বুকের ভেতরের সব দ্বিধা আর ভয় গলে গিয়ে জায়গা করে দিল এক অদম্য গর্বকে। রহিম কাকা হাসিমুখে বললেন, “আমি জানতাম, একদিন এই মুহূর্ত আসবে।” প্রান্তি মাঠের মাঝখানে দাঁড়িয়ে হাঁপাচ্ছিল, ঘামে ভিজে গিয়েছিল তার মুখ, কিন্তু তার চোখে ছিল আলো—স্বপ্ন জয় করার আলো। সেই দিন থেকেই সে আর শুধু গ্রামের এক মেয়ে নয়, সে হয়ে উঠল গ্রামের নায়িকা, প্রমাণ করে দিল—স্বপ্নের কোনো লিঙ্গ নেই।
১০
ফাইনালের সেই রাতের পর থেকে গোটা গ্রামে যেন এক অদ্ভুত পরিবর্তন দেখা গেল। যে মাঠে প্রান্তি একসময় লুকিয়ে খেলত, আজ সেই মাঠেই ছেলেরা তাকে “দিদি” বলে ডাকছে, তার সঙ্গে অনুশীলন করছে। যে মহিলারা আগে তার মাকে তিরস্কার করত, তারাই এখন সুবর্ণার দিকে তাকিয়ে গর্বের হাসি ছুঁড়ে দেয়। কিন্তু প্রান্তির কাছে এসব প্রশংসা শেষ নয়, বরং এক নতুন শুরুর ইঙ্গিত। তার ভেতরে যেন এক আগুন জ্বলছে—এই ছোট গ্রাম থেকে বেরিয়ে আরও বড় মঞ্চে পা রাখার আগুন। খেলার দিন গোপাল যখন মেয়ে গোল করল, তখনকার সেই করতালির শব্দ এখনও তার কানে বাজে। সেই শব্দ যেন তার প্রতিটি শিরায় রক্তের সঙ্গে মিশে গেছে। কিন্তু সে জানে, সামনে পথ আরও কঠিন। আজকের জয় তার যাত্রার প্রথম ধাপ, সামনে আরও অনেক প্রতিযোগিতা, আরও অনেক সমাজের বাঁধা, আরও অনেক রাত জেগে অনুশীলন তাকে অপেক্ষা করছে।
রাতের আকাশের নিচে প্রান্তি প্রায়ই একা দাঁড়িয়ে বলটাকে পায়ে দোলাতে দোলাতে ভবিষ্যতের স্বপ্ন আঁকে। তার চোখে তখন মাঠ আর গোলপোস্টের বাইরে আরও বড় ক্যানভাস ভেসে ওঠে—জার্সি পরে বড় দলে খেলা, রাজ্যের প্রতিনিধিত্ব করা, এমনকি দেশের পতাকা হাতে মাঠে নামা। সে জানে, স্বপ্ন বড় হলে লড়াইও বড় হয়। কিন্তু প্রথমবারের মতো সে বিশ্বাস করতে শিখেছে যে তার লড়াই বৃথা যাবে না। রহিম কাকা একদিন বলেছিলেন, “খেলোয়াড় মানে শুধু গোল দেওয়া নয়, খেলোয়াড় মানে ভয়কে জয় করা।” আজ প্রান্তি সেই কথার মানে বুঝতে পেরেছে। তার বাবার চোখে যে নীরব গর্ব সে দেখতে পায়, তা তাকে আরও শক্ত করে। একদিন যে বাবা সমাজের ভয়ে তাকে মাঠ থেকে সরিয়ে রাখতে চেয়েছিলেন, আজ সেই বাবাই তাকে জিজ্ঞাসা করেন, “কাল প্র্যাকটিসে কখন যাবে?” এই ছোট্ট প্রশ্নটাই প্রান্তির কাছে সবচেয়ে বড় আশীর্বাদ।
তবু সবকিছু এত সহজ নয়। গ্রামের বাইরে বেরোলেই এখনও লোকজন ফিসফিস করে, কেউ কেউ তাচ্ছিল্যভরা চোখে তাকায়। কেউ বলে, “এ সব করে কী হবে? মেয়েদের কাজ ঘর সামলানো।” কেউ বলে, “আজকে জিতেছে, কাল ভুল হলে আবার হাসির খোরাক হবে।” এইসব কথাগুলো প্রান্তির কানে বাজলেও এখন আর সে ভেঙে পড়ে না। বরং এসব কটূক্তিই তার জেদ বাড়ায়। সে ভাবে, “আমার খেলা আমার জবাব। আমি প্রতিটি ম্যাচে মাঠে নেমে প্রমাণ করব।” তার মায়ের চোখে এক অদ্ভুত প্রশান্তি ফুটে ওঠে, যেন মেয়ের ভেতরের আগুনে তিনি নিজের চাপা স্বপ্নও দেখতে পান। এক রাতে সুবর্ণা প্রান্তিকে কোলে টেনে নিয়ে শুধু বলেছিলেন, “তুই জিতলি মানে শুধু তুই জাস না, আমরা জাই। তোর স্বপ্নে আমারও স্বপ্ন আছে।” সেই কথাগুলো প্রান্তির মনে ঢেউ তুলেছিল—সে বুঝল, তার পথ একা নয়, তার মায়ের হৃদয়ও সেই পথের অংশ।
ফাইনালের বিজয়ের কয়েকদিন পরেই খবর এল—জেলায় আন্ডার-১৬ টিমের জন্য নির্বাচনী ক্যাম্প হবে। রহিম কাকা প্রথমে খবরটা আনলেন, প্রান্তির চোখে তখন একেবারে নতুন ঝিলিক। এটি শুধু একটি সুযোগ নয়, বরং তার জীবনের দরজা খুলে যাওয়ার মুহূর্ত। সে জানে, যদি এই নির্বাচনে নিজের সেরাটা দিতে পারে, তবে স্বপ্ন সত্যিই স্পর্শ করা যাবে। প্রান্তি দাঁড়িয়ে গেল গ্রামের প্রান্তে, দূরে সূর্যাস্তের লাল আভা মেঘ ছুঁয়ে আছে, আর সে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল—“আজ থেকে আর পেছনে ফেরার নয়। আমি শুধু আমার নয়, প্রতিটি গ্রামের মেয়ের প্রমাণ, যে স্বপ্নের কোনো লিঙ্গ নেই।” তার চোখে তখন কেবল আলো—সেই আলো, যা ভবিষ্যতের প্রতিটি লড়াইয়ে তাকে পথ দেখাবে। গল্প শেষ হয় প্রান্তির পায়ে বল গড়িয়ে যাওয়ার শব্দে, আর তার চোখে ভেসে ওঠা নতুন দরজার সামনে দাঁড়ানোর দৃঢ়তায়। সেই দরজা, যেখানে স্বপ্ন শুধু এক মেয়ের নয়, এক পুরো প্রজন্মের।
সমাপ্ত
				
	

	


