সুবর্ণ সাহা
অধ্যায় ১
সুন্দরবনের যাত্রা শুরু করার আগেই অনিরুদ্ধের মনে ছিল এক ধরনের রোমাঞ্চ মিশ্রিত ভয়। কলকাতার কোলাহল থেকে হঠাৎ করে এই জঙ্গলের বুক চিরে গড়ে ওঠা দ্বীপজীবনে পা রাখা, নিঃসন্দেহে তার কাছে ছিল এক বিরল অভিজ্ঞতা। অনিরুদ্ধ একজন সাংবাদিক; পরিবেশ ও সমাজ নিয়ে কাজ করতে করতে তিনি দেশের নানা প্রান্তে ঘুরেছেন, কিন্তু সুন্দরবনের মত প্রকৃতির রহস্যময়তা আর কোথাও তিনি পাননি। কলকাতা থেকে লঞ্চে নদীপথ পেরিয়ে এসে পৌঁছোনোর পর তার চোখে প্রথম যে দৃশ্য ধরা দিয়েছিল, তা একেবারেই অনন্য—ঘন জঙ্গল, বাঁকানো নদী, নোনা বাতাসে ভাসা লবণাক্ত গন্ধ আর গ্রামের সাধারণ মানুষের হাসিমাখা মুখ। দ্বীপের মানুষজন অনেকটা নিরুপদ্রব, কিন্তু তাদের জীবনযাপন প্রতিদিন প্রকৃতির সঙ্গে সংগ্রামের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। জোয়ার-ভাটার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হয়, ঝড়ের সময় ভেসে যায় কুঁড়েঘর, বাঘের ভয়ে রাতে ঘুম অস্থির হয়ে ওঠে—এই বাস্তবতা তিনি প্রথমবার এত কাছ থেকে দেখলেন। প্রতিবেদনের জন্য অনেক নোট নিচ্ছিলেন, ছবি তুলছিলেন, কিন্তু তাঁর সাংবাদিকসুলভ কৌতূহল তখনও জানত না—এই দ্বীপই শিগগিরই তাঁকে টেনে নেবে এক রহস্যময় অন্ধকারে।
সেদিন রাতটা ছিল অমাবস্যার। আকাশ জুড়ে ঝিকমিক করছিল তারা, কিন্তু জঙ্গলের ঘন অন্ধকার সবকিছু ঢেকে রেখেছিল। গ্রামের মানুষজন জোয়ারের সময়ে সাধারণত বাইরে বেরোয় না, কারণ নদীর স্রোত তখন ভয়াল রূপ নেয়। অনিরুদ্ধ অবশ্য শহরের মানুষ, অজানার প্রতি আকর্ষণ তাঁর মনে একটু বেশি। তাই কুঁড়েঘর থেকে বের হয়ে তিনি নদীর ধার ধরে হাঁটতে শুরু করলেন। বাতাসে তখন এক অদ্ভুত শব্দ—মনে হচ্ছিল, যেন গাছপালার ফাঁকে ফাঁকে কারও গোপন ফিসফিসানি ভেসে আসছে। হঠাৎ করেই নদীর ঢেউ গড়িয়ে এসে তাঁর পায়ের কাছে আছড়ে পড়ল। সেই জলের সাথে ভেসে এলো একটা অচেনা জিনিস—কাঁচের তৈরি পুরোনো এক বোতল। বোতলটি ছিল আধাভাঙা, কিন্তু ভেতরে কিছু একটা গুঁজে রাখা। অনিরুদ্ধ অবাক হয়ে বোতলটা তুলে নিলেন। নদীর ধারে মাটির ওপর বসে তিনি ধীরে ধীরে কর্ক খুলে ভেতরের জিনিসটা বের করার চেষ্টা করতে লাগলেন।
যা পেলেন, তা দেখে তিনি স্তম্ভিত। বোতলের ভেতরে ছিল এক টুকরো পুরোনো কাগজ, সময়ের দাগে হলদেটে হয়ে গেছে। আলতো করে সেটি মেলে ধরতেই তিনি বুঝলেন এটি একটি চিঠি। হাতের লেখা খানিকটা কেঁপে কেঁপে গেছে, যেন তাড়াহুড়ো করে লেখা হয়েছে। কাগজের গন্ধে ভেসে আসছিল স্যাঁতসেঁতে সময়ের স্মৃতি। প্রথম কয়েক লাইন পড়েই তাঁর ভ্রূ কুঁচকে গেল। লেখাটি কোনো সাধারণ আবেগপূর্ণ চিঠি নয়—মনে হচ্ছিল, লেখক যেন কারও কাছে শেষবারের মতো সত্য প্রকাশ করতে চাইছে। কিন্তু অনিরুদ্ধ যেই মুহূর্তে চিঠির শেষে চোখ নামালেন, তাঁর শিরদাঁড়া দিয়ে হিম স্রোত বয়ে গেল। কারণ চিঠির শেষে স্বাক্ষর করা নাম—“নিবারণ গায়েন।” এই নামটি স্থানীয় লোকদের মুখে তিনি এর আগেও শুনেছিলেন। কস্তুরী মণ্ডল নামের এক তরুণী শিক্ষিকা তাঁকে বলেছিলেন, বহু বছর আগে এই দ্বীপেই এক যুবক খুন হয়েছিল, তার নাম নিবারণ। সে ঘটনার পর থেকে গ্রামজুড়ে নীরব আতঙ্ক নেমে এসেছিল। কিন্তু সবাই ধীরে ধীরে সেই অতীত ভুলে গিয়েছিল। অথচ এখন, মৃত মানুষের নামে লেখা একটি চিঠি, সেটি আবার নদীর জোয়ারে ভেসে তাঁর হাতে এসে পড়ল—এ কেমন রহস্য!
অনিরুদ্ধ চিঠিটি হাতে নিয়েই যেন স্থবির হয়ে গেলেন। চারপাশের অন্ধকার হঠাৎ আরও ঘন হয়ে উঠল, নদীর কলকল ধ্বনি যেন অচেনা সুরে রূপ নিল। সাংবাদিক হিসেবে বহু ঘটনা কভার করেছেন তিনি, কিন্তু এমন অস্বাভাবিক অভিজ্ঞতা এর আগে হয়নি। মনে হচ্ছিল, কেউ যেন অদৃশ্য থেকে তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে। তিনি নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন—“এ কেবল কাকতালীয় ঘটনা।” হয়তো কোনো পুরোনো কাগজ, কারও ছুড়ে দেওয়া। কিন্তু মনে অন্য সুর বাজল—যদি এই চিঠি সত্যিই মৃত নিবারণের লেখা হয়? যদি তাঁর মৃত্যুর পেছনে কোনো অমীমাংসিত রহস্য থেকে যায়? নদীর ঢেউয়ের ভেতর থেকে উঠে আসা এই কাগজ যেন প্রকৃতির এক গুপ্ত আহ্বান—‘সত্য উদঘাটন করো’। অনিরুদ্ধ তখনও জানতেন না, এই একটিমাত্র চিঠিই তাঁকে টেনে নিয়ে যাবে মৃত্যুর স্মৃতি, বিশ্বাসঘাতকতা আর অদৃশ্য আতঙ্কে ভরা এক গোলকধাঁধায়, যেখানে তাঁর যুক্তিবাদী মন আর সাংবাদিকসুলভ কৌতূহল বারবার চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। সেদিন রাতের জোয়ারই যেন তাঁর ভাগ্যের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল।
অধ্যায় ২
পরদিন সকালে অনিরুদ্ধ চিঠিটা নিয়ে বসেছিলেন কস্তুরী মণ্ডলের স্কুলঘরের বারান্দায়। ভোরের আলোয় চারপাশ ঝকঝক করছে, কিন্তু তার চোখে ঘুম নেই; গত রাতের অদ্ভুত আবিষ্কার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। কস্তুরী ছিলেন গ্রামের স্কুলশিক্ষিকা, বয়স আঠাশ–ঊনত্রিশের কাছাকাছি, মুখে শান্ত ভরসার ছাপ, কিন্তু চোখে সবসময় এক অদ্ভুত গম্ভীরতা। তিনি চিঠিটা হাতে নিয়ে কয়েকবার পড়লেন, তারপর হঠাৎ চুপ করে গেলেন। তাঁর দৃষ্টি একদম শূন্যে স্থির হয়ে রইল। অনিরুদ্ধ বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করলেন, “আপনি কি এই হাতের লেখা চিনতে পারছেন?” কস্তুরীর ঠোঁট কাঁপতে লাগল। অবশেষে তিনি ধীরে ধীরে বললেন, “এটা… এটা নিবারণের হাতের লেখা।” নামটা উচ্চারণ করতেই যেন এক অদৃশ্য শীতল বাতাস বয়ে গেল চারপাশে।
কস্তুরী কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন, তারপর অনিরুদ্ধের দিকে তাকিয়ে বললেন, “নিবারণ আমার শৈশবের বন্ধু। আমরা একসঙ্গে পড়াশোনা করতাম, খেলতাম, নদীতে সাঁতার কাটতাম। ও ছিল খুব সৎ আর সাহসী ছেলে। গ্রামের অন্য ছেলেরা যখন ছোটখাটো ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েছিল, তখন নিবারণ সবার বিরুদ্ধে গিয়ে বলত—‘অন্যায় মানা যাবে না।’ সেই কারণেই হয়তো ওকে সবাই পছন্দ করত না। দশ বছর আগে, এক ঝড়ের রাতে, ওকে নদীতে ভেসে পাওয়া যায়। সবাই বলেছিল দুর্ঘটনা, কিন্তু আমি জানি ওকে খুন করা হয়েছিল।” কস্তুরীর গলা কেঁপে উঠল। অনিরুদ্ধ হতবাক হয়ে শুনছিলেন। তাঁর সাংবাদিকসুলভ বুদ্ধি বলছিল—এখানে নিশ্চিত কোনো অমীমাংসিত ঘটনা আছে। কিন্তু চিঠির তারিখটা তাঁকে আরও বিভ্রান্ত করে তুলল। তিনি চিঠিটা কস্তুরীর সামনে ধরে বললেন, “দেখুন, তারিখ লেখা আছে ওর মৃত্যুর আগের দিন। তাহলে কি এর মানে… এই চিঠি মৃত্যুর আগের রাতে লেখা?”
কস্তুরী মাথা নাড়লেন। তাঁর চোখে একধরনের আতঙ্ক ও দুঃখ একসাথে ফুটে উঠল। “হ্যাঁ, ও হয়তো বুঝেছিল তার জীবন হুমকির মুখে। তাই তাড়াহুড়ো করে এই চিঠি লিখেছিল। কিন্তু কেন এটা বোতলে ভরে নদীতে ভাসাল, সে কথা কেউ জানে না। আমি শুধু জানি, সেই রাতে গ্রামের অনেকের মুখে চাপা আতঙ্ক ছিল। সকলে যেন জানত কিছু একটা ঘটতে চলেছে। কিন্তু কেউ মুখ খোলেনি।” অনিরুদ্ধ মনোযোগ দিয়ে প্রতিটি শব্দ শুনছিলেন। তাঁর মনে হচ্ছিল, গ্রামটা যেন নিছক একটি দ্বীপ নয়—এখানে প্রতিটি গাছ, প্রতিটি নদী, প্রতিটি মানুষের ভেতরে লুকিয়ে আছে অগণিত গোপন ইতিহাস। তিনি প্রশ্ন করলেন, “আপনি কি সন্দেহ করেন কে নিবারণকে খুন করেছিল?” কস্তুরী উত্তর দিলেন না, শুধু চোখ নামিয়ে নিলেন। তাঁর চুপ থাকা-ই যেন প্রমাণ করছিল তিনি কিছু জানেন, কিন্তু ভয়ে বা সামাজিক চাপে তা প্রকাশ করতে চাইছেন না।
অনিরুদ্ধের মনে কৌতূহল আরও বেড়ে গেল। একজন সাংবাদিক হিসেবে তিনি জানতেন, প্রতিটি রহস্যের পেছনে সত্য থাকে, আর সেই সত্য যতই গভীর গোপনে চাপা পড়ুক, কোনো না কোনো সূত্র একসময় ভেসে ওঠে। নিবারণের মৃত্যুর ঘটনাটা তাঁর কাছে হঠাৎই ব্যক্তিগত হয়ে উঠল—কারণ সেই চিঠি এখন তাঁর হাতে, আর তার ভেতর লেখা আছে এক অমীমাংসিত ইতিহাসের শেষ সাক্ষ্য। তিনি কস্তুরীর দিকে তাকিয়ে দৃঢ় গলায় বললেন, “আমি এই রহস্যের শেষ খুঁজে বের করব। চিঠিটা যদি সত্যিই নিবারণের লেখা হয়, তাহলে এর ভেতরে এমন কিছু আছে যা দশ বছর ধরে চাপা পড়ে আছে। আমি জানি, এর উত্তর লুকিয়ে আছে এখানকার মানুষ, প্রকৃতি আর অতীতের অন্ধকারে।” কস্তুরী চুপচাপ তাঁর দিকে তাকালেন। তাঁর চোখে তখন ভয়ের সঙ্গে মিশে একটুখানি আশার ঝলক ফুটে উঠেছিল। কিন্তু তাঁর কণ্ঠস্বর নিস্তেজ—“আপনি জানেন না, অনিরুদ্ধবাবু, এই সত্য খোঁজার চেষ্টা করলে কী হতে পারে। যাঁরা নিবারণকে শেষ করে দিয়েছিল, তারা এখনও বেঁচে আছে। তারা এখনও ক্ষমতাবান। আপনিও যদি হাত দেন, আপনাকেও ছাড়বে না।”
অনিরুদ্ধ কিছুক্ষণ নীরব থাকলেন। বাইরে তখন জোয়ারের পানি আস্তে আস্তে বেড়ে চলেছে, বাতাসে ভাসছে স্যাঁতসেঁতে কাদার গন্ধ। দূরে ম্যানগ্রোভ গাছের ডালপালা নড়ছে, যেন প্রকৃতিই ফিসফিস করে সতর্ক করছে তাঁকে। কিন্তু তিনি ভিতরে ভিতরে জানতেন, এই রহস্যে পা না দিলেই তাঁর সাংবাদিক সত্তা হারিয়ে যাবে। তিনি মনে মনে স্থির করলেন, যেভাবেই হোক নিবারণের মৃত্যুর অন্ধকারে আলো ফোটাতে হবে। কস্তুরীর বলা কথাগুলো যেন তাঁর কানে বাজছিল—“যাঁরা খুন করেছিল, তারা এখনও বেঁচে আছে।” অনিরুদ্ধ বুঝলেন, এর মানে হচ্ছে এই দ্বীপে এখনও কেউ আছে যিনি দশ বছরের পুরোনো হত্যার রহস্য বয়ে বেড়াচ্ছেন। হয়তো এ গ্রামের ভেতরেই আছে সেই মুখ, যিনি নির্দোষ নিবারণকে শেষ করে দিয়েছিলেন। নদীর ঢেউ যেমন থেমে থাকে না, তেমনই এই রহস্যের জোয়ারও এখন থেমে থাকার নয়। আর সেই জোয়ারের স্রোতে ভেসেই অনিরুদ্ধ বুঝলেন, তাঁর জীবন হয়তো অন্য এক অচেনা পথে বাঁক নিতে চলেছে।
অধ্যায় ৩
চিঠির কথা মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়তে খুব বেশি সময় লাগল না। সুন্দরবনের ছোট্ট দ্বীপগ্রামে খবর মানেই ঝড়ের মতো দ্রুত ছড়িয়ে পড়া। অনিরুদ্ধের হাতে পাওয়া সেই বোতলবন্দি চিঠি যেন হঠাৎ করেই গ্রামের নিস্তব্ধতায় এক অদৃশ্য ভূকম্পন এনে দিল। সকালের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গেই বিভিন্ন বাড়ির উঠোনে, মাটির চৌকাঠে বসা মহিলাদের কথাবার্তায়, জেলেদের নৌকার বৈঠা চালানোর ফাঁকে ফাঁকে—সবার মুখে একটাই আলোচনা, “নিবারণের নামের চিঠি।” কেউ বলছে, এটা নেহাতই কোনো কাকতালীয় ব্যাপার, নদীর স্রোতে ভেসে আসা পুরোনো কাগজ। আবার কেউ কেউ আতঙ্কিত গলায় ফিসফিস করে বলছে, “এটা ভূতের ছেলেখেলা। মৃত মানুষ লিখে পাঠিয়েছে, নইলে দশ বছর পর এভাবে ভেসে আসে কী করে?” গ্রামজুড়ে এক অদ্ভুত অস্বস্তি ছড়িয়ে গেল, যেন প্রতিটি বাতাসে মিশে আছে এক পুরোনো ক্ষতের দগদগে গন্ধ।
অনিরুদ্ধ এই প্রতিক্রিয়াগুলো মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করছিলেন। সাংবাদিক হিসেবে মানুষের ভেতরের ভয় আর সংশয় তিনি বুঝতে পারছিলেন। তবে সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় ছিল—গ্রামের অনেকে যেন চিঠির নামটা শোনার পরই চুপ মেরে যাচ্ছিল। নিবারণের কথা উঠতেই যেন এক শূন্য নীরবতা নেমে আসে, চোখ নামিয়ে নেয় সবাই, কেউ সোজা উত্তর দেয় না। এই নীরবতা অনিরুদ্ধকে আরও কৌতূহলী করে তুলল। তাঁর মনে হচ্ছিল, নিবারণের মৃত্যুর ঘটনার সাথে গ্রামের সবাই কোনো না কোনোভাবে যুক্ত—সরাসরি নয়তো পরোক্ষভাবে। যেন সবাই কিছু জানে, কিন্তু প্রকাশ করতে ভয় পায়। কস্তুরীও তাঁকে আগেই ইঙ্গিত দিয়েছিল, তবে আজ তিনি আরও স্পষ্টভাবে বুঝলেন—এই গ্রামে একটা অদৃশ্য শিকল আছে, যা সত্যিটাকে বন্দি করে রেখেছে। রাতে কেউ বাইরে আলোচনা করলেও দিনের আলো ফুটতেই তারা মুখ বন্ধ করে ফেলে। এই ভীরু নীরবতা আসলে আরও বেশি প্রমাণ করে দিল যে নিবারণের মৃত্যু নিছক কোনো দুর্ঘটনা ছিল না।
এই অস্বস্তির মাঝেই দুলাল হালদারকে খুঁজে পেলেন অনিরুদ্ধ। দুলাল ছিলেন মাঝবয়সী এক জেলে, মদের নেশায় প্রায়ই হাবুডুবু খান। গ্রামে সবাই তাকে নিয়ে ঠাট্টা করে, কেউ গুরুত্ব দেয় না। কিন্তু অনিরুদ্ধ লক্ষ্য করলেন, চিঠির কথা উঠতেই দুলালের চোখে ভেসে উঠল এক অদ্ভুত ভীতি। সে দূরে নদীর দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল, যেন অতীতের কোনো দৃশ্য তার চোখে ভেসে উঠছে। অনিরুদ্ধ কাছে গিয়ে তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনি নিশ্চয়ই কিছু জানেন, দুলালদা? এত চুপ করে আছেন কেন?” দুলাল প্রথমে মাথা নাড়লেন, কিছু বলতে চাইছিলেন না। কিন্তু পরে ফিসফিস করে ইশারায় জানালেন, “সত্যিটা সবাই জানে, বাবু… কিন্তু মুখ খোলার সাহস কারও নেই।” কথাগুলো বলে আবার চুপ করে গেলেন। তাঁর চোখে-মুখে স্পষ্ট আতঙ্ক, যেন তিনি জানেন সত্য বললে তাঁর জীবন বিপদে পড়বে। অনিরুদ্ধের ভেতরে তখন প্রবল আগ্রহ জাগল, তিনি দুলালকে আরও প্রশ্ন করতে চাইলেন, কিন্তু দুলাল তখনই গলা নামিয়ে বলল, “সবাই ভয় পায় রতন মাঝিকে। ওর নাম কেউ উচ্চারণ করে না, তাও জোয়ারের রাতে তোমার হাতে চিঠি এসেছে… মানে ভাগ্য তোমাকে বেছে নিয়েছে।” এই কথার পরই সে হঠাৎ নীরব হয়ে উঠল, আর কিছু বলতে অস্বীকার করল।
গ্রামে ফিরে আসার পর অনিরুদ্ধ চারপাশের মানুষকে লক্ষ্য করছিলেন। কারও মুখে আতঙ্ক, কারও চোখে সংশয়, আবার কারও আচরণে ছিল অদ্ভুত গোপন হাসি। কস্তুরী তাঁকে বোঝালেন, “দেখেছেন তো? সবাই জানে, কিন্তু কেউ বলতে চায় না। ভয় এতো বেশি যে সত্যের মুখ সবাই এড়িয়ে চলে।” অনিরুদ্ধ মনে মনে স্থির করলেন, এই রহস্যের শেষ না খুঁজে তিনি ফিরবেন না। চিঠির খবর শুধু একটি পুরোনো মৃত্যুর স্মৃতি ফিরিয়ে আনেনি, বরং পুরো গ্রামকে আবার অস্থির করে তুলেছে। এখানে প্রতিটি মানুষ যেন এক অদৃশ্য নাটকের অভিনেতা—কারও মুখোশ ভয়, কারও মুখোশ নীরবতা, আবার কারও মুখোশ ক্ষমতার দম্ভ। অনিরুদ্ধ জানলেন, তাঁর কাজ কেবল চিঠি পাওয়া নয়, বরং এই গ্রামে চাপা পড়ে থাকা ভয় আর গোপন ইতিহাসকে জাগিয়ে তোলা। কারণ এই অস্বস্তির ভেতরেই লুকিয়ে আছে সেই উত্তর, যা নিবারণের মৃত্যুর ছায়াকে মুছে দিতে পারে। কিন্তু তিনি তখনও বুঝতে পারেননি—এই সত্য অনুসন্ধান তাঁকে এমন এক অন্ধকার খেলায় টেনে নেবে, যেখান থেকে ফিরে আসার পথ হয়তো খুব সহজে মিলবে না।
অধ্যায় ৪
গ্রামের চারপাশে তখন নিস্তব্ধতা, কিন্তু সেই নীরবতার আড়ালে জমে উঠছিল অদৃশ্য আতঙ্ক। চিঠির খবরে সবাই শিউরে উঠেছে, আর প্রতিটি ফিসফিসানি গিয়ে থেমে যাচ্ছে একটাই নামের সামনে—রতন মাঝি। গ্রামের সবচেয়ে প্রভাবশালী মানুষ সে। জঙ্গলের কাঠ থেকে শুরু করে নদীর মাছ, এমনকি সরকারি সাহায্যের টাকাও তার হাত ঘুরে আসে। গ্রামের অর্ধেক মানুষ তার ঋণে জড়িয়ে আছে, কেউ জমি দিয়েছে বন্ধক, কেউ নৌকা। তাই কেউ তার বিরুদ্ধে মুখ খোলে না। কস্তুরী মণ্ডল এই সত্য ভালো করেই জানে। তিনি ছোটবেলা থেকে রতনের দাপট দেখেছেন, আবার একইসাথে নিবারণের মৃত্যুর পর কিভাবে সবকিছু চাপা দেওয়া হয়েছিল, তাও চোখে দেখেছেন। সেই অভিজ্ঞতা তাঁকে একধরনের দ্বন্দ্বে জড়িয়ে রেখেছে—একদিকে সত্য প্রকাশের দায়, অন্যদিকে গ্রামের অসহায় মানুষগুলোর নিরাপত্তা।
সেই সন্ধ্যায় কস্তুরী স্কুলঘরের পেছনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। দূরে সূর্য ডুবছে, আকাশে রক্তমাখা কমলা রঙ। তিনি ভাবছিলেন—নিবারণ যদি বেঁচে থাকত, তবে হয়তো এতদিনে গ্রামের চেহারাটাই বদলে যেত। নিবারণ ছিল সাহসী, সত্যবাদী। আর এখন তাঁর স্মৃতি কেবল কস্তুরীর মনে দগদগে ক্ষত হয়ে রয়ে গেছে। তিনি নিজেকে প্রশ্ন করছিলেন—চিঠির কথা যদি প্রকাশ্যে আসে, তাহলে কী হবে? গ্রাম কি রতনের বিরুদ্ধে দাঁড়াবে, নাকি আবার ভয়ে মুখ বন্ধ করবে? হয়তো কেউ কেউ তাকে বিশ্বাস করবে না, উল্টো হাসাহাসি করবে—“মৃত মানুষের লেখা চিঠি আবার সত্যি হয় নাকি?” তাঁর মনে হচ্ছিল, এ এক অসম্ভব লড়াই। কিন্তু তবুও ভেতরে ভেতরে একটা ক্ষীণ আশার আলো জ্বলছিল—যদি এবার সত্যিই ন্যায় ফিরে আসে? যদি অনিরুদ্ধের মতো একজন বহিরাগত সাংবাদিক সাহস নিয়ে এগোয়, তবে হয়তো জোয়ারের মতোই এই মিথ্যার বাঁধ একদিন ভেঙে পড়বে।
ঠিক তখনই অনিরুদ্ধ এসে দাঁড়ালেন কস্তুরীর সামনে। তাঁর হাতে তখনও সেই বোতলবন্দি চিঠি। দৃঢ় চোখে কস্তুরীর দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, “আমি জানি, আপনি ভয় পাচ্ছেন। কিন্তু মনে রাখুন, মৃত মানুষও ন্যায়বিচার চায়। নিবারণের আত্মা হয়তো আজও শান্তি পায়নি, তাই এই চিঠি ফিরে এসেছে। হয়তো ভাগ্য আমাদের হাতে দায়িত্ব তুলে দিয়েছে।” অনিরুদ্ধের গলায় এক অদ্ভুত দৃঢ়তা ছিল। কস্তুরী তাঁর চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝলেন, শহরের এই সাংবাদিক হঠাৎ করেই যেন গ্রামের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন। কিন্তু ভেতরের দ্বিধা তখনও তাঁকে পীড়া দিচ্ছিল। তিনি মৃদু স্বরে বললেন, “আপনি বুঝছেন না, অনিরুদ্ধবাবু। রতন মাঝি শুধু একজন মানুষ নয়, সে এক প্রভাব। গ্রামের অর্ধেক মানুষ তার ওপর নির্ভরশীল। তার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো মানে শুধু নিজের জীবনকে নয়, অন্যদের জীবনকেও বিপদে ফেলা।”
অনিরুদ্ধ চুপ করে দাঁড়ালেন কিছুক্ষণ, তারপর ধীরে বললেন, “আমি বুঝি। কিন্তু সত্য চেপে রাখলে তা একদিন আরও ভয়ংকর রূপ নেয়। আমি শহরের মানুষ, হয়তো এখানকার নিয়ম আমি জানি না। কিন্তু আমি এটুকু জানি, অন্যায় যত বড়ই হোক, তাকে চাপা দিয়ে রাখা যায় না। আপনি যদি আমাকে সাহায্য করেন, তবে আমরা একসাথে সত্যটা বের করতে পারব।” কস্তুরীর মনে তখন ভীষণ টানাপোড়েন। একদিকে ভয়ের কণ্ঠ বলছিল, “চুপ থাকাই ভালো।” অন্যদিকে হৃদয়ের কণ্ঠ বলছিল, “নিবারণের জন্য অন্তত একবার দাঁড়াও।” তিনি নিরবে নদীর দিকে তাকালেন। জোয়ারের পানি তখন ধীরে ধীরে বাড়ছে, যেন প্রকৃতি নিজেই তাঁর মনে উত্তর লিখে দিচ্ছে। শেষ পর্যন্ত তিনি মৃদু মাথা নেড়ে বললেন, “ঠিক আছে, অনিরুদ্ধবাবু। আমি আপনার পাশে আছি। কিন্তু সাবধানে এগোবেন—রতনের ছায়া খুব দীর্ঘ, আর সেই ছায়ায় পা দিলেই জীবন ঝুঁকির মুখে পড়তে হয়।”
অধ্যায় ৫
সেই রাতে গ্রামের আকাশ ছিল ঘন মেঘে ঢেকে, বাতাসে ভেসে আসছিল কাদার তীব্র গন্ধ। অনিরুদ্ধ কুঁড়েঘরের ভেতর বসে চিঠির প্রতিটি শব্দ পড়ছিলেন বারবার। কাগজটা যেন কেবল কালি আর অক্ষরের সমষ্টি নয়, বরং অতীতের জমাট অন্ধকার থেকে উঠে আসা এক নিঃশ্বাস। হঠাৎই জানালার বাইরে পাতার খসখস শব্দ কানে এল। প্রথমে তিনি গুরুত্ব দিলেন না, কিন্তু শব্দটা যেন ধীরে ধীরে কাছে আসছিল। অনিরুদ্ধ বের হয়ে দেখলেন, অন্ধকারে কারও ছায়া নড়ছে। দূরে সরে যেতেই আবার অদৃশ্য। তিনি বুঝলেন, কেউ তাকে নজর রাখছে। বুকের ভেতর অজানা শীতলতা জমল, কিন্তু তিনি ভয়কে দমিয়ে রাখলেন। সাংবাদিকের প্রবৃত্তি বলছিল, সত্যের পথ কখনো সহজ নয়। হয়তো এই অনুসরণ প্রমাণ করছে তিনি সঠিক দিকেই এগোচ্ছেন।
কিছুক্ষণ নদীর ধার ঘুরে তিনি ফিরে আসছিলেন, কিন্তু পিছন থেকে সেই অদ্ভুত অনুভূতিটা তাঁকে ছাড়ছিল না। মনে হচ্ছিল কেউ যেন অদৃশ্য পায়ে তাঁর সাথে সাথে হাঁটছে। হঠাৎ বাঁশঝাড়ের ভেতর থেকে এক ছায়ামূর্তি স্পষ্ট হলো—কালো গায়ের কাপড়, ম্লান আলোয় মুখ বোঝা যায় না। অনিরুদ্ধ থমকে দাঁড়ালেন, কিন্তু ছায়াটি চোখের পলকে অদৃশ্য হয়ে গেল। ভয় আর কৌতূহলের লড়াই শুরু হলো তাঁর ভেতরে। তিনি মনে মনে ভাবলেন, “এরা বোঝাতে চাইছে, থেমে যাও। কিন্তু কেন?” ঠিক তখনই নদীর ওপর দিয়ে ঠান্ডা বাতাস বইল, আর সেই বাতাসে যেন ভেসে এলো অতীতের কোনো হাহাকার। অনিরুদ্ধ অনুভব করলেন, এই দ্বীপ কেবল মানুষে ভরা নয়—এখানে অদৃশ্য নজরদারি আছে, যা জীবিতদের থেকেও শক্তিশালী।
তিনি যখন ঘরে ফেরার জন্য পা বাড়াচ্ছিলেন, তখন হঠাৎ পিছন থেকে কারও কর্কশ কণ্ঠ শোনা গেল। ধীরে ঘুরে দাঁড়াতেই দেখলেন, অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসছেন এক বৃদ্ধা—কৃশকায় দেহ, কুঁচকে যাওয়া মুখ, কিন্তু চোখ দুটো যেন আগুনের মতো দীপ্ত। তিনি রুহিনী বালা, নিবারণের মা। গ্রামের মানুষ তাকে এড়িয়ে চলে, অনেকে বলে তিনি পাগল, কারণ ছেলে মারা যাওয়ার পর থেকে তিনি প্রায়শই নদীর ধারে বসে অস্পষ্ট কথা বলেন। কিন্তু আজ তাঁর কণ্ঠ ছিল স্পষ্ট, গা শিউরে ওঠার মতো। তিনি অনিরুদ্ধের দিকে তাকিয়ে বললেন, “ওর রক্ত নদীতে মিশে আছে। ও শান্তি পায়নি। এবার জোয়ার তাকে ফিরিয়ে আনবে।” কথাগুলো উচ্চারণ করেই তিনি হঠাৎ হাসলেন, সেই হাসি ছিল শীতল, যেন মৃত মানুষ হেসে উঠেছে। অনিরুদ্ধ স্তব্ধ হয়ে গেলেন। এই কথাগুলোর মধ্যে অদ্ভুত সত্যের ইঙ্গিত ছিল—নিবারণের মৃত্যু নিছক দুর্ঘটনা নয়, তার আত্মা যেন নদীর সাথে মিশে এখনও লড়াই করছে।
রুহিনী বালার চোখ তখন নদীর দিকে স্থির। অনিরুদ্ধ তাঁকে জিজ্ঞেস করতে চাইলেন, “আপনি কী বলতে চাইছেন? কারা মেরেছিল নিবারণকে?” কিন্তু বৃদ্ধা কিছুই বললেন না। শুধু আঙুল তুলে নদীর স্রোতের দিকে দেখালেন, যেখানে চাঁদের আলো কাঁপছিল ঢেউয়ের ওপর। তাঁর কণ্ঠ আবার ভেসে এল, “জোয়ার সব ফিরিয়ে আনে… মিথ্যে ঢেকে রাখলেও নদী সত্য গোপন করে না।” এর পরেই তিনি ছায়ার মতো মিলিয়ে গেলেন অন্ধকারে। অনিরুদ্ধ একা দাঁড়িয়ে রইলেন নদীর ধারে, চারপাশে অদ্ভুত নিস্তব্ধতা। মনে হচ্ছিল, এই দ্বীপের প্রতিটি গাছ, প্রতিটি ঢেউ যেন তাঁকে সতর্ক করছে—তিনি এমন এক সত্যের পথে পা দিয়েছেন, যা শুধু মৃতদেরই নয়, জীবিতদেরকেও অস্থির করে তুলবে। তিনি বুঝলেন, অদৃশ্য নজরদারি শুধু মানুষের নয়, প্রকৃতিরও। আর এই নজরদারি থেকে পালানো তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। সেই রাতের অন্ধকারে তাঁর মনে একটাই উপলব্ধি জন্ম নিল—এখানকার সত্য নদীর গভীরতার মতোই অগাধ, আর সেই সত্য খুঁজতে গেলে তাঁকেও ঢুকে পড়তে হবে মৃত্যুর ছায়ায়।
অধ্যায় ৬
অনিরুদ্ধ পরদিন সকালে আবার সেই বোতল থেকে পাওয়া চিঠিটি বার করলেন। রাতের ভয়ের ছায়া এখনো মনকে গ্রাস করে আছে, কিন্তু তার থেকেও গভীর এক কৌতূহল তাঁকে চালিত করছে। চিঠির প্রতিটি লাইন তিনি আলতো করে মসৃণ করছিলেন, যেন ছেঁড়া বা মলিন হয়ে যাওয়া অক্ষরের ভেতর থেকে শব্দগুলো আবার জেগে উঠুক। নিবারণ লিখেছিল—“আমি জানি, এদের লুকোনো কাজ কেবল আমাদের গ্রাম নয়, পুরো সুন্দরবনকে বিপদে ফেলবে। কাল আমি সত্য সবাইকে জানাবো। আর যদি কিছু হয়ে যায়, তবে মনে রেখো, আমি একা নই।” এই লাইনটি পড়ার সঙ্গে সঙ্গে অনিরুদ্ধের চোখে বিদ্যুৎ খেলে গেল। তিনি স্পষ্ট বুঝলেন, নিবারণ কোনো বড় সত্য আবিষ্কার করেছিল, যা প্রকাশ পেলে অনেকের মুখোশ খুলে যেত। আর সেই কারণেই হয়তো তার মৃত্যু ঘটানো হয়েছিল। চিঠির শেষ লাইনটা যেন এক অদ্ভুত ভবিষ্যদ্বাণীর মতো—“কাল যদি আমার কণ্ঠ থেমে যায়, তবে নদীই বলবে আমার কথা।”
চিঠির খবর কস্তুরীর কাছে পৌঁছাতেই তার ভেতরে দ্বিধা ও আতঙ্কের ঢেউ উঠল। সে শৈশবের সঙ্গী নিবারণকে মনে করতে লাগল, তার সরল চোখ, অকপট হাসি। কস্তুরী প্রায় কান্নায় ভেঙে পড়ল—“সে যদি সত্যিই এমন কিছু লিখে থাকে, তবে ওর মৃত্যু কোনো দুর্ঘটনা ছিল না।” অনিরুদ্ধ তাকে শান্ত করার চেষ্টা করলেন, কিন্তু কস্তুরীর দৃষ্টি ছিল দূরে, যেন সময়ের দেয়াল ভেদ করে সে চলে গেছে সেই রাতে, যেদিন নিবারণের লাশ ভেসে উঠেছিল নদীতে। চিঠির তারিখ আর নিবারণের মৃত্যুর সময় মিলিয়ে তারা দেখল, মৃত্যুর ঠিক আগের দিনই নিবারণ এই বার্তা লিখেছিল। অর্থাৎ, পরদিন তার প্রকাশের পরিকল্পনা সফল হওয়ার আগেই তাকে চিরতরে চুপ করিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কস্তুরী ফিসফিস করে বলল, “এর মানে, গ্রামের মানুষ যেটা ভাবত, সেটা সত্যিই ঘটেছিল। ও ষড়যন্ত্রের শিকার।”
অনিরুদ্ধ এবার গোটা বিষয়টিকে সাংবাদিকের চোখে দেখলেন। তিনি বুঝলেন, নিবারণ হয়তো চোরাকারবারের প্রমাণ জোগাড় করেছিল। সুন্দরবনের এই দ্বীপে কাঠ, বাঘের চামড়া, এমনকি বিদেশে পাচার হওয়া বিরল ভেষজেরও অবৈধ বাণিজ্য চলে বলে শোনা যায়। নিবারণ হয়তো সেই সিন্ডিকেটের কোনো চাবিকাঠি হাতে পেয়েছিল। কিন্তু গ্রামের মানুষ কেন চুপ করে ছিল? কেন কেউ মুখ খোলেনি? দুলাল হালদারের কথাগুলো হঠাৎ মনে পড়ল—“সবাই জানে, কিন্তু সাহস কারও নেই।” অনিরুদ্ধ কাগজটা কস্তুরীর হাতে দিলেন। সে অনেকক্ষণ ধরে কাগজে আঙুল বুলিয়ে রইল, যেন প্রিয় বন্ধুর শেষ কণ্ঠস্বর অনুভব করতে চাইছে। অবশেষে তার চোখে দৃঢ়তা দেখা গেল। “আমরা যদি চুপ করে থাকি, তবে রতন মাঝির মতো লোকেরা চিরকাল দাপট দেখাবে। নিবারণকে ন্যায়ের পথে ফিরিয়ে আনতে হবে।”
এই উপলব্ধি অনিরুদ্ধের মনেও এক নতুন শক্তি জাগাল। তিনি বুঝলেন, এই চিঠি কেবল একটি মৃত বন্ধুর শেষ বার্তা নয়—এটি প্রমাণ যে গ্রামের অন্ধকার আসলেই মানুষের সৃষ্টি। ভূতের গুজব, অশরীরীর ভয়—এসব ছলনা তৈরি করা হয়েছে যাতে কেউ সত্যের পথে না আসে। কিন্তু নিবারণ সেই ভয়ের দেয়াল ভেদ করতে চেয়েছিল, আর তাই তাকে হত্যা করা হয়। এখন কস্তুরী ও অনিরুদ্ধ দুজনেই একই পথে দাঁড়িয়ে গেলেন—একটি লড়াই, যেখানে প্রতিপক্ষ কেবল প্রভাবশালী মানুষ নয়, পুরো গ্রামের নীরবতাও। নদীর গর্জন যেন দূর থেকে ভেসে আসছিল, আর তাদের মনে হচ্ছিল, নিবারণ সত্যিই কথা বলছে ঢেউয়ের স্রোতে। অনিরুদ্ধ জানলেন, এই চিঠিই হবে তাঁর অস্ত্র, এবং কস্তুরীর স্মৃতিই হবে তাঁর সাহস। সত্যকে চাপা দেওয়া যায়, কিন্তু চিরতরে নয়—এবার জোয়ারে তা ফিরেই এসেছে।
অধ্যায় ৭
সন্ধ্যার পর গ্রামের আড্ডাঘরটা অদ্ভুত নিস্তব্ধ হয়ে উঠেছিল। অনিরুদ্ধ সেদিন সারাদিন চিঠি নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করেছেন, কস্তুরীর সঙ্গে কয়েকজন বৃদ্ধ গ্রামবাসীর কথাও শুনেছেন। কিন্তু তাঁকে ঘিরে এক অদৃশ্য অস্বস্তি যেন ক্রমশ ঘনীভূত হচ্ছিল। রাত নেমে আসতেই হঠাৎ করে বাতাসের ঝাপটা, আর সাথে সাথে আড্ডাঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে গেল রতন মাঝি। তার চোখে ছিল বিদ্রূপ, ঠোঁটে কৌতুকমাখা হাসি। “তুমি সাংবাদিক, তোমার কাজ কাগজে খবর ছাপা, আমাদের ঘরের কাহিনি নিয়ে নয়।” তার গলায় মিশে ছিল হুমকি, সেই সঙ্গে এক অদ্ভুত আত্মবিশ্বাস—যেন গোটা গ্রাম তার দখলে। অনিরুদ্ধ বুঝলেন, রতন সরাসরি বার্তা দিচ্ছে যে সে জানে, চিঠির কথা তাঁর কানে পৌঁছেছে। “যেখানে এসেছ, সেখান থেকে ঠিকঠাক ফেরার কথা ভাবো। বেশি নাক গলালে নদী তোমাকেও গিলে নেবে।” কথাটা শেষ করেই রতনের চোখ দুটি গাঢ় অন্ধকারের মতো হয়ে উঠল, যেন তার ভেতর লুকিয়ে আছে শত গোপন রহস্য আর অপরাধ।
কস্তুরী, যিনি একটু দূরে দাঁড়িয়ে কথোপকথন শুনছিলেন, ভয়ে কেঁপে উঠলেন। সে জানত, রতন মাঝি শুধু নামেই মাঝি নয়, সে আসলে গ্রাম-শাসনের এক ছায়া-রাজা। নদীপথে চোরাচালান থেকে শুরু করে কাকে কাজ দেওয়া হবে, কাকে অনাহারে থাকতে হবে—সব সিদ্ধান্তই তার হাতে। তাই গ্রামের অর্ধেক মানুষ তার ওপর নির্ভরশীল, আর বাকিরা তার ভয়ে চুপচাপ। কস্তুরী অনিরুদ্ধকে টেনে ভেতরে নিয়ে এলেন, ফিসফিস করে বললেন—“তুমি ওর সাথে আর ঝগড়া কোরো না। ওরা যা করার করে ফেলবে।” কিন্তু অনিরুদ্ধের চোখে তখন এক অন্য আগুন। তিনি শান্ত স্বরে উত্তর দিলেন, “আমি সাংবাদিক হিসেবে এসেছি। কিন্তু মানুষ হিসেবে দাঁড়িয়ে আছি ন্যায়ের পাশে। মৃত মানুষও ন্যায়বিচার চায়।” কস্তুরীর চোখে জল চলে এলো, কিন্তু অনিরুদ্ধের কথার দৃঢ়তায় তার বুকের ভিতরেও এক শিহরণ জাগল।
রাত গভীর হতে লাগল। চারদিকে নদীর ঢেউ, হাওয়ার গর্জন আর দূরে শেয়ালের ডাক মিলেমিশে অদ্ভুত এক ভয়াল পরিবেশ তৈরি করল। অনিরুদ্ধ খোলা বারান্দায় বসে কাগজে নোট লিখছিলেন। হঠাৎ খেয়াল করলেন, অন্ধকারে কারও ছায়া বারবার নড়ছে। রতনের লোকজন তাকে নজরে রেখেছে, এটা বুঝতে তাঁর বেশি সময় লাগল না। একসময় ছায়াটি স্পষ্ট হল—রতনের একজন সহযোগী দূর থেকে তাকিয়ে আছে। অনিরুদ্ধ ভেতরে ফিরে এলেন, কিন্তু কলম থামালেন না। তার প্রতিটি নোট যেন ছিল নিবারণের অসমাপ্ত লড়াইয়ের ধারাবাহিকতা। বাইরে থেকে অদৃশ্য চাপ, ভয় দেখানো, হুমকি—এসবই তাকে আরও বেশি দৃঢ় করে তুলছিল। তিনি ভাবলেন, “যদি আমি থেমে যাই, তবে আর কেউ কখনো মুখ খুলবে না। এই মৃত্যুপুরী চিরকাল অন্ধকারেই ডুবে থাকবে।”
পরদিন সকালে রতন আবার প্রকাশ্যে এগিয়ে এল। গ্রামের মাঝখানে দাঁড়িয়ে সে গলা চড়িয়ে বলল, “কেউ যদি আমার নামে বাজে কথা বলে, সে আর রক্ষে পাবে না। মনে রেখো, এই নদী অনেক কিছু লুকিয়ে রাখে।” তার কথায় গ্রামবাসীরা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। ভয় যেন তাদের হাড়ে গেঁথে গেছে। অনিরুদ্ধ কিন্তু ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়েই তাকে উত্তর দিলেন, “সত্যকে নদীও চিরকাল চাপা দিতে পারে না। একদিন না একদিন ঢেউ ফুঁড়ে সেটি ফিরে আসবেই।” সেই মুহূর্তে সবার চোখ তাদের দিকে ঘুরল। কেউ স্পষ্ট করে কিছু বলল না, কিন্তু নিঃশব্দে এক অদৃশ্য ফাটল গ্রামে তৈরি হল। রতন বুঝতে পারল, এই মানুষটি সহজে থামবে না। আর অনিরুদ্ধও উপলব্ধি করলেন, রতনের ছায়া যত গাঢ়ই হোক না কেন, সত্যের আলো ধীরে ধীরে তাকে ঘিরে ফেলছে। নিবারণের চিঠি শুধু অতীত নয়, বর্তমানের অন্ধকারও ভেদ করতে শুরু করেছে।
অধ্যায় ৮
গ্রামের এক কোণে, অন্ধকার নেমে আসার পর খোলা আকাশের নিচে ছোট্ট এক আসরে কয়েকজন বসেছিল। পেটমোটা শরীর, চোখে নেশার ঝাপসা আভা নিয়ে দুলাল হালদার সেই ভিড়ের মাঝে ছিল। তার হাতে মদের বোতল, ঠোঁটে অস্পষ্ট হাসি। অনিরুদ্ধ দূর থেকে তাকে লক্ষ্য করছিলেন। কস্তুরী ফিসফিস করে বলেছিল, “দুলাল অনেক কিছু জানে, কিন্তু ভয় তাকে চুপ করিয়ে রেখেছে।” সেই রাতে দুলালের মদের নেশা চরমে উঠতেই তার জিভ যেন আলগা হয়ে গেল। সে কেঁপে ওঠা গলায় হঠাৎ বলে ফেলল—“আমি সব দেখেছি সেদিন… ওকে নদীতে কে ফেলে দিয়েছিল, সব। কিন্তু আমি বলিনি… কিছুই বলিনি।” তার কণ্ঠে এক অদ্ভুত শ্বাসকষ্ট মিশে ছিল, যেন বুকের ভিতরে জমে থাকা ভার অনেক বছর পর হালকা হয়ে আসছে। চারপাশের মানুষ একে অপরের দিকে তাকাল, কেউ ফিসফিস করতে লাগল, কেউ আবার দুলালের মুখ চেপে ধরতে চাইলো। কিন্তু অনিরুদ্ধ সঙ্গে সঙ্গেই এগিয়ে এসে বললেন, “দুলালদা, তুমি যা জানো, সেটাই নিবারণের সত্য। আজ যদি না বলো, তবে সত্যটা চিরকাল অন্ধকারেই থেকে যাবে।”
মদের প্রভাবে দুলালের চোখে জল এসে গেল। সে কাঁপা হাতে বোতলটা নামিয়ে রেখে বলল, “ও রাতে আমি নৌকায় ছিলাম। রতন মাঝি আর তার দু-তিনজন লোক নিবারণকে ধরে এনেছিল। আমি ভেবেছিলাম, তারা শুধু ভয় দেখাবে। কিন্তু… কিন্তু তারা মারধর করতে লাগল। নিবারণ চিৎকার করছিল, ‘আমি সত্য সবাইকে জানাবো।’ তখন রতন গলা চেপে ধরে বলেছিল—‘তাহলে তোকে নদীই উত্তর দেবে।’ তারপর ঠেলেই তাকে জলে ফেলে দিল। আমি ভয়ে নড়তে পারিনি, শুধু দেখছিলাম।” তার গলা আটকে গেল, ঠোঁট কাঁপতে লাগল। নিস্তব্ধ পরিবেশে শুধু তার ভাঙা কণ্ঠের শব্দ প্রতিধ্বনিত হতে লাগল। গ্রামের কিছু মানুষ চোখ নামিয়ে নিল, কারণ প্রত্যেকেই রতনের দাপট জানত। অনিরুদ্ধ স্থির গলায় জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি এতদিন কেন চুপ ছিলে?” দুলাল মাথা নিচু করে বলল, “ওরা বলেছিল, যদি মুখ খুলি, আমাকেও নদী গিলে নেবে। আমি সন্তানদের মুখ ভেবেছিলাম।”
চুপচাপ বসে থাকা কস্তুরীর চোখ ভিজে উঠল। সে কাছে গিয়ে দুলালের কাঁধে হাত রাখল। দুলাল দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “কিন্তু জানো, প্রমাণ আজও রয়ে গেছে। নিবারণ ওদের মারধরের সময় একটা জিনিস আঁকড়ে ধরেছিল। সেটা পড়ে গিয়েছিল নৌকার তলায়। আমি ভয়ে সেটা নদীর ধারে বালির নিচে চাপা দিয়েছিলাম। আজও সেটা সেখানে আছে, যদি নদী ভাসিয়ে না নিয়ে গিয়ে থাকে।” অনিরুদ্ধ বিস্ময়ে তাকালেন। এ এক গুরুত্বপূর্ণ সূত্র, যা নিবারণের মৃত্যুর সত্যকে জোরালো করে তুলতে পারে। কস্তুরী কেঁদে ফেলল—“তাহলে এতদিন তুমি জানলে, অথচ কেউ কিছুই জানল না?” দুলাল মাথা নেড়ে বলল, “আমি পাপী, আমি কাপুরুষ। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে আর বুকের ভিতরে এই ভার নিয়ে বাঁচতে পারব না।” তার চোখে তখন আত্মগ্লানির সাথে মিশে ছিল মুক্তির তৃষ্ণা।
রাত আরও গভীর হল। নদীর হাওয়া বইছিল অদ্ভুত শীতলতায়, যেন প্রকৃতি নিজেই দুলালের স্বীকারোক্তিকে সাক্ষ্য দিচ্ছে। অনিরুদ্ধ অনুভব করলেন, এই একমাত্র প্রমাণ হয়তো গোটা ঘটনার মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে। কিন্তু তিনি জানতেন, এ কথাগুলো বেরিয়ে পড়লেই রতনের দাপট আরও হিংস্র হয়ে উঠবে। তাই দুলালকে শান্ত করে তিনি বললেন, “আগামীকাল সকালে আমরা একসাথে সেই জায়গাটা খুঁড়ব। সত্যকে লুকোনো যায় না, দুলালদা।” কস্তুরী চুপচাপ মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। সেই রাতের বাতাসে যেন অদ্ভুত ভার নেমে এল—একদিকে ভয়, অন্যদিকে আশার ক্ষীণ আলো। নিবারণের রক্ত নদীতে মিশে থাকলেও, তার সত্য হয়তো অবশেষে ভেসে উঠতে চলেছে।
অধ্যায় ৯
সুন্দরবনের আকাশে সেই রাত যেন অশুভ সংকেত ছড়িয়ে দিয়েছিল। কালো মেঘে ঢেকে গিয়েছিল চাঁদ, নদীর জলে উঠছিল জোয়ারের ঢেউ। দূরে কাঁকড়ার খোঁড়াখুঁড়ির শব্দও যেন হারিয়ে গিয়েছিল ঝড়ের গর্জনে। অনিরুদ্ধ আর কস্তুরী দুলালের নির্দেশ মতো পথ ধরে এগোচ্ছিলেন। দুলাল তাদের বলেছিল—“ওই ভাঙা কুঁড়েঘরের তলায় লুকানো আছে প্রমাণ, আমি হাত দিয়ে বালি চাপা দিয়েছিলাম।” অন্ধকারে টর্চের আলোতে জঙ্গল যেন আরও ভৌতিক হয়ে উঠছিল। গাছের ডালপালা বাতাসে কাঁপতে কাঁপতে শিসের মতো শব্দ তুলছিল, যেন বন নিজেই তাদের আগমনকে ভয় পাচ্ছে। কস্তুরীর বুক ধড়ফড় করছিল, তবে অনিরুদ্ধের চোখে এক অদম্য জেদ জ্বলছিল। তিনি জানতেন, আজ রাতেই সব সত্য বেরিয়ে আসবে। কুঁড়েঘরের কাছে এসে তারা হাতে খুঁড়তে শুরু করল। মাটি ও ভেজা বালির নিচে থেকে ধীরে ধীরে উঁকি দিলো কিছু পুরোনো কাগজ। কস্তুরী কাঁপা গলায় বলল, “দেখো! এটা নিবারণের হাতের লেখা।” অনিরুদ্ধ কাগজ হাতে নিয়ে বুঝতে পারলেন, এটি পাচারের বিস্তারিত হিসাব, যেখানে রতন মাঝি ও তার সহযোগীদের নাম স্পষ্টভাবে লেখা আছে। মুহূর্তের জন্য ঝড়ের ভেতরেও যেন চারপাশ থমকে গেল।
কিন্তু সেই নিস্তব্ধতা ভাঙতে বেশি সময় লাগল না। হঠাৎ পেছন থেকে ভেসে এলো এক তীক্ষ্ণ হাসি। টর্চের আলো ঘুরিয়ে দেখতেই তারা দেখতে পেল—রতন মাঝি কয়েকজন লাঠিধারী সঙ্গী নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখে বিদ্রুপের হাসি, চোখে শীতল হিংস্রতা। “খুব কষ্ট করে খুঁজেছো, সাংবাদিক বাবু,” সে গর্জে উঠল। “কিন্তু সত্য যদি এত সহজে বের হত, তবে কি আমি এতদিন গ্রামে রাজত্ব করতে পারতাম?” অনিরুদ্ধ দাঁতে দাঁত চেপে বললেন, “নিবারণ মরার আগে সত্য লিখে গিয়েছিল, আর আজ সেটা প্রমাণ করবে—তুমি খুনি।” রতন হেসে উঠল, ঝড়ের শব্দে সেই হাসি আরও শিউরে ওঠার মতো লাগছিল। “খুনি?” সে বলল, “খুনি তো নদী। আমি শুধু তাকে জলে ঠেলে দিয়েছিলাম।” তার সঙ্গীরা ঘিরে ধরতেই পরিস্থিতি মৃত্যুপুরীর মতো হয়ে উঠল। ঝড়ের কণ্ঠস্বর আর মানুষের শ্বাসপ্রশ্বাস মিশে যাচ্ছিল, যেন দ্বীপটাই এক ভয়ঙ্কর অঙ্গন।
লড়াই শুরু হলো হঠাৎই। অনিরুদ্ধ টর্চটা ছুঁড়ে মেরে একজনকে ফেলে দিলেন, কস্তুরী হাতের কাছে পাওয়া ভাঙা বাঁশ তুলে আঘাত করল আরেকজনকে। ঝড়ের বাতাসে ছুটে আসা ডালপালা, কাদার মধ্যে পা পিছলে পড়া, আর উত্তাল নদীর জল—সব মিলে যুদ্ধটা হয়ে উঠেছিল মৃত্যুর নৃত্য। রতন মাঝি হঠাৎ অনিরুদ্ধের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে মাটিতে ফেলে দিল। তার চোখে ছিল নিখাদ পশুত্ব, ঠোঁটে শীতল হুমকি—“আজ তুই নদীর খাদ্য হবি।” অনিরুদ্ধ সমস্ত শক্তি দিয়ে ধাক্কা মেরে তাকে সরালেন। কিন্তু রতন থামল না, সে আবার আক্রমণ করল। এদিকে কস্তুরী নিবারণের কাগজগুলো আঁকড়ে ধরে রাখছিল, যেন তার বন্ধুর শেষ স্মৃতি আর প্রমাণ কোনোভাবেই শত্রুর হাতে না যায়। ঝড়ের বিদ্যুৎ চমকানো আলোয় দেখা যাচ্ছিল—মানুষগুলো ছায়ার মতো একে অপরকে ছিঁড়ে খাচ্ছে।
ঠিক তখনই নদীর জলোচ্ছ্বাস ভেঙে কুঁড়েঘরের পাশে আছড়ে পড়ল। তীব্র ঢেউ সবকিছু গিলে নেওয়ার মতো এগিয়ে আসছিল। রতনের এক সঙ্গী জলে পড়ে সঙ্গে সঙ্গে তলিয়ে গেল, তার চিৎকার বাতাসে মিলিয়ে গেল। ভয়ে বাকিরা দুলতে লাগল, কিন্তু রতন দাঁতে দাঁত চেপে এগোচ্ছিল, যেন ঝড়কেও হার মানাতে চায়। কস্তুরী চিৎকার করে বলল, “নিবারণের রক্তই তোমাকে শেষ করবে, রতন!” মুহূর্তের মধ্যে বিদ্যুতের আলোয় তার মুখে যেন আতঙ্কের ছাপ দেখা দিল। অনিরুদ্ধ আবার লড়াই শুরু করলেন, আর হঠাৎ এক প্রচণ্ড ঝাপটায় রতন পিছলে গিয়ে নদীর ভেতরে পড়ে গেল। ঢেউ মুহূর্তেই তাকে গ্রাস করল। বাকি লোকজন আতঙ্কে পালিয়ে গেল, ঝড়ের ভয় আর মৃত্যুর দৃশ্য তাদের সাহস ভেঙে দিল। নদীর গর্জন যেন প্রতিশোধের মতো শোনাল, আর কুঁড়েঘরের ভেতর বেঁচে রইল শুধু নিবারণের লেখা কাগজগুলো। অনিরুদ্ধ হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, “সত্য লুকোনো যায় না… নদী নিজেই তা ফিরিয়ে আনে।” কস্তুরীর চোখ ভিজে উঠল, কিন্তু তার বুক থেকে নেমে গেল সেই দীর্ঘদিনের বোঝা। ঝড়ের রাত সাক্ষী হয়ে রইল—অন্যায়ের রক্তে ভেজা দ্বীপ অবশেষে ন্যায়বিচারের পথে এগিয়ে গেল।
অধ্যায় ১০
ঝড়ের পরের রাতটা যেন আরও ভৌতিক হয়ে উঠেছিল। আকাশে এখনও কালো মেঘ ঘনিয়ে ছিল, মাঝে মাঝে বিদ্যুতের ঝলকানি আলোকিত করছিল নদীর পাগল ঢেউ। সেই সময় রতন মাঝি অনিরুদ্ধকে ধরে আছাড় মারল ভেজা মাটিতে। তার চোখে শীতল হিংস্রতা, মুখে বিকৃত হাসি—“তুই সাংবাদিক, তোর কলম দিয়ে কাগজ ভিজে, কিন্তু আমার হাত দিয়ে রক্ত বয়। আজ তোর নামও নদী লিখে রাখবে তার কাদায়।” অনিরুদ্ধ সর্বশক্তি দিয়ে প্রতিরোধ করলেও রতনের মতো পেশীবহুল মানুষকে ঠেকানো ছিল কঠিন। কস্তুরী চেষ্টা করছিল তাকে বাঁচাতে, কিন্তু রতনের সঙ্গীরা লাঠি নিয়ে ঘিরে ধরেছিল। ঠিক সেই মুহূর্তে নদী যেন নিজের রায় দিতে এগিয়ে এল। প্রবল জোয়ার হঠাৎ বাঁধ ভেঙে আছড়ে পড়ল কুঁড়েঘরের চারপাশে। তীব্র ঢেউ সবকিছু গিলে নেওয়ার মতো ছুটে এলো। অনিরুদ্ধ পাথরে আঁকড়ে ধরলেন, কস্তুরীও চিৎকার করে গাছের শেকড়ে ধরে ফেলল। কিন্তু রতন মাঝি, যে এতক্ষণ অনিরুদ্ধের বুক চেপে বসেছিল, আচমকা পিছলে গিয়ে ঢেউয়ের ভেতরে পড়ে গেল। মুহূর্তের মধ্যেই তার শরীর তলিয়ে গেল নদীর গহ্বরে। তার চিৎকার ঝড়ের গর্জনে মিলিয়ে গেল, আর নদী যেন নিজেই বিচার সম্পূর্ণ করল। কস্তুরী হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, “দেখেছো? নদী কাউকে ছেড়ে দেয় না। নিবারণের রক্ত যে বুকে লেগে ছিল, সেখানেই তার রায় দিল।”
ঝড় থামতে থামতে ভোরের আলো ফুটল। সারা গ্রাম যেন রাতারাতি বদলে গেল। যাদের চোখে এতদিন ভয়ের ছায়া ছিল, তারা একে একে জড়ো হতে লাগল অনিরুদ্ধ ও কস্তুরীর পাশে। দুলাল হালদার কাঁদতে কাঁদতে সব খুলে বলল পুলিশের কাছে। ভাঙা কুঁড়েঘরের নিচে লুকোনো নিবারণের কাগজ, পাচারের হিসাব আর দুলালের সাক্ষ্য মিলে সত্য বেরিয়ে এলো দিনের আলোর মতো। পুলিশ যখন দ্বীপে এল, তখন গ্রামের মানুষরাও পাশে দাঁড়াল। কেউ আর ভয় পেল না রতনের অনুপস্থিতিতে। প্রমাণ হাতে নিয়ে পুলিশ ঘোষণা করল, রতন মাঝির চোরাকারবার ও খুনের সব অভিযোগ সত্য। গ্রামের মধ্যে ফিসফিসানি থেমে গিয়ে এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা নেমে এলো। সেই নিস্তব্ধতায় রুহিনী বালা, নিবারণের বৃদ্ধা মা, নদীর ধারে এসে দাঁড়ালেন। সাদা শাড়ি পরা তার ক্ষীণদেহী অবয়বের সামনে নদী যেনও মাথা নিচু করেছিল। তিনি ধীরে ধীরে চোখ তুলে নদীর দিকে তাকালেন। ঠোঁট কাঁপতে কাঁপতে তিনি ফিসফিস করে বললেন, “এবার আমার ছেলের আত্মা শান্তি পেল। নদী তাকে কেড়ে নিয়েছিল, আবার নদী-ই সত্য ফিরিয়ে দিল।” তার কণ্ঠে ছিল না আর অভিযোগ, ছিল নিঃশেষ শান্তির ভারী দীর্ঘশ্বাস।
অনিরুদ্ধের বুকটা ভারী হয়ে উঠেছিল এই দৃশ্য দেখে। সাংবাদিক হিসেবে তিনি অনেক অপরাধ, অনেক মৃত্যু দেখেছেন, কিন্তু এমন প্রতিশোধ—যেখানে প্রকৃতি নিজেই ন্যায়বিচারের হাতিয়ার হয়ে ওঠে—এমন দৃশ্য তিনি আগে কখনও দেখেননি। তিনি জানতেন, এ কেবল একটা খুন বা পাচারের গল্প নয়, এ এক গ্রামবাসীর দীর্ঘদিনের ভয়, নীরবতা আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে নদীর শপথের গল্প। কয়েকদিন পর কলকাতায় ফিরে তিনি ডেস্কে বসে প্রতিবেদন লিখতে শুরু করলেন। লেখার সময় তার মনে হচ্ছিল, প্রতিটি শব্দ যেন নদীর ঢেউ হয়ে কাগজে পড়ছে। তিনি লিখলেন—“সুন্দরবনের এক দ্বীপে, যেখানে মানুষ নদীর উপর নির্ভর করে বাঁচে, সেখানেই নদী হয়ে উঠল ন্যায়বিচারের সাক্ষী। রতন মাঝির মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে ভেসে উঠল লুকোনো সত্য। প্রমাণ জানাল, খুনের শিকার নিবারণ এক সাধারণ মানুষ হলেও তার সত্য আজ অন্ধকারকে ছিন্ন করে আলো দেখাল। কখনও কখনও জোয়ার শুধু জল আনে না, আনে ন্যায়বিচারের প্রতিধ্বনি।” লেখাটি শেষ করার পর অনিরুদ্ধ জানলেন, এই প্রতিবেদন শুধু পাঠকের চোখ খোলার জন্য নয়, বরং সেই গ্রামের মানুষের ইতিহাস পাল্টে দেওয়ার জন্যও লেখা হচ্ছে।
গ্রামের মানুষ ধীরে ধীরে নিজেদের মধ্যে সাহস ফিরে পেতে শুরু করল। যে ভয় এতদিন তাদের বাঁধা দিয়ে রেখেছিল, তা যেন নদী ভাসিয়ে নিয়ে গেল। কস্তুরী আবার গান গাইতে শুরু করল মেলাতে, দুলাল মদের বোতল ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বলল সে নতুন জীবন শুরু করবে, আর রুহিনী বালা প্রতিদিন সকালে নদীর ধারে বসে প্রার্থনা করতেন—কিন্তু এবার তার প্রার্থনায় ছিল না অভিযোগ, ছিল শুধু শান্তি। অনিরুদ্ধ কলকাতায় ফিরে গেলেও তার প্রতিবেদনের প্রতিধ্বনি পৌঁছে গেল সুন্দরবনের দূরতম কোণায়। সংবাদপত্রে ছাপা হল সেই রাতের সত্যকথা, মানুষ পড়ল আর ভাবল—“কতদিন আমরা অন্যায়ের সামনে চুপ থাকব?” নদীর জোয়ার যেমন ভাঙন আনে, তেমনই নতুন মাটি গড়ে দেয়। নিবারণের মৃত্যুর বিচার শুধু রতনের পতন ঘটাল না, বরং একটা গ্রামের ভেতর সত্য বলার শক্তি ফিরিয়ে দিল। অনিরুদ্ধ মনে মনে বললেন—“এটাই ছিল জলের রায়, যা কখনও মুছে যাবে না।”
___




